ছদ্মবেশী সময়

ছদ্মবেশী সময়

প্রাক্কথন

এই লেখাটা নিয়ে পরিচিত এক দাদার কাছে গিয়েছিলাম। সাহিত্যের লোক, লেখা- ফেখা বোঝেন। একটু পড়েই বললেন, “এসব কী? শুরুতেই ‘প্রমথ, একেনবাবু, আর আমি!” তোমার কী ধারণা, পাঠকরা তোমাদের সবাইকে চেনে! ক’জন তোমার লেখা আগে পড়েছে? আগে চরিত্রগুলোর পরিচয় দাও, তারপর গল্প শুরু করো। আর শোনো, সিরিয়াসলি লেখালিখি করতে চাইলে তোমার উচিত ক্রিয়েটিভ রাইটিং-এর একটা কোর্স করে নেওয়া।”

“ক্রিয়েটিভ রাইটিং!”

“অবাক হচ্ছ কেন, তোমাদের ইউনিভার্সিটিতেই তো করানো হয়!”

“না, না, তা নয়, লিখছি তো গোয়েন্দা কাহিনি!”

“তো? গোয়েন্দা কাহিনি কি সাহিত্য নয়, শুধুই প্লট-ড্রিভন হাবিজাবি? ক্যারেক্টার-ড্রিভন হতে পারে না? ডায়ালগ বা ডেস্ক্রিপ্টিভ এলিমেন্ট থাকবে না?”

আমার কাঁচুমাচু মুখ দেখে বোধহয় ওঁর করুণা হল। বললেন, “ঠিক আছে, আগে বলো প্রমথ কে?”

মনে মনে বললাম, ‘এক্কেবারে আপনার টাইপ, বাক্যবাণে আমাকে ক্ষতবিক্ষত করে আনন্দ পায়।’ মুখে বললাম, “আমার ছেলেবেলার বন্ধু, কেমিস্ট্রিতে পোস্ট ডক সবে শেষ করেছে।

“একেনবাবু?”

“কী মুশকিল, উনিই তো গোয়েন্দা, আপনি ওঁকে চেনেনও!”

“আমার চেনাটা বড়ো কথা নয়। পাঠকদেরও তো চিনতে হবে। আমি তো তোমাকেও চিনি। কিন্তু তুমি যে বাপি দে, নিউ ইয়র্ক ইউনিভার্সিটিতে ফিজিক্স পড়াও, সেটা ক’জন জানে?”

সেইসময় অপরিচিত কয়েক জন আড্ডা দিতে এসে পড়ায় রক্ষা পেলাম। বাড়ি ফিরে এসে যখন ভাবছি লেখাটা নতুন করে আরম্ভ করব কিনা, একেনবাবু ভরসা দিলেন, “কিচ্ছু পালটাবেন না, স্যার। সাহিত্য না-হলেও আপনার লেখা পড়ে তো বোঝা যায়।”

।।১।।

সকাল বেলায় প্রমথ, একেনবাবু, আর আমি বসে কফি খাচ্ছি, হঠাৎ টিং শব্দ। একেনবাবুর হোয়াটসঅ্যাপ-এর মেসেজ অ্যালার্ট।

দেখলাম, একেনবাবু ভুরু কুঁচকে লেখাটা পড়ছেন আর মাথা চুলকোচ্ছেন। প্রমথ পাশেই বসেছিল, এক ঝলকে মেসেজটা দেখে জিজ্ঞেস করল, “কে?”

“রিচার্ড র‍্যান্ডো।”

“আঃ, নামটা তো এখানেই লেখা, কিন্তু লোকটি কে?”

“ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্টের খুব পরিচিত স্যার, আমার সঙ্গে মাত্র বার দুয়েক দেখা হয়েছে। কিন্তু উনি যে ইন্ডিয়ায় জানতাম না স্যার!”

“কেন সাহেবরা কি ইন্ডিয়াতে যায় না?”

“না না স্যার, তা নয়…”

“তাহলে?”

প্রমথ এমন ত্যাড়াবাঁকা প্রশ্ন করতে থাকে যে আসল উত্তর পেতে খামোখা দেরি হয়। তাই বললাম, “লোকটা যে কে সেটাই কিন্তু জানা হচ্ছে না!”

“বলছি স্যার, আগে আরেক কাপ কফি হোক।”

“আপনি মশাই সামথিং!” বলে প্রমথ উঠে কিচেনে গেল কফির দানা গুঁড়ো

করতে। পেছন পেছন আমরাও গেলাম।

কিচেনে দঁড়িয়েই র‍্যান্ডো কাহিনি শুনলাম।

.

“অনেক দিন আগের কথা, এক বছরও হয়নি আমি এদেশে এসেছি, ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্টই পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন মিস্টার র‍্যান্ডোর সঙ্গে। একটা পরামর্শের জন্য ভদ্রলোক এসেছিলেন। চলে যাবার পর স্টুয়ার্ট সাহেব বলেছিলেন, ‘হলিউডের স্ট্রাগলিং স্ক্রিপ্ট রাইটার। ওঁর একটা স্ক্রিপ্ট চুরি গেছে, কিন্তু আমি এখানে বসে কী করতে পারি!’

“কাঁচা-পাকা চুল, ছেঁড়া জিন্স, ছাই-রঙা সোয়েটশার্ট—এই লোকটা হলিউডের স্ক্রিপ্ট রাইটার? আমি তো স্যার অবাক! কিন্তু স্ট্রাগলিং কেন? তখনই জানলাম হলিউডে এইসব কাজে প্রতিষ্ঠা পাওয়া নাকি ভাগ্যের ব্যাপার, শুধু ট্যালেন্ট থাকলেই হয় না। পরে অবশ্য ওঁর সঙ্গে আবার দেখা হয়েছিল। দু-বছর বাদে ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্ট আর আমি একটা কাজে ওল্ড ওয়েস্টবেরি-তে গেছি। বিশাল বিশাল পুরোনো বাড়ি, জানতামও না স্যার ওটা লং-আইল্যান্ডের সবচেয়ে দামি অঞ্চল। হঠাৎ একটা বাড়ির বাগানে কাউকে দেখে ক্যাপ্টেন গাড়ি থামালেন। সেই রিচার্ড র‍্যান্ডো! র‍্যান্ডো সাহেব ছাড়লেন না, টেনে বাড়িতে নিয়ে গিয়ে কফি খাওয়ালেন।”

“তার মানে তো হলিউডে স্ক্রিপ্ট বেচে ভালোই কামিয়েছিলেন!” প্রমথ মন্তব্য করল।

“না স্যার, তা নয়। কথায় কথায় উনিই বললেন, হলিউডে সুবিধা হয়নি, বড়োলোক হয়েছিলেন ওঁর এক নিঃসন্তান মামার বিশাল সম্পত্তি পেয়ে।”

“ভাগ্যবান লোক, এরকম মামা তো সবার জোটে না!”

“কিন্তু হঠাৎ এই হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজ?” আমি জিজ্ঞেস করলাম। “আপনার ফোন নম্বর পেলেন কোত্থেকে?”

“ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্টই নিশ্চয় দিয়েছেন। দেখি স্টুয়ার্ট সাহেবকে একটা ফোন করে।”

ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্ট একটা মিটিং-এ ব্যস্ত, পাওয়া গেল না।

.

কফি নিয়ে সবাই খাবার টেবিলে বসলাম। স্ক্রিপ্ট নিয়ে কথা হচ্ছিল তারই খেই ধরে প্রমথ বলল, “এই স্ক্রিপ্ট বা স্ক্রিন-প্লে চুরি করা কিন্তু হলিউডে মাঝে মাঝে হয়। মনে নেই, সত্যজিৎ রায়ের প্লট ঝেড়ে স্পিলবার্গ ‘দ্য এলিয়েন’ বানিয়েছিল? একবার কাউকে কিছু জমা দিলেই হল—এর হাত ওর হাত হয়ে পাবলিক প্রপার্টি হয়ে যায়!

“হ্যাঁ, সেরকমই একটা গুজব রটেছিল বটে, “ আমি বললাম, “তবে কাউকে কিছু দেবার আগে একটু সতর্ক হলে এগুলো এড়ানো যায়।”

“তার মানে?”

“ধর, কাউকে চিঠি দিয়ে স্ক্রিপ্ট বা কনসেপ্ট পাঠাবার আগে চিঠিশুদ্ধ তার একটা কপি নিজেকেই রেজিস্টার্ড পোস্ট-এ পাঠিয়ে সেটা এলে না খুলে রেখে দেওয়া। খামে পোস্ট অফিসের ডেট-দেওয়া স্ট্যাম্প থেকে কপিরাইটের ক্লেইম প্রমাণিত হবে।”

“তার জন্য পোস্ট অফিস লাগবে কেন?” প্রমথ প্রশ্ন তুলল। “ইমেল-এ অ্যাটাচ করে পাঠালেই তো প্রমাণ হয়ে যাবে কবে পাঠানো হয়েছে!”

“তা যাবে, ইমেলে-এ যদি স্ক্রিপ্ট নেয়। তবে আমাদের দেশে ওসব করলেও ঘোড়াড্ডিম হবে, দেশে কপিরাইটই কেউ মানে? আগাথা ক্রিস্টির অনুবাদ কলেজ স্ট্রিটে অজস্র পাবি। অথচ আজ পর্যন্ত আগাথা ক্রিস্টির ট্রাস্টিরা কাউকে বাংলা অনুবাদের পারমিশন দেয়নি… শুধু মাত্র কয়েকটা গল্পই কপিরাইটের আওতায় পড়ে না, কারণ প্রকাশিত হয়েছিল ১৯২৪ সালের আগে। কিন্তু তাতে আটকেছে কিছু?”

“১৯২৪ আবার কোত্থেকে পেলি? উলটোপালটা একটা সাল বলে দিস!”

“নেট-এ পেয়েছি।”

“আচ্ছা স্টুপিড তুই! নেট-এ যা পাবি তাই সত্যি?”

একেনবাবু চুপচাপ আমাদের কথা শুনছিলেন আর বসে বসে পা নাচাচ্ছিলেন।

“কী মশাই, মৌনব্রত নিলেন যে বড়ো?” প্রমথ জিজ্ঞেস করল।

“শুনছিলাম স্যার আপনাদের কথা। আপনারা সত্যি স্যার জ্ঞানের পাহাড়!”

“থামুন মশাই, তার জন্য নিশ্চয় পা নাচাচ্ছিলেন না?”

“আসলে স্যার ভাবছিলাম, র‍্যান্ডো সাহেবের অ্যাটর্নিকে এক বার ফোন করব কিনা।”

“নিশ্চয় করবেন। এ নিয়ে এত ভাববার কী আছে?

“তবু এক বার জিজ্ঞেস করে নিই স্টুয়ার্ট সাহেবকে, উনি নিশ্চয় এই তলব করার কারণটা জানেন।”

বেশি ভাবাভাবি করতে হল না, ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্টের ফোন এল। একেনবাবু র‍্যান্ডো সাহেবের মেসেজ পাওয়ার কথা বলতেই ক্যাপ্টেন অনেক কিছু বললেন। আমরা শুধু একেনবাবুর কথা শুনতে পাচ্ছিলাম। ‘তাই নাকি স্যার!’ ‘আচ্ছা… ইন্টারেস্টিং,’ ইত্যাদি, ইত্যাদি।

ফোন শেষ হতেই প্রশ্ন করলাম, “কী বললেন?”

“র‍্যান্ডো সাহেব বছর কয়েক ধরে ইন্ডিয়াতে আছেন। সেখানে একটা সমস্যায় পড়েছেন বলে ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্ট আমাদের সঙ্গে কথা বলতে বলেছেন।”

“‘আমাদের’ মানে ‘আপনার।’ এই বহুবচন ব্যবহার করার হ্যাবিটটা ছাড়ুন তো! তা সমস্যাটা কী?” প্রমথ প্রশ্ন করল।

“সেটা ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্ট জানেন না, কিন্তু মিস্টার র‍্যান্ডোর অ্যাটর্নি জানেন। যাঁর নাম-ঠিকানা র‍্যান্ডো সাহেব ওঁর মেসেজ-এ পাঠিয়েছেন।”

“এত ধোঁয়াশার মধ্যে না রেখে মেসেজটা কী ছিল পড়ুন তো!”

একেনবাবু মোবাইলটা পকেট থেকে বার করে দেখালেন। ছোট্ট মেসেজ :

আশা করি আমাকে মনে আছে। আমি এখন শান্তিনিকেতনের কাছে থাকি। ব্যক্তিগত একটা বিশেষ প্রয়োজনে আপনার সাহায্য চাই। আথ্রাইটিসে কাবু বলে নিউ ইয়র্কে যেতে পারছি না। আপনি যদি ইন্ডিয়াতে এসে আমার সঙ্গে দেখা করেন, সমস্যাটা গুছিয়ে বলব। ফোনে কিছু বলতে চাই না। বার্ড, কোজেন, অ্যান্ড গিবসন-এর অফিসে আমার নাম করলে এখানে আসার ডিটেলস আর অন্যান্য খরচাপাতি আপনাকে দিয়ে দেবে। ভালো থাকবেন।

শুভেচ্ছান্তে, রিচার্ড র‍্যান্ডো

নীচে অ্যাটর্নি বার্ড, কোজেন, আর গিবসন অফিসের নম্বর।

॥২॥

বিকেল বেলা অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে অ্যাটর্নি বার্ড, কোজেন, অ্যান্ড গিবসন-এর অফিসে গেলাম। বার্ড সাহেব অফিসে ছিলেন, রিচার্ড র‍্যান্ডো ওঁর-ই ক্লায়েন্ট। একেনবাবুকে বললেন, “মিস্টার র‍্যান্ডো একটা বিশেষ কাজে আপনার সাহায্য চান, কিন্তু কাজটা করতে হবে ইন্ডিয়াতে।”

“ইন্ডিয়াতে!”

“ইয়েস। যাতায়াতের জন্য আপনাকে বিজনেস ক্লাস-এর ভাড়া, ফাইভ স্টার হোটেলে থাকা, খাওয়া-দাওয়া, লোকাল ট্র্যান্সপোর্টেশন এবং অন্যান্য ইন্সিডেন্টাল খরচ সব দেওয়া হবে। আর কাজটা করতে পারলে তিরিশ হাজার ডলার পারিশ্রমিক দেওয়া হবে।”

তিরিশ হাজার! আমার মুখ দিয়ে প্রায় বেরিয়ে যাচ্ছিল, ‘ও মাই গড!’

“না পারলে স্যার?” একেনবাবুর প্রশ্ন

“না পারলে খরচের টাকা ফেরত দিতে হবে না, শুধু পারিশ্রমিক তিরিশ হাজার ডলার পাবেন না।”

“কিন্তু কাজটা কী স্যার?”

“সেটা জানি না, দেখা হলে উনি বলবেন।”

“মুশকিল হল স্যার,” একেনবাবু ইতস্তত করে আমাদের দু-জনকে দেখিয়ে বললেন, “এঁরা আমার অ্যাসোসিয়েট, ওঁদের ছাড়া আমি তো যেতে পারব না।”

বার্ড সাহেব বললেন, “তাহলে তো মুশকিলই হল। উনি যাতায়াতের জন্য শুধু এগারো হাজার ডলার মঞ্জুর করেছেন।”

এটা ঠিক, ভালো কোনো কোম্পানির প্লেনে ফ্লেক্সিবল বিজনেস ক্লাস বুক করলে ওইরকম টাকাই লাগে। এয়ার ইন্ডিয়াতে গেলে অবশ্য হাজার খানেক কম। তবে ট্যুরিস্ট ক্লাসের ডিসকাউন্ট টিকিটে ন-শো ডলারেই যাতায়াত হয়ে যায়। তার মানে আমরা চাইলে তিন জনই ওই টাকার মধ্যে আরামসে ঘুরে আসতে পারব।

বার্ড সাহেব মনে হয় ব্যাপারটা জানেন। বললেন, “দেখুন কীভাবে আপনারা যাবেন, আপনাদের ইচ্ছা। আমি শুধু যাবার জন্য এগারো হাজার ডলার দিতে পারি, প্লেন ভাড়ার রিসিটও দিতে হবে না। আর হোটেলের খরচা আমরা এখান থেকে দিয়ে দেব। আপনি শুধু জানাবেন কোথায় থাকছেন।”

এমনিতেই প্রতি বছর এই সময়ে আমি আর প্রমথ দেশে যাই, টিকিটও বুক করা ছিল। একেনবাবুই শুধু পয়সা বাঁচাতে দোনামনা করছিলেন, এখন তো সে প্রশ্ন ও নেই। আমরা নিজেদের মধ্যে বাংলায় একটু আলোচনা করে নিলাম।

“ঠিক আছে স্যার, কতদিনের মধ্যে কাজটা করতে হবে?” একেনবাবু জিজ্ঞেস করলেন।

“কোনো সময় বেঁধে দেননি। ইন্ডিয়াতে গিয়ে সরাসরি মিস্টার র‍্যান্ডোর সঙ্গে কথা বলে কাজটা জেনে নিতে হবে। তবে দেখুন একটা কথা বলি, উনি আমার ক্লায়েন্ট ঠিকই, কিন্তু ওঁর সঙ্গে কথা বলে কিছু বুঝতে পারা সহজ ব্যাপার নয়। একটু সতর্ক করছি আপনাকে। এখন আপনার ইচ্ছে।”

“কিন্তু কথা বলার পর যদি ঠিক করি কাজটা নেব না…”

“কোনো সমস্যা নেই। এগারো হাজার অ্যাডভান্স তো পেয়েই যাচ্ছেন। তবে ওঁর ধারণা সমস্যাটা শুনলে কাজটা আপনি নেবেন। সেইজন্যেই ভাড়াটা আগাম দিতে বলেছেন।”

.

কাহিনির শুরু এইভাবেই। এক খ্যাপা লোকের কাজের জন্য বিদেশ, থুড়ি দেশ-যাত্রা।

।।৩।।

বার্ড সাহেবের সঙ্গে দেখা হবার ঠিক পাঁচ দিন বাদে আমরা কলকাতায় পৌঁছোলাম। এর মধ্যে একেনবাবু র‍্যান্ডো সাহেবকে জানিয়ে দিয়েছেন কলকাতায় কখন পৌঁছোচ্ছি। পরে আরও কয়েকটা মেসেজ পাঠিয়ে জানতে চেয়েছেন, কোথায় কীভাবে আমরা দেখা করতে পারি। একেনবাবুর কলকাতার ঠিকানা, ফোন নম্বর, সব কিছুই তাতে দেওয়া ছিল, তার একটারও উত্তর আসেনি! এ তো আচ্ছা বিপদ! কলকাতায় এসে পর্যন্ত একেনবাবু উশখুশ করছেন র‍্যান্ডো সাহেবের কাছ থেকে কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে। আমরাও বিস্মিত, কিন্তু হেল্পলেস। ঠিকানাটাও জানি না যে অন্য কোনোভাবে যোগাযোগ করব। দু-দিন হয়ে গেছে এসে পৌঁছেছি। একটু চিন্তাই লাগছে। তিন দিনের দিন একেনবাবুর বাড়িতে আড্ডা দিতে দিতে নানান কথার মাঝে এক-আধ বার র‍্যান্ডো প্রসঙ্গও উঠল। একেনবাবু স্বগতোক্তি করলেন, “আথ্রাইটিসে কাবু লিখেছিলেন স্যার, ঠিকঠাক আছেন কিনা কে জানে!”

“আরে মশাই সে-বুড়ো আছে কি না-আছে, কী এসে যাচ্ছে! আমাদের তো ফোকটে আসা হল।” প্রমথটা একেবারে যাচ্ছেতাই!

“কী যে বলেন স্যার, নিশ্চয় একটা ঝামেলায় পড়ে আমাদের ডেকেছেন, অথচ জানতে পারছি না সমস্যাটা কী?”

.

আসলে ঝামেলাটা কিছুই না, র‍্যান্ডো সাহেবের নেট কানেকশন ক-দিন কাজ করছিল না। এবার আর মেসেজ পাঠানো নয়, উনি নিজেই ফোন করলেন। আছেন ইলামবাজারের কাছে একটা জায়গায়। যেখানে থাকেন, সেখানে ট্রেনে করে যেতে সময় লাগবে। উনি ভাড়া গাড়ির বন্দোবস্ত করবেন আমাদের নিয়ে যাবার জন্য। ওখানে কয়েক দিন থাকার কোনো অসুবিধা হবে না। ওঁর বাড়ি যথেষ্ট বড়ো। পাশে গেস্ট হাউসও আছে। কাজটা কী, সেটা অবশ্য জানালেন না- সাক্ষাতে কথা হবে।

র‍্যান্ডো সাহেবের সঙ্গে ফোনে কথা শেষ হবার পর প্রমথ একটা ভালো প্রস্তাব দিল। ইলামবাজার যদি হয়, তাহলে বোলপুর স্টেশন থেকে খুব দূর হবার কথা নয়। অদ্দূর গাড়ি করে না গিয়ে ট্রেনে যাওয়া যেতে পারে। শান্তিনিকেতনে ওর মাসির বাড়িতে থাকা যাবে, বাড়িটা এইসময় ফাঁকাই থাকে। আর বউদিও যেতে পারেন, ওঁরও একটা চেঞ্জ হবে।

প্রমথর কথা শুনে একেনবাবু লাফিয়ে উঠলেন, “দারুণ আইডিয়া স্যার!”

“তা তো হবেই, ওখানেও দিব্যি বউদির রান্না খাবেন, সাহেবের বাড়িতে হাবিজাবি খেতে হবে না।”

“কী যে বলেন স্যার, সেটা মাথাতেই আসেনি! আসলে ফ্যামিলি অনেকদিন ধরেই শান্তিনিকেতনে যাবার কথা বলছিল। তার ওপর আমরা সবাই একসঙ্গে গেলে ভীষণ খুশি হবে!”

“এই সময়টা গরম হবে কিন্তু। জল-টলের সমস্যা নেই তো তোর মাসির ওখানে?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।

“আরে না, জার্মান-জল আছে, তার ওপর ডিপ টিউবওয়েল না কী জানি লাগিয়েছে গত বছর। এখুনি সব কিছু খোঁজ নিচ্ছি,” নলে প্রমথ মাসিকে ফোন করতে বাড়ির বাইরে গেল। একেনবাবুর বাড়ির ভেতর থেকে জোরদার সিগন্যাল পাওয়া যায় না।

কয়েক ঘণ্টার মধ্যে সব কিছু ফাইনাল। কাল সকালেই শান্তিনিকেতন এক্সপ্রেসে সবাই রওনা দেব। একেনবাবু ওঁর পুলিশি কানেকশন লাগিয়ে বোলপুর-এ একটা গাড়ি বুক করলেন দিন তিনেকের জন্য। র‍্যান্ডো সাহেবকে সব খবর দিয়ে মেসেজ পাঠালেন ঠিকানা আর ডিরেকশন পাঠিয়ে দেওয়ার জন্য। কাল বিকেলেই দেখা করতে যাবেন।

.

পরদিন সকালে ব্যাগ গুছিয়ে আমরা একেনবাবুর বাড়িতে হাজির হলাম। তারপর সদলবলে হাওড়া স্টেশন। একেনবাবুর চেনা ট্যাক্সি, তাই চার জনকে গাড়িতে নিতে ঝামেলা করল না। হাওড়া ব্রিজের মুখটাতে একটু জ্যামে আটকা পড়লাম। ফলে ট্রেনটা ধরতে দৌড়োদৌড়ি করতে হল। বউদিকে নিয়ে চিন্তা হচ্ছিল। কিন্তু কোনো প্রয়োজনই ছিল না। ছোটাছুটিতে সবার সঙ্গেই পাল্লা দিলেন।

ট্রেনটা ভরতি। আমাদের পাঁচটা সিটই একটা রো-তে। একদিকে আমি আর বউদি বসলাম। বউদিই আমাকে ‘বসুন ভাই’ বলে জোর করে বসালেন। বউদি জানালার ধারের সিটে, আমি আইলে। অন্যদিকে একেনবাবু, প্রমথ, আর জানলার ধারে অন্য একজন। ট্রেনে উঠেই একেনবাবুর বকবকানি শুরু হল। প্রমথ মন দিয়ে ‘নিউ ইয়র্কার’ পড়ার চেষ্টা করছিল। ম্যাগাজিনটা কয়েক দিন আগে এসপ্ল্যানেডে ফুটপাথ থেকে কিনেছে। মাঝে মাঝে মার্কিন মুলুকের ম্যাগাজিন ওখানে মেলে- পুরোনো ইস্যু অবশ্য। প্রমথ সেগুলো দেখতে পেলেই কেনে। দেশে এলে আমার আবার ওসব ছুঁতেও ইচ্ছে করে না। সঙ্গে একটা বাংলা পত্রিকা এনেছিলাম, কিন্তু ইন্টারেস্টিং কিছুই চোখে পড়ল না বলে একেনবাবু আর প্রমথর কথা শুনছি।

“কী পড়ছেন স্যার?”

“হারিয়ে যাওয়া পাণ্ডুলিপি নিয়ে একটা আর্টিক্ল।

“ইন্টারেস্টিং স্যার?”

“ইন্টারেস্টিং না হলে পড়ছি কেন?”

“তা ঠিক স্যার। কিন্তু হারিয়ে গেলে সেটা নিয়ে লেখা যায় কী করে?”

“কী বলছেন আপনি! বইগুলো সম্পর্কে রেফারেন্স আছে, কিন্তু পাওয়া যাচ্ছে না। সেটা নিয়ে প্রবন্ধ লেখা যায় না? আর যখন সেটা পাওয়া যায়, হইচই পড়ে যায়। এই তো বিয়াট্রিক্স পটারের ‘দ্য টেল অফ কিটি-ইন-বুটস’-এর হারিয়ে যাওয়া পাণ্ডুলিপি উদ্ধার হয়ে বই হিসেবে প্রকাশ হবার আগেই এত অর্ডার পেল যে অ্যামাজন-এর বেস্ট সেলার চার্টে উঠে গেল!”

“অ্যামেজিং স্যার, ট্রলি অ্যামেজিং!”

“আরও শুনুন, ডক্টর স্যুস-এর ‘হোয়াট পেট শুড আই গেট?’-এর পাণ্ডুলিপি হারিয়ে গিয়েছিল। পরে উদ্ধার হয়েছিল একটা জুতোর বাক্সের মধ্যে! এল. ফ্র্যাঙ্ক বম-এর দুটো বইয়ের ম্যানাস্ক্রিপ্ট তো এখনও পাওয়া যায়নি।”

“তিনি আবার কে স্যার?”

“‘দ্য উইজার্ড অফ অজ’ যিনি লিখেছিলেন। ওগুলো যদি কেউ উদ্ধার করতে পারে অন্তত কয়েক মিলিয়ন ডলার পকেটে পুরবে।”

“কয়েক মিলিয়ন! বলেন কী স্যার?”

আমি জানি এগুলো একেনবাবুর ন্যাকামি। উনি খুব ভালো করেই জানেন এসবের মূল্য। কিন্তু বকবক করতে হলে একটা কিছু নিয়ে তো করতে হবে!

প্রমথর হাতের পত্রিকাটার জরাজীর্ণ অবস্থা দেখে জিজ্ঞেস করলাম, “ কবেকার পুরোনো পত্রিকা রে?”

প্রমথ কভারটা দেখে বলল, “চার মাস আগের। কেন?”

“অনেক দিন আগে টিভি-র একটা টক শো-তে ঠিক এই নিয়েই একটা আলোচনা শুনেছিলাম। একটা বইও বেরিয়েছিল এই বিষয়ে। খুব হইচই হয়েছিল এ নিয়ে।”

“হতে পারে, এখানে অনেক খবর মনে হয় সেই বই থেকেই।’

এরপর একেনবাবু কিছু বললেন। কিন্তু বউদি কী একটা প্রশ্ন করায় ওদিকে আর কান দিলাম না, বউদির সঙ্গেই গল্প শুরু করলাম।

.

দুপুর সাড়ে বারোটা নাগাদ বোলপুর পৌঁছোলাম। গেট থেকে বেরোতেই একটা লোক এসে জিজ্ঞেস করল, “আপনাদের মধ্যে একেনবাবু বলে কেউ আছেন?”

এজেন্সি থেকে গাড়ি নিয়ে এক ড্রাইভার এসেছে। বড়ো গাড়ি, টাটা সুমো। বসার কোনো অসুবিধা নেই।

গাড়িতে যখন উঠছি হাঁফাতে হাঁফাতে অল্পবয়সি এক যুবক এসে হাজির। “মিস্টার সেন?”

“হ্যাঁ স্যার, আমি একেন্দ্র সেন। আমার খোঁজ করছেন?

“আজ্ঞে হ্যাঁ। আমি মিস্টার র‍্যান্ডোর সেক্রেটারি, সমীর বসু।”

“আমরা তো বিকেলে যাব, মিস্টার র‍্যান্ডোকে জানিয়ে দিয়েছি।”

“জানি স্যার। আমাকে মিস্টার র‍্যান্ডো পাঠিয়ে দিলেন, অন্য কোনো সাহায্য যদি দরকার হয়, সেটা দেখার জন্য।”

“স্যার, কিছু কি দরকার আছে আমাদের?” আমাদের উদ্দেশে প্রশ্নটা ছুড়লেন একেনবাবু।

“ভালো খাবার জায়গা আছে শান্তিনিকেতনে?” প্রমথ জিজ্ঞেস করল সমীরকে।

“খাবার জায়গা অনেক আছে, তবে কতটা ভালো বলতে পারব না। আমি নিয়ে যেতে পারি।”

“আমরা তো এখন বাসায় যাচ্ছি।

“বেশ তো আমি আপনাদের ফলো করব। কোথায় যাচ্ছেন?”

“পূর্বপল্লী।”

“ঠিক আছে। আপনারা রওনা দিন।”

আমাদের গাড়ির ঠিক পেছনেই জিপ টাইপের আরেকটা গাড়ি। সমীর দ্রুত তাতে গিয়ে উঠল।

.

প্রমথর মাসির বাড়িতে আমি আগেও এক বার এসেছি। পদ্ম-ভবনের উলটো দিকে। ইন্টারেস্টিংলি, একেনবাবুর দুটো রহস্য কাহিনি ছিল শান্তিনিকেতনকে কেন্দ্র করে। প্রথম রহস্য কাহিনিতে শুধু আমি আর প্রমথ শান্তিনিকেতনে এসেছিলাম। একেনবাবু সেটার সমাধান করেছিলেন নিউ জার্সিতে বসে। দ্বিতীয়টার জন্য অবশ্য সবাই এসেছিলাম। ছিলাম রতনকুঠিতে, বীরভূম পুলিশের গেস্ট হয়ে।

রতনকুঠির তুলনায় প্রমথর মাসির বাড়ি খুবই সাদামাটা, তবে পরিষ্কার- পরিচ্ছন্ন। সামনে গেটের ওপর বেতের তৈরি আর্চ। সেখানে মাধবীলতা বা মাধুরীলতা ফুটেছে, গাছের নাম-ধাম আমার মনে থাকে না। গেটের পিছন দিয়ে লাল মোরাম বিছানো রাস্তা বারান্দার সিঁড়ির পাশ দিয়ে একটুখানি এগিয়ে শেষ হয়েছে। রাস্তার দু-দিকেই খানিকটা জায়গা বাগান করার জন্য। এখানকার মাটি ভালো নয়। বাইরে থেকে মাটি এনে ফ্লাওয়ার বেড করা হয়েছে। এ ছাড়া বেশ কিছু টব। টব-ভরতি সাদা সাদা ফুল। প্রমথ বলল বেলফুল। আসার পথে চোখে পড়েছে বড়ো বড়ো গাছগুলোতে লাল আর হলুদের ছড়াছড়ি। ওগুলো মনে হয় কৃষ্ণচূড়া আর রাধাচূড়া – একমাত্র ওই দুটো নামই আমার জানা। এর আগে শীতকালে শান্তিনিকেতনে এসে বাড়িতে বাড়িতে ফুলের সমারোহ দেখেছি। এই সময়ে ফুল তেমন হয় না।

.

বাড়ির কেয়ার-টেকার বিহারের ছেলে, সে-ই বাগান করে। তার বউ খিচুড়ি বানিয়ে রেখেছিল। ঠিক ছিল আমরা পৌঁছোনোর পর ডিম আর বেগুন ভাজা হবে। সেটা কতটা সুখাদ্য হত জানি না, কিন্তু ওটাই ছিল প্রমথর ব্যাক-আপ প্ল্যান যদি অন্য কোথাও কিছু না জোটে। সমীর বসুর কল্যাণে মোটামুটি একটা ভালো রেস্টুরেন্টেই পৌঁছোনো গেল। নাম? না, ওটা দেব না। পাঠক ভাববে বিজ্ঞাপন দিচ্ছি। আর খাবার এমন কিছু ভালো নয় যে প্রচার করতে হবে। সমীরও আমাদের সঙ্গে বসল।

সমীর কথা বলতে ভালোবাসে। ‘র‍্যান্ডো সাহেব কতদিন হল এখানে এসেছেন,’ প্রশ্নের উত্তরে এক ধাক্কায় প্রচুর ইনফরমেশন দিল।

“এখানে মানে এই অঞ্চলে এসেছেন আট বছর তো হবেই। প্রথমে পোলট্রি ফার্ম শুরু করেছিলেন ভেদিয়াতে, বোলপুরের আগের স্টেশন। সেটা বিক্রি করে ইলামবাজারে এসেছেন বছর পাঁচেক। বেশ কয়েক একর জমি নিয়ে বানিয়েছেন ‘অর্গানিক ফার্ম হাউস।’ কেমিক্যাল সার বা পোকা মারার ওষুধ ব্যবহার না করে সেখানে চাষবাস করা হচ্ছে। একটা রেস্টুরেন্ট আছে, পাশে রাতে থাকার লজও আছে…” ইত্যাদি, ইত্যাদি।

মনে মনে ভাবছিলাম কী করে সেটা সম্ভব! যদ্দূর জানি বিদেশিরা ভারতবর্ষে চাষের জমি কিনতে পারে না। বসবাসের জন্যেও জমি কিনতে পারে কিনা সন্দেহ, রেসিডেন্সি নিলে হয়তো পারে। এটা ঠিক, আইনত না হলেও আবার সব কিছুই হয়— ও নিয়ে প্রশ্ন তুলে লাভ নেই।

“শুনলাম স্যার মিস্টার র‍্যান্ডো নাকি খুব অসুস্থ?”

“খুব মানে কিছুদিন ধরে আথ্রাইটিসে বেশ কষ্ট পাচ্ছেন। ভালো করে হাঁটাচলা করতে পারছেন না। এখন ওষুধ খেয়ে খানিকটা কনট্রোলে, ওয়াকার নিয়ে চলাফেরা করতে পারছেন। এমনকী এক তলা-দোতলাও করছেন। আজ বিকেলে গেলেই দেখতে পাবেন।”

“পাঁচটা নাগাদ গেলে কোনো অসুবিধা হবে স্যার?”

“কিছুমাত্র না। আপনাদের গাড়ি কি থাকবে, না আমি গাড়ি আনব?”

“না না, গাড়িটা থাকবে স্যার। আমাদের ড্রাইভারকে জায়গাটা বলে দিন, ও ঠিক নিয়ে যাবে। আরেকটা কথা স্যার, আমার ফ্যামিলিকে যদি নিয়ে যাই, অসুবিধা আছে?”

“ফ্যামিলি!”

“উনি বলতে চাচ্ছেন ওঁর মিসেসকে নিয়ে।” আমি সমীরের ধন্ধটা মিটিয়ে দিলাম।

“সে কী কথা, নিশ্চয় নিয়ে আসবেন! আপনারা যখন কথা বলবেন আমি বউদিকে ফার্মটা ঘুরে দেখিয়ে দেব। কাছাকাছি আরও দু-একটা দেখার জায়গা আছে।”

“থ্যাংক ইউ স্যার, থ্যাংক ইউ ভেরি মাচ।”

একটা জিনিস কথাবার্তার মধ্যে খেয়াল করছিলাম- আমাদের থেকে একটু দূরে একজন মেমসাহেব দু-জন লোকের সঙ্গে বসে চা খাচ্ছে, আর মাঝে মাঝে আমাদের দিকে তাকাচ্ছে! হয়তো আমার চোখের ভুল। প্রমথকে ফিসফিস করে বললাম, ও পাত্তা দিল না।

সমীর আমাদের সঙ্গে বসেছিল বটে, কিন্তু চা ছাড়া আর কিছু খেল না। আমাদের খাবার মাঝখানেই ওর কী জানি একটা কাজ করতে হবে বলে চলে গেল। যাবার আগে বলে গেল, আমাদের ড্রাইভারকে কোথায় যেতে হবে বুঝিয়ে দেবে। ওর মোবাইল নম্বরটাও দিয়ে গেল, যদি পথে দরকার হয়। লক্ষ করলাম, সমীর চলে যাবার সঙ্গে সঙ্গে সেই মেমসাহেবও টেবিল ছেড়ে উঠে পড়লেন।

।।৪।।

আমরা খেয়ে-দেয়ে একটু বিশ্রাম করে বিকেল বিকেল রওনা দিলাম। এই পথে আগেও এক বার ইলামবাজার হয়ে কলকাতায় গিয়েছি। কিন্তু ইলামবাজার পর্যন্ত যেতেও হয় না, তার আগেই জায়গাটা পড়ে। রাস্তার দু-দিকে শালবন শুরু হবার পর একটু গেলেই ডান দিকে সরু যে-রাস্তা বনের ভিতর দিয়ে গেছে সেটা ধরতে হয়। রাস্তাটা আসলে পিচের, কিন্তু লাল ধুলোয় ঢাকা বলে পিচের না মাটির বোঝা কঠিন। কাছাকাছি নিশ্চয় কোথাও সাঁওতালপল্লী আছে, কয়েক জন সাঁওতালকে দেখলাম পথে। মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই গন্তব্যস্থলে পৌঁছে গেলাম। রাস্তাটা হঠাৎ করে শেষ হয়েছে পাঁচিল দেওয়া একটা বড়ো গেটের সামনে। তার ঠিক আগে পায়ে চলার ছোটো একটা পথ পাঁচিল ঘেঁষে বাঁ-দিকে চলে গেছে কোনো এক জঙ্গল মুল্লুকে! গেটের ওপরে বিশাল বোর্ড। ইংরেজিতে লেখা, ‘Organic Farm House, Ilambazar।’

.

গেটটা হাট করে খোলা। গাড়ি নিয়েই ঢুকলাম। প্রথমেই মোরাম বিছানো বড়োসড়ো একটা চত্বর। মাঝখানে একটা বটগাছ, তার নীচে কয়েকটা গাড়ি পার্ক করা। চত্বরের একদিকে এক তলা অফিসঘর, আর লাগালাগি একটা বুটিক। অন্যদিকে বোধহয় সেই লজ, যার কথা সমীর বলেছিল। সেখানে কয়েকটা জানলার নীচে এসি মেশিন চোখে পড়ল। চত্বরের মাঝখানে তিন দিক খোলা খড়ের ছাউনি দেওয়া খাবার জায়গা। সেখানে গোটা ছয়েক টেবিল আর চেয়ার পাতা। প্রত্যেকটা টেবিলের ওপরে একটা করে ফ্যান ঝুলছে আর বাতি। আসার পথে কোনো ল্যাম্প-পোস্ট চোখে পড়েনি। হয়তো নিজেদের জেনারেটরে চলে। তবে এইরকম অঞ্চলে ওপেন এয়ার-এ খাওয়া-দাওয়া? মশা তো একটা সমস্যা হবে! লোকজন নেই। এইসময় বোধহয় রেস্টুরেন্ট সার্ভিস বন্ধ। ছাউনির যে-পাশে দেয়াল, সেখানে হাত-মুখ ধোয়ার বেসিন। পাশেই লাগোয়া দোকানে জিনিসপত্র কেনা-বেচা চলছে। বড়ি, পাঁপড় থেকে শুরু করে জ্যাম, জেলি, আচার, মিষ্টি অনেক কিছুই বিক্রি হচ্ছে মনে হল। বুটিকটা খোলা। সেখানে একজনকে জিজ্ঞেস করতেই র‍্যান্ডো সাহেবের বাড়ি দেখিয়ে দিল। একটু ভেতরের দিকে। খাবার জায়গার পাশ দিয়ে একটা প্যাসেজ ধরে এগোতে হয়। মাটি দিয়ে তৈরি দোতলা বাড়ি। দেয়ালে আকর্ষণীয় সাঁওতালি আর্ট। সামনে ছোট্ট বাগান। পেছনে অনেকটা জমি, তাতে নানান ধরনের শাকসবজির চাষ চলছে। আরও পেছনে ফলের বাগান। আম, পেয়ারা, বাতাবি লেবু, খেজুর, ইত্যাদি নানান গাছ চোখে পড়ল।

সমীর আমাদের দেখতে পেয়ে নীচে নেমে এসেছে। বউদি বাড়িতে ঢুকতে চাইলেন না। একেনবাবুকে বললেন, “তুমি তোমার কাজ করো, আমি বরং বুটিকটা ঘুরে দেখি।”

প্রমথ আর বউদি বাইরেই রইল। আমি আর একেনবাবু সমীরের পিছন পিছন গেলাম।

বউদি আর প্রমথকে সমীর বলল, “আমি ওঁদের পৌঁছে দিয়ে আসছি, স্যার বলেছেন ব্যাপারটা প্রাইভেটলি একেনবাবুকে বলতে চান।”

.

মাটির বাড়ি, একটু ভয়ে ভয়েই সিঁড়ির দিকে এগোচ্ছিলাম। দেখলাম সিঁড়ি কাঠের। আরও খেয়াল করলাম নামেই মাটির বাড়ি। পরে শুনলাম বাড়ির ফ্রেম নাকি শাল কাঠের, প্লাইউডের দেয়ালে মাটির প্রলেপ দেওয়া হয়েছে— ওইটুকুই। মেঝে আমেরিকার মতো হার্ডউড, অর্থাৎ শক্ত কোনো কাঠ দিয়ে তৈরি। র‍্যান্ডো সাহেবের ব্যাকগ্রাউন্ড কী জানি না, কিন্তু বাড়িটা বানাতে ইঞ্জিনিয়ারিং বিদ্যা কাজে লাগানো হয়েছে সন্দেহ নেই। দোতলায় উঠে সমীর আমাদের মিস্টার র‍্যান্ডোর ঘরে নিয়ে গেল। ঘরটা মাল্টি-পারপাস রুম-শোওয়া, বসা, পড়া সব কিছুই চলে। দুটো আলমারিতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে কিছু বই, ছোটো ছোটো কয়েকটা বাক্স, আর হাবিজাবি কিছু জিনিস। গদি লাগানো চারটে হাতল দেওয়া চামড়ার চেয়ার। সেগুলোর মধ্যে একটা একটু বড়ো, যার সামনে একটা ফুট-রেস্ট, মানে পা-রাখার টুল। কাঁচা-পাকা চুল র‍্যান্ডো সাহেব সেই বড়ো চেয়ারে বসা। একটা ওয়াকার হেলান দিয়ে পাশে রাখা। আমাদের দেখে ওয়াকার নিয়ে উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করলেন।

“প্লিজ উঠবেন না স্যার।” একেনবাবু হইহই করে বাধা দিলেন। তারপর “কেমন আছেন স্যার?” প্রশ্ন করে আমার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন।

সামনের চেয়ার দুটো দেখিয়ে র‍্যান্ডো সাহেব বললেন, “এত শর্ট নোটিসে যে আপনি এসেছেন, আমি খুব কৃতজ্ঞ। জানি অনেকটা পথ। কিন্তু আমার সত্যিই সাহায্যের দরকার।”

মিস্টার র‍্যান্ডোর কত বয়স জানি না, কিন্তু তোবড়ানো গাল আর কোটরের মধ্যে ঢোকানো চোখ দেখলে কম সে কম সত্তর-পঁচাত্তর মনে হয়। গায়ে গেরুয়া রঙের ফতুয়া টাইপের জামা। খানিকটা সন্ন্যাসী সন্ন্যাসী ভাব।

“বলুন স্যার, কী সাহায্য করতে পারি?” একেনবাবু চেয়ারে বসতে বসতে বললেন।

“বলছি। সমীর, তুমি বেরোবার সময় দরজাটা বন্ধ করে দাও।”

সমীর চলে যাবার পর মিস্টার র‍্যান্ডো বললেন, “আপনাদের যা বলছি, তা খুবই গোপনীয়,” বলে আমার দিকে তাকালেন।

“আপনি স্যার স্বচ্ছন্দে বাপিবাবুর সামনে যা বলার বলতে পারেন। আমাকে বলাও যা, ওঁকে বলাও তাই।”

“বেশ।”

“ভেতরের দরজাটা খোলা দেখে আমি জিজ্ঞেস করলাম, “ওই দরজাটা কি বন্ধ করে দেব?’

“দরকার নেই, ফুলমনি ইংরেজি বোঝে না।”

ফুলমনি কে, একটু বাদেই বুঝলাম। স্টানিং চেহারার এক সাঁওতালি যুবতী জলের বোতল নিয়ে দরজা দিয়ে উঁকি দিতেই মিস্টার র‍্যান্ডো জিজ্ঞেস করলেন,

“চা খাবেন তো?”

“না না স্যার, কিচ্ছু লাগবে না।”

আমিও সায় দিলাম।

জলের বোতলটা পাশে একটা ছোট্ট টেবিলে রাখল ফুলমনি। আলমারি খুলে ওষুধের একটা স্ট্রিপ নিয়ে এসে বলল, “ওষুধটা খেয়ে নিয়ো, সময় হয়ে গেছে।’

“বেশ, তুই যা।”

র‍্যান্ডো সাহেব দেখলাম খুব একটা খারাপ বাংলা বলেন না। ‘বেশ” কথাটাও খেয়াল করেছি বীরভূমের লোকালরা খুব ব্যবহার করে।

ফুলমনি আর দাঁড়াল না। মেয়েটির হাঁটাচলায় একটা ছন্দ আছে। ফুলমণির চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছি দেখে র‍্যান্ডো বললেন, “আমার কাছে আছে বছর ছয়েক ধরে, আমাকে দেখাশোনা করে।”

নিশ্চয় হ্যাংলার মতো তাকিয়ে ছিলাম। লজ্জা পেলাম।

“এবার বলুন স্যার।”

মিস্টার র‍্যান্ডো তাঁর কাহিনি শুরু করলেন।

.

“আমার স্ত্রী, লুসি আমাকে ছেড়ে চলে যায় পঁয়ত্রিশ বছর আগে। যাবার দু-বছরের মধ্যে বোল্ডার সিটি-তে ও আগুনে পুড়ে মারা যায়। খবরটা আমি পাই হলিউড পুলিশের কাছ থেকে। পুলিশই খোঁজখবর নিয়ে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করে, কারণ লিগালি আমাদের ডিভোর্স বা সেপারেশন কিছুই হয়নি। স্বামী হিসেবে সৎকারের দায়িত্ব আমার, যদিও দেহ আগুনে পুড়ে কিছুই প্রায় ছিল না। এইভাবেই তেত্রিশ বছর আগে আমার বিবাহিত জীবনের সব কর্তব্য শেষ হয়ে যায়। এরপর আমি আর বিয়ে করিনি, মেয়েদের সঙ্গে আমার সব সম্পর্কই ছিল সাময়িক। আমার ধ্যানজ্ঞান সব কিছুই ছিল স্ক্রিপ্ট রাইটিং… এ লং স্ট্রাগ্ল। বারো বছর আগে হঠাৎ করেই আমার ভাগ্য খুলে যায়। নাথিং টু ডু উইথ হলিউড। আপনাকে তো এই নিয়ে বলেছি, তাই না?”

“হ্যাঁ, স্যার।”

“নানান দেশ ঘুরতে ঘুরতে কী করে এখানে এসে পৌঁছোলাম, সে এক দীর্ঘ কাহিনি। সেটা বাদ দিয়ে আসল প্রসঙ্গে আসি। মাস চারেক আগে, মেল ব্রুকস নামে একজনের কাছ থেকে আমি একটা ইমেল পাই। ‘তোমার স্ত্রী লুসি’ হেডিং না দেখলে হয়তো ডিলিট করে দিতাম। ইমেল-এর সঙ্গে ছিল একটা অ্যাটাচমেন্ট। মেল ব্রুকস হলিউডের একজন বিখ্যাত অভিনেতা, তিনি নিশ্চয় আমাকে ইমেল লিখবেন না। অর্থাৎ একই নামের অন্য কেউ। অচেনা কারোর কাছ থেকে আসা ইমেল-এ অ্যাটাচমেন্ট থাকলে আমি সাধারণত সেটা খুলি না। অনেক সময়ে ওগুলোতে ভাইরাস থাকে। একবার খুলে খুব ঝামেলায় পড়েছিলাম। না-খোলা অবস্থায় ইমেলটা পড়েছিল। ভুলেই গিয়েছিলাম ওটার কথা। কিছুদিন আগে পুরোনো ইমেল ঘাঁটতে ঘাঁটতে চোখে পড়ল। আমার নতুন ল্যাপটপের ভাইরাস প্রোটেকশন খুবই ভালো। তাই সাহস করে ইমেলটা খুলতেই দেখি বিয়ের আগে তোলা আমার আর লুসি-র একটা ছবি! আমি তো অবাক! পেল কোত্থেকে? কিন্তু তার নীচে যে ক’টা লাইন, সেটা আরও বিস্ময়কর… ‘তুমি চোর… লুসির ঠাকুরদার খাতা তুমি চুরি করেছ!” প্রথমে আমি ধরতেই পারছিলাম না ব্যাপারটা কী! কে এই মেল ব্রুকস? হলিউডে জনা দুয়েক মেলকে চিনতাম। মেল ব্রুকস তো একজন লেজেন্ড। অন্য মেল, মেল গিবসনও পরে বিখ্যাত অ্যাক্টর হয়েছিল। তার সঙ্গে এক বারই একটা পার্টিতে পরিচয় হয়েছিল। লুসি এদের কাউকে চিনত না। কিন্তু কোন খাতার কথা বলছে এই মেল? তার পরেই মনে পড়ল লুসি যখন বাড়ি ছেড়ে চলে যায় তখন একটা ছোটো কার্ডবোর্ডের বাক্স ফেলে রেখে গিয়েছিল। ওটা ফেলে দিইনি, কারণ ভেবেছিলাম লুসি হয়তো একদিন ফিরে আসবে।”

“একটা কথা স্যার, এই বাক্স বা খাতার প্রসঙ্গ বাড়ি ছেড়ে চলে যাবার পর ম্যাডাম লুসি আর কখনো তোলেননি?”

একমুহূর্ত চুপ করে থেকে র‍্যান্ডো সাহেব বললেন, “বার দুই ফোন করে ওগুলো চেয়েছিল, রাগ করেই দিইনি। শুনেছিলাম অন্য একটা লোকের সঙ্গে ও থাকে। তার সঙ্গেই থাকুক না, ওই বাক্সের আর কী দরকার! তারপর যা হয়, বেমালুম ভুলে গিয়েছিলাম বাক্সটার কথা! আমার একটা ক্লজেট প্রায় ভরতি ছিল কাগজপত্রে- নানান স্ক্রিপ্টের ড্রাফট, ফাইনাল কপি, ইত্যাদি। তার মধ্যে ওই বাক্সটাও পড়ে ছিল। নিউ ইয়র্কে চলে আসার জন্য যখন ক্যালিফোর্নিয়ার পাট চোকাচ্ছি, তখন মুভাররা ক্লজেট খালি করে সব কিছুই নিউ ইয়র্কে নিয়ে আসে। নিউ ইয়র্কে বাক্সগুলো আনপ্যাক করতে গিয়ে সেই পুরোনো কার্ডবোর্ড বাক্সটা চোখে পড়ে। খুলে দেখি মলাট-ছেঁড়া কয়েকটা খাতা। মাঝে মাঝে হয়, কিছু কিছু পুরোনো কথা হঠাৎ করে মনে আসে। মনে পড়ে গেল আমাদের বিয়ের পর পর এই বাক্সটা খুলে লুসি দেখিয়েছিল। ওগুলো ছিল ওর ঠাকুরদার স্মৃতি। ছেলেবেলাতেই তাঁকে হারায়, কিন্তু ওর ছেলেবেলার সুখস্মৃতি বলতে ছিল সেই ঠাকুরদা। ভদ্রলোকের একটা প্রিন্টিং প্রেস ছিল, নিজেই অবাক হচ্ছি যে-নামটা বলেছিল, সেটা পর্যন্ত আমার মনে আছে– লুসিডা প্রেস। কিন্তু এই খাতাগুলোর খবর এই লোকটা জানল কী করে? আর চুরি করার কথাই-বা আসছে কোত্থেকে! সব থেকে বড়ো প্রশ্ন, কে এই মেল নামের লোকটা? বুঝতে পারছেন আমার সমস্যা?”

“নিশ্চয় বুঝতে পারছি স্যার, কিন্তু আমার কেমন জানি মনে হচ্ছে এটা একটা উড়ো চিঠি, হঠাৎ করেই কিছু মিলে গেছে। ভালো কথা, ছবিটা কি আপনার স্ত্রী ম্যাডাম লুসির?”

“হ্যাঁ, ছবিটা লুসিরই। প্রথমে আমিও আপনার মতো ভেবেছিলাম, কেউ ছবিটা পেয়ে হয়তো মজা করে ইমেলটা আমাকে পাঠিয়েছে। কিন্তু ব্যাপারটা এখানেই শেষ নয়, যার জন্য এখন আমার চিন্তা হচ্ছে।”

“একটু বুঝিয়ে বলুন স্যার?”

“এই ইমেল-এর অ্যাটাচমেন্টটা খোলার একদিন বাদেই মেল ব্রুকস লোকটার আর একটা ইমেল এল, সেটাতেও একটা অ্যাটাচমেন্ট। খুলে দেখি, সেখানে লেখা – আমার কাছে প্রমাণ আছে তুমি লুসির ঠাকুরদার খাতা শুধু চুরি করোনি, তুমিই লুসির হত্যাকারী। আগেও এক বার লুসিকে খুন করার চেষ্টা করেছিলে। মনে রেখো ক্যালিফোর্নিয়াতে খুনের কেস কখনো ক্লোজ করা হয় না। এ ছাড়াও তোমার অন্য অপকর্মের কয়েকটা ফোটো আছে… মনে করার চেষ্টা করো। সেগুলোরও কিন্তু স্ট্যাচুট অফ লিমিটেশন নেই।

“সঙ্গের অ্যাটাচমেন্টে লুসির ছবি – চোখ-মুখ বিচ্ছিরিভাবে ফোলা, গালে কালশিরা। এবার আমি সত্যিই ভয় পেয়ে গেলাম, কিন্তু বুঝে উঠতে পারলাম না, ঠিক কী করা উচিত। পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করতেও সাহস হচ্ছে না। একবার ওদের জালে পড়লে শেষ পর্যন্ত কী দাঁড়াবে কে জানে! তার ওপর আমার ওল্ড ওয়েস্টবেরি-র বাড়িতে কয়েক মাস আগে বার্গলারির চেষ্টা হয়েছে। চুরি কিছু হয়নি অবশ্য। আপনার সঙ্গে হঠাৎ করেই আমার পরিচয় হয়েছিল। পরে স্টুয়ার্টের কাছে আপনার অনেক প্রশংসা শুনেছি। তাই আমি স্টুয়ার্টের সঙ্গে যোগাযোগ করে আপনার ফোন নম্বর জোগাড় করলাম।”

“ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্ট ব্যাপারটা জানেন?”

“না, আপনি ছাড়া আর কেউ জানে না, স্টুয়ার্টও তো পুলিশে কাজ করে। আমার নিউ ইয়র্কের বাড়িতে কেউ কিছু চুরির চেষ্টা করেছে অজুহাত দিয়ে আপনার নম্বর জোগাড় করেছি। সাধারণত ছোটোখাটো চুরি নিয়ে ওখানকার পুলিশ মাথা ঘামায় না, জানেন তো।”

“এই ছবিটা আপনি আগে দেখেননি, তাই কি স্যার?”

“মনে করতে পারছি না। শেষের দিকে মাঝে মাঝে আমার সঙ্গে লুসির ঝগড়া হত, মাতাল অবস্থায় দু-জনে মারামারিও করেছি। যদিও ওইরকমভাবে কোনোদিন লুসিকে আহত করেছি কিনা মনে নেই। আমিও রক্তাক্ত হয়েছি ওর আক্রমণে।”

“অন্য কয়েকটা অপকর্মের কথা যে চিঠিতে ছিল স্যার, সেগুলো কী অনুমান করতে পারেন?”

র‍্যান্ডো সাহেব মাথা নাড়লেন। যদিও দেখে মনে হল কিছু একটা চেপে যাচ্ছেন!

“একটা কাজ করা যাক স্যার, এভাবে আমার কাছে কিছু পরিষ্কার হবে না। আপনি একটু ডিটেলে বলুন আপনার আর আপনার স্ত্রী ম্যাডাম লুসির কথা- কবে থেকে ওঁকে চিনতেন, কোথায় আপনাদের দেখা হয়েছিল, ওঁর বাবা-মা, বন্ধুবান্ধবদের কথা, ওঁর মৃত্যুর কথা। কিচ্ছু বাদ দেবেন না।”

“বেশ, কিন্তু এটা দীর্ঘ কাহিনি হবে, আমি একটু ওয়াশরুম থেকে ঘুরে আসি।”

“নিশ্চয় স্যার।”

মিস্টার র‍্যান্ডো বেল বাজিয়ে ফুলমনিকে ডাকলেন। ফুলমনি প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ঘরে এল, মনে হয় দরজার বাইরেই বসে ছিল। মিস্টার র‍্যান্ডোকে ধরে ধরে নিয়ে গেল।

।।৫।।

খানিক বাদেই ফুলমনির কাঁধে হাত রেখে ফিরে এসে চেয়ারে বসলেন মিস্টার র‍্যান্ডো। একটু চুপ করে থেকে শুরু করলেন।

“সত্যি কথা বলতে কী, লুসির পরিবার সম্পর্কে আমি কিছুই বিশেষ জানতাম না। লুসি নিজের থেকে কিছু বলত না। ওর টুকরো টুকরো কথা থেকে যেটুকু জেনেছিলাম, তা হল ওর বাবা ছিলেন এক মদ্যপ জুয়াড়ি। লুসির মাকে এত মারধোর করতেন যে একদিন মা পালিয়ে বাঁচলেন। বাবাও একদিন কাউকে কিছু না জানিয়ে অদৃশ্য হলেন। লুসির বয়স তখন পনেরো। ওর আপন বলতে কেউই ছিল না’। দূর-সম্পর্কের দু-এক জন যারা ছিল তারা কেউই ওর দায়িত্ব নিতে চায়নি। ফলে মাইনর মেয়ে লুসি হয়ে গেল স্টেট-এর দায়িত্ব। লুসিকে পাঠানো হল একটা ফস্টার হোম-এ। লুসির নিজের বলতে ছিল অল্প কিছু জামাকাপড়, বইপত্তর, আর ওর ঠাকুরদা-র রেখে যাওয়া একটা বাক্স, যেটার কথা আপনাকে বলেছি। লুসির সেই ঠাকুরদাকে মনেও নেই, তবে ছোট্ট লুসিকে তিনি নাকি খুব ভালোবাসতেন। বোধহয় সেইজন্যেই নিজের পরিবারের ওই একটি মাত্র জিনিসই লুসি স্মৃতি হিসেবে আঁকড়ে রেখেছিল। ফস্টার হোমে থেকেই লুসি ওর হাই স্কুল শেষ করে।”

কথাগুলো বলে একটু চুপ করে থেকে আবার শুরু করলেন র‍্যান্ডো, “আমি যখন সিনিয়র ইয়ারে পড়ি, লুসি তখন ঢুকল ফ্রেশার হয়ে।”

“সিনিয়র ইয়ার মানে তো ফোর্থ ইয়ার, আর ফ্রেশার মানে ফার্স্ট— তাই তো স্যার?”

“ঠিক। কলেজে ক্যাফেটেরিয়াতে পার্ট-টাইম কাজ করত লুসি, সেখানেই পরিচয়। এক এক জনের সঙ্গে হঠাৎ ক্লিক করে যায়। লুসির সঙ্গে সেটাই ঘটল। খুব স্ট্রাগ্ল করে ও পড়াশুনো করছিল, আঠেরোতে পৌঁছোবার পর আইনত ফস্টার বাবা-মা’র ভরণ-পোষণের কোনো দায়দায়িত্ব থাকে না। নিজের সব খরচ নিজেকেই জোগাড় করতে হয়। অনেক সময় ফস্টার বাবা-মা কিছুটা সাহায্য করে। ওর ক্ষেত্রে সেটা ছিল একেবারেই শূন্য। থাকা-খাওয়া-পরা থেকে শুরু করে খাতা বইপত্তর, পড়াশুনোর পুরো খরচ নিজেকেই জোগাড় করতে হত। ক্যাফেটেরিয়ার পার্ট- টাইম কাজ আর একটা লোকাল রেস্টুরেন্টে নাইট-শিফট— এই দুই উপার্জন থেকে কোনোমতে জীবনধারণ। আমার ওকে ভালো লাগত, কারণ এত পরিশ্রম করার পরও ওর স্পিরিটটা ছিল অটুট। জীবনের এই স্ট্রাগ্ল ওর চেহারায় কোনো ছাপ ফেলত না। একটু সাজলেই শি লুকড গ্ল্যামারাস। অল্পদিনের মধ্যেই আমরা প্রেমিক-প্রেমিকা হয়ে গেলাম। আমার স্বপ্ন ছিল স্ক্রিপ্ট রাইটার হব। ক্লাসে আমার লেখা স্ক্রিপ্ট সবসময়ে A+ গ্রেড পেত, কিন্তু গ্র্যাজুয়েশনের পর দেখি আমার কলেজ-গ্রেডের মূল্য হলিউডে শূন্য। কেউই কোথাও আমাকে সুযোগ দিচ্ছে না। কিছুদিন রেস্টুরেন্টে ওয়েটারগিরি করলাম, কিছুদিন প্রতিষ্ঠিত স্ক্রিপ্ট রাইটারদের জন্য Ghost writing। অল্প কিছু টাকা পেলাম, কিন্তু স্বীকৃতি পেলাম না। ইতিমধ্যে লুসিকে বিয়ে করেছি। লুসিও পাশ করে ছোটোখাটো চাকরি করছে, কিন্তু হলিউডে যেখানে থাকতাম সেখানে আমাদের দু-জনের রোজগারে ভালোভাবে থাকা কঠিন। লুসিও চেষ্টা করছিল। কাজের ফাঁকে ফাঁকে এক মেক-আপ আর্টিস্টের শাগরেদি করল কিছুদিন। এক-আধটা কোর্সও করল। কিছুই হল না। লুসি আমাকে চাপ দিতে শুরু করল, হলিউডে কিছু পাবার আশা ছেড়ে আমরা অন্য কোথাও যাই, সেখানে অন্য কোনো কাজের চেষ্টা করি। আমারও গোঁ, কোনোমতেই সেটা করব না। খটাখটি সেখান থেকেই শুরু। তার ওপর লুসি ছিল অত্যন্ত পজেসিভ, অন্য কোনো মেয়ের সঙ্গে একটু হেসে কথা বললেই প্রচণ্ড অশান্তি শুরু করত, যার জের চলত দিনের পর দিন। মোটকথা, আমার ওপর অধিকারবোধটা ছিল ওর ষোলো আনা, ভালোবাসা কতটা অবশিষ্ট ছিল জানি না। কথাবার্তায় ঘৃণাই প্রকাশ পেত বেশি মাত্রায়। একদিন হলিউডের এক প্রডিউসারের কাছে প্রবলভাবে অপমানিত হয়ে ফিরে এসে যখন গুম হয়ে বসে আছি, সহানুভূতি তো পেলামই না, উলটে তিক্তভাবে বলল, ‘ইউ ডিজার্ভ ইট।’

“সেদিন থেকে লোকাল বার-এ গিয়ে মদ খাওয়া শুরু করলাম। রেস্টুরেন্টের কাজ শেষ করে বেশ রাত পর্যন্ত সেখানেই কাটাতাম। লুসিও বাইরে বাইরে ঘুরত। খেয়াল করতাম অনেক সময়েই কিছু খেয়ে ঝিম হয়ে আছে। ঝগড়াঝাঁটি চেঁচামেচি প্রায় নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়াল। এর মধ্যে একদিন আমার ব্যাঙ্ক থেকে নোটিস পেলাম, ওভার ড্রাফট করেছি বলে কুড়ি ডলার চার্জ করেছে। এমনিতে ব্যাঙ্কের ব্যাপারে আমি খুব হিসেব করে চলি। ব্যাঙ্কে যেতেই ওরা আমাকে লোকাল ডিপার্টমেন্ট স্টোরের নামে পাঁচশো ডলারের একটা চেক দেখাল, নীচে আমার সই। আমার সঙ্গে কথা না বলে আমার সই নকল করে চেক লিখেছে লুসি! সেদিন ব্যাপারটা দৈহিক পর্যায়ে পৌঁছোল, লুসি একটা প্যান-এর বাড়ি মেরে আমার কপাল ফাটাল, আমিও ঘুসি মেরে ওকে মাটিতে ফেললাম। লুসি ব্যথায় কাতরাচ্ছে আর কাঁদছে… যাইহোক, এইসবের মধ্যে একদিন আমি রাগ করে বাড়ি থেকে বেরিয়েই গেলাম। এক বন্ধুর বাড়ি রাতটা কাটিয়ে সকালে ফিরে দেখি, লুসি নেই। একটা নোট, ‘আই অ্যাম ডান উইথ ইউ। খোঁজার চেষ্টা কোরো না।’ ক্লজেট খুলে দেখলাম ওর জামাকাপড় নেই, ড্রেসার ড্রয়ারও ফাঁকা

“কেন আমি পুলিশকে জানাইনি জানি না। আসলে লুসি চলে যাওয়ায় মাথার থেকে মস্ত একটা বোঝাই যেন নেমে গেল। লুসিও যোগাযোগ করেনি। কিছুদিন বাদে এক পরিচিত আমাকে জানাল নেভাডার বোল্ডার সিটি-তে লুসিকে দেখেছে, একটা লোকের সঙ্গে থাকে। কথাটা শুনে একটু রাগ যে হয়নি তা নয়। মনে হচ্ছিল আমার সম্পত্তি কেউ যেন ভোগ করছে! তবে কিনা আমিও অন্য মেয়েদের সঙ্গে থাকতে শুরু করেছি। পার্মানেন্টলি নয়, তবে তার একটা নেশা তো আছেই। আমাদের বিয়েটা ভাঙেনি, কিন্তু দু-জনে দু-জায়গায়, কেউই কারোর খবর রাখি না। ভাড়াবাড়িতে থাকতাম, ফার্নিচার, খাট, এমনকী রান্নার বাসনপত্রগুলোও বাড়ির সঙ্গেই এসেছিল। তাই ভাগ-বাঁটোয়ারার ঝামেলা ছিল না। এইভাবে বছর দুই ধরে একা-একাই আছি হলিউডে, হঠাৎ মে মাসের এক বৃহস্পতিবার খুব সকালে দু-জন পুলিশ অফিসার বাড়িতে এসে হাজির। জিজ্ঞেস করল, আমার স্ত্রী-র নাম লুসি কিনা! আমি হতচকিত! তাঁদের জানালাম যে লুসি আর আমার ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে দু-বছর আগে

“ফর্মাল সেপারেশন অবশ্য হয়নি, সেটা আর বললাম না। অফিসার জানতে চাইল সোমবার কোথায় ছিলাম। সে সময়ে ছোট্ট একটা রেস্টুরেন্টে দিন-রাত কাজ করছি— সকালের শিফট আটটা থেকে দুপুর পর্যন্ত, রাতের শিফট আটটা থেকে মিড-নাইট। তারই ফাঁকে একটু লেখালেখি, আর অন্যান্য যা কাজকর্ম। ওটাই ছিল আমার রুটিন। সোমবারও সেখানেই কাজ করেছি। বিকেল বেলায় মিটিং করেছি হলিউডের এক ক্রিয়েটিভ ডিরেক্টরের সঙ্গে।

“কোন রেস্টুরেন্ট, তার ঠিকানা, ক্রিয়েটিভ ডিরেক্টরের নাম-ধাম ইত্যাদি লিখে নিয়ে একজন প্রশ্ন করলেন, লুসির বন্ধুদের খবর কিছু জানি কিনা। একজনের খবরই শুধু জানতাম, মিন্ডি। আমাদের বাড়িতে বার দুই এসেছিল। একটু কাঠ কাঠ টাইপ। আমার খুব একটা পছন্দ হত না। পরে নেভাডায় না কোথায় একটা লাইব্রেরিতে চাকরি পেয়ে চলে যায়।

“সেদিনই জানতে পারলাম লুসি-র অপঘাতে মৃত্যুর কথা। যারা এসেছিল তাদের কাছ থেকে এর বেশি আমি কিছু জানতে পারলাম না। তবে আমার এক পরিচিত ছিল পুলিশ ফোর্সে। তার কাছ থেকে পরে জানলাম, শুধু লুসি নয়, ওর সঙ্গে আরও একজন লোক আগুনে পুড়ে মারা গেছে। ধরে নিলাম যে লোকটা লুসির সঙ্গে থাকত সে-ই। আমাকে ছাড়া লুসির পরিবারের কাউকেই ওরা খুঁজে পায়নি। একজন বন্ধুর রেফারেন্স ওর বাড়িওয়ালা দিয়েছিল, কিন্তু তার সঙ্গেও পুলিশ যোগাযোগ করতে পারছে না। যেখানে সে কাজ করত, সেখানেও সে আর আসছে না। মোটামুটি ডেড এন্ড। এরকম শুনেছি অনেক সময়েই হয়। আর এই হল আমাদের দু-জনের জীবনকাহিনি।” মিস্টার র‍্যান্ডো চুপ করলেন।

“থ্যাংক ইউ স্যার। এখন দুয়েকটা প্রশ্ন করি?”

“করুন।’

“মিস্টার মেল-এর প্রথম ইমেল-এ আপনার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল ম্যাডাম লুসির ঠাকুরদার খাতা চুরি করার। যে-খাতাগুলো আপনি দেখছেন বললেন, সেগুলো কীসের খাতা?”

“সত্যি কথা বলতে কী, ভালো করে দেখিনি। হাতে লেখা কাটাকুটি করা পাতার পর পাতা। আত্মজীবনী হতে পারে, গল্প-কাহিনি বা রম্যরচনাও হতে পারে… যদ্দূর মনে পড়ে বাক্সে মাত্র দুটো খাতাই ছিল। খাতা দুটোর মলাট আর কয়েকটা পাতা ছেঁড়া… ওর ঠাকুরদার খাতা… বুড়ো বয়সে অনেকেরই এরকম লেখালেখির শখ চাপে।”

“ঠিক স্যার, আমার দাদুও শ্যামাসংগীত লিখতেন— পাতার পর পাতা।”

র‍্যান্ডো সাহেব বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “সেটা আবার কী?”

“স্পেশাল প্রেয়ার টু গডেস কালী স্যার। ও কথা থাক, খাতা দুটো ছাড়া আর কি কিছু সেখানে ছিল? চিঠিপত্র বা অন্য কিছু?”

মাথা নাড়লেন র‍্যান্ডো সাহেব, “আর কিছু ছিল বলে তো মনে করতে পারছি না। পুরো বাক্সটা নিউ ইয়র্কেই ফেলে এসেছি। আমাদের কোনো ছেলেপুলে নেই, লুসিও বেঁচে নেই—কেন যে ওগুলো বাড়িতে এখনও রয়ে গেছে নিজেই জানি না।”

একেনবাবুর মুখ দেখে আমি আঁচ করতে পারছিলাম, উনি ক্লু-লেস। সেটা স্বীকারও করলেন, “যে-খাতাগুলো চুরি করার অপবাদ ইমেল-এ দেওয়া হয়েছিল, তার ইম্পর্টেন্স কিন্তু আমার মাথায় ঢুকছে না! ম্যাডাম লুসি কি শুধু সেন্টিমেন্টাল কারণে ওগুলো রেখেছিলেন, না অন্য কোনো কারণে? কোনো গুপ্তধনের রেফারেন্স বা ওই ধরনের কিছু কি ওতে ছিল? কিন্তু যদি থেকেও থাকে, সেই খবরটা মিস্টার মেল জানবেন কী করে?” শেষের প্রশ্নটা একটু বিড়বিড় করে যেন নিজেকেই করলেন। তারপর বললেন, “এবার একটা অবান্তর প্রশ্ন স্যার, আপনি বললেন আপনার স্ত্রী আগুনে পুড়ে মারা গিয়েছিলেন। ধরে নিচ্ছি ওটা অ্যাক্সিডেন্ট?”

“তাই তো জানি। ওর অ্যাপার্টমেন্ট ছিল নেভাডার বোল্ডার সিটি-তে, আর আমি ক্যালিফোর্নিয়ায়— ধারে-কাছে ছিলাম না।

“তাহলে স্যার, আপনি ম্যাডাম লুসির হত্যাকারী-ইমেল-এর এই অভিযোগে এত ভয় পাচ্ছেন কেন?”

“আসলে, আসলে…” মিস্টার র‍্যান্ডো একটু কিন্তু কিন্তু করলেন। “লুসি আমাকে ছেড়ে চলে যাবার কিছুদিন আগে আমি একটা স্ক্রিপ্ট লিখেছিলাম… স্ক্রিপ্টে এক ট্রাক-ড্রাইভার কাজের জন্য দিনের পর দিন বাড়ির বাইরে থাকত, আর ওর স্ত্রী সেই সময়ে হাজবেন্ডেরই এক বন্ধুর সঙ্গে রাত কাটাত। এ নিয়ে লোকটার মনে সন্দেহ ছিল, কিন্তু সে নিয়ে কথা উঠলেই, স্ত্রী শুধু অস্বীকার করত না, হাজবেন্ডকে নোংরা মনের লোক বলে অপমান করত! একবার, যেদিন ফেরার কথা তার আগে গভীর রাতে বাড়ির ড্রাইভওয়েতে সেই বন্ধুর গাড়ি দেখে মেয়েটির হাজবেন্ড নিজেকে সামলাতে পারল না, বাড়িতে আগুন জ্বালিয়ে দিল। ওই স্ক্রিপ্ট থেকে মুভি হবার কথা হচ্ছিল।”

“কিন্তু স্যার, যেদিন আগুন লেগেছিল আপনি তো বাড়ির ধারে-কাছে ছিলেন না!”

“একটা অ্যালিবাই আমার স্ক্রিপ্টেও ছিল।”

“বুঝলাম স্যার।”

একেনবাবু আর কিছু বলার আগে, মিস্টার র‍্যান্ডো বললেন, “আমার কী মনে হচ্ছে জানেন, কেউ আমাকে ভয় দেখিয়ে ব্ল্যাকমেল করার চেষ্টা করছে।”

“এটা স্যার, আমার মাথায়ও ঘুরছে। তার মানে এই মিস্টার মেল জানেন, আপনি অনেক টাকার মালিক।”

“হতেই হবে, নইলে ব্ল্যাকমেল করতে চাইবে কেন?”

“ঠিক স্যার। আচ্ছা, আপনি তো হলিউডে অনেকদিন খুব স্ট্রাগল করেছিলেন, কিন্তু হলিউডে আপনার ভাগ্য খোলেনি। খুলেছিল পরে— তাই না?”

“হ্যাঁ, হলিউডে কিছুই হচ্ছিল না। লুসি আমাকে ছেড়ে চলে যাবার পর দু- বছর যেতে-না-যেতেই মারা গেল। তারপর আরও অনেক বছর হলিউডে ছিলাম। একে-তাকে আমার স্ক্রিপ্ট আইডিয়া গছানোর চেষ্টা করে যাচ্ছিলাম। একজন তো সেটা নিয়ে নিজের নামে একটা প্রোডাকশন হাউসে বেচে দিল। কিছুই করতে পারলাম না। তখনই মনে হয় আপনার সঙ্গে আমার পরিচয়।”

“হ্যাঁ স্যার, আমার মনে আছে।”

“যাইহোক, যখন স্ক্রিপ্ট রাইটার হবার ইচ্ছে প্রায় ছেড়ে দিচ্ছি, জানতে পারলাম এক দূর সম্পর্কের আঙ্কল অজস্র টাকা রেখে ক্যানাডাতে অটো-অ্যাক্সিডেন্টে মারা গেছেন। সেই আঙ্কল ছিলেন মায়ের কাজিন। মাকে খুব পছন্দ করতেন, সেই সূত্রে আমাকেও। উইলে ওঁর সম্পত্তি মাকে, মায়ের অবর্তমানে আমাকে দিয়ে গিয়েছেন! ব্যাপারটা আমি জানতাম না। ওঁর উকিলই খুঁজেপেতে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেন। আর আমিও রাতারাতি মাল্টি-মিলিয়নিয়ার হয়ে যাই। আপনার সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল তার কিছুদিন পরে লং আইল্যান্ডে, স্টুয়ার্টও ছিল আপনার সঙ্গে। মনে আছে?”

“আছে স্যার। কিন্তু এই ইতিহাসটা জানতাম না।”

“হ্যাঁ, হলিউড থেকে আমি কিছু পাইনি। কিন্তু আঙ্কলের কাছ থেকে যা পেয়েছিলাম, হলিউডে চার-পাঁচটা ব্লক-বাস্টার মুভির স্ক্রিপ্ট বেচেও তা পেতাম না।”

“বুঝলাম স্যার। কিন্তু এখন আমাকে কী কাজ করতে বলছেন?”

“আমি চাই আপনি এই মেল লোকটাকে খুঁজে বার করুন। হঠাৎ কেন এভাবে যোগাযোগ করার চেষ্টা করছে এবং আমার শান্তিতে বিঘ্ন ঘটাচ্ছে? মনে হচ্ছে এর হাতে আমার আর লুসির কিছু ব্যক্তিগত জিনিস আছে, যা দিয়ে আমার রেপুটেশন স্পয়েল করে ব্ল্যাকমেল করার চেষ্টা করবে।”

“দাঁড়ান স্যার, দাঁড়ান। এমন কী জিনিস এঁর কাছে থাকতে পারে যার জন্য আপনি এত দুশ্চিন্তা করছেন!”

মিস্টার র‍্যান্ডো কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। “আমার দুশ্চিন্তার কারণ আপনাকে বলতেই হবে, নইলে আপনি ব্যাপারটা ঠিক বুঝবেন না। কম বয়সে আমরা সবাই নানান অপরাধ করি, যার গুরুত্ব বোঝার ক্ষমতা তখন থাকে না। পরে যখন বোধবুদ্ধি হয়, তখন সতর্ক হই। কলেজে ঢুকে প্রথম দিকে অনেক ওয়াইল্ড পার্টি করেছি, যে-সব মেয়েরা তাতে আসত, তাদের কেউ কেউ কলেজেও পড়ত না, আশেপাশের হাইস্কুলের— চোদ্দো-পনেরো বছরের অর্থাৎ অপ্রাপ্তবয়স্ক, মাইনর। তাদের সঙ্গে নানানভাবে সেক্স করতাম… বুঝতে পারছেন কী বলছি?”

একেনবাবু তাড়াতাড়ি বলে উঠলেন, “ঠিক আছে, ঠিক আছে স্যার, বুঝতে পারছি।”

“আমাদের বন্ধু টোনি কাজ করত একটা ফোটো স্টুডিও-তে। সে ছবি তুলত। আর লুকিয়ে লুকিয়ে রাত্রি বেলায় দোকানে গিয়ে ছবিগুলো ডেভলপ করে নিয়ে আসত। ছবিগুলো থাকত আমার জিম্মায়। পার্টিতে ড্রিঙ্ক করতে করতে সেগুলো দেখে ফূর্তি করতাম, আর নতুন মেয়েদের ড্রিঙ্ক করিয়ে সেগুলো দেখিয়ে তাদের লজ্জা ভাঙাতাম। কিছুদিন বাদে পার্টি করার দলটা ভেঙে গেল, কিন্তু একটা খামে সেই ছবিগুলো আমার কাছে রয়ে গিয়েছিল। লুসি সেই খামটা একদিন আবিষ্কার করে। একজন কমবয়সি মেয়েকে ও চিনত। লুসি যখন চলে যায়, খামশুদ্ধ ছবিগুলো নিয়ে গিয়েছিল। আমি নিশ্চিত ছিলাম ওটা ছিল পরে আমাকে ঘায়েল করার মারণাস্ত্র।’

“মারণাস্ত্র কেন?” ফস করে আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল।

“কারণ সেক্সুয়াল অ্যাবিউজ অফ চিলড্রেন ইজ অ্যান ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইম, যার কোনো স্ট্যাচ্যুট অফ লিমিটেশন নেই।”

এতক্ষণে বুঝলাম র‍্যান্ডো সাহেবের দুর্ভাবনার কারণ এবং কেন খুঁজে বের করার চেষ্টা করছেন কে ইমেল পাঠাচ্ছে। কিন্তু লোকটাকে খুঁজে পেলে কী করবেন, সেটাই ভাবছিলাম।

একেনবাবু একটু চুপ করে থেকে বললেন, “সবগুলোই কি স্যার একই ইমেল অ্যাড্রেস থেকেই এসেছে?”

“হ্যাঁ।”

“আপনি কি কোনো উত্তর দিয়েছেন?”

“না।”

“আমি অবশ্য ইমেল-টিমেল-এর ব্যাপার ভালো বুঝি না… যাইহোক, ইমেল- এর একটা কপি আমাকে দিন।

র‍্যান্ডো সাহেব বিছানার পাশে সাইড টেবিল-এর ড্রয়ার থেকে একটা কাগজ বার করে দিলেন। আমার মাথায় অবশ্য ঢুকল না ইমেল-এর কপি নিয়ে একেনবাবু কী করবেন! ইমেল অ্যাড্রেস থেকে ফেসবুক সার্চ করে অনেক সময় নাম খুঁজে পাওয়া যায়, অবশ্য যদি ওই নামের কেউ ফেসবুকে থাকে। অনেক সময় একই নামের একাধিক লোক ফেসবুকে থাকে। অর্থাৎ, ফেসবুকে নামটা পেলেও নিশ্চিতভাবে পরিচয় জানার উপায় নেই। তার ওপর অনেকের প্রোফাইল আবার লক্ড থাকে। সেখান থেকে কিছুই উদ্ধার করা যায় না। ফেসবুকে না থাকলে নামটাও জানা যাবে না। কোন আইপি অ্যাড্রেস থেকে ইমেলটা এসেছে সেটা অবশ্য র‍্যান্ডো সাহেবের কম্পিউটার থেকে বার করা যায়। পৃথিবীর কোন অঞ্চল থেকে এসেছে, সেটাও বোঝা যায়। কিন্তু কেউ যদি ভার্চুয়াল প্রাইভেট নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে, সেখানেও সুবিধা হবে না। মনে হবে আসছে মুম্বই থেকে, কিন্তু আসলে আসছে নিউ ইয়র্ক থেকে। আমার টেকনোলজি জ্ঞান এখানেই খতম। পুলিশের সাইবার ক্রাইম এক্সপার্টরা র‍্যান্ডো সাহেবের ল্যাপটপ পেলে সেখান থেকে নিশ্চয় অনেক কিছুই উদ্ধার করতে পারত। কিন্তু সেসব তথ্য ইমেলের প্রিন্ট আউট থেকে পাওয়া অসম্ভব! তবে পুলিশের কাছে তো র‍্যান্ডো সাহেব যেতে চান না ঝামেলায় পড়বেন বলে! আমার মন বলছিল এসব ঝুটঝামেলার মধ্যে একেনবাবুরও জড়ানো অনুচিত। একেনবাবুকে কিন্তু বিশেষ উদ্‌বিগ্ন মনে হল না। এক বার চোখ বুলিয়ে কাগজটা পকেটে পুরলেন।

“একটা কথা স্যার, আপনার কি মনে হচ্ছে যিনি এই ইমেলগুলো পাঠিয়েছেন, তিনি এখন ইন্ডিয়াতে আছেন?”

“কেন বলুন তো?” র‍্যান্ডো সাহেব চমকে প্রশ্নটা করলেন!

একেনবাবু তাড়াতাড়ি বলে উঠলেন, “না না স্যার, প্রশ্নটা এমনিই করলাম।”

ওঁর এই চমকানি আমাদের দৃষ্টি এড়ায়নি বুঝেই র‍্যান্ডো সাহেব একটু চুপ করে থেকে বললেন, “কেন একটু চমকালাম জানেন, আসলে আপনার প্রশ্নে মনে পড়ল দিন পনেরো আগে নীচে আমার বুটিক-এ একজন মহিলা এসেছিল আমার সঙ্গে দেখা করতে। আমার বুটিক আর অর্গানিক ফার্মে বহু লোক কাজ করে, তারা সমীরকেই চেনে, আমাকে নয়। লোকজন থেকে আমি একটু দূরেই থাকি। সমীরের কাছ থেকে পরে জানতে পারি, যে-মহিলা আমার খোঁজ করছিল, সে আমার সম্পর্কে অনেক খবর রাখে। আমি যে স্ক্রিপ্ট লিখতাম, একসময় ক্যালিফোর্নিয়াতে ছিলাম, ইত্যাদি, ইত্যাদি। এর মধ্যে একদিন ঘরে ঢুকে দেখি আমার আলমারির পাল্লা খোলা। আমি সবসময় পাল্লা দুটো বন্ধ করে রাখি। আমার ব্যাঙ্কের পাসবই, হিসেবের কাগজপত্র সব আলমারিতে থাকে। এমনিতে এই জায়গাটা খুবই সেফ এবং সিকিওর, আর এ দুটো ব্যাপার হয়তো আনরিলেটেডও। তবে এত বছর বাদে লুসিকে নিয়ে ইমেল পাওয়া, আর এই মহিলার আমার খোঁজে আসা…..”

“ভেরি ইন্টারেস্টিং স্যার। ভদ্রমহিলা কি হোয়াইট লেডি?”

“হ্যাঁ।”

“এর পরে তিনি আর আসেননি বা যোগাযোগের চেষ্টা করেননি?”

“না। আর সেটা নিয়েও আমার বেশ অস্বস্তি। হঠাৎ করে এরকম একটা অখ্যাত-অজ্ঞাত জায়গায় এসে আমার খোঁজ করা!”

“একটা কথা স্যার, আপনি যে এখানে থাকেন, আপনার পুরোনো পরিচিতদের মধ্যে কেউ কি সেটা জানেন না?”

“আমার উকিল আর বিশেষ পরিচিত কয়েক জন শুধু জানে!”

“বিশেষ পরিচিত বলতে স্যার?”

“যেমন স্টুয়ার্ট আর আমার হলিউডের এজেন্ট। কিন্তু ওরা শুধু জানে আমি ইন্ডিয়াতে থাকি।”

“তাহলে এত অবাক হচ্ছেন কেন স্যার, হয়তো তাঁদেরই চেনাজানা কেউ এসে খোঁজ করছিলেন।”

“মনে হয় না, কারণ আমি স্ক্রিপ্ট লিখতাম ছদ্মনামে। আমার হলিউডের এজেন্ট আর আমার স্ত্রী ছাড়া কাউকেই সেটা জানাইনি। স্বপ্ন ছিল কোনোদিন অস্কার পেলে সবাইকে সারপ্রাইজ দেব। এই মহিলা এখানে এসে সেই ছদ্মনামে আমার খোঁজ করছিল।”

কথাগুলো শুনতে শুনতে আমার মনে পড়ল সেই সাদা মহিলাকে, যিনি খুব মন দিয়ে রেস্টুরেন্টে আমাদের কথা শুনছিলেন। খটকা লেগেছিল, কিন্তু ভালো করে দেখিনি।

“খুবই কনফিউজিং স্যার!” একেনবাবু মাথা চুলকোলেন।

এরপর আরও কয়েকটা কথা হল, আমি সেগুলো আর লিখে রাখিনি। একেনবাবু দেখলাম একদৃষ্টিতে র‍্যান্ডো সাহেবের খাটের নীচে তাকিয়ে আছেন। হঠাৎ মিস্টার র‍্যান্ডোকে জিজ্ঞেস করলেন, “আপনি শেষ কবে নিউ ইয়র্কে গিয়েছিলেন স্যার?”

প্রশ্নের আকস্মিকতায় মিস্টার র‍্যান্ডো অবাক হলেন, “আমি?”

“হ্যাঁ, স্যার, আপনি!”

“এমনিতে বছরে বার দুই যাই। শেষ বার গেছি তিন মাস আগে। ব্যাঙ্কের একটা কাজে হঠাৎ করেই আমাকে দিন কয়েকের জন্য যেতে হয়েছিল। কেন বলুন তো?”

“জানতে চাচ্ছিলাম ইমেলগুলো খোলার আগে না পরে?”

“আগে। ফিরে এসেই প্রথম ইমেলটা খুলি, আর তার পরের দিনই তো দ্বিতীয় ইমেলটা এল! সেটাও খুব চিন্তায় ফেলেছে আমাকে। মনে হচ্ছে কেউ যেন বুঝতে পেরেছে কখন আমি ইমেল খুলছি!”

একেনবাবুও মনে হল কিছু একটা ভাবছেন। কিন্তু ইমেল খোলার এই ব্যাপারটা আমি জানি। অনেক ইমেল প্রোগ্রামেই ট্র্যাকিং থাকে। কখন কে ইমেল খুলছে বা ইমেল-এ দেওয়া লিংকে ক্লিক করছে, যে-লোক ইমেল পাঠাচ্ছে সে জানতে পারে। তাই যে-মুহূর্তে র‍্যান্ডো সাহেব প্রথম ইমেলের অ্যাটাচমেন্ট খুলেছেন, মেল নামে যে লোকটা ইমেল পাঠিয়েছে সে জেনে গেছে। আর জানা-মাত্র দ্বিতীয় ইমেলটা পাঠিয়েছে। এটা কোনো ম্যাজিক নয়। পরে একেনবাবুকে এটা বলে দিতে হবে।

“আর কিছু জানতে চান?” র‍্যান্ডো সাহেব জিজ্ঞেস করলেন।

“আপাতত স্যার এইটুকুই, দেখি কদ্দূর এগোতে পারি,” একেনবাবু বললেন। তারপর “দু-এক দিনের মধ্যে আবার আসব,” বলে র‍্যান্ডো সাহেবের কাছ থেকে বিদায় নিলেন।

.

নীচে সমীর, প্রমথ আর একেনবউদির বুটিক ঘুরে দেখা সবে শেষ হয়েছে। একেনবউদির হাতে একটা বড়ো প্যাকেট। একটা ছবি কিনেছেন। প্রমথও টুকিটাকি কিছু কিনেছে, নিশ্চয় ফ্র্যান্সিস্কার জন্যে। মেয়েটা হ্যান্ডিক্র্যাফট খুব পছন্দ করে। ওদের বাইরে দাঁড়াতে বলে আমিও এক বার ঢুঁ মারতে বুটিক-এ গেলাম, একেনবাবুও গুটিগুটি এলেন। টুকিটাকি অজস্র জিনিসে ভরতি। মোটেই সাজানো-গোছানো নয়। তার ওপর একদিকে প্রচুর মনিহারি জিনিস— তেল, ডাল, ঢেঁকি-ছাঁটা চাল, চিঁড়ে, মুড়ির সঙ্গে নানান ধরনের ড্রাই ফ্রুট, আচার, বড়ি, আমসত্ত্ব, ইত্যাদি, যেগুলো খাবার জায়গার পাশের দোকানেও আছে দেখেছিলাম। অন্যদিকে ডাঁই করে আর্টস- ক্র্যাফটস-এর জঙ্গল! বেশ কিছু লোকাল আর্টিস্টদের আঁকা ছবি, কাঠ-খোদাই করা জন্তুজানোয়ার, বাঁশের কঞ্চির ল্যাম্পশেড, কাঁধে ঝোলানো ব্যাগ, ছোটোদের জামা, বড়োদের পাঞ্জাবি, টেবিল ক্লথ, বেড কভার–কী যে নেই সেখানে! তবে উদ্ধার করতে প্রচুর সময় লেগে যাবে। আরও সময় লাগবে জিনিসটার দাম আবিষ্কার করতে। প্রাইস-ট্যাগ বলতে কতগুলো সংখ্যা লেখা, যেগুলো আবার ভালো পড়া যায় না। মায়ের জন্য শ্রীনিকেতনি কাঠের কাজ করা হরিণ কিনব ভেবেছিলাম। কমবয়সি যে-মেয়েটি দোকান সামলাচ্ছে, সে কিছুই প্রায় জানে না। খাতা মিলিয়ে দাম বলতে হিমশিম খেল। প্রথমে বলল, ‘ছ-শো!’

ছ-শো দিয়ে কখনোই ওটা কিনব না। সেটা বুঝতে পেরেই বোধহয় বলল, “না, না, দু-শো। ভুল নম্বর দেখছিলাম!”

আরেকটা ব্যাপার, বেশ কিছু হাবিজাবি বিদেশি জিনিস চোখে পড়ল ‘মেড ইন চায়না,’ ‘মেড ইন মেক্সিকো,’ ‘মেড ইন ইটালি,’ ইত্যাদি। কোয়ালিটি খুবই বাজে, মার্কিন মুলুকে বিক্রি হবে না। প্রথমে একটু অবাক হয়েছিলাম। তারপর ভেবে দেখলাম এখানকার লোকাল ক্রেতাদের কাছে এগুলোর একটা আলাদা মূল্য আছে। একেনবাবু কিছু কিনলেন না, কিন্তু নেড়েচেড়ে অনেক কিছু দেখলেন।

ফেরার পথে গাড়িতে উঠতে উঠতে সমীরের সঙ্গে একটু গল্প হল। এই অর্গানিক ফার্ম-হাউস আর বুটিক শপ সম্বন্ধে জ্ঞান বাড়ল। সমীরের মতে এটা হল বীরভূমের স্থানীয় দরিদ্র মেয়েদের স্বাবলম্বী করে তোলার জন্য র‍্যান্ডো সাহেবের স্কিম। এটা চলে কো-অপারেটিভ হিসেবে, কিন্তু পেছনে টাকা জোগান র‍্যান্ডো সাহেব। তার মানে? সমীর বুঝিয়ে বলল, প্রায় শ’দুয়েক মেম্বার আছে কো-অপারেটিভের। তারা প্রত্যেকে দিনে প্রায় এক হাজার টাকা করে পায়। কিন্তু তার মধ্যে থেকে রাখতে পারে দু-শো টাকা, বাদবাকি জমা করতে হয় কো-অপারেটিভের অ্যাকাউন্টে। যাতে কো-অপারেটিভ বড়ো হয়ে ওঠে, পরে আরও নানান জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে। বিদেশি মালপত্রগুলো আসে ওই টাকায়। মেয়েরা সবাই খুশি। এই অঞ্চলে মাসে ছ’হাজার টাকা এভাবে রোজগার করা সহজ ব্যাপার নয়।

“দাঁড়ান স্যার, দাঁড়ান। বুটিক, জমিজমা, মুর্গি, ছাগল— সবই তো দেখলাম। কিন্তু এত টাকা ইনকাম হয় কোত্থেকে?”

“ওই যে বললাম, ওটা হল স্যারের দান, বলতে পারেন সমাজসেবা। এইভাবেই ভেদিয়াতে শুরু করেছিলেন কো-অপারেটিভ, এখন এখানে। আরেকটা চালু করছেন রামপুরহাটের কাছে একটা গ্রামে। দারুণ না?”

“একদম, ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো। ভগবান ওঁকে মাল্টি-বিলিয়নিয়ার করুন, আপনাদের বীরভূম তাহলে পালটে যাবে। কী বলেন একেনবাবু?”

প্রমথর শেষটা সমীর ধরতে পারল না। বলল, “আমরাও তাই ভাবি।”

।। ৬।।

পরের দিন সকালে একেনবউদিকে নিয়ে শান্তিনিকেতন ঘুরতে বেরোচ্ছি, একেনবাবু দেখি গভীর চিন্তায় মগ্ন।

“আপনারা যান স্যার, আমার এখন বেরোতে ইচ্ছে করছে না।”

“কী ব্যাপার একেনবাবু, আপনাকে রহস্য-কাবু মনে হচ্ছে?” প্রমথ জিজ্ঞেস করল।

“আরে না, স্যার।”

“শুনুন, ভেবে ভেবে সময় নষ্ট করবেন না,” প্রমথ বলল, “আমি যা বুঝছি- পুরো ব্যাপারটাই হচ্ছে খ্যাপামি, র‍্যান্ডো লোকটা ভুগছে প্যারানয়াতে। কোত্থেকে দু-একটা উড়ো ইমেল এসেছে। তার ভয়ে হাজার হাজার ডলার গ্যাঁটগচ্চা দিয়ে আপনাকে লাগিয়েছে রহস্য উদ্ঘাটন করতে! টোটাল ননসেন্স!”

“শুধু একেনবাবুকে দোষ দিচ্ছিস কেন, এখানেও তো লক্ষ লক্ষ টাকা খরচা করছেন। সেখানেও তো রহস্য নেই।” তারপর একেনবাবুকে বললাম, “একা একা সারাদিন বাড়িতে বসে থাকবেন! আমরা কিন্তু লাঞ্চ খেয়ে একেবারে বিকেল বেলায় আসব।”

“তাহলে তো ভালোই হল স্যার, আমাকেও বোলপুরে একজনের সঙ্গে লাঞ্চ খেতে হবে, তা ছাড়া কয়েক জনের সঙ্গে দেখাও করতে হবে।”

জিজ্ঞেস করলাম, “হঠাৎ? কাদের সঙ্গে?”

প্রমথ বলল, “সেটা কি আর আমাদের বলবেন? ঝেড়ে তো কাশেন না!”

“কী যে বলেন স্যার!”

.

পুরো দিনটা এদিক-ওদিক বউদিকে নিয়ে ঘুরলাম। আমি বউদিকে নিয়ে যখন ‘সুবর্ণরেখা’ বইয়ের দোকানটা দেখছি, প্রমথ চট করে গিয়ে রেলের রিজার্ভেশনটা করে এল। জানতাম না যে, কাছেই ইস্টার্ন রেলের রিজার্ভেশন কাউন্টার। তারপর সবাই মিলে চীনা ভবন, ডিয়ার পার্ক, উপাসনাগৃহ, প্রকৃতি ভবন, সোনাঝুরি ফরেস্ট, রবীন্দ্র ভবন, আমার কুটির, ছাতিম তলা… বলতে গেলে একটা ঝটিকা সফর।

প্রমথ জায়গাগুলো ভালো করে চেনে। ওই আমাদের গাইড। সবচেয়ে সময় লাগল মিউজিয়ামটা ঘুরে ঘুরে দেখতে। বাঁচা গেছে একেনবাবু নেই, থাকলে ওঁর বকবকানি আর উলটোপালটা প্রশ্নে প্রমথ খেপে যেত। ভালো করে কিছুই দেখা হত না। মধ্যে রতনপল্লীর একটা রেস্টুরেন্টে লাঞ্চ খেয়ে নিলাম। সেখানেই দেখা হল আবার সেই মেমসাহেবের সঙ্গে যিনি প্রথম দিন আমাদের দিকে বার বার তাকাচ্ছিলেন। প্রমথর চোখেই সেটা পড়েছিল। আজকে উনি একটা জিন্স আর টপ পরেছেন। টপটা নিশ্চয় শান্তিনিকেতনের কোনো দোকান থেকে কেনা। কাঁথা-স্টিচ করা। আজকে আর লুকিয়ে লুকিয়ে আমাদের দেখা নয়, সোজা একেনবউদির কাছে এসে বললেন, “আমার নাম হেলেন। এত অ্যাট্রাক্টিভ কাঁথা স্টিচের কাজ এখানে কোথাও দেখিনি। এর আগেও আপনাকে একটা রেস্টুরেন্টে দেখেছি তখন জিজ্ঞেস করব করব করেও জিজ্ঞেস করিনি, আপনার এই স্কার্ফ কোত্থেকে কিনেছেন?”

একেনবউদিকে আগে ইংরেজি বলতে শুনিনি, কিন্তু দেখলাম একেনবাবুর থেকে ভালো বলেন। হেলেনের প্রশ্নের উত্তর সপ্রতিভভাবেই দিলেন, “আমি তো জায়গাটা কোথায় বলতে পারব না, এঁরা জানেন,” বলে আমাদের দেখালেন।

যে-স্কার্ফটির কথা হেলেন জিজ্ঞেস করছেন, সেটা আমরাই আগের বার শান্তিনিকেতনে এসে কিনেছিলাম। প্রমথ ফ্র্যান্সিস্কার জন্য গিফট খুঁজছে শুনে প্রমথ মাসি কলাভবনের এক প্রাক্তন ছাত্রের কথা আমাদের বলেছিলেন। ভদ্রলোকের একটা বুটিক শপ আছে জামবুনিতে। সেখানে শ্রীনিকেতনি চামড়ার ব্যাগ, শান্তিনিকেতনি বাটিকের কাজ আর লোকাল সাঁওতালি শিল্পীদের এমব্রয়ডারি করা কামিজ, স্কার্ফ, চাদর ইত্যাদি মেলে। বাইরের মার্কেটে যা পাওয়া যায়, তার থেকে অনেক ভালো কোয়ালিটির। প্রমথর সঙ্গে আমিও বেভের জন্য গোটা দুই স্কার্ফ কিনেছিলাম। সেটা দেখে একেনবাবু আমাদের ধরেছিলেন, “আমার জন্যেও একটা কিছু বেছে দিন না স্যার, ফ্যামিলিকে দেব।

প্রমথ বলল, “কেন মশাই নিজে বাছতে পারেন না! বউদিকে উপহার দিয়ে বাহাবা কুড়োবেন তো আপনি!”

“কী যে বলেন স্যার! আপনারা তো জানেন এসব সূক্ষ্ম ব্যাপারগুলো আমি একেবারেই বুঝি না।”

“ঠিক আছে আমরা বেছে দেব, কিন্তু এর জন্য নিজে আপনি ক্রেডিট নেবেন না!”

“না না স্যার, আপনাদের সাহায্যের কথা তো আমি সবসময় ফ্যামিলিকে বলি।”

আমি আর প্রমথ তখন তিনটে কাঁথা-স্টিচ স্কার্ফ বেছেছিলাম বউদির জন্য- সবগুলোতেই সাঁওতালি মোটিফ—- নানান জিগজ্যাগ প্যাটার্নের।

“একেবারে তিন-তিনটে নিতে হবে স্যার!”

“কসি করবেন না তো! দিচ্ছেন তো নিজের ফ্যামিলিকে!” প্ৰমথ ধমক দিয়েছিল।

বউদি স্কার্ফগুলো পেয়ে এত খুশি হয়েছিলেন যে, এবার এসেই আমাদের সঙ্গে সেখানে গিয়েছেন। আরও কয়েকটা স্কার্ফ কিনেছেন কয়েক জনকে উপহার দেবেন বলে।

আমি হেলেনকে বললাম, “এটা কেনা হয়েছিল জামবুনির একটা দোকান থেকে, কিন্তু ঠিক এইরকম স্কার্ফ আর পাওয়া যাবে কিনা জানি না। হাতের কাজ তো! এক-একটা এক এক রকম ডিজাইনের হয়।”

“বুঝেছি, ডিজাইনার স্কার্ফ। তাও ঠিকানাটা দিন।”

“ঠিকানাটা তো বলতে পারব না, ডিরেকশনটা দিতে পারি।”

.

হেলেনের খাওয়া হয়ে গিয়েছিল। আমাদের টেবিলে এসে বসলেন। আমি রেস্টুরেন্ট ম্যানেজারের কাছ থেকে একটা কাগজ জোগাড় করে একটা স্কেচ করে দেখালাম। শান্তিনিকেতন-শ্রীনিকেতন রোড ধরে বড়ো রাস্তার মোড়ে বাঁ-দিকে গেলেই বোলপুর বাস স্ট্যান্ড। সেখানে শক্তি-বুটিকের খোঁজ করলেই লোকে বলে দেবে জায়গাটা।

হেলেন সেটা যত্ন করে ব্যাগে ঢোকানোর পর কিছুক্ষণ গল্প হল। বয়সে আমাদের থেকে বেশ একটু বড়োই হবেন— বস্টনে থাকেন, কিন্তু ইন্ডিয়ার প্রেমে পড়েছেন। বছরের অনেকটা সময় পন্ডিচেরিতে কাটান।

আমরা নিউ ইয়র্ক ইউনিভার্সিটিতে কাজ করি শুনে খুব খুশি হলেন। বললেন, “আমি মাঝে মাঝেই নিউ ইয়র্কে যাই। আমার ছেলেবেলার বান্ধবী আপনাদের ইউনিভার্সিটিতেই কাজ করে!”

“তাই নাকি? কোন ডিপার্টমেন্টে?”

“অ্যানথ্রপলজি”

নিউ ইয়র্ক ইউনিভার্সিটির ডিপার্টমেন্টগুলো এক-একটা এক এক জায়গায়, তবে কাছাকাছি। অ্যানথ্রপলজি ডিপার্টমেন্ট প্রমথর কেমিস্ট্রি ডিপার্টমেন্টের খুবই কাছে। প্রমথ জিজ্ঞেস করল, “আপনি কী করেন?”

“ফরেন্সিক হ্যান্ডরাইটিং অ্যানালিসিস।”

প্রমথ তো সবজান্তা, বলল, “ও, গ্রাফোলজিস্ট?”

“না, না, আমরা ফরেন্সিক ডকুমেন্ট এক্সামিনার। গ্রাফোলজিস্টরা লেখা দেখে লেখকের পার্সোনালিটি ট্রেইট বলতে পারে, আমাদের কাজ দুটো লেখা দেখে একই লোকের লেখা কিনা বলা।”

“আচ্ছা! এখন ছুটিতে?”

হেলেন হাসলেন। “কাজ এবং ছুটি। কাজ প্রায় শেষ, রিপোর্ট জমা দিলেই পুরো ছুটি।”

কী কাজে এসেছেন আর জিজ্ঞেস করা হল না। বলতে চাইলে নিশ্চয় বলতেন। বেশিক্ষণ গল্পও করা গেল না। হেলেনের কোথাও যাবার কথা ছিল। আমাদের ওঁর কার্ড দিলেন। আমরাও আমাদের নম্বর দিলাম। আমি বললাম, “দেশে ফিরে আমাদের ইউনিভার্সিটিতে কখনো এলে হয়তো দেখাও হয়ে যাবে।”

এগুলো কথার কথা। হেলেন হাসলেন, একেনবউদিকে অনেক ধন্যবাদ দিয়ে জামবুনি ছুটলেন স্কার্ফ কিনতে।

.

বিকেল বেলায় ফিরে দেখি একেনবাবু খুব সিরিয়াস মুখ করে চেয়ারে বসে পা নাচাচ্ছেন। ইন্টারেস্টিং সাইন।

“কী ব্যাপার, কী হল আজকে?”

“খুবই ইন্টারেস্টিং ব্যাপার স্যার। মিস্টার র‍্যান্ডোকে নিয়ে আমাদের আর দুর্ভাবনা করতে হবে না।”

“তার মানে?”

“ভদ্রলোক একটা হাওলা-চক্রে জড়িত থাকার জন্য সকালেই অ্যারেস্ট হয়েছেন।”

“বলেন কী, আপনি জানলেন কী করে?”

“ইন্ডিয়ার এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট আর মার্কিন মুলুকের ডিপার্টমেন্ট অফ ট্রেজারি এই ব্যাপারে হাতে হাত মিলিয়ে কাজ করছিল।”

“দাঁড়ান, দাঁড়ান, ইন্ডিয়ার হাওলা-চক্রের সঙ্গে মার্কিন মুলুকের সম্পর্ক কী?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।

“একটু কমপ্লিকেটেড স্যার। মার্কিন মুলুকে ট্রেজারি ডিপার্টমেন্টে টেররিজম আর ফাইনান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্সের একটা অফিস আছে।”

“বুঝলাম না, হাওলা-চক্রের সঙ্গে টেররিজম-এর সম্পর্ক কি?” প্রমথ প্ৰশ্ন তুলল।

“সন্ত্রাসবাদের অনেক টাকা আসে এইসব হাওলা স্কিম থেকে।”

“হাওলা স্কিমটা কী?” একেনবউদি জিজ্ঞেস করলেন।

‘হাওলা’ শব্দটার অর্থ আমার জানা ছিল। একজনকে সরাসরি টাকা না দিয়ে অন্য একজনের মারফতে টাকা দেওয়া। যখন ছাত্র ছিলাম স্টাইপেন্ডের টাকা থেকে বাঁচিয়ে মাঝেমধ্যে মাকে কিছু ডলার পাঠাতাম। ব্যাঙ্ক ফি আর বাজে এক্সচেঞ্জ রেট তার একটা বড়ো অংশ খেয়ে নিত! আর টাকা হাতে পেতে মায়ের সময়ও লাগত। সেটা জেনে আমার এক গুজরাতি বন্ধু বলেছিল, এরকম টাকা পাঠাবার দরকার হলে ওকে ক্যাশ ডলার দিতে, পরের দিনই ওর চেনাজানা একজন কলকাতায় মায়ের হাতে অনেক ভালো এক্সচেঞ্জ রেটে ক্যাশ টাকা দিয়ে দেবে। আমি অবশ্য সাহস পাইনি। পরে শুনেছিলাম ওটাই হচ্ছে হাওলা। সরকারের চোখের আড়ালে টাকার হাতবদল। কিন্তু হাওলা স্কিম ব্যাপারটা আমার জানা ছিল না।

“মানি লন্ডারিং স্কিম, মিনু। কালো টাকা সাদা করার কারবার।”

“তার মানে?” প্রশ্নটা শুধু বউদির নয়, আমার মাথাতেও এল। কালো টাকা সাদা করার কয়েকটা উপায়ের কথা শুনেছিলাম। যেমন, কালো টাকা বন্ধুকে ‘ধার’ দিয়ে সেই ধার শোধ করছে বলে তার কাছ থেকে ব্যাঙ্কের চেক নেওয়া; জমির দাম খাতায়-কলমে অনেক কম দেখিয়ে, আসল দামের বাকি অংশ কালো টাকায় দেওয়া (এতে দু-দিক থেকেই লাভ-কালো টাকা হাত থেকে বেরিয়ে যাবে, আবার বিক্রিতে রেজিস্ট্রেশন ফি-ও কম দিতে হবে); ইত্যাদি। কিন্তু এখানে কী হচ্ছে? একেনবাবু ব্যাপারটা বউদিকে বুঝিয়ে বললেন।

“আসলে মিনু, প্রথম থেকেই আমার মাথায় একটা প্রশ্ন ছিল, র‍্যান্ডো সাহেব তো বিদেশি— এদেশে ফার্মল্যান্ড কিনছেন কী করে? বাপিবাবুও সেই একই প্রশ্ন তুলেছিলেন। লাকিলি এইসময় আমার এদেশের কানেকশনগুলো কাজে লাগল। বোলপুরের এসডিপিও রমেনের কাছ খবর পেলাম যে-জমিটাতে উনি আছেন সেটা ওঁর নয়, এক গুজরাতি ব্যবসায়ীর। এর আগে ভেদিয়াতে যে জমি ছিল, সেটাও ওই একই ব্যবসায়ীর। কো-অপারেটিভ কোম্পানি ‘অর্গানিক ফার্ম হাউস’ একটা ভুয়ো কোম্পানি, যার নামে ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট খোলা হয়েছে। অ্যাকাউন্টের সিগনেচার অথরিটি ওঁর। সেটা কী করে সম্ভব হয়েছে জানি না, কারণ রিজার্ভ ব্যাঙ্কের নানানরকম নিয়মকানুন আছে ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট খোলা আর ব্যবহার করা নিয়ে। করা হয়েছে সবই ভুয়ো ডকুমেন্ট আর অসৎ ব্যাঙ্ক ম্যানেজারদের সাহায্যে…”

“অবাক করলেন মশাই,” প্রমথ কথার মাঝেই বলে উঠল, “আপনি এত সব খবর এক দিনের মধ্যে পেয়ে গেলেন!”

“আরে না স্যার, আমি তো কিছু জানতামই না- আজকেই জানলাম। রমেনের কাছে জমি আর কোম্পানিটার কথা শুনলাম।”

“এই প্রমথ, তুই চুপ করবি? বউদির প্রশ্নের জবাবটা আগে ওঁকে দিতে দে! বলুন একেনবাবু, হাওলা স্কিমের কথা তো মাঝে মাঝেই শুনি, কিন্তু ব্যাপারটা একটু বুঝিয়ে বলুন?”

“পুরো ব্যাপারটা এখনও ভালো করে জানি না, কিন্তু কোনো সন্দেহ নেই এই অর্গানিক ফার্ম হাউস থেকে কালো টাকা সাদা করা হচ্ছে।”

“কী করে?” এবার আমিই প্রশ্নটা করলাম।

“ভেবে দেখুন স্যার, ওইরকম ছোট্ট বুটিক আর কয়েক একর জমি থেকে দু-শো জন মেয়েকে পার্ট-টাইম কাজের জন্য প্রতিদিন দু-শো টাকা করে মজুরি দেওয়া সম্ভব? সেটা যদি-বা মানা যায়, কিন্তু রোজগার তো শুধু দু-শো টাকা নয়, প্রত্যেকে পাচ্ছে এক হাজার টাকা ক্যাশ, তার থেকে জমা দিচ্ছে আটশো টাকা অর্গানিক ফার্ম হাউসের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে। অর্থাৎ প্রতি মাসে চব্বিশ হাজার টাকা জমা পড়ছে প্রত্যেকটি মেয়ের কাছ থেকে। দু-শো জন মেয়ে, তার মানে মাসে আটচল্লিশ লক্ষ টাকা আসছে এই কোম্পানিতে। বারো দিয়ে গুণ করলে বছরে প্রায় ছ’কোটি টাকা।”

“পাঁচ কোটি ছিয়াত্তর লক্ষ।” প্রমথ শুদ্ধ করে দিল।

“ওই হল স্যার, মোট কথা অনেক। এই ক্যাশগুলো সব কালো টাকা। এসেছিল অসৎ উপায়ে ড্রাগ বিক্রি করে, বেআইনি জুয়ো চক্র, বা চুরির জিনিস বিক্রি করে… ভগবান জানেন কোত্থেকে! ওগুলো সব সাদা হয়ে গেল। প্রশাসন মনে করছে মেয়ে কর্মীরা নিজেদের কোম্পানিতে টাকা জমা দিচ্ছে অল্প অল্প করে কিছু টাকা, তাতে তো কোনো অপরাধ নেই।

“এটা কী বললেন আপনি? কোম্পানিতে যে এত টাকা আসছে, সেগুলো খরচা হচ্ছে কোথায়? তার জন্য কোনো হিসেব দিতে হয় না?” আমি প্রশ্ন তুললাম। “আরে না স্যার, ওগুলো তো খাতায়-কলমে দেখানো হচ্ছে বিদেশি জিনিসপত্র কেনার জন্য খরচ হচ্ছে। নিশ্চয় কেম্যান আইল্যান্ড বা কোনো অফশোর ব্যাঙ্কের সাহায্য নিচ্ছে।”

“ওই কতগুলো মেড-ইন চায়না আর মেড ইন মেক্সিকো-র শস্তা মালের জন্য?”

“ওইখানেই তো ভুল করলেন স্যার। যেটা আপনি দেখছেন পঞ্চাশ টাকা, খাতায়-কলমে ওটা হল পঞ্চাশ হাজার টাকা। ধরতে যাচ্ছে কে? আর এদিক-ওদিক কিছু ঘুষের খরচ।”

“তুমি জানলে কী করে, এটাই ওরা করছে?” একেনবউদি জিজ্ঞেস করলেন।

“আমি শুধু একটা সম্ভাবনার কথা বলছি মিনু।”

“আপনি অত্যন্ত সিমপ্লিস্টিক ব্যাখ্যা দেবার চেষ্টা করছেন।” প্রমথ বলল, “এসব ব্যাপারে অনেক প্যাঁচঘোঁচ থাকে। এদেশেও সরকারকে ফাঁকি অত সহজে দেওয়া যায় না।”

“এটা ঠিক বলেছেন স্যার, আমিও পরিষ্কার বুঝিনি বলেই বোঝাতে পারলাম না। ব্যাপারটা নির্ঘাৎ আরও অনেক কমপ্লিকেটেড।”

“যেটা আন-কমপ্লিকেটেড সেটা হল আপনি কোনো কাজ না করে ফোকটে র‍্যান্ডো সাহেবের টাকায় ইন্ডিয়া বেড়িয়ে যাচ্ছেন!” প্রমথ খোঁচা দিল।

“আপনি না স্যার, সত্যি! কিন্তু র‍্যান্ডো সাহেবের কাজটা যে আমি করব না আপনি কেন সেটা ভাবছেন?”

“কীভাবে করবেন শুনি। আপনার ক্লায়েন্ট তো এখন জেলে?”

“সেটাই একটু মুশকিল হয়ে গেল স্যার, কিন্তু যিনি চিঠিগুলো র‍্যান্ডো সাহেবকে পাঠিয়েছিলেন তিনি তো জেলে নন।”

“আপনার মুণ্ডু!”

.

এরপর আমাদের মধ্যে এই নিয়ে আর কোনো আলোচনা হল না। একেনবাবু আমাকে আর প্রমথকে বেভ আর ফ্রান্সিস্কার কথা জিজ্ঞেস করে একটু মজা করার চেষ্টা করলেন। প্রমথই ওঁকে সামাল দিল। “আপনার যখন এত দুশ্চিন্তা, ফোন করে জেনে নিন না! এখন তো হোয়াটসঅ্যাপ আছে, একটা পয়সাও খরচা হবে না আপনার!

“কী যে বলেন স্যার, আপনাদের ফোন আর আমার ফোন— দুটো কি ম্যাডামদের কাছে এক হবে!”

এইসব আগড়ম-বাগড়ম কথাবার্তাই ডিনার পর্যন্ত চলল।

.

পরের দিন সকালটা বাড়ির বারান্দায় বসে কয়েক কাপ চা, আর রতনপল্লী থেকে আনা গরম গরম কচুরি খেয়ে দিব্যি কাটল। দুপুরে শান্তিনিকেতন এক্সপ্রেস ধরে কলকাতা ফিরব। তবে একেনবাবুর প্রবল দুশ্চিন্তা, গতকাল প্রমথ যে-রিজার্ভেশনটা করে এনেছে, সেখানে প্রমথর হাতের লেখা পড়তে না-পারায় একেনবাবুর বয়স সাতানব্বই বছর হয়ে গেছে! প্রমথকে চিনি, হয়তো বজ্জাতি করেই কীর্তিটা করেছে। কিন্তু মুখে-চোখে প্রচণ্ড আন্তরিকতা ফুটিয়ে প্রবোধ দিচ্ছে, “আহা, এত চিন্তা করছেন কেন, মাথায় একটু পাউডার দিয়ে চুলগুলো সাদা করে দেব!” তারপর একটু বকুনিও দিচ্ছে, “আর কীরকম গোয়েন্দা মশাই আপনি, ছদ্মবেশ ধরতে জানেন না!”

“আপনি না স্যার, সত্যি! ফ্যামিলির বয়স পঁয়ত্রিশ, আর আমাকে বানাচ্ছেন বুড়োহাবড়া!”

“এটা কী বলছেন, বৃদ্ধস্য তরুণী ভার্যা হয় না?”

.

এই সবের মধ্যেই আমাদের স্টেশনে যাবার সময় প্রায় এসে গেল। বাড়িতে করা খিচুড়ি, বেগুন আর ডিম ভাজা খেয়ে বেরোতে যাচ্ছি, এমন সময় শুকনো মুখে সমীর এল। সঙ্গে গাড়ি নেই, সাইকেলে এসেছে। ওর কাছে শুনলাম, পুলিশ এসে র‍্যান্ডো সাহেবকে তো অ্যারেস্ট করেছেই, পুরো ফার্মটাই সিল করে দিয়েছে। সমীরকে অনেক জেরা করেছে, লাকিলি ওকে ছেড়ে দিয়েছে। কিন্তু বুটিক শপের ম্যানেজারও জেলে।

।।৭।।

নিউ ইয়র্কে ফিরেছি প্রায় এক মাস হল। ব্রুকলিনের একটা মার্ডার কেস নিয়ে একেনবাবু ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। ঘটনাটা হল, খুনি সন্দেহে একজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। লোকটির বিরুদ্ধে পুলিশ যে কেস খাড়া করেছে, সেটা যথেষ্ট মজবুত। লোকটি বলছে সে খুন করেনি। কিন্তু কোর্টে তো সেটা প্রমাণ করতে হবে। উকিলমশাই সেইজন্যেই একেনবাবুর সাহায্য চেয়েছেন।

ডিনারে বসে একেনবাবু আলতুফালতু অনেক কিছু নিয়ে বকবক করেন, কিন্তু এই মার্ডার কেসটার কথা এড়িয়ে যান। প্রমথর ধারণা ব্যাপারটা নিয়ে উনি ব্লু-লেস। সকালে বেরোনোর আগে রোজ জিজ্ঞেস করি, “আজকে কি ডিনারের আগে ফিরবেন?” একেনবাবুর উদ্‌বেলিত উত্তর, “অবশ্যই ফিরব স্যার। প্রমথবাবুর রান্না মিস করব!”

প্রমথ অবশ্য খোঁচা দিতে ছাড়ে না। “আমার রান্নার জন্য? না, বাড়িতে খেলে টু-পাইস বাঁচবে সেই কারণে?”

একেনবাবু আমার দিকে করুণভাবে তাকিয়ে বলেন, “প্রমথবাবু না স্যার, সত্যি!”

এর মধ্যে হঠাৎ একদিন ফিরলেন হাস্যোজ্জ্বল মুখে। বললেন, “বুঝলেন স্যার, আজকে দু-জন ইন্টারেস্টিং লোকের সঙ্গে দেখা হল।

এটা একেনবাবুর স্টাইল। যদি কারোর সম্পর্কে কিছু বলতে চান, এইভাবেই শুরু করেন। এরপর আমাকে প্রশ্ন করতে হয়, ‘কার কথা বলছেন?’ উনি একটা সংক্ষিপ্ত উত্তর দেন। তার পিঠে আমি বা প্রমথ আরেকটা প্রশ্ন করি, উনি তার উত্তর দেন… এইভাবে ব্যাপারটা বিশদ হয়। আজকের প্রশ্নোত্তর থেকে জানা গেল, প্রথম ইন্টারেস্টিং লোক হচ্ছেন একজন মহিলা—মিজ জনসন। এক্সপার্ট উইটনেস হিসেবে ওঁর মতামতকে কোর্ট নাকি খুব সম্মান করে, আর ওঁর জন্যেই মনে হচ্ছে ব্রুকলিন মার্ডারে পুলিশ যাকে দোষী ভেবেছে, সে ছাড়া পেয়ে যাবে।

প্রমথ বলল, “আপনি মশাই যা-তা। কেসটা কী সেটাই তো এতদিন বলেননি, দুম করে এখন একটা কনক্লুশন ছাড়ছেন!”

“বলিনি বুঝি স্যার? আসলে কেসটা তেমন ইন্টারেস্টিং নয়। ব্রুকলিনে একজন ওল্ড লেডি খুন হয়েছেন। তাঁর দুই ছেলে। ছোটো জন নিজের, আর বড়ো জন সৎ-ছেলে, মানে ওঁর দ্বিতীয় স্বামীর আগের পক্ষের। এই ছোটো ছেলেকেই পুলিশ গ্রেফতার করেছিল। আপাতত মহিলার দুই স্বামীর কেউই বেঁচে নেই। কোনো ছেলেই মাকে দেখত না, ফলে বুড়ি একাই থাকতেন। টাকাকড়ি ওঁর যা ছিল, তাতে দিব্যি চলে যেত। আর বাড়িটাও ছিল নিজের। ব্রুকলিনে বাড়ি— পুরোনো হলেও মিলিয়ান ডলার তো হবেই, তাই না স্যার?”

“তা হবে, নিউ ইয়র্ক বলে কথা,” উত্তরটা আমিই দিলাম।

“এই ওল্ড লেডিকেই কেউ রাত্রে এসে গুলি করে খুন করেছে। পুলিশের ধারণা টাকাকড়ি কিছুই খোয়া যায়নি, যদিও আলমারি খোলা ছিল, কিন্তু কেউ সেখানে হাত দিয়েছে বলে পুলিশের মনে হয়নি।”

“এ ধারণাটা পুলিশের হল কেন?” জিজ্ঞেস করলাম।

“ওল্ড লেডির বাড়ির খুব কাছেই ছিল ওঁর ব্যাঙ্ক। সোশ্যাল সিকিউরিটির চেক ওখানে জমা পড়ত। তিনি সেই টাকা আর যা পেনশন পেতেন, প্রতি মাসে সংসার খরচের জন্য তা তুলতেন। টাকার অঙ্ক খুব একটা বড়ো নয়, কিন্তু ওঁর চলে যেত।”

“মানে দিনে আনি দিনে খাই?”

“ঠিক তা নয় স্যার, ওঁর জমানো টাকাও ব্যাঙ্কে ছিল। কিন্তু তাতে হাত লাগাননি বেশ কয়েক বছর। ওঁর লকারে ছিল প্রায় দশ বছর আগে তৈরি একটা উইল, তাতে ওঁর স্থাবর-অস্থাবর পুরো সম্পত্তি সমানভাবে দুই ছেলেকে ভাগ করে দেবার নির্দেশ রয়েছে। কিন্তু ওঁর ডেস্ক-এর ড্রয়ারে পুলিশ পেয়েছিল আর একটা উইল, যেটা লেখা হয়েছিল উনি খুন হবার সাত দিন আগে। মনে হয় সেটাকে ব্যাঙ্কের লকারে রাখার সময় পাননি। এই উইলে পুরো সম্পত্তিই দিয়েছেন সৎ ছেলেকে। প্রথমে এই সৎ ছেলেই ছিল পুলিশের প্রাইম সাসপেক্ট। তার কোনো অ্যালিবাই নেই। আর সেই রাত্রে সে একাই নিজের বাড়িতে ছিল, যেটা ওল্ড লেডির বাড়ি থেকে খুব দূরে নয়। কিন্তু ব্যাপারটা পরে অন্যদিকে ঘুরে যায়। পুলিশের রিপোর্ট অনুসারে খুন হবার দিন দশেক আগে দুই ছেলে এসেছিল ওল্ড লেডির জন্মদিন উপলক্ষ্যে। কোনো কারণে বুড়ির সঙ্গে তখন ছোটো ছেলের তুমুল ঝগড়া হয়। পুলিশ দুয়ে দুয়ে এক করেছিল, কারণ ওর মা উইলে ওকে বাদ দিয়েছে শুনে ছোটো ছেলে খুব অবাক হয়েছিল! আগের উইলের একটা কপি ওর কাছে ছিল। সেটা থেকে ওর ধারণা হয়েছিল অর্ধেক সম্পত্তি ও পাবে। তবে ওর সঙ্গে যে মায়ের খুব ঝগড়া হয়েছিল, সেটা পুলিশের কাছে স্বীকার করেছে। বার্থ-ডে পার্টি থেকে মা ওকে প্রায় তাড়িয়েই দিয়েছিল। কিন্তু ওর বক্তব্য মা পুরোপুরি খামখেয়ালি…”

একেনবাবুর কাহিনি হয়তো আরও কিছুক্ষণ চলত, প্রমথ ওঁকে থামিয়ে দিয়ে বলল, “বুঝলাম। এখন বলুন, এই মিজ জনসন এমন কী করলেন, যাতে ছোটো ছেলে ছাড়া পেয়ে যাবে।”

“বলছি স্যার। ব্যাঙ্ক লকারের উইলের সইয়ের সঙ্গে নতুন উইলের সই একদম মিলে গেছে। সেখানেই সমস্যা।”

“আজব কথা, সেটাই তো হওয়া উচিত!” আমি বললাম।

“না স্যার, সই হুবহু মেলা মানেই সেটা অথেন্টিক নয়,” একেনবাবু বললেন।

একেনবাবুর মাথাটা কি গ্যাছে! আমি বললাম, “কী বলছেন যা-তা! শুনুন একেনবাবু, সই মেলেনি বলে কলকাতাতেই আমার ব্যাঙ্ক চেক বাউন্স করে দারুণ ঝামেলা হয়েছিল! ফোন করে কাজ হয়নি, শেষ পর্যন্ত সশরীরে উপস্থিত হতে হয়েছিল। ম্যানেজার মশাই আমাকে চিনতেন। তাও সামনে বসিয়ে আমাকে দিয়ে চেক সই করিয়েছিলেন। তাতেও মিলছে না বলে, ওঁদের রেকর্ড থেকে আমার পুরোনো সইয়ের ফোটোকপি বার করে সেটা মিলিয়ে সই করতে বলেছিলেন। সেটা কি মিছিমিছি!”

ব্যাপারটা এখানে একটু বিশদ করে বলি। আসলে আমি বাপি দে-র ডি-টা একটু কায়দা করে লিখি। ডি-এর যে শুঁড়টা দিই সেটাই একটু অন্যরকম হচ্ছিল! এদেশে এসে দেখি সই মেলার ব্যাপারে অতটা কড়াকড়ি নেই। আমার লেখা সই কখনো বাতিল হয়নি। অথচ আমি জানি সবসময় সইগুলো একদম একরকম হয় না। তাড়াহুড়ো করে একসময়ে সইটা একটু বাঁকাভাবে করি, ডি-র শুঁড় তো নানানরকম হয়। আবার এও শুনি ইলেকশনের সময় ব্যালট পেপারে সই করে যারা চিঠিতে ভোট দেয়, সই মেলেনি বলে তাদের অনেক ভোট গ্রাহ্য করা হয় না। ফলে ন্যায্য ভোট বাতিল হয় সই না-মেলার জন্য। পুরো ব্যাপারটাই আমার কাছে রহস্য। এ নিয়ে প্রমথ আমাকে অনেক জ্ঞান দেয়। লক্ষ লক্ষ ব্যালট পেপার নাকি কম্পিউটারে সর্ট করা হয়। সেখানে সই মেলানো হয় প্যাটার্ন রেকগনিশনের স্পেশাল কিছু সফটওয়্যার- পিক্সেল ম্যাচিং, সাপোর্ট ভেক্টর মেশিন টেকনিক, কৃত্রিম নিউরাল নেটওয়ার্কের ব্যাক প্রোপাগেশন মেথড, ইত্যাদি, কতগুলো দুর্বোধ্য টেকনিক দিয়ে। সবসময় সেগুলোও ঠিকমতো কাজ করে না। শেষে স্যাম্পল বেসিসে স্পেশালিস্টদের দিয়ে চেক করানো হয়। অনেক ভুল ধরা পড়লে তাদের দিয়ে নতুন করে ব্যালটগুলো গোনানো হয়। আমাদের দেশে সই মেলানোর জন্য ব্যাঙ্কে যাঁদের রাখা হয়, এঁরা নিশ্চয় তাদের মতো নয়! তাহলে তো বহু লোকের লেজিটিমেট ভোটই বাতিল হয়ে যাবে!

.

যাইহোক, একেনবাবু দেখলাম আমার এই তিক্ত অভিজ্ঞতা শোনার পরও খানিকটা নির্বিকার। বললেন, “না না, তা কেন স্যার, তবে কিনা সই মেলাটাই ফাইনাল নয়।”

“কথাটা একটু বুঝিয়ে বলুন তো! সই মিলে গেলে সমস্যাটা কোথায়? ইট মেকস নো সেন্স।”

“বলছি স্যার। এক্ষেত্রে মিজ জনসন অনেকগুলো যুক্তি দিয়েছেন, কেন দুটো সই হুবহু এক হতে পারে না। সময়ের ব্যবধান ছাড়াও, বৃদ্ধার আথ্রাইটিস রোগের বিষয়টা একটা বড়ো ফ্যাক্টর। একটু করে ওঁর হাতের লেখা আর সইয়ে যে পরিবর্তন এসেছে, সেটা দ্বিতীয় উইলে ধরা পড়েনি। সুতরাং ওটা নকল। এটার পর অঙ্ক অত্যন্ত সোজা। অর্থাৎ আগের উইলটাই ভ্যালিড, ছোটো ছেলে সম্পত্তির অর্ধেক পাবে।”

“শুধু অর্ধেক নয়, পুরোটাই পাবে।” প্রমথ বলল, “বড়ো ছেলেই নিশ্চয় জালিয়াতি করে পুরোটাই আত্মসাৎ করতে চেয়েছিল সমা-কে খুন করে, সে সম্পত্তির অর্ধেক পায় কী করে!”

আইন এ ব্যাপারে কী বলে জানি না, কিন্তু প্রমথর যুক্তিতে ধার আছে। “আপনার কি মনে হয় বড়ো ছেলেই খুন করেছে?” একেনবাবুকে প্রশ্ন করলাম।

“পুলিশ সে নিয়ে স্যার মাথা ঘামাক, আমার কাজ ছিল ছোটো ছেলের উকিলকে সাহায্য করা।”

“কীরকম সত্যান্বেষী আপনি, সত্যকে পাশ কাটিয়ে নিজের ফি নিয়ে কেটে পড়ছেন!” প্রমথ খোঁচা দিল।

“কী যে বলেন স্যার, আমি কি ব্যোমকেশ বক্সী নাকি! একটু-আধটু গোয়েন্দাগিরি করি মাত্র!

“ভারি আপনার গোয়েন্দাগিরি, গোয়েন্দা তো আপনার মিজ জনসন। ভালো করে তাঁর পরিচয়টা দিন তো?”

“মিজ জনসন একজন ফরেন্সিক সিগনেচার এক্সপার্ট। তিনিই নাকি ইস্ট কোস্টের টপ ডকুমেন্ট এক্সামিনার।”

“কোথায় থাকেন মহিলা?” এবার আমি প্রশ্ন করলাম।

“বস্টনে।”

“দাঁড়ান দাঁড়ান, মহিলার নাম কি হেলেন?” আমি উত্তেজিত হয়ে জিজ্ঞেস করলাম।

“হ্যাঁ, স্যার। আপনি কী করে জানলেন!”

“শুধু আমি না, আপনার ফ্যামিলি, মানে বউদিও তাঁকে চেনেন। আপনিও তাঁকে দেখেছিলেন শান্তিনিকেতনে প্রথম দিন যখন আমরা লাঞ্চ খাচ্ছিলাম। কেমন গোয়েন্দা মশাই আপনি, ক-দিন আগে যাঁকে দেখলেন তাঁকে চিনতে পারলেন না!” সুযোগ পেয়ে আমি একেনবাবুকে একটু ঠুকলাম।

“কী মুশকিল স্যার, আমি তো মিজ জনসনের সঙ্গে শুধু ফোনে কথা বলেছি। তবে উনি দু-দিন বাদেই নিউ ইয়র্কে আসছেন কেসটা ফলো-আপ করতে। কিন্তু আপনি তো একটা দারুণ কথা বললেন… শান্তিনিকেতনে কী করতে গিয়েছিলেন?”

“দেখুন, ওঁকেও র‍্যান্ডো সাহেব তলব করেছিলেন কিনা! সাহেব তো কম ধান্দাবাজ নয়!”

“মন্দ বলেননি স্যার, ওই খাতা দুটোর মূল্য নিশ্চয় কিছু আছে, নইলে এতদিন বাদে ওই নিয়ে কেউ ইমেল করত না। আর এই ইমেল পেয়ে র‍্যান্ডো সাহেবও গুচ্ছের টাকা খরচ করে মেল সাহেবকে খুঁজে বার করার চেষ্টা করতেন না!”

“শুধু খাতা দুটোর জন্য, না ওই আজেবাজে ছবিগুলোর জন্য? “ওটাও অন্য একটা সমস্যা। তবে দুটোর ভ্যালু কিন্তু আলাদা।”

“তা তো বটেই— একটা ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইম, বহু বছরের জেল, অন্যটা স্রেফ মানিটরি লাভ।” প্রমথ গম্ভীরভাবে বলল।

“আপনি না স্যার সত্যি! আচ্ছা স্যার, আজকে কি কফি পাব না?”

।। ৮।।

একেনবাবু দু-জন ইন্টারেস্টিং লোকের সঙ্গে দেখা হবার কথা বলেছিলেন, কিন্তু আমাদের কথার মাঝখানে দ্বিতীয় জনের প্রসঙ্গই চাপা পড়ে যাচ্ছিল। কফি নিয়ে বসে বললাম, “এবার আপনার দ্বিতীয় ইন্টারেস্টিং লোকের কথা বলুন।”

“ও হ্যাঁ, স্যার, এটাই হচ্ছে রিয়েল ইন্টারেস্টিং। হঠাৎ করে দেখা হয়ে গেল ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্টের পরিচিত নেভাডার এক ডিটেকটিভ, জ্যাক হোল্ডব্রুক-এর সঙ্গে।”

এখানে বলি, এই ‘হঠাৎ’ করে কথাটা সত্যি নয়। নিশ্চয় উনি তলে তলে খোঁজ করে যাচ্ছিলেন নেভাডার কোনো পুলিশ-গোয়েন্দার। এসব ব্যাপারে ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্ট অনেক সাহায্য করেন ওঁকে। আমার ধারণা ড্রামাটিক করার জন্য একেনবাবু ভাব দেখান সব কিছুই কাকতালীয়! যাইহোক, একেনবাবুর কথা শুনে বুঝলাম বছর পাঁচেক আগে নেভাডার ক্লার্ক কাউন্টির পুলিশ ফোর্স থেকে এই ভদ্রলোক অবসর নিয়েছেন। ওঁর জন্ম ও বড়ো হওয়া নিউ ইয়র্কে। নেভাডার একটি মেয়ের প্রেমে হাবুডুবু খেয়ে ‘ওয়াইল্ড ওয়েস্টে’ গিয়ে থিতু হয়েছিলেন। রিটায়ার করার পরও বছর দুই ওখানেই ছিলেন। কিন্তু প্রেমের তাগিদে নিউ ইয়র্ক থেকে চলে যেতে হলেও হোল্ডব্রুক সাহেব মনেপ্রাণে ছিলেন নিউ ইয়র্কার। স্ত্রীর মৃত্যুর পর ফিরে এসেছেন ‘স্বস্থানে।’ আসার পর একা একা কর্মহীন এই জীবন আর ভালো লাগছিল না। হালকা কাজ খুঁজছিলেন যেখানে ওঁর অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে পারেন। সেই সূত্রেই একেনবাবুর সঙ্গে যোগাযোগ।

“ওশন অফ নলেজ স্যার, উনি আসায় জটটা মনে হয় এবার খুলবে।”

“কোন জটের কথা বলছেন?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।

“ক-দিন ধরে র‍্যান্ডো সাহেবের কথা খুব মনে হচ্ছিল স্যার। মনের ভিতরটা খচ খচ করছিল। এত টাকা দিলেন, কিন্তু কাজটা করা হল না।”

“র‍্যান্ডো জোচ্চুরি করে টাকা কামিয়েছেন। সৎভাবে উপার্জন করা টাকা নিলে তবু আপনার গিল্টি ফিল করার মানে হত!” প্রমথ দাবড়ানি দিল!

“তাও ওঁকে জিজ্ঞেস করলাম স্যার, ম্যাডাম লুসি আর তাঁর বয়ফ্রেন্ডকে পুড়িয়ে হত্যা করার কেসটা। প্রথমে উনি মনে করতে পারছিলেন না কার কথা জিজ্ঞেস করছি। লাকিলি ওঁর বন্ধু ছিল জনি বেত্তো, ক্লার্ক কাউন্টির এক ফায়ার চিফ। আমার সামনেই তাঁকে ফোন করলেন। মিস্টার বেত্তোর কেসটা মনে আছে। ঘটনাটা ঘটেছিল ক্লার্ক কাউন্টিরই বোল্ডার সিটি-তে- লাস ভেগাস থেকে মাইল কুড়ি দূরে। প্রথমে আর্সন বলে সন্দেহ হয়েছিল। পরে অবশ্য আসন না-হওয়ার সম্ভাবনাও জোরদার হয়। এইসব শুনতে শুনতে হোল্ডব্রুক সাহেবের কেসটা মনে পড়ে গেল। আসলে কে বা কারা লুসি আর তার বয়ফ্রেন্ডকে ওইভাবে পুড়িয়ে মারতে চাইবে সেটা বার করা যায়নি। তবে আসন না হলে তো সে নিয়ে প্রশ্নও ওঠে না। আমার এ ব্যাপারে একটা ইন্টারেস্ট আছে দেখে হোল্ডব্রুক সাহেব বললেন, ওঁর কাছে কতগুলো পুরোনো কেস ফাইলের কপি আছে। একবার খুঁজে দেখবেন, ওই কেস নিয়ে কিছু আছে কিনা।”

“বাঃ। তাহলে তো বেগার খাটনির মশলাপত্রও পেয়ে যেতে পারেন!”

প্রমথর শেষটা গায়ে মাখলেন না একেনবাবু। “বেগার বলছেন কেন স্যার, ইমেল রহস্যটা তো উদ্ধার করা হয়নি— দুটো খাতা আর ছবি-ভরতি খামটাও তো পাওয়া যায়নি!”

“আপনি মশাই সামথিং!” প্রমথ বিরক্ত হয়ে বলল। “দুটো ফালতু খাতা, আর কয়েকটা পর্নোগ্রাফিক ছবি— এগুলোর জন্য আপনার মহা-মূল্যবান সময় আপনি নষ্ট করবেন? আর কে ইমেল পাঠিয়েছে বার করতে পারলেও আপনাকে টাকাটা দিচ্ছে কে?”

“না, না, স্যার, সেটা পাব। র‍্যান্ডো সাহেবের অ্যাটর্নি, বার্ড সাহেবের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। তিনি টাকাটা রিলিজ করবেন।”

“যাক, আপনার ক্যারেক্টারে যে অসঙ্গতি ছিল সেটা চলে যাচ্ছে দেখে ভালো লাগছে।”

“তার মানে স্যার?”

“এই যে, এদিকে আপনি হাড়-কেপ্পন, টু-পাইস ফাদার-মাদার। অন্যদিকে নিজের ফি নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছেন না— তাই বলছিলাম…”

একেনবাবু আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, “প্রমথবাবু না স্যার, সত্যি!”

প্রমথ বলল, “শুনুন একেনবাবু, আমি সত্যি না মিথ্যে জানি না, কিন্তু আপনি আরও একটা অ্যাঙ্গেল নিয়ে ভাবুন। ছবিগুলো তুলেছিল র‍্যান্ডো সাহেবেরই এক বন্ধু টোনি না কী জানি তার নাম। র‍্যান্ডো এখন বড়োলোক জেনে সে ব্যাটাও তো ব্ল্যাকমেল করতে পারে! ছবিগুলোর কথা সে জানে। ধরে নিচ্ছি সে-ই ছিল ফোটোগ্রাফার, সুতরাং ছবিতে সে নেই, আছে শুধু র‍্যান্ডো অ্যান্ড কোম্পানি। সেই টোনি ব্যাটাই এখন বেনামে ইমেল পাঠাচ্ছে র‍্যান্ডোকে।”

একেনবাবু একটু চুপ করে থেকে বললেন, “সবই সম্ভব স্যার, সবই সম্ভব। কিন্তু ওই খাতাগুলোর কথা তিনি জানবেন কী করে?”

এ নিয়ে আর কোনো কথা হল না। তবে হেলেন জনসন নিউ ইয়র্কে এলে একেনবাবু যে শান্তিনিকেতনের কথা জিজ্ঞেস করবেন সে নিয়ে আমার কোনো সন্দেহ নেই। কেন হেলেন শান্তিনিকেতনে গিয়েছিলেন, সেই রহস্যটাও উদ্ধার হবে। যদিও আমার মনে হল কাজটা নিশ্চয় রবীন্দ্র মিউজিয়াম সংক্রান্তই হবে। শুনেছিলাম বেশ কিছু পুরোনো চিঠি কার লেখা, সে নিয়ে কিছু কনফিউশন আছে, সেগুলো প্রদর্শনীতে তোলার আগে কর্তৃপক্ষ হয়তো নিঃসন্দেহ হতে চায়।

.

পরের দিন সকালে কলেজে গেছি। সপ্তাহে একটা দিন আমার কোনো ক্লাস থাকে না, আজকে সেই দিন। আজকে আমার পড়ানো নেই। এগারোটা নাগাদ একেনবাবু এলেন, সঙ্গে হেলেন!

“আসুন, আসুন,” বলতেই হেলেন বললেন, “ইটস আ স্মল ওয়ার্ল্ড, আমি একেনের সঙ্গে একটা প্রজেক্টে গত কয়েক দিন ধরে কাজ করছিলাম, কিন্তু জানতাম না ওঁর স্ত্রীর সঙ্গে আগেই আমার পরিচয় হয়েছে।”

আমি হেসে জিজ্ঞেস করলাম, “সেদিন আপনার পছন্দসই স্কার্ফ পেয়েছিলেন?”

“ইয়েস, থ্যাংকস টু ইউ। বাই দ্য ওয়ে, আপনার ডিরেকশন একেবারে পারফেক্ট ছিল।”

“থ্যাংক ইউ।”

একেনবাবু বললেন, “বুঝলেন স্যার, হেলেন ম্যাডামের সঙ্গে একটু আগে কথা হচ্ছিল। উনিও র‍্যান্ডো সাহেবের জন্যে একটা কাজ করছিলেন, কিন্তু ওঁর সঙ্গে দেখা হবার আগেই শুনলেন র‍্যান্ডো সাহেব অ্যারেস্টেড!”

করা।’

একেনবাবুর কথা বলার ধরনে হেলেন মুচকি মুচকি হাসছিলেন।

“কী কাজ?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।

“একটা ডকুমেন্টের কয়েকটা পাতা থেকে সেগুলো কার লেখা আইডেন্টিফাই

“সেটা কী করে সম্ভব?”

“এক্স্যাক্টলি, সেই নিয়েই একটু আগে একেনের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। আমি দুটো লেখা একজন লিখেছেন কি না বলার চেষ্টা করি। কিন্তু একটা লেখা দেখে কে সেটা লিখেছেন বলার ক্ষমতা তো আমার নেই।”

“এই কাজটা আপনাকে মিস্টার র‍্যান্ডো দিয়েছিলেন?”

“না, না, দিয়েছিলেন ওঁর এক অ্যাটর্নি- জ্যাক বার্ড। আরও কিছু ইনফর্মেশন ছাড়া এ কাজ আমি নিতে পারব না বলায় জ্যাক বললেন, ‘ভদ্রলোক ইন্ডিয়াতে থাকেন। ক-দিন আগে এই পাতাগুলো দিয়ে চলে গেছেন! উনি এখন থাকেন শান্তিনিকেতনের কাছে একটা জায়গায়।’ মজার ব্যাপার, আমি শান্তিনিকেতনেই যাচ্ছিলাম টেগোর মিউজিয়ামের কয়েকটা ডকুমেন্ট আইডেন্টিফিকেশনের কাজে। জ্যাককে সেটা জানিয়ে বললাম, “ওঁর সঙ্গে দেখা করে আমার প্রশ্নের জবাবগুলো পেলেই কাজটা নেব।’ তখনই জানলাম ভদ্রলোক একসময় স্বনামে-বেনামে হলিউডে স্ক্রিপ্ট লিখতেন, আর আঙ্কলের রেখে যাওয়া টাকায় এখন বড়োলোক। অ্যাটর্নি জ্যাক অবশ্য আমাকে সতর্ক করেছিলেন মিস্টার র‍্যান্ডো একটু খেপা লোক বলে। যাইহোক, উনি আমার সঙ্গে দেখা করেননি। ওঁর লোকেরাও হেল্পফুল নয়। সুতরাং কাজটা নিয়ে আমি আর এগোইনি।”

“আপনার টেগোর মিউজিয়ামের কাজগুলো শেষ হয়ে গেছে?”

“হ্যাঁ, কাজগুলো এখানে থাকতেই প্রায় শেষ করে ফেলেছিলাম, শুধু দুয়েকটা এক্সিবিটের অরিজিনাল নিজের চোখে না দেখে ফাইনাল রিপোর্ট লিখতে চাইনি। সেইজন্যেই যাওয়া। সত্যি কথা বলতে কী, সেটাও খানিকটা ছুতো, আসলে ইন্ডিয়া যেতে আমি খুবই ভালোবাসি। আমার বন্ধুরা অবাক হয়। জায়গাটা এত গরম, অপরিষ্কার রাস্তাঘাট, লোকজনের ভিড়, ডিসেন্ট ফেসিলিটির অভাব, হাজার রকমের কমপ্লেইন। এগুলো সবই ঠিক। কিন্তু ইন্ডিয়ার যে আলাদা একটা চার্ম আছে, সেটা ওরা মিস করে যায়।”

‘চার্ম’-টা ঠিক কী, জিজ্ঞেস করার আগেই একেনবাবু প্রশ্ন করলেন, “ম্যাডাম, আপনি ঠিক কী জানতে চেয়েছিলেন র‍্যান্ডো সাহেবের কাছে?”

“প্রশ্নটা ডেট এবং প্লেস সংক্রান্ত। লেখাগুলো কবে লেখা হয়েছিল এবং কোথায় লেখা হয়েছিল। এ ছাড়া অন্য কোনো সাপোর্টিং ডকুমেন্ট পাওয়া যাবে কি না— চিঠিপত্র, ডায়েরি, ইত্যাদি। যদি কোনো বিখ্যাত লোকের লেখা হয়ে থাকে, তাহলে স্থান এবং কাল দিয়ে অনেক কিছু বার করা যায়।”

“কীভাবে?”

“সমসাময়িক বিখ্যাত লোকেদের লেখা মিউজিয়াম, নেট, ইত্যাদি অনেক জায়গাতেই ছড়িয়ে আছে। খুঁজে খুজে সেগুলো বার করে মেলাতে হবে। প্রচুর খাটনি, কিন্তু কাজটা অসম্ভব নয়। কয়েকটা কম্পিউটার-বেসড রাফ সার্চিং টুলস আমাদের আছে।”

খুব ইন্টারেস্টিং তো, এটা আমার মাথায় আসেনি। র‍্যান্ডো সাহেবের সঙ্গে হেলেনের দেখা হলে, আর কাগজের লেখাগুলো বিখ্যাত কারোর হলে তাঁকে আইডেন্টিফাই করা যেত। আমি মোটামুটি বুঝতে পারছিলাম কাগজ দুটো ইমেল-এ উল্লেখ করা খাতার দুটো পাতার কপি। র‍্যান্ডো সাহেব মনে হয় অনুমান করতে পেরেছিলেন, এত বছর বাদে ইমেল-এ কেউ যখন ওটার খোঁজ করছে, ওটার মূল্য আছে। আর সেইজন্যেই মার্কিন মুলুকে এসে ওঁর অ্যাটর্নিকে কয়েকটা পাতার ফোটোকপি দিয়ে গেছেন। লোকটা অবশ্যই ঘোড়েল। খাতা দুটো কোথায় আছে ভালো করেই জানতেন, কিন্তু একেনবাবুর সঙ্গে কথা বলার সময় এমন ভাব দেখালেন যেন ভালো করে মনেও করতে পারছেন না, ইমেলে কীসের কথা বলা হয়েছে! যাইহোক, লোকটা এখন জেলে। পাপের শাস্তি ভোগ করছে, এ নিয়ে একেনবাবু কেন মাথা ঘামাচ্ছেন কে জানে! তবে একটা জিনিস, আমিও অনুমান করতে পারি পাতাগুলো কোন সময়ে লেখা। লুসির বয়স যদি র‍্যান্ডো সাহেবের কাছাকাছি হয়, তাহলে তাঁর ঠাকুরদার বয়স সম্পর্কে একটা অনুমান অন্তত করা যায়।

হেলেন মিনিট পাঁচেকের জন্য যখন রেস্টরুমে গেলেন, আমি একেনবাবুকে জিজ্ঞেস করলাম, “আচ্ছা, সেদিন আপনি হঠাৎ কেন র‍্যান্ডো সাহেবকে জিজ্ঞেস করলেন আপনি শেষ কবে নিউ ইয়র্কে গিয়েছিলেন- ইমেল পাবার আগে না পরে?”

“আসলে স্যার, আমি ওঁর খাটের নীচে একটা বড়ো ব্যাগ দেখতে পেয়েছিলাম, তাতে এয়ারলাইনের একটা ট্যাগ-এ ছাপা ছিল JFKCCU। মানে নিউ ইয়র্ক সিটির কেনেডি এয়ারপোর্ট থেকে কলকাতার দমদম। ট্যাগটা মোটামুটি পরিষ্কার, সুতরাং খুব একটা পুরোনো হতে পারে না। তখনই মনে হল, ইমেল-টা দেখেই হয়তো খাতাগুলো খুঁজতে গিয়েছিলেন। এত বছর পরে কেউ যখন সেটা নিয়ে লিখেছে, সেটার কিছু মূল্য নিশ্চয় আছে। তাই ইমেল না দেখে নিউ ইয়র্কে যাবার কথাটা হয়তো সত্যি নয়। আমি স্যার ট্রাস্ট বাট ভেরিফাই-এ বিশ্বাসী।”

“কিন্তু উনি যে বললেন ইমেল খুলেছেন এদেশ থেকে ফিরে গিয়ে?”

“আপনি স্যার ওঁর সব কথা বিশ্বাস করেন?” একেনবাবুর মুখে মুচকি হাসি।

“প্রমথ ঠিকই বলে, আপনি অত্যন্ত ধুরন্ধর লোক মশাই।”

“কী যে বলেন স্যার!”

“আরেকটা কথা। আপনি কি হেলেনকে বলে দেবেন পাতাগুলো কোন সময়ের লেখা হতে পারে? মানে লুসির ঠাকুরদার আমলের লেখা যখন, একটা অনুমান তো করাই যায়।”

“তা অবশ্য যায়, কিন্তু এই কাজের জন্য কি ম্যাডাম আর সময় নষ্ট করবেন!”

ইতিমধ্যে হেলেন রেস্টরুম থেকে ফিরে এসেছেন। ব্রুকলিন-এর কেস নিয়ে আলোচনা করার জন্য একেনবাবু চলে গেলেন হেলেনকে নিয়ে। ক্লাস না থাকলেও রিসার্চের বেশ কিছু কাজ জমে ছিল। একেনবাবুর কাহিনি লিখে তো আমার চাকরি টিকে থাকবে না। ইন্টারন্যাশনাল জার্নালে নিয়মিত পেপার, মানে গবেষণাপত্র ছাপাতে হবে। এদেশে সেগুলো না করলে চলে না। বাড়ি ফিরতে ফিরতে বিকেল হয়ে গেল।

।।৯।।

বাড়িতে এসে দেখি বাইরের ঘরে টার্টলনেক সোয়েটার আর কর্ডরয় প্যান্ট পরা এক সুপুরুষ ভদ্রলোক একেনবাবুর সঙ্গে বসে আছেন। প্রমথ কফি বানাচ্ছে। ভদ্রলোকের চুল, গোঁফদাড়ি সবই সাদা। এই বয়সেও ভদ্রলোক অত্যন্ত সুপুরুষ।

আমাকে দেখে একেনবাবু বললেন, “আসুন স্যার, আসুন। আর একটু দেরি হলেই প্রমথবাবুর তৈরি ফ্রেশ কফি মিস করে যেতেন!”

প্রমথ সঙ্গে সঙ্গে কিচেন থেকেই উঁচু গলায় বলল, “এখনও মিস করবে, ওর জন্য বানাইনি।”

“কী যে বলেন স্যার, আপনি সেরকম মানুষই নন।”

আমাদের কথা শুনে ভদ্রলোক মুচকি মুচকি হাসছেন। রসিক লোক।

একেনবাবু পরিচয় করিয়ে দিলেন। “এঁর কথাই সেদিন আপনাকে বলেছিলাম স্যার, নেভাডা পুলিশের বিখ্যাত ডিটেকটিভ, মিস্টার হোল্ডব্রুক। এখন রিটায়ার করে এখানে।”

আমি নিজের পরিচয় দিলাম।

“বিখ্যাত মোটেও নই,” একেনবাবুর দিকে হাসিমুখে একটু তাকিয়ে আমাকে বললেন, “তবে এটা ঠিক, পুলিশ ডিপার্টমেন্টে চাকরি করতাম নেভাডায়। এখন অবসরপ্রাপ্ত।”

বোঝাই যায় অত্যন্ত ভদ্রলোক।

একেনবাবু ওঁকে প্রমথ আর আমার সম্পর্কে কী বুঝিয়েছিলেন জানি না। নিশ্চয় বিরাট কোনো কাহিনি। বাপের বয়সি একজন ‘প্রফেসর, ‘প্রফেসর’ সম্বোধন করছেন বলে লজ্জাই লাগছিল। এর মধ্যে প্রমথর তিন রকমের কফি বিন গ্রাইন্ড করে স্পেশাল কফি বানানো শেষ হয়েছে। সবাই বসলাম কফি নিয়ে। হোল্ডব্রুক সাহেব একটা ফোল্ডার নিয়ে এসেছেন। নেভাডার ক্লার্ক কাউন্টির পুরোনো কেস ফাইল থেকে লুসি-র‍্যান্ডো সংক্রান্ত কাগজপত্রের ফাইল। ফোল্ডারটা আধ-খোলা অবস্থায় কফি টেবিলের ওপরে রাখা। একেনবাবুর সঙ্গে নিশ্চয় আগেই এ নিয়ে কথা হয়েছিল। আমি ঘরে ঢোকার আগেও মনে হয় ওই নিয়েই কথাবার্তা শুরু হয়েছিল। আমার চোখে পড়ল টাইপ করা রিপোর্টের পাশে হাতে লেখা কিছু নোট। নোটগুলো বেশ ক্রিপ্টিক।

কফিতে চুমুক দিয়ে হোল্ডব্রুক সাহেব একেনবাবুকে জিজ্ঞেস করলেন, “আপনার কোনো স্পেসিফিক প্রশ্ন আছে? এখানে বহু লোকের বয়ান আছে, বেশিরভাগই ইউজলেস। পুরোটা পড়ে সময় নষ্ট করার মানে হয় না।”

“ঠিক আছে স্যার, প্রথমে নাহয় প্রশ্ন দিয়েই শুরু করি। তার আগে বলি কেন আমরা এই কেসটা নিয়ে এত ভাবনাচিন্তা করছি। আমার ক্লায়েন্ট মিস্টার র‍্যান্ডো ছিলেন ম্যাডাম লুসি-র স্বামী। মিস্টার র‍্যান্ডো কতগুলো গোলমেলে ইমেল পেয়েছেন মেল ব্রুকস নামে এক ভদ্রলোকের কাছ থেকে। মিস্টার ব্রুকস দাবি করছেন ম্যাডাম লুসিকে খুন করেছেন মিস্টার র‍্যান্ডো।”

“হ্যাঁ, এই নিয়ে তো গতকালই আপনার সঙ্গে কথা হয়েছিল। এই কেস ফাইলে কাল রাতে আমি চোখ বুলিয়েছি। আসলে আমরা ইনভেস্টিগেশন শুরু করেছিলাম, লুসি বা লুসির বয়ফ্রেন্ডকে খুন করার জন্য কেউ ওদের ঘরে আগুন লাগিয়েছিল কিনা দেখতে। লুসির হাজবেন্ড রিচার্ড র‍্যান্ডো আমাদের সাসপেক্ট লিস্টে ছিল। লাকিলি যে সময় লুসির বাড়িতে আগুন লাগে সে সময় র‍্যান্ডো অনেক দূরে ছিল। শুধু র‍্যান্ডোর বিবৃতি অনুসারে নয়, যে-রেস্টুরেন্টে ও কাজ করছিল, সেখানে অনেকে ওকে দেখেছে। সুতরাং ওখান থেকে কোনোমতেই লুসির অ্যাপার্টমেন্টে র‍্যান্ডো আসতে পারে না।”

“হ্যাঁ স্যার, সেটাই উনি আমাদের বলেছেন। তবে এই মিস্টার মেল আরও উলটোপালটা কিছু চার্জ এনেছেন মিস্টার র‍্যান্ডোর নামে। মনে হচ্ছে উনি মিস্টার র‍্যান্ডোকে ব্ল্যাকমেল করার চেষ্টা করছেন ম্যাডাম লুসিকে জড়িয়ে। কিন্তু সেই নিয়ে বোঝাপড়া করতে গেলে মিস্টার মেল-এর পরিচয়টা আগে জানা দরকার। সেটা না-জানা পর্যন্ত র‍্যান্ডো সাহেব এ ব্যাপারে এগোতে পারছেন না। আমাকে ভার দিয়েছেন, তাঁকে ফিজিকালি খুঁজে বার করার।”

“র‍্যান্ডো আপনার ক্লায়েন্ট আমি জানি, কিন্তু এই র‍্যান্ডো সম্পর্কে আপনি কতটুকু জানেন জানি না। লোকটি ছিল আন-সাকসেসফুল স্ক্রিপ্ট রাইটার, লুসির টাকায় বহুদিন জীবন কাটিয়েছে, ডোমেস্টিক ভায়োেলন্সের জন্যেও র‍্যান্ডোকে একাধিক বার সতর্ক করা হয়েছিল। একদিন মারামারি, ঝগড়াঝাঁটির পর লুসি বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়। পরিচিত বন্ধুর বাড়িতে পেয়িং গেস্ট হিসেবে মাস কয়েক ছিল। সেখান থেকে পাততাড়ি গুটিয়ে নেভাডায় চলে যায়। যেটা বলতে চাচ্ছি, লুসিকে খুন না করলেও খুব একটা চরিত্রবান লোক র‍্যান্ডো নয়। তার জন্য এত ভাবছেন কেন?”

“আসলে আমি ভাবছি স্যার, আমার একটা খটকার জন্য।”

“খটকা?”

“মিস্টার র‍্যান্ডো বুঝতে পারছেন না এই মিস্টার মেল ব্রুকস লোকটি কে? এই নামের কাউকে তিনি চেনেন না!”

মিস্টার হোল্ডব্রুক বললেন, “মেল যে একজন ছেলে, এটা তিনি মনে করছেন কেন?”

“মানে?” একেনবাবু জিজ্ঞেস করলেন।

“মেল তো একটা জেন্ডার নিউট্রাল নাম- মেলভিন, মেলিসা, মেলভিনা, মেলানি, মেলিন্ডা- অনেক কিছুই হতে পারে। ইন ফ্যাক্ট লুসি একজন মেলিন্ডাকে চিনত— খুবই ভালো বন্ধু ছিল। এই ফাইলে তার নাম বেশ কয়েক বার আছেও, কিন্তু মেল বলে নয়, মিন্ডি বলে।”

একেনবাবু মাথা নাড়তে নাড়তে বললেন, “ভেরি কনফিউজিং তো স্যার। মেল মেলিন্ডা, আবার মেলিন্ডা মিন্ডি।”

সাহেবদের এই ডাকনামগুলোতে একেনবাবু এখনও মাঝে মাঝে গোলমাল করে ফেলেন।

“এত কনফিউশানের কী আছে!” প্রমথ বিরক্ত হয়ে বলল, “আমাদের সেক্রেটারি মেলিন্ডারই তো দুটো ডাকনাম চালু। কেউ ডাকে লিন্ডা, কেউ ডাকে মিন্ডি।”

“না না, বুঝতে পারছি স্যার। যিনি ইমেল পাঠিয়েছেন তিনি ম্যাডাম লুসির বন্ধু ম্যাডাম মিন্ডিও হতে পারেন— তাই তো?” এবার প্রশ্নটা হোল্ডব্রুক সাহেবকে।

“অসম্ভব নয়।” ভদ্রলোকের মুখ দেখে মনে হল মিন্ডি ওঁর পরিচিত।

“ওঁর সম্পর্কে কোনো খবর আছে স্যার আপনার কাছে?”

“এই ফাইলে অনেক তথ্যই আছে মিন্ডির সম্পর্কে। এগুলো সবই জানতে পারা গিয়েছিল লুসির মৃত্যুর পর বোল্ডার সিটি সেন্টার ফর ডেন্টিস্ট্রির রিসেপশনিস্ট ক্যাথির কাছ থেকে। আর এই ক্যাথিকে আমি প্রথমে অন্য সূত্রে চিনতাম। আমার প্রয়াত স্ত্রীর বন্ধু ছিল। স্মল ওয়ার্ল্ড, তাই না?”

“তা আর বলতে স্যার! বলুন স্যার বলুন, কী আছে শুনি।”

মিস্টার হোল্ডব্রুক শুরু করার আগেই ওঁর একটা ফোন এল। “এক্সকিউজ মি,” বলে উঠে একটু দূরে গিয়ে কথা বলতে শুরু করলেন।

।।১০।।

বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হল না, কয়েক মিনিটের মধ্যেই মিস্টার হোল্ডব্ৰুক ফোন শেষ করে ফিরে এলেন। “সরি, আপনাদের বসিয়ে রাখলাম, কলটা একটু দরকারি ছিল।”

“আরে না স্যার, তাতে কী হয়েছে।”

কেস ফাইলটা টেবিল থেকে তুলে পাতা উলটোতে উলটোতে হোল্ডব্রুক সাহেব বললেন, “মিন্ডির সম্পর্কে জানতে চাচ্ছিলেন, তাই তো?”

“হ্যাঁ, স্যার।”

ভদ্রলোক সত্যি গুছিয়ে গল্প করতে পারেন। যে-ভাবে পুরো ব্যাপারটা বললেন, আমি সেভাবে লিখে উঠতে পারব কিনা জানি না। তবু চেষ্টা করি।

“লুসির সঙ্গে মিন্ডির বন্ধুত্ব হলিউডেই শুরু হয়। মিন্ডি সেখান থেকে নেভাডার বোল্ডার সিটি লাইব্রেরিতে কাজ নিয়ে আসে, কিন্তু লুসির সঙ্গে ভালো যোগাযোগই ছিল। লুসি হলিউড ছেড়ে মিন্ডির বাড়িতেই প্রথমে উঠেছিল। মেডিক্যাল সেন্টারে কাজ পাবার পর লুসি নিজে একটা বাড়ি ভাড়া নেয়। লুসি যেখানে কাজ করত, সেখানে মিন্ডিও মাঝে মাঝে আসত।”

হোল্ডব্রুক সাহেব যখন ফাইলের দিকে চোখ রেখে বলে যাচ্ছেন তখন একেনবাবু ওঁর কাঁধের কাছে মাথা এনে ফাইলটা দেখার চেষ্টা করছেন। হঠাৎ বলে উঠলেন, “ওটা কী স্যার, ‘দ্য অপোজিট অ্যাট্রাক্টস?”

“ওটা আমার লেখা নোট। কেন লিখেছিলাম? ও হ্যাঁ,” পাতাগুলোতে আরেক বার চোখ বুলিয়ে হোল্ডব্রুক সাহেব বলে চললেন, “এক দিক থেকে দু-জনেরই মিল ছিল, কারোরই বাবা-মা ছিল না, বয়সও ছিল দু-জনের কাছাকাছি। কিন্তু মিলটা শেষ সেখানেই। মিন্ডির চেহারা ছিল সাদামাটা, অন্যপক্ষে লুসি ছিল সত্যিই সুন্দরী। কিন্তু লুসি ছিল পেরিনিয়ালি পুওর, আর মিন্ডি পারিবারিক সূত্রে প্রচুর টাকাকড়ি পেয়েছিল। ওর ঠাকুরদা নেভাডায় রিয়েল এস্টেট বিজনেসে প্রচুর টাকা কামিয়েছিলেন। স্বচ্ছলতা থাকলেও মিন্ডির টিন-এজটা কেটেছিল রেস্ট্রিকশনের মধ্যে— অল-গার্লস স্কুলে আর বইপত্র পড়ে। কলেজ লাইফ শেষ না-হওয়া পর্যন্ত বাইরের জগতের সঙ্গে সেভাবে মেশা হয়ে ওঠেনি। এই সময়েই লুসির সঙ্গে ওর পরিচয় হয়। বরের সঙ্গে লুসির তখনও ছাড়াছাড়ি হয়নি, কিন্তু লুসি একা একাই ঘোরাঘুরি করত আর পার্টি করে বেড়াত— জীবন কাটাত হাই-ফাই স্টাইলে। লুসি হয়ে উঠল মিন্ডির ফ্রেন্ড, ফিলোজফার, আর গাইড। কিন্তু ঠাকুরদা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ায় মিন্ডিকে নেভাডায় চলে আসতে হয়। কয়েক মাসের মধ্যে ঠাকুরদা মারা যান। এর মধ্যে লুসিও নেভাডায় চলে আসে।”

“ঠিক স্যার, ঠিক। এই ম্যাডাম মিন্ডির কথাই মিস্টার র‍্যান্ডো আমাদের বলেছিলেন যখন আমাদের সঙ্গে দেখা হয়েছিল,” একেনবাবু বলে উঠলেন।

“হতে পারে, মিন্ডি নামটা খুব কমন নয়। লুসির জীবনযাত্রা ছিল অসংযমী, ধারদেনায় জর্জরিত হয়ে থাকত। সবচেয়ে বেশি ধার ছিল মিন্ডির কাছে। ক্রেডিট কার্ডে জিনিসপত্র কিনে মান্থলি পেমেন্ট পর্যন্ত দিয়ে উঠতে পারত না। মিন্ডি ওকে উদ্ধার করত। লুসি আর মিন্ডি দু-জনকেই ক্যাথি ভালো করে চিনত। লুসির অফিস ছিল ক্যাথির অফিসের পাশে। ক্যাথি আর লুসি মাঝে মাঝে একসঙ্গে লাঞ্চ করত, এক-আধ সময়ে মিন্ডিও যোগ দিত।”

“ভেরি ইন্টারেস্টিং। এবার কেস ফাইলে ম্যাডাম লুসি আর মিন্ডিকে নিয়ে যা-যা আছে, একটু বলবেন স্যার। আর হ্যাঁ, ম্যাডাম লুসির সেই বয়ফ্রেন্ড, যিনি আগুনে পুড়ে মারা যান, তাঁর সম্পর্কেও।”

“ক্যাথি যে ডেন্টিস্ট্রি অফিসে কাজ করত, সেখানে কাজ করত ডেন্টিস্ট টম ভোলকার্ট। মিন্ডি বেশ কয়েক বছর ধরে ছিল টমের পেশেন্ট। ক্যাথির বয়ান অনুসারে ডেন্টিস্ট টম তার পেশেন্টদের সঙ্গে মাঝে মাঝে ডেট করত। অবভিয়াসলি খুব একটা এথিক্যাল ডাক্তার ছিল না। তার ওপর টাকার লোভ একটু বেশিই ছিল। জুয়োর নেশা ছিল, ক্যাসিনোতে গিয়ে টাকা ওড়াত, আর সেই নেশা মেটাতে নানান অছিলায় পেশেন্টদের এক্সট্রা চার্জ করত। ক্যাথি সেটা বুঝত পারত সেন্টারের অন্যান্য ডেন্টিস্টদের কথাবার্তা থেকে। টমের জন্য সেন্টারের বদনাম হচ্ছে বলে তারা চিন্তিত ছিল। লুসি নেভাডায় এসে মিন্ডির রেকমেন্ডেশনে টমের পেশেন্ট হল। লুসির সঙ্গে টমের যে একটা আলাদা সম্পর্ক শুরু হয়েছে, সেটা কিন্তু সেন্টারের অনেকেরই নজরে পড়েছিল। লুসি সময় পেলেই টমের প্রাইভেট অফিসে এসে গল্পগুজব করে যেত। শুধু তাই নয় ক্যাথি শুনেছিল টম নাকি মাঝে মাঝে লুসির অ্যাপার্টমেন্টে রাত কাটাচ্ছে! খবরটা পেয়েছিল লুসির এক প্রতিবেশীর কাছ থেকে। তাই ক্যাথি ভীষণ অবাক হয়েছিল একবার অনেক রাতে কোনো একটা বিশেষ কাজে অফিসে এসে মিন্ডির সঙ্গে টমকে খুব ঘনিষ্ঠ অবস্থায় দেখে! ক্যাথি দেখেনি দেখেনি করে বেরিয়ে এসেছিল। তবে ক্যাথির ধারণা এটা নিশ্চয় এক বারের ঘটনা নয়, আরও দু-এক বার ঘটেছিল। কারণ ওদের এই কম্প্রোমাইজিং পজিশন আরও কয়েক জনের চোখে পড়ায় ওদের নিয়েও একটা গুঞ্জন মেডিক্যাল সেন্টারে ছড়িয়ে পড়ে। ডক্টর টম ভোলকার্টকে গ্রুপ থেকে সরানো হচ্ছে এমন কানাঘুষো যখন শুরু হয়েছে, লুসি একদিন সকালে অফিসে এল। ক্যাথি তখন নিজের ডেস্কে নেই। সেদিনের পেশেন্টদের ফাইলগুলো জোগাড় করতে রেকর্ডরুমে গেছে। সেটাই সকালে ক্যাথির প্রথম কাজ, যাতে অ্যাপয়েন্টমেন্টের আগেই ডাক্তারদের কাছে পেশেন্টদের রেকর্ডগুলো সব রেডি থাকে। ক্যাথিকে খুঁজতে খুঁজতে লুসি সেখানে এসে হাজির। বোঝাই যাচ্ছে বেশ উত্তেজিত।

ক্যাথিকে জিজ্ঞেস করল, “তুমি কি জানো, মিন্ডি আজ রাতের বাসে এখান থেকে চলে যাচ্ছে?”

“না তো! কী ব্যাপার?”

“ওকে আর টমকে জড়িয়ে নানা রকমের কুৎসা বাইরে রটেছে!”

ক্যাথি পড়ল সংকটে। আমতা আমতা করে বলল, “না, না, সেরকম তো কিছু আমি জানি না।”

ইতিমধ্যে একটা ফোন আসায় তাড়াহুড়ো করে ক্যাথি নিজের ডেস্কের দিকে এগোল। কিন্তু লুসিকে এড়াবে কী করে? ফোনটা ধরে মেসেজ নিয়ে এসে দেখে লুসি তখনও ফাইল ক্যাবিনেটের সামনে ওর আসার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে। ক্যাথি আসতেই লুসি বলল, “ক্যাথি, তুমি আমাদের এত বন্ধু, নিশ্চয় সব জানো। আমায় প্লিজ বলো কী হয়েছে! আমি, টম আর মিন্ডি দু-জনকেই সন্ধ্যায় বাড়িতে ডেকেছি, এই গুজবটা কী করে বন্ধ করা যায় আলোচনা করতে, আর মিন্ডিকে আটকাতে। ‘

লুসি এত ইমোশানাল হয়ে আছে দেখে ক্যাথি ওকে শান্ত করার চেষ্টা করল। বলল, “ভেবো না, আমি দেখছি। আমিও মিন্ডিকে লাঞ্চের সময় ফোন করব। এর জন্য ও শহর ছাড়বে? সেটা কেমন কথা!” ইত্যাদি, ইত্যাদি।

লুসি বলল, “লাঞ্চের সময় মিন্ডিকে পাবে না, তবে যে-করে হোক আমি ওকে আটকাব। কাল অবশ্যই মিন্ডিকে একটা ফোন কোরো।”

হোল্ডব্রুক সাহেব কিছুক্ষণ নিজের নোটের ওপর চোখ বুলিয়ে চুপ করে রইলেন।

আমরা সবাই প্রায় রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করছি। বললাম, “তারপর?”

“তারপর তো রাতের সেই ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড। গোটা পাঁচেক দমকল ইঞ্জিন লেগেছিল সেটা নেভাতে। কিন্তু কিছুই রক্ষা করা যায়নি। লুসির বাড়ির অংশ পুরোপুরি পুড়ে ছাই। ফায়ার চিফ জনি বেত্তোর লোকেরা লাগল আগুন লাগার কারণ ইনভেস্টিগেট করতে, ইন্সিয়োরেন্সের লোকেরাও তাদের তদন্ত চালাল। আমরা এটাকে আসন অর্থাৎ ইচ্ছকৃতভাবে কেউ আগুন লাগিয়েছে ধরে নিয়ে কাজ শুরু করলাম।

“দুটো পুড়ে ছাই হওয়া বডি উদ্ধার হল। সে দুটো কার হতে পারে একটা ধারণা ইতিমধ্যেই আমাদের ছিল। লুসির সঙ্গে মাঝে মাঝেই রাত কাটাত টম। সেই রাতে টম নিজের বাড়িতে ফেরেনি, ওর পাশের বাড়ির মহিলা জানালেন। অন্যজন নিশ্চয় লুসি, বাড়িটা যার। এর ওপর ভিত্তি করে তো রিপোর্ট লেখা যায় না, ফরেন্সিক এভিডেন্স লাগবে। আর যদি এই দু-জনকে খুন করার জন্য কেউ আগুন জ্বালিয়ে থাকে, তাহলে তারা কে বা কারা? একজন অবভিয়াস ক্যান্ডিডেট হল লুসির বর, র‍্যান্ডো। তার কথা তো আগেই বললাম। আরেক জন যে এই ব্যাপারে জড়িত থাকতে পারে, সে হল মিন্ডি। টম, লুসি, আর মিন্ডি যে একটা লাভ-ট্রায়াঙ্গেলে জড়িয়ে গেছে, সেটা শুধু ক্যাথির কথা নয়, আরও দু-এক জন মেডিক্যাল সেন্টারের কর্মীর বিবৃতিতে স্পষ্ট। আমি নিজে চিন্তা করছিলাম এইভাবে— টম লাস্যময়ী সুন্দরী লুসির প্রতি মোহগ্রস্ত হয়ে পড়েছিল ঠিকই, কিন্তু ওকে সামাল দেওয়াটা সহজ ব্যাপার ছিল না। লুসি ছিল হাই মেন্টেনেন্স পার্সন। লুসির প্রেমে হাবুডুবু খেলেও ওর অর্থের প্রয়োজন মেটানো সাধারণ এক ডেন্টিস্ট টমের পক্ষে ছিল কঠিন। জুয়ো আর লুসি – দুটোকে একসঙ্গে সামাল দিতে টম নিশ্চয় হিমশিম খাচ্ছিল! মিন্ডির ব্যাপারটা আলাদা। মিন্ডি ছিল টমের বেশ কয়েক বছরের লাইফ বোট— বিপদে-আপদে অর্থ জোগাত।”

“একটা কথা স্যার, ডক্টর টম কি বিবাহিত ছিলেন?”

“না, সেটা হলে তো আর্সনের আরেকটা সাসপেক্ট থাকত।”

“ঠিক স্যার।”

“যেটা বলছিলাম— মিন্ডির টাকাপয়সা, আর লুসির দৈহিক আকর্ষণ, এই দুইয়ের ফাঁদে আটকা পড়েছিল টম। লুসি-মিন্ডির দু-নৌকোয় পা দিয়ে ভেসে থাকা ছাড়া টমের আর কোনো উপায় ছিল না! টম আর মিন্ডি দু-জনেই খুব সাবধানে ওদের সম্পর্ক লুকিয়ে রেখেছিল। হঠাৎ করে জানাজানি হয়ে যাওয়ার লজ্জাটা মিন্ডি নিতে পারেনি, তাই সে পালাবার প্ল্যান করেছিল। ওদিকে লুসি সম্পর্কটা জানতে পেরেও মিন্ডিকে আটকাতে চেয়েছিল, তার সবচেয়ে বড়ো কারণ মিন্ডি ওরও এক্সট্রা মানির সোর্স ছিল!”

হোল্ডব্রুক সাহেব আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, হঠাৎ একেনবাবু জিজ্ঞেস করলেন, “আচ্ছা স্যার, ম্যাডাম ক্যাথি কি ম্যাডাম মিন্ডির সঙ্গে পরের দিন যোগাযোগ করেছিলেন?”

“চেষ্টা করেছিল, কিন্তু ধরতে পারেনি। আর অগ্নিকাণ্ডের পরে তদন্তের স্বার্থে আমরাও নানানভাবে ওর খোঁজ করেছি, কিন্তু পাইনি।”

এতক্ষণ আমি কোনো কথা বলিনি। কিন্তু মিন্ডির এই হঠাৎ অদৃশ্য হওয়াটা ঠিক মানতে পারলাম না। হোল্ডব্রুক সাহেবকে জিজ্ঞেস করলাম, “কেউ হঠাৎ করে অদৃশ্য হয়ে যায় কী করে? এদেশে তো মিসিং পার্সন ট্র্যাক করার অনেক কৌশল আছে!”

“তাও তো বছরে ছ-লক্ষ লোক অদৃশ্য হয়। তার মধ্যে নব্বই পার্সেন্টকে অবশ্য পরে পাওয়া যায়, বেশ বড়ো অংশ মৃত অবস্থায়। তবে এর মধ্যে আরও একটা ব্যাপার ঘটেছিল, যার জন্য তদন্তে সেই জোরটা আর ছিল না। ফায়ার চিফ জনি বেত্তো আগুন লাগার আরেকটা সম্ভাবনার কথা বলায় আসনের যুক্তিটা আর তেমন জোরদার রইল না। গ্যাস স্টোভের কন্ট্রোল নবটা ওপেন ছিল। নিশ্চয় বাড়ির কেউ খেয়াল করেনি। আগুন জ্বলুক বা না-জ্বলুক, এটা ডেঞ্জারাস। জ্বলন্ত স্টোভের ওপর কিছু চাপানো না-থাকলে আশেপাশে থাকা কাপড় বা পেপার টাওয়েলে আগুন লেগে যেতে পারে। আর আগুন না জ্বালিয়ে ভুল করে কন্ট্রোল নব খুললে তো আরও ঝামেলা! ঘর যাবে গ্যাসে ভরে, তখন সিগারেটে আগুন লাগাতে গেলে, এমনকী আলো জ্বালানোর সুইচেও যে স্পার্ক হয় তাতেই পুরো ঘরটা দাউদাউ করে জ্বলে উঠবে।

“এই ঘটনার প্রায় দু-বছর বাদে মিন্ডির খোঁজ মিলেছিল টরোন্টোতে। আমার ডিপার্টমেন্টের এক ডিটেকটিভ রুটিন তদন্তে গিয়ে মিন্ডিকে জিজ্ঞাসবাদ করেছিল। মিন্ডির বক্তব্য সে আগুন লাগার আগেই বোল্ডার সিটি ছেড়ে লস এঞ্জেলেস হয়ে নিউ ইয়র্কে আসে। সেখান থেকে ক্যানাডায়। শুধু মুখের কথা নয়, ফ্লাইট রিজার্ভেশন, ইত্যাদি বেশ কিছু কাগজপত্রও তার কাছে ছিল। অর্থাৎ লুসি যে ক্যাথিকে বলেছিল মিন্ডি বোল্ডার সিটি থেকে চলে যাচ্ছে, তাতে কিছুমাত্র ভুল ছিল না। আসন প্রমাণিত হলেও, কোনোমতেই মিন্ডিকে চার্জ করা সম্ভব হত না।”

“এখনও ম্যাডাম মিন্ডি কি টরোন্টোতে?”

“না, এখন ও নিউ ইয়র্কের কোথাও থাকে বলে শুনেছি, ঠিক কোথায় অবশ্য জানি না। আমার সেই জুনিয়র হয়তো জানবে।”

“আপনার সঙ্গে কি ম্যাডাম ক্যাথির কোনো যোগাযোগ আছে?

“মাঝে মাঝে কথাবার্তা হয়। কেন বলুন তো?”

“আমি ওঁকে দুয়েকটা প্রশ্ন করতে চাই। তার থেকেও ভালো হয় স্যার, আপনি যদি আমার হয়ে প্রশ্নটা করেন।”

“তা করতে পারি, কিন্তু প্রশ্নটা কী?”

“ম্যাডাম লুসির ঠাকুরদার একটা খাতার প্রসঙ্গে। মিস্টার র‍্যান্ডো সেটা চুরি করেছেন বলে অভিযোগ করা হয়েছে। সেটা কী এমন দামি জিনিস হতে পারে আমার মাথায় ঢুকছে না!”

“ঠাকুরদার খাতা!” হোল্ডব্রুক সাহেব কনফিউজড মুখে তাকালেন।

আমরা ব্যাপারটা জানি, কিন্তু হোল্ডব্রুক সাহেব ইমেলটা দেখেননি। কনফিউজড হওয়াটাই স্বাভাবিক। প্রমথ ব্যাপারটা বিশদ করে দিল।

“একটা খাতা নিয়ে তিরিশ বছর আগের কোনো কথা কি ক্যাথির মনে থাকবে!” তারপর একটু চুপ করে থেকে বললেন, “থাকতেও পারে। ওর তো আবার হাইপারথাইমেসিয়া সিনড্রোম আছে।”

“সেটা কী স্যার?”

“হাইলি সুপিরিয়র অটোবায়োগ্রাফিক্যাল মেমারি। তদন্তের সময় লুসির ব্যাপারে ওকে যখন প্রশ্ন করেছিলাম এত ডিটেলে সব কিছু বলছিল, আমি অবাকই হয়েছিলাম। তখনই জেনেছিলাম ওর এই স্পেশাল মেমারির কথা। কারও এই বিশেষ স্মরণশক্তি থাকলে অনেক সময় দশ বছর আগে ডিনার খেতে খেতে কার সঙ্গে কী কথা হয়েছিল, সেটাও সে হুবহু বলতে পারে! ক্যাথির এই অস্বাভাবিক ক্ষমতার জন্য, হাইপারথাইমেসিয়া সিনড্রোম-এর ওপর কয়েকটা ন্যাশনাল রিসার্চে ও একজন সাবজেক্ট ছিল।” তারপর ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললেন, “ক্যাথি খুব সকালে ঘুম থেকে ওঠে… দাঁড়ান, ওকে ফোন করছি।”

.

ক্যাথিকে পাওয়া গেল। কিন্তু কিছুই মনে করতে পারলেন না ক্যাথি, না-পারাই স্বাভাবিক। আমরা যখন প্রমথর বানানো দ্বিতীয় প্রস্থের কফি খাচ্ছি, হোল্ডব্রুক সাহবের মোবাইলটা বাজল।

“আরে ক্যাথি, বলো… মনে পড়েছে… আচ্ছা… ঠিক আছে, ওঁকে জানিয়ে দিচ্ছি।”

মোবাইল পকেটে ঢুকিয়ে হোল্ডব্রুক সাহেব একেনবাবুকে বললেন, “ক্যাথি বলল, ওর মনে পড়েছে। সকালে নাতনির সঙ্গে বসে টিভি-তে ‘দ্য উইজার্ড অফ ওজ’ শুরু হতেই মনে পড়েছে। বহু বছর আগে ক্যাথি, মিন্ডি আর লুসি একসঙ্গে ‘রিটার্ন টু ওজ’ সিনেমাটা দেখেছিল। তখন কথায় কথায় মিন্ডি বলেছিল, ওর ঠাকুরদার কাছে শুনেছে অরিজিনাল ‘ওজ-এর লেখক এল. ফ্র্যাঙ্ক বম নাকি বড়োদের জন্যেও অনেকগুলো বই লিখেছিলেন। সেগুলো প্রিন্টিং প্রেস থেকে হারিয়ে যায়।

সেটা শুনে লুসি বলেছিল, ওর ঠাকুরদারও একটা প্রেস ছিল, আর ঠাকুরদা ওর জন্য দুটো খাতা রেখে গিয়েছেন। কিন্তু দুটোই লস এঞ্জেলেসের বাড়িতে ফেলে এসেছে।

মিন্ডি রিচার্ড র‍্যান্ডোকে চিনত। বলেছিল, ‘এখুনি রিচার্ডকে বলো ওগুলো তোমাকে পাঠাতে।’ এইটুকুই ক্যাথির হঠাৎ মনে পড়ল।”

“ভেরি ইন্টারেস্টিং স্যার, ভেরি ইন্টারেস্টিং।”

“বুঝলাম না। কোনটে ইন্টারেস্টিং?”

“জানি না স্যার।”

একেনবাবুর মাথায় কী ঘুরছে ভগবান জানেন! হোল্ডব্রুক সাহেব একটু অবাক হয়ে একেনবাবুর দিকে তাকালেন।

দ্বিতীয় কাপ কফিও ইতিমধ্যে শেষ হয়েছে। মিস্টার হোল্ডব্রুক বললেন, “আমাকে এক জায়গায় যেতে হবে, আর কি কোনো প্রশ্ন আছে?”

“এই মুহূর্তে নেই স্যার, কিন্তু কাল কি পরশু আপনার একটু সময় হবে?”

“নিশ্চয়। তবে কাল নয়, পরশু আমি সারাদিনই ফাঁকা।”

“থ্যাংক ইউ স্যার। থ্যাংক ইউ ভেরি মাচ।”

.

হোল্ডব্রুক সাহেব চলে যেতে-না-যেতেই প্রমথ পড়ল একেনবাবুকে নিয়ে।

“কী একটা বাজে সমস্যা নিয়ে আপনি বেগার খাটছেন! আমি এক বার বলেছি, আবার বলছি, যে-লোকটা আপনাকে অ্যাপয়েন্ট করেছিল, সে ব্যাটা জেলে এবং যথেষ্ট দুশ্চরিত্র লোক। আর আপনি কেন ভাবছেন যদি বারও করতে পারেন ওই মিন্ডি না পিন্ডিই র‍্যান্ডোকে ইমেল পাঠিয়েছিল- র‍্যান্ডোর উকিল বার্ড সাহেব উচ্চবাচ্য না করে আপনাকে বিশ হাজার ডলার দিয়ে দেবেন!”

“বিশ নয় স্যার, তিরিশ।”

“ওই হল, যেটা পাবেন না, সেটা এক মিলিয়ন হলেই-বা সমস্যা কী?”

“আপনি কিন্তু স্যার একটা ইম্পর্টেন্ট পয়েন্ট মিস করছেন।”

“কী?”

“দুটো খাতার কথা।”

“আপনার মুণ্ডু!

।।১১।।

একেনবাবুকে সকাল থেকে পাচ্ছি না। ব্রেকফাস্ট না করেই বেরিয়ে গেছেন। মাথায় কিছু চাপলে ওঁর কাণ্ডজ্ঞান থাকে না। কলেজে আমার ঘরে লাঞ্চের সময় এসে হাজির। দেখে মনে হল বেশ এক্সাইটেড।

“বুঝলেন স্যার, সেদিন ট্রেনে প্রমথবাবু প্রসঙ্গটা না তুললে এই লাইনে চিন্তাই করতাম না।”

“কী প্রসঙ্গ?”

“ওই যে বিখ্যাত লেখকদের হারিয়ে যাওয়া পাণ্ডুলিপির ব্যাপারটা। সকাল থেকে লাইব্রেরিতে ম্যাডাম হেলেনের সঙ্গে ছিলাম। ম্যাডাম হেলেনের মনে হচ্ছে র‍্যান্ডো সাহেবের কাছ থেকে পাওয়া দুটো পাতার হ্যান্ডরাইটিং সম্ভবত এল. ফ্র্যাঙ্ক বম-এর। অরিজিনাল খাতাটা পেলে সেটা নিশ্চিত করে বলতে পারবেন। র‍্যান্ডো সাহেবের অ্যাটর্নি মিস্টার বার্ডকে সেটা জানাতে গিয়ে যা শুনলাম, তাতে মনে হচ্ছে রহস্যটা বেশ ঘন হয়ে উঠেছে। র‍্যান্ডো সাহেবের বাড়িতে আবার কেউ ঢুকে জিনিসপত্র তছনছ করেছে। কয়েক মাস আগেও এক বার বার্গলারির চেষ্টা হয়েছিল, র‍্যান্ডো সাহেবই বলেছিলেন। মনে আছে স্যার?”

“নিশ্চয় আছে।”

“বাড়িতে এখন কেউই থাকে না। র‍্যান্ডো সাহেবের অনুরোধে এক প্রতিবেশী বাড়িটার ওপর নজর রাখতেন, এ ছাড়া একজন ক্লিনিং লেডি মাসে এক বার করে বাড়িটা পরিষ্কার করে যেত। সেই প্রতিবেশী ক-দিন আগে খেয়াল করেন, বাড়ির পেছনের দরজা খোলা। অর্থাৎ বাড়িতে কেউ ঢুকেছিল। র‍্যান্ডো সাহেবকে সেটা জানাবার জন্য ফোন করেন। কিন্তু তিনি তো ইন্ডিয়ার জেলে। দু-দিন চেষ্টা করে ধরতে না পেরে পুলিশকে জানান। পুলিশ এখন খুঁজে বার করার চেষ্টা করছে কী চুরি হয়েছে।”

“আপনি কী ইমপ্লাই করছেন বলুন তো, লোকগুলো সেই খাতা দুটোর খোঁজে এসেছিল?”

“কে জানে স্যার, কিছু চুরি গেছে কিনা সেটাই তো বোঝা যাচ্ছে না, দামি কিছু চুরি যায়নি। ড্রয়ার, ফাইল ক্যাবিনেট, আর ক্লজেটে ঘাঁটাঘাঁটির চিহ্ন। কিন্তু রুপোর দামি কিউরিওর বাক্স, ল্যাপটপ, ড্রেসিং ড্রয়ারে জুয়েলারির বক্স… সবই রয়েছে।”

“জুয়েলারির বক্স?”

“সেটাই তো বার্ড সাহেব বললেন, সম্ভবত ওটা ওঁর আঙ্কলের কাছ থেকে পাওয়া। মোট কথা ভেরি কনফিউজিং! বার্ড সাহেব জানালেন পুলিশের ধারণা এটা পাড়ার কমবয়সি ছেলেদের কীর্তি। কয়েকটা খালি বিয়ারের বোতল পড়েছিল। তার মানে বাড়িতে কয়েক জন ঢুকেছিল লুকিয়ে মদ-ফদ খেতে বা স্রেফ মজা করার লোভে— মাঝে মাঝে এটা নাকি এদেশে ঘটে। হাতের কাছে টাকাকড়ি কিছু পেলে পকেটস্থ করে। ছুটকোছাটকা কিছু চুরিও করে, যেগুলো ‘ইউজড গুড্‌ড্স’ হিসেবে বিক্রি করা যায়। হয়তো তাই।”

“আপনার কি মনে হচ্ছে, পুলিশের ধারণাটা ঠিক নয়?” একেনবাবুর চোখ-মুখ দেখে আমার মনে হল অন্য কিছু ওঁর মাথায় ঘুরছে।

“না, না, স্যার, সেটা বলছি না। তবে কিনা এখানে একটা হাইব্রিড ব্যাপার থাকতে পারে।”

“তার মানে?”

“আরও একটা ইম্পর্টেন্ট খবর পেয়েছি হেলেন ম্যাডামের কাছ থেকে। উনি এল. ফ্র্যাঙ্ক বম সম্পর্কে বেশ কিছু নতুন তথ্য আবিষ্কার করেছেন। বম সাহেব বড়োদের জন্য দুটো বই লিখেছিলেন, ‘আওয়ার ম্যারেড লাইফ,’ আর ‘দ্য মিস্ট্রি অফ বনিতা,’ বা ওরকম কিছু একটা নামে। পাণ্ডুলিপি দুটো প্রিন্টারের কাছে পাঠিয়েছিলেন, কিন্তু তারপর সেগুলোর খোঁজ পাওয়া যায়নি। আসলে উনি খুব অর্থকষ্টের মধ্যে ছিলেন। হতে পারে বই ছাপাতে প্রিন্টার পয়সা চেয়েছিল, উনি সেটা জোগাড় করে উঠতে পারেননি। পাণ্ডুলিপি দুটো পড়েই ছিল প্রিন্টারের অফিসে।”

“আরে, এই কথা তো মিন্ডিও জানতেন! মনে আছে ক্যাথি কী বলেছিলেন সেদিন ওঁর সুপিরিয়র অটোবায়োগ্রাফিক্যাল মেমারি থেকে? এটা যদি লুসির দাদুর রেখে যাওয়া খাতা হয়, তাহলে তো এর মূল্য অপরিসীম! চার-পাঁচ মিলিয়ন তো হবেই।”

“হতে পারে স্যার, কেউ একজন জানেন এই মহামূল্য ম্যানাস্ক্রিপ্টের কথা, আর সেটা হাতাতে কিছু কমবয়সি ছেলেমেয়েদের লাগিয়েছেন। বড়োলোকদের টিন-এজার ছেলেপুলেরা এসব অপরাধ করলে অনেক সময়েই পার পেয়ে যায়। সুতরাং তাদের হাত দিয়ে ওগুলো উদ্ধার করা গেলে তো সোনায় সোহাগা। ম্যানাস্ক্রিপ্ট নিয়ে এলে তাদের হাতে কিছু টাকা ধরিয়ে দেবেন। পরে নিজে সেটা আন্ডার-ওয়ার্ল্ড মার্কেটে বেচে বড়ো রকমের দাঁও মারবেন!”

“দাঁড়ান, দাঁড়ান, এটা আপনার মনে হচ্ছে কেন?”

“কারণ দামি কিছু চুরি হয়নি, কিন্তু ফাইল ক্যাবিনেট, ড্রয়ার, আর ক্লজেট-এর জিনিসপত্র ঘাঁটাঘাঁটি হয়েছে।”

“আপনি কি বলতে চান, এর মধ্যে সেই মিন্ডি না কে, তিনি জড়িত থাকতে পারেন?”

“বিপুলা এ পৃথিবীর কতটুকু জানি স্যার! তবে ম্যানাস্ক্রিপ্ট চুরি করে সেটা বিক্রি করতে হলে পেশাদার ‘আর্ট-চোর’ হতে হবে। স্পেশাল আন্ডারগ্রাউন্ড কনট্যাক্ট না থাকলে এইসব জিনিস বাজারে বিক্রি করা সহজ ব্যাপার নয়।”

“মিন্ডির যে সেই কনট্যাক্ট নেই, তা জানলেন কী করে?”

“ঠিকই বলেছেন স্যার। তবে কিনা আমাদের কাজ ছিল ইমেল যিনি পাঠিয়েছিলেন, সেই মেল বা ম্যাডাম মিন্ডিকে খুঁজে বার করা, ম্যাডাম লুসির দাদুর খাতা খোঁজা তো নয়। ওই নিয়ে ভেবে আর কী হবে!”

।।১২।।

পরের দিন সকাল বেলাতেই হোল্ডব্রুক সাহেব আমাদের অ্যাপার্টমেন্টে এসে হাজির! বুঝলাম একেনবাবুর সঙ্গে আগেই কথা হয়ে গিয়েছিল।

একেনবাবু জিজ্ঞেস করলেন, “কি স্যার, কোনো খোঁজ পেলেন ম্যাডাম মিন্ডির?”

“পেয়েছি। কাল রাতেই আমার সেই জুনিয়র ছেলেটির সঙ্গে কথা হয়েছে। মিন্ডি এখন লং আইল্যান্ডে আছে। ওখানে একটা বার-এর মালিক।”

“বাঃ, তাহলে ওঁর সঙ্গে তো এক বার দেখা করতেই হবে। তবে সত্যি কথা বলতে কী স্যার, জানি না দেখা করে কী করব।”

একেনবাবুর কথার মাথামুণ্ডু নেই। হোল্ডব্রুক সাহেব অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন।

“কারণটা বলি স্যার। র‍্যান্ডো সাহেব এখন ইন্ডিয়ার জেলে, কবে ছাড়া পাবেন কোনো ধারণাই নেই।”

“বলেন কি!”

“হ্যাঁ স্যার, হাওলা… মানে মানি লন্ডারিং কেস!”

“মাই গড! লোকটার সম্পর্কে উঁচু-ধারণা আমার ছিল না, কিন্তু এতটা যে খারাপ আমি ভাবিনি!”

“একটা কথা স্যার, ভুলে যাবার আগে জিজ্ঞেস করি। আপনাদের নেভাডাতে কি ফায়ার ভিক্টিম আইডেন্টিফিকেশনের জন্য ডিএনএ টেস্টিং হত?”

“সবসময় নয়। সাধারণভাবে ফায়ার ভিক্টিম আইডেন্টিফিকেশনের জন্য ওডন্টোলজিক্যাল টেকনিক, মানে ফরেন্সিক ডেন্টিস্ট্রি ব্যবহার করা হত। লাকিলি যদি ডেন্টাল রেকর্ড থাকে, তাহলে সেটা করা যেত। নইলে তো সবসময়েই ঝামেলা।”

“লাকিলি বলছেন কেন স্যার?”

“কারণ ডেন্টাল রেকর্ড শুধু ভিক্টিমের ডাক্তারের অফিসে থাকে— ইউনিভার্সাল কোনো ডেটাবেস নেই। এই জন্যেই ফরেস্ট ফায়ারে অনেক সময়েই চট করে সবাইকে আইডেন্টিফাই করা যায় না।”

“ম্যাডাম লুসি বা ডক্টর টমের ক্ষেত্রে তো সেই ঝামেলা হয়নি।”

“ঠিক।”

.

এইসব কথাবার্তার মধ্যেই স্টুয়ার্ট সাহেবের একটা ফোন। র‍্যান্ডো সাহেবের বাড়ির বার্গলাররা ধরা পড়েছে। আর একেনবাবুর সন্দেহটা ঠিক, ওরা পুরোনো ম্যানাস্ক্রিপ্ট চুরি করতেই এসেছিল। চোরেরা হল পাড়ারই কয়েক জন টিন-এজার। একজন মহিলা ওদের বলেছিলেন, ম্যানাস্ক্রিপ্টটা পেলে পাঁচশো ডলার দেবেন। সেইজন্যেই তিন বন্ধু মিলে এই কীর্তি করেছে। পুলিশ সেই মহিলাকে খুঁজে বার করার চেষ্টা করছে।

একেনবাবুর কথা থেকেই এগুলো বুঝতে পারলাম। একেনবাবু জিজ্ঞেস করলেন, “চুরি করতে পেরেছিল কি স্যার? …তার মানে খুঁজে পায়নি।”

একেনবাবুর মুখ উজ্জ্বল, “স্যার, মনে হয় হোল্ডব্রুক সাহেব ওই মহিলাটিকে চেনেন। উনি এখন আমার এখানেই আছেন। আপনি এলে সবাই মিলে মহিলার সঙ্গে দেখা করতে যেতে পারি।”

ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্ট কী বললেন শুনতে পেলাম না, কিন্তু মিনিট পনেরোর মধ্যেই তিনি সদলবলে এসে হাজির।

একেনবাবু প্রমথ আর আমাকে বললেন, “আপনারা কি ফ্রি স্যার? চলুন না, সবাই মিলেই যাই।”

আমরা তো এক পায়ে খাড়া।

ক্যাপ্টেন বললেন, “একেন্ড্রা, তুমি শিওর এই মহিলাই এর পেছনে আছেন?”

“মনে তো হয় স্যার, তবে আপনি দলবল নিয়ে পেছনে থাকবেন। আমি আগে দু-একটা কথা বলে দেখি, উনি সত্যিই এতে জড়িত কিনা!”

“ঠিক আছে।”

.

আমার গাড়িতে হোল্ডব্রুক সাহেব, প্রমথ, আর একেনবাবু। পেছনে ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্ট আর তাঁর সাঙ্গোপাঙ্গরা। হোল্ডব্রুক সাহেবের কাছে ঠিকানা ছিল। জিপিএস লাগিয়ে পৌঁছোতে কোনো অসুবিধা হল না। জরাজীর্ণ একটা বার-এর ওপরেই মালকিন মিন্ডির বাড়ি। বাড়িতেই ছিলেন। বেল বাজাতে যিনি দরজা খুললেন, তিনিই মনে হয় মিন্ডি। যথেষ্ট বয়স হয়েছে মহিলার। প্রসাধনহীন রুক্ষ মুখ, চোখে-মুখে ক্লান্তির ছাপ। ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলেন, “আপনারা কে? কী ব্যাপার!”

হোল্ডব্রুক সাহেব বললেন, “আমি জ্যাক হোল্ডব্রুক, আপনি আমার অ্যাসিস্ট্যান্টকে চিনবেন, বোল্ডার সিটি, নেভাডা পুলিশের ডিটেকটিভ জনাথন।”

মহিলাটি কেমন যেন হতভম্ব হয়ে মিস্টার হোল্ডব্রুকের দিকে তাকালেন।

“ইনি মিস্টার একেন্ড্রা সেন,” পরিচয় করিয়ে দিলেন হোল্ডব্রুক সাহেব। “উনি আপনাকে দুয়েকটা প্রশ্ন করতে চান।”

“হু ইজ হি?” ভদ্রমহিলা একটু সামলে উঠে প্রশ্ন করলেন।

“আমি একজন ডিটেকটিভ ম্যাডাম, মিস্টার র‍্যান্ডো আমার ক্লায়েন্ট। তাঁকে কি আপনি কয়েকটা ইমেল পাঠিয়েছিলেন? অস্বীকার করবেন না ম্যাডাম, আমরা কিন্তু ইমেল-এর সোর্স ট্রেস করতে পেরেছি।”

একেনবাবু মিথ্যে কথা বলছেন আমি জানি, কিন্তু কথাটা শুনে মহিলাটি একটু থতোমতো খেয়েই বললেন, “যদি পাঠিয়েও থাকি, সো হোয়াট!”

“সেই ইমেল-এ দুটো খাতার কথা ছিল। ক-দিন আগে কয়েক জন টিন এজার সেগুলো চুরি করার জন্য র‍্যান্ডো সাহেবের বাড়িতে গিয়েছিল।”

“আর ইউ ইনসেন!” এবার ভদ্রমহিলা রাগে ফেটে পড়লেন, “তার সঙ্গে আমার সম্পর্ক কী?”

“কারণ ম্যাডাম, সেগুলো ওদের চুরি করতে বলেছিলেন একজন মহিলা।”

“আমিই যে সেই মহিলা, সেটা আপনার মনে হয় কী করে—ওরা কি আমাকে আইডেন্টিফাই করেছে?

“না, ম্যাডাম।”

“তাহলে?”

“আসলে আমি ভাবছিলাম একটা সিনেমার কথা। এই ক-দিন আগে বাংলাদেশের একটা সিনেমা দেখছিলাম। বাংলাদেশের নাম নিশ্চয় আপনি শুনেছেন ম্যাডাম। সেই সিনেমার হিরো ছিল পড়াশুনোয় ফেলমারা এক ফোক্কর ফাঁকিবাজ। সেই ছেলে সুন্দরী হিরোইন টিচারের মন জয় করতে নিজের পুরো চেহারা-চরিত্রই বদলে ফেলল। চোখে-মুখে সেই ছ্যাবলামি বা বজ্জাতি ভাব নেই, তার বদলে হয়ে গেল সিরিয়াস চেহারার এক ভারিক্কি ইন্টেলেকচুয়াল। একই লোক কিন্তু একদম অন্য রকমের মানুষ।”

একেনবাবুর মাথাটা কি গেছে! এর সঙ্গে ইমেল, চুরি, খাতা— এগুলোর সম্পর্ক কী?

“হোয়াট ননসেন্স!” মহিলা ভীষণ রেগে চেঁচিয়ে উঠলেন।

“ননসেন্স নয় ম্যাডাম, আপনি তো মেক-আপের অনেক কোর্স করেছিলেন, আপনি নিশ্চয় বলতে পারবেন কী করে এগুলো করা হয়— মুহূর্তে মুহূর্তে কী করে ছদ্মবেশী হওয়া যায়। আমি নিশ্চিত ওই টিন এজাররা এখন আপনাকে দেখে চিনতেও পারবে না।”

ভদ্রমহিলার মুখ দেখলাম রাগে লাল হয়ে গেছে। হাতটাও থরথর করে কাঁপছে।

একেনবাবুর তাতে ভ্রূক্ষেপ নেই। বললেন, “ম্যাডাম, একটা জিনিস কিন্তু মেক-আপে পালটানো যায় না। সেটা হল নিজের দাঁত। আপনার ডেন্টিস্টের নামটা কী ম্যাডাম?’

“গেট আউট! গেট আউট রাইট নাও। এইভাবে হ্যারাস করার জন্য, আপনাদের দু-জনকেই আমি স্যু করব!”

“অবশ্যই করবেন ম্যাডাম, কিন্তু তার আগে আপনার ডেন্টাল রেকর্ড বোল্ডার সিটির ম্যাডাম লুসির সঙ্গে ম্যাচ করে কিনা, আমরা দেখব। কারণ আপনার অপরাধ কিন্তু শুধু চুরি করানোর চেষ্টা নয়, দু-জন নিরপরাধীকে আগুনে পুড়িয়ে মারা।

.

ঘরে বাজ পড়লেও এরকম এফেক্ট হত না। মহিলা কাঁপতে কাঁপতে সোফায় বসে পড়লেন। ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্টও দলবল নিয়ে ঘরে ঢুকে পড়লেন।

।।১৩।।

একেনবাবুকে জিজ্ঞেস করলাম, “আপনি কখন সন্দেহ করলেন যে লুসিই হচ্ছেন মিন্ডি?”

“মিস্টার র‍্যান্ডো যখন আমাকে ইমেল দুটো দিলেন, পড়ে মনে হল অনেক গোপন খবর সেখানে আছে, যেগুলো একমাত্র ম্যাডাম লুসির পক্ষেই জানা সম্ভব। ম্যাডাম লুসি কাউকে সেগুলো বলতে পারেন ঠিকই, কিন্তু সেই শোনা কথা মনে রেখে এত বছর বাদে মিস্টার র‍্যান্ডোকে কেউ হেনস্থা করবেন বিশ্বাস করা কঠিন! এদিকে লুসি তো মারা গেছেন! তাহলে? তখনই মাথায় এল স্যার, এটা কি সম্ভব যে ম্যাডাম লুসি সত্যি সত্যিই মারা যাননি, যিনি মারা গেছেন তিনি অন্য কেউ? এই প্রশ্নটার উত্তর ধীরে ধীরে স্পষ্ট হতে শুরু হল মিস্টার হোল্ডব্রুকের সঙ্গে পরিচয় হবার পর। উনি যেসব তথ্য দিলেন, তাতে এটা বুঝলাম, ডেন্টিস্ট টম আর ম্যাডাম লুসি দু-জনেই হাইফাই স্টাইলে থেকে টাকা ওড়াতে ভালোবাসতেন। ডক্টর টম খুব একটা চরিত্রবান ছিলেন না। গ্ল্যামারাস ম্যাডাম লুসির প্রতি মোহ থাকলেও টাকার লোভে টম সাহেব অন্য কারও হাতে ধরা দেবেন না, এটা মেনে নেওয়া মুশকিল। বিশেষ করে হাতের কাছেই ছিলেন ম্যাডাম লুসির বন্ধু ম্যাডাম মিন্ডি, পৈতৃক সূত্রে যাঁর অজস্র টাকা। তার ওপর ম্যাডাম মিন্ডি ছিলেন ডক্টর টমের প্রতি অনুরক্ত। সেটা আবছা আবছা সন্দেহ করলেও ম্যাডাম লুসি হঠাৎ করেই জানতে পারলেন ওঁদের দু-জনের সম্পর্ক দৈহিক পর্যায়ে পৌঁছে গেছে।

“ম্যাডাম লুসি বুঝতে পারছিলেন এবার দু-জনকেই উনি হারাবেন। এমনিতেই ম্যাডাম লুসি ছিলেন অত্যন্ত পজেসিভ। ডক্টর টম ওঁর সঙ্গে প্রেম করলেও শেষ পর্যন্ত ম্যাডাম মিন্ডির কাছেই ধরা দেবেন—এই চিন্তা ওঁকে খেপিয়ে তুলল। এটা ঘটা মানে একইসঙ্গে ওঁর বয়ফ্রেন্ড এবং সম্ভবত ওঁর ফাইনান্সের মস্ত বড়ো সোর্স হাতছাড়া হওয়া! কী করে সেটা আটকানো যায় এই চিন্তা থেকেই ম্যাডাম মিন্ডির আইডেন্টিটি চুরি করার ব্রিলিয়ান্ট প্ল্যানটা ওঁর মাথায় আসে। ম্যাডাম মিন্ডি আর ডক্টর টমকে খুন করে ম্যাডাম মিন্ডির আইডেন্টিটিতে তাঁরই ব্যাঙ্কের টাকায় ভবিষ্যৎ জীবন কাটাবেন! খুবই রিস্কি এবং কমপ্লিকেটেড প্ল্যান। এমনভাবে ওঁদের মারতে হবে যাতে বডি থেকে বোঝার উপায় না থাকে যে কার মৃতদেহ। অর্থাৎ বাড়িতে আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে মারা। ফায়ার ভিক্টিমদের আইডেন্টিফিকেশনের একটা উপায় ডেন্টাল রেকর্ড পরীক্ষা করা। হয়তো মিস্টার টমের কাছেই এটা শুনেছিলেন ম্যাডাম লুসি। আর্সন সন্দেহ না করলে ডিএনএ অ্যানালিসিস নিয়ে পুলিশ মাথা ঘামাবে না। এটা করার পর তিনি নিজে ম্যাডাম মিন্ডির মতো চুল কেটে সাজগোজ হাবভাব ইত্যাদি করবেন। নিজে মেক-আপ আর্টিস্টের ট্রেনিং নিয়েছিলেন। তার ওপর সই নকল করতেও অভ্যস্ত। র‍্যান্ডো সাহেবের সই নকল করে যে অথরিটিকে ধোঁকা দিয়েছিলেন, সেটা তো র‍্যান্ডো সাহেবের কথা থেকেই জেনেছি। ম্যাডাম মিন্ডির সঙ্গে বন্ধুত্বের জন্য মিন্ডি ম্যাডামের সোশ্যাল সিকিউরিটি নম্বর, জন্মদিন, জন্মস্থান, ঠিকানা, ইত্যাদি জোগাড় করা ম্যাডাম লুসির পক্ষে মোটেই কঠিন কাজ ছিল না। ওঁর অন্য বন্ধু ক্যাথির কাজের রুটিনও ম্যাডাম লুসির জানা ছিল। তিনি জানতেন ম্যাডাম ক্যাথি সকালে অফিসে গিয়েই রেকর্ডরুম থেকে সেদিনের পেশেন্টদের ফাইলগুলো নিয়ে আসেন ডাক্তারদের জন্য। তাই সকাল বেলাই রেকর্ডরুমে গিয়ে ম্যাডাম ক্যাথিকে জানান যে ম্যাডাম মিন্ডি চলে যাচ্ছেন, কিন্তু উনি ওকে আটকাবেন। এগুলো সবই পার্ট অফ দ্য প্ল্যান। সেই দিনই ডেন্টিস্ট অফিসের রেকর্ডরুমে ম্যাডাম মিন্ডির ডেন্টাল রেকর্ডের সঙ্গে নিজের রেকর্ডের ফোল্ডার পালটাপালটি করে নেন। ম্যাডাম ক্যাথির বয়ানেই ছিল তিনি যখন ফোন ধরতে রেকর্ডরুম থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন ম্যাডাম লুসি সেখানে ছিলেন, অর্থাৎ ফাইল পালটানোর সুযোগ ছিল। ম্যাডাম মিন্ডির কার্ডে লস এঞ্জেলেস-এ যাবার বাস-টিকিট কিনে ম্যাডাম মিন্ডির জন্য একটা অ্যালিবাই খাড়া করলেন। রাতে মিন্ডি ম্যাডামকে বাড়িতে ডেকেছিলেন ম্যাডাম লুসি। ডক্টর টমকেও ডেকেছিলেন। তিনি তো মাঝে মাঝেই রাতে আসতেন। ধরে নিচ্ছি সেখানেই ড্রিঙ্কের মধ্যে হেভি ডোজে ঘুমের ওষুধ বা কিছু মিশিয়ে ডক্টর টম এবং ম্যাডাম মিন্ডিকে খেতে দেন। সেই ওষুধ আর মদের প্রভাবে দু-জনে যখন প্রায় অচেতন, তখন ম্যাডাম মিন্ডির ব্যাগ থেকে টাকাকড়ি, সোশ্যাল সিকিউরিটি কার্ড, ড্রাইভার্স লাইসেন্স, ইত্যাদি হাতিয়ে নেন। ক্রেডিট কার্ডটা আগেই সরিয়েছিলেন বাসের টিকিট কেনার জন্য। তারপর গ্যাস স্টোভ অন করে কাছাকাছি সহজদাহ্য কিছু জিনিসপত্র রেখে বাইরে গিয়ে দরজা লক করে অদৃশ্য হন। আরও অনেক কিছুই নিশ্চয় করতে হয়েছে, কিন্তু মূল সিনারিওটা এই। এখন ক্লার্ক কাউন্টির কাজ হবে পুরো কেসটা খাড়া করা, তবে উনিই যে ম্যাডাম লুসি সেই সত্যটা এড়াতে পারবেন না।”

“আপনার এই এক্সপ্ল্যানেশনে কিন্তু একটা জিনিস মোটেই ক্লিয়ার হল না।” প্রমথ বলে উঠল।

“কী স্যার?”

“এত বছর বাদে লুসি কেন র‍্যান্ডো সাহেবের সঙ্গে ইমেল-এ যোগাযোগ করল?”

“কী মুশকিল, আপনিই তো সেদিন বলে দিলেন কারণটা।”

“আমি!”

“সেদিন যে ট্রেনে নিউ ইয়র্কার-এর লস্ট ম্যানাস্ক্রিপ্টের আর্টিকলটা পড়লেন! আপনিই তো বললেন ওগুলো পাওয়া গেলে লক্ষ লক্ষ ডলারে বিক্রি হবে। আমি পরে খোঁজ নিয়ে দেখলাম ওটা নিয়ে বেশ হইচই হয়েছিল সে সময়ে, মানে মাস চারেক আগে। তখনই নিশ্চয় সেটা ম্যাডাম লুসির নজরে পড়েছিল অথবা ওঁর বার-এ কেউ তা নিয়ে আলোচনা করেছিল। ম্যাডাম লুসির তখনই আবার মনে পড়ে ওঁর ঠাকুরদার খাতা দুটোর কথা। র‍্যান্ডোর কাছে ও দুটো এখনও আছে কি? এ ছাড়া র‍্যান্ডো যে এখন খুবই বড়োলোক- সেটাও নিশ্চয় জানা ছিল। ওঁকে যদি একটু ভয় দেখিয়ে ব্ল্যাকমেল করে কিছু টাকা আদায় করা যায়, মন্দ কি? সেইজন্যেই ওই ছবিগুলোর কথাও তুললেন। যেটা লেগে যায়! আর কী জানেন স্যার, নিশ্চয় ম্যাডাম মিন্ডির ব্যাঙ্কের টাকা ফুরিয়ে আসছিল, আর এই বার-এর ব্যবসায়ও বেশি টাকা আসছিল না। দেখলেন তো বার-এর ভগ্নদশা!”

আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল, “যেমন দেবা, তেমন দেবী!”

প্রমথ বলল, “আরেকটু বুদ্ধি খাটালে উনি একেবারেই ধরা পড়তেন না।”

“সেটা কী স্যার?”

“দাঁতগুলো সব তুলে ফেলে ডেঞ্চার লাগালে।’

“আপনি না স্যার, সত্যি!”

“কেন? কিছু ভুল বললাম?”

“আপনি আর কবে ভুল বলেন স্যার!”

পরিশিষ্ট

এইভাবেই একেনবাবুর কল্যাণে তেত্রিশ বছর আগের একটি হত্যাকাণ্ডের রহস্যের সমাধান হল। যার জন্য এই রহস্য কাহিনির সূত্রপাত, সেই রিচার্ড র‍্যান্ডো অর্থ তছরূপ এবং মানি লন্ডারিং করার অপরাধে এখনও জেলে। তাঁর স্ত্রী ম্যাডাম লুসির কেসও যে-ভাবে এগোচ্ছে, তাঁর কপালেও প্রাণদণ্ড বা দীর্ঘমেয়াদি কারাদণ্ড ঝুলছে। প্রমথর মতে এই কেসে একমাত্র টাকা পিটেছেন একেনবাবু। কড়কড়ে তিরিশ হাজার ডলার! হেলেন জনসন আর হোল্ডব্রুক সাহেবও শুনলাম কিছু পেয়েছেন, যদিও টাকার অঙ্কটা জানি না। আমি আর প্রমথ তো আমাদের যা প্রাপ্য ইতিমধ্যেই হজম করে ফেলেছি— মানে ইন্ডিয়া যাবার ফ্রি ট্রিপ। তবে এই রহস্য উদ্ঘাটনে সঙ্গী ছিলাম বলে একেনবাবু কথা দিয়েছেন রেস্টুরেন্টে ডিনার খাওয়াবেন! কঞ্জুস, কঞ্জুস!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *