চোরে ও ডাকাতে
সে আমলে আমাদের পরগনায় বিখ্যাত চোর ছিল সিধু। তার হাত খুব সাফ ছিল, মাথা ছিল ঠাণ্ডা, আর তুখোর বুদ্ধি। দিনের বেলা সিধু গৃহস্থের মতো চালচলন বজায় রাখত, আমাদের বাড়িতেও বেড়াতে-টেড়াতে আসত সে। আর পাঁচজনের মতোই ঠাকুমা তাকেও ফল-টল খাওয়াতেন, মুড়ি মেখে দিতেন। কেবল সে চলে যাওয়ার পর ঠাকুরমা গেলাস বাটি গুনে দেখতেন সব ঠিকঠাক আছে কিনা। সিধু সব বাড়িতে যেত খবর করতে, কার বাড়িতে নতুন লোক এল, কী নতুন কাপড়চোপড় এল দোল দুর্গোৎসবে, কোন বাড়িতে টাকা-পয়সার আমদানি হচ্ছে, ইত্যাদি। খবর বুঝে রাত-বিরেতে হানা দিত সেই বাড়িতে। এমন সব মন্ত্র জানা ছিল তার যে, সেই মন্ত্রের জোরে বাড়ির সবাই নিঃসাড়ে ঘুমোতো, সিধু হাসতে হাসতে চুরি করে নিয়ে যেত সব। এমন কি যাওয়ার আগে গেরস্তের ঘরে বসে দু দণ্ড জিরিয়ে তামাক-টামাক খেয়ে যেত। আমরা ছেলেবেলায় যখন তাকে দেখেছি তখন সে বেশ বুড়ো। পরনে ফরাসডাঙার ধুতি, গিলে-করা পাঞ্জাবি, পায়ে নিউকাট, মুখে পান, আর গলায় গান। বুড়ো বয়সেও বেশ শৌখিন ছিল সে। চার আঙুলে চারটে করে আংটি পরত। বাজার করতে গিয়ে দরাদরি করত না। চুরি করে প্রচুর পয়সা করেছিল সে। বাড়িতে দশ-বারোটা গরু, সাত-আটজন ঝি-চাকর, জুড়িগাড়ি সবই ছিল তার। বুড়ো বয়সে তার ভীমরতি হয়েছিল খানিকটা। তখন তার চোখে ছানি আসছে, বাত-ব্যাধিতেও কষ্ট পায়। খুব দরকার না পড়লে চুরি করতে যেত না। এদিকে তার ছোটো মেয়ে বিবাহযোগ্যা হয়েছে। একটা ভাল সম্বন্ধও পেয়ে গেল। মেয়ের বিয়ে, তার খরচ কম নয়। তার বৌ তখন তাকে প্রায়ই খোঁচাত, “মেয়ের বিয়ে আষাঢ়ে, তোমার তো গরজই নেই দেখছি, অত বড় ব্যাপার, তার খরচাপাতি আসবে কোত্থেকে? রাতের দিকে একটু-আধটু বেরোলে তো হয়।” সিধু তখন তার কাঁকালের ব্যথার কথা বলত, চোখের ছানির কথা বলত, কিন্তু তার বৌ সে-সব শুনত না। শোনা যায়, বুড়ো বয়সে সিধুর কিছু ভূতের ভয়ও হয়েছিল। নিশুত রাতে বেরোতে সাহস পেত না।
আমাদের পরগনায় আর একজন বিখ্যাত লোক ছিল। তার নাম হালিম। লোকে বলত হালুম মিঞা। তা হালিম ছিল সাঙ্ঘাতিক ডাকাত। যেমন তার বিরাট চেহারা, তেমনি তার সাহস। যে-বাড়িতে ডাকাতি করবে, সে বাড়িতে সাতদিন আগে গিয়ে তার সাকরেদ চিঠি দিয়ে আসত যে, অমুক দিন হালিম সে বাড়িতে ডাকাতি করতে আসবে। সে-আমলে পূর্ববঙ্গের গ্রামে-গঞ্জে দারোগা পুলিশ খুব বেশি ছিল না। তাছাড়া খালবিল জঙ্গলের দেশ বলে অধিকাংশ জায়গাই ছিল দুর্গম। সেসব জায়গায় চোর ডাকাতদের ভারী সুবিধে। হালিম বা হালুম মিঞাকে তাই কেউ কখনো জব্দ করতে পারেনি। সে ছিল দারুণ লাঠিয়াল, অসম্ভব সাহসী। দরকার না পড়লে খুন-টুন করত না। জমিদার বা ধনীরা সাধারণত হালিম মিঞা ডাকাতি করতে এলে খাতির টাতির করত। শোনা যায়, হালিম যে বাড়িতে ডাকাতি করতে যেত, সে-বাড়ি আগে থেকেই বিয়েবাড়ির মতো সাজানো হত, রোশনাই দেওয়া হতো, ভাল খাবারদাবারের বন্দোবস্ত থাকত। হালিম উপস্থিত হলে বাড়ির মালিক হাতজোড় করে ‘আসুন আসুন’ করত। হালিম বিনা বাধায় ডাকাতি করে চলে আসত, কিংবা ঠিক ডাকাতি তাকে করতে হতো না, বাড়ির লোকেরা তাকে সিন্দুকের চাবি-টাবি খুলে সব গুনে গেঁথে দিয়ে দিত। কিন্তু সকলের তো দিন সমান যায় না। আমাদের ছেলেবয়সে সেই কিংবদন্তীর ডাকাত হালিমও বুড়ো হয়েছে। গোরস্থানের কাছে তার বেশ বড় বাড়ি। তারও দাসী চাকর, ধানের মরাই, জোত জমি-গরু সবই আছে। আমরা হালিমকে দেখতাম কানে আতরের তুলো গুঁজে, চোখে সুর্মা দিয়ে, চমৎকার চেক-কাটা সিল্কের লুঙ্গি আর মখমলের পাঞ্জাবি পরে জমিদারের পুকুরে ছিপে মাছ মারছে। খুব গম্ভীর ছিল সে, চোখ দুখানা সবসময়ে লাল টকটকে। ডাকাতি করা তখন ছেড়েই দিয়েছে, তবে শিক্ষানবিশ ডাকাতরা তার কাছে তালিম নিতে আসত। সিধুর কথা যা বলছিলাম। বৌয়ের তাড়নায় অবশেষে সে একদিন রাতে চুরি করতে বেরোলো। চোখের ছানির জন্য রাস্তাঘাট ভাল ঠাহর হয় না, তাই সঙ্গে হ্যারিকেন নিল। একা যেতে ভূতের ভয়, তাই একজন চাকরকেও ডেকে নিল সঙ্গে। রাস্তায় সাপখোপের গায়ে পা পড়তে পারে ভেবে হাততালি দিয়ে দিয়ে পথ হাঁটতে লাগল। আর ভূতপ্রেত তাড়ানোর জন্য তারস্বরে রামনাম করতে লাগল। সেই হাততালি আর রামনামের চোটে এত বিকট শব্দ হচ্ছিল যে, রাস্তার দুপাশের বাড়ি ঘরে লোকজনের ঘুম ভেঙে যেতে লাগল। তারা সব উঁকি মেরে দেখছে, ব্যাপারখানা কী! অনেকেরই ধারণা হলো, সিধু চোর ধার্মিক হয়ে গেছে, তাই রাত থাকতে উঠে ঠাকুরের নাম নিতে নিতে প্রাতঃস্নান করতে যাচ্ছে নদীতে। এদিকে সিধুর হলো বিপদ, যে-বাড়িতেই ঢুকতে যায় সে-বাড়িতেই দেখে গৃহস্থ সজাগ রয়েছে। ঘুরে ঘুরে হয়রান হয়ে গেল সে। কত ঘুমপাড়ানী মন্ত্র পাঠ করল, কিন্তু বুড়ো বয়সে মন্ত্রের জোরও কমে এসেছে, তেমন কাজ হয় না।
ঘুরে ঘুরে হয়রান হয়ে গোরস্থানের কাছ-বরাবর এসে এক গাছতলায় বসে জিরিয়ে নিচ্ছিল সিধু। খুব ঠাহর করে সমুখপানে দেখে বলল,”ঐ মস্ত বাড়ি, ওটা কার রে?”
চাকর উত্তর দিল, “ও হালুম মিঞার বাড়ি।”
“বটে বটে!” বলে খুব খুশির ভাব দেখাল সিধু, “তা হালিম দু-পয়সা করেছে বটে। এতকাল তো খেয়াল হয়নি।”
এই বলে সিধু সিঁদকাঠি বের করল।
পরদিন গঞ্জে হৈ-চৈ পড়ে গেল। হালুম মিঞার বাড়িতে মস্ত চুরি হয়ে গেছে। সকালে হালিমের বউ পা ছড়িয়ে পড়া জানান দিয়ে কাঁদতে বসেছে–”ওগো, আমার কী হলো গো? আমার সব চেঁছে পুঁছে নিয়ে গেছে গো। বলি ও বুড়ো হালিম, তোর শরম নেই? যার দাপে বাঘে গরুতে একঘাটে জল খেত তার বাড়িতে চুরি? বলি ও মুখপোড়া হালিমবুড়ো, সাতসকালে গাঁজা টানতে বসেছিস। কচু গাছের সঙ্গে দড়ি বেঁধে ফাঁসি দে, থুথু ফেলে তাতে ডুবে মর…”
দাওয়ায় বসে গাঁজা খেতে খেতে হালিম কেবল রক্তচক্ষু মেলে তাকিয়ে তার বিবিকে ধমক দিয়ে বলে, “চুপ র, চুপ র বাঁদী। যে ব্যাটা চুরি করেছে তার গর্দানের জিম্মা আমার। দেখিস।”
তা শুনে বিবি আরো ডুকরে কেঁদে ওঠে।
হালিম দুটো কাজ করল। সিধুর নামে তিন ক্রোশ দূরের থানায় গিয়ে একটা নালিশ ঠুকে দিয়ে এল, আর সিধুর মেয়ের বিয়ের ঠিক সাত দিন আগে একটা চিঠি পাঠাল তার কাছে “তোমার কন্যার বিবাহের রাত্রে আমি সদলবলে উপস্থিত হইতেছি। আমাকে অভ্যর্থনা করিবার জন্য প্রস্তুত থাকিও…” ইত্যাদি।
চিঠি পেয়ে সিধু বলল, “ফুঃ।”
তারপর সেও গিয়ে তিন ক্রোশ দূরের থানায় দারোগাবাবুকে মুরগি আর মাছ ভেট দিয়ে মেয়ের বিয়েতে নেমন্তন্ন করে এসে দাওয়ায় বসে ফিক ফিক করে হাসতে আর তামাক খেতে লাগল।
সিধুর মেয়ের বিয়েতে আমাদেরও নেমন্তন্ন ছিল, ছোটোকাকা সমেত আমরা সব ঝেটিয়ে গিয়েছিলাম। গিয়ে দেখি, হালুম মিঞা ডাকাতি করতে আসবে শুনে যাদের নেমন্তন্ন হয়নি তারাও সব এসেছে গঞ্জ সাফ করে। বিয়েবাড়ি গিসগিস করছে লোকে। দারোগাবাবুও এসে গেছেন। সিধু তাঁকে বিবাহ বাসরের মাঝখানে বরাসনে বসিয়ে দিয়েছে। আর বর তার পাশে একটা মোড়ায় বসে নিজের হাতে হাতপাখার বাতাস খেতে খেতে ঘামছে।
তখনকার নিমন্ত্রণে চার পাঁচ রকমের ডাল খাওয়ান হতো, তারপর মাছ মাংস, দৈ মিষ্টি বা পায়েস দেওয়া হতো। আমরা সবে তিন নম্বর ডাল খেয়ে চার নম্বর ডালের জন্য তৈরি হচ্ছি এমন সময়ে উত্তরের মাঠ থেকে “রে রে” চিৎকার উঠল আর মশাল দেখা গেল। পাত ছেড়ে আমরা সব ডাকাতি দেখতে দৌড়ে গেলাম।
কী করুণ দৃশ্য! ষাট সত্তরজন সাকরেদ নিয়ে হালিম এসে গেছে। সকলের হাতেই বিশাল লাঠি, বল্লম, দা, টাঙ্গি। কপালে সিঁদুরের টিপ। খালি গা, মালকোচা করে ধুতি পরা। কিন্তু সব কজনই বুড়োসড়ো মানুষ। এতদূর জোর পায়ে এসে আর হাল্লাচিল্লা করে সকলেরই দম ফুরিয়ে গেছে। হালিমের হাঁপের টান উঠেছে, তাই সিধু তাকে ধরাধরি করে নিয়ে গিয়ে বারান্দায় বসাল। কয়েকজন ডাকাত উবু হয়ে বসে কাশতে কাশতে বুকের শ্লেষ্ম তুলছে। একজনকে দেখলাম, হাতের ভারী কুড়ুলটা আর বইতে না পেরে একজন বরযাত্রীর হাতে ধরিয়ে দিয়ে নিজের ভেরে যাওয়া হাতটাকে ঝেড়েঝুড়ে ঠিকঠাক করে নিচ্ছে।
সিধু অনেকক্ষণ হালিমের বুক মালিশ করে দেওয়ার পর হালিমের হাঁপের টানটা কমল। তখন হাতের খাঁড়াটা তুলে নিয়ে বলল, “এবার কাজের কথা হোক।”
সিধু হাতজোড় করে বলল, “তোমার মান মর্যাদা ভুলে যাইনি হে। এই নাও সিন্দুকের চাবি, দরজা টরজা সব খোলা আছে। চলে যাও ভিতর বাড়িতে।”
তো তাই হলো। হুঙ্কার দিয়ে দাঁড়িয়ে উঠল হালিম, সঙ্গে সঙ্গে তার দলবলও হুঙ্কার দিল। অবশ্য হুঙ্কারের সঙ্গে-সঙ্গেই খক্ খক্ করে কাশিও শুরু হয়ে গেল। কিন্তু বেশ দাপটের সঙ্গেই হালিম ভিতরে ঢুকে লুটপাট করতে লাগল। নিজের বাড়ির যে সব জিনিস চুরি গিয়েছিল সে সবই উদ্ধার করল হালিম। সিধু আগাগোড়া সঙ্গে রইল হাতজোড় করে। হালিম কোনো জিনিস নিতে ভুল করলে সিধু আবার সেটা দেখিয়ে দেয়, “ঐ কাঁসার বাটিটা নিলে না। বুড়ো বয়সে ভীমরতি ধরেছে নাকি, এ দেয়ালঘড়িটা যে তোমার, চিনতে পারছো না?”
এইভাবে ডাকাতি নির্বিঘ্নে এবং সাফল্যের সঙ্গে শেষ হলো। সারাক্ষণ দারোগাবাবু পা ছড়িয়ে বসে তামাক টানলেন। সবাই তার হাফপ্যান্টের নীচে বিশাল মোটা পা, মোটা বেল্ট আর ক্রসবেল্টে বেঁধে-রাখা প্রকাণ্ড উঁড়ি এবং চোমড়ানো গোঁফের খুব তারিফ করতে লাগল। তিনি কাউকে গ্রাহ্য করলেন না। বর বেচারা নিজেকে বাতাস করতে করতে ক্লান্ত হয়ে বসে ঢুলছে। বরযাত্রী সমেত সবাই ডাকাতি দেখছে ঘুরে ঘুরে।
ব্যাপারটা শেষ হলে হালিম আর সিধু এসে দারোগাবাবুর সামনে করজোড়ে দাঁড়াল। দারোগাবাবু হুঙ্কার দিলেন, “ঘটনাটা কি হলো বুঝিয়ে বলো। এই বুড়ো বয়সে চুরি ডাকাতি করতে যাস, একদিন মরবি।”
সিধু কাঁচুমাচু হয়ে বলে, “বড়বাবু, চুরি কি আর নিজের ইচ্ছায় করতে গেলাম! বৌয়ের কাছে ইজ্জৎ থাকে না, সে-ই ঠেলেঠুলে পাঠায়।”
হালিমও বলল, “আমারও ঐ কথা।”
দারোগাবাবু হাতের নল ফেলে খুব হাসলেন। তার হাসিরও সবাই প্রশংসা করল। তারপর বারান্দায় ঠাই করে হালিমের দলকে খেতে বসানো হলো। হালিমের অবস্থা ভালো, কিন্তু তার সাকরেদরা সবাই হাঘরে। ডাল আর বেগুনভাজা দিয়েই তারা পাত লোপাট করতে লাগল।
সেই দেখে আমাদেরও মনে পড়ল, আমাদের পাতে এবার চারনম্বর ডাল পড়বার কথা। আমরা সব দৌড়োদৌড়ি করে ফিরে এলাম খাওয়ার জায়গায়। এবং তারপরই গণ্ডগোল শুরু হয়ে গেল। অর্ধেক খেয়ে উঠে গেছি, ফিরে এসে হুটপাট করে বসে পড়বার কিছুক্ষণ পরেই সবাই টের পেতে লাগলাম, পাতের গণ্ডগোল হয়ে গেছে। কে কার পাতে বসেছি তার ঠিক পাচ্ছি না। যেমন, আমার ডানপাশে ছোটোকাকা বসেছিল, বাঁয়ে সুবল। পাতে দেড়খানা বেগুনভাজা ছিল, মুড়িঘন্টের একটা কানকো। এখন দেখছি, ছোটোকাকা উল্টোদিকের সারিতে বসে আছে, বাঁ পাশে বিপিন পণ্ডিত, পাতে আধখানা মোটে বেগুনভাজা, মুড়িঘণ্টের কানকোটা নেই, একটা পোকা পড়ে আছে। সবাই চেঁচামেচি করতে লাগল, “এই তুই আমার পাতে বসেছিস চোর কোথাকার…ও মশাই, আপনি তো আমার বাঁ ধারে ছিলেন. একি, আমার কুমড়োভাজা কোথায় গেল..” ইত্যাদি।
তবু খাওয়াটা সেদিন খুব জমেছিল।