চোখ – আনন্দ বাগচী
এক একদিন এরকম হয়। ওরা চলে যাবার পরও আড্ডা থামে না। আড্ডা তখন আমার মগজে পুরোনো ফাটা ‘রেকর্ডের’ মতো বাজতে থাকে। মেসের এক চিলতে ঘরে দড়ির খাটিয়ার ওপর চিৎপাত হয়ে শুয়ে বেড সুইচ নিবিয়ে নিস্পন্দ হয়ে পড়ে থাকি। আমার কানের মধ্যে ভূপতি আর নলিনাক্ষর আবেগমাখা অফুরন্ত কথা আর তর্কবিতর্ক, যুক্তি আর পালটা যুক্তি ধারাবাহিক বাজতে থাকে। বিষয় থেকে বিষয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে চলা এক অসংলগ্ন নাবিকের মতো। বা কখনো কোনো একটি ঝলসে ওঠা সংলাপ পিন বসে যাওয়া ফাটা রেকর্ডের মতো একটি দুটি শব্দের আখরে মুহুর্মুহু বাজতে থাকে। তারপর একসময় ঠাকুর এসে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে গলায় খাঁকারি দিয়ে ডাকে, বাবু খেতে আসেন!
ভূপতি ডাক্তার। হাসপাতালের সার্জন। প্রাইভেট প্র্যাকটিস করে না বলে তার হাতে সময় আর মাথায় খেয়ালের অন্ত নেই। কী একটা দুরূহ বিষয় নিয়ে ও অনেক দিন থেকে নিঃশব্দে গবেষণা করে চলেছে। আর নলিনাক্ষ কোনো কলেজের বটানির প্রফেসার। ওঁর লেখা টেক্সটবুক বাংলা ভাষায় একমাত্র বই যাকে অনেকেই সশ্রদ্ধ ঠাট্টায় বটানির বাইবেল বলে। একটা বইই ওকে বড়োলোক করে দিয়েছে। ওদের দুজনের মাঝখানে আমি হাইফেনের মতো এখনও বন্ধুত্বে অচ্ছেদ্য হয়ে আছি। কমনফ্রেন্ড যাকে বলে। আমি নিজেও সত্যিই কমন। বিয়ে—থা করিনি, চালচুলো নেই, মেসে থাকি। চাকরিটাও সাদামাটা। খবরের কাগজে। রং ফলিয়ে বলা যায় সাংবাদিক, আসলে খবরের কেরানি। টেলিপ্রিন্টারের নিউজপ্রিন্ট বাংলা তর্জমা করি, সাজাই, হেডিং তৈরি করি, ব্যস এই পর্যন্ত। আর আড্ডায়ও আমার ভূমিকা গৌণ, ওদের তর্কাতর্কিকে উসকে দিয়ে দিয়ে জিইয়ে রাখা, চাঙ্গা করা।
আর ওরা আসে বলেই আমার যে শুধু সময় কাটে তাই না, আমি লাভবানও হই। অনেক নতুন কথা শুনতে পাই, জ্ঞানের কথা, অভিজ্ঞতার কথা, আবিষ্কারের কথা। ওরা দুজনেই বইয়ের পোকা, আর আমি বইকুণ্ঠ, কলেজ—ইউনিভার্সিটি ছাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বইও ছেড়েছি। এখন খবরের কাগজ ছাড়া ছাপা অক্ষরের সত্যি আমার কদাচিৎই সাক্ষাৎ হয়। তাই আমার রস আর রসদ আসে আমার ওই দুটি বন্ধুর কাছ থেকে। নলিনাক্ষর কাছ থেকেই আমি অনেক বিচিত্র আর বিলীয়মান গাছের কথা শুনেছি। অনেক দুষ্প্রাপ্য গাছের বটানিক্যাল নাম পর্যন্ত আমার কণ্ঠস্থ হয়েছে। আজ সবাই জানে গাছের প্রাণ আছে একথা আবিষ্কার করেছিলেন এক বাঙালি ভদ্রলোক। কিছু গাছেরও যে মন আছে; স্মৃতি আছে, রুচি অরুচি আছে, তারাও যে মানুষের মতো কথা বলে, এমনকী মানুষের সঙ্গেও, ভয়ে ক্রোধে ভালোবাসায় উত্তেজিত হয়, হার্টফেল করে মারা যেতে পারে সে কথা নলিনাক্ষ না থাকলে আমি জানতেই পারতাম না।
আজকে ছিল ভূপতির দিন। আলোচনাটা শুরু করেছিল রাজনীতি নিয়ে, হাসপাতালের অচল অবস্থা নিয়ে। তারপর জ্যোতিষী, প্ল্যানচেট, জন্মান্তর ইত্যাদি বিষয়ে দুই বন্ধুর মল্লযুদ্ধ হতে হতে অ্যানাটিমি—ফিজিওলজিতে এসে ঠেকল!
প্রথমে বেশ হালকা ভঙ্গিতেই শারীরিক অসংগতি নিয়ে কথা শুরু হয়েছিল। প্রায় সেটা আরম্ভ হয়েছিল নলিনাক্ষর তরফ থেকেই। ও বলছিল, এরকম দেখেছি, এক একজন মানুষের চেহারা আর চরিত্রের সঙ্গে তার কোনো বিশেষ অঙ্গপ্রত্যঙ্গের মিল হয়নি। নিখুঁত মূর্তি গড়তে গড়তে ভগবান মাঝে মাঝে কেন এমন করেন জানি না। কারও হাত মনে হয় তার নিজের নয়, শরীরের ছাদের সঙ্গে একদম মানায়নি, কিংবা হাতের সঙ্গে আঙুলগুলো, বেমানান দেখলেই মনে হয় হাতে ঝুলিয়ে নিয়ে যাচ্ছে— দু—ছড়া কলার মতো। মাথা যেন মাথা নয়— ঘাড়ে চেপে বসেছে উটকো ভাড়াটের মতো। এইভাবে কারও নাক, কারও কান, কারও পা। একজন ঢিলে—ঢালা অলস স্বভাবের মানুষ, দেখলেই বোঝা যায় আঠারো মাসে বছর কিন্তু হাঁটে যখন মনে হয় টাট্টু ঘোড়া ছুট লাগিয়েছে।
আমি বলছিলাম, হ্যাঁ, এই অমিলগুলো হাসির কারণও হয়ে ওঠে কখনো কখনো। হয়তো আড়াইমন ওজনের পিপের মতো মোটা লোকটা পেনসিলের সিসের মতো সরু গলায় কথা বলে ওঠে। আবার প্যাঁকাটি মার্কা নির্জীব চেহারার মানুষের গলায় মেঘ ডেকে ওঠে, চমকে গিয়ে তখন তোমার রবীন্দ্রনাথের সেই কবিতার লাইনটাই মনে পড়বে: অ্যাতোটুকু যন্ত্র হতে এতো শব্দ হয়, সত্যি বিষম বিস্ময়কর ব্যাপারই বটে!
নলিনাক্ষ হাসল, হ্যাঁ, এই বিশ্বচরাচরের সমস্ত ব্যাপারের মধ্যেই একটা অদৃশ্য হার্মনি আছে। ছোটো ঘড়ি বড়ো ঘড়ি সব এক মাত্রায় চলছে। নিক্তি মাপা রাস্তায়। কিন্তু কখনো কখনো কিছু ব্যাপার খাপছাড়ার মতো ঘটে। কেমন যেন শ্রিংকোনাইজ করে না। ঘড়ির কাঁটা এক কথা বলছে কিন্তু তার বাজনা অন্য কথা। বাড়িতে আটটা বেজেছে হয়তো কিন্তু ঢং ঢং করে বারোটা বেজে গেল, দেখোনি কখনো? মানুষের চোখে আর ঠোঁটেও এমনি ঘটনা ঘটতে দেখেছি। ঠোঁটের সঙ্গে চোখ মিলছে না, কিংবা চোখের সঙ্গে ঠোঁট। হয়তো হাসির কথা বলছে। ঠোঁট—মুখ হাসিতে ফেটে পড়ছে কিন্তু চোখ হাসছে না, কেমন বিষণ্ণ কিংবা ক্রুদ্ধ হয়ে গেছে। খুব নিবিষ্ট হয়ে কোনো সমস্যার কথা ভাবছে লোকটা কিন্তু তার চোখ দুটো খঞ্জনি পাখির মতো নেচেই চলেছে অনবরত। কিংবা হাসছে রহস্যময় হাসি।
ভূপতি লুফে নিল কথাটা, ‘ইয়েস নলিন, তুমি একটা জব্বর প্রশ্ন তুলেছ কিন্তু তার আগে বলি, চোখ আমাদের একটা ভাইটাল অর্গান। প্রতিমায় দেখোনি চক্ষুদান করা হয় সকলের শেষে, চক্ষু যোজনা মানেই প্রাণ প্রতিষ্ঠা। জড় পদার্থ দেখতে পায় না, কেননা তাদের প্রাণ নেই। তোমার সাবজেক্টেই আসি, গাছ দেখতে পায়, তার চোখ আছে, সে যে প্রাণী এইটেই তার সবচেয়ে বড়ো প্রমাণ। চোখ আমাদের অর্ধেক মগজ, বলতে গেলে আমাদের বারো আনা মনই বাঁধা আছে তার মধ্যে। জীবনের একটা প্রধান ধর্মই হচ্ছে গ্রহণ এবং বর্জন। চোখের ভিতর দিয়ে সেই কাজটাই আমরা প্রতিমুহূর্তে করে যাচ্ছি। চোখ তাই কেবল শরীরের সৌন্দর্য বর্ধন করে না, সে আমাদের চেতনা বা প্রাণকে সজাগ রাখে।
আমি হেসে উঠলাম শব্দ করে। আমার হাসি মানেই উসকানি। বললাম, ‘তোমার কথাগুলো আমি ঠিক গিলতে পারছি না, বেজায় গুরুপাক হয়ে যাচ্ছে, ভূপতি। তোমরা বিজ্ঞানীরা আমি দেখেছি সহজ ব্যাপারটাকে কেমন জটিল করে তুলে আনন্দ পাও। চোখ জিনিসটা তো শুধু দেখবার জন্যে, যেমন চশমা। তার মধ্যে ফালতু এতসব ব্যাপার ঢুকিয়ে দিচ্ছ কেন?’
ভূপতি রেগে গেল। বলল, ‘তোমার মুণ্ডু! সত্যি, মাথায় যদি তোমার শুধু গোবর পোড়া থাকত তাহলেও আশা ছিল। গোবর থেকে গ্যাস হয়, তা থেকে জ্বালানি, আলো, বৈদ্যুতিক শক্তি পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু যাদের খুলির মধ্যে শুধু রীম রীম নিউজ প্রিন্ট ঠাসা তারা হোপলেস! চোখ দুটো দিয়ে কি আমরা শুধু দেখিরে হতভাগা! চোখ দিয়ে আমরা যেকোনো জিনিসকে ছুঁতে পারি, আস্বাদন করতে পারি। আমাদের শাস্ত্রে আছে ঘ্রাণে অর্ধেক ভোজন হয়। কথাটার মধ্যে বৈজ্ঞানিক ভিত্তি আছে। চোখ দিয়েও আমরা খেতে পারি, শুনতে পারি, কথা কইতে পারি। ভিসুয়্যাল মেমরি বলে একটা কথা শোনা আছে নিশ্চয়। তা চোখের সত্যিই স্মরণ ক্ষমতা আছে, স্মৃতি আছে। একবার তার নিজস্ব, মস্তিষ্ক নিরপেক্ষ স্বাধীন ব্যাপার। বুঝলে ব্রাদার, এরকমটা নির্ভুল কমিউনিকেটিভ কম্পিউটার তুমি সারা দেহ তল্লাশি করলেও পাবে না। এই ব্যাপারটা নিয়ে আমি বহুকাল থেকে গবেষণা করে চলেছি। হয়তো একদিন প্রমাণ করে দিতে পারব।’
জানতাম। ভূপতির গবেষণার ব্যাপারটা আমার যে একেবারে অজানা ছিল তা নয়। নিউক্লিয়ার জিনিস নিয়ে ও কি সব পরীক্ষানিরীক্ষা করছিল তাও জানি। আমাদের শরীরের সবচেয়ে ছোটো ইউনিট সেল বা কোষের যে নিজস্ব একটা জীবন আছে প্রাণ আছে, আলাদা করে বেঁচে থাকা আছে এরকম একটা কথা ভূপতিই আমাকে একদিন বলেছিল। এই ইনার ইউনিভার্স এই অন্তর্বিশ্ব যার রহস্যের দরজায় ও ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপ নিয়ে মাথা খুঁড়ে মরছে। কিন্তু চোখ, যা সহজেই আমাদের চোখে পড়ে, কোনো সূক্ষ্ম অতি সূক্ষ্ম যন্ত্রের দরকার হয় না, তা নিয়ে যে এতখানি মাথা ঘামিয়েছে সেইটেই জানতাম না।
আজকেও ওরা চলে যাবার পর আলো নিবিয়ে খাটিয়ার ওপর চিৎপাত হয়ে আমি একটা ঘোরের মধ্যে পড়েছিলাম। না ঘুমোইনি, নিশ্চয়ই ঘুমোইনি। এই উত্তেজক আলোচনার সঙ্গে নিজের চিন্তাভাবনা মিশিয়ে কিছু ভাববার চেষ্টা করছিলাম। আমি বিজ্ঞানের ছাত্র নই, আমার চিন্তা সেই পথ ধরেও এগোচ্ছিল না। বুদ্ধিতে যার ব্যাখ্যা চলে না এমন এক রহস্যের জট পাকানো সুতোর তাল দিয়ে নাড়াচাড়া করছিলাম মাত্র। জন্মান্তর, এই জীবনের বাইরের জীবন, মানুষের ইচ্ছাশক্তি, জিনের স্রোত বেয়ে আসা মানুষের সংস্কার, অভ্যেস এবং সব শেষে এই অলৌকিক ক্যামেরা চোখ— যার ভেতর দিয়ে একজনের মন আর একজনের মধ্যে গিয়ে পৌঁছায়, সম্মোহনের এই চাবি কাঠি, এই এক ধরনের রিমোট কন্ট্রোল নিয়ে কল্পনার জাল বুনে চলেছিলাম এমন সময় আমার নাম ধরে কেউ ডাকল! ডাকল খুব কাছ থেকে, অদ্ভুত গলার, আমার এক চিলতে ঘরের ঠিক দরজায় এসে।
এক ঝটকায় যেন গোটা মাকড়সার জালটা ছিঁড়ে আমার হাতে মুখে জড়িয়ে গেল, কে! আমি ধড়মড়িয়ে উঠে বসলাম। প্যাসেজের জিরো ওয়াটের কমজোরি আলোয় দেখলাম চৌকাঠে হাত রেখে এক সিলুয়েট মূর্তি।
‘ঘুমিয়ে পড়েছিলেন নাকি?’
‘কই না।’
হাত বাড়িয়ে সুইচ টিপলাম। বার কয়েক চোখ পিট পিট করে টিউব লাইটটা জ্বলে উঠল। আলোয় চিনলাম। আমাদের মেসের নতুন বোর্ডার। সুশ্রী, ছিপছিপে, নায়ক—নায়ক চেহারা। একবার তাকালে ঝট করে চোখ সরিয়ে নেওয়া যায় না। বয়স গোটা পঁয়ত্রিশের মধ্যে। দিন পাঁচেক হল এখানে এসে উঠেছেন, কিন্তু আলাপ হয়নি। এমনিতেই আমি একটু অমিশুক তার ওপর গোটা সপ্তাহটাই নাইট ডিউটিতে গেছে। নিশাচর প্রাণীর মতো দিনে ঘুমানো আর সন্ধে হলেই কোটর ছেড়ে বেরিয়ে পড়া। তবু আসতে যেতে দু—এক ঝলক দেখেছি দূর থেকে।
‘একখানা চেয়ার এগিয়ে দিয়ে বললাম, ‘আসুন আসুন।’
‘সরি, ডিসটার্ব করলাম নাকি।’
‘না না সে কি!’
‘দীপক ব্যানার্জি, পাবনা থেকে এসেছি।’ চেয়ারে ডবসে পড়ে সহাস্যে নমস্কার জানালো।
‘আমি ধ্যানেশ সেন, খবরের কাগজে আছি।’
‘জানি। মানে শুনেছি। আমি তো আপনার পাশের ঘরেই আছি।’
আমি জানতাম না, কারণ পাশের ঘরে অন্য একজন ছিলেন। তিনি বোধহয় ঘর বদলে নিয়েছেন। এটা সেটা দু—চার কথায় আলাপ জমে উঠল। দীপকের বাড়ি পাটনায়। অবস্থা বেশ ভালো। চাকরিটা শখের। এক ওষুধ কোম্পানির রিপ্রেজেন্টেটিভ, বদলি হয়ে কলকাতায় এসেছে।
ইতস্তত করে একসময় বলল, ‘আপনার বন্ধুটি কি চোখের ডাক্তার?’
প্রসঙ্গটা ধরতে না পেরে আমি জিজ্ঞাসু চোখে ওর মুখের দিকে তাকালাম। আর তখনই সত্যি করে চমকালাম। এতক্ষণ মনের যে অস্বস্তিকর কারণটা ঠিক ধরতে পারছিলাম না, এবার স্পষ্ট করে চোখে পড়ল। সেই চোখ। দীপকের চোখ দুটো কেমন সবুজ লুমিনাস পেন্টের মতো, থেকে থেকে আলো পড়ে জ্বলে উঠছে। কিছু কিছু পশুর চোখ এরকম জ্বলে কিন্তু সেটা তেমন কোনো ব্যাপার নয়। আসল ব্যাপার বোধহয় অন্য! ওর চোখের দিকে ভালো করে তাকিয়ে মনে হল আর দশজনের যেমন হয় তেমন না। এ চোখ যেন ওর সমস্ত অস্তিত্বের বাইরে আলাদা এক ব্যক্তিত্ব। যেন আলাদা একটা মানুষ ওই চোখের ভেতর দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। শিরদাঁড়ার ভেতরটায় কেমন শিরশির করে উঠল। বুদ্ধি কিংবা কথা দিয়েও ঠিক ব্যাখ্যা করা যায় না। একটা অশরীরী অস্তিত্বের গন্ধ পাচ্ছিলাম যেন।
আমার মুখের চেহারা নিশ্চয় পালটে গিয়েছিল। ভয়—পাওয়া লোকের মতো ফ্যাকাসে দেখাচ্ছিল।
চাপা গলায় দীপক বলল, ‘আমার চোখের দিকে কী দেখছেন অমন করে?’
ধরা পড়ে গিয়ে আমি তাড়াতাড়ি কথা ঘোরালাম, ‘কই না। ভাবছিলাম আপনি আমার কোনো বন্ধুর কথা জিজ্ঞেস করছেন।’
গলা পরিষ্কার করে নিয়ে দীপক বলল, ‘ক্ষমা করবেন, এটাকে আড়ি পাতা ভাববেন না। আপনাদের আড্ডার সব কথাই আমি স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছিলাম পাশের ঘর থেকে। ভেরি ইন্টারেস্টিং সাবজেক্ট, অন্তত আমার কাছে। আপনার যে বন্ধুটি চোখের কথা বলছিলেন, উনি নিশ্চয়ই আই স্পেশালিস্ট?’
‘ও তাই বলুন। না। চোখের ডাক্তার না। তবে— ‘
‘তবে?’
‘চোখের ব্যাপার নিয়ে ওর একটা কেমন খ্যাপামি আছে। চক্ষু বিষয়ে কী একটা গবেষণা করছে বলল।’
‘শুনলাম। তবে আই মাস্ট সে খ্যাপামি নয়। আমি এ ব্যাপারে একেবারেই অজ্ঞ, আনাড়ি। তবু বলব, ওঁর অ্যানালিসিস আমাকে চমকে দিয়েছে, চোখ ফুটিয়েছে—’
আমি কথা বলছিলাম কিন্তু আমার চোখ দুটোকে যেন কোনো জোরালো চুম্বক টানছিল। চুরি করে এক আধ পলকের জন্য আমি দীপকের চোখের দিকে তাকাচ্ছিলাম। আর একবার চমকে দিয়ে দীপক শব্দ করে হেসে উঠল। বিস্মিত গলায় বললাম, ‘হাসছেন?’
দীপক মাথা নেড়ে বলল, ‘হ্যাঁ। এ হাসি অনেক দুঃখের, ধ্যানেশবাবু।’
‘বুঝলাম না।’
‘ইফ ইউ ডোন্ট মাইন্ড, একটা প্রশ্ন করব।’
‘কী প্রশ্ন?’ অস্বস্তি নিয়ে প্রশ্ন করলাম।
‘আপনি আমার চোখ দেখছিলেন! দেখছিলেন না?’
একটু সময় নিয়ে শেষে শুকনো গলায় বললাম, ‘হ্যাঁ।’
‘দেখে কি মনে হচ্ছে? এ আমার নিজের চোখ নয়, তাই না?’
উত্তর দিতে পারলাম না। বুকের ভেতরটা কেমন কেঁপে গেল। লোকটা কি মনের কথা সব টের পায়! বিব্রত হয়ে চুপ করে থাকলাম।
‘ঠিকই ধরেছেন। এ চোখ আমার নিজের নয়।’
আমি হতভম্ব। দীপক আমার দিকে তীব্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। ভাবছি কিছু একটা বলা দরকার। কিন্তু আমাকে কিছুই বলতে হল না, ও নিজেই আবার কথা বলল।
‘বিলিভ মি। এ চোখ আমার সত্যিই নিজের নয়। আর সেটা বুঝতে পারলাম প্রথম কলকাতায় এসে। তা দিন দশেক আগে, তখনও মেসে এসে উঠিনি। এখানে এসে প্রথমে একটা ভাড়া বাড়িতে উঠেছিলাম। তারপর সেখান থেকে পালিয়ে এই মেসে। একটা বিবর্ণ হাসি দীপকের ঠোঁটে ভেসে উঠে ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল, ‘কিন্তু আমি মূর্খ, নিজের কাছ থেকে কি কেউ পালাতে পারে!’
ভদ্রতাবশত আমি বাধা দিলাম, ‘কী বলছেন আপনি! আপনার কথার মাথামুণ্ডু কিছু বুঝতে পারছি না।’
‘পারবেন। তবে সে এক লং স্টোরি। আপনাকে বোর করছি না তো?’
দীপককে দেখে, তার কথা শুনে আমার কৌতূহল ক্রমশ বাড়ছিল। এই চোখের পিছনে কী রহস্য লুকোনো আছে কে জানে।
বললাম, ‘ঠিক উলটো। বলুন আপনি। গল্প শুনতে কার না ভালো লাগে!’
‘এটা কিন্তু গপ্পো নয়। ফ্যাকট, সত্যি ঘটনা। ব্যাকরণ ভুল হল নিশ্চয়ই, ট্রু ফ্যাকটের মতো। তবে আপনার ভাবনার কোনো কারণ নেই, যতদূর সংক্ষেপে বলা যায় তাই বলব।’
দীপকের কথাগুলোকে ছাঁটকাট করে সাজালে তার মুখের গল্পটা এইরকম দাঁড়ায়:
সম্পূর্ণ অন্ধ হয়ে গেলে এই পৃথিবী, এই চারপাশ, এই জীবন কেমন লাগে আমার জানা আছে। কারণ একটানা পাঁচবছর আমি কমপ্লিট ব্লাইন্ড হয়ে ঘরে বসেছিলাম। আমার দুনিয়া তখন দু—হাতের গণ্ডির মধ্যে, হাতড়ে বেড়ানো ছোট্ট পরিধির মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে গিয়েছিল। ঘড়ি তখন শুধু কানে শোনা একটা বাদ্যযন্ত্র ছাড়া কিছু নয়। প্রহরে প্রহরে ভাগ করা, দিন আর রাত একাকার হয়ে গিয়ে অনিঃশেষ একটি ভয়ংকর রাত্তির হয়ে গিয়েছিল, যে রাত্রে চাঁদ নেই, তারা নেই, নিরেট নিশ্ছিদ্র অন্ধকার ছাড়া কিছু নেই। আমার জীবন অর্থহীন, আমার আহার বিস্বাদ, আমার প্রিয় বইগুলো বোবা। সম্পূর্ণ একলা মানুষের চেয়েও আমি নিঃসঙ্গ, একা। শব্দ এবং নৈঃশব্দের মাঝখানে বন্দি প্রেতের মতো ভেসে রয়েছে। এই যন্ত্রণার তুলনা হয় না।
অথচ দুর্ঘটনা যখন ঘটে এরকমই অকারণে এক পলকে ঘটে যায়। ঘটনার পিছনে যুক্তি থাকে, কিন্তু দুর্ঘনার কোনো যুক্তি নেই। অর্থাৎ সেটা না ঘটতেই পারত তবু ঘটল। আমার তিরিশ বছরের জীবনে বছর বছর হোলির দিন এসেছে, চলে গেছে। সাবান মেখে সে আবির আর রং তুলে ফেলেছে। কিন্তু প্রায় পাঁচ বছর আগে দোলের দিনটি বোধহয় আলকাতরার মতো কালো রং নিয়ে এসেছিল। সেদিন ফাগুয়ার তাণ্ডবের মধ্যে কেউ আমার চোখে রং ছুঁড়েছিল। কী ছিল সেই রঙের মধ্যে জানি না, অনেক কষ্টে যখন চোখ খুললাম তখন দুটো চোখেই আর দৃষ্টি নেই, বেবাক অন্ধ হয়ে গেছি। চোখের সামনে যেন কোনো মানুষ নেই, দৃশ্য নেই, কিচ্ছু নেই। তবু তখনও একটু আলো ছিল, ঠিক আলো নয়, আলোর আভার মতো। ঠিক কী রকম জানেন, গভীর জলের তলায় ডুব দিয়ে চোখ খুললে যেমন দেখা যায় অনেকটা সেই রকম। ডাক্তার বদ্যি এলেন কিন্তু তাঁরা বিদায় নেবার আগেই সে আভাটুকুও আমার দুচোখ ছেড়ে চলে গেল।
পাটনায় আমরা তিন পুরুষের প্রবাসী বাঙালি। আমার ঠাকুরদা ছিলেন বিহারের ও অঞ্চলের বিধান রায়। বাবা এখনও ডাকসাইটে অ্যাডভোকেট। দুই পুরুষের জমানো সম্পত্তি আমার একটা জীবনেও ফেলে ছড়িয়ে বোধহয় শেষ করতে পারব না। কত বড়ো বড়ো কানেকশান আমাদের। দিল্লির দরবার ইস্তক ছড়ানো। তবু শেষ চেষ্টা, ভাই ব্যাঙ্ক থেকে একজোড়া চোখ পেতে আমাকে দীর্ঘকাল অপেক্ষা করে থাকতে হল। রক্ত বললেই যেমন রক্ত, ব্লাড গ্রুপ মিলতে হয়, চোখ বললেই তেমনি চোখ নয়। আমাদের দেহকোষ বা সেলের আধার যে টিস্যু, তার স্বভাব, তার চরিত্রও বিচিত্র। ফরেনবডিকে সহজে গ্রহণ করতে চায় না। বোধহয় তারও পছন্দ অপছন্দ আছে।
শেষপর্যন্ত তেমন চোখ পাওয়া গেল। অপারেশনও সাকসেসফুল হল। আমি আবার আগের মতোই দৃষ্টি ফিরে পেলাম। আগে লেখাপড়া করার জন্য চশমার দরকার হত, এখন হয় না। চোখ ভালো হল, কিন্তু চশমা বেচারি ইনভ্যালিড হয়ে গেল, তার চোখ হারাল। আমি খুশি, আমার যেন পুনর্জন্ম হল। আমি আবার পুরোনো কাজে বহাল হলাম।
দিন যাচ্ছিল তরতর করে, ভালোই। কিন্তু কোথায় যে ছন্দ কেটে গেছে, টের পাইনি তখনও। আসলে আমার স্বভাবের মধ্যে পরিবর্তন আসছিল! চির ধরছিল মনের মধ্যে। সব মানুষের মনের মধ্যেই হ্যাঁ আর না থাকে। অর্থাৎ এক মনের মধ্যে দুই মন। এক মন যাতে সায় দেয়, অন্য মন তাতেই বাগড়া দিতে চায়। তবে এটা খুবই অস্পষ্ট আকারে এবং কখনো কদাচিৎ, তাই তেমন করে বুঝতে পারা যায় না। কিন্তু আমার কেস আলাদা, দুটোই সমান জোরালো। থেকে থেকে টাগ অফ ওয়ার লেগে যায়। এর ফলে কি না জানি না, আমি ক্রমশ কেমন রাগী হয়ে উঠছিলাম।
এই সময় অফিস থেকে আমাকে কলকাতায় পাঠাতে চাইল। আগের দিন হলেই নিশ্চয়ই এই বদলিতে রাজি হতাম না। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার, আমার জন্যে আমার মনটা কেমন নেচে উঠল। চলে এলাম, বাড়ির অমত সত্ত্বেও। বাসাও ভাড়া নিলাম একটা। কিন্তু কলকাতায় এসে একটা নতুন উপসর্গ দেখা দিল। আমার চোখের থেকে ডবল ভিসন দেখতে লাগলাম, ডবল ইমেজ বললে স্পষ্ট হবে কথাটা। প্রথম দিনের কথাই বলি। কলকাতায় সেটা আমার দ্বিতীয় দিন। একটা রাস্তা দিয়ে হনহনিয়ে যাচ্ছিলাম হঠাৎ থমকে দাঁড়াতে হল একটা চেনা দোকান দেখে। থরে থরে কাচের শোকেসের ওপিঠে যে লোকটি বসেছে সে আমার বহুদিনের চেনা। এমনকী তার পেছনের ক্যালেন্ডারের ছবিটি পর্যন্ত। মনে পড়ল এই দোকানে কতদিন সরপুরিয়া খেয়েছি। পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলাম। মাই গড! একি দেখছি। ক্যালেন্ডারের সালটি ১৯৭৪। ঠিক দশ বছর পুরোনো। এরকম ঝকঝকে দোকানে এক পুরোনো ক্যালেন্ডার? চোখ রগড়ে তাকালাম। দৃষ্টি বিভ্রম ছুটে গেল। দেখলাম, না। ১৯৮৪ সালেরই ক্যালেন্ডার। আর ছবিটা আদৌ আমার চেনা নয়। চেনা নয় ক্যাশবাক্স আগলে বসা লোকটাও। আর সবচেয়ে তাজ্জব ব্যাপার, কাচের শোকেসের রসগোল্লা সন্দেশ সরপুরিয়া কোনো ভোজবাজিতে রুপোর গয়না হয়ে গেছে। ঝকমকে বাউটি, কানপাশা, টায়রা, কাঁকই। যেন ইলেকট্রিক শক খেলাম। খেয়াল হল এই রাস্তায় জীবনে এই প্রথম পা রেখেছি। আসলে কলকাতায় এই আমার স্বচক্ষে আসা। এর আগেও একবার অবশ্য এসেছিলাম, মাস কয়েক আগে। সে তো সোজা হাসপাতালে, অন্ধ অবস্থায়। আই গ্র্যাফটিংয়ের পর কালো চশমা পরে সোজা দমদম এয়ারপোর্ট। সুতরাং চেনা লাগবার আদপেই কোনো রাস্তা নেই।
আমাকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকতে দেখে জিজ্ঞেস করল, কী চাই আপনার, বলুন দেখাচ্ছি।
আমি ঢোক গিলে বললাম, এখানে কাছে পিঠে একটা মিষ্টির দোকান ছিল না?
ছিল, কিন্তু এখন নেই। লোকটা হাসল, আপনি বোধহয় অনেককাল এ পাড়ায় আসেননি?
কেন বলুন তো?
এইটেই মিষ্টির দোকান ছিল। বছর দুই আগে—
লোকটিকে কথা শেষ করতে না দিয়ে আমি পালিয়ে এসেছিলাম সেদিন। কিন্তু পরপর আরও গুটি তিনেক ঘটনা ঘটল সেই দিনই। সবই দৃষ্টি বিভ্রমের। কোনোটার সঙ্গে কোনোটার মিল নেই। উলটোপালটা, রহস্যময়। সেসব ডিটেলস বলে আপনাকে বোর করব না! তবে কথাটা এই, রীতিমতো ভড়কে গেলাম। কেমন মনে হল চোখ খারাপ হয়েছে, তাই এরকম ইলিউশন দেখছি। বোধহয় চশমাই নিতে হবে।
একজন নামকরা আই স্পেশালিস্টের কাছে গেলাম। তিনি নানাভাবে পরীক্ষা করে বললেন, আপনার চোখের স্বাস্থ্য বোধহয় আপনার থেকেও ভালো। আপনি বরং অমুক ডাক্তারের সঙ্গে আজই দেখা করুন। ওঁর চিঠি নিয়ে সেখানে গেলাম। তিনি সাইকিয়াট্রিস্ট। সাদা বাংলায় পাগলের ডাক্তার। আমাকে নানাভাবে বাজিয়ে দেখলেন। তারপর দাঁত খিঁচিয়ে বললেন, দূর মশাই, আপনার চোদ্দো পুরুষে কেউ পাগল নয়। সাধের পাগল না সেজে সোজা বাড়ি যান। একটা ঘুমের বড়ি দিচ্ছি। সেটি গিলে একখানা উনিশ রীলের ঘুম লাগান। দেখবেন ফ্রেশ হয়ে গেছেন।
ঘুমের বড়ি আর হালকা মন নিয়ে বাসায় ফিরেছিলাম সেদিন। কিন্তু সব মাটি করে দিল একখানা আয়না। দাড়ি কামানোর আয়নায় নিজের চোখের দিকে তাকিয়ে চমকে উঠলাম। শিরশির করে উঠল শিরদাঁড়ার ভেতরটা। কী দেখলাম জানেন? নিশ্চয় জানেন। একটু আমার চোখে আপনি যা দেখেছেন ঠিক তাই।
তারপর সে রাতে ঘুমের বড়ি খেয়েও কোনো লাভ হল না। ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘের মতো টুকরো টুকরো তন্দ্রা মাখা ঘুম ভেসে যেতে লাগল চোখের ওপর দিয়ে। প্রতিবারই জেগে উঠে আমার একটা অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল আমার গায়ের সঙ্গে গা মিলিয়ে আর একটা লোক শুয়ে আছে আমার পিছনে। তার গায়ে অসম্ভব তাপ, যেন পুড়ে যাচ্ছে। যন্ত্রণায় নিঃশব্দে ছটফট করছে লোকটা। থেকে থেকে তার ছোঁয়া লাগছে আমার গায়ে। সে ছোঁয়া কী রকম জানেন। বোবায় ধরলে, কিংবা হঠাৎ ভূতের ভয় পেলে যেরকম গাটা ভারী হয়ে যায় সেই রকম।
পরদিন ধুম জ্বর নিয়ে জ্ঞান ফিরল যখন, তখন দুপুর গড়িয়ে গেছে। এক সহকর্মীর বাড়িতে দিন দুয়েক কাটিয়ে তারই চেষ্টায় উঠে এলাম এই মেসে। এখানে অন্তত একা থাকতে হবে না। সিঙ্গল সিটের রুম দিতে চেয়েছিলেন ম্যানেজার, নিইনি। আমার ঘরে আর একজন ভদ্রলোক আছেন।
* * * *
দীপক ব্যানার্জির গল্পটা এইখানেই শেষ হতে পার। কিন্তু হল না। ভূপতি আর আমি কি করে ওর গল্পের সঙ্গে জড়িয়ে গেলাম। নলিনাক্ষ অবশ্য সব শুনে বলেছিল, ‘এটা বিজ্ঞানের যুগ। অলৌকিক গাঁজাখুরি গল্পের পেছনে তোরা যদি দৌড়াতে চাস দৌড়ো, আমি ওসবের মধ্যে নেই। লোকটার হয় মাথার গোলমাল, নয়তো মিথ্যে বলছে।’
‘মিথ্যে বলে লাভ?’
‘এক একজন লোক দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য ওরকম মিথ্যে বলে। তা ছাড়া অন্য ধান্ধাও থাকতে পারে।’
‘কী ধান্ধা?’
‘কী করে জানব!’ নলিনাক্ষ পাশ কাটিয়ে গেল। আমার অবশ্য ওরকম মনে হল না। দীপকের সঙ্গে কথা বলে যেটুকু বুঝেছি তাতে ওর মাথায় গোলমাল থাকতে পারে কিন্তু মিছে কথা বলছে না। আর অন্য কোনো মতলব নিশ্চয় নেই। ভূপতি তো ওর কেসটা লুফেই নিল। তার থিওরির এমন কংক্রিট উদাহরণ একেবারে হাতের গোড়ায় এসে যাবে, এ যেন ভাবাই যায় না। সবচেয়ে সুবিধের কথা এই, আমাদের তিনজনের মধ্যে ব্যাপারটা নিয়ে কোনো লুকোচাপা নেই। দীপক জানে আমরা তার শুভার্থী, তার এই বিপদের দিনে আমরা তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছি দুই ঘনিষ্ঠ বন্ধুর মতো।
ভূপতির অনুমান এই নতুন চোখজোড়া থেকে দীপকের এই বিপত্তি শুরু হয়েছে। কিন্তু একটা প্রশ্ন তবু থেকেই যায়। দৃষ্টি ফিরে পাবার পরেও কয়েকমাস দীপক পাটনায় ছিল। এই নতুন চোখের প্রতিক্রিয়া তাহলে তখন ঘটেনি কেন। সত্যি বলতে কী, কলকাতায় আসার পর ডবল ভিশন দেখার মতো কোনো ঘটনাই তার জীবনে ঘটেনি। কে ঘটেনি? কলকাতায় এসেই বা কেন ঘটল। এখানে এসে যে বাড়ি ভাড়া নিয়েছিল। সেই বাড়ির থেকেই কি তার ওপরে অলৌকিক কোনো শক্তি ভর করল? যে শক্তি তাকে অতীতকে দেখার শক্তি জোগায় কোনো কোনো মুহূর্তে? একই রাস্তায় একইসঙ্গে অতীত এবং বর্তমানকে পাশাপাশি দেখতে পাওয়া অবিশ্বাস্য ব্যাপার। ত্রিকালঙ সিদ্ধ—পুরুষরা অতীত বর্তমানের পাশে ভবিষ্যৎকে দেখতে পান। ফিল্মের ডাবল এক্সপোজারের মতো শোনা যায় ট্রিপল এক্সপোজার। তিনটে ছবিই পরস্পরের মধ্যে গায়ে গায়ে সাঁটা। তবে ওসব পৌরাণিক গাল—গল্প বলে উড়িয়ে দেওয়া গেলেও দীপকের ব্যাপারটা কী? ভৌতিক কাহিনি? তাহলে তো প্রেতাত্মায় বিশ্বাস করতে হয়।
ভূপতি কোনো গল্পে সন্তুষ্ট হবার মানুষ নয়। বিজ্ঞানের মাপকাঠিতেই সে সব কিছু মাপতে চায়। তাই তার খুঁটিনাটি প্রশ্নের শেষ নেই। দীপককে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে নানা কথা জিজ্ঞেস করে আর নোট নেয়। কোন হাসপাতালে কবে তার অপারেশন হয়েছিল, কে অপারেশন করেছিলেন। তার পাটনার ঠিকানা, কলকাতায় সেই ভাড়া বাসার ঠিকানা। অসুস্থ অবস্থায় যে সহকর্মীর বাড়িতে ছিল। যে চোখের ডাক্তার, যে সাইকিয়াট্রিস্ট তাকে দেখেছিলেন তাদের সকলের নামধাম বিবরণ যেভাবে সে নোট করে নিল তাতে বুঝলাম ভূপতির সামনে এখন হাতে কলমে অনেক কাজ। মুখে কিছু না বলুক, তার অনুসন্ধানী অভিযান শুরু হয়ে গেছে। দীপকের গল্প আমি অবিশ্বাস করছি না, কিন্তু সত্যি বলতে কি তার সঙ্গে আলাপ হবার পরে পুরো একটা সপ্তাহ কেটে গেছে অথচ ওরকম ঘটনা আর একদিনও ঘটেনি। ভূপতির কথা মতো দীপক দিন দশেকের ছুটি নিয়েছে, কাজে বেরোচ্ছে না। এই কদিন আমি আর ভূপতি পালা করে ওর সঙ্গে সেঁটে রয়েছি। একসঙ্গে খাই, ঘুমোই, বেড়িয়ে বেড়াই। বসে বসে গল্প করি। কিন্তু কোনো বিস্ময়কর ঘটনা পলকের জন্যেও ঘটেনি। নলিনাক্ষ প্রায় প্রতিদিনই আসে, দীপকের অলক্ষ্যে সে আমাদের দিকে তাকিয়ে বাঁকা হাসি হেসে চলে যায়। আমরা কিছুই বলি না, বলার কিই বা আছে। হাতেনাতে প্রমাণ দেখাতে না পারলে অবিশ্বাসীকে বিশ্বাস করানো যায় না। উলটে বিশ্বাসী মানুষের মনও ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে আসে। আমার মনের অবস্থা এখন খানিকটা সেই রকমই। দীপকের চোখ জোড়া দীপকের মুখের সঙ্গে মেলেনি, তার স্বভাবের সঙ্গে বেমানান হয়ে আছে— সেটা টের পাই। সেটা হতেই পারে, কারণ ওই চোখ ওর নিজের নয়, আর একজনের, বাইরে থেকে চেষ্টা করে জোড়া লাগানো। তাই এ—রকম মনে হতেই পারে। রাতের বেলায় এক আধ মুহূর্তের জন্যে ওর চোখের মধ্যে সবুজ আলোর ঝিলিক ভূপতিও দেখেছে। ওর চোখের ক্লোজআপ ছবিও ভূপতি তুলেছে কয়েকখানা।
কিন্তু এতে কি প্রমাণ হয়? কিছুই না। অবিশ্যি সুস্থ মনে হলেও দীপক এক এক সময়ে কেমন উলটোপালটা ব্যবহার করে। দারুণ হাসাহাসি গল্পগুজব চলছে হঠাৎ দীপক গম্ভীর হয়ে গেল, মিনিট দশেক গুম হয়ে বসে থাকল, একটি কথাও বলল না। কিংবা দিব্যি বেড়াচ্ছি, আচমকা কী হল, কোনো কথা না বলে ও হঠাৎ পিছন ফিরে হনহনিয়ে হাঁটা দিল। পরে এ কথা হলে ও অবাক হয়, ও বিশ্বাস করতে চায় না ও—রকম কিছু করেছে বলে। নলিনাক্ষ শুনে বলে, এ সবই শো বিজনেস বুঝলে।
আজকেও দুজনে বেড়াচ্ছিলাম। রোজ দু—চার মাইল আমরা এভাবে হাঁটি। ভূপতি আজ দিন তিনেক কলকাতায় নেই। বোধহয় পাটনায় গেছে। আজকাল ও যে কী করে, কী ভাবে, কিছুই ভেঙে বলে না। আমার ওপর শুধু একটা নির্দেশ রেখে গেছে, দীপককে যেন সবসময় চোখে চোখে রাখি। রাখছিও। আজকেও গল্প করতে করতে ফিরছিলাম। হঠাৎ একটা কাণ্ড হল।
ফুটপাথের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা একটা অ্যাম্বাসাডার সবে চলতে শুরু করেছে এমন সময় দীপক গাড়ির মধ্যে কাউকে দেখতে পেয়েই পাগলের মতো চিৎকার করতে করতে ছুটে গেল। আমি ভালো করে কিছু বুঝে ওঠার আগেই দেখলাম চলন্ত গাড়ির দরজা খুলে ফেলে বিদ্যুৎগতিতে সে গাড়ির ভেতর ঢুকে গেল। গাড়িটাও থামল না, টপ স্পিডে বেরিয়ে গেল। আমি বোকার মতো দীপকের নাম ধরে ডাকতে ডাকতে কিছুদূর পর্যন্ত দৌড়ালাম। শেষে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলাম রাস্তার মাঝখানে। ধারে কাছে একটা ট্যাক্সি পেয়ে গেলেও গাড়ির পিছু ধাওয়া করতে পারতাম হয়তো, কিন্তু দরকারের সময় এই শহরে হাতের কাছে কিছুই পাওয়া যায় না। বহুক্ষণ দীপকের জন্য অপেক্ষা করে শেষে মেসে ফিরে এলাম। কিন্তু সারারাত অপেক্ষা করেও যখন দীপক ফিরল না আমার দুশ্চিন্তা হতে লাগল। মনে হল কাল রাতেই আমার থানায় ডায়েরি করা উচিত ছিল।
থানায় যাবার জন্য জামা কাপড় পরছি এমন সময় সেই ভোর সকালে ভূপতি এসে হাজির, মুখে চোখে ক্লান্তি। চুল উসকোখুসকো কিন্তু ঠোঁটে একটা সাফল্যের হাসি। এ সময় ও কখনো আসে না। তাই ভীষণ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কিরে কী ব্যাপার? কোথায় ডুব মেরেছিলি এই কদিন?’
ভূপতি উত্তেজিত গলায় বলল, ‘সে অনেক কথা, পরে বলব। তবে আসল রহস্যের বোধহয় যবনিকা তুলতে পেরেছি। প্রথম থেকেই আমি এরকমটাই সন্দেহ করেছিলাম।’
আমি নিজের কথা, দীপকের কথা সেই মুহূর্তের জন্য ভুলে গিয়ে সংক্ষেপে ভূপতির অনুসন্ধানের যে কাহিনি শুনলাম সে সত্যি রোমাঞ্চকর। বছরখানেক আগে আমাদের কাগজের হেডলাইনগুলো আমার চোখে যেন ভেসে উঠল। কারণ সেগুলো আমিই লিখেছিলাম।
অনেকগুলো ডাকাতি মামলার ফেরারি আসামি ভাস্কর নস্কর ওরফে ফান্টাবাবুর হত্যার ব্যাপার নিয়ে তখন কলকাতায় ক—দিন খুব হইচই হয়েছিল। এই লোকটির শরীরে দুটি রিভলভারের বুলেট পাওয়া গিয়েছিল। কিন্তু সে জন্য নয়। একদল লোকের ধারণা হয়েছিল বেওয়ারিশ এই লোকটিকে দিয়ে আসামি সাজিয়ে পুলিশ অন্য কোনো বড়ো ব্যাপার ধামাচাপা দিতে চাইছে। পুলিশ অবশ্য ফান্টাবাবুর খুনিকে ধরতে পারেনি, শুধু খুনির ফেলে যাওয়া রিভলভার আর কয়েকফোঁটা রক্ত আবিষ্কার করেছিল। খুনির ব্লাড গ্রুপ আর আঙুলের ছাপ ছাড়া তাদের রেকর্ডে আর কিছু নথিপত্র হয়নি। এদিকে মুমূর্ষ লোকটি যে দৃষ্টান্ত রেখে গিয়েছিল তা অভাবনীয়, মৃত্যুকালে সে তার দুটি চোখই আই ব্যাঙ্ককে দান করে গিয়েছিল। তার এই শেষ ইচ্ছার কারণ হিসেবে বলেছিল, সে এখনই মরতে চায় না। আরও কিছুদিন বেঁচে থাকতে চায়। প্রায় কবির মতোই কথা। ‘মরিতে চাহিনা আমি সুন্দর ভুবনে। মানবের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই।’ যাইহোক, ভাস্করবাবু ওরফে ফান্টাবাবু সত্যিই ডাকাত ছিল কি না তা জানা না গেলেও সে যে অমানুষিক ইচ্ছাশক্তির অধিকারী ছিল সে বিষয়ে ডাক্তাররা দ্বিমত হননি। ছ—ছটি বুলেট হজম করে, ফুসফুসে—হৃৎপিণ্ডে সরাসরি জখম হয়েও কোনো মানুষ যে ঘণ্টাখানেক মৃত্যুর সঙ্গে সজ্ঞানে যুঝতে পারে এবং তার চোখ দুটো তুলে নেবার জন্যে পীড়াপীড়ি করতে পারে, তাদের কেতাবি বিদ্যায়—এর ব্যাখ্যা নেই।
কিন্তু আমাদের কাছে সবচেয়ে বড়ো খবর ফান্টাবাবুর এই চোখ দুটিই শেষপর্যন্ত দীপকের কপালে জুটেছিল।
ভূপতির মুখে দীপকের নাম শোনা মাত্র আমি সম্বিৎ ফিরে পেলাম। ভূপতিকে ওর নিরুদ্দেশের খবর বললাম।
ভূপতি চমকে উঠে বলল, ‘সে কি! থানায় ডায়েরি করেছিলি? অ্যাঁ, তাও করিসনি, যাঃ ইডিয়েট! গাড়িটার রং আর নম্বরও নিশ্চয় এতক্ষণে ভুলে মেরে দিয়েছিস? না!’
কালো রং আর আমার একটি প্রিয় সংখ্যা পরপর চারবার ব্যবহার হওয়ায় নম্বর প্লেট মনের মধ্যে জ্বলজ্বল করছিল। ছুটলাম লোকাল থানায়, সেখান থেকে লালবাজারে, তারপর দক্ষিণ কলকাতার এক হাসপাতালে কাল রাতেই অজ্ঞাত পরিচয় ব্যক্তির আহত ও সংজ্ঞাহীন দেহ পুলিশ রাস্তা থেকে হাসপাতালে কুড়িয়ে নিয়ে এসেছিল। তাকে দীপক ব্যানার্জি বলে শনাক্ত করে আমরা ফের ছুটলাম ভূপতির এক্স—পেশেন্ট এবং প্রায় বন্ধুস্থানীয় ব্যারিস্টার ডি আর মিত্রর কাছে। আইন আদালতের খবরে যাঁদের বিন্দুমাত্র কৌতূহলও আছে তাঁরাই মিত্র সাহেবকে নামে এবং কাহিনিতে চিনবেন। অপরাধীদের কাছে এই ক্ষুরবুদ্ধি আইনজীবী মানুষটি ডিয়ার তো নন—ই, মিত্রও নন। লোকে রসিকতা করে বলে, ইংরেজি ডেনজার শব্দের আদি এবং অন্তের দুটি নিয়ে ধ্রুব রঞ্জনের ডি. আর।
রূপকথার গল্পের মতোই দীপকের গল্পও এখানেই শেষ। সুস্থ হয়ে হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়ে সে মেসে ফিরে এসেছিল। তবে রাজসাক্ষী হয়ে তাকে যথাসময়ে কোর্টে হাজির হতে হয়েছিল। কারণ আমার দেওয়া গাড়ির নম্বর, আর তার দেওয়া মোটর আরোহীর বিবরণের সঙ্গে পুলিশ বছর খানেক আগে তুলে রাখা আঙুলের ছাপ আর রক্ত মিলিয়ে ফান্টাবাবুর হত্যাকারীকে হাতকড়া পরিয়েছিল! সে অনেক ঘটনা এখন। তবে দীপকের চোখ আর তাকে কোনোদিন ট্রাবল দেয়নি। কিন্তু ভূপতির থিওরি এইখানে এসেই আচমকা একটা ধাক্কা খেয়েছে।