চ্যাপ্টার ২: দ্য বিগিনিং অভ দ্য এন্ড

চ্যাপ্টার ২: দ্য বিগিনিং অভ দ্য এন্ড

সেদিনের মতো উনিশতমবার; মাথা ঝাঁকিয়ে বো করে “আমি দুঃখিত” বলার পর, আমার মাথা ঘুরতে লাগল। মাটিতে পড়ে জ্ঞান হারালাম তৎক্ষণাৎ।

এটা ঘটেছিল আমার বিয়ার গার্ডেনের পার্ট-টাইম জবের সময়। কারণটা ছিল স্পষ্ট। যে কেউই গনগনে সূর্যের নিচে এত অল্প আহার করে কাজ করলে জ্ঞান হারাতে বাধ্য।

নিজেকে কোনোরকমে অ্যাপার্টমেন্টে টেনেটুনে আনার পর, আমার চোখ এমনভাবে ব্যথা করতে লাগল; যেন ওগুলো উপড়ে ফেলে হয়েছিল। সুতরাং, শেষ পর্যন্ত আমাকে হাসপাতালে যেতেই হলো।

ইমার্জেন্সি ক্লিনিকে যাওয়ার জন্য ট্যাক্সি ভাড়া করতে আমার ওয়ালেটের উপর দিয়ে আরেকটা ঝড় গেল। তার উপর, আমার বস আমাকে বলল কয়েকদিন বিশ্রাম নিতে।

আমি জানি আমাকে খরচ কমাতে হবে। কিন্তু আর কিভাবে খরচ কমাতে পারি সে বিষয়ে কোনো ধারণাই নেই আমার।

ঠিক কবে মাংস খেয়েছিলাম আমার মনে নেই। প্রায় চার মাস ধরে চুল কাটাইনি। গত শীতে কোট টা কেনার পর আর কোনো কেনাকাটা করিনি। কলেজে ভর্তি হওয়ার পর থেকে কারও সাথে দেখা পর্যন্ত করতে যাইনি। বাবা- মায়ের প্রতি নির্ভর করার কোনো উপায় নেই, সুতরাং আমাকে নিজের ব্যবস্থা নিজেকেই করতে হবে।

বই এবং সিডি হাতছাড়া করতে আমার অন্তর জ্বলে যাচ্ছিল। এগুলো সবগুলোই অনেক যাচাই বাছাইয়ের পরে সেকেন্ড হ্যান্ড কিনেছিলাম, কিন্তু আমার অ্যাপার্টমেন্টের এগুলোই একমাত্র বস্তু; যা আমাকে কিছু টাকা-পয়সা এনে দিতে পারে। আমার এমনকি কম্পিউটার অথবা টিভিও নেই।

সিদ্ধান্ত নিলাম সবগুলো সিডিকে বিদায় জানানোর আগে আরেকবার শুনে নিবো। হেডফোন কানে দিয়ে, ম্যাটের উপরে শুয়ে প্লে বাটনে চাপ দিলাম।

সেকেন্ডহ্যান্ড দোকান থেকে কেনা নীল ব্লেডের ফ্যানটা চালু করে দিয়ে, এক কাপ ঠান্ডা পানির জন্য আস্তে আস্তে রান্নাঘরে গেলাম।

কলেজে ওঠার পর এই প্রথমবারের মতো কলেজ ফাঁকি দিচ্ছি। কিন্তু কারোই আমার অনুপস্থিতিতে কোনো পরোয়া নেই। ওরা কেউই হয়তো খেয়ালই করবে না আমি যে আজকে যাইনি।

অ্যালবামের পর অ্যালবাম আমার ডান পাশের টাওয়ার থেকে বাম পাশের টাওয়ারে স্থানান্তরিত হতে লাগল।

*****

এটা ছিল গ্রীষ্মকাল, আর আমার বয়স ছিল বিশ বছর। কিন্তু পল নিজানের মতো, আমি কাউকে এ-কথা বলতে দিবো না এটা তোমার জীবনের সেরা সময়।

“আজ থেকে দশ বছর পরের গ্রীষ্মে আমাদের জীবনে সত্যিই দারুণ কিছু একটা ঘটবে, আর তখন অবশেষে বেঁচে থাকার জন্য আমরা সত্যিই আনন্দ অনুভব করবো।”

হিমেনোর ভবিষ্যৎবাণী ভুল ছিল। অন্ততপক্ষে আমার ক্ষেত্রে ভালো কোনো কিছুই হচ্ছে না। আর সামনেও ভালো কিছু হওয়ার আভাস নেই।

মাঝে-মাঝে ভাবি ও এখন কী নিয়ে আছে। ও ফোর্থ গ্রেডে স্কুল পরিবর্তন করে ফেলেছিল। সুতরাং আমাদের আর দেখা হয়নি।

ঠিক এরকমটা হওয়ার কথা ছিল না। অন্যদিক দিয়ে চিন্তা করলে মনে হয় যা হয়েছে সবচেয়ে ভালো হয়েছে। আমাকে মিডেল স্কুল, হাই স্কুল এবং কলেজে অনুসরণ না করার ফলে, একজন নিয়মিত গড়পড়তা এবং বিরক্তকর মানুষ হিসাবে রূপান্তরিত হতে দেখতে হয়নি।

যদিও এভাবেও চিন্তা করা যায়: যদি আমার ছোটবেলার বন্ধু আমার সাথে একই স্কুলে পড়ত, আমি সম্ভবত শেষ পর্যন্ত এই অবস্থায় উপনীত হতাম না।

যখন ও আমার আশপাশে থাকতো, আমার মধ্যে একটা চাপ কাজ করতো। আমি যদি লজ্জাজনক কিছু করি, ও আমাকে নিয়ে হাসবে। আমি যদি দারুণ কিছু করি, ও আমাকে অভিশাপ দিবে।

সম্ভবত ওর কারণে একটা আলাদা উত্তেজনা অনুভব করতাম বলেই আমার মাঝে সবসময় সেরাটা দেওয়ার ব্যাকুলতা থাকতো।

গত কয়েক বছর ধরে আমি নিয়মিতভাবেই প্রভাবটা অনুভব না করার জন্য অনুশোচনা করে যাচ্ছি। দশ বছরের সেই আমি, বর্তমানের আমাকে নিয়ে কী ভাববে?

একনাগাড়ে তিনদিন প্রায় সবগুলো সিডি শোনার পরে, কয়েকটি অপরিহার্য অ্যালবাম বাদে বাকিগুলো একটা পেপারের ব্যাগে প্যাকেট করলাম। আরেকটি ব্যাগ ইতোমধ্যে বোঝাই করে ফেললাম বই দিয়ে। দুটো ব্যাগই তুলে নিয়ে গেলাম শহরে।

সূর্যের নিচে যাওয়া মাত্রই আমার কান ঝালাপালা করতে শুরু করল। ঘুঘুরে পোকার অনিয়মিত ডাকের কারণে আমি হয়তো বা উল্টাপাল্টা জিনিস শুনতে পাচ্ছিলাম। তবে মনে হচ্ছিল ওগুলো আমার কানের ঠিক পাশেই আছে।

*****

এই নির্দিষ্ট বইয়ের দোকানটাতে আমি প্রথমবার গিয়েছিলাম গত গ্রীষ্মে, কলেজে প্রবেশ করার কয়েক মাস পরে।

আমার তখনো শহরের ভৌগলিক অবস্থান সম্পর্কে ভালো ধারণা ছিল না। খুব সহজে আমি হারিয়ে যেতাম। তাই সবসময়, হাঁটার সময় কোথায় যাচ্ছি সেটা নজর রাখতে হতো।

কয়েকটা সরু গলি পেরিয়ে, সিঁড়ি বেয়ে উঠার পরে আমি বইয়ের দোকানটা খুঁজে পেলাম। এরপরে বহুবার আমি ওখানে যাওয়ার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু জায়গাটা ঠিক কোথায় মনে করতে পারিনি। এমনকি যখন আমি বিষয়টার দিকে নজর দিতে চেষ্টা করতাম; সবসময়ই দোকানের নাম ভুলে যেতাম।

সুতরাং ব্যাপারটা আমার সাথে এভাবে কাজ করতো যে, ঠিক যখনই আমি পথ ভুল করে হারিয়ে যেতাম, আমি ওইখানেই পৌঁছে যেতাম। যেন প্রায় ঝোঁকের বশে বইয়ের দোকানের রাস্তা আপন খেয়ালে বদলে যেত।

মাত্রই এ-বছর আমি হারিয়ে না গিয়ে দোকানটায় যেতে পেরেছি।

দোকানের সামনে মর্নিং-গ্লোরি ফুল ফুটে আছে। অভ্যাসবসত আমি দোকানের বাইরের সস্তা বইয়ের সেলফে খুঁজে দেখলাম। সেখানে ভিন্ন ধরনের কোনো বই নেই দেখে নিশ্চিত হয়ে ভিতরে গেলাম।

বিল্ডিংয়ের ভেতরে অন্ধকারাচ্ছন্ন পরিবেশ। তাতে পুরাতন কাগজের দুর্বার ঘ্রাণ। পেছনে একটা রেডিও চলতে শুনলাম।

সাইডওয়ে’কে পাশ কাটিয়ে একটা সরু প্যাসেজের ভিতর দিয়ে এগিয়ে গিয়ে দোকানের মালিককে ডাকলাম। বুড়ো মিয়া বইয়ের টালের মাঝ দিয়ে তার ক্লান্ত বলিরেখাযুক্ত মুখটা বাড়িয়ে দিলো। দোকানের মালিক বুড়ো মিয়া কাউকেই হাসিমুখে অভ্যর্থনা করেন না। উনি সাধারণত মাথা নিচু করে থেকে নিজের কাজ করে যান।

কিন্তু আজকের দিনটা ভিন্ন ছিল। আমি যখন একগাদা বই নিয়ে আসলাম বিক্রি করার জন্য, উনি মাথা তুলে আমার চোখের দিকে তাকালেন।

লোকটার চেহারায় বিস্ময় ভাব দেখতে পেলাম। ব্যাপারটা আমি বুঝতে পেরেছি।

যে বইগুলো আমি বিক্রি করছি সেগুলো এমন ধরনের বই; যার মূল্য লুকিয়ে আছে বারবার পড়ার মধ্যে। এগুলো হাতছাড়া করা একজন বইপ্রেমীর জন্য খুবই কঠিন।

“তুমি কি বাসা পাল্টাচ্ছো বা এমন কিছু করছো নাকি?” লোকটি বিস্ময়কর কণ্ঠে আমাকে জিজ্ঞেস করল।

“না, এমন কিছু না।”

“আচ্ছা, ঠিক আছে” এক টাল বইয়ের দিকে তাকিয়ে লোকটি বলল। “তাহলে অযথা এসব করছো কেন?”

“খাবার হিসাবে কাগজ তেমন পুষ্টিকর ভালো কিছু না।“

বুড়ো মিয়া মনে হচ্ছে আমার রসিকতা ভালোমতোই বুঝতে পেরেছে। “হাতে টান পড়েছে” তার মুখটা বেঁকে গেল।

আমি মাথা ঝাঁকালাম, লোকটা তার হাত দুটো একসাথ করল যেন গভীরভাবে কিছু একটা চিন্তা করছে।

তার পরে মত পরিবর্তন করে দম নিয়ে বললেন, “হিসাব করতে আধা ঘণ্টার মতো লাগবে” তারপরে বইগুলো নিয়ে পিছনে চলে গেলেন।

বাইরে বের হয়ে রাস্তা শেষের একটা পুরাতন বিলবোর্ডের দিকে তাকালাম। ওতে সামার ফেস্টিভ্যাল, জোনাকি-দেখা, তারা-দেখা এবং বইয়ের ক্লাবের পোস্টার লাগানো।

বেড়ার অপরপাশ থেকে, গাছের গন্ধের সাথে মিশে ধূপ এবং তাতামি ম্যাটের গন্ধ পেলাম; সামগ্রিকভাবে একটা নস্টালজিক ঘ্রাণ। দূরের একটা ঘর থেকে বাতাসের একটানা সুর ভেসে আসতে লাগল।

হিসাব-নিকাশ শেষ হওয়ার পরে দেখা গেল আমি যা আশা করেছিলাম এর তিন ভাগের দুইভাগ দাম পেলাম। বুড়ো মিয়া বলল, “শোনো, তোমাকে একটা কথা বলতে চাই।”

“জি?”

“তোমার টাকার প্রয়োজন, ঠিক কি-না?”

“ব্যাপারটা এমন না যে সেটার প্রয়োজন এখনই শুরু হয়েছে।” আমি সন্দেহের সাথে উত্তর দিলাম। বৃদ্ধ লোকটি মাথা নাড়ল, ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছে মনে হয়।

“তো, তুমি ঠিক কতটা গরীব অথবা ঠিক কতটা গরীব হয়ে গিয়েছে; সেটা আমি গ্রাহ্য করি না। আমি শুধু তোমাকে একটা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতে চাই।”

বুড়ো মিয়া কিছুক্ষণের জন্য থামল।

“তুমি কি তোমার আয়ুষ্কাল থেকে কিছুটা বিক্রি করতে চাও?”

আমার উত্তর দিতে কিছুটা দেরি হলো। সাথে কয়েকটি অস্বাভাবিক শব্দ যুক্ত হলো।

“আয়ুষ্কাল?” ঠিক শুনেছি কিনা নিশ্চিত হওয়ার জন্য, আমি পাল্টা প্রশ্ন করলাম।

“হ্যাঁ, আয়ুষ্কাল। না, আমি কিনছি না। যদিও, আমি জানি বেশ চড়া দামে বিক্রি হয় এটা।”

দেখে শুনে তো মনে হচ্ছে না প্রচণ্ড গরমে আমার কান আমার সাথে ছলনা করছে।

আমি কয়েক মুহূর্তের জন্য চিন্তা করলাম।

শেষ বয়সের ভয় বুড়ো মিয়াকে সম্ভবত একটা ঝটকা দিয়েছে। প্রথমে এটাই ছিল আমার চিন্তা-ভাবনা। আমার চেহারা দেখে, বুড়ো মিয়া বলল, “বুড়ো শালাকে ভীমরতি ধরেছে অথবা আমি রসিকতা করছি, এমনটা ভাবতে হচ্ছে বলে তোমাকে দোষারোপ করতে পারি না। যদি তুমি আমার কথাবার্তা নিয়ে মজা নিতে চাও, যাও দেখে এসো। আমি তোমাকে বলে দিচ্ছি কোথায় যেতে হবে। তাহলে তুমি বুঝতে পারবে আমি মিথ্যা বলছি কিনা।”

আমি উনার ব্যাখ্যা শুনলাম। সত্য-মিথ্যা সম্পর্কে নিশ্চিত না তখনো। সংক্ষেপে, তিনি আমাকে এই কথাগুলোই বললেন।

এখান থেকে খুব বেশি দূরে নয় এমন একটা বিল্ডিংয়ের চার তলায়, একটা দোকান আছে; যারা কিনা তোমার আয়ুষ্কাল কিনে নেবে। কত দামে বিক্রি হবে সেটা আসলে লোকজনের উপর ভিত্তি করে। তোমার ভবিষ্যৎ জীবনে যদি বেশি সফলতা পাও তবে বেশি দাম পাবে।

“ওরা ঠিক কত টাকা দেয় আমি জানি না, কিন্তু তোমাকে দেখে খারাপ লোক মনে হচ্ছে না, আর আমার মনে হয় তুমি বই পছন্দ করো। নিশ্চয় বেশ ভালো দাম হবে?”

আমার নস্টালজিকভাবে এলিমেন্টারি স্কুলের সেই শিক্ষার কথা মনে পড়ে গেল, আর ভাবতে লাগলাম ঠিক কতটা পরিচিত ঠেকছে সেটা।

লোকটার ভাষ্যমতে আয়ুষ্কাল বাদেও, সময় এবং স্বাস্থ্যও বিক্রি করা যায় ওখানে।

“আয়ুষ্কাল এবং সময়ের মধ্যে পার্থক্য কী?” আমি প্রশ্ন করলাম। “আয়ুষ্কাল এবং স্বাস্থ্যর পার্থক্য নিয়েও কোনো ধারণা নেই।”

“বিস্তারিত কিছু জানি না। এমন না আমি নিজে কিছু বিক্রি করেছি। কিন্তু ভয়ঙ্কর অসুস্থ মানুষ কয়েক দশক পর্যন্ত বেঁচে থাকতে পারে। আর সুস্বাস্থ্যের অধিকারী মানুষ হঠাৎ মরে যেতে পারে; এটা একটা পার্থক্য, তাই না? যদিও, সময়ের হিসাবনিকাশ কিভাবে হবে সে-সম্পর্কে কোনো ধরণা নেই।

বুড়ো মিয়া আমার জন্য একটা রোড ম্যাপ এঁকে একটা নাম্বার লিখে দিলো। আমি উনাকে ধন্যবাদ দিয়ে দোকান থেকে বেরিয়ে এলাম।

কিন্তু আমি একদম নিশ্চিত এই “আয়ুষ্কাল কেনা-বেচা করার দোকান” বুড়ো মিয়ার নিজেকে খুশি রাখার জন্য কল্পনা ছাড়া কিছুই না।

মৃত্যু এগিয়ে আসছে বলে ভয়ে পেয়ে, শেষ পর্যন্ত আয়ুষ্কাল বেচা-কেনার ধারণা উদয় হয়েছে উনার মনে।

আসলে, আমি বলতে চাচ্ছিলাম, ঘটনাটা সত্যি হওয়ার পক্ষে একটু বেশি বাড়াবাড়ি না?

*****

আমার প্রত্যাশা অর্ধেক পূরণ হয়েছিল।

কথাটা সত্যি হওয়ার পক্ষে আসলেই একটু বেশিই ছিল।

কিন্তু একই সাথে আমার প্রত্যাশা অর্ধেক পূরণ হয়নি।

সত্যি সত্যিই আয়ুষ্কাল নিয়ে ব্যবসা করে এমন দোকান আছে।

***********

বইগুলো বিক্রি করার পরে, আমার পা আমাকে সিডির দোকানে বয়ে নিয়ে গেল।

রাস্তায় সূর্যের বিচ্ছিরিরকম প্রতিফলন হচ্ছিল, ঘামের ফোঁটা আমার মুখ বেয়ে পড়তে লাগল। সাথে বেশ তৃষ্ণাও পেল আমার। কিন্তু ভেন্ডিং মেশিন থেকে জুস কেনার মতো অতিরক্ত টাকা আমার কাছে ছিল না। অ্যাপার্টমেন্টে যাওয়ার আগ পর্যন্ত কোনোমতে সহ্য করে যেতে হবে।

বইয়ের দোকানের ঠিক বিপরীতে, সিডির দোকানে ভালো এয়ার-কন্ডিশন আছে। অটোমেটিক দরজা খুলে গেলে এয়ার কন্ডিশনটা আমাকে ঠান্ডা হাওয়ায় গোসল করিয়ে দিতেই, নিজেকে সেখানে ভাসিয়ে দিতে মনে চাইল।

দীর্ঘ একটা দম নিয়ে শরীরে বাতাস টেনে নিলাম। দোকানে গ্রীষ্মের একটা জনপ্রিয় গান বেজে চলছে। যেটা আমি মিডেল স্কুলে থাকা অবস্থা থেকেই জনপ্রিয় ছিল। কাউন্টারে যাওয়ার পরে, সচরাচর যে ক্লার্ককে ডাকি, তাকে ডাক দিলাম। তারপরে আমার ডান হাতের ব্যাগের দিকে নির্দেশ করলাম। সে আমার দিকে সন্দেহজনকভাবে তাকাল।

তার মুখটা ধীরে-ধীরে এমনভাবে রূপান্তরিত হয়ে গেল যেন আমি তার সাথে বেশ কয়েকবার বিশ্বাসঘাতকতা করেছি। ওর চেহারাটা হয়তো আমাকে বলছে, “কিভাবে তুমি এই সিডিগুলো বিক্রি করে দিতে পারো?” বলতে গেলে প্রতিক্রিয়াটা বইয়ের দোকানের সেই বুড়ো মিয়ার মতো।

“কী হয়েছে?” স্বর্ণকেশী লোকটি আমাকে জিজ্ঞেস করল। লোকটার বয়স বিশের শেষের দিকে, চোখগুলো ঈষৎ নত। লোকটা রক ব্যান্ডের টি-শার্ট পরেছে, সাথে ডেনিম প্যান্ট। তার আঙুলগুলো সবসময়ের মতো কাঁপছে।

বইয়ের দোকানের মতো এখানেও আমাকে ব্যাখ্যা করতে হলো, কেন আমি সিডিগুলো বিক্রি করছি। লোকটা তখন হাত জড়ো করে বলল, “সেক্ষেত্রে…”

“আপনার জন্য আমার কাছে দারুণ একটা খবর আছে। হয়তো এটা আপনাকে আমার একদমই বলা উচিত না। কিন্তু আপনার মিউজিকের টেস্টের সাথে আমার টেস্ট একদম মিলে যায়, ভায়া। এটা শুধু আপনার আর আমার মধ্যেই গোপন থাকবে, ঠিক আছে?”

জোচ্চররা নিজেদের মধ্যে যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়ে থাকে, লোকটার কথাগুলো শুনে সেরকম কিছু মনে হচ্ছে। স্বর্ণকেশী লোকটি বলল: “শহরে একটা দোকান আছে যেখানে আপনার আয়ুষ্কাল কিনে নিতে পারে!”

“আয়ুষ্কাল!” আমি প্রশ্ন করলাম। আমি নিশ্চিতভাবেই বুঝতে পারছি জিনিসটা একটু আগের কথোপকথনের পুনরাবৃত্তি হতে চলেছে। কিন্তু আমাকে পুনরায় প্রশ্নগুলো করতে হবে।

“হ্যাঁ। আয়ুষ্কাল” সে গম্ভীর হয়ে নিশ্চিত করল।

এটা কি গরীব লোকদের সাথে মজা করার জন্য কোনো খোশখেয়াল নাকি? কিভাবে উত্তর দিবো এ-নিয়ে যখন দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগছিলাম, সে আমাকে খুব দ্রুত ব্যাখ্যা করল। বলতে গেলে তার বলা গল্পটা বইয়ের দোকানের বুড়ো মিয়ার গল্পের সাথে বেশিরভাগ মিলে যায়। কিন্তু এই লোকের ক্ষেত্রে, মনে হয় লোকটি নিজেই কিছুটা আয়ুষ্কাল বিক্রি করেছে। যখন আমি তাকে কত টাকায় বিক্রি করেছে জিজ্ঞেস করলাম, “আপনাকে ঠিক বলতে পারবো না” বলে পাশ কাটিয়ে গেল।

,

স্বর্ণকেশী একটা ম্যাপ আঁকল। আর একটা ফোন নাম্বার লিখে দিলো। আগেই বলে নেয়া উচিত বুড়ো মিয়া আমাকে যে ম্যাপ আর ফোন নাম্বার দিয়েছিল তার সাথে হুবহু মিলে গিয়েছে।

আমি ধন্যবাদের ভঙ্গি করে দোকান থেকে বেরিয়ে এলাম।

সূর্যের নিচে আসতেই, ভারী গরম বাতাস আমার শরীরের সাথে জড়িয়ে গেল।

‘শুধুমাত্র আজকের জন্য’ কাছের ভেন্ডিং মেশিনে কয়েন ঢুকাতে-ঢুকাতে নিজেকে প্রবোধ দিলাম। অনেক চিন্তা-ভাবনা করে সিডার নিলাম।

দুই হাতে ঠান্ডা ক্যানটা কিছুক্ষণের জন্য ধরে রেখে, অবশেষে আমি ট্যাব টান দিয়ে সময় নিয়ে পান করলাম।

সতেজ সফট ড্রিংকসয়ের মধুরতা সারা মুখে ছড়িয়ে পড়ল। বেশ অনেকদিন যাবৎ আমি কার্বোনেট জাতীয় কিছু পান করিনি, সুতরাং প্রতিটি ঢোক আমার গলায় কম্পন এনে দিলো।

পুরোটা শেষ করে খালি ক্যানটা ট্র্যাশে ফেলে দিলাম।

দুই ক্লার্কের দেওয়া ম্যাপগুলো পকেট থেকে বের করে সেগুলোর দিকে তাকিয়ে রইলাম। নিশ্চিতভাবেই সেটা হাঁটা দূরত্বে অবস্থিত। মনে হচ্ছে ওই বিল্ডিংয়ে গিয়ে আয়ুষ্কাল, সময় কিংবা স্বাস্থ্য বিক্রি করে আসবো আমি।

আমি এতটাই নির্বোধ!

চোখ ডলে ম্যাপটা বলের মতো দলা পাকিয়ে ছুড়ে ফেলে দিলাম।

******

কিন্তু শেষ পর্যন্ত নিজেকে আমি আবিষ্কার করলাম সেই বিল্ডিংয়ের সামনে। বিল্ডিংটা পুরাতন। দেয়াল এতটাই কালো যে আসলে ঠিক কী রংয়ের ছিল সেটা এখন আর বলা যাচ্ছে না। সম্ভবত বিল্ডিংটার নিজেরও এখন আর মনে নেই। বিল্ডিংটা বেশি প্রশস্ত না। আমার মনে হচ্ছিল দুই পাশের বিল্ডিং এটাকে মাঝখানে দুই পাশ থেকে চেপে ধরেছে।

এলিভেটর কাজ করছিল না। সুতরাং আমাকে চারতলায় যেতে সিঁড়ি ব্যবহার করতে হলো। ফ্লুরোসেন্ট লাইটের আলোতে দুর্গন্ধযুক্ত বাতাস টেনে নিতে লাগলাম। প্রতিটা পদক্ষেপের সাথে সাথে ঘামতে লাগলাম আমি।

আয়ুষ্কাল বিক্রির গল্পটা আমি একদমই বিশ্বাস করিনি।

বরং, দুই ক্লার্ক মিলে সরাসরি বলতে না পেরে রূপক অর্থে লোভনীয় কোনো কাজের কথা বলছিল এমনটা ভাবলাম আমি। যেমন ধরুন, “আয়ুষ্কাল কমে যাওয়ার জোরাল সম্ভাবনা আছে এমন ঝুঁকিপূর্ণ কাজ।”

“ঠিক কত টাকা দেয় ওরা আমি জানি না, কিন্তু তোমাকে দেখে খারাপ লোক মনে হচ্ছে না। আর আমার মনে হয় তুমি বই পছন্দ করো। নিশ্চয় বেশ ভালো দাম হবে, তাই না?”

চতুর্থতলার খুঁজে পাওয়া দরজায় কিছুই লেখা নেই। কিন্তু কিভাবে যেন আমি নিশ্চিত ছিলাম ওরা এই জায়গার কথাই বলেছিল।

দম বন্ধ করে ডোরনবের দিকে পাক্কা পাঁচ সেকেন্ড তাকিয়ে রইলাম। তার পরে কোনোরকম দ্বিধা না করেই সেটা ধরলাম।

দরজার পিছনের রুমটা বিল্ডিংয়ের বাইরের অংশের তুলনায় অকল্পনীয়ভাবে পরিষ্কার। আমি তেমন একটা বিস্ময় দেখালাম না।

রুমের ঠিক মধ্যখানে খালি শোকেস। দেয়ালের পাশে খালি শেলফ। কিন্তু কিভাবে যেন আমার কাছে স্বাভাবিকই মনে হলো।

সাধারণ দৃষ্টিকোণ থেকে যদিও এটা বেশ অদ্ভুত একটা ঘর। যেন অলঙ্কার ছাড়া অলংকারের দোকান, চশমা ছাড়া একজন চশমীশ, বই ছাড়া বইয়ের দোকান।

আমার মনে এর চেয়ে ভালো তুলনা এলো না।

আমার পাশেই যে কেউ একজন ছিল; সেটা উনার কথা বলে উঠার আগ পর্যন্ত খেয়াল করিনি।

“স্বাগত।”

কণ্ঠটা অনুসরণ করে ঘুরে তাকিয়ে দেখলাম একটা মেয়ে স্যুট পরে বসে আছে। সে আমার দিকে সরু ফ্রেমের চশমার নিচ থেকে দেখতে লাগল; যেন নিঃশব্দে হিসাব-নিকাশ করছে।

“এটা কোন ধরনের ঘোড়ার ডিমের জায়গা?” প্রশ্নটা করতে ব্যর্থ হলাম আমি। কারণ, আমি মুখ খোলার আগেই মেয়েটা জিজ্ঞেস করল, “আপনার সময়? আপনার স্বাস্থ্য? নাকি আপনার আয়ুষ্কাল?”

চিন্তা করতে করতে ত্যক্ত হয়ে গিয়েছিলাম আমি।

যদি আমার সাথে মজা নিতে চাও, ঠিক আছে তাহলে। নাও মজা “আয়ুষ্কাল” আমি তৎক্ষণাৎ উত্তর দিলাম।

আমি ভাবতে লাগলাম, কিছুক্ষণ খেলা খেলাই যাক না। আমার হারানোর মতো আর কিইবা আছে?

*****

কোনো কিছুই সঠিকভাবে বলা যায় না। ধরে নিলাম আমার আরও ষাট বছর বাকি আছে। আমার হিসাব মতে প্রায় ৬০০ মিলিয়ন ইয়েন হওয়ার কথা।

এখন এলিমেন্টারি স্কুলের মতো এতটা অহংকারী না আমি। কিন্তু আমি এখনো বিশ্বাস করি সাধারণ মানুষের তুলনায় আমার মূল্য অনেক বেশি। তো আমি ধরে নিলাম এক বছরে ১০ মিলিয়ন করে বিক্রি করতে পারবো।

এমনকি বিশ বছর বয়সেও, নিজেকে ‘বিশেষ কিছু একটা’ ভাবার ধারণা থেকে বের হতে পারিনি। অবশ্যই বিশ্বাসটা কিছুতেই গ্রহণযোগ্য না। আমি আগের গৌরবকে আঁকড়ে ধরার চেষ্টা করে যাচ্ছিলাম।

বাস্তবতা থেকে চোখ সরিয়ে নিয়েছিলাম আমি। যা পরিবর্তন হওয়ার কোনো লক্ষণই ছিল না। নিজেকে এই বলে প্রবোধ দিয়েছি যে কোনো একদিন, আমি অবশ্যই এতটা সফল হবো; মনে হবে মূল্যহীন এই বছরগুলো যেন কখনই আমার জীবনে ঘটেনি।

বছর ঘুরে আরেক বছর এলো, সেই সাথে আমার বয়সও বাড়তে লাগল। যে সাফল্যের স্বপ্ন আমি দেখেছিলাম; তার পাল্লাও সেইসাথে বড় হতে থাকল। যতই কোণঠাসা হতে লাগলাম; ততই পাশার দান ঘোরানোর মরিয়া চেষ্টায় নিজেকে নিয়োজিত রাখলাম।

কিন্তু এমনটাই তো হবার ছিল। খেলার শেষার্ধে যখন প্রতিপক্ষের চেয়ে দশ পয়েন্ট পিছিয়ে থাকে কেউ, তখন প্রার্থনা েেনা কাজে দেয় না। সপাটে ব্যাট ঘোরাতে হবে, বল যেরকমই হোক না কেন

কিছুক্ষণের মধ্যেই অমর হবার স্বপ্ন ভেসে উঠলো আমার মনের পর্দায়। আমি যদি পুরো বিশ্বের তোলপাড় ফেলে দেয়ার মতো কিছু না করি, কেউ মনে রাখবে না আমাকে।

ঠিক দিশা খুঁজে পাওয়ার একটাই উপায় আছে এখন। এমন কাউকে দরকার যে সম্পূর্ণরূপে উপেক্ষা করবে আমাকে। পালাবার কোনো পথ থাকবে না এবং নিজেকে বাঁচাতেও পারবো না। চোখ দিয়ে পানি গড়ানো অবধি মার সহ্য করতে হবে।

এভাবে ভাবলে আমার আছু বিক্রি করে দেয়াই একমাত্র উত্তর।

তাহলে শুধুমাত্র আমার অতীত জীবনই নয় ভবিষ্যৎ জীবনকেও সম্পূর্ণভাবে অস্বীকার করা হবে।

*********

মেয়েটার দিকে ভালো করে তাকিয়ে বুঝলাম, ওর বয়স খুবইও কম। শুধু বাহ্যিক উপস্থিতি দেখে আমার মনে হচ্ছে আঠারো থেকে চব্বিশ-এর মধ্যে।

“আপনার মূল্য নির্ধারণ শেষ হতে তিন ঘণ্টা লাগবে” মেয়েটি বলল। ওর হাত ইতোমধ্যে কিবোর্ডে টাইপ করতে শুরু করেছে।

আমি ভেবেছিলাম বিরক্তিকর কোনো প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে যেতে হবে হয়তো। কিন্তু মনে হচ্ছে আমাকে আমার নামটা পর্যন্ত বলতে হয়নি। মাত্র তিন ঘণ্টায় মানুষের অপূরণীয় জীবনের মূল্যে জানা যাবে এটা না হয় বাদই দিলাম।

অবশ্যই, মূল্যটা ওরাই নির্ধারণ করে দিবে। সর্বজনীন হবে না। কিন্তু এটাও তো আসলে একটা মানদণ্ড।

বিল্ডিংটা থেকে বেরিয়ে এসে উদ্দেশ্যবিহীনভাবে ঘুরতে লাগলাম। আকাশটা ইতোমধ্যে রং হারাতে শুরু করেছে। পা’দুটো ক্লান্ত হয়ে গেল। একইসাথে খিদেও পেল। একটা রেস্টুরেন্টে ঢুঁ মারতে ইচ্ছে করছিল কিন্তু আমার কাছে খরচ করার মতো পর্যাপ্ত অর্থ ছিল না।

শপিং ড্রিস্ট্রিকের বেঞ্চে আমি এক প্যাকেট সেভেন স্টারস এবং একশ’ ইয়েনের লাইটার পড়ে থাকতে দেখলাম। আশাপাশে তাকালাম। কিন্তু এগুলোর সম্ভাব্য মালিক হতে পারার মতো এমন কাউকে দেখতে পেলাম না।

বেঞ্চে বসে স্বাভাবিকভাবে সেগুলো পকেটে ঢুকিয়ে দিলাম। তারপরে গলিতে ফিরে গেলাম। গাদা করে রাখা একটা কাঠের টুকরোর পিছনে দাঁড়িয়ে সিগারেট ধরিয়ে লম্বা করে একটা টান দিলাম। বেশ অনেকদিন হয়ে গিয়েছে শেষবারের মতো সিগারেট টেনেছিলাম। তাই গলা ব্যথা করতে লাগল।

সিগারেট পায়ের তলায় পিষে ট্রেন স্টেশনের দিকে গেলাম। গলা আবারো শুকিয়ে গেল।

প্লাজার একটা বেঞ্চে বসে কবুতর দেখতে লাগলাম। একজন মধ্যবয়সী মহিলা ঠিক তার বিপরীতে বসে ওদের খাওয়াচ্ছিলেন।

বয়সের তুলনায় উনার ফ্যাশনটা কম বয়সীদের মতো মনে হচ্ছে। উনি বিরতিহীনভাবে খাবার ছুড়ে দিচ্ছিলেন। উনাকে দেখে আমার মনের মধ্যে এমন একটা অনুভূতি হলো; যেটাকে আমি ঠিক কী বলবো তা নিয়ে নিশ্চিত নই।

সেই সাথে, কবুতরগুলোকে রুটিতে ঠোকর দিতে দেখে, আমার খিদে চাগিয়ে তোলার জন্য ঘৃণা করতে লাগলাম। আমি ঠিক অতটা ক্ষুধার্ত ছিলাম না। কিন্তু ওদের সাথে মাটিতে ঠুকরে খাবার খাওয়ার কাছাকাছি পর্যায়ে চলে গিয়েছি আমি।

…আশা করছি, আমার আয়ুষ্কাল বেশ ভালো দামে বিক্রি হবে।

জিনিসপত্র বিক্রির সময় মানুষজন যা করে, সত্যিকারের মূল্য দেখার আগ পর্যন্ত ঠিক কত মূল্য আসতে পারে তার একটা আনুমানিক হিসাব করার চেষ্টা করলাম।

প্রাথমিকভাবে আমি ৬০০ মিলিয়ন রাজত্বের একটা চিন্তা করলাম, কিন্তু অতিরিক্ত পরিমাণের জন্য দাম নিয়ে তর্কাতর্কি এড়াতে, আমি সবচেয়ে খারাপ চিন্তাটাই করলাম।

সে হিসাবে, আমি ৩০০ মিলিয়নের চিন্তা করছিলাম। যখন আমি ছোট ছিলাম, আমি ভাবতাম আমার দাম প্রায় ৩ বিলিয়ন; তো সেই হিসাবে তুলনা করলে, বলা যায় মূল্যটা খুবই কম ছিল।

কিন্তু আমি আমার জীবনের মূল্য নিয়ে অতিরিক্ত অনুমান করছি। একজন সাধারণ সেলসম্যানের ব্যয় হচ্ছে ২০০ থেকে ৩০০ মিলিয়ন। হিমেনোর পরামর্শ এখনো মনে আছে আমার।

যদিও এলিমেন্টারি স্কুলে থাকার সময় যখন প্রথমবারের মতো একটা মেয়ের কাছ থেকে জীবনের মূল্য সম্পর্কে শুনেছিলাম। ও বলেছিল, “কেউ কখনই মানুষের জীবনে সুযোগের কোনো মূল্য নির্ধারণ করতে পারে না।” আর আমি এর জন্য ক্ষতিপূরণও চেয়েছিলাম! কথাটা আমি প্রায় ভুলে গিয়েছিলাম।

*****

দোকানটায় একটু আগেভাগেই ফিরে এসে সোফাতে ঘুমিয়ে পড়লাম। একটা মেয়ে আমার নাম ধরে ডাকাতে ঘুম ভেঙে গেল। মনে হচ্ছে হিসাবনিকাশ শেষ হয়েছে।

“মি. কুসুনোকি” মেয়েটি বলল। নিশ্চিতভাবেই মেয়েটি এই নামটিই বলেছে। ওদেরকে আমার নাম বলেছি বলে তো মনে পড়ছে না। কিংবা শনাক্ত করার কোনো আইডিকার্ডও দেইনি। কিন্তু তারা যে-কোনোভাবে সবকিছু জানে।

সত্যি-সত্যি এই জায়গাটি; নিশ্চয় সাধারণ বিচারবুদ্ধির বাইরে কোনোভাবে পরিচালিত হয়।

অদ্ভুতভাবে যে সময়ে আমি বিল্ডিংটায় ফিরে এলাম, আয়ুষ্কাল বিক্রির সন্দেহজনক গল্পটা বিশ্বাস করার জন্য স্বেচ্ছায় রাজি ছিলাম।

কেন এমন হলো, সে সম্পর্কে আমি অনেক অনেক জটিল কারণ দেখাতে পারি। এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে উপযুক্ত কারণ যেটা, তা হলো—সেই মেয়েটি।

প্রথমবারে মতো দেখা হওয়া কারও প্রতি এরকম অনুভূতি হওয়াটা সম্ভবত অদ্ভুত-ই। কিন্তু…আমার মনে হচ্ছে এই মেয়েটা যেসব কিছুতে জড়িত; সেটা কখনই মিথ্যা হতে পারে না।

….হিসাবনিকাশে ফিরে যাওয়া যাক।

যে মুহূর্তে মেয়েটার মুখ থেকে “তিন” শব্দটা শুনতে পেলাম, আমার হৃদয়ের গভীরে আশার প্রদীপ জ্বলে উঠল। আমার মনে হয়েছে, আমার চেহারায় প্রত্যাশার আলো জ্বলে উঠেছিল। স্বভাবতই আমার মনে হলো, ছোটবেলার করা আমার তিন বিলিয়নের হিসাবটা ঠিক ছিল।

মেয়েটা আমার চেহারা দেখে, অপ্রভিতভাবে তাকিয়ে মধ্যমা আঙুল দিয়ে ওর চিবুক চুলকাতে লাগল। দেখে মনে হচ্ছে আমাকে কিছু একটা সরাসরি বলতে পারছে না। সে কম্পিউটারের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে ধুমধাম করে কয়েকটি ‘কী’ চাপতে লাগল। অতঃপর কাউন্টারে একটা প্রিন্ট করা কাগজ রাখল।

“হিসাবনিকাশের পরে এটাই হচ্ছে আপনার ফলাফল। আপনি কী করতে চান এখন?”

প্রথমে, ফর্মের “৩০০,০০০” নাম্বারটা দেখে ভাবলাম এক বছরের মূল্য এটা।

আশি বছরের জীবনকালে, সবমিলিয়ে চব্বিশ মিলিয়ন হবে।

“চব্বিশ মিলিয়ন” আমার মাথায় বারেবারে ঘুরতে লাগল।

মনে হচ্ছে শরীর থেকে সমস্ত শক্তি শুষে নিয়েছে। যে কোনো মূল্যেই এটা কম দাম।

দ্বিতীয়বারের মতো দোকানটা নিয়ে আমার সন্দেহ হতে লাগল। হয়তো বা এটা কোনো টিভি শো-এর সেটআপ। কিংবা কোনো সাইকোলজিক্যাল এক্সপেরিমেন্ট। না, হয়তো কোনো জঘন্য কৌতুক….

কিন্তু যতই আমি কোনো ছুতা বের করি না কেন, সবই বৃথা। আমার সহজাত-প্রবৃত্তিকে কঠিন সময় পার করতে হচ্ছিল। নতুবা আমার সমস্ত প্রবৃত্তিই আমাকে বলছে “মেয়েটা ঠিকই বলেছে।”

যে কোনো মূল্যেই, আমাকে এই চব্বিশ মিলিয়ন সংখ্যাটাকে মেনে নিতেই হবে। আর এটা মানতে দৃঢ় মনোবল প্রয়োজন।

কিন্তু মেয়েটা আমার মুখোমুখি হয়ে সবচেয়ে নিষ্ঠুর সত্যিটাই বলল।

“সবকিছু দেখেশুনে এটাই জানা গেল, আপনার প্রতি বছরের মূল্য ১০,০০০ ইয়েন। যে কারো জন্য সর্বনিম্ন মূল্য এটাই। যেহেতু আপনার আয়ুষ্কালের ৩০ বছর ৩ মাস বাকি আছে, আপনি সবমিলিয়ে পাবেন ৩০০,০০০ ইয়েন।”

আমি তখন হাসতে লাগলাম। মেয়েটার কথাগুলোকে রসিকতা হিসাবে নিয়েছি বলে না। বরং বাস্তবতার মুখোমুখি হয়ে কিছুতেই না হেসে পারলাম না।

ফর্মে আমার ফলাফল লেখা আছে। সেটা আমার প্রত্যাশার চেয়েও অনেক অনেক নিচে।

******

“অবশ্যই কোনো প্রকার সর্বজনীন মূল্যের দিকে ইঙ্গিত করার কোনো উপায় নেই। এটা সম্পূর্ণই আমাদের মানদণ্ড অনুযায়ী ফলাফল” নিজের কথাকে সমর্থন করার জন্য মেয়েটি বলল।

“প্রকৃত হিসাব করেছে অন্য একজন পরামর্শক। তো আমি আসলে সঠিক জানি না। কিন্তু আমাকে বলা হয়েছে সুখের মাত্রা, কার্য বাস্তবায়ন, কোনো কিছুতে অবদান রাখা মূল্যের উপর দারুণ প্রভাব ফেলে। সংক্ষেপে, মূল্যটা নির্ধারণ করা হয় আমাদের পরবর্তী জীবন ঠিক কতটা সুখের হবে, কিভাবে অন্যকে সুখী করবে, এর মধ্যে কতগুলো স্বপ্ন বাস্তবায়ন হবে, সমাজে ঠিক কতটুকু আবদান রাখতে পারবে ঠিক এগুলোর উপর।”

ন্যায়পরায়ণতা আমাকে আবারো সম্পূর্ণভাবে ছিটকে ফেলল।

আমি যদি সুখী না হই, অথবা কাউকে সুখী করতে না পারি, অথবা কোনো স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে না পারি অথবা সামাজে কোনো অবদান না রাখতে পারি; যদি আমি এসব ক্যাটাগরিতে অকেজো বলে প্রমাণিত হই, আমার তাহলে কোনো সমস্যা নেই।

কিন্তু আমি যদি নিজে সুখী না হতে পারি, অন্য কাউকে সুখী করতে না পারি, অথবা কোনো স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে না পারি, আর সামাজে কোনো অবদান না রাখতে পারি; আমি জানি না ঠিক কোথায় আমি মুক্তি খুঁজে পাবো।

অন্যদিকে, বিশ বছরের পর থেকে ত্রিশ বছর তো খুবই অল্প সময়। আমি নিশ্চয় বড়োসড়ো অসুখে ভুগবো, তাই তো? নাকি কোনো দুর্ঘটনায় পড়বো?

“আমার আয়ুষ্কাল এতো ছোট কেন?” আমি প্রশ্ন করলাম, ভেবে দেখলাম অন্ততপক্ষে ওকে এটা জিজ্ঞেস করা উচিত।

“আমি খুবই দুঃখিত” মাথাটা কিছুটা নামিয়ে মেয়েটি বলল। “যারা তাদের সময়, স্বাস্থ্য অথবা আয়ুষ্কাল বিক্রি করেছে; তাদের ব্যতীত অন্য কারো কাছে কোনো তথ্য ফাঁস করতে পারবো না।“

ভ্রু কুঁচকে গভীরভাবে চিন্তা করতে লাগলাম।

“আমাকে একটু চিন্তা করতে দিন।”

“যত ইচ্ছে সময় নিন,” সে উত্তর দিলো। কিন্তু ওর কণ্ঠ শুনে তখনই সিদ্ধান্ত নিয়ে নিতে মন চাচ্ছিল।

****

শেষ পর্যন্ত, শুধুমাত্র তিন মাস রেখে, আমি সম্পূর্ণ ত্রিশ বছর বিক্রি করে দিলাম।

পার্ট-টাইম জবে দৌড়ঝাঁপের মধ্যে থাকা, বইয়ের দোকান এবং সিডি দোকানের ঘটনাটা আমার মধ্যে অন্যায় চুক্তি সহ্য করার শক্তি গড়ে তুলেছে।

মেয়েটি যখন আমাকে চুক্তিপত্রের পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা দিচ্ছিল, আমি প্রায় সবগুলোর ক্ষেত্রেই চিন্তা না করেই হ্যাঁ বলে দিচ্ছিলাম। এমনকি যখন সে আমাকে জিজ্ঞেস করল আমার কোনো প্রশ্ন আছে কিনা, আমি বললাম, তেমন কিছু নেই।

আমি কেবল প্রক্রিয়াটা শেষ করে এখান থেকে বেরিয়ে যেতে চাচ্ছিলাম। এই দোকান থেকে, এই জীবন থেকে বেরিয়ে যেতে চাচ্ছিলাম।

“আপনি তিনবার পর্যন্ত লেনদেন করতে পারবেন” মেয়েটি বলল। “তার মানে, আপনি আরও দু’বার আপনার আয়ুষ্কাল, স্বাস্থ্য অথবা সময় বিক্রি করতে পারবেন।”

এনভেলাপে ৩০০,০০০ ইয়েন নিয়ে আমি দোকান থেকে বের হয়ে আসলাম।

যদিও আমার কাছে চাক্ষুষ কোনো প্রমাণ কিংবা কোনো ধারণা ছিল না কিভাবে সেটা হয়েছিল। আমি নিশ্চতভাবেই অনুভব করতে পারছিলাম আমি আয়ুষ্কাল হারিয়েছি। আমার শরীরের একদম গভীর থেকে ৯০ শতাংশের মতো কিছু একটা বের হয়ে গিয়েছে।

বলা হয়ে থাকে মাথা কেটে ফেলার পরেও মুরগি বেশ কিছুক্ষণ দৌড়াতে পারে। আমি ধারণা করলাম এটা সম্ভবত সেরকম অনুভূতি। সম্ভবত চাইলে আমাকে এই মুহূর্তে লাশ বলা যাবে।

আশি বছর টিকে থাকবে আশা করা একটি শরীর একুশ বছরও দেখতে পারবে না, এমন একটা শরীরে আমি অধৈর্য হয়ে উঠেছি। প্রতিটি সেকেন্ডের ভারত্ব আগের চেয়ে বেড়ে গিয়েছে।

ওই সময় আমি অবচেতন মনে এটাও ভেবেছিলাম, “আরে, আমার তো এখনো ষাট বছর বাকি আছে।” কিন্তু এখন তিন মাস বাকি থাকা অবস্থায় আমি অধৈর্য হয়ে উঠেছি; যেন আমাকে কিছু একটা করতে হবে।

বাসায় ফেরার সময় আমি একজন উদ্ভট মানুষকে পাশ কাটিয়ে গেলাম। লোকটাকে দেখে মনে হচ্ছিল বিশের শেষের দিকে বয়স। একটা বিস্তর হাসি মুখে নিয়ে একা একা হাঁটছিল। যেন নিজেকে উপভোগ না করে পারছে না। ব্যাপারটা আমাকে ভীষণভাবে বিরক্ত করল।

শপিং ড্রিস্ট্রিকের একটা মদের দোকানে থেমে চারটা বিয়ারের ক্যান কিনলাম। আরেকটা দোকান থেকে পাঁচ পিস গ্রিল চিকেন কিনলাম। অতঃপর বাসায় যেতে যেতে সেগুলো পেটে চালান করে দিলাম।

তিন মাস মাত্র বাকি আছে। তাই টাকার চিন্তা করে লাভ নেই।

অনেক অনেক দিন হয়ে গিয়েছে আমি অ্যালকোহল গিলেছি। পানীয়টা আমাকে শান্ত করল। হয়তো এটা তেমন কোনো ভালো আইডিয়া না।

কারণ, খুব দ্রুতই আমি অসুস্থ অনুভব করতে লাগলাম। বাসায় পৌঁছানো মাত্রই বমি করা শুরু করলাম।

এভাবেই আমি শুরু করলাম আমার জীবনের শেষ তিনটে মাস।

বলতে গেলে প্রায় সবচেয়ে বাজে উপায়ে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *