ভোর ছটায় কেউ কলিং বেল টিপতে থাকলে মেজাজ বিগড়ে যাবার কথা। মিসির আলির মেজাজ তেমন বিগড়াল না। সকাল দশটা পর্যন্ত কেন জানি তাঁর মেজাজ বেশ ভালো থাকে। দশটা থেকে খারাপ হতে থাকে, চূড়ান্ত রকমের খারাপ হয় দুটার দিকে। তারপর আবার ভালো হতে থাকে। সন্ধ্যার দিকে অসম্ভব ভালো থাকে, তারপর আবার খারাপ হতে শুরু করে। ব্যাপারটা শুধু তাঁর বেলায় ঘটে, না সবার বেলায়ই ঘটে, তা তিনি জানেন না। প্রায়ই ভাবেন। একে-ওকে জিজ্ঞেস করবেন-শেষ পর্যন্ত জিজ্ঞেস করা হয়ে ওঠে না। তাঁর চরিত্রের বড় রকমের দুর্বল দিক হচ্ছে পরিচিত কারো সঙ্গে কথা বলতে ভালো লাগে না। অপরিচিত মানুষদের সঙ্গে দীর্ঘ সময় কথা বলতে পারেন, কথা বলতে ভালোও লাগে। সেদিন রিকশা করে আসতেআসতে রিকশাওয়ালার সঙ্গে অতি উচ্চ শ্রেণীর কিছু কথাবার্তা চালিয়ে গেলেন।
রিকশাওয়ালার বক্তব্য হচ্ছে—পৃথিবীতে যত অশান্তি সবের মূলে আছে মেয়েছেলে।
মিসির আলি বললেন, এই রকম মনে হওয়ার কারণ কি?
রিকশাওয়ালা অত্যন্ত উৎসাহের সঙ্গে বলল, চাচামিয়া, এই দেহেন আমারে। আইজ আমি রিকশা চালাই। এর কারণ কি? এর কারণ বিবি হাওয়া। বিবি হাওয়া যদি কুবুদ্ধি দিয়া বাবা আদমরে গন্ধম ফল না খাওয়াইত, তা হইলে আইজ আমি থাকতাম বেহেশতে। বেহেশতে তো আর রিকশা চালানির কোনো বিষয় নাই, কি কন চাচামিয়া? গন্ধম ফল খাওয়ানির কারণেই তো আইজ আমি দুনিয়ায় আইসা পড়লাম!
মিসির আলি রিকশাওয়ালার কথাবার্তায় চমৎকৃত হলেন। পরবর্তী দশ মিনিট তিনি রিকশাওয়ালাকে যা বললেন, তার মূল কথা হল–নারীর কারণে আমরা যদি স্বর্গ থেকে বিতাড়িত হয়ে থাকি তাহলে নারীই পারে আবার আমাদের স্বর্গে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে।
রিকশাওয়ালা কী বুঝল কে জানে। তার শেষ বক্তব্য ছিল, যাই কন চাচামিয়া, মেয়েমানুষ আসলে সুবিধার জিনিস না।
কলিং বেল আবার বাজছে।
মিসির আলি বেল টেপার ধরন থেকে অনুমান করতে চেষ্টা করলেন-কে হতে পারে।
ভিখিরি হবে না। ভিখিরিরা এত ভোরে বের হয় না। ভিক্ষাবৃত্তি যাদের পেশা তারা পরিশ্রান্ত হয়ে গভীর রাতে ঘুমুতে যায়, ঘুম ভাঙতে সেই কারণেই দেরি হয়। পরিচিত কেউ হবে না। পরিচিতরা এত ভোরে আসবে না। তাঁকে ঘুম থেকে ডেকে তুলতে পারে এমন ঘনিষ্ঠতা তাঁর কারো সঙ্গেই নেই।
যে এসেছে, সে অপরিচিত। অবশ্যই মহিলা। পুরুষরা কলিং বেলের বোতাম অনেকক্ষণ চেপে ধরে থাকে। মেয়েরা তা পারে না। মেয়েটির বয়স অল্প তাও অনুমান করা যাচ্ছে। অল্পবয়স্ক মেয়েদের মধ্যে এক ধরনের ছটফটে ভাব থাকে। তারা অল্পসময়ের মধ্যে কয়েক বার বেল টিপবে। নিজেদের অস্থিরতা ছড়িয়ে দেবে কলিং বেলে।
মিসির আলি পাঞ্জাবি গায়ে দিয়ে দরজা খুললেন। বিস্মিত হয়ে দেখলেন, তাঁর অনুমান সম্পূর্ণ ভূল প্রমাণ করে মাঝবয়সী এক ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে আছেন। বেঁটেখাটো একজন মানুষ। গায়ে সাফারি। চোখে সানগ্লাস। এত ভোরে কেউ সানগ্লাস পরে না। এই লোকটি কোন পরেছে কে জানে!
স্যার, স্নামালিকুম।
ওয়ালাইকুম সালাম।
আপনার নাম কি মিসির আলি?
জ্বি।
আমি কি আপনার সঙ্গে খানিকক্ষণ কথা বলতে পারি?
মিসির আলি কী বলবেন মনস্থির করতে পারলেন না। লোকটিকে তিনি পছন্দ করছেন না, তবে তার মধ্যে এক ধরনের আত্মবিশ্বাস লক্ষ করছেন-যা তাঁর ভালো লাগছে। আত্মবিশ্বাসের ব্যাপারটা আজকাল আর দেখাই যায় না।
লোকটি শান্ত গলায় বলল, আমি আপনার কিছুটা সময় নষ্ট করব ঠিকই।–তবে তার জন্যে আমি পে করব।
পে করবেন?
জ্বি। প্রতি ঘন্টায় আমি আপনাকে এক হাজার করে টাকা দেব। আশা করি আপনি আপত্তি করবেন না। আমি কি ভেতরে আসতে পারি?
আসুন।
লোকটি ভেতরে ঢুকতে-ঢুকতে বলল, মনে হচ্ছে আপনার এখনো হাত-মুখ ধোয়া হয় নি। আপনি হাত-মুখ ধুয়ে আসুন, আমি অপেক্ষা করছি।
মিসির আলি বললেন, ঘন্টা হিসেবে আপনি যে আমাকে টাকা দেবেন—সেই হিসেবে কি এখন থেকে শুরু হবে? নাকি হাত-মুখ ধুয়ে আপনার সামনে বসার পর থেকে শুরু হবে?
লোকটি খানিকটা অপ্ৰস্তুত হয়ে বলল, টাকার কথায় আপনি কি রাগ করেছেন?
রাগ করি নি, মজা পেয়েছি। চা খাবেন?
খেতে পারি। দুধ ছাড়া।
মিসির আলি স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বললেন, এক কাজ করুন।–রান্নাঘরে চলে যান। কেতলি বসিয়ে দিন। দু কাপ বানান। আমাকেও এক কাপ দেবেন।
ভদ্ৰলোক হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলেন।
মিসির আলি হাসিমুখে বললেন, আমাকে ঘন্টা হিসেবে পে করবেন বলে যেভাবে হকচাকিয়ে দিয়েছিলেন, আমিও ঠিক একইভাবে আপনাকে হকচাকিয়ে দিলাম। বসুন, চা বানাতে হবে না। সাতটার সময় রাস্তার ওপাশের রেস্টুরেন্ট থেকে আমার জন্যে চা-নাশতা আসে। তখন আপনার জন্যেও চা আনিয়ে দেব।
থ্যাংক ইউ স্যার।
আপনি কথা বলার সময় বারবার বা দিকে ঘুরছেন, আমার মনে হচ্ছে আপনার বী চোখটা নষ্ট। এই জন্যেই কি কালো চশমা পরে আছেন?
ভদ্রলোক সহজ গলায় বললেন, জ্বি। আমার বা চোখটা পাথরের।
ভদ্রলোক সোফার এক কোণে বসলেন। মিসির আলি লক্ষ করলেন, লোকটি শিরদাঁড়া সোজা করে বসে আছে। চাকরির ইন্টারভ্যু দিতে এলে ক্যান্ডিডেটরা যে-ভঙ্গিতে চেয়াতে বসে অবিকল সেই ভঙ্গি। মিসির আলি বললেন, আজকের খবরের কাগজ এখনো আসে নি। গত দিনের কাগজ দিতে পুরি? যদি আপনি চোখ বোলাতে চান।
আমি খবরের কাগজ পড়ি না। এক-একা বসে থেকে আমার অভ্যাস আছে। আমার জন্যে আপনাকে ব্যস্ত হতে হবে না। শুরুতে টাকা দেওয়ার কথা বলে যদি আপনাকে আহত করে থাকি, তার জন্যে ক্ষমা প্রার্থনা করছি।
মিসির আলি টুথব্রাশ হাতে বাথরুমে ঢুকে গেলেন। লোকটিকে তাঁর বেশ ইস্টারেষ্টিং বলে মনে হচ্ছে। তবে কোনো গুরুতর সমস্যা নিয়ে এসেছে বলে মনে হয়। না। আজকাল অকারণেই কিছু লোকজন এসে তাঁকে বিরক্ত করা শুরু করেছে। মাসখানেক আগে একজন এসেছিল ভূতবিশারদ। সে নাকি গবেষণাধর্মী একটি বই লিখছে—যার নাম বাংলার ভুত। এ-দেশে যত ধরনের ভূত-পেত্নী আছে সবুর নাম, আচার-ব্যবহার বইয়ে লেখা। মেছো ভূত, গেছে ভূত, জলা ভূত, শাকচুন্নি, স্কন্ধকাটা, কুনী ভূত, কুত্তি ভূত, আঁধি ভূত সর্বমোট এক শ ছ রকমের ভূত।
মিসির আলি বিরক্ত হয়ে বলেছিলেন, ভাই, আমার কাছে কেন? আমি সারা জীবন ভূত নেই এটাই প্রমাণ করতে চেষ্টা করেছি।
সেই লোক মহা উৎসাহী হয়ে বলল, কোন কোন ভূত নেই বলে প্রমাণ করেছেন—এটা কাইন্ডলি বলুন। আমার কাছে ক্যাসেট প্লেয়ার আছে। আমি টেপ করে নেব।
সানগ্লাস-পরা বেঁটে ভদ্রলোক সেই পদের কেউ কি না কে বলবে?
তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছতে-মুছতে মিসির আলি বললেন, ভাই, বলুন কী ব্যাপার।
প্রথমেই আমার নাম বলি-এখনো আমি আপনাকে আমার নাম বলি নি। আমার নাম রাশেদুল করিম। আমেরিকার টেক্সাস এম অ্যান্ড এন বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের আমি একজন অধ্যাপক। বর্তমানে এক বছরের স্যাঘাটিক্যাল লীভে দেশে এসেছি। আপনার খোঁজ কীভাবে এবং কার কাছে পেয়েছি তা কি বলব?
তার দরকার নেই। কী জন্যে আমার খোঁজ করছেন সেটা বলুন।
আমি কি ধূমপান করতে পারি? সিগারেট খেতে-খেতে কথা বললে আমার জন্যে সুবিধা হবে। সিগারেটের ধোঁয়া এক ধরনের আড়াল সৃষ্টি করে।
আপনি সিগারেট খেতে পারেন, কোনো অসুবিধা নেই।
ছাই কোথায় ফেলব? আমি কোনো অ্যাশটে দেখতে পাচ্ছি না।
মেঝেতে ফেলুন। আমার গোটা বাড়িটাই একটা অ্যাশট্রে।
রাশেদুল করিম সিগারেট ধরিয়েই কথা বলা শুরু করলেন। তাঁর গলার স্বর ভারি এবং স্পষ্ট। কথাবার্তা খুব গোছানো। কথা শুনে মনে হয় তিনি কী বলবেন তা আগেভাগেই জানেন। কোন বাক্যটির পর কোন বাক্য বলবেন তাও ঠিক করা। যেন ক্লাসের বক্তৃতা। আগে থেকে ঠিকঠাক করা। প্রবাসী বাঙালিরা এক-নাগাড়ে বাংলায় কথা বলতে পারেন না–ইনি তা পরছেন।
আমার বয়স এই নভেম্বরে পঞ্চাশ হবে। সম্ভবত আমাকে দেখে তা বুঝতে পারছেন না। আমার মাথার চুল সব সাদা। কলপ ব্যবহার করছি গত চার বছর থেকে। আমার স্বাস্থ্য ভালো। নিয়মিত ব্যায়াম করি। মুখের চামড়ায় এখনো তাঁজ পড়ে নি। বয়সজনিত অসুখবিসুখ কোনোটাই আমার নেই। আমার ধারণা, শারীরিক এবং মানসিক দিক দিয়ে আমার কর্মক্ষমতা এখনো একজন পয়ত্রিশ বছরের যুবকের মতো। এই কথাটা বলার উদ্দেশ্য হচ্ছে, আমি বিয়ে করতে যাচ্ছি। আজ আমার গায়ে-হলুদ। মেয়েপক্ষীয়রা সকাল নটায় আসবে। আমি ঠিক আটটায় এখান থেকে যাব। আটটা পর্যন্ত সময় কি আমাকে দেবেন?
দেব। ভালো কথা, এটা নিশ্চয়ই আপনার প্রথম বিবাহ না। এর আগেও আপনি বিয়ে করেছেন?
জ্বি। এর আগে এক বার বিয়ে করেছি। এটি আমার দ্বিতীয় বিবাহ। আমি আগেও বিয়ে করেছি, তা কী করে বললেন?
আজ আপনার গায়ে-হলুদ, তা খুব সহজভাবে বললেন দেখে অনুমান করলাম। বিয়ের তীব্ৰ উত্তেজনা আপনার মধ্যে দেখতে পাই নি।
সব মানুষ তো এক রকম নয়! একেক জন একেক রকম। উত্তেজনার ব্যাপারটি আমার মধ্যে একেবারেই নেই। প্রথম বার যখন বিয়ে করি, তখনো আমার মধ্যে বিন্দুমাত্র উত্তেজনা ছিল না। সেদিনও আমি যথারীতি ক্লাসে গিয়েছি। গ্রুপ থিওরির ওপর এক ঘন্টার লেকচার দিয়েছি।
ঠিক আছে, আপনি বলে যান। রাশেদুল করিম শান্ত গলায় বললেন, আপনার ভেতর একটা প্রবণতা লক্ষ করছি—আমাকে আর দশটা মানুষের দলে ফেলে বিচার করার চেষ্টা করছেন। দয়া করে তা করবেন না। আমি আর দশ জনের মতো নাই।
আপনি শুরু করুন!
অঙ্কশাস্ত্রে এম.এ. ডিগ্ৰী নিয়ে আমি আমেরিক যাই পিএইচ. ডি. করতে। এম.এ.- তে আমার রেজাল্ট ভালো ছিল না। টেনেটুনে সেকেণ্ড ক্লাস। প্রাইভেট কলেজে চাকরি খুঁজে বেড়াচ্ছি, তখন বন্ধুদের দেখাদেখি জি.আর.ই. পরীক্ষা দিয়ে ফেললাম। জি.আর.ই. পরীক্ষা কী, তা কি আপনি জানেন? গ্যাজুয়েট রেকর্ড একজামিনেশন। আমেরিকান ইউনিভার্সিটিতে গ্রাজুয়েট ক্লাসে ভরতি হতে হলে এই পরীক্ষা দিতে হয়।
আমি জানি।
এই পরীক্ষায় আমি আশাতীত ভালো করে ফেললাম। আমেরিকান তিনটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আমার কাছে আমন্ত্রণ চলে এল। চলে গেলাম। পিএইচ ডি করলাম প্রফেসর হোবলের সঙ্গে। আমার পিএইচ. ডি. ছিল গ্রুপ থিওরির একটি শাখায়-নন এবেলিয়ান ফাংশানের ওপর। পিএইচ. ডি.-র কাজ এতই ভালো হল যে আমি রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে গেলাম। অঙ্ক নিয়ে বর্তমানকালে যাঁরা নাড়াচাড়া করেন, তাঁরা সবাই আমার নাম জানেন! অঙ্কশাস্ত্রের একটি ফাংশান আছে, যা আমার নামে পরিচিত। আর.কে. এক্সপোনেনশিয়াল। আর.কে. হচ্ছে রাশেদুল করিম।
পিএইচ. ডি.-র পরপরই আমি মন্টানা ষ্টেট ইউনিভার্সিটিতে অধ্যাপনার কাজ পেয়ে গেলাম। সেই বছরই বিয়ে করলাম। মেয়েটি মন্টানা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফাইন আর্টসের ছাত্রী-স্প্যানিশ আমেরিকান। নাম জুডি বার্নার।
প্রেমের বিয়ে?
প্রেমের বিয়ে বলাটা বোধহয় ঠিক হবে না। বাছাবাছির বিয়ে বলতে পারেন। জুডি অনেক বাছাবাছির পর আমাকে পছন্দ করল।
আপনাকে পছন্দ করার কারণ কী?
আমি ঠিক অপছন্দ করার মতো মানুষ সেই সময় ছিলাম না। আমার একটি চোখ পাথরের ছিল না। চেহারা তেমন ভালো না হলেও দুটি সুন্দর চোখ ছিল। আমার মা বলতেন-রাশেদের চোখে জন্মকাজল পরানো। সুন্দর চোখের ব্যাপারটা অবশ্য ধর্তব্য নয়। আমেরিকান তরুণীরা প্রেমিকদের সুন্দুর চোখ নিয়ে মাথা ঘামায় না।–তারা দেখে প্রেমিক কী পরিমাণ টাকা করেছে এবং ভবিষ্যতে কী পরিমাণ টাকা সে করতে পারবে। সেই দিক দিয়ে আমি মোটামুটি আদর্শ– স্থানীয় বলা চলে। ত্রিশ বছর বয়সে একটি আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয়ে ফ্যাকান্টি পজিশন পেয়ে গেছি! ট্যানিউর পেতেও কোনো সমস্যা হবে না। জুডি স্বামী হিসেবে আমাকে নির্বাচন করল। আমার দিক থেকে আপত্তির কোনো কারণ ছিল না। জুডি চমৎকার একটি মেয়ে। শত বৎসর সাধনার ধন হয়তো নয়, তবে বিনা সাধনায় পাওয়ার মতো মেয়েও নয়।
বিয়ের সাত দিনের মাথায় আমরা হানিমুন করতে চলে গেলাম সানফ্রান্সিসকো। উঠলাম হোটেল বেডফোর্ডে। দ্বিতীয় রাত্রির ঘটনা। ঘুমুচ্ছিলাম। কান্নার শব্দে ঘুম ভেঙে গেল। তাকিয়ে দেখি জুডি পাশে নেই, ঘড়িতে রাত তিনটা দশ বাজছে। বাথরুমের দরজা বন্ধ। সেখান থেকে ফুঁপিয়ে কান্নার শব্দ আসছে। আমি বিস্মিত হয়ে উঠে গেলাম। দরজা ধাক্কা দিয়ে বললাম, কী হয়েছে জুডি, কী হয়েছে? কান্না থেমে গেল। তবে জুডি কোনো জবাব দিল না।
অনেক ধাক্কাধাব্ধির পর সে দরজা খুলে হতভম্ব হয়ে আমাকে দেখতে লাগল। আমি বললাম, কী হয়েছে?
সে ক্ষীণ স্বরে বলল, ভয় পেয়েছি।
কিসের ভয়?
জানি না কিসের ভয়।
ভয় পেয়েছ তো আমাকে ডেকে তোল নি কেন? বাথরুমে দরজা বন্ধ করে ছিলে কেন?
জুড়ি জবাব দিল না। একদৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। আমি বললাম, ব্যাপারটা কি আমাকে খুলে বল তো?
সকালে বলব।।না, এখুনি বল। কী দেখে ভয় পেয়েছ?
জুডি অস্পষ্ট স্বরে বলল, তোমাকে দেখে।
আমাকে দেখে ভয় পেয়েছ মানে? আমি কী করেছি?
জুডি যা বলল তা হচ্ছে–রাতে তার ঘুম ভেঙে যায়। হোটেলের ঘরে নাইট লাইট জ্বলছিল, ওই আলোয় সে দেখে, তার পাশে যে শুয়ে আছে সে কোনো জীবন্ত মানুষ নয়, মৃত মানুষ–যে-মৃত মানুষের গা থেকে শবদেহের গন্ধ বেরুচ্ছে। সে তয়ে কাঁপতে থাকে, তবু সাহসে হাত বাড়িয়ে মানুষটাকে স্পর্শ করে। স্পর্শ করেই চমকে ওঠে, কারণ মানুষটার শরীর বরফের মতোই শীতল। সে পুরোপুরি নিশ্চিত হয়ে যায় যে আমি মারা গেছি। তার জন্যে এটা বড় ধরনের শক হলেও সে যথেষ্ট সাহস দেখায়-টেবিল-ল্যাম্প জ্বেলে দেয় এবং হোটেল ম্যানেজারকে টেলিফোন করবার জন্যে টেলিফোন সেট হাতে তুলে নেয়। ঠিক তখন সে লক্ষ করে, মৃতদেহের দুটি বন্ধ চোখের একটি ধীরে-বীরে খুলছে। সেই একটিমাত্র খোলা চোখ তীব্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে। জুডি টেলিফোন ফেলে দিয়ে ছুটে বাথরুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেয়। এই হল ঘটনা।
রাশেদুল করিম কথা শেষ করে সিগারেট ধরলেন। হাতের ঘড়ি দেখলেন। মিসির আলি বললেন, থামলেন কেন?
সাতটা বেজেছে। আপনি বলেছেন, সাতটার সময় আপনার জন্যে চা আসে। আমি চায়ের জন্যে অপেক্ষা করছি। চা খেয়ে শুরু করব। আমার গল্প শুনতে আপনার কেমন লাগছে?
ইন্টারেষ্টিং। এই গল্প কি আপনি অনেকের সঙ্গে করেছেন? আপনার গল্প বলার ধরন থেকে মনে হচ্ছে অনেকের সঙ্গেই এই গল্প করেছেন।
আপনার অনুমান সঠিক। ছ থেকে সাত জনকে আমি বলেছি। এর মধ্যে সাইকিয়াট্রিস্ট আছেন। পুলিশের লোক আছে।
পুলিশের লোক কেন?
গল্প শেষ করলেই বুঝতে পারবেন পুলিশের লোক কী জন্যে।
চা চলে এল! চায়ের সঙ্গে পরোটা-ভাজি। মিসির আলি নাশতা করলেন। রাশেদুল করিম সাহেব পরপর দু কাপ চা খেলেন।
আমি কি শুরু করব?
জ্বি, শুরু করুন।
আমাদের হানিমুন মাত্র তিন দিন স্থায়ী হল। জুডিকে নিয়ে পুরনো জায়গায় চলে এলাম। মনটা খুবই খারাপ। জুডির কথাবার্তা কিছুই বুঝতে পারছি না। রোজ রাতে সে ভয়ংকর চিৎকার করে ওঠে। ছুটে ঘর থেকে বের হয়ে যায়। আমি যখন জেগে উঠে তাকে সন্তুনা দিতে যাই, তখন এমনভাবে তাকায়, যেন আমি একটা পিশাচ কিংবা মূর্তিমান শয়তান। আমার দুঃখের কোনো সীমা রইল না। সেই সময় নন এবেলিয়ান গ্রুপের ওপর একটা জটিল এবং গুরুত্বপূৰ্ণ কাজ করছিলাম। আমার দরকার ঠাণ্ডামাথায় চিন্তা করার মতো পরিবেশ, মানসিক শান্তি। সব দূর হয়ে গেল। অবশ্য দিনের বেলায় জুডি স্বাভাবিক। সে বদলাতে শুরু করে সূর্য ডোবার পর থেকে। আমি তাকে একজন সাইকিয়াটিস্টের কাছে নিয়ে গেলাম।
সাইকিয়াটিস্ট প্রথমে সন্দেহ করলেন সমস্যা ড্রাগঘটিত। হয়তো জুডি ড্রাগে অভ্যস্ত! সেই সময় বাজারে হেলুসিনেটিং ড্রাগ এল.এস.ডি. প্রথম এসেছে। শিল্পসাহিত্যের লোকজন শখ করে এই ড্রাগ খাচ্ছেন। বড়গলায় বলছেন–মাইন্ড অলটারিং ট্রিপ নিয়ে এসেছি। জুডি ফাইন আর্টস-এর ছাত্রী। ট্রিপ নেওয়া তার পক্ষে খুব অস্বাভাবিক নয়।
দেখা গেল, ড্রাগঘটিত কোনো সমস্যা তার নেই। সে কখনো ড্রাগ নেয় নি। সাইকিয়াট্রিস্টরা তার শৈশবের জীবনে কোনো সমস্যা ছিল কি না তাও বের করতে চেষ্টা করলেন। লাভ হল না। জুডি এসেছে গ্রামের পরিবার থেকে। এ-ধরনের পরিবারে তেমন কোনো সমস্যা থাকে না। তাদের সহজ এবং স্বাভাবিক।
সাইকিয়াটিস্ট জুডিকে ঘুমের অষুধ দিলেন। কড়া ডোজের ফেনোবাৰ্বিটন! আমাকে বললেন, আপনি সম্ভবত লেখাপড়া নিয়ে থাকেন। স্ত্রীর প্রতি, বিশেষ করে নববিবাহিত স্ত্রীর প্রতি যতটা সময় দেওয়া দরকার তা দিচ্ছেন না। আপনার প্রতি আপনার স্ত্রীর একধরনের ক্ষোভ জন্মেছে। সে যা বলছে, তা ক্ষোভেরই বহিঃপ্রকাশ।
জুডির কথা একটাই-আমি ঘুমুবার পর আমার দেহে প্ৰাণ থাকে না। একজন মৃত মানুষের শরীর যেমন অসাড় পড়ে থাকে, আমার শরীরও সে-রকম পড়ে থাকে। ঘুমের মধ্যে মানুষ হাত নাড়ে, পা নাড়ে- আমি তার কিছুই করি না। নিঃশ্বাস পর্যন্ত ফুেলি না। গা হয়ে যায় বরফের মতো শীতল। একসময় গা থেকে মৃত মানুষের শরীরের পচা গন্ধ বেরুতে থাকে এবং তখন আচমকা আমার বা চোখ খুলে যায়, সেই চোখে আমি একদৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে থাকি। সেই চোখের দৃষ্টি সাপের মতো কুটিল।
জুডির কথা শুনে—শুনে আমার ধারণা হল, হতেও তো পারে। জগতে কত রহস্যময় ব্যাপারই তো ঘটে। হয়তো আমার নিজেরই কোনো সমস্যা আছে। আমিও ডাক্তারের কাছে গেলাম। ক্লিপ অ্যানলিস্ট। জানার উদ্দেশ্য একটিই-ঘূমের মধ্যে আমার কোনো শারীরিক পরিবর্তন হয় কি না! ডাক্তাররা পুঙ্খানুপুঙ্খ পরীক্ষা করলেন। একবার নয়, বারবার করলেন। দেখা গেল আমার ঘুম আর দশটা মানুষের ঘুমের চেয়ে আলাদা নয়। ঘুমের মধ্যে আমিও হাত-পা নাড়ি। অন্য মানুষদের যেমন ঘুমের তিনটি স্তর পার হতে হয়, আমারও হয়। ঘুমের সময় আর দশটা মানুষের মতো আমার শরীরের উত্তাপও আধ ডিগ্ৰী হ্রাস পায়। আমিও অন্য সবার মতো স্বপ্ন ও দুঃস্বপ্ন দেখি! জুডি সব দেখেশুনে বলল, ডাক্তাররা জানে না। ডাক্তাররা কিছুই জানে না। আমি জানি। তুমি আসলে মানুষ না দিনের বেলা তুমি মানুষ থাক—সূৰ্য ডোবার পর থাক না।
আমি কী হই?
তুমি পিশাচ বা এই জাতীয় কিছু হয়ে যাও।
আমি বললাম, এইভাবে তো বাস করা সম্ভব নয়। তুমি বরং আলাদা থাক। খুবই আশ্চর্যের ব্যাপার-জুডি তাতে রাজি হল না। অতি তুচ্ছ কারণে আমেরিকানদের বিয়ে ভাঙে। স্বামীর পছন্দ হলুদ রঙের বিছানার চাদর স্ত্রীর পছন্দ নীল রঙ। ভেঙে গেল বিয়ে। আমাদের এত বড় সমস্যা, কিন্তু বিয়ে ভাঙল না। আমি বেশ কয়েক বার তাকে বললাম, জুডি, তুমি আলাদা হয়ে যাও! ভালো দেখে একটা ছেলেকে বিয়ে করা। সারা জীবন তোমার সামনে পড়ে আছে। তুমি এইভাবে জীবনটা নষ্ট করতে পার না।
জুডি প্রতিবারই বলে, যাই হোক, যত সমস্যাই হোক, আমি তোমাকে ছেড়ে যাব না, I love you. I love you.
……আমি গল্পের প্রায় শেষ পর্যায়ে চলে এসেছি। শেষ অংশটি বলার অ্যাগে আমি আপনাকে আমার চোখের দিকে তাকাতে অনুরোধ করব। দয়া করে আমার চোখের দিকে তাকান।
রাশেদুল করিম সানগ্লাস খুলে ফেললেন। মিসির আলি তৎক্ষণাৎ বললেন, আপনার চোখ সুন্দর। সত্যি সুন্দর। আপনার মা যে বলতেন চোখে জন্মকাজল, ঠিকই বলতেন।
রাশেদুল করিম বললেন, পৃথিবীতে সবচেয়ে সুন্দর চোখ কার ছিল জানেন?
ক্লিওপেট্রার?
অধিকাংশ মানুষের তাই ধারণা। এ-ধারণা সত্যি নয়। পৃথিবীতে সবচেয়ে সুন্দর চোখ ছিল বুদ্ধদেবের পুত্ৰ কুনালের। ইংরেজ কবি শেলির চোখও খুব সুন্দর ছিল। আমার স্ত্রীর ধারণা, এই পৃথিবীতে সবচেয়ে চোখ আমার। জুডি বলত—এই চোখের কারণেই সে কোনোদিন আমাকে ছেড়ে যেতে পারবে না।
রাশেদুল করিম সানগ্লাস চোখে দিয়ে বললেন, গল্পের শেষ অংশ বলার আগে আপনাকে ক্ষুদ্র ধন্যবাদ দিতে চাচ্ছি।
মিসির আলি বিস্মিত হয়ে বললেন, কী জন্যে বলুন তো? কাউকে যখন আমি আমার চোখের দিকে তাকাতে বলি, সে আমার পাথরের চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে। আপনি প্রথম ব্যক্তি-যিনি একবারও আমার পাথরের চোখের দিকে তাকান নি। আমার আসল চোখের দিকে তাকিয়ে-ছিলেন। Sonice of you, Sir.
রাশেদুল করিমের গলা মুহূর্তের জন্যে হলেও ভারি হয়ে গেল। তিনি অবশ্যি চট করে নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, আটটা প্ৰায় বাজতে চলল, গল্পের শেষটা। বলি-জুডার অবস্থা ক্রমেই খারাপ হতে লাগল। কড়া ডোজের ঘুমের অষুধ খেয়ে ঘুমুতে যায়, দু-এক ঘন্টা ঘুম হয়, বাকি রাত জেগে বসে থাকে। মাঝে-মাঝে চিৎকার করে ছুটে ঘর থেকে বের হয়ে যায়। বারান্দায় দাঁড়িয়ে ফুঁপিয়ে-ফুঁপিয়ে কাঁদে।…..
এমনি একরাতের ঘটনা। জুলাই মাস। রাত সাড়ে তিনটার মতো হবে। জুডির মাথা পুরোপুরি খারাপ হয়ে গেল-সে আমার বা চোখটা গেলে দিল।…
আমি ঘুমুচ্ছিলাম, নারকীয় যন্ত্রণায় চিৎকার করে উঠলাম। সেই ভয়াবহ কষ্টের কোনো সীমা-পরিসীমা নেই।
রাশেদুল করিম চুপ করলেন। তাঁর কপালে বিন্দু-বিন্দু ঘাম জমতে লাগল।
মিসির আলি বললেন, কী দিয়ে চোখ গেলে দিলেন?
সুঁচালো পেনসিল দিয়ে। আমার মাথার বালিশের নিচে প্যাড এবং পেনসিল থাকে। তখন গ্রুপ থিওরি নিয়ে গভীর চিন্তায় ছিলাম। মাথায় যদি হঠাৎ কিছু আসে তা লিখে ফেলার জন্যে বালিশের নিচে প্যাড় এবং পেনসিল রাখতাম।
আপনার স্ত্রী ঘটনা প্রসঙ্গে কী বক্তব্য দিয়েছেন?
তার মাথা পুরোপুরি নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। সে কিছুই বলে নি। শুধু চিৎকার করেছে। তার একটিই বক্তব্য-এই লোকটা পিশাচ। আমি প্রমাণ পেয়েছি। কেউ বিশ্বাস করবে: না। কিন্তু আমার কাছে প্রমাণ আছে।
কী প্রমাণ আছে তা কি কখনো জিজ্ঞেস করা হয়েছে?
না। একজন উন্মাদকে প্রশ্ন করে বিপর্যস্ত করার কোনো মানে হয় না। তা ছাড়া আমি তখন ছিলাম হাসপাতালে। আমি হাসপাতালে থাকতে—থাকতেই জুডির মৃত্যু হয়।
স্বাভাবিক মৃত্যু?
না। স্বাভাবিক মৃত্যু নয়। সে মারা যায় ঘুমের অষুধ খেয়ে। এইটুকুই আমার গল্প। আমি আপনার কাছে একটাই অনুরোধ নিয়ে এসেছি, আপনি সমস্যাটা কী, বের করবেন। আমাকে সাহায্য করবেন। আমি যদি পিশাচ হই, তাও আমাকে বলবেন। এই ফাইলের ভেতর জুডির একটা স্কেচবুক আছে। স্কেচবুকে নানান ধরনের কমেন্টস লেখা আছে। এই কমেন্টসগুলি পড়লে জুডির মানসিক অবস্থা আঁচ করতে আপনার সুবিধা হতে পারে! আটটা বাজে, আমি তাহলে উঠি?
আবার কবে আসবেন?
আগামীকাল ভোর ছটায়। ভালো কথা, আমার এই গল্পে কোথাও কি প্ৰকাশ পেয়েছে, জুডিকে আমি কতটা ভালবাসতাম?
না, প্ৰকাশ পায় নি।
জুডির প্রতি আমার ভালবাসা ছিল সীমাহীন।
আমি এখন উঠছি।।
ছিল বলছেন কেন? এখন কি নেই?
ভদ্রলোক জবাব দিলেন না। রাশেদুল করিম চলে যাবার পর মিসির আলি ফাইল খুললেন। ফাইলের শুরুতেই একটা খাম। খামের ওপর মিসির আলির নাম লেখা।
মিসির আলি খাম খুললেন। খামের ভেতর ইংরেজিতে একটা চিঠি লেখা। সঙ্গে চারটি এক শ ডলারের নোট। চিঠি খুবই সংক্ষিপ্ত।
প্রিয় মহোদয়, আপনার সার্ভিসের জন্যে সন্মানী বাবদ সামান্য কিছু দেওয়া হল। গ্ৰহণ করলে
খুশি হব।
বিনীত
আর, করিম।
০২.
মিসির আলি স্কেচবুকের প্রতিটি পাতা সাবধানে ওন্টালেন। চারকেল এবং পেনসিলে স্কেচ আঁকা। প্রতিটি স্কেচের নিচে আঁকার তারিখ। স্কেচের বিষয়বস্তু অতি তুচ্ছ, সবই ঘরোয়া জিনিস-এক জোড়া জুতো, মলাট-ছোড়া বই, টিভি, বুকশেলফ। স্কেচ বুকের শেষের দিকে শুধুই চোখের ছবি। বিড়ালের চোখ, কুকুরের চোখ, মাছের চোখ এবং মানুষের চোখ। মানুষের চোখের মডেল যে রাশেদুল করিম তা বলার অপেক্ষা রাখে না। না বললেও ছবির নিচের মন্তব্য থেকে বোঝা যাচ্ছে মন্তব্যগুলি বেশ দীর্ঘ। যেমন একটি মন্তব্য :
আমি খুব মন দিয়ে আমার স্বামীর চোখ লক্ষ করছি। মানুষের চোখ একেক সময় একেক রকম থাকে। ভোরবেলার চোখ এবং দুপুরের চোখ এক নয়। আরো একটি জিনিস লক্ষ করলাম-চোখের আইরিশের ট্রান্সপারেন্সি মুডেরু ওপর বদলায়। বিষাদগ্ৰস্ত মানুষের চোখের আইরিশ থাকে অস্বচ্ছ মানুষ যতই আনন্দিত হতে থাকে তার চোখের আইরিশ ততই স্বচ্ছ হতে থাকে। আমার এই অবজারভেশন কতটুকু সত্য তা বুঝতে পারছি না।
মেয়েটি মাঝে-মাঝে তার মনের অবস্থাও লিখেছে–অনেকটা ডায়েরি লেখার ভঙ্গিতে। মনে হয়। হাতের কাছে ডায়েরি না-থাকায় স্কেচবুকে লিখে রেখেছে। সব লেখাই পেনসিলে। প্রচুর কাটাকুটি আছে। কিছু লাইন রাবার ঘষে তুলেও ফেলা হয়েছে।
১৮.৫.৮২
আমি ভয়ে অস্থির হয়ে আছি। নিজেকে বোঝানোর চেষ্টা করছি—এই ভয় অমূলক। বোঝাতে পারছি না। আমি আমার স্বামীকে ভয় পাচ্ছি, এই তথ্য স্বভাবতই স্বামী বেচারার জন্যে সুখকর নয়। সেনানানভাবে আমাকে সত্ত্বনা দেবার চেষ্টা করছে। কিছুকিছু চেষ্টা বেশ হাস্যকর। আজ আমাকে বলল, জুড়ি, আমি ঠিক করেছি-এখন থেকে রাতে ঘুমুব না। আমার অঙ্কের সমস্যা নিয়ে ভািবব। লেখালেখি করব। তুমি নিশ্চিন্ত হয়ে ঘুমাও। আমি দিনের বেলায় ঘুমুব। একজন মানুষের জন্যে চার ঘন্টা ঘূমই যথেষ্ট। নেপোলিয়ান মাত্র তিন ঘন্টা ঘুমুতেন।
আমি এই গম্ভীর, স্বল্পভাষী লোকটিকে ভালবাসি। ভালবাসি, ভালবাসি, ভালবাসি। আমি চাই না, আমার কোনো কারণে সে কষ্ট পাক। কিন্তু সে কষ্ট পাচ্ছে, খুব কষ্ট পাচ্ছে। হে ঈশ্বর, তুমি আমার মন শান্ত কর। আমার ভয় দূর করে দাও।
২১.৮.৮২
যে-জিনিস খুব সুন্দর তা কত দ্রুত অসুন্দর হতে পারে—বিস্মিত হয়ে আমি তা-ই দেখছি। রাশেদের ধারণা আমি অসুস্থ। কি অসুস্থ? আমার মনে হয় না। কারণ, এখনো ছবি আঁকতে পারছি। একজন অসুস্থ মানুষ আর যা-ই পারুক-ছবি আঁকতে পারে না। গত দু দিন ধরে ওয়াটার কালারে বাসার সামনের চেরি গাছের ফুল ধরতে চেষ্টা করছিলাম। আজ সেই ফুল কাগজে বন্দি করেছি। অনেকক্ষণ ছবিটির দিকে তাকিয়ে রইলাম! ভালো হয়েছে। রাশেদ ছবি তেমন বোঝে বলে মনে হয় না-সেও মুগ্ধ হয়ে অনেকক্ষণ দেখল। তারপর বলল, আমি যখন বুড়ো হয়ে যাব, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসর নেব, তখন তুমি আমাকে ছবি আঁকা শিখিয়ে দেবে! এই কথাটি সে আজ প্রথম বলে নি, আগেও বলেছে। আন্তরিক ভঙ্গিতে বলেছে। কেউ যখন আন্তরিকভাবে কিছু বলে তখন তা টের পাওয়া যায়। আমার মনে হয় না সে কোনোদিন ছবি আঁকবে। তার মাথায় অঙ্ক ছাড়া কিছুই নেই।
২১.৫.৮২
আমি ছবি আঁকতে পারছি না। যেখানে নীল রঙ চড়ানো দরকার, সেখানে গাঢ় হলুদ রঙ ব্যসাচ্ছি। ডাক্তার সিডেটিভের পরিমাণ বাড়িয়ে দিয়েছে। সারাক্ষণ মাথা ঝিম ধরে থাকে। কেন জানি খুব বমি হচ্ছে।
আজ দুপুরে অনেকক্ষণ ঘুমুলাম। মজার ব্যাপার হচ্ছে, সুন্দর একটা স্বপ্নও দেখে ফেললাম। সুন্দর স্বপ্ন আমি অনেক দিন দেখি না, অনেক দিন দেখি না, অনেক দিন দেখি না। অনেক দিন দেখি না? অনেক দিন দেখি না। আচ্ছা, আমি কি পাগল হয়ে যাচ্ছি? শুনেছি পাগলরাই একই কথা বারবার লেখে। কারণ তাদের মাথায় একটি বাক্যই বারবার ঘুরপাক খায়।
বৃহস্পতিবার কিংবা বুধবার
আজ কত তারিখ আমি জানি না। বেশ কয়েক দিন ধরেই দিন-তারিখে গণ্ডগোল হচ্ছে। আজ কত তারিখ তৈা জানার কোনো রকম আগ্ৰহ বোধ করছি না। তবে মনের অবস্থা লেখার চেষ্টা করছি, যাতে পরবর্তী সময়ে কেউ আমার লেখা পড়ে বুঝবে যে মাথা খারাপ হবার সময় একজন মানুষ কীভাবে কী চিন্তা করে।
মাথা খারাপের প্রথম লক্ষণ হচ্ছে, আলো অসহ্য হওয়া! আমি এখন আলো সহ্য করতে পারি না। দিনের বেলায় দরজা-জানালা বন্ধ করে রাখি। ঘর অন্ধকার বলেই প্ৰায় অনুমানের ওপর নির্ভর করে আজকের এই লেখা লিখছি। দ্বিতীয় লক্ষণ হচ্ছে, সারাক্ষণ শরীরে একধরনের জ্বালা অনুভব করা। মনে হয়, সব কাপড় খুলে বাথটাবে শুয়ে থাকতে পারলে ভালো লাগত। আমার আগে যারা পাগল হয়েছে তাদেরও কি এমন হয়েছে? জানার জন্যে পাবলিক লাইব্রেরিতে টেলিফোন করেছিলাম। আমি খুব সহজভাবে বললাম, আচ্ছা, আপনাদের এখানে পাগলের লেখা কোনো বই আছে?
যে-মেয়েটি টেলিফোন ধরেছিল। সে বিস্মিত হয়ে বলল, পাগলের লেখা বই বলতে কী বোঝাচ্ছেন?
মানসিক রুগীদের লেখা বই?
মানসিক রুগীরা বই লিখবে কেন?
কেন লিখবে না? আমি তো লিখছি, বই অবশ্যি নয়-ডায়েরির আকারে লেখা।
ও, আচ্ছা। ঠিক আছে, আপনার বই ছাপা হোক। ছাপা হবার পর অবশ্যই আমরা আপনার বইয়ের কপি সংগ্রহ করব।
আমি মনে-মনে হাসলাম। মেয়েটি আমাকে উন্মাদ ভাবছে। ভাবুক উন্মাদকে উন্মাদ ভাববে না তো কী ভাববে?
রাত দুটো দশ
আমার মা এই কিছুক্ষণ আগে টেলিফোন করলেন। দুপুররাতে তাঁর টেলিফোন করার বদঅভ্যাস আছে। আমার মার অনিদ্রা রোগ আছে। কাজেই তিনি মনে করেন। পৃথিবীর সবাই অনিদ্রার রুগী। যাই হোক, আমি জেগে ছিলাম। মা বললেন, জুডি, তুই আমার কাছে চলে আয়।
আমি বললাম, না, রাশেদকে ফেলে আমি যাব না।
মা বললেন, আমি তো শুনলাম ওকে নিয়েই তোর সমস্যা।
ওকে নিয়ে আমার কোনো সমস্যা নেই মা। I love him. I love him.। ove him.
চিৎকার করছিস কেন?
চিৎকার করছি না। মা, টেলিফোন রাখি। কথা বলতে ভালো লাগছে না।
আমি টেলিফোন নামিয়ে রাখলাম। রাশেদকে ফেলে যাবার প্রশ্নই ওঠে না। আমার ধারণা, রাশেদ নিজেও অসুস্থ হয়ে পড়েছে। সেও এখন রাতে ঘুমায় না। গ্রুপ থিওরির যে-সমস্যাটি নিয়ে সে ভাবছিল, সেই সমস্যার সমাধান অন্য কে নাকি বের করে ফেলেছে। জার্নালে ছাপা হয়েছে। সে গত পরশু ঐ জার্নাল পেয়ে কুচিকুচি করেছিঁড়েছে। শুধু তাই না-বারান্দার এক কোণায় বসে ছেলেমানুষের মতো কাঁদতে শুরু করেছে। সত্ত্বনা দেবার জন্যে তার কাছে গিয়ে চমকে উঠলাম। সে কাঁদছে ঠিকই, কিন্তু তার বা চোখ দিয়ে পানি পড়ছে, ডান চোখ শুকনো।
আমি তাকে কিছু বললাম না। কিন্তু সে আমার চাউনি থেকেই ব্যাপারটা বুঝে ফেলল। নিচু গলায় বলল, জুডি, ইদানীং এই ব্যাপারটা হচ্ছে—মাঝে-মাঝেই দেখছি বা চোখ দিয়ে পানি পড়ে।
কথাগুলি বলার সময় তাকে এত অসহায় লাগছিল! আমার ইচ্ছা করছিল তাকে জড়িয়ে ধরে বলি-I love you. I love you. I love you.
হে ঈশ্বর! হে পরম করুণাময় ঈশ্বর। এই ভয়াবহ সমস্যা থেকে তুমি আমাদের দু জনকে উদ্ধার করা।
স্কেচবুকের প্রতিটি লেখা বারবার পড়ে মিসির আলি খুব বেশি তথ্য বের করতে পারলেন না, তবে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য যা জানা গেল তা হচ্ছে-মেয়েটি তার স্বামীকে ভালবাসে, যে-ভালবাসায় একধরনের সারল্য আছে।
স্কেচবুকে কিছু স্প্যানিশ ভাষায় লেখা কথাবার্তাও আছে। স্প্যানিশ ভাষা না— জানার কারণে তার অর্থ উদ্ধার করা সম্ভব হল না। তবে এই লেখাগুলি যেভাবে সাজানো তাতে মনে হচ্ছে–কবিতা কিংবা গান হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মডার্ন ল্যাংগুয়েজ ইনষ্টিটিউটে স্কেচবুক নিয়ে গেলেই ওরা পাঠোদ্ধারের ব্যবস্থা করে দেবে-তবে মিসির আলির মনে হল তার প্রযোজন নেই। যা জানার তিনি জেনেছেন। এর বেশি কিছু জানার নেই।
০৩.
রাশেদুল করিম ঠিক ছটায় এসেছেন। মনে হচ্ছে বাইরে অপেক্ষা করছিলেন। ঠিক ছটা বাজার পর কলিং বেলে হাত রেখেছেন। মিসির আলি দরজা খুলে বললেন, আসুন।
রাশেদুল করিমের জন্যে সামান্য বিস্ময় অপেক্ষা করছিল। তাঁর জন্যে টেবিলে দুধছাড়া চা। মিসির আলি বললেন, আপনি কাঁটায়-কাঁটায় ছটায় আসবেন বলে ধারণা করেই চা বানিয়ে রেখেছি। লিকার কড়া হয়ে গেছে বলে-আমার ধারণা। খেয়ে দেখুন
রাশেদুল করিম চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বললেন, ধন্যবাদ।
মিসির আলি নিজের কাপ হতে নিতে-নিতে বললেন, আপনাকে একটা কথা শুরুতেই বলে নেওয়া দরকার। আমি মাঝে-মাঝে নিজের শখের কারণে সমস্যা নিয়ে চিন্তা করি। তার জন্যে কখনো অর্থ গ্রহণ করি না। আমি যা করি তা আমার পেশা না-নেশা বলতে পারেন। আপনার ডলার আমি নিতে পারছি না। তা ছাড়া অধিকাংশ সময়ই আমি সমস্যার কোনো সমাধানে পৌঁছতে পারি না। আমার কাছে পাঁচ শ পৃষ্ঠার একটা নোট বই আছে। ঐ নোট বই ভর্তি এমন সব সমস্যা-যার সমাধান আমি বের করতে পারি নি।
আপনি কি আমার সমস্যাটার কিছু করেছেন?
সমস্যার পুরো সুমাধান বের করতে পারি নি—আংশিক সমাধান আমার কাছে আছে। আমি মোটামুটিভাবে একটা হাইপোথিসিস দাঁড় করিয়েছি। সেই সম্পর্কে আপনাকে আমি বলব, আপনি নিজে ঠিক করবেন—আমার হাইপোথিসিসে কী কী ত্রুটি আছে। তখন আমরা দু জন মিলে ত্রুটিগুলি ঠিক করব।
শুনি আপনার হাইপোথিসিস।
আপনার স্ত্রী বলেছেন, ঘুমুবার পর আপনি মৃত মানুষের মতো হয়ে যান। আপনার হাত-পা নড়ে না। পাথরের মূর্তির মতো বিছানায় পড়ে থাকেন। তাই না?
হ্যাঁ, তাই।
স্লিপ অ্যানালিস্টরা আপনাকে পরীক্ষা করে বলেছেন-আপনার ঘুম সাধারণ মানুষের ঘুমের মতোই। ঘুমের মধ্যে আপনি স্বাভাবিকভাবেই নড়াচড়া করেন।
জ্বি, কয়েকবারই পরীক্ষা করা হয়েছে।
আমি আমার হাইপোথিসিসে দুজনের বক্তব্যই সত্য ধরে নিচ্ছি। সেটা কীভাবে সম্ভব? একটিমাত্র উপায়ে সম্ভব-আপনি যখন বিছানায় শুয়ে ছিলেন তখন ঘুমুচ্ছিলেন না। জেগে ছিলেন।
রাশেদুল করিম বিস্মিত হয়ে বললেন, কী বলছেন আপনি!
মিসির আলি বললেন, আমি গত কালও লক্ষ করেছি, আজও লক্ষ করছি।– আপনার বসে থাকার মধ্যেও একধরনের কাঠিন্য আছে। আপনি আরাম করে বসে নেই-শিরদাঁড়া সোজা করে বসে আছেন। আপনার দুটো হাত হাঁটুর ওপর রাখা। দীর্ঘ সময় চলে গেছে, আপনি একবারও হাত বা পা নাড়ান নি। অথচ স্বাভাবিকভাবেই আমরা হাত-পা নাড়ি। কেউ-কেউ পা নাচান!
রাশেদুল করিম চুপ করে রইলেন। মিসির আলি বলল, ঐ রাতে আপনি বিছানায় শুয়েছেন।–মূর্তির মতো শুয়েছেন। চোখ বৃন্ধ করে ভাবছেন আপনার অঙ্কের সমস্যা নিয়ে। গভীরভাবে ভাবছেন। মানুষ যখন গভীরভাবে কিছু ভাবে তখন একধরনের টেন্স ষ্টেটে ভাবজগতে চলে যায়। গভীরভাবে কিছু ভাবা হচ্ছে একধরনের মেডিটেশন। রাশেদুল করিম সাহেব
জ্বি।
অঙ্ক নিয়ে ঐ ধরনের গভীর চিন্তা কি আপনি এই করেন না?
জ্বি, করি।
আপনি কি লক্ষ করেছেন এই সময় আশেপাশে কী ঘটছে তা আপনার খেয়াল থাকে না?
লক্ষ করেছি।
আপনি নিশ্চয়ই আরো লক্ষ করেছেন যে, এই অবস্থায় আপনি ঘন্টার পর ঘন্টা পার করে দিচ্ছেন। লক্ষ করেন নি?
করেছি।
তাহলে আমি আমার হাইপোথিসিসে ফিরে আসি। আপনি বিছানায় শুয়ে আছেন। আপনার মাথায় অঙ্কের জটিল সমস্যা। আপনি ভাবছেন, আর ভাবছেন? আপনার হাতপা নড়ছে না। নিঃশ্বাস এত ধীরে পড়ছে যে মনে হচ্ছে আপনি মৃত!
রাশেদুল করিম সাহেব সানগ্লাস খুলে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। মিসির আলি বললেন, ভালো কথা, আপনি কি লেফট হ্যানডেড পার্সন? ন্যাটা?
ভদ্রলোক বিস্মিত হয়ে বললেন, হ্যাঁ, কেন বলুন তো?
আমার হাইপোথিসিসের জন্যে আপনার লেফট হ্যানডেড পার্সন হওয়া খুবই প্রয়োজন।
কেন?
বলছি। তার আগে—শুরুতে যা বলছিলাম সেখানে ফিরে যাই। দৃশ্যটি আপনি দয়া করে কল্পনা করুন। আপনি একধরনের টেন্স অবস্থায় আছেন। আপনার স্ত্রী জেগে আছেন-ভীত চোখে আপনাকে দেখছেন। আপনার এই অবস্থার সঙ্গে তাঁর পরিচয় নেই। তিনি ভয়ে অস্থির হয়ে গেলেন। তাঁর ধারণা হল আপনি মারা গেছেন। তিনি আপনার গায়ে হাত দিয়ে আরো ভয় পেয়ে গেলেন। কারণ আপনার গা হিমশীতল।।
গা হিমশীতল হবে কেন?
মানুষ যখন গভীর ট্রেন্স স্টেটে চলে যায় তখন তার হার্টবিট কমে যায়। নিঃশ্বাসপ্রশ্বাস ধীরে বয়। শরীরের টেম্পরেচার দুই থেকে তিন ডিগ্ৰী পৰ্যন্ত নেমে যায়। এইটুকু নেমে যাওয়া মানে অনেকখানি নেমে যাওয়া। যাই হোক, আপনার স্ত্রী আপনার গায়ে হাত দেওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই আপনি তাকালেন।–তাকালেন। কিন্তু এক চোখ মেলে। বী চোখে। ডান চোখটি তখনো বন্ধ।
কেন?
ব্যাখ্যা করছি। রাইট হ্যানডেড পার্সন যারা আছে, তাদের এক চোখ বন্ধ করে অন্য চোখে তাকাতে বললে তারা বা চোখ বন্ধ করে ডান চোখে তাকবে। ডান চোখ বন্ধ করে বা চোখে তাকানো তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। এটা সম্ভব শুধু যারা ন্যাটা তাদের পক্ষেই। আপনি লেফট হ্যানডেড পার্সনা-আপনি একধরনের গভীর টেন্স ষ্টেটে আছেন। আপনার স্ত্রী আপনার গায়ে হাত রেখেছেন। আপনি কী হচ্ছে জানতে চাচ্ছেন। চোখ মেলছেন। দুটি চোখ মেলতে চাচ্ছেন না। গভীর আলস্যে একটা চোখ কোনোমতে মেললেন-অবশ্যই সেই চোখ হবে-বী চোখ। আমার যুক্তি কি গ্রহণযোগ্য মনে হচ্ছে?
রাশেদুল করিম হা-না কিছু বললেন না।
মিসির আলি বললেন, আপনার স্ত্রী আরো ভয় পেলেন। সেই ভয় তাঁর রক্তে মিশে গেল। কারণ শুধুমাত্র একবার এই ব্যাপার ঘটেনি। অনেকবার ঘটেছে। আপনার কথা থেকেই আমি জেনেছি, সেই সময় অঙ্কের একটি জটিল সমাধান নিয়ে আপনি ব্যস্ত। মুড়ার সমগ্ৰ চিন্তা-চেতনায়য় আছে–অঙ্কের সমাধান-নতুন কোনো থিওরি। নয় কি?
হ্যাঁ।
এখন আমি আমার হাইপোথিসিসের সবচেয়ে জটিল অংশে আসছি। আমার হাইপোথিসিস বলে, আপনার স্ত্রী আপনার চোখ গেলে দেন নি। তাঁর পক্ষে এটা করা সম্ভব নয়। তিনি আপনার চোখের প্রেমে পড়েছিলেন। একজন শিল্পীমানুষ কখনো সুন্দর কোনো সৃষ্টি নষ্ট করতে পারেন না। তবুও যদি ধরে নিই তাঁর মাথায় হঠাৎ রক্ত উঠে গিয়েছিল এবং তিনি এই ভয়াবহ কাণ্ড করেছেন—তাহলে তাঁকে এটা করতে হবে ঝোঁকের মাথায়, আচমকা। আপনার চোখ গেলে দেওয়া হয়েছে পেনসিলে-যে পেনসিলটি আপনার মাথার বালিশের নিচে রাখা। যিনি ঝোঁকের মাথায় একটা কাজ করবেন। তিনি এত যন্ত্রণা করে বালিশের নিচে থেকে পেনসিল নেবেন না। হয়তো-বা তিনি জানতেনও না বালিশের নিচে পেনসিল ও নোটবই নিয়ে আপনি ঘুমান!
রাশেদুল করিম বললেন, কাজটি তাহলে কে করেছে?
সেই প্রসঙ্গে আসছি—আপনি কি আরেক কাপ চা খবেন। বানিয়ে দেব?
না।
অ্যাকসিডেন্ট কীভাবে ঘটল তা বলার আগে আপনার স্ত্রীর লেখা ডায়েরির প্রতি আপুনার দৃষ্টি আকর্ষণ করছি—এক জায়গায় তিনি লিখেছেন-আপনার বা চোখ দিয়ে পানি পড়ত। কথাটা কি সত্যি?
হ্যাঁ, সত্যি।
কোন পানি পড়ত? একটি চোখ কেন কাঁদত? আপনার কী ধারণা?
করিম বললেন, আমার কোনো ধারণা নেই। আপনার ধারণা বলুন। আমি অবশ্যি ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলেছিলাম। ডাক্তার বলেছেন এটা তেমন গুরুত্বপূর্ণ কিছু না। যে-ফ্ল্যাণ্ড চোখের জল নিয়ন্ত্রণ করে, সেই গ্ল্যাণ্ড বা চোখে বেশি কর্মক্ষম ছিল।
মিসির আলি বললেন, এটা একটা মজার ব্যাপার! হঠাৎ কেন বঁ। চোখের গ্ল্যাণ্ড কর্মক্ষম হয়ে পড়ল। আপনি মনে-মনে এই চোখকে আপনার সব রকম অশান্তির মূল বলে চিহ্নিত করার জন্যেই কি এটা হল? আমি ডাক্তার নই। শারীরবিদ্যা জানি না। তবে আমি দু জন বড় ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলেছি। তাঁরা বলেছেন এটা হতে পারে। মোটেই অস্বাভাবিক নয়। গু্যাণ্ড নিয়ন্ত্রণ করে মস্তিষ্ক। একটি চোখকে অপছন্দও করছে মস্তিষ্ক।
তাতে কী প্রমাণ হচ্ছে?
মিসির আলি কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে বললেন, তাতে একটি জিনিসই প্রমাণিত হচ্ছে-আপনার বা চোখ আপনি নিজেই নষ্ট করেছেন।
অনেকক্ষণ চুপচাপ থেকে রাশেদুল করিম ভাঙা গলায় বললেন, কী বলছেন আপনি?
কনশ্যাস অবস্থায় আপনি এই ভয়ংকর কাজ করেন নি। করেছেন। সাবকনশ্যাস অবস্থায়। কেন করেছেন তাও বলি—আপনি আপনার স্ত্রীকে অসম্ভব ভালবাসেন। সেই স্ত্রী আপনার কাছে থেকে দূরে সরে যাচ্ছেন। কেন দূরে সরে যাচ্ছেন? কারণ তিনি ভয় পাচ্ছেন। আপনার বা চোখকে। আপনি আপনার স্ত্রীকে হারাচ্ছেন বা চোখের জন্যে। আপনার ভেতর রাগ, অতিমান জমতে শুরু করেছে। সেই রাগ আপনার নিজের একটি প্রত্যঙ্গের ওপর। চোখের ওপর। এই রাগের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে প্রচণ্ড হতাশা। আপনি যে— বিষয় নিয়ে গবেষণা করছেন সেই গবেষণা অন্য একজন করে ফেলেছেন। জার্নালে তা প্রকাশিত হয়ে গেছে। আপনার চোখ সমস্যা তৈরি না-করলে এমনটা ঘটত না। নিজেই গবেষণাটা শেষ করতে পারতেন। সবকিছুর জন্যে দায়ী হল চোখ।
মিসির আলি আরেকটি সিগারেট ধরাতে-ধরাতে বললেন, আমার এই হাইপোথিসিসের পেছনে আরেকটি শক্ত যুক্তি আছে। যুক্তিটি বলেই আমি কথা শেষ করব।
বলুন।
আপনার স্ত্রী পুরোপুরি বিকৃত মস্তিষ্ক হবার পরে যে-কথাটা বুলতেন।–তা হল, এই লোকটা পিশাচ। আমার কাছে প্রমাণ আছে। কেউ আমার কথা বিশ্বাস করবে না। কিন্তু প্রমাণ আছে। তিনি এই কথা বলতেন, কারণ-পেনসিল দিয়ে নিজের চোখ নিজে গেলে দেওয়ার দৃশ্য তিনি দেখেছেন। আমার হাইপোথিসিস আমি আপনাকে বললাম। এর বেশি আমার কিছু বলার নেই।
রাশেদুল করিম দীর্ঘ সময় চুপ করে রইলেন। মিসির আলি আরেক বার বললেন, ভাই, চা করব? চা খাবেন?
তিনি এই প্রশ্নেরও জবাব দিলেন না। উঠে দাঁড়ালেন। চোখে সানগ্লাস পরলেন। শুকনো গলায় বললেন, যাই?
মিসির আলি বললেন, মনে হচ্ছে। আমি আপনাকে আহত করেছি-কষ্ট দিয়েছি। আপনি কিছু মনে করবেন না। নিজের ওপরেও রাগ করবেন না। আপনি যা করেছেন-প্ৰচণ্ড ভালবাসা থেকেই করেছেন।
রাশেদুল করিম হাত বাড়িয়ে মিসির আলির হাত ধরে ফেলে বললেন, আমার স্ত্রী বেঁচে থাকলে তার সঙ্গে আপনার পরিচয় করিয়ে দিতাম।–আপনি দেখতেন, সে কী চমৎকার একটি মেয়ে ছিল! এবং সেও দেখত-আপনি কত অসাধারণ একজন মানুষ!
ঐ দুর্ঘটনার পর জুডির প্রতি তীব্র ঘৃণা নিয়ে আমি বেঁচে ছিলাম। আপনি এই অন্যায় ঘৃণা থেকে তাকে মুক্তি দিয়েছেন। জুডির হয়ে আমি আপনাকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি।
ভদ্রলোকের গলা ধরে এল। তিনি চোখ থেকে সানগ্লাস খুলে ফেলে বললেন, মিসির আলি সাহেব, তাই দেখুন—আমার দুটি চোখ থেকেই এখন পানি পড়ছে। চোখ পাথরের হলেও চোখের অশ্রাগ্রন্থি এখনো কার্যক্ষম। কুড়ি বছর পর এই ঘটনা ঘটল। আচ্ছান্ন ভাই যাই।
দু, মাস পর আমেরিকা থেকে বিমান-ড়াকে মিসির আলি বড় একটা প্যাকেট পেলেন। সেই প্যাকেটে জলরঙে আঁকা একটা চেরি গাছের ছবি। অপূর্ব ছবি।
ছবির সঙ্গে একটি নোট। রাশেদুল করিম সাহেব লিখেছেন: আমার সবচেয়ে প্রিয় জিনিসটি আপনাকে দিতে চাচ্ছিলাম। এই ছবিটির চেয়ে প্রিয় কিছু এই মুহূর্তে আমার কাছে নেই। কোনোদিন হবে বলেও মনে হয় না।