ছদ্মবেশী ফুল

ছদ্মবেশী ফুল

হঠাৎ প্রচণ্ড জোরে ল্যাবের অ্যালার্ম বেজে উঠল!

এতক্ষণ ল্যাবরেটরির ভিতরে কোনো আওয়াজ ছিল না৷ অন্যদিনও বিশেষ থাকে না৷ শুধু মাঝেমধ্যে টেস্টটিউবের টুংটাং আর বিকারে জল গরম করার খলবল শব্দ অস্ফুট ভাবে শোনা যায়৷ ভিতরের মানুষগুলো ক্কচিৎ  কদাচিৎ কথা বলে৷ তাদের কথা বলার সময় কোথায়? সবাই সাদা অ্যাপ্রন পরে কাজ করতেই ব্যস্ত!

আজ সকালেও এমন শান্ত পরিবেশ ছিল৷ ল্যাবের মুখ্য বিজ্ঞানী ডঃ হিঙ্গোরানি একটি গোপন আবিষ্কার নিয়ে ব্যস্ত আছেন! ঐ ঘরে সবার প্রবেশ নিষিদ্ধ৷ একমাত্র ডঃ হিঙ্গোরানিই প্রাইভেট পাসওয়ার্ড দিয়ে ও ঘর খুলতে পারেন৷ ব্যাপারটার সাথে ডিফেন্স মিনিস্ট্রি ওতপ্রোত ভাবে জড়িত বলেই এত কড়াকড়ি! এত গোপনীয়তা! নতুন আবিষ্কারটা নিয়ে একাই দিনরাত কাজ করে যাচ্ছেন৷ এমনকি আমাকেও সাহায্য করতে দেননি৷

আজও প্রায় সকাল আটটায় এসে সোজা ঢুকে গেছেন নিজের ল্যাবে৷ আর তাঁর প্রধান অ্যাসিস্ট্যান্ট, ডঃ অনুপম সেন, তথা আমি আমার নিজস্ব কেবিনে বসে কয়েকটা প্রয়োজনীয় রিপোর্ট তৈরি করছি৷

এমন সময়ই অ্যালার্মের পরিত্রাহি চিৎকার! ক্যাঁও…ক্যাঁও করে সমস্ত ল্যাবরেটরিকে চকিত করে তারস্বরে বেজে উঠল!

উপস্থিত সবাই চমকে ওঠে! অ্যালার্ম বাজছে কেন? আওয়াজটা সবচেয়ে বেশি জোরে আসছে ডঃ হিঙ্গোরানির ল্যাব থেকে!

বুকের ভিতরটা প্রায় লাফিয়ে উঠল! কী হল? ডঃ হিঙ্গোরানির কিছু হল না তো! নতুন আবিষ্কারটা ঠিক আছে……?

তখন কিছু বলার বা ভাবার মতো অবস্থা ছিল না৷ সবাই ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়েছে ডঃ হিঙ্গোরানির প্রাইভেট ল্যাবের দিকে! আমার সহযোগী গৌতম উল্টোদিক থেকে পড়িমড়ি করে ছুটে এল৷ বেচারা অ্যালার্মের শব্দে ঘাবড়ে গেছে৷ হাঁপাতে হাঁপাতে এসে কোনোমতে বলে, ‘স্যার…! কি হল? অ্যালার্ম বাজছে…!’

কোনোমতে উত্তর দিই, ‘জানি না৷’

‘ডঃ হিঙ্গোরানি…’ সে ভয়ার্ত ভাবে বলে, ‘ওনার ঘরেই তো অ্যালার্ম বাজছে মনে হয়…’

প্রায় দৌড়তে দৌড়তেই জবাব দিলাম, ‘হ্যাঁ, চলো শিগগিরি…দেখি কি হল…’

অন্যান্য দিন ডক্টরের প্রাইভেট ল্যাবের লোহার দরজা পাসওয়ার্ড সিস্টেমে বন্ধ থাকে! আজও তেমনই থাকার কথা৷ কিন্তু দরজায় হাত রেখেই এক নতুন ট্রেনি গবেষকের ভুরু কুঁচকে গেল৷

‘ডঃ সেন…’ সে একটু ভয় পেয়ে পিছিয়ে এসেছে৷ তার কন্ঠস্বরে বিস্ময়;‘দরজাটা খোলা!’

দরজা খোলা! ভাবাই যায় না! এই দরজা দিনে দুবারই খোলে৷ যখন ডঃ হিঙ্গোরানি ল্যাবে ঢোকেন তখন একবার, আর যখন বেরিয়ে যান স্রেফ তখন! এর মধ্যে ল্যাবের দরজা কোনোমতেই খোলা সম্ভব নয়! এ দরজা শুধু পাসওয়ার্ডে খোলে৷

আর পাসওয়ার্ড ডক্টর নিজে ছাড়া আর কেউ জানে না!

কিছু গোলমাল হয়েছে…কী ঘটেছে জানি না…কিন্তু সেই মুহূর্তে একটা ভীষণ অমঙ্গলের ছায়া সবার মুখেই ছাপ ফেলে সরে সরে যাচ্ছিল৷

‘ডঃ সেন…স্যার, আপনি দেখুন৷’ গৌতম ফিসফিস করে বলে, ‘আমি সাহস পাচ্ছি না!’

সাহস তো আমিও পাচ্ছিলাম না! দরজাটা খোলা দেখেই ভয়ে ঘামছি৷ ভিতরে রয়েছেন ডক্টর আর তাঁর গোপনীয় ও অমূল্য আবিষ্কার! ঘরে ঢুকে কি দেখব সেই আশঙ্কায় কাঁটা হয়ে ছিলাম৷ তবু…কাউকে তো এগোতেই হবে…!

ভিতরে তখনও ফুলদমে এসি চলছে! চিলড এসির স্পর্শে শরীর ছ্যাঁত করে উঠল৷ চতুর্দিকে সারসার সাজানো কেমিক্যালের শিশি৷ কাচের বাক্সে রাখা স্পেসিমেন৷ কোনটা কেমিক্যালে ডোবানো৷ কোনটা আবার এমনিই রাখা!

‘ডঃ হিঙ্গোরানি…ড-ক্ট-র…৷’

কোনো সাড়া নেই! ল্যাবের ভিতরের টিউবটা শুধু দপদপ করে জ্বলার চেষ্টা করছে৷ কিন্তু পুরোপুরি জ্বলছে না৷ থেকে থেকে জ্বলছে নিভছে৷

আমরা গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে গেলাম ভিতরের দিকে৷ ডানদিকে আর বাঁদিকে বইয়ের সেলফ৷ বইগুলো এলোমেলো ভাবে পড়ে! যেন ওগুলোর উপর দিয়ে ঝড় বয়ে গেছে!

অথচ এমন হওয়ার কথাই নয়৷ ডক্টর ভীষণ গোছালো প্রকৃতির৷ বিশেষ করে বইয়ের যত্ন নেওয়ার ব্যাপারে তিনি ভীষণ খুঁতখুঁতে৷ তাঁর ব্যক্তিগত লাইব্রেরির একটু অযত্ন হলেই আমায় পাঁচ কথা শুনিয়ে ছাড়েন৷ কোনো বইয়ের পাতা সামান্য ছেঁড়া দেখলেই সারা অফিস মাথায় তোলেন৷

সেই লোকের ঘরে বইয়ের এই অবস্থা!

‘ডক্টর……ডক্টর হিঙ্গোরানি…স্যা–র…!’

‘অ-নু-প-ম!’

এবার উত্তর এল৷ কিন্তু একদম অস্বাভাবিক উত্তর! ডক্টরের কন্ঠস্বর শুনেই বুঝেছিলাম কিছু একটা হয়েছে৷ আরেকটু এগিয়ে যেতেই যা চোখে পড়ল তা দেখে আঁতকে উঠি……

ডক্টর প্রায় বেহুঁশের মতন পড়ে আছেন মাটিতে৷ মাথা ফেটে গলগল করে রক্ত পড়ছে৷…

‘স্যার…স্যার…৷’

ব্যাকুল হয়ে তাঁকে ধরে কোনোমতে তোলার চেষ্টা করি৷ ডক্টর নির্জীবের মতো আমার বুকের উপর এলিয়ে পড়লেন৷ প্রায় সর্বহারার মতো আঙুল তুলে সামনের কাচের বাক্সটা নির্দেশ করলেন, ‘ঐ দ্যাখো!’

কী সর্বনাশ! বাক্সটা ফাঁকা! সেখানে ক্যামোফ্লেজিয়া নেই!

.

‘ক্যামোফ্লেজিয়া মিসিং? হাউ ক্যান ইটস পসিবল?’

মন্ত্রীর ভুরু দুটো ঠিক শুঁয়োপোকার মতন দেখাচ্ছিল! মুখে চিন্তার ছাপ প্রকট৷

‘আমি জানি না৷’ ক্লান্ত স্বরে বলছিলেন ডঃ হিঙ্গোরানি৷ মাথায় তিনটে স্টিচ নিয়ে তাঁকে আরও ক্লান্ত দেখাচ্ছিল৷ ব্যান্ডেজ করা কপালে হাত রেখে চুপ করে বসেছিলেন৷

‘কীভাবে এরকম হয়? এরকম গুরুত্বপূর্ণ একটা আবিষ্কার!’ রেগে গিয়ে বললেন মন্ত্রী, ‘আপনাদের সুরক্ষাপ্রণালীই কাঁচা! এবার আমি উপরমহলকে কী জবাব দেব?’

অনেক যুক্তি দিয়েও কিছুতেই তাঁকে বোঝানো গেল না যে ক্যামোফ্লেজিয়াকে যথেষ্ট কড়া নজরেই রাখা হয়েছিল৷ ডঃ হিঙ্গোরানির সুরক্ষা ব্যবস্থা প্রায় নিশ্ছিদ্রই বলা যায়৷ তা সত্ত্বেও দুষ্কৃতী কোথা দিয়ে ঢুকল তা বুঝতে পারছি না কেউই!

‘এরকম একটা গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার!’ তিনি আরও চটে গিয়ে বলেন, ‘ডিফেন্স মিনিস্ট্রি কয়েক কোটি টাকা ঢেলেছে এটার পিছনে৷ ডঃ হিঙ্গোরানি, আপনার কাছ থেকে এটা আশা করিনি৷’

‘হ্যাং ইওর কয়েক কোটি টাকা!’ এবার ডক্টরের ধৈর্যও জবাব দিয়েছে,‘আপনি কয়েক কোটি টাকা দেখছেন? কয়েক কোটি মানুষের কথা ভাবছেন না? ওটা কোনো সাধারণ জিনিস নয়৷ দ্যাট ইজ আ মার্ডার ওয়েপন৷ আ ভেরি ডেঞ্জারাস ব্লাডি মার্ডার ওয়েপন…এত কোটির দেশে সেটা একবার বাইরে পড়লে কেউ বাঁচবে না৷ নট আ সিঙ্গল ওয়ান……বুঝেছেন?’

মন্ত্রী কটমট করে ডক্টরের দিকে তাকাচ্ছেন, ‘জানি৷ তাই তদন্ত দরকার৷ এভাবে ওটাকে বাইরে ছেড়ে দিতে পারি না আমরা৷ এ চোর জানে যে জিনিসটা কোথায় রাখা ছিল৷ আপনার পাসওয়ার্ড ভেঙে সে ঘরে ঢুকেছে, অথচ এখানকার কোনো স্টাফ, সিকিউরিটি গার্ড কোনো অপরিচিত ব্যক্তিকে ঢুকতে বা বেরোতে দেখেননি৷’

সবাই একসঙ্গে মাথা নাড়ল৷

‘তাহলে সে কোনো বাইরের কেউ নয়৷ ঘরেরই লোক৷ এই ল্যাবেরই কোনো কর্মী৷’ মন্ত্রীজি আমাদের সবার দিকে রক্তচক্ষু করে তাকালেন, ‘আপনারই কোনো লোক!’

একেই অমন মারাত্মক জিনিসটা চুরি যাওয়ার আতঙ্ক তো ছিলই৷ তার উপর আবার নতুন আপদ জুটল! সন্দেহ!

ক্যামোফ্লেজিয়া জিনিসটা বারদুয়েক স্বচক্ষে দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার৷ একটা সামান্য ঘাসফুলের মতো দেখতে জিনিসটাকে৷ কেউ দেখলে ভাববেই না যে জিনিসটা অমন মারাত্মক!

ঘাসফুলের একটি প্রজাতির জেনেটিক কোড ব্রেক করে বিশেষ ভাবে ডি এন এ তৈরি করার পর ক্যামোফ্লেজিয়া জন্মেছে৷ মূল ফর্মুলাটা গুপ্ত৷ ডঃ বিবেক টোডি, ডঃ হিঙ্গোরানি ও ডঃ সুকুমার বসু ছাড়া আর কেউ জানে না৷ জিনিসটা তৈরি হওয়ার পর একঝলক দেখেছিলাম৷ সাদা ধবধবে ছোট্ট একটা ফুল৷ ঘাসফুলই বলা যায়৷ কিন্তু তিন বৈজ্ঞানিক বলেছিলেন যে, যতই নিরীহ হোক না কেন—এ ফুল মারাত্মক৷ এ ফুলের গন্ধ এতটাই বিষাক্ত যে একটা ফুলই দশটা মানুষ মারার পক্ষে যথেষ্ট৷ অ্যাকোনিটামের বিষাক্ত ডি এন এ-র সাথে মিলিয়ে যেহেতু তৈরি তাই এর গন্ধে অ্যাকোনাইটের মতো মারাত্মক বিষ আছে! একবার নাকে গেলে রক্ষা নেই৷ কোমা অবধারিত! এবং পরে মৃত্যু৷

ক্যামোফ্লেজিয়ার সবচেয়ে মারাত্মক বৈশিষ্ট্য যে এটি রং পাল্টাতে পারে! এটা কী করে করলেন তিন বৈজ্ঞানিক তা জানা যায়নি৷ কিন্তু ক্যামোফ্লেজিয়ার ডেমোনস্ট্রেশনের সময়েই দেখেছি যে এই ফুলটা অদ্ভুতভাবে রং পাল্টায়!

প্রথমবার যখন দেখি তখনই প্রায় চক্ষু চড়কগাছ হয়ে গিয়েছিল! ভাবতেই পারিনি যে এমনও হতে পারে! ডেমোনস্ট্রেশনের আগেই কনফারেন্স হলে উপস্থিত ছয় দর্শককে গ্যাস মাস্ক পরিয়ে দেওয়া হয়েছিল,যাতে নাকে গন্ধ না যায়! সেই ছ’জনের মধ্যে আমিও ছিলাম৷ বাকি পাঁচজন ডিফেন্স মিনিস্ট্রির হোমরাচোমরা৷

দর্শকাসনে বসেই বিস্ফারিত চোখে দেখলাম ডঃ হিঙ্গোরানি একটা গিনিপিগের বাক্সে ক্যামোফ্লেজিয়া রেখে দিলেন! এক মিনিটও লাগল না! গিনিপিগগুলো পটাপট মরে গেল!

শুধু এইটুকুই নয়, ডক্টর ফুলটা হাতে তুলে নিয়ে তার পেছনে একের পর এক রঙের জিনিস রাখতে লাগলেন৷ কখনও ব্যাকগ্রাউন্ডে কালো, কখনও নীল, কখনও লাল!

আমরা বোকার মতো হাঁ করে দেখলাম ব্যাকগ্রাউন্ডের সাথে মিলিয়ে মিলিয়ে রং পাল্টাচ্ছে ক্যামোফ্লেজিয়া! একদম মিশে যাচ্ছে পেছনের জিনিসটার সাথে!

এ এক অদ্ভুত অস্ত্র৷ একরাশ যে-কোনো ফুল, গাছ বা অন্যকিছুর মধ্যে একটা রেখে দিলে সেটাকে কেউ আলাদা করে চিনতেই পারবে না৷ রং পালটিয়ে সে মিশে যাবে পিছনের বস্তুটির সাথে৷ এবং সেখান থেকেই বিষ মাখা সুগন্ধ দিয়ে যাবে এই অদৃশ্য ফুল৷ তার সামনে বসে থাকা হতভাগা জীবটি বুঝতেও পারবে না যে কখন তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে ছদ্মবেশী শমন! বোঝার আগেই শেষ!

ডিফেন্স মিনিস্ট্রির লোকেরা উঠে দাঁড়িয়ে অভিনন্দন জানিয়েছিল ডক্টরকে৷ কিন্তু আমি ভয় পেয়েছিলাম! ভেবেছিলাম, এইরকম ভয়ংকর অথচ নিরীহ চেহারার মারণাস্ত্র তৈরি করে কী সর্বনাশই না করলেন ডক্টর! কত নিরীহ মানুষের প্রাণ নেবে এই সাধারণ চেহারার ছদ্মবেশী ফুল, ক্যামোফ্লেজে সিদ্ধহস্ত—ক্যামোফ্লেজিয়া!

কিন্তু ডিফেন্স মিনিস্ট্রির কাছে হস্তান্তরিত হওয়ার আগেই লোপাট হয়ে গেল ক্যামোফ্লেজিয়া৷ সঙ্গে সঙ্গেই গোপনে চলল কড়া তদন্ত৷ আমাদের সবার বাড়ি তোলপাড় করে সার্চ করা হল৷ কিন্তু কারুর বিরুদ্ধেই কিছু পাওয়া গেল না৷

তখন অন্য রাস্তা ধরল প্রতিরক্ষা মন্ত্রক৷ প্রতিটা দূতাবাসে খোঁজ রাখল, সন্দিগ্ধ ব্যক্তিদের ফলো করল৷ সেখানেও কিছুই পাওয়া গেল না৷ শুধু একটা ব্যাপারে আশ্বস্ত হল তারা৷ ক্যামোফ্লেজিয়া যে চুরি করেছে, সে সেটা অন্য কোনো দেশকে বিক্রি করার জন্য চুরি করেনি৷ হয়তো তার অন্য কোনো উদ্দেশ্য আছে৷

কিন্তু কী?

.

উদ্দেশ্যটা বুঝতে অবশ্য এক সপ্তাহও সময় লাগল না!

প্রথমেই মারাত্মক কার্ডিয়াক অ্যাটাকে মারা গেলেন ডঃ বিবেক টোডি!

তখনও ব্যাপারটাকে অস্বাভাবিক কিছু মনে হয়নি৷ হূদযন্ত্রের সমস্যায় ভুগছিলেন তিনি৷ বয়েসও হয়েছিল৷ তার উপর ডাক্তারদের বারবার বারণ করা সত্ত্বেও অ্যালকোহলের নেশাকে অতিক্রম করতে পারছিলেন না৷ তাই তাঁর মৃত্যুটা খুব আশ্চর্যজনক কিছু নয়৷ দুঃসংবাদটা শুনে আঘাত পেয়েছিলাম ঠিকই, কিন্তু বিস্মিত হইনি৷

কিন্তু ডঃ সুকুমার বসুও যখন হঠাৎ একদিন তাঁর বাড়িতেই পড়ে গিয়ে অজ্ঞান হয়ে গেলেন, তখন ব্যাপারটা চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়াল৷ ডঃ বসুকে নার্সিংহোমে ভর্তি করা হলে ডাক্তাররা বলল যে তিনি কোমায় আছেন৷ সাইনাস ট্যাকিকার্ডিয়া এবং সঙ্গে ভয়ানক ভেন্ট্রিকুলার অ্যারিদমিয়াস!

এই সবগুলো লক্ষণ শুনেই বুকের ভিতরটা কেমন কেমন করতে লাগল৷ এর সবক’টাই অ্যাকোনিটামের লক্ষণ! মন বলতে লাগল, এ ঠিক সমাপতন নয়! এর পিছনে গুরুতর কোনো চক্রান্ত আছে৷ ক্যামোফ্লেজিয়ায় অ্যাকোনিটামের পার্সেন্টেজ যথেষ্ট!

প্রথম মৃত্যুটাকেও তখন আর স্বাভাবিক বলে মনে হচ্ছিল না আমাদের৷ ডঃ বিবেক টোডি ও ডঃ বসু; দুজনেই এমন মারাত্মকভাবে হূদযন্ত্রের অসুখে আক্রান্ত হলেন! তাও মাত্র তিনদিনের ব্যবধানে! কী করে হতে পারে? এ কি নিতান্তই কাকতালীয়? না অন্য কিছু? দুজনেই ক্যামোফ্লেজিয়ার আবিষ্কারে যুক্ত ছিলেন৷ এই দুজন আর ডঃ হিঙ্গোরানি; এই তিনজনই তার জন্মদাতা৷ মূল ফর্মুলাটা এঁরাই জানেন৷ তারপর আর কেউ যদি সামান্য কিছুও জেনে থাকে, সে আমি! প্রথম তিনজনকে সরিয়ে দিতে পারলে এই মারাত্মক অস্ত্রটি দ্বিতীয়বার আর আবিষ্কৃত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না৷ সেক্ষেত্রে যে চুরি করেছে, তার কাছে ছাড়া আর কোথাও পাওয়া যাবে না ক্যামোফ্লেজিয়ার নমুনা! সমস্ত বৈদেশিক শক্তি, তার সাথে ভারতও টাকার থলে নিয়ে তার পেছনে অসহায়ের মতো ছুটবে৷

বেশ বুঝতে পারছি যে এ আমাদের মধ্যেই কারুর কীর্তি৷ কিন্তু কে? কে হতে পারে? এখানে প্রথম তিনজনের পরই আমার স্থান৷ আমি নই৷ তবে? গৌতম…?

কয়েকদিন গৌতমকে খুব চোখে চোখে রাখলাম৷ কিন্তু তেমন কিছুই চোখে পড়ল না৷ সে স্বাভাবিক ভাবেই কাজ করছে৷ এবং যতদূর জানি এতবড় দুঃসাহসিক কাজ করার সাধ্যও তার নেই৷ সত্যি বলতে, এ অফিসের কারুর আদৌ আছে কিনা সন্দেহ!

তবু কেন জানি না কাউকেই বিশ্বাস করতে পারছি না৷ যাকেই দেখছি, মনে হচ্ছে, এই সে নয় তো!

থাকতে না পেরে একদিন ডঃ হিঙ্গোরানিকে কথাটা বলেই ফেললাম৷ মনে হচ্ছিল স্যারকে সতর্ক করাটা সত্যিই দরকার৷

ডঃ হিঙ্গোরানির টেবিলের উপর একটা ফুলের বোকে রাখা ছিল৷ সম্ভবত গোলাপ ফুলের৷ তিনি আমায় একটা গ্যাস মাস্ক এগিয়ে দিয়ে বলেন, ‘পরে নাও অনুপম, গোলাপের গন্ধে তো তোমার আবার মারাত্মক অ্যালার্জি হয়৷ এইমুহূর্তে তুমিই আমার ডানহাত৷ তুমি অসুস্থ হয়ে পড়লে মুশকিল৷’

গোলাপের গন্ধে সত্যিই আমার ভয়াবহ অ্যালার্জি৷ তাই বিনাবাক্যব্যয়ে গ্যাস মাস্ক পরে নিই৷

‘হ্যাঁ, বলো কী বলছিলে?’

নিজের থিওরি ও সন্দেহের কথা স্পষ্ট করেই বললাম৷ শুনতে শুনতে ভুরু কুঁচকে গেল তাঁর৷ কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে থেমে থেকে বললেন, ‘তোমার সন্দেহ সঠিক কিনা জানি না৷ ডঃ বসু এখনও কোমায়৷ কিন্তু দুজনের ক্ষেত্রেই অ্যাসফিক্সিয়া বা অক্সিজেন ডেফিশিয়েনসির লক্ষণ দেখা গেছে৷ তোমার কথা উড়িয়ে দেওয়া যায় না৷’

‘সেক্ষেত্রে স্যার, আপনার সাবধান হওয়া উচিত৷’

তিনি সরু দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকান, ‘শুধু আমারই নয়, তোমারও সাবধানে থাকা উচিত অনুপম৷’

‘আমি!’ অবাক হয়ে বলি, ‘কিন্তু আমি তো খুব অল্পই জানি এ সম্বন্ধে!’

‘সে তো তুমি আর আমি জানি৷’ ডক্টর শান্তভাবেই বললেন, ‘কিন্তু যার মাথায় একাই ঐ আবিষ্কারের পেটেন্ট নেওয়ার দুর্বুদ্ধি ঘুরছে সে তো জানে না, তুমি আমার মেইন অ্যাসিস্ট্যান্ট৷ ডানহাত যাকে বলে৷ আমার পরে তোমারই তো সব জানার কথা৷ পুরোটা না জানলেও অল্পবিস্তর তো জানোই৷ তোমায় ছেড়ে দেওয়ার ঝুঁকি কি সে নেবে?’

এ কথাটা আগে মাথায় আসেনি৷ ডঃ হিঙ্গোরানি বলার পর মেরুদণ্ড বেয়ে যেন একটা শীতল স্রোত বয়ে গেল৷ সত্যিই তো!

‘এসব নিয়ে মাথা ঘামিও না অনুপম৷’ তিনি সহজ ভাবেই বলেন, ‘এটা স্রেফ একটা কো-ইনসিডেন্স, আই হোপ৷’

আই হোপ; শব্দটার মধ্যে তেমন জোর পাওয়া গেল না!

উনি যত সহজে ব্যাপারটা উড়িয়ে দিলেন, আমি কিন্তু তা পারলাম না৷

ওঁর বলা শেষ কথাগুলো বারবার মনে পড়ে যাচ্ছিল৷ সত্যিই তো! আমাকেও কি ছাড়বে ঐ অজানা আততায়ী? ডঃ টোডি, ডঃ বসু ও ডঃ হিঙ্গোরানির পর তো আমিই একমাত্র মানুষ যে ক্যামোফ্লেজিয়া সম্পর্কে সামান্য হলেও খবর রাখে৷ অন্তত ক্যামোফ্লেজিয়াটা আমি স্বচক্ষে দেখেছি৷ দেখেছি সেটা কীভাবে কাজ করে৷ তার সাথে এও জানি যে জিনিসটার এফেক্ট মানব শরীরে কী হয়, সিম্পটমগুলো ও মিক্সড ভেনামের নামটাও জানি৷

গাড়িতে যেতে যেতেই বারবার কথাগুলো মাথার মধ্যে ঘুরছিল৷ বাড়িতে পৌঁছেও দুশ্চিন্তাটা মাথা থেকে গেল না৷

আমার বাড়িটা বেশ বাংলোবাড়ির মতো করে সাজিয়েছি৷ ছোট্ট সুন্দর লাল টালি বসানো দোতলা বাড়ি৷ লাল টালিগুলো আমারই পছন্দ করে কেনা৷ সামনে ছোট্ট একটা বাগান৷ মালির যত্নে বেশ ঝকঝকে চকচকে হয়ে উঠেছে৷ বোগেনভিলিয়ার ঝাড়ে, নানান বিদেশি ফুল, লতায়, মশে রঙিন হয়ে উঠেছে! ভেলভেটের মতো ঘাসের সবুজ রঙে পান্নার ঔজ্জ্বল্য! দু-দিকে দুটো ঝাউগাছ মালির যত্নে একদম নিখুঁত আকারে রাজার মতো দাঁড়িয়ে রয়েছে৷

রোজ বাড়িতে ঢোকার সময়ে এই বাগানটার দিকে তাকালেই মন ভালো হয়ে যায় আমার৷ কিন্তু আজ………

আজ ভয় হল!

কে বলতে পারে, এই বাগানেই কেউ একটা ক্যামোফ্লেজিয়া রেখে যায়নি! ডক্টর হিঙ্গোরানির কাছে এও শুনেছি যে এই স্পেসিজটা খুব তাড়াতাড়ি বংশবৃদ্ধি করে৷ মাত্র এক সপ্তাহের মধ্যেই সে প্রায় একটা গোটা ব্যাটেলিয়ন তৈরি করে ফেলতে পারে৷ অসম্ভব শক্তিধর এই আবিষ্কার!

কোনোদিন এত খুঁটিয়ে বাগানটাকে দেখিনি৷ আজ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে শুরু করলাম৷ নাগকেশরের ঝাড় রীতিমতো ফুলেফেঁপে উঠেছে৷ পাশে স্পাইনি অ্যাকান্থাস আর ফায়ারস্পাইক ফুটে রয়েছে৷ ইচ্ছে ছিল অ্যান্থোনিয়ামও রাখব গ্লাসহাউস করে৷ কিন্তু ফুলগুলো বাঁচেনি৷

আমার গোলাপের গন্ধে অ্যালার্জি৷ তাই গোলাপের কোনো প্রজাতিকেও রাখিনি৷ এ ছাড়া আরও বিভিন্ন ফুলে, গোলাপি, হলুদে, লালে জমকালো হয়ে উঠেছে আমার বাগান৷

আজ ফুলের সৌন্দর্য দেখার মানসিকতা ছিল না৷ আমার সন্ধানী চোখ আঁতিপাতি করে খুঁজছিল রঙিন ফুলের মধ্যে একটা ছোট্ট বিশেষ ফুলকে৷ রঙের বিষয়ে সঠিক ভাবে বলা মুশকিল৷ হয়তো সে পুরোপুরি বেগুনি হয়ে মিশে গেছে ডেজার্ট পিটুনিয়ার ভিড়ে৷ অথবা গোলাপি হয়ে আইসপ্ল্যান্টের মধ্যে চুপ করে লুকিয়ে বসে আছে৷ কিচ্ছু বলা যায় না…কিচ্ছু বলা যায় না….! ক্যামোফ্লেজিয়ার পক্ষে সবই সম্ভব!

প্রায় গোরুখোঁজা খুঁজতে খুঁজতেই হঠাৎ চোখে পড়ল ঘাসের ফাঁকে ছোট ছোট সাদা ফুল!

ঘাসফুল! না….

টের পেলাম হঠাৎ করেই বুকের ভিতরটা কেমন শুকিয়ে যাচ্ছে৷ এতগুলো ঘাসফুল কবে আমার বাগানে ফুটল? আগেই ফুটেছিল? না এখন……? আজকেই…?

‘প্রতাপ…প্র-তা-প!’

নিজের কণ্ঠস্বরকেই আর তখন চিনতে পারছি না৷ গলা দিয়ে প্রায় আওয়াজ বেরোচ্ছিল না৷ তাই চেঁচিয়ে ডাকতে গিয়ে নিজের কানেই নিজের গলা ভীষণ কর্কশ শোনাল!

আমার তারস্বরে চিৎকার শুনে প্রতাপ প্রায় দৌড়তে দৌড়তে আসে৷ আমায় এইভাবে চেঁচাতে ও আগে কখনও দেখেনি৷ রীতিমতো ঘাবড়ে গিয়েই সে ছুটে এসেছে৷

‘স্যার,…’ সে আমার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায়৷ এত ফুলের ভিড়ে দাঁড়িয়ে তার স্যার কেন অমন আর্তনাদ করছেন তা বোধহয় বুঝে উঠতে পারেনি৷

‘এগুলো কী?’ আমি তখন ঘামছি৷ কোনোমতে আঙুল তুলে ছোট ছোট সাদা ফুলগুলোকে দেখাই৷

সে অবাক, ‘ঘাসফুল স্যার!’

‘ঘাসফুল!’ কী করব ঠিক করতে না পেরে ওর উপরই রেগে যাই, ‘এ বাগানে ঘাসফুল কেন?’

‘স্যার…’ প্রতাপ থতোমতো খেয়ে কিছু বলতে যায়৷ কিন্তু তার আগেই ওকে থামিয়ে দিয়েছি, ‘এখুনি কেটে ফেলো৷ এক্ষুনি…ইমিডিয়েটলি…এখানে আর একটাও ঘাসফুল দেখতে চাই না আমি৷’

ভ্যাবলার মতো কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে সে মাথা নাড়ল৷

‘আর…হ্যাঁ…ওগুলো ছেঁটে ফেলার আগে মুখে মাস্ক পরে নেবে৷ নাকে যেন গন্ধ না যায়৷ বুঝেছ?’

আমি আর ওখানে দাঁড়াই না৷ মোরাম বিছানো পথ দিয়ে বাড়ির দিকে হাঁটতে হাঁটতে দেখি, প্রতাপ কিছুক্ষণের জন্য হাঁ করে দাঁড়িয়ে রইল৷ তারপর এককোণের স্টোররুম থেকে কাটারি নিয়ে এল৷ আমার কথা অবজ্ঞা করেনি৷ গামছা দিয়ে নাক-মুখ পেঁচিয়ে বেঁধেছে৷

স্বস্তির নিঃশ্বাস পড়ল৷ প্রতাপ কী ভাবল কে জানে৷ হয়তো ভাবল স্যারের মাথায় ছিট! যাই ভাবুক৷ ঐ ফুলগুলো তো আর ওখানে থাকবে না!

ঘরের তালা খুলে ভিতরে ঢুকতেই একটা ভ্যাপসা গন্ধ! সবসময় বন্ধ থাকলে যা হয় আর কী! সকালে চাউমিন খেয়ে বেরিয়েছিলাম৷ তার সসের গন্ধ এখনও নাকে ঝাপ্টা মারছে৷

ভীষণ বিরক্ত লাগল৷ আমার কাজের লোক, মদন, এক নম্বরের ফাঁকিবাজ! আমিও বেরিয়েছি, অমনি সেও জানলা-দরজা বন্ধ করে পাড়া ঘুরতে বেরিয়েছে৷ দিনভর খালি এখানে-ওখানে টো টো করে ঘুরে বেড়ায়৷ অবশ্য আমার ফেরার আগেই সচরাচর ফিরে আসে৷

আজ তাড়াতাড়ি চলে এসেছি৷ ফলস্বরূপ মদনের দেখা নেই!

অগত্যা আপনা হাত-জগন্নাথ! প্রথমেই জানলাগুলো সব খুলে দিলাম৷ তাকের উপর রুমফ্রেশনারটা ছিল৷ স্প্রে করতে গিয়ে দেখি ফসফস আওয়াজ হচ্ছে! ওটা শেষ!

এমন সময়ই শেষ হতে হল! বাধ্য হয়েই আমার দামি পারফিউমটা স্প্রে করে দিলাম৷ অন্তত এই অসহ্য ভ্যাপসা গন্ধটা তো যাবে! মনে মনে তখন মদনের পূর্বপুরুষের শ্রাদ্ধ করে চলেছি৷ আশ্চর্য! রুমফ্রেশনারটা যে শেষ হয়ে গেছে, সেটাও তার খেয়াল নেই৷ নতুন কিনে আনা তো দূর! এত টাকা দিয়ে ওকে রেখেছি কেন আমি? পরের বাড়ির ঝিয়ের সাথে গল্পগুজব করার জন্য?

মনে মনে গরম হয়ে উঠি৷ একবার ফিরুক হতভাগা; তারপর ওর হচ্ছে!

ভীষণ খিদে পেয়েছিল৷ তাড়াতাড়ি কোনোমতে গায়ে দু-মগ জল ঢেলে এলাম৷ শরীর আর মাথা তো ঠান্ডা হল৷ কিন্তু পেটের ভিতরে ইঁদুরের রেস চলছে! মদন কখন ফিরবে তার ঠিক নেই৷ তাই নিজের হাত পুড়িয়েই কিছু বানিয়ে নিতে হবে৷ ফ্রিজে হয়তো এক-দু-টুকরো ব্রেড এখনও আছে৷ তার সাথে ডিমের একটা ওমলেট আর চা যথেষ্ট!

রান্নাঘরে ঢুকে বুঝলাম যে কাজটা যতটা সহজ মনে হচ্ছিল, ঠিক ততটা নয়৷ ফ্রিজ থেকে পাঁউরুটি আর ডিম উদ্ধার করা গেলেও চায়ের পাতা, চিনি কোথায় রাখা থাকে কিছুই জানি না! তাকের উপর সারিসারি শিশি৷ তার কোনটায় চিনি, কোনটায় নুন, কোনটায় কি, সেসব সম্পর্কে কোনো জ্ঞানই নেই৷ নিজের কিচেনের চেয়ে বরং ল্যাবরেটরিটা আমার কাছে অনেক বেশি চেনা!

প্রায় অসহায়ের মতোই তন্ন তন্ন করে খুঁজছি সব উপকরণ৷ খুঁজতে খুঁজতেই রান্নাঘরের ঠিক জানলাটার সামনে এলাম৷

ঠিক তখনই……

…একটা অদ্ভুত মিষ্টি গন্ধ নাকে এল!

অদ্ভুত মিষ্টি একটা গন্ধ!…এমন গন্ধ তো আগে কখনও পাইনি! কেমন যেন নেশা ধরানো সুবাস…৷

আমার ইন্দ্রিয়গুলো সব সতর্ক হয়ে উঠল৷ এটা কীসের গন্ধ?…রান্নাঘরের জানলা দিয়ে ফুরফুর করে হাওয়া আসছে৷ তার সাথে সাথেই গন্ধটা ঝাপ্টা মেরে ঢুকে পড়ছে৷ খুব তীব্র নয়…কিন্তু…

ক্যামোফ্লেজিয়ার গন্ধ কেমন তা জানি না৷ ডেমোনস্ট্রেশনের সময়ে নাকে মাস্ক পরেছিলাম৷ কিন্তু শুনেছি গন্ধটা মিষ্টি৷…

গন্ধটা কি এইরকম?…কীসের গন্ধ এটা…?…ক্যামোফ্লেজিয়া…?

‘প্রতাপ…প্র— তা— প!’

প্রায় মৃত্যুভয়েই আর্তচিৎকার করে উঠেছি৷ বুকের ভিতরটা কেমন কেমন করছে৷ একটা বিরাট টারবাইনের মতো ধপ ধপ করে চলছে! ভীষণ রকমের আকুলিবিকুলি! বোধহয় এখনই হার্টফেল করব…আর সময় নেই…সেই মারাত্মক মারণাস্ত্র আজ আমায় শেষ করেই ছাড়বে!

‘স্যার…স্যার…’

প্রতাপ বোধহয় ঘাসফুল পরিষ্কার করতেই ব্যস্ত ছিল৷ চিৎকার শুনে কাটারি হাতেই ব্যস্তসমস্ত হয়ে ছুটে এসেছে৷

‘কী হয়েছে স্যার…?’

ভয়ে গলা কাঁপছে৷ কোনেমতে বললাম, ‘ওটা কীসের গন্ধ?’

প্রতাপ জোরে জোরে বেশ কয়েকবার নিঃশ্বাস নিয়ে গন্ধটা শুঁকল৷ আমি প্রায় দমবন্ধ করে রেখেছি৷ কিছুতেই ওই বিষ নিঃশ্বাস নেব না আমি…কিছুতেই না!

‘ওঃ…’ সে গন্ধটা অনুধাবন করেই হেসে ফেলেছে, ‘এটা তো জুঁই ফুলের গন্ধ৷’

‘জুঁই ফুল!’ ’আমি নিঃসন্দেহ হতে পারি না৷ কে বলতে পারে, ক্যামোফ্লেজিয়ার ডি এন এ গঠনে হয়তো জুঁই ফুলের অবদানও আছে! হয়তো তার গন্ধটা জুঁইফুলের মতোই!

‘জুঁই ফুলের গন্ধ! এখানে জুঁই ফুলের গন্ধ কোথা থেকে আসবে?’

প্রতাপ আমার অবস্থা দেখে অবাক হয়৷ আস্তে আস্তে বলে, ‘আপনার মনে নেই স্যার? আপনিই তো চারাগাছটা নিয়ে এসেছিলেন৷ বাগানে জায়গা ছিল না বলে রান্নাঘরের পিছনেই লাগিয়েছিলাম আমি…’

‘কেটে ফেলো৷’

সে বোধহয় আমার কথার মাথামুন্ডু বুঝতে পারল না৷ কেমন বেকুবের মতো দাঁড়িয়ে আছে৷ বোধহয় বুঝতে পারছে না যে কী করবে৷

‘একদম গোড়া থেকে কেটে ফেলো৷’ আমি জোরালো গলায় বলি, ‘জুঁই ফুলের গাছ চাই না আমার৷ একদম উপড়ে ফেল৷ এই গন্ধ যেন আর আমি না পাই৷’

সে কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে আস্তে আস্তে মাথা নাড়ে৷

‘ঘাসফুলগুলো সব ছেঁটে দিয়েছ?’

‘হ্যাঁ’৷

স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলি; ‘ঠিক আছে…এটাকেও…’

‘ঠিক আছে স্যার৷’

প্রতাপের মুখ বিষণ্ণ৷ বাগানের প্রত্যেকটা ফুল, গাছ তার বড় প্রিয়৷ বড় যত্নে, প্রায় সন্তানের মতো করেই সে বড় করে তুলেছে প্রত্যেকটা গাছ৷ আর আজ তাকেই আমি সেগুলো কেটে ফেলার নির্দেশ দিচ্ছি!

মনে হল ওকে কসাই-এর কাজ দিয়েছি৷ একবার মনে হল ডেকে বারণ করে দিই৷ পরক্ষণেই মনকে বোঝাই…৷ …কেউ বলতে পারে না…কেউ বলতে পারে না…হয়তো এই নিরীহ ফুলের মধ্যেই নিরীহতর মুখ করে বসে আছে ক্যামোফ্লেজিয়া! আমায় শেষ করার মতলবে বিষ সৌরভ ছড়াচ্ছে!

তখনও হাত-পা কাঁপছিল৷ কোনোমতে আবার বসার ঘরে ফিরে আসি৷ আজ আর রান্না করার মতো অবস্থা নেই৷ কোনোমতে শুকনো পাঁউরুটি আর জল খেয়েই চালাতে হবে৷

কিছুক্ষণ বসে থাকার পর মনে হল একটু ধাতস্থ হয়েছি৷ আস্তে আস্তে উঠে ল্যাপটপটাকে নিয়ে এলাম৷ অনেক কাজ পড়ে আছে৷ ডঃ হিঙ্গোরানির জন্য কিছু প্রোজেক্ট রিপোর্ট তৈরি করতে হবে৷ ডক্টর কাজে গাফিলতি একদম বরদাস্ত করেন না৷

ফ্রিজে নতুন একটা হুইস্কির বোতল ছিল৷ আমি সচরাচর খুব টেনসড না হলে ড্রিংক করি না৷ কিন্তু আজ একটা ড্রিংক নিজেই বানিয়ে নিয়েছি৷ যে অবস্থায় আছি তাতে একটু অ্যালকোহল পেটে না পড়লে কাজ হবে না৷

ল্যাপটপে একমনে কাজ করতে করতে মগ্ন হয়ে গিয়েছিলাম৷ কখন যে বাইরে ঘন অন্ধকার নেমে এসেছে তা খেয়াল নেই৷ হুইস্কির প্রভাবে হোক, বা অন্য যে কোনো কারণে, ক্যামোফ্লেজিয়ার কথা মাথা থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল৷ হুঁশ ফিরল মদনের ডাকে—

‘বাবু!’

আগে ভেবেছিলাম ও এলে একচোট বকাবকি করব৷ কিন্তু এখন সে ইচ্ছেটা আর টের পেলাম না৷

‘আপনি আজ তাড়াতাড়ি ফিরেচেন!’ সে একহাত জিভ কাটে, ‘কিচু খাননি নিচ্চই!’

আমি শান্ত গলায় বলি, ‘খেয়েছি৷’

সে আবার জিভ কাটল৷ কার উদ্দেশে কে জানে, ‘রাত্তরে কী খাবেন বাবু’?

‘রুটি কর’৷ একটু ভেবে জবাব দিই, ‘আর ডিম কষা হলেই চলে যাবে৷’

‘আচ্চা৷’ ও চলে যাচ্ছিল৷ আমি পিছন থেকে ডাকি; ‘শোন…’

‘হ্যাঁ বাবু৷’

‘রুমফ্রেশনারটা শেষ হয়ে গেছে৷ দোকান থেকে একটা নিয়ে আসিস’৷

‘অকে…৷’

‘অকে’টা ‘ওকে’-এর মদনীয় সংস্করণ৷ আমাকে প্রায়ই ‘ওকে’ বলতে শোনে৷ সেখান থেকেই রপ্ত করেছে৷

মদন চলে গেল রান্নাঘরে৷ আমি আবার কাজে মন দিলাম৷ প্রোজেক্ট রিপোর্ট শেষ করতে করতেই রাত দশটা বাজল৷ তারপর কয়েকটা ই-মেল পাঠালেই আজকের মতো কাজ শেষ!

ঘড়িতে ঢং ঢং করে দশটার ঘণ্টা পড়ছে৷ আমি প্রায় ল্যাপটপের মধ্যে মাথা গুঁজে ই-মেল টাইপ করছি, ঠিক তখনই মোবাইল ফোনটা তীব্র স্বরে বেজে উঠল৷

একটু বিরক্ত হলাম৷ কাজের সময়ে ফোন বাজলে ভীষণ বিরক্ত লাগে৷ এখনও সাতটা ই-মেল পাঠাতে হবে আমায় দেশ-বিদেশের নানা বিজ্ঞানীকে৷ লম্বা লম্বা বয়ানের চিঠি৷ সময় লাগবে৷ তার উপর একটাও স্পেলিং মিস্টেক হওয়া চলবে না৷ একটা বানান ভুল হলেও ডক্টর আমায় বকাবকি করে আস্ত রাখবেন না৷ যথাসম্ভব সতর্ক হয়ে কাজ করছি৷

এমন সময় কে আবার জ্বালাতে ফোন করল?

প্রথমে ভেবেছিলাম ফোন ধরব না৷ কিন্তু আড়চোখে তাকিয়ে দেখি ফোনের ডিসপ্লে-তে জ্বলছে নিভছে—‘কলিং গৌতম’!

আমার মনে একটা তীব্র আশঙ্কা উন্মত্তের মতো নাচতে শুরু করল৷ গৌতম এখন ফোন করছে কেন? সচরাচর সে খুব একটা ফোন করে না৷ যা কথা হওয়ার তা ল্যাবেই হয়৷ আজও বেরিয়ে আসার আগে ওকে সমস্ত কাজকর্ম বুঝিয়ে দিয়ে এসেছি৷ ডঃ হিঙ্গোরানি ল্যাবে আছেন৷ আমি আজ একটু তাড়াতাড়ি চলে এসেছি বলে ওকে ডিউটিতে থাকতে হয়েছে৷

কিন্তু সে ফোন করছে কেন? আবার কী হল?

তাড়াতাড়ি ফোনটা ধরি—

‘হ্যালো৷’

ওপ্রান্ত থেকে ভেসে এল গৌতমের ভাঙা ভাঙা উত্তেজিত স্বর, ‘স্যার?’

‘বলছি, বলো৷’

ঠিক হাহাকারের মতো শোনাল তার কথাগুলো—

‘ডঃ হিঙ্গোরানি ল্যাবে কাজ করতে করতেই অসুস্থ হয়ে পড়েছেন৷ অসম্ভব ব্রিদিং ট্রাবল৷ নিঃশ্বাস নিতে পারছেন না৷ আমি ওঁকে লাইফকেয়ার নার্সিংহোমে নিয়ে যাচ্ছি৷ আপনি ইমিডিয়েটলি চলে আসুন৷’

আমার ব্রহ্মতালু থেকে পায়ের নখ অবধি যেন বরফ হয়ে গেল! হাতটা ভীষণ অবশ লাগছে৷ ফোনটা ঠক করে হাত থেকে পড়ে গেল মেঝেতে!

ব্রিদিং ট্রাবল….না…আবার ক্যামোফ্লেজিয়া!!!

.

লাইফকেয়ারের আই সি ইউ-তে গভীর কোমায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিলেন ডঃ হিঙ্গোরানি৷ ভেন্টিলেশন চলছে৷ ডাক্তারবাবু প্রথমে ভিতরে কাউকে অ্যালাউ করছিলেন না৷ অনেক কাকুতি-মিনতির পর আমাকে কয়েক মুহূর্তের জন্য কাছে যাওয়ার অনুমতি দিলেন৷

ডঃ হিঙ্গোরানির পাশের বেডটাতেই ডঃ সুকুমার বসু শুয়ে আছেন৷ তিনিও কোমায় আছেন৷ মুখটা বিবর্ণ৷ কেউ যেন ব্লটিং পেপার দিয়ে সমস্ত রং শুষে নিয়েছে৷ চোখ-দুটো আঠা দিয়ে যেন আটকানো৷ অসম্ভব তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ছিল ডঃ বসুর৷ ভারী কাচের চশমার ফাঁক দিয়ে যখন তাকাতেন, তখন মনে হত একেবারে ভিতর অবধি দেখে নিচ্ছেন….

অথচ এই চোখ-দুটো হয়তো আর কখনও খুলবে না৷

আর তাঁর পাশেই ডঃ হিঙ্গোরানি…

অমন দাপুটে মানুষটাকে এত অসহায় আগে আর কখনও মনে হয়নি৷ কী শীতল নিরাপত্তাহীনতায় পড়ে আছেন বিছানায়৷ মুখে মৃত্যুর পাণ্ডুর ছায়া!

কেন জানি না…যদিও আমি…খুব শক্ত…খুব শক্ত মানুষ…আমি আমার বাবার মৃত্যুতেও কাঁদিনি…কিছুতেই আমার চোখে জল আসে না……৷

কিন্তু আজ কেঁদে ফেললাম! ডঃ হিঙ্গোরানির দিকে তাকিয়ে চোখ জলে ভরে এল৷ আর নিজেকে সামলাতে পারি না৷ কোনোমতে আই সি ইউ থেকে টলতে টলতে বেরিয়ে এসেছি৷

গৌতম বাইরেই দাঁড়িয়েছিল৷ আমার অবস্থা দেখে সে ভুলে গেল যে আমি ওর স্যার৷ সঙ্গে সঙ্গে এগিয়ে এসে জড়িয়ে ধরেছে আমাকে৷

‘স্যার…’

ওইটুকু বলারই অপেক্ষা ছিল৷ ওর বুকে মাথা রেখে ছোট শিশুর মতো হাউ হাউ করে কান্নায় ভেঙে পড়লাম৷ ওর চোখেও জল৷ ডঃ হিঙ্গোরানিকে ভালোবাসে না, এমন লোক বোধহয় নেই৷ ভীষণ মেজাজি লোক ঠিকই, কিন্তু দয়ামায়া কাকে বলে তা বোধহয় ওঁর কাছ থেকেই শিখতে হয়৷ কী ছিলাম আমি? কতটুকু ছিলাম? বিজ্ঞানী হওয়ার স্বপ্ন ছিল চোখে৷ কিন্তু সংস্থান ছিল না৷ বাবার সামান্য রোজগারে স্বপ্ন সফল হওয়ার সম্ভাবনাই ছিল না৷ সেইসময় ডঃ হিঙ্গোরানিই আমার হাত ধরেছিলেন৷ ঈশ্বর সকলের জীবনেই একজন না একজন দেবদূত পাঠান৷

আমার সেই দেবদূত এখন আই সি ইউ-তে গভীর কোমায় আচ্ছন্ন হয়ে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছে!

অথচ আমার কিছু করার নেই! কী অসহায় আমি!

গৌতম বিড়বিড় করে যেন আপনমনেই বলে, ‘ফুলের বোকেটার জন্যই এ সর্বনাশ!’

আমি ওর কথাটা ঠিক ধরতে পারি না৷ অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি দেখে সে আবার বলল, ‘আপনি চলে যাওয়ার প্রায় তিনঘণ্টা পরে একটা ফুলের বোকে এসেছিল স্যার৷’

আমার চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে৷ বুঝতে অসুবিধে হল না যে গৌতমের সন্দিগ্ধ ইঙ্গিত কোনদিকে৷

‘ক্যামোফ্লেজিয়া?’

ও আমার দিকে তাকিয়ে সম্মতিসূচক মাথা নাড়ে৷

‘আপনি বুঝতে পারছেন না স্যার?’ ফিসফিস করে বলল গৌতম, ‘পরপর ইনসিডেন্টগুলো দেখুন৷ সবকটা সিম্পটম দেখুন৷ যখন আমি ডঃ হিঙ্গোরানির চিৎকার শুনে ছুটে যাই তখন ওঁর নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল৷ এবং সবচেয়ে বড় কথা যে উনি কনফিউজড হয়ে গিয়েছিলেন৷ নার্সিংহোম শব্দটাও ঠিক মতো বলতে পারছিলেন না৷ একবার জল খেতে চাইছিলেন, কিন্তু যখন জল দিতে গেলাম তখন জলের দিকে এমন করে তাকালেন যেন জিনিসটা কী বুঝতে পারছেন না! এখানে আসার পর ডক্টর বললেন, মেজর কেস অব অ্যাসিস্টল৷ কোনো কার্ডিয়াক ইলেক্ট্রিক্যাল অ্যাকটিভিটি ছিল না তখন৷’

ও চুপ করে থাকে কিছুক্ষণ৷ বলাই বাহুল্য যে এই হার্ট অ্যাটাক, সাইনাস ট্যাকিকার্ডিয়া, ভেন্ট্রিকুলার অ্যারিদমিয়া, কনফিউশন এবং অ্যাসিস্টল; এগুলো সব অ্যাকোনিটামের লক্ষণ! ক্যামোফ্লেজিয়াই যে সব কিছুর মূলে তা বুঝতে আর বাকি রইল না!

‘বোকেটা কে পাঠিয়েছিল জানো?’

‘নাঃ৷’ সে বলে, ‘বোকেটার উপর কোনো নাম ছিল কি না মনে নেই৷ একগুচ্ছ নানা রঙের ফুলের বোকে ছিল শুধু এইটুকু মনে আছে৷ আর যখন ডঃ হিঙ্গোরানি পড়ে গিয়ে ছটফট করছিলেন তখন তাঁর পাশেই পড়েছিল বোকেটা৷’

‘ফাইন৷’ আমি তড়াক করে উঠে দাঁড়াই, ‘চলো গৌতম৷’

‘কোথায়?’

‘অফিসে৷’ অজান্তেই নিজের চোয়াল শক্ত হয়ে উঠেছে, ‘বোকেটা কে পাঠিয়েছে দেখা দরকার৷ লেটস গো৷’

গৌতম প্রথমে একটু কিন্তু কিন্তু করলেও পরে রাজি হয়ে গেল৷ ওর গাড়িতেই ফের আমরা ফিরে গেলাম ল্যাবে৷ ল্যাবরেটরির একটা চাবি সবসময় আমার সাথেই থাকে৷ সুতরাং ভেতরে ঢুকতে কোনো অসুবিধে হয়নি৷

কিন্তু অবাক কাণ্ড! পুরো ল্যাবরেটরি তন্ন তন্ন করে খুঁজেও পাওয়া গেল না বোকেটা! সেটা যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে! যে ঘরে ডক্টর পড়েছিলেন সে ঘর থেকে শুরু করে ডাস্টবিন পর্যন্ত আমরা সব খুঁজে, ঘেঁটে দেখলাম৷ কিন্তু ফুলের তোড়াটা অধরাই থেকে গেল!

অনেকক্ষণ খোঁজার পর যখন আমরা হতক্লান্ত হয়ে রণে ভঙ্গ দিলাম ততক্ষণে প্রায় ভোর হয়ে এসেছে৷ গৌতম রীতিমতো হাঁপাচ্ছে৷ কোনোমতে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল—

‘কেউ সরিয়ে নিয়েছে৷ আমি শিয়োর বোকেটা এখানেই পড়েছিল…কিন্তু কেউ…’

‘কে?’

সে খানিকক্ষণ চুপ করে থাকে৷ কী যেন ভাবছে৷ একটু সময় নিয়ে আবার বলল—

‘একটা কথা মনে হচ্ছিল স্যার৷’

আমি ল্যাবরেটরির টেবিলে রাখা বোতল থেকে জল খেতে খেতে বলি,‘কি?’

‘ডঃ টোডি, ডঃ বসু ও ডঃ হিঙ্গোরানির মতো লোক এতবড় একটা কাঁচা কাজ করলেন কী করে?’

‘মানে?’

‘মানে কোনো অ্যান্টিডোটের বন্দোবস্ত না করেই ক্যামোফ্লেজিয়ার মতো বিষধর জিনিস আবিষ্কার করবেন, এত বড় মূর্খ কি তাঁরা ছিলেন?’

আমি গৌতমের দিকে অপলকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকি৷ এই কথাটা এতক্ষণ আমার মাথায় আসেনি কেন?

কিন্তু অ্যান্টিডোট যদি থাকে তবে সেটা তাঁরা নিজেরা ব্যবহার করেননি কেন?

গৌতমকে কথাটা বলতেই ওর উত্তর—‘হয়তো সুযোগ পাননি৷ বোঝার আগেই বিষ কাজ করতে শুরু করেছে৷’

‘হতে পারে৷’ আমি উত্তেজিত, ‘তাহলে সেক্ষেত্রে তার অ্যান্টিডোট এখানেই থাকবে৷ হয় অ্যান্টিডোট, কিংবা তার ফর্মুলা৷ যতদূর জানি অ্যাকোনিটামের অ্যান্টিডোট হিসাবে নাক্স ভম কিংবা ক্যার ইউজ হয়৷ একবার গোটা ফর্মুলাটা পেয়ে গেলে বানিয়ে নিতেও অসুবিধে হবে না৷…চিয়ার আপ…খোঁজো গৌতম… খোঁজো…৷’

শুরু হল খোঁজাখুঁজি৷ গৌতম আর আমি দুজনেই বুঝতে পারছিলাম যে ক্যামোফ্লেজিয়ার প্রকোপ এরপর আমাদের উপরই পড়বে৷ আমাদের অবস্থাও ডঃ টোডি, ডঃ বসু বা ডঃ হিঙ্গোরানির মতো হবে৷ তাই অ্যান্টিডোট বা তার ফর্মুলাটা পাওয়া আমাদের কাছে জীবন-মরণ সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ দুজনেই মরিয়া হয়ে খুঁজছি! যে কোনো মূল্যেই হোক জিনিসটা পেতেই হবে৷ নয়তো আমাদেরও শেষ করে ছাড়বে ঐ ছদ্মবেশী ঘাতক!

ডঃ হিঙ্গোরানির প্রাইভেট ল্যাব আজ খোলা ছিল৷ উনি অসুস্থ হয়ে পড়ায় এই দরজা বন্ধ হয়নি৷ আর কেউ পাসওয়ার্ড জানত না৷

মনে হল, হয়তো ডক্টর অ্যান্টিডোটটাও ঐ ঘরেই রেখেছেন৷

‘গৌতম, তুমি বাইরেটা খোঁজো৷’ আমি প্রাইভেট ল্যাবের দিকে পা বাড়াই,‘আমি ভিতরটা দেখছি৷’

ল্যাবের ভিতরে সারি সারি শিশিতে নানারকম কেমিক্যাল৷ কোনটা সবুজ, আবার কোনটা বা গোলাপি৷ ছোট ছোট কাচের শিশিতে নানারকম তরল৷ এত শিশি আর বোতলের মাঝখানে দাঁড়িয়ে নিজেকে ভীষণ অসহায় মনে হচ্ছিল৷ এর কোনটায় আমাদের ইপ্সিত বস্তু লুকিয়ে আছে? অ্যান্টিডোট ছাড়া ফুলটা তৈরি হল কী করে? যখন এটা তৈরি হচ্ছিল তখন থেকেই নিশ্চয়ই বিজ্ঞানীরা গ্যাস মাস্ক পরে ছিলেন না৷ ক্যামোফ্লেজিয়ার গন্ধ কখনও না কখনও তাঁদের নাকে গিয়েই থাকবে৷ মনে আছে ডঃ হিঙ্গোরানি বলেছিলেন, ‘গন্ধটা মিষ্টি৷’ যদি গন্ধ তাদের নাকেই না যায় তবে বুঝলেন কী করে যে গন্ধটা মিষ্টি!

দৃঢ় বিশ্বাস হল, তার মানে অ্যান্টিডোট আছে৷ গবেষণা চলাকালীন বিজ্ঞানীরা ফুলের গন্ধও পেয়েছিলেন৷ কিন্তু তখন তাঁদের কিছু হয়নি৷ অ্যাকোনাইট কাজ করতে বেশি সময় নেয় না৷ একঘণ্টা দু-ঘণ্টার মধ্যেই কাম তামাম করে ফেলে৷

সুতরাং তখন তাঁরা নিশ্চয়ই অ্যান্টিডোট নিয়েছিলেন৷ ওটা এখানেই কোথাও আছে৷

কিন্তু কোথায়?

ল্যাবের ভিতরে একটা মস্তবড় ফ্রিজার৷ মাইনাস সিক্স ডিগ্রিতে সেট করা আছে৷ এটাকে মাইনাস ফরটি ডিগ্রি অবধি সেট করা যায়৷ গ্লাভস পরে ফ্রিজারের দরজা খুলতেই হাড় হিম করা ধোঁয়া বেরিয়ে এল৷ সেই ধোঁয়ার ভিতর দিয়ে দেখা যাচ্ছে আরও কিছু ছোট ছোট শিশি৷ গায়ে লেবেল সাঁটা৷ সামনের ব্লকে বড় বড় করে লেখা, ‘অ্যান্টিডোটস’৷

এগুলোই অ্যান্টিডোট! নানান বিষ নিয়ে কাজ করেন ডক্টর৷ তাই প্রত্যেকটা বিষের ওষুধও তৈরি করা থাকে৷ সারসার শিশির মধ্যে আর্সেনিক অ্যান্টিডোট, থ্যালিয়াম অ্যান্টিডোট, সায়ানাইড অ্যান্টিডোট, নিউরোটক্সিন এলডি ফিফটির অ্যান্টিডোট; সবই চোখে পড়ল৷

কিন্তু ক্যামোফ্লেজিয়া নেই!

আশ্চর্য ব্যাপার! ক্যামোফ্লেজিয়ার অ্যান্টিডোট এখানে নেই কেন? তবে কি অন্য কোথাও…?

প্রথমে সবকটা শিশি নামিয়ে নামিয়ে দেখলাম৷…নেই! ল্যাবরেটরি প্রায় তছনছ করে খুঁজছি…৷…নেই!….কাগজপত্র, ফাইল ঘেঁটে দরকারি-অদরকারি কাগজ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে একশা করলাম৷ আমারই তৈরি করা প্রোজেক্ট রিপোর্ট, ডিফেন্স মিনিস্ট্রির চিঠি, ক্যামোফ্লেজিয়ার ইনশিওরেন্স পেপার; সব বেরোল…

কিন্তু ফর্মুলা?

…নেই!

হতক্লান্ত হয়ে মেঝের উপরই বসে পড়েছি৷ আবার ভীষণ কান্না পেয়ে গেল৷ ডঃ হিঙ্গোরানির জন্য নয়৷ নিজের কথা ভেবে! শেষ পর্যন্ত আমাকেও বিষ নিশ্বাস নিয়ে অসহায় গিনিপিগের মতো মরতে হবে! চোখের সামনে দেখলাম—ক্যামোফ্লেজিয়া আমার পিছনে ধাওয়া করছে৷ নীল বিষাক্ত শরীরে আমি……

নাঃ৷ এভাবে, এত সহজে মরব? আমিও বিজ্ঞানী৷ এই কাগজপত্রের মধ্যে আর কিছু না হোক, কোথাও না কোথাও ক্যামোফ্লেজিয়ার ডি এন এ কোড রয়েছে৷ যদি একবারও সেটা পাই, তবে নিজেই তার অ্যান্টিডোট তৈরি করতে পারি৷ শুধু একবার ঠান্ডা মাথায় আমায় কাগজটা দেখতে হবে৷

ফাইলের মধ্যে সমস্ত কাগজপত্র নিয়ে বেরিয়ে এলাম প্রাইভেট ল্যাব থেকে৷ গৌতম ততক্ষণে সমস্ত ডিভিডি, সিডি চালিয়ে দেখে নিয়েছে৷ কম্পিউটার তন্ন তন্ন করে খুঁজে দেখেছে৷ ডঃ টোডি, ডঃ বসু আর ডঃ হিঙ্গোরানির নিজস্ব কম্পিউটার তাঁদের কেবিনেই থাকে৷ সবকটা দেখেছে, এমনকি আমার কম্পিউটারও ছাড়েনি৷ যদি কোনো সিডিতে বা কম্পিউটারে ক্যামোফ্লেজিয়ার প্রেজেন্টেশন থাকে৷ কিংবা তার অ্যান্টিডোটের প্রেজেন্টেশন৷ আজকাল বিজ্ঞানীরা কম্পিউটারেই তাঁদের রেকর্ড বেশি রাখেন৷ তাই সে তাও দেখতে বাকি রাখেনি৷

কিন্তু ডঃ হিঙ্গোরানিকে আমি হাড়ে হাড়ে চিনি৷ তিনি কম্পিউটারে কিছু রাখার লোক নন৷

দেখা গেল আমার চেনাটাই সঠিক৷ গৌতম সব কম্পিউটার ঘেঁটেও কিছু পায়নি৷ হয় সেগুলো কেউ সরিয়ে দিয়েছে৷ নয়তো ডক্টররা কম্পিউটারে জিনিসটা রাখেননি৷

‘এখন কি করব স্যার?’

তার কন্ঠস্বরে হতাশা, ‘কিছুই তো পেলাম না৷—

‘পাওয়া যাবে গৌতম, নিশ্চয়ই পাব আমরা৷’ ওকে সান্ত্বনা দিই, ‘আমি বাড়িতে বসে ঠান্ডা মাথায় এই কাগজপত্রগুলো দেখব৷ আমার দৃঢ় বিশ্বাস এর মধ্যেই কিছু আছে৷ যদি ক্যামোফ্লেজিয়ার ডি এন এ কোডও পেয়ে যাই তবে তা থেকে অ্যান্টিডোট বানিয়ে নিতে পারি৷ শুধু এইমুহূর্তে মাথা ঠান্ডা রাখা দরকার৷’

সে ক্লান্তভাবে মাথা নাড়ে৷

‘এখন তুমি বাড়ি যাও৷’ আমি আস্তে আস্তে বললাম, ‘সকাল দশটার আগে তো ভিজিট করতে দেবে না৷ আমিও আসব৷’

গৌতম সম্মতিসূচক ভাবে মাথা নাড়ল—‘চলুন স্যার, আপনাকে বাড়িতে ড্রপ করে দিই৷’

‘চলো৷’

বাড়ি ফিরতে ফিরতে সকাল সাতটা বাজল৷ সারারাত জেগে, খোঁজাখুঁজি করে দুজনেই ভীষণ অবসন্ন হয়ে পড়েছি৷ বিশ্রাম দরকার৷

আসার পথে আমাদের দুজনের কোনো কথা হয়নি৷ কোনো এক ভয় আমাদের তাড়া করে বেড়াচ্ছিল৷ আমি অন্যমনস্ক ভাবে ফাইলের কাগজ উলটেপালটে দেখছিলাম৷ গৌতম ড্রাইভ করছিল৷ কোনো কথা বলেনি৷ আমাদের অমোঘ আশঙ্কা একটা ভীতিকর পরিস্থিতি তৈরি করেছে৷

আমাকে ড্রপ করার সময়ে গৌতমই প্রথম মুখ খুলল, ‘আমার মনে হয় স্যার, কেউ সব রেকর্ড মুছে দিয়েছে৷ আমাদের মধ্যেই কেউ…আর বোধহয় বাঁচার উপায় নেই৷’

দেখলাম ওর উদভ্রান্ত চোখে জল চিকচিক করছে৷

আমারও মনে এই সন্দেহটা ঘুরছিল৷ কেউ ইচ্ছাকৃত ভাবেই সরিয়ে ফেলেছে অ্যান্টিডোট৷ হয়তো কাগজপত্রও গায়েব করে দিয়েছে!

বুঝতে পারছিলাম না ওকে কি বলব৷ কিছু বলার আগেই সে আবার বলল, ‘আসছি স্যার, সাবধানে থাকবেন৷’

গৌতম চলে গেল৷ আমি নিজের বাড়ির দিকে পা বাড়াই৷ একটু বিশ্রাম দরকার৷ ক্লান্তিতে শরীর ভেঙে আসছে৷ একটু ঘুম……

কিন্তু…এ কী!

বাগানের পাশ দিয়ে যেতে যেতেই চমকে উঠলাম! কাল প্রতাপকে বলেছিলাম ঘাসফুলগুলো ছেঁটে ফেলতে! ওকে কাটারি দিয়ে ঘাসফুল ছাঁটতেও দেখেছি….

তবে ওগুলো কী!…

বাগান আলো করে ঘাসের মধ্যে ছোট ছোট সাদা ফুল শিশির মেখে ঝলমল করছে! কাল সংখ্যায় কম ছিল৷ কিন্তু আজ প্রায় গোটা বাগান জুড়েই…!

মনে হল ফুলগুলো বোধহয় আমার দিকে তাকিয়ে ব্যঙ্গের হাসি হাসছে! এত তাড়াতাড়ি এত ঘাসফুল কোথা দিয়ে এল! সংখ্যায় প্রচুর! আর সারা বাগানই প্রায় ছেয়ে ফেলেছে! এগুলো কালও ছিল না…৷

ঘাসফুল নয়…এ ঘাসফুল হতেই পারে না!

মুহূর্তের মধ্যে সিদ্ধান্ত নিলাম৷ পুরো বাগানের ঘাসই উপড়ে ফেলব৷ ঘাস কাটার মেশিনটা আছে স্টোররুমে৷ ওটা দিয়েই নিকেশ করবো রক্তবীজের বংশধরদের৷ ঘাসও থাকবে না…ঘাসফুলও নয়!

আজ আর প্রতাপকে ডাকলাম না৷ এ কাজ নিজের হাতেই করা ফেলা ভালো৷ ওকেও বিশ্বাস করতে পারছি না৷ আমিই দেখে নেব…!

গ্রাস কাটার চলতে শুরু করল৷

চোখের সামনে দেখলাম ঘাসের গোড়া থেকে উপড়ে যাচ্ছে৷ সাদা ছোট ছোট ফুলগুলো নেতিয়ে পড়ছে ছিন্নমূল হয়ে৷ নাক আগেই ঢেকে নিয়েছিলাম৷ তাই গন্ধ পাওয়ার সম্ভাবনাই ছিল না৷ ঘাস কাটতে কাটতেই একটা পৈশাচিক আনন্দ টের পাই৷ যেন আমার মাথায় দানব ভর করেছে৷ সব কেটে ফেলব…সব শেষ করব…সবকটাকে যমের দোরে পাঠাব৷

দেখতে দেখতে গোটা বাগান সাফ হয়ে গেল৷ ঘাসগুলো বিধ্বস্ত হয়ে উপড়ে পড়ে আছে! তার সাথে ঘাসফুলও!

হিংস্র আনন্দে তাকিয়ে দেখলাম আমার বাগান ন্যাড়া হয়ে গেছে! বিবর্ণ হয়ে গেছে! প্রতাপ ঘুম থেকে উঠে বাইরে বেরিয়ে এসে দৃশ্য দেখে আঁতকে উঠেছে! বাগানে কোনো ঘাস নেই! সে পাগলের মতো ছুটে আসে৷ প্রায় হাহাকার করে ওঠে—

‘স্যার…একী করছেন!’

আমি রক্তচোখে ওর দিকে তাকাই৷ নির্ঘুম এক রাত কাটিয়ে, দুশ্চিন্তায় চেহারাটা উন্মাদের মতো লাগছিল৷ লাল চোখ, উস্কোখুস্কো চুল, মুখে না কামানো দাড়ি! ও বোধহয় এই রূপ দেখে ঘাবড়ে গেল৷ কিছু বলতে গিয়েও থেমে যায়৷

আশেপাশে তাকিয়ে দেখি, ছোট ছোট ফুলের ঝাড় জ্বল জ্বল করছে৷ এত ছোট ছোট নানা রঙের ফুল কবে এল আমার বাগানে! একেবারে গাছ আলো করে থোকায় থোকায় ফুটে আছে৷

মনের ভিতরের সন্দেহ আর আশঙ্কা একসাথে দানবের মতো দাপাতে শুরু করে৷

ওগুলো কী? কী?…কী?

বলা যায় না…কিচ্ছু বলা যায় না…ও ফুল যেকোনো জায়গায়, যেকোনো রঙে ছদ্মবেশে ফুটে থাকতে পারে৷

নাঃ, ফুল চাই না আমি…এ বাগানে কোনো ফুল থাকবে না…কোনো ফুল…কোনো গাছ নয়! বরং বাগানটাই দরকার নেই! বাগানটাই থাকবে না…ওড়াও…সব উড়িয়ে দাও…কিচ্ছু দরকার নেই!…নিজের প্রাণের চেয়ে বেশি কিছু না…কোনো সৌন্দর্য, কোন সৌরভ—কিচ্ছু না!

ধ্বংস হোক…ধ্বংস হোক সব…

প্রতাপকে দিয়ে কাজটা করালাম না৷ বলা যায় না, হয়তো মায়ায় পড়ে একটা-দুটো গাছ রেখে দেবে৷ তাই নিজের হাতেই এক এক করে সব ধ্বংস করলাম৷ আমার বাগান নিমেষের মধ্যে ধ্বংসপ্রাপ্ত হিরোশিমা-নাগাসাকির মতো ধ্বংসস্তূপে পরিণত হল৷ যে গাছগুলোকে নিজেই এনেছিলাম, সাজিয়ে তুলেছিলাম বাগান, সেই গাছগুলোকে নির্মম হাতে তুলে ফেলে দিলাম!

ফুল বড় ভালবাসতাম আমি…

আজ সবচেয়ে বেশি ভয় পাই এই ফুলকেই…ঘেন্না করি…ঘেন্না করি…

.

বিকেলের দিকে ভিজিটিং আওয়ারে আরেকবার দেখে এলাম দুই বৈজ্ঞানিককে৷

অবস্থার উন্নতি কিছুই হয়নি৷ বরং ইনটেনসিভ কেয়ারে ডাক্তারদের ব্যস্ততা দেখে মনে হল আজ বোধহয় দুজনেরই অবস্থা খারাপ৷

আমরা আজ আর ভিতরে ঢোকার অনুমতি পেলাম না৷ বাইরে দাঁড়িয়েই জানলার কাচ দিয়ে দেখলাম মৃত্যুশয্যায় শায়িত দুই বৈজ্ঞানিককে৷

ডঃ হিঙ্গোরানির ছেলে বিদেশে থাকে৷ খবর পেয়েছে, কিন্তু এসে পৌঁছোতে পারেনি৷ ডঃ বসুর স্ত্রী আমার পাশেই দাঁড়িয়ে আছেন৷ কত রাত ঘুমোননি কে জানে৷ চোখের তলায় কালি পড়েছে৷ তাঁর দিকে তাকাতেও পারছিলাম না! কথা বলার সাহসও হল না৷

ডিফেন্স মিনিস্ট্রির একজন হোমরাচোমরা এসেছিলেন আজ৷ গম্ভীর মুখ করে বাইরে থেকেই ব্যাপারটা দেখে গেলেন৷ তাঁর মুখে একটা নিরাশার ছাপ লক্ষ করছিলাম৷ সেটা আবিষ্কারটা হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার জন্য না দুই বিজ্ঞানীর অবস্থা দেখে, কে জানে!

গোটা ভিজিটিং আওয়ারটাই বাইরে দাঁড়িয়ে কেটে গেল৷ বিকেলবেলা ফিরে এলাম বাড়িতে৷ বাগানের জায়গায় এখন মরুভূমির মতো নিষ্ফলা একটুকরো জমি খাঁ খাঁ করছে৷ অন্য সময় হলে বুকের ভিতরটা হু হু করে উঠত৷ কিন্তু আজ আমি নিষ্ঠুর! ভীষণ নিষ্ঠুর!

স্নায়ুর উপর দিয়ে ভীষণ চাপ যাচ্ছিল৷ এক পেগ হুইস্কি তৈরি করতে করতেই অনুভব করলাম…

গোলাপের গন্ধ! সারা ঘরে হাল্কা গোলাপের গন্ধ ছড়িয়ে আছে!…

কিছুক্ষণের জন্য যেন হূৎপিণ্ডটা স্তব্ধ হয়ে গেল…৷ গোলাপের গন্ধ কোথা দিয়ে আসছে? বাগানের ত্রিসীমানায় আগেই কোনো গোলাপ ছিল না৷ এখন তো বাগানটাই নেই! তবে গোলাপ কোথা দিয়ে এল?

হঠাৎই বুঝতে পারলাম শরীরটা খারাপ লাগছে৷ হার্টবিট বেড়ে গেছে! আমার গোলাপের গন্ধে অ্যালার্জি৷

আমার ড্রয়ারে সবসময়ই নেস্ট্রোমিফিন রাখা থাকে৷ অ্যালার্জির ওষুধ৷ ফয়েল থেকে বের করে একটা খেয়ে নিলাম৷ গোলাপের গন্ধটা তাড়ানো দরকার৷ কোথা থেকে আসছে কে জানে৷ জানলা-দরজা বন্ধ করে রুমফ্রেশনার ছড়িয়ে দিই চতুর্দিকে৷ মদন আজ সকালেই এই নতুন রুমফ্রেশনারটা দোকান থেকে নিয়ে এসেছে বোধহয়৷

সব কাজ শেষ করে নিশ্চিন্ত হয়ে ফের কাজে লেগে যাই৷ ল্যাব থেকে আনা কাগজগুলো খুব মন দিয়ে পড়তে শুরু করেছি৷ অদরকারি কাগজপত্রই বেশি৷ ক্যামোফ্লেজিয়ার কয়েক কোটি টাকার ইনশিওরেন্স আছে৷ তার কাগজপত্র, ডিফেন্সের চিঠি, কিছু কেমিক্যাল কেনার রসিদের কপি, অ্যাকোনিটাম কেনার রসিদ….

দেখতে দেখতেই চোখে পড়ল একটা কাগজে কী যেন হিজিবিজি লেখা…

কোনো সন্দেহ নেই যে এটা ডক্টর হিঙ্গোরানির হাতের লেখা৷ তাঁর মতো দুর্বোধ্য হিব্রুর মতো হাতের লেখা আর কারুর নেই৷

কিন্তু এসব কী হিজিবিজি এঁকেছেন! দেখে মনে হচ্ছে একটা প্ল্যানিং৷ ডি এন এ কোডের প্ল্যানিং?

উত্তেজনায় শরীর টানটান হয়ে উঠল৷ এই তবে ক্যামোফ্লেজিয়ার ডি এন এ কোডের ছবি৷ এত খোঁজাখুঁজির পর শেষ পর্যন্ত পাওয়া গেল!

কিন্তু একী! এর মধ্যে অ্যাকোনিটামের ডি এন এ তো দেখছি না৷ বরং কিছু সাপের বিষের সাইকেন দেখা যাচ্ছে! ক্যামোফ্লেজিয়া সাপের বিষে তৈরি! ডক্টর হিঙ্গোরানি কি তবে ভুল বলেছিলেন? বা চেপে গিয়েছিলেন আমাদের কাছে আসল সত্যিটা?

আমি ভালো করে কাগজটা দেখতে চাইছিলাম৷ কিন্তু ক্রমশই শরীরটা কেমন যেন অবসন্ন হয়ে আসছে৷ গোলাপের গন্ধটা আরও তীব্র৷ ভীষণ অসুস্থ মনে হচ্ছে নিজেকে৷ চোখে ঝাপসা দেখছি, বুক ধড়ফড় করছে…

সব দরজা-জানলা বন্ধ! তবে গোলাপের গন্ধ আসছে কোথা দিয়ে! মদন কি ঘরে কোথাও গোলাপ এনে রেখেছে নাকি? আমি হুইস্কির গ্লাসে কয়েকটা উত্তেজিত চুমুক লাগাই, তারপর ফয়েল থেকে আরও কয়েকটা নেস্ট্রোমিফিন বের করে টপাটপ খেয়ে ফেলি৷ অ্যালার্জিটা ক্রমশই বাড়ছে৷ দেখতে হবে গোলাপ কোথায় রাখা আছে৷

অদ্ভুত ব্যাপার; সমস্ত ঘর খুঁজেও কোথাও গোলাপের একটা পাপড়ি তো দূরের কথা, একটা কাঁটাও নজরে এল না! কোত্থাও গোলাপ নেই এ বাড়িতে৷ তবে?

আবার একটা আশঙ্কা মনের মধ্যে চেপে বসল! ক্যামোফ্লেজিয়ার গন্ধ কি তবে গোলাপের মতো! ক্রমশই মনে হচ্ছে বুকের উপর কীসের যেন একটা ভয়ানক চাপ৷ শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে…৷ চোখের সামনে সব ঝাপসা হয়ে আসছে৷

আমি জোরে জোরে শ্বাস নিতে শুরু করি…৷ কিন্তু পারছি না! দেহ অবশ হয়ে আসছে৷ প্রচণ্ড বমি পাচ্ছে, দরদর করে ঘামছি৷

বুঝতে পারছি এ যাত্রা বোধহয় আর বাঁচব না! নার্ভগুলো কাজ করা ছেড়ে দিয়েছে, বুকে ভীষণ কষ্ট! এ ক্যামোফ্লেজিয়ার সিম্পটম! নির্ঘাৎ ক্যামোফ্লেজিয়া…! কিন্তু কোথায়? আমার বাগানে আর কোনো ফুল নেই৷ আশেপাশে কোনো ফুল চোখে পড়েনি৷ ভেবেছিলাম ক্যামোফ্লেজিয়াকে আমি অনেক দূরে ফেলে আসতে পেরেছি….

আঃ…অক্সিজেন…একটু অক্সিজেন…আমি ধড়ফড় করছিলাম একটু অক্সিজেনের জন্য…চোখে আস্তে আস্তে অন্ধকার নেমে আসছে…মৃত্যু যন্ত্রণা কাকে বলে বুঝতে পারছি…বুঝতে পারছি ক্যামোফ্লেজিয়া আমার খুব কাছেই আছে….

জ্ঞান হারাবার আগে শুনতে পেলাম আমার মোবাইল ফোন বাজছে৷ বাজছে আমার খুব প্রিয় রিংটোন…কারেন কার্পেন্টারের গলা—-

‘জাস্ট লাইক মি…দে ওয়ান্ট টু বি…ক্লোজ টু ইউ….’

তারপরই সব অন্ধকার!

.

মনে হচ্ছিল কোথাও একটা ভেসে বেড়াচ্ছি!

না এই জবরজং শরীরটা নিয়ে নয়৷ বরং বেশ সূক্ষ্ম একটা অস্তিত্ব টের পাচ্ছিলাম৷ এত হাল্কা নিজেকে কখনও মনে হয়নি৷ এত মুক্তও নয়৷ অনাবিল অন্ধকারের মধ্যে যেন সাঁতরে বেড়াচ্ছি!

সাঁতরাতে সাঁতরাতেই টের পেলাম যে শরীরটা হঠাৎ করে বড্ড ভারী হয়ে যাচ্ছে৷ আঃ…অন্ধকারের মধ্যে কে আলো জ্বেলে দিল দুম করে? শান্ত নিস্তব্ধতা ভেঙে নানারকম আওয়াজ কানে আসছে৷

দপ করে যেন চোখের সামনে লক্ষ হ্যালোজেন জ্বলে উঠল৷ জন্মযন্ত্রণা যেন দ্বিতীয়বার অনুভব করলাম৷ মনে হচ্ছিল আমি কোনো গহ্বর থেকে বেরিয়ে আসছি; চতুর্দিকে অনেক আওয়াজ, অনেক আলো আমায় কষ্ট দিচ্ছে৷ অনুভূতিগুলো যেন একটা অদ্ভুত পীড়নের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল৷

কোনোমতে চোখ মেলে তাকাই…কে আমায় এমনভাবে বিরক্ত করছে? কেনই বা করছে? দিব্যি তো ছিলাম একা একা! কে…?

আলোর তীব্রতায় কিছুক্ষণের জন্য চোখ বুজে ফেলেছিলাম৷ আবার তাকানোর চেষ্টা করি…এত আলো!…আমি কোথায়?…

‘অ-নু-প-ম!’

কেউ আমার নাম ধরে ডাকছে! আমার মুখের সামনে দুটো ঝুঁকে পড়া উদ্বিগ্ন মুখ!

কে?… চিনতে পারলাম না…সব ঝাপসা…! শরীরটাকে ভীষণ ভারী মনে হচ্ছিল৷ কোনমতে উত্তর দিই; ‘উঁ’৷

‘থ্যাঙ্ক গড! জ্ঞান ফিরেছে!’ কে যেন সোল্লাসে চেঁচিয়ে ওঠে, ‘ওঃ ঈশ্বর…হি ইজ ওকে…হি ইজ গেইনিং সেন্স…’

ভীষণ ঘুম পাচ্ছিল৷ আস্তে আস্তে ঘুমটা যেন আমায় চেপে ধরল৷

আবার অন্ধকার!

কতক্ষণ মড়ার মতো ঘুমিয়েছি জানি না৷ অনেকক্ষণ একটানা ঘুমোনোর পর আস্তে আস্তে হুঁশ ফিরে পেলাম৷ এবার বুঝতে পারি নার্সিংহোমে আছি৷ এটা আই সি ইউ৷ আমার নাক থেকে বোধহয় সদ্যই অক্সিজেন মাস্ক খোলা হয়েছে৷

‘অনুপম, কেমন লাগছে এখন?’

পরিচিত গলার স্বর শুনে ঘাড় ঘুরিয়ে পাশে তাকাই৷ যা দেখি তাতেই চক্ষু চড়কগাছ! আমাকে রাখা হয়েছে ডঃ হিঙ্গোরানি ও ডঃ বসুর নার্সিংহোমেই৷ ইনফ্যাক্ট তাঁদের পাশেই!

বিস্ময়ের কথা এটা নয়৷ যা দেখে চমকে উঠলাম, তা হল;….

উপরোক্ত দুজনই আমার বিছানার পাশে বসে উদ্বিগ্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন আমার দিকে!

বিস্ময়ের পরই অদ্ভুত আনন্দে মন ভরে গেল৷ পারেনি…ক্যামোফ্লেজিয়া এই দুজনকে নিয়ে যেতে পারেনি…ক্যামোফ্লেজিয়া হেরে গেছে…হেরে গেছে…সৃষ্টি স্রষ্টাকে ধ্বংস করতে পারেনি…

আমি প্রায় লাফ মেরে উঠে বসতেই যাচ্ছিলাম, তার আগেই ডঃ হিঙ্গোরানি আমায় ধরে ফেলেছেন৷ সস্নেহে টেনে নিলেন বুকে, ‘ওয়েলকাম ব্যাক অনুপম! যা ভয় দেখিয়েছিলে! সাতদিন ধরে তোমার সেন্স ছিল না৷ এমন কাণ্ড একজন বিজ্ঞানী হয়ে করলে কি করে?’

আমি বলতে গেলাম, ‘ক্যামোফ্লেজিয়া……’

আমাকে থামিয়ে দিয়েই ডঃ বসু বললেন, ‘ক্যামোফ্লেজিয়া নয়৷ তোমার রোজ এসেন্সে অ্যালার্জি৷ তার সাথে প্রচুর নেস্ট্রোমিফিন খাওয়া, এবং লাস্ট বাট নট দ্য লিস্ট সাথে অ্যালকোহল! তুমি একটা বিজ্ঞানী অনুপম! তোমার মনে ছিল না যে নেস্ট্রোমিফিন যতই নিরীহ অ্যালার্জির ওষুধ হোক না কেন, অ্যালকোহলের সাথে মিষলে মারাত্মক বিষ হয়ে দাঁড়ায়? কটা খেয়েছিলে ট্যাবলেট?’

মনে করার চেষ্টা করি—‘চার পাঁচটা হবেই…৷’

ডঃ হিঙ্গোরানি শাসনের ভঙ্গিতে বলেন, ‘তোমার লজ্জা করে না? উপরে যাওয়ার বন্দোবস্ত তো প্রায় পাকাই করে ফেলেছিলে৷ তোমার কাজের লোক মদন ঠিক সময়ে উদ্ধার না করলে কোথায় থাকতে তুমি?’

এরপর তাঁদের মুখ থেকেই শুনি মদন আমায় ঐ অবস্থায় দেখে সঙ্গে সঙ্গে ল্যান্ডফোন থেকে ফোন করে গৌতমকে৷ মদন মোটামুটি এসব কাজ করতে পারে৷ প্রতাপও পারে৷ গৌতমের কথামতো ওরা দুজনেই আমাকে ঐ অবস্থায় এই নার্সিংহোমে নিয়ে আসে৷ এই সাতদিন রোজ দু’বেলা গৌতম এসেছে৷ মদন আমায় দেখতে না পেলেও, আই সি ইউর সামনে থেকে একমুহূর্তও নড়েনি৷ আজ আমার হুঁশ ফিরেছে শুনে মন্দিরে ছুটেছে পুজো দিতে৷

আবেগে চোখে জল এল৷ এরা সবাই আমায় কত ভালোবাসে! অথচ এ ক’দিন আমি শুধু স্বার্থপরের মতো নিজের কথাই ভেবে গেছি…কী স্বার্থপর আমি…!

মনে একটা প্রশ্ন বারবার ফিরে আসছিল৷ থাকতে না পেরে প্রশ্নটা করেই ফেলি—

‘ডক্টর?’

‘বলো৷’

‘গোলাপের গন্ধটা কোথা থেকে এল? আমার ঘরে কোথাও গোলাপ ছিল না৷ বাগান তো আমি নিজেই উড়িয়েছি৷ তবে…?’

‘সেটার উত্তরও মদন তোমার ডাক্তারকে দিয়েছে৷’ ডঃ হিঙ্গোরানি হাসলেন,‘তুমি ওকে রুমফ্রেশনার আনতে দিয়েছিলে৷ ও জানত না যে তোমার রোজ এসেন্সে মারাত্মক অ্যালার্জি৷ বেচারা একটা রোজ এসেন্সের রুমফ্রেশনার এনেছিল৷’

এইবার ব্যাপারটা পরিষ্কার হল৷ ক্যামোফ্লেজিয়া নয়৷ আসল ভিলেন ঐ রুমফ্রেশনার৷ আমি ঘরে ঢোকার আগেই সম্ভবত মদন স্প্রে করে রেখেছিল৷ ঘরে ঢোকামাত্রই ঐ গন্ধটা পেয়েছি৷ গন্ধটা কাটাবার জন্য দরজা-জানলা বন্ধ করে দিয়ে বোকার মতো ঐ রুমফ্রেশনারটাই বারবার স্প্রে করেছিলাম৷ যার জন্য গোলাপের গন্ধ ক্রমশই বাড়ছিল!

আর তার সাথে বাড়ছিল আমার অ্যালার্জি৷

‘অ্যান্ড দেন ফাইভ নেস্ট্রোমিফিনস উইদ অ্যালকোহল৷’ ডঃ হিঙ্গোরানি বললেন, ‘আরেকটু হলেই চ্যাপ্টার ক্লোজড হচ্ছিল তোমার৷ বেঁচে যে আছ এই অনেক৷’

আমি আনন্দে গদগদ হয়ে বলি, ‘স্যার, আপনাদের দেখে যে কী আনন্দ হল কী বলি…৷ আমাদের যে কী অবস্থা হয়েছিল….৷’

‘হ্যাঁ জানি৷’ ডঃ বসু বললেন, ‘তুমি তো একেবারে ভেউভেউ করে কাঁদছিলে৷’

ওঁর কথা শুনে চমকে উঠলাম! উনি জানলেন কী করে? দুজনেই তো কোমায় ছিলেন!

কথাটা বলতেই উত্তর এল, ‘ঘোড়ার ডিম ছিলাম! কিস্যু হয়নি আমাদের৷ স্রেফ অসুস্থতার অ্যাকটিং করে কয়েকটা দিন ছুটিতে কাটাচ্ছিলাম৷’

আমি পুরো হাঁ! তবে? ক্যামোফ্লেজিয়া…? যা ভাবছিলাম…তার সবটাই কী…!

‘ক্যামোফ্লেজিয়া৷’ হেসে ফেললেন ডঃ হিঙ্গোরানি, ‘ক্যামোফ্লেজিয়ার ফর্মুলা শুনবে? বেশ, শোন তাহলে…৷’

এরপর ডক্টর যা বললেন তাতে আমার আরেকবার হার্টফেল করার মতো দশা হল…

ডক্টর হিঙ্গোরানি, ডঃ বসু ও ডঃ টোডি; তিনজনে মিলে গোপনে ক্যান্সারের উপর রিসার্চ করছিলেন৷ ক্যান্সারের ওষুধ বের করার চেষ্টা চলছিল৷ কাজ অনেকটাই গুটিয়ে এসেছে৷ অথচ এক্সপেরিমেন্ট এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য মূলধন অপর্যাপ্ত৷ সরকারি সাহায্য চাইলেন৷ প্রত্যাখ্যাত হল তাঁদের আবেদন৷

এদিকে কাজ এগোনোর জন্য টাকা চাই৷ কী করণীয়?

এই সময়ে ডক্টর টোডির মাথায় এক অদ্ভুত বুদ্ধি জোগাল৷ তিনি বললেন যে, সরকার জীবনদায়ী ওষুধের পিছনে টাকা খরচ করে না৷ কিন্তু মারণাস্ত্রের পেছনে করবে৷ তাই তিনজনে মিলে তৈরি করলেন এই সাইলেন্ট কিলারের পরিকল্পনা! নতুন আবিষ্কারের উদ্দেশ্য নিয়ে নয়, সরকারের কাছ থেকে কিছু টাকা হাতানোর জন্য; যাতে তাঁদের গোপন আবিষ্কারের কাজ ঠিকঠাক চলতে পারে৷

‘তাহলে…আমরা যে দেখলাম…! ক্যামোফ্লেজিয়া শুঁকে গিনিপিগগুলো মরল….?’

ডঃ বসুর সহাস্য উত্তর, ‘ওগুলো রোগেভোগে কষ্ট পাচ্ছিল৷ তাই ভাবলাম মার্সিডেথ দিয়ে দিই৷ ত্রিশ মিলিগ্রাম অ্যাকোনাইট আগেই ওদের শরীরে পুশ করা ছিল৷ একদম সঠিক মাত্রায়, সঠিক টেম্পারেচারে৷ যাতে ঠিক একঘণ্টা পরেই মারা যায়৷ আর ঠিক একঘণ্টা পরেই তোমরা ডেমো দেখেছিলে৷’

আমি হাঁ৷ কী বলব বুঝতে পারছিলাম না৷

‘তবে…তবে রং পাল্টানোর ব্যাপারটা…?’

‘ওটাও প্রযুক্তিবিদ্যার কারিকুরি ডিয়ার৷’ ডঃ হিঙ্গোরানি হাসছেন, ‘যে ডায়াসের উপরে আমি দাঁড়িয়েছিলাম তার ঠিক মাথার উপরই একটা ন্যানো প্রোজেক্টর ছিল৷ সেটা কন্ট্রোল করছিলেন ডঃ বসু৷ আমি সারফেসে যে রং রাখছিলাম উনি ঠিক সেইরকম আলোই প্রোজেক্টরের মাধ্যমে ফুলটার উপরে ফেলছিলেন৷ ওটার অরিজিনাল রং সাদা বলে মনে হচ্ছিল রং পালটে পালটে যাচ্ছে৷’

‘আর ডক্টর টোডি?’

ডঃ হিঙ্গোরানি দীর্ঘশ্বাস ফেলেন, ‘ওনার মৃত্যুটা ওরিজিনাল৷ বড্ড ড্রিংক করছিলেন আজকাল৷ ওটা আমাদের প্ল্যানের মধ্যে ছিল না৷ কথা ছিল আমি কাচের মধ্যে যে ফুলটা ছিল সেটা একদম নষ্ট করে ফেলব, এবং মাথা ফাটিয়ে ক্যামোফ্লেজিয়া চুরি যাওয়ার নাটক করব৷ আর সেটা করতে হবে কয়েকদিনের মধ্যেই৷ কারণ কয়েকদিন পরেই ডিফেন্স ক্যামোফ্লেজিয়া নিয়ে যাবে৷ তার আগেই…’

‘তাহলে ওটাও নাটক!’

‘হ্যাঁ৷’ ডঃ হিঙ্গোরানি বললেন, ‘ভেবেছিলাম যে ডিফেন্স মিনিস্ট্রি হতাশ হয়ে এমন জিনিস দ্বিতীয়বার আর তৈরি করার কথা বলবে না৷ কিন্তু তারা আমাদের উপর চাপ দিতে লাগল দ্বিতীয়বার ক্যামোফ্লেজিয়া তৈরি করার জন্য৷ কী করে এড়ানো যায় তাই ভাবছিলাম৷ এর মধ্যেই ডঃ টোডি হার্টফেল করলেন৷ ওঁর হার্টের অবস্থা খারাপ ছিল৷ মৃত্যুটা খুব স্বাভাবিক৷ কিন্তু ওঁর মৃত্যুটাই আমাদের রাস্তা দেখিয়ে গেল৷ ঠিক তখনই দুজনে মিলে ঠিক করলাম এইরকম একটা নাটক করব, যাতে ডিফেন্স মিনিস্ট্রি হাড়ে হাড়ে টের পায় যে এই জাতীয় অস্ত্র কী মারাত্মক হতে পারে৷’ তিনি হাসতে হাসতে বলেন, ‘আশা করি এতদিন কোমায় থাকার পর ওরা আর আমাদের নতুন করে ফের জিনিসটা আবিষ্কার করতে বলবে না৷ যথেষ্টই ভয় পেয়েছে৷’

বিস্ময়ের প্রায় শেষ পর্যায়ে পৌঁছেছিলাম৷ ব্যাপারটা যত পরিষ্কার হচ্ছিল ততই নিজের গালে চড় মারার ইচ্ছেটা প্রবল হয়ে উঠছিল৷

তা সত্ত্বেও আমার মনে একটা কিন্তু ছিল৷

‘ডিফেন্স মিনিস্ট্রির টাকাটার কী হবে?’

‘কী আর হবে?’ ডক্টর সুন্দর হাসলেন, ‘ক্যামোফ্লেজিয়ার একটা মোটা টাকার ইনশিওরেন্স ঐ কথা ভেবেই করিয়ে রাখা হয়েছে৷ সেই টাকা থেকেই ওদের টাকা ফেরত যাবে৷ বাকি টাকাটা লাগবে আমাদের ক্যান্সার রিসার্চ প্রোজেক্টে৷’

‘তার মানে ক্যামোফ্লেজিয়া…?’

‘ঐ নামে কিছু কোনোদিন ছিল না, এখনও নেই, আগামীতেও হবে না৷’ তিনি দুষ্টু বাচ্চার মতো হেসে উঠলেন; ‘তোমরা যা দেখেছ সেটা নেহাতই একটা ঘাসফুল৷ আর বাদবাকি সব মায়া! একথা আগে আমরা তিনজন আর পরে এই নার্সিংহোমের ডক্টর জানতেন৷ তিনিও চমৎকার অ্যাকটিং করেছেন৷ আর এখন জানলে তুমি…৷’

আমি হতভম্ব হয়ে বসে রইলাম! তাহলে এতদিন কীসের ভয় পেয়ে এসেছি…!

হঠাৎ করে প্রতাপের মুখটা মনে পড়ল৷ বড় কষ্ট হল ওর জন্য৷ বাড়িতে ফিরে ওকে বোঝানোর চেষ্টা করব নিশ্চয়ই…

কিন্তু ও কি বুঝবে….?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *