চোরের উপর!! (অতি অদ্ভুত অনুসন্ধান কাহিনী!)
প্রথম পরিচ্ছেদ
১৮৮৪ সালের ২১শে বৈশাখ দিবা দশটার সময় সংবাদ পাইলাম, মাণিকতলায় সিঁদচুরি মোকদ্দমার অনুসন্ধানের ভার আমার উপর পড়িয়াছে।
আদেশানুযায়ী দিবা এগারটার সময় মাণিকতলা পুলের নিকটবর্তী, এবং খালের পূর্ব্ব পার্শ্বে বৈষ্ণব-পাড়ায় গিয়া উপস্থিত হইলাম। দেখিলাম, পুলিসের অনেক কৰ্ম্মচারী উপরি-উক্ত সিঁদচুরি মোকদ্দমার অনুসন্ধানে নিযুক্ত আছেন। আরও দেখিলাম, রমণদাস বাবাজী নামক এক ব্যক্তি সেইস্থানে বিষণ্নমনে বসিয়া আছে।
রমণদাস বাবাজী একজন প্রবীণ বৈষ্ণব। বহুকাল অতীত হইল, বাবাজী বৈষ্ণবধৰ্ম্ম অবলম্বন পূৰ্ব্বক সেইস্থানেই বাস করিতেছে। ইহার বয়ঃক্রম এখন পঞ্চান্ন বৎসরের ন্যূন হইবে না। সহরের নানাস্থানে সমস্ত দিবস ভিক্ষা করিয়া যাহা কিছু প্রাপ্ত হয়, তাহারই দ্বারা তাহার নিজের ও তাহার বৈষ্ণবীর জীবিকা-নির্ব্বাহ এবং মধ্যে মধ্যে আগন্তুক অতিথিগণের আতিথ্য-সৎকার প্রভৃতিও করিয়া থাকে।
প্রায় ছয় মাস অতীত হইল, বাবাজী বৈষ্ণবীর সহিত বৈষ্ণবের প্রধান স্থান—শ্রীবৃন্দাবনে গমন করিয়াছিল। সেই স্থানেই বৈষ্ণবীর বৃন্দাবন লাভ হয়। সুতরাং বাবাজী একাকীই সেইস্থান হইতে মাণিকতলায় প্রত্যাগমন করে। বাবাজীর বাড়ীতে কেবলমাত্র একখানি দক্ষিণদ্বারী মাটির ঘর আছে; উহাতে গোলপাতার ছাউনি। সেই গৃহের ভিতর তিনি শয়ন করেন। রন্ধনাদি কার্য্য সেই গৃহে দাওয়াতেই হইয়া থাকে। সেই গৃহের সম্মুখে প্রশস্ত প্রাঙ্গণ আছে; উহাও মৃত্তিকা-নিৰ্ম্মিত প্রাচীর দ্বারা তিনদিকে বেষ্টিত। দক্ষিণ প্রাচীরের মধ্যস্থানে বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিবার দ্বার। সেই একমাত্র দ্বারভিন্ন বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিবার আর কোনরূপ উপায় নাই। বাবাজীর বাড়ীর চতুষ্পার্শ্বের নিকটবর্ত্তী স্থানে অন্য আর কাহারও গৃহ নাই। উহার চতুর্দ্দিক্ অল্প অল্প জঙ্গলের সহিত পতিত জমী দ্বারা বেষ্টিত। উক্ত বাড়ীর পূর্ব্ব, দক্ষিণ, এবং পশ্চিমদিকে কিছু কিছু দূরে—অন্যান্য বৈষ্ণবদিগের আবাসস্থান।
বাবাজীর বাড়ীর উত্তরাংশে অন্য আর একজন বাবাজীর গৃহ ছিল, প্রায় দুই বৎসর পূর্ব্বে সে সেইস্থান পরিত্যাগ পূৰ্ব্বক কোথায় চলিয়া গিয়াছে। খাজানার নিমিত্ত জমীদার সেই গৃহ ভাঙ্গিয়া বিক্রয় করিয়া লইয়াছেন। সেইস্থান এখন সামান্য জঙ্গল-সমাকীর্ণ ভিটায় পরিণত হইয়াছে। কাহারই সেইস্থানে গমনাগমনের প্রায় প্রয়োজন হয় না।
বাবাজীর বাড়ীর উত্তরাংশে সেই জঙ্গল-সমাকীর্ণ ভিটার উপর গমন করিলাম। সেইস্থানে দণ্ডায়মান হইতেই দেখিতে পাইলাম, বাবাজীর গৃহের উত্তরাংশের প্রাচীরের প্রায় মধ্যভাগে পোতার উপর সিঁদের গহ্বর রহিয়াছে। সিঁদটি মাপিয়া দেখিলাম, ঊর্দ্ধে প্রায় দুই ফুট, প্রস্থে দেড় ফুটের কম নহে। মৃত্তিকা সকল বাহিরের দিকে পড়িয়া আছে। সিঁদের স্থানে স্থানে অস্ত্রের চিহ্ন সকল স্পষ্ট প্রতীয়মান হইতেছে। চিহ্ন সকল দেখিয়া বোধ হইল, এক-ইঞ্চি বিস্তৃত-ফলাযুক্ত কোন প্রকার অস্ত্র দ্বারা সেই সিঁদ কাটা হইয়াছে।
সিঁদের অবস্থা দেখিয়া পুনরায় বাড়ীর ভিতর গমন করিলাম। যে গৃহে সিঁদ হইয়াছে, সেই গৃহের ভিতর গমন করিয়া দেখিলাম, সেইস্থানে একটি স্ত্রীলোক বসিয়া রহিয়াছে। গৃহের ভিতর একটি বাক্স রহিয়াছে; উহা বেশ চক্চকে, কাঁঠাল কাঠের বাক্স। বাক্সটি তালাবন্ধ। উহা নিতান্ত ক্ষুদ্র নহে; দৈর্ঘ্যে আড়াই ফুট, প্রস্থে দুই ফুট, এবং ঊর্দ্ধে দেড় ফুট হইবে। বাক্সের চাবি চাহিলাম, বাবাজী কোমর হইতে চাবি বাহির করিয়া দিল। বাক্সটি খুলিলাম, দেখিলাম, উহার ভিতর বাবাজীর বসনাদি সমস্ত দ্রব্যই যেরূপভাবে রাখা ছিল, সেইরূপ অবস্থাতেই রহিয়াছে। বস্ত্র সকলের নীচে একটি বস্ত্রের থলির ভিতর নগদ ৩২৩ টাকা আছে।
উক্ত বাক্সের নিকট আর একটি বাক্সের চিহ্ন রহিয়াছে। সেই চিহ্ন দেখিয়া বোধ হইল, উহা দৈর্ঘ্যে প্রায় তিন ফুট, এবং প্রস্থে আড়াই ফুটের কম নহে। উক্ত বাক্স সেইস্থান হইতে উঠাইয়া কে লইয়া গিয়াছে। অনুসন্ধানে অবগত হইলাম যে, যে সকল দ্রব্য চুরি গিয়াছে বলিয়া নালিস হইয়াছে, তাহার সমস্তই সেই বাক্সের ভিতর ছিল।
বাবাজীর বাড়ীর প্রাঙ্গণে একটি বাক্স ছিল, উহাও উত্তমরূপে পরীক্ষা করিলাম। দেখিলাম, বাক্সের ডালাগোল অস্ত্রের দ্বারা চাড় দিয়া ভাঙ্গা; যে স্থানের ভিতর অস্ত্র প্রবেশ করান হইয়াছিল, সেইস্থানের কাষ্ঠের উপর গোল চিহ্ন পড়িয়াছে। বাক্সের ভিতর দেখিলাম, কয়েকখানি পুরাতন বস্ত্র ভিন্ন অপর আর কিছুই নাই। গৃহের ভিতর যে স্থানে বাক্সের চিহ্ন স্পষ্ট দেখা যাইতেছিল, তাহার উপর সেই বাক্স স্থাপন পূর্ব্বক দেখিলাম, উহা চিহ্নের সহিত মিলিয়া গেল। বুঝিলাম, এই বাক্সই সেইস্থানে ছিল।
কথিত বাক্স ভগ্নাবস্থায় কোথায় পাওয়া গেল, জিজ্ঞাসা করাতে অবগত হইলাম যে, বাবাজীর বাড়ীর উত্তরদিকে প্রায় অর্দ্ধ মাইল দূরে একটি বাঁশবাগানের ভিতর তাহা পাওয়া যায়। সিঁদ হওয়া প্রকাশ হইবার পরেই যখন সেইস্থানে গোলযোগ উপস্থিত হয়, সেই সময়ে পাড়ার লোক সকলেই চারিদিকে সেই চোরের অনুসন্ধান আরম্ভ করে। রমণ দাসও চারিদিক অনুসন্ধান করিতে থাকে। পরিশেষে বাবাজীই পূর্ব্বকথিত বাঁশবাগানের ভিতর সেই বাক্স ভগ্নাবস্থায় দেখিতে পায়, ও সেইস্থান হইতে উহা উঠাইয়া আপনার বাড়ীতে আনয়ন করে। বাক্সের ভিতর যে কয়েকখানি পুরাতন বস্ত্র এখনও রহিয়াছে, তাহা সেই বাঁশবাগানের ভিতর বাক্সের চতুষ্পার্শ্বে অযথা বিস্তারিত ছিল।
এই সকল ঘটনা দেখিয়া ও শ্রবণ করিয়া, পরিশেষে রমণদাস ও সেই স্ত্রীলোকটি কি কি বিষয় অবগত আছে, তাহাই জানিবার চেষ্টা করিলাম!
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
রমণদাসকে জিজ্ঞাসা করায় সে অনেক কথা ক্রমে ক্রমে বলিতে লাগিল, আমিও তাহার সমস্ত কথা আস্তে আস্তে লিখিয়া লইতে লাগিলাম। বিস্তারিতভাবে লিখিবার স্থান না থাকাতে উহার সংক্ষিপ্তভাষা নিম্নে প্রদত্ত হইল :—
“বহুদিবস হইতে আমি এইস্থানে বাস করিয়া আসিতেছি। প্রায় ছয় মাস অতীত হইল, আমি আমার বৈষ্ণবীর সহিত শ্রীবৃন্দাবনধামে গমন করিয়াছিলাম। সেইস্থানে আমার সহচরী বৃন্দাবন লাভ করিলে, আমার মন নিতান্ত অধীর হইয়া পড়ে। অনেক চেষ্টা করিয়াও কোনক্রমে আমি আমার মনের গতি রোধ করিতে সমর্থ হই নাই। পরিশেষে আমি সেইস্থান পরিত্যাগ পূর্ব্বক পুনরায় আমার বাড়ীতে প্রত্যাগমন করি। গৃহে স্ত্রীলোক না থাকিলে পুরুষগণকে যে কিরূপ কষ্ট পাইতে হয়, তাহা এতদিবস আমি বুঝিতে সমর্থ হই নাই; কিন্তু বাড়ীতে আসিয়া সেই কষ্ট উত্তমরূপে অনুভব করিতে পারিলাম। যিনি আমাকে পরিত্যাগ করিয়াছেন, তাঁহার জন্য আমার মন সতত নিতান্ত কাতর থাকিলেও সংসার-মায়ার তাড়নায়, এই বৃদ্ধবয়সেও পুনরায় আমি আবার বৈষ্ণবী করিবার সঙ্কল্প করিলাম; কিন্তু আমার মনোমত স্ত্রীলোক অদ্যাবধি প্রাপ্ত না হওয়ায় আমার মনোরথ সফল করিতে সমর্থ হই নাই।
“গত চৈত্র মাসে একটি মহোৎসব উপলক্ষে আমাকে শ্রীপাট নবদ্বীপধামে গমন করিতে হইয়াছিল। সেইস্থানে ওই স্ত্রীলোকটির সহিত আমার প্রথম সাক্ষাৎ হয়। ইহার নাম বামা। বিশেষ যত্ন করিয়া বামা আমাকে তাহার বাড়ীতে লইয়া যায়। দুই তিন দিবস আমি সেইস্থানে অবস্থান করিয়া যে কার্য্যের নিমিত্ত আমি সেইস্থানে গমন করিয়াছিলাম, সেই মহোৎসব-কাৰ্য্য সমাপন পূর্ব্বক আপনার স্থানে প্রত্যাগমন করি। আসিবার সময় সে আমার কলিকাতার ঠিকানা জানিয়া লয়।
“আমি আপনার বাড়ীতে প্রত্যাগমন করিবার আট দশ দিবস পরেই বামা আমার বাড়ীতে আগমন করে। এবার উহার সহিত অপর একটি বৃদ্ধা স্ত্রীলোক ছিল। উভয়েই আমার বাড়ীতে প্রায় এক সপ্তাহ অতিবাহিত করে। উহারা কালী দর্শন মানসে এখানে আগমন করিয়াছিল, ও একদিবস কালীঘাটে গমনও করিয়াছিল।
“বামার বাসস্থান নবদ্বীপে; এ সেইস্থানের একটি চরিত্রহীনা স্ত্রীলোক। তাহার অনেকগুলি সোণারূপার অলঙ্কার, এবং ছোট রকমের একখানি পাকা একতালা বাড়ী আছে। ইহার বয়ঃক্রম এখন চল্লিশ বৎসরের ন্যূন হইবে না। আমার বাড়ীতে সে যে কয়েক দিবস ছিল, তাহারই মধ্যে আমি ইহাকে উত্তমরূপে ধর্ম্মোপদেশ প্রদান করিয়া, আমাদিগের এই সত্য বৈষ্ণবধর্ম্ম গ্রহণ করিতে উপদেশ প্রদান করি। বামা পরিশেষে আমাদিগের ধর্ম্মের মাহাত্ম্য উত্তমরূপে অবগত হইয়া, এই ধৰ্ম্ম গ্রহণ করাই স্থির করে। আর ইহাও স্থির হয় যে, সে দশ পনর দিবসের মধ্যে নবদ্বীপ হইতে প্রত্যাগমন পূৰ্ব্বক বৈষ্ণবধৰ্ম্ম গ্রহণ করিবে, ও আমার বৈষ্ণবীরূপে পরিণত হইবে।
“এইরূপ স্থির হইলে স্ত্রীলোকদ্বয় আমার বাড়ী পরিত্যাগ করে। পরিশেষে আজ তিনদিবস মাত্র অতীত হইল, সে তাহার সমস্ত অলঙ্কারাদির সহিত আমার এখানে পুনরায় আগমন করিয়াছে। তাহারই সমস্ত অলঙ্কার আমি আমার ঐ বাক্সের মধ্যে রাখিয়া দিই। গত রাত্রিতে বামা গৃহের ভিতর শয়ন করিয়াছিল, গ্রীষ্মবোধ হওয়ায় আমি আমার দাওয়ার উপর শয়ন করিয়াছিলাম। বাড়ীর সদর দ্বার ভিতর হইতে বন্ধ ছিল। প্রাতঃকালে যখন আমার নিদ্রাভঙ্গ হইল, তখন দেখিলাম, সদর দ্বার খোলা। গৃহের দ্বার বাহির হইতে শিকলি-বদ্ধ ছিল। উহা খুলিয়া দেখিলাম, গৃহের ভিতর সিঁদ! যে বাক্সের ভিতর অলঙ্কারগুলি ছিল, সেই বাক্সটিই নাই। এই অবস্থা দেখিয়া গোলযোগ করিলাম, পাড়ার সকলে একত্র হইল, সকলেই চতুদিক্ অনুসন্ধান করিতে লাগিল, আমিও সেই সঙ্গে মিশিলাম। খুঁজিতে খুঁজিতে ঐ বাক্সটি বাঁশবাগানের ভিতর ভগ্নাবস্থায় প্রাপ্ত হইলাম। উহার চতুষ্পার্শ্বে এই বস্ত্রগুলি ছড়ান ছিল। অলঙ্কারগুলি সমস্তই লইয়া গিয়াছিল। বাক্সটি সেইস্থান হইতে উঠাইয়া আনিয়া পরিশেষে থানায় গিয়া সংবাদ প্রদান করিলাম।”
রমণের কথাগুলি শেষ হইয়া গেলে, বামাকে ডাকিলাম। তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলে রমণদাস যেরূপ বলিয়াছিল, সেও সেই প্রকার কহিল; কিন্তু তাহার দুই একটি কথা রমণের কথার সহিত বিলক্ষণরূপ অমিল হইল, ও দুই একটি কথাতে রমণদাসের উপর সন্দেহও জন্মিতে লাগিল। বামা বলিল, “প্রথমবার আমি যখন এইস্থানে আগমন করিয়াছিলাম, সেই সময় আমার একখানি অলঙ্কারও আমার সঙ্গে ছিল না, সমস্তই আমার বাড়ীর লোহার সিন্দুকে বন্ধ করিয়া আসিয়া ছিলাম। অলঙ্কারগুলি আমি কেন সঙ্গে করিয়া আনি নাই, রমণদাস তাহা আমাকে বার বার জিজ্ঞাসা করিয়াছিল, ও আমি যখন বাড়ীতে ফিরিয়া যাই, তখন সে আমাকে সবিশেষরূপে অনুরোধ করিয়া বলিয়া দিয়াছিল, অলঙ্কার সেই স্থানে রাখিয়া আসিও না, এখানে আসিবার সময়ে উহা সঙ্গে লইয়া আসিও।’ রমণদাসের ইচ্ছানুসারেই এবার আমি আমার সমস্ত অলঙ্কার, এবং অপর লোকের কতকগুলি অলঙ্কার যাহা আমার নিকট বন্ধক ছিল, তাহাও সঙ্গে করিয়া এইস্থানে আনয়ন করিয়াছিলাম। এইস্থানে আগমন করিয়া প্রথমে আমি আমার আনীত অলঙ্কারগুলি রমণের হস্তে প্রদান না করিয়া, আমারই নিকট রাখিয়া দিয়াছিলাম। রমণ তাহাতে প্রথমে একটু অসন্তুষ্ট হয়; কিন্তু পরিশেষে আমাকে অনেক বুঝাইয়া এবং একটু ভয়মাত্রাও দেখাইয়া আমার মনের গতি পরিবর্তিত করে পরে আমি তাহারই মতে মত দিয়া, আমার যথাসর্বস্ব তাহারই হস্তে সমর্পণ করি। আমার সম্মুখে রমণ সেইগুলি ঐ সিন্দুকের ভিতর বন্ধ করিয়া রাখে। সিন্দুক দুইটি তালা দ্বারা বন্ধ করিয়া তাহার একটির চাবি আমার হস্তে প্রদান করে, অপরটির চাবি নিজের নিকটই রাখিয়া দেয়। যে দিবস রমণ আমার নিকট হইতে অলঙ্কারগুলি গ্রহণ করে, তাহার পরদিবস রাত্রিতেই সিঁদ হইয়া যে সিন্দুকে আমার দ্রব্যাদি ছিল, সেই সিন্দুকই অপহৃত হয়। কিন্তু যে সিন্দুকে রমণদাসের দ্রব্যাদি এবং টাকাকড়ি ছিল, তাহা চোরে স্পর্শও করে নাই।”
তৃতীয় পরিচ্ছেদ
উভয়ের কথাগুলি শ্রবণ করিয়া আমার মনে এই কয়েকটি প্রশ্ন আসিয়া উদয় হইল।—
১। গৃহের পশ্চাদ্ভাগে যে সিঁদকাটা হইয়াছে, তাহার ভিতর দিয়া মানুষ প্রবেশ করিলে, গৃহের ভিতর দিকের সিঁদ—মুখের মাটীর উপর মনুষ্য প্রবেশের কোন প্রকার চিহ্ন দেখা যাইতেছে না কেন?
২। এত বড় সিন্দুক গৃহ হইতে বাহির করিবার সময়ে বামা বা রমণ তাহার বিন্দুবিসর্গও জানিতে পারিল না কেন?
৩। বামা যাহাতে সহজে গৃহের বাহির হইতে না পারে, সেই নিমিত্ত গৃহ বাহির হইতে শিকলি-বদ্ধ হইল। কিন্তু রমণদাস যাহাতে চোরের প্রতিবন্ধক হইতে না পারে, সে বিষয়ের কোন প্রকার বন্দোবস্ত হইল না কেন?
৪। বৃদ্ধ রমণদাসের রাত্রিতে প্রায়ই নিদ্রা হয় না সমস্ত রাত্রিই প্রায় হুঁকার সহিত কথোপকথন করিয়া থাকে, কিন্তু সে দিন তাহার এত নিদ্রা আসিল কিসে?
৫। যে সিন্দুকের ভিতর রমণদাস বহুদিবসাবধি আপনার দ্রব্যাদি ও টাকাকড়ি রাখিয়া আসিতেছে, এবং যে বিষয় অনেক লোকই অবগত আছে, সেই বাক্স চুরি না হইয়া যাহাতে পূর্ব্বে কিছুই থাকিত না, সেই বাক্সই বা চুরি হইল কেন?
৬। বামার সমস্ত দ্রব্যই চুরি হইয়া গেল, আর রমণের কপর্দকও অপহৃত হইল না কেন?
৭। বামা যখন পূর্ব্বে এখানে আগমন করিয়াছিল, তখন তাহার অলঙ্কারপত্র এখানে আনিয়াছে কি না, সে বিষয়ে অনুসন্ধান করা রমণের কি প্রয়োজন ছিল?
৮। দ্বিতীয়বার এখানে আগমনের সময় তাহার সমস্ত অলঙ্কারাদি এখানে সঙ্গে করিয়া আনিবার নিমিত্ত, বামাকে বারম্বার অনুরোধ করিবারই বা রমণের কি প্রয়োজন ছিল?
৯। বামার নিকট হইতে অলঙ্কারগুলি লইয়া বামার অনিচ্ছা থাকিলেও, রমণদাস তাহার নিজের বাক্সের ভিতর বন্ধ করিয়া রাখিয়াছিল কেন?
১০। ভাঙ্গা বাক্স অপর কাহারও দৃষ্টিতে না পড়িয়া রমণদাসের দৃষ্টিতেই বা পড়িল কেন?
এইরূপ কয়েকটি কথা আমার মনে উদয় হইল। আমি কাহাকেও কিছু না বলিয়া যেস্থানে বসিয়াছিলাম, সেইস্থান হইতে গাত্রোত্থান করিলাম, ও সেই বাড়ীর ভিতরস্থিত স্থান সকল একটু অনুসন্ধান করিয়া দেখিতে লাগিলাম। প্রথমে কোনস্থানে সন্দেহসূচক কোন দ্রব্যই প্রাপ্ত হইলাম না। প্রাচীরের নিকট কতকগুলি কাষ্ঠ ছিল, সেইস্থানে গমন করিয়া দেখিলাম, সেই কাষ্ঠ-রাশির ভিতর একখানি সাবল রহিয়াছে। উহার এক প্রান্ত প্রায় এক ইঞ্চি প্রশস্ত, ও উহাতে নূতন মাটী লাগিয়া আছে; বোধ হয়, দুই এক দিনের মধ্যে উহা দ্বারা মৃত্তিকা খনন করা হইয়াছিল।
সিঁদের স্থানে স্থানে যে সকল অস্ত্রের চিহ্ন ছিল, তাহার সহিত ঐ সাবলের বিস্তৃত প্রান্ত মিলাইয়া দেখিলাম। বোধ হইল, উক্ত সাবল বা ঠিক্ সেই প্রকারের অপর কোন অস্ত্র দ্বারা সেই সিঁদ কাটা হইয়াছে।
উক্ত সাবলের কথা রমণদাসকে জিজ্ঞাসা করায় সে কহিল, এ সাবল তাহার। কিন্তু উহাদ্বারা সম্প্রতি যে কোন্ স্থানের মৃত্তিকা খনন করা হইয়াছে, এবং কোন্ ব্যক্তিই বা উহা ব্যবহার করিয়াছে, তাহার কোন প্রকার সন্তোষজনক উত্তর প্রদান করিতে সমর্থ হইল না।
এই সকল সামান্য সামান্য কারণে রমণদাসের উপরে নানাপ্রকার সন্দেহ হইতে লাগিল। কেবলমাত্র আমারই মনে যে সন্দেহ হইল, তাহা নহে; কৰ্ম্মচারীমাত্রই সাবল পাইবার পূর্ব্ব হইতেই উহার উপর সন্দেহ করিতেছিলেন। এখন সেই প্রকার সাবল পাইয়া তাঁহাদের সেই সন্দেহ আরও দৃঢ়ীভূত হইল। অনুসন্ধানের নিমিত্ত যাহা কিছুর প্রয়োজন দেখিলাম, এখন সমস্তই রমণদাসের উপর পতিত হইল। বাবাজী কিন্তু বার বার বলিতে লাগিল, “এ বিষয়ে আমি নির্দোষ, এ চুরি আমা দ্বারা হয় নাই, বা এ সম্বন্ধে বিন্দুবিসর্গও আমি অবগত নহি।” কিন্তু রমণদাসের সে কথা কে শুনে? সকলেই এখন তাহাকে লইয়া ব্যস্ত হইলেন।
যখন দেখিলাম, সকলেই রমণদাস বাবাজীর উপর সন্দেহ করিতেছেন, যখন রমণদাসকে লইয়াই অনুসন্ধান আরম্ভ হইয়াছে, তখন রমণদাসের চরিত্র সম্বন্ধে আরও একটু চিন্তা করিবার প্রয়োজন হইল। পূৰ্ব্বকথিত সন্দেহসূচক কারণ ব্যতীত তাহার উপর আরও কোন প্রকার সন্দেহ হইতে পারে কি না? এই বিষয় যখন আমি একটু বিশেষ মনোযোগের সহিত চিন্তা করিতে লাগিলাম, তখন তাহার সপক্ষেও দুই একটি কথা আমার মনে উদয় হইতে লাগিল। ভাবিলাম, এই কাৰ্য্য যদি রমণদাসের দ্বারাই সম্পন্ন হইয়া থাকে, তাহা হইলে অন্য কোন ব্যক্তির সাহায্য ব্যতীত এই কার্য্য নির্ব্বাহ করা রমণদাসের পক্ষে অসম্ভব। বৃদ্ধ বাবাজী সেই বাক্স একাকী বহন করিয়া বাঁশবাগানের ভিতর লইয়া যাইতে কখনই সমর্থ নহে। অথচ অন্য কাহারও সাহায্য গ্রহণ করা রমণদাসের পক্ষে কতদূর সম্ভব, তাহাও একবার আমাদিগের দেখা উচিত। বৈষ্ণবধর্ম্ম গ্রহণপূর্ব্বক রমণেরই বৈষ্ণবী হইবার সঙ্কল্প করিয়া, বামা তাহার যথাসর্ব্বস্ব লইয়া রমণদাসেরই আশ্রয়ে উপনীত হইয়াছে। দুই এক দিবসের মধ্যেই বামা তাহার পত্নীত্ব স্বীকার করিয়া তাহারই বশীভূতা হইয়া, উভয়ে একত্র জীবনযাত্রা নির্ব্বাহ করিবে। এরূপ অবস্থায় রমণদাস কি এইরূপ বিশ্বাস—ঘাতকের কার্য্য করিতে সমর্থ হইবে? আবশ্যক হইলে বিনাক্লেশে যখন সে উহার সমস্ত দ্রব্য পাইলেও পাইতে পারিবে, তখন অন্য লোকের সাহায্য লইয়া অন্য লোককে, অযথা অংশ প্রদান করিয়া এরূপ ঘৃণিতকার্য্যে হস্ত প্রদান করাও রমণদাসের পক্ষে কতদূর সম্ভব, তাহাও একবার বিবেচনা করা কর্তব্য। এই জগতে দেখিতেছি, রমণদাসের আপন বলিতে আর কেহই নাই। যখন একজন আসিয়া তাহার আপন হইতে চলিল, তখন কি রমণদাস তাহারই সর্ব্বনাশ—সাধন করিবে? আর উহার সর্ব্বনাশ করিয়া কাহার যে ইষ্টসিদ্ধি করিবে, তাহাও ভাবিয়া কিছুই শেষ করিতে পারিতেছি না। রমণদাসের সম্বন্ধে যেমন তাহার বিপক্ষে দেখিতে লাগিলাম, সেইরূপ তাহার সপক্ষেও দুই চারিটি কথা মনে আসিয়া উদয় হইতে লাগিল। এইরূপে নানাপ্রকার চিন্তা করিতে করিতে এখন কোন পথ অবলম্বন করা কৰ্ত্তব্য, তাহাই মনে মনে ভাবিয়া স্থির করিতে লাগিলাম। পরিশেষে বামার নিকট আরও কিছু অবগত হওয়া আবশ্যক বিবেচনা করিয়া, সেইস্থান হইতে বামাকে নির্জ্জনে লইয়া গেলাম।
চতুর্থ পরিচ্ছেদ
আমি। বামা! আমি তোমাকে আরও দুই একটি কথা জিজ্ঞাসা করিতে চাহি, তুমি বেশ মনে করিয়া তাহার উত্তর দিতে সমর্থ হইবে কি?
বামা। হাঁ মহাশয়! আমি যতদূর অবগত আছি, তাহার প্রকৃত উত্তর দিতে কেন সমর্থ হইব না?
আমি। তুমি প্রথমে যখন এখানে আগমন করিয়াছিলে, সেই সময় তোমার সহিত অপর আর একটি স্ত্রীলোক এখানে আগমন করিয়াছিল; একথা পূর্ব্বে তুমি আমাকে বলিয়াছ না?
বামা। হাঁ মহাশয়! বলিয়াছি, আমার সহিত একটি স্ত্রীলোক এখানে আগমন করিয়াছিল।
আমি। সে স্ত্রীলোকটি কে? কোথা হইতে তোমার সহিত আগমন করিয়াছিল, কেনই বা আসিয়াছিল, এবং কোথায়ই বা গমন করিল?
বামা। সেই স্ত্রীলোকটির নাম আমি জানি না, তাহাকে পরাণের মা বলিয়াই জানি। সে তাহার ভগিনীর নিকট নবদ্বীপেই থাকে। তাহার পুত্র পরাণ এবং পরাণের মামা হরি, থাকে –হাবড়ায়। কালীদর্শন করিবার অভিপ্রায়ে সে আমার সহিত আগমন করে। আমার সহিত সে এই স্থানেই ছিল। আমি যখন আমার বাড়ীতে গমন করি, সেই সময় সে হাবড়ায় তাহার পুত্রের নিকট গমন করে। কেন মহাশয়! তাহার কথা জিজ্ঞাসা করিতেছেন? সে পরশ্ব তারিখে আমার সহিত সাক্ষাৎ করিতে এইস্থানে আগমন করিয়াছিল।
আমি। পরশ্ব তারিখে কোন সময়ে সে এখানে আসিয়াছিল? মনে আছে কি?
বামা। বেলা বারটা কি একটার সময় আসিয়াছিল
আমি। রমণদাস একথা ত আমাদিগকে এখন পর্যন্ত বলে নাই।
বামা। সেই স্ত্রীলোকটি যে এখানে আগমন করিয়াছিল, সে কথা বাবাজী অবগত নহে। বাবাজী সেই সময় ভিক্ষার্থ গমন করিয়াছিল।
আমি। পরাণের মা’র সহিত তোমার কি কি কথা হইয়াছিল, মনে হয় কি?
বামা। হাঁ মনে হয় বই কি? অনেক কথা হইয়াছিল। আমাদিগের সংসারের কথা, আমার বৈষ্ণবী হইবার কথা, বাবাজী আমাকে কিরূপ ভালবাসেন, তাহার কথা, প্রভৃতি অনেক কথা হইয়াছিল।
আমি। তোমার বাড়ী হইতে আসিবার সময় তুমি কোন অলঙ্কারাদি আনিয়াছ কি না, সে বিষয়ে সে কোন কথা তোমাকে জিজ্ঞাসা করিয়াছিল?
বামা। হাঁ মহাশয়! তাহাও জিজ্ঞাসা করিয়াছিল, আমি আমার সমস্ত অলঙ্কার সঙ্গে করিয়া আনিয়াছি কি না, ঐ অলঙ্কারাদি কোথায়, এবং কি প্রকারে রাখিয়াছি, তাহা আমাকে বিশেষ করিয়া সে জিজ্ঞাসা করিয়াছিল। আমিও তাহাকে সমস্ত বলিয়াছিলাম, আর বাবাজী যে এই সিন্দুকের ভিতর সেই সকল দ্রব্যাদি রাখিয়া দিয়াছে, তাহাও তাহাকে বলিয়াছিলাম। সে আমার নিকট সমস্ত কথা শ্রবণ করিয়াছিল, এবং সিন্দুকটি বিশেষ করিয়া দেখিয়া পরিশেষে ইহাও বলিয়াছিল, “দেখিস্ ভাই, সাবধানে থাকিস্! কলিকাতা বড় মন্দ স্থান। এখানে চোর-জুয়াচোরের বড় ভয়। দেখিস, যেন তোর দ্রব্যাদি চুরি না হয়। সর্ব্বদা সাবধানে থাকিস্, এবং বাবাজীই হউন বা আর কেহই হউন, এখানে সহসা কাহাকেও বিশ্বাস করিস্ না।”
আমি। পরাণের মা হাবড়ার কোন স্থানে থাকে, তাহা তুমি বলিতে পার?
বামা। না, তাহা আমি জানি না, কিন্তু বাবাজী তাহা অবগত আছে। পূর্ব্বে পরাণের মা যখন এইস্থানে ছিল, সেই সময়ে সে একদিবস বাবাজীকে সঙ্গে লইয়া, তাহার পুত্রের সহিত সাক্ষাৎ করিতে গমন করিয়াছিল।
বামার নিকট হইতে এই সকল বিষয় অবগত হওয়ার পর, আমার মনে যেন কেমন এক প্রকার সন্দেহ আসিয়া উপস্থিত হইল। পরাণের মা’র এ সকল বিষয় বিশেষ করিয়া জানিয়া লওয়ার কারণ আমি কিছুই ভাবিয়া স্থির করিতে পারিলাম না। একবার ভাবিলাম, এ সকল বিষয় জিজ্ঞাসা করা কোন কোন স্ত্রীলোকের স্বভাব-সিদ্ধ গুণ; কিন্তু তাহা বলিয়াই একবারে নিশ্চিন্ত থাকা যুক্তি-যুক্ত বিবেচনা না করিয়া পরাণের মা’ই বা কে, কেনই বা পরশ্ব তারিখে সে এখানে আগমন করিয়াছিল, তাহা জানিবার জন্য আমার মনে ইচ্ছা হইল। আমার মনের ভাব কাহারও নিকটে প্রকাশ না করিয়া, কথায় কথায় রমণদাসের নিকট পরাণের মা’র ঠিকানা জানিয়া লইলাম, ও কাহাকেও কিছু না বলিয়া মাণিকতলা হইতে সোজা পথে আহীরীটোলার ঘাটে চলিয়া গেলাম। তথায় অৰ্দ্ধ পয়সা ব্যয় করিয়া ষ্টীমারে উঠিলাম, দেখিতে দেখিতে উহা ভাগীরথী পার হইয়া অপর পারে গমন করিল। ষ্টীমার হইতে অবতরণ করিয়া কিনারায় উঠিলাম।
কিনারা হইতে ক্রমে সালিখার বাজারের মধ্যে প্রবেশ করিলাম। রমণদাস আমাকে যে ঠিকানা বলিয়া দিয়াছিল, তাহাতে পরাণ যে বাড়ীতে থাকে, তাহার সন্ধান করিতে কোন কষ্টই হইল না, অনায়াসেই তাহার বাড়ী পাইলাম। ইহা একখানি খোলার ঘর; ঘরের অধিকারী জীবন সাঁতরা। ছবি তাহার বাড়ীর ভাড়াটিয়া। পরাণ হরির গৃহেই থাকিত, পরাণের মা কয়েক দিবস সেই গৃহেই ছিল।
জীবনকেজিজ্ঞাসা করিয়া অবগত হইলাম, যে সেইদিন প্রাতঃকালে বা পূর্ব্ব রাত্রিতে তাহারা সকলেই সেই বাড়ী পরিত্যাগ করিয়া কোথায় চলিয়া গিয়াছে। গমনকালে কাহাকেও কিছু বলিয়া যায় নাই, সুতরাং জীবন বা তাহার বাড়ীর অপর কেহই বলিতে পারিল না যে, তাহারা কোথায় গমন করিয়াছে।
হঠাৎ এই বাড়ী পরিত্যাগ পূর্ব্বক গমন করিয়াছে শুনিয়া, উহাদিগের উপর আমার মনে আরও সন্দেহ আসিয়া উপস্থিত হইল। হরি বা পরাণ কোন্ দেশীয় লোক, তাহাদিগের বাসস্থানই বা কোথায়, একথা জীবন বা অপর আর কেহই বলিতে সমর্থ হইল না।
হরি যে গৃহে শয়ন করিত, পরিশেষে সেই গৃহে একটু অনুসন্ধান করিয়া দেখিলাম। অলঙ্কারাদি বা অন্য কোন দ্রব্যাদি প্রাপ্ত হইলাম না; কেবলমাত্র দেখিলাম, সেই গৃহের ভিতর বেড়ার গায়ে এক টুকরা কাগজ রহিয়াছে। ঐ কাগজের নিকট গমন করিয়া উহা হস্তে উঠাইয়া লইলাম। উত্তমরূপে পরীক্ষা পূর্ব্বক তখন দেখিলাম, উহা একখানি পুরাতন পত্র। উক্ত পত্র ডাকযোগে আসিয়াছে, উহাতে ডাকের মোহর এখন পর্য্যন্তও বিদ্যমান আছে। পত্রখানি খুলিলাম। উহা বাঙ্গালায় লেখা। পাঠ করিয়া অবগত হইলাম, সেখানি দাসপুর হইতে হরির ভাই সনাতন, হরিকে লিখিতেছে। উক্ত পত্র প্রাপ্ত হইয়া আমার সবিশেষ যে কোন উপকার হইল, তাহা নহে, কেবল হরি কোন্ দেশীয় লোক এবং তাহার বাসস্থান বা কোথায়, তাহাই জানিতে পারিলাম মাত্র। অতঃপর সেই পত্রখানি সঙ্গে লইয়া সালিখা হইতে পুনরায় মাণিকতলায় সেই রমণদাস বাবাজীর বাড়ীতে আসিয়া উপনীত হইলাম। দিবাকরও ক্রমে অস্তগত হইলেন।
পঞ্চম পরিচ্ছেদ
পরাণ, পরাণের মা এবং হরি যে কোথায় গমন করিল অনুসন্ধানে তাহার কোন সংবাদই প্রাপ্ত হইলাম না। পরিশেষে নবদ্বীপে পরাণের ভগিণীর বাড়ীতে গমন করিয়া উহাদিগের অনুসন্ধান করাই স্থির করিলাম। পরদিবস প্রত্যূষে ষ্টীমারে উঠিয়া কালনায় গমন করিলাম। বৈশাখ মাসে ভাগীরথীর জল কম হওয়ায়, স্থানে স্থানে বালির চড়া পড়িয়াছে। কালনা হইতে নবদ্বীপাভিমুখে ষ্টীমার চলিবার আর সুবিধা নাই, কাজেই সেইস্থান হইতে একখানি নৌকা ভাড়া করিয়া নবদ্বীপ-অভিমুখে গমন করিলাম। এই নবদ্বীপ হইতেই নদীয়া জেলার নামকরণ। নদীয় জেলার মধ্যে এই একমাত্র গ্রামই কেবল ভাগীরথীর অপর পারে স্থাপিত। ইহা বৈষ্ণবদিগের একটি প্রধান তীর্থস্থান। বৎসর বৎসর নানাস্থান হইতে অনেক বৈষ্ণব এইস্থানে আগমন করিয়া আপন আপন জন্ম সার্থক বিবেচনা করেন। এই শ্রীপাট নবদ্বীপেই পরাণের পাপীয়সী ভগিনী তারার বাসস্থান। তারাও একটি চরিত্রহীনা স্ত্রীলোক। বৈষ্ণব পাড়ার ভিতর ইহার নিজের একখানি কুটীর আছে।
সন্ধানে তারার বাড়ী পাইলাম, কিন্তু তাহার মাতা বা ভ্রাতা, অথবা হরির কোন প্রকার সন্ধান প্রাপ্ত হইলাম না। অন্য লোকের নিকট হইতেও অবগত হইলাম, বাস্তবিকই উহারা এখানে আগমন করে নাই। তখন অনন্যোপায় হইয়া, পুনরায় কলিকাতায় প্রত্যাগমন করিলাম। এবার দাসপুরে গমন করাই স্থির করিলাম।
দাসপুর মেদিনীপুর জেলার প্রান্তবর্তী, অথচ বালেশ্বর জেলার মধ্যস্থিত একটি পল্লীগ্রাম। সেই প্রদেশে আমি পূর্ব্বে কখনও গমন করি নাই। আমাদিগের মধ্যে একজন উৎকলবাসী কর্মচারী ছিলেন। তাঁহার নিকট হইতে অবগত হইলাম, ষ্টীমারযোগে উড়িষ্যার খাল-পথে কাঁথি পর্যন্ত গমন করিলে, সেইস্থান হইতে দাসপুরে যাইতে সবিশেষ কষ্ট হইবে না। উড়িয়ার কথায় বিশ্বাস করিয়া, সেই পথ অবলম্বন করিলাম। কলিকাতা হইতে গেঁয়োখালি পর্যন্ত ষ্টীমারে গমন করিতে কোনরূপ কষ্টই হইল না। সেইস্থানে সঙ্কীর্ণ খালের ভিতর একখানি অপ্রশস্ত ও নিতান্ত ক্ষুদ্র ষ্টীমার ছিল, তাহাতেই উঠিতে হইল। যাত্রীর আতিশয্য-হেতু কষ্টে বসিবার মাত্র স্থান পাইলাম। সময়-মত ষ্টীমার নিতান্ত আস্তে আস্তে চলিতে লাগিল। তিনদিবস সেই একস্থানে বসিয়া ও দণ্ডায়মান হইয়া যে সুখে কাঁথিতে গিয়া উপনীত হইলাম, তাহা পাঠকগণ বুঝিয়া লউন। তিনদিবস পরে সেইস্থানে আহারাদি করিতে ক্রমে সন্ধ্যা হইয়া গেল। জিজ্ঞাসা করিয়া জানিতে পারিলাম, আমার গন্তব্যস্থান সেইস্থান হইতে দেড় ক্রোশমাত্র দূরে। একবার ভাবিলাম, সন্ধ্যার পরেই এই দেড় ক্রোশ পথ গমন করিয়া সেইস্থানে উপস্থিত হই, কিন্তু কে যেন তখনই আমার মনের গতি রোধ করিয়া বলিয়া দিল, অপরিচিত স্থানে রাত্রিকালে গমন করিও না।
সেই রাত্রি সেইস্থানেই অতিবাহিত করিলাম। রাত্রি দশটার পর গগনে হঠাৎ মেঘের সমাগম হইয়া প্রায় দুই ঘণ্টাকাল মুষলধারায় বৃষ্টি পড়িতে লাগিল। নদী-নালা প্রভৃতি ভাসিয়া গেল। প্রশস্ত ময়দান সকল জলে পরিপূর্ণ হইয়া সমুদ্রব শোভা ধারণ করিল।
পরদিবস প্রাতঃকালে পাঁচটার সময় গাত্রোত্থান করিয়া আমার গন্তব্য স্থানাভিমুখে বহির্গত হইলাম। যে স্থান দিয়া আমাদিগকে গমন করিতে হইবে, সেই স্থান দিয়া গাড়ী ঘোড়া প্রভৃতি চলিবার উপায় নাই, সবিশেষ অনুসন্ধান পাওয়াও যায় না। দেড় ক্রোশমাত্র পথ অতিক্রম করিতে করিতে কোন প্রকার বন্দোবস্তের প্রয়োজনও দেখিলাম না। জুতা খুলিয়া হস্তে লইলাম, পরিধেয় বস্তু উঠাইয়া পরিলাম। আমার সহিত যে একটি ছোট পোর্টমেন্ট ছিল, তাহা আমার সমভিব্যাহারী একমাত্র কনষ্টেবল জগন্নাথ সিংহ গ্রহণ করিল।
আলি-রাস্তার কাদা, ময়দানের জল, ভাঙ্গিতে ভাঙ্গিতে উভয়েই গমন করিতে লাগিলাম। এক হাঁটু জল হইতে একগলা জল পর্যন্তও অনেক স্থানে অতিক্রম করিতে হইল। প্রাতঃকাল পাঁচটা হইতে বেলা নয়টা পৰ্য্যন্ত চলিলাম। চারি ঘণ্টা কাল অনবরত গমন করিয়াও সেই দেড় ক্রোশ পথ অতিবাহিত করিতে পারিলাম না। সেইস্থানে জিজ্ঞাসা করিয়া অবগত হইলাম, এখনও দেড় ক্রোশ পথ অবশিষ্ট। পুনরায় চলিলাম। ঘড়ী খুলিয়া দেখিলাম, দিবা দুইটা, তখনও পথের শেষ নাই। পুনরায় গমন করিতে লাগিলাম, বেলা চারিটা বাজিয়া গেল; তথাপি সেই দেড় ক্রোশ পথ অতিবাহিত করিতে সমর্থ হইলাম না। ক্ষুধায় শরীর কাতর, পিপাসায় ছাতি ফাটিয়া যাইতেছে; কিন্তু কি করি, কোনস্থানে আহারীয় দ্রব্য পাইবার উপায় নাই। কাজেই সেই ক্ষুধাতৃষ্ণা সহ্য করিয়া চলিতে হইল।
এইরূপে ক্রমে রাত্রি দশটা পৰ্য্যন্ত চলিয়া, পরিশেষে একটি থানায় গিয়া উপনীত হইলাম। এ থানার নাম করিতে চাহি না। অনেক দিবস অতীত হইল, আমি সেইস্থানে গমন করিয়াছিলাম, এবং তাহাদিগের নিকট যে প্রকার ব্যবহার প্রাপ্ত হইয়াছিলাম, তাহা এখনও অন্তর হইতে অন্তর্হিত হয় নাই বলিয়া, দুই একটি কথা বলিতে হইল। থানায় গিয়া উপস্থিত হইয়া শুনিলাম, দারোগা মহাশয় থানায় নাই, কোন অনুসন্ধানোপলক্ষে স্থানান্তরে গমন করিয়াছেন। জমাদার সাহেব এখন থানার মালিক। ইনি একজন উৎকলবাসী কায়স্থ। থানায় গিয়া তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করিলাম। আমরা কে, কোনস্থান হইতে আগমন করিতেছি, কোথায় গমন করিব, তাহার সমস্তই তাঁহাকে কহিলাম। বিনা-আহারে সমস্ত দিবস আমরা যেরূপ কষ্ট পাইয়া দেড় ক্রোশমাত্র পথ অতিক্রম করিতে সমর্থ হই নাই, তাহাও তাঁহাকে কহিলাম। আমাদিগের সমস্ত কথা তিনি শ্রবণ করিয়া কহিলেন, “এখানে আপনাদিগের থাকিবার স্থান হইবে না, এবং আহারোপযোগী কোন দ্রব্যই এখানে পাওয়া যায় না।” জমাদার সাহেবের কথা শ্রবণ করিয়া আমার সমস্ত শরীর জ্বলিয়া গেল। উত্তরে তাঁহাকে কহিলাম, “মহাশয়, আমি সরকারী কর্মচারী হইয়া, সরকারী কার্য্যোপলক্ষে সরকারী স্থানে আসিয়া উপস্থিত হইয়াছি। এইস্থানেই আমি রাত্রি অতিবাহিত করিব। আপনার কথা শ্রবণ করিয়া আমি অন্য কোনস্থানে গমন করিব না। তবে আহারাদি সম্বন্ধে যদি কিছু সংগ্রহ করিতে পারি, ভালই; না হয়, উপবাসেই থাকিব।” এই কথায় জমাদার সাহেব অনেক কথা বলিলেন, আমরা কিন্তু কিছুতেই কাণ না দিয়া, নিতান্ত নির্লজ্জের ন্যায় সেইস্থানে দাঁড়াইলাম। দেখিলাম, নিকটে একখানি কম্বল রহিয়াছে, উহা লইয়া একস্থানে বিছাইয়া তদুপরি উপবেশন করিলাম। নিকটে কোন দোকান আছে কি না, দেখিবার নিমিত্ত জগন্নাথকে পাঠাইয়া দিলাম। নিকটে একখানি মুদির দোকান ছিল, সেইস্থানে হাঁড়ি, চাউল এবং কিছু তরকারিও পাওয়া গেল, কেবল কাষ্ঠ সেইস্থানে পাওয়া গেল না। সেই সকল দ্রব্যাদি আনিয়া উপস্থিত করিয়া পুনরায় জগন্নাথ সেই রাত্রিতে, সেই অপরিচিত স্থানে কাষ্ঠ সংগ্রহের জন্য বাহির হইল; কিন্তু কোন প্রকারেই কোনস্থান হইতে কাষ্ঠের সংস্থান করিতে সমর্থ হইল না। এমন কি পরিশেষে একবারের রন্ধনোপযোগী কাষ্ঠের নিমিত্ত আট আনা পর্যন্তও দিতে সম্মত হইলাম, কিন্তু তাহাতেও কাষ্ঠ প্রাপ্ত হইলাম না। থানায় একজন হিন্দুস্থানী কনষ্টেবল ছিল। আমাদিগের এই অবস্থা দেখিয়া তাহার মনে একটু কষ্ট হইল। তাহার কিছু কাষ্ঠ সংগ্রহ ছিল, সে উহা আমাদিগকে প্রদান করিতে সম্মত হইল। জমাদার সাহেব কিন্তু এই বিষয় জানিতে পারিয়া তাহাকে নিষেধ করিলেন, সুতরাং সে বা অপর কেহ ইচ্ছা থাকিলেও আমাদিগের সাহায্য করিতে সমর্থ্য হইল না। তখন আমরা অনন্যোপায় হইয়া আনীত চাউলাদি জমাদার সাহেবকে উপঢৌকন দিয়া, অনায়াসেই সেই কম্বলোপরি শয়ন করিলাম!
ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ
পূর্ব্বোক্ত থানা হইতে প্রায় অৰ্দ্ধ মাইল ব্যবধানে হুগলী জেলার একজন সম্ভ্রান্ত জমীদারের কাছারি আছে। এতৎপ্রদেশীয় একজন প্রবীণ ব্রাহ্মণ সেইস্থানের কর্ম্মকর্তা। জানি না, কোন উপায়ে সেই কর্ম্মচারী মহাশয় আমাদিগের আগমনবার্তা জানিতে পারিয়াছিলেন। রাত্রি বারটার সময় দেখিলাম, সেই প্রবীণ কর্ম্মচারী মহাশয় স্বয়ং একটি লণ্ঠন হস্তে থানায় আসিয়া উপস্থিত হইলেন। তাঁহার মিষ্টকথায়, সেই কষ্টের সময়ও আমার মনে সুখের সঞ্চার হইল। তাঁহার ব্যবহারে অতিশয় পরিতুষ্ট হইলাম। দেখিলাম, জমাদার সাহেবের ব্যবহারে তাঁহার হৃদয়ে বাস্তবিকই কষ্টের উদয় হইয়াছে। তিনি উঁহাকে ডাকাইয়া যথোচিত তিরস্কার করিলেন, এবং পরিশেষে আমাদিগকে সমভিব্যাহারে লইয়া তাঁহার কাছারিতে গমন করিলেন। আমি নিতান্ত ক্লান্ত ছিলাম বলিয়া, অনুনয় বিনয় করিয়া প্রথমে তাঁহার সহিত গমন করিতে অসম্মত হইলাম। কিন্তু তিনি আমাদিগের কোন কথাই শ্রবণ করিলেন না, এক প্রকার বলপূর্ব্বক আমাদিগকে লইয়া গেলেন।
কাছারিতে গমন করিবামাত্রই প্রথমে তিনি জলযোগের ব্যবস্থা করিয়া দিলেন। সমস্ত দিবসের পর উত্তমরূপে জলযোগ করিলাম। কাছারি-বাড়ীর মধ্যে একটি গৃহের ভিতর আমাদিগের নিমিত্ত একটি শয্যা প্রস্তুত হইল। সেইস্থানে উপবেশন করিলাম, ক্রমে শয়নও করিলাম; নিদ্রাদেবী আসিয়াও উপস্থিত হইলেন।
কিয়ৎক্ষণ পরে নায়েব মহাশয় পুনরায় সেই গৃহে প্রবেশ পূর্ব্বক আমার নিদ্রাভঙ্গ করিলেন। আমাকে সমভিব্যাহারে লইয়া তিনি আর একটি গৃহের ভিতর প্রবেশ করিলেন।
দেখিলাম, সেইস্থানে অন্নব্যঞ্জন প্রস্তুত। অধিক রাত্রিতে আহার করিতে প্রথমে অসম্মত হইলাম, কিন্তু নায়েব মহাশয়ের নিকট আমার কোন প্রকার আপত্তিই স্থান পাইল না।
পরিতোষের সহিত আহার করিতে হইল। সেই গৃহে নায়েব মহাশয় ব্যতীত অপর আর কাহাকেও দেখিতে না পাইয়া আমার মনে এক প্রকার কৌতূহল উপস্থিত হইল। ভাবিলাম কোন ব্যক্তি এত রাত্রিতে এরূপভাবে রন্ধনাদি করিলেন। সেই সময়ে এই কথা তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিতে সমর্থ হইলাম না; কিন্তু পরিশেষে জানিতে পারিয়াছিলাম যে, ব্রাহ্মণ নায়েব মহাশয়ের রন্ধনাদি কার্য্য করেন, নায়েব মহাশয়ের আহারাদি সমাপন হইলে, তিনি সন্ধ্যার পরেই আপন কার্য্য শেষ করিয়া, আপনার বাড়ীতে গমন করিয়াছেন। সেই ব্রাহ্মণকে না পাইয়া সেই রাত্রিতে নায়েব মহাশয় কেবলমাত্র আমাদিগের নিমিত্তই স্বহস্তে অন্নব্যঞ্জন পাক করিয়াছেন। কলিকাতার পাঠকগণের মধ্যে অনেকেই হয় ত আমার উপর সম্পূর্ণরূপে দোষারোপ করিয়া কহিবেন, “ইহাও কি কখন সম্ভব যে, একজন অপরিচিত লোকের নিমিত্ত সেই বৃদ্ধ নায়েব মহাশয় নিঃস্বার্থভাবে এত কষ্ট সহ্য করিবেন? ইহা কখনই সম্ভবে না, ইহা লেখকের বর্ণনামাত্র।” কিন্তু সৌভাগ্যের বিষয়, মফঃস্বলেও আমাদের বিস্তর পাঠক আছেন, তাঁহারা পূর্ব্বকথিত পাঠকগণের নিকট এ সম্বন্ধে সাক্ষ্য প্রদান করিতে পারিবেন যে, মফঃস্বলবাসী লোকগণ এখনও কলিকাতাবাসীর সদৃশ স্বার্থপর হয়েন নাই। এখনও তাঁহারা অতিথি-অভ্যাগতের সমাদর করিয়া থাকেন, অপরিচিত লোকের উপর পরিচিতের ন্যায় ব্যবহার করিয়া থাকেন, নিরাশ্রয়কে আশ্রয় দান করিয়া থাকেন, বিপদাপন্ন ব্যক্তিকে এখনও বিপদ হইতে উদ্ধার করিবার চেষ্টা করিয়া থাকেন। বৃদ্ধ নায়েব মহাশয়ের তুল্য এখনও অনেক ব্যক্তি মফঃস্বলে আছে। যাঁহাদের কথা শ্রবণ করিয়া সহরবাসী ব্যক্তিগণ একবারে বিস্ময়ান্বিত হইবেন।
যাহা হউক, আহারাদি সমাপন-পূর্ব্বক রাত্রির অবশিষ্টাংশ সেইস্থানেই সুখে অতিবাহন করিলাম। প্রাতঃকালে নায়েব মহাশয় আমার নিকট আসিয়া উপবেশন করিলেন। তাঁহার সহিত অনেক প্রকার কথাবার্তার পর, তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “মহাশয়! কাঁথি হইতে দাসপুর কত ক্রোশ? আর আমরাই বা কত ক্রোশ আগমন করিয়াছি, এবং কত পথ এখনও বাকি আছে?”
উত্তরে নায়েব মহাশয় কহিলেন, “এখানকার লোকেরা উভয় স্থানের ব্যবধান দেড় ক্রোশ কহিয়া থাকে, তাহার মধ্যে আপনি প্রায় তিন ভাগ আগমন করিয়াছেন, এক-চতুর্থাংশ এখনও বাকি আছে।”
বিজ্ঞ নায়েব মহাশয়ের কথা শ্রবণ করিয়া আমি অতিশয় বিস্ময়াবিষ্ট হইলাম, ও তাঁহাকে কহিলাম, “সে কি মহাশয় প্রাতঃকাল হইতে রাত্রি দশটা পর্য্যন্ত চলিয়া আমরা এই সামান্য পথ অতিবাহিত করিতে পারিলাম না, ইহা বড় আশ্চর্য বিষয়!”
প্রত্যুত্তরে নায়েব মহাশয় কহিলেন, “আশ্চৰ্য্য কিছুই নহে। আপনাদিগের স্বদেশীয় ক্রোশ ও এইস্থানের ক্রোশ অনেক প্রভেদ। আপনাদিগের দেশে দুই মাইল পথ গমন করিলে, এক ক্রোশ পথ অতিক্রম করা হয়। এখানকার ক্রোশ—সে প্রকার ক্রোশ নহে। ইহাকে “ডাল ভাঙা” ক্রোশ কহে, অর্থাৎ কোন একটি সতেজ বৃক্ষ হইতে একটি কাঁচা ডাল ভাঙ্গিয়া লইয়া সেই ডাল হস্তে গমন করিতে হয়। গমন করিতে করিতে সেই শাখাসংলগ্ন পাতাগুলি যখন শুখাইয়া যাইবে, তখনই জানিবেন যে আপনি এক ক্রোশ পথ অতিবাহিত করিলেন। আপনি যতদূর চলিয়া আসিয়াছেন, আপনাদিগের দেশের ক্রোশ অনুযায়ী বোধ হয়, আপনি আঠার ক্রোশ পথ চলিয়া আসিয়াছেন; এখনও বোধ হয়, আপনার গন্তব্যস্থানে গমন করিতে প্রায় ছয় সাত ক্রোশ পথ বাকি আছে।”
নায়েব মহাশয়ের কথা শ্রবণ করিয়া তখন সেই দেড় ক্রোশ পথের অর্থ বুঝিতে পারিলাম। সেই দিবসের প্রাতঃকাল সেইস্থানে অতিবাহিত করিলাম। আহারান্তে সেইস্থান হইতে বহির্গত হইলাম। এবার আর পদব্রজে গমন করিতে সাহস হইল না। নায়েব মহাশয় একখানি পাল্কীর যোগাড় করিয়া দিলেন, উহাতে আরোহণ করিয়া সন্ধ্যার পরেই আপনার গন্তব্যস্থানে গিয়া উপনীত হইলাম।
সপ্তম পরিচ্ছেদ
রাত্রিকাল দাসপুরের থানাতেই অতিবাহিত করিতে হইল। প্রথমে পথে যেরূপ কষ্ট পাইয়াছিলাম, এখানে কিন্তু আর সেরূপ কষ্ট পাইতে হইল না। থানার দারোগা একজন উৎকলবাসী বটে; কিন্তু তাঁহাকে ভদ্রলোক বলিয়া বোধ হইল। যথাসাধ্য তিনি আমাকে সাহায্য প্রদান করিলেন। হরির বাড়ী সেইস্থান হইতে বহুদূর নহে। পরদিন প্রাতঃকালে ছয়টার সময় থানা হইতে বহির্গত হইয়া, আটটার মধ্যেই তাহার বাড়ীতে গিয়া উপনীত হইলাম। হরি তাহার বাড়ীতেই ছিল, সেইস্থানে গমন করিবামাত্রই হরিকে পাওয়া গেল। গৃহের ভিতর প্রবেশ করিয়া দেখিলাম, পরাণের মা শয়ন করিয়া আছে; সুতরাং তাহাকেও পাইতে সবিশেষ কষ্ট হইল না। কিন্তু পুরাণ সেইস্থানে ছিল না। তাহার কথা উহাদিগকে জিজ্ঞাসা করায়, পরাণ তাহাদের সহিত আগমন করে নাই, ইহাই আমাকে বুঝাইবার চেষ্টা করিতে লাগিল। হরি ও পরাণের মা’কে যে সকল কথা জিজ্ঞাসা করিতে লাগিলাম, একে একে তাহার সমস্তই তাহারা অস্বীকার করিতে লাগিল। এমন কি, রমণদাসের বাড়ীতে পরাণের মা যে গমন করিয়াছিল, তাহা কোন প্রকারে সেই প্রবীণা স্ত্রীলোকের মুখ হইতে বহির্গত হইল না। হাবড়া হইতে হঠাৎ আগমনের কথা হরি অস্বীকার করিয়া কহিল, “আমি বাড়ীর সকলকেই বলিয়া, বাড়ীর সমস্ত খাজানা মিটাইয়া দিয়া সেইস্থান পরিত্যাগ করিয়াছি।”
এই প্রকার মিথ্যা কথা শ্রবণ করিয়া, উহাদিগের উপর তখন আমার আরও অধিক সন্দেহ আসিয়া উপস্থিত হইল। উহাদিগের খানা-তল্লাসি করাই তখন স্থির করিলাম। হরির বাড়ীতে তিনখানি মৃত্তিকা-নির্ম্মিত গৃহ ভিন্ন অপর গৃহ ছিল না, এক এক করিয়া সমস্তই অনুসন্ধান করিলাম। প্রত্যেক গৃহের মৃত্তিকা খনন করিয়াও দেখিলাম, চালের খড় সকল উছাঁইয়া ফেলিলাম, প্রাঙ্গণের ভিতর সমস্ত স্থান উত্তমরূপে দেখিলাম; কিন্তু কোনস্থানেই অপহৃত দ্রব্যাদির কোন প্রকার সন্ধান প্রাপ্ত হইলাম না। তখন অনন্যোপায় হইয়া উহাদিগকে থানায় লইয়া গেলাম। সমস্ত দিন রাত্রি থানায় কাটিয়া গেল, তথাপি উহাদিগের নিকট হইতে একটি মাত্র কথাও বাহির হইল না। এইরূপে পরদিবস ও অতিবাহিত হইল, কিন্তু নূতন কোন কথাই আর পাইলাম না। সেই সময়ে একবার ভাবিলাম, তবে কি ইহারা প্রকৃতই দোষী নহে? যদি ইহারাই অলঙ্কারাদি অপহরণ করিয়া আনিয়া থাকে, তাহা হইলে আর কোন্ স্থানে সে সকল রাখিতে পারে? পরাণ কি তবে সমস্ত দ্রব্য লইয়া স্থানান্তরে প্রস্থান করিয়াছে? পরাণও প্রকৃত চোর নহে, আমারই অনুমানের ভ্রম হইয়াছে? তবে কি রমণদাসই এই ঘটনার নায়ক? রমণদাসের দ্বারাই যদি ইহা হইয়া থাকে, তাহা হইলে রমণদাস সেই সকল দ্রব্য বাহির করিয়াই বা দিল না কেন? পুলিস ত উহাকে লইয়া কোন প্রকার অনুসন্ধান করিতে পরা মুখ হয়েন নাই। এই উভয়-পক্ষীয় কোন লোকের দ্বারা যদি এই কার্য্য না হইয়া থাকে, তাহা হইলে তৃতীয়-পক্ষীয় কোন লোকের দ্বারাই হওয়া সম্ভব। কিন্তু হরি হাবড়া হইতে তাহার দেশে আগমন-সম্বন্ধে মিথ্যা কথা কহিতেছে কেন? আর পরাণের মা-ই বা রমণদাস বাবাজীর বাড়ীতে গমন করার কথা একেবারেই অস্বীকার করে কেন? এইরূপ নানাপ্রকার ভাবিয়া পরিশেষে এক উপায় অবলম্বন করিবার ইচ্ছা করিলাম। আর ইহাও ভাবিলাম, যদি কোন প্রকারে হরি বা পরাণের মা’র নিকট হইতে কোন প্রকার মনের কথা বাহির করিতে সমর্থ না হই, তাহা হইলে অগত্যা উহাদিগকে ছাড়িয়া দিতেই হইবে। চোরা-দ্রব্য না পাইয়া কেবলমাত্র উহাদিগকে কলিকাতায় লইয়া গিয়া কি করিব?
এইরূপে মনে মনে নানাপ্রকার ভাবিয়া সন্ধ্যার পর, একাকী থানা হইতে বহির্গত হইলাম। সেই অপরিচিত স্থানে, অন্ধকারের ভিতর দিয়া একাকীই গমন করিতে লাগিলাম। ব্যাঘ্র প্রভৃতি কোন প্রকার শ্বাপদ জন্তুর কথা একবারেই মনোমধ্যে উদিত হইল না। সেই রাত্রিকালে অপরিচিত স্থানে একাকী কোন না কোন বিপদে যে অনায়াসেই পড়িতে পারি, তাহাও একবারের জন্য ভাবিবার সময় পাইলাম না। কি প্রকারে চোরা দ্রব্য সকলের পুনরুদ্ধার করিতে সমর্থ হই, তাহাই ভাবিতে ভাবিতে একাকীই গমন করিতে লাগিলাম। কোনস্থানে আম্র-বাগানের মধ্য দিয়া, কোনস্থানে বাঁশবাগানের পার্শ্ব দিয়া, কোনস্থানে প্রকাণ্ড অশ্বত্থবৃক্ষের নিকট দিয়া, গমন করিতে করিতে ক্রমে হরির সেই বাড়ীতে গিয়া উপনীত হইলাম। প্রথম দিবস কেবলমাত্র হরির স্ত্রীকে বাড়ীতে রাখিয়া আসিয়াছিলাম। আজ তাহারই নিকট গিয়া পুনরায় উপনীত হইলাম। আমাকে দেখিয়া সেই সামান্য-বুদ্ধি স্ত্রীলোক চিনিতে পারিল না। প্রথম দিবস আমি যেরূপ পরিচ্ছদ-পরিহিত ছিলাম, এখন কিন্তু তাহার কিছুই নাই। না আছে সেই পেন্টুলন, না আছে সেই কোট, না আছে সেই বুট। এখন পরিধানে কেবল একমাত্র ধুতি, স্কন্ধে একখানি গাম্ছা। পদ পাদুকা-বিহীন। হরির বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিয়া যে স্থানে তাহার স্ত্রী বসিয়াছিল, সেই দাওয়ার নিকট গিয়া দণ্ডায়মান হইলাম।
অষ্টম পরিচ্ছেদ
আমি সেই অবলার নিকট গিয়া দণ্ডায়মান হইলে, সে বার বার আমার মুখের দিকে চাহিয়া দেখিতে লাগিল। তাহাকে দেখিয়া বোধ হইল, সে যেন আমাকে কোথায় দেখিয়াছে। আমাকে পরিচিত বলিয়া তাহার মনে হইতেছে, কিন্তু স্পষ্ট করিয়া আমাকে কোন কথা জিজ্ঞাসা করিতে সাহসিনী হইতেছে না। স্ত্রীলোকের এই অবস্থা দেখিয়া আমি তাঁহাকে কহিলাম, “তুমি কি দেখিতেছ? আমাকে চিনিতে পারিতেছ না কি? কতবার আমি তোমার স্বামীর সহিত এইস্থানে আগমন করিয়াছি, কতদিন তোমাদিগের বাড়ীতে আহারাদি করিয়া চলিয়া গিয়াছি। তোমাদিগের এই বিপদের কথা শ্রবণ করিয়া আমি থানায় গিয়াছিলাম। হরি সেইস্থানে আছে, কোন ভয় নাই। হরির সহিত আমার সাক্ষাৎ হইয়াছে। তাহাকে বাঁচাইবার সমস্ত উপায়ই স্থির করিয়া আসিয়াছি, তোমার আর কোন ভাবনা নাই। রাত্রি প্রভাত হইলেই উহারা প্রত্যাগমন করিবে; কিন্তু একটি কথা আছে, তাহারই নিমিত্ত সে আমাকে তোমার নিকট এই রাত্রিতে প্রেরণ করিয়াছে।”
আমার কথা শ্রবণ করিয়া স্ত্রীলোকটি উঠিল, একখানি কম্বল আনিয়া আমাকে বসিতে দিল। আমি সেইস্থানে উপবেশন করিলে সে জিজ্ঞাসা করিল, “কি কথার নিমিত্ত তিনি আপনাকে প্রেরণ করিয়াছেন?”
উত্তরে আমি কহিলাম, “যখন আমি শ্রবণ করিলাম হরি ধৃত হইয়া থানায় নীত হইয়াছে ও তাহাকে কোনরূপে বাঁচাইবার নিমিত্ত গ্রামের কোন ব্যক্তিই সেইস্থানে গমন বা উপায় অন্বেষণ করেন নাই, তখন আমি সেইস্থানে গমন করিলাম। প্রথমে হরির সহিত সাক্ষাৎ করিলাম, পরে থানার দারোগার নিকট গমন করিয়া, যাহাতে হরি এ যাত্রা রক্ষা পায়, তাহার উপায় জিজ্ঞাসা করিলাম। দারোগা মহাশয়ের সহিত আমার পূৰ্ব্ব হইতেই বিশেষ জানা-শুনা ছিল এবং তাঁহার নিমিত্ত অনেক কাৰ্য্য অনেক সময়ে আমাকে সম্পন্ন করিতেও হইয়াছে। কাজেই তিনি কোন প্রকারে আমার অনুরোধ লঙ্ঘন করিতে পারিলেন না। যেরূপে হউক হরিকে বাঁচাইবেন বলিয়া প্রতিজ্ঞায় আবদ্ধ হইলেন; কিন্তু কহিলেন, এ মোকদ্দমা একাদিক্রমে তাঁহার হাতে নহে, কলিকাতায় একজন কৰ্ম্মচারী আসিয়া ইহার অনুসন্ধান করিতেছেন, সুতরাং তাঁহাকে সন্তুষ্ট করা আবশ্যক, তাঁহাকে কোন প্রকারে সন্তুষ্ট করিতে না পারিলে হরির পরিত্রাণের উপায় নাই। দারোগা মহাশয়ের কথা শুনিয়া আমি তাঁহাকে সন্তুষ্ট করিতে সম্মত হইলাম, এবং কহিলাম, “কি হইলে এ গোলযোগ মিটিয়া যায়?” দারোগা মহাশয় কহিলেন, “দুই শত টাকা ঐ কৰ্ম্মচারীকে প্রদান করিতে পারিলেই সমস্ত গোল মিটিয়া যাইবে। হরি ও পরাণের মা বাড়ীতে প্রত্যাগমন করিতে পারিবে।” আমি কিন্তু দুই শত টাকায় স্বীকৃত হইলাম না, বিশেষ কাকুতি মিনতি করিয়া হরির সহিত পরামর্শ অনুযায়ী পরিশেষে একশত টাকায় তাহাদিগকে স্বীকৃত করিয়াছি। এখন ঐ একশত টাকার প্রয়োজন। হরি বলিয়া দিয়াছে, যেখানে যাহা আছে তাহা কতক তুমি অবগত আছ তাহা হইতে যেরূপে হউক ঐ টাকা জোগাড় করিতে হইবে। ইহাতে যদি কিছু বিক্রয় করিতে বা বন্ধক দিতে হয়, তাহাও করিতে হইবে। এইরূপে টাকা সংগ্রহ করিয়া সেই টাকা লইয়া আমার সহিত তোমাকে যাইতে বলিয়াছে, এবং ইহাও বলিয়া দিয়াছে, এ সকল কথা পাড়ার অপর কেহ যেন জানিতে না পারে, কারণ এখন হরি বুঝিতে পারিতেছে যে, পাড়ার আর কেহই তাহার মিত্র নহে, বরং শত্রু।”
আমার সমস্ত কথা হরির স্ত্রী বিশেষ মনোযোগের সহিত শ্রবণ করিল। বোধ হইল, আমার সমস্ত কথা বিশ্বাস করিয়াছে। পরিশেষে সে কহিল, “আমার নিকট নগদ টাকা নাই, তাহা ত তিনি জানেন, কিন্তু তাঁহার রক্ষিত অলঙ্কার এখন কোথায়, বন্ধক দিলে টাকা পাওয়া যাইতে পারে, তাহা ত আমি জানি না।”
“তোমার নিকট নগদ টাকা নাই, তাহা হরি আমাকে বলিয়াছে, আর ইহাও বলিয়া দিয়াছে, তাহার রক্ষিত গহনার ভিতর হইতে কতক বাহির করিয়া আমার সহিত লইয়া গেলে উহা বন্ধক বা বিক্রয় পূর্ব্বক আমি টাকার সংস্থান করিয়া দিব। আর অধিক সময় নষ্ট করার প্রয়োজন নাই, একশত টাকা পাওয়া যাইতে পারে। এই পরিমিত অলঙ্কার লইয়া তুমি আমার সহিত চল।”
দেখিলাম, আমার কথায় হরির স্ত্রী ভুলিয়া গেল। আমার কথার উপর নির্ভর করিয়া সেই অবোধ স্ত্রীলোক তাহার স্বামীর সর্ব্বনাশ সাধনের পথ পরিষ্কার করিয়া দিল। আমাকে সেই স্থানে বসাইয়া একখানি কোদালিহস্তে সে বাটী হইতে বহির্গত হইল। দেখিলাম, তাহার বাড়ীর প্রায় তিন শত হস্ত উত্তরে একটি জঙ্গলের ভিতর একস্থানে মৃত্তিকা খনন করিয়া, দুই তিন খানি সোণার অলঙ্কার বাহির করিয়া আনিল ও সেগুলি আমার হস্তে দিয়া কহিল, “এই লউন, এখন যাহাতে আমার স্বামী পরিত্রাণ পায়, তাহা করুন।”
অলঙ্কারত্রয় হস্তে করিয়া তাহাকে কহিলাম, “এখন চল তোমার স্বামীকে উদ্ধার করিয়া আনি।” সে আমাকে সম্পূর্ণ বিশ্বাস করিয়াছিল, সুতরাং আমার সহিত গমন করা প্রথমে অনাবশ্যক বিবেচনা করিল। কিন্তু পরে আমার অনুরোধ লঙ্ঘন করিতে না পারিয়া, আমার সহিত সেই রাত্রিতে বাটী হইতে বহির্গত হইল। স্বামী-উদ্ধারের জন্য গমন করিতেছে, সুতরাং অন্য কোন অনিষ্টের আশঙ্কা না করিয়া, আমার পশ্চাৎ পশ্চাৎ গমন করিতে লাগিল। আমি তাহাকে অন্য কোনস্থানে লইয়া গেলাম না, যা অলঙ্কার বিক্রয় বা বন্ধক দেওয়ার কোনরূপ চেষ্টা করিলাম না, তাহাকে একবারেই থানায় লইয়া আসিলাম। থানার ভিতর অপর একস্থানে তাহাকে রাখিয়া, দারোগাকে সমস্ত কথা কহিলাম। তিনি সেই অলঙ্কারত্রয় আমার হস্ত হইতে লইয়া হরিকে এবং পরাণের মাকে দেখাইলেন; তাহাতেও কিন্তু তাহারা কোন কথা স্বীকার করিল না। তখন উহাদিগকে লইয়া পুনরায় আমরা হরির বাড়ীতে গমন করিলাম। যেস্থানে অলঙ্কার পোতা ছিল দেখিয়াছিলাম, সেইস্থানে অনুসন্ধান করিতে করিতেই বিস্তর অলঙ্কার পাওয়া গেল। যত অলঙ্কার চুরি গিয়াছিল, তাহার সমস্ত কিন্তু পাওয়া গেল না। তখন উহারা সমস্ত কথা স্বীকার করিল, বক্রী অলঙ্কার বিক্রয় করিবার নিমিত্ত পরাণ মেদিনীপুর সহরে গমন করিয়াছে, ইহাও বলিল।
থানায় আসিয়া হরির স্ত্রীকে ছাড়িয়া দিলাম, সে কাঁদিতে কাঁদিতে আপন আলয়াভিমুখে প্রস্থান করিল। আমি সেই রাত্রি সেই থানাতেই থাকিলাম। পরদিবস মেদিনীপুরে গমন করিয়া, পরাণের সন্ধান করিবার ইচ্ছা করিলাম। যে সকল দ্রব্য পাওয়া গিয়াছিল, তাহার একটি তালিকা করিয়া সেই থানায় জমা দিলাম। উহারা আমাকে একটি রসিদ প্রদান করিল। হরি ও পরাণের মা’কেও সেই পুলিসের জিম্মা করিয়া দিলাম। তাহারা নিয়মিত সময়ে মাল ও আসামী কলিকাতায় পৌঁছাইয়া দিবে বলিয়া প্রতিজ্ঞা করিল। এই সকল বন্দোবস্ত করিয়া আমি মেদিনীপুরে গমন করিবার নিমিত্ত সেইস্থান পরিত্যাগ করিলাম।
মেদিনীপুরে যাত্রা করিবার পূর্ব্বেই হরি ও পরাণের মা’কে ধৃত করার, এবং তাহাদিগের নিকট হইতে অধিকাংশ অলঙ্কার প্রাপ্ত হওয়ার সমাচার কলিকাতায় তারযোগে প্রেরণ করিলাম। পরিশেষে শুনিয়াছিলাম, আমি কলিকাতা পরিত্যাগ করিবার পরেই রমণদাসের উপর পুলিসের সন্দেহ আরও বৃদ্ধি পাইয়াছিল, এবং এ যাবৎকাল সে হাজত—গৃহে পচিতেছিল। আমার নিকট হইতে সংবাদ পাওয়াতে তাহাকে ছাড়িয়া দেওয়া হইয়াছিল। তখন সকলেই জানিতে পারিয়া ছিলেন যে, রমণদাস বাবাজী চোর নহে, বা সেই রমণীর সর্ব্বনাশ সাধনের চেষ্টাও করে নাই।
নবম পরিচ্ছেদ
মেদিনীপুর হইতে যে পথ কটকের মধ্য দিয়া গমন করিয়াছে, সেই পথ অবলম্বন করিয়া মেদিনীপুর-দিকে গমন করিতে লাগিলাম। সেইস্থান হইতে মেদিনীপুর অনেকদূর, সুতরাং একখানি গরুর গাড়ি ভাড়া করিয়া লইলাম। কখন উহার ভিতরে বসিয়া, কখন উহাতে শয়ন করিয়া, কখন উহার অগ্রে অগ্রে চলিয়া, ক্ৰমে মেদিনীপুর সহরে উপনীত হইলাম। মেদিনীপুর সহর নিতান্ত ক্ষুদ্র স্থান নহে। উহার ভিতর একস্থানে একটি ঘর ভাড়া লইয়া সেইস্থানে অবস্থিতি পূর্ব্বক পরাণের অনুসন্ধান করিতে আরম্ভ করিলাম। দুই দিন, চারি দিন, ক্রমে দশ দিন পর্য্যন্ত অনুসন্ধান করিলাম, কিন্তু কোনস্থানে তাহার সন্ধান প্রাপ্ত হইলাম না। তথাপি মনে করিলাম, আরও দুই চারি দিবস এইস্থানে উত্তমরূপে পরাণের অনুসন্ধান করিয়া, পরিশেষে কলিকাতায় গমন করিব। কার্য্যে কিন্তু তাহা ঘটিল না। মেদিনীপুরের যে স্থানে আমার বাসা ছিল, তাহা অপর কেহই জানিত না। কেবল আমার কলিকাতার কর্তৃপক্ষীয়গণ তাহা জানিতেন। কারণ, আমি যখন যে স্থানে থাকিতাম, পত্রদ্বারা তাহা তাঁহাদিগকে জানাইতাম।
একাদশ দিবসের প্রাতঃকালে আমি একখানি টেলিগ্রাফ পাইলাম। কলিকাতা হইতে উহা আমার একজন ঊর্দ্ধতন কর্মচারী প্রেরণ করিয়াছেন। উহা পাঠ করিয়া আমি নিতান্ত বিস্মিত হইলাম। উহার ভাবার্থ এই—হরি ও পরাণের মা’কে কলিকাতায় আনিবার কালে মেদিনীপুরের পথে উহাদিগকে ও উহাদিগের সমভিব্যাহারী পুলিস-কৰ্ম্মচারীগণকে বিষ প্রয়োগ করিয়া, অলঙ্কারপত্র প্রভৃতি যাহা কিছু তাহারা কলিকাতায় আনিতেছিল, তাহার সমস্তই কে চুরি করিয়াছে। উহারা সেইস্থানের পুলিসকর্তৃক মেদিনীপুরের হাসপাতালে নীত হইয়াছে। এখন এই মোকদ্দমার অনুসন্ধান করিয়া, সেই পুনরপহৃত দ্রব্যের সন্ধান করা আবশ্যক।
আর কালবিলম্ব করিতে পারিলাম না, সেই টেলিগ্রাফ সহিত মেদিনীপুরের হাসপাতালে গিয়া উপনীত হইলাম। হাসপাতালের প্রধান ডাক্তারকে উক্ত টেলিগ্রাফ দেখাইলে, তিনি আমার পরিচয় পাইলেন, ও সেই সকল ব্যক্তির নিকট গমন করিয়া অনুসন্ধান করিতে আদেশ প্রদান করিলেন।
আমি ওয়ার্ডের ভিতর প্রবেশ করিলাম। দেখিলাম, একটি গৃহের ভিতর হরি, পরাণের মা, কনষ্টেবল, এবং একজন জমাদার রহিয়াছে। ইহারা এখনও সম্পূর্ণরূপে সুস্থ হইতে পারে নাই, কিন্তু বিপদের আর আশঙ্কা নাই। একজন কম্পাউণ্ডার সেইস্থানে বসিয়া রহিয়াছে দেখিলাম। তাহাকে জিজ্ঞাসা করিয়া কেবল এইমাত্র অবগত হইতে পারিলাম যে, ইহারা সকলেই ধুতুরা খাইয়া অজ্ঞান হইয়া পড়িয়াছিল। এখন যদি সুস্থ হইয়াছে সত্য, তথাপি ইহাদের নেসার ঘোর এখনও সম্পূর্ণরূপে অন্তর্হিত হয় নাই।
এইরূপ অবস্থায় এখন উহাদিগের জবানবন্দী লওয়া অযুক্ত বিবেচনা করিলাম। ভাবিলাম, এখন উহারা কেহই প্রকৃত কথা বলিতে সমর্থ হইবে না, কি বলিতে কি বলিবে, প্রকৃত কথা অবগত হইতে না পারিলে অনুসন্ধানের পক্ষে গোলযোগ হওয়াই সম্পূর্ণ সম্ভব। এইরূপ নানাপ্রকার ভাবিয়া উহাদিগকে কোন কথাই জিজ্ঞাসা না করিয়া সেইস্থান হইতে বহির্গত হইলাম। হাসপাতাল হইতে মেদিনীপুরের থানা বহুদূর নহে; তখন সেই থানায় গমন করিলাম। দেখিলাম, যে থানার এলাকায় হরি প্রভৃতিকে অচৈতন্য অবস্থায় পাওয়া গিয়াছিল, সেই থানার দারোগা ঐ স্থানে আমার অপেক্ষা করিতেছেন। তিনি পূর্ব্বেই টেলিগ্রাফযোগে অবগত হইয়াছেন যে, আমি তাঁহার সাহায্যের নিমিত্ত তথায় গমন করিতেছি। দারোগার সহিত সাক্ষাৎ হইল, তিনি আমার নিকট হইতে মূল মোকদ্দমার সমস্ত বিষয় বিশেষরূপে অবগত হইলেন। আমি কিরূপ উপায়ে উহাদিগের নিকট হইতে চোরাদ্রব্য সকল বাহির করিতে সমর্থ হইয়াছি ও কেনই বা উহাদিগকে চোরাদ্রব্যের সহিত সেইস্থানের স্থানীয় পুলিসের হস্তে সমর্পণ করিয়াছিলাম, তিনি তাহার সমস্ত ব্যাপার বিশেষরূপে আমার নিকট হইতে অবগত হইয়া লিখিয়া লইলেন। পুনঃপ্রাপ্ত মালের তালিকা যাহা আমার নিকট ছিল, তাহারও একখণ্ড নকল করিয়া লইলেন। এইরূপে ক্রমে সমস্ত দিবস অতিবাহিত হইল, রাত্রিও কাটিয়া গেল। উহাদিগকে কিরূপ অবস্থায় এবং কোথায় পাওয়া গিয়াছিল জিজ্ঞাসা করায় জানিতে পারিলাম একজন চৌকিদার সেই দারোগার নিকট গিয়া সংবাদ প্রদান করে যে, কটক হইতে যে পথ মেদিনীপুরের ভিতর দিয়া গমন করিয়াছে, তাহার মধ্যে একস্থানে একটি চটীতে দুইজন পুলিস কর্ম্মচারী, একটি অপর ব্যক্তি ও একটি স্ত্রীলোক অচৈতন্য অবস্থায় পড়িয়া রহিয়াছে। সংবাদ প্রাপ্তি-মাত্র দারোগামহাশয় সেইস্থানে গমন করিয়া দেখিলেন, যে, প্রকৃতই তাহারা অচৈতন্য অবস্থায় সেইস্থানে পতিত। তৎক্ষণাৎ তিনি উহাদিগকে উঠাইয়া হাসপাতালে লইয়া যান। হাসপাতালের ডাক্তারের বিশেষ যত্ন ও পরিশ্রমের গুণে ইহারা ক্রমেই সুস্থ হইয়া উঠিতেছে, উহাদিগের মৃত্যুর ভয় আর নাই। ডাক্তার মহাশয় বলেন, ধুতুরা খাইয়া উহারা এরূপ অচৈতন্য হইয়া পড়িয়াছিল। সময়ে চিকিৎসা না হইলে উহাদের বাঁচিবার কোনরূপ সম্ভাবনা থাকিত না। এখন উহাদিগের জ্ঞান হইয়াছে, উহারা কথা কহিতে সমর্থ হইয়াছে। কিরূপ ঘটনায় উহারা ঐরূপ অবস্থায় পতিত হয়, তাহার কতক কতক এখন স্মরণ করিয়া বলিতেও সমর্থ হইতেছে; কিন্তু নেসার ঘোর একেবারে তিরোহিত হয় নাই। এক কথা বলিতে গিয়া এখনও নিতান্ত অসংলগ্ন অন্য কথা আনিয়া তাহার ভিতর মিশ্রিত করিয়া ফেলিতেছে। যাহা হউক, দুই এক দিনের মধ্যেই যে উহারা সম্পূর্ণ আরোগ্যলাভ করিবে, ও সমস্ত অবস্থা আদ্যোপান্ত বলিতে সমর্থ হইবে, তাহার আর কিছুমাত্র সন্দেহ নাই।
দশম পরিচ্ছেদ
পরদিবস আহারান্তে আমরা পুনরায় হাসপাতালে গিয়া উপস্থিত হইলাম। আজ দেখিলাম, উহারা সম্পূর্ণরূপে সুস্থ হইয়াছে, নেসার চিহ্নমাত্র নাই। এখন সমস্ত কথা স্মরণ করিয়া কহিতে পারিতেছে। কিন্তু ডাক্তার মহাশয় উহাদিগকে ছাড়িয়া দিলেন না, কহিলেন, সে দিন কিরূপ থাকে দেখিয়া কল্য প্রাতঃকালে উহাদিগকে থানায় পাঠাইয়া দিবেন! ডাক্তার মহাশয়ের কথা শুনিয়া, আমরা থানায় প্রত্যাগমন করিলাম। সে রাত্রিও সেই থানায় অতিবাহিত করিতে হইল।
পরদিবস প্রাতঃকালে নয়টার সময় সকলেই থানায় গিয়া উপস্থিত হইল, এখন ইহারা সম্পূর্ণরূপ সুস্থ। কি প্রকার অবস্থায় পড়িয়া এইরূপ বিপদ ঘটিয়াছিল, তাহার বিবরণ বিস্তারিতরূপে বর্ণন করিতে উহাদিগকে কহিলাম। জমাদার প্রথম হইতে আরম্ভ করিয়া, ক্রমে ক্রমে সমস্ত বলিতে লাগিল। বলিতে বলিতে যাহা কিছু বাদ পড়িতে লাগিল জমাদার যাহা ভুলিয়া যাইতে লাগিল, উক্ত কনষ্টেবল তাহা মনে করিয়া দিতে লাগিল। আর আমরা উভয়েই ক্রমে ক্রমে তাহা লিখিয়া লইতে লাগিলাম। জমাদার কহিল—”কয়েক দিবস অতীত হইল, থানা হইতে আদেশ প্রাপ্ত হইলাম যে, দুইজন আসামী এবং অলঙ্কারাদি লইয়া আমাকে কলিকাতায় গমন করিতে হইবে। একটি কনষ্টেবলও আমার সঙ্গে যাইবে। এরূপ অবস্থায় কলিকাতায় গমন করিতে আদৌ আমার ইচ্ছা ছিল না; কিন্তু কি করি, সরকারী কার্য্য বলিয়া কোনরূপে আদেশ লঙ্ঘন করিবার আমাদিগের ক্ষমতা নাই, সুতরাং অনিচ্ছা থাকিলেও আমাকে সম্মত হইতে হইল। অলঙ্কারগুলি তালিকার সহিত মিলাইয়া এই ঝোলার ভিতর পুরিলাম। ঝোলাটি বিশ্বাস করিয়া কনষ্টেবলের হস্তে পর্যন্ত দিলাম না, নিজের গলায় উহা ঝুলাইয়া লইলাম। কি চলিবার সময়, কি বসিবার সময়, কি আহার করিবার সময়, সেই ঝোলা আর আমার গলা হইতে নামাইলাম না, উহা সৰ্ব্বদাই আমার গলায় ঝুলিতে লাগিল। আসামীদ্বয়কে লৌহ-হাতকড়ির দ্বারা উত্তমরূপে বন্ধন করিয়া আমরা থানা হইতে বহির্গত হইলাম। কটকের প্রশস্ত পথ অবলম্বন করিয়া, মেদিনীপুরাভিমুখে ক্রমে আমরা গমন করিতে লাগিলাম। সমস্ত দিবস আমরা পদব্রজে চলিয়া যে স্থানে রাত্রি হয়, তাহার নিকটবর্ত্তী কোনস্থানে পুলিসের থানা বা ফাড়ী অনুসন্ধান করিয়া সেইস্থানে গমন করি। তথাকার হাজতে আসামীদ্বয়কে বদ্ধ করিয়া রাখিয়া, রাত্রি সেইস্থানে অতিবাহিত করি। এইরূপে আমরা ক্রমে চলিতে লাগিলাম। ক্রমে মেদিনীপুর সহরের নিকটবর্তী হইলাম; আর এক আধ দিবস চলিলেই মেদিনীপুরে উপস্থিত হইতে পারিব, মনে এরূপ আশা হইতে লাগিল।
“যে দিবস আমাদিগের সেইরূপ অবস্থা হয়, সেইদিবস দিবা দ্বিপ্রহরের সময় আমরা একটি চটীতে গিয়া উপস্থিত হই। আমরা সকলেই ক্ষুধায় ও তৃষ্ণায় অতিশয় অস্থির হইয়াছিলাম; সুতরাং সেইস্থানে পাকাদি করিতে আর আমাদিগের ইচ্ছা হইল না। চটীর দোকান হইতে চিড়া গুড় ক্রয় করিলাম, দধিও সেইস্থানে পাইলাম। সেইস্থানে সকলে উদর পূরিয়া ফলার করিলাম। ফলার করিতে করিতে ক্রমে শরীর অবসন্ন হইয়া আসিতে লাগিল ও পরিশেষে ক্রমে চৈতন্য শূন্য হইয়া পড়িলাম। তাহার পর আমাদিগের দশা যে কি হইয়াছিল, তাহার কিছুই বলিতে পারি না। যখন জ্ঞান হইল, তখন দেখিলাম, আমরা মেদিনীপুর হাসপাতালে রহিয়াছি। শুনিলাম, যে সকল অলঙ্কার আমার নিকট ঝোলার ভিতর ছিল, তাহা ঝোলা সহিতই পাওয়া যায় নাই।”
জমাদারের এই কয়েকটি কথা শ্রবণ করিয়া, তাহাকে নিম্নলিখিত দুই চারিটি প্রশ্ন করিতে হইল :—
প্রশ্ন। তোমার যে সকল দ্রব্যের সহিত ফলার করিয়াছিলে বলিলে, তাহার সমস্ত দ্রব্যই চটীর সেই দোকানদারের নিকটে পাইয়াছিলে কি?
উত্তর। হাঁ, সেইস্থানেই সমস্ত দ্রব্য পাইয়াছিলাম।
প্রশ্ন। তোমরা যে চিড়া খরিদ করিয়াছিলে, তাহা দোকানদার কোথা হইতে দিয়াছিল?
উত্তর। একটি চাঙ্গারিতে অনেক চিড়া ছিল, তাহারই ভিতর হইতে সে আমাদিগকে প্রদান করিয়াছিল। প্রশ্ন। গুড় কোথা হইতে দিয়াছিল?
উত্তর। হাঁড়ীর ভিতরস্থিত অনেক গুড়ের ভিতর হইতে সে আমাদিগকে গুড় বাহির করিয়া দিয়াছিল।
প্রশ্ন। লবণ ব্যবহার করিয়াছিলে কি? যদি করিয়া থাক, তাহা হইলে উহাই বা কোথা হইতে আসিয়াছিল? উত্তর। লবণ লইয়াছিলাম। মুদি উহা দিয়াছিল। কোথা হইতে আনিয়াছিল, তাহা দেখি নাই।
প্রশ্ন। দধি কোথা হইতে দিয়াছিল?
উত্তর। মুদি দধি দেয় নাই; সেই দোকানের নিকট এক ব্যক্তি বসিয়া দধি বিক্রয় করিতেছিল, তাহারই নিকট হইতে উহা ক্রয় করা হইয়াছিল।
প্রশ্ন। কে ক্রয় করিয়াছিল?
উত্তর। আমার এই কনষ্টেবল গিয়া ক্রয় করিয়া আনে।
প্রশ্ন। তাহার নিকট কি পরিমাণ দধি ছিল, আর তোমরাই বা কি পরিমাণ ক্রয় করিয়া আনিয়াছিলে?
উত্তর। উহার নিকট দধি অধিক ছিল না, কেবল এক হাঁড়ী ছিল, তাহার সমস্তই আমরা ক্রয় করিয়া লইয়াছিলাম। প্রশ্ন। দধি কি সকলেই আহার করিয়াছিল?
উত্তর। হাঁ মহাশয়! আমরা সকলে মিলিয়া সেই দধি খাইয়াছিলাম।
প্রশ্ন। যে হাঁড়ীতে দধি ছিল বলিলে, সে হাঁড়ী কি হইল বলিতে পার?
উত্তরে দারোগা কহিলেন, “দধির হাঁড়ী এবং ভোজনাবশিষ্ট যাহা কিছু ছিল, তাহা সমস্ত থানায় রক্ষিত আছে।”
প্রশ্ন। যে দধি বেচিতেছিল, সে তোমাদিগের নিকট হইতে দাম লইয়াই তৎক্ষণাৎ চলিয়া গিয়াছিল, কি সেই স্থানেই অপেক্ষা করিতেছিল?
উত্তর। যখন সেই দধির দাম স্থির করা হয়, সে সময়ে উহা উত্তম বলিয়া আমাদিগের বোধ না হওয়ায় সে যে দাম চাহিতেছিল, আমরা তাহা অপেক্ষা কম দাম দিতে চাহি। সে কিন্তু কম দাম লইতে সম্মত না হইয়া কহে “আপনারা অগ্রে এই দধি খাইয়া দেখুন, যদি ভাল হয় তাহা হইলে পূরা দাম লইব, মন্দ হয় ত আপনাদিগের কথা মত দাম দিবেন।” আমরাও তাহার প্রস্তাবে সম্মত হইয়া আহারে প্রবৃত্ত হইলাম, সে সেইস্থানেই বসিয়া রহিল। পরিশেষে তাহার মূল্য আর আমরা দিতে পারিলাম না। কারণ ক্রমে আমরা সকলেই অজ্ঞান হইয়া পড়িলাম।
প্রশ্ন। যাহার নিকট হইতে তোমরা দধি ক্রয় করিয়াছিলে তাহাকে পুনরায় দেখিলে চিনিতে পারিবে?
উত্তর। হাঁ মহাশয়! উত্তমরূপে চিনিতে পারিব।
জমাদারের নিকট হইতে এই সকল বিষয় অবগত হইয়া কনষ্টেবল প্রভৃতি অপরাপর ব্যক্তিগণকে জিজ্ঞাসা করিলাম। তাহারাও ঐ প্রকার কহিল। এখন তাহাদিগকে লইয়া যে স্থানে উহারা অজ্ঞান হইয়া পড়িয়াছিল, সেইস্থানে গমন পূৰ্ব্বক অনুসন্ধান করাই স্থির করিলাম। সুতরাং উহাদিগের সকলকে সমভিব্যাহারে লইয়া দারোগা ও আমি সেই চটী অভিমুখে প্রস্থান করিলাম।
একাদশ পরিচ্ছেদ
জমাদার সেই চটী আমাদিগকে দেখাইয়া দিল। চটীর দোকানদারের নাম কেবলকৃষ্ণ দাস। কেবল সেইস্থানে একাকীই থাকে, তাহার দোকানে আর কেহই থাকে না। জমাদার প্রভৃতিকে দেখিয়া কেবলকৃষ্ণ চিনিতে পারিল। সে উহাদিগের নিকট যাহা যাহা বিক্রয় করিয়াছিল, তাহা সমস্ত স্বীকার করিল। চিড়ার চাঙ্গারি বাহির করিয়া দিল, গুড়ের হাঁড়ী আনিয়া সম্মুখে রাখিল। দধির কথা জিজ্ঞাসা করায় কহিল, নিধিরাম ঘোষ উহাদিগের নিকট দধি বিক্রয় করিয়াছিল। নিধিরাম ঘোষ কোন গ্রামে বাস করে, তাহা যদিও বলিতে পারিল না, তথাপি ইহা কহিল, নিধিরাম কোন দূরবর্তী স্থানে থাকে না; নিকটবর্ত্তী কোন গ্রামে তাহার বাসস্থান। সে প্রায়ই এইরূপে দধি দুগ্ধ প্রভৃতি বিক্রয় করিতে আইসে।
কেবলের এই কথা শ্রবণ করিয়া নিকটবর্তী গ্রাম সমূহে নিধিরামের সবিশেষ অনুসন্ধান করিলাম; কিন্তু কোনস্থানে তাহার কোন প্রকার সন্ধান প্রাপ্ত হইলাম না। সেই চিড়া, গুড় প্রভৃতি যাহা সেই মুদির নিকট ছিল, এবং দধির হাঁড়ী প্রভৃতি যাহা থানায় ছিল, তাহা হইতে কিছু কিছু কলিকাতার কেমিকেল এক্জামিনারের নিকট পাঠান হইল। আমরা কিন্তু নিধিরামের সন্ধানেই নিযুক্ত রহিলাম। কারণ, আমাদিগের মনে দৃঢ় বিশ্বাস হইল যে, নিধিরামই দধির সহিত ধুতুরা মিশ্রিত করিয়া ইহাদিগকে খাওয়াইয়াছে, পরিশেষে ইহারা অজ্ঞান হইয়া পড়িলে, সমস্ত দ্রব্যাদি অপহরণ করিয়া প্রস্থান করিয়াছে।
প্রায় সাত আট দিবস ধরিয়া নিধিরামের অনুসন্ধান করিলাম, কিন্তু তাহার কোন প্রকার সন্ধান পাইলাম না। এদিকে কলিকাতা হইতে সংবাদ আসিল, “পরীক্ষা দ্বারা জানা গিয়াছে যে, দধির সহিত অধিক ধুতুরা মিশ্রিত আছে। চিড়া, গুড় বা লবণে কিছুই পাওয়া যায় নাই; কিন্তু ভোজনাবশিষ্ট ফলারের মধ্যে ধুতুরার চূর্ণ পাওয়া গিয়াছে।”
এই সংবাদ পাইয়া তখন যাহাতে নিধিরামকে পাওয়া যায়, তাহারই চেষ্টা প্রাণপণে করিতে লাগিলাম; কিন্তু কেহই তাহার কোন প্রকার সন্ধান প্রদান করিতে সমর্থ হইল না। এইরূপে আরও কয়েক দিবস অতীত হইয়া গেল, এমন সময় একদিবস দেখিলাম, দধির ভার স্কন্ধে করিয়া নিধিরাম সেইস্থানে আপনি আসিয়া উপস্থিত হইল। দোকানদার তাহাকে চিনিল। জমাদার প্রভৃতি সকলেই কহিল, “এই ব্যক্তিই আমাদিগের নিকট দধি বিক্রয় করিয়াছিল।”
নিধিরাম ধৃত হইলে, তাহার দধির ভার সেইস্থানে পড়িয়া রহিল। তাহাকে লইয়া আমরা তাহার গ্রামে গেলাম। এইস্থান ঘটনা-স্থান হইতে প্রায় পনর ক্রোশ ব্যবহিত। উহার বাটীতে রীতিমত খানা—তল্লাসি করিলাম, বাক্স, পেট্রা খুলিয়া দেখিলাম, ঘর উঠানাদি খনন করিয়া দেখিলাম, কিন্তু কোনস্থানে চোরা-দ্রব্যের কোন সন্ধানই হইল না।
নিধিরাম কিন্তু উহাদিগের নিকট দধি বিক্রয় করিবার কথা স্বীকার করিল; তবে উহার ভিতর কিরূপে ধুতুরা চূর্ণ আসিল, তাহার কিছুই বলিল না। দধির মূল্য-সম্বন্ধে কহিল, “ইহারা ফলার করিয়া যখন ক্রমে ক্রমে সকলে শয়ন করিল, তখন ইহাদিগের একজন সঙ্গী আমার দাম চুকাইয়া দিল। আমি আমার দাম লইয়া প্রস্থান করিলাম। তাহার পর আমার পায়ে বেদনা হওয়ায়, আর আমি এখানে আগমন করি নাই। “
জমাদার প্রভৃতি সকলকে দেখান হইল, সকলকে দেখিয়া নিধিরাম কহিল, “যে ব্যক্তি আমাকে দধির দাম দিয়াছিল, সেই ব্যক্তি ইহার মধ্যে নাই।” জমাদার প্রভৃতিকে জিজ্ঞাসা করায়, তাহাদিগের সঙ্গে অপর যে আর কেহ ছিল, তাহা কেহ বলিতে পারিল না। আমরা মনে করিলাম, নিধিরাম বাঁচিবার নিমিত্ত কতকগুলি মিথ্যা কথা কহিয়া আমাদিগকে প্রতারিত করিবার চেষ্টা করিতেছে।
নিধিরামের গ্রাম হইতে পুনরায় আমরা সেই ঘটনা স্থানে গিয়া উপস্থিত হইলাম। সেই দোকানদারকে জিজ্ঞাসা করায় সেও কতক পরিমাণে নিধিরামের পক্ষ সমর্থন করিল দেখিলাম। সেও কহিল, ইহাদিগের সহিত আর এক ব্যক্তি ছিল। দোকানদারের কথা শুনিয়া তাহারও উপর একটু সন্দেহ হইতে লাগিল। মনে করিলাম, নিধিরাম ও দোকানদার একত্র হইয়া এই কার্য্য সমাপন করিয়াছে বলিয়া, দোকানদার নিধিরামের পক্ষ সমর্থন পূৰ্ব্বক যাহাতে তাহাকে বাঁচাইতে পারে, তাহারই চেষ্টা করিতেছে।
আমরা যখন এইরূপ ভাবিতেছি, তখন পরাণের মা কহিল, “মহাশয়! আমার বোধ হয়, ইহারা সত্য কথা কহিতেছে। কারণ, এখন আমার বেশ মনে হইতেছে, যখন আমরা এখানে আগমন করি, সেই সময় আমাদিগের সঙ্গে সঙ্গে একটি লোক আসিয়াছিল। সে যদিও আমাদিগের সঙ্গী নহে, কিন্তু প্রায় পাঁচ ছয় ক্রোশ পথ সে আমাদিগের সঙ্গে আগমন করিয়াছিল।”
পরাণের মা’র কথা শ্রবণ করিয়া, সে কথা সকলের মনে পড়িল। তখন সকলেই কহিল, “হাঁ মহাশয়! সত্যই এক ব্যক্তি মেদিনীপুরের দিকে আমাদিগের সহিত আসিয়াছিল। পথে সে আমাদিগের নানারূপ সাহায্য করিবার চেষ্টা করিয়াছিল, এবং ফলার করিবার সময়ে সেই ব্যক্তি স্বহস্তে আমাদিগের সকলকেই দধি প্রদান করিয়াছিল। তাহাদের কিন্তু ফলার করিতে বা আমাদের সঙ্গ ছাড়িয়া যাইতে আমরা দেখি নাই।”
দোকানদারকে জিজ্ঞাসা করায় উক্ত লোক-সম্বন্ধে সে আর সবিশেষ কোন কথা বলিতে পারিল না।
জমাদার তখন ক্ষণেক চিন্তা করিয়া কহিল, “মহাশয় আমার বোধ হয়, তাহার নাম রামজীবন।”
প্রশ্ন। তুমি কি প্রকারে জানিলে যে, তাহার নাম রামজীবন? সে কি তোমাকে তাহার প্রকৃত নাম বলিয়াছে মনে কর?
উত্তর। আমি তাহার নাম জিজ্ঞাসা করি নাই, বা সেও আমাকে তাহার নাম বলে নাই বটে; কিন্তু যখন আমরা মেদিনীপুরের পথে গমন করিতেছিলাম, তখন সেও আমাদিগের পশ্চাৎ পশ্চাৎ আসিতেছিল। সেই পথের ধারে একস্থানে কয়েকজন কৃষক জমীতে চাষ দিতেছিল, তাহাদিগের মধ্যে একজন উহাকে ‘রামজীবন’ বলিয়া ডাকিয়াছিল, তাহাতেই আমার বোধ হয়, তাহার নাম রামজীবন।
প্রশ্ন। যেস্থানে কৃষকগণ চাষ দিতেছিল, তোমরা সেইস্থান দেখাইয়া দিতে পারিবে?
উত্তর। বোধ হয় পারিলেও পারিতে পারি।
তখন আর কালবিলম্ব না করিয়া আমরা সকলেই চলিতে লাগিলাম। প্রায় চারি ক্রোশ পথ গমন করিলে একস্থান দেখাইয়া দিয়া জমাদার এবং অন্যান্য সকলে কহিল, “বোধ হয় এইস্থানে সেই কৃষকগণ জমীতে চাস দিতেছিল।”
ময়দানের কৃষকগণের নিকট অনুসন্ধান করিয়া অবগত হইলাম, কথিত দিবসে কোন্ কোন্ ব্যক্তি সেই জমীতে চাস দিতেছিল।
গ্রামের ভিতর গমন করিয়া সেই চাষীগণের সকলকেই একত্র করিলে, তাহাদিগের মধ্যে হলধর দাস জমাদারের কথা সমর্থন করিল ও বলিয়া দিল, রামজীবনের বাড়ী গোবিন্দপুরে। গোবিন্দপুর সেইস্থান হইতে তিন চারি ক্রোশ মাত্র ব্যবহিত। গোবিন্দপুরে গমন করিয়া সহজেই রামজীবনকে পাওয়া গেল। সে প্রথমে গহনার কথা অস্বীকার করিল; কিন্তু পরিশেষে যে কারণেই হউক, সমস্ত কথা স্বীকার করিল, এবং যে স্থানে অলঙ্কারগুলি পুতিয়া রাখিয়াছিল, সেইস্থান হইতে সমস্ত গুলিই বাহির করিয়া দিল। তালিকার সহিত মিলাইয়া দেখিলাম, সমস্তই ঠিক মিলিয়া গেল, কেবল এক জোড়া সোণার বালা পাওয়া গেল না, বালা-সম্বন্ধেও রামজীবন স্বীকার করিল ও কহিল যে, সে একজন অপরিচিত লোকের নিকট উহা বিক্রয় করিয়া টাকাগুলি খরচ করিয়া ফেলিয়াছে।
রামজীবনের বিষ খাওয়ান মোকদ্দমার বিচার মেদিনীপুরে হইল। তাহাতে জমাদার, কনষ্টেবল এবং আমার আসামীদ্বয়েরা সাক্ষী হইল। বিচারে রামজীবন কঠিন পরিশ্রমের সহিত সাত বৎসরের জন্য জেলে গমন করিল। এই মোকদ্দমা শেষ হইয়া গেলে, হরি ও পরাণের মা’কে সেই সকল অলঙ্কারের সহিত কলিকাতায় আনয়ন করিলাম।
এখানে উভয়েই মাজিষ্ট্রেট সাহেবের নিকট আসামী শ্রেণীতে প্রেরিত হইল। বিচারে পরাণের মা ছয় মাস ও হরি এক বৎসরের নিমিত্ত জেলে গমন করিল। এই সকল গোলযোগে পরাণের আর কোনরূপ সন্ধান করিতে সমর্থ হইলাম না।
অলঙ্কারগুলি বামা প্রাপ্ত হইল। রমণদাসের উহার তাহার যে একটু সন্দেহ হইয়াছিল, তাহা মিটিয়া গেল। এই ঘটনায় প্রায় দুই মাস পরে বামা বৈষ্ণবধর্ম্ম গ্রহণপূর্ব্বক রমণদাসের পদসেবায় নিযুক্তা হইল। উভয়েই এখন স্ত্রী—পুরুষের মত রমণদাস বাবাজীর সেই বাড়ীতেই বাস করিতেছে।
[আষাঢ়, ১৩০০ ]