চ্যাটার্টন– বালক-কবি

‘And we at sober eve would round thee throng,
Hanging, enraltured, on thy stately song;
And greet with smiles the young-eyed loesy,
All deftly mashed, as near Antiquity।’
–Coleridge

কবি যখন আপনার গুণ বুঝিতে পারিতেছেন ও জগৎ যখন তাঁহার গুণের সমাদর করিতেছে না, তখন তাঁহার কী কষ্ট! যখন তিনি মনে করিতেছেন পৃথিবীর নিকট হইতে যশ ও আদর তাঁহার প্রাপ্য, তাঁহার ন্যায্য অধিকার, তখন তিনি যদি ক্রমাগত উপেক্ষা সহ্য করিতে থাকেন, তাহা হইলে তাঁহার প্রতিহিংসা-প্রবৃত্তি প্রজ্বলিত হইয়া উঠে, কিন্তু কী উপায়ে সে প্রতিহিংসা সাধন করেন? আপনাকে বিনাশ করিয়া! তিনি বলেন, পৃথিবী যখন তাঁহাকে অনাদর করিল, তখন পৃথিবী তাঁহাকে পাইবার যোগ্য নহে, তিনি আপনাকে বিনষ্ট করেন ও মনে করেন পৃথিবী একদিন ইহার জন্য অনুতাপ করিবে। বালক কবি চ্যাটার্টন যখন যশ ও অর্থের নিমিত্ত লালায়িত হইয়া লন্ডনে গেলেন ও যখন নিরাশ হইয়া অনাহারে দিন যাপন করিতেছিলেন, তখন একজন তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিয়াছিল যে, তিনি কেন তাঁহার লেখা ছাপাইয়া অর্থ উপার্জন করেন না, তখন কবি কহিলেন, পুরানো বস্ত্র কিনিবার জন্য ও গৃহ সাজাইবার জন্য তিনি কোনো কবিতা লেখেন নাই; পৃথিবী যদি ভালোরূপ ব্যবহার না করে তাহা হইলে সে পৃথিবী তাঁহার কবিতার একটি ছত্রও দেখিতে পাইবে না! আরও কিছুদিন অপেক্ষা করিলেন, দেখিলেন পৃথিবী ভালো ব্যবহার করিল না, তখন তিনি তাঁহার সমস্ত অপ্রকাশিত কবিতা দগ্ধ করিয়া ফেলিলেন ও আপনার প্রাণও নষ্ট করিয়া ফেলিলেন; পৃথিবী আজ অনুতাপ করিতেছে। ১৭৭০ খৃস্টাব্দে যে পৃথিবী তাঁহার মৃত্যুর পর একটি অশ্রুজলও ফেলে নাই; ১৮৪০ খৃস্টাব্দে সেই পৃথিবী তাঁহার স্মরণার্থে প্রস্তরস্তম্ভ নির্মাণ করিয়া পূর্বকৃত অন্যায় ব্যবহারের যথাসাধ্য প্রতিকার করিবার চেষ্টা পাইল।

চ্যাটার্টন তাঁহার শৈশবকাল অবধি এমন সংসর্গে ছিলেন যে, তাঁহার প্রতিভা কিরূপে স্ফূর্তি পাইল ভাবিয়া পাওয়া যায় না। অনুকূল অবস্থায় অনেকের প্রতিভার বীজ অঙ্কুরিত হইতে দেখা যায়, কিন্তু প্রতিকূল অবস্থায় তাহা অতি অল্প লোকের ভাগ্যে ঘটিয়া থাকে। অবস্থা বিশেষে অনুকূল না হইলে অসময়ে শৈশবে প্রতিভার পূর্ণস্ফূর্তি হওয়া এক প্রকার অসম্ভব। পিতার মৃত্যুর তিন মাস পরে ব্রিস্টল নগরে চ্যাটার্টনের জন্ম হয়। তাঁহার মাতা, তাঁহার ধর্ম মা Mrs Edkinsবিরক্ত হইয়া তাঁহাকে ভর্ৎসনা করিয়া কহিলেন, “তোর বাপ যদি বাঁচিয়া থাকিতেন, তাহা হইলে তোকে সিধা করিতেন!’ শুনিয়া বালক চমকিয়া উঠিয়া কহিল, “আহা যদি তিনি বাঁচিয়া থাকিতেন।’ বলিয়াই একটি গভীর দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া অনেকক্ষণ নীরবে বসিয়া রহিল! কখনো কখনো অনেকক্ষণ কী কথা ভাবিতে ভাবিতে তাঁহার কপোলে একটি একটি করিয়া অশ্রু বহিয়া পড়িত, তাহা দেখিয়া তাঁহার মাতা আসিয়া কারণ জিজ্ঞাসা করিলে বালক যথার্থ কারণ বলিতে চাহিত না! আবার এক-এক সময় কতক্ষণ নিস্তব্ধ বসিয়া থাকিয়া হঠাৎ একটা কলম লইয়া অনর্গল লিখিতে আরম্ভ করিত, কিন্তু কী লিখিত সে বিষয়ে কাহারও কখনো কৌতূহল হয় নাই। এ-সকল যে অসাধারণ অস্ফূর্ত প্রতিভা-উদ্ভূত, তাহা তাঁহার মাতা কিরূপে বুঝিবেন বলো? স্কুলের শিক্ষক তাঁহাকে একটা গর্দভ মনে করিত, তাঁহার সহপাঠীরা তাঁহার ভাবগতিক বুঝিতে না পারিয়া অবাক হইত। বাল্যকালে তাঁহার পাঠে তেমন মন ছিল না– কিন্তু হঠাৎ এক সময়ে এমন তাঁহার পড়িতে মন বসিয়া গেল যে, শয্যা হইতে গাত্রোত্থান করিয়াই পড়িতে আরম্ভ করিতেন, ও ঘুমাইতে যাইবার সময়ে বহি বন্ধ করিতেন। যখন তিনি পাঠের গৃহে বসিয়া পাঠে মগ্ন থাকিতেন, তখন কিছুতেই আহার করিতে আসিতেন না, অবশেষে Mrs Edkinsতাঁহার বাল্য-প্রিয়তমা Miss Sukey Will-এর নাম করিলে তিনি তাড়াতাড়ি উঠিয়া আসিতেন!

যখন এমন কেহ তাঁহার সঙ্গী ছিল না যে তাঁহাকে বুঝিতে পারিবে, তাঁহার সহিত সমানুভব করিবে, তখন ব্রিস্টলের এক অতি প্রাচীন গির্জা ও সেই গির্জার মধ্যস্থিত অতি প্রাচীন কালের লোকদের পাষাণ-মূর্তি সকলই তাঁহার সঙ্গী ছিল। শুনা যায়, প্রায় তিনি সেই গির্জায় যাইতেন ও ক্রীড়া-সহচরদিগের মধ্যে তাঁহার বিশেষ সুহৃদ্‌দিগকে কবিতা শুনাইতেন। শৈশবে কী বিষয় লইয়া তিনি কবিতা লিখিবেন? স্কুলের হেডমাস্টার তাঁহাকে প্রহার করিয়াছিলেন, তাহার নামে ঠাট্টা করিয়া একটা কবিতা লিখিলেন, দুষ্টামি করিয়া পাড়ার একটা দোকানদারের নামে কবিতা লিখিয়া খবরের কাগজে ছাপাইয়া দিলেন। লোকে বলে এগারো বৎসরের সময় তিনি কবিতা লিখিতে শুরু করেন, কিন্তু তাহারও পূর্বে দশ বৎসরের সময় তাঁহার একটি কবিতা পাওয়া গিয়াছে। কবিতাটি যিশুখৃস্টের পৃথিবীতে অবতরণ সম্বন্ধে। আসলে এ কবিতাটির মূল্য তেমনি কিছুই নহে, এ সম্বন্ধে তিনি স্কুলে যাহা পড়িয়াছেন তাহাই ছন্দে গাঁথিয়াছেন মাত্র, তথাপি দশ বৎসরের বালকের কবিতার একটা নমুনা পাঠকদের হয়তো দেখিতে কৌতূহল হইবে। অনুবাদ অবিকল করিবার মানসে অমিত্রাক্ষরে লিখিলাম–

উপর হইতে দেখো আসিছেন মেঘে,
বিচারক, বিভূষিত মহিমা ও প্রেমে;
আলোকের রাজ্য দিয়া আনিবারে তাঁরে
দ্বিধা হয়ে গেল দেখো শূন্য একেবারে
বদন ঢাকিয়া তার ফেলিল তপন
যিশুর উজ্জ্বলতর হেরিয়া কিরণ
চন্দ্র তারা চেয়ে থাকে বিস্ময়ে মগন!
ভীষণ বিদ্যুৎ হানে, গরজে অশনি
কাঁপে জলধির তীর কাঁপিল অবনী!
স্বর্গের আদেশ– শৃঙ্গ বাজিল অমনি
জল স্থল ভেদি তার উচ্ছ্বাসিল ধ্বনি!
মৃতেরা শুনিতে পেলে আদেশের স্বর
পুণ্যবান হাসে, পাপী কাঁপে থর থর
ভীষণ সময় কাছে এসেছে এখন
উঠিবেক কবরের অধিবাসীগণ
অনন্ত আদেশ তাঁর করিতে গ্রহণ।

ব্রিস্টলের রেডক্লিফ্‌ গির্জায় (St Mary Redcliffe Church) একটি ঘর ছিল, সেখানে কতকগুলি কাঠের সিন্দুক অনেকদিনকার পুরানো নানা প্রকার কাগজপত্র দলিল দস্তাবেজ থাকিত। সে-সকল পুরানো অক্ষরের পুরানো ভাষার কাগজপত্রের বড়ো যত্ন ছিল না। চ্যাটার্টনের পিতা যখন গির্জার কর্মচারী ছিলেন, তখন মাঝে মাঝে সেই-সকল সিন্দুক হইতে রাশি রাশি লিখিত পার্চমেন্ট লইয়া তাঁহার রান্নাঘরে জিনিসপত্র সাফ করিতেন ও অন্যান্য নানা গৃহকর্মে নিয়োগ করিতেন। যাহা-কিছু প্রাচীন তাহারই উপর চ্যাটার্টনের অসাধারণ ভক্তি ছিল। চ্যাটার্টন সেই-সকল কাগজপত্র তাঁহার পড়িবার ঘরে লইয়া গিয়া দরজা বন্ধ করিয়া প্রাচীন অক্ষর ও ভাষা পাঠ করিতে চেষ্টা করিতেন ও সেই-সকল অক্ষর অনুকরণ করিতে প্রয়াস পাইতেন। এইরূপে প্রাচীন ইংরাজি ভাষা তাঁহার দখল হয় ও তখন হইতে প্রাচীন কবিদের অনুকরণ করিয়া কবিতা লিখিতে আরম্ভ করেন। তাঁহার সেই ক্ষুদ্র অন্ধকার পাঠগৃহে দরজা বন্ধ করিয়া কতকগুলা রঙ ও কয়লার গুঁড়া লইয়া স্তূপাকার প্রাচীন কাগজপত্রের মধ্যে চ্যাটার্টন কী করিতেন তাহা তাঁহার মাতা ভাবিয়া পাইতেন না। কিরূপ করিলে পার্চমেন্ট প্রাচীন আকার ধারণ করে তিনি তাহা নানাবিধ উপায়ে পরীক্ষা করিতেন। এই সময়ে চ্যাটার্টন প্রাচীন ভাষায় কবিতা লিখিতেন ও অতি যত্নে তাহা লুকাইয়া রাখিতেন ও যখন প্রকাশ করিতেন, কহিতেন রাউলি (ছষংরনঁ) নামক একজন ব্রিস্টলের অতি প্রাচীন কবি এই-সকল কবিতা লিখিয়াছেন, তিনি অনেক অনুসন্ধান করিয়া সেই-সকল পুস্তক পাইয়াছেন। কেহ অবিশ্বাস করিত না, কে করিবে বলো? কে জানিবে যে, একজন পঞ্চদশবর্ষীয় বালক প্রাচীন কবিদের অনুকরণ করিয়া এই-সকল কবিতা লিখিয়াছে। তাঁহার সঙ্গীদের মধ্যেই বা এমন কে ছিল যে সেই-সকল প্রাচীন ইংরাজি ভালো করিয়া বুঝিবে? তাঁহার মাতা, তাঁহার ভগিনী, একটা অবৈতনিক বিদ্যালয়ের কতকগুলি মূর্খ বালক ও তাহাদের অপেক্ষা জ্ঞানে দুই-এক সোপান মাত্র উন্নতি দুই-একটি অল্প বেতনের শিক্ষক প্রাচীন ইংরাজি সাহিত্যের অতি অল্পই ধার ধারিত।

নামক এক পত্রিকায় চ্যাটার্টন রাউলির ছদ্মনাম ধারণ করিয়া ‘Elinoure and Juga'(এলিনোর ও জুগা) নামক একটি গাথা প্রকাশ করিলেন। রুড্‌বোর্ন নদীতীরে বসিয়া এলিনোর ও জুগা তাহাদের যুদ্ধ-নিহত প্রণয়ীর জন্য শোক করিতেছে। জুগা কহিতেছে–

              আয় বোন, করি মোরা হেথায় বিলাপ,
              এই ফুলময় তীরে, বিষাদ যথায়
              রয়েছে তাহার দুটি পাখা ছড়াইয়া
              উষার শিশির আর সায়াহ্নের হিমে
              এইখানে বসি বসি ভিজিব দুজনে!
              বজ্র-দগ্ধ, শুষ্ক দুই পাদপ যেমন 
              উভয়ের 'পরে রহে উভয়ে ঝুঁকিয়া।
              কিংবা জনশূন্য যথা ভগ্ন নাট্যশালা
              হৃদয়ে পুষিয়া রাখে বিভীষিকা শত,
              অমঙ্গল কাক যেথা ডাকে অবিরাম।
              কাঁদিয়া কাঁদিয়া পেঁচা জাগায় নিশিরে।
              বংশীরবে উষা আর উঠিবে না জাগি
              নৃত্যগীত বাদ্য আদি হবে নাকো আর।
              এলিনোর
                            ঘোটকের পদশব্দ শৃঙ্গের গর্জনে
              অরণ্যে প্রাণীরা আর উঠিবে না কাঁপি!
              সারা দীর্ঘ দিন আমি ভ্রমিব গহনে
              সারা রাত্রি গোরস্থানে করিব যাপন
              প্রেতাত্মারে কব যত দুখের কাহিনী।

যদিও চ্যাটার্টনের অহংকার আতি অল্পই প্রশ্রয় পাইয়াছিল ও তাঁহার যশ-লালসা তৃপ্ত হয় নাই তথাপি তাঁহার অহংকার ও যশের ইচ্ছা অতি বাল্যকাল হইতে অত্যন্ত বলবান ছিল। তাঁহার বাল্যকালে তাঁহার মাতার এক কুম্ভকার বন্ধু চ্যাটার্টনকে একটি মৃৎপাত্র উপহার দিবার মানস করিয়া তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিল, সে পাত্রের উপর কী চিত্র আঁকিবে। চ্যাটার্টন কহিলেন, “একটি দেবতা (angel) আঁকো, তাহার মুখে একটি শৃঙ্গা দেও, যেন সমস্ত পৃথিবীময় সে আমার যশঃকীর্তন করিতেছে।’ তাঁহার এমন প্রশংসা-তৃষ্ণা ছিল যে, যতদিন তিনি ব্রিস্টলে ছিলেন, তিনি এমন একটি সামান্য কবিতা লিখেন নাই যাহা তাঁহার সহপাঠীদের শোনান নাই; অনেক সময়ে সে বেচারীরা বিরক্ত হইয়া উঠিত। সন্দিগ্ধ লোকেরা কহিত, যাঁহার যশ-লালসা এত প্রবল, তিনি কোন্‌ প্রাণে নিজে কবিতা লিখিয়া ছন্মনামে প্রকাশ করিলেন? রাউলি-রচিত কবিতাগুলি চ্যাটার্টনের রচিত নয় বলিয়া সন্দেহ করিবার এই একটি প্রধান কারণ! মানুষের চরিত্রে এত প্রকার বিরোধী ভাব মিশ্রিত আছে যে, ওরূপ একদিক মাত্র দেখিয়া কোনো সিদ্ধান্তে উপনীত হইতে গেলে ভ্রমে পড়িতে হয়। তাঁহার সহস্র অহংকার থাক্‌, তথাপি কত কারণবশত যে তিনি তাঁহার নিজের নাম প্রকাশ করেন নাই তাহা কে বলিতে পারে? তাঁহার চলিত ভাষায় লিখিত ছোটোখাটো কবিতাগুলিতে তাঁহার নিজের নাম প্রকাশ করিতেন ও তাহা লইয়া যথেষ্ট গর্ব অনুভব করিতেন, আর তাঁহার প্রাচীন ভাষায় রচিত কবিতাগুলি যদিও খুব গর্বের সহিত সকলকে শুনাইতেন, তথাপি তাহাতে নিজের নাম ব্যবহার করিতেন না, ইহার কারণ খুঁজিতে গেলে যে একেবারে নিরুপায় হইয়া পড়িতে হয় তাহা নহে। যতদূর জানা যায়, তাহাতে দেখিতে পাওয়া যায়, তিনি তাঁহার নিজের লিখিত প্রাচীন ভাষার কবিতাগুলিকে অতিশয় ভক্তির চক্ষে দেখিতেন, যেরূপ ভক্তির সহিত লোকে অতি পুরাকালের গ্রন্থসমূহকে পূজা করে, তাঁহার নিজ-রচিত কবিতার প্রতি তাঁহার ভক্তি যে তদপেক্ষা ন্যূন ছিল, তাহা নহে; কল্পনার মোহিনী-মায়ায় মানুষ নিজহস্তগঠিত প্রতিমাকে দেবতার মতো পূজা করে ও সেই কল্পনার ইন্দ্রজালে চ্যাটার্টন সাধারণ লোকের অনধিগম্য পবিত্র মৃত ভাষায় যে কবিতা লিখিতেন তাহা এক প্রকার সম্ভ্রমের সহিত নিরীক্ষণ করিতেন। যেন সেগুলি তাঁহার নিজের সাধ্যায়ত্ত কবিতা নহে, যেন প্রাচীন যুগের কোনো মৃত কবির আত্মা তাঁহাতে আবির্ভূত হইয়া তাঁহার মুখ দিয়া সেই কবিতা বলাইয়াছেন মাত্র। সামান্য সামান্য বিষয়মূলক– রাজনীতি বা বিদ্রূপসূচক কবিতা লইয়া তিনি খবরের কাগজে ছাপাইতেন, নাম দিতেন, সকলকে শুনাইতেন– অর্থাৎ সেগুলি লইয়া নাড়াচাড়া করিতে বড়ো সংকোচ অনুভব করিতেন না, কিন্তু “রাউলি কবিতা’ এক স্বতন্ত্র পদার্থ, তাহা অতি গোপনে লিখিতেন, গোপন রাখিতেন, যদি কখনো বাহিরে প্রকাশ করিতেন তবে সে প্রাচীনকালের ও অতি প্রাচীন লেখকের বলিয়া। দুই-একবার, তিনি নিজে লিখিয়াছেন বলিয়া স্বীকার করিয়াছিলেন, কিন্তু লোকের মুখে সন্দিগ্ধ উপহাসের হাসি দেখিয়া তখনি আবার ঢাকিয়া লইতেন। তাঁহার “রাউলি কবিতা’ লইয়া ওরূপ সন্দেহ, উপহাস তিনি সহিতে পারেন না, লোকের ওই কবিতাগুলি ভালো লাগিলেই তিনি সন্তুষ্ট থাকেন। প্রথম প্রথম যখন তিনি প্রাচীন ভাষায় লিখিতে আরম্ভ করেন, তখন হয়তো বালকস্বভাববশত অনেককে ফাঁকি দিবেন ও মজা করিবেন মনে করিয়া ছদ্মনাম ব্যবহার করেন, অথবা হয়তো মনে করিয়াছিলেন যদি তিনি নিজের নাম প্রকাশ করেন তাহা হইলে কেহ বিশ্বাস করিবে না এই ভাবিয়া একটা মিথ্যা নামের আশ্রয় লইয়া থাকিতেন। কিন্তু ক্রমে তিনি যতই লিখিতে লাগিলেন, ততই কল্পনা-চিত্রিত প্রাচীন পুরোহিত কবি রাউলি তাঁহার হৃদয়ে জীবন্ত হইয়া উঠিতে লাগিল, যেন সত্যই রাউলি একজন কবি ছিলেন, রাউলিকে যেন দেখিতে পাইতেন, রাউলির কথা যেন শুনিতে পাইতেন। আর প্রথম যে কারণবশতই এই-সকল কবিতা তাঁহার লুকাইয়া ও ঢাকিয়া ঢুকিয়া রাখিতে প্রবৃত্তি হোক-না কেন, ক্রমে ক্রমে তাঁহার নিজের চক্ষেও সেই-সকল কবিতার উপর একটা রহস্যের আবরণ পড়িয়া গেল, তাঁহার নিজের কাছেও সে-সকল কবিতা যেন কী একটি গোপনীয়, পবিত্র, প্রাচীন পদার্থ বলিয়া প্রতিভাত হইল। ইহা নূতন কথা নহে যে, অনেকে কোনো একটি বিষয়ে অন্যকে প্রতারণা করিতে গিয়া সেই বিষয়ে আপনাকেও প্রতারণা করে। তাহা ছাড়া তাঁহার চতুর্দিকে এমন সব সঙ্গী ছিল, যাহারা প্রতারিত হইতে চায়। একটি প্রাচীন ভাষায় রচিত ভালো কবিতা শুনিলে তাহারা বিশ্বাস করিতে চায় যে, তাহা কোনো প্রাচীন কবির রচিত। যদি তাহারা জানিতে পায় যে, সে-সকল কবিতা একটি আধুনিক বালকের লেখা, যে বালক তাহাদেরই ভাষায় কথা কয়, তাহাদেরই মতো কাপড় পরে– বাহিরের অনেক বিষয়েই তাহাদের সহিত সমান, তাহা হইলে তাহারা কি নিরাশ হয়! তাহা হইলে হয়তো তাহারা চটিয়া যায়, তাহারা সে কবিতাগুলির মধ্যে কোনো পদার্থ দেখিতে পায় না, নানা প্রকার খুঁটিনাটি ধরিতে আরম্ভ করে, যদি বা কেহ সে-সকল কবিতার প্রশংসা করিতে চায়, তবে সে নিজে একটি উচ্চতর আসনে বসিয়া বালকের মাথায় হাত বুলাইতে বুলাইতে অতি গম্ভীর স্নেহের স্বরে বলিতে থাকে যে, হাঁ, কবিতাগুলি মন্দ হয় নাই, এবং বালককে আশা দিতে থাকে যে, বড়ো হইলে চেষ্টা করিলে সে একজন কবি হইতে পারিবে বটে! তাহাদের যদি বল, এ-সকল একটি প্রাচীন কবির লেখা, তাহারা অমনি লাফাইয়া উঠিবে, ভাবে গদগদ হইয়া বলিবে, এমন লেখা কখনো হয় নাই হইবে না; কাগজে পত্রে একটা হুলস্থূল পড়িয়া যাইবে– শত প্রকার সংস্করণে শত প্রকার টীকা ও ভাষ্য বাহির হইতে থাকিবে, এরূপ অবস্থায় একজন যশোলোলুপ কবি-বালক কী করিবে? সে আপনার নাম প্রকাশ করিয়া কতকগুলি বিজ্ঞতাভিমানী বৃদ্ধের নিকট হইতে দুই-চারিটি ওজর করা ছাঁটাছোঁটা মুরুব্বিয়ানা আদর-বাক্য শুনিতে চাহিবে, না, যে নামেই হউক-না কেন, নিজের রচিত কবিতার অজস্র অবারিত প্রশংসাধ্বনি শুনিয়া তৃপ্ত হইতে চাহিবে? যে যশোলালসার দোহাই দিয়া তুমি “রাউলি-কবিতা’গুলি বালকের লেখা বলিয়া অবিশ্বাস করিতে চাহ, সেই যশোলালসাই যে তাহাকে আত্মনাম গোপন করিতে প্রবৃত্তি দিবে, তাহার কী ভাবিলে বলো? লোকে যখন “রাউলি-কবিতা’ বিষয়ে সাধ করিয়া প্রতারিত হইতে চাহিত, তখন কবি তাহাদের প্রতারণা করিতেন। ব্যারেট নামক একজন লেখক ব্রিস্টলের বিস্তারিত ইতিহাস লিখিতেছিলেন। তাঁহার বন্ধুবর্গ সেই ইতিহাসের উপকরণ সংগ্রহে ব্যস্ত ছিলেন। একদিন ক্যাট্‌কট নামক তাঁহার এক বন্ধু আসিয়া তাঁহাকে সংবাদ দিলেন যে, চ্যাটার্টন নামক এক বালক অনুসন্ধান করিতে করিতে অনেকগুলি ব্রিস্টলের প্রাচীন কবিতা ও বিবরণ পাইয়াছে; ব্যারেট চ্যাটার্টনের নিকট হইতে তাঁহার ইতিহাসের উপকরণ সংগ্রহ করিতে লাগিলেন। বালকের ভাণ্ডার অজস্র, তুমি যে বিষয় জানিতে চাও, সেই বিষয়েই সে একটা-না-একটা প্রাচীন ভাষায় লিখিত প্রমাণ আনিতে পারে– ঐতিহাসিকের তাঁহাকে সন্দেহ করিবার বড়ো একটা কারণ ছিল না। চ্যাটার্টন তাঁহাকে অনর্গল প্রমাণ রচনা করিয়া আনিয়া দিতে লাগিলেন, তাঁহার ইতিহাস লেখাও অবাধে অগ্রসর হইতে লাগিল। তিনি গর্বের সহিত লিখিলেন– “এই নগরের (ব্রিস্টল) পুরাতত্ত্ব অনুসন্ধান করিবার উপযোগী প্রাচীন পুস্তকাদি আমি যেরূপে পাইয়াছি, এমন আর কাহারও ভাগ্যে কখনো ঘটে নাই।’ তাহা সত্য বটে! ব্যারেট একবার “রাউলি-রচিত’ “হেস্টিংসের যুদ্ধ’ নামক এক অসম্পূর্ণ কবিতা আনিবার জন্য চ্যাটার্টনকে পীড়াপীড়ি করিতে আরম্ভ করেন, চ্যাটার্টন সমস্তটা লিখিয়া উঠিতে পারেন নাই; অনেক পীড়াপীড়ির পর তিনি স্বীকার করিলেন যে, সে কবিতাটি তাঁহার নিজের লেখা। সহস্র প্রমাণ পাইলেও ব্যারেট তখন বিশ্বাস করিতে চাহিবেন কেন? তাঁহার ইতিহাসের অমন সুন্দর উপকরণগুলি এক কথায় হাতছাড়া করিতে ইচ্ছা হইবে কেন? তিনি প্রতারিত হইতে চাহিলেন, চ্যাটার্টন তাঁহাকে প্রতারণা করিলেন। চ্যাটার্টন তাঁহার অসম্পূর্ণ “হেস্টিংসের যুদ্ধ’ সম্পূর্ণ করিয়া আনিয়া দিলেন।

ভারতী, আষাঢ়, ১২৮৬

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *