চ্যাপ্টার ১ : অ্যা প্রমিজ ফর টেন ইয়ার’স টাইম
আয়ুষ্কাল বিক্রি করা যায়, এই কথাটা প্রথমবারের মতো জানার পরে, আমার এলিমেন্টারি স্কুলে শেখানো নৈতিক শিক্ষার কথা মনে পড়ে গেল।
আমাদের বয়স ছিল তখন দশ বছর। কিভাবে নিজেদের ভালো-মন্দ নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করবো সেটা আমাদের মাথায় ছিল না। সুতরাং আমাদের গ্রেডের শিক্ষিকা, বিশের শেষের দিকের বয়সের একজন মহিলা, আমাদের এমন কিছু একটা জিজ্ঞেস করল :
“এতদিন তোমরা জানতে, মানুষের জীবন কোনো কিছুর বিনিময়েই বদলানো যায় না। মানুষের জীবন সবকিছুর চেয়ে মূল্যবান। এখন ধরো, যদি জীবনের বিনিময়ে আর্থিক মূল্য ধরা হয়ে থাকে তাহলে তোমাদের কী মনে হয়। কত টাকা মূল্য হওয়া উচিত?”
উনি এরপরে চিন্তিত ভঙ্গিতে চুপ করে রইলেন। ব্যক্তিগতভাবে, আমি মনে মনে ভেবেছিলাম উনার প্রশ্ন করার ধরনটা একেবারেই অযৌক্তিক। উনার হাতে তখনো চক ধরা। ব্ল্যাকবোর্ডের দিকে তাকিয়ে আছেন ছাত্রদের দিকে পিঠ করে। প্রায় বিশ সেকেন্ডের মতো চুপ করে ছিলেন তিনি।
এই যখন পরিস্থিতি, ছাত্র-ছাত্রীরা আগ্রহের সাথে প্রশ্নটা নিয়ে ক্লাসরুম গরম করে ফেলল। তাদের অনেকেই সুন্দরী এই তরুণী শিক্ষিকাকে পছন্দ করতো। সুতরাং তারা এমন কোনো ভালো কথা বলতে চাইল যাতে তাদের প্রশংসা করা হয়।
একটা চালাক চতুর ছেলে হাত তুলল।
“আমি একবার একটা বইতে পড়েছিলাম, একজন চাকুরীজীবীর জীবনযাপনের খরচ প্রায় দুইশ মিলিয়ন থেকে তিনশ’ মিলিয়িন ইয়েন। তাই আমার মনে হয় একজন সাধারণ মানুষের মূল্য এর আশপাশেই হবে।”
অর্ধেক ছাত্র-ছাত্রী বিস্ময়সূচক ধ্বনি করল। বাকি অর্ধেক কিছুটা বিরক্ত এবং উদাস হয়ে গেল। তবে বেশিরভাগ ছাত্র-ছাত্রীই চালাক ছেলেটাকে ঘৃণা করা শুরু করল।
শিক্ষিকা হেসে মাথা নাড়লেন। “বিষয়টা মোটামুটি সত্যি। সম্ভবত বয়স্করাও একইরকম উত্তর দিতো। একটা উত্তর হতে পারে ‘এক জীবনে যে পরিমাণ টাকাপয়সা খরচ করা হয় সেটা জীবনের মূল্যের সমান।’ কিন্তু আমি চাই তোমরা এই চিন্তাধারা থেকে সরে আসো। রূপক অর্থে ধরা যাক। সচরাচর আমরা যে রূপক অর্থ ধরি।”
বোর্ডে নীল চক দিয়ে শিক্ষিকার আঁকা রেখাটি যে কী সেটা কেউই বুঝতে পারল না। এটাকে মানুষ হিসাবে ধরে নেওয়া যায় অথবা রাস্তার গামের পৌঁচও ধরে নেওয়া যায়।
কিন্তু এটাই ছিল উনার আসল উদ্দেশ্য।
“এই ‘অজানা সৃষ্টি’র কাছে প্রয়োজনের চেয়েও অনেক বেশি টাকা আছে। এটা মানুষের মতো লম্বা সময় বাঁচতে চায়। ফলে সেটা অন্য কারো জীবন কিনে নেওয়ার চেষ্টা করতে লাগল। ধরো একদিন তুমি সেই কিছু একটার পাশ দিয়ে যাচ্ছিলে। তখন সেটা তোমাকে জিজ্ঞেস করল, ‘এই যে, তুমি কি আমার কাছে তোমার আয়ুষ্কালটা বিক্রি করবে?”
উনি গল্পটা সেখানেই কিছুক্ষণের জন্য বিরতি দিলেন।
“যদি আমি সেটা বিক্রি করি, তাহলে কী ঘটবে?” একজন বেশ সিরিয়াস ধরনের ছেলে হাত তুলে জিজ্ঞেস করল।
“নিশ্চিতভাবেই, তুমি মারা যাবে।” শিক্ষিকা মজা করে উত্তর দিলো। “তুমি কিছু সময়ের জন্য সেই কিছু একটাকে মানা করে দিলে। কিন্তু ওটা তোমার পেছনে লেগে রইল। ‘ঠিক আছে, শুধু অর্ধেকটা বিক্রি করলে তেমন কিছু হবে না। শুধুমাত্র তোমার ষাট বছর থেকে ত্রিশ বছর বিক্রি করতে চাও নাকি? জানোই তো, আমার সত্যিই খুব দরকার।
আমার মনে পড়ে থুতনির নিচে হাত দিয়ে আমি উনার কথা শুনতে শুনতে ভেবে নিয়েছিলাম, “আমি ধরতে পেরেছি”। অবশ্যই, যদি অজানা সৃষ্টিটা এরকম করে তাহলে, আমি সত্যিই বিক্রি করার মন-মানসিকতায় থাকবো। আমার সীমাবদ্ধতা আছে। আপাতভাবে বেশ হৃষ্টপুষ্ট ছোট জীবন, দীর্ঘ এবং অভাবের জীবন থেকে অনেক ভালো।
“এখন, প্রশ্নে আসি। এই কিছু একটা যা কিনা মানুষের মতো জীবনযাপন করতে চায়, তার তো তোমার বাকি জীবনের একটা মূল্য নির্ধারণ করতে হবে, তাই না? আমি আগেই বলে দিচ্ছি, এর কোনো সঠিক উত্তর নেই। আমি শুধু জানতে চাই তোমরা কী ভাবছ এবং কিভাবে তোমরা সে-সিদ্ধান্তে এলে। এখন তোমরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করো।”
সম্পূর্ণ ক্লাসরুম আলাপ-আলোচনা মুখোর হয়ে উঠল। আমি এসবের কোনোটাতেই যুক্ত হলাম না। স্পষ্ট করে বললে, যুক্ত হতে পারলাম না।
কারণ, আয়ুষ্কালের ব্যয় নিয়ে উত্তর দেওয়া সেই ছেলেটির মতো, আমিও ছিলাম ক্লাসের মধ্যে সবচেয়ে ঘৃণিত মানুষ
আমি ভান করলাম, আমি এ-বিষয়ে কথা বলতে আগ্রহী নই; তাই সময় অতিবাহিত করার জন্য অপেক্ষা করছি।
আমার সামনে বসা একটা দলকে বলতে শুনলাম, “যদি একটা সম্পূৰ্ণ জীবন তিনশো মিলিয়ন ইয়েন হয়…”
আমি ভাবতে লাগলাম, যদি সেটা তিনশ’ মিলিয়ন হয়ে থাকে, তাহলে… আমার দাম যদি তিন বিলিয়ন হয় তাহলে এটাউদ্ভট লাগবে না।
আলোচনার ফলাফল কী হয়েছিল সেটা আমি মনে করতে পারছি না। তবে এটুকু নিশ্চিত যে, শুরু থেকে একদম শেষ পর্যন্ত অন্তঃসারশূন্য ছিল সেটা।
এলিমেন্টারি স্কুলের বাচ্চারা সামলাতে পারবে এমন কোনো সহজ বিষয় ছিল না সেটা। আর যদি কোনোভাবে হাই স্কুলের কতগুলো ছাত্র-ছাত্রীকে এর সাথে যোগ করে দেওয়া হয়, ওরা সম্ভবত এর সাথে সেক্স ঢুকিয়ে ফেলবে।
স্পষ্টভাবে একটা মেয়ের কথা মনে আছে আমার। যে কিনা বিষণ্ণ দৃষ্টিতে ভীষণভাবে জোরাজুরি করতে লাগল, “কিছুতেই একটা জীবনের মূল্য নির্ধারণ করা যায় না।”
আমি ভাবলাম, হ্যাঁ, কেউ যদি মেয়েটার মতো জীবনযাপনের সুযোগটা কাজে লাগিয়ে থাকে তবে আমি সেটাকে কোনো মূল্য দিবো না। হয়তো বা সত্যি-সত্যিই ক্ষতিপূরণের টাকাও চাইতাম।
প্রায় প্রতিটি ক্লাসেই রসিকতা করে এমন ধরনের ভাঁড় কাউকে না কাউকে পাওয়া যাবেই; যে কিনা অন্যদের মতো করে একই ধারায় চিন্তা করছে। “আমি যদি আমার জীবনের মতো ঠিক একই রকম জীবনযাপনের জন্য নিজেকে বিক্রি করি, তাহলে কেউই এমনকি তিনশ’ ইয়েনও দিবে না, তাই না?” অন্যদের হাসিয়ে ছেলেটা বলল।
আমি ওর চিন্তা-ধারার সাথে একমত। ছেলেটা জানে আশপাশের গম্ভীর গর্দভগুলোর চেয়ে ওর দাম বেশি হবে, তবুও বিনয়ীর হাসি হাসছে। এই ব্যাপারটা আমার কাছে বিরক্তিকর লাগছে।
বলে রাখি, শিক্ষিকা সেদিন বলেছিল এর কোনো সঠিক উত্তর নেই। কিন্তু এক প্রকার সঠিক উত্তর সত্যিই আছে।
কারণ, দশ বছর পরে, আমার বয়স যখন বিশ, সত্যি বলতে, আমি নিজেই আমার আয়ুষ্কাল বিক্রি করে মূল্য পেয়েছিলাম।
****
যখন ছোট ছিলাম, আমি ভাবতাম বড় হয়ে বিখ্যাত কেউ একজন হবো। আমি ভেবেছিলাম আমার যুগের বাকি সবার চেয়ে কয়েক কদম এগিয়ে ছিলাম আমি।
দুর্ভাগ্যজনকভাবে, যে ছোট নরকে আমি বাস করতাম তাতে বাবা-মায়েরা ছিল বিরক্তিকর এবং অকর্মণ্য। যারা বিরক্তিকর বাচ্চাকাচ্চা জন্ম দিয়ে যাচ্ছে। তাদের অকর্মণ্য ছেলেমেয়েরাই হচ্ছে আদর্শ।
এটাই আমাকে এই ভুল ধারণার দিকে ঠেলে দিয়েছিল।
আমার চারপাশের ছেলে-মেয়েদের আমি নিচু চোখে দেখতাম। বলার মতো কোনো গুণ কিংবা ভদ্রতা আমার ছিল না। সুতরাং স্বাভাবিকভাবেই, আমার ক্লাসমেটরা আমার প্রতি সহানুভূতিশীলও ছিল না।
দল থেকে আমাকে বের করে দেওয়া তেমন দুর্লভ কিছু ছিল না। অথবা আমার জিনিসপত্র চুরি করা কিংবা লুকিয়ে রাখা ছিল নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার।
টেস্টে আমি সবসময়ই নিখুঁত স্কোর করতাম। এক্ষেত্রে আমিই একমাত্র ছিলাম না। হিমেনোও নিখুঁত স্কোর করতো। হ্যাঁ, উপরে বলা সেই “চালাক চতুর” মেয়েটাই হচ্ছে হিমেনো।
ওকে অশেষ ধন্যবাদ, আমি সত্যিকারের এক নাম্বার হতে পারিনি। সেইসাথে আমাকেও ধন্যবাদ, হিমেনোও সত্যিকারের এক নাম্বার হতে পারেনি।
সুতরাং, অন্ততপক্ষে উপরে উপরে আমরা একে অন্যের প্রতিদ্বন্দ্বী বা এরকম কিছু একটা ছিলাম। আমরা একে অন্যকে পিছেন ফেলে আগে বাড়ার চিন্তা করতাম।
অন্যদিক দিয়ে দেখলে, আমরা যে একে অন্যকে ভালো বুঝতে পারি এটা ছিল তার প্রমাণ। আমাকে কোনো প্রকার ভুল না বুঝে আমি কী বলতে চাচ্ছি; সেটা একমাত্র ও-ই সবসময় বুঝতে পারতো। হয়তোবা এর বিপরীতটাও সত্যি ছিল।
একারণেই, শেষ পর্যন্ত আমরা দুজনই সবসময় একসাথে থাকতাম।
গোড়া থেকে বলতে গেলে, আমাদের দুজনেরই বাসা ছিল একদম কাছাকছি। সুতরাং, শৈশব থেকেই আমরা প্রায়ই একসাথে খেলতাম। আমার মনে হয় এক্ষেত্রে “বাল্যবন্ধু” শব্দটাই উপযুক্ত।
আমাদের বাবা-মায়েরা ছিল একে অপরের বন্ধু। এলিমেন্টারি স্কুলে ভর্তি হওয়ার আগ পর্যন্ত, আমার বাবা-মা ব্যস্ত থাকলে ওর বাসায় আমাকে দেখাশোনা করার জন্য রেখে যাওয়া হতো। আর ওর বাবা-মা ব্যস্ত থাকলে হিমেনোকে আমার বাসায় রেখে যাওয়া হতো।
যদিও আমরা একে অন্যকে প্রতিদ্বন্দ্বী হিসাবে দেখতাম। তবে আমাদের বাবা-মায়ের সামনে নিজেদের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ করার মৌন সম্মতিতে পৌঁছেছিলাম।
সত্যি বলতে, বলার মতো তেমন কোনো কারণও ছিল না। আমরা কেবল ভেবেছিলাম এটাই সবচেয়ে ভালো উপায়। যদিও টেবিলের তলায় আমাদের সম্পর্ক ছিল ঠ্যাঙাঠেঙি এবং খোঁচাখুঁচির। অন্ততপক্ষে আমাদের বাবা-মায়েরা যখন সামনে থাকতো, আমরা ছিলাম ছোটবেলার বন্ধু।
হয়তোবা আমরা সত্যিই তাই ছিলাম।
*******
হিমেনোকে ঠিক আমার মতো একই কারণে ক্লাসের কেউ পছন্দ করতো না। ও নিজেকে বুদ্ধিমান মনে করতো। সেজন্য ওর আশপাশের সবাইকে নিচু চোখে দেখতো। যেহেতু আচরণটা খুবই অশোভন ছিল; তাই ক্লাসরুমে ওকে এড়িয়ে যাওয়া হতো।
আমার এবং হিমেনোর বাড়ি একটা পাহাড়ের চূড়ায় ঠিক পাশাপাশি ছিল। অন্যান্য ছাত্র-ছাত্রীদের বাড়ির চেয়ে অনেক দূরে।
ব্যাপারটা আমাদের জন্য আশীর্বাদস্বরূপ ছিল। অন্যান্যদের সাথে বাইরে না মিশে, বাসায় ঘরকুণো হয়ে বসে থাকার জন্য দূরত্বটাই আমাদের জন্য ছুতা হিসাবে কাজ করতো।
একমাত্র চরম মাত্রায় বিরক্ত হলেই কেবল ঠেকায় পড়ে আমরা একে অন্যের বাসায় যেতাম। অনিচ্ছা সত্ত্বেও হেসে আভাস দিতাম “আমি এখানে এসেছি মানে এই না আমি আসতে চেয়েছি।”
সামার ফেস্টিভ্যাল এবং ক্রিসমাসের মতো দিনগুলোতে, আমাদের বাবা- মায়েদের দুশ্চিন্তা থেকে মুক্ত রাখতে, আমরা বাইরে বের হতাম। একসাথে সময় নষ্ট করতাম। প্যারেন্ট-চাইল্ড এক্টিভিটি এবং ক্লাস ভিজিটের সময় আমরা মিলেমিশে চলার ভান করে যেতাম।
আমরা ভান করতাম যেন ব্যাপারটা ঠিক এমন “আমরা দুজনে একসাথে থাকতে পছন্দ করি, তাই আমরা নিজ ইচ্ছায় এসব করছি।” আমরা তখন ভাবতাম; অন্ততপক্ষে অন্যান্য ক্যাবলা বন্ধুদের চেয়ে ঘৃণ্য বাল্যবন্ধুর সাথে থাকাই ভালো।
আমাদের কাছে, এলিমেন্টারি স্কুল ছিল এমন একটা জায়গা যেখানে আমাদের জন্য প্রেরণা মরে ভূত হয়ে গিয়েছিল। প্রায়ই আমাদের দু’জনকে সমস্যা হিসাবে বিবেচনা করা হতো। আর আমাদের ক্লাস কাউন্সিল করতে হতো।
যে মহিলা আমাদের চতুর্থ থেকে ষষ্ঠ গ্রেড পর্যন্ত পড়িয়েছিলেন; উনার এই ধরনের সমস্যা সম্পর্কে ধারণা ছিল। তাই যতক্ষণ পর্যন্ত বাবা-মা’কে ফোন না করে থাকতে পারতেন; ততক্ষণ পর্যন্ত চুপ করে থাকতেন।
বাস্তবতা হচ্ছে, আমাদের যে বুলিং করা হচ্ছে সেটা যদি আমাদের বাবা- মায়েরা জেনেও যায়, তবে অবস্থার কোনো পরিবর্তন হবে না। আমাদের শিক্ষিকা বুঝতে পেরেছিলেন, আমাদের অন্তত একটা নিজস্ব জগৎ থাকা প্রয়োজন যেখানে আমাদের প্রতি করা নিষ্ঠুর আচরণ ভুলে যেতে পারি আমরা।
কিন্তু যেভাবেই হোক না কেন, হিমেনো এবং আমি সবসময়ই বিরক্ত থাকতাম। বাকি সবাইও মোটামুটিভাবে আমাদের প্রতি বিরক্ত ছিল। যেহেতু “বিরক্ত হওয়া” ছিল ওদের সাথে আমাদের একমাত্র সম্পর্ক
আমাদের জন্য সবচেয়ে বড় সমস্যা ছিল; আমাদের ভাণ্ডারে সুন্দর হাসি ছিল না। সবাই একসাথে হাসি দেওয়ার “সময়”টা কিছুতেই ঠিকমতো ধরতে পারতাম না আমি।
যখনই আমি মুখের মাংসপেশি নড়াচড়া করানোর চেষ্টা করতাম, আমার অন্তরের একদম ভিতর থেকে কোনো একটা সুর কেটে যাওয়ার শব্দ শুনতে পেতাম। হিমেনোও নিশ্চয় এরকমই অনুভব করে থাকবে।
এমনকি কোনো কিছুর অনুমোদনের হাসি দেওয়ার সময়ও, আমরা আমাদের চোখের ভ্রূ পর্যন্ত নাড়াতাম না। না, বরং বলা ভালো, নাড়াতে পারতাম না।
রুক্ষ এবং দাম্ভিকতার জন্য আমাদের উপহাস করা হতো। সত্যিই আমরা রুক্ষ ছিলাম। একইসাথে দাম্ভিকও ছিলাম।
কিন্তু অন্যদের সাথে হাসতে না পারাটা আমাদের একমাত্র ভুল ছিল না। হিমেনো এবং আমি একদম গোঁড়া থেকেই ভুল পথে ছিলাম। যেন ভুল ঋতুতে ভুল ফুল ফোটার চেষ্টা করছে।
সেই গ্রীষ্মে যখন আমার দশ বছর বয়স হয়েছিল। হিমেনোর কাঁধে ছিল প্রায় এক ডজনবার আবর্জনায় ফেলে দেওয়ার মতো ব্যাগটা। আমি পরে ছিলাম কেচি দিয়ে অনেকবার কাটা জুতাটা। লালচে বর্ণ ধারণ করা অস্তগত সূর্যটা দেখতে দেখতে আমরা মঠের সিঁড়িতে বসে কিছু একটার জন্য অপেক্ষা করছিলাম।
যেখানে আমরা বসেছিলাম, সেখান থেকে নিচে ফেস্টিভ্যালের মাঠ দেখা যাচ্ছিল। মঠে আসার সরু রাস্তাটা কার্ট দিয়ে বোঝাই ছিল। দুই সারি কাগজের লণ্ঠন রাস্তার লাইটের মতো জ্বালিয়ে রাখা হয়েছিল। লাল আলোতে চারপাশ আলোকিত হয়ে ছিল।
পাশ কাটিয়ে যাওয়া সবাইকেই হাসিখুশি দেখাচ্ছিল। একারণেই আমরা নিচে যেতে পারতাম না।
আমরা দুজনেই চুপ করে ছিলাম। কারণ, আমরা জানতাম যদি আমরা মুখ খুলি, আমাদের কণ্ঠ আস্তে-আস্তে মিইয়ে যাবে। ধৈর্যসহকারে, দৃঢ়ভাবে আমাদের মুখ বন্ধ রেখে চুপ করে বসে রইলাম।
হিমেনো এবং আমি “কিছু একটা”র জন্য অপেক্ষা করছিলাম। যা আমাদের অস্তিত্বকে মেনে নিবে এবং আমাদের সম্পূর্ণভাবে বুঝবে।
যেহেতু আমরা এমন একটা মঠে ছিলাম যার আশাপাশে অবিরাম ঘুঘুরে পোকা ডেকে চলেছে। তাই আমাদের প্রার্থনা করার সম্ভাবনাটা উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছিল না।
সূর্যটা অর্ধেকের মতো অস্ত গিয়েছে। এমন সময় হিমেনো হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে স্কার্ট থেকে ময়লা পরিষ্কার করে সোজা সামনের দিকে তাকাল।
“আমাদের ভবিষ্যৎ দারুণ হবে” ওর মোলায়েম কণ্ঠে বলল। শুনে মনে হচ্ছিল ও এমন একটা বিষয় নিয়ে কথা বলছে যা কিনা এইমাত্র ও বুঝতে পেরেছে।
“…ঠিক কতটুকু সামনের ভবিষ্যতের কথা বলছি আমরা?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।
“অত সামনেও না। কিন্তু আবার খুব বেশি দূরেও না। সম্ভবত, এই ধরো দশ বছর।”
“দশ বছর পরে” আমি পুনরাবৃত্তি করলাম। “তখন আমাদের বিশ হবে।”
দশ বছর বয়স্ক আমাদের কাছে, বিশ বছর বয়স ছিল সত্যি বেড়ে ওঠার মতো বয়স। সুতরাং আমি ধরে নিলাম হিমেনোর দাবিতে কিছুটা সত্যতা আছে।
ও বলে যেতে লাগল, “হ্যাঁ, সেই ‘কিছু একটা’ অবশ্যই গ্রীষ্মে ঘটবে। আজ থেকে দশ বছর পরের গ্রীষ্মে আমাদের ভাগ্যে খুব ভালো কিছু একটা ঘটবে; আর তখন বেঁচে থাকার জন্য আমরা সত্যিই আনন্দ অনুভব করবো। আমরা বড়লোক আর বিখ্যাত হবো। এলিমেন্টারি স্কুলের দিকে পিছন ফিরে তাকালে, আমরা বলবো… ‘এই স্কুল আমাদের কিছুই দেয়নি। সব ছাত্র-ছাত্রীরা একদম নির্বোধ। এখান থেকে এমনকি ভুল থেকে শিক্ষা নেওয়ার মতোও কিছু ছিল না। সত্যিই খুব বাজে এলিমেন্টারি স্কুল।’”
“হ্যাঁ, হ্যাঁ। স্কুলটা তো সত্যিই কতগুলো নির্বোধ দিয়ে ঠাসা। সত্যি খুব ফালতু স্কুল” আমি বললাম।
সেসময়ে এই দৃষ্টিকোণটা আমাদের জন্য উপন্যাসের মতো ছিল। একজন গ্রেডের ছাত্রের জন্য তাদের স্কুলই তাদের দুনিয়া। এর আগপিছু কিছু চিন্তা করাও যেত না।
“সুতরাং দশ বছরের মধ্যে আমাদের অনেক ধনী এবং বিখ্যাত হতে হবে। এতটাই বিখ্যাত যে আমাদের সহপাঠীদের ঈর্ষায় হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে যাবে।”
“যাতে ঈর্ষায় ওরা ওদের ঠোঁট কামড়ে ধরে” আমি একমত হলাম।
“যদি ওরা সেটা না করে, তবে সেটার গুরুত্ব থাকবে না।” ও হাসল।
আমি এটাকে আশ্বাসের বাণী হিসাবে চিন্তা করিনি। যে মুহূর্তে কথাটা হিমেনো’র মুখ থেকে বের হয়েছে, আমি প্রায় ধরেই নিয়েছিলাম এটাই আমাদের নিশ্চিত ভবিষ্যৎ। এটা অনেকটা ভবিষ্যৎবাণীর মতো মনে হতে লাগল।
হয়তো বা যেরকম বলা হচ্ছে সেরকম বিখ্যাত কেউ হবো না আমরা। কিন্তু দশ বছর পরে, আমরা ওদের পেছনে ফেলে দিবো। আমাদের সাথে এরকম ব্যবহারের জন্য ওরা কবর পর্যন্ত অনুতাপ করবে।
“… তবুও, বিশ বছর হওয়া নিশ্চয় দারুণ কিছুই হবে” অস্তগত সূর্য্যের দিকে তাকিয়ে এবং হাত পিছনে নিয়ে গিয়ে হিমেনো বলল। “দশ বছর পরে বিশ…”
“আমরা ড্রিঙ্ক করতে পারবো। সিগারেট ফুঁকতে পারবো। আর বিয়ে করতে পারবো… দাঁড়াও, দাঁড়াও এটা তো আরও আগেই করা যায়” আমি বললাম।
“ঠিক, মেয়েরা ষোলো বছর বয়সেই বিয়ে করতে পারে।”
“আর ছেলেরা আঠারো বছর বয়সে… কিন্তু আমার মনে হচ্ছে আমি কখনই বিয়ে করতে পারবো না।”
“কেন?”
“আমি পছন্দ করি না এমন জিনিসের সংখ্যা অনেক। এই পৃথিবীতে ঘটে চলেছে এমন অনেক জিনিস আছে যা আমার পছন্দ না। তো আমার মনে হয় না আমি বিয়ে টিকিয়ে রাখতে পারবো।”
“হুহ, হ্যাঁ। আমার ভাগ্যেও মনে হয় একই ঘটনা ঘটবে।” হিমেনো মাথা নিচু করে বলল।
সূর্যাস্তে রঙিন হওয়ার কারণে ওর মুখটা স্বাভাবিকের চেয়ে অন্যরকম লাগছে। মনে হচ্ছে আরও বেশি পরিণত, কিন্তু একই সাথে আরও বেশি ভঙ্গুর।
“…শোনো, তাহলে” হিমেনো বলল, আমার চোখের দিকে পূর্ণদৃষ্টিতে তাকিয়ে। কিন্তু দ্রুতই ও চোখ সরিয়ে নিলো। “বিশ বছর বয়সে আমরা যখন বিখ্যাত হয়ে যাবো… যদি, লজ্জাজনকভাবে এখনকার মতো অবস্থায় থাকি। বিয়ে করার মতো কাউকে খুঁজে না পাই…” ও ধীরে-ধীরে কাশতে লাগল। “যদি এমন হয় আমাদের নিজেদের ছাড়া আর কেউই নেই, তাহলে তুমি কি চাও আমরা একসাথ হই?”
“কী বলছ তুমি?” আমি ভদ্রভাবে উত্তর দিলাম।
“…ঠাট্টা করলাম। ভুলে যাও” হিমেনো হাসল। যেন সে কথাটা এড়িয়ে দিতে চাচ্ছে। “শুধু নিজেই এই কথাটা শুনতে চেয়েছিলাম। এমন না যে আমার কোনো গতি হবে না।”
তাহলে ঠিক আছে, আমি হাসলাম।
কিন্তু আমি জানি ব্যাপারটা শুনতে বেকুবের মতো মনে হবে; যদিও হিমেনো এবং আমি ভিন্ন ভিন্ন পথ বেছে নিয়েছিলাম। আমি সবসময়ই এই প্রতিজ্ঞার কথা মনে রেখেছিলাম। এমনকি মোটামুটি চলনসই কোনো মেয়ে যদি আমার প্রতি অনুরাগ দেখাতোও, তবুও আমি ওদের ফিরিয়ে দিতাম। মিডেল স্কুলে, হাই স্কুলে, এমনকি কলেজেও।
যাতে আবার যখন ওর সাথে আমার দেখা হবে, আমি যাতে ওকে দেখাতে পারি, আমি এখনোও “আগের মতোই আছি।”
হ্যাঁ, আসলে ব্যাপারটা হচ্ছে। আমিও জানি ব্যাপারটা নির্বোধের মতো হয়ে যাচ্ছে।
সেসময়ের পর থেকে দশ বছর হয়ে গিয়েছে।
এখন যদি পেছনে ফিরে তাকিয়ে দেখি, আমার মনে হয় সেটা ছিল চমৎকার সময়। ঠিক ওই সময়ের মতো করে।