চোরের বুদ্ধি (অর্থাৎ চরিত্রহীনের তীক্ষ্ণবুদ্ধির দৃষ্টান্ত রহস্য!)

চোরের বুদ্ধি (অর্থাৎ চরিত্রহীনের তীক্ষ্ণবুদ্ধির দৃষ্টান্ত রহস্য!) 

চোরের উপস্থিত বুদ্ধির ভিতর প্রবেশ করা যে নিতান্ত সহজ ব্যাপার নহে, তাহ সকলে অবগত আছেন কি না, জানি না। পাঠক-পাঠিকাগণের মধ্যে যদি কেহ তাহা উত্তমরূপে অবগত না থাকেন, তাহা হইলে আজ সামান্য সামান্য কয়েকটি উদাহরণ দ্বারা উহা তাঁহাদিগকে বুঝাইবার চেষ্টা করিব। কিন্তু কতদূর কৃতকার্য্য হইব, বলিতে পারি না। 

পুলিস বিভাগে প্রবিষ্ট হইবার অতি অল্পদিবস পরেই একজন চোরের নিকট আমার ঊর্দ্ধতন-কর্মচারীর সহিত আমি যেরূপে প্রতারিত হইয়াছিলাম, তাহার আনুপূর্বিক অবস্থা যতদূর মনে করিতে পারি, তাহা প্রথমেই এইস্থানে বিবৃত করিলাম। ইহাতেই পাঠকগণ বুঝিতে পারিবেন যে, চোর সকল কি প্রকার প্রত্যুৎপন্নমতিত্বের সহিত তাহাদিগের কার্যক্ষেত্রে প্রবিষ্ট হইয়া, অবলীলাক্রমে সকলের চক্ষে ধূলি-মুষ্টি নিক্ষেপ করে। 

এক 

অনেক দিবস অতীত হইল, একদিবস অধিক রাত্রিতে আমি নিয়মিতরূপে রোঁদে (Rounds) গমন করিতেছি, এমন সময় একটি পাড়ার মধ্যে হইতে হঠাৎ ‘চোর চোর’ শব্দ উত্থিত হইল। সেই শব্দ লক্ষ্য করিয়া আমি দ্রুতপদে সেই পাড়ার ভিতর প্রবেশ করিলাম। ত্রস্তভাবে আমাকে সেইদিকে গমন করিতে দেখিয়া নিকটবর্তী স্থান হইতে দুইজন কনষ্টেবল আসিয়া আমার সহিত যোগ দিল। যে বাড়ির ভিতর হইতে ‘চোর চোর’ শব্দ নির্গত হইতেছিল, পরিশেষে আমরা সেই বাড়িতে গিয়া উপনীত হইলাম। 

যে বাড়ীতে আমরা প্রবেশ করিলাম, উহা ইষ্টক-নির্ম্মিত একটি দ্বিতল বাটী, ও উহার চতুর্দিক উন্নত ইষ্টক প্রাচীর দ্বারা পরিবেষ্টিত। সেই বাড়ীর ভিতর আমাদিগকে প্রবিষ্ট হইতে দেখিয়া গৃহস্বামীর একটু সাহসের উদয় হইল। তিনি আমাদিগকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, “আপনারা ঠিক্ সময়-মত আমার বাড়ীতে আসিয়া উপস্থিত হইতে পারিয়াছেন, ইহাতে আমি যে কতদূর উপকৃত হইলাম, তাহা বলিতে পারি না। কারণ, আমার এই রন্ধনশালার ভিতর চোর প্রবেশ করিয়াছে; কিন্তু কিরূপ উপায়ে যে আমরা উহাকে ধৃত করিতে সমর্থ হইব, তাহার কিছুই স্থির করিয়া উঠিতে পারিতেছি না।” 

গৃহস্বামীর কথা শ্রবণ করিয়া আমি তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “আপনার রন্ধনশালার ভিতর চোর যে প্রবেশ করিয়াছে, তাহা আপনি কি প্রকারে জানিতে পারিলেন?” 

আমার প্রশ্নের উত্তরে গৃহস্বামী কহিলেন, “আমার রন্ধন গৃহের ভিতর চোর প্রবেশ করিতে আমি স্বচক্ষে দেখিয়াছি। কোন কাৰ্য্যবশতঃ আমি আমার গৃহ হইতে উঠিয়া বাহিরে আসিবার সময় দেখিলাম, এক ব্যক্তি দ্রুতপদে আমার রান্নাঘরের ভিতর প্রবেশ করিল। আমার এই রান্নাঘরে কেবলমাত্র দুইটি ভিন্ন দ্বার নাই। উহার একটি ভিতর হইতে বন্ধ করিবার উপায় আছে, কিন্তু বাহির হইতে বন্ধ করিবার কোনরূপ উপায় নাই। অপরটিও ভিতর হইতে বন্ধ করা যায়। কিন্তু বাহির হইতে বন্ধ করিবার উপায়ও আছে, এবং সর্বদাই উহা বাহির হইতে বন্ধ করা হইয়া থাকে। সেই গৃহের ভিতর অধিক মূল্যবান কোন দ্রব্যই থাকে না বলিয়া, উহাতে তালাচাবি বন্ধ করা হয় না। কেবল বাহির হইতে শিকল দেওয়া থাকে মাত্র। থালা, ঘটি, বাটী প্রভৃতি যে সকল দ্রব্যাদির সর্ব্বদা ব্যবহার হইয়া থাকে, তাহা ব্যতীত অপর কোন অধিক মূল্যবান দ্রব্যাদি সেই গৃহের ভিতর নাই। 

“যে সময়ে লোকটি শিকল খুলিয়া রান্নাঘরের ভিতর প্রবেশ করিল, সেই সময় আমিও তাহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ রান্নাঘরের দ্বার পর্য্যন্ত গমন করিলাম। কিন্তু গৃহের ভিতর প্রবেশ করিতে পারিলাম না। কারণ, সেই লোকটি গৃহের ভিতর প্রবেশ করিয়া ভিতর হইতে দ্বার বন্ধ করিয়া দিল। পরিশেষে এক এক করিয়া দ্বার পরীক্ষা করিয়া দেখিলাম, উভয় দ্বারই ভিতর হইতে বন্ধ। সেই সময় হইতে আমি সেইস্থানে দাঁড়াইয়া ছিলাম, এবং দ্বারদ্বয় এখন পর্যন্ত ভিতর হইতে আবদ্ধ আছে। 

“এই অবস্থা দেখিয়া যখন আমি বেশ বুঝিতে পারিলাম, গৃহের ভিতর হইতে সেই ব্যক্তি পলায়ন করিতে সমর্থ হয় নাই, তখন আমি ‘চোর চোর’ করিয়া চীৎকার করিতে লাগিলাম। আমার চীৎকার শব্দে পাড়ার অনেক লোক আসিয়াই আমার আমার বাড়ীতে উপস্থিত হইলেন ও পরিশেষে আপনারাও আগমন করিলেন। এখন যেরূপে পারেন, ঐ গৃহের মধ্যস্থিত উক্ত চোরকে ধৃত করিয়া উহাকে উপযুক্ত দণ্ড প্রদান করুন।” 

এই বলিয়া গৃহস্বামী তাঁহার রন্ধনাগার আমাকে দেখাইয়া দিলেন। আমি সেই রান্নাঘরের নিকট গমন করিয়া দেখিলাম যে, তিনি যাহা বলিয়াছিলেন তাহা প্রকৃত। পূর্ব্বকথিত দুইটি মাত্র দ্বার ব্যতিরেকে সেই গৃহ হইতে বহির্গত হইবার আর কোনরূপ উপায় নাই। সেই দ্বার দুইটিও আমি সে সময় পরীক্ষা করিয়া দেখিলাম। দেখিলাম, উহা তখন পর্য্যন্ত ভিতর হইতে বন্ধ! 

এরূপ অবস্থায় কি করা কর্তব্য, প্রথমে তাহার কিছুই স্থির করিয়া উঠিতে পারিলাম না। একবার ভাবিলাম, দ্বার ভাঙিয়া গৃহের ভিতর প্রবেশ পূর্ব্বক চোরকে ধৃত করি, কিন্তু একজন সামান্য নিম্নশ্রেণীর নতুন পুলিস-কর্মচারীর হৃদয়ে সেই সময় সেইরূপ সাহস কুলাইল না। তখন উহাকে ধৃত করিবার উপর কোনরূপ উপায় হঠাৎ মনে উদয় না হওয়ায় রান্নাঘরের যে দ্বারটিতে বাহির হইতে শিকল বন্ধ হইত, সেই দ্বারের শিকল বন্ধ করিয়া দিলাম। যে দ্বারটি কেবলমাত্র ভিতর হইতে বন্ধ করিবার উপায় আছে, তাহা বাহির হইতে কোনরূপে আবদ্ধ করিতে না পারিয়া, ভিতর হইতে আবদ্ধ সেই দ্বারের সম্মুখে আমি উপবেশন করিলাম। পল্লীর যে সমস্ত লোক সেই সময়ে সেইস্থানে গিয়া উপস্থিত হইয়াছিলেন, তাঁহারা সকলেই আমার সন্নিকটে রহিলেন। ভিতর হইতে দেওয়ালে সিঁদ কাটিয়া পাছে রান্নাঘরের পশ্চাদ্ভাগ দিয়া বহির্গত হইয়া যায়, এই ভয়ে একজন কনষ্টেবলকে সেইদিকে রাখিয়া দিলাম। অপর কনষ্টেবলকে থানায় গিয়া ইনস্পেক্টার সাহেবকে এই সংবাদ প্রদান করিতে বলিলাম। সে দ্রুতপদে সেইস্থান পরিত্যাগ পূর্ব্বক থানা অভিমুখে ছুটিল। 

যে সময়ের কথা আমি বলিতেছি, সেই সময়ে যে ইনস্পেক্টারের অধীনে আমি কর্ম্ম করিতাম, তিনি একজন শ্বেতকায় যুবাপুরুষ ছিলেন। এখন অবশ্য প্রবীণ হইয়াছেন, এবং এখন পর্যন্ত এই পুলিশের একটি উচ্চস্থান অধিকার করিয়া মনের সুখে আমাদিগের উপর কিঞ্চিৎ প্রমাণ আধিপত্য করিতেছেন। পূর্ব্বে ইনি সৈনিক বিভাগে কর্ম করিয়া কয়েকটি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সম্মুখযুদ্ধে আপনার বীরত্ব দেখাইয়া উর্দ্ধতন কর্মচারীর নিকট পরিচিত হইয়াছিলেন, এবং জয়লাভ করিয়া উপযুক্তরূপ পারিতোষিকও প্রাপ্ত হইয়াছিলেন। এইরূপ কথা মধ্যে মধ্যে আমাদিগের নিকট গল্প করিয়া তিনি যেরূপ বাহাদুরি দেখাইতেন, তাহাতে সকলেই ভাবিত যে, ইনি একজন প্রকৃতই বীরপুরুষ, এবং ইহার অতীব সাহস। যাহা হউক, সংবাদ পাইবামাত্র সাহেব আরও চারি পাঁচ জন কনষ্টেবলের সহিত তথায় গিয়া উপস্থিত হইলেন। তাঁহাকে দেখিয়া আমার অনেক ভরসা উপস্থিত হইল, এবং আমার নিজের দায়িত্বও অনেক কমিয়া গেল। গৃহস্বামীর নিকট হইতে আমি যে সকল ব্যাপার অবগত হইতে পারিয়াছিলাম, এবং রান্নাঘরের অবস্থা আমি স্বচক্ষে যেরূপ দেখিয়াছিলাম, এক এক করিয়া ক্রমে তাহার সমস্তই সাহেবকে বুঝাইয়া দিলাম। আমার নিকট হইতে সমস্ত ব্যাপার অবগত হইয়া সাহেব নিজে গিয়া রান্নাঘরের দ্বার ঠেলিয়া দেখিলেন যে, উভয় দ্বারই তখন পর্যন্ত পূর্ব্বের ন্যায় ভিতর হইতে বদ্ধ। 

গৃহস্বামীর কথায় বিশ্বাস করিয়া যে উদ্দেশ্যে আমরা সেইস্থানে দণ্ডায়মান ছিলাম, সেই গৃহের অবস্থা দেখিয়া ও আমাদিগের কথায় বিশ্বাস করিয়া সাহেবও সেইস্থানে সেই উদ্দেশ্যে দণ্ডায়মান হইলেন। আমাদিগের কোলাহলে সেইস্থানে প্রতিবেশীর জনতা ক্রমেই বর্দ্ধিত হইতে লাগিল। এক কথায় সেই সময় সেইস্থানে গিয়া উপস্থিত না হইয়াছিলেন; প্রতিবেশীর মধ্যে এরূপ পুরুষ প্রায় কেহই ছিলেন না। এইরূপে প্রায় দুই ঘণ্টাকাল অতিবাহিত হইয়া গেল। কিন্তু সেই গৃহের দ্বার খুলিয়া কোন ব্যক্তিই বাহিরে আসিল না। এরূপ অবস্থায় সেই সময় কি করা কর্তব্য, তাহার কিছুই স্থির করিতে না পারিয়া, পরিশেষে দ্বার ভাঙ্গিয়া সেই গৃহের ভিতর প্রবেশ করাই সাব্যস্ত হইল। 

দ্বার ভাঙ্গিয়া সাহেব সেই গৃহের ভিতর প্রবেশ করিবার পরামর্শ করিতেছেন, এমন সময় আমাদিগের সকলের সম্মুখে সেই রান্নাঘরের একটি দ্বার হঠাৎ ভিতর হইতে খুলিয়া গেল, ও সেই সঙ্গে সঙ্গে হস্তপদ বিস্তারিত করিয়া মনুষ্যের অবয়ব-বিশিষ্ট কে যেন আমাদিগের সম্মুখে “হু হা” শব্দ করিতে করিতে আসিয়া উপস্থিত হইল। উহার হাবভাব ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দেখিয়া আমরা হঠাৎ জড়বৎ হইয়া পড়িলাম। আমাদিগের কাহারই মুখ হইতে কোন কথা বাহির হইল না। প্রতিবেশীবর্গ যাহারা সেইস্থানে উপস্থিত ছিল, তাহাদিগের মধ্যে কেহ চীৎকার করিয়া উঠিল; কেহ বা অৰ্দ্ধমূর্ছিত অবস্থায় সেইস্থানে পড়িয়া গেল, কেহ বা আপন প্রাণ লইয়া ঊর্দ্ধশাসে সেইস্থান হইতে প্রস্থান করিল। অবশিষ্ট যাহারা রহিল, তাহার আমাদিগের সদৃশ জড়বৎ হইয়া পরস্পর পরস্পরের মুখাবলোকন করিতে লাগিল। 

যাহাকে দেখিয়া আমাদিগের সকলের এইরূপ অবস্থা ঘটিল, তাহার পরিধানে বস্ত্র ছিল না। মসীনিন্দিতবর্ণের একখানি নিতান্ত ক্ষুদ্র কৌপীন দ্বারা লজ্জা নিবারিত ছিল মাত্র। হাত, পা, মুখ, কাণ প্রভৃতি সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ একবারে আবরণ-রহিত; কিন্তু চাকচিক্যময় মসীরঙ্গে এরূপ ভাবে রঞ্জিত ছিল যে কেবলমাত্র চক্ষু ব্যতীত সমস্ত অঙ্গই এক অভূতপূর্ব্ব রূপ ধারণ করিয়াছিল। ইহার উপর এরূপ ভাব-ভঙ্গীর সহিত সে আসিয়া আমাদিগের সম্মুখে উপস্থিত হইল যে, তাহাকে দেখিয়া হঠাৎ কেহই মনে করিতে পারিলেন না, এ মনুষ্য, কি না। বরং অনেকেই উহাকে ভূতযোনি বলিয়া মনে মনে স্থির করিয়া লইলেন, এবং প্রাণের বিয়ে সেইস্থান হইতে পলায়ন করিলেন। উহার সেই প্রকার অবস্থা দেখিয়া আমার মুখ হইতে কোন কথাই নির্গত হইল না, সাহেবের অবস্থাও সেই প্রকার হইল, কনষ্টেবলগণ কে কোথায় পলায়ন করিল। সুতরাং সেই ব্যক্তি অনায়াসে আমাদিগের সম্মুখ দিয়া বাড়ীর বাহিরে গমন করিল, ও পাড়ার ভিতর গমন করিয়া ক্রমে সকলের দৃষ্টিপথের অতীত হইয়া গেল। 

সে প্রস্থান করিবার পর আমাদিগের চমক ভাঙ্গিল। তখন সাহেব কহিলেন, “আমাদিগের সম্মুখ দিয়া সেই চোর অনায়াসেই প্রস্থান করিল, আর আমরা নিতান্ত হতবুদ্ধির ন্যায় এই স্থানে দণ্ডায়মান রহিলাম! ইহা বড়ই লজ্জার কথা! দেখ—সে এখন কোন দিকে গমন করিল? তাহাকে না ধরিতে পারিলে, এ লজ্জা রাখিবার স্থান থাকিবে না!” সাহেবের কথা শ্রবণ করিয়া আমাদিগের মনেও লজ্জার উদয় হইল; কিন্তু কি করিব, তখন সে আমাদিগের হস্ত ছাড়াইয়া পলায়ন করিয়াছে। তথাপি এদিক্ ওদিক্ চতুর্দ্দিকে তাহার সন্ধান করিলাম, কিন্তু কোনস্থানেই আর তাহার সন্ধান পাইলাম না। তখন অনন্যোপায় হইয়া পুনরায় সেই বাড়ীতে প্রত্যাগমন করিলাম। 

গৃহস্বামীর কোন দ্রব্য অপহৃত হইয়াছে কি না, তাহা জানিবার নিমিত্ত পরিশেষে আমরা সেই রান্নাঘরের ভিতর প্রবেশ করিলাম। দেখিলাম,—থালা, ঘটি বাটী প্রভৃতি পিতল কাঁসার দ্রব্যাদি সমস্ত যে স্থানে রক্ষিত ছিল, তাহা সেই প্রকারেই সেইস্থানেই রক্ষিত আছে। উহার কিছুমাত্র অপহৃত বা স্থানান্তরিত হয় নাই। তবে মৎস্য প্রভৃতি কোন কোন দ্রব্য রন্ধিত হইয়া পরদিবসের নিমিত্ত সেই গৃহের ভিতর অতীব যত্নের সহিত রক্ষিত ছিল; কিন্তু আমরা গৃহের ভিতর প্রবেশ করিয়া তাহার কিছুমাত্র দেখিতে পাইলাম না। বুঝিলাম, যে দুই ঘণ্টাকাল আমরা তাহাকে ধরিবার নিমিত্ত উপায় উদ্ভাবন করিতেছিলাম, সেই দুই ঘণ্টা সে রান্নাঘরের ভিতর বসিয়া অন্নব্যঞ্জন সকল নির্বিবাদে ভক্ষণ করিতেছিল। আহার সমাপন করিয়া যখন সে দেখল যে, কোন দ্রব্যাদি লইয়া আমাদিগের সম্মুখ দিয়া যে কোনমতে বাহিরে গমন করিতে পারিবে না, তখন এই এক অভিনব উপায় বাহির করিয়া অবলীলাক্রমে সে আমাদিগের চক্ষুতে ধূলিরাশি প্রদান করিল। গৃহের অবস্থা দেখিয়া গৃহস্থিত প্রদীপের অবস্থা দেখিয়া এবং যে সকল হাঁড়ীতে রন্ধনাদি হইত, তাহাদের অবস্থা দেখিয়া আমরা আরও বুঝিতে পারিলাম যে, আহারান্তে যে রন্ধন করিবার হাঁড়ীর বহির্ভাগস্থিত কালি সকল উঠাইয়া লইয়া, প্রদীপে যে তৈল ছিল, তাহার সহিত মিশ্রিত করিয়া আপনার শরীরের স্থানে স্থানে উত্তমরূপে মৰ্দ্দন করিয়া নিজে মসীবর্ণ ধারণ করিয়াছিল। পরিশেষে কৌপীনমাত্র পরিধান করিয়া বিকটবেশে গৃহ হইতে বহির্গত হইয়াছিল, ও আমাদিগকে প্রভাবিত করিয়া সেইস্থান হইতে অনায়াসেই প্রস্থান করিয়াছে। 

এই প্রকার কৌশল অবলম্বন করিয়া যদি আমাদিগের সম্মুখ হইতে পলায়ন করিতে না পারিত। তাহা হইলে তাহার যে কোনরূপেই নিষ্কৃতি ছিল না, তাহা সে উত্তমরূপে জানিত। 

উক্তরূপে কৌশল অবলম্বন করিয়া আমাদিগের হস্ত হইতে সেই চোর পরিত্রাণ পাইল সত্য; কিন্তু আমরা মনে মনে বিলক্ষণ লজ্জিত হইয়া নিতান্ত ক্ষুণ্নমনে থানায় প্রত্যাগমন করিলাম। চোরের এই প্রকার বুদ্ধির ভিতর আমরা সহজে প্রবেশ করিতে পারিলাম না সত্য, কিন্তু তাহার নিকট হইতে আমাদিগের সবিশেষ শিক্ষালাভ হইল। 

দুই 

আমি ডিটেকটিভ পুলিসে পরিবর্তিত হইয়া আসিবার অতি অল্পদিন পূর্ব্বে একদিন সন্ধ্যার পর আমি থানার আফিসে বসিয়া আছি। এমন সময় হঠাৎ একজন শালওয়ালা একটি বৃদ্ধ ব্রাহ্মণকে বন্ধনাবস্থায় আমার সম্মুখে আনিয়া উপস্থিত করিল ও কহিল, “মহাশয়! এই জুয়াচোর আমার সর্ব্বনাশ করিয়াছে, জুয়াচুরি করিয়া আমার দেড় সহস্রমুদ্রা লইয়া গিয়াছে। আমি উহাকে ধরিয়া আপনার সম্মুখে আনয়ন করিয়াছি, এখন যাহাতে আমার টাকাগুলি প্রাপ্ত হইতে পারি, আপনি তাহার উপায় করুন।” 

শালওয়ালা ব্রাহ্মণকে যেরূপভাবে ধরিয়া আনিয়াছিল, এবং সে যেরূপভাবে আমাকে কহিল, তাহাতে আমি প্রথমে একরূপ বিশ্বাস করিয়া লইলাম যে, এই ব্রাহ্মণ কোন না কোনরূপ জুয়াচুরির কৌশল অবলম্বন করিয়া শালওয়ালার নিকট হইতে দেড় সহস্র মুদ্রার শাল লইয়া প্রস্থান করিয়া ছিল। এইরূপে জুয়াচুরি করিয়া চলিয়া যাইবার পর এই ব্রাহ্মণের আর কোনরূপ সন্ধান করিয়া উঠিতে পারে নাই। আজ কোনস্থানে দেখিতে পাইয়া ইহাকে ধরিয়াছে, এবং আমার সম্মুখে আনিয়া উপস্থিত করিয়াছে। মনে এইরূপ ভাবিয়া আমি শালওয়ালাকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “কিরূপ উপায়ে ও কতদিবস হইল, এই ব্রাহ্মণ জুয়াচুরি করিয়া তোমার এত অধিক টাকা মূল্যের শাল লইয়া পলায়ন করিয়াছিল? এবং আজই বা কোথা হইতে হইাকে পাইয়া এইরূপে ধৃত করিয়া আনিলে?” 

শালওয়ালা উত্তরে কহিল, “মহাশয়! এ অদ্যকারই ঘটনা। অদ্যই এই ব্যক্তি অপর আর এক ব্যক্তির সাহায্যে জুয়াচুরি করিয়া আমার নিকট হইতে শাল গ্রহণ করে, ও উহার সহচর সেই অপর ব্যক্তি দ্বারা সেই শাল স্থানান্তরে প্রেরণ করিয়াছে। সেই ব্যক্তি যে কে এবং শাল লইয়া যে কোথায় গমন করিয়াছে, তাহার কিছুমাত্র আমরা স্থির করিতে পারি নাই। সুতরাং ইহাকেই ধৃত করিয়া আপনার সম্মুখে আনয়ন করিয়াছি, এখন যাহা আপনার কর্তব্য বিবেচনা হয়, তাহা আপনি করুন।” 

শালওয়ালার কথা শ্রবণ করিয়া আমি তাহাকে পুনরায় কহিলাম, “কিরূপ উপায় অবলম্বন করিয়া ইহারা জুয়াচরি করিয়া তোমার দোকান হইতে এত টাকা মূল্যের শাল গ্রহণ করিয়াছে, তাহার আনুপূর্ব্বিক ব্যাপার আমার নিকট বর্ণনা কর। তাহা হইলে আমি বুঝিতে পারিব যে, এ বিষয়ে কিরূপ অনুসন্ধানের প্রয়োজন হইবে, এবং কিরূপেই বা তুমি তোমার অপহৃত দ্রব্য পুনঃপ্রাপ্ত হইবে।” 

শালওয়ালা উত্তরে কহিল, “মহাশয়! অদ্য সন্ধ্যার কিছুক্ষণ পূর্ব্বে এই ব্রাহ্মণ ও ইহার অনুচর আমার দোকানে গিয়া হঠাৎ উপস্থিত হয় ও কহে যে, উহারা দুইজোড়া শাল খরিদ করিবার মানসে সেইস্থানে আগমন করিয়াছে। ইহাদের কথায় বিশ্বাস করিয়া আমি আমার দোকানে ইহাদিগকে বসিতে দিলাম, এবং শালের গাঁটরি খুলিয়াই শাল দেখাইতে আরম্ভ করিলাম। প্রথমতঃ অল্প মূল্যেই অনেক শাল ইহাদিগকে দেখাইলাম; কিন্তু তাহার একখানিও ইহাদিগের মনোনীত হইল না। তৎপরে অধিক মূল্যের শাল সকল বাহির করিয়া উহাদিগকে দেখাইতে থাকিলাম। অনেক দেখিয়া শুনিয়া পরিশেষে উহারা দুই জোড়া শাল মনোনীত করে। উহার এক জোড়ার মূল্য আট শত, ও অপর জোড়ার মূল্য সাত শত টাকা। উভয় শালের মূল্য শ্রবণ করিয়া প্রথমতঃ উহারা একটু চমকিয়া উঠে। কিন্তু পরিশেষে আমারই প্রস্তাবে উক্ত পনর শত টাকা মূল্যের উভয় শালই লইতে প্রস্তুত হইয়া আমাকে কহে, নিকটবর্তী স্থানে আমাদিগের একটি বিশিষ্ট আত্মীয় লোক আছেন। তিনি যদিও শাল-ব্যবসায়ী নহেন, তথাপি শাল দেখিলে উহা কিরূপ দ্রব্য এবং মূল্যই বা কত, তাহা তিনি অনায়াসে বলিয়া দিতে পারেন। আপনি যদি এই শাল লইয়া আমাদের সহিত তাঁহার নিকট গমন করেন, এবং এই শাল দেখিলে যদি তাঁহার মনোনীত হয়, তাহা হইলে উভয় শালই আমরা গ্রহণ করিব ও সেইস্থানে আপনাকে সমস্ত মূল্য চুকাইয়া দিব।’ উহাদিগের প্রস্তাবে আমি যদিচ মনে মনে সম্মত হইলাম, কিন্তু দোকানে অপর আর কোন ব্যক্তি না থাকায় আমি তাহাদিগের সহিত গমন করিতে পারিলাম না। কহিলাম, আপনাদিগের প্রস্তাব অযুক্তি-সিদ্ধ না হইলেও লোকাভাব বশতঃ উত্তরে ইহারা কহিল, যদি আপনি আমাদিগের সহিত আগমন করিতে অসমর্থ হন, তাহা হইলে অন্য উপায়ে আমাদিগের সকল কাৰ্য্য নিৰ্ব্বাহ হইতে পারে। আপনি শাল ব্যবসায়ী? ভদ্রলোকদিগের সহিত আপনি সদাসৰ্ব্বদা ব্যবহার করিয়া থাকেন, এবং ভদ্রলোকদিগের কথায় বিশ্বাস করিয়া আপনাকে কার্য চালাইতে হয়। এরূপ অবস্থায় আমাদিগের কথার উপর অবিশ্বাস করিবার বিশিষ্ট কোন কারণ না থাকিলেও, যখন আপনার সহিত আমাদিগের সবিশেষ পরিচয় নাই, তখন আমাদিগকে বিশ্বাস করিতে আপনাকে বলিতে পারি না, অথচ আমার সেই বন্ধুটিকে না দেখাইয়া আমিও ইহা কোন প্রকারে খরিদ করিতে পারি না। এইরূপ অবস্থায় একটি সামান্য উপায় অবলম্বন করিলে আমার বোধ হয়, আপনার ও আমাদিগের উভয়েরই কার্য্য নিৰ্ব্বাহ হইতে পারে। আমার বিবেচনায় আমাদিগের দুইজনের মধ্যে শালের জামিনস্বরূপ একজন আপনার দোকানে বসিয়া থাকিতে পারে। অপর একজন এই শাল লইয়া সেই বন্ধুকে দেখাইয়া যত শীঘ্র পারে ফিরিয়া আসিবে, তাহাতেই সকল গোলই মিটিয়া যাইবে।’ 

“উহাদিগের এই কথা শ্রবণ করিয়া আমি ভাবিলাম, এ নিতান্ত অযুক্তির কথা নয়। আরও ভাবিলাম যে, এই দুই জোড়া শাল যদি বিক্রয় করিতে পারি, তাহা হইলে বেশ দশ টাকা উপার্জ্জনও হইতে পারে। এরূপ অবস্থায় এরূপ লোভ সম্বরণ করা দোকানদারের পক্ষে নিতান্ত সহজ কথা নহে। এই ভাবিয়া পরিশেষে আমি উহাদিগের প্রস্তাবেই সম্মত হইলাম। যে ব্যক্তি এই ব্রাহ্মণের সহচররূপে আসিয়াছিল, সেই এই ব্রাহ্মণকে আমার দোকানে রাখিয়া নিজে শাল দুই জোড়া লইয়া আমার দোকান হইতে প্রস্থান করিল। যাইবার সময় সে এই ব্রাহ্মণকে বলিয়া গেল, আমি যত শীঘ্র পারি, প্রত্যাগমন করিব। কিন্তু যে পর্য্যন্ত আমি ফিরিয়া না আসি, সেই পৰ্য্যন্ত তুমি এ দোকান পরিত্যাগ করিও না।’ 

“মহাশয়! দুঃখের কথা বলিব কি? যে ব্যক্তি শাল লইয়া পলায়ন করিয়াছিল, অনেকক্ষণ পর্য্যন্ত তাহার জন্য অপেক্ষা করিলাম। কিন্তু যখন দেখিলাম, তাহার প্রত্যাগমনের আর কোন আশা নাই, তখন এই ব্রাহ্মণকে তাহার সহচরের নাম ও ঠিকানা জিজ্ঞাসা করায় এ কহিল, ‘আমি উহাকে চিনি না, বা উহার নামও জানি না।’ ইহার নিকট এইকথা শ্রবণ করিয়া আমি চতুর্দিক অন্ধকার দেখিলাম ও বুঝিতে পারিলাম যে, ইহারা জুয়াচুরি করিয়া আমার সর্ব্বনাশ করিয়াছে! এই ত মহাশয় অবস্থা! এখন যাহা কর্তব্য হয়—করুন।” 

শালওয়ালার কথা শেষ হইলে, সেই ব্রাহ্মণকে আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, “ইনি যাহা কহিলেন, তাহা তুমি সকলই শ্রবণ করিলে। তোমরা জুয়াচুরি করিয়া ইঁহার নিকট হইতে পনর শত টাকা হস্তগত করিবার চেষ্টা করিতেছ। কিন্তু তাহা কোনরূপেই পারিবে না। যে প্রকারেই পারি, আমি তোমাদিগের নিকট হইতে সেই শাল আদায় করিয়া লইব। তুমি ব্রাহ্মণ, আমি তোমাকে শেষ উপদেশ দিতেছি; যদি তুমি এই বিপদ হইতে আপনাকে উদ্ধার করিতে চাহ, তাহা হইলে যে ব্যক্তি শাল লইয়া চলিয়া গিয়াছে, তাহার নাম ও ঠিকানা আমাদিগকে বলিয়া দাও। যদি তুমি আমার প্রস্তাবে সম্মত না হও, তাহা হইলে নিশ্চয় জানিও যে, এ বিপদ হইতে তুমি কোনরূপেই উদ্ধার পাইবে না।” 

আমার কথা শ্রবণ করিয়া সেই বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ একবারে উচ্চৈঃস্বরে কাঁদিয়া ফেলিল, তাহার চক্ষু দিয়া বেগে বারিধারা বহির্গত হইল। কিন্তু কাঁদিতে কাঁদিতে কহিতে লাগিল, “মহাশয়! আমি ইহার কিছুই জানি না। আমি কোনরূপ জুয়াচুরি করিয়া ইহাকে ক্ষতিগ্রস্ত করিবার চেষ্টা করি নাই। আমি পাড়াগেঁয়ে লোক, আমাকে ছাড়িয়া দিউন। আমি এখনই এই শহর পরিত্যাগ করিয়া প্রস্থান করিতেছি। 

বৃদ্ধের এইরূপ অবস্থা দেখিয়া প্রথমে মনে হইল যে, জুয়াচোরগণ পুলিশের হস্তে পড়িলে প্রথমে এইরূপই করিয়া থাকে। কিন্তু পুনরায় ভাবিলাম, –-এ দেখিতেছি, পাড়াগেঁয়ে লোক। কলিকাতার অবস্থা যদি এ উত্তমরূপে অবগত না থাকে, তাহা হইলে জুয়াচোরের হস্তে পড়িয়া কোন না কোনরূপে যে প্রতারিত না হইতে পারে, তাহাই বা বলিব কি প্রকারে? এই ভাবিয়া আমি সেই বৃদ্ধব্রাহ্মণকে কহিলাম, ‘এখন তোমার কাঁদিবার সময় নাই। তুমি এখন ভয়ানক অপরাধে ধৃত হইয়া বন্দী হইয়াছ। এখন তোমার কর্তব্য কৰ্ম্ম—প্রকৃত ঘটনা কি, তাহা আমাদিগের নিকট প্রকাশ করা। তোমার নিকট হইতে সমস্ত ব্যাপার অবগত হইতে পারিলে, আমরা বুঝিতে পারিব যে, এ বিষয়ে তোমার কোনরূপ দোষ আছে কি না? আর যদি প্রকৃতকথা না বলিয়া কেবল রোদন করিয়াই সময় অতিবাহিত কর, তাহা হইলে তোমার কিছুমাত্র উপকার অপেক্ষা অপকারের সম্ভাবনাই অধিক। এরূপ অবস্থায় তুমি যেরূপ ভাল বিবেচনা কর, তাহা করিতে পার। কারণ কোন কথা বলা বা না বলার অধিকার এখন তোমার।” 

আমার কথা শ্রবণ করিয়া বৃদ্ধ রোদন করিতে নিবৃত্ত হইল। তখন সে আমার দিকে লক্ষ্য করিয়া বলিতে লাগিল, “মহাশয়! প্রকৃত অবস্থা যাহা ঘটিয়াছিল, তাহা আমি আপনার নিকট সমস্ত বলিতেছি। আমার কথা শ্রবণ করিলে আপনি নিশ্চয়ই বুঝিতে পারিবেন যে, আমি জুয়াচোর কি না। আমার বাসস্থান এই কলিকাতা সহরে নহে, পল্লীগ্রামে আমি বাস করিয়া থাকি। কিন্তু গঙ্গাস্নান বা অপর কোনরূপ কার্য্যের আবশ্যক হইলে, কখন কখন আমাকে কলিকাতায় আসিতে হয়। ইহার পূর্ব্বে তিন চারি বার আমি কলিকাতায় আসিয়াছি। কিন্তু এবার যেরূপ বিপদে পড়িয়াছি, সেইরূপ বিপদে আর কখনও পতিত হই নাই। এবার কোন বিশিষ্ট কার্য্যোপলক্ষে আমি কলিকাতায় আগমন করি নাই, এইস্থানে আসিবার মুখ্য উদ্দেশ্য—গঙ্গাস্নান। আজ বৈকালে আমি আমার বাসা হইতে বহির্গত হইয়া গঙ্গাদর্শন বাসনায় গমন করিতেছি, এমন সময় পথের মধ্যে হঠাৎ একটি লোক আসিয়া আমার সম্মুখে উপস্থিত হইল,এবং সাষ্টাঙ্গ প্রণিপাত করিয়া আমাকে কহিল, “আপনি কি আমাদিগের গুরুপুত্র? আপনার নাম কি কালীপ্রসন্ন? আপনার বাসস্থান কি নবগ্রামে? আপনার পিতার নাম কি কাশীশ্বর?” উহার কথা শ্রবণ করিয়া আমি ভাবিলাম, এই ব্যক্তি আমার প্রকৃত পরিচয় জানিল কি প্রকারে? তখন আমি তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘আপনি আমার নাম ও পিতার নাম প্রভৃতি কি প্রকারে অবগত হইলেন?’ 

“উত্তরে সে কহিল, ‘আমার পিতা—আপনার পিতার শিষ্য। তিনি আপনার পিতারই নিকট হইতে ইষ্টমন্ত্র গ্রহণ করেন, একথা আমি পিতার নিকটই শ্রবণ করিয়াছি, এবং আপনার পিতাকেও আমাদিগের বাড়িতে অনেকবার দেখিয়াছি। কিন্তু এখন আমার পিতা ও আপনার পিতা উভয়েই স্বর্গে গমন করিয়াছেন। আপনি আমাদিগের বাড়িতে এ পর্য্যন্ত কখনই আগমন করেন নাই বলিয়া, আমাদিগকে চিনেন না। আমার সহিত আপনার চাক্ষুষ আলাপ না থাকিলেও আমি কিন্তু লোক-পরম্পরায় আপনার সন্ধান রাখিয়া থাকি। এখন আমি আমার পত্নীর সহিত মন্ত্ৰ লইতে মনস্থ করিয়াছি কিন্তু পৈতৃক গুরুবংশ ব্যতীত অপর কাহারও নিকট হইতে মন্ত্র লওয়া যাইতে পারে না। এই নিমিত্ত আপনাকে আনবার নিমিত্ত আপনার গ্রামে আমি লোক পাঠাইয়াছিলাম; কিন্তু সেই লোক প্রত্যাগমন করিয়া কহিল, আপনি কলিকাতায় আগমন করিয়াছেন। আপনার নিমিত্ত কলিকাতায় অনেক অনুসন্ধান করিয়াছি। কিন্তু বাসার ঠিকঠিকানা জানিতে না পারায়, এ পর্য্যন্ত আপনার সন্ধান করিয়া উঠিতে পারি নাই। সৌভাগ্যক্রমে আজ আপনার পরিচিত একটি লোকের সহিত আমার সাক্ষাৎ হয়। এদিকে আসিবার কালে তিনিই দূর হইতে আপনাকে দেখাইয়া দেন। তাঁহারই অনুগ্রহে আজ আমি আপনাকে প্রাপ্ত হইয়াছি। এখন কোনরূপেই আমি আপনাকে ছাড়িব না। আমার সহিত আপনাকে আমাদিগের বাড়িতে গমন করিতে হইবে।” 

“আগন্তুকের কথা শ্রবণ করিয়া তাহার সমস্ত কথাই আমি বিশ্বাস করিয়া লইলাম ও কহিলাম, “আমি এখন গঙ্গাদর্শনে গমন করিতেছি। এখন আমি আপনার বাড়িতে গমন করিতে পারি না। আপনার বাড়ির নম্বর ও ঠিকানা আমাকে বলিয়া দিউন, সন্ধান করিয়া সন্ধ্যার পর আমি আপনার বাড়ীতে গমন করিব।’ 

“আমার কথা শ্রবণ করিয়া সে কহিল, ‘আমার বাড়ী সহজে আপনি খুঁজিয়া লইতে পারিবেন না। আমার এখন সবিশেষ কোনরূপ কাৰ্য্য নাই। চলুন, আমি আপনার সহিত গমন করিতেছি। গঙ্গাদর্শন প্রভৃতি আপনার কার্য্য সকল শেষ হইলে, আপনাকে সঙ্গে করিয়া আমি আমার বাড়ীতে লইয়া যাইব।” 

“আমি উহার প্রস্তাবে সম্মত হইয়া গঙ্গাভিমুখে গমন করিলাম। সে ব্যক্তিও আমার পশ্চাৎ পশ্চাৎ গমন করিল। গঙ্গাতীরে উপনীত হইয়া সে আমাকে কহিল, “যখন আমি আপনার সহিত গঙ্গাতীরে আগমন করিয়াছি, তখন আমি আপনাকে কিছু না খাওয়াইয়া এ স্থান হইতে আপনাকে লইয়া যাইতেছি না। এইস্থানে আপনি একটু অপেক্ষা করুন, আমি এখনই প্রত্যাগমন করিতেছি।’ এই বলিয়া আমাকে সেইস্থানে রাখিয়া উক্ত ব্যক্তি সেইস্থান হইতে প্রস্থান করিল, ও কিয়ৎক্ষণ পরে বড়বাজারের উত্তম উত্তম কতকগুলি খাবার লইয়া পুনরায় আগমন করিল। সেই সময়ে আমার আহার করিবার ইচ্ছা ছিল না। কিন্তু কোনরূপেই তাহার অনুরোধ হইতে পরিত্রাণ পাইলাম না; কাজেই সেই গঙ্গার ঘাটে বসিয়া আমি পরিতোষরূপে আহার করিলাম। 

“আহারান্তে আমরা সেইস্থান হইতে প্রস্থান করিলাম। কিছুদূর গমন করিলেই সে আমাকে কহিল, ‘যখন আমরা বড়বাজার অঞ্চলে আসিয়া উপস্থিত হইয়াছি, তখন আর একটি কার্য্য শেষ করিয়া যাওয়াই কর্তব্য। আমার নিজের এক জোড়া শালের প্রয়োজন আছে, এবং আপনার জন্য একজোড়া আমাকে প্রদান করিতে হইবে। টাকাও আমার সঙ্গে আছে। চলুন, কোন দোকান হইতে দুইজোড়া শাল ক্রয় করিয়া লইয়া যাই।’ পূর্ব্ব হইতেই আমি উহার সমস্ত কথা বিশ্বাস করিয়াছি, তাহার উপর উদর পূরিয়া সে আহারও করাইয়াছে, তদ্ব্যতীত আমাকেও একজোড়া শাল ক্রয় করিয়া দিবে, এ লোভ সম্বরণ করা আমা সদৃশ ব্রাহ্মণের কার্য নহে। সুতরাং তাহার কথায় বিশ্বাস করিয়া তাহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ গমন করিলাম, ও পরিশেষে সে আমাকে লইয়া এই শালওয়ালার দোকানে গিয়া উপস্থিত হইল। পরিশেষে যাহা যাহা ঘটিয়াছে, তাহা সমস্তই এই শালওয়ালার নিকট অবগত হইয়াছেন; আমি কোন কথা বলি নাই। শালওয়ালার সহিত যে কোন কথা হইয়াছে, তাহা তাহারই সহিত হইয়াছে, তবে আমি সেইস্থানে উপস্থিত ছিলাম মাত্র। পরিশেষে সে আমাকে শালওয়ালার দোকানে বসাইয়া সেই শাল লইয়া প্রস্থান করিল। আমি তাহার কথায় সম্পূর্ণরূপ বিশ্বাস করিয়াছিলাম; সুতরাং আমি কোন আপত্তি না করিয়া, সেইস্থানেই বসিয়া রহিলাম। এই আমার অপরাধ। এই অপরাধের নিমিত্ত আপনি আমার উপর যে দণ্ডের ব্যবস্থা করিতে চাহেন, আমি তাহা লইতে প্রস্তুত আছি। আমি আপনার নিকট যাহা বলিলাম, সেই ব্যক্তি সম্বন্ধে তাহা ব্যতীত আর আমি কিছুই অবগত নহি।” এই বলিয়া বৃদ্ধ নীরব হইল। 

বৃদ্ধের কথা শ্রবণ করিয়া আমি তাহার কথায় বিশ্বাস করিলাম। যে ব্যক্তি শাল লইয়া প্রস্থান করিয়াছে, তাহার অবয়ব, আকৃতি প্রভৃতি কিরূপ, তাহা উত্তমরূপে জানিয়া লইলাম, এবং শালওয়ালা ও ব্রাহ্মণের থাকিবার স্থান জানিয়া লইয়া তাহাদিগকে বিদায় করিয়া দিলাম। 

দুই তিন দিবস অনুসন্ধানের পরই জানিতে পারিলাম, এ জুয়াচোর কে? আরও জানিতে পারিলাম, সেই শাল দুইজোড়া সে কোথায় বন্ধক দিয়া আপনার কার্য্য উদ্ধার করিয়া লইয়াছে। এই সকল ব্যাপার জানিতে পারিবামাত্র পূর্ব্বকথিত শালওয়ালার দ্বারা সেই জুয়াচোরের নামে একটি নালিস রুজু করিয়া দিলাম। কোর্ট হইতে ওয়ারেন্ট বাহির হইল, আসামীও ধৃত হইল। অপহৃত শালের উদ্ধার হইল। বৃদ্ধব্রাহ্মণও নিষ্কৃতিলাভ করিল। সেই জুয়াচোরের নাম রামপদ। বিচারে রামপদ দুই বৎসরের নিমিত্ত শ্রীঘরে গমন করিল। ইহার পূর্ব্বেও চুরি করা অপরাধে আরও তিনবার সেইস্থানে সে গমন করিয়াছিল। 

পাঠকগণ দেখিলেন, চোরের বুদ্ধি কি প্রকার? 

তিন 

অনেক দিবস অতীত হইল, উচ্চ আদালতের আদেশ অনুযায়ী আমাকে একটি মোকদ্দমার অনুসন্ধানে নিযুক্ত হইতে হয়। সৰ্ব্বদা যে প্রকারের মোকদ্দমার অনুসন্ধানে আমাকে লিপ্ত হইতে হয়, ইহা সে প্রকারের মোকদ্দমা নহে; ইহার আসামী সাবেক পুলিসের একজন পুরাতন দারোগা। এই অসন্তোষজনক ঘটনা যদিও আমাদিগের এলাকার মধ্যে ঘটে নাই, ইহা যদিও সুদূর মফঃস্বলের ঘটনা, তথাপি হাইকোর্টের আজ্ঞামত আমাদিগের হস্তেই ইহার অনুসন্ধানের ভার অর্পিত হয়। আমি যেরূপভাবে এই মোকদ্দমার অনুসন্ধান করিয়াছিলাম ও পরিশেষে আমার অনুসন্ধানের ফল যাহা ফলিয়াছিল, তাহা এইস্থানে বলিবার প্রয়োজন নাই। কারণ, এই প্রবন্ধের প্রধান উদ্দেশ্য—চোরের যে প্রকার বুদ্ধি, তাহাই পাঠকগণকে বিদিত করা। সুতরাং আমি যে অনুসন্ধান করিয়াছিলাম, তাহার আনুপূর্ব্বিক বিবরণ আপাততঃ পরিত্যাগ করিয়া মূল মোকদ্দমার ব্যাপার প্রথমেই বিবৃত করিতে প্রবৃত্ত হইলাম। 

যে দারোগার বিরুদ্ধে আমি অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হইয়াছিলাম, এক সময় তাঁহার থানার এলাকাস্থিত অনেক গ্রামে সিঁদ ও চুরি হইতে আরম্ভ হয়। তিনি প্রাণপণে সেই সকল মোকদ্দমার অনুসন্ধান করেন; কিন্তু একটিমাত্র চুরি প্রমাণের কোনরূপ উপায় করিতে পারেন না। একটি চুরির অনুসন্ধান করিতেছেন, সে অনুসন্ধান শেষ করিয়া উঠিতে পারেন নাই; অমনি অপর স্থানে আর একটি চুরি হইল। সেইস্থানে গমন করিতে না করিতে, অপর আর এক গ্রাম হইতে আর একটি চুরির সংবাদ আসিল। এইরূপে অল্প সময়ের মধ্যে চোরের জ্বালায় তিনি নিতান্ত জ্বালাতন হইয়া পড়েন। দিকে একটি মোকদ্দমাও সুচারুরূপে প্রমাণিত করিতে না পারায়, ঊর্দ্ধতন-কর্মচারীবর্গের নিকটও নিতান্ত অপদস্থ ইতে আরম্ভ হন। 

চুরি নিবারণের নিমিত্ত পুলিস কর্মচারীর যে সকল উপায় অবলম্বন করা কর্তব্য, তাহার কোন বিষয়েই তিনি ত্রুটী করিলেন না। চৌকিদারদিগের উপর পীড়াপীড়ি, কনষ্টেবল ও অফিসারবর্গের উপর রোঁদ লইয়া কাড়াকড়ি, এলাকার চোর-বদমায়েসদিগের উপর কঠোর দৃষ্টি প্রভৃতি পুলিস কর্মচারীর অত্যাবশ্যক বিষয় সকলের উপর তিনি তীক্ষ্ণরূপে দৃষ্টি রাখিতে লাগিলেন। রাত্রিকালে নিজেও গ্রামে গ্রামে রোঁদে ঘুরিয়া বেড়াইতে লাগিলেন; তথাপি কোনরূপে চুরি বন্ধ করিতে পারিলেন না। এদিকে উর্দ্ধতন কর্মচারীবর্গের নিকট হইতে পরোয়ানার উপর পরোয়ানা আসিতে লাগিল, কৈফিয়তের উপর কৈফিয়ৎ তলপ হইতে লাগিল। বৃদ্ধ দারোগা এই সকল দেখিয়া শুনিয়া মনে মনে স্থির করিলেন, এইবার তাঁহার চাকরীর শেষ হইয়াছে। কিন্তু তিনি চুরি দমনের চেষ্টা করিতে বিরত হইলেন না, ফলতঃ কিছুতেই তাহার কোন সুফল হইল না। যাহা হউক, এইরূপে কিছুদিবস অতীত হইয়া গেল। 

একদিবস অতি প্রত্যূষে দারোগা মহাশয় চিন্তিত অন্তঃকরণে থানার বারান্দায় বসিয়া হস্তমুখ প্রক্ষালন করিতেছেন, এমন সময় একজন কনষ্টেবল ও দুইজন চৌকিদার এক ব্যক্তিকে বন্ধনাবস্থায় থানায় আনিয়া উপস্থিত করিল, ও দারোগা বাবুর সম্মুখে তাহাকে আনিয়া কহিল, “মহাশয়! এতদিবস পরে আজ চোর ধৃত হইয়াছে। আর আমাদিগের ভাবনা নাই, ইহার দ্বারা আজ সকল চুরি মোকদ্দমার প্রমাণের উপায় করিয়া লইব।” 

দারোগা। এ ব্যক্তি চোর, একথা তোমাদিগকে কে বলিয়া দিল? 

কনষ্টেবল। কেহ বলিয়া দেয় নাই। আজ অপহৃত দ্রব্যের সহিত ইহাকে ধৃত করিয়াছি। 

দারোগা। অপহৃত দ্রব্যের সহিত? কই দেখি। 

দারোগার এই কথা শ্রবণ করিবামাত্র সেই কনষ্টেবল তাহার ঝোলা হইতে একটি পুঁটলি বাহির করিয়া দারোগার হস্তে অর্পণ করিল। দারোগা অতীব আগ্রহের সহিত সেই পুঁটলিটি খুলিলেন। দেখিলেন, উহার ভিতর প্রায় সহস্র টাকা মূল্যের কতকগুলি সোণা ও রূপার অলঙ্কার। এই ব্যাপার দেখিয়া তিনি অতিশয় সন্তুষ্ট হইয়া কনষ্টেবলকে সোৎসুকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “এই সকল অলঙ্কারের সহিত কিরূপে এই ব্যক্তি ধৃত হইল?” 

কনষ্টেবল। এই দুইজন চৌকিদারের সহিত আমি গত রাত্রিতে বহির্গত হইয়াছিলাম। নানা গ্রামে রোঁদে ঘুরিয়া যখন আমরা প্রত্যাগমন করিতেছিলাম, সেই সময় দেখিলাম যে, এই ব্যক্তি অপর দিক হইতে আগমন করিতেছে। প্রথমে বোধ হয়, এ আমাদিগকে দেখিতে পায় নাই; তাহা হইলে একবারে আমাদিগের সম্মুখে পড়িবে কেন? যখন এ আমাদিগের তিনজনকেই সম্মুখে দেখিতে পাইল, তখন পথের মধ্যস্থল পরিত্যাগ করিয়া একপার্শ্বে গমন করিল ও প্রস্রাব ত্যাগ করিবার ভান করিয়া সেইস্থানে বসিয়া পড়িল। ইচ্ছা—আমরা চলিয়া গেলে সে উঠিয়া প্রস্থান করিবে। ইহার এইরূপ ব্যাপার দেখিয়া আমার মনে কেমন একরূপ সন্দেহের উদয় হইল। আমরাও আর পদমাত্র অগ্রবর্তী না হইয়া, সেইস্থানেই দণ্ডায়মান রহিলাম। এ যখন দেখিল, আমরা সেইস্থান পরিত্যাগ করিলাম না, তখন অনন্যোপায় হইয়া সে গাত্রোত্থান করিল, এবং দ্রুতপদে সেইস্থান হইতে প্রস্থান করিবার উপক্রম করিল। এই ব্যাপার দেখিয়া আমি ইহাকে দাঁড়াইতে কহিলাম। জানি না, কি ভাবিয়া এ দাঁড়াইল। আমি ইহার নিকটে গমন করিলাম, দেখিলাম, বস্ত্রের মধ্যে বগলের নিম্নে কি যে লুকাইয়া রাখিয়াছে। সুতরাং আমি ইহার সন্ধান লইলাম, ও ইহার নিকট হইতে পুঁটুলি বাঁধা এই সকল দ্রব্য প্রাপ্ত হইলাম। আমার নিশ্চয় বোধ হইতেছে যে, আমাদের এলাকায় যে সকল চুরি হইতেছে, তাহা ইহারই কার্য্য; নতুবা এত অলঙ্কার এ কোথায় পাইবে? এই অলঙ্কার সকল এ কোথায় পাইয়াছে, তাহা ইহাকে জিজ্ঞাসা করায় এ সন্তোষজনক কোনরূপ উত্তর প্রদান করিতে পারিল না। সুতরাং অপহৃত দ্রব্য সন্দেহে আমরা ইহাকে ধৃত করিয়া আপনার সম্মুখে উপস্থিত হইয়াছি। এখন আপনার যাহা সদ্বিবেচনা হয়, আপনি তাহা করুন। 

কনস্টেবলের কথা শুনিয়া এবং অলঙ্কারগুলিও উত্তমরূপে দেখিয়া দারোগাও মনে মনে স্থির করিয়া লইলেন যে, এই ব্যক্তিই তাঁহার এলাকায় চুরি করিয়া তাহাকে একেবারে জ্বালাতন করিয়া তুলিয়াছে, ও তাঁহার সর্ব্বনাশ-সাধন করিতে বসিয়াছে। মনে মনে এইরূপ ভাবিয়া তিনি সেই ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “তোমার নাম কি?” 

“আমার নাম ইসলাম খাঁ।” 

দারোগা। এ অলঙ্কারগুলি কাহার? 

ইসলাম। এ সকল আমার অলঙ্কার। 

দারোগা। এ দেখিতেছি, বাঙ্গালীদের পরিধান করিবার অলঙ্কার; কিন্তু তোমাকে পশ্চিম-দেশবাসী বলিয়া অনুমান হইতেছে। এ সকল অলঙ্কার তোমার হইবে কি প্রকারে? 

ইসলাম। পশ্চিম-দেশবাসী হইলে বাঙ্গালীদের পরিধান উপযোগী অলঙ্কার কি ব্যবহার করিতে নাই?

দারোগা। আমার এলাকায় তোমাকে কখন দেখিয়াছি বলিয়া বোধ হয় না। তুমি কোথায় থাক? 

ইসলাম। আমার থাকিবার স্থিরতা নাই। পূর্ব্বে আমি কলিকাতায় থাকিতাম। সেইস্থানে আমার স্ত্রীর মৃত্যু হওয়ায় এবং আমার আত্মীয়স্বজনের মধ্যে অপর আর কেহ না থাকায়, আমি আমার স্ত্রীর অলঙ্কারগুলি সঙ্গে করিয়া নানাস্থানে ঘুরিয়া বেড়াই। 

দারোগা। এ তোমার মিথ্যা কথা, তুমি চোর। এ সকল দ্রব্য কোথা হইতে চুরি করিয়াছ, তাহা তোমাকে বলিতে হইবে। 

ইসলাম! আমি কখনই চোর নই, এবং এই সকল অলঙ্কার কোনস্থান হইতে চুরিও করি নাই। এরূপ অবস্থায় আমি মিথ্যা করিয়া কাহারও ঘর দেখাইয়া দিব? 

ইস্লামের সহিত দারোগামহাশয়ের এইরূপ দুই চারিটি কথাবার্তার পর দারোগা মহাশয় তাহাকে তখন গারদে বদ্ধ করিবার আদেশ প্রদান করিলেন। অনতিবিলম্বে তাঁহার আদেশ প্রতিপালিত হইল। দারোগা মহাশয় তখন সেইস্থান হইতে গাত্রোত্থান করিয়া আপনার দপ্তরে গিয়া উপবেশন করিলেন ও কেতাব পত্র লইয়া পূর্ব্ব পূর্ব্ব মোকদ্দমার অপহৃত দ্রব্যের তালিকার সহিত এক্ষণকার ধৃত দ্রব্যের কোন প্রকার সে সাদৃশ্য কি না, তাহা দেখিতে আরম্ভ করিলেন 

ইসলাম কোন কথাই বলিল না। দারোগা মহাশয় তখন ইসলামকে লইয়া তাঁহার সাধ্যমত সন্ধান করিলেন; কিন্তু উহার সম্বন্ধে সবিশেষ কিছুই জানিতে পারিলেন না। তাহার এলাকায় পূর্ব্বে যে সকল চুরি হইয়া গিয়াছিল, তাহাতে যে সকল অলঙ্কার অপহৃত হইয়াছিল, তাহার মধ্যে যাহার সহিত উপস্থিত অলঙ্কারের সৌসাদৃশ্য হইল, সেই সে অলঙ্কার-চুরির মোকদ্দমায় ইসলামকে আসামী করিয়া মাজিষ্ট্রেট সাহেবের নিকট বিচারার্থ প্রেরণ করিলেন। সেইস্থানে যথাসময়ে ইসলামের বিচার আরম্ভ হইল। যাহা হউক, এইরূপে কতকগুলি মোকদ্দমার একবারে প্রমাণ সংগ্রহ হওয়ায় দারোগা মহাশয় যে কতদূর আনন্দিত হইলেন, তাহা বলা যায়না। 

মাজিষ্ট্রেট সাহেবের এজলাসে একদিবস এই মোকদ্দমার বিচার হইতেছিল। সেইদিবস পশ্চিম-দেশীয় একজন পুলিস-কর্মচারী কোন কাৰ্য্যোপলক্ষে সেইস্থানে গমন করেন। তিনি পূর্ব্ব হইতে ইসলামকে চিনিতেন। তিনি বলিলেন যে, উহার নাম ইসলাম নহে; ইহার প্রকৃত নাম আলি নেওয়াজ। এ ব্যক্তি একজন প্রসিদ্ধ চোর। পশ্চিম দেশ হইতে আট দশ বার জেল খাটিয়া আপন দেশ পরিত্যাগ করিয়াছে। এখন যে কোথায় থাকে, তাহা কেহই অবগত নহে। 

পশ্চিম-দেশীয় পুলিস কর্মচারীর কথা শ্রবণ করিয়া আলি নেওয়াজ তাহাকে সহস্র গালি প্রদান করিল ও কহিল, যে মোকদ্দমায় আমি অভিযুক্ত, তাহাতে আমি দোষী না হইলেও মনে মনে স্থির করিয়াছিলাম যে, আমি দোষ স্বীকার করিয়া লইব। কারণ, এইস্থানের পুলিস আমার পূর্ব্বের অবস্থা অবগত নহেন; সুতরাং আমার দুই এক বৎসরের অধিক মেয়াদ হইবে না, আমি অনায়াসেই অল্প দিবস জেলে থাকিয়া নিষ্কৃতিলাভ করিব। কিন্তু তুমি যখন আমার সমস্ত পূৰ্ব্ববৃত্তান্ত প্রকাশ করিয়া দিলে, তখন আর আমার সে উপায় নাই। এখন যদি আমার সাজা হয়, তাহা হইলে আমাকে আর প্রত্যাগমন করিতে হইবে না।” 

এদিকে মাজিষ্ট্রেট সাহেব ও পুলিস কর্মচারী, পশ্চিমদেশীয় কর্মচারীর কথা শ্রবণ করিয়া নিতান্ত বিস্মিত হইলেন। সেইদিবস মোকদ্দমা মুলতবি করিয়া আলি নেওয়াজের পূর্ব্ব মেয়াদের তারিখ সকল আনাইবার অভিপ্রায়ে সেই প্রদেশীয় মাজিষ্ট্রেট সাহেবের নিকট পত্র লিখিলেন। সময়-মত সাবেক সাজার তারিখ সকল আসিল। এদিকে ফরিয়াদী ও সাক্ষীগণের দ্বারা মোকদ্দমা উত্তমরূপে প্রমাণিত হইয়া গেল। কিন্তু যে ব্যক্তি পূর্ব্বে আট নয় বার মেয়াদ খাটিয়াছে, তাহাকে তিনি সাজা দিতে পারিলেন না। বিচারার্থ উহাকে দায়রায় পাঠাইয়া দিলেন। 

সময় মত দায়রায় উহার মোকদ্দমা উঠিল। পাঁচজন জুরির সহিত জজসাহেব উহার বিচার করিতে বসিলেন। ফরিয়াদী মাল সকল সনাক্ত করিল। নিম্ন আদালতের সাক্ষীগণ যাহা যাহা বলিয়াছিল, এখানেও তাহাই কহিল। এক—কথায় মোকদ্দমা উত্তমরূপে প্রমাণিত হইয়া গেল। জজ ও জুরিগণকে দেখিয়া বোধ হইল, তাহারা সকলেই এই মোকদ্দমা বিশ্বাস করিয়াছেন। সেই সময় জজসাহেব আসামীকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “তোমার বিরুদ্ধে এখন এই মোকদ্দমা যেরূপ প্রমাণিত হইল, তাহা তুমি শ্রবণ করিলে। এখন তুমি এ সম্বন্ধে কি বলিতে চাহ?” 

আলি নেওয়াজ। কি বলিব ধর্ম্মাবতার! এ মোকদ্দমা সম্পূর্ণ মিথ্যা। এ সকল চুরি আমার দ্বারা হয় নাই। একে আমি পুরাতন চোর, তাহার উপর কতকগুলি অলঙ্কার আমার নিকট পাওয়া গিয়াছে; কাজেই দারোগা মহাশয় সেই সকল অলঙ্কার ফরিয়াদীগণের দ্বারা মিথ্যা সনাক্ত করাইয়া আমার নামে এই মিথ্যা মোকদ্দমা রুজু করিয়াছেন। আমি যে একজন চোর, সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই, এবং চুরি করিয়াই যে আমি জীবন ধারণ করি, সে বিষয়েও কোন প্রকার ভুল নাই। কিন্তু যে সকল দ্রব্য চুরি করার অপরাধে আমি এখন অভিযুক্ত হইয়াছি, সেই সকল চুরি আমার দ্বারা হয় নাই। 

জজসাহেব। এই সকল চুরি যে তোমার দ্বারা হয় নাই, তাহা তুমি প্রমাণ করিতে পারিবে কি প্রকারে? 

আলি নেওয়াজ। তাহা আমি প্রমাণ করিতে পারিব বলিয়া, আমার বিশ্বাস থাকিলেও ধর্ম্মাবতারের অনুগ্রহের উপর তাহা সম্পূর্ণরূপে নির্ভর করিতেছে। 

জজসাহেব। আমার নিকট হইতে তুমি কি অনুগ্রহ প্রার্থনা কর? 

আলি নেওয়াজ। আমি একটি সাক্ষী ডাকিতে প্রার্থনা করি, কিন্তু দুর্ভাগ্যবশতঃ সেই সাক্ষীর নাম আমি জানি না; বরং তাহার বাড়ি চিনি। যদি আপনি অনুগ্রহ করিয়া আপনার বিশ্বাসী কোন লোককে আমার সহিত পাঠাইয়া দেন, তাহা হইলে আমি তাহার বাড়ি দেখাইয়া দিতে পারি। পরে তাহার নাম অবগত হইতে পারিলে যেরূপ উপায়ে হউক, আপনি তাহাকে এইস্থানে উপস্থিত করিতে পারিবেন, ও তখন জানিতে পারিবেন যে, এই সকল মোকদ্দমায় আমি অপরাধী কি না। 

জজসাহেব। ভাল, তুমি যাহা বলিলে, তাহা করিবার ক্ষমতা যেন আমার আছে। কিন্তু তুমি একে পুরাতন চোর; তাহার উপর এই সকল মোকদ্দমা উত্তমরূপে প্রমাণিত হইয়াছে। এইরূপ অবস্থায় এইরূপ ভান করিয়া তুমি যে পলায়ন না করিবে, তাহা আমি কি প্রকারে বিশ্বাস করিতে পারিব? 

আলি নেওয়াজ। আমার কথায় বিশ্বাস করা না করা ত ধর্ম্মাবতারের ইচ্ছা। তবে আমি এইমাত্র বলিতে পারি যে, হাতে হাতকড়ি দিয়া, পায়ে বেড়ি দিয়া বা অপর যে কোন উপায়ে হউক, যাহাতে আমি পলাইতে না পরি, এরূপভাবে আমাকে উত্তমরূপে বন্ধন করিয়া এবং উপযুক্ত পরিমাণ প্রহরী বা প্রধান কর্মচারীর জিম্মায় রাখিয়া আমাকে সেইস্থানে পাঠাইয়া দেওয়া হউক। আমি সেই বাড়ীতেও গমন করিব না, দূর হইতে কেবল তাহার বাড়ী দেখাইয়া দিব। তখন আপনি সেই বাড়ীওয়ালাকে ডাকাইয়া লইবেন, ও তাহার পর তাহার সাক্ষ্য গ্রহণ করিবেন। তাহা হইলে আপনার বিশ্বাস হইবে যে উপস্থিত মোকদ্দমায় আমি সম্পূর্ণরূপে নির্দোষ। 

জজসাহেব। তুমি সাক্ষ্যদ্বারা কি প্রমাণ করাইতে চাহ, তাহা আমাকে পূৰ্ব্বে বলিলে আমি বুঝিতে পারিব যে, সেই সাক্ষীর দ্বারা তোমার কোনরূপ উপকার হইতে পারে কি না? যদি বুঝিতে পারি, তাহার দ্বারা তোমার কোনরূপ উপকার হইবার সম্ভাবনা, তাহা হইলে তখন তাহার জন্য বন্দোবস্ত হইতে পারে। 

আলি নেওয়াজ। আমি আমার সাক্ষীদ্বারা কি প্রমাণ করাইতে পারিব যে তাহা আমি আপনার নিকট বলিতে বাধ্য। কিন্তু আদালতের ভিতর যদি অমি তাহা প্রকাশ করি, তাহা হইলে আমার অভিসন্ধির বিষয় পুলিস ও অপরাপর সকলেই জানিতে পারিবে; সুতরাং তাহার দ্বারা আমার আর কোনরূপ উপকারের সম্ভাবনা থাকিবে না। আমার পক্ষে সে যে কি সাক্ষ্য দিবে, তাহা সে প্রথমে নিজেই জানিতে পারিবে না। যখন সে আপনার সম্মুখে আসিয়া উপস্থিত হইবে, তখন আমি তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলে বাধ্য হইয়া তাহাকে প্রকৃতকথা বলিতে হইবে। সে আমার পক্ষে কি প্রমাণ করিতে পারিবে, তাহা যদি নিতান্তই অগ্রে জানিতে চাহেন, তাহা হইলে আমি কেবলমাত্র আপনার নিকট আমার মনের কথা বলিতে পারি। 

জজসাহেব আলি নেওয়াজের প্রস্তাবে সম্মত হইলেন। তখন আলি নেওয়াজ তাঁহার নিকট একান্তে আনীত হইল, ও সে চুপি চুপি জজসাহেবকে দুই চারিটিমাত্র কথা বলিয়া চলিয়া আসিল। জজসাহেবকে সে যে কি বলিল, তাহা তাপর কেহই জানিতে পারিল না। কিন্তু জজসাহেব তাহার আবেদন গ্রাহ্য করিয়া সেই দিবসের নিমিত্ত মোকদ্দমা স্থগিত রাখিলেন, এবং আসামীকে উত্তমরূপে বন্ধন করিয়া তাহার কথিত মত স্থানে লইয়া যাইবার নিমিত্ত পুলিসকে আদেশ প্রদান করিলেন ও বলিয়া দিলেন যে, আলি নেওয়াজ যে বাড়ী দেখাইয়া দিবে, সেই বাড়ীর অধিকারী বা সেই বাড়ীতে অবস্থিতি করে, এরূপ ব্যক্তিকে আনিয়া তাঁহার নিকট উপস্থিত করা হয়। 

জজসাহেবের আদেশ প্রতিপালিত হইল। আলি নেওয়াজ পুলিসকে যে বাড়ী দেখাইয়া দিল, সেই বাড়ী হইতে দুইজন পুরুষ মানুষকে আনিয়া, তৃতীয় দিবসে জজসাহেবের নিকট উপস্থিত করা হইল। 

নিয়মিত সময়ে সেই মোকদ্দমা পুনরায় উপস্থিত হইলে, জজসাহেব আলি নেওয়াজকে কহিলেন, “তুমি আমার প্রেরিত পুলিসকে যে বাড়ী দেখাইয়া দিয়াছ, সেই বাড়ী হইতে দুই ব্যক্তি আগমন করিয়াছে, তাহাদিগকে যদি তুমি ডাকিতে চাহ, ত’ ডাকিতে পার।” 

আলি। হাঁ ধর্ম্মাবতার! আমি উহাদিগকে ডাকিতে চাহি। আপনি পুলিসকে আদেশ প্রদান করুন, উহাদিগের একজনকে প্রথমে আনিয়া এইস্থানে উপস্থিত করান। 

জজসাহেবের আদেশে একজনকে সেইস্থানে আনা হইল। জজসাহেব তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “তোমার নাম কি?” 

উত্তরে সাক্ষী কহিল, “আমার নাম শ্রীগোপালচন্দ্ৰ সোম।” 

জজ। তোমার সম্মুখে যে ব্যক্তি দাঁড়াইয়া আছে সে সিঁদচুরি মোকদ্দমায় অভিযুক্ত, এবং যেরূপ প্রমাণ পাওয়া গিয়াছে, তাহাতে ইহার দোষ অনেকটা সাব্যস্ত হইয়াছে। কিন্তু এই ব্যক্তি তোমাকে সাক্ষ্য মানিয়াছে, এখন তুমি আসামীর পক্ষে কি সাক্ষ্য দিতে প্রস্তুত আছ? 

গোপাল। ধর্ম্মাবতার! আমরা গৃহস্থ লোক। চোরের সহিত আমাদিগের কোনরূপ সংস্রব নাই। বিশেষতঃ আমি ইহাকে চিনি না, আর কখন ইহাকে যে দেখিয়াছি, তাহাও আমার বোধ হয় না। এরূপ অবস্থায় আমি উহার বিপক্ষে কি সাক্ষ্য প্রদান করিব? 

আলি। আপনি আমাকে চিনুন বা না চিনুন, আমি কিন্তু আপনাকে যাহা জিজ্ঞাসা করিব, তাহার প্রকৃত উত্তর আপনি দিবেন, কি না? 

গোপাল। আমার জ্ঞান ও বিশ্বাস মতে আমি যতদূর জানি, তাহার প্রকৃত উত্তর অবশ্য প্রদান করিব। 

আলি। আপনি যে বাড়ীতে অবস্থিতি করেন, সেই বাড়ীতে অল্পদিবসের মধ্যে কোন চুরি হইয়াছে, কি না? গোপাল। হাঁ চুরি হইয়াছে। ঘরে সিঁদ কাটিয়া ঢোর আমাদিগের যথাসর্বস্ব লইয়া গিয়াছে। 

আলি। সিঁদ দিয়া আপনার গৃহ হইতে চোরে সকল দ্রব্য যে চুরি করিয়া লইয়া গিয়াছে, সে সংবাদ আপনি থানায় প্রদান করিয়াছেন কি? 

গোপাল। হাঁ, করিয়াছি বৈকি? পুলিস এখন পর্যন্ত সেই মোকদ্দমার অনুসন্ধান করিতেছেন। 

আলি। আপনার পশ্চাদ্ভাগে যে দারোগা বাবু বসিয়া আছে, তাঁহারই থানায় আমি ধৃত হইয়া এই মোকদ্দমায় আসামী হইয়াছি। আপন কি এই দারোগা বাবুর নিকট আপনার চুরির সংবাদ প্রদান করিয়াছেন? 

গোপাল। এই দারোগাবাবুর থানার এলাকায় আমার ঘর নহে, অমার বাড়ী অন্য থানার এলাকায়। সুতরাং আমি আমাদিগের থানাতেই সংবাদ প্রেরণ করিয়াছি। 

আলি। আপনার যে সকল দ্রব্য অপহৃত হইয়াছে, তাহার মধ্যে অলঙ্কারাদি কিছু ছিল কি? 

গোপাল। হাঁ, অনেক টাকার অলঙ্কার ছিল। 

আলি। আপনার যে সকল অলঙ্কার অপহৃত হইয়াছে, তাহার যথাযথ তালিকা আপনি অনুসন্ধানকারী দারোগা বাবুকে প্রদান করিয়াছেন, কি না? 

গোপাল। তাহার তালিকা আমি দিয়াছি, ও তাহার ওজন পৰ্য্যন্তও লিখিয়া দিয়াছি। 

আলি। আপনার যে সেকল অলঙ্কার অপহৃত হইয়াছে, তাহার কোন অলঙ্কার আপনি পুনঃপ্রাপ্ত হইয়াছেন কি?

গোপাল। না। 

আলি। দেখুন দেখি, এই অলঙ্কারগুলির মধ্যে কোন অলঙ্কার আপনি চিনিতে পারেন কি না? 

এই বলিয়া আলি নেওয়াজ জজসাহেবকে কহিল, “ধর্ম্মাবতার! যে সকল অলঙ্কার অপহরণ করার অভিযোগে আমি এইস্থানে আনীত হইয়াছি, সেই অলঙ্কারগুলি এবং অবশিষ্ট অলঙ্কার সকল যাহা অমার নিকট পাওয়া গিয়াছে বলিয়া আমি অভিযুক্ত, সেই সমস্ত অলঙ্কার অনুগ্রহ পূর্ব্বক একবার গোপাল বাবুকে দেখাইতে আজ্ঞা হয়।” 

আসামীর প্রার্থনা জজসাহেব মঞ্জুর করিয়া অলঙ্কারগুলি গোপালবাবুর সম্মুখে রাখিতে কহিলেন। বলিবামাত্র আদেশ প্রতিপালিত হইল। 

গোপাল। আমার যে সকল অলঙ্কার অপহৃত হইয়াছে, ইহা সেই সকল অলঙ্কার বলিয়া বোধ হইতেছে। 

গোপাল বাবুর কথা শ্রবণ করিয়া আদালতের সমস্ত লোক একেবার বিস্মিত হইলেন; সকলে সকলের মুখের দিকে দেখিতে লাগিলেন। দারোগা বাবুর মুখ শুখাইয়া গেল। গোপালের সাক্ষ্য এইস্থানেই শেষ হইয়া গেল! অপর সাক্ষীকেও জজসাহেব ডাকিলেন, তিনিও গোপাল বাবুর সমস্ত কথা সমর্থন করিলেন। গোপালবাবু যে দারোগার নিকট নালিস করিলেন, জজসাহেব মালের তালিকা ও ডায়ারি প্রভৃতির সহিত সেই দারোগাকেও ডাকিলেন। গোপাল—বাবুর কথা যে প্রকৃত, তাহা দারোগাবাবুও প্রমাণিত করিলেন! 

সেই সময় আলি নেওয়াজ পুনরায় কহিল, “ধর্ম্মাবতার! আমি চোর, চুরি করিয়াই আমি আমার জীবন যাত্রা নির্ব্বাহ করিয়া থাকি; কিন্তু যে সকল অভিযোগে আমি অভিযুক্ত সেই সকল চুরি আমার দ্বারা হয় নাই। এ সমস্ত অলঙ্কারের মধ্যে একখানিও বর্তমান ফরিয়াদীবর্গের নহে। ইহার সমস্তই গোপালবাবুর বাড়ী হইতে অপহৃত। গোপালবাবুর বাড়ী হইতে অপহরণ করা অপরাধে যদি আমার দণ্ড হয়, তাহাতে আমার কোন দুঃখ নাই। কিন্তু দারোগাবাবু মিথ্যা করিয়া কতকগুলি মোকদ্দমায় আমাকে জেলে পাঠাইতে বসিয়াছেন, ইহাই বড় দুঃখের বিষয়। এখন প্রকৃতকথা আমি সমস্তই বলিলাম, আপনার যাহা ইচ্ছা হয়, আপনি তাহা করিতে পারেন।” 

আসামীর কথা এবং তাহার পক্ষীয় সাক্ষীগণের জবানবন্দী শ্রবণ করিয়া জুরিগণ বর্তমান সমস্ত মোকদ্দমার আসামীকে নির্দোষ সাব্যস্ত করিলেন। জজসাহেবও তাঁহাদিগের মতে মত দিয়া বৰ্ত্তমান সমস্ত মোকদ্দমা হইতে আসামীকে অব্যাহতি প্রদান করিলেন; কিন্তু গোপালবাবুর বাড়ী হইতে অপহরণ করার নিমিত্ত আসামীর নামে মোকদ্দমা রুজু করিতে আদেশ দিলেন। আসামীও জজ সাহেবের আদেশ শ্রবণ করিয়া তাঁহাকে বার বার ধন্যবাদ প্রদান করিল। যখন একবারে নিষ্কৃতি পাইবে না, তখন জজসাহবেকে কেন সে ধন্যবাদ প্রদান করিতেছে, সেই বিষয় জানিবার নিমিত্ত জজসাহেবের কৌতূহল হইল; তিনি তাহাকে সেই ধন্যবাদের কারণ জিজ্ঞাসা করিলেন। 

উত্তরে আলি নেওয়াজ কহিল, “ধর্ম্মাবতার! আমি যতগুলি মোকদ্দমায় আপনার নিকট অভিযুক্ত হইয়াছিলাম, তাহার সমস্তগুলিই উত্তমরূপে প্রমাণিত হইয়াছিল; সুতরাং আপনি বাধ্য হইয়া প্রত্যেক মোকদ্দমাতেই আমাকে দণ্ড প্রদান করিতেন। তাহা হইলে আমার দণ্ডের সংখ্যা যে অত্যন্ত বাড়িয়া যাইত, তাহার আর কিছুমাত্র সন্দেহ নাই। এখন আমি একটিমাত্র মোকদ্দমাতেই আসামী হইলাম; সুতরাং একই মোকদ্দমায় দণ্ড পাইব। এখন আমার সেই দণ্ডের পরিমাণ অনেক কম হইবে। এই নিমিত্তই আমি আপনাকে ধন্যবাদ প্রদান করিতেছি।” 

ইহার কথা শ্রবণ করিয়া জজসাহেব বুঝিলেন, এ যাহা বলিতেছে, তাহা প্রকৃত। ইহাকেই চোরের বুদ্ধি কহে। এই মোকদ্দমার যথাযথ ব্যাপার জজসাহেব লিখিয়া হাইকোর্টে প্রেরণ করেন। সেইস্থান হইতে মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়া অপরাধে প্রত্যেক ফরিয়াদীর নামে ও মিথ্যা মোকদ্দমা সাজান অপরাধে দারোগার নামে নালিস রুজু করিবার আদেশ হয়। এই মোকদ্দমার অনুসন্ধানে পরে আমাকেই লিপ্ত হইতে হয়। পরিশেষে দারোগা ও ফরিয়াদীগণকে শ্রীঘরে গমন করিতে হইয়াছিল। এদিকে আলি নেওয়াজও গোপালবাবুর দ্রব্য অপহরণ করার অভিযোগে কারারুদ্ধ হইয়াছিল। 

চার 

রাত্রি প্রভাত হইতে কিছু বিলম্ব আছে, কোন কৰ্ম্ম উপলক্ষে আমি সে দিবস বাসায় গমন করিতে পারি নাই, থানাতেই শয়ন করিয়া আছি, এমন সময় পশ্চিম-দেশীয় একজন কর্মচারী একটি চোরকে ও একখানি চট্টমোড়া প্রায় দশ সের আন্দাজ চিনির থলিয়া আমার সম্মুখে উপস্থিত করিল ও কহিল, “বোঁদ হইতে ফিরিয়া আসিবার সময় থানার সম্মুখেই আমি এই লোকটিকে এই চিনি লইয়া যাইতে দেখিতে পাই। আমি ইহাকে পূৰ্ব্ব হইতে চিনিতাম, এ ব্যক্তি একজন পুরাতন চোর। আমাকে দেখিবামাত্র এই চিনির বস্তা ফেলিয়া পলায়ন করিবার চেষ্টা করে; কিন্তু … আমি নিতান্ত সন্নিকটে থাকায় কৃতকাৰ্য্য হইতে পারিল না। আমি ইহাকে এই দ্রব্যের সহিত ধৃত করিয়া আনিয়াছি। এখন যেরূপ আদেশ প্রদান করিবেন, সেইরূপই করিব।” 

কর্মচারীর কথা শ্রবণ করিয়া আমি সেই চোরকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “এ চিনি তুমি কোথায় পাইলে?”

উত্তরে চোর কহিল, “আর কোথা পাইব মহাশয়? সবই ত জানিতে পারিতেছেন। যখন ধরা পড়িয়াছি, তখন আর মিথ্যা বলিয়া কি করিব? হাবড়ার মালগুদাম হইতে এই চিনি অপহরণ করিয়া আনিয়াছি।” 

আমি। মালগুদাম হইতে তুমি কি প্রকারে অপহরণ করিলে? সেইস্থানে প্রহরীর পাহারা থাকে। 

চোর। পাহারা থাকে সত্য, কিন্তু প্রহরী জাগিয়া পাহারা দেয় না। যখন দেখিলাম যে, প্রহরী নিদ্রা যাইতেছে, সেই সময় সুবিধা বুঝিয়া একখানি বস্তা কাটিয়া এই চিনি বাহির করিয়া লইলাম। 

আমি। সে কাটা বস্তা এখন কোথায়? 

চোর। যে স্থানের বস্তা, সেই মালগুদামেই পড়িয়া আছে। 

এই কথা শ্রবণ করিয়া আমি সেই পশ্চিম-দেশীয় কর্মচারীকে কহিলাম, “অতি সাবধানের সহিত ইহাকে লইয়া যাও, এবং দেখ—যে বস্তা হইতে চিনি বাহির করিয়া আনিয়াছে, সেই বস্তা এখনও সেইস্থানে আছে কি না? যদি প্রকৃতই কাটা বস্তা দেখিতে পাও, ও সেই বস্তার চিনির সহিত এই চিনির সৌসাদৃশ্য হয়, তাহা হইলে মাল ও আসামী হাবড়া পুলিসের হস্তে সমর্পণ করিয়া আসিবে। কারণ, প্রকৃতই যদি এ হাবড়া হইতে চুরি করিয়া থাকে, তাহা হইলে এ মোকদ্দমা হাবড়ার—আমাদিগের নহে। এ পুরাতন চোর। তুমি একাকী ইহাকে লইয়া যাইও না, একজন কনষ্টেবলকে সঙ্গে করিয়া লইয়া যাও।” 

আমার কথা শ্রবণ করিয়া কর্মচারী চোর ও চিনি লইয়া আমার গৃহ হইতে প্রস্থান করিল। 

প্রাতঃকালে আমি নিদ্রা হইতে গাত্রোত্থান করিয়া অন্যান্য কার্য্যে ব্যস্ত রহিলাম। বেলা আটটার সময় দেখিলাম, কর্মচারী সেই চোরকে লইয়া পুনরায় আমার সম্মুখে উপস্থিত হইল। যে কনষ্টেবল তাহার সঙ্গে গমন করিয়াছিল, সেও সেই সঙ্গে আগমন করিল। উহাদিগকে দেখিয়া আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, “চোর যে কথা বলিয়া তোমাদিগকে লইয়া গিয়াছিল, তাহা কি প্রকৃত?” 

আমার কথা শ্রবণ করিয়া উহারা সকলেই চুপ করিয়া রহিল, কেহই কোন উত্তর প্রদান করিল না। তাহাদিগের ভাব দেখিয়া আমার মনে বড়ই সন্দেহ হইল। পুনরায় জিজ্ঞাসা করিলাম, “আমার কথায় তোমরা কেহই কোনরূপ উত্তর প্রদান করিতেছ না কেন?” 

কর্ম্মচারী। কি আর উত্তর দিব? যতদূর বেকুব হইতে হয়, তাহার আর কিছুই বাকি নাই। এখন যাহাতে এই বিপদ হইতে উদ্ধার হইতে পারি, তাহার কোন উপায় করুন। 

আমি। কি হইয়াছে বা কিরূপ বিপদে পতিত হইয়াছ, তাহার সমস্ত ব্যাপার প্রথমে আমাকে বল। তাহার পর বুঝিতে পারিব যে, উদ্ধারের কোনরূপ উপায় আছে কি না? 

কর্ম্মচারী। বলিব কি মহাশয়! বলিতে লজ্জা হইতেছে! আজ আমাদিগের দ্বারা যেরূপ অহম্মুখতা হইয়াছে, ইহার পূর্ব্বে সেইরূপ আর কখনও হয় নাই। যাহা হউক, সমস্ত ব্যাপার আপনার নিকট প্রকাশ না করিলে যখন কোনরূপ উপায় নাই, তখন বলিতেই হইবে। আপনার আদেশ মত এই কনষ্টেবলকে সঙ্গে লইয়া, আমি থানা হইতে বহির্গত হইলাম। চোরকে আমি নিজে ধরিয়া লইয়া যাই, কিন্তু চিনির থলিয়া কনষ্টেবলের নিকট প্রদান করি। সে উহা লইয়া আমাদিগের পশ্চাৎ পশ্চাৎ গমন করিতে থাকে। কিয়দ্দূর গমন করিলে এই চোর আমাকে কহে, ‘মহাশয়! আমি চুরি করিয়াছি। সুতরাং ইহার নিমিত্ত যদি কোনরূপ দণ্ড লইবার প্রয়োজন হয়, তাহা আমাকেই লইতে হইবে। কিন্তু আমার নিমিত্ত এই দরিদ্র কনষ্টেবলকে আপনি দণ্ড দিতেছেন কেন? আমি চোর হইয়া বাবুর মত আপনার সঙ্গে সঙ্গে গমন করিতেছি, আর এই কনষ্টেবল আমারই নিমিত্ত মুটিয়ার মত মোট বহিয়া আমাদিগের সঙ্গে সঙ্গে গমন করিতেছে। ইহা দেখিতে ভাল দেখায় না, এবং এরূপভাবে তাহার দ্বারা মোট বহান আমার কর্তব্য নহে। আমি চুরি করিয়া এই দ্রব্য আনয়ন করিয়াছি, সুতরাং এ মোট আমারই বহন করা কর্তব্য। তাই বলি, আপনি কনষ্টেবলকে আদেশ করুন, যাহাতে সে এই মোট আমাকে প্রদান করে। আমি উহা নিজ মস্তকে ধারণপূর্ব্বক আপনাদিগের সঙ্গে সঙ্গে গমন করিতেছি।’ 

“একে কনষ্টেবল তাহার অনিচ্ছা হইলেও সবিশেষ কষ্টের সহিত সেই মোট বহন করিয়া লইয়া যাইতেছিল, তাহার উপর চোরের এই কথা শ্রবণ করিয়া আমিও মনে মনে ভাবিলাম যে, বাস্তবিকই এক ব্যক্তির অপরাধের নিমিত্ত অপরকে শাস্তি দেই কেন? যে চুরি করিয়াছে, এই মোট তাহারই বহন করা কর্তব্য। এই ভাবিয়া কনষ্টেবলকে কহিলাম, ‘তুমি যে চিনির মোট বহন করিয়া লইয়া যাইতেছ, তাহা চোরকে প্রদান কর। এই চোরই উহা বহন করিয়া লইয়া যাউক।’ 

“আমার আদেশ পাইবামাত্র কনষ্টেবল তাহার মস্তকস্থিত মোট চোরের মস্তকে উঠাইয়া দিল। চোর সেই মোট অতীব যত্নের সহিত আপন মস্তকে ধারণ করিল। আমি চোরকে ধরিয়া লইয়া যাইতেছিলাম; এখন সেই কনষ্টেবল উহাকে ধরিল ও আমার অগ্রে অগ্রে গমন করিতে লাগিল। 

“এইরূপে আমরা হাবড়া অভিমুখে গমন করিতে লাগিলাম, ক্রমে সহর ছাড়িয়া পুলের উপর গিয়া উপস্থিত হইলাম। যখন আমরা পুলের প্রায় মধ্যস্থলে গিয়া উপস্থিত হইলাম, সেই সময়ে এই চোর হঠাৎ তাহার মস্তকের মোট গঙ্গার ভিতর ফেলিয়া দিল। পড়িবামাত্র উহা অগাধ জলের ভিতর প্রবেশ করিল, উহার চিহ্নমাত্রও আর দেখিতে পাইলাম না। তখন কি করা কর্তব্য—তাহার কিছুই স্থির করিতে না পারিয়া, সেইস্থানে কিয়ৎক্ষণ দণ্ডায়মান রহিলাম। চিনির মোট হঠাৎ কেন গঙ্গার মধ্যে নিক্ষেপ করিল? ক্রোধভরে একথা তখন ইহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম; এই চোর উত্তর করিল, “আমি ইচ্ছা করিয়া ফেলিয়া দেই নাই। পুলের কিনারা দিয়া যাইতে যাইতে হঠাৎ আমার মস্তক ঘুরিয়া উঠিয়াছিল, ও আপনা-আপনিই সেই মোট আমার মস্তকচ্যুত হইয়া গঙ্গাগর্ভে পড়িয়া গিয়াছে। 

“যখন দেখিলাম সেই দ্রব্য পুনরায় প্রাপ্ত হইবার আর কোনরূপ উপায় নাই, তখন অনন্যোপায় হইয়া আমি হাবড়ার মালগুদামে গমন করিলাম। দেখিলাম, সেইস্থানে চিনির বস্তাই নাই। বুঝিলাম এ পূর্ব্বে যাহা বলিয়াছিল, তাহার সমস্তই মিথ্যা। এই ত মহাশয় যেমন বেকুব হইতে হয় তাহা হইয়াছি। এখন আপনার যাহা কর্তব্য হয়, তাহা আপনি করিতে পারেন।” 

কর্মচারীর কথা শ্রবণ করিয়া আমি নিতান্ত বিস্মিত হইলাম, ও সেই চোরকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “তুমি চিনির বস্তা গঙ্গায় নিক্ষেপ করিলে কেন?” 

উত্তরে সে কহিল, “মহাশয়! আমি পুরাতন চোর; চোরা-দ্রব্যের সহিত ধৃত হইয়াছি। সেই দ্রব্যের ফরিয়াদী যদি আপনারা প্রাপ্ত হন, তাহা হইলে বহুদিনের নিমিত্ত আমাকে নিশ্চয়ই জেলে গমন করিতে হইবে। কাজেই আপনার নিকট মিথ্যা কথা বলিয়া আপনার প্রতীতি জন্মাইলাম যে, হাবড়ার মালগুদাম হইতে আমি সেই দ্রব্য চুরি করিয়া আনিয়াছি। কারণ জানি এরূপ অবস্থায় আপনি নিশ্চয়ই আমাকে হাবড়ায় লইয়া যাইতে কহিবেন। সুতরাং পুলের উপর দিয়া নিশ্চয়ই আমি গমন করিতে পাইব। সেই সময় সুযোগ মত সেই অপহৃত দ্রব্য যদি গঙ্গাবক্ষে নিক্ষেপ করিতে পারি, তাহা হইলে আপনাদিগের হস্ত হইতে এ যাত্রা নিশ্চয়ই পরিত্রাণ পাই। যেরূপ সঙ্কল্প করিয়াছিলাম, কাৰ্য্যেও তাহাই ঘটিয়াছে। মাল ও ফরিয়াদী না পাইলে আপনারা কি করিতে পারেন?” 

দেখিলাম, চোরের কথা মিথ্যা নহে, ফরিয়াদীও নাই, মালও নাই। সুতরাং তাহাকে ছাড়িয়া দিতে হইল। 

ইহাকেই চোরের বুদ্ধি কহে! 

[কাৰ্ত্তিক, ১৩০২] 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *