চোরের গাড়ি চড়া
এক দিবস সন্ধ্যার সময় মেছুয়াবাজারের এক স্থানে আমি বসিয়া আছি, এমন সময় দেখিলাম, হরিমোহন মুখোপাধ্যায় একটি সোনার আংটা সেইস্থানের একজন পোদ্দারের নিকট বিক্রয় করিতেছে। আমি তাহাকে উত্তমরূপে জানিতাম। সুতরাং ঐ আংটী বেচিতে দেখিয়া আমার সন্দেহ হইল। ভাবিলাম, সে নিশ্চয়ই এই আংটী কোথা হইতে চুরি করিয়া আনিয়াছে। সুতরাং ঐ আংটীর সহিত তাহাকে ধরিলাম, এবং অনুসন্ধান করিয়া আগত হইলাম যে, এই হরিমোহন মুখোপাধ্যায় কলিকাতার একজন জানিত জুয়াচোর। দুই একবার শ্রীমন্দিরে সে বাস করিয়াও আসিয়াছে; কিন্তু যাঁহারা তাঁহাকে না জানেন, তাঁহারা কেহই তাহার চেহারা দেখিয়া বা তাহার সহিত আলাপ পরিচয় করিয়া বলিতে পারেন না, যে, সে জুয়াচোর। তাহার বয়স এক ২৭/২৮ বৎসর; বর্ণ পরিষ্কার গৌর। মুখশ্রী মনোহর, সকল সময়েই সে উত্তম পরিচ্ছেদে সজ্জিত থাকে; তাহাকে হঠাৎ দেখিলে কোন ভদ্রবংশসম্ভূত ধনশালী ব্যক্তি বলিয়াই বোধ হয়। তাহার বাসস্থান অতি নীচস্থানে; হাড়কাটা গলির একটি হতভাগিনীর সংসর্গে ইহার মন কলুষিত হইয়াছে। কেহ কেহ এমনও বলিয়া থাকেন যে, সে ঐ হতভাগিনীর সহিত এক পাত্রে আহারাদিও করিয়া থাকে; ও নানাপ্রকার অসৎ উপায় অবলম্বন করিয়া ‘তাহার’ মনস্তুষ্টি করিয়া আসিতেছে।
অদ্য ‘তাহার হুকুম হইল যে, একটি নীল আংটী চাই। হরিমোহনকে তাহা আনিয়া দিতেই হইবে। হরিমোহন বলিল,—“আচ্ছা।” কিন্তু মনে মনে ভাবিতে লাগিল,—“হাতে একটিও পয়সা নাই। এখন কি উপায় অবলম্বন করি? কিন্তু যাহা হউক, দেখিতে হইবে, কতদূর কি করিয়া উঠিতে পারি!” এইরূপ ভাবিয়া কাপড় ছাড়িয়া সে বাটী হইতে বহির্গত হইল। হাড়কাটা গলি হইতে বহির্গত হইয়া আস্তে আস্তে বহুবাজারের চৌমাথায় যাইয়া উপস্থিত হইল।
সেইস্থানে তিন চারি মিনিট দাঁড়াইয়া আছে, এমন সময় পূৰ্ব্বদিক হইতে একখানি দ্বিতীয় শ্রেণীর কম্পাস গাড়ি আসিয়া সেই স্থানে পৌঁছিল। তাহাতে সহিস ছিল না। গাড়োয়ান, বাবুকে দেখিয়া জিজ্ঞাসা করিল।—“বাবু গাড়ি চাই! হরিমোহন বলিল,—“হাঁ, চাই”। গাড়ি দাঁড়াইল। হরিমোহন পকেট হইতে ঘড়িটি বাহির করিয়া বলিল,—“তিনটা বাজিতে এক পোয়া বাকি আছে।” এই বলিয়া গাড়িতে উঠিল। গাড়ি উত্তরমুখে চলিল। পরে হরিমোহন সেই গাড়িতে নানা স্থান ভ্রমণ করিয়া, সন্ধ্যা ৫টার সময় তালতলায় একজন পোদ্দারের দোকানে যাইয়া উপস্থিত হইল; ও তাঁহার দোকান হইতে পছন্দমত একটি সিল আংটী লইয়া তাহার দাম জিজ্ঞাসা করিল। পোদ্দারও সুযোগ বুঝিয়া ও বড়মানুষ দেখিয়া বড়মানুষী দর বলিতেও ভুলিলেন না। হরিমোহনও ১০ টাকার আংটী ১৫ টাকা দিতে স্বীকৃত হইল। এবং পোদ্দারকে বলিল, “আমার সহিত এখন টাকা নাই, আপনি একটি লোক আমার সহিত দিন, তিনি আমার বাটীও দেখিয়া আসিবেন এবং ইহার দামও লইয়া আসিবেন।” পোদ্দার একেবারে ৫ টাকা অধিক পাইতেছেন, সুতরাং সে প্রলোভন ছাড়িতে না পারিয়া তাহাতেই সম্মত হইলেন।
অতঃপর দোকানের একজন সরকারকেতাঁহার সঙ্গে দেওয়া হইল। কিন্তু পোদ্দার তাহাকে কানে কানে যেন কি বলিয়া দিল। আংটী হরিমোহনের হাতেই রহিল। সরকার হরিমোহনের সহিত তাহার সেই গাড়িতে উঠিল। গাড়ি ধর্ম্মতলার দিকে চলিল, ও ক্রমে চাঁদনী বাজারের দক্ষিণের দরজায় আসিয়া উপস্থিত হইল। হরিমোহন গাড়ি হইতে নামিয়া, কিছু কাপড় খরিদ করিবার অভিপ্রায় প্রকাশ করিয়া বাজারের ভিতর প্রবেশ করিল। সরকারও তাঁহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ গমন করিল। হরিমোহন বাজারের ভিতর একটি কাপড়ের দোকানে বসিয়া নানা প্রকার কাপড় দর করিতে ও দেখিতে লাগিল। কিন্তু একখানিও তাহার পছন্দ হইল না। এমন সময় যেন তাহার শরীর একটু খারাপ হইয়াছে ও তাহার বমি হইবার উপক্রম হইতেছে। এইরূপ ভাব প্রকাশ করিয়া পকেট হইতে একটি পয়সা বাহির করিয়া সরকারের হস্তে দিল, ও বলিল, “শীঘ্র এক পয়সার পান আন।”
সামান্য-বুদ্ধি সরকার অত কিছু বুঝিতে না পারিয়া, পান আনিতে দ্রুতপদে গমন করিল ও শীঘ্র পানসহ ফিরিয়া আসিল। কিন্তু আসিয়া আর বাবুকে দেখিতে পাইল না। বাজারের ভিতর অনুসন্ধান করিল, কিন্তু অনুসন্ধান মাত্রই হইল। আর তাহার দেখা পাইল না। তখন সে আর কি করিবে! আর কোন উপায় না দেখিয়া গাড়োয়ানকে বলিল,—“যখন সেই বাবু তোর গাড়িতে আমাদিগের দোকানে গিয়েছিলেন, তখন তুই নিশ্চয়ই তাঁহার বাড়ী জানিস। তোকে তাঁহার বাড়ী দেখাইয়া দিতে হইবে।” গাড়োয়ান কহিল,–”তুই যখন আমার গাড়ীতে চড়িয়াছিস, তখন আমার গাড়ির সমস্ত ভাড়া তোর নিকট হইতে আদায় করিব।”
এইরূপে উভয়ে ক্রমে বকাবকি করিতে করিতে গালাগালি সুরু হইল। ক্রমে হাতাহাতিও হইতে লাগিল। তাহার পরে উভয়েই সরকারী রাস্তার উপরে মারামারি করার অপরাধে পুলিশ কর্তৃক ধৃত হইয়া থানায় প্রেরিত হইল।
সেই দিবস সন্ধ্যার সময় আমিও হরিমোহনকে লইয়া সেই থানায় উপস্থিত হইলাম। পোদ্দার, তাঁহার সরকার এবং গাড়োয়ান তাহাকে সনাক্ত করিল। পরদিবস মেজিস্ট্রেট সাহেব বঞ্চনা অপরাধে কঠিন পরিশ্রমের সহিত ৬ মাসের নিমিত্ত তাহাকে জেলে পাঠাইয়া দিলেন। পোদ্দার তাঁহার আংটী প্রাপ্ত হইলেন। কিন্তু গাড়োয়ান তাহার গাড়ির ভাড়া আর পাইল না।
[কার্তিক, ১২৯৯]