চোখের বাহিরে – হীরেন চট্টোপাধ্যায়
বুড়ীদের ওই এক দোষ, সব সময় বকবক করবেই—সায় দেবার মত কাছে কেউ থাক আর নাই থাক।
মণিপিসিকে খানিকটা সেইজন্যেই এ বাড়ির কেউ পছন্দ করে না, আমি ছাড়া। আমার নিজেরও মাঝে মাঝে বিরক্তি ধরে যায়, যেমন এখন। কিন্তু মণিপিসিকে আমি ভালবাসি। গুরুজনদের মধ্যে একমাত্র মণিপিসিই জীবিত বলে নয়, মণিপিসি আমায় সত্যি করে স্নেহ করেন বলেই। আমার বাবার নিজের বোন অবশ্য ছিল না, মণিপিসি বাবার খুড়তুতো বোন, বাবার চেয়ে বছর পাঁচেকের বড়। কিন্তু মানুষ হয়েছে সব একসঙ্গে—একই একান্নবর্তী পরিবারে। একান্নবর্তী পরিবার কবে ভেঙেচুরে গিয়েছে, সুতরাং আমার সম্পর্কিত পিসি সংসারের অন্ন ধ্বংস করবেন—সুরমা স্বাভাবিক ভাবেই সেটা পছন্দ করেনি। বাধা দিতে পারেনি আমার জন্যেই, কিন্তু ওর বিরক্তিও আমি চাপা দিতে পারিনি।
আমার একমাত্র মেয়ে মোম যে ওর দিদাকে খুব অপছন্দ করে তা নয়, অফিস থেকে ফিরে অনেকদিনই আমি দেখতে পেয়েছি মোম পিসির কোলের কাছ ঘেঁষে বসে গল্প শুনছে। কিন্তু ওর পছন্দসই কাজ না হলেই দিদার ওপর ও চোটপাট করে, এবং বলা বাহুল্য মায়ের কাছ থেকে সে ব্যাপারে কোন বাধা পায় না।
মণিপিসিকে বলতে গেলে আমিই আড়াল করে রেখেছি। বাবা নেই মা নেই—ওঁদের স্মৃতি জাগিয়ে রাখার মতো একটিমাত্র আপনজন এ পৃথিবীতে আমার আছে, মণিপিসি। সব ভাল মণিপিসির, কেবল এই সন্ধের সময়টুকু ছাড়া। একবাটি মুড়ি নিয়ে এই সময় বসবেন মণিপিসি প্রায়ান্ধকার বারান্দার একটা কোণে। ওপরে তিনটে আর নিচে চারটে—সাকুল্যে এই সাতটা দাঁত নিয়ে অবিশ্রান্ত চেষ্টা করে যাবেন মুড়িগুলোকে কায়দা করবার। আসলে মুড়ি খাওয়াটাও যেন পিসির আসল উদ্দেশ্য নয়, এই সময়টা কেমন ঝিমুনি ধরে পিসির। এই দৃশ্যটা ছুটির দিনে আমি অনেকবার দেখেছি। মুড়ির বাটি নিচে নামানো। চোয়াল নড়ছে মণিপিসির। শরীর এলানো। চোখ বোজা নয়, সামনে চেয়ে আছেন—কিন্তু চোখের দিকে তাকালে মনে হবে কুয়াশার মধ্যে দিয়ে আকাশের তারা দেখছি। আর ওই বিড়বিড় করে চলেছেন একটানা—যত সব অর্থহীন কথাবার্তা। বেশির ভাগ কথাই আপন মনে এবং এইরকম:
‘কে রে, বুড়ো নাকি! কেমন আছিস বাবা? কেন যে কষ্ট করে আসিস—আমি তো ভালোই আছি! খোকা আমায় খুব ভালবাসে!’
অথবা এইরকম:
‘না না, ভয় নেই বিভা—তোমার সংসার আমি মাথায় করে রেখেছি। বৌমার কথা বলছো? না, ওই মুখেই যা বলে—মনে মনে আমাকে বেশ ভক্তি করে ও!’
বুড়ো আমার বাবার নাম, পিসি ওই নামেই বাবাকে ডাকতেন। বিভা আমার মার নাম। বাবা মারা গেছেন আমি যে বছর কলেজে ভর্তি হই সেই বছর, আর মা মারা যান বছর পাঁচেক আগে। মণিপিসি ভুল বকছেন মনে করা শক্ত, কারণ এসব তিনি জ্বর-জারি হলে বলেন না, সুস্থ অবস্থাতেই বলেন। দ্বিতীয়ত, ঘুমের ঘোরে বা ঘুমিয়ে স্বপ্নটপ্ন দেখে এসব বলতে আমি পিসিকে কখনো শুনিনি। এসব শুরু করলে সুরমার বিরক্তি অত্যন্ত বেড়ে যায়, সৌজন্যের আবরণ না রেখে ওঁকে শুনিয়ে ও প্রায়ই বলে, ‘বুড়ো হলে মানুষের ভীমরতি হয়!’
মোম প্রথম প্রথম মজা পেত, বলত, ‘ও দিদু, তুমি যাত্রার পার্ট বলছো নাকি!’ পরে অবশ্য জ্বালাতন করে পিসির ভুল বকা বন্ধ করার আগ্রহই ওর বেশি দেখতে পাই।
আমি নিজেও পিসিকে বারণ করেছি, বলেছি, ‘সন্ধেবেলা ওরকম আবোলতাবোল বকে তুমি কী আনন্দ পাও বল দেখি!’
মণিপিসি একগাল হেসে বলেছেন, ‘ওমা, আবোলতাবোল কী রে, ওরা এলে আমি চুপ করে থাকব?’
‘ওরা মানে? বাবা মা তোমার কাছে আসে বলতে চাও?’
‘না এলে কেউ ওদের সঙ্গে কথা বলে?’
‘আর কে কে আসে?’
‘আসে—কখনো সখনো তোর জ্যেঠাকেও দেখতে পাই, ক্বচিৎ কখনো পিসেমশাইও আসে—’
‘আসে তো আমরা দেখতে পাই না কেন?’
‘সে তো আমি জানি না বাবা।’
‘দেখো পিসিমা—’ আমি পিসিকে প্রথম দিকে বেশ কয়েকবার এ কথা বলেছি, ‘এসব তোমার মনের ভুল। এরকম করে আপন মনে কথা বললে লোকে তোমায় পাগল বলবে।’
‘তোর মেয়ে তাই মনে করে বটে!’
‘সবাই তাই মনে করবে। এসব পাগলামি তুমি আর করো না।’
ওই বলাই সার। শেষ পর্যন্ত হাল ছেড়ে দিয়েছি আমি। বুড়ীদের একটু বেশি বকার দোষ থাকে, মণিপিসি আপন মনে এরকম বাজে বকে, এই ভেবেই ব্যাপারটাকে উড়িয়ে দিয়েছি।
কিন্তু সব সময় তো আর মানুষের মনমেজাজ ভাল থাকে না। যেমন, এখন। বৃষ্টি-বাদলা দেখে চারটের মধ্যে অফিস থেকে বেরিয়ে পড়েছি। কিন্তু তার পর থেকে আকাশ যেন ভেঙে পড়েছে! মুষলধারে বৃষ্টি চলছে তো চলছেই—আটটা বাজে, ছাড়া দূরে থাক কমারও কোন লক্ষণ নেই। অথচ অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার সেনসাহেবের মেয়ের বিয়ে, এদের যদি নিয়ে নাও যাই, নিজে তো একবার হাজির হতেই হবে। সেনসাহেবের বাড়িও কাছেপিঠে নয়, দমদমের ওদিকে জয়পুর রোড়ে। নিজের গাড়ি আছে বটে, কিন্তু ভবানীপুর থেকে দমদম যাওয়া এই দুর্যোগে কি চাট্টিখানি কথা! যাওয়া হবে না বলে মোম যখন গাল ফুলিয়ে বসে আছে, সুরমা ওকে জামাকাপড় ছাড়িয়ে একটা বোনা নিয়ে বসেছে, ঠিক সেই সময়েই মণিপিসি শুরু করেছেন তাঁর বকুনি।
সুরমার ভুরু কুঁচকে উঠেছে, আমি দেখতে পাচ্ছি। হতেই পারে, কারণ বৃষ্টির জন্যে বারান্দায় নয়—এই ঘরেই বসেছেন আজ। আমার নিজের মনের অবস্থাও তো তেমন ভালো নয়। বেশ চড়া মেজাজেই বললাম, ‘মণিপিসি, তুমি একটু থামবে?’
প্রথমে যেন শুনতেই পেলেন না, দ্বিতীয়বার কথাটা বলতে আমার দিকে ফিরে বললেন, ‘বলছিস কিছু?’
‘হ্যাঁ, বলছি! রোজই তো চলে পাগলামি—আজ অন্তত একটু থামাও।’
মুখ ঘুরিয়ে সামনের দেওয়ালের দিকে তাকালেন, বললেন, ‘তুই আজ যা বুড়ো, খোকা রাগ করছে। অ্যাঁ, কি বললি—যেতে বারণ করব? বারণ করলে কি আর শুনবে রে—বারণ তো আগেই করেছি। কোন সাহেবের মেয়ের বিয়ে যেন আজ—’
বিরক্তিকর! মণিপিসির দিকে না তাকিয়ে সুরমাকে আমি বলেছি, বৃষ্টি কমার কোন লক্ষণ নেই। আমি ঘুরেই আসছি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব।’
গ্যারেজের সামনেটাও পায়ের পাতা ডোবানো জল। ছাতাটা গ্যারেজের ভেতরেই ঝুলিয়ে রেখে সন্তর্পণে বার করলাম গাড়ি। বাইরের ফটক বন্ধ কার জন্যে একবার বেরুতে হল। তাতেই অর্ধেক ভিজে গেলাম প্রায়।
সবে স্টার্ট দিয়েছি, লোডশেডিং হয়ে গেল!
অসহ্য! বিরক্তিতে আমার মাথার শিরা দপদপ করতে লাগল। বিপদ যখন আসে সব দিক দিয়েই আসে। ব্যাটারি অবশ্য ফুল চার্জ করা আছে—কিন্তু ঘন বৃষ্টির দেওয়াল ফুঁড়ে আলো আর যাচ্ছে কতদূর! সামনে আসা গাড়িগুলোও হাত বিশেকের মধ্যে না এসে গেলে তাদের আলো দেখতে পাচ্ছি না। এইভাবে আমি কতক্ষণে পৌঁছবো দমদম!
মোটামুটি মাথা ঠাণ্ডা রেখেই চালাচ্ছিলাম, স্পীডও কম রেখেছিলাম যতটা সম্ভব। ঝামেলাটা হয়ে গেল থিয়েটার রোডের কাছাকাছি এসে। ডানদিকের রাস্তা থেকে সবেগে বেরিয়ে আসা একটা মোটর-সাইকেলকে বাঁচাতে গিয়ে মুখোমুখি পড়ে গেলাম এগিয়ে আসা একটা বাসের।
কী যে হয়ে গেল মুহূর্তের মধ্যে কিছুই বুঝতে পারলাম না। দুটো হেডলাইটের তীব্র চোখ-ঝলসানো আলো, সজোরে ব্রেক চাপার বীভৎস শব্দ, মাথায় একটা তীব্র যন্ত্রণা—তারপরই সবকিছু অন্ধকার!
আস্তে আস্তে জ্ঞান যখন ফিরে এল, কোথায় আছি বুঝতেই আমার খানিকটা সময় কেটে গেল।
বুঝতে পারলাম, গাড়িতেই আছি। কিন্তু গাড়িটা এখন সোজা নেই—বেশ খানিকটা কাত হয়ে রয়েছে। রাস্তার ওপরও ঠিক নেই, একটা ধারে টাল খেয়ে পড়েছে।
বেরুলাম কোনরকম করে! মাথায় যন্ত্রণাটা এখন টের পাচ্ছি না। এত বড় দুর্ঘটনার পর হাতে-পায়ে ব্যথা-বেদনাও তেমন কিছু নেই। এখন হয়তো বুঝতে পারছি না, পরে জানান দেবে!
বৃষ্টি তখনও হয়ে চলেছে সমান তালে। রাস্তায় গাড়িও চলছে এখনও, তবে সংখ্যায় কম। ক’টা বাজে বুঝতে পারছি না, হাতের ঘড়িটা আটটা পঁচিশ হয়ে বন্ধ হয়ে রয়েছে।
গাড়ির অবস্থা দেখে কান্না পেলো। সামনের বনেট তুবড়ে যা তা অবস্থা। এঞ্জিনটা প্রায় বিধ্বস্ত বলা চলে। এ গাড়ি যে চলবে না সেটা বোঝা এমন কিছু শক্ত নয়। পোশাকের অবস্থা অন্ধকারে ভাল টের পাচ্ছি না, কিন্তু এ অবস্থায় কোথাও যাওয়া যায় না। বাড়ি ফিরতে হবে।
গাড়ির মায়া ছেড়ে দিয়ে রাস্তায় এসে দাঁড়ালাম। বাসের আশা এখন না করাই ভাল। রাত যতই হোক, পথচারী প্রায় নেই। ট্যাক্সিও দেখা যাচ্ছে কদাচিৎ, এবং কোনটাই খালি নয়। সুতরাং হাঁটা ছাড়া পথ নেই।
কী করে যে এলাম এতটা রাস্তা সে-কথা না বলাই ভাল। গেট খুললাম নিজের হাতে। গ্যারেজের দরজা তখনও হাঁ হয়ে আছে। বারান্দায় উঠে নিশ্চিন্ত হলাম। রাত বেশি হয়নি! জানলা দিয়ে বাইরের ঘরের ভেতরটা দেখা যায়। যেমন দেখে গিয়েছিলাম, ঠিক তেমনিই রয়েছে অবস্থাটা—মণিপিসি মুড়ির বাটি নিয়ে ঝিমুচ্ছেন। সুরমা উল বুনছে। মোম একটা কমিকস পড়ছে উপুড় হয়ে।
সমস্ত ব্যাপারটা ভাবতে গিয়ে হাসি পেল আমার। কী বিরাট দুর্ঘটনা থেকে বেঁচে গিয়েছি ওরা কেউ জানে না। এরকম মুখোমুখি সংঘর্ষ হলে প্রাণ নিয়ে ফেরাটাই যেখানে সংশয়, সেখানে রাস্তায় পড়ে থাকা নয়, হাসপাতাল নয়, সোজা বাড়িতে ফিরে এসেছি আমি!
কলিংবেলে হাত দিলাম।
আশ্চর্য, সুরমার কোন ভাবান্তর নেই। শুনতে পাচ্ছে না নাকি! কিন্তু কলিংবেল তো ঠিকই আছে! বিকেলেও অফিস থেকে ফিরে কোন গণ্ডগোল দেখিনি।
আবার টিপলাম। আবার।
ব্যাপারটা কী! বিরক্ত হয়ে দরজায় ধাক্কা মারলাম। দরজা এমনিই খুলে গেল।
রাগ হলো সুরমার ওপর। রাত হয়েছে, ফিরতে আমার কত দেরি হত ঠিক নেই কিছু! দরজা খুলে রাখে এমনি করে!
ঘরে ঢুকতেই একরাশ উজ্জ্বল আলো ঝাঁপিয়ে পড়ল আমার ওপর।
একী! নিজের অবস্থা দেখে নিজেই ভয় পেয়ে গেলাম আমি।
সমস্ত জামাকাপড় রক্তে আর কাদায় মাখামাখি। এত বৃষ্টিতেও সেসব ধুয়ে যায়নি! কী করে যে এলাম এতটা রাস্তা সেটাই আশ্চর্য।
কিন্তু এটা কেমন ব্যাপার! ঘরে ঢুকে পড়েছি, তবু সুরমার খেয়াল নেই! এত মন দিয়ে উল বোনার কী থাকতে পারে!
রাগে সর্বাঙ্গ জ্বলছিল আমার। কোনরকমে নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম, ‘সুরমা, ব্যাপার কী বল তো!’
সুরমা আগের মতই নির্বিকার। আমার গলা ওর কানে গিয়েছে বলে মনে হল না। মোম যখন বই পড়ে তখন মন দিয়েই পড়ে। কিন্তু আমি ঘরের মধ্যে চলে এসেছি—ডাকছি, তাও শুনতে পাবে না!
চকিতে একটা সম্ভাবনা আমার মাথায় বিদ্যুতের মত খেলে গেল।
তাহলে কি, তাহলে কি আমি—
ভয়ে দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে আমি চিৎকার করে উঠলাম, ‘সুরমা, আমি এসেছি—দেখো, আমি যেতে পারিনি ওখানে—’
সুরমা একটা হাই তুলে উলকাঁটা সরিয়ে রাখল। মোমের দিকে ফিরে বলল, ‘মোম, খাবি এখন?’
মোম মুখ তুলল। এবার আমার মুখোমুখি। কিন্তু ঘরে কাউকে দেখতে পাচ্ছে বলে আমার মনে হল না। কমিকসটা আবার টেনে নিয়ে বলল, ‘বাপি আসুক মা!’
ভয়ের একটা হিমশীতল স্রোত আমার শিরদাঁড়া বেয়ে নেমে গেল। পাগলের মত গলা ফাটিয়ে আমি আবার বলে উঠলাম, ‘সুরমা, মোম,—তোমরা দেখো, আমি এখানে—এই ঘরে! আমি ফিরে এসেছি, আমি ফিরে এসেছি—’
আমার বিহ্বল চোখের সামনে মোম কমিকসে আবার মুখ গুঁজে দিল, সুরমা উলকাঁটা টেনে নিল ফের। কেবল মণিপিসি মুখ তুলে চাইলেন আমার দিকে। যন্ত্রণায় পিসির মুখ বিবর্ণ হয়ে গিয়েছিল, টেনে টেনে বলতে লাগলেন, যেমন প্রতি সন্ধ্যায় বলেন, ‘খোকা রে, এত করে বারণ করলেন ওরা, তবু গেলি! কপাল আমার—সবাই তোরা এমনি করে আমার সামনে থেকে চলে যাবি রে! আয় বাবা, বোস, কী করে এমন হল বল দেখি—’