চোর-পুলিশ – প্রতুলচন্দ্র গুপ্ত
সমস্ত রাত বৃষ্টি হয়েছে। সকালবেলার দিকে জল একটু ধরেছে, অনেক রুটের ট্রাম এখনও বন্ধ। ইন্সপেক্টর নাড়ুগোপাল বর্ষাতি গায়ে জড়িয়ে গামবুট পরে ছপ ছপ করে জল ভেঙে তার আপিস অর্থাৎ থানায় গিয়ে পৌঁছল। বিধান সরণি থেকে তার আপিস দু’ মিনিটের পথ। ঠেলাগাড়ি, বিকশার ভিড় ঠেলে আপিসের ভিতরে ঢুকল। নিজের ঘরে বর্ষাতিটা টাঙিয়ে রাখতে রাখতে শুনল, বড়বাবু তাকে তলব দিয়েছেন। বড়বাবু লোকটি ভাল। মাথায় টাক, কাঁচা-পাকা গোঁফ, হৃষ্টপুষ্ট চেহারা, দেখলে মনে হয় নিতান্ত ভালমানুষ, সাতেও নেই পাঁচেও নেই। দরকারের সময় মুখ খুব মিষ্টি। নাড়ুগোপালকে ঘরে ঢুকতে দেখে বললেন, “এই যে এসো নাড়ুগোপাল।”
নাড়ুগোপাল বলল, “আমাকে ডেকেছেন সার?”
বড়বাবু বললেন, “ডেকেছি কি আর সাধে, আমি কেন, লালবাজারের ডাকও বলতে পারো। তাদের এক্ষুনি একটা সরকারি রিপোর্ট দরকার। দিল্লি থেকে চেয়ে পাঠিয়েছে। কিন্তু চাইলে কী হবে? রিপোর্ট লালবাজারে নেই, সরকারি মহাফেজখানাতেও নেই, একমাত্র ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে আছে। তাদের ডিরেক্টরকে ফোন করেছিলাম। ভদ্রলোক বললেন, নকল দিতে দেরি হবে, তাঁদের মেশিন খারাপ হয়ে রয়েছে; তবে এক্ষুনি লোক পাঠালে দেখে যেতে পারে, বের করে রাখা আছে। পুরনো কী ইতিহাসের ব্যাপার। তুমিও তো ইতিহাসের ছাত্র ছিলে। ওদের ডিরেক্টরও তো শুনেছি ইতিহাস পড়াতেন। চেনো নাকি ওঁকে?”
নাড়ুগোপাল বলল, “না সার, তবে নাম শুনেছি।”
বড়বাবু বললেন, “আমাদের ভ্যান যাচ্ছে ওদিকে, তোমাকে পৌঁছে দেবে। আসার সময় জল কমে যাবে, তুমি কিছু একটা ধরে চলে এসো। ওদিকে তো জল বিশেষ জমে না, যত জল আমাদের পাড়ায়।”
নাড়ুগোপাল বলল, “হ্যাঁ সার, আমি এক্ষুনি যাচ্ছি।”
ঘরে এসে এক পেয়ালা কড়া চা খেল। বর্ষাতিটা গায়ে চাপাল, গামবুট আবার পরল, তারপর সরকারি ভ্যানে করে বেলভেডিয়ারে ন্যাশনাল লাইব্রেরির সামনে এসে পৌঁছল। তখন সবে বারোটা বেজেছে।
ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে একজন মাঝারি বয়সের ভদ্রলোক বললেন, “মিস্টার শিকদার, আপনার কাগজ সব তৈরি আছে। আপনি নোট করে নিয়ে যান।” একতাড়া কাগজ, তাই নিয়ে লাইব্রেরির এক কোণে একটা টেবিলের সামনে বাবুটি নাড়ুগোপালকে বসালেন। নাড়ুগোপাল কাজে মন দিল। ঘণ্টাখানেক কাজ করার পর নাড়ুগোপাল বুঝতে পারল, দিনের আলো আরও কম হয়ে এসেছে। লাইব্রেরিতে পড়ুয়ার সংখ্যাও খুব কম। এই দুর্যোগে কে আর আসবে! পড়তে পড়তে তার মন অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছিল। কলেজে পড়বার সময় সে কবিতা লিখত। তার মনে হতে লাগল, এমন দিন কি সরকারি রিপোর্ট পড়বার জন্য সৃষ্টি হয়েছিল? লাইব্রেরির উপরে ঘন মেঘের ছায়া, থেকে থেকে চিড়িয়াখানা থেকে বাঁদরের চিৎকার আর বাঘের হুংকার শোনা যাচ্ছিল। নাভূগোপাল একবার হাতের ঘড়িটা দেখল, তারপর ওসব দিকে মন না দিয়ে কাজ শেষ করবার চেষ্টা করতে লাগল।
রিপোর্টটা বড়। তা পড়ে নোট নিতে ঘণ্টা দুয়েক কেটে গেল। শেষ হলে আবার ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল সওয়া দুটো বেজেছে। বৃষ্টিটা একটু ধরেছে মনে হচ্ছে। বাবুটিকে রিপোর্টের নকলের কথা আর একবার মনে করিয়ে দিয়ে সিঁড়ি ভেঙে নেমে এল। তার কিছুক্ষণ ধরে মনে হচ্ছিল খিদে পেয়েছে। সকালে বৃষ্টির জন্য বাজার হয়নি। নাড়ুগোপাল ভাবল, চিড়িয়াখানায় ঢুকলে বৃষ্টি থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে, কিছু ভাল করে খেয়েও নেওয়া যাবে। চিড়িয়াখানার গেটে এসে তার মত বদলাল, এখানে এক ‘বুড়ির চুল’ ছাড়া কিছুই সস্তা নয়। কী হবে অত পয়সা খরচ করে।
নাড়ুগোপাল একটু উলটো দিকে এগোল। ন্যাশনাল লাইব্রেরির পশ্চিমদিকে বড় রাস্তার উপর একটা পেট্রল পাম্প আছে, সেখানে কফি আর স্ন্যাক্স পাওয়া যায়। দাঁড়িয়ে খেতে হবে, তাতে কী। বৃষ্টির দিনে মাথার উপর একটা আচ্ছাদন তো থাকবে। সেখানে বেশ ভিড়। সে বুঝতে পারল তাকে অর্ডার দিতে হলে আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে। নাড়ুগোপাল যেখানে দাঁড়িয়েছিল সেখানে একটা অসুবিধা, রাস্তা দিয়ে জোরে গাড়ি চলে গেলে জল-কাদা তার গায়ে ছিটকে এসে লাগতে পারে। কিছুক্ষণ পরে সে দেখল, তার তিন-চারটে কাউন্টার দূরে এক ভদ্রলোক খাওয়া শেষ করে বেরিয়ে গেলেন, তাঁরও পরনে পুলিশের পোশাক। তাঁর মুখ নাড়ুগোপাল চিনতে পারল না। কলকাতায় তো কত ইন্সপেক্টর, সবার মুখ কি নাড়ুগোপাল চেনে? নাড়ুগোপাল সরে গিয়ে সেই জায়গায় দাঁড়াল। কুপন কিনে অর্ডার দিল। একটা মশলা দোসা ও এক পেয়ালা কফি। ওখানে দাঁড়িয়ে তার বর্ষাতির পকেট থেকে সেদিনকার খবরের কাগজ বার করল। সকালে তাড়াহুড়োয় ভাল করে পড়া হয়নি। এখন খেতে খেতে কাউন্টারের উপর কাগজটা ভাল করে খুলে ধরল। রাজনীতির খবর নয়, যে তিনটে খবর সে মন দিয়ে পড়ল, তার একটি হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞানের অধ্যাপক দুর্গাদাস রায় ক’দিন আগে বাড়ি থেকে নিখোঁজ হয়েছেন। কাগজে লিখেছে, এরকম আগেও হয়েছে কয়েকবার। রেগে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়ে কোনও ছাত্রের বাড়ি যেতেন। তক্তপোশ পাতা থাকলে সেখানে শুয়ে পড়তেন। ছাত্রকে বলতেন, ‘আজ তোমার এখানে খাব।’ খেয়েদেয়ে দুপুরে ঘুমিয়ে নিয়ে বিকেলে বাড়ি ফিরে যেতেন। ছাত্ররাই তাঁকে বাড়ি পৌঁছে দিত। তাঁর মনে থাকত না কেন সকালে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন। কিন্তু এবার কয়েকদিন হয়ে গেল অধ্যাপকমশাইয়ের কোনও খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। পুলিশ ছাত্রদের বাড়ি খোঁজ করে দেখেছে তিনি সেখানে যাননি। একজন ছাত্র আবার খবরের কাগজের রিপোর্টারকে বলেছে যে, তার বিশ্বাস পূর্ব ইউরোপের কোনও দেশ তার মাস্টারমশাইকে ভুলিয়ে ভালিয়ে নিয়ে গেছে, আর ফিরতে দিচ্ছে না। আর-একটি খবর বেরিয়েছে যে, কলকাতার জাদুঘর থেকে কিছু কিছু ছোট মূর্তি, সোনা বা অন্য ধাতুতে গড়া, হঠাৎ উধাও হয়ে গিয়েছে। পুলিশ খোঁজ করেও কোনও হদিশ করতে পারেনি। তৃতীয় খবর হচ্ছে যে, কলকাতার এয়ারপোর্টে একটি বেআইনি পাচারকারী দলের নেতা ধরা পড়েছে। তার সঙ্গে কয়েক লক্ষ টাকার হিরে ও বেশ কিছুটা হেরোইন।
এই খবরটি পড়ে নাড়ুগোপালের মুখে একটি হাসি দেখা গেল, কারণ একে ধরবার মূলে সেও ছিল। মামলার কবে শুনানি হবে কে জানে। তবে লোকটিকে জামিন দেওয়া হয়নি। পড়তে পড়তে নাড়ুগোপালের খাওয়া শেষ হয়ে গিয়েছিল। সে উঠে বড় রাস্তায় গিয়ে দাঁড়াল। দক্ষিণ দিক থেকে একটা বাস আসছিল। হাত বাড়িয়ে থামিয়ে সে বাসের পাদানিতে উঠে পড়ল। যে ছোকরা তাকে খাবার দিচ্ছিল, সে ছুটতে ছুটতে এসে কাউন্টারে ফেলে-আসা খবরের কাগজটা নাড়ুগোপালের হাতে “আপনার কাগজ সার” বলে গুঁজে দিল। নাড়ুগোপাল কাগজটা দরকার নেই বলে ফেলে এসেছিল, কিন্তু কিছু বলার আগেই বাস ছেড়ে দিল।
নাড়ুগোপাল কাগজটা তার বর্ষাতির পকেটে ফেলে একটা সিটে গিয়ে বসল। বৃষ্টি আবার চেপে এল। কিন্তু বেশি সময় লাগল না। মিনিট চল্লিশের মধ্যেই বাস তার থানার কাছে এসে দাঁড়াল। নাড়ুগোপাল ঘরে ঢুকে দু’বার হাঁচল; ভাবল পরে আর-এক পেয়ালা চা খেতে হবে। টিউনিকের পকেট থেকে লাইব্রেরিতে লেখা নোট বার করল। কাগজের প্যাড সামনে নিয়ে বসল। ভাবল, লিখে টাইপ করতে করতেই তো পাঁচটা বাজবে। তারপর লালবাজারে পৌঁছনো। সে অবশ্য বড়বাবুর কাজ। বর্ষাতির পকেটে হাত ঢুকিয়ে তার রুমালটা বার করতে গেল। সে দেখল, পকেটে রুমাল নেই কিন্তু কী একটা হাতে ঠেকল। বের করে দেখল তার সেই খবরের কাগজ। কাগজটা বার করতেই তার ভিতর থেকে একটা ছোট বেড়ালের মূর্তি বেরিয়ে পড়ল। ছোট বটে তবে বেশ ভারী। সেটা নিয়ে পাশের টেবিলে রামবাবুর কাছে গেল। গিয়ে বলল, “দেখুন তো দাদা, এটা কীসের তৈরি?” রামবাবু অনেকদিন পুলিশে চাকরি করছেন, কিন্তু উঁচুতে উঠতে পারেননি। রামবাবু বিরসমুখে জবাব দিলেন, “তুমিই দ্যাখো ভায়া। আমি মুখ লোক, কীই বা বুঝব।”
নাড়ুগোপাল মূর্তিটাকে খুব খুঁটিয়ে দেখল। মূর্তিটা যে বেড়ালের সে-বিষয়ে সন্দেহ নেই। মিশরে যেসব দেবদেবীর ছবি দেখেছে তার একটির কারও সঙ্গে মিল আছে। আমাদের দেশের কাবুলি বেড়ালের মতো নয়। এই মূর্তিটা তার পকেটে এল কী করে? যে ছোকরা খবরের কাগজে মূর্তিটা জড়িয়ে দিয়েছিল সে কি ইচ্ছে করেই দিয়েছিল, না তার অন্য কোনও উদ্দেশ্য ছিল? নাড়ুগোপালের হঠাৎ মনে পড়ল, তার মতো পুলিশের পোশাক পরা একজন লোক সেখান থেকে খাওয়া শেষ করে চলে গিয়েছিল। মূর্তিটা কি তার জন্য? ছেলেটি লোক ভুল করে তাকে দিয়েছে? কিন্তু তারই বা অর্থ কী?
নাড়ুগোপাল আবার মূর্তিটাকে খুঁটিয়ে দেখল, তারপর পকেটে নিয়ে বড়বাবুর কাছে গেল। বড়বাবু একটা চিঠি ডিকটেট করছিলেন। ওর দিকে ফিরে তাকালেন। নাড়ুগোপাল বলল, “একটু পরে বলছি।”
বড়বাবু কেরানিকে বললেন, “এটা টাইপ করে নিয়ে এসো। আমার তাড়া নেই, বাড়ি যাবার আগে দিলেই হবে।”
তারপর নাড়ুগোপালের দিকে তাকিয়ে বললেন, “রিপোর্ট লেখা হয়ে গেল এর মধ্যে?”
নাড়ুগোপাল বলল, “এইটে আগে দেখুন সার।” বলে পকেট থেকে মূর্তিটাকে বার করে বড়বাবুর সামনে টেবিলের উপর রেখে দিল।
বড়বাবু বললেন, “ওই পুতুলটাকে আবার আমার কাছে কেন নিয়ে এলে?” তারপরেই তাঁর মুখের ভাব বদলে গেল। মূর্তিটা হাতে নিয়ে বললেন, “বেশ ভারী তো, চকচক করছে। সোনার নাকি?”
নাড়ুগোপাল বলল, “বুঝতে পারছি না সার। খবরের কাগজ দেখেছেন?” এই বলে সেদিনের কাগজটা দেখাল।
বড়বাবু গম্ভীর মুখে বললেন, “হুঁ বুঝলাম।” অর্থাৎ কিছুই বোঝেননি, বললেন, “একবার দত্তসাহেবকে ফোন করে দেখি।” তিনি তাঁকে বললেন, “আমার আপিসের এক ছোকরা কী মূর্তি এনে হাজির করেছে। সোনার হতে পারে, ব্যাঙের মতো দেখতে।”
নাড়ুগোপাল বলল, “না সার, ব্যাঙ নয়, বেড়াল।”
বড়বাবু বললেন, “ওই হল, ইতর প্রাণী তো।”
তারপর কথা থামিয়ে নাড়ুগোপালকে বললেন, “তোমার ঘরে যাও। দত্তসাহেব কিছুক্ষণের মধ্যেই এসে পড়বেন, মূর্তিটা আমি রেখে দিচ্ছি।” এই বলে একটা স্টিল ক্যাবিনেট খুলে মূর্তিটা তার মধ্যে ঢুকিয়ে রাখলেন। তারপর নাড়ুগোপালকে বললেন, “বুঝলে হে নাড়ুগোপাল, মূর্তিটা সোনারও হতে পারে। হলে আশ্চর্য হব না। ক’ভরি হবে বলতে পারো?”
আধঘণ্টাটাক পরে মিস্টার দত্ত আপিসের গাড়ি করে থানায় এলেন। মিস্টার দত্ত পুলিশে কী করেন সে-কথা এখন বলা চলবে না। তিনি চান না সবাই জানুক যে, তিনি পুলিশে কাজ করেন। তাঁর আপিস লালবাজারে নয়। তিনি পুলিশের হয়ে অনেক গোপনীয় কাজ করেন, কিন্তু সে-কথা কোনও সরকারি নথিপত্রে লেখা থাকে না। লালবাজারে একটা নাম্বারে ফোন করলে তাঁকে পাওয়া যায়। একটা কোড নাম্বার আছে, সেটা বলা বারণ। তাঁর আপিস হচ্ছে শেক্সপিয়ার সরণিতে, একটা তেতলা ফ্ল্যাটে। ঢুকলে আপিস বলে মনে হবে না, মনে হবে যেন বসবার ঘর, অর্থাৎ একটা ছোট সেক্রেটারিয়েট টেবিল, খানকতক সোফা। লোক এলে সেই ঘরে দেখা করেন। ঘরে কোনও টেলিফোন নেই। এত ঝুঁকির কাজ যিনি করেন, তাঁর সুরক্ষার ব্যবস্থা থাকাই স্বাভাবিক। দরজার কাছে একজন লোক বসে থাকে, দেখলে মনে হবে বেয়ারা কিন্তু তার পকেটে সবসময় একটা রিভলভার থাকে। তার কথাবার্তা শুনে মনে হবে না যে, সে জীবনে এসব জিনিস চোখে দেখেছে। দরকার হলে সে চা-টা নিয়ে আসে, টেলিফোন ধরে। দত্তসাহেবের বসবার ঘরে একজন ছোকরা মতো লোক টাইপরাইটার নিয়ে বসে থাকে। মাঝে মাঝে খটখট করে টাইপ করে। তার পকেটেও রিভলভার থাকে, শুনেছি তার হাতের টিপ অব্যর্থ। কোনও লোক দত্তসাহেবের সঙ্গে কথা বলতে এলে সে বাইরে চলে যায়। দত্তসাহেবের টেবিলের তলায় একটা বোতাম আছে, যে চেয়ারে তিনি বসেন তার খুব কাছে। বোতাম টিপলে ঘরের সব কথা রেকর্ড হয়ে যায়। তা ছাড়া বাড়িতে আরও দু’জন লোক আছে দেখলে মনে হয় ফাইফরমাশ খাটে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তাদের কাজ অন্যরকম। দত্তসাহেব নিজে অবশ্য কোনও রিভলভার ব্যবহার করেন না। তাঁর পকেটে একটা-দুটো ফাউন্টেন পেন ও একটা ডায়েরি—তাতে এনগেজমেন্ট লেখা থাকে। এমনভাবে লেখা যে, সহজে পড়ে বোঝা যায় না। তাঁর ভিতরের ঘরও বইয়ে ঠাসা। বেশিরভাগই কেমিষ্ট্রি, শিকার ও অপরাধতত্ত্বের বই। এই ঘরের টেবিলের তলায় আরও একটা বোতাম আছে, তাতে কিছু রেকর্ড করা যায় না। সেটা টিপলে বাইরের ঘরে একটা আলো জ্বলে ওঠে, যার মানে তাঁর ঘরে কিছু অবাঞ্ছিত ব্যাপার ঘটছে, এখনই আসা দরকার। বাইরের লোক অনেকে ভাবেন দত্তসাহেব বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক, এখানে বসে কী সব সরকারি গবেষণা করেন।
দত্তসাহেব নাড়ুগোপালের ঘরে ঢুকে তাঁর সামনে বসলেন। মূর্তিটা টেবিলের উপর রেখে বললেন, “এটা কি ভাল করে দেখেছেন?”
নাড়ুগোপাল বলল, “আমাকে সার আপনি বলছেন কেন? আর লক্ষ করবার সময় পেলাম কোথায়? বড়বাবুকে দেখাতে তিনি তো ব্যাও বলে দেরাজে পুরে রাখলেন। এটা বেড়াল ছাড়া আর কিছু নয়।”
দত্তসাহেব বললেন, “বেড়ালই বটে। আপনি পুরনো ইজিপশিয়ান দেবদেবীর কথা পড়েননি? বেড়ালকে পুজো করা হত। আমাদের দেশেও বেড়ালকে ষষ্ঠীর বাহন হিসেবে খাতির করা হয়, তার চেয়ে বেশি কিছু নয়। আমরা বেড়াল পুষি, কিন্তু তাকে পুজো করি না। এবার বলুন তো ভাল করে গুছিয়ে, এটা কী করে এল আপনার পকেটে?” নাড়ুগোপাল সব খুলে বলল। ন্যাশনাল লাইব্রেরি থেকে কফি খেতে যাওয়া, লোকটার কাগজটা হাতে দেওয়া পর্যন্ত। দত্তসাহেব মন দিয়ে সব কথা শুনলেন। তারপর বললেন, “আর একজন পুলিশের লোক কফি খাচ্ছিলেন, তাকে ভাল করে লক্ষ করেছ? কীরকম দেখতে?”
নাড়ুগোপাল বলল, “প্রায় আমার সমান লম্বা। আর দেখার কথা বলছেন, পুলিশের পোশাক পরলে তার উপর বর্ষাতি গায়ে দেওয়া থাকলে সবাইকে প্রায় একইরকম লাগে। বড় গোঁফ কিংবা দাড়ি থাকলে অবশ্য তফাত করা যেত। পায়ের দিকটা তো লক্ষ করিনি, হয়তো আমার মতো গামবুটও পরা ছিল।”
দত্তসাহেব বললেন, “হঠাৎ দেখলে তোমার চেহারার সঙ্গে গুলিয়ে যেতে পারে?”
নাড়ুগোপাল বলল, “আগে তো সে-কথা মনে হয়নি সার। এখন বোধ হচ্ছে, হলেও হতে পারে। কাগজে মোড়া মূর্তিটা তা হলে বোধহয় ওর জন্যই। রাখা হয়েছিল, কারও ভুলে আমার পকেটে চলে এসেছে।”
দত্তসাহেব বললেন, “অসম্ভব নয়। যাই হোক, আমি এখন আপিসে ফিরে যাচ্ছি। মূর্তিটা এখন বড়বাবুর কাছে রইল। লালবাজার থেকে লোক আসবে, তাদের আমি বলে দেব, কী করতে হবে। তুমি একটু চোখ-কান সজাগ রাখবে। তুমি কে তা ওরা জানে না; কিন্তু জানতে কতক্ষণ।”
দত্তসাহেব তো চলে গেলেন। এদিকে প্রায় পাঁচটা বেজেছে। নাড়ুগোপাল রিপোর্ট নিয়ে বসেছে কিন্তু সে-কাজে তার মন বসছে না। পরদিন শনিবার। নাড়ুগোপাল সকালে উঠে দেখল, তার মাথা টিপটিপ করছে, ইনফ্লুয়েঞ্জার লক্ষণ। সেদিন আর আপিস গেল না। পরের দিন রবিবার তার আপিসে যাবার দরকার ছিল না। শরীরটা অনেক ঝরঝরে লাগছিল। জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখল মেঘের আস্তরণ সরে গিয়েছে। দুটো নারকেল গাছের মাথায় একচিলতে রোদ্দুর, সেদিকে তাকিয়ে তার মনে হল শরীর তো ভালই আছে, দিনটা নষ্ট করে কী হবে? তার চেয়ে একবার কেষ্টনগরে ঘুরে আসা যাক। কেষ্টনগর সরকারি হাসপাতালে তার এক দূর সম্পর্কের আত্মীয় চাকরি করেন, তিনি ডাক্তার। সকালের দিকে একটা ট্রেন ধরে রানাঘাটে বদল করে অন্য ট্রেন ধরতে হল। রানাঘাট স্টেশনে নেমে আলুভাজা আর এক পেয়ালা চা খেয়ে নিল।
খাওয়া শেষ না হতেই কেষ্টনগরের ট্রেন ছাড়বার সময় হয়ে গেল। সে ছুটতে ছুটতে শেষের দিকের একটা কামরায় উঠে পড়ল। কেষ্টনগরে পৌঁছে তো তার চক্ষুস্থির। গিয়ে দেখল জ্যাঠামশাই বাড়ি নেই। তিনি বাড়ি, ঘরদোর বন্ধ করে জ্যাঠাইমা ও ছেলেমেয়েদের নিয়ে ছুটির দিন কাটাতে কলকাতায় গিয়েছেন। অনেক রাত্তিরে ফিরবেন। বাড়িতে কেবল একজন আনকোরা কাজের লোক আছে, কাজেই নাড়ুগোপাল যা ভেবেছিল তা আর হল না। খানিকক্ষণ চুর্ণী নদীর কাছে ঘোরাঘুরি করতে লাগল। ছেলেবেলায় চুর্ণী নদী তার বেড়াবার প্রিয় জায়গা ছিল। এখন আর তত ভাল লাগল না। কেবল মনে হতে লাগল, কে যেন দূর থেকে তাকে লক্ষ করছে। কিন্তু এদিক-ওদিক তাকিয়ে কাউকে দেখতে পেল না। খানিকক্ষণ ঘুরে যেখানে মাটির পুতুল তৈরি হচ্ছে সেসব দিকে বেড়িয়ে বেলা থাকতে থাকতে স্টেশনে ফিরে এল। একটা ট্রেন প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে ছিল। সেটা সোজা কলকাতায় যাবে না, রানাঘাটে বদল করতে হবে। রানাঘাটে এসে দেখল কলকাতার ট্রেন আসবার সময় হয়ে গেছে। তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে ওভারব্রিজে উঠতে লাগল। ওভারব্রিজের উপরে উঠে আবার যখন নীচে নামতে যাচ্ছে তখন দেখল আর একটি লোকও কলকাতার ট্রেন ধরবার জন্য প্ল্যাটফর্মের দিকে যাচ্ছে। তবে কেমন চেনা চেনা লাগছে। পরনে ট্রাউজার ও বুশশার্ট। একটু পরে মনে হল, এ তো সেই লোক যে বেলভেডিয়ারে চা খেতে এসেছিল। এখন অবশ্য পরনে পুলিশের পোশাক নেই। নাড়ুগোপালও পুলিশের পোশাক পরে আসেনি। ট্রাউজারের সঙ্গে হাফশার্ট। ট্রেন যখন এল তখন দেখা গেল খুব ঠাসাঠাসি ভিড়। কয়েকজন নেমে গেল। নাড়ুগোপাল দেখল, সেই লোকটি কামরায় উঠে বসবার জায়গা পেয়েছে। নাড়ুগোপালও একটু ভেবে সেই কামরাতেই উঠল। মনে হল না তাকে কেউ চিনতে পারবে। তখন সব আসন ভরতি হয়ে গিয়েছে। নাড়ুগোপাল দরজার কাছে দাঁড়িয়ে রইল। লোকটা উলটো দিকের বেঞ্চিতে বসে ছিল। দেখলে চোর-ডাকাত বলে মনে হয় না। লম্বা-চওড়া চেহারা, শরীরের গাঁথুনি বেশ মজবুত, কিন্তু মনে হচ্ছে তার জামার তলায় একটা হলস্টার। হলস্টার তো একটা কাজেই ব্যবহার হয়, কিন্তু নাড়ুগোপাল একেবারে নিরস্ত্র। তার পকেটে পার্সে পঁচিশটা টাকা আর একটা ডটপেন; আর ট্রাউজারের পকেটে কিছু খুচরো পয়সা। এই সম্বল নিয়ে দরকার হলে সে কি ওই লোকটাকে আটকাতে পারবে? ইচ্ছে হল লোকটার পিছনে পিছনে গিয়ে দেখবে লোকটা কোথায় যায়। কিছু হদিশ মিলতে পারে। লোকটি যে সন্দেহ করতে পারে এ-কথা তার মনে হল না। শেয়ালদা স্টেশনে এসে নাড়ুগোপাল লোকটির পিছনে পিছনে চলল। ভাবল এক বাসে কিংবা ট্রামে চাপবে। তা ঠিক হল না। লোকটি স্টেশন থেকে বেরিয়েই একটা খালি ট্যাক্সি পেয়ে উঠে পড়ল। নাড়ুগোপালও ‘ট্যাক্সি, ট্যাক্সি’ করে চেঁচাতে লাগল, কিন্তু স্টেশনে ট্যাক্সি পাওয়া সবসময়ই কঠিন। লোকটি হুশ করে বেরিয়ে গেল।
সোমবার সকালে আপিসে এসে নাড়ুগোপাল দেখল, টেবিলে বড়বাবুর একটা স্লিপ রয়েছে। সে যেন একবার মিস্টার দত্তর আপিসে যায়। জরুরি তলব। দত্তসাহেব আরও জানিয়েছেন, সে যেন পুলিশের পোশাক পরে না যায়। নাড়ুগোপালের আগেই সে-কথা মনে হয়েছিল। সে সাদা পোশাক পরে বেরিয়ে গেল। গিয়ে শুনল দত্তসাহেবের সঙ্গে দেখা হবে না, তিনি আরও জরুরি কাজে কোথায় বেরিয়ে গিয়েছেন। আপিসে বলে গিয়েছেন, নাড়ুগোপাল পরদিন সকাল এগারোটায় যেন তাঁকে টেলিফোন করে।
নাড়ুগোপাল বোকা বোকা মুখ করে আপিসে চলে এল। ছুটি হওয়ার পর তার মনে হল মনটা খিঁচড়ে রয়েছে। একবার কোথাও আড্ডা দিতে পারলে হত। হঠাৎ মনে পড়ল বাগুইহাটিতে তার এক পুরনো বন্ধু থাকে। অনেকদিন বলেছে, তার বাড়ি দেখা করতে যাবে। ভাবল আজ তার বাড়িতে গিয়ে দেখা করে আসি-না, হলই বা দূর। সে বিধান সরণি থেকে বাস ধরল। বাস তাকে অরবিন্দ সেতুর উপর দিয়ে ভিআইপি রোডে এনে ফেলল। সে এসে বাগুইহাটিতে নামল। একটু হেঁটে গেলেই তার বন্ধুর বাড়ি। বাস-স্টপ থেকে বন্ধুর বাড়ি যেতে গেলে খানিকটা জলা জায়গা, খালি মাঠ, কয়েকটা চালাঘর পেরিয়ে যেতে হয়। একটু গিয়ে একটা বাঁক নিয়ে যা দেখল তাতে সে আর এগোল না, ওইখানেই দাঁড়িয়ে পড়ল। তার কাছ থেকে হাত-পঞ্চাশেক দূরে একটা পুরনো ভাঙা বাড়ি। একসময় কোনও বড়লোকের বাড়ি ছিল। অনেকদিন কেউ থাকে না, একটা দিক ভেঙে পড়েছে। সেইখানের একটা কোণে দাঁড়িয়ে সেই ভদ্রলোক, যার সঙ্গে আগে দু’বার দেখা হয়েছে, সে চুপ করে সিগারেট খাচ্ছে। সামনের দিকে তাকিয়েছিল বলে নাড়ুগোপালকে দেখতে পায়নি। নাড়ুগোপাল লক্ষ করল, আজকেও তার পরনে পুলিশের পোশাক নেই। একটু পরে সে হাতের সিগারেটটা ফেলে দিল। নাড়ুগোপালের মনে হল লোকটা ভাঙা বাড়ির মধ্যে ঢুকতে যাচ্ছে। এত কাছে এসে শিকার হাতছাড়া হয় দেখে নাড়ুগোপাল তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে দিল। প্রায় ছুটতে লাগল।
নাড়ুগোপালের পায়ের শব্দে লোকটা পিছন ফিরে তাকাল। সঙ্গে সঙ্গে নাড়ুগোপাল এক লাফে তার কলার চেপে ধরল। বলল, “চুপ করে থাকো, চেঁচিয়েছ কি পালাবার চেষ্টা করেছ কি মরেছ। তুমি কে আমার জানতে বাকি নেই। এখনই পুলিশের হাতে দিয়ে দেব।”
লোকটা কেমন বোকার মতো হয়ে গেল। বলল, “বিসওয়াস করুন।” সঙ্গে সঙ্গে একটা ব্যাপার ঘটে গেল। নাড়ুগোপালের মনে হল, তাকে কে যেন লোহার ডান্ডা দিয়ে পিছন থেকে মাথায় মারল। জ্ঞান হারিয়ে ফেলতে ফেলতে সে বুঝতে পারল, কাপড় দিয়ে তার মুখটা ঢেকে দেওয়া হল; টানতে টানতে তাকে যেন কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। তারপর আর কিছু মনে নেই।
পরের দিন যখন নাড়ুগোপালের ঘুম ভাঙল তখন মাথায় অসহ্য যন্ত্রণা। দেখল, সে হাসপাতালে একটা ঘরে শুয়ে আছে। তার বিছানার পাশে। চেয়ারে বড়বাবু বসে আছেন, দরজায় একজন পুলিশ দাঁড়িয়ে। বড়বাবু বললেন, “এই যে নাড়ুবাবু এতক্ষণে ঘুম ভাঙল? কেমন আছ? ভাল খেলা দেখালে যা হোক। তুমি লোক ধরতে গিয়েছিলে, নিজেই ধরা দিয়ে বসে আছ।”
নাড়ুগোপাল কী একটা বলবার চেষ্টা করছিল। বড়বাবু বললেন, “থাক, থাক, তোমাকে কথা বলতে হবে না, ডাক্তারের বারণ আছে। কাল দত্তসাহেবের সঙ্গে তোমার একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছিল না? সে তো রাখা গেল না। দত্তসাহেব কাল বিকেলে এখানে আসছেন কথা বলতে, ততক্ষণ চুপ করে থাকো, মাথা ঘামিয়ে দরকার নেই। যাক, তোমার মাথার কোনও ক্ষতি হয়নি, গ্রে ম্যাটার ঠিক আছে। সামান্য রক্তপাত হয়েছে। দু’দিনে সেরে উঠবে।”
বড়বাবু চলে গেলেন। নাড়ুগোপাল কিছু ভাবতে পারল না। মাথা ঠিক কাজ করছে না, সব কেমন গুলিয়ে যাচ্ছে। একটু পরে ঘুমিয়ে পড়ল। পরের দিন বিকেলে দত্তসাহেব দেখা দিলেন, বললেন, “কী, এখন অনেকটা ভাল তো? উঠে বসতে পারবে?”
নাড়ুগোপালের মনে হল তার মাথার যন্ত্রণা খানিকটা কমেছে। নাড়ুগোপাল কথা বলতে পারল। বলল, “দত্তসাহেব আমি কেসটা বোধহয় গুলিয়ে ফেলেছি।”
দত্তসাহেব বললেন, “গুলিয়ে ফেলতে আর পারলে কই? যা হবার তা ঠিকই হয়েছে। ডাক্তার আজকেও তোমাকে নড়াচড়া করতে বারণ করেছেন। কাল সকালে সাড়ে এগারোটা নাগাদ আমার কাছ থেকে লোক আসবে, তার সঙ্গে আমার আপিসে এসো। একটু তোমার কষ্ট হবে কিন্তু তারপর দিন পনেরো ছুটি নাও। ডাক্তার টাক্তার সব দেখিয়ো, ব্যবস্থা ঠিক হয়ে আছে।”
পরদিন সাড়ে দশটা নাগাদ দত্তসাহেবের আপিস থেকে একটা বড় গাড়ি এল। ড্রাইভারের পাশে একজন সিপাই আর দত্তসাহেবের আপিসের একজন লোক। নাড়ুগোপালকে একটু ধরতে হল, কিন্তু নিজেই লোকটির কাঁধে ভর দিয়ে এসে গাড়িতে উঠে বসল। দত্তসাহেবের আপিসে পৌছে নাড়ুগোপালকে দত্তসাহেবের ঘরে নিয়ে বসানো হল। ঢুকেই নাড়ুগোপাল দেখল দত্তসাহেব তাঁর টেবিলে বসে আছেন; তাঁর সামনে বড়বাবু। পাশের দরজা ঠেলে যে হাসতে হাসতে ঢুকল, তাকে দেখে তো নাড়ুগোপালের চক্ষুস্থির। এই সেই লোক যার সঙ্গে তার আলিপুরে দেখা হয়েছিল, পরে রানাঘাট স্টেশনে এবং ট্রেনেও, শেষ দেখা হয়েছিল বাগুইহাটির কাছে। আজ পরনে কিন্তু পুলিশের পোশাক। ভদ্রলোক ঘরে ঢুকেই বললেন, “নোমোস্কার ইন্সপেক্টর সাহাব। এইবার তো বুঝিয়েছেন আমি আপনার মতন একজন। খামোকা সেমসাইড গোল হয়ে গেল।”
দত্তসাহেব মুখ খুললেন। বললেন, “নাড়ুগোপাল, তুমি ইন্সপেক্টর চৌবেকে চেনো না। উনি উত্তরপ্রদেশের পুলিশের লোক। এই কেসের জন্য চার মাস আগে কলকাতায় এসেছেন। তুমি বোধহয় খুব অবাক হয়ে গেছ। রবিবার বাড়ি থেকে অন্তর্ধান হবার পর খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম, তুমি কেষ্টনগরে তোমার জ্যাঠামশাইয়ের বাড়িতে গিয়েছ। চৌবেকে তোমার খোঁজে পাঠালাম। একটু নজর রাখলে মন্দ কী! কোথায় ফ্যাসাদে পড়বে কে জানে? চৌবে তোমাকে জ্যাঠামশাইয়ের বাড়িতে পায়নি। তারপর খোঁজ করতে করতে চুর্ণী নদীর কাছে তোমাকে দেখতে পায়। যে কেষ্টনগরে যায় সে একবার সময় পেলে চুর্ণী নদীর ধারে ঘুরে আসে।”
ইন্সপেক্টর চৌবে বললেন, “হ্যাঁ, নাড়ুগোপালবাবু, আমিও পুলিশের লোক আছি। এই কেসের এক জরুরি কাজে সেদিন আমি চায়ের দোকান থেকে একটু আগে উঠে বাইরে গিয়েছিলাম। আমাকে একটা খবর ভেজবার কথা ছিল। যে গাড়িতে উঠলাম তাতে বেশি দূর যাইনি, কাছেই ছিলাম। দেখলাম দোকানের একটি ছোকরা খবরের কাগজে মোড়া একটা জিনিস আপনার হাতে দিয়ে গেল। বুঝলাম ঠিকই হয়েছে, পাত্তা মিলেছে।”
নাড়ুগোপাল বলল, “এ-কথা তো আপনি আমাকে বলেননি বাগুইহাটিতে।”
ইন্সপেক্টর চৌবে বললেন, “বলে কিছু ফায়দা হত না। আপনি বিসওয়াস করতেন না, খামোখা ঝামেলা বাড়ত।”
নাড়ুগোপাল চুপ করে রইল। এমন সময় দত্তসাহেব বললেন, “একবার পাশের ঘরে তোমরা এসো। তা হলেই সব বুঝতে পারবে।”
পাশের ঘরে দত্তসাহেব, নাড়ুগোপাল ও ইন্সপেক্টর চৌবে গেলেন। নাড়ুগোপাল আশ্চর্য হয়ে দেখল, একটা শক্ত চেয়ারে প্রোফেসর রায় বসে আছেন। ঠিক বসে নেই, তাঁকে জোর করে বসিয়ে রাখা হয়েছে। তাঁর পাশে দু’জন ছোকরাকে চেয়ারে বেঁধে রাখা হয়েছে।
দত্তসাহেব বললেন, “এদের পিছনে আর-একজন ছোকরা বসে আছে, তাকে চিনতে পারছ?”
ছেলেটা কালো বুশশার্ট ও কালো ট্রাউজার পরা, চকচকে জুতো। চুল ভাল করে পিছন দিকে ব্রাশ করা। মি. দত্ত বললেন, “ছেলেটি কাগজের সঙ্গে মূর্তিটা দিয়েছিল। চিনতে একটু দেরি হল তো। সামান্য চেষ্টায় লোকের চেহারা কেমন বদলে যায় দেখলে। তোমাকে আর-একটু খুলে বলি। ইন্সপেক্টর চৌবে কিছুদিন হল ওই চায়ের দোকানে ঘোরাফেরা করছিলেন। দোকানের মালিকরা কিছু জানত না। ছোকরাটির প্রথম থেকেই কেমন খটকা লেগেছিল। তার সন্দেহ হল পুলিশ দোকানের উপর নজর রেখেছে। আজ হোক কাল হোক, তল্লাশি হবে তখন মূর্তিসুদ্ধু ধরা পড়াটা কোনও কাজের কথা নয়। একদিন বৃষ্টির মধ্যে ইন্সপেক্টর চৌবে চা খেতে এলেন, তার আধঘণ্টাটাক পরে তুমি এলে। ছোকরাটির মনে হল, পুলিশ রেইড হবার আর বেশি দেরি নেই। দোকানে যারা খাচ্ছে তাদের মধ্যেও কয়েকজন সাদা পোশাকে পুলিশের লোক থাকতে পারে। মূর্তিটা বাইরে পাঠিয়ে দেওয়ার পক্ষে তুমি ছিলে আদর্শ। পুলিশকে কে সন্দেহ করতে যাচ্ছে? ছোকরাটি যা ভেবেছিল তাই হল। মূর্তিটা পকেটে করে তুমি সোজা থানায় গিয়ে হাজির হলে।”
মিস্টার দত্ত প্রোফেসর রায়কে দেখিয়ে বললেন, “নাড়ুগোপাল, এই যে তোমার আসামি। মনস্তত্ত্বের প্রোফেসর ছিলেন ঠিকই কিন্তু কিছুদিন আগে রিটায়ার করেছেন। স্টিভেনসনের লেখা জেকিল ও হাইডের গল্প পড়েছ? এক লোকের মধ্যেই দু’রকম লোক বাস করতে পারে। একসময় নামডাকও হয়েছিল, পরে উনি কীরকম বদলে গেলেন। কেন গেলেন সে অন্য মনস্তাত্ত্বিকরাই বলতে পারেন। যেসব ছাত্রের বাড়ি উনি যেতেন তারা সব ওঁরই দলের লোক। দুটিকে তো তুমি দেখতে পাচ্ছ, বাকিগুলোও ধরা পড়বে। ওদের চোরাই জিনিস পাচার করার দল আছে। বিদেশেও পাচার করত। প্রোফেসর রায় অবশ্য অনেক টাকা পেতেন। অত টাকার তাঁর দরকার ছিল না। তবে মানুষের কখন কী মতি হয় কে বলতে পারে। যাই হোক, কেসটা শেষ হয়েছে এতেই আমি খুশি।”
বড়বাবু আর নাড়ুগোপাল দত্তসাহেবের আপিসের গাড়িতে থানায় ফিরে এল। ঘরে বসে বড়বাবু নাড়ুগোপালকে বললেন, “ছুটির দরখাস্ত দিয়ে তুমি বাড়ি চলে যাও, পনেরো দিন পরে আবার দেখা হবে। ওঃ হো, আর-একটা কথা বলতে ভুলে গিয়েছি। গাড়িতে কিছু খাবার ছিল, আমি নামিয়ে রেখেছি। দত্তসাহেব দিয়ে দিয়েছেন। তোমাকে যে মারধোর করা হয়েছিল তার কথঞ্চিৎ ক্ষতিপূরণ। খুলে দেখবে নাকি?”
নাড়ুগোপাল বলল, “আপনি ঢাকনাগুলো খুলুন।”
বড়বাবু ঢাকনা খুলে বললেন, “এ দেখছি চিকেন স্যুপ, খেলে দু’দিনে তোমার শরীর ভাল হয়ে যাবে। অনেকটা দিয়েছেন, দু’-তিনজনের মতো হবে মনে হয়।”
আর-একটা পাত্রের ঢাকনা খুলে বললেন, “এ তো মুরগির মাংস। বড় সাদা করে বেঁধেছে। বোধহয় সাহেবি রান্না। ঝাল-মশলা দেয়নি মনে হচ্ছে। খেতে কীরকম হবে কে জানে।”
নাড়ুগোপাল বলল, “খেয়ে দেখলেই তো হয়। দুটো প্লেট আনতে বলি।”
বড়বাবু একটু হেসে বললেন, “তুমি যখন বলছ তখন আর আপত্তি কী? খেয়েই দেখা যাক।”
৮ মার্চ ১৯৮৯
অলংকরণ: অনুপ রায়