চৌদ্দ নম্বর গিনিপিগ

চৌদ্দ নম্বর গিনিপিগ 

শংকর সাহেবের স্বাভাবিক হতে বেশ কিছুক্ষণ সময় লাগল। প্রচণ্ড শিকওয়েভের কারণে মাথার ভেতরে চাপ অনুভব করলেন তিনি। কিছুক্ষণ পরে স্বাভাবিক হতেই তিনি দেখলেন বশির জামান ঠায় দাঁড়িয়ে আছেন। জেলখানার ধ্বংসাবশেষ জ্বলছে। ধুমায়মান টিলা বেয়ে এলোমেলোভাবে কয়েকজন লোক নিচে নেমে আসছে। লোকগুলো কাছাকাছি আসতেই শংকর সাহেবের নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হল। এরা হল সেই তেরোজন ভয়ংকর আসামী। তেরোজনকেই কোন না কোনভাবে চেনেন শংকর। কায়জুদ্দিন, মুনশী, সুমিত এদের মুখগুলো ভোলার মত না। এরা জলজ্যান্ত পিশাচ। কিন্তু একেবারে সামনে জেলখানার গার্ডের পোষাক পরিহিত বিশালদেহী আর পেশীবহুল যুবককে তিনি আগে কখনও দেখেননি। 

কি হচ্ছে না হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারলেন না শংকর। এই বিস্ফোরণ, এই তেরোজনের বেরিয়ে আসা- সব কিছু যেন এক সেকেন্ডের ভেতরে হয়ে গেল। তিনি যখন এইসব হিসাব মিলাতে ব্যস্ত তখনই তার মোবাইলটা বেজে উঠল। ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে তার সারা শরীর জমে গেল। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের বিশেষ নম্বর। জেলখানায় বিস্ফোরণের খবরটা হয়ত এরই মধ্যে স্বয়ংক্রিয়ভাবে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পৌঁছে গিয়েছে। ভাইব্রেশনের চাপা শব্দে ফোনটা শংকরের মুঠোর ভেতরে কাঁপতে থাকল। শংকর একবার বশিরের দিকে তাকালেন। বশির সেই অচেনা যুবকের সাথে কথা বলছেন। পেছনে অস্ত্রধারী তেরোজন। কেউ শংকরকে লক্ষ্য করছে বলে মনে হল না। 

প্রধানমন্ত্রীকে জানানো দরকার। যেভাবেই হোক জানানো দরকার। শংকর কাঁপা হাতে সবুজ বাটনে চাপ দিতে যাবে, তখনই বশির জামান পেছনে ঘুরলেন। শংকর ফোনটা তাড়াতাড়ি শার্টের আস্তিনে লুকিয়ে ফেললেন। কিছুক্ষণ পরে লাইনটা কেটে গেল। 

“পরিচয় করিয়ে দেই, ইনি হলেন মেজর ইকবাল। আমাদের খুব বিশ্বস্ত একজন এজেন্ট।” বশির জামান অচেনা যুবকের দিকে তাকিয়ে বললেন। শংকর মুখে একটা কৃত্রিম হাসি আনার চেষ্টা করলেন। জেলখানার গার্ডের ইউনিফর্মে মোড়া পেশীবহুল শরীর যুবকের। বাম কাঁধে ঝুলছে ভারি এলএমজি। যুবক একটা কাষ্ঠ হাসি উপহার দিল শংকরকে। 

বশির বলল, “চীনের প্রাচীর থাকা সত্ত্বেও কেন মোঙ্গলরা শহরের ভেতরে ঢুকে পড়ত এখন বুঝেছেন শংকর সাহেব? প্রাচীরের প্রহরীরাই মোঙ্গলদেরকে ঢুকতে দিত। শুধুমাত্র কিছু ঘুষের বিনিময়ে। যাই হোক, আপনি বোধহয় হিসাব মিলাতে পারছেন না। ব্যাপার না। মেজর ইকবাল হিসাবগুলো মিলিয়ে দিচ্ছে।” 

মেজর ইকবাল বললেন, “আমি দুইমাস আগে গার্ড হিসাবে এই জেলখানায় আসি। মেজর জেনারেল ফিরোজ স্যারই আমাকে এখানে পাঠানোর জন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে সুপারিশ করেন। উনি শুধু বলেছিলেন, একটা প্ল্যান আছে। সময় আসলে জানাবেন। সময়ের জন্য অপেক্ষা কর। আমি সময়ের অপেক্ষা করতে থাকি। কিন্তু একটু ভুল হয়ে যায়। ফিরোজ স্যারের সাথে আমার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। কারণ এই জেল থেকে বাইরে যোগাযোগের কোনরকমের সুযোগ দেওয়া হত না।” 

কিছুক্ষণ বিরতি। 

“আমি আস্তে আস্তে জেলখানার ভেতরের সব তথ্য সংগ্রহ করতে থাকি। কতজন গার্ড। নিরাপত্তা ব্যবস্থা কেমন কী, কয়টা দরজা আছে ইত্যাদি। এক সপ্তাহের ভেতরে আমি পুরো জেলখানার একটা ম্যাপ বানিয়ে ফেলি। কিন্তু কোন তথ্যই আমি স্যারকে জানাতে পারছিলাম না। জেলখানার বাইরে কোন গার্ডকেও বের হতে দেওয়া হত না। তাই জেলটার একজাক্ট লোকেশনও জানাতে পারছিলাম না। কারণ জেলখানার ভেতরে কাউকে ইলেকট্রনিক ডিভাইস ব্যবহার করতে দেওয়া হত না। জেলখানার ভেতরে একটা মাঝারী রেঞ্জের র‍্যাডার ছিল যেটার সাহায্যে আশেপাশে কেউ ফোনে বা ওয়াকিটকিতে কথা বলছে কিনা দেখা হত। তাছাড়া ওখানে যাতায়াতের কোন ব্যবস্থা ছিল না। প্রতি সপ্তাহে একটা হেলিকপ্টারে করে সপ্তাহের রেশন পাঠানো হত। ওটাই ছিল একমাত্র বাহন বা মাধ্যম যেটা জেলখানার বাইরে যেত। তাই আমি রেশন ম্যানেজমেন্ট সেকশনে নাম লিখিয়ে ফেললাম। একদিন হেলিকপ্টারের অপারেটরকে মোটা অংকের ঘুষ দিয়ে ফিরোজ সাহেবকে একটা চিঠি পাঠাই। তাকে জানাই যে তিনি যেন আমার সাথে রেশনের হেলিকপ্টারটার মাধ্যমে যোগাযোগ করেন। চিঠির সাথে পাঠিয়ে দেই পুরো জেলখানার ম্যাপটাও। ঠিক তার পরের সপ্তাহে রেশনের বস্তার ভেতরে একটা চিরকুট এলো যেটাতে সাংকেতিক ভাষায় লেখা ছিল, পরেরবার সবজির বস্তায় বিস্ফোরকের জিনিসপত্র পাঠানো হবে। কি কি করতে হবে সেটাও জানিয়ে দেওয়া হয়। আমি যেন প্রস্তুত থাকি। আমি দুই বছর বম্বস্কোয়াডে ছিলাম। বিস্ফোরক সম্পর্কে আমার মোটামুটি ধারণা ছিল। আমি প্রস্তুত ছিলাম। আর রোজ তেরোজন আসামীদেরকে চিরকুটের মাধ্যমে জানাতাম যে আর কয়েকদিনের ভেতরেই তাদের জেল পালানোর সুযোগ আসবে। আমাকে অনুসরণ করলে ওরা নিরাপদ জায়গায় সরে যেতে পারবে। ওরাও ধীরে ধীরে প্রস্তুতি নিচ্ছিল।” 

আকাশ আস্তে আস্তে মেঘলা হতে শুরু করল। দমকা বাতাসে আশেপাশের গাছগুলো হেলে পড়তে শুরু করল। কিন্তু কারও কোথাও যাওয়ার তাড়া নেই। তেরোজন জেল ভাঙা আসামী পাথরের মতো বশির জামানের পেছনে দাঁড়িয়ে আছে। যেন তাদেরকে সম্মোহন করা হয়েছে। স্থির চোখে ইকবালের কথা শুনছে সবাই। শংকর সাহা সহ উপস্থিত সবাই মনযোগী শ্রোতা। 

পরের সপ্তাহে বিস্ফোরক আসল। আমি গানপাউডার আর ডেটোনেটরগুলো সবজির ভেতরে লুকিয়ে ব্যারাকের পেছনে নিয়ে গেলাম। ব্যারাকের পেছনে জেনারেটর রুম ছিল। ওখানেই আমি ডিউটি শেষ করে এসে কাজ করতাম। বোমা বানানোর জন্য বিস্ফোরক দ্রব্যগুলো আসত প্ৰতি সপ্তাহে। কিন্তু অল্প-অল্প করে। তাই আমাকেও খুব অল্প অল্প কাজ করতে হত। তিনটা সি-ফোর বানাতে আমার সময় লেগে গেল টানা দুই মাস। তারপর আজ ভোরে রেশনের সাথে আসা একটা এরিয়াল ফোন আর চিরকুটে লেখা ছিল আমাকে কি কি করতে হবে। এরিয়াল ফোন চেনেন তো?” 

শংকর মাথা নাড়ল। না, তিনি আগে এরকম কিছু দেখেননি কিংবা এর নামও শোনেননি। 

“এরিয়াল ফোন হল একটা ছোট ইলেক্ট্রনিক ডিভাইস। এটা দিয়ে মোর্স কোডের মাধ্যমে ১০ শব্দের মেসেজ আদান প্রদান করা যায়,” ইকবাল বললেন। 

শংকর সাহেব মাথা নাড়লেন। অনুমান করে নিলেন বশিরের হাতে ধরা ওই ‘মোবাইলটাই’ এরিয়াল ফোন। চিরকুটগুলো যে মেজর ফিরোজের পাঠানো সেটাও তার বুঝতে বাকি থাকল না। 

প্রথমত এরিয়াল ফোনে মেসেজ আসার সাথে সাথে আমি সি-ফোরগুলো নিয়ে তৈরি হয়ে গেলাম। একটা ব্যারাকের সেই জেনারেটররুমে লাগালাম। দ্বিতীয়টার স্থান হলো জেলখানার উত্তরের প্রাচীর ঘেঁষা গাৰ্ডরুমে আর তৃতীয়টা মূল ভবনের সদর দরজায় যেখানে কয়েদীরা থাকত। তারপর অপেক্ষা করতে লাগলাম। সি-ফোরগুলো বিস্ফোরিত হওয়ার সাথে সাথে ভাঙা জেলখানা থেকে কয়েদীরা বের হয়ে আসে। হাতে অস্ত্র তুলে নেয়। তারপর বাকিটা তো দেখলেনই।” 

মেজর ইকবাল এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে গেলেন যেন তাকে অনেক আগে থেকেই মুখস্ত করানো হয়েছিল কথাগুলো। 

এই নিখুঁত পরিকল্পনা শুনে শংকর স্তব্ধ হয়ে গেলেন। হঠাৎ হাতের গোটানো আস্তিনে লুকানো মুঠোফোনটা আবার কাঁপতে শুরু করল। পিঠ চুলকানোর ভান করে মোবাইলটা পিঠের সাথে চেপে ধরতেই কোন একটা বাটনে চাপ পড়ল। ফোনের কাঁপুনি থেমে গেল। যেভাবেই হোক প্রধানমন্ত্রীকে জানাতেই হবে। সুযোগের জন্য ধৈর্য্য ধরতে হবে। কিন্তু কিভাবে? 

শংকর গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন, “বশির জামান সাহেব। একটু এদিকে আসবেন? কথা আছে।” 

বশির জামান এগিয়ে গেলেন। শংকর নিচু গলায় উপদেশ দেওয়ার ভঙ্গিতে বললেন, “এই কয়েদীগুলোর হাতে অস্ত্র দেওয়া কি খুব দরকার ছিল?” 

“আপনার কি মনে হয়?” 

“একটা পাগলা কুকুরকে কখনও বেল্ট ছাড়া রাখতে দেখেছেন কখনও ?”

“শংকরবাবু। এরা অপরাধী। এরা সাধারণত অবিশ্বাসে অভ্যস্ত। এদের হাতে অস্ত্র আমি দেইনি। মেজর ইকবালও দেয়নি। এরা নিজেরাই গার্ডদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়েছে। কিন্তু তারপরেও আমি এদেরকে কিছু বলিনি। কারণ, এরা বুঝেছে যে আমি এদেরকে বিশ্বাস করছি। এদের হাতে অস্ত্র দেখেও আমি কিছু বলছি না মানে, এদের কাছে আমার কোন স্বার্থ নেই। তাই আমি এদেরকে ভয় পাচ্ছি না। এরা বহুবছর রাজনৈতিক ঘুঁটি হিসাবে কাজ করেছে। এদের কাছে বিশ্বাস জিনিসটা অনেক মূল্যবান। আমি এতজন অপরাধীকে একা নিয়ন্ত্রণ করছি কারণ আমি তাদেরকে বিশ্বাস করাতে সক্ষম হয়েছি যে আমিও তাদের অপরাধেরই একটা অংশ।” 

“আপনি বলেছিলেন আপনি শুধু এদের সাথে কিছু কথা বলবেন। অথচ আপনি এদেরকে জেল ভেঙে বের করে আনলেন! আসলেই কি আপনার কোন স্বার্থ নেই?” 

“আছে। এরা আমাদের প্রায়শ্চিত্ত প্রকল্পের গিনিপিগ। এদেরকে দিয়েই পুরো মানবজাতির প্রায়শ্চিত্ত হবে।” 

শেষের কথাটা যেন খুব বেশি বিশ্বাস নিয়ে বললেন বশির জামান। মেজর ইকবালের দিকে তাকিয়ে কি যেন একটা ইশারা করলেন। তারপর শংকরের দিকে তাকিয়ে বললেন, “আপনাকে এত কিছু কেন বললাম, জানেন শংকর সাহেব? প্রায়শ্চিত্ত প্রকল্পের পুরো ব্যাপারটা আলফা লেভেলের সিক্রেট। এত গোপন একটা ব্যাপার এমন একজনকে কেন বললাম যে কিনা আমাকে একটা মাইনফিল্ডে এনে ফেলছিল আর যে কিনা এই পুরো ব্যাপারটা প্রধানমন্ত্রীকে জানানোর জন্য ছটফট করছে? কারণ আমি মৃত মানুষের কৌতূহল পুরণ করি। ইকবাল, ওর সেল ফোনটা নিয়ে নাও।” 

শংকরের মাথায় যেন বাজ পড়ল। বশির কিভাবে বুঝল তার মনের কথা? কিছু বলার আগেই মেজর ইকবাল বিদ্যুৎবেগে হাতের গোটানো আস্তিন থেকে সেলফোনটা একরকম ছিনিয়ে নিল। তারপর বশিরের হাতে দিল। বশির জামান তার আলাস্কান রোগারটা হোলস্টারে রাখতে রাখতে ফোনটা চেক করতে শুরু করলেন। ফোনের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ তার মুখমণ্ডলের মাংসপেশী শক্ত হয়ে গেল। মেজর ইকবালকে নিচু গলায় বললেন, “খবর পৌছে গেছে ইকবাল। আমি যাচ্ছি, তুমি আসো।” 

শংকর সাহেবের চোয়াল ঝুলে গেল। এই লোক কি অন্তর্যামী? শংকর নিজেকে আর সামলাতে পারলেন না, তোতলাতে শুরু করলেন। 

“আপনার, আপনার ভুল হচ্ছে। আমি, একবারও, শোনেন, কোথায় যাচ্ছেন?” শংকর সাহেব এলোমেলোভাবে কথাগুলো বলে ফেললেন। 

“আপনার প্রশ্ন করার সময় শেষ, শংকর সাহেব। আপনি এত বড় গাধা শংকর সাহেব! প্রধানমন্ত্রীকে বলতে যাচ্ছিলেন আপনি? প্রধানমন্ত্রী যদি জানতে পারেন যে আপনিই আমাকে জেলখানা চিনিয়ে এনেছিলেন তাহলে আপনার কি হত ভাবতে পেরেছেন? আমাকে প্রধানমন্ত্রী চেনেন না। চেনেন আপনাকে। আপনি এখন একজন জলজ্যান্ত খলনায়ক। আপনাকে এখন প্রধানমন্ত্রী শিকারী কুকুরের মত খুঁজবে শংকর সাহেব। এই তেরোজন কয়েদী অনেক রাজনৈতিক অপরাধের সাক্ষী। এরা মিডিয়ার হাতে গেলে কার্পেটের নিচে লুকানো অনেক নোংরা বেরিয়ে আসবে। আপনি সেই কুকুরগুলোকে খাঁচা ভেঙে ছেড়ে দিয়েছেন। আপনার রিভলভারটা এখানেই ফেলে রেখে গেলাম, যাতে তদন্তে বেরিয়ে আসে কে ছিল চৌদ্দ নম্বর গিনিপিগ।” 

শংকর সাহেবের মনে হল কেউ তার গলা চেপে ধরেছে। এটাতো একবারও তার মাথায় আসেনি। মেজর ফিরোজ তাহলে তাকে কাল মিথ্যা বলেছিলেন! তিনি কি এগুলো আগে থেকেই জানতেন? শুধুমাত্র তাকে ব্যবহার করার জন্যই এই পরিকল্পনাটা লুকিয়েছিলেন তিনি? তার ভেতরটা কিছু একটা বলার জন্য ছটফট করে উঠল। কিন্তু গলা দিয়ে কোন আওয়াজ বের হল না। 

বশির জামান বললেন, “যাই হোক, আপনাকে এগুলো বলা দুটো কারণে। এক, আমাদের পরিকল্পনা নিয়ে আপনার যে ধারনা ছিল সেটা ভাঙা দরকার ছিল। আর দ্বিতীয় কারণ হল, আমি মৃত মানুষের কৌতূহল পুরণ করি। পরপারে এগুলো হয়ত আপনার কাজে লাগবে। হয়ত আমাদের আর দেখা হচ্ছে না। আপনার ওই নিঃশ্বাসের দামগুলো আমি নিয়ে গেলাম। আর হ্যাঁ, ধন্যবাদ।” 

শংকরের হৃৎস্পন্দন থেমে গেল। পরপারে কাজে লাগবে মানে? শংকর সাহেব কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন, “আমি মেজর জেনারেলের সাথে কথা বলতে চাই। উনি বলেছিলেন উনি আমার আর আমার পরিবারের নিরাপত্তা দেবেন।” 

বশির জামান কিছু না বলে কয়েদীদের দিকে হাঁটা শুরু করলেন। শংকর নিজের ওপরে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে রাগে ক্ষোভে একটা গালি দিয়ে বশিরের দিকে হাত বাড়াচ্ছিলেন। কয়েক পা সামনে এগিয়ে যেতেই মেজর ইকবালের এলএমজির বাঁটের গুঁতো গিয়ে পড়ল শংকরের বাম কাঁধে। শংকর মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন। ব্যথায় মুখ দিয়ে একটা বিকৃত আওয়াজ বেরিয়ে এলো। 

ঝমঝম করে বৃষ্টি নামলো। 

শংকর দেখলেন, বশির জামান কয়েদীদেরকে কিছু একটা বললেন। তারপর কয়েদীদেরকে নিয়ে হাঁটতে শুরু করলেন। দেখে মনে হল স্বয়ং মোজেস তার অনুসারীদেরকে নিয়ে মিশর ছেড়ে বেরিয়ে যাচ্ছেন। 

বৃষ্টির ভেতরে খুব তাড়াতাড়িই যেন হারিয়ে গেল মানুষগুলো। শংকর প্রানপণে মাটিতে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলেন। কাদা মাটিতে তার হাত জোড়া বেশ খানিকটা দেবে গেল। মেজর ইকবালের ভারি এলএমজির বাঁটের আঘাত এসে পড়ল শংকরের কোমরে। অবর্ণনীয় ব্যথায় বাঁকা হয়ে আবার ভূলুণ্ঠিত হলেন শংকর। বামহাতের ওপরে ইকবালের বুটের ভারি স্পর্শ অনুভব করলেন তিনি। চোখের সামনে একমাত্র মেয়ে সুতপার মুখটা ভেসে উঠল। দপ করে যেন মনের গভীরে নিভতে থাকা প্রদীপটা একটু জ্বলে উঠল। শংকর দাঁতে দাঁত চেপে কাত হলেন। তারপর ডান পা দিয়ে সজোরে একটা লাথি চালালেন মেজর ইকবালের হাঁটু বরাবর। আর বাম পা দিয়ে একটা লাথি চালালেন মেজর ইকবালের উরুসন্ধি বরাবর। কিন্তু দ্বিতীয় লাথিটা গিয়ে লাগল ইকবালের বাম উরুতে। 

মেজর ইকবাল এটা আশা করেনি। মুহূর্তের জন্য পড়ে যেতে গিয়েও তাল সামলে এলএমজির বাঁট চালালেন শংকরের মাথা বরাবর। শংকর মাথা সরিয়ে ফেলাতে এলএমজির ভারী বাঁট গিয়ে পড়ল কাদামাটিতে। শংকর শরীরের শেষ শক্তি দিয়ে এবার ইকবালের ডান পাঁজর বরাবর লাথি চালালেন। কিন্তু এটা আগেরটার মত শক্তিশালী হল না। ইকবাল এলএমজি ফেলে দিয়ে শংকরের শরীরের দুই পাশে পা দিয়ে শংকরের গায়ের ওপরে উঠে বসতে যাচ্ছিলেন। শংকর চিন্তা করলেন, সামান্য একটা গুলি করেই তো তাকে শেষ করা যায়। সেটা না করে ইকবাল কেন এত কষ্ট করছে? তাহলে কি এলএমজিতে গুলি নেই? শংকর ডান হাতের আঙুল চালালেন ইকবালের গলা বরাবর। এইবার কাজ হল। প্রচণ্ড ব্যথায় ইকবালের মাথা নিচু হতেই তারপরের আঘাতটা করলেন শংকর। ডানহাতের আঙুল দিয়ে চোখে খোঁচা মারতেই ইকবাল দুই হাতে মুখ ঢেকে পড়ে গেল। মুখ দিয়ে বেরিয়ে এলো আর্তনাদ। দৈত্যের মতো পেশীবহুল শরীরটা বৃষ্টি ভেজা নরম মাটিতে পড়ে গেল। কিন্তু নিজেকে সামলাতে দেরি করল না মেজর ইকবাল। মাথা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে আবার উঠে দাঁড়াল। 

কিন্তু ততক্ষনে শংকর নিজেকে ঠেলে দিয়েছে ঢালু জমির দিকে। গড়াতে গড়াতে নিচে পড়তে শুরু করেছে শংকরের শরীর। উঠে দাঁড়াতে পারছেন না তিনি। কোমর থেকে শরীরের নিচের অংশ অবশ হয়ে গিয়েছে। কিন্তু যেভাবেই হোক তাকে বাঁচতেই হবে। 

গড়াতে গড়াতে শরীরটা একটা ঝোপের ওপরে গিয়ে পড়ল। শংকর কোনরকমে দুই হাতে ভর দিয়ে হামাগুড়ি দিতে লাগলেন। সামনে পাথুরে জমি। এখান থেকে গড়িয়ে নিচে নামতে গেলে অনেক বেশি আহত হওয়ার সম্ভাবনা আছে। মৃত্যুও হতে পারে। পেছনে তাকালেন শংকর। মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। মেজর ইকবালকে আর দেখা যাচ্ছে না এখান থেকে। 

শংকর হামাগুড়ি দিয়ে ঝোপের ভেতরে ঢুকে পড়লেন। হঠাৎ টরর টর করে আওয়াজ হল। তারমানে এলএমজিতে গুলি আছে। শংকরের কিছুক্ষণ আগে করা অনুমান ভুল প্রমাডুত করে বামদিকের ঝোপে গুলি লাগল। ভেজামাটিতে গুলি পড়তেই থকথক করে শব্দ হল। ইকবালের এলএমজিতে এখনও গুলি আছে। আর সে গুলি করতে করতে ঢাল বেয়ে নেমে আসছে। 

শংকর নিজের দুই হাতে ভর দিয়ে শরীরটাকে টেনে আরও নিচে নামতে লাগলেন। শরীরের নিম্নাংশ যেন পাথরের চেয়েও ভারী। শংকরের হঠাৎ মনে হল, আশেপাশে কোথাও সেই মাইনফিল্ডটা আছে। ওখানে নেমে পড়তে পারলে দুইজনের জীবন মরণের সম্ভাবনা অর্ধেকে নামিয়ে আনা যাবে। কিন্তু বৃষ্টি শংকরের কাজটা আরও কঠিন করে দিল। 

শংকর জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ঝোপের ভেতর থেকে বের হলেন। টররটরর। এলএমজির গুলি শংকরের ডান কাঁধের মাংস ছিঁড়ে বেরিয়ে গেল। শংকর কিছু বুঝে ওঠার আগেই আরও কয়েকটা গুলি তার পিঠ আর ডান হাত ভেদ করে বেরিয়ে গেল। লাল রক্ত ছিটকে পড়ল। একটা জান্তব চিৎকার চাপা পড়ে গেল গুরুগম্ভীর মন্ত্রে। 

শংকরের দেহটা একটা তুলার পুতুলের মত পাথুরে ঢালে ধাক্কা খেতে খেতে নিচের বনে হারিয়ে গেল। 

সেই মানুষখেকো বনে। যেখান থেকে কোন মানুষ কখনও ফিরে আসেনি। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *