ছক্কা মিয়ার টমটম – সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ
এ মুলুকে রাতবিরেতে বাস ফেল করলে ছক্কা মিয়ার টমটম ছাড়া আর উপায় ছিল না৷ ঝড়-বৃষ্টি হোক, মহাপ্রলয় হোক, রাতের বেলা ভীমপুর গদাইতলা দশমাইল পিচের সড়কে যদি কষ্ট করে একটু দাঁড়িয়ে থাকা যায়, ছক্কা মিয়ার টমটমের দেখা মিলবেই মিলবে৷ অন্ধকার ঝড়বৃষ্টির মধ্যে প্রথমে ঠাহর হবে একচিলতে টিমটিমে আলো৷ তারপর আলোটা এগিয়ে আসবে আর এগিয়ে আসবে৷ মেঘের ডাকাডাকি যতই থাক, কানে বাজবে অদ্ভুত এক আওয়াজ টং লং….টং লং…টং৷ বিদ্যুতের আলোয় হঠাৎ চোখে পড়বে কালো এক এক্কাগাড়ি—তেরপলের চৌকা একটা টোপর চাপানো৷ সামনে কালো এক মূর্তি আর নড়বড় করে দৌড়ানো এক টাট্টু!
মুখে কিছু বলার দরকার নেই৷ ছক্কা মিয়ার টমটম সওয়ারি দেখামাত্র থেমে যাবে৷ তখন একলাফে পেছনের তেরপল সরিয়ে চৌকা টোপরে ঢুকলেই নিশ্চিন্ত৷ আবার টলতে টলতে চলতে থাকবে ছক্কা মিয়ার টমটম—টং…লং…টং লং৷
টমটম কথাটা এসেছে ইংরেজি ‘ট্যান্ডেম’ থেকে—যে গাড়ির সামনে কয়েক সার ঘোড়া যেত৷ কিন্তু ভীমপুরের ছক্কা মিয়ার এক্কাগাড়ির ঘোড়া মোটে এক৷ তবু আদর করে লোকে নাম দিয়েছিল টমটম৷
ছক্কা মিয়ার চেহারাটি কিন্তু ভারি বদরাগী৷ ঢ্যাঙা, টিঙটিঙে রোগা, একটু কুঁজো গড়ন৷ লম্বাটে মুখের বাঁকানো নাকের তলায় পেল্লায় গোঁফ৷ চামড়ার রং রোদপোড়া তামাটে৷
তেমনি তার টাট্টুও৷ যেমন মনিব, তেমনি ঘোড়া৷ হাড়-জিরজিরে লম্বাটে গড়ন৷ ঠ্যাং চতুষ্টয় যেন চারখানি কাঠি৷ মাথাটা দেখে সময় সময় ঠাহর করা কঠিন, এই প্রাণীটি সিঙ্গি, না প্রকৃত একটি ঘোড়া৷ হ্রেষাধ্বনি করলেই পিলে চমকে ওঠে৷ ভীমপুর বাজারের তাবৎ নেড়িকুকুর দিশেহারা হয়ে পালিয়ে যায় লেজ গুটিয়ে৷
লোকে আজকাল রাস্তা চলতে বাস-রিকশোই পছন্দ করে৷ ছক্কা মিয়ার টমটম চড়লে হাড়-মাংস দলা পাকাতে থাকে বলেও না৷ কালের রেওয়াজ আসলে৷
কিন্তু ওই যে বলেছি, রাতবিরেতে বাস ফেল করলে তখন উপায়? ছক্কা মিয়া এটা বোঝে এবং দিনে তার টমটমের বাহনটিকে নিয়ে বনজঙ্গল বা ঝিলে চরিয়ে নিয়ে বেড়ায়৷ রাতের বেলা ছোট্ট বাজারের চৌরাস্তায় শিরীষ গাছের তলায় ঘাপটি পেতে বসে থাকে৷ পাশেই টমটম রেডি৷…
সেবার পুজোর সময় কলকাতা থেকে ছোটমামার সঙ্গে আসছি৷ মাঝপথে একখানে ট্রেন দাঁড়িয়ে রইল তো রইল, আর নড়ার নাম নেই৷ ব্যাপার কী? না—আগের স্টেশনে মালগাড়ি বেলাইন৷ বেলা গড়িয়ে সন্ধ্যা হল৷ তারপর যখন ট্রেনের চাকা গড়াল, ছোটমামা বেজার মুখে বললেন, ‘বরাতে আবার হতচ্ছাড়া ছক্কা মিয়ার টমটম আছে৷ বাপস!’
ওই টমটমে কখনো চাপিনি৷ তাই কথাটা শুনে আমার আনন্দ হয়েছিল৷ বললুম, ‘খুব মজা হবে, তাই না ছোটমামা?’
ছোটমামা দাঁতমুখ খিঁচিয়ে বললেন, ‘মজা হবে! বুঝবে ঠ্যালাটা ’খন!’
ঠ্যালাটা কিসের বুঝলাম না আগেভাগে৷ দেখলাম, ছোটমামা ট্রেনের জানলা দিয়ে মুণ্ডু বাড়িয়ে বার বার যেন আকাশ দেখছেন৷ একটু পরে বললেন, ‘খুব ঝড়বৃষ্টি হবে৷ কার মুখ দেখে যে বেরিয়েছিলাম! বড়দা অত করে বললেন, তবু থাকলুম না, ছ্যা ছ্যা, আমার কী আক্কেল!’
ভীমপুর স্টেশনে যখন নামলুম, তখনো কিন্তু ঝড়বৃষ্টির পাত্তা নেই৷ রাত একটা বেজে গেছে৷ বাজার নিশুতি৷ চৌমাথায় শিরীষতলায় গিয়ে দেখি, ছক্কা মিয়ার টমটম দাঁড়িয়ে আছে৷ বলা-কওয়া নেই, দরদস্তুর নেই, ছোটমামা টমটমের পিছনদিকের তেরপল তুলে ঢুকে ডাকলেন, ‘হাঁ করে দেখছিস কী? উঠে আয়, এক্ষুনি একগাদা লোক এসে ভালো জায়গা দখল করে ফেলবে যে৷’
ভেতরে খড়ের পুরু গাদার ওপর তেরপল পাতা৷ কেমন একটা বিচ্ছিরি গন্ধ৷ অন্ধকারও বটে৷ যেন এক গুহায় ঢুকেছি৷ সামনে সরে গিয়ে ছোটমামা পর্দাটা ফাঁক করে রাখলেন৷ একটু পরে আরো জনা দুই লোক ভেতরে ঢুকে পড়ল৷ সে এক ঠাসাঠাসি অবস্থা৷
আর তারপরই আচমকা চিক্কুর ছেড়ে ছেড়ে মেঘ ডাকল এবং শনশন করে এসে গেল একটা জোরালো হাওয়া৷ ছোটমামা বললেন, ‘ওই যা বলেছিলুম, হল তো?’
ছক্কা মিয়া সামনের আসন থেকে ঘোষণা করল, ‘আরাম করে বসুন বাবুমশাইরা৷ এবার রওনা দিই৷’ তার ঘোড়াটাও মেঘের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চিঁ হিঁ হিঁ ডাক ছেড়ে যখন পা বাড়াল, তখন টের পেলাম কেন ছোটমামা ‘বাপস’ বলে মুখখানা তুম্বো করেছিলেন৷
সত্যি ‘বাপস’! হাড়গোড় ভেঙে যাবার দাখিল৷ বাইরে হাওয়ার হইচই আর মেষের হাঁকডাক যত বাড়ছে, ছক্কা মিয়ার ঘোড়াটাও তত যেন তেজী হয়ে উঠছে৷ একটু পরেই চড়বড়িয়ে বৃষ্টির ফোঁটা টোপরের তেরপলে পড়তে শুরু করল৷ ছোটমামা ফাঁকটুকু বন্ধ করে দিলেন৷ আমি তখন অবাক৷ ছক্কা মিয়া বাইরে বসে চাবুক হাঁকাচ্ছে, ওর বৃষ্টির ছাঁট লাগবে না?
রাস্তাটা ঘুরে রেল লাইন পেরুলে দুধারে বিশাল আদিগন্ত মাঠ৷ ফাঁকা জায়গায় ঝড়বৃষ্টিটা মিয়ার টমটমকে বেশ বাগে পেল৷ প্রতিমুহূর্তে মনে হচ্ছিল, এই বুঝি উল্টে গিয়ে রাস্তার ধারের গভীর খালে নাকানিচুবানি খাবে৷ আমাদের অবস্থা কী দাঁড়াবে, সেও ভাববার কথা৷
কিন্তু আশ্চর্য, টমটম সমান তালে নড়বড়িয়ে টলতে টলতে চলেছে৷ মাঝে মাঝে ঝড়বৃষ্টির শব্দের ভেতর শোনা যাচ্ছে অদ্ভুত এক শব্দ—টং লং…টং লং…টং লং৷ কখনো ছক্কা মিয়ার টাট্টুঘোড়া বিকট চিঁ হিঁ করে চেঁচিয়ে উঠছে৷ তারিফ করে আমার পেছন থেকে এক সওয়ারি বলে উঠলেন, ‘পক্ষীরাজের বাচ্চা!’
এতক্ষণে তেরপলের টোপর থেকে ফুটো দিয়ে জল চোঁয়াতে থাকল৷ সওয়ারিরা নড়েচড়ে বসার চেষ্টা করছিল, কিন্তু সরবে কোথায়? বেহদ্দ ভিজে সপসপে হয়ে যাচ্ছিল জামাকাপড়৷ একসময় ছোটমামা হঠাৎ বাজখাঁই চেঁচিয়ে বললেন, ‘আঃ! হচ্ছে কী, হচ্ছে কী মশাই? আমার ওপর পড়ছেন কেন?’
‘আপনার ওপর আমি পড়লুম, না আপনি আমার ওপর পড়লেন!’
‘কী বাজে কথা বলছেন, আমায় ঠাণ্ডা করে দিয়ে আবার তক্ক? আপনি মানুষ, না বরফ?’
‘আমি বরফ! আপনিই তো বরফ৷ ইস, কী ঠাণ্ডা! হাড় অবদি জমে গেল দেখছেন না৷’
আমার পিছনের সওয়ারি চাপা খিকখিক করে হেসে আমার কানের ওপর বলল, ‘ঝগড়া বেধে গেছে৷ বরাবর যায়, বুঝলেন তো মশাই? ছক্কা মিয়ার টমটমের এই নিয়ম৷ খিকখিক খিকখিক৷
এমন বিদঘুটে হাসি কখনো শুনিনি৷ কিন্তু এঁর শ্বাসপ্রশ্বাসও যে বরফের মতো হিম৷ বললুম, ‘ইস! একটু সরে বসুন না৷ বড্ড ঠাণ্ডা করে যে!’
লোকটা ভারি অদ্ভুত৷ সে ওই বিদঘুটে খিকখিক হাসতে হাসতে আরো যেন ঠেসে ধরল আমাকে৷ চেঁচিয়ে উঠলাম, ‘ছোটমামা! ছোটমামা!’
কিন্তু ছোটমামার কোনো সাড়া পেলাম না৷ টোপরের ভেতরটা যেন ঘন অন্ধকার৷ ফের ডাকলুম, ‘ছোটমামা, কোথায় তুমি?’
লোকটা সেই খিকখিক হাসির মধ্যে বলল, ‘আর ছোটমামা বড়মামা৷ মামারা এখন রাস্তায় পড়ে কুস্তি করছে!’
হতভম্ব হয়ে হাত বাড়িয়ে ছোটমামাকে খুঁজলুম৷ সুটকেসটা হাতে ঠেকল৷ কিন্তু সত্যিই ছোটমামা নেই৷ তারপর পেছনের দিকে চোখ পড়ল৷ ওদিককার পর্দাটা যেন ফর্দাফাঁই৷ বৃষ্টির ছাট এসে ঢুকছে৷ আমি প্রচণ্ড চেঁচিয়ে বললাম, ‘ছক্কা মিয়া, ছক্কা মিয়া! গাড়ি থামাও—গাড়ি থামাও!’
পেছনের সওয়ারি ফের সেই বিদঘুটে হাসি হেসে উঠল৷ এবার আমি সামনের পর্দা ঠেলে সরিয়ে ছক্কা মিয়ার ভেজা জামা খামচে ধরলুম৷ ‘গাড়ি থামাও, গাড়ি থামাও বলছি!’
এতক্ষণে যেন ছক্কা মিয়া আমার কথা শুনতে পেল৷ ঘুরে বলল, ‘কী হয়েছে বাবুমশাই৷
‘ছোটমামা পড়ে গেছেন কোথায়!’
ছক্কা মিয়া বলল, ‘বালাই ষাট পড়বেন কোথায়? ঠিকই আছেন৷ খুঁজে দেখুন না!’
‘নেই৷ তুমি গাড়ি থামাবে কিনা বলো?’
‘সামনে একটা মন্দির আছে, সেখানে থামাব৷’ ছক্কা মিয়া চাবুক নেড়ে ঘোড়াটাকে খুঁচিয়ে দিয়ে বলল, ‘যেখানে-সেখানে থামলে ঝড়বৃষ্টিতে কষ্ট পাবেন বাবুমশাই, বুঝলেন না? ওইখানে থামিয়ে আপনার ছোটমামাকে খুঁজবেন বরঞ্চ৷’
মন্দিরের আটচালার সামনে গাড়ি দাঁড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে আমি ছক্কা মিয়ার পাশ দিয়ে লাফ দিলাম৷ তারপর আটচালায় ঢুকে পড়লাম৷ বুদ্ধি করে ছোটমামার সুটকেস আর আমার কিটব্যাগটাও দু’হাতে নিয়েছিলাম৷
কিন্তু আটচালায় ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে দেখলুম, ছক্কা মিয়ার টমটম বৃষ্টির মধ্যে আচমকা গড়াতে শুরু করেছে৷ ঘোড়াটা চিঁ হিঁ হিঁ ডেকে তেমনি নড়বড়ে পায়ে দৌড়তে লেগেছে৷ আমি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলুম৷ মুখে কথাটি পর্যন্ত আর ফুটল না৷ ভারি অদ্ভুত লোক তো ছক্কা মিয়া!
এখন ঝড়টা প্রায় কমে এসেছে৷ বৃষ্টি সমানে পড়ছে৷ নির্জন আটচালায় দাঁড়িয়ে আছি৷ প্যান্ট শার্ট ভিজে চবচব করছে৷ প্রায় কেঁদে ফেলার অবস্থা আর কি!
কিছুক্ষণ পরে বিদ্যুতের আলোয় দেখি, কে যেন আসছে৷ আমি চেঁচিয়ে উঠলুম, ‘কে—কে?’
ছোটমামার সাড়া এল৷ ‘অন্তু নাকি রে?’
আমি কাঁদো কাঁদো গলায় বললুম, ‘হ্যাঁ৷ তোমার কী হয়েছিল ছোটমামা?’
ছোটমামা আটচালায় ঢুকে বললেন, ‘কী হবে আবার! যা হবার, তাই হয়েছিল৷ তবে ব্যাটাকে এবার যা জব্দ করেছি, আর কক্ষনো ছক্কা মিয়ার টমটমে ভুলেও চড়তে আসবে না৷’
ছোটমামা আমার কাছে সুটকেস দেখে খুশি হয়ে বললেন, ‘জানতুম, তুই ঠিকই নেমে পড়ে আমার অপেক্ষা করবি কোথাও৷’
‘কিন্তু লোকটা কোথায় রইল?’
হাসলেন ছোটমামা৷ ‘ওকে তুই লোক বলছিস এখনো? ওটা কি লোক নাকি?’
‘তবে কে?’
‘বুঝলিনে? ওর ঘাড়ে একটা চন্দ্রবিন্দু বসিয়ে দে, তাহলে বুঝবি৷ থাকগে, এখন রাতবিরেতে ও-নিয়ে আলোচনা করতে নেই৷ ব্যাপারটা কী জানিস, অন্তু? রাতবিরেতে অমন দু-একজন সওয়ারি ছক্কা মিয়ার টমটমে উঠে পড়বে৷ তারপর কী করবে জানিস? অন্ধকারে ঘাড় মটকানোর তাল করবে৷ যেই টের পেয়েছি আমার পেছনের লোকটার মতলব কী, অমনি ওকে ঠেলে ফেলে দেবার চেষ্টা করেছি৷ কিন্তু ব্যাটা পড়বার সময় অ্যায়সা হ্যাঁচকা টান মেরেছে যে আমিও ওর সঙ্গে তেরপলের ফাঁক দিয়ে নিচে পড়েছি৷’
‘তারপর? তারপর ছোটমামা?’
‘তারপর আর কী? ঝড়বৃষ্টির মধ্যে রাস্তায় কুংফু জুডো যা সব অ্যাদ্দিন কষ্ট করে শিখেছি, চালিয়ে গেলুম৷ এক প্যাঁচে ওকে এমন করে ছুঁড়লুম যে একেবারে বিশ ফুট গভীর খাদে গিয়ে পড়ল৷ এতক্ষণ কোনো বাজ পড়া ন্যাড়া গাছের ডগায় বসে হিঁপিয়ে হিঁপিয়ে কাঁদছে৷’ ছোটমামা হাসতে হাসতে গায়ের জামা খুলে নিঙড়ে নিলেন৷ তারপর বললেন, ‘ঘণ্টা তিনেক কাটাতে পারলেই ফার্স্ট বাস পেয়ে যাব৷ জামাটা নিঙড়ে নে৷ ব্যাগ থেকে তোয়ালে বের করে মাথা মুছে ফেল৷ বাপস!’
আমি শুধু ভাবছিলুম, তাহলে আমার পেছনকার সেই সওয়ারিও কি লোক নয়, সেই লোকটিও কি আমার ঘাড় মটকানোর তালে ছিল? অন্য লোকটার মতো?
আমার মুখ দিয়ে ছোটমামার প্রতিধ্বনি বেরিয়ে গেল, ‘বাপস!…
ছক্কা মিয়ার টমটমে তারপর আর ভুলেও চাপার কথা ভাবতুম না৷ কিন্তু বছর দশেক পরে, যখন কিনা আমি পুরোপুরি সাবালক, একরাতে ভীমপুর স্টেশনে নেমে শুনলুম লাস্ট বাস চলে গেছে৷
স্টেশনবাজার তখন নিঃঝুম৷ সময়টা শীতের৷ আকাশে একটুকরো চাঁদও আছে৷ কিন্তু কুয়াশার ভেতর তার দশা বেজায় করুণ৷ একটা চায়ের দোকান খোলা ছিল৷ শীতের রাত বারোটায় চা-ওলা সবে ঝাঁপ ফেলার যোগাড় করছিল, আমাকে দেখে বুঝি তার দয়া হল৷ এক কাপ চা খাইয়ে দিল৷ শেষে বলল, ‘বাবুমশাই, তাহলে যাবেন কিসে গদাইতলা?’
‘কিসে আর যাব?’ বরং দেখি যদি ওয়েটিং রুমে রাতটা কাটানো যায়!’
চা-ওলা মুচকি হেসে বলল, ‘ছক্কা মিয়ার টমটমেও যেতে পারেন৷’
ছক্কা মিয়ার টমটমের কথা ভুলে গিয়েছিলুম৷ সেবার ঝড়বৃষ্টি ছিল কম৷ ছোটমামাও বড় গল্পে মানুষ ছিলেন৷
হনহন করে চৌমাথায় চলে গেলুম৷ গিয়ে দেখি, শিরীষতলায় আগুন জ্বেলে বসে আছে সেই আদি অকৃত্রিম ছক্কা মিয়া৷ পাশেই তার টমটম তৈরি৷ ঘোড়াটা স্থির দাঁড়িয়ে আছে৷ শীত বাঁচাতে তার পিঠে একটুকরো চটের জামা৷ বললুম, ‘গদাইতলা যাবে নাকি ছক্কা মিয়া?’
ছক্কা মিয়া ইশারায় টমটম চড়তে বলল৷
আজ আর কোনো সওয়ারি এল না দেখে আশ্বস্ত হওয়া গেল৷ টমটম তেমনি নড়বড় করে চলতে শুরু করল৷ ঘোড়াটাও বিকট চিঁ-হিঁ-হিঁ ডাকতে ভুলল না৷ অবিকল সব আগের মতোই আছে৷ এমনকি ছক্কা মিয়ার পেল্লায় গোঁফটারও ভোল বদলায়নি৷ আর সে অদ্ভুত ঘণ্টার শব্দ, টং লং…টং লং…টং লং৷
কনকনে ঠাণ্ডা হাওয়া তেরপলের ঘেরাটোপের ছেঁদা দিয়ে আঙুল ঢুকিয়ে উত্যত্ত করছিল৷ জড়সড় হয়ে কোণা ঘেঁষে রইলুম৷ সামনেকার মোটা ছেঁদা দিয়ে বাইরে কুয়াশা মাখানো জ্যোৎস্নায় ঝিমধরা মাঠঘাট চোখে পড়ছিল৷ গাছগুলো আগাপাছতলা কুয়াশার আলোয়ান চাপিয়েছে আর মাথায় পড়েছে কুয়াশার টুপি৷ টুকরো চাঁদখানা ছেঁড়া ঘুড়ির মতো একটা ন্যাড়া তালগাছের ঘাড়ে আটকে গেছে দেখতে পাচ্ছিলুম৷
মাইলটাক চলার পর রাস্তার ধার থেকে কে বাজখাঁই হাঁক ছাড়ল, ‘রোখো, রোখো!’ অমনি টমটম থেমে গেল৷ ঘোড়াটাও স্বভাবত সামনে দু’ঠ্যাং তুলে একখানা চিঁ-হিঁ ছাড়ল৷ তারপর ছক্কা মিয়ার গলা শুনলুম, ‘দারোগাবাবু নাকি? সেলাম, সেলাম!’
মুখ বাড়িয়ে দেখি, বিশাল এক ওভারকোট পরা মূর্তি৷ সাইকেল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন কোনো এক দারোগাবাবু৷ বললেন, ‘রোসো৷’ সাইকেলখানা তুলে দিলেন৷ তারপর যখন টোপরের ভেতর ঢুকলেন, মনে হল ভূমিকম্প হচ্ছে৷ ঢুকেই আমাকে টের পেয়ে চমকানো গলায় বলে উঠলেন, ‘কে? কে?’
বললুম, ‘আমি৷’
‘আমি? আমি কি মানুষের নাম হয় নাকি?’ বলে দারোগাবাবু টর্চ জ্বেলে সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে আমাকে দেখে নিলেন৷ নামধাম বলতেই হল৷ পুলিশের লোক বলে কথা! সব শুনে উনি বললেন, ‘আমি আপনাদের গদাইতলা থানার চার্জে৷ কিন্তু আপনাকে কখনো দেখিনি৷’
বেগতিক দেখে বললুম, ‘কলকাতায় আছি বহুকাল, তাই দেখেননি৷ তা আপনার নামটা জানতে পারি স্যার?’
‘বংকুবিহারী রায়৷’
‘আসামী ধরতে বেরিয়েছিলেন বুঝি? ওঁকে খুশি করার জন্যই বললুম৷
বঙ্কু দারোগা জলদগম্ভীর স্বরে বললেন, ‘হুম! ব্যাটা এক দাগী বেগুনচোর, ভীষণ ভোগাচ্ছে৷ আজ একটা বেগুনক্ষেতে দুজন সেপাই নিয়ে ওৎ পেতে ছিলুম৷ তাড়া খেয়ে সটান একটা তালগাছের ডলায় উঠে গেল৷ তাকে আর নামাতে পারলুম না৷ তখন সেপাই দুজনকে তালগাছের গোড়ায় বসিয়ে রেখে এলুম৷ আসতে আসতে হঠাৎ সাইকেলের বেয়াদপি৷’
দাগী বেগুনচোর এই শীতকালে সারারাত তালগাছের ডগায় বসে আছে৷ কিন্তু তার জন্য নয়, হতভাগা সেপাই দুজনের কথা ভেবে আমার উদ্বেগ হচ্ছিল৷ মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল, ‘আহা!’
‘আহা মানে?’ আমাকে ফের টর্চ জ্বেলে সন্দিগ্ধ নজরে দেখে বঙ্কু দারোগা বললেন, ‘হুম! আপনি মশাই এই মড়া-বওয়া গাড়িতে এত রাতে চাপলেন যে? আপনি জানেন, আজকাল সওয়ারি জোটে না বলে ছক্কা মিয়া মড়া বয়ে নিয়ে যায় গঙ্গার ঘাটে!’
‘বলেন কী! তাহলে তো ভয়ের কথা৷’ অবাক হয়ে বললুম, ‘সত্যি ভয়ের কথা, আগে জানলে…’
কথা কেড়ে বঙ্কু দারোগা বললেন, ‘হয়তো জেনেশুনেই চেপেছেন৷ কিচ্ছু বলা যায় না৷’
‘কেন এ কথা বলছেন?’
‘বলছি আপনার চেহারা দেখে৷ এমন শুঁটকো রোগা চিমসে বাসি মড়ার মতো লোক সচরাচর দেখা যায় না কি না৷’
এবার আমার খুব রাগ হল৷ ‘কী বলতে চান আপনি?’
‘রাতবিরেতে আজকাল ছক্কা মিয়ার টমটমে কে জ্যান্ত, কে মড়া বোঝা যায় না মশাই!’
হাত বাড়িয়ে বললুম, ‘এই আমার হাত! পরীক্ষা করে দেখতে পারেন, আমি মড়া না জ্যান্ত!’
বঙ্কু দারোগা আমার হাত সরিয়ে দিলেন জোরে৷ ‘বাপস! এ যে বেজায় ঠাণ্ডা!’
‘ঠাণ্ডা হবে না? শীতের রাতে এই মাঠের মধ্যে হাত কি গরম থাকবে?’
‘না মশাই, এমন রাতে বিস্তর সিঁদেল চোরের হাত পাকড়েছি, তারা কেউ এমন ঠাণ্ডা ছিল না৷’
‘কী? আমায় সিঁদেল চোর বললেন?’
বঙ্কু দারোগা গলার ভেতর থেকে বললেন, ‘সিঁদেল চোরের ভূত হতেও পারেন৷ কিচ্ছু বলা যায় না৷ তখন আহা বলা শুনেই সন্দেহ জেগেছে৷’
আর সহ্য হল না৷ খাপপা হয়ে চেঁচালুম, ‘পুলিশ হোন আর যাই হোন, আপনাকে আমি সাবধান করে দিচ্ছি মশাই৷’
দারোগাবাবু ফের মুখের ওপর টর্চ জ্বেলে বললেন, ‘উঁ হুঁ হুঁ৷ বড্ড এগিয়ে এসেছেন৷ সরে বসুন! সরে বসুন বলছি!’
মুখের ওপর টর্চের আলো কারই বা সহ্য হয়! ‘টর্চ নেভান!’ বলে টর্চটা ঠেলে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিলুম৷ টর্চটা নিভে গেল৷ এবং কোথায় ছিটকে পড়ল৷ কিন্তু এটাই বোধ হয় ভুল হল৷ আর বঙ্কু দারোগা বিকট গলায় ‘ভূত! ভূত!’ বলে চিক্কুর ছেড়ে আমাকে এক রামধাক্কা মারলেন৷ টোপরের একপাশের জরাজীর্ণ তেরপলের ওপর কাত হয়ে পড়লুম৷ তেরপলটা ফরফর করে ছিঁড়ে গেল এবং টাল সামলাতে না পেরে গড়িয়ে নিচে পড়ে গেলুম৷ কানের পাশ দিয়ে চাকা গড়িয়ে গেল প্রচণ্ড বেগে৷ পলকের জন্য দেখলুম কুয়াশা-ভরা নীলচে জ্যোৎস্নায় কালো টমটম দূরে সরে যাচ্ছে৷ ভেসে আসছে অদ্ভুত এক শব্দ টং লং…টং লং…টং লং…!
ভাগ্যিস রোডস দফতরের লোকেরা রাস্তা মেরামতের জন্য কিনারায় বালির গাদা রেখেছিল! আঘাত টের পেলুম না৷ সামনে একটা বাড়ি দেখা যাচ্ছিল, লোকেরা লণ্ঠন লাঠিসোঁটা নিয়ে বেরিয়ে এল৷ তখন ঘটনাটা তাদের আগাগোড়া বলতে হল৷
কিন্তু সব শুনে ওরা আমার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে রইল৷ একজন বলল, ‘কী বলছেন বাবু? ছক্কা মিয়ার টমটম পেলেন কোথায়? কাল ভীমপুরের কাছেই একটা ট্রাকের ধাক্কায় ছক্কা মিয়া আর তার ঘোড়াটা মারা পড়েছে যে! ভাগ্যিস টমটমে একটা মড়া ছিল শুধু! সঙ্গের লোকেরা বাসে চেপে গঙ্গার ধারে গিয়েছিল৷ কিন্তু অবাক কাণ্ড দেখুন, মড়াটা একেবারে আস্ত ছিল৷ তুলে নিয়ে গিয়ে ভালোয় ভালোয় চিতেয় তুলতে পেরেছে৷’
বঙ্কু দারোগার ওপর সব রাগ সঙ্গে সঙ্গে ঘুচে গেল৷ বরং উনি আমাকে বাঁচিয়েই দিয়েছেন দেখা যাচ্ছে৷ কিন্তু ওঁর নিজের ভাগ্যে কী ঘটল কে জানে! আহা বেচারা!
কী ঘটল, তা পরদিন শুনলুম৷ বঙ্কুবাবু তখন হাসপাতালে৷ লোকে বলছে, আসামী ধরতে গিয়ে সাইকেল থেকে পড়ে কোমরের হাড় ভেঙেছে৷ সাইকেলও অক্ষত নেই৷ কিন্তু আসল ব্যাপারটা তো আমি জানি৷ তবে যাই হোক, আমার ওপর যেটুকু ফাঁড়া গেছে, তার জন্য দায়ী স্টেশন বাজারের সেই ধড়িবাজ চা-ওলা৷ কেমন হেসে বলেছিল, ‘ছক্কা মিয়ার টমটমেও যেতে পারেন!’ সব জেনেশুনেও কী অদ্ভুত রসিকতা!
অবশ্য এমনও হতে পারে, সে বলেছিল, ‘ছক্কা মিয়ার টমটমেও যেতে পারতেন৷’ আমিই হয়তো ভুল শুনেছিলুম৷ ক্রিয়াপদের গোলমাল স্রেফ!…