1 of 2

চৌরঙ্গীর জঙ্গলের রানী

চৌরঙ্গীর জঙ্গলের রানী 

১৬৯০ খ্রীষ্টাব্দে জোব চার্ণক যখন তৃতীয় বা শেষবারের মত সুতানটিতে এসে কলকাতা শহরের প্রাণপ্রতিষ্ঠা করেন, ঠিক সেই সময়েই চৌরঙ্গীর জঙ্গলে ছিল দশনামী সম্প্রদায়ভুক্ত সাধু জঙ্গলগিরি চৌরঙ্গী (যাঁর নাম থেকে জায়গাটার নাম হয়েছে চৌরঙ্গী) প্রতিষ্ঠিত মহাদেবের এক মন্দির ও আশ্রম। ওখানে এসে আশ্রয় নিয়েছিল বাঙলাদেশের এক রানী। স্বামী কর্তৃক বিতাড়িত হয়ে চৌরঙ্গীর ওই মহাদেবের আশ্রমে আশ্রয় নিয়েছিলেন রানী অজিতাসুন্দরী। রানী অজিতাসুন্দরী ছিলেন চেতুয়া-বরদার ইতিহাস প্রসিদ্ধ রাজা শোভা সিংহের প্রথমা রানী। চেতুয়া-বরদা ছিল মন্দারন সরকারের (বর্তমান মেদিনীপুর) পাঁচ নম্বর মহল। রাজা শোভা সিংহ ছিল অত্যন্ত চরিত্রহীন, লম্পট ও অত্যাচারী জমিদার। তারই সময়ে বরদার যদুপুর গ্রামে বাস করত রামেশ্বর ভট্টাচার্য, যিনি পরবর্তীকালে কর্ণগড়ের রাজা রাম সিংহের পৃষ্ঠপোষকতায় রচনা করেছিলেন ‘শিবায়ন’ কাব্য। 

যদুপুরে বরদা-বর্ধমান রাজপথের পাশে ছিল এক মস্ত দিঘি। একদিন রামেশ্বরের স্ত্রী সুমিত্রা যখন স্নান করতে যাচ্ছিল ওই দিঘিতে, তখন ওই পথে অশ্বারোহণে যাচ্ছিল রাজা শোভা সিংহ। সুমিত্রার রূপলাবণ্যে মুগ্ধ হয়ে শোভা সিংহ বলপূর্বক তুলে নেয় তাকে ঘোড়ার ওপর। সুমিত্রা প্রাণপণে আত্মরক্ষার প্রয়াস করে। তাতে বিব্রত হয়ে শোভা সিংহ তাকে ফেলে দিয়ে যায় পথের ধারে। শোভা সিংহের এই কুকীর্তির কথা তরুণ কবি রামেশ্বরের কানে গিয়ে পৌঁছায়। রামেশ্বর ছিল তান্ত্রিক সাধক। তাঁর বাসভবনের অনতিদূরেই ছিল তাঁর তন্ত্রসাধনার স্থান পঞ্চমুণ্ডির আসন। সেখানে আরম্ভ করে রামেশ্বর এক মারণযজ্ঞ, যার আহুতি সম্পন্ন হলে অনিবার্য হবে শোভা সিংহের মৃত্যু। শোভা সিংহ নিদারুণভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ে। মুখে মুখে প্রচারিত হল সুমিত্রার ওপর শোভা সিংহের অত্যাচার ও রামেশ্বর কর্তৃক মারণযজ্ঞ আরম্ভের কথা। কথাটা শুনে বিচলিত হয়ে উঠল শোভা সিংহের প্রথমা রানী অজিতাসুন্দরী। ছুটে গেল সে রামেশ্বরের পঞ্চমুণ্ডির আসনের দিকে। লুটিয়ে পড়ল রামেশ্বরের পদপ্রান্তে। অনুনয় করে বলল—”দাও ঠাকুর আমার স্বামীর প্রাণ, অপরাধ তার মার্জনা কর, এমন কুৎসিত কাজ ভবিষ্যতে সে আর কখনও করবে না।” পতিপ্রাণা নারীর করুণ ক্রন্দন বিগলিত করল রামেশ্বরের রুষ্ট মনকে। ‘ক্ষণে রুষ্ট, ক্ষণে তুষ্ট’ রামেশ্বর বলল, ভবিষ্যতে তার স্বামী যেন কোন নারীর ওপর বলপ্রয়োগ না করে। অজিতাসুন্দরী স্বীকার করল রামেশ্বরের কাছে যে ভবিষ্যতে তার স্বামী এরূপ কুকার্য আর কখনও করবে না। 

রামেশ্বরের অভয়দানে আশ্বস্ত হয়ে রানী ফিরে এল রাজপ্রাসাদে। শোভা সিংহ শীঘ্রই নিরাময় হয়ে উঠল। কিন্তু প্রতাপশালী শোভা সিংহ যখন শুনল যে রানী অজিতাসুন্দরী একজন সামান্য ব্রাহ্মণের পায়ে পড়ে তার প্রাণ ভিক্ষা করে নিয়ে এসেছে, তখন রুষ্ট হয়ে সে রানীকে বিতাড়িত করে দিল রাজপ্রাসাদ থেকে। বিতাড়িত হয়ে রানী আশ্রয় নিল চৌরঙ্গীর জঙ্গলে চৌরঙ্গীশ্বরের মন্দিরে। এ সবই ১৬৯০ খ্রীষ্টাব্দের ঘটনা। 

এর প্রতিক্রিয়া গিয়ে পড়ল বর্ধমানের রাজবাটীতে। এই ঘটনার কিছু আগে শোভা সিংহ প্রস্তাব করে পাঠিয়েছিল বর্ধমানের রাজা কৃষ্ণরামের কাছে, যে সে তার মেয়ে সত্যবতীর পাণিপ্রার্থী হতে চায়। কৃষ্ণরাম সম্মতি দিয়েছিল। কিন্তু অজিতাসুন্দরীকে বিতাড়িত করবার খবর যখন বর্ধমানে গিয়ে পৌঁছাল, তখন বেঁকে দাঁড়াল সত্যবতী ও তার পিতা কৃষ্ণরাম। শোভা সিংহকে কন্যাদান করতে অসম্মত হল কৃষ্ণরাম। বাগদত্তা কন্যাকে কৃষ্ণরাম শোভা সিংহের হাতে তুলে দিতে অস্বীকৃত হয়েছে, একথা যখন লোকমুখে প্রচারিত হল, শোভা সিংহ তখন নিজেকে অপমানিত বোধ করে, কৃষ্ণরামের ওপর এর প্রতিহিংসা নেবার সঙ্কল্প করল। কৃষ্ণরামকে শিক্ষা দেবার জন্য সে বর্ধমান আক্রমণ করবার মতলব করল। যদিও তখন মোগল আধিপত্য দুর্বল হয়ে পড়েছিল, তা হলেও সে একা এটা করতে সাহস করল না। সাহায্য চেয়ে পাঠাল ওড়িশার আফগান সরদার রহিম খানের কাছে। 

রহিম খান ও শোভা সিংহের সম্মিলিত সৈন্যবাহিনী ১৬৯৫ খ্রীষ্টাব্দের শেষদিকে বর্ধমান অভিমুখে যাত্রা করে। কৃষ্ণরাম আশঙ্কিত হয়ে নিজ পুত্র জগত্রায়কে স্ত্রী-বেশে শিবিকা করে নবদ্বীপাধিপতির কাছে পাঠিয়ে দেয়। যুদ্ধে কৃষ্ণরাম নিহত হয়। কৃষ্ণরামের পরিবারের মেয়েরা জহর-ব্রত অবলম্বন করে আগুনে ঝাঁপ দেয়। কেবল সত্যবতী ধৃত ও বন্দী হয়। ওদিকে জগৎত্রায় নবদ্বীপ থেকে ঢাকায় পালিয়ে গিয়ে নবাবের কাছে নালিশ করে। কিন্তু হুজুর তখন ‘গুলিস্তান’ পড়তেই মশগুল। জগৎত্রায়ের নালিশ তার কানেই গেল না। সেই সুযোগে শোভা সিংহের সৈন্যদল চতুর্দিকে তাণ্ডবলীলা চালাতে লাগল। এই সময় শোভা সিংহের দলের সঙ্গে যোগ দিল চন্দ্রকোনার জমিদার রঘুনাথ সিংহ। চতুর্দিকেই তারা লুণ্ঠন ও অত্যাচার চালাল। হুগলিকে কেন্দ্র করে ভাগীরথীর পশ্চিম তীরবর্তী ১৮০ মাইল ব্যাপী অঞ্চলে শোভা সিংহ নিজ আধিপত্য স্থাপন করে নৌবাণিজ্যের শুল্ক আদায় করতে লাগল। ইংরেজ, ফরাসী, ওলন্দাজ সকলেই ভয় পেয়ে গেল। বিদ্রোহীদের আক্রমণ থেকে নিজেদের বাঁচাবার জন্য তারা যথাক্রমে কলকাতা, চন্দননগর ও চুঁচুড়ায় দুর্গ নির্মাণ করবার প্রার্থনা নবাবের কাছে পেশ করল। বিদ্রোহ দমনেও তারা নবাবকে সাহায্য করল। নবাব তাদের প্রার্থনা মঞ্জুর করল। এর ফলেই ইংরেজরা কলকাতায় দুর্গ নির্মাণের অনুমতি পায়। 

ওদিকে শোভা সিংহ কৃষ্ণরামের মেয়ে সত্যবতীকে বন্দী করে রেখেছিল। ভাগীরথীর পশ্চিম অঞ্চলে নিজ আধিপত্য স্থাপনের পর শোভা সিংহ প্রণয়প্রার্থী হয়ে সত্যবতীর কাছে যায়। সত্যবতী বসনের ভিতর লুকিয়ে রেখেছিল একখানা ছুরিকা। পিতৃহত্যার প্রতিশোধ স্বরূপ সে অতর্কিতে শোভা সিংহকে ছুরিকাঘাত করে নিহত করে। 

শোভা সিংহের মৃত্যুসংবাদ যখন যদুপুরে গিয়ে পৌঁছাল, রামেশ্বর তখন উল্লসিত হয়ে এক কবিতা লিখে ফেলল। কবিতার মর্ম হচ্ছে নারীর প্রতি অত্যাচারীর এরূপই স্বাভাবিক পরিণতি ঘটে, যেমন ঘটেছিল রাবণ ও দুর্যোধনের। লোকের মুখে মুখে এই কবিতা আবৃত্তি হতে লাগল। চটে গেল শোভা সিংহের স্থলাভিষিক্ত তার ভাই হেমন্ত সিংহ। বিতাড়িত করে দিল রামেশ্বরকে যদুপুর থেকে। রামেশ্বর আশ্রয় পেল কর্ণগড়ের রাজা রাম সিংহের নিকট। 

যদিও রানী অজিতাসুন্দরীর বিতাড়ন ইতিহাসের ওপর সুদূরপ্রসারী ছাপ রেখে গেছে, তথাপি চৌরঙ্গীর জঙ্গলে রানী অজিতাসুন্দরীর শেষ পর্যন্ত কি হল, সে সম্বন্ধে ইতিহাস নীরব। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *