ছত্রপতির ছত্রভঙ্গ
পূর্বাভাষ
ছত্রপতি কে? যিনি সম্রাট, বা রাজ চক্রবর্তী, বা মহারাজাধিরাজ।
সম্রাট হর্ষবর্ধন যে নিজেকে ‘মহারাজাধিরাজ’ বলে মনে করতেন, তার প্রমাণস্বরূপ তাঁর স্বাক্ষর অদ্যাবধি বর্তমান আছে।
ঢাল নেই, তরোয়াল নেই, তবু নিধিরাম নিজেকে ‘সর্দার’ মনে করত বলে একটা ঠাট্টার কথা শুনি। ওই নিধিরামের মতো একালের কোনও কোনও খেতাবি ধনীও নিজেকে ‘মহারাজাধিরাজ’ বলে প্রচার করতে লজ্জিত হন না। অভিধানকেও ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দিতে চান।
ভারতের প্রথম ছত্রপতি কে?
প্রশ্নের উত্তর খোঁজবার জন্যে কেউ যেন রামায়ণ বা মহাভারতের দিকে দৃষ্টিপাত না করেন। রামায়ণ ও মহাভারত মহাকাব্য হলেও ইতিহাস নয়। তাদের মধ্যে ইতিহাসের মাল-মশলা থাকতে পারে, কিন্তু সেগুলির সাহায্যে প্রামাণিক ও পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস রচিত হতে পারে না।
সাল ও তারিখ না পেলে এবং সত্য ও প্রামাণিক তথ্যের দ্বারা বিশেষজ্ঞরা বিচার না করলে ইতিহাস রচিত হয় না। প্রাচীন হিন্দুরা সাল-তারিখ নিয়ে মাথা ঘামায়নি আদৌ। নিরঙ্কুশ কবির কল্পনাও তাদের কাছে ইতিহাস বলে স্বীকৃত হয়েছিল।
খ্রিস্টপূর্ব সপ্তম শতাব্দীকেই সাধারণত ঐতিহাসিক যুগের আরম্ভ বলে ধরা হয়। ওই সময়ের অল্পস্বল্প যা জানা গেছে তার উপর নির্ভর করে বলা চলে যে, ষোলোটি রাজ্য নিয়ে আর্যাবর্ত বা উত্তর ভারতবর্ষ গঠিত হয়েছিল।
দাক্ষিণাত্যে নয়, আর্যাবর্তে যিনি প্রধান হতে পারতেন, তাঁকেই সর্বশ্রেষ্ঠ বা সম্রাট বা ছত্রপতি বলে স্বীকার করা হত। দাক্ষিণাত্য ও আর্যাবর্তকে আলাদা করে রেখেছিল প্রধানত বিন্ধ্য শৈলশ্রেণি।
কিন্তু তখনও ভারতে কেউ ছত্রপতি বা সম্রাট বলে পরিচিত হননি।
বুদ্ধদেবের জীবনচরিতে বা বৌদ্ধ জাতকে আর্যাবর্তের একাধিক শক্তিশালী নরপতির সঙ্গে পরিচয় হয়। তাঁদের কেউ ‘ছত্রপতি’ বলে মানত না। প্রাদেশিক রাজার দল পরস্পরের সঙ্গে মারামারি কাটাকাটি নিয়েই ব্যস্ত হয়ে থাকতেন, ছত্রপতি হওয়ার শক্তি বা অবসর তাঁদের ছিল না।
সত্যিকথা বলতে কী, তখনও ভারতে যথার্থ ঐতিহাসিক যুগ আসেনি।
গ্রিক দিগবিজয়ী আলোকজান্ডার দি গ্রেট-এর ভারত আক্রমণের ফলেই খুলে যায় এখানে ইতিহাসের বদ্ধ দ্বার। এ হচ্ছে খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দীর কথা। পঞ্চনদের সৈন্যরা রণক্ষেত্রে পরাজিত হল বটে, কিন্তু আর একদিক দিয়ে ভারতের হল পরম লাভ। সে নিজেকে খুঁজে পেলে ইতিহাসের আলোকে।
ভারতের প্রত্যন্ত দেশে আলেকজান্ডারের শিবিরে যখন যুদ্ধের উদ্যোগপর্ব চলছে, সেই সময়ে সেখানে গিয়ে উপস্থিত হলেন এক পঁচিশ বৎসর বয়স্ক তরুণ ভারতীয় যুবক—তিনি গ্রিক নরপতির সঙ্গে দেখা করতে চান।
যথাসময়ে দেখা হল। আলেকজান্ডার শুধোলেন, ‘কে তুমি?’
উত্তর হল, ‘আমি মৌর্যবংশীয় এক রাজপুত্র, নাম চন্দ্রগুপ্ত।’
‘আমার কাছে কী দরকার?’
‘আপনাকে সাহায্য করতে চাই।’
‘কীরকম সাহায্য?’
‘ভারতের প্রধান নরপতি হচ্ছেন মগধের অধীশ্বর মহাপদ্ম নন্দ। তাঁকে জয় করতে না পারলে ভারত জয় করা অসম্ভব। তিনি ভীষণ অত্যাচারী, তাঁরই জন্যে আমি আজ নির্বাসন দণ্ড ভোগ করছি। প্রজারাও তাঁকে ঘৃণা করে, তাঁর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করতে চায়। আমি, সেখানে আপনাকে নিয়ে যেতে, তাঁকে আক্রমণ করবার সমস্ত অন্ধিসন্ধি বলে দিতে এসেছি।’
বুদ্ধিমান আলেকজান্ডার বুঝলেন, এই সুচতুর যুবক তাঁর সাহায্যে মগধ রাজ্য জয় করতে চায়। তিনি বললেন, ‘আপনার সাহায্য আমার দরকার হবে না। আমি নিজেই মগধ রাজ্য জয় করতে পারব।’
হতাশ হয়ে চন্দ্রগুপ্ত ফিরে এলেন বটে, কিন্তু ইতিমধ্যেই তাঁর সন্ধানী দৃষ্টি গ্রিক ফৌজের অনেক বিশেষত্ব আবিষ্কার করতে ভুললে না।
ভারতের প্রথম ছত্রপতি
কিন্তু গ্রিক দিগবিজয়ীকে মগধ রাজ্য জয় না করেই স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করতে হল।
কয়েকটি ছোট ছোট রাজ্য দখল করবার পর আলেকজান্ডার রাজা পুরুকে হারিয়ে পাঞ্জাব ও সিন্ধু অধিকার করলেন। কিন্তু অপেক্ষাকৃত অধিক শক্তিশালী হলেও পুরুকে একজন প্রাদেশিক রাজা ছাড়া আর কিছুই বলা চলে না। সুবৃহৎ মগধ রাজ্য অধিকার না করা পর্যন্ত ভারত-বিজেতা রূপে গৌরব অর্জন করা সম্ভব নয় (মগধ বলতে তখন বোঝাত উত্তর ও দক্ষিণ বিহার, বেনারস, কোশল ও অঙ্গ রাজ্য নিয়ে গঠিত বিপুল এক দেশ)।
অতএব আলেকজান্ডার মগধের দিকে সৈন্য চালনা করতে উদ্যত হলেন।
কিন্তু সমস্ত গ্রিক সৈন্য—এমনকী সেনাপতিরাও একেবারে বেঁকে দাঁড়াল—কারণ তারা খবর পেয়েছিল যে, মহাপদ্ম নন্দের অধীনে আছে আশি হাজার অশ্বারোহী, দুই লক্ষ পদাতিক, আট হাজার রথারোহী (তার মানে ষোলো হাজার যোদ্ধা—কারণ প্রত্যেক রথের উপরে থাকত দুইজন করে যোদ্ধা), এবং ছয় হাজার গজারোহী (অর্থাৎ আঠারো হাজার যোদ্ধা—কারণ প্রত্যেক হস্তির উপরে থাকত তিন জন করে যোদ্ধা) সৈনিক।
আলেকজান্ডার বহু চেষ্টার পরেও তাদের মধ্যে উদ্দীপনার সঞ্চার করতে না পেরে অবশেষে হতাশ হয়ে প্রত্যাবর্তন করতে বাধ্য হলেন। গ্রিক ঐতিহাসিকেরই মতে, সে প্রত্যাবর্তন পলায়নেরই নামমাত্র—তাঁর ভারত জয় করা আর হল না।
আলেকজান্ডারের উচ্চাকাঙ্ক্ষা পূর্ণ হল না বটে, কিন্তু সফল হল চন্দ্রগুপ্তের স্বপ্ন।
তিনি উত্তর-পশ্চিম প্রান্ত থেকে বিপুল এক বাহিনী গঠন করে মহাপদ্ম নন্দকে পরাজিত ও নিহত করে মগধের সিংহাসন অধিকার করলেন (৩২২ খ্রিস্টপূর্বাব্দে)। তাঁর অধীনে মগধের সৈন্যবল আরও বেড়ে উঠল—তিরিশ লক্ষ অশ্বারোহী, ছয় লক্ষ পদাতিক, আরোহী সুদ্ধ নয় হাজার রণহস্তী এবং অসংখ্য রথ।
তারপর তিনি সমস্ত গ্রিকদের তাড়িয়ে পাঞ্জাব ও সিন্ধুদেশ পুনরধিকার করলেন। ভারত বিদেশিদের নাগপাশ থেকে সম্পূর্ণরূপে মুক্ত!
তখন আলেকজান্ডার আর ইহলোকে বিদ্যমান নেই। তাঁর অন্যতম প্রধান সেনাপতি সেলিউকস ফিরে ফিরতি পাঞ্জাব ও সিন্ধু অধিকার করতে এসে বীর্যবন্ত চন্দ্রগুপ্তের কাছে খালি হেরেই গেলেন না, উপরন্তু বাধ্য হয়ে ভারতের বাইরেকার আরও কয়েকটি দেশ ছেড়ে দিয়ে নিজের কন্যাকেও তাঁর হাতে সম্প্রদান করলেন।
মাত্র আঠারো বৎসরের মধ্যে প্রায় অসম্ভবকেও সম্ভব করে চন্দ্রগুপ্ত যে বিরাট সাম্রাজ্যের অধীশ্বর হলেন তার একদিকে ছিল বঙ্গোপসাগর এবং অন্যদিকে বইত আরব সাগর। চন্দ্রগুপ্তই ভারতের প্রথম ঐতিহাসিক সম্রাট বা ছত্রপতি।
আর্যাবর্তকে সম্পূর্ণরূপে স্বাধীন করে চন্দ্রগুপ্ত মাত্র ছয় বৎসর রাজত্ব করে পুত্র বিন্দুসারের হাতে রাজ্যভার দিয়ে সন্ন্যাস গ্রহণ করে প্রায়োপবেশনে বা অনশনে প্রাণত্যাগ করেন (২৯৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দে)। কথিত আছে পরে তিনি জৈনধর্ম অবলম্বন করেছিলেন।
সেলিউকসকে হারিয়ে চন্দ্রগুপ্ত উত্তর-পশ্চিম দিকে ভারতের সীমা যতদূর বাড়াতে পেরেছিলেন, ইংরেজরা নিজেদের চূড়ান্ত গৌরবের যুগেও তা পারেনি। বিদেশি ঐতিহাসিকরা বলেন, পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ নরপতিদের সঙ্গে তাঁর নাম উচ্চারণ করা চলে।
যুবরাজ বিন্দুসার যখন সম্রাট হয়ে সাম্রাজ্যের সীমা বিস্তৃত করেছিলেন দক্ষিণ দিক পর্যন্ত, তখন বোঝা যাচ্ছে তিনিও ছিলেন একজন বড় যোদ্ধা। তাঁর পুত্র মহামতি অশোক শান্তির মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে পৃথিবীর রাজাদের মধ্যে অতুলনীয় হয়ে আছেন। এঁরাও ছিলেন ছত্রপতি, কিন্তু পূর্বপুরুষের উত্তরাধিকারী হয়ে সবদিক দিয়ে সমৃদ্ধ সাম্রাজ্য হাতে না পেলে তাঁরা এতটা বড় হতে পারতেন না বলেই মনে হয়। কাজেই চন্দ্রগুপ্তের পর আর কোনও মৌর্য রাজার কথা না বললেও চলবে।
ছত্রপতি অশোকের পরেই মৌর্য বংশের প্রাধান্য লুপ্ত হয়। আর একজন ছত্রপতির জন্যে বহু কাল অপেক্ষা করবার পর (১২০ খ্রিস্টাব্দ) সিংহাসনে উপবিষ্ট হলেন কুশান রাজবংশীয় সম্রাট কণিষ্ক। কিন্তু তাঁর কথা এখানে বলব না, কারণ তিনি বৌদ্ধধর্ম অবলম্বন করলেও বিজাতীয় শক ছিলেন।
কণিষ্কের অপঘাত-মৃত্যুর পর (১৬০ খ্রিস্টাব্দ) আরও কিছুকাল পর্যন্ত শক সম্রাটেরা রাজত্ব করেন (২২০ খ্রিস্টাব্দ)। তারপরেই তাঁদের প্রভুত্ব লুপ্ত হয় এবং নেমে আসে ঘনীভূত অন্ধকারের যবনিকা—তা ভেদ করে কিছুই দেখা যায় না। তারপর চতুর্থ শতাব্দীর প্রথমেই দেখা যায় মগধের সিংহাসনে উপবিষ্ট গুপ্তবংশীয় প্রথম চন্দ্রগুপ্ত। তাঁকে প্রাদেশিক রাজা ছাড়া আর কিছুই বলা চলে না।
সূর্যোদয়ের ছত্রপতি
নিশ্ছিদ্র অন্ধকারের পর সমুজ্জ্বল সূর্যোদয়! প্রথম চন্দ্রগুপ্তের পর রাজদণ্ড ধারণ করলেন তাঁরই পুত্র সমুদ্রগুপ্ত—ইংরেজ ঐতিহাসিক যাঁর নাম দিয়েছেন ‘ভারতীয় নেপোলিয়ন’।
সমগ্র ভারতবর্ষ তাঁর পতাকার সামনে মস্তক নত করতে বাধ্য হয়। আর্যাবর্ত বা উত্তর ভারতে রাজত্ব করতেন তখন প্রধান নয়জন মহারাজা। সমুদ্রগুপ্ত তাঁদের প্রত্যেককেই পরাজিত করেন এবং তার ফলে তাঁর রাজ্য পরিণত হয় সাম্রাজ্যে—সম্রাট অশোকের পর এত বড় সাম্রাজ্যের অধিকারী হননি আর কোনও ভারতীয় নরপতি—তার পশ্চিম দিকে ছিল আরব সাগর এবং পূর্ব দিকে বঙ্গোপসাগর।
কিন্তু সমুদ্রগুপ্ত তবু তরবারি কোশবদ্ধ করলেন না, সসৈন্যে যাত্রা করলেন দাক্ষিণাত্যের দিকে। তারপর দেশের পর দেশ জয় করে দাক্ষিণাত্য উজাড় করে কল্পনাতীত ধনরত্ন নিয়ে আবার দেশে ফিরে এলেন এবং দিগবিজয়ী রূপে পৌরাণিক অশ্বমেধ যজ্ঞের পুনরানুষ্ঠান করলেন। সমগ্র ভারতবর্ষের উপরে নিজের জয়পতাকা প্রতিষ্ঠিত করবার জন্যে তাঁকে দুই বৎসরের মধ্যে দুই থেকে তিন হাজার মাইল অতি দুর্গম পথ অতিক্রম করতে হয়। সম্ভবত সমগ্র ভারতে যুদ্ধজয়ী হয়ে সমুদ্রগুপ্ত স্বদেশে ফিরে আসেন তিন শত পঞ্চাশ খ্রিস্টাব্দে এবং আর্যাবর্তের পৌরাণিক সম্রাটদের মতো ছত্রপতি রূপে অশ্বমেধ যজ্ঞের অনুষ্ঠান করেন।
সমুদ্রগুপ্তের সভাকবি বলেছেন, তিনি গানে এবং বাজনায় এবং কবিতা রচনায় সুনিপুণ ছিলেন। উপরন্তু তাঁর ছন্দসম্বন্ধীয় রচনাও আছে অনেকগুলি। তাঁর একটি দুর্লভ স্বর্ণমুদ্রা পাওয়া যায় তাতে দেখি, সমুদ্রগুপ্তের পরনে হাত-কাটা ও হাঁটুর উপর পর্যন্ত বিস্তৃত পোশাক। অনেকটা একেলে চেয়ারের মতন আসনে উপবিষ্ট হয়ে তিনি বীণাবাদনে নিযুক্ত। বিদ্বজ্জনদের সঙ্গে শাস্ত্র, সংগীত ও কবিতা নিয়ে আলোচনা করে তিনি প্রভূত আনন্দ লাভ করতেন। বেশ বোঝা যায়, যুদ্ধের সঙ্গে কাব্য ও ললিতকলার ক্ষেত্রেও তিনি ছিলেন এক প্রতিভাধর পুরুষ। এমন সর্বোত্তম প্রতিভার অধিকারী দিগবিজয়ী পৃথিবীর আর কোনও দেশে দেখা যায়নি।
সমুদ্রগুপ্তের পরলোক গমনের পর তাঁর পুত্র গুপ্তবংশীয় দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত নামে সিংহাসনে বসে বিক্রমাদিত্য উপাধি ধারণ করেন এবং তিনিই হচ্ছেন চলতি ভারতীয় কথা ও কাহিনিতে প্রসিদ্ধ রাজা বিক্রমাদিত্য। তিনিও ছিলেন যোদ্ধা, ভারত থেকে শক প্রভুত্ব একেবারে বিলুপ্ত করে দেন। কিন্তু ছত্রপতির সম্মান লাভ করবার যোগ্য হলেও তাঁর বা গুপ্তবংশীয় আর কোনও সম্রাটের কীর্তি নিয়ে এখানে আলোচনা করব না, কারণ বিন্দুসার ও অশোকের মতো তাঁরাও সমুদ্রগুপ্তের দ্বারা সুদৃঢ় ভিত্তির উপরে প্রতিষ্ঠিত বিশাল সাম্রাজ্যের অধিকারী হয়েছিলেন।
প্রায় পঞ্চম শতাব্দী পর্যন্ত আর্যাবর্তে গুপ্তবংশের প্রভুত্ব বজায় থাকে। ওই সময়েই রাজার পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করে ভারত কাব্যে, চিত্রে, ভাস্কর্যে ও স্থাপত্যে এবং জ্ঞানবিজ্ঞানের অন্য নানা ক্ষেত্রে সর্বশ্রেষ্ঠ বলে গণ্য হয়েছিল। তারপরেই এখানে উপদ্রব আরম্ভ করে বিভীষণ ও নৃশংস হুন অত্যাচারীর দল। ভারত তখন আবার ছোট-বড় নানা রাজ্যে বিভক্ত হয়ে যায় এবং সেখানে আর কেহই ছত্রপতি উপাধি অর্জন করবার অধিকারী হননি। তারপর সপ্তম শতাব্দীর প্রথম মুখেই দেখতে পাই আর একজন এমন বীরপুরুষকে, যিনি আর্যাবর্তের উপরে আপন বিজয়পতাকা উত্তোলন করে আবার ছত্রপতি আখ্যালাভের যোগ্য হতে পেরেছিলেন।
হিন্দুযুগের শেষ ছত্রপতি
তাঁর নাম হর্ষবর্ধন—তাঁর নিজের স্বাক্ষর আজও বিদ্যামান আছে। তা দেখলে জানা যায়, নিজেকে তিনি ‘মহারাজাধিরাজ শ্রীহর্ষ’ বলে পরিচিত করতেন। হর্ষবর্ধনের আগে তাঁর বড়ভাই থানেশ্বরের সিংহাসনে আরোহণ করেন। তারপরেই তিনি খবর পান যে তাঁর ভগ্নীপতি রাজা গ্রহবর্মণ মৌখারি মালবরাজের হস্তে নিহত হয়েছেন এবং তাঁর সহোদরা রাজ্যশ্রীকেও তিনি বন্দিনী করেছেন। রাজ্যবর্ধন তৎক্ষণাৎ যুদ্ধযাত্রা করে মালবরাজকে পরাজিত ও নিহত করলেন বটে, কিন্তু তারপরেই তিনি নিজেও মধ্যবঙ্গের অধিপতি শশাঙ্কের হস্তে মারা পড়লেন এবং সেই অবসরে রাজ্যশ্রী কারাগার থেকে পালিয়ে গিয়ে নিরুদ্দিষ্ট হলেন।
রাজ্যবর্ধনের ছোটভাই হর্ষবর্ধন তখন নানাদিকে খোঁজাখুঁজি করে অবশেষে ভগ্নী রাজ্যশ্রীকে উদ্ধার করে দেশে ফিরে আসেন এবং অবশেষে থানেশ্বরের সিংহাসনে আরোহণ করেন ছয় শত ছয় খ্রিস্টাব্দে। বুদ্ধিমতী ভগ্নী রাজ্যশ্রীর সঙ্গে পরামর্শ করে হর্ষবর্ধন রাজ্যচালনা করতে থাকেন।
কিন্তু থানেশ্বরের সংকীর্ণ চতুঃসীমার মধ্যে হর্ষবর্ধনের চিত্ত আবদ্ধ হয়ে থাকতে চাইল না, তাঁর মানসচক্ষে তখন জাগতে লাগল একই ছত্রের ছায়ায় সারা আর্যাবর্তকে এনে ছত্রপতি হওয়ার সমুজ্জ্বল স্বপ্ন। এই সময়ে তাঁর ফৌজে ছিল পাঁচ হাজার গজারোহী, বিশ হাজার অশ্বারোহী এবং পঞ্চাশ হাজার পদাতিক সৈন্য। চিরাচরিত রীতি না মেনে ফৌজ থেকে অপ্রয়োজনীয় ভেবে তিনি রথারোহী সেনাদের বাদ দিয়েছিলেন।
যুদ্ধের পর যুদ্ধ জিতে এবং দেশের পর দেশ হস্তগত করে অবশেষে হর্ষবর্ধন সমগ্র উত্তরাপথের উপরে উড়িয়ে দিলেন বিজয় পতাকা। তাঁর সৈন্যসংখ্যাও যথেষ্ট বেড়ে উঠল। তারপর তিনি দাক্ষিণাত্যের দিকে অগ্রসর হলেন—ভারতবর্ষে আর কোনও বিক্রমশালী রাজার অস্তিত্ব তাঁর পক্ষে অসহনীয়। দাক্ষিণাত্যের সর্বপ্রধান নরপতি ছিলেন চালুক্যবংশের দ্বিতীয় পুলকেসিন। তিনি আগে থাকতেই সাবধান হয়ে আটঘাট বেঁধে বসেছিলেন, সে বাধা এড়িয়ে দক্ষিণ দিকে আর এগুতে না পেরে হর্ষবর্ধন বিফল মনোরথ হয়ে ফিরে আসতে বাধ্য হন (৬২০ খ্রিস্টাব্দে)।
তারপর তাঁর শেষ যুদ্ধ হচ্ছে গাঞ্জামের বিরুদ্ধে। সাঁইত্রিশ বৎসর ধরে যুদ্ধের পর যুদ্ধ করে অবশেষে হর্ষবর্ধন তরবারি কোশবদ্ধ করলেন। তারপর সম্রাট অশোকের অনুকরণে শান্তির মন্ত্র পাঠ করতে করতে তাঁর বাকি জীবনের কয়েকটা বছর কেটে গেল।
সমুদ্রগুপ্তের মতো হর্ষবর্ধনও ছিলেন যোদ্ধা হয়েও উচ্চশ্রেণির কবি। সমুদ্রগুপ্তের কোনও রচনা আর খুঁজে পাওয়া যায় না, কিন্তু হর্ষবর্ধনের ‘নাগানন্দ’, ‘রত্নাবলী’ ও ‘প্রিয়দর্শিকা’ নামে তিনখানি নাটকীয় রচনা আজও সংস্কৃত সাহিত্যে বিখ্যাত হয়ে আছে। কবি বাণ ছিলেন তাঁর সভাকবি।
কিন্তু শান্তির মন্ত্র পাঠ করেও হত্যাকারীর কবল থেকে হর্ষবর্ধন আত্মরক্ষা করতে পারেননি। তিনি নিহত হন ৬৪৬ কি ৬৪৭ খ্রিস্টাব্দে।
হর্ষবর্ধনের প্রায় দেড় শতাব্দীর পর বঙ্গবীর ধর্মপাল বিপুল সাম্রাজ্য গঠন করে ছত্রপতি রূপে সুদীর্ঘ চৌষট্টি বৎসর কাল রাজদণ্ড ধারণ করেছিলেন বটে, কিন্তু ধর্মে তিনি হিন্দু ছিলেন না, ছিলেন বৌদ্ধ এবং সেইজন্যেই তাঁর কাহিনি এখানে বলা হল না। তবু প্রসঙ্গসূত্রে বলতে পারি, বাংলার এই বীর সন্তানের সাম্রাজ্য বিস্তৃত ছিল বঙ্গোপসাগর থেকে উত্তরে দিল্লি ও পাঞ্জাবের জলন্ধর এবং দক্ষিণে বিন্ধ্য গিরিশ্রেণির উপত্যকা পর্যন্ত। ধর্মপাল ও তাঁর বংশধররা সাড়ে চার শতাব্দী ধরে রাজ্যচালনা করে বঙ্গদেশকে ভারতের অন্যতম প্রধান দেশ বলে পরিচিত করেছিলেন, এ তথ্যও উল্লেখযোগ্য।
পালবংশের পর আর কোনও স্বদেশি ও হিন্দু রাজবংশ আর্যাবর্তের উপরে একচ্ছত্র অধিকার স্থাপন করতে পারেনি।
নামে আর্যাবর্ত, কিন্তু সেখানে আর্যদের প্রভুত্ব প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গেল—কেবল বিতাড়িত শক ও হুনের দল রাজস্থানে আশ্রয় নিয়ে, হিন্দুধর্ম গ্রহণ করে নিজেদের চন্দ্র ও সূর্যবংশীয় রাজপুত বলে প্রচার করে বহুকাল পর্যন্ত মুসলমানদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে স্বাধীনতা রক্ষা করেছিল।
আর্যাবর্তের উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ল মধুলোভী বোলতার মতো ঝাঁকে ঝাঁকে আরব, তুর্কি, পারসি, আফগান ও মোগল প্রভৃতি। মোগলেরা ও আফগানদের অনেকেই হিন্দুদের বুকে বসে ভারতকেই স্বদেশ বলে গ্রহণ করলে, কিন্তু তারপর ইউরোপ থেকে যারা আসতে আরম্ভ করলে তাদের বিদেশি লুণ্ঠনকারী দস্যু ভিন্ন আর কিছুই বলা যায় না।
প্রথমে এল পোর্তুগিজরা, তারপর ওলন্দাজরা, তারপর ফরাসি। কিন্তু সর্বশেষে ইংরেজরা ছলে-বলে-কৌশলে সর্বগ্রাস করে গোটা ভারতবর্ষকে বিরাট এক গোলামখানায় পরিণত করলে।
কিন্তু সেটা কি সম্ভবপর হত? এ প্রশ্নের একমাত্র উত্তর হচ্ছে, না। কেন, এইবারে তাই বলছি।
ঔরঙ্গজিবের রাজত্বকালে যখন মোগলদের গৌরবসূর্য নিস্তেজ হওয়ার কোনও লক্ষণই প্রকাশ পায়নি, যখন দুর্ধর্ষ আফগান ও রাজপুতদেরও অনেকেই মোগলের দাসত্ব স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছে, সেই সময়েই সপ্তদশ শতাব্দীর উত্তরার্ধে দাক্ষিণাত্যের আর-একজন হিন্দু বীর ভারতের অনেক অংশকে স্বাধিকারে এনে নিজেকে ছত্রপতি রূপে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। কিন্তু তাঁর পরলোকগমনের পর আর কেউ এই মহান অবদানের গৌরব রক্ষা করতে পারেনি। বিধর্মীর অধীন ভারতবর্ষে তখন আর্যাবর্ত ও দাক্ষিণাত্যকে কেউ আর আলাদা করে দেখত না।
দাক্ষিণাত্যে ছত্রপতির আত্মপ্রকাশ
তাঁর নাম শিবাজী। তাঁর প্রতিজ্ঞা ও জীবন-ব্রত ছিল স্বাধীন হিন্দু ভারতবর্ষের পূর্বগৌরব পুনরুদ্ধার করা।
ঔরঙ্গজিব শিবাজীকে বশীভূত করবার জন্যে নিজের শ্রেষ্ঠ সেনাধ্যক্ষদের প্রেরণ করেছিলেন—কিন্তু কেহই তাঁকে বাগে আনতে পারেননি। এমনকী ভারতবিখ্যাত সেনাধ্যক্ষ দিলির খাঁকে পর্যন্ত তাঁর হাতে নাস্তানাবুদ হতে হয়েছিল। শিবাজীকে বন্দি করে স্বয়ং ঔরঙ্গজিবও তাঁকে ধরে রাখতে পারেননি।
শিবাজীকে একসঙ্গে শক্তিশালী মোগল সাম্রাজ্য, বিজাপুর, পোর্তুগিজ ও ইংরেজ প্রভৃতির সঙ্গে একা লড়তে হয়েছিল, তবু তিনি শেষ পর্যন্ত দুই শত চল্লিশটি দুর্গ দখল করে এবং বিরাট ভূখণ্ড জুড়ে প্রকাণ্ড এক রাজ্য গঠন করতে ও সাত কোটি টাকা বার্ষিক আয়ের অধিকারী হতে পেরেছিলেন—তার উপরে ছিল তাঁর দ্বারা সঞ্চিত বিপুল অর্থ।
শিবাজীর রাজ্য বিস্তৃত ছিল উত্তর দিকে ধমরপুর থেকে দক্ষিণে বোম্বাই প্রদেশের গঙ্গাবর্তী নদীতট পর্যন্ত। পূর্ব দিকে তার সীমার মধ্যে গণ্য হত ভাগলানা, নাসিক ও পুনা প্রদেশ, সমগ্র সাতারা ও কোলহাপুর প্রদেশের অধিকাংশ। শেষের দিকে তিনি পশ্চিম কর্ণাটকের বেলগম থেকে মাদ্রাজের তুঙ্গভদ্রা নদীতীরবর্তী দেশ পর্যন্ত নিজের অধীনে আনতে পেরেছিলেন। মাত্র বাহান্ন বৎসর কয়েক মাস বয়সে তাঁর অকালমৃত্যু (কারুর কারুর মতে বিষ খাইয়ে তাঁকে হত্যা করা হয়) না হলে তিনি যে আরও কত দেশ নিজের দখলে আনতে পারতেন সেটা আজ কল্পনাও করা যায় না।
তাঁর ফৌজে ছিল পঁচাশি হাজার অশ্বারোহী ও এক লক্ষ পদাতিক সৈন্য। এবং তাঁর কামানের সংখ্যা ছিল দুই শত। অষ্টপ্রধান বা আটজন মন্ত্রীর (এঁদের মধ্যে মুখ্যপ্রধানকে পেশোয়া বলে ডাকা হত) সাহায্যে তিনি শাসনকার্য চালনা করতেন।
শিবাজী উপলব্ধি করলেন যথানিয়ম অনুসারে অভিষেক না হলে এবং মুকুট না পরলে কেউ তাঁকে মহারাজা বলে মানতে চাইবে না।
শিবাজীকে পেয়ে হিন্দুদের মনেও আশা জেগেছিল যে আবার হিন্দু গৌরবের পুনরুত্থান হবে এবং তারা লাভ করবে স্বরাজ ও নতুন ছত্রপতি।
ছত্রপতি উপাধি ও রাজমুকুট ধারণ করে শিবাজী গুরু রামদাসস্বামী ও মাতা জিজাবাইয়ের চরণে মাথা রেখে প্রণাম করলেন। পতি পরিত্যক্তা জিজাবাইয়ের সেদিন কী আনন্দ, মৃত্যুর মাত্র বারো দিন আগে তিনি দেখে যেতে পারলেন যে, তাঁর আদরের পুত্র কত শতাব্দীর পর অধীনতার শৃঙ্খল ছিঁড়ে ভারতের প্রথম দিগবিজয়ী ও ছত্রপতি।
অভিষেক মহোৎসবে শিবাজী মুক্তহস্তে অর্থব্যয় করেছিলেন। সারা ভারতের নানা দেশ থেকে নিমন্ত্রণ পেয়ে যেসব ব্রাহ্মণ পত্নী ও সন্তানসন্ততি নিয়ে রায়গড়ের উৎসবক্ষেত্রে এসে হাজির হন, তাঁদের মোট সংখ্যা পঞ্চাশ হাজার। চার মাস ধরে তাঁরা নূতন হিন্দু-ছত্রপতির আতিথ্য স্বীকার করেছিলেন। সবসুদ্ধ নিমন্ত্রিতের সংখ্যা হয়েছিল প্রায় এক লক্ষ! অভিষেকের জন্যে খরচ হয়ে গিয়েছিল পঞ্চাশ লক্ষ টাকা—এ যুগের হিসাবে তখনকার পঞ্চাশ লক্ষের মূল্য কী অসামান্য হয়ে উঠবে তা অনুমান করতে গেলে বিস্ময়ে হৃদয় পূর্ণ হয়ে যায়।
বহুশতাব্দীব্যাপী ঘৃণ্য অধীনতার অভিশাপ বহন করে সারা ভারতবর্ষ যখন প্রায় জীবন্মৃত হয়ে পড়েছিল, সেই সময়েই সর্বপ্রথমে ছত্রপতি শিবাজী আত্মপ্রকাশ করেন ভারতের মুক্তি-সংগ্রামের অগ্রদূতের মতো। সমগ্র ভারতের দেশে দেশে তাঁর নাম ছড়িয়ে পড়ে আবালবৃদ্ধবনিতার মুখে মুখে জপমন্ত্রের মতো। আধুনিক যুগেও কেউ তাঁকে ভোলেনি।
সুদূর বঙ্গদেশও তাঁকে নিতান্ত আপন বলে মনে করেছে, তাই ‘স্বদেশি’ আন্দোলনের সময়েও তাঁর কাছে প্রেরণা লাভ করে মহাকবি রবীন্দ্রনাথ তাঁকে স্মরণ করে উদাত্ত কণ্ঠে গেয়ে উঠেছেন—
‘মারাঠির সাথে আজি হে বাঙালি, এক কণ্ঠে বলো
‘জয়তু শিবাজী!
মারাঠির সাথে আজি যে বাঙালি, একসঙ্গে চলো
মহোৎসবে সাজি।
আজি এক সভাতলে ভারতের পশ্চিম-পুরব
দক্ষিণে ও বামে
একত্রে করুক ভোগ একসাথে একটি গৌরব
এক পুণ্য নামে।’
ছত্রপতির স্বপ্নভঙ্গ
শিবাজী যে সাম্রাজ্যের প্রাথমিক কাজ শেষ করে গিয়েছিলেন তাঁর বংশধরেরা যদি তার মর্যাদা রক্ষা করতে পারতেন, তাহলে কোথায় থাকত মোগল ও ইংরেজের প্রতাপ—আজ হয়তো ভারতের নীলাকাশের তলায় বাতাসের তালে তালে সগৌরবে উড়ত শিবাজী পরিকল্পিত গৈরিক পতাকা!
কিন্তু তা হয়নি। শিবাজীর দুই পুত্র—শম্ভুজী ও রাজারাম—সিংহাসনে আরোহণ করেছিলেন বটে, কিন্তু তাঁরা পিতার প্রতিভা থেকে বঞ্চিত হয়ে কেবল সম্পত্তিরই উত্তরাধিকারী হয়েছিলেন! তাঁরা ছিলেন শিবাজীর অযোগ্য সন্তান।
গুপ্তবংশীয় প্রথম চন্দ্রগুপ্তের উত্তরাধিকারী হয়ে সমুদ্রগুপ্ত পিতার কাছ থেকে প্রাপ্ত রাজ্যকে পরিণত করেছিলেন এক বিরাট সাম্রাজ্যে। তেমন যুদ্ধপ্রতিভা, বুদ্ধি ও শক্তি শিবাজীর উত্তরাধিকারীদের কারুর ছিল না, তাই ছত্রপতি শিবাজীর প্রসাদে অমন এক সুপরিচালিত ও সুবৃহৎ রাজ্য ও বিপুল বাহিনী হাতে পেয়েও চারিদিকে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি ছাড়া তাঁরা আর কিছুই করতে পারেননি। শম্ভুজী তো মোগলের হাতে বন্দি হয়ে মৃত্যুদণ্ড থেকে নিষ্কৃতিলাভ করেননি।
তারপর রাজ্যচালনার ভার পড়ে পেশোয়া বা প্রধানমন্ত্রীদের উপরে। তাঁরা তখন সুযোগ পেয়ে তার সদ্ব্যবহার করতে লাগলেন। তাঁদের মনীষা, কূটনীতি ও সামরিক শক্তি শিবাজীর সৃষ্ট রাজ্যকে ক্রমেই আকার বাড়িয়ে ভারতের মধ্যে প্রধান করে তুললে।
তারপর ১৭৬০ খ্রিস্টাব্দে পেশোয়া বালাজীর অধীনে মারাঠিদের গৌরব উঠল উন্নতির চরম শিখরে—পেশোয়া বালাজী রাও তাঁর সেনাপতি সদাশিব রাওয়ের সাহায্যে দিল্লি অধিকার করলেন এবং বাদশাহ দ্বিতীয় সাজাহানকে সিংহাসন থেকে নামিয়ে ঘোষণা করলেন—অতঃপর সম্রাট উপাধিতে ভূষিত হলেন আলি গহর বা দ্বিতীয় শা আলম।
সারা ভারতে জাগ্রত হল অভাবিত বিস্ময়। হিন্দুর কবলগত রাজধানী দিল্লি। সকলে ভাবতে লাগল—আজও নামমাত্র সার হয়ে বাদশাহ বিদ্যমান আছেন বটে, কিন্তু যে প্রবল শক্তি সম্রাটকে সিংহাসনে ওঠাতে পারে, অদূর ভবিষ্যতে নিশ্চয়ই সে স্বয়ং প্রভু হয়ে দাঁড়াবে।
ভারতীয় জনসাধারণ স্বপ্নে দেখতে লাগল, আবার এক নূতন হিন্দু ছত্রপতির ছবি।
কিন্তু সে দিবাস্বপ্ন ভেঙে যেতে বিলম্ব হল না। ১৭৬১ খ্রিস্টাব্দে আহাম্মদ শা আবদালি শেষ বারের মতো ভারতের ভাগ্যনিয়ন্তা হয়ে পানিপথের যুদ্ধক্ষেত্রে মারাঠিদের শোচনীয় ভাবে পরাজিত করলেন।
কিন্তু এটা সম্ভবপর হত না যদি পেশোয়া বালাজী রাও স্বয়ং সশরীরে রণক্ষেত্রে উপস্থিত থাকতেন। তাঁর অবর্তমানে প্রধান প্রধান সেনাপতিরা সাংঘাতিক আত্মকলহে লিপ্ত হয়ে যুদ্ধজয়ের যে কোনও আশাকেই নির্মূল করে দিয়েছিল।
হিন্দুদের সেদিনকার দুর্ভাগ্য স্মরণ করলে মন শিউরে না উঠে পারে না।
কেবল যে বাইশ হাজার স্ত্রী-পুরুষ (মারাঠিদের শিবিরে বহু নারীও ছিল) আফগানদের হাতে বন্দি হল তা নয়, যুদ্ধক্ষেত্র পরিণত হল বিরাট এক মারাঠি শবস্থানে। আঠাশ হাজার মারাঠির মৃতদেহে পানিপথের রণক্ষেত্র পূর্ণ হয়ে গেল। তার উপরে শিবিরে শিবিরেও পাওয়া গেল কত হাজার মৃতদেহ তার সংখ্যা কেউ জানে না। পানিপথ শহরেও আশ্রয় নিতে গিয়ে এক দিনেই মারা পড়ে প্রায় নয় হাজার মারাঠি। বিজেতাদের দ্বারা অনুসৃত হয়ে যেসব রাস্তা ও জঙ্গল দিয়ে মারাঠিরা পলায়ন করেছিল সেসবও ছেয়ে গেল শবদেহে শবদেহে।
প্রধান সেনাপতি সদাশিব রাও পরাজিত হয়ে রণক্ষেত্রে বারংবার মৃত্যুকে স্মরণ করেও যখন মৃত্যুকে লাভ করলেন না, তখন তাঁর মনে এই দুর্ভাবনাই প্রবল হয়ে উঠেছিল, অতঃপর কেমন করে পুনায় ফিরে পেশোয়াকে তিনি মুখ দেখাবেন!
কিন্তু তাঁর বহুমূল্য পরিচ্ছদ ও রত্নভূষণের দিকে আকৃষ্ট হয়ে একদল আফগান তেড়ে এসে গর্জন করে বললে, ‘এই কাফের, যদি নিজের প্রাণ বাঁচাতে চাস, তাহলে এখনই আত্মসমর্পণ কর!’
কিন্তু পরাজিত সদাশিব নিজের প্রাণ বাঁচাতে চান না, তিনি আত্মসমর্পণ করলেন না। আহত অবস্থায় খোঁড়াতে খোঁড়াতে সেই শত্রুদলের মধ্যে অসিহস্তে সিংহবিক্রমে তিনি ঝাঁপিয়ে পড়লেন এবং একাই তিন-চারজন শত্রুর প্রাণবধ করে স্বেচ্ছায় মৃত্যুকে বরণ করে নিলেন।
মারাঠার প্রত্যেক পরিবার থেকে কেউ না কেউ পানিপথের যুদ্ধক্ষেত্রে প্রাণ বিসর্জন দিয়েছিল।
কিন্তু তখনও মারাঠিদের জীবনীশক্তি নিঃশেষ হয়ে যায়নি।
ছত্রপতি শিবাজীর সঞ্জীবক আদর্শ তখনও জাতির মধ্যে একনায়কত্বের আশা লুপ্ত হতে দেয়নি। কয়েক বৎসর যেতে না যেতেই মারাঠিরা আবার চাঙ্গা হয়ে উঠল। তারা আবার ভারতের রাজধানী দিল্লি আক্রমণ ও অধিকার করলে এবং আবার নির্বাসিত বাদশাহ শা আলমকে সঙ্গে করে এনে দিল্লি পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে গেল (১৭৭১ খ্রিস্টাব্দে)।
কিন্তু সে হচ্ছে নেববার আগে প্রদীপের শিখা জ্বলজ্বল করে ওঠার মতো। ব্রিটিশ সিংহ তখন পলাশির যুদ্ধ জিতে শক্তিসঞ্চয় করে প্রবল হয়ে উঠেছে। কিছুদিন যেতে না যেতেই যোদ্ধা ও রাজনৈতিক লর্ড ওয়েলেসলি আবার মারাঠিদের রণক্ষেত্রে অনায়াসে পরাস্ত করে তাদের সমস্ত উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে ধূলিস্যাৎ করে দিলেন।
তারপর বহুদিন আমাদের জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ব্রিটিশ সিংহ অবশেষে শ্বেতদ্বীপে নিজের ডেরায় পালিয়ে গিয়েছে। ভারত এখন স্বাধীন।
আজ প্রজাতন্ত্রের জয়জয়কার। কেউ আর এখানে ছত্রপতি হতে চায় না, কারণ একনায়কত্বের যুগ বিগত।