ছত্রপতি
অনেক রকমের মানুষ। অনেক রকমের ছাতা। হালফিল বর্ষার অভিজ্ঞতা। নিরীহ মানুষ আছে আবার বলদর্পী মানুষও আছে। বৈষ্ণব আছে। শাক্ত আছে। প্রাণহীন ছাতা মানুষ বিশেষে চরিত্র পায়। যেমন বেত। ঝাড়ের শান্তশিষ্ট লিকলিকে বেত পণ্ডিত মশাইয়ের হাতে মারাত্মক। গাড়ির স্টিয়ারিং। লরি চালকের হাতে বেপরোয়া। একই জুতো, কেরানির পায়ে মিনমিনে। বড় সায়েবের পায়ে অহঙ্কারে মসমসে। কোমরের বেল্ট। মাস্তানের বেল্ট প্রাণসংহারী।
আমাদের হোমিওপ্যাথ ডাক্তারবাবুর বগলে সারাবছরই একটি ছাতা থাকে। ডাক্তারবাবু টুকটুকে ফরসা, ছাতাটি কুচুকুচে কালো। সাদা টুইলের শার্টের ওপর বড় সুন্দর খোলে। ছাতা বগলে বৃষ্টিতে ভিজতে-ভিজতে চলেছেন। পথচারী দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন—ডাক্তারবাবু ছাতাটি খুলুন না। তিনি মৃদু হেসে বললেন—এটি আমার গ্রীষ্মের ছাতা, বর্ষার নয়।
তার মানে?
মানে অতি সহজ। জল পড়লেই কালো রং গলে-গলে গায়ে পড়বে।
ছাতার শুধু চরিত্র নয়, রকমও আছে। একহারা শিক, দোহারা শিক। সিল্কের কাপড়, নাইলনের কাপড় প্লেন কাপড়। বাঁশের বাঁট, বেতের বাঁট, লোহার বাঁট। হাতলের রকমারি বাহার। এক ধরনের হাতল আছে, অনেকটা লম্পট লম্পট দেখতে। দেখলেই শরীর সিরসির করে।
গোব্দাগাব্দা মেহনতী ছাতার পাশাপাশি, শৌখিন ছাতাও আছে। ছাতার সমাজে মানুষের সমাজের মতই শ্রেণিবৈষম্য খুঁজে পাওয়া যাবে। ছাতা আর রুমাল বড় বেশি ক্লাস-কনসাস। ধনীর রুমাল আর সাধারণ মধ্যবিত্তের রুমাল দেখলেই চেনা যায়। যেসব ছাতা গাড়িতে-গাড়িতে ঘোরে তাদের চেকনাই অন্যরকম। যত্নে লালিত, ভিটামিনপুষ্ট শিশুর মতো। পিওনের ছাতার সঙ্গে মিল পাওয়া যাবে না।
আজকাল আবার পিলে চমকানো, পায়রা ওড়ানো ছাতা বেরিয়েছে। ভদ্রমহিলা বোতাম টিপলেন। মেয়েদের সোহাগের ধমক—ভ্যাট শব্দে ছাতা খুলে গেল। ভদ্রলোক বড় কাছাকাছি ছিলেন। চশমাটি শিকের ঝাপটায় পাখা মেলে নাকের ডগা থেকে উড়ে, সচল ব্র্যাবোর্ন রোডে ছিটকে পড়ল। উদ্ধারের আগেই চাকার তলায়। মোলায়েম একটি ‘সরি’, মহিলা অটোমেটিক ছাতা মাথায় কলকাতার প্যাচপেচে বর্ষাকে রমণীয় করে ব্যাঙ্ক অফ টোকিওর দিকে ছুটলেন। বোতাম টেপাছাতার কল্যাণেই তলপেটে একজনের চোদ্দোটি চলছে। শ্রাবণী কুকুর একটু খিপ্ত মেজাজে থাকে। কুকুর তো আর মানুষ নয়। ছাতার ধমক সহ্য হল না। তেড়ে এসে পায়ে কামড়। নাও, এখন পাস্তুরে হাজিরা দাও। বিজ্ঞানের কেরামতি।
ফোল্ডিং ছাতার আর একটি শ্রেণি আছে। ধাপে-ধাপে খুলতে হয়। প্রথমে লক খোলো। না লক নয়। প্রথমে খাপ খোলো। তারপর ফিতে খোলো। তারপর লক খোলো। আধখানা আছে উলটো ভাঁজে, কায়দা করে ভাঁজ খোলো। টেনে লম্বা করো। তারপর এক ঝটকায় খুলে ফ্যালো। চটপট বৃষ্টি। ছাতা খুলতে-খুলতেই ভিজে একশা। ওয়েদার ফোরকাস্ট দেখে আগেই খুলে না রাখলে না খোলাই ভালো, কারণ আবার ধাপে-ধাপে মুড়ে খোলে ঢোকাতে হবে। বাজনার চেয়ে খাজনা বেশি। বুদ্ধিমান যাঁরা তাঁরা এমন ছাতা সঙ্গে রাখেন, কদাচিৎ খোলেন। প্রয়োজনে অন্যের ছাতার তলায় মাথাটি ঢুকিয়ে দেন। শরীরটি দকারাস্ত হয়ে ছাতার বাইরেই পড়ে থাকে। মাথাটি ছত্রধারীর গতির বেগে চলতে থাকে। দেখলে মনে হবে, কেউ যেন চুলের মুঠি ধরে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে চলেছে।
সাবেককালের বড় ছাতার আশ্রয়ে স্বার্থপরের মতো একা একা চলার উপায় নেই। যেকোনও শেডের তলা থেকে দাদা দাদা বলে, ম্যানেজ মাস্টার কেউ না কেউ ছুটে এসে আশ্রয় নেবেই। কোয়ালিশানের যুগ। তিনি লম্বা হলে, আমার হাতে দিন, বলে ছাতার দখল নিয়ে নেবেন। চলতে-চলতে বলবেন, ভিজচেন নাকি! যার ছাতা তিনি লাজুক-লাজুক গলায় বলবেন না, না, ঠিক আছে, ঠিক আছে। নিজের ছাতার গড়ানো জলে, ডানপাশ কী বাঁ-পাশ সপসপে করে, মনে-মনে চোদ্দোপুরুষ উদ্ধার করলেও, মুখে কিছু বলবেন না। শেষ পাওনা একটি থ্যাংকস, ফাউ ফু।
যুগ পালটে গেছে। এ যুগ হল—’কে তুমি হরিদাস পালের যুগ।’ আজকাল কেউ কাউকে পথ দিতে চায় না। গায়ে জোর থাকলে ঠেলে ধাক্কা মেরে সরাতে হয়। না হয় ধাক্কা খেয়ে পাশে টাল খেয়ে পড়তে হয়। গরুর নিয়ম। গরু কখনও পথ ছাড়ে না। সোজা চলে। শিং আছে, বিশাল ভুঁড়ি আছে। সেই জোরে চারপাশে সব উলটে পালটে ফেলে গদাই লস্করি চালে চলতে থাকে। এখনকার মানুষ সেই দৃষ্টান্তই অনুকরণ করে গুরু হয়েছে। মার ধাক্কা, গদাম।
এখন সব ছাতাই সেই কারণে বীরের ছাতা। কিছু দুর্বলের ছাতাও আছে। খোঁচা খেয়ে হেলে যায়। পার্শ্বচারীর টাকে শিকের ঠোকর মেরে গালাগাল খেয়ে ফিরে আসে। আধুনিক ছাতা, আধুনিক বাসস্থানের মতোই উচ্চতায় খাটো। বীরের মাথায় সে জিনিস অতি সাংঘাতিক। তেড়ে এসে চোখে খোঁচা মারতে চায়। বীরে বীরে খেলা বেশ ভালোই জমে। ছাতায়-ছাতায় ইন্টারলক হয়, শিঙে শিং লাগানো গরুর মতো কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে থাকে। দুই বীরই বলতে থাকে, আয় দেখি তোর হিম্মত কত!
প্রাচীনের যুগ এখনও শেষ হয়নি। বাঁশের হাতলওয়ালা ম্যাগনাম ছাতা মাথায় প্রাচীন মানুষটি চাঁদনী দিয়ে চলেছেন। উলটো দিক থেকে আসছে প্রতাপশালী ছাতা। সংঘর্ষ এড়াতে প্রাচীনের হাতটি উর্ধ্বে উঠল। তারপর আর মনে নেই। চাঁদনিতে পাহাড়ী ধস! মাথার ওপর ঝুলছিল পথ-বিপনীর নানা মাপের স্যুটকেস, ব্রিফকেস, চেন, শিকল ইত্যাদি। সব নেমে এল ঘাড়ে। সমাহিত অবস্থায় মধুর দুটি বাক্য কানে এল—মার শালাকে। আজকাল আবার জিওগ্রাফি পালটে দেওয়ার যুগ। দিকে-দিকে নতুন ভূগোল তৈরি হচ্ছে। ছাতা আর ছাতাধারী, দুজনেরই জিওগ্রাফি বদলে গেল।
DARUN