চোর আর সাধু

চোর আর সাধু

রাত তখন গভীর৷ নদীর ধারে এক সাধুবাবা তখনও জেগে আছেন! তাঁর সামনে জ্বলছে ধুনির আগুন, তার ওপাশে একটা মড়ার মাথার খুলি৷ সেই দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে সাধুবাবা মনে মনে কথা বলছেন৷ এটাই হল তাঁর ধ্যান৷

বেশ জ্যোৎস্না আছে, আকাশে অনেক তারা৷ হাওয়া বইছে ঠান্ডা ঠান্ডা৷ এই সময় সবাই আরামে ঘুমোয়, শুধু সাধুরাই জেগে থাকে৷

না, শুধু সাধুরা নয়, চোরেরাও জেগে থাকে এই রকম সময়ে৷

পেছনে কিসের শব্দ হতে সাধুবাবা মুখ ফিরিয়ে তাকালেন৷ একটা লোক এই দিকেই দৌড়ে আসছে৷ লোকটা একেবারে সাধুবাবার কোলের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে হাঁপাতে হাঁপাতে বলতে লাগল, বাবা, আমাকে বাঁচান৷ দয়া করুন৷ আর পারছি না৷

সাধুবাবা বললেন, আরে ওঠো ওঠো৷ কী হয়েছে বল৷ কারুর অসুখ?

লোকটি বলল, না, সাধুবাবা৷ পুলিশ আমায় তাড়া করেছে৷ পাঁচদিন ধরে পালিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছি৷ কিন্তু আজ আর রক্ষে নেই৷ পুলিশ এই জঙ্গলে ঢুকে পড়েছে৷ এখান থেকে আর বেরুতে পারব না আমি!

সাধুবাবা চঞ্চল হয়ে বললেন, পুলিশ? কেন, পুলিশ তোমায় তাড়া করেছে কেন? তুমি কি অপরাধ করেছ?

লোকটি বলল, বিশেষ কিছু করিনি বাবা! একদিন শুধু ভুল করে একটু চুরি করে ফেলেছি৷ তারপর থেকে পুলিশ আমার পিছু ধাওয়া করেছে৷

সাধুবাবা বললেন, ভুল করে চুরি করে ফেলেছ? তা হলে তো তোমায় শাস্তি পেতেই হবে!

চোরটি বলল, শুধু শাস্তি নয়, সাধুবাবা! দু-এক বছরের জেল আমি খাটতে রাজি ছিলুম৷ কিন্তু, একটা মেয়ের গলা থেকে সোনার হার টেনে খুলে নেবার সময় সেই মেয়েটা দম আটকে মারা গেছে৷ সেই জন্য পুলিশ ধরতে পারলে আমায় ফাঁসি দেবে!

সাধুবাবা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, তা হলে আমি তোমায় বাঁচাব কি করে?

চোরটি বলল, আপনি আমাকে আশ্রয় দিন৷ এখানে কোথাও লুকিয়ে রাখুন!

সাধুবাবা বললেন, এখানে কোথায় তোমাকে লুকোব? আমি একা একা থাকি, পুলিশ তোমাকে দেখলেই বুঝবে!

দূরে একটা জিপ গাড়ির আওয়াজ শোনা যেতেই চোরটি বলে উঠল, ওই, ওই যে এসে পড়ল! সাধুবাবা, আপনি পুণ্যাত্মা লোক, আপনার সামনে ওরা আমাকে ধরে নিয়ে যাবে, আপনি আমার মৃত্যুর জন্য দায়ী হবেন? আপনি দয়া করুন৷ একটা কিছু ব্যবস্থা করুন৷

সাধুবাবা উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, আর তো বেশি সময় নেই! পুলিশের কাছে আমি মিথ্যে কথা বলতে পারব না৷ একটা মিথ্যে কথা বললেই আমার এতদিনের সাধনা নষ্ট হয়ে যাবে৷ তোমাকে বাঁচাবার একটাই উপায় আছে৷ তুমি আমার পোশাক পরে নাও৷ এইখানেই আমার আসনে বসে থাকো, আমি নদী পেরিয়ে চলে যাচ্ছি৷ তুমি সাধু সেজে থাকতে পারবে?

চোরটি বলল, হ্যাঁ পারব৷ বাঁচার জন্য আমি সব কিছু পারব৷

সাধুবাবা নিজের গেরুয়া পোশাক খুলে দিতে দিতে বললেন, তবে শোন, আমি আবার যতদিন না ফিরে আসি, তোমাকে এখানেই থাকতে হবে! ওই আসন ছেড়ে কোথাও যাবে না৷ আমার এই ধুনি সারাদিন-রাতে একবারও যাতে না নেভে কথা দিচ্ছ?

চোরটি বিগলিত হয়ে বলল, নিশ্চয়ই কথা দিচ্ছি, সাধুবাবা! আপনার দয়ায় যদি প্রাণে বেঁচে যাই, তা হলে চিরদিন আপনার ক্রীতদাস হয়ে থাকব!

তাড়াতাড়ি চোরটি সাধুবাবার পোশাক পরে নিল৷ মুখে আর গায়ে মেখে নিল ছাই৷ মাথার চুলে ধুলো মেখে এলোমেলো করে দিল৷ সাধুবাবা নেমে গেলেন নদীর জলে৷

একটু পরেই পুলিশের জিপটি এসে পৌঁছাতেই চোর-সাধুটি মড়ার মাথার খুলিটি হাতে নিয়ে চেঁচিয়ে উঠল, ব্যোম কালী! জয় বাবা বিশ্বনাথ!

পুলিশের লোকেরা জানতই যে নদীর ধারে একজন সাধু ধুনি জ্বালিয়ে বসে থাকে৷ তাই তারা সন্দেহ করল না৷ দুজন পুলিশ গাড়ি থেকে নেমে এসে বলল, প্রণাম সাধুবাবা, এদিকে একটা লোককে কি যেতে দেখেছেন?

চোর-সাধু কটমট করে তাদের দিকে তাকিয়ে বলল, কে লোক? লোক না পোক? মানুষ না ফানুস? মান হুঁশ না বে-হুঁশ?

একজন পুলিশ বলল, সে একজন সাংঘাতিক খুনি, সাধুবাবা! সে এখানে লুকিয়ে থাকলে আপনার বিপদ হতে পারে৷

চোর-সাধু ধুনি থেকে একটা জ্বলন্ত কাঠ তুলে বললে, ব্যোম কালী! জয় বাবা শঙ্কর!

তারপর সে সেই জ্বলন্ত কাঠখানা চতুর্দিকে ঘোরাতে লাগল৷ সেই আলোতে দেখা গেল, তার আশেপাশে কেউ লুকিয়ে নেই৷

দ্বিতীয় পুলিশটি বলল, ইনি তান্ত্রিক সাধু, ইনি কিছুই লক্ষ করেন না৷ চল, এখানে বসে থেকে লাভ নেই, জঙ্গলের অন্য দিকটা খুঁজে দেখা যাক৷

পুলিশের জিপটা চলে গেলে চোর-সাধু খুব একচোট হাসল৷ তারপর সে নিশ্চিন্ত মনে ঘুমিয়ে পড়ল৷

পরদিন সকালে তার ঘুম ভাঙল বেশ বেলাতে৷ চোখ মেলে দেখল, কয়েকজন ভক্ত তার জন্য ফলমূল আর মিষ্টি নিয়ে এসেছে৷ তাদের জমি নিয়ে মামলা, তারা সাধুবাবার আশীর্বাদ চায়৷

চোর-সাধু তাদের মাথায় হাত ছুঁইয়ে আশীর্বাদ করে বলল, নিশ্চিন্ত মনে চলে যা! সব ঠিক হয়ে যাবে৷ তবে, ভগবানে বিশ্বাস রাখবি! নিয়মিত পুজো দিবি!

সেই ভক্তরা চলে যাবার পর চোর-সাধু পেট ভরে সেই ফলমূল আর মিষ্টি খেল৷ আর মনে মনে ভাবল, বেশ মজা তো! জঙ্গলের মধ্যে থেকেও দিব্যি খাবার পাওয়া যায়৷ সাধু সেজে থাকায় আরাম আছে৷ তা হলে আর বাড়ি ফিরে লাভ কী?

চোর-সাধু সেখানেই রয়ে গেল৷ ভক্তরা আসে, অনেকরকম খাবার আনে, তার বদলে চোর-সাধু প্রাণ ভরে তাদের আশীর্বাদ আর উপদেশ দেয়৷

দিন তিনেক পরে আবার গভীর রাত্রে চুপি চুপি একজন লোক এসে হাজির হল৷ সে এসে চোর-সাধুর পা জড়িয়ে ধরে বলল, বাবা খুব বিপদে পড়েছি৷ পুলিশ আমাকে সন্দেহ করেছে৷ এবারে আমার বাড়ি সার্চ হবে৷ তুমি আমার এই জিনিসগুলো কয়েকদিনের জন্য রাখো৷

সেই লোকটি একটা পুঁটুলি খুলে অনেকগুলো সোনার হার, দুল, চুড়ি, আংটি বার করে রাখল৷ একসঙ্গে অত দামি দামি গয়না দেখে চোর-সাধুর চোখ লোভে চকচক করে উঠল৷

সে বলল, ওরে বাবা, এতসব দামি জিনিস আমি রাখব, তারপর আমার ওপর যদি পুলিশ হামলা করে?

অন্য চোরটি বলল, তোমাকে কে সন্দেহ করবে, বাবা? তুমি তান্ত্রিক সাধু, পুলিশও তোমাকে ভয় পায়৷ আজ ভোরে আমার বাড়ি তল্লাশি করে যদি কিছু না পায়, তা হলে আমি কালই এসে এগুলো নিয়ে যাব৷ তোমায় প্রণামী দেব!

চোর-সাধু সেই গয়নার পুঁটুলিটা নিয়ে রাখল নিজের আসনের তলায়৷

পরদিন কিন্তু সেই চোরটা আর ফিরে এল না৷ তার পরের দিনও না৷ সে নির্ঘাৎ পুলিশের হাতে ধরা পড়ে গেছে৷ তা হলে গয়নাগুলো কী হবে?

চোর-সাধু ভাবল, এবারে সেও এখান থেকে পাততাড়ি গুটোবে৷ এই জঙ্গলের মধ্যে থাকতে আর ভালো লাগছে না৷ শুধু ফলমূল আর মিষ্টি খেয়ে কতদিন থাকা যায়৷ ভাত, মাছের ঝোল খেতে ইচ্ছে করছে৷

পরদিন দুপুরবেলা আসল সাধুবাবা এসে উপস্থিত হলেন৷ চোর-সাধু তাঁকে দেখে উঠে দাঁড়াতেই আসল সাধু বললেন, কী রে বেটা, ঠিকঠাক আছিস তো? ধরা পড়িসনি তা হলে?

চোর-সাধু বলল, আপনার আশীর্বাদে প্রাণে বেঁচে গেছি, সাধুবাবা৷

আসল-সাধু বললেন, আমি কয়েকদিন নানান গ্রাম ঘুরলাম৷ এদিকে পুলিশের উপদ্রব কমে গেছে৷ পশ্চিম দিকে দুটো বড় বড় ডাকাতি হয়েছে, পুলিশ সেই দিকে মন দিয়েছে৷ তুই এক কাজ কর, নদী পার হয়ে উত্তরে চলে যা৷ সেখানে ট্রেন লাইন পাবি৷ ট্রেন ধরে চলে যা কোনো বড় শহরে, তা হলে পুলিশ আর তোর পাত্তা পাবে না৷

চোর-সাধু বলল, ঠিক বলেছ, সাধুবাবা! তাই-ই যাব৷ তার আগে তোমার সব জিনিস বুঝে নাও! সব ঠিকঠাক পাহারা দিয়েছি৷

চোর-সাধু তার বসবার আসনটা সরাতেই দেখা গেল সেখানে একটা গর্ত৷ তাতে আগের চোরের পুটুলির গয়না ছাড়াও আরও অনেক গয়না আর টাকা রয়েছে৷

আসল-সাধু সে সব দেখে খুশি মনে বললেন, বাঃ, তুই খুব বিশ্বাসী, তোর মুখ দেখেই বুঝেছিলুম৷ পুলিশ আমি পছন্দ করি না, তাই সেদিন পুলিশ এসে পড়াতে তোর ওপর ভার দিয়ে সরে পড়েছিলুম৷ তুই যে ঠিকঠাক দায়িত্ব পালন করেছিস, সেজন্য তোকে পুরস্কার দেব! এই নে!

তিনি দু-খানা গয়না এগিয়ে দিলেন চোর-সাধুর দিকে৷

চোর-সাধু বলল, এর বদলে তোমাকেও আমি একটা গয়না দিতে চাই সাধুবাবা!

চোর-সাধু ঝট করে তার জামার তলা থেকে বার করল একটা রিভলবার আর একটা হাতকড়া৷ রিভলবারটা সাধুবাবার কপালের দিকে তাক করে বলল, খবরদার, পালাবার চেষ্টা করলে তোমার মাথাটাও ওই মড়ার মাথার খুলি হয়ে যাবে৷

হাতকড়াটা সাধুর হাতে পরিয়ে দিয়ে বলল, অনেকদিন থেকেই আমরা সন্দেহ করেছিলুম, তুমি চোরাই মালের কারবার কর৷ এবারে হাতে-নাতে ধরা পড়লে৷ আমার নাম ইন্সপেক্টর রবি সরকার৷ এবার চল থানায়!

সাধুবাবার মুখখানা হাঁ হয়ে গেল!

___

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *