চোর

চোর

রিকশায় ওঠার সময় পায়ে কী যেন বাধলো। মবিন প্রায় উল্টে পড়ে যাচ্ছিল। নিজেকে সামলে নিয়ে দেখে পায়ের কাছে মেয়েদের একটা বাহারি হ্যান্ডব্যাগ। অষ্টম আশ্চর্যের কাছাকাছি ঘটনা। ঢাকা শহরে রাস্তায় এমন সুন্দর একটা হ্যান্ডব্যাগ পড়ে থাকবে আর কেউ কুড়িয়ে নেবে না তা হয় না। হাত থেকেই টেনে ব্যাগ নিয়ে যায়। আর এটাতো পড়ে আছে রাস্তায়। মবিন নিচু হয়ে ব্যাগ হাতে নিলো। বেশ ভারি ব্যাগ। ঈদের বাজার শুরু হয়েছে। মেয়েরা এখন ব্যাগ ভর্তি টাকা নিয়ে বের হয়। হাইজ্যাকারের ভয়ে গায়ের গয়না টয়নাও খুলে ব্যাগে রাখে। ভারি হওয়াই স্বাভাবিক। মবিন বেশ স্বাভাবিক ভঙ্গিতে রিকশায় উঠে বসলো। নিজেকে খানিকটা চোর চোর লাগছে। মনে হচ্ছে, এই বুঝি তীক্ষ্ণ মেয়েলী গলায় কেউ একজন চেঁচিয়ে বলবে–আপনি আমার। ব্যাগ নিয়ে কোথায় যাচ্ছেন?

কেউ কিছু বলল না। যার জিনিস সেকি দূর থেকে ব্যাপারটা লক্ষ্য করছে? অবাক হয়ে দেখছে নিতান্ত ভদ্র চেহারার একটা ছেলে ব্যাগ নিয়ে রিকশা করে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টায় আছে। সে বিস্ময়ে হতভম্ব বলে কিছু বলতে পারছে না। হতভম্ব ভাবটা কাটলেই চোর চোর বলে চেঁচিয়ে উঠবে। মেয়েদের ভীত গলার চিৎকার সাইরেনের চেয়েও ভয়াবহ। নিমিষের মধ্যেই লোকে লোকারণ্য হয়ে যাবে।

সময়টা ভর সন্ধ্যা। সন্ধ্যা হচ্ছে অস্থির ধরনের সময়। এই সময় লোকজন এক ধরনের অস্থিরতার ভিতর থাকে। চারপাশে তেমন করে দেখে না। মবিন মোটামুটি নিশ্চিত হলো, যার ব্যাগ সে আশপাশে নেই। থাকলে এতক্ষণে চেঁচিয়ে উঠতো। চুপচাপ অপেক্ষা করার মতো ধৈর্য কোনো মেয়ের নেই। মবিনের ধারণা, শুধু শিশু পালনের ক্ষেত্রেই মেয়েরা ধৈর্যশীলা–অন্য কোনো ক্ষেত্রে নয়।

রিকশাওয়ালা বলল, যাইবেন কই?

মবিন ঠিক মনে করতে পারল না কোথায় যাওয়ার জন্যে সে রিকশায় উঠেছে। মনে হচ্ছে টেনশানে তার ব্রেইন শর্টসার্কিট হয়ে গেছে। সে বলল, সামনে চলো—সামনে। রিকশা সামনে এগুচ্ছে না। চেইন পড়ে গেছে। রিকশাওয়ালা চেইন নিয়ে ঘটঘট করছে। তাড়াতাড়ি এখান থেকে সরে পড়া উচিত। সরে পড়া যাচ্ছে না। একটা

সামান্য চেইন ঠিক করতে রিকশাওয়ালা দেখি বুড়ো হয়ে যাচ্ছে। মবিন আশপাশে। তাকালো। তার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে কেউ তাকে অস্বাভাবিক চোখে দেখছে কিনা তা লক্ষ্য করা। সবার চোখই তার কাছে অস্বাভাবিক লাগছে। মবিনের তীব্র ইচ্ছা করছে। রিকশা থেকে নেমে লম্বা লম্বা পা ফেলে। যাকে বলে ক্রাইম স্পট থেকে পগার পাড়।

মবিন রাগি গলায় বলল, রিকশায় কী হয়েছে?

চেইন ছিলিপ কাটছে।

ছিলিপ কাটলে ছিলিপ ঠিক কর।

করতাছি।

যে সময় নিচ্ছ এই সময়ে তো একটা প্রমাণ সাইজের চেইন বানিয়ে ফেলা যায়।

বানাইতে পারলে বানান।

অন্য সময় হলে ফাজলামি ধরনের কথার কারণে রিকশাওয়ালা কঠিন ধমক খেতো। আজ মবিন ধমক দিতে পারল না। অপরিচিত একজনকে ধমক দিতে হলে রাগের একটা বিশেষ মাত্রা পর্যন্ত উঠতে হয়। রাগ সেই মাত্রায় উঠছে না। চোররা সহজে রাগ করতে পারে না। চোর টাইপের সব লোকই এই কারণে বিনয়ী। অত্যন্ত অপমানসূচক কথা শুনলেও তারা দাঁত কেলিয়ে হাসবে। ভাবটা এ রকম–যেন। অপমানটা সে ধরতে পারছে না।

রিকশার চেইন ঠিক হয়েছে। রিকশা চলতে শুরু করেছে। এখনো কেউ চোর চোর বলে চেঁচাচ্ছে না। আশ্চর্য ব্যাপারতো। মবিন কপালে হাত দিয়ে দেখলো তার কপাল ঘামছে। রিকশা যতই এগুচ্ছে ততই শরীর হালকা লাগছে। ফুরফুরে ভাব চলে আসছে। বৈশাখ মাসের দারুন গরমের পর হঠাৎ যেন দক্ষিণ দিক থেকে খানিকটা হাওয়া চলে এসেছে। এই ব্যাপারটা নিশ্চয়ই হাইজ্যাকারদেরও হয়। তাদের আরো বেশি হওয়ার কথা। হাইজ্যাকিং এর সময় ওদের টেনশান নিশ্চয়ই মবিনের টেনশানের চেয়ে অনেক বেশি থাকে। টেনশান মুক্তির আনন্দও সে কারণেই বেশি হবার কথা।

.

ট্রাফিক সিগন্যালে রিকশা থেমেছে। রাস্তার মোড় বলে আলো বেশি। ট্রাফিক পুলিশের পাশে একজন সার্জেন্টকে বিরস মুখে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যাচ্ছে। মবিনের বুকের ভেতর কোনো এক জায়গায় সিরসির করে উঠলো। পুলিশ দেখার কারণে বোধ হয়। তার কোলে ভ্যানিটি ব্যাগ চকচক করছে। চাদর গায়ে থাকলে ভালো হত। চাদরের নিচে ব্যাগ লুকিয়ে ফেলা যেত। লাল বাতি নিভে গিয়ে সবুজ বাতি জ্বলছে। রিকশাওয়ালা তবু রিকশা টানছে না। মবিন বলল, দাঁড়িয়ে আছ কেন? চলো।

রিকশাওয়ালা বলল, যাইবেন কই?

মবিন বলল, কোথাও যাব না। খানিকক্ষণ ঘুরব।

রিকশাওয়ালা ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো। যে সব যুবক রিকশায় করে অকারণে ঘুরতে চায় তাদের বিষয়ে সব রিকশাওয়ালাই সাবধান। দিনকাল ভাল না।

সব রিকশা গাড়ি চলছে আর তারটা দাঁড়িয়ে আছে। অস্বস্তিকর অবস্থা। ট্রাফিক পুলিশ তাকিয়ে আছে তাদের দিকে। এইবার সার্জেন্টও তাকাচ্ছে। তাদের দৃষ্টি যেন কেমন কেমন। মবিন রিকশাওয়ালাকে বলল, কী হলো?

রিকশাওয়ালা নির্বিকার গলায় বলল, চেইন ছিলিপ কাটছে।

মনে হচ্ছে চেইন ছিলিপ কাটায় সে আনন্দিত। পুলিশ সার্জেন্ট এগিয়ে আসছে তাদের দিকে। সে কি মবিনের দিকে তাকিয়ে সন্দেহজনক ভঙ্গিতে বলবে–আপনার হাতে মেয়েদের ব্যাগ কেন?

বলার কোনো কারণ নেই। পুরুষের হাতে মেয়েদের ব্যাগ থাকা নিষিদ্ধ কিছু না, থাকতে পারে। সে যদি মেয়েদের মতো ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে বসে থাকতো তাহলে চোখে পড়ার মতো ব্যাপার হতো। পুরুষ মানুষ ভাজ করা শাড়ি হাতে নিয়ে যেতে পারে কিন্তু শাড়ি পরে যেতে পারে না।

সার্জেন্ট এসেই রিকশাওয়ালার গালে ওজনদার এক চড় বসিয়ে দিয়ে বলল, হারামী চেইন ফেলনের জায়গা পাও না। রিকশা নিয়া দূরে যাও।

সার্জেন্ট অতঃপর যে কান্ডটি করলো তার জন্যে মবিন ঠিক প্রস্তুত ছিল না। সার্জেন্ট রিকশার পেছনে গিয়ে আচমকা একটা ধাক্কা দিলো। মবিন প্রায় হুমড়ি খেয়ে পড়তে গিয়ে নিজেকে সামলে নিলো। দু’টা কাজই ঘোরতর অন্যায়ের পর্যায়ে পড়ে। পুলিশ ব্রুটালিটি। মবিনের উচিত সার্জেন্টের সঙ্গে কিছু উত্তপ্ত কথাবার্তা বলা। পুলিশের সঙ্গে কথা কাটাকাটি করলে মানবিক দিক দিয়ে তৃপ্তি পাওয়া যায়। মনে হয় একটা সকাজ করা হয়েছে। মবিন সে রকম কিছুই করলো না। বরং সার্জেন্টের দিকে তাকিয়ে এমন ভঙ্গিতে হাসলো যার অর্থ, স্যার খুব ভালো করেছেন। ঢাকা শহরটা রিকশাওয়ালারা নষ্ট করে ফেলছে। ব্যাটাকে আরো চড় দেন। এক চড়ে ওর শিক্ষা হবে না। গোটা পাঁচেক চড় দরকার।

মবিনের রিকশা রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে। রিকশাওয়ালা গেছে ইটের সন্ধানে। ইট দিয়ে বাড়ি না দিলে নাকি চেইন ঠিক হবে না। মবিন অস্বস্তি নিয়ে বসে আছে, কারণ সার্জেন্ট কাছেই দাঁড়িয়ে। কয়েকবার দেখলো মবিনকে। সরু চোখে দেখা। তার মনে কি কোনো রকম সন্দেহ দেখা দিয়েছে? মবিনের চেহারায় কি চোর চোর ছাপ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে? যে ছাপ শুধু পুলিশের পক্ষেই বোঝা সম্ভব। সাপের হাঁচি বেদেয় চেনে। ঈদের বাজারে প্রচুর ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটছে। তার হাতে মেয়েদের ব্যাগ দেখে পুলিশের সন্দেহ হওয়া স্বাভাবিক যে সে ব্যাগ ছিনতাই করে রিকশা নিয়ে পালাচ্ছে। সার্জেন্ট যদি কাছে এসে জিজ্ঞেস করে, আপনার হাতের ব্যাগটা কার? তাহলে সে কি বলবে? এমনো তো হতে পারে যে, ব্যাগে প্রচুর টাকা পয়সা গয়না-টয়না ছিল। যার ব্যাগ সে ব্যাগের বর্ণনা দিয়ে থানায় ডাইরী করিয়েছে। ওয়াকিটকির মাধ্যমে সে খবর সব পুলিশ সার্জেন্টের কাছ চলে গিয়েছে। বাংলাদেশের পুলিশ বড় চোর ধরতে পারে না। ছোট চোর চট করে ধরে ফেলে। তাছাড়া মবিন আয়নায় নিজেকে না দেখেই পরিষ্কার বুঝতে পারছে, তার চেহারায় একটা কাচুমাচু ভাব চলে এসেছে।

মাসখানেক আগে এ রকম একটা ব্যাপার হলো। দুপুর বেলা তার ঘরে কয়েক বন্ধু মিলে অনেকক্ষণ আড্ডা দিল। বন্ধুদের মধ্যে ছিল রশীদ। বিরাট মালদার। বাপের কন্ট্রাকটারিতে নেমে ভাল পয়সা কামাচ্ছে। আটমাসের গর্ভবতী মেয়েদের মতো পেট মোটা মানিব্যাগ পকেটে নিয়ে সে ঘোরে। কৃপণের হাড্ডি। একটা পয়সা বের করে না। বন্ধুরা চলে যাওয়ার পর বিস্ময় ও আনন্দ নিয়ে মবিন দেখলো রশীদের গর্ভবতী মানিব্যাগ মেঝেতে পড়ে আছে। সে ইচ্ছা করলেই রাস্তা থেকে ডাক দিয়ে রশীদকে। নিয়ে আসতে পারতো। তা করলো না। মানিব্যাগ খুলে ভেতরটা দেখলো। কাগজপত্রে ঠাসা, আসল জিনিস তেমন নেই। চারটা ৫০০ টাকার নোট, একটা ১০০ টাকার। নোট। তিনটা অতি ময়লা দু টাকার নোট। মবিন মানিব্যাগটা তোষকের নিচে ঠেলে দিল। তার প্রায় ঘন্টা খানিক পর রশীদ এসে উপস্থিত। মুখ চোখ শুকনা।

দোস্ত, তোর এখানে মানিব্যাগ ফেলে গেছি।

 মবিন অবাক হওয়ার ভঙ্গি করে বলল, কই? না তো।

মবিনের চেহারায় তখন নিশ্চয়ই কাচুমাচু ভাব কিংবা চোর ভাব ছিল। কারণ রশীদ বলল, দোস্ত টাকা পয়সা কোনো ব্যাপার না। জরুরি কিছু কাগজপত্র ছিল।

অত্যন্ত অপমানসূচক কথা। প্রকারান্তরে বলে দেয়া–টাকাগুলো রেখে মানিব্যাগ ফেরত দাও। এ রকম কঠিন অপমানও মবিন গায়ে মাখলো না। সে ক্ষীণ গলায় বলল, এখানে ফেলিসনি–বাইরে কোথায় ফেলেছিস।

খুব জরুরি কিছু কাগজ ছিল।

তুই নিজেই পরীক্ষা করে দেখ। থাকলে তো মেঝেতেই থাকবে।

এই বলেই মবিন মাথা নিচু করে মেঝেতে মানিব্যাগ খুঁজতে লাগলো। মবিনের বুক এমন ধক ধক করছিল যে মবিনের মনে হলো রশীদ তার বুকের ধক ধক শব্দ পরিষ্কার শুনতে পাচ্ছে।

.

এখনো মবিনের বুকে ধক ধক শব্দ হচ্ছে। এটা তার বুকের শব্দ, না রিকশাওয়ালা যে ইট দিয়ে চেইন বাড়ি দিচ্ছে তার শব্দ, মবিন ঠিক বুঝতে পারছে না। সার্জেন্টটা তাকিয়ে আছে তাদের দিকে। মবিনের, অস্বস্তি লাগছ। একটা সিগারেট ধরাতে পারলে ভালো হতো। সঙ্গে সিগারেট আছে। ধরাতে গেলে হ্যান্ডব্যাগটা খুলে রিকশার সিটে রাখতে হয়। তাতে ব্যাগটার উপর সার্জেন্টের নজর পড়ার সম্ভাবনা। তা করা ঠিক হবে না।

 শেষ পর্যন্ত চেইন ঠিক হয়েছে। রিকশা চলতে শুরু করেছে। মবিন সিগারেট ধরালো। ভালো সিগারেট। বেনসন। রশীদের মানিব্যাগ পাওয়ায় রক্ষা। কিছুদিন ভালো সিগারেট খাওয়া গেল। ক্ষতি একটা হয়েছে–রশীদের সঙ্গে সম্পর্ক নষ্ট হয়ে গেছে। সে ঠিক সন্দেহ করেছে। ভুলেও আর মবিনের বাসায় আসে না। সেদিন তার বাসায় কী একটা খাওয়া দাওয়া ছিল। বন্ধু বান্ধব সবাইকে বলেছে, মবিনকে বলেনি। পথে ঘাটে দেখা হলে এমনভাবে তাকায় যেন চিনতে পারছে না।

রশীদের মানিব্যাগ না নিয়ে তার উপায় ছিল না। প্রতিটি পয়সা বাবার কাছে চেয়ে নিতে হয়। চুল কাটতে হবে, ১০ টাকার কমে চুল কাটা যায় না। মবিন যদি তা মা’র কাছে চায় তিনি খুবই অবাক হয়ে বলেন, আমার কাছে টাকা চাচ্ছিস কেনরে? আমি টাকা পয়সার কী জানি? তোর বাবার কাছে থেকে নে। ক্লাস থ্রী ফোরে পড়ার সময় বাবার কাছ থেকে চুল কাটার টাকা চাওয়া যায়। কিন্তু তিন বছর আগে এম, এ পাস করে বসে থাকা একজনের পক্ষে বাবার কাছে চুল কাটার টাকা চাওয়া ভয়াবহ ব্যাপার।

মবিন চুল কাটার জন্যে টাকা চাইলে তিনি টাকা দেন। তবে চাওয়া মাত্র দেন না। অনেক জেরাটেরা করেন।

চুল কাটতে দশ টাকা লাগবে কেন? এয়ার কন্ডিশন্ড সেলুনে বসে চুল কাটবি? দু টাকা দিলেই তো চুল কেটে দেয়।

টাকা দেয়ার পর শুকনো গলায় বলেন, আর কত দিন এভাবে চলবে? ডু সামথিং ইয়াং ম্যান। শো মি সাম ফায়ার।

ফায়ার দেখানোর চেষ্টা মবিন করছে না তা না। তিন বছর ধরে করছে। তার কাঠ ভেজা। তিন বছরেও আগুন জ্বলছে না, শুধু ধোয়া বেরুচ্ছে। সে করবে কি?

.

মবিনের বাবা মোবারক হোসেন ঢাকার একটা মেয়ে কলেজের ইংরেজী ভাষা ও সাহিত্যের অধ্যাপক। সাহিত্যের অধ্যাপক মানেই আবেগ টাবেগ আছে বলে ধারণা। করা হয়। এ ধারণা যে কত ভুল তা মোবারক সাহেবকে না দেখলে বোঝা মুশকিল। বাসায় তিনি কখনো হাসেন না। পরিবারের সবার সঙ্গে যে ব্যবহার করেন তা শুধু ইংরেজী ভাষা ও সাহিত্য কেন যে কোনো বিষয়ের অধ্যাপকের জন্যেই মানান সই নয়। তরকারীতে তেল বেশি হয়ে গেলে স্ত্রীকে ডেকে শান্ত গলায় বলেন, এক মাসের তেল একদিনে খরচ করার জন্যে কেনা হয়নি। তোমার হাতে তেল মশলা বেশি খরচ হয় এই কথা আমি এ পর্যন্ত এক লাখ বার বলেছি। আর বলব না। আবার তেল বেশি হলে ঘর থেকে বিদায় করে দেব। স্ট্রেইট ইন দি স্ট্রিট। অ্যান্ড দিস ইজ ফাইন্যাল।

মোবারক হোসেন সাহেবের রোজগার খারাপ না। কলেজের বেতন ছাড়াও প্রাইভেট টিউশানি করে ভালো টাকা পান। সপ্তাহে তিনদিন বিকেলে তার বাসায় রীতিমতো ক্লাস বসে–রবি, সোম আর মঙ্গল। শুধু বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় একজন ছাত্রী পড়তে আসে। বড়লোকের কোনো মেয়ে হবে। লাল রঙের গাড়িতে করে আসে, গাড়ি করে যায়।

তিনি ইস্ত্রি করা পাঞ্জাবি পরে হাসি মুখে ছাত্রীদের পড়ান। এই সময় তিনি গায়ে খানিকটা সেন্টও মাখেন। পড়াতে গিয়ে মাঝে মাঝেই মজার মজার কিছু কথাও বলেন বলে মনে হয়। কারণ প্রায়ই তার ছাত্রীদের কুটিকুটি হাসি শোনা যায়। যতক্ষণ পড়ান ততক্ষণই তার স্ত্রী পর্দার ওপাশের বারান্দায় ঘোরাঘুরি করেন। স্বামীর হাসির কথায় ছাত্রীরা হাসে, তিনি হন বিস্মিত। তিনি কখনো স্বামীর কোন কথায় হাসতে পারেননি।

মবিন বাসায় ফিরে দেখে গেটের কাছে লাল গাড়ি। বসার ঘরে আলো জ্বলছে। তার মানে আজ বৃহস্পতিবার। বাবার কাছে ছাত্রী এসেছে। বাবার এই ছাত্রীর নাম মীরা। সে অসম্ভব রূপবতী। এই সময় তাদের সামনে দিয়ে ঘরে ঢোকা যাবে না। মোবারক হোসেন সাহেব তাকে দেখলেই অদ্ভুত ভঙ্গিতে তাকাবেন এবং অতি অবশ্যই বলবেন–কোত্থেকে ফিরলি? ডু সামথিং ইয়াংম্যান। শো মি সাম ফায়ার। রূপবতীদের সামনে অপমানিত হতে ভাল লাগে না।

মবিন বাড়ির পেছনে রান্নাঘরের কাছের দরজা দিয়ে চুপিচুপি ঘরে ঢুকলো। বাসায় কোনো চোর ঢুকলে এভাবেই হয়তো ঢুকতো। মবিনের মা রান্নাঘরের বারান্দায় বসেছিলেন। তাকে পাশ কাটিয়ে মবিন নিজের ঘরে চলে গেল। একজন কেউ যে ঘরে ঢুকেছে মবিনের মা বুঝতেও পারলেন না।

মবিনের ঘর বসার ঘরের পাশে। সে বাতি জ্বালালো না। বাতি জ্বালালেই উপস্থিতি জানান দেওয়া হবে। দরকার কি? মেয়েদের বাহারী হ্যান্ডব্যাগটা সে খাটের নিচে লুকিয়ে ফেলল। ভিতরে কী আছে তা এখনি দেখার দরকার নেই। এক সময় দেখলেই হবে। কিছু না কিছু তো থাকবেই। কপাল ভালো থাকলে বেশ কিছুদিন বাবার কাছে সেলুনে চুল কাটার টাকা চাইতে হবে না। বাবা তাকে বলতে পারবেন না–শো মি সাম ফায়ার, ইয়াং ম্যান।

মবিন তার বিছানায় লম্বা হয়ে শুয়ে পড়েছে। পাশের ঘরে বাবা ছাত্রী পড়াচ্ছেন। বাবার গলার স্বর পরিষ্কার। ঝন ঝন করে বাজছে। তিনি বলছেন–শোন মীরা, এক্সপ্রেশনিস্টরা কাজ করে ডিস্টরশন আর এক্সাজারেশন নিয়ে। এক্সপ্রেশনিজম হলো জার্মানদের আন্দোলন। ফিউচারিজম হলো ফরাসীদের। বাঙালী কবিদের কেউ কেউ এক্সপ্রেশনিস্ট ধারায় কবিতা লিখেছেন। যেমন ধর আমাদের জীবনানন্দ। আট বছর আগের একদিন কবিতাটার কথা মনে আছে?

শোনা গেলো লাশ কাটা ঘরে
নিয়ে গেছে তারে
কাল রাতে ফাল্গুনের রাতের আধারে…

মোবারক হোসেন সাহেব কবিতা আবৃত্তি করে যাচ্ছেন। বাবার ছাত্রীর সঙ্গে মবিনও কবিতা শুনছে। তার কবিতা শুনতে বেশ ভালো লাগছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *