চ্যাপ্টার ৫: এভ্রিথিং টু কাম

চ্যাপ্টার ৫: এভ্রিথিং টু কাম

আমি লাইট বন্ধ করে পান করা শুরু করলাম। সৌভাগ্যক্রমে, অন্যান্য দিনের তুলনায় আজ নিজেকে আরও বেশি মাতাল করতে সক্ষম হলাম।

এরকম সময়ে নিজের পায়ে ঘুরে দাঁড়ানোর সবচেয়ে সহজ উপায় হলো, নিজের অনুভূতি বিরুদ্ধে না যাওয়া। বরং হতাশা এবং নিজের প্রতি করুণার জলাশয়ে ডুব দেওয়া।

আমার চিরপরিচিত অ্যাপার্টমেন্টটা স্বাভাবিকের তুলনায় কিছুটা অন্যরকম লাগছিল।

জানালা দিয়ে জ্যোৎস্না এসে ঘরটাকে নীল রঙে রাঙিয়ে তুলল। রাতের গ্রীষ্মের মৃদুমন্দ বাতাস প্রবাহিত হচ্ছে। কোণে মিয়াগির উপস্থিতি প্রহরীর মতো মনে হতেই, এটাকে আগের চাইতেও বেশি অতিপ্রাকৃত লাগছে। আমার অ্যাপার্টমেন্টের এরকম কোনো দিক যে আছে তা জানা ছিল না আগে।

মনে হতে লাগল আমি স্টেজের একটা উইঙে আছি। যখনই এর থেকে বেরিয়ে আসবো, ঠিক তখনই আমার ক্রিয়াকলাপ দেখানোর সময় হবে।

হঠাৎ আমার মনে হতে লাগল আমি সব কিছু করতে পারবো। এটা আসলে মাতাল হওয়ার কারণে আমার প্রতিভাহীন অবস্থার কথা ভুলে যাওয়া ছাড়া আর কিছুই না। কিন্তু আমি এটাকে অন্তরের কোনো পরিবর্তন বলে ধরে নিলাম।

আমি মিয়াগির দিকে ঘুরে গর্ব করে ঘোষণা করলাম:

“আমার শেষ তিন মাসে ৩০০,০০০ ইয়েন দিয়ে আমি কিছু একটা পরিবর্তন করবো।”

এই বলেই, আমি সর্বশেষ বিয়ারটা শেষ করলাম এবং ঢকাস করে টেবিলে ক্যানটা রাখলাম।

মিয়াগিকে তেমন একটা প্রভাবিত মনে হলো না। ওর দৃষ্টি সর্বোচ্চ কয়েক ইঞ্চি তুলে বলল, “আচ্ছা” তারপরে ওর চোখ আবার নোটবুকে ফিরে গেল।

আমি কোনো কিছু মনে না করে বলে যেতে লাগলাম, “এটা তেমন বড় কিছু না। কিন্তু এটা আমার জীবন। আমি ৩০০,০০ ইয়েনকে ৩ বিলিয়ন মূল্যে রূপান্তর করবো! পৃথিবীতে ফিরে আসার জন্য আমি কাজ করে যাবো। “

মাতাল হয়ে আমি ভেবেছিলাম কথাগুলো বেশ দারুণ শোনাচ্ছে।

কিন্তু মিয়াগি আমাকে করুণা করতে লাগল। “সবাই এই কথাই বলে।”

কলম একপাশে সরিয়ে রেখে হাঁটু জড়িয়ে ধরে তাতে চিবুক রাখল সে।

“আমার পর্যবেক্ষণের সময়ে অন্তত পাঁচবার একই কথা শুনেছি। মৃত্যু নিকটবর্তী হলে সবাই চরমপন্থী কথাবার্তা বলে। বিশেষত সেসব লোকজন, যারা বলতে পারবে না এই পর্যন্ত ওদের জীবন পরিপূর্ণ ছিল। একই যুক্তিতে, যে যুক্তিতে হারতে থাকা জুয়াড়ি পাশার দান ঘুরে যাবার আশায় খেলেই যেতে থাকে। যারা জীবনে প্রতিনিয়ত হারতে থাকে; তারা অবাস্তব সুখের আশা করে। মৃত্যু ঘনিয়ে আসলে জীবনের দ্যুতিতে অনেকেই উজ্জীবিত অনুভব করে। তারা বিশ্বাস করে তারা এটা করতে পারবে, ওটা করতে পারবে; কিন্তু এসব লোকজন একটা গুরুত্বপূর্ণ ভুল করে। তারা মাত্রই শুরু করেছে। তারা মাত্রই অনেকদিনের বিরতির পরে আত্ম্যংযম ফিরে পেতে শুরু করেছে। এই সুযোগকে সবকিছু আমূল বদলে দেওয়ার সুযোগ মনে করাটা বিরাট ভুল এবং এটা তাদের জন্য ভালো কিছু বয়ে আনবে না।”

“…তাই প্লিজ, মি. কুসুনোকি। এভাবে চিন্তা করুন। আপনার বাকি ত্রিশ বছরের এত কম মূল্য হওয়ার কারণ ওই সময়ে আপনি কিছুই অর্জন করেননি। আপনি ঠিকমতো বুঝতে পেরেছেন তো?” মিয়াগি আমাকে স্পষ্ট করে মনে করিয়ে দিলো “যে লোকটা ত্রিশ বছরে যা করতে পারেনি; সে কীভাবে মাত্র তিন মাসে সেটা করবে?”

“… ‘চেষ্টা’ করার আগ পর্যন্ত তো আমাদের জানার উপায় নেই” আমি তর্ক করলাম। আমার কথাগুলো কতটা ফাঁপা এমনকি আমি নিজেও সেটা বুঝতে পারলাম। ও যে সত্যি কথাই বলেছে তার জন্য বিশেষজ্ঞ হওয়ার চেষ্টা করার প্রয়োজন নেই।

“একটা সাধারণ পরিতৃপ্তি খোঁজার চেষ্টা করাটাকেই আমি বুদ্ধিমানের কাজ বলবো।” মিয়াগি বলল। “কিছুই পুনরুদ্ধার করা সম্ভব না। কোনো কিছু পরিবর্তন করার জন্য তিন মাস অনেক কম সময়। সবচেয়ে বড় কথা কিছু না করাটাই বরং পরিতৃপ্তি কিছুটা বাড়িয়ে দেয়। আপনি কি একমত না যে, সুখকে ব্যাখ্যা করার জন্য ছোট ছোট আনন্দ জমানো বিচক্ষণের কাজ? মানুষ হেরে যায় কারণ, তারা শুধু বিজয়ের কথা চিন্তা করে। ব্যর্থতার ফলাফলে মাঝে বিজয় খুঁজে পাওয়া হচ্ছে আসল ব্যাপার।”

“ঠিক আছে, আমি বুঝতে পেরেছি। তুমি ঠিক বলেছ। বহুত যুক্তি দিয়েছ” আমি মাথা নেড়ে বললাম। যদি আমি মাতাল না হতাম, তাহলে হয়তো ওর সাথে তর্কে যেতাম। কিন্তু আমার এখন আর কোনো শক্তি অবশিষ্ট নেই।

“আমি নিশ্চিত, আমি হচ্ছি সেসব লোকজনের একজন যে কিনা সত্যিই জানে না কিরকম অপদার্থ সে…তাই, শোনো, তাহলে কি তুমি সামনে কী ঘটবে সবকিছু খুলে বলতে পারবে? কিভাবে আমি বাকি ত্রিশ বছর কাটাতাম? যদি আমি সেটা শুনি, হয়তো যে অযৌক্তিক আশাগুলোর কথা ভেবেছি তা আমি বন্ধ করে দিতে পারবো।”

মিয়াগি বেশ কিছুক্ষণের জন্য মুখ খুলল না। তারপরে এমনভাবে কথা বলতে শুরু করল যেন হাল ছেড়ে দিয়েছে।

“আমারও তাই মনে হয়। সম্ভবত এখন সবকিছু জানা আপনার জন্য ভালো… যাহোক, শুধু মনে করিয়ে দিতে চাই, আমি যা বলবো এসব শুনে আপনার হতাশ হওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। আমি যা বলবো সেগুলো হচ্ছে সম্ভাবনা। এখন সেগুলো হচ্ছে এমন কিছু ঘটনা যা আদৌ কখনো ঘটবে না।”

“আমি জানি। আমি শুধু আমার নিয়তিটা শুনতে চাচ্ছি। ছোটখাটো বিষয় নিয়ে আমি তোমাকে উল্টাপাল্টা কিছু বলবো না। আর উল্টাপাল্টা কিছু বলার মতো কোনো বিষয় থাকলে তবেই না উল্টাপাল্টা কিছু বলবো।”

“আশা করছি এরকম কিছু হবে না।” মিয়াগি বলল।

*********

মাটি কেঁপে উঠার মতো শব্দ পেলাম আমি। মনে হচ্ছে সুবিশাল কোন টাওয়ার মুখ থুবড়ে পড়ছে। শব্দটা যে আতশবাজির সেটা বুঝতে আমার কিছুটা সময় লেগেছে, যেহেতু অনেক বছর হলো আমি সত্যিই আতশবাজি দেখতে যাইনি।

আমি যা কিছু দেখেছি সবসময়ই সেটা জানালা দিয়ে দেখেছি। স্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে খাবার খেতে খেতে কিংবা গার্লফ্রেন্ডের হাতে হাত রেখে একবার ওর দিকে এবং আরেকবার সেগুলোর দিকে তাকানোর মতো কিছুই দেখা হয়নি।

যে মুহূর্ত থেকে নিজের সিদ্ধান্ত নিজেই নিতে পারলাম; সেই মুহূর্ত থেকেই নিজেকে সমাজচ্যুত করে ফেললাম। যে কি-না গণজমায়েত পরিহার করে চলে। এসব জায়গায় গেলে মনে হতো ভুলক্রমে এসে পড়েছি। সেখানে পরিচিত কারো সাথে দেখা হয়ে যাওয়ার চিন্তা আমাকে দ্বিধায় ফেলে দিতো।

এলিমেন্টারি স্কুলে থাকতে যতক্ষণ পর্যন্ত না কেউ আমাকে জোর করতো, আমি কখনই পার্কে, পুলে, স্কুলের পেছনের পাহাড়ে যাইনি। এমনকি কেনাকাটা করতে, সামার ফেস্টিভ্যাল, অথবা কোনো আতশবাজির প্রদর্শনীতেও যাইনি।

হাই স্কুলেও, কোনো সাফল্যমণ্ডিত জায়গায় আশপাশেও যেতাম না আমি। শহরে হাঁটার সময় যতটা পারা যায় প্রধান সড়ক এড়ানোর চেষ্টা করতাম।

শেষবার আতশবাজি পুড়তে দেখেছিলাম যখন আমি খুব ছোট ছিলাম।

আরও ঠিক করে বলা যায় তখন হিমেনোও সাথে ছিল।

আমি প্রায় ভুলেই গিয়েছি খুব কাছ থেকে বিশাল আতশবাজি দেখতে কেমন। কাছ থেকে কত জোরে আওয়াজ হয় সেটাও ভুলে গিয়েছি।

ওটা থেকে কি গানপাউডারের গন্ধ আসে? আকাশে ঠিক কতটুকু ধোঁয়া থাকে? আতশবাজির দিকে তাকিয়ে থাকার সময় মানুষজনের চেহারা কেমন হয়?

এভাবে প্রতিটি খুঁটিনাটি চিন্তা করে, আপাতত দেখা যাচ্ছে আমি আসলে আতশবাজি সম্পর্কে কিছুই জানি না।

জানালা দিয়ে বাইরে তাকানোর লোভ লাগছিল। কিন্তু মিয়াগি পর্যবেক্ষণ করা অবস্থায় এরকম শোচনীয় কিছু করতে মনে চাচ্ছে না। যদি তা করি, ও হয়তোবা এরকম কিছু একটা বলবে, “যদি আপনার এতই আতশবাজি দেখার শখ থাকে তাহলে বাইরে বের হয়ে দেখছেন না কেন?”

আমি কিভাবে এর উত্তর দিবো? আমি কি ওকে বলবো যে, আমি খুবই ভীতু। সবার চোখ যদি আমার দিকে পড়ে তবে সেটা সামলানোর ক্ষমতা আমার নেই। অন্যরা আমাকে নিয়ে কী ভাববে সেটা নিয়ে কেন চিন্তা করছি? যখন আমার হাতে এত অল্প সময় বাকি আছে!

নিজের ইচ্ছের সাথে যুদ্ধ করতে হচ্ছে বলেই মিয়াগি সম্ভবত আমাকে টিটকারি মেরে; আমার সামনে দিয়ে হেঁটে গিয়ে জানালা খুলল। তারপরে জানালায় ঝুঁকে আতশবাজি উপরে উঠে যাওয়া দেখতে লাগল।

সুন্দর কিছু দেখে অভিভূত হওয়ার চেয়ে, ও মনে হচ্ছে অস্বাভাবিক কোনো দৃশ্যের প্রশংসা করছে। যা-ই হোক না কেন, দেখে অন্তত মনে হচ্ছে ও এতে আগ্রহ পাচ্ছে।

“আরেহ, বাহ। তোমার কি এগুলো দেখার সুযোগ আছে নাকি, মিস পর্যবেক্ষক? আমি যদি হঠাৎ সরে পড়ি তাহলে কী করবে তুমি?”

আতশবাজি দেখতে দেখতে মিয়াগি ব্যঙ্গ করে বলল, “আপনি কি চাইছেন, আমি আপনার ওপর নজর রাখি?”

“আরে নাহ। আমি চাই তুমি যত দ্রুত সম্ভব চলে যাও। তুমি আমার দিকে তাকিয়ে থাকলে আমার জন্য কোনো কিছু করা কঠিন হয়ে যায়।”

“সত্যি নাকি? সম্ভবত আপনার নিজের কাছেই নিজেকে অপরাধী লাগছে। আপনি যদি পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন এবং আমার থেকে একটা নির্দিষ্ট দূরত্ব তৈরি করেন; আমি ধরে নিবো আপনি ঝামেলা পাকনোর চেষ্টা করছেন। আমি তক্ষুনি আপনার জীবন অবসান করে দিবো। আমার পরামর্শ থাকবে আপনি সাবধানে থাকবেন। “

“কী রকম দূরত্ব?”

“নির্দিষ্ট করা নেই কিন্তু ধরে নিন ১০০ মিটার।”

একথা যদি ও প্রথমেই বলতো।

“আমি সাবধানে থাকবো” ওকে বললাম।

পর পর বেশ কয়েকবার একই ধরনের আওয়াজ আকাশ থেকে ভেসে আসতে লাগল। প্রদর্শনীটা চরম পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছে মনে হচ্ছে। আমি বুঝতে পারলাম পাশের বাসার সবকিছু শান্ত হয়ে গিয়েছে। হয়তো ওরাও আতশবাজি দেখতে গিয়েছে।

তারপর অবশেষে, মিয়াগি কথা বলতে শুরু করল। যা যা ঘটতে পারতো প্রায় সবকিছুই

“তো এখন, আপনার শেষ ত্রিশ বছর… প্রথমেই, আপনার কলেজ লাইফ চোখের পলকেই শেষ হয়ে যেত” মিয়াগি বলল।

“আপনি কেবলমাত্র বিল দেন, বই পড়েন, মিউজিক শোনেন, এবং ঘুমান। ধীরে-ধীরে এক একটি অন্তঃসারশূন্য দিন থেকে আরেকটি দিনকে আলাদা করা অসম্ভব হয়ে পড়তো। একবার এটা ঘটলে সময় দ্রুত চলে যেত। আপনি কলেজ থেকে বলতে গেলে কিছু না শিখেই পাস করতেন। হাস্যকরভাবে যে সময়টা আপনি আশা করে কাটিয়েছিলেন; ওই সময়টার প্রতি ঘৃণা জন্মাতো।”

“আপনি জানতেন তখন আপনার উচিত ছিল বাস্তবতাকে মেনে নেওয়া। কিন্তু নিজেকে বিশেষ কিছু একটা মনে করার ধারণা থেকে বের হতে পারতেন না। আপনি অন্য সবার মতো দলের অংশভুক্ত না; এটা বিশ্বাস করতেন বিধায় আপনি কখনই অভ্যস্ত হতে পারতেন না। শূন্য দৃষ্টিতে আপনি বাসা এবং অফিসে আসা যাওয়া করতেন। দিনে দিনে আপনি ড্রিঙ্ক করা উপভোগ করতেন। একদিন বিখ্যাত কেউ হবেন এই বিশ্বাস যখন উধাও হয়ে যেতে শুরু করে; তখনই আপনি আপনার ছোটবেলার ফ্যান্টাসি থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতেন।“

“অস্বাভাবিক এমনটা বলতে পারছি না।” আমি আস্তে করে বললাম।

“অবশ্যই, অস্বাভাবিক না। এটা প্রায় প্রচলিত ধরনের হতাশা। অবশ্যই, বেদনা মানুষ ভেদে পরিবর্তন হয়। আপনি অবশ্যই এমন একজন মানুষ যার কিনা সবার কাছে সুপিরিয়র হওয়া প্রয়োজন ছিল। কেউ আপনার উপর নির্ভর না করার ফলে আপনার জগতে আপনি একাই থাকতেন। আত্মবিশ্বাস ভেঙে পড়লে কষ্টটা আপনাকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিতো।”

“ধ্বংস?” আমি পুনরাবৃত্তি করলাম।

“আপনি বুঝতে পারবেন আপনি ত্রিশের শেষের দিকে চলে এসেছেন। একাকী উদ্দেশ্যবিহীনভাবে মোটর সাইকেলে ঘুরে বেড়ানো আপনার শখে পরিণত হবে। কিন্তু আপনি নিজেই জানবেন এটা বিপজ্জনক শখ। বিশেষত সেসব মানুষদের জন্য; যারা কিনা ইতোমধ্যে তাদের জীবনের উপর থেকে হাল ছেড়ে দিয়েছ। একদিন আপনার বাইকের সাথে কোনো একজনের গাড়ির সংঘর্ষ হবে। তবে কোনো পথচারী আহত হবে না। শুধু আপনি বাদে। কিন্তু আঘাতটা হতো তীব্র। আপনি আপনার অর্ধেক চেহারা হারাতেন, হাঁটার ক্ষমতা হারাতেন, এবং প্রায় সবগুলো আঙুল হারাতেন।“

“অর্ধেক চেহারা হারাতেন” কথাটা শুনে বোঝা খুব সহজ কিন্তু কল্পনা করা কঠিন।

সম্ভবত এটা এমন ভয়ঙ্কর যে মানুষ একবার তাকালেই সাথে সাথে বলে, “ওখানে এক সময় একটা চেহারা ছিল।”

“যেহেতু আপনি নিজে; নিজেকে ছাড়া আর কারো উপর নির্ভর করতেন না, সেহেতু আপনি আপনার শেষ অবলম্বন শেষ করে দেওয়ার কথা চিন্তা করতেন। কিন্তু সর্বশেষ ধাপে ঝাঁপ দিতে পারতেন না। এমনকি আপনি শেষ আশা ছাড়তে পারতেন না। ‘হয়তো বা সমানে ভালো কিছু একটা ঘটবে।’ …অবশ্যই, এটা কেউই সম্পূর্ণভাবে অস্বীকার করতে পারবে না। কিন্তু এটা কেবলই এমন একটা অবস্থা যে কিছুতেই এটার অস্তিত্ব অস্বীকার করা যায় না; এরচেয়ে বেশি কিছু নয়। সেই অনির্ভরযোগ্য আশা আপনাকে পঞ্চাশ পর্যন্ত নিয়ে যাবে। যতক্ষণ পর্যন্ত না চূড়ান্তভাবে আপনি একা-একা মারা না যাবেন। কেউ আপনাকে ভালোবাসবে না। কেউ আপনাকে মনে রাখবে না। সবকিছু এভাবে হওয়ার কথা ছিল না; এই কষ্ট পেয়ে আপনার জীবনাবসান হবে।”

বড়ই অদ্ভুত।

ও যা বলেছে আমি তা সাগ্রহে মেনে নিলাম।

“তো, কী ভাবছেন?”

“ঠিকই আছে। প্রথমেই বলতে চাই আমি সত্যি খুশি। সম্পূর্ণ ত্রিশ বছর বিক্রি করে দিয়েছি বলে।” আমি উত্তর দিলাম।

এটা আঙুর ফল টকের মতো না; যেমনটা মিয়াগি বলেছিল। এগুলো ঘটার আর সম্ভাবনা নেই, এগুলো আসলে কখনই ঘটবে না।

“ধুর, আমার মনে হয় তিন মাসের বদলে তিন দিন রেখে বাকিটা বিক্রি করে দিলে ভালো হতো।”

“আসলে, সেজন্য এখনো সময় আছে, মিয়াগি বলল। “আপনি আরও দু’বার আয়ুষ্কাল বিক্রি করতে পারবেন।”

“এবং তিন দিন হয়ে গেলে তুমি চলে যাবে, ঠিক?”

“হ্যাঁ, যদি সত্যিই আপনি আমার উপস্থিতি মেনে নিতে না পারেন, তাহলে এটা একটা ভালো সুযোগ।”

“আমার মনে থাকবে কথাটা।” আমি বললাম।

সত্যি বলতে, তিন মাসের মধ্যে কিছু একটা হবে এই আশায় না থেকে, মাত্র তিন দিন রেখে দেওয়াটাই শ্রেয়।

‘হয়তো বা সামনে ভালো কিছু একটা ঘটবে। সম্পূর্ণ আয়ুষ্কাল বিক্রির ব্যাপারে; এই আশাটা আমাকে বাধা দিচ্ছে।

আসছে তিন মাস এবং আমাকে বলা মিয়াগির “হারানো ত্রিশ বছর” সম্পূর্ণ ভিন্ন হবে। ভবিষ্যৎ পরিবর্তন করার মতো অসম্ভব কিছু না।

তো ভালো কিছু একটা ঘটতেও পারে।

এই সম্ভাবনাটা একদম ফেলে দেওয়া যায় না। এভাবে চিন্তা করলে, আমি অন্তত এখনো মরতে পারি না।

****

বৃষ্টির শব্দে মাঝরাতে ঘুম ভেঙে জেগে উঠলাম। ভাঙা পাইপ দিয়ে অবিরাম বৃষ্টির পানি রাস্তায় পড়ার শব্দ শুনতে পেলাম। ঘড়ির দিকে তাকালাম। সময় রাত তিনটা।

একটা মিষ্টি ঘ্রাণে সম্পূর্ণ ঘর ভরে গিয়েছে। অনেকদিন হলো গন্ধটা পাইনি। সেজন্য আমার বেশ কিছুটা সময় লাগল বুঝতে যে এটা মেয়েদের শ্যাম্পুর ঘ্রাণ।

প্রসেস অভ এলিমিনেশন পদ্ধন্তি অনুসরণ করে আমি বুঝতে পারলাম এটা নিশ্চিতভাবেই মিয়াগির কাছ থেকে আসছে। আমি ঘুমে থাকা অবস্থায় মিয়াগি গোসল করেছিল।

যাহোক, উপসংহারে আসা আমার জন্য একটু কঠিনই ছিল। বড়াই করার জন্য বলছি না কিন্তু আমার ঘুম এতটাই পাতলা যে এটাকে তন্দ্রাও বলা যেতে পারে।

এমনকি ক্ষুদ্রতম শব্দও যেমন, পত্রিকা ডেলিভারি দেওয়া অথবা উপরতলার পায়ের শব্দও আমার ঘুম ভাঙিয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। আমার ঘুম একবারের জন্যও না ভাঙিয়ে মিয়াগি গোসল করতে পারবে এটা ভাবা সম্পূর্ণ অস্বাভাবিক।

হয়তো বা বৃষ্টির সাথে মিশে গিয়েছিল শব্দটা

এই বিষয়ে চিন্তা করা বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিলাম। মাত্রই পরিচয় হওয়া একটা মেয়ে আমার অ্যাপার্টমেন্টে গোসল করেছে চিন্তা করাটা বেশ অদ্ভুত। তাই আমি পুরোপুরিভাবে এটা নিয়ে চিন্তা করা বন্ধ করে দিলাম।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথা হলো আমার আগামীকালের জন্য ঘুম প্রয়োজন। এরকম বৃষ্টিস্নাত রাতে ঘুম ভেঙে গিয়েছে! ভালো কথা, এমনটা ঘটতেই পারে।

কিন্তু আবার ঘুমানো সহজ কোনো কাজ না। সুতরাং সচরাচর যা করি, মিউজিকের শক্তি ধার নিলাম। বিক্রি না করা একটা সিডি তুলে নিলাম, “প্লিজ, মি. লস্টম্যান” প্লেয়ারে ছেড়ে দিয়ে হেডফোন দিয়ে শুনতে লাগলাম।

আমি যা ভাবছি এটা ঠিক সেটাই, কিন্তু যেসকল মানুষজন নির্ঘুম রাতে মি. লস্টম্যান শোনে তারা যথাযথ জীবনযাপন করতে পারে না। আমি এরকম মিউজকের সাথে নিজেকে অভ্যস্ত করেছি। কারণ, এই পৃথিবীর সাথে নিজেকে খাপ-খাওয়াতে আমার একটা ছুতা প্রয়োজন ছিল। সম্ভবত আমি এর জন্য এখনো মূল্য চুকিয়ে যাচ্ছি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *