চোর চৌঘুড়িতে (অর্থাৎ ভদ্র (!) চোরের সাহসকে বলিহারি!)
প্রথম পরিচ্ছেদ
ঘটনা প্রায় আট বৎসরের। শীতকালে, পৌষ মাস, অতি প্রত্যূষে অনেকেই আপনাপন শয্যায় শয়ন করিয়া আছেন, এমন সময়ে সংবাদ আসিল যে, বৌ-পদ্মের গলিতে একটি ভয়ানক চুরি হইয়া গিয়াছে।
সংবাদ পাইবার সঙ্গে সঙ্গে শয্যা হইতে গাত্রোত্থান করিলাম। যে ব্যক্তি আমার নিকট সংবাদ লইয়া আসিয়াছিল, তাহাকে চুরির অবস্থা জিজ্ঞাসা করিলাম; কিন্তু সে আমার প্রশ্নের কোনরূপ সন্তোষ-জনক উত্তর প্রদান করিতে পারিল না। সুতরাং অনন্যোপায় হইয়া তৎক্ষণাৎ আমাকে বৌ-পদ্মের গলি অভিমুখে গমন করিতে হইল।
মফস্বলবাসী পাঠকগণের মধ্যে বোধ হয়, অনেকেই অবগত নহেন যে, বৌ—পদ্মের গলির অধিকাংশ অধিবাসীবর্গের অবস্থা কি প্রকার, বা তাহারা কিরূপ শ্রেণীর লোক। কিন্তু এই কলিকাতা সহরের অধিবাসীবর্গের মধ্যে অনেকেই অবগত আছেন যে, বৌ-পদ্মের গলির অধিকাংশ স্থান বার-বনিতাগণের দ্বারা অধিকৃত।
বৌ-পদ্মের গলিতে চুরি হইয়াছে, এই কথা শুনিবামাত্র সহজেই মনে হইল, কোন বার-বনিতার গৃহ হইতে নিশ্চয়ই এই চুরি হইয়া থাকিবে। মনে যাহা ভাবিয়াছিলাম, সেই স্থানে গমন করিয়া দেখিলাম, কার্য্যেও ঠিক তাহাই ঘটিয়াছে। প্রকৃতই জনৈক বার-বনিতার সৰ্ব্বস্ব অপহৃত হইয়াছে।
যে স্ত্রীলোকটির অলঙ্কার-পত্র সমস্তই অপহৃত হইয়াছে, তাহার নাম চপলা। বৌ-পদ্মের গলিতে চপলা বহু দিবস পর্য্যন্ত বাস করিতেছে, সেই গলির ভিতর অনেক বাড়ীতেই সে ভাড়াটিয়া ছিল। যে বাটীতে চপলা এখন বাস করিতেছে, সেই বাটির সঙ্গে অনেক দিবসের ভাড়াটীয়া নহে। এই বাটীতে ছয় মাসের অধিক তাহার বাস হয় নাই।
চপলা নীচ ব্যবসা অবলম্বন করিয়া, এবং মধ্যে মধ্যে দুই একটি ভদ্র-তনয়ের সর্ব্বনাশ করিয়া, অলঙ্কার—পত্রাদিতে প্রায় তিন চারি সহস্র মুদ্রার সংস্থান করিয়াছিল; কিন্তু আজ তাহার সমস্তই অপহৃত হইয়াছে।
কিরূপে চপলার যথাসৰ্ব্বস্ব অপহৃত হইয়াছে, তাহা জানিবার অভিপ্রায়ে তাহাকে যে কয়েকটি কথা জিজ্ঞাসা করিলাম, এবং উত্তরে যাহা কিছু অবগত হইতে পারিলাম, তাহার সংক্ষিপ্ত বিবরণ নিম্ন প্রদত্ত হইল। পাঠ করিলেই পাঠকগণ তাহার আনুপূর্বিক ব্যাপার অবগত হইতে পারিবেন।
আমি। তোমারই কি অলঙ্কার-পত্র চুরি গিয়াছে?
চপলা। হাঁ। মহাশয়
আমি। তোমার নাম কি?
চপলা। চপলা বিবি।
আমি। তোমার জাতি কি? হিন্দু না মুসলমান?
চপলা। আমি মুসলমান হইব কেন? আমি হিন্দুর ঘরে জন্মিয়াছি, ও এখন পর্য্যন্ত হিন্দুই আছি।
আমি। যদি তুমি মুসলমান নও, তবে তোমার নাম চপলা বিবি হইল কি প্রকারে? কোন হিন্দু স্ত্রীলোক আপনাকে “বিবি” বলিয়া পরিচয় দেয় না।
চপলা। আপনি যাহা বলিতেছেন, তাহ সত্য; কিন্তু আমাদিগের বার-বনিতা-সমাজে “বিবি” শব্দটির ব্যবহার হইয়া থাকে।
আমি। সে কথা যাউক, কিরূপে তোমার অলঙ্কারগুলি অপহৃত হইল, তাহার আনুপূর্ব্বিক ব্যাপার আমাকে একবার বল দেখি।
চপলা। ব্যাপার আর কি বলিব মহাশয়! যে ব্যক্তি আমার ঘরে আসিয়াছিল, সেই আমার সর্ব্বনাশ করিয়া গিয়াছে!
আমি। কে তোমার ঘরে আসিয়াছিল?
চপলা। একটি বাবু। এখন দেখিতেছি, সে বাবু নহে, সে চোর।
আমি। সে বাবুটি কে?
চপলা। তাহাকে চিনি না।
আমি। তাহার নাম কি?
চপলা। জানি না।
আমি। সে থাকে কোথায়?
চপলা। তাহাও আমি অবগত নহি।
আমি। যখন তুমি তাহার কোন বিষয়ই অবগত নহে, তখন সে তোমার ঘর হইতে কিরূপে তোমার অলঙ্কারগুলি অপহরণ করিল?
চপলা। প্রত্যহ সন্ধ্যার সময় অলঙ্কারাদি পরিধান করিয়া যেরূপে বারান্দায় গিয়া উপবেশন করি, গত কল্য সন্ধ্যার সময় সেইরূপ ভাবে বারান্দায় বসিয়া আছি, এরূপ সময় দেখিতে পাইলাম যে, একটি বাবু আমাদিগের বাটির সম্মুখ দিয়া গমন করিতেছে। যে বারান্দায় আমি বসিয়াছিলাম, দেখিলাম, সেই বারান্দার দিকে দেখিতে দেখিতে প্রথমতঃ সে গমন করিল। কিন্তু পরক্ষণেই পুনরায় প্রত্যাবর্তন করিয়া আমাদিগের বাটীর ভিতর প্রবেশ করিল, এবং ক্রমে আমার গৃহে আসিয়া উপবেশন করিল। তাহার ব্যাপার দেখিয়া, আমি অনুমান করিয়া লইলাম যে, উক্ত ব্যক্তি সেই রাত্রিতে আমার ঘরে বসিয়া আমোদ আহ্লাদ করিতে চাহে। মনে মনে এইরূপ ভাবিয়া, তাহার মনের ভাব আমি জিজ্ঞাসাও করিলাম, এবং জানিতে পারিলাম যে, আমি পূৰ্ব্বে যাহা ভাবিয়াছিলাম, তাহাই ঠিক। সে সমস্ত রাত্রি আমার গৃহে অবস্থিতি করিবার নিমিত্ত আমাকে পাঁচ টাকা প্রদান করিতে সম্মত হইল। তদ্ব্যতীত আমার গৃহে বসিয়া মদ্যাদি পান করিবার যে কিছু ব্যয় হইবে, তাহাও প্রদান করিতে সম্মত হইল। আমি তাহার প্রস্তাবে সম্মত হইয়া, সমস্ত রাত্রি তাহাকে আপনার গৃহে স্থান প্রদান করিতে সম্মত হইলাম। সে আমাকে যে পাঁচা টাকা প্রদান করিতে চাহিয়াছিল, তাহা সৰ্ব্বাগ্রে আমার হস্তে প্রদান করিল; তদ্ব্যতীত মদ্য এবং মাংস আনিবার নিমিত্ত আমায় আরও দুই টাকা প্রদান করিল।
আমি। সেই টাকা লইয়া তুমি কি করিলে?
চপলা। আমার পাঁচ টাকা আমার দেরাজের ভিতর রাখিয়া দিলাম।
আমি। তাহার সম্মুখে তখনই রাখিলে?
চপলা। তাহার সম্মুখেই দেরাজ খুলিয়া সেই টাকা পাঁচটি তাহার মধ্যে রাখিয়া দিলাম।
আমি। দেরাজের চাবি কি করিলে?
চপলা। আমার আঁচলের “খুঁটে” বাঁধিয়া রাখিলাম।
আমি। ইহাও সে দেখিল?
চপলা। দেখিল বৈকি।
আমি। তাহার পর কি হইল?
চপলা। অপর টাকা দুইটি আমার বেহারার হস্তে প্রদান করিলাম, এবং কহিলাম,–“এক বোতল মদ ও চাটের দোকান হইতে কিছু মাংস আনয়ন কর। মদ যেন ভাল হয়। এই টাকায় যদি সংকুলান না হয়, তাহা হইলে শুঁড়ীর দোকানে বাকী রাখিয়া আয়। পরিশেষে বাবু উহাও প্রদান করিবেন।”
আমি। দুই টাকা বাদে যাহা অবশিষ্ট থাকিবে, তাহা বাবু প্রদান করিবেন, এ কথা বলিবার উদ্দেশ্য কি? বাবু সে কথা তোমাকে কিছু বলেন নাই?
চপলা। নাই বলুন, ঐরূপ উপায়ে আমরা এরূপ বাবুদিগের নিকট হইতে আরও কিছু আদায় করিয়া লইয়া থাকি। আমাদিগের চাকরগণকে পূর্ব্ব হইতেই বলিয়া দেওয়া থাকে, তাহারা এক টাকা খরচ করিয়া দুই টাকার হিসাব দেয়। বাবুগণ কোনরূপ আপত্তি না করিয়া লজ্জার খাতিরেই হউক, বা যে কোন কারণেই হউক, উহা ত প্রদান করিয়াই থাকেন; তদ্ব্যতীত পারিতোষিক বলিয়া, সেই চাকরকে আরও কিছু প্রদান করেন।
আমি। তোমার চাকরের নাম কি?
চপলা। আমার চাকরের নাম রামচরণ।
আমি। রামচরণ সেই বাবুকে উত্তমরূপে দেখিয়াছে?
চপলা। দেখিয়াছে বৈকি। সে অনেকবার তাহার সম্মুখে গমন করিয়াছিল।
আমি। রামচরণ এখন কোথায়?
চপলা। এই খানেই আছে।
আমি। রামচরণ ব্যতীত আর কোন লোক তাহাকে দেখিয়াছে কি?
চপলা। আমি ও রামচরণ ব্যতীত আর কেহ তাহাকে দেখিয়াছে, কি না, তাহা আমি অবগত নহি।
আমি। মদ ও মাংস আনিবার নিমিত্ত রামচরণের হস্তে টাকা প্রদান করিবার পর কি হইল?
চপলা। কিয়ৎক্ষণ পরেই সে এক বোতল মদ, কয়েক বোতল সোডা ওয়াটার, কিছু মাংস ও কয়েক দোনা পান আনিয়া উপস্থিত করিল।
আমি। তাহার পর
চপলা। তাহার পর যাহা হইল, তাহা আপনি বুঝিতেই পারিতেছেন। রামচরণ তামাক সাজিয়া দিয়া বাহিরে গমন করিল। আমি ঘরের দরজা বন্ধ করিয়া দিলাম এবং উভয়েই মদ্য পান করিতে প্রবৃত্ত হইলাম।
আমি। মদ কে ঢালিয়া দিতে লাগিল?
চপলা। কখন বা আমি ঢালিতে লাগিলাম, কখন বা সেও ঢালিয়া লইতে লাগিল।
আমি। তোমরা দুইজন ব্যতীত বাটীর অপর ভাড়াটীয়া, বা অপর কোন লোক আসিয়া মদ্য পানে তোমাদিগের সহিত যোগ দিয়াছিল কি?
চপলা। না, আমরা দুই জন ব্যতীত অপর কেহই আমাদিগের সহিত যোগ দেয় নাই।
আমি। তুমি কি মদ্য অধিক পরিমাণে পান করিয়াছিলে?
চপলা। আমি সচরাচর যে পরিমাণে মদ্য পান করিয়া থাকি, তাহা অপেক্ষা অনেক অল্প পরিমাণে আমি পান করিয়াছিলাম। কিন্তু সচরাচর আমার যেরূপ নেসা হইয়া থাকে, তাহা অপেক্ষা অধিক নেসা হইয়াছিল; আমি অজ্ঞান হইয়া পড়িয়াছিলাম।
আমি। তুমি সচরাচর যেরূপ পরিমাণে পান করিয়া থাক, তাহা অপেক্ষা অনেক অল্প পরিমাণে পান করিয়াও তুমি কি নিমিত্ত অজ্ঞান হইয়া পড়িলে?
চপলা। কেন যে আমি অজ্ঞান হইয়া পড়িলাম, তাহা আমি বলিতে পারি না। কিন্তু তৃতীয় কি চতুর্থ গেলাস পান করিবার সঙ্গে সঙ্গে আমি যে অজ্ঞান হইয়া পড়িয়াছিলাম, তাহা কিন্তু আমার বেশ মনে আছে।
আমি। সেই গেলাসের মদ বোতল হইতে কে ঢালিয়া ছিল, তাহা তোমার মনে হয় কি?
চপলা। বেশ মনে হয়, সেই গেলাসের মদ আমিই ঢালিয়াছিলাম।
আমি। সেই গেলাসের মদ কি সমস্তই তুমি পান করিয়াছিলে, না কিছু কিছু উভয়েই গ্রহণ করিয়াছিলে?
চপলা। আমার যতদূর মনে হয়, তাহাতে আমি বেশ বলিতে পারি,—বোতল হইতে মদ ঢালিয়াই গেলাসটি আমি তাহার হস্তে প্রদান করি। সেও আমার হস্ত হইতে উহা গ্রহণ করিয়া যেমন পান করিবার উদ্যোগ করিতেছে, এমন সময় তাহার বমি হইবার উপক্রম হয়। অমনি গেলাস হস্তে করিয়াই সে শয্যা হইতে উত্থিত হইয়া একবারে বারান্দায় গমন করে, এবং সেই স্থানে বমি করিবার উপক্রম করে; কিন্তু বমি হয় নাই। সেই সময় আমি তাহার সহিত বারান্দায় গমন না করিয়া, ঘরের ভিতরেই বসিয়া থাকি। কিয়ৎক্ষণ পরে সে সেই গেলাস হস্তে পুনরায় ঘরের ভিতর প্রবেশ করিয়া আপনার স্থানে উপবেশন করে। সেই সময় গেলাস পূর্ব্বের ন্যায় সুরায় পূর্ণ ছিল না, আন্দাজ অর্দ্ধেক প্রায় খালি হইয়া পড়িয়াছিল। সে সেই সময় উক্ত গেলাস আমার হস্তে প্রদান করিয়া কহিল, “আমার অংশ আমি পান করিয়াছি। যাহা অবশিষ্ট আছে, তাহা তোমার অংশ; তুমি ইহা পান কর।”
আমি। তাহার কথার উপর নির্ভর করিয়া সেই অবশিষ্ট অংশ তুমি পান করিলে?
চপলা। করিলাম বৈকি। সেই গেলাস পান করিবার সঙ্গে সঙ্গেই আমি ক্রমে অজ্ঞান হইয়া পড়িলাম।
আমি। ইহার পরে কোন সময় তোমার জ্ঞান হইল?
চপলা। রাত্রি প্রায় তিনটার সময় আমার জ্ঞান হইল।
আমি। সেই সময় তুমি কি দেখিলে?
চপলা। দেখিলাম, আমার আঁচলে যে চাবির গোচ্ছা ছিল, তাহা নাই। বাক্স, দেরাজ প্রভৃতি ঘরের সমস্ত দ্রব্যই খোলা উহার মধ্যে যে সকল মূল্যবান দ্রব্যাদি ছিল, তাহাদের চিহ্নমাত্রও নাই। তদ্ব্যতীত আমার অঙ্গে পরিহিত যে সকল অলঙ্কার ছিল, তাহার এক খানিও নাই। বাবুটিও নাই। সেই সময় আমি বুঝিতে পারিলাম যে, সেই ব্যক্তিই আমার সর্ব্বনাশ করিয়া প্রস্থান করিয়াছে।
আমি। তুমিত জ্ঞানশূন্য হইয়া পড়িয়াছিলে; কিন্তু সেই সময় তোমার চাকর রামচরণ কোথায় ছিল?
চপলা। এখন জানিতে পারিতেছি, তাহাকেও ফাঁকি দিয়া সে প্রস্থান করিয়াছে।
আমি। রামচরণকে সে কিরূপে ফাঁকি দিল?
চপলা। আমাদিগের ঘরের দরজা ভিতর হইতে বন্ধ ছিল, কিন্তু রামচরণ ঘরের বাহিরে দরজার নিকট বসিয়াছিল।
আমি। রামচরণ যদি ঘরের বাহিরে বসিয়া থাকিবে, তাহা হইলে সেই ব্যক্তি যখন প্রস্থান করিল, তখন তাহাকে সে নিশ্চয়ই দেখিতে পাইয়াছে?
চপলা। না, প্রস্থান করিবার সময় রামচরণ তাহাকে দেখিতে পায় নাই। রামচরণ যদি সেই সময় সেই স্থানে থাকিত, তাহা হইলে এইরূপে সেই ব্যক্তি প্রস্থান করিতে পারিত কি?
আমি। তবে সেই সময় রামচরণ কোথায় ছিল?
চপলা। রামচরণ বলিতেছে,—যখন সেই ঘরের বাহিরে চুপ করিয়া বসিয়াছিল, সেই সময় সেই ব্যক্তি হঠাৎ দরজা খুলিয়া বাহিরে রামচরণের নিকট গমন করে, এবং তাহার হস্তে পুনরায় দুইটি টাকা প্রদান করিয়া বলিয়া দেয়, “শীঘ্র আর এক বোতল মদ আনয়ন কর।” ইহা বলিয়াই সে পুনরায় ঘরের ভিতর প্রবেশ করে, এবং ভিতর হইতে ঘরের দরজা বন্ধ করিয়া দেয়।
আমি। রামচরণ মদ আনিতে পুনরায় গমন করিয়াছিল কি?
চপলা। হাঁ, গিয়াছিল বৈকি, কিন্তু মদ লইয়া সে যখন পুনরায় প্রত্যাগমন করে, তখন দেখিতে পায় যে, ঘরের দরজা ভিতর হইতে বন্ধ নাই। ঘরের ভিতর প্রবেশ করিয়া দেখে যে, সেই ব্যক্তি ঘরের ভিতরে নাই, আমি অজ্ঞান অবস্থায় পড়িয়া রহিয়াছি। বাক্স, আলমারি প্রভৃতি সমস্তই খোলা, এবং আমার পরিহিত অলঙ্কার পত্র কিছুই নাই।
আমি। এই অবস্থা দেখিয়া রামচরণ কি করিল?
চপলা। রামচরণকে জিজ্ঞাসা করিলেই জানিতে পারিবেন। এই অবস্থা দেখিয়া রামচরণ গোলমাল করিয়া উঠে। তাহার গোলযোগ শুনিয়া বাটীর অপরাপর ভাড়াটীয়াগণ আমার গৃহে আগমন করে, এবং আমার সেই অবস্থা দৃষ্টি করিয়া প্রথমতঃ চারিদিকে সেই বাবুর অনুসন্ধান করে; কিন্তু তাহার কোনরূপ সন্ধান প্রাপ্ত না হইয়া পরিশেষে থানায় সংবাদ প্রেরণ করে।
আমি। থানা হইতে কর্ম্মচারীগণ যখন তোমার বাটীতে আসিয়া উপস্থিত হন, সেই সময় তুমি ভালরূপে সংজ্ঞালাভ করিয়াছিলে কি?
চপলা। না মহাশয়! সেই সময় আমার কিছুমাত্র জ্ঞান ছিল না, সেই সময় আমার গৃহে যে কি হইয়াছে, তাহার কিছুই আমি অবগত নহি। যখন আমার পুনরায় জ্ঞান হইল, তখন দেখিলাম, পুলিশের লোকগণের দ্বারা আমার গৃহ পরিপূর্ণ।
আমি। এখন তোমার সম্পূর্ণরূপ জ্ঞান হইয়াছে ত?
চপলা। হাঁ মহাশয়! এখন আর আমি জ্ঞান শূন্য নহি। কেন মহাশয়! আমার কথা শুনিয়া কি আপনার অনুমান হয় যে, এখন পর্যন্তও আমি প্রকৃতিস্থ হইতে পারি নাই?
আমি। আমার বোধ হয়, তুমি এখন সম্পূর্ণরূপ প্রকৃতিস্থ হইয়াছ। এখন তোমাকে আমি একটি কথা জিজ্ঞাসা করি, বেশ বিবেচনা করিয়া তুমি তাহার উত্তর প্রদান কর দেখি।
চপলা। কি জিজ্ঞাসা করিতে চাহেন?
আমি। যে সময় তুমি অজ্ঞান হইয়া পড়িয়াছিলে, সেই সময় তোমার গৃহে সেই ব্যক্তি বসিয়াছিলে, ও তোমার অলঙ্কার পত্র সমস্তই ঠিক ছিল?
চপলা। তাহা ছিল।
আমি। যখন তোমার জ্ঞান হয়, সেই সময় জানিতে পারিলে, তোমার দ্রব্যাদি নাই, এবং সেই লোকও নাই। কিন্তু তোমার সংজ্ঞা হইবার অনেক পূর্ব্বে রামচরণ প্রথমতঃ তোমার সেই অবস্থা দেখিতে পাইয়াছিল। এরূপ অবস্থায় ইহা কি হইতে পারে না যে ব্যক্তি তোমার গৃহে আগমন করিয়াছিল, সে প্রকৃত চোর নহে, কোন ভদ্রলোক। পরে তিনি যখন দেখিতে পাইলেন, সামান্য মদ পান করিয়া তুমি অজ্ঞান হইয়া পড়িলে, সেই সময় তাঁহার অতিশয় ভয় হইল, এবং কোনরূপে পাছে তিনি অপমানিত হন, এই ভাবিয়া তোমাকে একাকিনী রাখিয়া প্রস্থান করিলেন। এদিকে রামচরণু বা অপর কোন ব্যক্তি তোমার সংজ্ঞাহীন অবস্থা দৃষ্টি করিয়া ও সুবিধামত সুযোগ পাইয়া তোমার সর্ব্বস্ব অপহরণ করিয়া পরিশেষে গোলযোগ করিয়া উঠিল। সেই সময় যাহারা আসিল, তাহারা স্বভাবতই মনে করিল যে, সেই বাবু তোমার এরূপ অবস্থা করিয়া তোমার যথাসর্ব্বস্ব অপহরণ করিয়া প্রস্থান করিয়াছে। কেমন হহা হইতে পারে নাকি?
চপলা। আপনি যাহা বলিতেছেন, তাহা একবারে অসম্ভব না হইলেও রামচরণের দ্বারা কখনই এ কাৰ্য্য হইতে পারে না। কারণ, রামচরণকে আমি যথাসর্ব্বস্ব দিয়া বিশ্বাস করিতে পারি। সেই বাবুটিই যে আমার সর্ব্বনাশ করিয়া প্রস্থান করিয়াছে, তাহার আর কিছুমাত্র ভুল নাই।
আমি। এমন অনেক দেখা গিয়াছে যে, যে ব্যক্তি বহু দিবস পর্য্যন্ত আপন মনিবের নিকট নিতান্ত বিশ্বাসের সহিত কার্য্য করিয়া আসিয়াছে, সময়ে সেই ব্যক্তিই অবিশ্বাসের কার্য্য করিতে ত্রুটি করে নাই।
চপলা। এরূপ ঘটনা সময়ে সময়ে ঘটিয়া থাকে সত্য; কিন্তু বর্তমান অবস্থায় তাহা কোনরূপেই হইতে পারে না। আমি রামচরণের বিষয় যতদূর অবগত আছি, তাহাতে এ কার্য্য তাহার দ্বারা কখনই হয় নাই। বিশেষতঃ যেরূপ সামান্য মদ্য পান করিয়া, আমি একবারে অজ্ঞান হইয়া পড়িয়াছিলাম, সেরূপ সামান্য সুরা পানে এ পর্যন্ত কখনও আমার কিছুমাত্র নেসা হয় নাই। আমার অনুমান হয় যে, সে ব্যক্তি কেবল যে আমাকে সুরা পান করাইয়াছে তাহা নহে; সেই সুরার সহিত কোনরূপ বিষাক্ত দ্রব্য মিশ্রিত করিয়া দিয়াছিল বলিয়া, আমার সেই অবস্থা ঘটিয়াছিল।
আমি। বোতাল হইতে সুরা ত তুমিই ঢালিয়া দিয়াছ, সে পান করিয়াছে মাত্র। এরূপ অবস্থায় কোন সময়ে বিষাক্ত দ্রব্য সে সুরার সহিত মিশ্রিত করিতে সমর্থ হইল?
চপলা। একবার তাহার উত্তম সুযোগ ঘটিয়াছিল, সেই সময় সে অনায়াসেই মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করিতে পারিয়াছিল।
আমি। তুমি কোন্ সময়ের কথা বলিতেছ?
চপলা। বমি করিবার অভিপ্রায়ে সুরা-পূর্ণ গেলাস হস্তে করিয়া যখন সে একাকী বারান্দায় গমন করিয়াছিল, আমার অনুমান হয়, সেই সময় অর্দ্ধ গেলাস সুরা সে পান করিয়া অবশিষ্ট অর্দ্ধ গেলাস সুরার সহিত কোনরূপ বিষাক্ত দ্রব্য মিশ্রিত করিয়া আমার হস্তে প্রদান করে। সেই সুরা পান করিবার পরই আমার জ্ঞান লুপ্ত হয়। এরূপ অবস্থায় রামচরণ বা অপর কাহারও দ্বারা এ কার্য্য কিরূপে সম্পন্ন হইতে পারে?
আমি। তোমাকে নিতান্ত নির্ব্বোধ স্ত্রীলোক বলিয়া বোধ হয় না। কারণ, তুমি যাহা বলিতেছ এবং যেরূপ তোমার অভিমত প্রকাশ করিতেছ, তাহাতে আমি বেশ বুঝিতে পারিতেছি যে, প্রকৃত কথা অনুমান করিতে তুমি সৰ্ব্বতোভাবে সমর্থ। তুমি যাহার উপর সন্দেহ করিতেছ, আমারও সম্পূর্ণ সন্দেহ তাহার উপর। সেই ব্যক্তির আকৃতি প্রকৃতি কিরূপ, বেশ ভাবিয়া চিন্তিয়া তাহা আমাকে বল দেখি।
চপলা। আকৃতি প্রকৃতি কিরূপ বলিব, তাহা আমি বুঝিতে পারিতেছি না।
আমি। বুঝিতে না পার, আমি তোমাকে যাহা যাহা জিজ্ঞাসা করিতেছি, তাহার যথাযথ উত্তর প্রদান কর। সেই লোকটির বয়ঃক্রম আনুমানিক কত হইবার সম্ভাবনা?
চপলা। আমার অনুমান হয়, তাহার বয়ঃক্রম ত্রিশ বৎসরের কম হইবে না, পঁয়ত্রিশ বৎসরের অধিক হইয়াছে বলিয়াও বোধ হয় না।
আমি। তাহার বর্ণ কি প্রকার? কাল, শ্যাম, না গৌর?
চপলা। আমি তাহাকে রাত্রিকালে দেখিয়াছি, আমার বিবেচনায় তাহার বর্ণ উজ্জ্বল শ্যাম।
আমি। আকৃতি কিরূপ? দীর্ঘ, না ক্ষুদ্র?
চপলা। নাতিদীর্ঘ, নাতিক্ষুদ্র, তাহাকে মধ্যমাকৃতির লোক বলিয়া অনুমান হয়।
আমি। কৃশ কি স্থূলকায়?
চপলা। অত্যন্ত স্থূলাকায় নহে; কিন্তু বেশ হৃষ্ট-পুষ্ট।
আমি। মুখের আকৃতি কি প্রকার?
চপলা। চক্ষু দুইটি বেশ বড়; কিন্তু যেন একটু রক্তিম। উহা সুরা পান জনিত লাল, কি স্বাভাবিক লাল, তাহা আমি অবগত নহি। লোকটি যেন একটু লম্বা গোছের বলিয়া বোধ হয়। গোঁপ আছে, দাড়ি কামান। উহার চেহারা দেখিয়া ও উহার কথা শুনিয়া উহাকে বেশ ভদ্রলোক বলিয়া অনুমান হয়।
আমি। উহার মুখের উপর বা শরীরের যেস্থান সর্ব্বদা দেখিতে পাওয়া যায়, এরূপ স্থানে কোনরূপ চিহ্ন আছে দেখিয়াছ কি?
চপলা। কিরূপ চিহ্ন?
আমি। কোনরূপ কাটা দাগ, ঘায়ের দাগ, তিল বা সেইরূপের অপর কোন চিহ্ন, যাহা দেখিলে অনায়াসেই উহাকে চিনিতে পারা যায়।
চপলা। না, সেরূপ কোন প্রকার চিহ্ন আছে বলিয়া আমার অনুমান হয় না। থাকিলেও বিশেষ লক্ষ্য করিয়া আমি তাহা দেখি নাই।
আমি। উহার পরিহিত কাপড়, জুতা প্রভৃতি কিরূপ?
চপলা। পরিধানে একখানি ফিনফিনে কালাপেড়ে ধুতি। গায়ে একটি কাল কোট, তাহার উপর এক যোড়া লাল রঙ্গের সাল। পায়ে হরিদ্রাবর্ণের মোজা, এবং বার্ণিশ করা এক ঘোড়া বেশ ভাল জুতা। এক কথায়, ভদ্রলোকেরা যেরূপ পোষাক পরিচ্ছদ পরিধান করিয়া থাকেন, ইহার পোষাক পরিচ্ছদও সেই প্রকারের।
আমি। তুমি তাহার কথা শুনিয়াছ। তাহার কথার ভাবে তাহাকে কোন্ দেশীয় লোক বলিয়া অনুমান হয়?
চপলা। তাহার কথা শুনিয়া তাহাকে কলিকাতার লোক বলিয়া বোধ হয় না। কেমন যেন একটু টানা টানা ভাবে সে কথা কহিয়া থাকে।
আমি। সে কোন্ দেশীয় লোক, তাহা কিছু অনুমান করিয়া উঠিতে পার কি?
চপলা। বঙ্গদেশীয় লোক বলিয়া আমার অনুমান হয়; অথচ তাহার কথা সম্পূর্ণরূপ বঙ্গদেশবাসীর কথা বলিয়া অনুমান হয় না। বঙ্গদেশীয় লোক হইলেও বোধ হয়, অনেক দিবস পর্য্যন্ত সে কলিকাতায় আছে।
আমি। উহাকে আর কখনও দেখিয়াছ বলিয়া তোমার অনুমান হয় কি?
চপলা। ইতিপূৰ্ব্বে উহাকে আর যে কখন দেখিয়াছি, আমার এরূপ বোধ হয় না। আমার বোধ হয়, এই বারেই আমি তাহাকে সৰ্ব্ব প্রথম দেখিয়াছি।
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
চপলার নিকট আনুপূর্বিক সমস্ত ব্যাপার অবগত হইবার পর আমার বেশ অনুমান হইল যে, রামচরণ বা অপর কোন ব্যক্তির দ্বারা এ কার্য্য সম্পন্ন হয় নাই। যে ব্যক্তি চপলার গৃহে আসিয়া তাহার সহিত মদ্য পান করিয়াছিল, ইহা তাহারই কার্য্য। কিন্তু সেই ব্যক্তি কে? কোথায় থাকে, এবং কিরূপেই বা তাহার সন্ধান করিতে সমর্থ হইব? মনে মনে এইরূপ ভাবিয়া চপলার বাড়ী হইতে বহির্গত হইলাম।
চপলার বাটী হইতে বহির্গত হইলাম সত্য; কিন্তু সেই অপরিচিত লোকের অনুসন্ধান করিবার নিমিত্ত যে কোথায় গমন করিব, তাহার কিছুমাত্র স্থির করিতে না পারিয়া, আস্তে আস্তে আপনার থানায় আসিয়া উপস্থিত হইলাম।
যে সময় আমি থানায় আসিয়া উপনীত হইলাম, সেই সময় বেলা দশটা হইয়াছিল। সুতরাং স্নান আহার না করিয়া থানা হইতে আর বহির্গত হইলাম না।
পাঠকগণ! আপনারা কিছু বুঝিতে পারিতেছেন কি যে, এতবড় একটি মোকদ্দমার অনুসন্ধান পরিত্যাগ করিয়া হঠাৎ থানায় আসিয়া কেন উপস্থিত হইলাম? আপনারা হয়ত মনে করিবেন যে, বেলা ক্রমে অধিক হইতেছে বলিয়া স্নান আহার করিবার নিমিত্ত থানায় প্রত্যাগমন করিলাম। কিন্তু আমার থানায় প্রত্যাগমন করিবার কারণ, আপনারা যাহা ভাবিতেছেন, প্রকৃত প্রস্তাবে তাহা নহে। কোনরূপ গোলযোগ মিশ্রিত অনুসন্ধানে পতিত হইয়া, কাহার দ্বারা অপরাধ ঘটিয়াছে তাহার কিছুমাত্র স্থির করিয়া উঠিতে না পারিলে, অনুসন্ধান করিবার সময় এইরূপে প্রায় আমাকে থানায় আসিতে হয়, এবং থানার ভিতর আমার যে সকল পুরাতন খাতাপত্র আছে, তাহা উত্তমরূপে দেখিয়া লইয়া পরিশেষে অনুসন্ধানে লিপ্ত হইতে হয়।
আমি থানায় আসিয়াই সর্ব্ব প্রথম আমার পুরাতন খাতাপত্র বাহির করিলাম। উহার ভিতর এক স্থানে কতকগুলি লোকের নাম ও ঠিকানা লেখা ছিল। বাছিয়া সেইগুলি বাহির করিয়া লইলাম, এবং আহারান্তে সেই নামগুলি লইয়া পুনরায় থানা হইতে বহির্গত হইয়া গেলাম।
সেই নামগুলি কাহার, তাহা পাঠকগণ অনায়াসেই বুঝিতে পারিয়াছেন। যে সকল ব্যক্তি বারাঙ্গনা-গৃহে গমন পূৰ্ব্বক তাহাদিগকে মদ্য পানে অজ্ঞান করিয়া তাহাদিগের যথাসর্বস্ব অপহরণ করিয়া লইয়া যাওয়া অপরাধে পুলিস কর্তৃক ধৃত হইয়া কারাদণ্ড গ্রহণ করিয়াছে; এবং যে সকল ব্যক্তির উপর, সেই প্রকার অপরাধে সংসৃষ্ট থাকা বলিয়া সন্দেহ আছে, অথচ এ পর্য্যন্ত কারাদণ্ডে দণ্ডিত হয় নাই; এই উভয় শ্রেণীর নামই উহাতে আছে।
উক্ত নামগুলি সংগ্রহ করিয়া থানা হইতে বহির্গত হইবার আমার প্রধান উদ্দেশ্য এই যে, সেই লোকগুলির প্রত্যেকের অনুসন্ধান করিব। তাহাদিগের থাকিবার স্থানে গমন করিয়া উহাদিগের প্রত্যেককে দর্শন করিব। উহাদিগের আকৃতির সহিত, চপলার বর্ণিত সেই অজ্ঞাত পুরুষের আকৃতির সহিত মিলাইয়া দেখিব, এবং যদি কাহারও উপর আমার কোনরূপ সন্দেহ হয়, তাহা হইলে চপলাকে লইয়া গিয়া, সেই ব্যক্তিকে দেখাইব। চপলা যদি চিনিতে পারে, তাহা হইলে আমাদিগের কার্য্য-উদ্ধার হইয়া যাইবে। অপরাধী ধৃত হইবে, এবং অপহৃত দ্রব্যের পুনরুদ্ধার হইলেও হইতে পারিবে। আর যদি চপলা চিনিতে না পারে, তাহা হইলে সেই আকৃতির লোকের অনুসন্ধানে পুনরায় প্রবৃত্ত হইব।
মনে মনে এইরূপ ভাবিয়া, সেই প্রকার লোকের অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হইলাম। যে সকল ব্যক্তির সহিত চপলা—বর্ণিত হুলিয়ার* সহিত কথঞ্চিৎ মিলিত লাগিল, তাহাকেই চপলাকে দেখাইতে লাগিলাম। কিনতু চপলা কাহাকেও চিনিয়া উঠিতে পারিল না। যাহাকে তাহার সম্মুখে আনিলাম, তাহাকেই দেখিয়া কহিল, “না এ ব্যক্তি সে নহে।”
[* বিশিষ্ট অবয়বের। ]
প্রায় এক সপ্তাহ পৰ্য্যন্ত এইরূপ অনুসন্ধানে লিপ্ত থাকিয়া কত লোককে যে চপলাকে দেখাইলাম, তাহার সংখ্যা কে করে? কিন্তু কোন প্রকারেই আপনার কার্য্য উদ্ধার করিয়া উঠিতে পারিলাম না, বা কোন্ ব্যক্তিদ্বারা চপলার যথাসৰ্ব্বস্ব অপহৃত হইয়াছে, তাহারও কিছুমাত্র স্থির করিয়া উঠিতে পারিলাম না।
এইরূপে আরও পাঁচ সাত দিবস অতিবাহিত হইয়া গেল, চপলার অলঙ্কার পত্র যে ব্যক্তি অপহরণ করিয়াছে, তাহার কিছুমাত্র সন্ধান করিতে না পারিয়া, অতঃপর কি উপায় অবলম্বন করা যায় বসিয়া বসিয়া এইরূপ ভাবিতেছি, এরূপ সময় সংবাদ আসিল যে, বালাখানায় একটি স্ত্রীলোকের যথাসর্বস্ব অপহৃত হইয়াছে; আমাকে সেই অনুসন্ধানে লিপ্ত হইতে হইবে।
যে সময় আমার নিকট এই সংবাদ আসিয়া উপস্থিত হইল, তখন বেলা নয়টার অধিক হয় নাই।
কালবিলম্ব না করিয়া আমি বালাখানায় গিয়া উপস্থিত হইলাম। যে স্ত্রীলোকের যথাসৰ্ব্বস্ব অপহৃত হইয়াছে, অনুসন্ধানে তাহার বাড়ীও পাইলাম। কিন্তু গৃহে গিয়া সেই স্ত্রীলোককে দেখিতে পাইলাম না। জানিলাম, সেই স্ত্রীলোকটিও একটি বার-বনিতা, নাম কুমারী। কুমারী যে বাড়ীতে বাস করিয়া থাকে, সেই বাড়ীতে কুসুম নাম্নী আর একটি স্ত্রীলোক ভিন্ন অপর আর কেহই বাস করে না। কুসুম বাড়ীতেই ছিল; তাহাকে ডাকিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম, “তোমার নাম কি?”
কুসুম। আমার নাম কুসুম!
আমি। তোমরা কে কে এই বাড়ীতে বাস করিয়া থাক?
কুসুম। আমি ও কুমারী, উপরে থাকি। নীচে অপরাপর বাসাড়িয়াগণ বাস করিয়া থাকে।
আমি। কুমারী এখন কোথায়?
কুসুম। সে এখন হাস্পাতালে।
আমি। সে হাস্পাতালে গমন করিল কেন?
কুসুম। সরকারি লোক তাহাকে হাস্পাতালে লইয়া গিয়াছে।
আমি। কেন তাহাকে হাস্পাতালে লইয়া গেল?
কুসুম। সে অজ্ঞান অবস্থায় তাহার গৃহের ভিতর পড়িয়া ছিল। যখন কোনরূপেই তাহার জ্ঞান হইল না, তখন অনন্যোপায় হইয়া তাহাকে হাস্পাতালেই লইয়া যাইতে হইল।
আমি। সৰ্ব্ব প্রথম কে তাহাকে অজ্ঞান অবস্থায় তাহার গৃহের মধ্যে দেখিতে পায়?
কুসুম। আমি সৰ্ব্ব প্রথম তাহাকে অজ্ঞান অবস্থায় গৃহের ভিতর দেখিতে পাই।
আমি। কিরূপ ব্যাপার ঘটিয়াছিল, তাহার যতদূর তুমি অবগত আছ, তাহার আনুপূর্ব্বিক ঘটনা আমাকে বল দেখি।
কুসুম। গত কল্য সন্ধ্যার একটু পরেই একটি লোক কুমারীর গৃহে আগমন করে। সে যে কখন আসে, তাহা আমি জানি না; কিন্তু রাত্রি আন্দাজ আটটার সময় কি একটি সামান্য কার্য্যের নিমিত্ত আমি কুমারীর গৃহে যাইবার বাসনা করি। কিন্তু গৃহের নিকট গমন করিয়া দেখি, তাহার গৃহের দরজা ভিতর হইতে বন্ধ। আমি কুমারীকে বাহির হইতে ডাকিয়া দরজা খুলিয়া দিতে অনুরোধ করি; কিন্তু কুমারী তাহার গৃহের দরজা না খুলিয়াই গৃহের ভিতর হইতে আমাকে কহিল, এখন দরজা খুলিবার যো নাই। কারণ, আমার গৃহে এখন একটি বাবু আছেন।’ কুমারীর এই কথা শুনিয়া আমার গৃহে প্রত্যাগমন করি। কুমারীর গৃহের দিকে আর যাই নাই। সেই দিবস সন্ধ্যার সময় আমার গৃহে অপর কোন ব্যক্তি না আসায়, আমি চুপ করিয়া শয়ন করিয়া থাকি, এবং ক্রমে নিদ্রিত হইয়া পড়ি। আমার গৃহের দরজা কিন্তু খোলাই থাকে। আমার একটি বাবু আছে। তিনি অধিক রাত্রিতে আমার গৃহে আসিয়া থাকেন বলিয়া, রাত্রির প্রথম অংশে আমি আমার গৃহের দরজা প্রায়ই বন্ধ করি না।
‘রাত্রি আন্দাজ একটার সময় আমার নিদ্রা হঠাৎ ভঙ্গ হইল। দেখিলাম, আমার বাবু সে পৰ্য্যন্ত আগমন করেন নাই। ভাবিলাম, তবে বুঝি তিনি আর আসিবেন না। এই ভাবিয়া আমার গৃহের দরজা বন্ধ করিয়া শয়ন করিতে মনস্থ করিয়া, যখন দরজা বন্ধ করিতে গেলাম, সেই সময়ে কুমারীর গৃহ হইতে কেমন একরূপ “গোংড়ান” শব্দ আমার কর্ণে প্রবেশ করিল।
“কুমারীর গৃহ হইতে প্রকৃতই সেই শব্দ আসিতেছে কিনা, জানিবার অভিপ্রায়ে আমি কুমারীর গৃহের সন্নিকটে গমন করিলাম। দেখিলাম,—তাহার গৃহের দরজা পূর্ব্বের ন্যায় বন্ধ আছে, এবং দরজার ফাঁক দিয়া গৃহের আলোক অল্প অল্প বাহির হইতেছে। পূর্ব্বে যেরূপ অল্প অল্প শব্দ শুনিতে পাইতেছিলাম, কুমারীর গৃহের নিকট গমন করিলে সেই শব্দ আরও অধিক পরিমাণে কর্ণে প্রবেশ করিতে লাগিল। তখন আরও স্পষ্ট অনুমান হইতে লাগিল যে, সেই শব্দ কুমারীর গৃহ হইতেই বাহির হইতেছে।
“সেইরূপ শব্দ শ্রবণ করিয়া আমি আর কালবিলম্ব করিলাম না; ‘কুমারী’ ‘কুমারী’ বলিয়া ডাকিতে ডাকিতে তাহার দরজায় ধাক্কা দিলাম। এবার দরজা ভিতর হইতে বন্ধ ছিল না, ধাক্কা মারিতেই সেই দরজা খুলিয়া গেল। আমিও দ্রুতপদে গৃহের ভিতর প্রবেশ করিলাম। দেখিলাম, গৃহের ভিতর অপর আর কেহই নাই, কেবলমাত্র কুমারী অচেতন অবস্থায় গৃহের ভিতর পড়িয়া গোঁ গোঁ করিতেছে। তাহার গৃহের দেরাজ, আলমারী প্রভৃতি সমস্তই খোলা, এবং তাহার অঙ্গে যে সকল অলঙ্কার সচরাচর থাকিত, তাহার একখানিও নাই। আমি কুমারীকে অনেকবার ডাকিলাম, কিন্তু তাহার কোন উত্তরই প্রাপ্ত হইলাম না। পরিশেষে তাহার গায়ে হাত দিয়া বার বার ঠেলিলাম; কিন্তু তাহাতেও কোনরূপ উত্তর না পাইয়া, আমি গোলযোগ করিয়া উঠিলাম। আমার গোলযোগ শুনিয়া নীচের ভাড়াটীয়াগণ ক্রমে উপরে আসিয়া উপস্থিত হইল। তাঁহারা কুমারীর এইরূপ অবস্থা দৃষ্টি করিয়া তৎক্ষণাৎ তাহাকে হাস্পাতালে প্রেরণ করিলেন। সমস্ত রাত্রিই কুমারী অচেতন অবস্থায় হাস্পাতালে ছিল। এখন শুনিতেছি যে, তাহার জ্ঞান হইয়াছে। তাহাকে যে সকল কথা জিজ্ঞাসা করা যাইতেছে, এখন তাহার যথাযথ উত্তর প্রদান করিতেছে।”
আমি। যে লোকটি কুমারীর গৃহে আগমন করিয়াছিল, তুমি তাহাকে দেখিয়াছ কি?
কুসুম। না মহাশয়! আমি তাহাকে দেখি নাই। সে কোন্ সময় কুমারীর গৃহে প্রবেশ করিয়াছিল, তাহাও আমি জানি না।
আমি। তোমার বাবু সেই রাত্রিতে তোমার গৃহে আসেন নাই কেন?
কুসুম। কেন আসেন নাই, তাহা আমি বলিতে পারি নাই। এমন মধ্যে মধ্যে তিনি আসেনও না।
আমি। তোমার বাবুই ত কল্য রাত্রিতে কুমারীর গৃহে চুপে চুপে গমন করেন নাই?
কুসুম। তিনি কেন কুমারীর গৃহে গমন করিবেন?
আমি। কেন, তাহা আর বুঝিতে পারিতেছ না? কিছু লাভ করিবার আশায়।
কুসুম। আমার বাবু ওরূপ লাভের প্রত্যাশা করেন না, তিনি চোর নহেন।
আমি। তিনি ওরূপ লাভের প্রত্যাশা করেন কি না, বা তিনি চোর কি না, তাহা তুমি কিরূপে জানিলে? তাঁহার মনে কি আছে, তাহা তুমি বলিতে পার কি?
কুসুম। তাহাই যদি বুঝিতে না পারিব, তাহা হইলে কিরূপে বলিতেছি যে, তিনি সে প্রকৃতির লোক নহেন? আর আমার কথাই বা আপনি বিশ্বাস করিবেন কেন? কুমারী ত এখনও মরে নাই; বোধ হয়, মরিবেও না। সে আমার বাবুকে উত্তমরূপে চিনে। তাহাকেই জিজ্ঞাসা করিলে জানিতে পারিবেন যে, তাহার গৃহে যে ব্যক্তি আসিয়াছিল, সে আমার বাবু কি না।
কুসুমের কথা শুনিয়া বুঝিতে পারিলাম যে, সে নিতান্ত নির্ব্বোধ স্ত্রীলোক নহে। সেই সময় তাহাকে আর কোন কথা জিজ্ঞাসা করিবার প্রয়োজন বোধ করিলাম না। সুতরাং তখন তাহাকে আর কোন কথা জিজ্ঞাসা না করিয়া, কুমারী এখন কিরূপ অবস্থায় আছে, তাহার মুখ হইতে কোন কথা পাওয়া যাইবে কি না, তাহা জানিবার নিমিত্ত সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিলাম।
কুসুমের গৃহ হইতে বহির্গত হইয়া, যে হাস্পাতালে কুমারী এখন চিকিৎসাধীন আছে, সেই হাস্পাতালে গিয়া উপস্থিত হইলাম।
আমি যে সময়ে হাস্পাতালে গিয়া উপস্থিত হইলাম, সেই সময় কুমারী সম্পূর্ণরূপে প্রকৃতিস্থা হইতে না পারিলেও তাহার সম্পূর্ণরূপ জ্ঞানোদয় হইয়াছিল। যে সমস্ত প্রশ্ন তাহাকে জিজ্ঞাসা করা হইতেছিল, সে সকল সে উত্তমরূপে বুঝিতে পারিতেছিল, এবং তাহাদের যথাযথ উত্তরও প্রদান করিতেছিল। সেই সময়ে হাস্পাতালে যে ডাক্তার উপস্থিত ছিলেন, তাঁহার আদেশ লইয়া আমি নিম্ন-লিখিত মত কয়েকটি প্রশ্ন কুমারীকে জিজ্ঞাসা করিলাম।
আমি। তোমার নাম কুমারী?
কুমারী। হাঁ মহাশয়! আমার নাম কুমারী।
আমি। তোমার থাকিবার স্থান বালাখানায়?
কুমারী। হাঁ।
আমি। তুমি কুসুমকে চেন?
কুমারী। চিনি।
আমি। তুমি যে বাড়ীতে বাস কর, কুসুমও কি সেই বাড়ীতে বাস করিয়া থাকে?
কুমারী। হাঁ।
আমি। তুমি এখন কোথায় আছ, তাহা কিছু বুঝিতে পারিতেছ কি? এই স্থানেই কি বাস করিয়া থাক?
কুমারী। না মহাশয়! এ আমার থাকিবার স্থান নহে, এ হাস্পাতাল।
আমি। এখানে তোমাকে কে আনিল?
কুমারী। জানি না।
আমি। এখানে কেন আসিয়াছ, তাহা জান কি?
কুমারী। আমি অজ্ঞান হইয়া পড়িয়াছিলাম, তাই আমাকে এখানে আনা হইয়াছে।
আমি। কেন অজ্ঞান হইয়া পড়িয়াছিলে?
কুমারী। মদ খাইতে খাইতে।
আমি। কোথায় বসিয়া মদ খাইতেছিলে?
কুমারী। আমার গৃহে বসিয়া।
আমি। একাকী বসিয়া মদ খাইতেছিলে?
কুমারী। না, আর একটি বাবু ছিলেন।
আমি। সেই বাবুটির নাম কি?
কুমারী। জানি না।
আমি। তিনি কোথায় থাকেন?
কুমারী। তাহা জানি না।
আমি। কত দিবস হইতে তোমার সহিত তাহার পরিচয়?
কুমারী। পূর্ব্ব হইতে তাহার সহিত আমার পরিচয় ছিল না। এই প্রথম সে আমার গৃহে আসিয়াছিল।
আমি। তোমার মদ খাওয়া অভ্যাস আছে কি?
কুমারী। আছে, প্রায়ই আমি মদ খাইয়া থাকি।
আমি। মদ খাইতে খাইতে এবার তুমি যেরূপ ভাবে অজ্ঞান হইয়া পড়িয়াছিলে, সেরূপ ভাবে আর কখনও অজ্ঞান হইয়াছ কি?
কুমারী। না মহাশয়! এরূপ ভাবে পূর্ব্বে আর কখন আমি অজ্ঞান হই নাই।
আমি। এবার যে পরিমাণ মদ খাইয়া তুমি অজ্ঞান হইয়া পড়িয়াছিলে, সেই পরিমাণ মদ ইতিপূৰ্ব্বে কখনও তুমি খাইয়াছ কি?
কুমারী। ইহা অপেক্ষা অনেক অধিক পরিমাণে অনেক বার আমি মদ খাইয়াছি; কিন্তু এরূপ ভাবে আমি কখনও অজ্ঞান হইয়া পড়ি নাই। এবার আমি নিতান্ত সামান্য পরিমাণে মদ খাইয়াছিলাম, বোধ করি দুই কি তিন গেলাসের অধিক খাই নাই।
আমি। এবার মদ কোথা হইতে ক্রয় করিয়া আনা হইয়াছিল?
কুমারী। জানি না।
আমি। মদ কে আনিয়াছিল?
কুমারী। সেই আনিয়াছিল।
আমি। সে কখন মদ আনিয়াছিল? তোমার গৃহে প্রথম আসিবার সময়, কি সে মদ সঙ্গে করিয়া আনিয়াছিল?
কুমারী। না, সে সময়ে সে মদ আনে নাই। আমার গৃহে সামান্য একটু মদ ছিল, প্রথমে আমরা উভয়ে তাহাই পান করি। পরিশেষে সে নিজেই গমন করিয়া এক বোতল মদ ও কিছু আহারীয় আনয়ন করে। এই মদ হইতে কেবলমাত্র এক গেলাস পান করিতে করিতেই আমি অজ্ঞান হইয়া পড়ি। তাহার পর কি হইয়াছে, তাহার কিছুই আমি অবগত নহি।
আমি। বোতল খুলিবার পর সর্ব্ব প্রথম গেলাস মদ কে খাইয়াছিল, তুমি না সে?
কুমারী। প্রথম গেলাস সে পান করে নাই। বোতল হইতে ঢালিয়া প্রথমেই সৰ্ব্ব প্রথম গেলাস সে আমাকে প্রদান করে। সর্ব্ব প্রথম উহা পান করিতে আমি অসম্মত হই, কিন্তু তাহার অনুরোধ লঙ্ঘন করিতে না পারিয়া পরিশেষে আমি উহা পান করি।
আমি। যে সময় তুমি তাহার সহিত মদ্য পান করিতে আরম্ভ কর, এবং পরিশেষে যখন তুমি অজ্ঞান হইয়া পড়, সেই সময় তোমার অঙ্গে কোনরূপ অলঙ্কার ছিল নাকি?
কুমারী। ছিল বৈকি মহাশয়! আমার যাহা কিছু অলঙ্কার পত্র আছে, তাহার প্রায় সমস্তই আমার গায়ে ছিল।
আমি। কৈ, এখন ত তাহার একখানিও তোমার গায়ে দেখিতে পাইতেছি না?
কুমারী। আমিও দেখিতেছি যে, তাহার একখানিও আমার গায়ে নাই।
আমি। উহারা এখন কোথায় আছে, তাহা তুমি বলিতে পার কি?
কুমারী। আমার অজ্ঞান অবস্থায় এই হাস্পাতালে কেহ খুলিয়া রাখেন নাই কি?
আমি। না, এখানকার কোন ব্যক্তিই তোমার কোন অলঙ্কার খুলিয়া রাখেন নাই। যে সময়ে তুমি হাস্পাতালে আসিয়াছিলে, সেই সময় তোমার গায়ে কোন অলঙ্কারাদি ছিল না।
কুমারী। আমাকে হাস্পাতালে কে আনিয়াছিল?
আমি। পুলিশ।
কুমারী। তাহা হইলে পুলিশই সেই সকল অলঙ্কার রাখিয়া দিয়া থাকিবেন। কারণ, তাঁহারা আমাকে অচেতন অবস্থায় দেখিয়া মনে করিয়া থাকিবেন, এরূপ অবস্থায় আমার গাত্র হইতে অলঙ্কারগুলি চুরি হইবার সম্ভাবনা। সুতরাং তাঁহারা নিশ্চয়ই খুলিয়া রাখিয়া দিয়া থাকিবেন।
আমি। না, পুলিশ তোমার অলঙ্কার রাখিয়া দেন নাই। যে সময় পুলিশ তোমার বাড়ীতে গমন করিয়া তোমাকে অচেতন অবস্থায় দেখিতে পান, সেই সময় তোমার গাত্রে কোন অলঙ্কার ছিল না। এখন তুমি যেরূপ অলঙ্কার বিহীন অবস্থায় আছ, তখনও সেইরূপ অবস্থায় ছিলে।
কুমারী। তাহা হইলে, কুসুম কি বাড়ীর অপর কোন লোক আমার গহনাগুলি রাখিয়া দেয় নাই ত?
আমি। বাড়ীর কোন লোকই ত তাহা স্বীকার করে না।
কুমারী। তবে কি আমার সেই সমস্ত অলঙ্কার অপহৃত হইয়াছে?
আমি। এখন তাহার কিছুই আমরা বুঝিয়া উঠিতে পারিতেছি না। যে বাবু তোমার গৃহে আসিয়া তোমার সহিত মদ্য পান করিয়াছিল, সেই বাবু ত তোমার অলঙ্কারগুলি অপহরণ করিয়া লইয়া যায় নাই?
কুমারী। সেই বাবু চুরি করিয়াছে? না মহাশয়! তাহা আমার বোধ হয় না। তাহাকে বিশিষ্ট ভদ্রলোক বলিয়া বোধ হয়। এরূপ অবস্থায় আমি কিরূপে বিশ্বাস করিতে পারি যে, সে চোর?
আমি। কেন ভদ্রলোক কি কখনও চোর হয় না?
কুমারী। যে ভদ্রলোক, সে কি কখন চোর হয়? সে সকল সময়েই ভদ্রলোক।
আমি। তুমি এইমাত্র বলিয়াছ যে, সেই প্রথম দিনেই সে তোমার গৃহে আসিয়াছিল। ইঁহার পূর্ব্বে তুমি তাহাকে আর কখনও দেখ নাই। এরূপ অবস্থায় তুমি কিরূপে জানিলে, সে চোর নহে, ভদ্রলোক?
কুমারী। ব্যবহার দেখিলেই ভদ্র অভদ্র অনায়াসেই চিনিতে পারা যায়। তাহার ব্যবহার নিতান্ত ভদ্রলোকের ব্যবহারের মত।
আমি। সে তোমার গৃহে নিতান্ত অল্প সময় ছিল। সেই সামান্য সময়ের মধ্যে তুমি তাহার এরূপ কি ভদ্রতার পরিচয় পাইয়াছ যে, তুমি তাহাকে ভদ্রলোক স্থির করিয়া লইয়াছ?
কুমারী। সে আমার গৃহে আসিয়াই সমস্ত রাত্রি আমার গৃহে অতিবাহিত করিবার প্রস্তাব করে। আমি তাহার প্রস্তাবে সম্মত হইয়া সমস্ত রাত্রির নিমিত্ত আমি তাহার নিকট চারি টাকা প্রার্থনা করি। সে বিনা বাক্যব্যয়ে চারি টাকা দিতেই সম্মত হয়, এবং আপনার পকেট হইতে তৎক্ষণাৎ চারিটি টাকা বাহির করিয়া আমার হস্তে প্রদান করে। বলুন দেখি মহাশয়! এরূপ অবস্থায় তাহাকে ভদ্রলোক ভিন্ন অপর আর কি বলা যাইতে পারে? তদ্ব্যতীত যখনই সে মদ্য পান করিয়াছে, তখনই অগ্রে আমাকে না দিয়া, সে একবারও পান করে নাই। যে ব্যক্তির এইরূপ ব্যবহার, সে কখনও চোর হইতে পারে? বিশেষতঃ সে যতক্ষণ আমার নিকট ছিল, ততক্ষণ কোন প্রকার রূঢ় বা অভদ্র কথা বলে নাই।
আমি। তোমার এইরূপ বিশ্বাস বলিয়াই তোমার সর্ব্বনাশ হইয়াছে। ভাল, সেই টাকা কয়েকটি তুমি কোথায় রাখিয়াছিলে?
কুমারী। আমার দেরাজের ভিতর।
আমি। দেরাজের ভিতর তোমার সে টাকা নাই?
কুমারী। আপনি কিরূপে জানিলেন যে, আমার সেই টাকা নাই। আমি দেরাজের কোন্ স্থানে রাখিয়াছি, তাহাত আপনি দেখেন নাই।
আমি। তুমি তোমার টাকা দেরাজের কোন স্থানে রাখিয়াছ, তাহা আমি দেখি নাই সত্য; কিন্তু তোমার দেরাজ আমি এখন দেখিয়াছি, তাহার ভিতর তোমার টাকা নাই।
কুমারী। সে কি মহাশয়! তাহার ভিতর আমার যে আরও টাকা ছিল! আপনি দেরাজ কিরূপে দেখিলেন, তাহার চাবি আপনি কোথায় পাইলেন?
আমি। চাবি তুমি কোথায় রাখিয়া দিয়াছিলে?
কুমারী। অপর আর একটি বাক্সের ভিতর।
আমি। চাবি রাখিবার সময় সেই ব্যক্তি কোথায় ছিল?
কুমারী। সে আমার গৃহেই ছিল।
আমি। চাবি রাখিবার সময় সেই ব্যক্তি তবে নিশ্চয়ই দেখিয়াছিল?
কুমারী। দেখিয়াছিল বৈকি? কেন মহাশয়! চাবি সেই স্থানে নাই?
আমি। আছে বৈকি? চাবি তোমার গৃহের ভিতরেই আছে। তবে তুমি যে বাক্সের ভিতর রাখিয়াছিলে, সেই বাক্সের ভিতর নাই। উহা দেরাজের গায়ে লাগান আছে।
কুমারী। তবে কি আমার গৃহের সমস্ত দ্রব্য চুরি হইয়া গিয়াছে?
আমি। চুরি হইয়াছে সত্য; কিন্তু কি কি দ্রব্য অপহৃত হইয়াছে, তাহা আমি জানি না। কারণ, তোমার কি কি ছিল, এবং এখন তাহার কি কি দ্রব্যই বা নাই, তাহা আমরা কি প্রকারে জানিব?
আমার কথা শুনিয়া কুমারী মাথায় হাত দিয়া সেই স্থানে বসিয়া পড়িল। আমি তাহাকে আর কোন কথা জিজ্ঞাসা না করিয়া সেই স্থান হইতে বহির্গত হইলাম। কিন্তু হাস্পাতালের বাহিরে আসিবামাত্রই আমার আর একটি কথা মনে পড়িল; সুতরাং পুনরায় আমাকে হাস্পাতালের ভিতর প্রবেশ করিতে হইল। যে স্থানে আমি কুমারীকে ছাড়িয়া আসিয়াছিলাম, পুনরায় গমন করিয়া তাহাকে সেই স্থানেই সেইরূপ অবস্থায় দেখিতে পাইলাম। সেই সময় আমি কুমারীকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “ যে বাড়ীতে তুমি বাস কর, সেই বাড়ীতে কুসুম নাম্নী আর একটিস্ত্রীলোক বাস করে। সেই কুসুমের যে একটি উপপতি আছে, তুমি তাহাকে চিন কি?” আমার কথার উত্তরে কুমারী কহিল, “হাঁ মহাশয়! আমি উত্তমরূপে চিনি। যে বাবুটি আমার গৃহে আসিয়াছিল, তাহা অপেক্ষা কুসুমের বাবুর বয়ঃক্রম অনেক অধিক।”
এই সময়ে কুসুমের নিকট সেই ব্যক্তির চেহারা প্রভৃতির কথা জিজ্ঞাসা করিলাম। উত্তরে সে যেরূপ কহিল, তাহাতে বুঝিতে পারিলাম যে, যেরূপ চেহারার লোক চপলার অলঙ্কার পত্র ইতিপূর্ব্বে অপহরণ করিয়াছিল, তাহার চেহারার সহিত ইহার চেহারায় অনেকটা সাদৃশ্য আছে। এই বিষয় জানিতে পারিয়াই আমার মনে কেমন এক ধারণা হইল যে, যে ব্যক্তি পূর্ব্বে চপলার গৃহ হইতে চুরি করিয়াছে, সেই ব্যক্তিই আজ কুমারীর সর্ব্বনাশ করিয়াছে।
তৃতীয় পরিচ্ছেদ
কুমারীর নিকট হইতে পূৰ্ব্ব-কথিত বিষয়গুলি অবগত হইয়া, সেই হাস্পাতালের ডাক্তারের সহিত আমি পুনরায় সাক্ষাৎ করিলাম। তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিয়া জানিতে পারিলাম যে, কুমারী যেরূপ ভাবে হতজ্ঞান হইয়া পড়িয়াছিল, কেবলমাত্র মদ্য পান করিলে, সেরূপ ভাবে জ্ঞান-শূন্য হইতে পারে না। তাঁহার বিবেচনায় সুরার সহিত অপর কোন বিষাক্ত দ্রব্য মিশ্রিত ছিল। কিন্তু কিরূপ বিষ মিশ্রিত ছিল, তাহা রাসায়নিক পরীক্ষা ভিন্ন তিনি বলিতে পারেন না।
চপলার গৃহ হইতে চুরি হইবার পর আমি যেরূপভাবে অনুসন্ধান করিয়া আসিয়াছিলাম, এখনও পুনরায় সেইরূপ ভাবে অনুসন্ধানে নিযুক্ত হইলাম। সেইরূপ অপরাধে যাহারা দণ্ড গ্রহণ করিয়াছে, যাহাদিগের উপর সেইরূপ অপরাধের নিমিত্ত আমরা এ পর্য্যন্ত সন্দেহ করিয়া আসিতেছি, এবং চপলা ও কুমারী বর্ণিত চেহারার লোকের যতদূর সংগ্রহ করিতে পারিলাম, কোন না কোনরূপ উপায় অবলম্বন করিয়া, তাহাদিগের প্রত্যেককেই চপলা ও কুমারীকে দেখাইতে লাগিলাম। কিন্তু উহারা তাহাদিগের কাহাকেই চিনিয়া উঠিতে পারিল না।
এরূপ ধরণের চুরি কলিকাতার ভিতর প্রায় এক বৎসর কাল ঘটিয়াছিল না। কিন্তু উপর্যুপরি একই ধরণের দুইটি চুরি হওয়াতে আমাদিগের মনে নিশ্চিত ধারণা হইল যে, সেই প্রকারের কোন চোর কলিকাতার ভিতর আগমন করিয়াছে, বা কোন লোক এই প্রকারে চুরি করিতে আরম্ভ করিয়াছে। এখন হইতেই যদি সেই ব্যক্তি সহজে ধৃত না হয়, তাহা হইলে ক্রমে সেই প্রকারে আরও অনেক চুরি হইতে থাকিবে, এবং আমাদিগকে এইরূপ ভাবে ক্রমেই ভুগিতে হইবে।
মনে মনে এরূপ ভাবিয়া যে যে স্থানে বার-বনিতাগণের বাস, সেই সেই স্থানে সেইরূপ আকৃতির লোক কেহ আইসে কি না, তাহা জানিবার অভিপ্রায়ে গুপ্ত পাহারার বন্দোবস্ত করিয়া দিলাম। সহরের বাহির হইতে সেই চোর আগমন করিয়া, এই রূপ ভাবে চুরি করিয়া যদি পুনরায় কলিকাতার বাহিরে গমন করে, এই ভাবিয়া ষ্টিমার ঘাট, রেলওয়ে ষ্টেশন, পুল, সহরে প্রবেশ করিবার পথ সকল, যতদূর সম্ভব দেখিতে লাগিলাম। কিন্তু কোনরূপেই সেই চোরকে ধৃত করিতে সমর্থ হইলাম না, বা তাহার কোনরূপ সন্ধানও করিয়া উঠিতে পারিলাম না। ক্রমে দিন গত হইতে লাগিল। এক এক করিয়া প্রায় এক মাস গত হইতে না হইতে পুনরায় আর একটি চুরির সংবাদ আসিয়া আমার নিকট উপস্থিত হইল। এবার যে সংবাদ আসিল, তাহা কেবলমাত্র সংবাদ নহে; সেই সংবাদের সঙ্গে সঙ্গে ঊর্দ্ধতন কর্ম্মচারীর নিকট হইতে একখানি কড়া পত্র আসিয়াও উপস্থিত হইল। সেই পত্রের মর্ম্ম এইরূপ :—
“এই প্রকারের চুরি দেখিতে দেখিতে তিনটি হইয়া গেল; কিন্তু এ পর্যন্ত সেই চোর ধৃত হইল না। এইরূপ ভাবে নিত্য নিত্য একই ব্যক্তির দ্বারা যদি চুরি হইবে, এবং সেই চোর যদি ধৃত না হইবে, তাহা হইলে পুলিশ রাখিবার প্রয়োজন কি? ডিটেক্টিভ-এরই বা আবশ্যক কি?”
ঊর্দ্ধর্তন কর্মচারীর নিকট হইতে এইরূপ পত্র পাইয়া সবিশেষ চিন্তিতান্তঃকরণে থানা হইতে বহির্গত হইলাম, এবং যে স্থানে চুরি হইয়াছিল, সেই স্থানে গিয়া উপনীত হইলাম।
এবার যে বাড়ী হইতে চুরি হইয়াছে, দেখিলাম, তাহা গলির ভিতরে নহে; চিৎপুর রাস্তার উপর। বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিয়াই জানিতে পারিলাম যে, অপরাপর ভাড়াটীয়াগণের মধ্যে মল্লিকা নাম্নী একটি স্ত্রীলোকও সেই বাড়ীতে বাস করে। দোতলার উপরিস্থিত বারান্দার সংলগ্ন যে তিন চারি খানি গৃহ আছে, তাহারই একখানি মল্লিকার দ্বারা অধিকৃত। মল্লিকা একটি চরিত্রহীনা স্ত্রীলোক হইলেও কুপ্রবৃত্তি ও অসদ্ উপায় অবলম্বন করিয়া, অনেকগুলি অলঙ্কারের সংস্থান করিয়াছিল।
মল্লিকার গৃহের ভিতর প্রবেশ করিয়া দেখিলাম,—-চপলা ও কুমারীর গৃহের অবস্থা যেরূপ ঘটিয়াছিল, ইহার গৃহের অবস্থাও প্রায় সেইরূপ ঘটিয়াছে। আলমারী, বাক্স প্রভৃতি যাহা গৃহের ভিতর আছে, তাহার সমস্তই খোলা। চাবির গোচ্ছা সেই স্থানেই পড়িয়া আছে। কিন্তু উহার ভিতর হইতে কি কি দ্রব্য অপহৃত বা স্থানান্তরিত হইয়াছে, তাহা বাড়ীর অপরাপর কেহই অবগত নহে; অথচ মল্লিকাকেও সেই স্থানে দেখিতে পাইলাম না।
বাড়ীর অপরাপর ভাড়াটীয়াগণের নিকট হইতে নিম্ন লিখিত কয়েকটি বিষয় অবগত হইতে পারিলাম।
১ম। রাত্রি আন্দাজ এগারটার সময় যখন মল্লিকা বাহিরের বারান্দায় বসিয়াছিল, সেই সময় একটি অপরিচিত লোক তাহার নিকট আগমন করে, ও তাহার সহিত দুই একটি কথাবার্তা হইবার পরই উভয়ে মল্লিকার গৃহে প্রবেশ করে।
২য়। ইহার কিয়ৎক্ষণ পরেই বারান্দার দরজা খুলিয়া মল্লিকা পুনরায় বারান্দায় গমন করে, এবং সেই স্থান হইতে বাড়ীর নীচে যাহার পানের দোকান আছে, তাহাকে এক বোতল মদ আনিতে কহে। পরে পুনরায় আপন গৃহে প্রবেশ করিয়া, গৃহের দরজা বন্ধ করিয়া দেয়।
৩য়। কিছুক্ষণ পরেই পানওয়ালা এক বোতল মদ, কিছু খাবার ও কয়েক দোনা পান লইয়া আইসে, এবং মল্লিকার গৃহে প্রবেশ করিয়া, সেই সকল দ্রব্য প্রদান পূর্ব্বক প্রস্থান করে।
৪র্থ। অপর কোন দিবস কোন ব্যক্তি মল্লিকার গৃহে আগমন করিলে, মল্লিকা প্রায়ই তাহার গৃহের দরজা বন্ধ করিত না। তাহার গৃহে বসিয়া সেই ব্যক্তি যদি মদ্যপানে প্রবৃত্ত হইত, তাহা হইলে মল্লিকা বাড়ীর অপরাপর ভাড়াটীয়া গণের মধ্যে কাহাকে না কাহাকেও আপনার নিকট ডাকাইয়া আনিত ও পরিশেষে সকলে মিলিয়া একত্র মদ্য পান করিত। এবার মল্লিকা কিন্তু তাহার ঠিক বিপরীত করিয়াছিল। আগন্তুক ব্যক্তি তাহার গৃহে আসিবামাত্রই মল্লিকা তাহার সহিত দুই চারিটি কথা বলে, ও আপনার গৃহের দরজা বন্ধ করিয়া দেয়। পরিশেষে মদ্য পান করিবার সময়ও অপরাপর দিবসের মত আর কাহাকেও ডাকে না, গৃহের দরজা বন্ধ করিয়া তাহারাই দুইজনে মদ্য পান করিতে প্রবৃত্ত হয়।
৫ম। রাত্রি আন্দাজ দুইটার সময় বাড়ীর অপর আর একটি স্ত্রীলোক তাহার কোন প্রয়োজনের নিমিত্ত আপন গৃহ হইতে বাহিরে আগমন করে। সেই প্রথমতঃ মল্লিকার গৃহ হইতে কেমন একরূপ অস্ফুট শব্দ শুনিতে পায়। সে-ই মল্লিকার গৃহের নিকট গমন করিয়া, দরজায় ধাক্কা দেয়। সেই সময় দরজা ভিতর হইতে বন্ধ ছিল না। সুতরাং ধাক্কা দিবামাত্র দরজা আপনা হইতেই খুলিয়া যায়। সেই স্ত্রী লোকটি তখন মল্লিকার গৃহের ভিতর প্রবেশ করিয়া দেখিতে পায় যে, গৃহে আর কোন ব্যক্তি নাই, কেবলমাত্র মল্লিকা অচেতন অবস্থায় পড়িয়া আছে। তাহার অঙ্গে যে সকল অলঙ্কার পত্র ছিল, তাহার একখানিও নাই; অধিকন্তু তাহার গৃহে আলমারী, বাক্স প্রভৃতি যাহা কিছু ছিল, তাহার সমস্তই খোলা। এই ব্যাপার দৃষ্টি করিয়া স্ত্রীলোকটি গোলযোগ করিয়া উঠে। এই গোলযোগ শ্রবণ করিয়া বাড়ীর অপরাপর ভাড়াটীয়াগণও সেই গৃহে আসিয়া উপস্থিত হয়, ও তাহারাও মল্লিকার দশা দেখিতে পায়। ক্রমে এই সংবাদ পাহারাওয়ালার কর্ণগোচর হয়, এবং পরিশেষে পুলিস কর্মচারীগণ আসিয়া মল্লিকাকে হাস্পাতালে পাঠাইয়া দেয়।
মল্লিকা যে বাড়ীতে বাস করে, সেই বাড়ী হইতে পূৰ্ব্ববর্ণিত ঘটনা সকল অবগত হইয়া, মল্লিকাকে দেখিবার নিমিত্ত হাস্পাতালে গিয়া উপস্থিত হইলাম।
যে সময় আমি হাস্পাতালে গিয়া উপস্থিত হইলাম, সেই সময় পৰ্য্যন্ত মল্লিকা সম্পূর্ণরূপে সংজ্ঞা-লাভ করিতে পারে নাই। সুতরাং সেই সময় তাহাকে কোন কথা জিজ্ঞাসা করা নিষ্প্রয়োজন বিবেচনা করিয়া, সেই স্থান পরিত্যাগ করিলাম।
পাঠকগণ পূৰ্ব্বেই অবগত হইয়াছেন যে, একজন পানওয়ালা এক বোতল মদ ও কিছু খাদ্যের সহিত মল্লিকার গৃহে প্রবেশ করিয়াছিল। আসামী সম্বন্ধে পানওয়ালা যদি কোন কথা বলিতে পারে, এই ভাবিয়া সেই পানওয়ালার নিকট গমন করিলাম।
পানওয়ালাকে জিজ্ঞাসা করিয়া আসামী সম্বন্ধে সবিশেষ কোন কথাই অবগত হইতে পারিলাম না। সে আসামীকে যতদূর দেখিতে পাইয়াছিল, এবং তাহার আকৃতি প্রকৃতি সম্বন্ধে যতদূর সে বলিতে পারিল, তাহাতে স্পষ্টই বুঝিতে পারিলাম যে, সে ব্যক্তি কর্তৃক চপলা ও কুমারীর যথাসর্বস্ব অপহৃত হইয়াছে, এই ব্যক্তিও সেই ব্যক্তি। আরও ভাবিলাম যে, যত দিবস পর্য্যন্ত সেই চোর ধৃত না হইবে, ততদিবস বার-বনিতাদিগের গৃহ হইতে এইরূপ ভাবে অনবরত চুরি হইতেই থাকিবে। কিন্তু কিরূপে যে এই প্রকারের চুরি বন্ধ করিতে সমর্থ হইব, ভাবিয়া চিন্তিয়া তাহার কোন উপায়ই স্থির করিয়া উঠিতে পারিলাম না।
চতুর্থ পরিচ্ছেদ
চপলা ও কুমারীর ঘরে চুরি হইবার পর আমার সাধ্যমত যতদূর অনুসন্ধান হইবার সম্ভাবনা, তাহার কিছুই ত্রুটি করি নাই; কিন্তু প্রকৃত চোরের কোনরূপ সন্ধান করিয়া উঠিতেও পারি নাই। এখন আবার কোন্ পন্থা উদ্ভাবন করিয়া পুনরায় অনুসন্ধানে নিযুক্ত হইব, মনে মনে তাহারই চিন্তা করিতে লাগিলাম।
পূর্ব্বে যেরূপভাবে অনুসন্ধান করিয়াছিলাম, সেইরূপ ভাবে অনুসন্ধান করিতে করিতে সেই দিবস গত হইয়া গেল, পর দিবসেরও অধিক সময় কাটিয়া গেল; কিন্তু কাহার নিকট হইতে আশাপ্রদ কোন সংবাদই প্রাপ্ত হইলাম না।
পর দিবস সন্ধ্যার পূর্ব্বে পুনরায় মল্লিকার বাড়ীতে গিয়া উপস্থিত হইলাম। সেই সময় দেখিতে পাইলাম, মল্লিকা হাসপাতাল হইতে আপন বাড়ীতে প্রত্যাগমন করিয়াছে। এখন আর তাহার অজ্ঞান অবস্থা নাই, সম্পূর্ণরূপে জ্ঞানোদয় হইয়াছে। কোন কথা তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলে, এখন সে তাহার প্রকৃত উত্তর প্রদান করিতে সম্পূর্ণভাবে সমর্থ।
কিরূপে মল্লিকার এই দশা ঘটিয়াছিল, তাহা তাহাকে জিজ্ঞাসা করিয়া জানিতে পারিলাম যে, চপলা ও কুমারী যেরূপ ভাবে নবাগত একটি লোকের দ্বারা প্রতারিত হইয়াছিল, মল্লিকাও প্রায় সেইরূপে প্রতারিত হইয়া, তাহার সহিত মদ্য পানে প্রবৃত্ত হয়, ও ক্রমে সেও অজ্ঞান হইয়া পড়ে। মল্লিকার নিকট হইতে উক্ত নবাগত লোকটির আকৃতি আদি যেরূপ অবগত হইতে পারিলাম, তাহাতে আমাদিগের মনের বিশ্বাস আরও দৃঢ়ীভূত হইল। সকলেই একবাক্যে কহিতে লাগিলেন, এই তিনটি ঘটনাই একই ব্যক্তির দ্বারা ঘটিয়াছে।
ইহার পর আরও পাঁচ সাত দিবস উক্ত মোকদ্দমার অনুসন্ধান করিলাম; কিন্তু অপরাধীর কোনরূপ সন্ধান করিতে না পারিয়া, নিতান্ত চিন্তিতান্তঃকরণে এক দিবস পুনরায় মল্লিকার ঘরে গিয়া উপনীত হইলাম।
ঘরের ভিতর প্রবেশ করিয়া মল্লিকাকে দেখিতে পাইলাম না। ঘরের দরজা খুলিয়া রাখিয়া, মল্লিকা পুনরায় কোথায় গমন করিল, মনে মনে এইরূপ ভাবিতেছি, সেই সময় সদর রাস্তার উপর সেই বাড়ীর যে বারান্দা ছিল, হঠাৎ সেইদিকে আমার নয়ন আকৃষ্ট হইল। দেখিলাম,—মল্লিকা সেই বারান্দায় উপরিস্থিত একখানি বেঞ্চের উপর বসিয়া রহিয়াছে। আমিও দুই এক পা করিয়া, মল্লিকার নিকট গমন করিলাম। কেন যে আমি তাহার নিকট গমন করিলাম, তাহা জানি না; কিন্তু মল্লিকা আমাকে দেখিবামাত্র আমাকে সেইস্থানে বসিতে কহিল। আমিও সেই বেঞ্চের উপর উপবেশন করিলাম।
কিরূপে সেই ব্যক্তি তাহার ঘরে আগমন করিয়াছিল, পানওয়ালা ব্যতীত অপর আর কোন ব্যক্তি তাহাকে দেখিয়াছে কি না, অপহৃত প্রত্যেক অলঙ্কারগুলি ওজন কত ছিল, ও কোন্ কোন্ কারিগরের নিকট হইতে সেই সকল অলঙ্কার প্রস্তুত করিয়া লওয়া হয়, প্রভৃতি এই প্রকারের কথা মল্লিকাকে জিজ্ঞাসা করিতেছি, ও মল্লিকা আমার কথার উত্তর প্রদান করিতেছে, এমন সময় মল্লিকা আমাকে শীঘ্র ডাকিয়া কহিল, “দেখুন মহাশয়! দেখুন মহাশয়! ঐ বাবুর মতন, সেই বাবুটির চেহারা।”
উত্তরে আমি কহিলাম, “কোন্ বাবুটির মতন।” এই বলিতে বলিতে একখানি দ্রুতগতি চৌঘুড়ি উত্তর দিক হইতে বারান্দার সম্মুখে আসিয়া উপস্থিত হইল।
সেই সময় মল্লিকা পুনরায় কহিল, “ যে বাবু চৌঘুড়িতে বসিয়া আছেন, প্রায় উহারই মতই তাহার চেহারা।” মল্লিকার এই কথা শুনিয়া চৌঘুড়িস্থিত বাবুটিকে দেখিবার নিমিত্ত সেইদিকে দৃষ্টিপাত করিলাম; কিন্তু বাবুটিকে সম্পূর্ণরূপে দেখিতে পাইলাম না। মুহূর্তের মধ্যে চৌঘুড়ি সেই বারান্দার সম্মুখ হইতে দূরে গিয়া উপস্থিত হইল। বাবুটিকে দেখিতে পাইলাম না সত্য; কিন্তু চৌঘুড়ির ঘোড়াগুলি কিরূপ বর্ণের ও সহিস কোচমানগণ কিরূপ পোষাক পরিয়া ছিল তাহার কিয়দংশ যেন দেখিতে পাইলাম।
যে ব্যক্তি চৌঘুড়িতে উপবেশন করিয়া, বায়ু সেবনার্থ সন্ধ্যার পূর্ব্বে বাহির হইয়াছেন, তিনি কোনরূপে চোর ত হইতেই পারেন না; কারণ তিনি নিশ্চয়ই কলিকাতার এক জন বড়লোক হইবেন। মনে মনে এইরূপ ভাবিলাম সত্য, কিন্তু ঐ বাবুটিকে একবার দেখিবার নিমিত্ত নিতান্ত ইচ্ছা হইল। কারণ, আমরা যে চোরের অনুসন্ধান করিয়া বেড়াইতেছি, তাহার আকৃতিতে যদি এই বাবুর আকৃতির সহিত কিয়ৎ পরিমাণে সাদৃশ্য থাকে, তাহ হইলে, সেই চোরকে অনুসন্ধান করিয়া বাহির করিবার একটি সুন্দর উপায় হইবে। ঐরূপ আকৃতি-বিশিষ্ট লোককে দেখিতে পাইলেই, গুপ্ত অনুসন্ধানে জানিতে পারিব, সেই ব্যক্তি কে, বা আবশ্যক হইলে, চপলা, কুমারী বা মল্লিকা প্রভৃতি যাহারা তাহাকে দেখিয়াছে, তাহাদিগকে আমি অনায়াসেই দেখাইতে সমর্থ হইব।
মনে আরও ভাবিলাম,—চৌঘুড়িতে করিয়া বাবু যখন বায়ু সেবনে বাহির হইয়াছেন, অভাবপক্ষে রাত্রি ৭/৮ টার মধ্যে তাহাকে নিশ্চয়ই ফিরিতে হইবে। আর যদি সে এই পথেই প্রত্যাগমন করে, তাহা হইলে তাহার চেহারা অনায়াসেই দেখিয়া লইতে পারিব। এই ভাবিয়া আমি সেই বারান্দার উপরেই স্থির ভাবে বসিয়া রহিলাম।
আমি যাহা ভাবিয়াছিলাম, কাৰ্য্যেও দেখিলাম যে, তাহাই হইল। তিন চারিটি ঘোড়া একত্রে দ্রুতবেগে গমন করিলে, যেরূপ ভাবে তাহাদিগের পদশব্দ উত্থিত হয়, সন্ধ্যা ছয়টার সময়ই সেইরূপ শব্দ হঠাৎ আমার কর্ণে আসিয়া উপস্থিত হইল। চকিতের ন্যায় আমি রাস্তার দিকে নয়ন ফিরাইলাম। দেখিতে দেখিতে সেই চৌঘুড়ি দক্ষিণ দিক হইতে আসিয়া পুনরায় আমাদিগের চক্ষুর বাহির হইয়া গেল। এবারও বাবুটিকে উত্তমরূপে দেখিতে পাইলাম না।
আমার মনের ইচ্ছা পূর্ণ করিতে না পারিয়া, নিতান্ত দুঃখিতান্তকরণে মল্লিকার বারান্দা পরিত্যাগ করিলাম, ও রাস্তায় উপনীত হইয়া ধীরে ধীরে পদব্রজে চিৎপুর রাস্তা বাহিয়া দক্ষিণ মুখে গমন করিতে লাগিলাম। ইচ্ছা থানায় গমন করি।
যে সময় আমি ফৌজদারী বালাখানার সন্নিকটে আসিয়া উপস্থিত হইলাম, সেই সময় দেখিলাম, পূৰ্ব্ব কথিত চৌঘুড়ি খানি আমার পশ্চাৎ দিক হইতে আস্তে আস্তে আগমন করিতেছে। উহাতে কোচম্যান ও সহিসগণ ব্যতীত কোন আরোহী নাই।
এই অবস্থা দৃষ্টি করিয়া আমি সেইস্থানে দণ্ডায়মান হইলাম। চৌঘুড়িখানি আমার সম্মুখে আসিয়া উপস্থিত হইল। সেই সময় আমি কোচম্যানকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “এ কাহার চৌঘুড়ি?” উত্তরে একজন সহিস কহিল, “দেখিতে পাইতেছেন না, ইহা আড়গড়ার গাড়ি?” আমি পুনরায় জিজ্ঞাসা করিলাম, “কোন্ বাবু তোমাদিগের এই গাড়ি ভাড়া লইয়াছিল?” এবার কিন্তু কেহই আমার কথার কর্ণপাত করিল না, বা কোনরূপ উত্তর প্রদানও করিল না। আমি বুঝিলাম, –উহারা আমার কথার আর কোনরূপ উত্তর প্রদান করিবে না। তখন অন্য আর কোনরূপ উপায় দেখিতে না পাইয়া, একখানি ঠিকাগাড়ি ভাড়া করিয়া আমি সেই চৌঘুড়ির পশ্চাৎ পশ্চাৎ গমন করিয়া দেখিলাম, উহা কোন আড়গড়ায় প্রবেশ করে।
চৌঘুড়ি যে আড়গড়ায় প্রবেশ করিল, সেই আড়গড়া যে থানার এলাকায়, পরিশেষে আমি সেই থানায় গমন করিয়া, সেই থানার জনৈক কর্ম্মচারীকে সঙ্গে লইয়া পুনরায় সেই আড়গড়ায় গিয়া উপস্থিত হইলাম। এখন আমরা আড়গড়ার যাহাকে যাহা জিজ্ঞাসা করিলাম, আমাদিগকে পুলিশ জানিতে পারিয়া, তাহারা আমাদিগের প্রশ্নের যথাযথ উত্তর প্রদান করিল।
কোন্ বাবু উক্ত চৌঘুড়ি ভাড়া করিয়াছেন, কোচম্যান সহিসগণ তাহা বলিতে পারিল না; কিন্তু এইমাত্র কহিল যে, যে বাবু চৌঘুড়ি ভাড়া করিয়াছেন, তিনি সোনাগাছিতে একটি স্ত্রীলোকের বাড়ীতে থাকেন। কল্য সন্ধ্যার পূর্ব্বে যখন তাহারা পুনরায় চৌঘুড়ি লইয়া যাইবে, সেই সময় চৌঘুড়ির পশ্চাৎ পশ্চাৎ গমন করিলেই সেই বাড়ী ও বাবুকে দেখিতে পাইব।
এই বন্দোবস্ত মতেই কার্য্য হইল। পর দিবস একখানি গাড়ি করিয়া চৌঘুড়ির পশ্চাৎ পশ্চাৎ গমন করিলাম। সোণাগাছির যে বাড়ীতে সেই বাবু থাকিতেন, সেই বাড়ীর সম্মুখে গিয়া চৌধুড়ি দণ্ডায়মান হইল। কিয়ৎক্ষণ পরেই বাবু উপর হইতে নাবিয়া চৌঘুড়িতে উঠিলেন, ও বায়ু সেবন করিবার অভিপ্রায়ে নিয়মিতরূপে গমন করিলেন।
বাবুটি বহির্গত হইয়া যাইবার পরই, আমরা সেই বাড়ীর ভিতর গমন করিয়া, উক্ত বাবুটি কে, তাহার অনুসন্ধান করিলাম; কিন্তু সেই বাড়ীতে যতগুলি বারবনিতা ছিল, তাহারা কেহই উহার প্রকৃত কথা বলিতে পারিল না। সকলেই কহিল, “উনি প্রকৃত বঙ্গদেশীয় বড় লোক, বেড়াইবার নিমিত্ত কলিকাতায় আসিয়া এইস্থানে অবিস্থিতি করিতেছেন।”
এ কথা আমার ভাল লাগিল না। ভাবিলাম,,—যে, এত বড়লোক, সে বারবনিতার গৃহে রাত্রি দিবস যাপন করিবে কেন? মনে মনে এইরূপ ভাবিয়া আর কালবিলম্ব না করিয়া তৎক্ষণাৎ আমি আমার গাড়িতেই সেইস্থান হইতে বহির্গত হইলাম, এবং চপলা, কুমারী, মল্লিকা, ও আরও কয়েকজন পুলিস কর্মচারীকে সঙ্গে লইয়া পুনরায় সেই বাড়ীতে গিয়া উপস্থিত হইলাম। বাবুটি তখনও প্রত্যাগমন করেন নাই। যাহার ঘরে সেই বাবুটি অবস্থিতি করিতেন, তাহার ঘরের সন্নিকটবর্ত্তী অপর আর একটি বারবনিতার ঘরে আমরা উপবেশন করিলাম। কিয়ৎক্ষণ পরেই বাবুটি প্রত্যাগমন করিলেন। ইহাকে দেখিবামাত্রই চপলা, কুমারী, ও মল্লিকা একবারেই বলিয়া উঠিল, ‘এ-ই সে-ই।’
বলা বাহুল্য, বাবুটি তৎক্ষণাৎ ধৃত হইলেন। তাহার থাকিবার স্থান অনুসন্ধান করায়, তিনটি চুরিরই দুই একখানি গহনা প্রাপ্ত হওয়া গেল। তদ্ব্যতীত আরও কতকগুলি অলঙ্কার পাওয়া গিয়াছিল। পরিশেষে জানিতে পারা যায়, উক্ত অলঙ্কারগুলি ঢাকা হইতে অপহরণ করিয়া আনিয়াছে।
বাবুর হাতে হাতকড়ি দিয়া, সেই চৌঘুড়িতে চড়াইয়া আপনার থানায় আনিলাম।
ইহাকেই কহে “চোর চৌঘুড়িতে।”
[মাঘ, ১৩০৩]