চ্যাপ্টার ৬ : ওয়ান হু চেঞ্জড, ওয়ান হু নেভার ডিড
সকালেও বৃষ্টি পড়তে লাগল। এতই ভারী বৃষ্টি হতে লাগল যে তখনই বিছানা না ছাড়ার একটা অজুহাত পেয়ে গেলাম। এই কারণে এরপরে কী করবো সেটা নিয়ে ভাবার সময় পেয়ে গেলাম।
যখন আমি “মৃত্যুর আগে যা যা করতে চাই” লিস্টটার দিকে তাকিয়ে ছিলাম, মিয়াগি এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করল, “আজকের দিন কিভাবে কাটাবেন বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন?”
ওর মুখ থেকে দুঃসংবাদ শোনার জন্য অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছি আমি। তাই ওর পরবর্তী কথার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম। ও যা-ই বলুক না কেন; ঝটকা না খাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। কিন্তু আমার লিস্টের দিকে তাকিয়ে ও শুধু এইটুকুই বলল। প্রশ্নটায় কোনো গভীর অর্থ আছে বলে মনে হলো না।
আমি মিয়াগির দিকে আরেকবার তাকালাম।
ওর সাথে প্রথমবার দেখা হওয়ার সময় থেকেই আমি একথা ভাবছি। ওর হাবভাবে সুশৃঙ্খলার বদলে নিজস্বতা আছে।
স্বীকার করতে দোষ নেই, ও একদম ঠিক আমি যেরকম মেয়ে পছন্দ করি; সেরকম ধরনের। সতেজ চোখ, বিষণ্ন ভ্রু, সরু ঠোঁট, মাপা মাথা, ঝরঝরে চুল, নার্ভাস আঙুল, সরু উরু; আমি আরও বলে যেতে পারবো।
এই কারণে ও আমার অ্যাপার্টমেন্টে আসার পর থেকে, আমার আচার আচরণ একটা চক্রের মধ্যে বন্দি হয়ে পড়েছে।
আমার রুচির সাথে একদম যথাযতভাবে মিলে যায় এমন একটা মেয়ের সামনে অসাবধানতাবসত হাইও তুলতে পারি না। আমি আমার অভিব্যক্তি এবং শ্বাসপ্রশ্বাস লুকাতে চাচ্ছিলাম।
আমার পর্যবেক্ষক যদি ঠিক ওর বিপরীত কেউ হতো। কুৎসিত, নোংরা এবং মধ্য-বয়সি কেউ; নিশ্চিত আমি আরও বেশি আয়েশ করতে এবং সঠিক কাজ করার জন্য যথেষ্ট চিন্তা করতে পারতাম।
কিন্তু মিয়াগিকে পেয়ে আমার বিকৃত কামনা এবং দীনহীন আকাঙ্ক্ষা চাগিয়ে উঠল।
“এটা শুধুই নিজস্ব মতামত” মিয়াগি বলতে শুরু করল। “কিন্তু আপনি কি সত্যি অন্তর থেকে ‘যা যা করতে চাই” এর লিস্ট অনুযায়ী কাজ করতে চান?”
“আপাতত, সেরকমই চিন্তা-ভাবনা আমার।“
“আমি যদি ভুল না বলে থাকি, আমার মনে হচ্ছে আপনি এমন জিনিসের তালিকা করেছেন; যা কিনা আপনার কাছে মনে হয়েছে অন্যরাও মৃত্যুর আগে করতো…”
“তুমি সম্ভবত ঠিকই বলেছ” আমি স্বীকার করে নিলাম। “হয়তো বা মৃত্যুর আগে আমি সত্যিই কিছু করতে চাই না। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে আমি আসলে কিছুই করতে পারবো না। সেজন্য আমি অন্যকে অনুকরণ করার চেষ্টা করছি।”
“আমার মনে হয় চাইলে আপনি এরচেয়ে ভালো কোনো উপায় পেয়ে যাবেন।”
আমার উপরে কিছুক্ষণ জ্ঞান ফলিয়ে, মিয়াগি ওর নিজের জায়গায় ফিরে গেল।
সেই সকালে আমি যে উপসংহারে পৌছলাম তা হলো।
আমার বিকৃত কামনা এবং দীনহীন আকাঙ্ক্ষাটা আরেকটু নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। আমার সস্তা চিন্তা করা উচিত, আরও নির্লজ্জ, আরও অভদ্র হওয়া উচিত, এবং আমার শেষ কয়েকটি মাস নিজের সহজাত প্রবৃত্তি অনুসারে চলা উচিত।
এই পর্যায়ে সংশোধন করার প্রয়োজন কী? আমার তো হারানোর কিছুই নেই।
আমি আবারো তালিকার দিকে তাকালাম। তারপরে, নিজেকে প্রস্তুত করে একজন বন্ধুকে ফোন করলাম।
এবার, অল্প কয়েকটা ডায়ালটোনের পরে, উত্তর এলো।
*****
একটা ছাতা নিয়ে বের হলাম আমি। কিন্তু যে সময়ে ট্রেন স্টেশনে পৌঁছালাম, ততক্ষণে বৃষ্টি থেমে গিয়েছে।
পরিষ্কার আকাশের নিচে সঙ্গে ছাতা রাখার অর্থ হচ্ছে, একটু আগে হয়ে যাওয়া বৃষ্টিটাকে অযৌক্তিক কোনো মিথ্যার মতো মনে হয়।
ভেজা রাস্তা জ্বলজ্বল করছিল। উত্তাপ থেকে বাঁচার জন্য স্টেশনের ভেতরে গেলাম। কিন্তু ভেতরেও একই অবস্থা।
অনেকদিন হয়ে গেছে ট্রেনে চড়িনি। ওয়েটিং রুমে ঢুকে ভেন্ডিং মেশিন থেকে একটা সোডা কিনলাম। বেঞ্চে বসে তিন ঢোকে ড্রিংকসটা শেষ করলাম। মিয়াগি ওর জন্য মিনারেল ওয়াটার কিনে, চোখ বন্ধ করে ঢকঢক করে গিলে ফেলল।
আমি জানালা দিয়ে আকাশের দিকে তাকালাম। একটা ক্ষীণ রংধনু তৈরি হচ্ছে। আমি ভুলেই গিয়েছি এমন বিস্ময় কখনো ঘটেছিল কিনা।
রংধনু দেখতে কেমন হয় তা আমি অবশ্যই জানি। যখন রংধনু সৃষ্টি হয়, কিভাবে মানুষ রংধনুর সাথে জড়িয়ে যায়। কিন্তু কোনো কারণে “এটা যে সত্যি” আমি এই প্রাথমিক জ্ঞানটাই ভুলে বসে আছি।
একটা নতুন জিনিস খেয়াল করলাম, আকাশের বিশাল ধনুকের ছিলার মতো বাঁকানো বস্তুটার মধ্যে আমি মাত্র পাঁচটা রং দেখতে পাচ্ছি, লাল, হলুদ, সবুজ, নীল, বেগুনি। সাতটার মধ্যে দুইটি দেখতে পারছি না।
কোন কোন রং বাদ পড়ে যাচ্ছে চিন্তা করে কাল্পনিক প্যালেটে রং মেশাতে লাগলাম। তারপরেই বুঝতে পারলাম যে দুটি রং আমি দেখতে পারছিলাম না সেগুলো হচ্ছে কমলা এবং বেগুনি নীল।
“হ্যাঁ আপনার উচিত ভালো করে দেখে নেওয়া” মিয়াগি বলল এক পাশ থেকে। “এটাই হয়তো আপনার দেখা শেষ রংধনু হতে পারে।”
“হ্যাঁ,” আমি মাথা নাড়লাম। “আমরা যদি ব্যাপারটা আরও বিস্তারিত বলি, আমি সম্ভবত আর কোনো ওয়েটিং রুম ব্যবহার করতে পারবো না। অথবা এটা ড্রিঙ্কিং সোডার ক্ষেত্রেও ঘটতে পারে। অথবা এমনও হতে পারে শেষবার মতো ক্যানটা ছুড়ে মারলাম।“
“যে-কোনো কিছুই সম্ভবত শেষবার। কিন্তু এটা সবসময়ই এভাবেই সাজানো ছিল। এমনকি আমি আয়ুষ্কাল বিক্রির আগেও” আমি বললাম। কিন্তু মিয়াগির কথাটা আমাকে উতলা করে তুলল।
রংধনু, ওয়েটিং রুম, সোডা, ক্যান এসব কে পাত্তা দেয়। কিন্তু মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ঠিক কয়টা সিডি শুনতে পারবো আমি? কয়টা বই পড়তে পারবো? কয়টা সিগারেট খেতে পারবো? ব্যাপারটা চিন্তা করে, হঠাৎ কেন জানি ভয় পেতে শুরু করলাম। মৃত্যু মানে হচ্ছে কোনো কিছু করতে না পারার অক্ষমতা
নারুসের সাথে দেখা করতে, ট্রেন থেকে নেমে বাসে করে পনেরো মিনিটে যাওয়ার মতো দূরত্বের একটা রেস্টুরেন্ট গেলাম।
নারুসে হচ্ছে আমার হাই স্কুলের বন্ধু। ও আমার মতো মাঝারি উচ্চতার। হয়তো একটু খাটো, সাথে অনেকটা বাটালির মতো দেখতে মুখ ি
ওর মাথা খুব দ্রুত চলে। ও এমনভাবে কথা বলে যে মানুষ আকৃষ্ট হয়ে পড়ে। সুতরাং ওকে ওর সঙ্গীরা পছন্দ করে।
ভাবতেই অবাক লাগে আমার মতো সমাজ থেকে পরিত্যক্ত একজনের সাথে ওর ভালো সম্পর্ক আছে।
আমাদের মাঝে সামান্যতম মিলও নেই। এবং পৃথিবীর যে কোনো বিষয় নিয়েই আমরা প্রাণখুলে হাসতে পারি।
হাই স্কুলে থাকতে, ফাস্ট-ফুড রেস্টুরেন্টে আমরা অনেকক্ষণ যাবৎ বসে থাকতাম। প্রতিদিনকার নানা বিষয় নিয়ে ঠাট্টা বিদ্রূপ করতাম।
আমি ওভাবে আরও একবারের জন্য হাসতে চাই। এটাই ছিল আমার প্রথম উদ্দেশ্য। কিন্তু আরেকটা কারণ আছে ওর সাথে দেখা করতে চাওয়ার জন্য।
নারুসের জন্য অপেক্ষা করার সময়, মিয়াগি আমার পাশে বসল। টেবিলটা চারজনের বসার জন্য বানানো। কিন্ত সিটগুলো খুব একটা প্রশস্ত নয়, তাই বলতে গেলে মিয়াগি এবং আমি পাশাপাশিই বসেছি।
মিয়াগি খুব কাছ থেকে আমাকে পর্যবেক্ষণ করতে লাগল। মাঝে মাঝে আমাদের চোখে চোখ পড়ে যাচ্ছিল। কিন্তু ও কিছু মনে না করেই এক নজরে তাকিয়ে থাকল।
কোথাও গেলে, সবসময় মিয়াগি আমার পেছনে ঝুলে থাকে। তাই নারুসে আমার আর মিয়াগির সম্পর্ক নিয়ে ভুল বুঝবে। এমনটাই আশা করছি আমি।
সাথে এ-ও বুঝতে পারছি এই আশা কতটা অসহনীয় হতে পারে আমার জন্য। কিন্তু আমি যদি কিছু করতেই চাই, আমার তা করতেই হবে। এটা খুবই দুঃখের বিষয়, কিন্তু আয়ুষ্কাল বিক্রির পরে “আমি করতে চাই” এই তালিকার এটাই প্রথম কোনো কিছু যা নিয়ে স্পষ্টভাবে ভেবেছি আমি।
“এই যে, মিস পর্যবেক্ষক” আমি মিয়াগিকে বললাম।
“কী?”
ঘাড় চুলকে আমি বললাম “আসলে, আমার একটা অনুরোধ…“
যে ছেলেটা আসবে তাকে যেন যথাযথ উত্তর দেওয়া হয় সেই অনুরোধ করতে চাচ্ছিলাম। কিন্তু আমি খেয়াল করলাম একজন ওয়েট্রেস আমাদের টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে আমাদের দিকে চওড়া হাসি দিচ্ছে। “এক্সিউজ মি, আপনি কি অর্ডার দেওয়ার জন্য প্রস্তুত?”
কিছুক্ষণের জন্য থেমে আমি কফি অর্ডার করলাম। ওয়েট্রেস তখন অর্ডার নিশ্চিত করছিল; আমি মিয়াগির দিকে ঘুরে জিজ্ঞেস করলাম।
“তুমি কিছুই অর্ডার করবে না?”
আমার কথা শুনে, মিয়াগি জবুথবু মুখ করে রইল।
“….উম, অন্যেদের সামনে আমার সাথে কথা বলা উচিত না।”
“কী? এতে দোষের কী আছে?”
“আমার মনে হয় আমি আপনাকে আগেই ব্যাখ্যা করেছি, কিন্তু … দেখুন, আসলে, যাকে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে সে ছাড়া আর কেউই পর্যবেক্ষকদের উপস্থিতি বুঝতে পারে না।”
মিয়াগি ওয়েট্রেসের জামার আস্তিন ধরে আস্তে করে টানতে লাগল। অবশ্যই মিয়াগির কথা মতো, কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা গেল না।
“আমার সাথে ঘটা যে-কোনো শারীরিক স্পর্শ এমনভাবে দেখা হয়; যেন ব্যাপারটা কখনও ঘটেনি” একটা গ্লাস তুলে নিয়ে মিয়াগি বলল।”যদিও আমি এই গ্লাসটি তুলে নিয়েছি। ব্যাপারটা এমন নয় যে, সে এই মুহূর্তে গ্লাসটিকে শূন্যে ভাসতে দেখছে; বলা যেতে পারে, গ্লাসটিকে আমি ধরার পরে সে হঠাৎ ওটাকে উধাও হয়ে যেতেও দেখে না আবার গ্লাসটি নড়াচড়া করছে এমনটাও দেখে না। অর্থাৎ এমনটা যেন ঘটেনি। আমি ‘এখানে’ আছি এমনটা অনুভূত হয় না। আবার আমি ‘এখানে নেই” এমনটাও অনুভূত হওয়ার নয়। যাহোক, একটাই ব্যতিক্রম আছে। একমাত্র ব্যক্তি; যে পর্যবেক্ষকের উপস্থিতি অনুভব করবে পারবে, সে হলো পর্যবেক্ষিত হওয়া ব্যক্তি নিজেই। সমস্যা হচ্ছে, যখন আমি মূলত “অস্তিত্বহীন” থাকি বা যে আমার সম্পর্কে জানে; তার কাছে অস্তিত্বহীন হওয়া সম্ভব না। আসল কথা হচ্ছে, মি. কুসুনোকি, আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে আপনি বর্তমানে অদৃশ্য কারও সাথে কথা বলছেন।”
আমি ওয়েট্রেসের অভিব্যক্তির দিকে খেয়াল করলাম।
সে আমার দিকে এমনভাবে তাকিয়ে আছে যেন আমি বদ্ধ কোনো উন্মাদ। কয়েক মিনিট পরে আমার কফি আসলে আমি ওতে চুমুক দিতে দিলাম। কফি শেষ করে, নারুসের সাথে দেখা না করেই এখান থেকে চলে যাওয়ার চিন্তা-ভাবনা করতে লাগলাম।
যদি ও আর কয়েক সেকেন্ড পরে আসতো, আমি নিশ্চিত; তাই করতাম আমি। কিন্তু আমি নিশ্চিত হওয়ার আগেই নারুসেকে রেস্টুরেন্টে ঢুকতে দেখলাম। অনিচ্ছা সত্ত্বেও উঠে গিয়ে ওকে অভিবাদন জানলাম।
আমরা বসার পরেই, আমাদের পুনর্মিলন নিয়ে ওকে খুব খুশি দেখাতে লাগল। অবশ্যই ও আমার পাশে মিয়াগিকে দেখতে পায়নি।
“অনেকদিন হলো দেখা নেই। তুই ভালো ছিলি তো?” নারুসে জিজ্ঞেস করল।
“হ্যাঁ, আমার তো তাই মনে হয়।”
আর ছয় মাসও বাঁচবে না এমন একজনের জন্য কথাটা খাটে না, আমি ভাবলাম।
****
বর্তমানে দিনকাল কেমন যাচ্ছে বলার পরে, আমরা এমনভাবে কথা বলতে শুরু করলাম; যেন আমরা হাই স্কুলে ফিরে গিয়েছি।
আমরা কি নিয়ে কথা বলেছি; সেটা ঠিকমতো মনে করতে পারছি না। কিন্তু আমাদের কথাবার্তার বিষয়বস্তু অবশ্যই প্রয়োজনীয় কিছু ছিল না।
আমরা সবকিছু নিয়েই কথা বলেছি। এটাই ছিল আমাদের উদ্দেশ্য। নারুসে আর আমি এমন নগণ্য সব বিষয় নিয়ে কথা বলেছি এবং হেসেছি; যা সাথে সাথেই ভুলে গিয়েছি।
আয়ুষ্কাল নিয়ে একটা কথাও বললাম না আমি। ও বিশ্বাস করবে কিনা আমি নিশ্চিত না। আমাদের মধ্যে যে রসায়নটা ছিল; সেটা নষ্ট করতে চাচ্ছিলাম না।
যদি নারুসে জেনে যায়; আমি আর কয়েক মাস বেঁচে আছি, সে সম্ভবত অন্যরকম আচরণ করবে। আমার সাথে রূঢ় আচরণ না করার চেষ্টা করবে। সব ধরনের রসিকতা বন্ধ করে দিবে এবং আমাকে সান্ত্বনা বাণী শোনানোর চেষ্টা করবে। আমি এসব আবোলতাবোল কথাবার্তা চিন্তা করতে যেমন চাই না; তেমনি শুনতেও চাই না।
ওর মুখ থেকে সেই কথাটা বের হওয়ার আগ পর্যন্ত, আমি বলবো আমার মজাই লাগছিল।
“বাই দ্য ওয়ে, কুসুনোকি” হঠাৎ মনে পড়ে যাওয়ার ভঙ্গিতে নারুসে বলল। “তুই কি এখনো আঁকিস?”
“না” আমি চটপট উত্তর দিলাম, তারপরে সতর্কতার সাথে সঠিক কথা খুঁজতে লাগলাম বলার জন্য। “…কলেজে ওঠার পর থেকে একটুও আঁকিনি।”
“আমিও তাই ভেবেছি” নারুসে বলল। “তুই যদি এখনো আঁকতিস, তাহলে যে আমি কী করতাম ভেবে পাই না।”
এই কথাটাই কফিনের শেষ পেরেক ঠুকে দিলো। আমি জানি এটা অদ্ভুত, কিন্তু এই দশ সেকেন্ডে ওর প্রতি গত তিন বছর ধরে যত টান ছিল, সব ধূলিসাৎ হয়ে গেল।
ও যখন মুখ চালিয়ে যাচ্ছিল, আমি মনে মনে ওর নাম ধরে ডাকলাম।
ওই, নারুসে।
এটা তোর মশকরার বিষয় না।
এটা সত্যি, আমি আঁকাআঁকি ছেড়ে দিয়েছি। কিন্তু এর মানে এই নয় যে এটা নিয়ে হাসাহাসি কিংবা মশকরা করতে পারবি।
ধীরে-ধীরে আমি ওকে অন্তঃসারশূন্য হাসি ফিরিয়ে দিতে লাগলাম। সিগারেট ধরিয়ে কথা বলা বন্ধ করে দিলাম আর নারুসের দিকে শুধু মাথা দোলাতে লাগলাম।
মিয়াগি আমার পাশ থেকে কথা বলে উঠল।
“…তাহলে এখন, চলুন উত্তরগুলো পর্যবেক্ষণ করে দেখি।”
আমি হালকা মাথা ঝাঁকালাম, ও অগ্রাহ্য করে গেল ব্যাপারটা।
“মনে হচ্ছে এখন আপনি মি. নারুসেকে কিছুটা ঘৃণা করা শুরু করেছেন। কিন্তু সত্যি বলতে, আপনি যেমনটা ভাবছেন মি. নারুসেও আপনাকে তেমন একটা পছন্দ করে না। মূলত, আপনার সাথে মি. নারুসের এভাবেই দুই বছর পরে দেখা হতো এবং একটা ক্ষুদ্র বিষয় নিয়ে ঝগড়া হতো। আর আপনাদের দুজনের সম্পর্ক শেষ হয়ে যেত। আপনার উচিত ওই পর্যায়ে যাওয়ার আগেই এই পার্ট চুকিয়ে ফেলা। এই লোকের উপর আশা করে কোনো ফায়দা হবে না।”
আমার বন্ধুকে ও অপমান করেছে; এই জন্য ওর প্রতি আমি বিরক্ত হইনি। বিষয়টি এমনও ছিল না যে, ও আমাকে এমন কিছু বলেছে যা আমি শুনতে চাইনি। আর এটা এইজন্যও হয়নি যে, আমি যা অনুভব করছি না; সেরকম চেহারা করে রাখতে হচ্ছে।
.
নারুসে একদা আমার একটা সময়ের স্বপ্নের প্রতি বিদ্রূপ করেছে বলে ওর প্রতি রাগ হলেও, মিয়াগির প্রতি বিরক্ত হইনি।
তাহলে প্রশ্ন উঠতে পারে, আমি কিসের প্রতি এত বিরক্ত।
নারুসে আমার সামনে চিন্তা-ভাবনা না করে বকবক করে যাচ্ছে। এমনকি মিয়াগিও আমার পাশে বসে বিষণ্ণ সব কথাবার্তা বিড়বিড় করে যাচ্ছে। অপরপাশের দুই তরুণী মেয়ে এমন উচ্চ কণ্ঠে কথা বলে যাচ্ছে; সেগুলো যেন কথার চেয়েও বেশি শব্দ নিক্ষেপের খেলা বলে মনে হচ্ছে। আমার পেছনের এক দল প্রচণ্ডভাবে ওদের মতামত জাহির করে যাচ্ছিল পাক্কা মাতালদের মতো। অনেক দূরের সিটে একদল ছাত্র হাততালি দিচ্ছে এবং চিল্লাচিল্লি করছে। হঠাৎ আমি আর নিতে পারছিলাম না। চুপ করো, আমি ভাবলাম।
কেন সবাই একটু চুপ করতে পারো না?
পরমুহূর্তেই, আমি মিয়াগির দিকে দেওয়ালটায় গ্লাস ছুড়ে মারলাম।
যেরকমটা আশা করেছিলাম এর চেয়েও বেশি জোরে চূর্ণবিচূর্ণ হওয়ার আওয়াজ হলো। কিন্তু রেস্টুরেন্টটা মাত্র কয়েক মুহূর্তের জন্য নীরব রইল। তারপরে আবার আগের মতো গমগম হয়ে উঠল।
নারুসে আমার দিকে চোখ বড়ো বড়ো করে তাকাল। আমি একজন কর্মচারীকে দৌড়ে আসতে দেখলাম। মিয়াগি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
কী বালছাল করছি আমি?
টেবিলে হাজার ইয়েনের বিল রেখে দৌড়ে রেস্টুরেন্ট থেকে বের হয়ে গেলাম।
স্টেশনে যাওয়ার বাসে উঠে জানালা দিয়ে বাইরে তাকাতেই একটা পুরাতন ব্যাটিং সেন্টার আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করল।
আমি নেমে যাওয়ার বাটনে চাপ দিয়ে বাস থেকে নেমে গেলাম। এরপর ওখানে তিনশটা শট নিলাম। যতক্ষণে হাত থেকে ব্যাটটা নামালাম, ততক্ষণে আমার হাত রক্তাক্ত এবং অসাড় হয়ে গিয়েছে। বুট পর্যন্ত ঘেমে গিয়েছি আমি।
একটা ভেন্ডিং মেশিন থেকে পোকারি সোয়েট কিনে একটা বেঞ্চে বসে একদল লোকের ব্যাটিং দেখতে দেখতে ধীরে-সুস্থে পান করতে লাগলাম। আমার মতে তারা কাজ শেষে বাসায় ফিরে যাচ্ছে।
হয়তো এটা আলোকসজ্জার কারণে হতে পারে, কিন্তু সবকিছুই মনে হচ্ছে অদ্ভুত নীল রঙয়ের।
নারুসেকে ওভাবে ফেলে আসার জন্য আমি একটুও অনুতাপ অনুভব করছি না। আমার এখন সন্দেহ হচ্ছে আমার প্রতি ওর ঠিক কতটুকু টান ছিল।
হয়তো বা আমি সত্যিই নারুসের মতো লোকদের গ্রাহ্য করি না। কিন্তু আমি শুধু আশা করেছিলাম আমি ওর মাধ্যমে নিজেকে ভালোবাসতে পারবো। যেহেতু আমি যেভাবে চিন্তা করি; সে ওভাবেই আমাকে মেনে নিয়েছিল।
যেখানে নারুসে বদলে গিয়েছে, আমি বদলাইনি।
এমনও হতে পারে নারুসেই ঠিক ছিল।
ব্যাটিং সেন্টারটাকে পেছনে ফেলে আমি স্টেশনের দিকে হাঁটা দিলাম। প্লাটফর্মে যাওয়ার সাথে সাথেই, ট্রেন এসে পড়ল।
ট্রেনটা ক্লাব থেকে আসা হাই স্কুলের ছেলেপেলে দিয়ে ভর্তি ছিল। হঠাৎ নিজেকে বয়স্ক মনে হতে লাগল আমার। চোখ বন্ধ করে সম্পূর্ণ মনোযোগ ট্রেনের শব্দের দিকে নিবদ্ধ করলাম।
রাত নেমে এসেছে। অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিংয়ে যাওয়ার আগে কনভেনিয়েন্স স্টোরে ঢু মেরে গেলাম।
পার্কিং লটে বেশ অনেকগুলো বড় বড় পোকা দেখতে পেলাম। কিন্তু সেগুলোর মাঝে নড়াচড়ার কোনো লক্ষণ দেখা গেল না।
যখন বিয়ার এবং স্ন্যাকস নিয়ে রেজিস্টারে পৌঁছালাম, জার্সি এবং স্যান্ডেল পরিহিতি এক জোড়া কলেজের যুগলকেও কেনাকাটা করতে দেখলাম।
বাসায় ফিরে, কৌটাজাত ইয়াকিনিকুর সাথে যোগ করা গ্রিন ওনিয়ন এবং বিয়ার দিয়ে গরম-গরম খাবার খেলাম। মৃত্যুর আগে ঠিক কত লিটার বিয়ার খেতে পারবো; সেটা চিন্তা করে বিয়ারও আগের চেয়ে মজাদার মনে হলো।
“ওই, মিস পর্যবেক্ষক” মিয়াগিকে ডাক দিলাম। “একটু আগে যা ঘটেছে তার জন্য দুঃখিত। আমি তখন বিভ্রান্ত ছিলাম। মাঝে মাঝে আমার ভেতরে একটা আগুন জ্বলে ওঠে। তখন কিছু একটা করে ফেলি। জানোই তো।”
“হ্যাঁ, আমি জানি” মিয়াগি বলল। ওর চোখগুলো আমার দিকে সতর্কতার সাথে তাকাতে লাগল। আমি ওকে দোষ দিতে পারি না। কথার মাঝে গ্লাস ছুড়ে মারা লোকের প্রতি যে কেউই সতর্ক থাকবে।
“তুমি ব্যথা পাওনি?”
“দুর্ভাগ্যজনকভাবে, না।“
“ওই, আমি সত্যি দুঃখিত।”
“সমস্যা নেই কারণ, আমি আঘাত পাইনি।“
“পর্যবেক্ষণ লগ লিখতে লিখতে ড্রিঙ্ক করবে নাকি?”
“…আপনি বলতে চাচ্ছেন, আপনি আমার সাথে ড্রিঙ্ক করতে চান?”
আমি এমন প্রতিক্রিয়া আশা করিনি। আমার মনে হয় সত্যি কথা বলাটাই ভালো। “হ্যাঁ, আমি সত্যি নিঃসঙ্গ।”
“তাই বুঝি! তারপরেও, আমি ক্ষমাপ্রার্থী। আমি পারবো না। আমি এখন ডিউটিতে আছি।”
“তোমার উচিত ছিল প্রথমেই বলে দেওয়া।”
“দুঃখিত। আমার কাছে একটু অদ্ভুত লেগেছিল। ভেবেছিলাম কেন আপনি এই কথা বলবেন।“
“ঠিক সবার মতোই আমিও মাঝে মাঝে একাকিত্ব অনুভব করি। অন্য লোকজন যাদের তুমি পর্যবেক্ষণ করেছিলে, মৃত্যুর আগে তারাও নিশ্চয় সহচর্য চেয়েছিল?”
“এরকম কিছু আমার মনে পড়ছে না” মিয়াগি বলল।
বিয়ারের বোতল খালি করার পরে আমি হট শাওয়ার নিলাম এবং দাঁত মাজলাম। একটা তৃপ্তিদায়ক ঘুম ঘুমাতে পারার অবস্থায় এলাম আমি। এটা নিশ্চিতভাবে ব্যাটিং সেন্টারে আমার পরিশ্রমের ফল।
বাতি নিভিয়ে ম্যাট্রেসের আরও গভীরে নিজেকে ডুবিয়ে দিলাম।
মৃত্যুর যত কাছে আসতে লাগলাম; পৃথিবীটা আমার কাছে হঠাৎ তত সুন্দর হয়ে উঠছে না। মনে হচ্ছে সবকিছুর প্রতি আমার মতামত শুধরে নিতে হবে। আমি ভাবতে লাগলাম।
হয়তো বা পৃথিবীটা সেসকল মানুষের কাছে সুন্দর হয়ে ধরা দেয়; যাদের ইতোমধ্যে মৃত্যু ঘটেছে। এটা নিশ্চিত করতে হবে। কিন্তু মনে হচ্ছে আমি আমার শিশুসুলভ চিন্তা এখনো ঝেড়ে ফেলতে পারিনি।
মনের গভীরে কোথাও, আমি এখনো আশা করছি হঠাৎ করে পৃথিবীটা সুন্দর লাগা শুরু করবে।