৩৭
বিহারী একলা নিজেকে লইয়া অন্ধকার রাত্রে কখনো ধ্যান করিতে বসে না। কোনোকালেই বিহারী নিজের কাছে নিজেকে আলোচ্য বিষয় করে নাই। সে পড়াশুনা কাজকর্ম বন্ধুবান্ধব লোকজন লইয়াই থাকিত। চারি দিকের সংসারকেই সে নিজের চেয়ে প্রাধান্য দিয়া আনন্দে ছিল, কিন্তু হঠাৎ একদিন প্রবল আঘাতে তাহার চারি দিক যেন বিশ্লিষ্ট হইয়া পড়িয়া গেল; প্রলয়ের অন্ধকারে অভ্রভেদী বেদনার গিরিশৃঙ্গে নিজেকে একলা লইয়া দাঁড়াইতে হইল। সেই হইতে নিজের নির্জন সঙ্গকে সে ভয় করিতে আরম্ভ করিয়াছে; জোর করিয়া নিজের ঘাড়ে কাজ চাপাইয়া এই সঙ্গীটিকে সে কোনোমতেই অবকাশ দিতে চায় না।
কিন্তু আজ নিজের সেই অন্তরবাসীকে বিহারী কোনোমতেই ঠেলিয়া রাখিতে পারিল না। কাল বিনোদিনীকে বিহারী দেশে পৌঁছাইয়া দিয়া আসিয়াছে, তাহার পর হইতে সে যে-কোনো কাজে যে-কোনো লোকের সঙ্গেই আছে, তাহার গুহাশায়ী বেদনাতুর হৃদয় তাহাকে নিজের নিগূঢ় নির্জনতার দিকে অবিশ্রাম আকর্ষণ করিতেছে।
শ্রান্তি ও অবসাদে আজ বিহারীকে পরাস্ত করিল। রাত্রি তখন নয়টা হইবে; বিহারীর গৃহের সম্মুখবর্তী দক্ষিণের ছাদের উপর দিনান্তরম্য গ্রীষেমর বাতাসউতলা হইয়া উঠিয়াছে। বিহারী চন্দ্রোদয়হীন অন্ধকারে ছাদে একখানি কেদারা লইয়া বসিয়া আছে।
বালক বসন্তকে আজ সন্ধ্যাবেলায় সে পড়ায় নাই–সকাল সকাল তাহাকে বিদায় করিয়া দিয়াছে। আজ সান্ত্বনার জন্য, সঙ্গের জন্য, তাহার চিরাভ্যস্ত প্রীতিসুধাস্নিগ্ধ পূর্বজীবনের জন্য তাহার হৃদয় যেন মাতৃপরিত্যক্ত শিশুর মতো বিশ্বের অন্ধকারের মধ্যে দুই বাহু তুলিয়া কাহাকে খুঁজিয়া বেড়াইতেছে। আজ তাহার দৃঢ়তা, তাহার কঠোর সংযমের বাঁধ কোথায় ভাঙিয়া গেছে। যাহাদের কথা ভাবিবে না পণ করিয়াছিল, সমস্ত হৃদয় তাহাদের দিকে ছুটিয়াছে, আজ আর পথরোধ করিবার লেশমাত্র বল নাই।
মহেন্দ্রের সহিত বাল্যকালের প্রণয় হইতে সেই প্রণয়ের অবসান পর্যন্ত সমস্ত কথা–যে সুদীর্ঘ কাহিনী নানাবর্ণে চিত্রিত, জলে-স্থলে পর্বতে নদীতে বিভক্ত মানচিত্রের মতো তাহার মনের মধ্যে গুটানো ছিল- বিহারী প্রসারিত করিয়া ধরিল। যে ক্ষুদ্র জগৎটুকুর উপর সে তাহার জীবনের প্রতিষ্ঠা করিয়াছিল, তাহা কোন্খানে কোন্ দুর্গ্রহের সহিত সংঘাত পাইল, তাহাই সে মনে করিয়া দেখিতে লাগিল। প্রথমে বাহির হইতে কে আসিল। সূর্যাস্তকালের করুণ রক্তিমচ্ছটায় আভাসিত আশার লজ্জামণ্ডিত তরুণ মুখখানি অন্ধকারে অঙ্কিত হইয়া উঠিল, তাহার সঙ্গে-সঙ্গে মঙ্গল-উৎসবের পূণ্যশঙ্খধ্বনি তাহার কানে বাজিতে লাগিল। এই শুভগ্রহ অদৃষ্টাকাশের অজ্ঞাত প্রান্ত হইতে আসিয়া দুই বন্ধুর মাঝখানে দাঁড়াইল–একটু যেন বিচ্ছেদ আনিল, কোথা হইতে এমন একটি গূঢ় বেদনা আনিয়া উপস্থিত করিল, যাহা মুখে বলিবার নহে, যাহা মনেও লালন করিতে নাই। কিন্তু তবু এই বিচ্ছেদ, এই বেদনা অপূর্ব স্নেহরঞ্জিত মাধুর্যরশ্মি দ্বারা আচ্ছন্ন পরিপূর্ণ হইয়া রহিল।
তাহার পরে যে শনিগ্রহের উদয় হইল–বন্ধুর প্রণয়, দম্পতির প্রেম, গৃহের শান্তি ও পবিত্রতা একেবারে ছারখার করিয়া দিল, বিহারী প্রবল ঘৃণায় সেই বিনোদিনীকে সমস্ত অন্তঃকরণের সহিত সুদূরে ঠেলিয়া ফেলিতে চেষ্টা করিল। কিন্তু এ কী আশ্চর্য। আঘাত যেন অত্যন্ত মৃদু হইয়া গেল, তাহাকে যেন স্পর্শ করিল না।
সেই পরমাসুন্দরী প্রহেলিকা তাহার দুর্ভেদ্যরহস্যপূর্ণ ঘনকৃষ্ণ অনিমেষ দৃষ্টি লইয়া কৃষ্ণপক্ষের অন্ধকারে বিহারীর সম্মুখে স্থির হইয়া দাঁড়াইল। গ্রীষ্মরাত্রির উচ্ছ্বসিত দক্ষিণ বাতাস তারই ঘন নিশ্বাসের মতো বিহারীর গায়ে আসিয়া পড়িতে লাগিল। ধীরে ধীরে সেই পলকহীন চক্ষুর জ্বালাময়ী দীপ্তি মলান হইয়া আসিতে লাগিল; সেই তৃষাশুষ্ক খরদৃষ্টি অশ্রুজলে সিক্ত স্নিগ্ধ হইয়া গভীর ভাবরসে দেখিতে দেখিতে পরিপ্লুত হইয়া উঠিল; মুহূর্তের মধ্যে সেই মূর্তি বিহারীর পায়ের কাছে পড়িয়া তাহার দুই জানু প্রাণপণ বলে বক্ষে চাপিয়া ধরিল-তোহার পরে সে একটি অপরূপ মায়ালতার মতো নিমেষের মধ্যেই বিহারীকে বেষ্টন করিয়া বাড়িয়া উঠিয়া সদ্যোবিকশিত সুগন্ধি পুষ্পমঞ্জরিতুল্য একখানি চুম্বনোন্মুখ মুখ বিহারীর ওষ্ঠের নিকট আনিয়া উপনীত করিল।
বিহারী চক্ষু বুজিয়া সেই কল্পমূর্তিকে সমৃতিলোক হইতে নির্বাসিত করিয়া দিবার চেষ্টা করিতে লাগিল; কিন্তু কোনোমতেই তাহাকে আঘাত করিতে যেন তাহার হাত উঠিল না–একটি অসম্পূর্ণ ব্যাকুল চুম্বন তাহার মুখের কাছে আসন্ন হইয়া রহিল, পুলকে তাহাকে আবিষ্ট করিয়া তুলিল।
বিহারী ছাদের নির্জন অন্ধকারে আর থাকিতে পারিল না। আর-কোনো দিকে মন দিবার জন্য সে তাড়াতাড়ি দীপালোকিত ঘরের মধ্যে আসিয়া প্রবেশ করিল।
কোণে টিপাইয়ের উপর রেশমের-ঢাকা-দেওয়া একখানি বাঁধানো ফোটোগ্রাফ ছিল। বিহারী ঢাকা খুলিয়া সেই ছবিটি ঘরের মাঝখানে আলোর নীচে লইয়া বসিল–কোলের উপর রাখিয়া দেখিতে লাগিল।
ছবিটি মহেন্দ্র ও আশার বিবাহের অনতিকাল পরের যুগলমূর্তি। ছবির পশ্চাতে মহেন্দ্র নিজের অক্ষরে “মহিনদা” এবং আশা স্বহস্তে “আশা” এই নামটুকু লিখিয়া দিয়াছিল। ছবির মধ্যে সেই নবপরিণয়ের মধুর দিনটি আর ঘুচিল না। মহেন্দ্র চৌকিতে বসিয়া আছে, তাহার মুখে নূতন বিবাহের একটি নবীন সরস ভাবাবেশ; পাশে আশা দাঁড়াইয়া–ছবিওয়ালা তাহাকে মাথায় ঘোমটা দিতে দেয় নাই, কিন্তু তাহার মুখ হইতে লজ্জাটুকু খসাইতে পারে নাই। আজ মহেন্দ্র তাহার পার্শ্বচরী আশাকে কাঁদাইয়া কতদূরে চলিয়া যাইতেছে, কিন্তু জড় ছবি মহেন্দ্রের মুখ হইতে নবীন প্রেমের একটি রেখাও বদল হইতে দেয় নাই, কিছু না বুঝিয়া মূঢ়ভাবে অদৃষ্টের পরিহাসকে স্থায়ী করিয়া রাখিয়াছে।
এই ছবিখানি কোলে লইয়া বিহারী বিনোদিনীকে ধিক্কারের দ্বারা সুদূরে নির্বাসিত করিতে চাহিল। কিন্তু বিনোদিনীর সেই প্রেমে-কাতর যৌবনে-কোমল বাহুদুটি বিহারীর জানু চাপিয়া রহিল। বিহারী মনে মনে কহিল, “এমন সুন্দর প্রেমের সংসার ছারখার করিয়া দিলি!” কিন্তু বিনোদিনীর সেই উর্ধ্বোৎক্ষিপ্ত ব্যাকুল মুখের চুম্বনেিনবেদন তাহাকে নীরবে কহিতে লাগিল, “আমি তোমাকে ভালোবাসি। সমস্ত জগতের মধ্যে আমি তোমাকে বরণ করিয়াছি।”
কিন্তু এই কি জবাব হইল। এই কথাই কি একটি ভগ্ন সংসারের নিদারুণ আর্তস্বরকে ঢাকিতে পারে। পিশাচী!
পিশাচী! বিহারী এটা কি পুরা ভর্ৎসনা করিয়া বলিল, না, ইহার সঙ্গে একটুখানি আদরের সুর আসিয়াও মিশিল। যে মুহূর্তে বিহারী তাহার সমস্ত জীবনের সমস্ত প্রেমের দাবি হইতে বঞ্চিত হইয়া একেবারে নিঃস্ব ভিখারীর মতো পথে আসিয়া দাঁড়াইয়াছে; সেই মুহূর্তে বিহারী কি এমন অযাচিত অজস্র প্রেমের উপহার সমস্ত হৃদয়ের সহিত উপেক্ষা করিয়া ফেলিয়া দিতে পারে। ইহার তুলনায় বিহারী কী পাইয়াছে। এতদিন পর্যন্ত সমস্ত জীবন উৎসর্গ করিয়া সে কেবল প্রেমভাণ্ডারের খুদকুঁড়া ভিক্ষা করিতেছিল। প্রেমের অন্নপূর্ণা সোনার থালা ভরিয়া আজ একা তাহারই জন্য যে ভোজ পাঠাইয়াছেন, হতভাগ্য কিসের দ্বিধায় তাহা হইতে নিজেকে বঞ্চিত করিবে।
ছবি কোলে লইয়া এইরকম নানা কথা যখন সে একমনে আলোচনা করিতেছিল, এমন সময় পার্শ্বে শব্দ শুনিয়া চমকিয়া উঠিয়া দেখিল মহেন্দ্র আসিয়াছে। চকিত হইয়া দাঁড়াইয়া উঠিতেই কোল হইতে ছবিখানি নীচে কার্পেটের উপর পড়িয়া গেল–বিহারী তাহা লক্ষ্য করিল না।
মহেন্দ্র একেবারেই বলিয়া উঠিল, “বিনোদিনী কোথায়।”
বিহারী মহেন্দ্রের কাছে অগ্রসর হইয়া তাহার হাত ধরিয়া কহিল, “মহিনদা, একটু বোসো ভাই, সকল কথার আলোচনা করা যাইতেছে।”
মহেন্দ্র কহিল, “আমার বসিবার এবং আলোচনা করিবার সময় নাই। বলো, বিনোদিনী কোথায়।”
বিহারী কহিল, “তুমি যে প্রশ্নটি জিজ্ঞাসা করিতেছ, এক কথায় তাহার উত্তর দেওয়া চলে না। একটু তোমাকে স্থির হইয়া বসিতে হইবে।”
মহেন্দ্র কহিল, “উপদেশ দিবে? সে-সব উপদেশের কথা আমি শিশুকালেই পড়িয়াছি।” বিহারী। না, উপদেশ দিবার অধিকার ও ক্ষমতা আমার নাই।
মহেন্দ্র। ভর্ৎসনা করিবে? আমি জানি আমি পাষণ্ড, আমি নরাধম এবং তুমি যাহা বলিতে চাও তাহা সবই। কিন্তু কথা এই, তুমি জান কি না, বিনোদিনী কোথায়। বিহারী। জানি।
মহেন্দ্র। আমাকে বলিবে কি না। বিহারী। না।
মহেন্দ্র। বলিতেই হইবে। তুমি তাহাকে চুরি করিয়া আনিয়া লুকাইয়া রাখিয়াছ। সে আমার, তাহাকে ফিরাইয়া দাও।
বিহারী ক্ষণকাল স্তব্ধ হইয়া রহিল। তাহার পর দৃঢ়স্বরে বলিল, “সে তোমার নহে। আমি তাহাকে চুরি করিয়া আনি নাই, সে নিজে আমার কাছে আসিয়া ধরা দিয়াছে।”
মহেন্দ্র গর্জন করিয়া উঠিল, “মিথ্যা কথা!” এই বলিয়া পার্শ্ববর্তী ঘরের রুদ্ধ দ্বারে আঘাত দিতে দিতে উচ্চস্বরে ডাকিল, “বিনোদ, বিনোদ!”
ঘরের ভিতর হইতে কান্নার শব্দ শুনিতে পাইয়া বলিয়া উঠিল, “ভয় নাই বিনোদ! আমি মহেন্দ্র, আমি তোমাকে উদ্ধার করিয়া লইয়া যাইব–কেহ তোমাকে বন্ধ করিয়া রাখিতে পারিবে না।”
বলিয়া মহেন্দ্র সবলে দ্বারে ধাক্কা দিতেই দ্বার খুলিয়া গেল। ভিতরে ছুটিয়া গিয়া দেখিল, ঘরে অন্ধকার। অস্ফুট ছায়ার মতো দেখিতে পাইল, বিছানায় কে যেন ভয়ে আড়ষ্ট হইয়া অব্যক্ত শব্দ করিয়া বালিশ চাপিয়া ধরিল। বিহারী তাড়াতাড়ি ঘরের মধ্যে ঢুকিয়া বসন্তকে বিছানা হইতে কোলে তুলিয়া সান্ত্বনার স্বরে বলিতে লাগিল, “ভয় নাই বসন্ত, ভয় নাই, কোনো ভয় নাই।”
মহেন্দ্র তখন দ্রুতপদে বাহির হইয়া বাড়ির সমস্ত ঘর দেখিয়া আসিল। যখন ফিরিয়া আসিল, তখনো বসন্ত ভয়ের আবেগে থাকিয়া থাকিয়া কাঁদিয়া উঠিতেছিল, বিহারী তাহার ঘরে আলো জ্বালিয়া তাহাকে বিছানায় শোয়াইয়া গায়ে হাত বুলাইয়া তাহাকে ঘুম পাড়াইবার চেষ্টা করিতেছিল।
মহেন্দ্র আসিয়া কহিল, “বিনোদিনীকে কোথায় রাখিয়াছ।”
বিহারী কহিল, “মহিনদা, গোল করিয়ো না, তুমি অকারণে এই বালককে যেরূপ ভয় পাওয়াইয়া দিয়াছ, ইহার অসুখ করিতে পারে। আমি বলিতেছি, বিনোদিনীর খবরে তোমার কোনো প্রয়োজন নাই।”
মহেন্দ্র কহিল, “সাধু! মহাত্মা! ধর্মের আদর্শ খাড়া করিয়ো না। আমার স্ত্রীর এই ছবি কোলে করিয়া রাত্রে কোন্ দেবতার ধ্যানে কোন্ পুণ্যমন্ত্র জপ করিতেছিলে? ভণ্ড!”
বলিয়া, ছবিখানি মহেন্দ্র ভূমিতে ফেলিয়া জুতাসুদ্ধ পা দিয়া তাহার কাচ চুর্ণ চূর্ণ করিল এবং প্রতিমূর্তিটি লইয়া টুকরা টুকরা করিয়া ছিঁড়িয়া বিহারীর গায়ের উপর ফেলিয়া দিল। তাহার মত্ততা দেখিয়া বসন্ত আবার ভয়ে কাঁদিয়া উঠিল। বিহারীর কণ্ঠ রুদ্ধপ্রায় হইয়া আসিল–দ্বারের দিকে হস্তনির্দেশ করিয়া কহিল, “যাও।”
মহেন্দ্র ঝড়ের বেগে বাহির হইয়া চলিয়া গেল।