ছত্রপতি
বৃষ্টি নামিতে তাড়াতাড়ি একটু পা চালাইয়া একটা দোতলা বাড়ির নীচে আসিয়া দাঁড়াইলাম। এখানে ফুটপাথটা ঢাকা, আশ্রয় মিলিল।
মনটা বিষণ্ণ হইয়া আছে। বাড়ি হইতে বাহির হইতেই ভাইপোটা টুকিয়া দিয়াছিল, কাকা, ছাতা নিলে না?
সেই থেকে মনটা খিঁচড়াইয়া আছে। ঠিক যাত্রার মুখে পিছনে ডাকা আমার সয় না; খুব একচোট বকাবকি করিলাম। যাত্রাটা শোধরাইয়া লইবার জন্য একটু বসিয়া গেলাম। তাহার পর আবার যেন পিছন না ডাকে, সেজন্য সতর্ক করিয়া দিয়া উঠিয়া আসিয়াছি। আবার যে ছাতাটা না লইয়াই উঠিয়াছি, ছেলেটা সেটুকু আর মনে করাইয়া দিতে সাহস পায় নাই।
পাশেই বারান্দাটার মধ্যে গায়ে গায়ে তিনটি দোকান। একটি চায়ের, একটি হোমিওপ্যাথির, একটি ছাতার সঙ্গে কিছু কাপড়ও আছে।
সমাবেশটা একটু অদ্ভুত,—চা, হোমিওপ্যাথি, ছাতা। অন্য সময়ে নজর পড়ে না বটে, কিন্তু বর্ষার এই রকম জোর-করা অবসরের মধ্যে এই সামান্য অসামঞ্জস্যগুলাও মনকে যেন অভিভূত করিয়া বসে।
চিন্তার মধ্যে একবার ফিরিয়া দেখিতেই চক্ষে পড়িল, ছাতার দোকানীটা আমার পানে একদৃষ্টে চাহিয়া আছে। চোখ সরাইয়া লইতে গিয়া দৃষ্টিটা চায়ের দোকান গিয়া পড়িল; সেখানেও সেই অবস্থা, দোকানীর দুইটি লোলুপ চক্ষু আমার উপর নিবদ্ধ।
ব্যাপারটা বুঝিলাম। অত্যন্ত অস্বস্তি বোধ হইতে লাগিল। জামা-কাপড় একটু ভিজিয়া গিয়াছে, বর্ষার ছাটে বেশ একটু শৈত্যভাব। অসময় হইলেও বর্ষাটা যে শীঘ্র থামিবে, এমন ভরসা নাই। এ অবস্থায় একটু চা পান না করা, অথবা সামনেই ছাতার দোকান থাকিতে একটা ছাতা কিনিয়া না লওয়া কেমন যেন একটা কিম্ভূতকিমাকার ব্যাপার বলিয়া মনে হইতে লাগিল। চা আমি পান করি না; বাড়িতে একটা ছাতা আছেই, এই সেদিন কিনিয়াছি। আমি দোকান হইতে সবলে দৃষ্টি ফিরাইয়া রাস্তার পানে চাহিয়া রহিলাম, কিন্তু মাথার পিছনে যে চারিটি লুব্ধ চক্ষুর দৃষ্টি আসিয়া পড়িতেছে, তাহাদের হাত হইতে কোনমতেই পরিত্রাণ পাইলাম না। সম্মোহকেরা শুনিয়াছি চোখের উপর চোখ রাখিয়াই বশীভূত করিতে পারে, এদের দৃষ্টি আমার মাথা ফুঁড়িয়া আমার মস্তিষ্ককে যেন বেশ বিবশ করিয়া ফেলিতে লাগিল। কেবলই মনে হইতে লাগিল; আমার মত এমন নিদারুণ অবস্থাতে পড়িয়াও যদি কেহ ইহাদের ফাঁকি দেয় তো কেনই বা ইহাদের এই এত কষ্ট করিয়া পাঁচজনের জন্য হাতের এত কাছে প্রয়োজনের সম্ভার সব যোগাইয়া রাখা? আরও কি সব আত্মধিক্কারের কথা মনে উদয় হইল, এখন ঘরের নিরাপদ আশ্রয়ে বসিয়া বসিয়া মনে পড়িতেছে না। মোট কথা, ঘুরিয়া ছাতার দোকানের দিকে অগ্রসর হইলাম।
.
২
আকার-প্রকারে মনে হইল, খুব পুরানো দোকান। প্রবেশ করিতেই ‘এই যে আসুন’ বলিয়া দোকানী ছোট্ট দোকানটির ভিতরে সরিয়া গিয়া হাত দিয়া আমার বসিবার জায়গাটা ঝাড়িয়া পরিষ্কার করিয়া দিল। বলিল, বিশ্রী বর্ষা পড়েছে মশাই। এবারের নতুন পাঁজিতে বর্ষফল দেখেছেন তো?
বলিলাম, না।
চক্ষু বিস্ফারিত করিয়া বলিল, দেখেন নি! বোশেখ মাস থেকেই যে বর্ষা পড়ে যাবে বলছে। আর যে-রকম সে-রকম বর্ষা নয়, বলছে—গত পঞ্চাশ বছরের মধ্যে নাকি এ রকম বর্ষা দেখেনি কেউ। কি ছেলেমেয়েদের জামা চাই নাকি—কত বয়েস?
বলিলাম জামা নয়, ছাতা চাই একটা, আমার নিজের জন্যে।
দোকানী নিজের কপালে ছোট একটি করাঘাত করিয়া বলিল, দেখুন এই বুদ্ধি নিয়ে দোকান করব! তাই করতেও পারলাম না কিছু। দেখছি ছাতাই দরকার আপনার, অথচ জিজ্ঞেস করছি, জামা চাই? কিরকম ছাতা দেখাই বলুন দেখি?
সামনে কয়েক রকমের ছাতা একটা টাঙানো ছিল। মাথায় একটা বুদ্ধি আসিল। মিছামিছি পয়সাটা খরচ করিব? ওদিকে বৃষ্টিটাও যেন একটু ধরিয়া আসিতেছে। বলিলাম, একটু ভাল আর মজবুত হলে বেশ হয়, ওগুলো যেন নেহাত শৌখিন, আর, কি যে বলে— দোকানী তর্জনী উঁচাইয়া গম্ভীরভাবে আমার মুখের কথাটা পূরণ করিয়া দিল—আর পলকা। ঠিক। তা এ যে শৌখিন, ফাঁকি আর পলকার যুগ মশাই। চেহারা দেখুন, চুল ছাঁটা দেখুন, জামা দেখুন, জুতো দেখুন—সব যেন উড়ছে। তা দোব আপনাকে, এমন ছাতা দোব যে, এ যুগে পাওয়াই যায় না। আমরা নিজেরা যে সব সে-যুগের। এই দেখুন, এগুলো কি এই সব ছোকরাদের যুগের বলে ভুল হবার জো আছে?—বলিয়া নিজের মাথার এক খামচা অবিন্যস্ত শুভ্র কেশ তুলিয়া ধরিয়া হাসিয়া উঠিল।
ছাতা আসিল। বাস্তবিক, অমন ছাতা আমি কলিকাতা শহরে পূর্বে কখনও দেখি নাই। যেমন দীর্ঘ, তেমনই আড়ে। সাধারণ ছাতায় আটটা করিয়া শিক থাকে, দোকানী এক এক করিয়া চৌদ্দটা গুনিয়া দিল। শিকের মাথাগুলা এক একটা মটরের মত। মোটা অমসৃণ একটা বাঁশের বাঁট—যেন নিজের চর্বিতে মাথার কাছটা একটু একটু ফাটিয়া গিয়াছে। দোকানী একবার হাতে তৌল করিয়া সামনে ফেলিয়া দিয়া বলিল, নিন, একবার ওজনটা দেখুন, ঘণ্টাখানেক বইলে আজকালকার রগ-কামানো ছোকরা বাবুদের হাঁপ ধরে যাবে না? এই একটি ছিল, এর পরে আপনার মত খদ্দের এলে আর দিতে পারব না। এ জিনিস আর করে না। বইবার লোক নেই তো আর করবে কার জন্যে মশাই! আপনার মত সাজোয়ান লোক কটা চোখে পড়ে?
মনটা বেশ একটু খুঁতখুঁত করিতেছিল, কিন্তু আধুনিক ছাতাকে বিদ্রূপ করিয়া আরম্ভ করিয়াছি, খোলাখুলি কিছু বলিতে পারিতেছিলাম না। তবুও যা একটু বলিব বলিব মনে করিতেছিলাম, দোকানী ‘সাজোয়ান’ করিয়া দিয়া সেটুকুও প্রকাশ করিবার আর সামর্থ্য রাখিল না। বছর দশেকের মধ্যে যাহাকে কেহ শক্তিমান বলিয়া ভ্রম করে নাই, ওই মন্ত্রটুকু শুনিলে তাহার মনের অবস্থা কেমন হয়? একবার খুলিয়া দেখিতে যাইতেছিলাম, দোকানী তাড়াতাড়ি হাত হইতে এক রকম কাড়িয়া লইয়া হাসিয়া বলিল, তা বলে কি খুলতেও গাজুরি চলবে বাবু? এ যে হাসালেন আপনি। শক্তিমান লোকের দোষ ওই।—বলিয়া সন্তর্পণে আঙুলের টিপ দিয়া ছাতা খুলিয়া ধরিয়া আমার মুখের পানে স্মিত হাস্যে চাহিল। সমস্ত ঘরটি যেন অমাবস্যার অন্ধকারে ভরিয়া গেল!
দাম তিন টাকা। কিন্তু দোকানী বলিল, তবে আপনি ভাববেন, জিনিসটা পছন্দ হয়েছে, তাতে এই দুর্যোগ, আর পাঁজিতে যেমন লিখছে, ছাতাটা হাতছাড়া করাও মুখ্যুমি, তাই দোকানী বেটা দাঁও হাঁকড়াচ্ছে। না মশাই, আপনি আড়াই টাকাই দিন। খদ্দেরের সঙ্গে তো এক দিনের সম্পর্ক নয়। আজ আট গণ্ডা পয়সা গুণাগার দিলাম, কাল আবার দরকার পড়লে আপনাকে এই দোকানে পায়ের ধুলো দিতে হবে।
যে লোকটা এত সুবিবেচক, যে কিছু বলিবার পূর্বে নিজে হইতেই তিন টাকা হইতে আড়াই টাকায় নামিয়া আসিতে পারে, তাহার সহিত দর-কষাকষি চলে না। ছাতাটা কিনিয়া বাহির হইয়া আসিলাম।
.
৩
বৃষ্টি ধরিয়া আসিয়াছে, তবে এখনও গুঁড়িগুঁড়ি পড়িতেছে। ছাতাটা কিন্তু সেইখানেই খুলিতে অত্যন্ত সঙ্কোচ বোধ হইল। একটু সরিয়া গিয়া আঙুল টিপিয়া টিপিয়া খুলিতে হইবে। ছাতা লইয়া বাহির হইয়া আসিবার সঙ্গে সঙ্গে অনেকের দৃষ্টি এদিকে আকৃষ্ট হইয়া পড়িয়াছে। চায়ের দোকানী কি করিতেছে জানি না, খুব মনের জোর দিয়া ওদিক হইতে দৃষ্টিকে সংযত রাখিয়াছি। ইহার উপর ছাতা খুলিয়া আর বাড়াবাড়ি করিবার ভরসা হয় না। পাক দিয়া যতটা সম্ভব ছাতাটার আকার সঙ্কুচিত করিয়া কোলের কাছে লইয়া অগ্রসর হইলাম এবং একটা মোড় ঘুরিয়া অন্য পথ ধরিলাম! একটা স্বস্তির নিশ্বাস পড়িল, এবং মনের সহজ ভাবটা ফিরিয়া আসিলে ইংরেজি বাংলা ভাষায় (?)–যতগুলি গালাগাল জানা আছে, সমস্তগুলি দোকানীটার উপর উজাড় করিলাম। কি প্রবঞ্চক! মান্ধাতার আমলের কবেকার একটা ছাতা কিনিয়া রাখিয়াছে, খদ্দের নাই, জো বুঝিয়া ঠিক আমায় গছাইয়া দিল! আচার্য রায় এই জাতকে দোকান করিতে উৎসাহিত করেন!
এ ছাতা লইয়া বাড়ি ফেরা চলিবে না। এমনই আমি কিছু সওদা করিয়া বাড়ি ফিরিলে সবাই আসিয়া ঘিরিয়া দাঁড়ায় নানাবিধ অরুচির মন্তব্য লইয়া। তাহার উপর যদি এই ছাতা দেখে—
এক জায়গায় বারান্দার উপর একটি মাড়োয়ারি ঘণ্টি বাজাইয়া ছিটের টুকরা নিলাম করিতেছিল। একটু ভিড় হইয়াছে, ছাতাটা কোলের কাছে লইয়া দাঁড়াইলাম। বৃষ্টিটা নিতান্ত আর গুঁড়িগুঁড়ি পড়িতেছে না, একটু জোর হইয়াছে, কিন্তু নিলাম দেখায় এত তল্লীন হইয়া গিয়াছি—বৃষ্টির কথাটা যেন মনেই নাই। একটি ফতুয়া-পরা বখাটে গোছের ছোকরা মনে করাইয়া দিল। মুখের দিকে দুই-তিনবার চাহিয়া বলিল, ভিজছেন যে মশাই, ছাতাটা খুলুন না! আর একটু কাছে ঘেঁষিয়া আসিল।
বলিলাম, তাই তো! খেয়ালই ছিল না।
ভুলটা হঠাৎ জানিতে পারিলে তাড়াতাড়ি যেমন শোধরাইয়া লয় লোকে—লওয়া উচিত যেমন, সেইভাবে ছাতাটা মাথার উপর তুলিয়া শিকের গোড়ার জোরে একটা ঠেলা দিলাম।
বাঁটের ঠেক এক-তৃতীয়াংশ গিয়া আটকাইয়া গেল। না নীচে নামে, না উপরে যায়। যত রকম ভাবে সম্ভব—অন্তত সে অবস্থায় যতরকম ভাবে সম্ভব ছিল, চেষ্টা করিলাম। কিছুতেই কিছু হইল না। শেষে হাল ছাড়িয়া দিয়া সেই অর্ধমুক্ত ছাতা মাথার উপর ধরিয়া নিলামে মনঃসংযোগ করিবার চেষ্টা করিতে লাগিলাম। ছোকরাও বোধ হয় একটু অন্যমনস্ক হইয়া গিয়াছিল, হঠাৎ মুখ তুলিয়া বিরক্তি এবং বিদ্রূপের স্বরে বলিল, আচ্ছা কিপটে তো মশাই আপনি! তেরপলের মত একটা ছাতা কিনেছেন—ঠিক অর্ধেকটি খুলে নিজের মাথাটি বাঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। ইচ্ছে করলে তো মাড়োয়ারিটাকে পর্যন্ত এর মধ্যে টেনে নিতে পারেন।
আরও দুই-একজন প্রত্যাশী তাহার সঙ্গে যোগ দিল। বলিলাম, না, কি রকম আটকে গেছে খানিকটা উঠে।
দেবার ইচ্ছে না থাকলে ও রকম আটকায় মশাই। কই, দেখি, কি রকম আটকেছে? হাত হইতে ছাতাটা লইয়া উপরে ঠেলিবার চেষ্টা করিল। একেবারে অনড়। দাঁত-মুখ কুঞ্চিত করিয়া ঈষৎ কুব্জ হইয়া নীচের দিকে টানিল। অতি কষ্টে আধ ইঞ্চিটাক নীচে নামিয়া সেই যে কাপে কাপ বসিয়া গেল, আর না উপরে যায়, না নীচে নামে। কসরতের চোটে শিকের ডগাগুলো ঘটাঘট করিয়া আশেপাশের মাথাগুলির উপর ঠোক্কর দিতে লাগিল অচিরেই নিলামের ভিড়ের একটা মোটা অংশ ছাতার চারিদিকে ঘেরিয়া মারমুখো হইয়া উঠিল। ছোকরার হাতেই ছাতাটা, আমি দর্শক সাজিয়া গিয়া অনেকটা নিরাপদ ছিলাম। ব্যাপার খুব ঘোরালো হইয়া উঠিতে ছোকরা বলিল, এই, এঁর ছাতা। পয়সা দিয়ে কিনেছিলেন নাকি মশাই? নিন, টুপি করে পরে থাকুন।—বলিয়া ছাতাটা আমার হাতে দিয়া হনহন করিয়া বাহির হইয়া গেল।
আমিও সেই স্বল্প-উদ্ঘাটিত ছাতায় যতটা সম্ভব চারিদিকের বিদ্রূপবাণ হইতে আত্মগোপন করিয়া সেখান হইতে সরিয়া পড়িলাম।
কিন্তু সরিয়া যাইব কোথায়? বৃষ্টি পড়িতেছে একটু একটু করিয়া। মাথায় আধখোলা বিরাট ছাতা। কোথায় লোক কম আছে এই রকম গলিঘুঁজি দেখিয়া বেড়াইতে হইবে। দাঁড়ইলেই সেখানে বড় ছাতার মধ্যে আশ্রয়ের লোভে লোক জুটিয়া যাইবে, সঙ্গে সঙ্গে প্ৰশ্ন, বিদ্রূপ, মন্তব্য
কয়েকটা গলি ঘুরিয়া মাথায় একটু বুদ্ধি আসিল। একটা ছোট মনিহারী দোকানে গিয়া একটা ছুরি কিনিলাম। আর একটু গিয়া রেলিঙে ঘেরা একটি ছোট পার্কের মত দেখা গেল। গোটা তিনেক বেঞ্চ পাতা আছে। একটির মাথায় কাঠের একফালি চালা গোছের, একটু জল আটকায়। সেই বেঞ্চিতে বসিয়া ছাতার বাঁটটা চাঁচিতে আরম্ভ করিয়া দিলাম।
উপর আর নীচের অংশটি চাঁচিতে সময় লাগিল না, কিন্তু যেখানটা আটকাইয়াছে, ছুরির ছোট ফালির কোণ সাঁদ করাইয়া কুরিয়া কুরিয়া কাটিতে অনেক বিলম্ব লাগিল। যাহা হউক, ফল হইল। হঠাৎ আমার বাঁ হাতের বুড়া আঙুলটা খামচাইয়া দিয়া ছাতাটা সশব্দে বন্ধ হইয়া গেল।
একটি স্বস্তির নিশ্বাস ফেলিতে যাইব, দেখি উপদ্রব অন্যদিক দিয়া মাথা ফুড়িয়া বাহির হইয়াছে।
ছাতাটা শুধু আকারের দিক দিয়াই প্রাচীন নয়, সরঞ্জামের দিক দিয়াও একেবারে পচা। পূর্ণভাবে উদ্ঘাটিত করার চেষ্টায় শিকের গোড়ায় তারের বাঁধুনিটা কখন ছিঁড়িয়া গিয়াছে টের পাই নাই, ছাতাটা হঠাৎ মুড়িয়া যাইতেই একসঙ্গে গোটা পাঁচ-ছয় শিকের মুখ কুঁড়িয়া বাহির হইয়া আসিল। হতাশ দৃষ্টিতে সেই ভগ্নাবশেষের দিকে চাহিয়া কিছুক্ষণ বসিয়া রহিলাম।
.
৪
আড়াইটা টাকা গিয়াছে, কপালে লোকসান লেখা ছিল, কি আর হইবে? এখন কথা হইতেছে, এই ছাতার হাত হইতে পরিত্রাণ পাই কি করিয়া? এই বস্তু বহন করিয়া কি করিয়া ফিরি? একটি ছাতা মেরামতের দোকান নাই, ‘ছাতা মেরামত’ করিয়া লোকও হাঁকে না। একটু নিরিবিলি জায়গার খোঁজে প্রায় ঘণ্টা দুই আড়াই ঘুরিতে ঘুরিতে কোন্ পাড়ায় যে আসিয়া পড়িয়াছি, তাহাও বুঝিতে পারিতেছি না।
বৃষ্টিটা বেশ ছাড়িয়া গেল। আকাশ পরিষ্কার হইয়া আসিতেছে। ছোট পার্কটিতে একটি চাকর তিন-চারটি ছেলেমেয়ে লইয়া প্রবেশ করিল। আমি উঠিলাম, মাথায় একটা বুদ্ধি আসিয়াছে।
চাকরটাকে প্রশ্ন করিলাম, এখান থেকে ট্রামের রাস্তা কতটা? কোন্ দিক দিয়ে যেতে হবে?
কোথায় যাবেন আপনি?
আমার ট্রামের দরকার, কোথায় যাই সেটা অবান্তর।
বলিলাম, বউবাজার স্ট্রীটে গিয়ে আমায় ট্রাম ধরতে হবে। কতটা হবে এখান থেকে?
উত্তর করিল, গ্রে স্ট্রীটের ট্রাম লাইন এখান থেকে সবচেয়ে কাছে।
বলিলাম, তাতেও চলবে। কোন্ দিকে?
চাকরটা একটু সন্দিগ্ধভাবে মুখের দিকে চাহিল, তাহার পর হাত দেখাইয়া বলিল, তা হলে সোজা গিয়ে একটু মোড় ফিরেই সিধে পশ্চিমে চলে যান।
টানাহিঁচড়া করিতে কয়েকটা শিকের মাঝখানটা বাঁকিয়া গিয়া ছাতার পেটটা ফুলিয়া গিয়াছে, যথাসম্ভব গুছাইয়া লইয়া যাত্রা করিলাম।
গ্রে স্ট্রীটে আসিয়া একটা চিৎপুরগামী ট্রামের সেকেন্ড ক্লাসে উঠিয়া পড়িলাম। একবার ভাল করিয়া দেখিয়া লইলাম, ট্রামের এক কোণে দুই-একজন সন্দিগ্ধ-প্রকৃতির লোক পরস্পরের কাছে মুখ সরাইয়া লইয়া কি একটা পরামর্শে লাগিয়া আছে। ইহাদেরই খুঁজিতেছি। গিয়া ঠিক তাহাদের সামনের সীটটিতে বসিলাম, এবং তাহাদের যাহাতে কোন অসুবিধাই না হয়, সেইজন্য ছাতাটা নিজের সামনে না রাখিয়া বেঞ্চটার পিঠে ঠিক তাহাদের হাতের কাছে টাঙাইয়া রাখিলাম।
সামনে লম্বালম্বি করিয়া বসানো একটা বেঞ্চে কতকগুলি পাড়াগেঁয়ে গোছের বাঙালি বসিয়া তর্ক করিতেছিল। বসিতেই সামনের লোকটি আমার ছাতার দিকে একবার দৃষ্টিপাত করিয়া যুক্ত করে মাথা নোয়াইয়া খুব ভক্তিভরে বলিল, প্রণাম হই
তাহার পর সঙ্গীদের দিকে ফিরিয়া বলিল, কেন এত তর্ক বাপু তোমাদের? এই এঁকেই জিজ্ঞাসা কর না, আমাদের ভাগ্যে যখন এসে পড়েছেন। এরা বলছে, আজ বারোটা একচল্লিশ মিনিট গতে অমাবস্যা পড়বে, অথচ আমার যেন মনে হচ্ছে, পাঁজিতে দেখে এলাম—
অত্যন্ত বিস্মিত হইলাম, কিন্তু তখনই ব্যাপারটা পরিষ্কার হইয়া গেল। ইহারা ছাতা দেখিয়া আমায় নিশ্চয় গুরুপুরোহিত গোছের কিছু একটা ঠাহর করিয়া থাকিবে। ঘুরিয়া ঘুরিয়া চেহারাতেও নিশ্চয় একটা পরিব্রাজক গোছের ছাপ পড়িয়াছে। তাহার উপর মুণ্ডিত মুখমণ্ডল, পায়ে একটু পুরাতন গোছের স্যান্ডাল—এসবের সাক্ষ্য তো আছেই। কিন্তু সব চেয়ে বড় নিদর্শন ওই ছাতা। নির্ঘাত শিষ্য-বাড়ির জিনিস, মেদিনীপুর ঘাটাল অথবা একেবারে সুন্দরবন ঘেঁষিয়া কোন শিষ্য বাড়ি হইতে আমদানি—কলিকাতার বহুদূরে এবং এ যুগের ছোঁয়াচ হইতে সম্পূর্ণ মুক্ত কোন শিষ্য-বাড়ি।
লোকগুলো চিৎপুরের মাঝামাঝি একটা জায়গায় নামিয়া গেল। পিছনের সেই লোক দুইটা বসিয়া আছে। কান ওই দিকেই পাতিয়া রাখিয়াছি। না, যতটা বুঝা যাইতেছে, খাঁটি লোক। ইহারা আমায় ছাতা-সমস্যা হইতে মুক্ত করিবেই। হ্যারিসন রোডের কাছে আসিয়া ভিড়টা চাপ বাঁধিয়া উঠিল। এই সুযোগ। আমি উঠিয়া পড়িলাম এবং ছাতাটা ভুলিয়া, ভিড় ঠেলিয়া ট্রামের ফুটবোর্ডের নিকট আসিয়া দাঁড়াইলাম। নামিতে যাইব, কাঁধে একটা রুক্ষ হস্তের স্পর্শ অনুভব করিলাম। ফিরিয়া দেখি, আমার পিছনের সঙ্গীদের মধ্যে একজন একটি সশ্রদ্ধ প্রণাম করিয়া বলিল, ঠাকুর মশাই, আপনার ছাতা!
ও, ভুলেই গেছলাম তো। বলিয়া ছাতাটা লইয়া নামিয়া ফুটপাতে গিয়া দাঁড়াইলাম।
আকাশ-পাতাল ভাবিতে লাগিলাম। কি করা যায়! চোর-গুণ্ডাকেও নির্লোভ সাধু করিয়া তোলে, এ কি পাপ ঘাড়ে আসিয়া পড়িল! বাড়ি যাই কি করিয়া? শিবপুরের রামরাজাতলা—এখানে তো নয়। ট্রাম-বাস—অসম্ভব হইয়া উঠিতেছে, তা ছাড়া উঠিই বা কি করিয়া বাড়িতে এ জিনিস লইয়া? ওদিকে ছাতা ক্রমেই অঙ্গবিস্তার করিতেছে। এদিকে নিজের শরীর দুশ্চিন্তা আর নিরুদ্দেশ ঘোরাঘুরিতে একেবারে অবসন্ন
সুবিধার মধ্যে বৃষ্টির ছাটে মাথাটা ঠাণ্ডা আছে, আবার একটু বুদ্ধি আসিল।
লোয়ার চিৎপুর হইয়া এসপ্ল্যানেডে আসিলাম এবং সেখান হইতে একেবারে ইডেন গার্ডেনে গিয়া উপস্থিত হইলাম। পথের বিড়ম্বনাটনা আর লিপিবদ্ধ করিতেছি না।
খুব ঝোপঝাপ দেখিয়া একটি নিভৃত স্থানে গিয়া বসিলাম। তখন বেলা গিয়া বেশ একটু গা-ঢাকা হইয়া আসিয়াছে।
পরে বুঝিলাম, অত বেশি নিভৃত স্থান খুঁজিতে যাওয়াই ভুল হইয়াছিল।
বেঞ্চে একটু বসিয়া ছাতা ভুলিয়া একটু বাহিরে ফাঁকায় আসিয়া পড়িয়াছি, একটা উড়িয়া মালী আসিয়া বাঁ হাতে ছাতাটা লইয়া হাসিয়া দক্ষিণ হস্ত প্রসারিত করিয়া বলিল, ছাতাটা ভুলে যাচ্ছিলেন, বকশিশ দেবেন বাবু!
চূড়ান্ত অবস্থা হইয়া আসিয়াছে। স্খলিত কণ্ঠে বলিলাম, ঠিক, ভুলে গেছলাম বটে।
একটু চিন্তা করিয়া সঙ্কোচ কাটাইয়া বলিলাম, গরিব মালী হয়েও যে রকম সাধুলোক, নে, তুই ছাতাটাই নিয়ে নে।
মালীও একটু চিন্তা করিল, একটু লুব্ধ দৃষ্টিতে ছাতাটার পানে চাহিল বটে, কিন্তু বুঝিলাম, কি একটা প্রবল দ্বিধায় পড়িয়াছে। উৎসাহিত করিবার জন্য বলিলাম, নে চারটে পয়সা, বরং মেরামত করে নিস। আহা, গরিব লোক!
মালী ভীত সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে একবার আমার দিকে চাহিল, জায়গাটার নিভৃত ভাবটাও একবার দেখিয়া লইল। তাহার পর হঠাৎ যেন একটা অজানা বিপদের ইঙ্গিত পাইয়া নিজের লোভ সংযত করিয়া বলিল, না বাবু, থাক, বকশিশ চাই না, সেলাম।
তাড়াতাড়ি চলিয়া গেল।
.
গভীর নৈরাশ্যে অবশেষে মা-গঙ্গাকে আশ্রয় করিতে হইল।
কতবার ভাবিয়াছি, মানুষ আত্মহত্যা করে কেন? আজ একটি দিনের সামান্য একটা ছত্রবিভ্রাটের মধ্যে তাহার উত্তর পাইয়াছি।
কেবল একটা বৈরাগ্য আসিয়া গিয়াছে। এই তো জীবন—এতটুকু একটা তুচ্ছতায় যাহার মধ্যে এত বড় একটা বিপর্যয় আনিয়া ফেলিতে পারে, একেও মানুষ এত করিয়া চায় কেন? একটা সামান্য ছাতা, না হয় অসামান্যই, কিন্তু ছাতাই তো! ইহার দ্বারাও যদি এতটা নির্যাতন সম্ভব জীবনে তো কেন মানুষ এ জীবন আঁকড়াইয়া থাকে?
সন্ধ্যার অন্ধকার, গঙ্গার তীর–এমনিই মনটাকে উদাস করিয়া তোলে, তায় নিতান্ত অহেতুক ভাবেই আজ সমস্ত দিনটা এই নিগ্রহ
স্ট্র্যান্ড রোড পার হইয়া গঙ্গার ধার দিয়া খানিকটা দক্ষিণে চলিয়া গেলাম। কেল্লার সামনাসামনি জেটির বালাই নাই, নৌকাও কাছে-পিঠে দেখা যায় না। এই উপযুক্ত জায়গা। কেহ একটা কথাও জিজ্ঞাসা করিতে আসিবে না। আমি সন্তর্পণে জলের ধারে নামিয়া গেলাম।
কাছেই একটা গোল পাথরের বড় চাঁই, কেমন করিয়া ঠিক এই জায়গাটিতে আসিয়া পড়িয়াছিল জানি না—মা বোধ হয় এই বিড়ম্বনার অবসান করিবেন বলিয়াই।
এইবার খানিকটা দড়ি দরকার। নিজের বস্ত্রের পানে চাহিলাম। এত সাধের দেহটাকেই যে বস্ত্রখণ্ডের মত এক কথায় ত্যাগ করা চলে, সে বস্ত্রখণ্ডের জন্য এত মায়া কেন? কোঁচার খুঁটটা খুলিয়া কাপড়টা ছিঁড়িয়া ফেলিলাম।
পাথরটা ভাল করিয়া বাঁধিলাম। প্রায় পনেরো-কুড়ি সেরের শিলা, ইহাকে আলিঙ্গন করিয়া যদি অতলকে আশা করা যায় তো অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টি কোন সন্ধানই পায় না।
তারপর?
তারপর মায়া। হ্যাঁ, জীবনে এত দুঃখ-দুর্গতির পাশেও যে কোথা হইতে এত মায়া আসিয়া জমা হয় কি করিয়া বলি? দেহই বল অথবা অন্য কিছুই বল—যাহা লইয়া এত নির্যাতন, তাহাকেই আবার বিদায়ের সময় প্রাণ এমন করিয়া জড়াইয়া ধরে কেন?
ছাতাটার পানে একবার করুণ নেত্রে চাহিলাম, তারপর পাথর-লগ্ন কাপড়ের পাড়ের সঙ্গে সেটাকে বাঁধিয়া পাথরটা ধীরে ধীরে গঙ্গার গর্তে ঠেলিয়া দিলাম।
***