চ্যাপ্টার ৮: ইনঅ্যাপ্রোপিয়েট অ্যাক্ট

চ্যাপ্টার ৮: ইনঅ্যাপ্রোপিয়েট অ্যাক্ট

প্রথম ট্রেন আসার কয়েক ঘণ্টা আগেই আমি ঘুম থেকে জেগে উঠলাম। তারপরে ভেন্ডিং মেশিন থেকে একটা এনার্জি ড্রিঙ্ক কিনলাম।

আমার সারা শরীরে ব্যথা। চারপাশে এখনো অন্ধকার। সকালের ঘুঘুরে পোকা, কাক, ঘুঘুর ডাক শুনতে পেলাম।

মিয়াগিকে ভিতরে উঠে বসে দু’হাত দু’দিকে প্রসারিত করতে দেখলাম। এই কাজটা করতে দেখে ওর মনুষ্য দিকটা আরও বেশি ফুটে উঠল। বলাই বাহুল্য এই প্রথমবারের মতো একজন সাধারণ মানুষ যা করে; সেরকম কিছু একটা করল ও।

আমি ওর দিকে তাকালাম। এখনো আমার হাতে একটা বোতল ধরা। সম্ভবত গতরাতের গরমের জন্যই, ও সামার কার্ডিয়ান খুলে কোলে রেখেছে। এই কারণে উন্মুক্ত হয়ে পড়েছে ওর কমনীয় কাঁধ।

…নয়তো আমি বিভ্রান্ত হয়ে গিয়েছি।

না-হয় তিন মাস বেঁচে থাকা অসহ্য হয়ে যাচ্ছে আমার জন্য। এমনও হতে পারে একের পর এক হতাশায় নিমজ্জিত হচ্ছিলাম আমি। সম্ভবত আমি এখনো আধো-ঘুমে, ক্লান্ত এবং যন্ত্রণায় ছিলাম বলে।

অথবা আমি যেরকম মেয়ে পছন্দ করি; আমার প্রত্যাশার তুলনায় মিয়াগি মেয়েটা অনেকটা সেরকমই।

আসলে এটা এখন কোনো ব্যাপার না। হঠাৎ আমার মাঝে মিয়াগির সাথে ভয়ঙ্কর কিছু করার তাড়না অনুভব করলাম। আরও স্পষ্টভাবে, মিয়াগিকে চেপে ধরে খারাপ কিছু করার ইচ্ছে হলো। আমার সমস্ত আবেগের বহিঃপ্রকাশ ওকে ব্যবহার করে করার ইচ্ছে হলো।

আমার চিন্তাটা সম্পূর্ণ অনৈতিক। এমন একটা কাজ যেটা নিশ্চিতভাবেই আমার আয়ুষ্কাল অবসান করে দিবে। কিন্তু তাতে কী? আমি বেশ কিছু মাস আগেই মারা যাবো।

তো আমি যা করতে চাই; সেটা করেই হাসিমুখে মারা যাবো। আমার “মৃত্যুর আগে যা করতে চাই” তালিকায়, আমার কামনার বিরুদ্ধে না যাওয়ার জন্য লিখেছিলাম।

এর আগে আমি ওকে আমার সেসব কামনার ব্যাপ্তির বাইরে বিবেচনা করেছিলাম। কিন্তু একবার ওকে সে-দৃষ্টিতে দেখতে শুরু করার পরে মনে হচ্ছে মিয়াগির চেয়ে উপযুক্ত আর কেউ নেই এমন মরিয়া ঘটনা ঘটানোর জন্য।

আমি জানি না কেন ও আমার স্যাডিস্ট স্বভাবকে আরও উদ্দীপ্ত করে তুলল। যেহেতু ও সবসময় নির্বিকার থাকার ভান করে। আমি ওকে ওর এই ভান ধরে থাকাটাকে একটু বিরক্ত করতে চাই এবং ওর দুর্বল জায়গা দেখিয়ে দিতে চাই। ওকে বলতে চাই, “তুমি এতটা কঠোর হওয়ার ভান করো, আদতে তুমি খুবই দুর্বল।”

ওর সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই, মিয়াগি হালকা রক্ষণাত্মক ভঙ্গি করল যেন ও আমার চিন্তাটা ধরতে পেরেছে।

“তোমার কাছে আমার একটা প্রশ্ন আছে।”

“…জি?”

“একবার যদি কোনো পর্যবেক্ষক তাদের লক্ষ্যবস্তুকে ‘অনুচিত’ কাজ করতে দেখে অথবা এধরনের কিছু করে, তার জীবন অবসান করতে ঠিক কত সময় লাগে?”

মিয়াগির চোখে সতর্কতা দেখা গেল। “কেন আপনি একথা জিজ্ঞেস করছেন?”

“আমি যদি তোমার সাথে এখানে জবরদস্তি করি তাহলে মৃত্যুর আগে আমি ঠিক কতটুকু সময় পাবো জানতে চাচ্ছিলাম।”

কথাটা শুনে, ওকে ততটা আশ্চর্য মনে হলো না।

ঘৃণার সাথে, ও আমাকে আগের চেয়েও ঠান্ডা চোখে দেখতে লাগল।

“আমি সাথে সাথেই যোগাযোগ করতে পারবো। এরপরে, বিশ মিনিটও লাগবে না। পালিয়ে যাওয়া সম্পূর্ণ অসম্ভব ব্যাপার।”

“তো, আমার ইচ্ছেমতো কাজ করার জন্য দশ মিনিট হাতে আছে?” আমি ঝটপট ওকে আবারো প্রশ্ন করি।

মিয়াগি চোখ সরিয়ে নিয়ে দুর্বল কণ্ঠে বলল, “এরকম কথা কেউ বলেনি।”

অদ্ভুতভাবে, মিয়াগি পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করল না। ও কেবল ওর কোলের দিকে তাকিয়ে রইল।

আমার হাত ওর দিকে এগিয়ে গেল।

আমার পরিকল্পনা ছিল ওকে অপমান করা এবং আঘাত দেয়া, কিন্তু যে মুহূর্তে আমি ওর উন্মুক্ত কাঁধ স্পর্শ করলাম, ওর দুঃখ ভারাক্রান্ত মুখটা আমার শরীর আড়ষ্ট করে ফেলল।

আমি কি সত্যি মিয়াগির উপর জোর খাটাতে পারবো? আমার কামনা চরিতার্থ করার জন্য ওকে ব্যবহার করবো?

যদি তাই করি, ও নিশ্চিতভাবেই আঘাত পাবে। হতে পারে হাঁটুর কাছের বিশাল ক্ষমতার পাশে আরেকটি যোগ হবে?

হয়তো আমি ওর ঘোর-কালো চোখ থেকে আরও একটু আলো কেড়ে নিবো।

অথবা সবকিছু শেষ হয়ে যাওয়ার পরে, ও শুধু ব্যঙ্গাত্মক মন্তব্য করবে যেন সে এসবে একটুও বিচলিত হয়নি। …আপনি কি সন্তুষ্ট?”

সত্যি কি আমি সন্তুষ্ট হবো?

আমি কী করার চেষ্টা করছি?

“আমার শক্ত হয়ে উঠা পেশী তৎক্ষণাৎ নিস্তেজ হয়ে এলো। তার বদলে, আমি তীব্র শূন্যতা অনুভব করলাম।

মিয়াগির হাল ছেড়ে দেওয়া চোখগুলোর উপর চোখ পড়তেই, আমি নিজেও বিষণ্ন হয়ে পড়লাম।

ওর কাঁধ থেকে হাত সরিয়ে নিয়ে পাশে বসলাম। কত দ্রুত আমার আচরণ বদলে গেল চিন্তা করে আমি ব্রিত হয়ে গেলাম।

“সবসময় আমার মতো আবর্জনাদের সামলানো খুব বিপজ্জনক চাকরি হওয়ার কথা।” আমি বললাম।

ও এখনো চোখ সরিয়ে রেখেছে। “যতক্ষণ পর্যন্ত আপনি সেটা বুঝতে পারেন।“

এখন আমি বুঝতে পারছি কেন আমার মূল্য ৩০০,০০০ ইয়েন। ফিরে আসার আর কোন উপায় নেই এমন একটা কাজ করা থেকে আমি এক ধাপ দূরে ছিলাম।

“বিপজ্জনক কাজ। আমি বাজি ধরতে পারি, আমার মতো লোকজনের তো অভাব থাকার কথা না? মৃত্যুর আগে উন্মাদ হয়ে যাওয়া লোকজন এবং ওদের রাগ পর্যবেক্ষকের উপর বহিঃপ্রকাশ করে এমন।”

মিয়াগি আস্তে করে ওর মাথা ঝাঁকাল। “বাস্তবতা হচ্ছে, আপনার কেসটা অনেক সহজ। অনেকেই ছিল যারা আরও বেশি বেপরোয়া হয়ে উঠেছিল” আমাকে শান্ত রাখার চেষ্টা করে ও বলল।

আমি ওকে ওর হাঁটুর ক্ষতটা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করতে চাচ্ছিলাম। ওর সাথে যেদিন দেখা হয়েছে; সেদিন থেকেই আমার কৌতূহল ছিল। কিন্তু আমি চুপ করে রইলাম। এখন জানতে চেষ্টা করা এবং উদ্বেগ দেখানো আমার জন্য চপেটাঘাতের মতো হবে। আর এর ফলাফল হচ্ছে বিষণ্ণতা।

তার বদলে, আমি জিজ্ঞেস করলাম, “তুমি এরকম চাকরি নিলে কেন?”

“সহজ করে বললে, আমার নিতে হয়েছিল।”

“আমাকে স্পষ্ট করেই বলো।”

মিয়াগি অবাক হলো। “আমি ভেবেছিলাম মিস. হিমেনো ছাড়া আর কিছুতেই আপনার কোনো আগ্রহ নেই।”

“কথাটা একদম সত্যি নয়। আমি যদি তোমার মধ্যে কোনো আকর্ষণ অনুভব না করতাম; তাহলে আমি যা করার চেষ্টা করেছিলাম, সেটা করার চেষ্টা করতাম না।”

“…তাই নাকি। ধন্যবাদ।”

“তুমি না চাইলে এ-বিষয়ে কথা বলার প্রয়োজন নেই।”

“আসলে, আমার অতীত নিয়ে নির্দিষ্ট করে কিছু লুকানোর নেই… উম, আমি ইতোমধ্যে আপনাকে আয়ুষ্কাল ছাড়া অন্যান্য সব সম্পর্ক নিয়ে বলেছি। একজন ব্যক্তি তার স্বাস্থ্য এবং সময়ও বিক্রি করতে পারে, তাই না?”

আমি সম্মতিসূচক মাথা নাড়লাম।

“তাহলে, আমি সময় বিক্রি করেছি। মোটামুটিভাবে প্রায় ত্রিশ বছর।”

…একদম মিলে গেছে। আমি প্রথম থেকেই এটাই চিন্তা করছিলাম।

সময় বিক্রি করার মানেটা কী।

“বলতে চাচ্ছি… যদি তুমি সময় বিক্রি করো, তার মানে হচ্ছে…“

“অবশ্যই, পর্যবেক্ষকদের বেশিরভাগ হচ্ছে তারাই; যারা আপনার মতো দোকানে এসেছিল এবং তাদের সময় বিক্রি করেছিল। যদিও এটা করার মাধ্যমে তারা তাদের কার্যত নিরাপত্তা এবং সম্পর্কও সাথে সাথে বিক্রি করে দেয়…

“তো এর আগ পর্যন্ত তুমি সাধারণ মানুষ ছিলে?”

“হ্যাঁ। আপনার মতো সাধারণ মানুষ ছিলাম, মি. কুসুনোকি।”

আমি স্বাভাবিকভাবেই ধরে নিয়েছিলাম মিয়াগি জন্ম থেকেই অন্যরকম ছিল। জন্ম থেকেই ব্যঙ্গাত্মক। জন্ম থেকেই শক্ত ধাঁচের।

কিন্তু এখন ও আমাকে যা বলল। হয়তো বা টিকে থাকার জন্য ওর এসব বৈশিষ্ট্য অর্জন করে নিতে হয়েছিল।

“তোমার বয়স তবুও বাড়ে? তো যদি তুমি ত্রিশ বছর বিক্রি করে দিয়ে থাকো… একবার তুমি চাকরি থেকে মুক্তি পেলে, তোমার বয়স তখন চল্লিশ হবে?”

“অবশ্যই আমার বয়স বাড়ে। হ্যাঁ, এটা সম্ভব। যদি ততদিন পর্যন্ত আমি টিকে থাকি” ও বলল বিনয়ী হাসি দিয়ে।

তার মানে ওকে আরও কয়েক দশক অদৃশ্য থাকতে হবে।

“…তোমার টাকার এতো প্রয়োজন হলো কেন?”

“আজকে অনেক প্রশ্ন করছেন, হুম।”

“উত্তর দেওয়া জরুরি নয়।”

“আমি যদি বলি এটা খুব মজার গল্প না?”

“আমার আয়ুষ্কাল বিক্রির চেয়ে মজার কিছু হবে এটা নিশ্চিত।”

মিয়াগি টাইম টেবিলের দিকে তাকাল। “মনে হচ্ছে, প্রথম ট্রেন আসার আগ পর্যন্ত বেশ কিছুটা সময় আছে।”

তারপরে ও আমাকে অল্প অল্প করে উত্তর দেয়া শুরু করল।

***********

“আমার এখনো বুঝে আসে না কেন আমার মা আরও আয়ুষ্কাল কেনার জন্য, উনার জীবনের কয়েক দশক সময় বিক্রি করে দিয়েছিলেন। উনাকে যতটুকু মনে পড়ে, আমার মা যে বাস্তব জগতে থাকতেন; সেটা নিয়ে সবসময় অসন্তুষ্ট ছিলেন। স্পষ্টভাবে বললে আমার বাবা আমার জন্মের আগেই উনাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন। উনি বাবাকে প্রতিটি ক্ষুদ্র বিষয়ে অভিশাপ দিতেন। কিন্তু আমার বিশ্বাস অন্তরের গভীর থেকে উনি চাইতেন বাবা যেন ফিরে আসে। সম্ভবত এ-কারণেই মা উনার আয়ুষ্কাল বাড়াতে চাইতেন। বাবার জন্য অপেক্ষা চালিয়ে যাওয়ার জন্য। অবশ্যই, এর সাথে আমার বাবার জীবনকালে কোনো প্রভাব পড়েনি, এবং আমার মা সবার কাছেই অদৃশ্য হয়ে রইলেন। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, উনাকে এতগুলো আঘাত দিয়ে চলে যাওয়া একজন মানুষের জন্য অপেক্ষার কারণ বুঝতে পারতাম না। তবুও যদি উনি বাবার জন্য আয়ুষ্কাল বাড়ানোর আশা করেও থাকে, তবুও লোকটি কে তা গ্রাহ্য করার মতো বিষয় ছিল না। কারো উপর নির্ভর করার মতো কেউ ছিল না উনার। বাবা ছাড়া আর কেউ উনাকে ভালোবাসতেন না।“

“আমি আমার দুর্দাশাগ্রস্ত মাকে ঘৃণা করতাম। তিনিও আমাকে ঘৃণা করতেন। সবসময় আমাকে মনে করিয়ে দিতেন কিভাবে তিনি আশা করেছিলেন ‘এটা কিছুতেই যাতে জন্ম না নেয়। যখন তিনি উনার সময় বিক্রি করে পর্যবেক্ষক হয়ে আমার চোখের সামনে থেকে উধাও হয়ে গেলেন, আমার মনে পড়ে আমার তখন ছয় বছর বয়স। এরপরে আমার খালা আমাকে পরবর্তী বছরগুলোতে উনার জিম্মায় নিয়ে নেন। সেখানেও আমাকে আপদ হিসাবে বিবেচনা করা হতো।”

মিয়াগি চুপ করে গেল। ওর মুখ চিন্তায় বন্ধ হয়ে গেল।

ও মনে হচ্ছে অনুভূতিটা কাটিয়ে উঠতে পারেনি। ও হয়তো বা বুঝতে পেরেছে; ওর বক্তব্য অজান্তেই সহানুভূতির মতো শোনাচ্ছে।

ও কথা চালিয়ে যেতেই ওর কথাগুলো আগের চেয়ে নির্লিপ্ত শোনাতে লাগল। যেন ও অন্য কারো কথা বলছে।

“আমার বয়স যখন দশ বছর, তখন আমার মা মারা যায়। কিভাবে তিনি মারা গিয়েছিলেন সেটা অস্পষ্ট। যাহোক, তিনি যাদের পর্যবেক্ষণ করতেন তাদের কারো হাতেই উনার মৃত্যু হয়েছে। এতটুকু স্পষ্ট ছিল। যতই কেউ আয়ুষ্কাল বাড়াক না কেন, আঘাত এবং অসুস্থতা সম্পূর্ণ অন্য ইস্যু। যখন আমি প্রথম শুনলাম, আমি ভাবলাম এটা হয়তো কোনো প্রতারণা হতে পারে।”

“যে লোকটি আমাকে উনার মৃত্যু সম্পর্কে অবহিত করেছিলেন; তিনি আমাকে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সম্পর্কে জানালেন…। ‘তোমার ঋণ আছে লোকটি বলেছিল। ‘তোমার মায়ের রেখে যাওয়া অনেক বড় ঋণ। সেটা ফিরিয়ে দেওয়ার মাত্র তিনটি পথ খোলা আছে তোমার সামনে। তোমার আয়ুষ্কাল বিক্রি করা, তোমার সময় বিক্রি করা, অথবা তোমার স্বাস্থ্য বিক্রি করা’ আমার মা উনার আয়ুষ্কাল বাড়ানোর জন্য, বলতে গেলে উনার সারা জীবনের মূল্যের মতো সময় বিক্রি করেছিলেন। কিন্তু উনার বিক্রি করা সময়ে কাজ করার আগেই মারা গিয়েছেন। ঋণটা তখন সবচেয়ে কাছের আত্মীয়, তার মেয়ের কাছে অতিবাহিত হয়েছে। আমি যদি ওই মুহূর্তে ঋণ পরিশোধ করতে না পারি; তবে আমাকে জোরপূর্বক যে-কোনো একটি বেছে নিতে হবে।

“আর তুমি সময় বেছে নিলে” আমি বললাম।

“ঠিক। আমাকে ত্রিশ বছরের একটু বেশি বিক্রি করতে হলো ঋণ পরিশোধ করার জন্য। তো এখন আমি পর্যবেক্ষক হিসাবে কাজ করছি। এটা অনেক ঝুঁকিপূর্ণ নিঃসঙ্গ ধরনের কাজ, কিন্তু বিনিময়ে, এটা আমাকে মানুষের জীবনযাত্রা সম্পর্কে গভীর ধারণা দিয়েছে এবং মানুষের জীবনের মূল্য শিখিয়েছে। একবার ঋণ পরিশোধের পরে আমার মনে হয় আমি অন্য যে কারো চেয়ে ‘যথাযথ’ উপায়ে জীবনযাপন করতে পারবো। এসব দিক চিন্তা করলে, এটা খুব একটা খারাপ চাকরি না।“

ও এমনভাবে কথা কথাগুলো বলল, মনে হলো এটা ছিল ওর দায়মোচন। কিন্তু যেভাবেই দেখি না কেন; মিয়াগির জীবনটা পুরোদস্তর ট্র্যাজেডি।

“আমি বুঝতে পারলাম না” আমি বললাম। “আমি হলে এমন অবস্থায় আয়ুষ্কাল বিক্রি করে দিতাম। কারণ, ঋণ পরিশোধ করার আগ পর্যন্ত তুমি টিকে থাকবে; এরকম কোনো গ্যারান্টি নেই, আছে না কি? আর তোমার মা-ও মারা গিয়েছে। এমনকি যদি তুমি শেষ পর্যন্ত টিকে যাও-ও, তোমার জীবনের সেরা মুহূর্তগুলো ততদিনে শেষ হয়ে যাবে। আমি বিদ্রূপ করার জন্য বলছি না। আমি তোমার কথাই ধার নিচ্ছি, তুমি মাত্র পথ চলা শুরু করেছো। এতসব যন্ত্রণার সাথে কারবার করার পরে চল্লিশ বছরে নতুন করে সবকিছু শুরু করা! আমি এটাকে ট্র্যাজেডিই বলবো। এরচেয়ে বিক্রি করে দেওয়াই ভালো।”

“আমার আয়ুষ্কাল যদি মূল্যবান হতো, আমি সত্যিই বিক্রি করে দিতাম।”

“মূল্যটা কত?”

“আপনার সমান” মিয়াগি বলল; যেন সে খুব মজার কথা বলেছে। “বছরে ১০,০০০ ইয়েন… যদি আমি আপনার সাথে কঠোর আচরণ করে থাকি; তবে এর অর্থ আমিও এত কম মূল্য মেনে নিতে পারছিলাম না। অন্যভাবে বলতে গেলে, আমরা একই। সুতরাং, আপনার উপর দিয়ে ঝাল ঝাড়ার জন্য আমি দুঃখিত।”

“…আমি কঠোর হতে চাই না। কিন্তু এই মুহূর্তেই কি মরে যাওয়া ভালো নয়?” আমি জিজ্ঞেস করলাম। “ভবিষ্যতে তো আশা করার মতো কিছু নেই।”

“হ্যাঁ। আপনি ঠিকই বলেছেন। আপনি একদম ঠিক বলেছেন। তবুও আমার মনে হয় আমি এটা করতে পারবো না কারণ, আমি আমার মায়ের মতো হয়েছি। আমি একটা অথর্ব, গর্দভ। বেঁচে থাকার কোনো মানে নেই; তবুও আমি দীর্ঘজীবী হতে চাই। সম্ভবত এমনকি মৃত্যুর সময়ও আমরা একইরকম থাকবো। কিন্তু… আপনি দেখতে পাচ্ছেন, এটা তেমন সহজ বিষয় নয়। সম্ভবত কোনো একদিন ভালো কিছু হবে।”

“আমি এমন একজন লোককে চিনি যে কিনা পঞ্চাশ বছর বয়স পর্যন্ত নিজেকে এই কথা বলতে বলতে মরে গিয়েছে কিন্তু শেষ পর্যন্ত কিছুই হয়নি” আমি রসিকতা করে বললাম।

“আমিও এমন একজনকে চিনি” মিয়াগি কৃত্রিম হাসি হাসল।

ওর সাথে হাসিতে যোগ দিয়ে একটা সিগারেট ধরলাম। মিয়াগি উঠে দাঁড়াল। আমার হাত থেকে একটা সিগারেট নিয়ে মুখে পুরল।

ও একটা লাইটার তুলল জ্বালানোর জন্য। কিন্তু মনে হচ্ছে ওটার তেল শেষ হয়ে গিয়েছে। বারবার চেষ্টা করার পরেও আগুন জ্বলল না।

মিয়াগি আমার সিগারেটের দিকে ইঙ্গিত করে ওর মুখটা কাছে ঘেঁষে আনলো। আমি ওর ইশারা অনুসরণ করে একই কাজ করলাম। শেষভাগে ছোঁয়া লাগল। অগ্নিশিখা ধীরে ধীরে মিয়াগির দিকে স্থানান্তর হতে লাগল।

মিয়াগিকে প্রথমবারের মতো রিল্যাক্স করতে দেখলাম।

আমি চাই ও আমাকে অন্তত সহনীয় লোক হিসাবে মনে রাখুক।

আমি রেললাইনের দিকে তাকালাম। সূর্য উঠা শুরু হয়েছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *