আমার নিজের বিশ্বাস যে, আমরা ছন্দ রচনা করি স্বতই কানের ওজন রেখে, বাজারে প্রচলিত কোনো বাইরের মানদণ্ডের দ্বারা মেপে মেপে এ কাজ করি নে, অন্তত সজ্ঞানে নয়। কিন্তু ছান্দসিক প্রবোধচন্দ্র সেন এই বলে আমাদের দোষ দিয়েছেন যে– আমরা একটা কৃত্রিম মানদণ্ড দিয়ে, পাঠকের কানকে ফাঁকি দিয়ে, তার চোখ ভুলিয়ে এসেছি; আমরা ধ্বনি চুরি করে থাকি অক্ষরের আড়ালে।
ছন্দোবিৎ কী বলেছেন ভালো করে বোঝবার চেষ্টা করা যাক। তাঁর প্রবন্ধে আমার লেখা থেকে কিছু লাইন তুলে চিহ্নিত করে দৃষ্টান্তস্বরূপে ব্যবহার করেছেন। যথা–
+ । +। । উদয়দিগন্তে ঐ শুভ্র শঙ্খ বাজে। + । মোর চিত্ত মাঝে, + চিরনূতনেরে দিল ডাক । + পঁচিশে বৈশাখ।
তিনি বলেন, “এখানে দণ্ডচিহ্নিত যুগ্মধ্বনিগুলিকে এক বলে ধরা হয়েছে, কারণ এগুলি শব্দের মধ্যে অবস্থিত; আর যোগচিহ্নিত যুগ্মধ্বনিগুলিকে দুই বলে ধরা হয়েছে, যেহেতু এগুলি শব্দের অন্তে অবস্থিত।” অর্থাৎ “উদয়’এর অয়্ হয়েছে দুই মাত্রা অথচ “দিগন্ত’-এর অন্ হয়েছে একমাত্রা, এইজন্যে “উদয়’ শব্দকেও তিন মাত্রা এবং “দিগন্ত’ শব্দকেও তিন মাত্রা গণনা করা হয়েছে। “যুগ্মধ্বনি’ শব্দটার পরিবর্তে ইংরেজি সিলেবল্ শব্দ ব্যবহার করলে অনেকের পক্ষে সহজ হবে। আমি তাই করব।
বহুকালপূর্বে একদিন বাংলার শব্দতত্ত্ব আলোচনা করেছিলুম। সেই প্রসঙ্গে ধ্বনিতত্ত্বের কথাও মনে উঠেছিল। তখন দেখেছিলুম, বাংলায় স্বরবর্ণ যদিও সংস্কৃত বানানের হ্রস্বদীর্ঘতা মানে না তবু এ সম্বন্ধে তার নিজের একটি স্বকীয় নিয়ম আছে। সে হচ্ছে বাংলায় হসন্ত শব্দের পূর্ববর্তী স্বর দীর্ঘ হয়। যেমন জল, চাঁদ। এ দুটি শব্দের উচ্চারণে জ-এর অ এবং চাঁ-এর আ আমরা দীর্ঘ করে টেনে পরবর্তী হসন্তের ক্ষতিপূরণ করে থাকি। জল এবং জলা, চাঁদ এবং চাঁদা শব্দের তুলনা করলে এ কথা ধরা পড়বে। এ সম্বন্ধে বাংলার বিখ্যাত ধ্বনিতত্ত্ববিৎ সুনীতিকুমারের বিধান নিলে নিশ্চয়ই তিনি আমার সমর্থন করবেন। বাংলায় ধ্বনির এই নিয়ম স্বাভাবিক বলেই আধুনিক বাঙালি কবি ও ততোধিক আধুনিক বাঙালি ছন্দোবিৎ জন্মাবার বহু পূর্বেই বাংলা ছন্দে প্রাক্হসন্ত স্বরকে দুই মাত্রার পদবি দেওয়া হয়েছে। আজ পর্যন্ত কোনো বাঙালির কানে ঠেকে নি; এই প্রথম দেখা গেল, নিয়মের ধাঁধায় পড়ে বাঙালি পাঠক কানকে অবিশ্বাস করলেন। কবিতা লেখা শুরু করবার বহুপূর্বে সবে যখন দাঁত উঠেছে তখন পড়েছি, “জল পড়ে, পাতা নড়ে।” এখানে “জল’ যে “পাতা’র চেয়ে মাত্রা-কৌলীন্যে কোনো অংশে কম, এমন সংশয় কোনো বাঙালি শিশু বা তার পিতামাতার কানে বা মনেও উদয় হয় নি। এইজন্যে ঐ দুটো কথা অনায়াসে এক পংক্তিতে বসে গেছে, আইনের ঠেলা খায় নি। ইংরেজি মতে “জল’ সর্বত্রই এক সিলেব্ল্, “পাতা’ তার ডবল ভারি। কিন্তু জল শব্দটা ইংরেজি নয়। “কাশীরাম’ নামের “কাশী’ এবং “রাম’ যে একই ওজনের এ কথাটা কাশীরামের স্বজাতীয় সকলকেই মানতেই হয়েছে। “উদয়দিগন্তে ঐ শুভ্র শঙ্খ বাজে’ এই লাইনটা নিয়ে আজ পর্যন্ত প্রবোধচন্দ্র ছাড়া আর কোনো পাঠকের কিছুমাত্র খটকা লেগেছে বলে আমি জানি নে, কেননা তারা সবাই কান পেতে পড়েছে নিয়ম পেতে নয়। যদি কর্তব্যবোধে নিতান্তই খটকা লাগা উচিত হয়, তাহলে সমস্ত বাংলাকাব্যের পনেরো-আনা লাইনের এখনি প্রুফ-সংশোধন করতে বসতে হবে।
লেখক আমার একটা মস্ত ফাঁকি ধরেছেন। তিনি বলেন, আমি ইচ্ছামতো কোথাও “ঐ’ লিখি, কোথাও লিখি “ওই’, এই উপায়ে পাঠকের চোখ ভুলিয়ে অক্ষরের বাটখারার চাতুরীতে একই উচ্চারণকে জায়গা বুঝে দুই রকমের মূল্য দিয়েছি।
তাহলে গোড়াকার ইতিহাসটা বলি। তখনকার দিনে বাংলা কবিতায় এক-একটি অক্ষর এক সিলেব্ল্ বলেই চলত। অথচ সেদিন কোনো কোনো ছন্দে যুগ্মধ্বনিকে দ্বৈমাত্রিক বলে গণ্য করার দরকার আছে বলে অনুভব করেছিলুম।
আকাশের ওই আলোর কাঁপন
নয়নেতে এই লাগে,
সেই মিলনের তড়িৎ-তাপন
নিখিলের রূপে জাগে।
আজকের দিনে এমন কথা অতি অর্বাচীনকেও বলা অনাবশ্যক যে, ঐ ত্রৈমাত্রিক ভূমিকার ছন্দকে নিচের মতো রূপান্তরিত করা অপরাধ–
ঐ যে তপনের রশ্মির কম্পন এই মস্তিষ্কেতে লাগে, সেই সম্মিলনে বিদ্যুৎ-কম্পন বিশ্বমূর্তি হয়ে জাগে।
অথচ সেদিন বৃত্রসংহারে এইজাতীয় ছন্দে হেমচন্দ্র ঐন্দ্রিলার রূপবর্ণনায় অসংকোচে লিখতে পেরেছিলেন–
বদনমণ্ডলে ভাসিছে ব্রীড়া।
বেশ মনে আছে, সেদিন স্থানবিশেষে “ঐ’ শব্দের বানান নিয়ে আমাকে ভাবতে হয়েছিল। প্রবোধচন্দ্র নিশ্চয় বলবেন, “ভেবে যা হয় একটা স্থির করে ফেলাই ভালো ছিল। কোথাও বা “ঐ’, কোথাও বা “ওই’ বানান কেন।” তার উত্তর এই বাংলার স্বরের হ্রস্বদীর্ঘতা সংস্কৃতের মতো বাঁধা নিয়ম মানে না, ওর মধ্যে অতি সহজেই বিকল্প চলে। “ও–ই দেখো, খোকা ফাউন্টেন পেন মুখে পুরেছে”, এখানে দীর্ঘ ওকারে কেউ দোষ ধরবে না। আবার যদি বলি “ঐ দেখো, ফাউন্টেন পেনটা খেয়ে ফেললে বুঝি”, তখন হ্রস্ব ঐকার নিয়ে বচসা করবার লোক মিলবে না। বাংলা উচ্চারণে স্বরের ধ্বনিকে টান দিয়ে অতি সহজেই বাড়ানো-কমানো যায় ব’লেই ছন্দে তার গৌরব বা লাঘব নিয়ে আজ পর্যন্ত দলাদলি হয় নি।
এ-সব কথা দৃষ্টান্ত না দিলে স্পষ্ট হয় না, তাই দৃষ্টান্ত তৈরি করতে হল।
মনে পড়ে দুইজনে জুঁই তুলে বাল্যে
নিরালায় বনছায় গেঁথেছিনু মাল্যে।
দোঁহার তরুণ প্রাণ বেঁধে দিল গন্ধে
আলোয়-আঁধারে-মেশা নিভৃত আনন্দে॥
এখানে “দুই’ “জুঁই’ আপন আপন উকারকে দীর্ঘ করে দুই সিলেব্ল্এর টিকিট পেয়েছে, কান তাদের সাধুতায় সন্দেহ করলে না, দ্বার ছেড়ে দিলে। উলটো দৃষ্টান্ত দেখাই।–
এই যে এল সেই আমারি স্বপ্নে দেখা রূপ,
কই দেউলে দেউটি দিলি, কই জ্বালালি ধূপ।
যায় যদি রে যাক-না ফিরে, চাই নে তারে রাখি,
সব গেলেও হায় রে তবু স্বপ্ন রবে বাকি॥
এখানে “এই’ “সেই’ “কই’ “যায়’ “হায়’ প্রভৃতি শব্দ এক সিলেব্ল্এর বেশি মান দাবি করলে না। বাঙালি পাঠক সেটাকে অন্যায় না মনে ক’রে সহজ ভাবেই নিলে।
কাঁধে মই,বলে, “কই ভুঁইচাপা গাছ।”
দইভাঁড়ে ছিপ ছাড়ে, খোঁজে কইমাছ।
ঘুঁটেছাই মেখে লাউ রাঁধে ঝাউপাতা,
কী খেতাব দেবে তায় ঘুরে যায় মাথা॥
এখানে “মই’ “কই’ “ভুঁই’ “দই’ “ছাই’ “লাউ’ প্রভৃতি সকলেরই সমান দৈর্ঘ্য, যেন গ্র৻ানেডিয়ারের সৈন্যদল। যে-পাঠক এটা পড়ে দুঃখ পান নি সেই পাঠককেই অনুরোধ করি, তিনি পড়ে দেখুন–
দুইজনে জুঁই তুলতে যখন গেলেম বনের ধারে, সন্ধ্যা-আলোর মেঘের ঝালর ঢাকল অন্ধকারে। কুঞ্জে গোপন গন্ধ বাজায় নিরুদ্দেশের বাঁশি, দোঁহার নয়ন খুঁজে বেড়ায় দোঁহার মুখের হাসি॥
এখানে যুগ্মধ্বনিগুলো এক সিলেব্ল্-এর চাকার গাড়িতে অনায়াসে ধেয়ে চলেছে। চণ্ডীদাসের গানে রাধিকা বলেছেন, “কানের ভিতর দিয়া মরমে পশিল গো।” বাঁশি-ধ্বনির এই তো ঠিক পথ, নিয়মের ভিতর দিয়ে প্রবেশ করলে মরমে পৌঁছত না। কবিরাও সেই কান লক্ষ্য করে চলেন, নিয়ম যদি চৌমাথার পাহারাওয়ালার মতো সিগ্ন্যাল তোলে তবু তাঁদের রুখতে পারে না।
আমার দুঃখ এই, তথাচ আইনবিৎ বলছেন যে, লিপিপদ্ধতির দোষে “অক্ষর গুনে ছন্দরচনার অন্ধ অভ্যাস’ আমাদের পেয়ে বসেছে। আমার বক্তব্য এই যে, ছন্দরচনার অভ্যাসটাই অন্ধ অভ্যাস। অন্ধের কান খুব সজাগ, ধ্বনির সংকেতে সে চলতে পারে, কবিরও সেই দশা। তা যদি না হত তাহলেই পায়ে পায়ে কবিকে চোখে চশমা এঁটে অক্ষর গ’নে গ’নে চলতে হত।
“বৎসর’ “উৎসব’ প্রভৃতি খণ্ড ৎ-ওয়ালা কথাগুলোকে আমরা ছন্দের মাপে বাড়াই কমাই, এ রকম চাতুরী সম্ভব হয় যেহেতু খণ্ড ৎ-কে কখনো আমরা চোখে দেখার সাক্ষ্যে এক অক্ষর ধরি, আবার কখনো কানে শোনার দোহাই দিয়ে তাকে আধ অক্ষর বলে চালাই– প্রবন্ধলেখক এই অপবাদ দিয়েছেন। অভিযোগকারীর বোঝা উচিত, এটা একেবারেই অসম্ভব, কেননা ছন্দের কাজ চোখ-ভোলানো নয়, কানকে খুশি করা– সেই কানের জিনিসে ইঞ্চি-গজের মাপ চলেই না। “বৎসর’ প্রভৃতি শব্দ গেঞ্জিজামার মতো; মধুপুরের স্বাস্থ্যকর হাওয়ায় দেহ এক-আধ ইঞ্চি বাড়লেও চলে, আবার শহরে এসে এক-আধ ইঞ্চি কমলেও সহজে খাপ খেয়ে যায়। কান যদি সম্মতি না দিত তাহলে কোনো কবির সাধ্য ছিল না ছন্দ নিয়ে যা খুশি তাই করতে পারে।
বৎসরে বৎসরে হাঁকে কালের গোমায়ু–
যায় আয়ু, যায় আয়ু, যায় যায় আয়ু।
এখানে “বৎসর’ তিনমাত্রা। কিন্তু সেতারের মীড় লাগাবার মতো অল্প একটু টানলে বেসুর লাগে না। যথা–
সখা-সনে উৎসবে বৎসর যায়
শেষে মরি বিরহের ক্ষুৎপিপাসায়।
ফাগুনের দিনশেষে মউমাছি ও যে
মধুহীন বনে বৃথা মাধবীরে খোঁজে॥
টান কমিয়ে দেওয়া যাক–
উৎসবের রাত্রিশেষে মৃৎপ্রদীপ হায়,
তারকার মৈত্রী ছেড়ে মৃত্তিকারে চায়।
দেখা যাচ্ছে, এটুকু কমিবেশিতে মামলা চলে না,বাংলাভাষার স্বভাবের মধ্যেই যথেষ্ট প্রশ্রয় আছে। যদি লেখা যেত
“সখাসনে মহোৎসব বৎসর যায়
তাহলে নিয়ম বাঁচত, কারণ পূর্ববর্তী ওকারের সঙ্গে খণ্ড ৎ মিলে একমাত্রা; কিন্তু কর্ণধার বলছে ঐখানটায় তরণী যেন একটু কাত হয়ে পড়ল। আমি এক জায়গায় লিখেছি “উদয়-দিক্প্রান্ত-তলে’। ওটাকে বদলে “উদয়ের দিক্প্রান্ত-তলে’ লিখলে কানে খারাপ শোনাত না একথা প্রবন্ধলেখক বলেছেন, সালিসির জন্যে কবিদের উপর বরাত দিলুম।
অপরপক্ষে দেখা যাক, চোখ ভুলিয়ে ছন্দের দাবিতে ফাঁকি চালানো যায় কিনা।
এখনই আসিলাম দ্বারে,
অমনই ফিরে চলিলাম।
চোখও দেখে নি কভু তারে,
কানই শুনিল তার নাম।
“তোমারি’, “যখনি’ শব্দগুলির ইকারকে বাংলা বানানে অনেক সময়ে বিচ্ছিন্ন করে লেখা হয়, সেই সুযোগ অবলম্বন করে কোনো অলস কবি ওগুলোকে চারমাত্রার কোঠায় বসিয়ে ছন্দ ভরাট করেছেন কি না জানি নে, যদি করে থাকেন বাঙালি পাঠক তাঁকে শিরোপা দেবে না। ওদের উকিল তখন “বৎসর’ “দিক্প্রান্ত’ “উৎসব’ প্রভৃতি শব্দগুলির নজির দেখিয়ে তর্ক করবে। তার একমাত্র উত্তর এই যে, কান যেটাকে মেনে নিয়েছে কিম্বা মেনে নেয় নি, চোখের সাক্ষ্য নিয়ে কিম্বা বাঁধানিয়মের দোহাই দিয়ে সেখানে তর্ক তোলা অগ্রাহ্য। যে-কোনো কবি উপরের ছড়াটাকে অনায়াসে বদল করে লিখতে পারে–
এখনি আসিনু তার দ্বারে,
অমনি ফিরিয়া চলিলাম।
চোখেও দেখি নি কভু তারে,
কানেই শুনেছি তার নাম।
“বৎসর’ ‘উৎসব’ প্রভৃতি শব্দ যদি তিনমাত্রার কোঠা পেরোতে গেলেই স্বভাবতই খুঁড়িয়ে পড়ত তাহলে তার স্বাভাবিক ওজন বাঁচিয়ে ছন্দ চালানো এতই দুঃসাধ্য হত যে, ধ্বনিকে এড়িয়ে অক্ষরগণনার আশ্রয়ে শেষে মান-বাঁচানো আবশ্যক হত। ওটা চলে বলেই চালানো হয়েছে, দায়ে পড়ে না। কেবল অক্ষর সাজিয়ে অচল রীতিকে ছন্দে চালানো যদি সম্ভব হত তাহলে খোকাবাবুকে কেবল লম্বা টুপি পরিয়ে দাদামশায় বলে চালানো অসাধ্য হত না।
পৌষ, ১৩৩৮