চ্যাপ্টার ১৫ : দ্য গিফট অভ দ্য ম্যাজাই

চ্যাপ্টার ১৫ : দ্য গিফট অভ দ্য ম্যাজাই

এটা ছিল শেষ তিন দিনের প্রথম দিনের সকাল।

আমার উপরে আর কোনো পর্যবেক্ষকের চোখ থাকবে না।

সুতরাং, মিয়াগি ও চলে গিয়েছে।

কিভাবে শেষ তিনদিন কাটানো যায় সেই বিষয়ে কিছুক্ষণ আগে আমি সিদ্ধান্ত নিলাম। সকালে নোটবুকের কাজটা শেষ করে ফেললাম।

গতকালের ঘটনাগুলো লেখা শেষ হয়ে গেলে কলম তুলে রেখে কয়েক ঘণ্টা ঘুমালাম।

ঘুম থেকে উঠে, ধূমপান করার জন্য বাইরে গেলাম। তারপরে একটা ভেন্ডিং মেশিন থেকে তৃষ্ণা নিবারণের জন্য সিডার কিনে আনলাম।

আমি বিছানার দিকে তাকালাম।

একশ’ সাতাশি ইয়েন। আমার একমাত্র সম্বল। আর এর মধ্যে ষাট ইয়েন হচ্ছে ১ ইয়েনের কয়েন।

তিনবার গুণলাম আমি। তিনবারই একশ’ সাতাশি ইয়েন হলো।

অদ্ভুত মিল বুঝতে পেরে, আমার চিবুক জ্বালা করতে লাগল। তিন দিন এগুলো দিয়ে কাটানো একপ্রকার অনিশ্চিত বলে মনে হলো; তার পরেও এখন পর্যন্ত আমি এই পরিস্থিতি বেশ ভালোই উপভোগ করছি।

নোটবুকে তাকিয়ে এবং কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিস্তারিত যোগ করে কাবে উঠে পড়লাম এবং মিয়াগির সাথে যেসব জায়গায় গিয়েছিলাম সেসব জায়গায় ঘুরতে লাগলাম। এবার আমি সত্যিই একা ছিলাম।

নীল আকাশের নিচ দিয়ে কাব চালিয়ে গেলাম আমি যেন সেখানে মিয়াগির ঘ্রাণ রয়ে গিয়েছে।

আমার জানতে ইচ্ছে করছে মিয়াগি কি কাউকে পর্যবেক্ষণ করছে?

প্রার্থনা করি ওরা হতাশ হয়ে যেন মিয়াগিকে আক্রমণ না করে বসে।

প্রার্থনা করি মিয়াগি যেন ওর ঋণ পরিশোধ করার আগ পর্যন্ত কাজ করে যেতে পারে। এবং আমাকে ভুলে গিয়ে সুখী জীবনযাপন করতে পারে।

প্রার্থনা করি আমার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ কাউকে যেন মিয়াগি খুঁজে পায়। সে- ও যেন মিয়াগিকে আমার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ মনে করতে পারে।

পার্কে হেঁটে যাওয়ার সময়, বাচ্চারা আমার দিকে হাত নাড়ল। হঠাৎ আমার মাথায় একটা আইডিয়া খেলে গেল, আমি ভান করতে লাগলাম যেন মিয়াগি আমার সাথেই আছে।

আমি হাত বের করে কাল্পনিক মিয়াগির হাতে হাত রেখে বললাম, “দেখো, মিয়াগি!”

সবার জন্য এটাই খুব স্বাভাবিক। “আহ, সেই গর্দভ কুসুনোকি ওর কাল্পনিক গার্লফ্রেন্ডকে নিয়ে হেঁটে যাচ্ছে।”

কিন্তু এটা আমার জন্য অন্যরকম ছিল। সত্যি বলতে, একটুও মিল ছিল না বললেই চলে।

নিজের সাথে এরকম করতে গিয়ে, আমাকে এতটাই বিষণ্ণতা চেপে ধরল যে, আমি কোনোমতে দাঁড়িয়ে রইলাম। মিয়াগির অনুপস্থিত আগের চেয়েও বেশি বুঝতে পারলাম।

আমার একটা তত্ত্ব আছে।

যদি একদম শুরু থেকে পুরোটাই আমার বিভ্রম হয়ে থাকে?

আমি প্রায় নিশ্চিত আমার জীবন তিনদিন পরে শেষ হয়ে যাবে। আমি বুঝতে পারছি আমার জীবনের একটা অংশ খরচ করা হয়ে গিয়েছে। এই অনুভূতিটা মিথ্যা হতে পারে না।

কিন্তু মিয়াগি নামের মেয়েটার অস্তিত্ব কি সত্যি আছে? শুধু ওর অস্তিত্বই না, আয়ুষ্কাল নিয়ে লেনদেন করা দোকানের অস্তিত্ব কি আসলেই আছে? নাকি আমার মৃত্যু সন্নিকটে বুঝতে পেরে নিজেই এসব কল্পনা করে নিয়েছি?

আমার পক্ষে এখন আর এসব জানার কোনো উপায় নেই।

আমি একটা ফোয়ারার কিনারে মাথা নিচু করে বসে ছিলাম। মিডেল স্কুল পড়ুয়া একটা ছেলে আর একটা মেয়ের ডাকে মাথা তুললাম। ওরা নিষ্পাপ কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল, “মি. কুসুনোকি, মিস. মিয়াগি কেমন আছে?”

“মিয়াগি আর আমার সাথে নেই” আমি বললাম।

মেয়েটা বিস্ময়ে মুখে হাত চাপা দিলো।

“কী বলেন? কী হয়েছে? আপনারা কি ঝগড়া করেছেন?”

“ওরকমই কিছু একটা। তোমরা দুজনও কি ঝগড়া করো না?”

ওরা দুজনে একে অন্যের দিকে তাকিয়ে সম্মতির ভঙ্গিতে মাথা ঝাঁকাল। “আসলে, আমি জানি না… এমনকি মি. কুসুনোকি আর মিস. মিয়াগিও তর্ক করে নাকি?”

“যদি তোমরা দুজনে এত ভালোভাবে মিলেমিশে থাকা সত্ত্বেও ঝগড়া করতে পারো তাহলে আমারাও যে এরকম করবো না, তা কী করে হয়।“

আমি বলতে চেয়েছিলাম “জানো, এটাই সত্যি।” কিন্তু শব্দটা বের হলো না।

কিছু বুঝে উঠার আগেই আমি বাঁধ ভাঙা কান্নায় ভেঙে পড়লাম। যতই আমি কল্পনা করার চেষ্টা করলাম, মিয়াগি আমার পাশে বসে আমাকে সান্ত্বনা দিচ্ছে; ততই অশ্রু ঝরতে লাগল আমার।

ওরা দুজনে আমার পাশে বসে আমাকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করল।

তার পরে আশ্চর্যজনকভাবে, আমি দেখতে পেলাম, আমি যা ভেবেছিলাম এরচেয়েও বেশি লোক আমার সম্পর্কে জানে।

সকল বয়সের লোকজন আমার চারপাশে দাঁড়িয়ে দৃশ্য দেখতে লাগল যেন তারা বলতে চাচ্ছে “কুসুনোকি নতুন কিছু একটা করছে।”

শিনবাসির বন্ধু সুজুমি এবং আশাকুরাও ওখানে ছিল। ‘কী হয়েছে?’ সুজুমি আমাকে জিজ্ঞেস করল।

কিভাবে উত্তর দিবো আমি বুঝতে পারছিলাম না। সুতরাং আমি ওদের বললাম আমি আর মিয়াগি ঝগড়া করেছি। আমাদের বিচ্ছেদ হয়ে গিয়েছে। আমি একটা গল্প বানালাম, কিভাবে ও আমার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে এবং আমাকে পরিত্যাগ করেছে।

“মিয়াগি হয়তো কুসুনোকিকে পছন্দ করতো না?” একটা তীক্ষ্ণ চোখের হাই স্কুলের মেয়ে রেগেমেগে বলল। ও এমনভাবে কথা বলছিল যেন সে সত্যি সত্যি ও মিয়াগির অস্তিত্বে বিশ্বাস করে।

“এরকম কিছু কেন ঘটল?” ওর পাশের একজন লোক জিজ্ঞেস করল। আমি লোকটাকে চিনতে পারলাম।

ঠিক। লোকটি ছিল ফটো স্টুডিও’ও মালিক। মিয়াগির অস্তিত্বে স্বীকৃতি দেয়া প্রথম ব্যক্তি উনি।

“মেয়েটাকে তো এরকম নিষ্ঠুর মনে হয়নি?”

“এর মানে কি ও একেবারেই চলে গিয়েছে?” সুজুমি জিজ্ঞেস করল।

ট্যাংক-টপ পরা একজন যুবক আমাকে বলল পেছনে মৃদু থাপ্পড় দিয়ে, “মিয়াগি মেয়েটা কোনো কাজের না। এরকম একটা ছেলেকে ধোঁকা দিয়েছে ও!”

আমি ছেলেটার দিকে ঘুরলাম কিছু বলার জন্য, কিন্তু মুখ দিয়ে কিছুই বের হলো না।

…ঠিক তখনই, পেছন থেকে একটা কণ্ঠ ভেসে এলো।

“অবশ্যই। যেখানে উনি একজন ভালো মানুষ।”

আমি কণ্ঠটা চিনতে পারলাম। এক দুই দিনে কিছুতেই কণ্ঠটা ভুলবো না।

কণ্ঠটা ভুলতে আমার ত্রিশ বছর, তিনশ’ বছর, তিন হাজার বছর লাগবে।

কণ্ঠটা যে দিক থেকে এসেছিল আমি সেদিকে ঘুরলাম।

আমার কিছুতেই ভুল শোনার কথা না।

কিন্তু নিজ চোখে দেখার আগ পর্যন্ত আমি বিশ্বাস করবো না।

ও মুখ টিপে হাসতে লাগল।

“সেই মিয়াগি মেয়েটা সত্যিই কোনো কাজের না।”

মিয়াগি ওর হাত আমার গলায় রেখে আমাকে জড়িয়ে ধরল।

“আমি ফিরে এসেছি মি. কুসুনোকি। আমি আপনার খোঁজ করছিলাম।“

আমি সহজাত প্রবৃত্তির বশবর্তী হয়ে ওকে পাল্টা জড়িয়ে ধরে ওর চুলের ঘ্রাণ নিতে লাগলাম। এই ঘ্রাণটা “মিয়াগি” ছাড়া আর কারো হওয়ার কথা না।

একমাত্র আমারই পরিস্থিতিটা হজম করতে সমস্যা হচ্ছিল না। হয়তোবা আমার চারপাশের সবারই একইভাবে বিমূঢ় এবং অভিভূত হয়ে গিয়েছিল। তারা সম্ভবত ভাবছিল, “মিয়াগি মেয়েটার না অস্তিত্বহীন হওয়ার কথা ছিল?”

আমি ওদের সবার প্রতিক্রিয়া দেখে স্তব্ধ হয়ে চুপ হয়ে গেলাম। সবাই মিয়াগিকে দেখতে পারছে।

“আপনি নিশ্চয় মিস. মিয়াগি?” জার্সি পরিহিত একজন লোক ত্রস্তভাবে জিজ্ঞেস করল।

“হ্যাঁ। আমিই সেই অকাজের মিয়াগি।” মিয়াগি উত্তর দিলো।

লোকটা আমার কাঁধে চাপড় দিলো।

“সৃষ্টিকর্তার কাছে শুকরিয়া!” লোকটা হাসতে লাগল। “কে জানতো, ওর সত্যি সত্যি অস্তিত্ব আছে। আর আপনি সত্যি খুব সুন্দরী, মিস. মিয়াগি! আমি ঈর্ষান্বিত!”

কিন্তু আমি তখনো বুঝতে পারছিলাম না কী ঘটছে।

মিয়াগি এখানে কী করছে? কেন অন্যান্য লোকজন ওকে দেখতে পারছে?

“তাহলে, মিস. মিয়াগি… সত্যি মিস… মিয়াগি” হাই স্কুলের মেয়েটা বড় বড় চোখে বলল। “…হ্যাঁ। কিভাবে যেন, আমি আপনাকে যেভাবে কল্পনা করেছিলাম আপনি ঠিক সেরকমই।”

আশাকুরা ভিড়ের পিছন থেকে আমাদের একা থাকতে দেওয়ার পরামর্শ দিলো সবাইকে। তো লোকজন আমাদের নিয়ে তামাশা করে এবং অভিনন্দন জানিয়ে একজন দু’জন করে চলে যেতে লাগল।

আমি আশাকুরাকে ধন্যবাদ জানালাম।

“আমি অনুমান করে নিয়েছিলাম আমি যে ধরনের মেয়দের পছন্দ করি

মিয়াগি সত্যিই সেই ধরনের মেয়েই হবে” আশাকুরা হেসে বলল। “তোমরা দুজনে, সুখী হও।”

এরপরেই আমরা একা হয়ে গেলাম।

মিয়াগি আমার হাত তুলে নিয়ে ব্যাখ্যা করতে লাগল।

“অদ্ভুত, তাই না? কিভাবে আমি এখানে আসলাম? কিভাবে সবাই আমাকে দেখতে পাচ্ছে?…খুবই সহজ। আমি একই কাজ করেছি যা আপনি করেছিলেন।”

“একই কাজ?”

কয়েক মুহূর্ত পরে, আমি বুঝতে পারলাম ও কি বোঝাতে চাচ্ছে।

“কত দামে… তুমি বিক্রি করেছো?”

“একই দামে। আমি সবটুকুই বিক্রি করে দিয়েছি। তিনদিন বাদে সবগুলো দিন।”

আমার মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গেল।

“আপনি আপনার আয়ুষ্কাল বিক্রির পরেই, অন্য পর্যবেক্ষকটা আমার সাথে যোগাযোগ করে। সে আমাকে বলল আপনি আমার ঋণ পরিশোধ করার জন্য আরও আয়ুষ্কাল বিক্রি করেছেন। কথাটা শোনার সাথে সাথেই আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলাম। উনিই বাকি আনুষ্ঠানিকতা শেষ করেছেন।”

আমি নিশ্চিত আমার দুঃখ পাওয়া উচিত।

যে মানুষটাকে রক্ষা করার জন্য আমি সবকিছু বিসর্জন দিয়েছিলাম, সে আমার ইচ্ছার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে এবং নিজের জীবন ছুড়ে ফেলে দিয়ে এসেছে। আমার দুঃখ পাওয়া উচিত।

অথচ, আমার সুখী সুখী লাগছে।

ওর বিশ্বাসঘাতকতা, ওর বোকামি, এখন আমার কাছে অন্য সবকিছুর চেয়েও বেশি প্রিয় লাগছে।

মিয়াগি আমার পাশে বসে, আমার গায়ে হেলান দিলো।

“দারুণ কাজ দেখিয়েছেন, মি. কুসুনোকি। মাত্র ত্রিশ দিনেই আমার বাকি জীবন প্রায় কিনে ফেলেছেন… আমি খুবই দুঃখিত। আপনি আমার জন্য এত কষ্ট করেছিলেন আর আমি সেটা ছুড়ে ফেলে দিয়ে এলাম। আমি সত্যি বোকা একটা মেয়ে।“

“বোকা?” আমি বলল। “আমিই বোকা। আমি এমনকি তিনদিনও তোমাকে ছাড়া বাঁচতে পারতাম না, মিয়াগি। আমি নিশ্চিত ছিলাম না আমি কী করবো।“

মিয়াগি সুখের হাসি দিলো। তার পরে ওর চিবুক আমার কাঁধে রাখল।

“আপনাকে ধন্যবাদ, আমার জীবনের মূল্য কিছুটা বেড়েছিল। তো বাকি ঋণ পরিশোধ করার পরেও, আগামী তিনদিন চলার পরেও বেশ কিছু টাকা থেকে যাবে আমাদের হাতে।”

“তাহলে আমরা এখন ধনী” মিয়াগিকে জড়িয়ে ধরে এবং ঝাঁকুনি দিয়ে বললাম আমি।

“হ্যাঁ, আমরা ধনী।” মিয়াগি উত্তর দিলো।

আবারো চোখ থেকে অশ্রু বের হয়ে এলো। মিয়াগিও আমার মতো অবস্থা। আমি এতে কিছু মনে করলাম না।

***********

মারা যাওয়ার সময় আমি কিছুই পেছনে ফেলে যাবো না।

হয়তো কিছু কৌতূহলী মানুষ আমাকে বোকা হিসাবে মনে রাখবে। কিন্তু বেশিরভাগ মানুষই আমাকে ভুলে যাবে।

এতে আমার কিছু যায় আসে না।

একদা এক সময়ে যে অমরত্ব আমার স্বপ্ন ছিল, সেটার আর কোনো প্রয়োজন নেই আমার।

কেউ যদি আমাকে মনেও না রাখে তাতে আমার কিছুই যায় আসে না।

কারণ, ও আমার সাথে আছে, পাশে বসে হাসছে।

শুধু একারণেই, আমি অন্য সবকিছুভুলে যেতে পারি।

*****

“তো, মি. কুসুনোকি।“

মিয়াগি সামনে এগিয়ে গিয়ে আমার দিকে পেছন ফিরে একটা মিষ্টি হাসি দিলো।

“এই তিনদিন কিভাবে কাটাবেন বলে ঠিক করেছেন?”

মর্মান্তিক যে ত্রিশ বছর আমাকে কাটাতে হতো, তার সাথে তুলনা করে আমি এই তিনটে দিনকে বিশ্বাস করি।

যে উপযুক্ত ত্রিশ দিন আমাক কাটাতে হতো, তার সাথে তুলনা করেও এই তিন দিন অনেক, অনেক, অনেক বেশি মূল্যবান।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *