ইংরেজি সাহিত্য ও নারীবাদ: বিতর্ক ও বিশ্লেষণ – স্নেহা কর চৌধুরী
এই প্রবন্ধের প্রতিপাদ্য বিষয় হল ইংরেজি সাহিত্যে নারীর উপস্থাপনা। কীভাবে নানান সামাজিক বাধা উত্তীর্ণ করে বিভিন্ন মহিলা কবি, ঔপন্যাসিক ও নাট্যবিদ সাহিত্যের ইতিহাসের মূল ধারায় জায়গা করে নিয়েছেন এবং ইংরেজি বা ব্রিটিশ নারীসাহিত্যের এই উন্মোচন কীভাবে নারীবাদের দর্শনকে সাহায্য করেছে তা আলোচিত হয়েছে এখানে— নারীবাদ ও সাহিত্যের ওতপ্রোত সম্পর্ক। এই সম্পর্ককে বুঝতে গেলে ব্রিটিশ সমাজে নারীর স্থান ও অধিকার কীভাবে বিবর্তিত হল তা বোঝা দরকার। এই প্রবন্ধে ব্রিটেনে নারীসাহিত্যের বিবর্তন ও নারী চরিত্র উপস্থাপনার রাজনীতি সম্পর্ক আলোচনা করা হবে। কীভাবে নারীবাদ ইংরেজি সাহিত্যকে পাঠ করতে সাহায্য করেছে বা কীভাবে সাহিত্যের নারীবাদী পাঠ সম্ভব তা বোঝার প্রয়াসও থাকবে এই প্রবন্ধে। নারীবাদের এই বিভিন্ন ধরনের পাঠগুলি ইংরেজি সাহিত্যে নারীর স্থান, নারী চরিত্রের মূল্যায়ন, এবং নারীকে কেন্দ্র করে সাহিত্যে যে উপস্থাপনার রাজনীতি তা স্পষ্ট করে তোলে।
ব্রিটিশ সাহিত্য বলতে আমরা এখন যা বুঝি, তা মোটামুটিভাবে প্রাচীন সাহিত্য হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে অ্যাংলো-স্যাক্সন যুগে। ইংরেজি অ্যাংলো-স্যাক্সন সাহিত্য মূলত মহাকাব্য ও বিভিন্ন ধারার কবিতাকে প্রাধান্য দেয়। যেমন বেউলফ্ হল এই সময়ের সবথেকে মূল্যবান গ্রন্থ— এই মহাকাব্যে যুদ্ধ, সাম্রাজ্যবিস্তার, মৃত্যু ও দেশের মানুষের জন্য বীর যোদ্ধা বেউলফের লড়াই বিস্তারিতভাবে বর্ণিত আছে। তা ছাড়া যুদ্ধ, সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং সর্বোপরি, ঈশ্বরের প্রতি মানুষের ভক্তিকে কেন্দ্র করে বহু সাহিত্য রচিত হয়। রাজা অ্যালফ্রেড সিংহাসনে আরোহণ করার পর কবিতা ছাড়াও ইংরেজি গদ্যের বিকাশ ঘটান। এই গদ্য মূলত বাইবেল অনুবাদ ও বিভিন্ন গ্রিক সাহিত্যকর্মকে অনুসরণ করেই গড়ে উঠেছিল। এটি বলাই বাহুল্য যে, এইসমস্ত সাহিত্যরচনায় সেই যুগের কোনও নারীর কোনওই ভূমিকা ছিল না। অ্যাংলো-স্যাক্সন যুগে কোনও নারীসাহিত্য বিকশিত হয়নি। কারণ এই যুগে ব্রিটিশ সমাজে মহিলাদের অবস্থান খুবই দুর্বল, সীমিত ও সম্পূর্ণ পুরুষনির্ভর ছিল। মহিলাদের বিদ্যার্জন করা বা উপার্জন করার অনুমতি ছিল না। যেহেতু তখন দেশকে সংগঠিত করতে বার বার ভাইকিংদের আক্রমণ থেকে রক্ষা করার জন্য যুদ্ধ হত, তাই এই ব্যাপারে নারীকে তেমন প্রাধান্য দেওয়া হয়নি। তার স্থান যোদ্ধার মা, বোন, স্ত্রী বা মেয়ে হিসাবেই চিহ্নিত ছিল। প্রাচীন গ্রিক সাহিত্যে আমরা স্যাফোর মতো বলিষ্ঠ মহিলা কবিকে পেলেও, ইংরেজি সাহিত্যে কোনও মহিলা লেখককেই পাওয়া যায় না। পুরুষ সাহিত্যিক বা কবিরাও তাই সমাজের মূলধারাকে অনুসরণ করে তাদের রচনায় নারীকে প্রাধান্য দেননি। আমরা প্রাচীন ইংরেজি সাহিত্যে বীর যোদ্ধার উপাখ্যান বেউলফ-এ মূলত পুরুষদেরই উল্লেখযোগ্য অবদান দেখি, আর গ্রেন্ডেল নামক দৈত্যের মা হল এই গ্রন্থের একমাত্র মহিলা চরিত্র। এই মহিলাকে ভয়ংকর হিসাবেই চিত্রিত করা হয়। কারণ সে রাক্ষসী এবং দুর্বৃত্ত গ্রেনডেলের জননী। তাই এইরকম ভয়াল চরিত্র কখনওই নারীর ভাবমূর্তি সঠিকভাবে ফুটিয়ে তোলে না, বরং এক মহিলা রাক্ষসের বীভৎসতাকে প্রকট করে। এবং এই রাক্ষসী ও তার ছেলেকে নিধন করে পরাক্রমী ও সাহসী পুরুষ বেউলফ কালজয়ী নায়ক তথা অপ্রতিরোধ্য পুরুষ যোদ্ধা হিসাবে প্রতিষ্ঠা পায়। অর্থাৎ প্রাচীন ইংরেজি সমাজ ও সাহিত্যে মেয়েদের স্থান খুবই কম ও তারা নানান উপেক্ষার পাত্রী। তাই, যদি এই যুগের ইংরেজি সাহিত্যের ইতিহাসে পুরুষ লেখকদের আধিপত্যের ধারা অনুসরণ করি, তাহলে আমরা মহিলা লেখকদের তেমন একটা উল্লেখ বা উপস্থিতি টের পাই না। মধ্যযুগেও এই ধারা বজায় থাকে।
প্রাচীন ও মধ্যযুগের পাশ্চাত্যজীবনে পুরুষতন্ত্রের সক্রিয়তা এত বেশি ছিল যে, তখন সমাজে নারী শুধুমাত্র পুরুষের মা, বোন, স্ত্রী বা রক্ষিতা হিসাবেই পরিচিত ছিলেন। তাদের শিক্ষাদান বা সামাজিক স্বাধীনতা বা স্বাধিকার দেওয়ার বিষয়ে কোনও উদ্যোগ ছিল না, বরঞ্চ মেয়েদের শুধু গৃহবন্দি হয়ে থাকাই শ্রেয় ছিল। তাদের কোনও নিজস্বতা বা স্বাতন্ত্র্য ছিল না। আমরা যদি এই বিষয়ে নারীবাদী সমালোচক গারডা লারনার-এর বই দ্য ক্রিয়েশন অফ পেট্রিয়ার্কি পড়ি তাহলে জানতে পারি যে উনি কীভাবে পেট্রিয়ার্কি বা পুরুষতন্ত্রের গোড়াপত্তনের ইতিহাস আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন।১ লারনারের মতে সমাজে সব প্রতিষ্ঠানের মতো পুরুষতন্ত্রও একটি ঐতিহাসিক ধারা— যার যেমন শুরুও আছে তেমন শেষও আছে। পুরুষতন্ত্র সমাজে ধীরে ধীরে বিস্তারিত হয়— যেমন আদিম আদিবাসী সমাজে পুরুষ ও নারীর মধ্যে কাজের বণ্টন করা হয় এবং মহিলাবর্গকে গৃহকর্মে আবদ্ধ রাখা হয়। এই পরিস্থিতির ফলে মহিলারা গৃহসর্বস্ব হয়ে পড়েন এবং এই ধারাই পুরুষকে বলশালী যোদ্ধা বা শিকারি হিসাবে প্রতিষ্ঠা করে। ফলে নারী পুরুষের অধীনস্থ হয়ে পড়ে। সে পুরুষের আধিপত্য মেনে নেয় এবং সমাজজীবনে লিঙ্গবৈষম্য ক্রমশ দানা বাঁধতে থাকে। লারনার মনে করেন, সচেতন হলেই লিঙ্গভেদ সমাজ থেকে ধীরে ধীরে লুপ্ত হবে এবং পুরুষতন্ত্রের পতন ঘটবে। তিনি বলেন লোকসাহিত্য ও কথাসাহিত্যে নারী ও পুরুষের সমান ভূমিকা ছিল। তবে ধীরে ধীরে সংগঠিতভাবে নারী-পুরুষের মধ্যেকার সম্পর্কের অসাম্যকে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। তাই তিনি লেখেন:
নারী সমাজসৃষ্টির ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় ও কেন্দ্রস্থানীয়। তারা সবসময়ই ইতিহাসের ধারক ও বাহক। নারী ইতিহাস সৃষ্টি করেছে, অথচ তাদের নিজস্ব ইতিহাসকে জানা ও তার মূল্যায়ন করা থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। মহিলাদের সংগঠিতভাবে চিহ্ন সৃষ্টি, দর্শন, বিজ্ঞান ও আইন সৃষ্টি করা থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে।২
লারনার সমাজে ও ইতিহাসে নারীর গুরুত্ব সম্পর্কে আমাদের অবগত করলেও বুঝিয়ে দেন যে নারীকে ধারাবাহিকভাবে পিতৃতন্ত্রের মাধ্যমে দুর্বল ও পরনির্ভর করে তোলার এক প্রবল প্রক্রিয়াও চালু ছিল। লারনারের এই ইতিহাসধর্মী বিশ্লেষণ, নারীবাদের দর্শনে অত্যন্ত প্রয়োজনীয় সমাজসত্য আমাদের সামনে নিয়ে আসে। মধ্য যুগের ইংরেজি সাহিত্যের ধারা অনুধাবন করলে দেখা যায় যে বিভিন্ন কাব্য ও নাট্যে নারী চরিত্রকে প্রাধান্য দেওয়া হলেও, কোনও মহিলা লেখকের আবির্ভাব তেমনভাবে ঘটেনি। এই যুগের ধর্মনির্ভর সাহিত্য নানানভাবে ভগবান ও ভক্তের সম্পর্কের আলোচনা করে এবং ঈশ্বরবাদকে প্রাধান্য দেয়। সেই যুগে রাজা আর্থার ও তার বীর সামন্ত যোদ্ধাদের কাহিনিও সারা ইউরোপ জুড়ে জনপ্রিয়তা অর্জন করে। ব্রিটিশ রাজা আর্থারের জীবন ও উত্থানকাহিনি মধ্যযুগের চারণকবিদের কাব্যের প্রধান বিষয় হয়ে ওঠে। এই সাহিত্যে আমরা রাজার স্ত্রী গিনিভার ও স্যার ল্যান্সলটের প্রেমিকা ইলেনের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা দেখতে পাই। তাদের ভালবাসা, সৌন্দর্য, ব্যক্তিত্ব যেকোনও পাঠককেই মুগ্ধ করে। কিন্তু বিশেষ চরিত্র হলেও এরা কিন্তু নারীবাদী চরিত্র নয়— রাজার স্ত্রী বা সামন্তপ্রভুদের প্রেমিকা ও বাগ্দত্তা হিসাবেই এদের জীবন বিবর্তিত হয়। পুরুষকে উপেক্ষা করে তারা নিজের কোনও অস্তিত্ব প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করে না। তাদের আবেগপ্রবণ ও বলিষ্ঠ উপস্থিতি আমাদের আকর্ষিত করে, তাদের মর্মস্পর্শী কাহিনি আমাদের মনকে নাড়া দেয় মাত্র। মধ্যযুগের প্রেম ও প্রকৃতি বিষয়ক কবিতায় নারী ছিল পুরুষের মানসকন্যা ও কামনার পাত্র।
আমরা যদি অন্য দিকে, ধর্মনির্ভর মধ্যযুগীয় সাহিত্যচর্চাকে ব্যাখ্যা করি, তাহলে লক্ষণীয় যে, এই ধরনের কবিতাগুচ্ছ, নাটক কিংবা প্রবন্ধে নারীর অস্তিত্ব খুবই ম্রিয়মাণ ও দুর্বল । বরঞ্চ আমরা যদি মধ্যযুগের ব্রিটিশ কবি জিয়োফ্রে চসারের কালজয়ী সৃষ্টি দ্য ক্যান্টারবেরি টেলস্ ৩ পড়ি, আমরা বিভিন্ন ধরনের মহিলা চরিত্র দেখতে পাই— যেমন বহুবিবাহিত ওয়াইফ অফ বাথ কিংবা ধর্মীয় নারী প্রায়োরেস। এই দুই চরিত্রের গল্পের মাধ্যমে চসার আমাদের সামনে সমাজে নারীর বহুধর্মী অবস্থানকে তুলে ধরেছেন। যেমন ওয়াইফ অফ বাথ অনেক পুরুষের সঙ্গী হয়েছেন, বহুবার বিবাহে আবদ্ধ হয়েছেন এবং বহুবার বিচ্ছেদও হয়েছে তার স্বামীদের সঙ্গে। এই মহিলার যৌনতা, কৌতুকপ্রিয়তা ও নিজস্বতা খুবই ব্যতিক্রমী। আবার আরেকটি গল্পে প্রায়োরেস চরিত্রটি তার ধর্ম, যৌবন ও সৌন্দর্য নিয়ে দ্বিধাবিভক্ত— আসলে চসার নারীর নিজস্বতার উন্মোচনের কিছু দৃষ্টান্ত আমাদের সমক্ষে আনতে চেয়েছেন। চসারের অন্যান্য কাব্যগ্রন্থতেও আমরা গুরুত্বপূর্ণ নারী চরিত্রের উপস্থিতি লক্ষ করি কারণ এই ব্রিটিশ কবি সমাজের বিভিন্ন আঙ্গিক আমাদের সামনে নিয়ে আসতে চাইতেন এবং নারীর সামাজিক অবস্থান, নারী-পুরুষের সম্পর্কের চাপান-উতোর ও নারীর ব্যক্তিস্বাধীনতার প্রকাশ তাঁকে আকর্ষিত করত। তবে তাঁর রচিত সাহিত্যে নারীকে কোনওভাবেই সংগ্রামী ও আত্মমর্যাদাসম্পন্ন নারীবাদী হিসাবে তুলে ধরা হয়নি, বরং তার স্বেচ্ছাচারিতাকে অনেকসময়ই ব্যঙ্গ করা হয়েছে। মধ্যযুগের সাহিত্যে আমরা অ্যাংলো-স্যাক্সন বা অ্যাংলো-নর্মান যুগের থেকে নারীর উপস্থিতি বেশি পেলেও এই যুগে নারীমুক্তি নিয়ে কোনও গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, চসারের মতো প্রতিষ্ঠিত পুরুষ লেখকও নারীদের কামনার বস্তু হিসাবেই দেখিয়েছেন এবং মেয়েদের যৌনতা ও যৌনচাহিদা প্রসঙ্গে কৌতুক বা ব্যঙ্গের আশ্রয় নিয়েছেন।
ইংরেজি সাহিত্যে যখন রেনেসাঁ বা নবজাগরণ শুরু হয় তখন কিছু বিশেষ অর্থে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে পরিবর্তনের হাওয়া আসে। নবযুগের ‘হিউম্যানিজ্ম’৪ মধ্যযুগের অচলায়তন দূর করে নতুনভাবে সমাজকে আলোকিত করে। এই প্রেক্ষিতে আমরা রাজপরিবারের অন্তর্গত কিছু লেখিকার, মূলত মহিলা কবির সন্ধান পাই। যেমন ইংল্যান্ডের স্বর্ণযুগের রানি এলিজাবেথের লেখা বা রাজবংশের সঙ্গে যুক্ত ইসাবেলা উইটনি ও ক্যাথরিন ফিলিপস-এর কবিতা। মূলত কবিতাকে মাধ্যম করে তাঁরা নারী-পুরুষের প্রেম, বিরহ ও বেদনার কথা ব্যক্ত করেন। স্বর্ণযুগের কবি স্যার ফিলিপ সিডনি ও স্যার ইডমন্ড স্পেনসার-এর অনুকরণে তাঁরা প্রেম ও প্রকৃতি বিষয়ক কবিতা লিখতে শুরু করেন, তাই বিখ্যাত মার্কিন নারীবিদ ইলেন সোঅল্টার-এর ধারণা যে ওই রেনেসাঁ যুগের সামান্য নারীসাহিত্য যেমন এক দিকে নারীপ্রগতি ও নারীশিক্ষার সূর্যোদয়, তেমনি এঁদের মধ্যে যে পুরুষের লেখা ও ভাব অনুকরণ করার প্রবণতা ছিল, তা তাঁদের মৌলিকতার পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। বেশিরভাগ রচনাই তাই কিছুটা একঘেয়েমি সৃষ্টি করে। পুরুষের সাহিত্যধারা বা মূল্যবোধকে অনুসরণ করে এই নারীসাহিত্য ‘ফেমিনিন’ বা মেয়েলি ধারা হিসাবে চিহ্নিত হয়।৫ কিন্তু পাশ্চাত্য সভ্যতায় নারীপ্রগতির ইতিহাসে ও বিভিন্ন ভাষার সাহিত্যের ইতিহাসে রাজবংশীয় নারীদের শিক্ষা ও সৃষ্টিশীলতার নিদর্শন খুবই গুরত্বপূর্ণ। পুরুষতন্ত্রকে প্রকাশ্যে সমালোচনা না করেও, এই রেনেসাঁ নারীসাহিত্য সমাজে নারীশিক্ষার দিশারি; পুরুষের সমান বিদ্যা বা সাহিত্যসৃষ্টির অধিকার অর্জন করে এঁরা প্রাচীন লেস্বসের (গ্রিস) নারী কবি স্যাফোর উত্তরাধিকারিণী; স্যাফো যেমন প্রাচীন গ্রিক সাহিত্যের অন্যতম বিরল মহিলা কবি তেমনই রেনেসাঁ-ইউরোপে এই মহিলা কবিরাও ছিলেন বিরল ও ব্যতিক্রমী। পুরুষের লেখা অনুকরণ করলেও তাঁদের লেখনী একভাবে নারীর সাহিত্যচর্চার ক্ষমতাকেও প্রতিষ্ঠা করে। রেনেসাঁ বিশারদ জোয়ান কেলির মতে ষোড়শ শতাব্দীতে পুরুষের নবজাগরণ হলেও তার পাশাপাশি নারীর নবজাগরণ হয়নি। কারণ নারীসমাজ তখন স্বাধীনতা ও শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত।৬ দার্শনিকরাও মূলত পুরুষ ছিলেন, মহিলা ছিলেন না; বরঞ্চ সাহিত্যের আঙিনায় কিছু রাজবংশীয় মহিলাদের পদচারণা লক্ষণীয়। এই নারীসাহিত্যের আবির্ভাবের ফলেই আরও অনেক মহিলারা লেখা শুরু করেন। তবে এই সুবিধা শুধুমাত্র কিছু শহুরে ও প্রতিষ্ঠিত বংশের মহিলারাই পান, সাধারণ বর্গের নারী বহু বছর পরও এই অধিকার সহজে পাননি।
নারীশিক্ষা, নারীজাগরণ ও সমাজের মহিলাদের পুরুষের সমান অধিকার অর্জনের লড়াইয়ের এক কিংবদন্তি মহিলা কাণ্ডারি হলেন ব্রিটিশ শিক্ষাবিদ মেরি উলস্টোনক্রাফ্ট। যখন সারা ইউরোপ জুড়ে ফরাসি বিপ্লবের দাবানল ছড়িয়ে পড়ে, তখন থমাস পেন রচিত রাইটস অফ ম্যান মনীষীদের উপর বিশেষ প্রভাব বিস্তার করে। এই বইয়ের উপজীব্য বিষয় ছিল সাধারণ মানুষের মুক্তি, সমতা ও সৌভ্রাতৃত্ববোধ, তবে এই পুরুষ লেখক পুরুষের প্রাচীন সামন্ততান্ত্রিক সমাজের থেকে মুক্তির প্রতি জোর দেন। নারীবর্গের কথা আলাদাভাবে উল্লেখ করা হয়নি। মেরি উলস্টোনক্রাফ্ট এই কথাটি তুলে ধরেন তার বই আ ভিনডিকেশান অফ দ্য রাইটস অফ ওম্যান বইটিতে। তিনি বলেন যে, যেমন ফরাসি বিপ্লবের দিক্পাল দার্শনিকরা, মূলত রুশো, পেন ও ভলতেয়ার, রাজার প্রহসন থেকে সাধারণ মানুষের মুক্তির পক্ষে ছিলেন, তেমনই তিনি পুরুষের তৈরি পুরুষতন্ত্রের আগ্রাসন ও প্রহসন থেকে নারীর মুক্তি দাবি করেন। তিনি নারীশিক্ষা, নারীর সামাজিক, আর্থিক ও আইনি অধিকারের দাবি জানিয়ে এই বইটি লেখেন। তাঁর লেখা অনুযায়ী:
এটা ভাবার কোনও কারণ নেই যে আমি সৃষ্টির ছন্দকে উলটে দিতে চাই, আমি আগেই মেনে নিয়েছি যে তাদের শরীরের গঠনের জন্য পুরুষরা ঈশ্বরের আশীর্বাদে বেশি অর্জন করতে সক্ষম। কিন্তু আমি সামগ্রিক লিঙ্গের কথা বলতে চাই, কোনও যুক্তিতেই এটা মেনে নেওয়া যায় না যে তাদের গুণ তাদের স্বভাব অনুযায়ী পরিবর্তিত হবে। যদি গুণের একটাই সংজ্ঞা হয় তাহলে নারীরও সেই ঈশ্বরদত্ত গুণ থাকতে পারে।৭
নারীমুক্তির পক্ষে বলার জন্য তাঁকে অনেক সমালোচনার সম্মুখীন হতে হয়, কারণ সমাজের তথাকথিত শিক্ষিত পুরুষরাও নারীমুক্তির ব্যাপারে যথেষ্ট উদাসীন ছিলেন। তাঁদের মধ্যে অনেকেই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মহিলাদের মানসিক ও শারীরিকভাবে দুর্বল ও অক্ষম হিসাবে চিহ্নিত করে আত্মতৃপ্তি লাভ করতেন। তাই এই পুরুষবর্গই উলস্টোনক্রাফ্টকে ‘হায়না ইন পেটিকোটস’ বা ‘সায়া পরা হায়না’ আখ্যা দেন। আসলে তাঁরা এই মহিলার একক বলিষ্ঠ প্রতিবাদ মেনে নিতে পারেননি, কিন্তু ব্রিটেন বা সমগ্র ইউরোপে নারীমুক্তির জন্য সংগ্রাম এই পরিস্থিতিতে অনিবার্য ছিল এবং কতিপয় পুরুষের কটাক্ষ এদের থামাতে পারেনি।
মেরি উলস্টোনক্রাফ্টকে আমরা ইউরোপে নারীপ্রগতির জননী আখ্যা দিতেই পারি, এবং তারই পদানুসরণ করে তখনকার কিছু শিক্ষিত নারী যেমন ফ্যানি বার্নে (১৭৫২-১৮৪০) বা জেন অস্টেন (১৭৭৫-১৮১৭) সাহিত্যচর্চায় মনোনিবেশ করেন। আসলে সপ্তদশ শতাব্দীতে নারীশিক্ষার সুযোগ সমাজে কিছুটা প্রসারিত হয় এবং মহিলারাও শিক্ষার সুযোগ পান। সামন্ততান্ত্রিক মধ্যযুগীয় সমাজ ব্যবস্থায় নারীশিক্ষা বা নারীর সার্বিক উন্নতি সমাজের বরেণ্য ব্যক্তিদের কাছে খুব-একটা গুরুত্ব পায়নি বরং তাঁরা মহিলাদের গৃহনির্ভর হওয়াই কাম্য মনে করেছেন। এই মর্মে যেসব বই খুব প্রচলিত ছিল সেগুলি হল মহিলাদের চালনা করার জন্য কনডাক্ট ম্যানুয়াল ৮ যার মাধ্যমে কীভাবে মেয়েরা যথার্থ মেয়ে, স্ত্রী ও মা হয়ে উঠতে পারে তারই বিশদ নির্দেশিকা দেওয়া হত। অতএব পুরুষতান্ত্রিক সমাজে ছেলেরা নিয়ম বানাতেও পারে আবার ভাঙতেও পারে, কিন্তু নারীর সেই অধিকার ছিল না। এই পরিস্থিতির পরিবর্তন হয় যখন সামন্ততান্ত্রিক সমাজের অগ্রগতি হয় এবং বুর্জোয়া মধ্যবিত্ত সমাজ প্রতিষ্ঠিত হয়। অষ্টাদশ তথা ঊনবিংশ শতাব্দীতে এই সামগ্রিক অগ্রগতি লক্ষণীয়। এর ফলে আমরা ইংরেজি সাহিত্যে জেন অস্টেনের মতো গুণী ও সফল মহিলা ঔপন্যাসিককে পাই।
জেন অস্টেনের প্রসঙ্গে আসার আগে আমাদের মনে রাখতে হবে ব্রিটিশ সাহিত্যে অষ্টাদশ শতকে গথিক ও ঐতিহাসিক উপন্যাস খুব জনপ্রিয় হয়। এইসব উপন্যাসগুলির লেখক শুধু মহিলারা ছিলেন না, এইসময় আমরা হরেস ওয়ালপুল ও ওয়ালটার স্কটের উপন্যাসও পাই। কিন্তু এটা লক্ষণীয় যে, তৎকালীন সমাজে নারীশিক্ষার অগ্রগতি হয় এবং রাজবংশীয় নারীরা ছাড়াও মধ্যবিত্ত প্রভাবশালী ব্যবসায়ী পরিবারের বাড়িতেও শিক্ষার ব্যবস্থা প্রচলিত হয়। এইসময় তাই এই গথিক ও ঐতিহাসিক উপন্যাসের বহু মহিলা পাঠক আমরা দেখতে পাই। ওয়ালপুল ও স্কটের লেখা বহু শিক্ষিত ইংরেজ নারীর মন জয় করে নেয় এবং বিপুল পরিমাণে বই ছাপা শুরু হয়। মহিলা পাঠকদের চাহিদাপূরণ করতে ঊনবিংশ শতকে নারীশিক্ষা আরও অগ্রসর হওয়ায় নারীর লেখা উপন্যাস ও নারী পাঠকের সংখ্যা অনেক বৃদ্ধি পায়। তবে এই অভ্যাসের সূচনা হয় অষ্টাদশ শতকের শেষে। এবং অস্টেন ছাড়াও, অ্যান র্যাডক্লিফ ও বার্নে-র উপন্যাসগুলিও বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করে। ফ্যানি বার্নের উপন্যাসগুলি কিছুটা হেনরি ফিলডিং কিছুটা স্যামুয়েল রিচার্ডসনের ‘এপিস্টোলারি’৯ লেখার মতো— যেমন ইভেলিনা (১৭৭৮)। এইসব লেখায় মেয়েদের মনের সূক্ষ্ম বিশ্লেষণ, সমাজে নারীর প্রতিকূলতা ও গভীর মনোজগতে তার প্রভাব— এই বিষয়গুলিকে প্রাধান্য দিয়ে রচিত। পুরুষের রচিত সাহিত্যের অনুকরণে লেখা তখন মহিলাদের কাছে খুবই প্রচলিত ছিল, কিন্তু এই ধরনের রচনায় অনেকসময়ই একাধিক বিশেষত্ব থাকত এবং সম্পূর্ণ মৌলিকতা বর্জিত হত না। তেমনি বার্নের লেখায় আমরা ইতিহাস ও নারীর যে সম্পর্কের বিশ্লেষণ পাই তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গির থেকে আলাদা ও মৌলিক ছিল এইসব লেখিকাদের রচিত চরিত্রের রূপ, তাই বার্নের লেখা নারী চরিত্র সামগ্রিকভাবে স্বতন্ত্র এবং আবেগপ্রবণ হয়েও বলিষ্ঠ ও দৃঢ়চেতা; আমরা অ্যান র্যাডক্লিফের লেখা রোমাঞ্চকর গথিক কাহিনিগুলিতেও প্রধান মহিলা চরিত্রের বুদ্ধি, বিবেচনা ও মানসিক দৃঢ়তাকে বার বার দেখতে পাই। আসলে এইসব কাহিনিগুলির মাধ্যমে ইংরেজি সাহিত্যে মহিলা লেখিকা, মহিলা পাঠক ও কেন্দ্রীয় চরিত্রে একজন নারীর আত্মপ্রকাশ ঘটে। যা পুরুষদের মহিলা চরিত্র নিয়ে লেখার থেকে আলাদা। জেন অস্টেন এই নারীকেন্দ্রিকতায় এক নতুন মাত্রা সংযোজন করেন এবং সেইজন্যই তার লেখা নিয়ে আলোচনা করা প্রয়োজনীয়। তবে এটা বলে রাখা ভাল যে স্বয়ং অস্টেনই কিন্তু বার্নে বা র্যাডক্লিফের উপন্যাসগুলিকে খুব উচ্চমানের সাহিত্য বলে গণ্য করেননি। তাই গথিক কাহিনিগুলির বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে তিনি সন্দিহান ছিলেন— এইসব উপন্যাসের ভৌতিক পটভূমিকা তাঁর তথাকথিত যুক্তিবাদী চিন্তাধারা মেনে নিতে পারেনি। তাঁর রচিত উপন্যাস নর্থঅ্যাঙ্গার অ্যাবি-তে তিনি গথিক উপন্যাসের ধারাকে উপহাস করেছেন। আসলে তাঁর যুক্তিবাদী মন কখনওই মহিলা লেখিকাদের গথিক/ভৌতিক এবং আবেগমিশ্রিত, অবাস্তব তথা অবিশ্বাস্য কাহিনিগুলিকে উন্নতমানের সাহিত্য হিসাবে গ্রহণ করতে পারেনি।
সাধারণ মধ্যবিত্ত বাড়ির মেয়ে অস্টেন তার উপন্যাসগুলিতে যে দক্ষতার সঙ্গে তৎকালীন সমাজের বিভিন্ন পারিবারিক সমস্যা তুলে ধরেছিলেন, তা যেকোনও পুরুষ লেখকের লেখার থেকে কম নয়। সংসারের বিভিন্ন কাজের ফাঁকে উনি উপন্যাসগুলি লেখেন; তাঁর প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল নারী-পুরুষের প্রেম ও সমাজজীবনে এই সম্পর্কের গ্রহণযোগ্যতা। আবার সামাজিক বিভিন্ন রীতি-নীতি যা শ্রেণিভেদ ও লিঙ্গবৈষম্যকে বজায় রাখে, সেইসব ক্ষেত্রগুলিকে অস্টেন উপহাসের মাধ্যমে আমাদের কাছে উপস্থাপনা করেছেন। তাঁর বিখ্যাত উপন্যাসগুলি হল প্রাইড অ্যান্ড প্রেজুডিস, ম্যানফিল্ড পার্ক, এমা, সেনস অ্যান্ড সেনসিবিলিটি এবং পারসুয়েশন। এই প্রত্যেকটি কাহিনিতে যেমন তার নায়িকা চরিত্ররা খুবই বলিষ্ঠ, তেমনই তাদের জীবন প্রেম ও বিবাহ দ্বারা আবদ্ধ। অস্টেন নিজে অবিবাহিত থাকলেও বিবাহকে নারীর লক্ষ্য হিসাবেই দেখাতেন, এবং তার সুখী ও সফল নায়িকারা বহু প্রতিকূলতাকে অতিক্রম করে তাদের কাঙ্ক্ষিত পুরুষকে স্বামী হিসাবে লাভ করেছে। অস্টেন মহিলা লেখিকা হিসাবে কিছুটা ব্যতিক্রমী হলেও তাঁর সৃষ্ট নারী চরিত্রগুলির প্রতিবাদ ও আক্রমণের ভাষা ছিল না বললেই চলে। তাই ইলেন সোঅল্টারের মতে, অস্টেনের মতো মহান উপন্যাসিকও সেই ষোড়শ শতাব্দীর ‘মেয়েলি’ সাহিত্যের ধারক ও বাহক, তাঁর লেখায় যতই উৎকৃষ্ট ভাষা ও ভাবের কারুকার্য থাক। তিনি উপন্যাস লিখেছিলেন তাঁর অগ্রজ বা সমসাময়িক পুরুষ লেখকদের পদচারণা অনুসরণ করে। তাই তাঁর উপন্যাস আমাদের স্যামুয়েল রিচার্ডসন ও হেনরি ফিল্ডিং-এর মতো পুরুষ লেখকদের সমগোত্রীয় কিছু রচনার কথা মনে করিয়ে দেয়। তবে যে দক্ষতার সঙ্গে অস্টেন অন্তঃপুরের কথা নিঁখুতভাবে লিখে গেছেন, তা মহিলা হিসাবে তাঁর বিচক্ষণতাকে প্রতিষ্ঠা করে। আসলে পুরুষসাহিত্যের ধারাকে অনুসরণ করলেও তিনি নারীজীবনের নানান খুঁটিনাটি উপন্যাসের উপজীব্য বিষয় হিসাবে তুলে ধরেন।
অস্টেন যেভাবে উপন্যাসকে একটি মহিলা লেখক, চরিত্র ও পাঠকের জগৎ হিসাবে প্রতিষ্ঠা করেন সেই ধারা ঊনবিংশ শতকে শিক্ষিত নারীদের মধ্যে এক বিশেষ আলোড়ন সৃষ্টি করে। ১৮০৭ সালে ইংল্যান্ডের রাজসিংহাসনে অভিষিক্ত হন রানি ভিক্টোরিয়া। তাঁর রাজত্বকালে নারীপ্রগতির উদ্দেশ্যে অনেক সামাজিক সংগ্রামের উদ্যোগ আমরা দেখি, যেমন মেয়েদের বিদ্যার্জন, আইনি অধিকার, কর্মের অধিকার ও আর্থিক স্বনির্ভরতা নিয়ে নানান আন্দোলন শুরু হয়। এই সামগ্রিক আলোড়ন সৃষ্টির অগ্রণী ভূমিকা নেন মার্গারেট ওলিফ্যান্ট, ফ্যান্সিস পাওয়ার কব, জর্জ এলিয়ট বা এলিজাবেথ গ্যাসকেল-এর মতো উচ্চশিক্ষিত মহিলারা, তাঁরা তাঁদের উপন্যাস ও সামাজিক নানান বক্তৃতা বা বইয়ের মাধ্যমে নারীমুক্তির জন্য সংগ্রাম করেন। নারীর অধিকারের জন্য সংগ্রাম এত বড় আকার ধারণা করে যে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট এই বিতর্ককে ‘দ্য ওম্যান কোয়েশ্চেন’ বলে আখ্যা দেয়। এই প্রেক্ষিতে কিছু পুরুষ মনীষীদেরও অগ্রণী ভূমিকা প্রশংসনীয়। এই উদারচেতা পুরুষ শিক্ষাবিদ, দার্শনিক বা ঔপন্যাসিকরা হলেন জন স্টুয়ার্ট মিল, জর্জ গিসিং এবং থমাস হার্ডি। আমরা যদি মিলের বিখ্যাত বই দ্য সাবজেকসন অফ উইমেন (১৮৬৯) দেখি তাহলে তাঁর বলিষ্ঠ বক্তব্যের মধ্যে নারীর প্রতি পুরুষদের প্রহসনের নিন্দা দেখতে পাই। তিনি বলেন:
যে নীতি এখন সমাজে দুই লিঙ্গের সম্পর্ক নিয়ন্ত্রণ করে— যেমন আইনি মতে এক লিঙ্গের কাছে অপরের নতিস্বীকার— সেটা সম্পূর্ণভাবে ভুল, আর এই কারণই মানুষের অগ্রগতির পথে এক প্রধান বাধা, আর এটি দূর করতে আমাদের সমতা নীতি অবলম্বন করতে হবে যাতে কোনও দক্ষতা বা অধিকার এক লিঙ্গের আধিপত্য ও অন্য লিঙ্গের অক্ষমতার কারণ না হয়।১০
সভ্যতার গোড়াপত্তন থেকেই প্রত্যেক মহিলাই কোনও-না-কোনও পুরুষের অধীন ছিলেন কারণ তিনি মূল্যবান, কিন্তু কায়িক শক্তিতে কম।১১
মিলের জোরালো বক্তব্য এই সত্যকেই প্রতিষ্ঠা করে যে সমাজে নারীবিদ্বেষ বা নারীকে অক্ষম ভাবা আসলে পুরুষকেই দুর্বল করে দেবে, কারণ সমাজের অর্ধেক ভাগ যদি পুরুষের সাহায্যে না আসে তাহলে একটি দেশ সৃষ্টি হবে না। ঊনবিংশ শতকে যখন সারা ইউরোপ জুড়ে দেশগঠনের জন্য সমস্ত রাষ্ট্রগুলি খুব সক্রিয় হয়, সেই অবস্থায় নারী দেশের জননী এবং জনসংখ্যার অর্ধেক ভাগ হিসাবে বেশ প্রাধান্য পেতে শুরু করে, এই শতকে নারীসাহিত্যের পরিমাণও বিপুলভাবে বৃদ্ধি পায়। প্রধানত উপন্যাস লেখায় মহিলা লেখকরা বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করেন এবং এলিজাবেথ গ্যাসকেল, জর্জ এলিয়ট কিংবা ব্রন্টে সিস্টারস-এর নাম বহু মানুষই জানতেন, যেহেতু এইসময় উপন্যাসের জনপ্রিয়তা তুঙ্গে ছিল, তাই মহিলা সাহিত্যিকরাও ব্যাপকভাবে উপন্যাস লেখা শুরু করেন। কখনও তাঁরা জেন অস্টেনের ধারায় পারিবারিক প্রেমের কাহিনি লেখা শুরু করেন। অথবা কখনও স্কট, ডিকেন্স ও থ্যাকোর-এর মতো ঐতিহাসিক ও সামাজিক সময়কে কেন্দ্র করে তাঁদের কাহিনি তৈরি করেন। মহিলা পাঠকরা এই লেখিকাদের সাহিত্যের বিষয়ে আলাদাভাবে উৎসাহ দেখান এবং এই সূত্রেই বহু সাধারণ মানের লেখাও বাজার ছেয়ে যায়। এই শতকে লেখা মহিলা ঔপন্যাসিকের সব গ্রন্থই খুব উচ্চমানের ছিল না, তবে বিপুল পরিমাণে মহিলাদের দ্বারা রচিত সাহিত্য কেউ অগ্রাহ্যও করতে পারে না। গ্যাসকেল, এলিয়ট কিংবা এই যুগের শেষ প্রান্তে ‘নিউ ওম্যান’ লেখিকা, যেমন জর্জ স্যান্ড, অলিভ স্ক্রাইনার ও সারা গ্রান্ট-এর মতো লেখিকাদের অবদান আমরা ইংরেজি সাহিত্যের ইতিহাসে অগ্রাহ্য করতে পারি না। এইসমস্ত বিখ্যাত মহিলা ঔপন্যাসিকদের সমাজ সম্পর্কে ধারণা, সাহিত্যচেতনা, রসবোধ এবং তাত্ত্বিক জ্ঞান অবশ্যই পুরুষ লেখকদের সমান। এই মহিলা সাহিত্যিকরা খুবই জ্ঞানী ও প্রতিভাবান ছিলেন এবং তাঁদের কাছ থেকে আমরা বহু ভাল উপন্যাস পাই। এই যুগের নারীসাহিত্যের এক বিশেষ অবদান ছিল এঁদের রচিত মেয়েদের বড় হওয়ার গল্প, যা ইউরোপীয় সাহিত্যে ‘বিলন্ডুংসরোমা’ হিসাবে বিখ্যাত, আমরা শার্লট ব্রন্টের উপন্যাস জেন আয়ার এবং জর্জ এলিয়েটের কাহিনি দ্য মিল অন দ্য ফ্লস (১৮৬০) পড়লে মেয়েদের বড় হওয়ার নানান পারিবারিক ও সামাজিক টানা-পোড়েনের গল্প জানতে পারি। মহিলাদের কণ্টকিত ও বিতর্কিত মেয়েবেলাকে এঁরা জনসমক্ষে তুলে ধরেন। এই শতাব্দীর শেষ প্রান্তে আরও প্রগতিমূলক নারী চরিত্র সৃষ্টি হয় ‘নিউ ওম্যান’ উপন্যাসগুলিতে। তবে প্রখ্যাত নারীবিদ স্যান্ডরা গিলবার্ট ও সুজান গুবার-এর বিখ্যাত বই দ্য ম্যাড ওম্যান ইন দি অ্যাটিক (১৯৭৯) পড়লে আমরা জানতে পারি যে ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে লেখা অধিকাংশ নারীসাহিত্য খুবই গোপনীয়তার সঙ্গে তাদের প্রতিবাদের ভাষাকে ফুটিয়ে তোলে। এই লেখনী পদ্ধতিকে তাঁরা ‘প্যালিমসেস্ট’ পদ্ধতি আখ্যা দেন।১২ অর্থাৎ, প্রাচীন যুগে যেমন কাগজের অভাবে একই কাগজের উপর লেখা মুছে আবার নতুনভাবে লেখা হত তেমনি এই ভিক্টোরিয়ান লেখিকারা তাঁদের পুরুষের প্রতি বিদ্বেষ ও প্রতিবাদ তাঁদের ভাষার আড়ালে বুঝিয়ে দেন। পুরনো লেখা মুছে গেলেও যেমন তার ঝাপসা ছাপ থাকে নতুন লেখার সঙ্গে, এই প্রতিবাদের ভাষাও ছিল তেমনই ঝাপসা ও লুক্কায়িত। যদিও সোওল্টারের মতে এই সাহিত্যকে শুধু মেয়েলি ধারার লেখা বলা চলে না, এই যুগেরই শেষের দিকে ফেমিনিস্ট বা নারীবাদী লেখার সূচনা হয়। এই ধরনের লেখা শুধু পুরুষদের রচনাকে অনুকরণ করেই থেমে যায়নি, এর মধ্যে নারীসত্তার বিকাশ, সামাজিক সংঘাত ও উত্তরণের কথা কথিত আছে। যেমন এই যুগের মহিলারা যে অল্পবিস্তর কবিতা লেখেন, যেমন এলিজাবেথ ব্যারেট ব্রাউনিং-এর কবিতা বা এমিলি ব্রন্টের কবিতা, আমাদের পুরুষতান্ত্রিক শোষণ ও অসাম্যের বিরুদ্ধে সক্রিয় হতে সাহায্য করে।
এই যুগের সাহিত্যচর্চায় মহিলাদের উপস্থিতি বিপুল এবং বহুমুখী। এক দিকে রক্ষণশীল মনোভাবের অনেক লেখিকা তৎকালীন সমাজের চিত্র তাঁদের গোঁড়ামি ও দ্বিধার মাধ্যমে ব্যক্ত করেন। অন্য দিকে কিছু মহিলা কবি ও সাহিত্যিক কিন্তু তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি আত্মবিশ্বাস ও নির্ভীকতার পরিচয় দেন। সাধারণত গ্যাসকেল বা এলিয়ট রক্ষণশীল হলেও, এই যুগের শেষ প্রান্তে যে মহিলা ঔপন্যাসিকদের আত্মপ্রকাশ ঘটে তাঁরা অনেক সাহসী ও প্রগতিশীল। যুগান্তে যখন ইংরেজসমাজে নারী বহু আন্দোলন করে তাদের শিক্ষাগত অধিকার, আইনি অধিকার ও স্বতন্ত্রভাবে চাকরি করার স্বাধীনতা অর্জন করে তখন নারীমুক্তির ধারা সাহিত্যেও বিশেষ প্রভাব বিস্তার করে। এই প্রসঙ্গে আমরা দেখি যে মহিলা সাহিত্যিকরা এই ‘নতুন’ নারীকে নিয়ে গল্প লেখেন। যেমন জর্জ স্যান্ড, সেরা গ্রান্ড ও ওলিভ স্ক্রাইনারের মতো মহিলারা এই নতুন রূপ বিশ্লেষণ করেন— এই সদ্যপ্রাপ্ত বিদ্যা, অর্থ ও স্বাধীনতা মেয়েদের কতটা সাহায্য করেছে বা মুক্ত করেছে বা তাদের কোন নতুন দ্বিধাদ্বন্দ্ব বাড়িয়ে দিয়েছে। আসলে এইসময় মেয়েরা যখন কিছুটা স্বাধিকার বা মুক্তির সাধ পায় তখন এইসব তথাকথিত ‘আধুনিকা’দের নিয়ে পুরুষদের মধ্যেও নানান মানসিক জটিলতা সৃষ্টি হয়, এইসব মহিলাদের প্রতি পুরুষ আকর্ষণ বোধ করলেও প্রত্যাখ্যানের ভয়ও তাদের গ্রাস করে। স্বাধীনচেতা নারীর প্রেমিক বা স্বামী হওয়া তাদের কাছে বিশেষ চিন্তার বিষয় হয়ে পড়ে। তাই অনেকসময় এই মুক্ত, শিক্ষিত ও সক্ষম মেয়েরা অবিবাহিতই থাকে বা তারা সম্পর্কের জটিলতায় ও বিবাহবিচ্ছেদে জড়িয়ে পড়ে। তাই মুক্ত নারী তার সংগ্রামের মাধ্যমে পুরুষতন্ত্রকে আঘাত করলেও নিজে অনেক ক্ষেত্রে প্রেম, সংসার ও মাতৃত্বের আস্বাদ থেকে বঞ্চিত হয়। থমাস হার্ডি ও জর্জ ঘিসিং-এর মতো পুরুষ লেখক তাঁদের উপন্যাসে এই নতুন নারীদের নানান সমস্যা, পারিবারিক ও বৈবাহিক পীড়ন ও তাদের সংগ্রাম তুলে ধরেন। কারণ দার্শনিক মিলের মতো এই সহানুভূতিশীল লেখকরাও মেয়েদের মুক্তিকে সমর্থন করতেন। আবার এই যুগে মহিলাদের সমকামিতার একটি ধারাও সমাজে লক্ষণীয়। রক্ষণশীল মধ্যবিত্ত সমাজ ও চার্চ সর্বস্তরে সমকামীকে খারাপ ও অপবিত্র হিসাবে চিহ্নিত করে। কিন্তু এই যুগে গোপনভাবে বহু নারী লেখক, কবি ও সমাজবিদ সমকামিতাকে নানানভাবে সমর্থন করেন। যেমন ‘মাইকেল ফিলড’ নামক কবির রচনা খুব প্রসিদ্ধ হয়— আসলে তাঁরা দুই সমকামী নারী— ক্যাথরিন ব্যান্ডলি ও এডিথ কুপর। পুরুষদের ছদ্মনামে লেখা তখনকার সময় খুবই প্রচলিত ছিল। সমাজে পিতৃতান্ত্রিক মনোভাব তীব্র হওয়ার দরুন তাঁরা এই পথ বেছে নেন— তাঁদের নারীর পরিচয় গোপন করে সমাজে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার লড়াই এখানে দেখা যায়। এই ধরনের ছদ্মনাম তখনকার ছোট-বড় মাপের বহু মহিলা কবি বা সাহিত্যিক ব্যবহার করেন যাতে প্রকাশক ও পাঠক কিংবা সমালোচকরা তাঁদের মহিলা হওয়ার জন্য ব্রাত্য না করেন। উপন্যাস ছাড়াও কবিতা ও গদ্যের মাধ্যমে অনেক প্রগতিশীল মনোভাবাপন্ন নারী ও পুরুষ সমাজে মহিলাদের সমান অধিকারের জন্য লড়াই করেন। অনেক নারী কবির লেখায় আমরা তাঁদের জটিল মনোজগতে পুরুষসৃষ্ট সমাজের প্রতি বিদ্বেষের সুন্দর প্রকাশ পাই। এমিলি ব্রন্টে, এমিলি ডিকিনসন, মাইকেল ফিল্ডের মতো কবিরা বিভিন্নভাবে পুরুষের শোষণ ও নিপীড়নের কথা প্রকাশ করেন। সাহিত্যের পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে নারী ও পুরুষ উভয়পক্ষই এই সামাজিক অনৈক্য ও বৈষম্যের তীব্র প্রতিবাদ করেন। তাই আধুনিক যুগ প্রারম্ভের আগে কিছুটা হলেও ইংরেজসমাজে মহিলারা মুক্তির স্বাদ পান, কিন্তু সাম্যের লড়াই অনেকটাই বাকি থাকে।
ঊনবিংশ শতাব্দীতে নারীজাগরণের যে রূপ আমরা দেখতে পাই তা নারীসাহিত্যে বিশেষ প্রভাব বিস্তার করে, পাশ্চাত্যজীবনে এই নবজাগরণ (সামগ্রিকভাবে নারীমুক্তি) এক বিশেষ দিক— নারীশিক্ষা, আইনি অধিকার, আর্থিক স্বনির্ভরতা নারীকে এক বিশেষ আসনে প্রতিষ্ঠা করে, এই মৌলিক অধিকারলাভ মহিলাদের আরও ক্ষমতায়নের দিকে অনুপ্রাণিত করে। ঊনবিংশ শতকের শেষের দিকে যে ‘নিউ ওম্যান মুভমেন্ট’ শুরু হয় তার অবদান আমরা অগ্রাহ্য করতে পারি না। এই যুগে ইংল্যান্ডে ‘দ্য ওম্যান কোয়েশ্চেন’ এবং ‘দ্য নিউ ওম্যান মুভমেন্ট’ আমাদের সমাজে মহিলাদের স্বাধীনতা নিয়ে ভাবতে শেখায়। এই প্রগতিমূলক আন্দোলন ও বিতর্কের হাত ধরে বিংশ শতকের নারীবর্গ তাদের অধিকারের জন্য লড়াই জারি রাখে।
বিংশ শতাব্দীতে ব্রিটিশ সাহিত্যে যে মহিলা লেখকের অবদান অনস্বীকার্য, তিনি হলেন ভার্জিনিয়া উল্ফ্। উল্ফ্কে শুধুমাত্র সাহিত্যিক বললে ভুল হবে, তিনি একজন সক্রিয় নারীবাদীও ছিলেন। উল্ফের উপন্যাসে আমরা নারীমুক্তির ছোঁয়া পাই, তবে তাঁর রচনাসমগ্র পড়লে তাঁর সমাজচেতনা সম্পর্কে আরও বেশি করে অবহিত হই। তাঁর বিখ্যাত রচনাগুলি হল আ রুম অফ ওয়ান্স ওন এবং থ্রি গিনিস। উলফের মতে এই নিজস্ব ঘর অর্থাৎ আর্থিক স্বাধীনতাই নারীমুক্তির পথিকৃৎ হতে পারে। এইভাবে নিজস্বতা অর্জন করলে মহিলারা স্বাধীনতাও অর্জন করতে পারবেন। উল্ফ্ যেমন নারীর আলাদা স্থান দাবি করেছিলেন, উনি ‘অ্যাড্রোজিনি’-র ধারণাও তুলে ধরেন, তাঁর মতে একজন সম্পূর্ণ পুরুষ সে যার মধ্যে পুরুষ ও নারীর গুণ ও বৈশিষ্ট্যগুলি সমভাবে বিদ্যমান, তেমনি নারীর মধ্যে পুরুষালি বৈশিষ্ট্য এবং আচরণ থাকাও বাঞ্ছনীয়, তাহলেই যেকোনও মহিলা অন্দরমহল ও বাইরের পৃথিবীতে সমান স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করবে। আসলে ঊনবিংশ শতকে যে ‘পাবলিক স্ফিয়ার’ ও ‘প্রাইভেট স্ফিয়ার’-এর ধারণা মহিলাদের অন্দরমহলের প্রাণী হিসাবে চিহ্নিত করেছিল, বিংশ শতকের সমাজের পথিকৃৎরা এই ধারণাকেই ভুল প্রমাণ করার জন্য বিতর্ক সৃষ্টি করেন। ঊনবিংশ শতাব্দীতে নারীশিক্ষা ও নারীসাহিত্যের উল্লেখযোগ্য উন্নতি হলেও, সমাজে কিছু দার্শনিক, মনোবিদ ও বিজ্ঞানী মহিলাদের দুর্বল, অক্ষম ও কম আত্মবিশ্বাসী মনে করেন। তাই মহিলাদের বিবাহ ও সংসার-সন্তান নিয়েই মগ্ন থাকতে বলা হয়, কারণ বাইরের পৃথিবীতে সফল হতে যে বুদ্ধি, পরিশ্রমক্ষমতা ও বিচক্ষণতার প্রয়োজন, তা নারীসমাজে নেই। তবে কিছু সফল, উচ্চশিক্ষিত ও নিজ পেশায় দক্ষ নারী এই থিয়োরির সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। বিংশ শতকে উল্ফ্ এই ধারার এক নারীবিদ, তাঁর বিখ্যাত রচনা পড়লে আমরা দেখি তিনি কীভাবে সমাজে নারীর বিরুদ্ধে পুরুষের শোষণের প্রতিবাদ করেন। তিনি বলেন যে, শেক্সপিয়রের মতো কিংবদন্তি লেখক, নাট্যকার বা কবি হওয়া কোনও মহিলার পক্ষে সম্ভব ছিল না। শেক্সপিয়রের মতো সে গ্রাম থেকে শহরে এসে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার ক্ষেত্রে পুরুষের লোলুপ দৃষ্টি ও যৌনহেনস্থার শিকার হয়ে পতিতালয়ে স্থান পেত। এই মর্মান্তিক সত্য সমাজে মহিলাদের অনেক পিছিয়ে দিয়েছে। তাই যুগ যুগ ধরে মহিলারা পুরুষতান্ত্রিক সমাজে শৃঙ্খলামুক্ত হতে পারেনি, বার বারই পুরুষের শক্তির কাছে নতিস্বীকার করতে বাধ্য হয়েছে এবং সেই সুযোগে রাষ্ট্রযন্ত্র পিতৃতান্ত্রিক সমাজকে প্রতিষ্ঠা করেছে।
পাশ্চাত্য সভ্যতায় নারীমুক্তি আন্দোলনের তিনটি পর্যায় আমরা দেখতে পাই— প্রথম পর্যায়, যে-ধরনের প্রতিবাদ ও আন্দোলন আমরা ঊনবিংশ শতকে দেখি; দ্বিতীয়, বিংশ শতকের প্রথমার্ধে; এবং তৃতীয় পর্যায়টি অবস্থিত বিংশ শতকের শেষ প্রান্তে। ১৯৭০ সাল নাগাদ পশ্চিমে প্রথম সবথেকে ব্যাপক এবং সংগঠিত নারী আন্দোলন শুরু হয়। এই আন্দোলনের কাণ্ডারিরা সমাজে নারী ও পুরুষের সমান অধিকার ও প্রতিষ্ঠা দাবি করেন। পিতৃতান্ত্রিক কাঠামোর মধ্যে পুরুষের অনুগত হয়ে থাকতে তারা রাজি ছিলেন না। তাই সমাজের সর্বস্তরে শুরু হয় ব্যাপক আন্দোলন, প্রতিবাদ ও ধিক্কার সূচি। কোনও সময় কর্মক্ষেত্রে মহিলারা পুরুষের সমান উপার্জন করার দাবি করেন; আবার অন্য দিকে আইনি মতে মেয়েদের পিতার সম্পত্তির উপর সমান অধিকারের দাবিতে লড়াই উন্মোচিত হয়। সমাজের সর্বক্ষেত্রে যখন এই নারীমুক্তি আন্দোলন খুবই ব্যাপক আকার ধারণ করে তখন আমরা প্রধানত দুই ধারার নারীবাদের উন্মেষ লক্ষ করি। একটা ধারা হল ব্রিটেন ও আমেরিকার নারীবিদদের সমাজতত্ত্বনির্ভর বা অ্যাংলো-আমেরিকান নারীবাদ এবং আরেকটি ধারা নারীর মনস্তত্ত্বনির্ভর ফরাসি নারীবাদ। এই দুই নারীবাদের উপপাদ্য বিষয় ছিল নারী-পুরুষের বৈষম্য দূরীকরণ। ভিন্ন মতাদর্শ থাকলেও তাঁদের উদ্দেশ্য একই ছিল— তাঁরা সমাজে নারী-পুরুষ সম্পর্কে সাম্যের দাবি করেন। অ্যাংলো-আমেরিকান ধারার অন্যতম প্রবক্তা ছিলেন গারডা লারনার, ইলেন সোঅল্টার, স্যান্ডরা গিলবার্ট, সুজান গুবার, ইলেন মোয়ার্স, কেট মিলেট প্রমুখ। আবার ফরাসি ধারার প্রবক্তা ছিলেন জুলিয়া ক্রিস্তেভা, হেলেন সিৎজু এবং লুস ইরিগেরে। এই তৃতীয় নারীবাদকে উত্তর-আধুনিক/পোস্টমডার্ন ধারার একটি শাখা ধরা হয়।
ফরাসি ধারার নারীবাদীরা বিভিন্ন ধরনের মনস্তত্ত্বভিত্তিক আলোচনার সাহায্যে পিতৃতন্ত্রকে সমালোচনা করেন। কিন্তু ইংল্যান্ড বা আমেরিকার কিছু বিখ্যাত নারীবাদীদের মতে নারীর পিছিয়ে থাকার কারণ হল সমাজের বিভিন্ন রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক সমস্যা। নারীকে পুরুষের যোগ্য করে তুলতে হলে, সমাজের বিভিন্ন বিধিকে পরিবর্তন করতে হবে যা মেয়েদের জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে। তাঁরা নারীর শিক্ষা, আর্থিক ও আইনি অধিকার দাবি করেন এবং নারীকে পুরুষের সমান অধিকার দেওয়ার প্রস্তাবে সোচ্চার হন। আমরা যদি এই ধারার বিশিষ্ট নারীবাদী লেখিকা কেট মিলিটের সেক্সচুয়াল পলিটিক্স্ (১৯৭০) বইটি পড়ি তাহলে জানতে পারি উনি কীভাবে সেই দর্শকের নারীমুক্তি আন্দোলেনের উপযোগিতা ব্যাখ্যা করেন।১৩ তাঁর মতে মহিলাদের পুরুষের সমান অধিকার দেওয়া প্রয়োজন, যা বহুযুগ ধরে তাদের থেকে দূরে রাখা হয়েছে। তাঁর বইটিতে বিভিন্ন পুরুষ লেখক কীভাবে নারী চরিত্রকে শুধুমাত্র যৌনলালসার আধার হিসাবে চিত্রিত করেছেন তারও ব্যাখ্যা আছে। মিলেটের ধারণা নারী চরিত্র সৃষ্টির সময় ছেলেদের কামুক মনোভাব তাদের অপর লিঙ্গকে বিকৃত ও যৌনউত্তেজক হিসাবে চিহ্নিত করতে উসকে দেয়। সাহিত্যে মহিলাদের উপস্থাপন নিয়ে বিপুল গবেষণা-আলোচনাও নারীবাদীদের প্রিয় বিষয় হয়ে ওঠে। গিলবার্ট ও গুবারের লেখা, ইলেন মোয়ারসের লেখা এবং ইলেন সোঅল্টার রচিত এ লিটারেচার অফ দেয়ার ওন প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।
আমরা যদি এই নারীবাদের ধারাকে লক্ষ করি তাহলে দেখি যে সোঅল্টার তার প্রসিদ্ধ রচনা ফেমিনিস্ট ক্রিটিসিজ্ম ইন দ্য উইল্ডারনেস–এ বহু মূল্যবান গবেষণার তথ্য আমাদের সামনে তুলে ধরেন। যেমন তার অমূল্য অবদান হল গাইনোক্রিটিসিজ্ম তত্ত্ব। এই তত্ত্বে উনি বলেন যে সাহিত্যের আধুনিক নারীবাদীদের মূল উদ্দেশ্য হল দু’ ধরনের: ১) পুরুষের লেখা সাহিত্যে নারীকে কীভাবে চিত্রিত করা হয়েছে; ২) নারীদের রচিত সাহিত্য সঠিক সম্মানের সঙ্গে সাহিত্যের ইতিহাসে স্থান পাচ্ছে কি না এবং কোনও মহিলার রচিত কাজ যা পূর্বতন যুগে অবহেলিত হয়েছে তার সঠিক মূল্যায়ন করে সেই কাজগুলিকে সর্বসমক্ষে আনা। অতএব নারীসাহিত্য এবং নারী চরিত্র দুটোই যদি পুরুষের অবহেলার পাত্র হয়ে থাকে, সেইসব সাহিত্যকে পুনর্মূল্যায়ন করতে হবে। সোঅল্টার ইংরেজি সাহিত্যকে তিনটি ধারায় ভাগ করেন—‘ফেমিনিন’, ‘ফেমিনিস্ট’ ও ‘ফিমেল’— নারীসুলভ, নারীবাদী ও নারী সাহিত্য। অষ্টাদশ শতকের শেষে নারীবাদী সাহিত্যের উন্মেষ ঘটে আর সেসব লেখায় প্রতিবাদী নারীসত্তার বিকাশ লক্ষ করা যায়। আবার বিংশ শতাব্দীর মধ্য ও শেষ প্রান্তে বিভিন্ন তত্ত্বের প্রভাবে যে আধুনিক সাহিত্য রচিত হয় তা নারীমুক্তির প্রতীক। বিংশ শতাব্দীর শেষ প্রান্তে ব্রিটিশ সাহিত্যের আঙিনায় বহু প্রতিভাবান মহিলা কবি ঔপন্যাসিক ও নাট্যকারের আবির্ভাব হয়। তাঁদের লেখার মাধ্যমে তাঁরা পুরুষতান্ত্রিক শোষণের বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রতিবাদ করেন এবং বিভিন্ন বলিষ্ঠ ও স্বনির্ভর নারী চরিত্র সৃষ্টি করেন। এইসব উল্লেখযোগ্য মহিলা লেখকরা হলেন কবি সিলভিয়া প্লাথ, ঔপন্যাসিক অ্যান্টোনিয়া বায়াট, ডোরিস লেসিং, এনজেলা কার্টার ও নাট্যকার সিলাগ ডিলানে এবং ক্যারিল চার্চিল ইত্যাদি। এই সাহিত্যিকরা নারীকেন্দ্রিক সাহিত্যে বিশেষ পারদর্শিতা অর্জন করেন এবং আধুনিক সমাজে মুক্ত নারীর জীবনের বিভিন্ন টানা-পোড়েন নিয়ে সাহিত্য সৃষ্টি করেন। এই আধুনিক যুগের নারীসাহিত্য শুধু পুরুষতন্ত্র নয়, মাঝে মাঝে ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধেও সরব। এই সময়ের মধ্যে বিশেষভাবে কিছু লেখিকা ইউরোপে তথা ব্রিটেনে তাঁদের দেশ ছেড়ে বসবাস করতে শুরু করেন। আমেরিকাতেও বহু কৃষ্ণাঙ্গ সাহিত্যিক এবং এশিয়া তথা মধ্যপ্রাচ্যের লেখকরা প্রভাব বিস্তার করেন। এইসব বহিরাগত লেখক-লেখিকার সাহিত্যের মধ্যে পশ্চিমের ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে বক্তব্যগুলি খুবই জোরালো। যদিও বিংশ শতাব্দীর শেষে বেশিরভাগ সাম্রাজ্যের পতন ঘটে, তবু বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে বহু লেখক ও লেখিকারা সরব হয়ে ওঠেন। এই প্রেক্ষিতে বহু কৃষ্ণাঙ্গ লেখিকার মধ্যে নারীবাদ ও বর্ণভেদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ সংমিশ্রিত হয়। তা ছাড়া সমসাময়িক নারীবাদ সমকামী সম্পর্কের দাবিতে সোচ্চার হয়ে ওঠে। তাই আমরা জিনেট উইন্টারসনের মতো নারীবাদী লেখিকাকে এইসব বিষয়গুলির উপর জোর দিতে দেখি।
ব্রিটিশ সাহিত্যে বিংশ শতাব্দীর শেষ প্রান্তে বিভিন্ন দেশ তথা যেগুলি ওই দেশের পূর্বতন সাম্রাজ্যের অংশ ছিল সেইসব জায়গার কবি, নাট্যকার ও লেখিকাদের উপস্থিত লক্ষণীয়। সুদূর ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জ, বিভিন্ন কমনওয়েলথের দেশ যেমন পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশ এবং অবশ্যই ভারতের বহু পুরুষ ও মহিলা ইংরেজি ভাষায় গল্প, কবিতা, উপন্যাস ও নাটক রচনার ধারাকে প্রতিষ্ঠা করে। এসব মহিলা লেখকরা বেশিরভাগই ইংল্যান্ডের নানান প্রান্তে ‘ডায়াসপরিক’ বা দেশান্তরিত নাগরিক হয়ে বসবাস করে। তাই আমেরিকান কৃষ্ণাঙ্গ ঔপন্যাসিক এলিস ওয়াকার ও টনি মরিসনের মতো তাদের রচিত ইংরেজি সাহিত্য ব্রিটিশ সাহিত্যের মূলধারা ও ইতিহাসে স্থান তৈরি করে নেয়। এবং এর ফলে ব্রিটিশ সাহিত্যের যেমন সমৃদ্ধি হয় তেমনই ভিন্নধর্মী ও অন্য জাতির নারীদের সামাজিক জীবনের দর্পণ হয়ে ওঠে। এইসব মহিলাদের জীবন ও তাঁদের লেখাগুলি খুবই জটিল এবং কণ্টকাকীর্ণ জীবনের প্রতিচ্ছবি; কারণটা হল এঁদের নিজেদের দেশের পিতৃতন্ত্র, ব্রিটিশ পুরুষতন্ত্র— সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে যেখানে নিজেদের অস্তিত্ব স্থাপন করতে হয়। নানান সামাজিক, পারিবারিক নিয়মকানুন ও ধর্মের অনুশাসন বার বার তাঁদের আত্মমর্যাদা প্রতিষ্ঠার পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। এবং এইসমস্ত বাধাবিপত্তিকে জয় করেই এঁরা এগিয়ে চলেন।
সমকালীন ব্রিটিশ সাহিত্য শুধু শ্বেতাঙ্গ লেখিকাদের প্রাধান্য দেয় না, কারণ ব্রিটেনে এখন বহু মানুষ বসবাস করেন যাঁরা আসলে ভারতীয় উপমহাদেশ, ক্যারিবিয়ান অথবা আফ্রিকান মহাদেশের মানুষ। তাঁদের ব্রিটেনে থাকার বিভিন্ন অভিজ্ঞতা এই মিশ্রধারার ব্রিটিশ সাহিত্যের মূল বিষয়। এইসময় আমরা ভি.এস. নাইপল, শিবা নাইপল, কাজুয়ো ইশিগুরো, টিমোথি মো কিংবা ক্যারিল ফিলিপসের মতো ভিন্ন দেশের পুরুষ লেখকদের দেখতে পাই। এঁদের সাহিত্যে ব্রিটেনে বসবাসকারী পুরুষদের অভিজ্ঞতাকে বেশি প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। এঁদের সাহিত্যে নারী চরিত্রগুলি প্রাধান্য পায়নি বা কৃষ্ণাঙ্গ বা ভারতীয় উপমহাদেশে অবস্থিত নারীর ব্রিটেনে বাস করার নানান সমস্যা ও প্রতিবন্ধকতা এঁদের বিষয় হয়ে ওঠেনি। এঁদের লেখায় নারী চরিত্র উপস্থিত থাকলেও তার কেন্দ্রবিন্দু হল পুরুষের বিভিন্ন সামাজিক সংগ্রাম ও আর্থ-সামাজিক জটিলতা। ভারতীয় ডায়াসপরিক লেখার উত্তরণ হয় অনিতা দেশাই, ভারতী মুখার্জি, মীরা সায়াল, জেডি স্মিথ, চিত্রা ব্যানার্জি দিবাকরণী ও কিরণ দেশাই-এর মতো প্রতিভাময়ী মহিলা লেখিকাদের আবির্ভাবের পর। এঁরা বর্ণবিদ্বেষ ও নারীর সংগ্রামকে নতুনভাবে গুরুত্ব দিয়ে তার সত্যতা প্রতিষ্ঠা করেন।
তাই ‘পোস্টকলোনিয়াল’ বা ‘উত্তর-ঔপনিবেশিক’ ধারায় আমরা যে নতুন মিশ্রতা ও উদারতা দেখতে পাই তা এইসব পুরুষ ও মহিলা লেখকদের সংগ্রামের কাহিনি আমাদের সামনে তুলে ধরে। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের পতন হলেও ব্রিটেনে বসবাসকারী অন্যান্য দেশের নারী ও পুরুষ কী ধরনের শোষণ, বঞ্চনা ও বর্ণবৈষম্যের শিকার হন, এইসব সাহিত্য সেই ছবিই তুলে ধরে। যেমন, ব্রিটেনে বসবাসকারী বাংলাদেশের মহিলাদের জীবন ও সামাজিক জটিলতা নিয়ে মনিকা আলি লেখেন ব্রিক লেন এবং জেডি স্মিথ লেখেন হোয়াইট টিথ। এই দুই উপন্যাস বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করে ও বহু পুরস্কারে ভূষিত হয়। এইসব কাহিনি ব্রিটিশসমাজে বসবাসকারী বাংলাদেশি মহিলাদের আশা-নিরাশার কথা বর্ণনা করে। তাদের ধর্ম ও দেশীয় সমাজের প্রভাব ও পারিবারিক রক্ষণশীলতার বা আইনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের চিত্র আমাদের সামনে নিয়ে আসে। আসলে বিদেশে বসবাস করলেও, পুরুষতান্ত্রিক সমাজের নানান বিধি-নিষেধ তাদের মুক্তির পথে যে কতটা অন্তরায়, সেই সমস্যাই কথিত আছে এইসব লেখাগুলিতে। মীরা সায়ালের উপন্যাসও এই একইরকমভাবে ভারতীয় মহিলাদের পরবাসে সংগ্রামের কাহিনি তুলে ধরে বিপুল সংখ্যায় পাঠকদের মন জয় করেছে। উন্নতমানের ইন্টারনেট-নির্ভর প্রযুক্তির সাহায্যে এখন সারা পৃথিবীর মানুষ এইসব কাহিনি পড়তে পারে। এখন তাই এই মিশ্রধারার ব্রিটিশ সাহিত্য শুধু ইংরেজ মহিলাদের সংগ্রাম ও স্বাধিকারের কথা বলেই থেমে যায় না, এইসব রচনা এখন বিদেশে বসবাসকারী ভারতীয়, বাংলাদেশি ও কৃষ্ণাঙ্গ মহিলাদের জীবনগাথা ও লড়াইয়ের নিরন্তর চিত্র আমাদের সামনে উপস্থাপন করে।
এই প্রসঙ্গে আমরা বলতে পারি যে, কৃষ্ণাঙ্গ মহিলাদের সংগ্রাম জটিল পর্যায়ে পৌঁছায় কারণ তারা দু’গুণ নিপীড়িত— প্রথমত তাদের স্বজাতীয় পিতৃতন্ত্র এবং দ্বিতীয়ত ব্রিটিশ আধিপত্যবাদ বা সাম্রাজ্যবাদী মনোভাব দ্বারা শোষিত। ঘরে-বাইরে প্রতিনিয়ত এরা এই দুই শক্তির সঙ্গে লড়াই করে নিজেদের অস্তিত্বকে বজায় রাখে। মনিকা আলি, আমরিল জনসন কিংবা অনিতা দেশাই ও কিরণ দেশাই রচিত উপন্যাস ও কবিতায় আমরা এইসব কঠিন সমস্যার চিত্র দেখতে পাই। তাঁরা সমাজে নারীর উপস্থাপনাকে সাহিত্যে নারীর বিন্যাসের সঙ্গে একত্র করেন— এইসব সমকালীন রচনাগুলিতে আমরা মহিলাদের সামাজিক অবস্থান ও তার নারীবাদী পাঠ পড়তে সক্ষম হতে পারি। বর্তমান যুগের সাহিত্যকর্ম হিসাবে এইসব লেখার মধ্যে নারীবাদী চিন্তার প্রকাশ স্পষ্ট এবং দ্বিধাহীন। এইসব লেখার মধ্যে শ্বেতাঙ্গসমাজ ও ডায়াসপরিক ভারতীয় উপমহাদেশের মানুষের যে জীবনচিত্র আমরা পাই, তাতে মহিলাদের অভিজ্ঞতাকে বিশেষ প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। বর্ণবিদ্বেষ ও লিঙ্গবৈষম্যের বিরুদ্ধে তাদের লড়াকু মনোভাব ও আত্মমর্যাদাবোধের উত্তরণকে তুলে ধরা হয়েছে। বর্তমান সময়ে অবস্থিত এইসব নারী চরিত্রগুলি প্রতিবাদী ও প্রগতিশীল। এই অবস্থান নারীবাদী লেখিকাদের এক নতুন প্রজন্মের মুক্তমনের নারীসত্তার সন্ধান করতে সাহায্য করেছে।
এই যুগের নারীসাহিত্যে আমরা একটি বেশ নতুন ধরনের লেখার প্রবণতা দেখতে পাই। পুরনো গ্রন্থ ও তাঁদের চরিত্রকে অবলম্বন করে নারী ও পুরুষ লেখকরা সমানভাবে সাহিত্য রচনা করেন। যেমন ড্যানিয়েল ডিফোর অষ্টাদশ শতাব্দীর উপন্যাস রবিনসন ক্রুশো অবলম্বনে লেখা হয় ফো। একইভাবে, শেক্সপিয়রের বিভিন্ন নাটকও পুনরায় নতুন সাহিত্যের উপাদান হয়ে ওঠে। এইসব লেখার মূল উদ্দেশ্য হল পুরনো সাহিত্যের রূপান্তর করা ও সেই রচনায় যা-কিছু অব্যক্ত ছিল সেগুলিকে আধুনিক যুগের চিন্তাধারা অনুযায়ী পুনরায় ব্যাখ্যা করা। এই ধরনের ইন্টারটেক্সচুয়াল লেখা, আধুনিক বহু নারীবাদী লেখিকাকে অনুপ্রাণিত করেছিল এবং তাঁরা সাহিত্যে নারীর স্থানকে পুনর্গঠিত করেছিলেন তাঁদের নতুন লেখার মাধ্যমে। এই ধরনের সৃষ্টিশীল গ্রন্থ নারীর স্থান ও ভাবমূর্তিকে আধুনিকভাবে মূল্যায়নের সুযোগ দেয়। তাই ব্রিটিশ সাহিত্যিক অ্যানজেলা কারটার কিংবা সুদূর ক্যারিবিয়ান লেখিকা জিন রিস পুরনো পাশ্চাত্যের নানান কাহিনিকে নতুনভাবে রচনা করেন। কারটার পাশ্চাত্যে জনপ্রিয় লোকসাহিত্যে প্রচলিত রূপকথা ও পৌরাণিক আখ্যানগুলির উপর নির্ভর করে সাহিত্য রচনা করে তাতে মহিলাদের স্থান প্রতিষ্ঠা করেন। যেমন তাঁর উপন্যাস দ্য প্যাশন অফ নিউ ইভ-এ বাইবেলের ইভের চরিত্র নতুন করে ব্যাখ্যা ও মূল্যায়ন করেন। আবার দ্য ম্যাজিক টয়শপ কিংবা নাইটস অ্যাট দ্য সার্কাস উপন্যাসগুলিতে কিছু পৌরাণিক চরিত্রের নতুন নারীবাদী ব্যাখ্যা দেন। জিনেট উইন্টারসনের উপন্যাস সেক্সিং দ্য চেরি উপন্যাসও এই ধারা অনুসরণ করে মহিলাদের সমকামিতা বিষয়টি তুলে ধরে। রিস আবার শার্লট ব্রন্টের কালজয়ী উপন্যাস জেন আয়ার অবলম্বনে নতুন একটি উপন্যাস লেখেন—ওয়াইড সারগাসো সি। এই গল্পে তিনি নায়কের উন্মাদ স্ত্রী বার্থা মেসন, যিনি মিশ্র ক্রিয়েল জাতির সদস্য, তার দুঃখ ও বঞ্চনার কাহিনি নিজস্ব কল্পনাশক্তি দিয়ে বিবৃত করেন; তাদের মধ্যে সাহস ও প্রতিবাদ জাগানোর জন্য। যথাক্রমে চন্দ্রা মোহান্তি বা গৌরী বিশ্বনাথনের মতো স্বনামধন্য নারীবাদীরাও ব্রিটিশ সাম্রাজ্য, ভারতীয় নারী ও ঔপনিবেশিক শোষণের কাহিনিকে যুগোপযোগী হিসাবে দেখেছেন। এইসব তৃতীয় বিশ্বের নারীসাহিত্য তাদের গবেষণার বস্তু হয়ে উঠেছে। প্রথম বিশ্বের মহিলা সাহিত্যিক তথা নারীবাদীরা, শ্বেতাঙ্গ মহিলাদের সমতার লড়াইকে প্রাধান্য দেন। কিন্তু কৃষ্ণাঙ্গ, তৃতীয় বিশ্বের মহিলা কিংবা সমকামী মহিলারা উপেক্ষা ও তাচ্ছিল্যের নজরে দুই রকমের অবহেলিত নারীদের সংগ্রামের কথা আমাদের সামনে তুলে ধরেন। বিশ্বায়নের যুগে ইংরেজি সাহিত্যে শুধু ব্রিটিশ সাহিত্যিকরাই নন, সারা বিশ্বেই বিভিন্ন দেশের লোক ইংরেজি ভাষায় লিখে বিশ্বজোড়া খ্যাতি ও প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন। তাই এটা ভাবার কোনও কারণ নেই যে কেবলমাত্র ব্রিটিশ সাহিত্যেই নারীবাদের উন্মোচন দেখা যায়।
সামগ্রিকভাবে নারীবাদ ও ইংরেজি সাহিত্যের মধ্যে যোগাযোগ গভীর। বিভিন্ন যুগে নারীর রচিত সাহিত্যে সমাজে নারীর ভূমিকা তুলে ধরা হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রেই সাহিত্যের মাধ্যমে নারীর মনের বিকাশ ও সামাজিক অবস্থানকে নিয়ে নানান চর্চা সমাজকে ও পাঠককে প্রভাবিত করেছে। নারীবাদী সাহিত্য অধুনা যুগে বহুল পরিমাণে রচিত হচ্ছে এবং বিগত কিছু দশক ধরে নারীবাদী সমালোচক ও সমাজবিদেরও কোনও অভাব নেই। তবে এই অবস্থা অর্জন করতে পাশ্চাত্যে নারীকে বহু যুগ ধরে বহু আন্দোলন ও প্রতিবাদ করতে হয়েছে এবং সাহিত্য সেই লড়াইয়ে বারংবার মহিলাদের একটা গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হয়ে উঠেছে। এই সত্য ব্রিটিশ সাহিত্যের ইতিহাসেও অনস্বীকার্য। তাই নারীবাদ, সাহিত্য ও সমাজকে এক সূত্রে বেঁধে যেভাবে আধুনিক যুগে নারীর ক্ষমতায়ন হয়েছে সেই ধারা বজায় রাখার জন্য নারীবিদদেরই সক্রিয় হতে হবে।
টীকা ও সূত্রনির্দেশ
১. Gerda Lerner, The Creation of Patriarchy (Oxford and New York: Oxford University Press, 1988), p. 5.
২. Ibid., p. 7.
৩. চসার ১৩৮৭ থেকে ১৪০০ সালের মধ্যে দ্য ক্যান্টারবেরি টেলস লিখেছিলেন। যেটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৪৭৬ সালে।
৪. ইউরোপে ষোড়শ শতাব্দীতে বহু বিদ্বান ব্যক্তি গ্রিস ও রোমের সাহিত্য ও সভ্যতাকে পুনর্মূল্যায়ন করেন এবং পৃথিবীতে মানুষের কেন্দ্রীয় ভূমিকা সম্পর্কে অবহিত করেন। পিকো, এরাসমাস ও ম্যাকিয়াভিলি এই হিউম্যানিজ্মের প্রবর্তক, ইংল্যান্ডে এই ধারার পণ্ডিত ছিলেন থমাস মোর, মারলো, লিলি, গ্রিন প্রমুখ; মধ্যযুগের ঈশ্বরসর্বস্য জীবনধারার বদলে এঁরা মানবজাতির প্রাধান্যকে প্রতিষ্ঠা করেন।
৫. Elaine Showalter, ‘Feminist Criticism in the Wilderness’, Critical Enquiry, 8:1, (Winter 1981): 179-205. See also: A Literature of Their Own (London and New York: Virago Press, 1997), pp. 42-85.
৬. Joan Kelly, Women, History and Theory (Oxford: Oxford University Press, 1984), pp. 76-98.
৭. Mary Wollstonecraft, A Vindication of the Rights of Woman (London and New York: Worldview, 1986), p. 26.
৮. কনডাক্ট ম্যানুয়ালগুলি মহিলাদের দৈনন্দিন জীবনে কী করা উচিত ও কী করা উচিত নয় তা প্রকাশ করত। এই পর্যবেক্ষণগুলি মূলত পুরুষতন্ত্র দ্বারা নির্ধারিত হত। কোনও নির্দিষ্ট লেখকের নাম প্রায়শই সেখানে থাকত না, তবে নির্ধারিত রীতিনীতিগুলি মহিলাদের জন্য আদর্শ হিসাবে বিবেচিত হত।
৯. এই ধরনের উপন্যাস-কাঠামো ১৭০০ খ্রিস্টাব্দে শুরু হয়েছিল। বিশেষত, ফিল্ডিং ও রিচার্ডসনের মতো লেখকেরাই তাঁদের উপন্যাস চিঠির আদলে লিখতে শুরু করেছিলেন।
১০. John Stuart Mill, On Liberty and Other Writings, ed. Stefan Collini (Cambridge: Cambridge University Press, 2009), p. 1.
১১. Ibid., p. 3.
১২. Sandra Gilbert and Susan Gubar, The Madwoman in the Attic (London and New York: Worldview, 1979), pp. 37-45.
১৩. Kate Millett, Sexual Politics (London: Doubleday, 1970), pp. 3-4.