চোখ
তার চোখদুটো আমায় অভিভূত করে দিয়েছিল। শুধু চোখ দুটো!
অন্ধকারে লোকে যেমন সবার আগে হেডলাইট দেখতে পায়, তার চোখদুটোও তেমনি সবকিছু ছাপিয়ে চোখে পড়ছিল।
ভাববেন না যে চোখদুটো খুব সুন্দর ছিল। একেবারেই না। আমি ভালো-খারাপের মধ্যে দিব্যি পার্থক্য করতে পারি। সেই চোখ আদৌ সুন্দর ছিল না, কিন্তু তাতে কী একটা যেন আকর্ষণ ছিল!
সেই চোখের সঙ্গে আমার দেখা এক হাসপাতালে। নাম বলছি না। কারণ হাসপাতালের নামের সঙ্গে এই গল্পের কোনো সম্পর্ক নেই।
এটুকু বলাই যথেষ্ট যে সেই হাসপাতালে আমি গেছিলাম আমার এক বন্ধুকে দেখতে। বন্ধু তখন মৃত্যুশয্যায়।
এমনিতে সেবা-শুশ্রূষা করা, মিথ্যে আশা বা সান্ত্বনা দেওয়া এসব আমার দ্বারা হয় না। স্ত্রী হুড়ো দেওয়ায় শেষমেশ আমায় হাসপাতাল যেতে হয়েছিল; মৃত্যুপথযাত্রী বন্ধুকে আমার ভালোবাসার প্রমাণ দেখাতে।
বিশ্বাস করুন, হাসপাতালে যেতে আমার বিশ্রী লাগে। কেন, তা ঠিক জানি না। একটা কারণ অবশ্য হতে পারে। একবার বোম্বাইতে আমার বুড়ি মাকে কব্জির চোটের জন্য দেখাতে গিয়ে জে জে হাসপাতালের ক্যাসুয়ালটিতে পাক্কা আড়াই ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয়েছিল। সেই সময় যে ক’জন লোকের সঙ্গে দেখা হয়েছিল, সবাই যেন লোহার তৈরি! ঠান্ডা, সংবেদনহীন!
যাই হোক, যে চোখদুটোর কথা বলছিলাম।
পছন্দ অপছন্দ খুবই ব্যক্তিগত ব্যাপার। হতে পারে আপনারা ওই চোখদুটো দেখে মোটেই আকৃষ্ট হতেন না। বা হতে পারে আপনারা বলতেন, ‘বিচ্ছিরি চোখ!’
কিন্তু আমি যখন মেয়েটাকে দেখেছিলাম, শুধু চোখদুটোই নজরে পড়েছিল।
সে বোরখা পরে ছিল। মুখ অনাচ্ছাদিত। ডানহাতে খালি বোতল। বাঁ-হাতে একটা ছোট ছেলের হাত ধরে সে জেনারেল ওয়ার্ডের বারান্দা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল।
তার চোখ দেখে আমি থমকে দাঁড়ালাম। সেই চোখদুটো! না বড় না ছোট, না কালো না বাদামি, না নীল না সবুজ—চোখদুটো যেন আমায় টেনে ধরল! সেও দাঁড়িয়ে পড়ল। তারপর সঙ্গের ছেলেটাকে ঘাবড়ে যাওয়া গলায় বলল, ‘হাঁটতে পারো না ঠিক করে?’
ছেলেটা হাত ছাড়িয়ে বিরক্তির সঙ্গে উত্তর দিল, ‘হাঁটছি তো!…অন্ধের মতো কথা যত!’
শুনে আমি চোখদুটোর দিকে আবার তাকালাম। তার সমস্ত অস্তিত্বের মধ্যে শুধু চোখদুটোই আমায় টানছিল।
আমি এগিয়ে তার কাছে গেলাম।
সে নিষ্পলক চোখে আমার দিকে তাকিয়ে জিগ্যেস করল, ‘এক্স-রে করতে কোনওদিকে যেতে হবে?’
কাকতালীয়ভাবে ওই সময় এক্স-রে ডিপার্টমেন্টে আমার এক বন্ধু কাজ করত। আমি আমার অসুস্থ বন্ধুর ব্যাপারে কথা বলতে তার কাছেই যাচ্ছিলাম। আমি মেয়েটাকে বললাম, ‘চলো, আমি নিয়ে যাচ্ছি…আমিও সেখানেই যাচ্ছি।’
মেয়েটা ছেলেটার হাত ধরে আমার সঙ্গে এগোতে লাগল।
এক্স-রে ডিপার্টমেন্টে পৌঁছে আমি অফিসে ডাঃ সাদিকের খোঁজ করলাম। শুনলাম সে ভিতরে স্ক্রিনিং করছে।
দরজা বন্ধ ছিল। কড়া নাড়লাম। ভিতর থেকে জোর গলায় ভেসে এল, ‘কে?…দরজায় ধাক্কা দেবেন না।’
আমি আবার দরজা ধাক্কালাম।
দরজা খুলল। ডাঃ সাদিক গাল দিতে গিয়ে আমায় দেখে থেমে গেল ‘ওঃ! তুমি!’
‘হ্যাঁ ভাই! তোমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলাম। তোমার অফিসে গিয়ে শুনলাম তুমি এখানে।’
‘ভিতরে এসো।’
আমি মেয়েটাকে বললাম, ‘এসো। ছেলেটাকে বাইরেই থাকতে দাও।’
ডাঃ সাদিক ফিসফিস করে আমায় জিগ্যেস করল, ‘ইনি কে?’
‘জানি না…এক্স-রে ডিপার্টমেন্ট খুঁজছিলেন। আমি বললাম, চলো আমি নিয়ে যাচ্ছি।’
ডাঃ সাদিক দরজাটা আরেকটু খুলল। আমি মেয়েটাকে সঙ্গে নিয়ে ভিতরে ঢুকলাম।
ভিতরে চার-পাঁচজন রোগী বসেছিল। ডাঃ সাদিক তাড়াতাড়ি স্ক্রিনিং করে তাদের ছেড়ে দিল।
ঘরে তখন শুধু তিনজন—ডাঃ সাদিক, আমি আর সেই মেয়েটা।
ডাঃ সাদিক আমায় জিগ্যেস করল, ‘কী সমস্যা?’
আমি মেয়েটার দিকে তাকালাম, ‘কী সমস্যা তোমার? এক্স-রে করতে কোন ডাক্তার বলেছে?’
অন্ধকার ঘরে আমার দিকে তাকিয়ে সে উত্তর দিল, ‘তা তো জানি না!…আমাদের পাড়ায় একজন ডাক্তারবাবু আছেন…তিনি বলেছেন এক্স-রে করিয়ে আসতে।’
ডাঃ সাদিক তাকে মেশিনের দিকে এগোতে বলল। এগোতে গিয়ে সে জোর একটা ধাক্কা খেল।
ডাঃ সাদিক ব্যস্ত হয়ে বলে উঠল, ‘লাগল নাকি!…আরে!…এরকমভাবে কেউ হাঁটে! দেখবে না সামনে কী আছে!’
মেয়েটা চুপচাপ মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে রইল।
ডাক্তার এগিয়ে গিয়ে তার বোরখা আর ওড়না খুলে একপাশে রেখে দিল। তারপর তার কাঁধ ধরে তাকে স্ক্রিনের পিছনে দাঁড় করিয়ে দিল। সুইচ অন করতেই স্ক্রিনে আলো জ্বলে উঠল। স্ক্রিনে মেয়েটার পাঁজর দেখতে পেলাম। পাঁজরের ফাঁক দিয়ে কালো ছোপের মতো উঁকি মারছে হৃৎপিণ্ড।
ডাক্তার পাঁচ ছ’মিনিট ধরে স্ক্রিনটাকে উপরে নীচে, ডানদিকে বাঁদিকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে কী যেন দেখতে থাকল। তারপর সুইচ অফ করে দিল।
মেয়েটা স্ক্রিনের পিছনে দাঁড়িয়েই থাকল। ডাক্তার তাকে আবার কাঁধ ধরে সেখান থেকে বের করে এনে বলল, ‘বুক একদম পরিষ্কার। কোনো চিন্তা নেই।’
সে কী বুঝল কে জানে! হঠাৎ করে দু’হাত দিয়ে নিজেকে ঢেকে অন্ধকারে এদিক-ওদিক চাইতে লাগল। আমি হাত বাড়িয়ে বোরখাটা তুলে তার হাতে দিলাম।
ডাঃ সাদিক একটা কাগজে রিপোর্ট লিখতে লিখতে জিগ্যেস করল, ‘তোমার নাম কী?’
মেয়েটা বোরখা পরতে পরতে বলল, ‘জি…আমার নাম হানীফা।’
‘হানীফা…’, ডাঃ সাদিক কাগজে তার নাম লিখে তাকে ধরিয়ে দিল, ‘যাও, তোমার ডাক্তারবাবুকে রিপোর্ট দেখাও।’
সে কাগজটা নিয়ে বোরখার নীচ দিয়ে জামার ভিতরে ঢুকিয়ে নিল।
আমি তার হাত ধরে বললাম, ‘চলো।’
ঘর থেকে বেরিয়ে এসে সে ছোট ছেলেটার সঙ্গে হাঁটতে শুরু করল।
আমি কিছুক্ষণ পাথরের মতো দাঁড়িয়ে রইলাম। বুঝতে পারছিলাম না এবার কী করা উচিত! শেষে উচিত অনুচিত শিকেয় তুলে তাদের পিছন পিছন এগোতে লাগলাম।
আমি জানতাম যে ডাঃ সাদিক নিশ্চিত ভেবেছে, আমার আর মেয়েটার মধ্যে কোনো ব্যাপার আছে! কিন্তু আপনারা সত্যিটা জানেন। ব্যাপার বলতে, আমি তার চোখ দুটোর প্রেমে পড়েছিলাম। ব্যস!
সে ছেলেটার হাত ধরে হাঁটছিল। আমি পিছনে।
হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে টাঙ্গার স্ট্যান্ডে পৌঁছে আমি তাদের কাছে এগিয়ে গিয়ে জিগ্যেস করলাম, ‘কোথায় যাবে?’
সে একটা গলির নাম বলল।
আমি মিথ্যে বললাম, ‘ও! আমিও তো ওদিকেই যাচ্ছি!…চলো তোমায় নামিয়ে দিচ্ছি।’
আমি তার কোমর ধরে তাকে টাঙ্গায় বসিয়ে দিলাম। মনে হল যেন আমার চোখ এক্স-রে মেশিনের মতো তার কাঠামোটা দেখতে পাচ্ছে! বাকি শরীর নয়, শুধু তার চোখ! প্রাণবন্ত, অদ্ভুত সেই চোখ!
ইচ্ছা করছিল তার সঙ্গে বসতে। কিন্তু খারাপ দেখাবে বলে ছেলেটাকে তার পাশে বসিয়ে আমি নিজে পিছনে গিয়ে বসলাম।
টাঙ্গা চলতে শুরু করলে সে জিগ্যেস করল, ‘তুমি কে?’
‘আমি!…আমার নাম সাদত হাসান মান্টো।’
‘মান…টো!…মান-টো কী?!’
‘একটা কাশ্মীরি জাত।’
‘ও!…আমরাও কাশ্মীরি!’
‘তাই?’
‘আমরা কুঙ্গ জাত।’
‘ও বাবা!…সে তো খুব উঁচু জাত!’
সে হাসল। তার চোখদুটো যেন আরো উজ্জ্বল হয়ে উঠল।
আমি জীবনে অনেক সুন্দর চোখ দেখেছি। কিন্তু হানীফার চোখের মতো আকর্ষণ কেউ করেনি। জানি না তার চোখে এমন কী ছিল! আগেই বলেছি যে এমন কিছু সুন্দর না! কিন্তু আমার মনে একটা অদ্ভুত দাগ কেটে গেছিল!
আমি সাহস করে তার মুখের উপর থেকে চুলের গোছা আলতো করে সরিয়ে দিলাম। সে কিছু বলল না।
আমি আরো একটু সাহস করে তার হাত দুটো ধরলাম।
সে বাধা দিল না। পাশের ছেলেটার দিকে তাকিয়ে জিগ্যেস করল, ‘আমার হাত টিপছ কেন?’
আমি সঙ্গে সঙ্গে তার হাত ছেড়ে দিলাম। ছেলেটাকে জিগ্যেস করলাম, ‘তোমাদের বাড়ি কোথায়?’
ছেলেটা হাত দিয়ে দেখাল, ‘ওই বাজারের পরের গলিটায়।’
টাঙ্গা সেদিকে ফিরল।
বাজারে ভীষণ ভিড়! টাঙ্গা থেমে থেমে চলছিল। রাস্তায় বড় বড় খানাখন্দ। জোর ঝাঁকুনি খাচ্ছিলাম।
বারবার তার মাথা আমার কাঁধে ধাক্কা খাচ্ছিল। ইচ্ছা করছিল তার মাথাটা আমার কোলে রেখে তার চোখদুটো দেখতে থাকি।
একটু পরে তাদের গলিতে পৌঁছে গেলাম। ছেলেটা টাঙ্গা থামাল।
টাঙ্গা থামতে সে নেমে গেল।
মেয়েটা বসেই ছিল। আমি বললাম, ‘তোমার বাড়ি এসে গেছে!’
সে আমার দিকে ফিরল, ‘বদ্রু কই?’
‘বদ্রু কে?’
‘আমার সঙ্গের ছোট ছেলেটা!’
আমি ছেলেটার দিকে তাকালাম। সে নেমে কোচোয়ানের পাশেই দাঁড়িয়েছিল। আমি বললাম, ‘ওই তো!’
‘আচ্ছা।’ সে ডাকল, ‘বদ্রু, আমায় নামাও তো।’
ছেলেটা তার হাত ধরে কষ্টেসৃষ্টে তাকে নামাল।
আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছিলাম! ছেলেটাকে জিগ্যেস করলাম, ‘কী হল ব্যাপারটা?…নিজে নামতে পারে না?’
সে জবাব দিল, ‘জি না…! ও চোখে দেখতে পায় না…ও অন্ধ।’