চোখবদল
পৃথিবীটা একেবারে অন্ধকার হয়ে গেছে। আক্ষরিকভাবেই। বাইরের পৃথিবী।
বাইরে হয়তো রোদ আছে এখন। নিশ্চয়ই। অবশ্যই আলো ঝলমল করছে মুম্বই-এর হাসপাতালের সামনের ব্যস্ত পথে। ছুটে যাচ্ছে নানা-রঙা সব মড গাড়ি। এখন তো ভারতেই তৈরি হচ্ছে সবই। বড়োলোক হয়ে গেছে ভারতবাসী। মাত্র বারো লাখেই মার্সিডিজ পাওয়া যাচ্ছে। ছ-লাখে সিয়েলো। ওপেল অ্যাস্টর। ফোর্ড এসকর্ট। একটু কমে ফিয়াট এন ই, হান্ড্রেড অ্যাণ্ড ফিফটিন। নানা মেটালিক রং চমকাচ্ছে দ্রুতগামী সেইসব গাড়ি থেকে। ওই বিচ্ছুরণের বৈভবের মধ্যে কোনো চক্ষুষ্মান মানুষ এ-পথে চোখ মেলে চাইলে বিশ্বাসই করবেন না যে, এই দেশের অনেক মানুষের আজও দু-বেলা ভাত জোটে না খেতে। অথবা পরনের কাপড় জোটে না শীতে।
এ এক আশ্চর্য বৈপরীত্যর দেশ। অন্ধকারের দেশ।
অঘোরবাবুর নিজের চোখ অন্ধকার, তাই তাঁর সমস্ত জগৎই অন্ধকার। এই জগতের তাবৎ অনুষঙ্গ, পরিবেশ এবং প্রতিবেশ যে প্রত্যেক মানুষের নিজের নিজস্ব জগতের মাধ্যমেই দৃশ্যমান, অনুভূতি-সাপেক্ষ, এই কথা এই হাসপাতালে শুয়ে না থাকলে তাঁর পক্ষেও কোনাদিনও বোঝা সম্ভব হত না।
তবে আলো অবশ্যই উথালপাথাল হচ্ছে হাওয়া-লাগা আরব সাগরের অশান্ত বুকের ওপরে। শীতের সাগর শান্ত কিন্তু তার মুখের রঙে কোনো শান্তি নেই, স্থৈর্য নেই। না তার নিজের মধ্যে, না যে-দেখে সেই দর্শকের চোখের মণিতে।
এখন সকাল ক-টা কে জানে? মিস্টার মুঙ্গেশকর ব্রেকফাস্ট খাইয়ে চলে গেছেন অনেকক্ষণ।
অঘোরবাবু ভাবছিলেন, এখন নিশ্চয়ই ইণ্ডিয়া গেট এবং তাজমহল হোটেলের সামনে থেকে রঙিন শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ক্যাটামেরন ছুটে চলেছে নীল জলে সাদা পিচকিরি তুলে, আলিবাগের পথে। সেই আলিবাগ, যেখান থেকে মুকুন্দ হয়ে আরব সাগরের মধ্যের জানজিরা দুর্গে যেতে হয়।
আসলে, চোখে অপারেশন না হলে, চোখ বন্ধ করে অন্ধকার ঘরে মুম্বই-এর এই ব্রিচক্যাণ্ডি হাসপাতালে না শুয়ে থাকলে, পৃথিবীতে যে এত আলো আছে, এত রং, সে-কথা হয়তো কোনোদিন জানতেও পারতেন না অঘোরবাবু। দাঁত থাকতে যেমন কেউই দাঁতের মর্যাদা দেন না, চোখ থাকতে চোখও যে কী জিনিস সেকথাও কেউই বোঝেন না। ফুলের রং, পাখির ডানার রং, আকাশের রং, ক্ষণে ক্ষণে রং-বদলানো আরব সাগরের জলের রং যে একজন মানুষের জীবনে কত বড়ো আনন্দের বাহক, তার একঘেয়েমির কত বড়ো বিনাশকারী, সেকথা যিনি চোখে দেখেন তিনি কোনোদিন জানতেও পারবেন না, বুঝবেন না।
এই ঝামেলা অনেক দিন আগে শেষ করা যেত। কিন্তু তাঁর বাতিল হওয়া চোখের মণির গহ্বরে যে অন্য মণি লাগানো হবে তা নাকি পাওয়া যাচ্ছিল না। অঘোরবাবুর কনীনিকাতে ঠিকমতো মানায় এমন একটি চোখের অপেক্ষাতে ছিলেন ডক্টর ঘোড়পাড়ে অনেকদিন। কিন্তু তা থাকলে কী হয়! মনোমতো চোখ নাকি পাওয়া গেল না। এদিকে অপারেশানের দিনও অনেকবার পেছোনো হয়েছে। আর পেছোনো সম্ভবও ছিল না। তাই…
এই হাসপাতালেরই কোনো শয্যাতে শুয়েছিলেন গত একমাস এক চল্লিশোর্ধ্ব মহিলা। মৃত্যুর অপেক্ষাতে। ডঃ ঘোড়পাড়ে হেসে বলেছিলেন, ডঃ আড়ুয়ালপালকারের রোগী। পেটের ক্যান্সারের চিকিৎসা করাতে এসেছিলেন ভদ্রমহিলা, অন্তিমশয্যায় শায়িত ছিলেন তিনি। তাঁরই চোখ। দান করেছিলেন জীবদ্দশাতেই। গতশনিবারে সেই মহিলা নাকি পাড়ি দিয়েছেন অদৃশ্য ক্যাটামেরনে চড়ে অদৃশ্যলোকের দিকে। সঙ্গে সঙ্গেই ডঃ ঘোড়পাড়ে ডঃ আড়ুয়ালপালকারের সঙ্গে কথা বলে সেই মহিলার চোখের বাঁ-মণিটি সংগ্রহ করেছিলেন বলেই, অঘোরবাবুর পক্ষে এই চোখবদল সম্ভব হল।
সেই মহিলার নামটি কী? যদি জানা যেত। মুম্বই-এর কোন পাড়ার বাসিন্দা তিনি? বিবাহিতা? বা কুমারী? খুবই জানতে ইচ্ছে করে অঘোরবাবুর। মহিলা দেখতে কেমন ছিলেন? কেমন দেখতে ছিল তাঁর চোখ?
অঘোরবাবুর নামটি সেকেলে হলে কী হয়, তিনি মানুষটি অত্যন্ত আধুনিক। এবং এই আধুনিকতা আদৌ লোক-দেখানো নয়। বহুযুগ হল, তিনি মুম্বই-এরই বাসিন্দা। জীবনের নানা পথ, নানা অলিগলি ঘুরে, মাঝপঞ্চাশে তিনি একটি পৃথিবীজোড়া বহুজাতিক সংস্থার একেবারে ওপরে পৌঁছেছেন। গত কয়েক বছরে যা ডিভিডেন্ট পেয়েছেন এবং FERA আইনে অদলবদল হওয়াতে বিনে পয়সাতে পড়ে-যাওয়া শেয়ারগুলি বিক্রি করে যা-টাকা পেয়েছেন, তাতে তিনি বহুক্রোড়পতি। মুম্বই-এর মতন টাকাওয়ালা মানুষদের শহরেও তিনি এখন সমাজের একেবারে ওপরতলার মানুষ হিসেবে গণ্য।
তবে মানুষটি অন্য দশজনের মতন নয়।
তাঁর বাবা রানাঘাট স্টেশনের কাছেই একটি চায়ের দোকান চালাতেন। নিজে হাতে চা করতেন। দেশভাগের পরে কোনোরকমে বাঁচার লড়াই চালিয়েছিলেন এভাবে। সে-লড়াই আক্ষরিকার্থের লড়াই। শুধুমাত্র স্লোগানের লড়াই নয়। মিছিলের লোক-দেখানোর লড়াইও নয়। জীবনের সমস্ত প্রকৃত লড়াই যে লোকচক্ষুর আড়ালেই লড়তে হয়, সেকথা অঘোরবাবু তাঁর বাবাকে দেখেই শিখেছিলেন।
স্কুল ফাইনাল অবধি পড়েছিলেন রানাঘাটেই। তার পর জীবন শুরু করেছিলেন তৎকালীন মুম্বইয়ের বাসিন্দা এক দূরসম্পর্কের কাকার বাড়ির বিনি মাইনের চাকর হিসেবে। তবে মুম্বাই-এর ফিলম লাইনের ফেরেববাজ, সেই কাকা নিজে মাইনে না দিলেও তাঁকে রোজগারের একটা পথ করে দিয়েছিলেন। এক কাগজের ফিরিওয়ালার হেল্পার হিসেবে তাকে লাগিয়ে দিয়েছিলেন। রাত তিনটেতে ঘুম থেকে উঠে দাদার-এ তিনি সাইকেলে করে বাঙালিপাড়াতে কাগজ বিলি করতেন। তাঁর বিচিত্র কর্মময় জীবনের প্রথম সোপান ছিল সেই প্রভাতফেরি। সেখান থেকে কী করে তিনি ম্যারিনার অ্যাণ্ড ম্যারিনার-এর এম ডি হয়ে উঠেছিলেন সে এক লম্বা ইতিহাস। প্রায় অবিশ্বাস্য। এই ওঠাটা পুরোপুরি সরল পথে হয়নি। অনেকখানি পথই বক্র এবং কণ্টকময় ছিল। চাণক্যও হতে হয়েছিল তাঁকে বহু বার। তবে তিনি নিজে মনে করেন যে এই সাফল্যের নব্বই ভাগই এসেছিল তাঁর কঠোর পরিশ্রম, জেদ এবং অসাধারণ বুদ্ধির হাত ধরে। শুধুমাত্র দশ ভাগ মতন ছিল কপাল এবং ঈশ্বরের দয়া।
অবশ্যই।
মাঝে মাঝেই মাঝরাতে ঘুম ভেঙে যাওয়াতে বিছানার ওপরে উঠে বসে, অথবা খোলা জানলার কাছে দাঁড়িয়ে মালটিস্টোরিড বাড়িতে বাড়িতে ঢাকা মুম্বই-এর আকাশের দিকে চেয়ে সাম্প্রতিক অতীতে তিনি অপারবিস্ময়ে ভেবেছেন প্রায়ই তাঁর বর্তমানজীবনের কথা। রানাঘাটের দিনগুলির কথা এবং মুম্বই-এর অতীতের দিনগুলির কথাও। সেই তিনিই যে এই তিনি, এই কথা তাঁর বিশ্বাস করতেও অবাক লাগে। কাকে ধন্যবাদ দেবেন বা কাকে অভিনন্দন জানাবেন কতটুকু, তাও ভেবে পাননি।
অন্ধকার ঘরে তাঁর চোখের মধ্যে পরস্ব মণি নিয়ে চোখ ঢেকে শুয়ে আছেন তাই নড়াচড়ারও উপায় নেই। কত যে ভাবনা ভিড় করে আসছে তাঁর মস্তিষ্কে তা বলার নয়।
তিনি ভাবছিলেন, মানুষের এই মস্তিষ্ক বড়ো আশ্চর্য এক জিনিস। এই পৃথিবীতে যেইক্ষণে মানুষের জন্ম হয়, সেইক্ষণেই সেই অনির্বাণ ব্লাস্ট ফার্নেস-এ আগুন ধরিয়ে দেন সৃষ্টিকর্তা। তার পর যতদিন না, মানুষের নিজেদের শরীর চিতাতে ছাই হচ্ছে, ততদিনই সেই আগুন জ্বলতেই থাকে। শরীরের বিশ্রাম ঘটে, আলো নেভাতে হয়, ঘরের কি মনের, কিন্তু মস্তিষ্কের মধ্যের এই নিরন্তর অদৃশ্য আগুন জ্বলতেই থাকে। না এই আগুনের ছুটি আছে, না ছুটি আছে তার আঁধারের। এ এক আশ্চর্য দাসত্ব। দাসত্বই বই কী।
আজ সকালে ডঃ ঘোড়পাড়ে তাঁর চোখের ব্যাণ্ডেজ কেটে দিলেন। আলো, প্রথমে অল্প অল্প করে চোখে সওয়াতে হবে এমনই আদেশ। অন্ধকার থেকে আলোতে আসার সেই-ই বোধ হয় সবচেয়ে বেশি মান্যপন্থা। চারধারে বহুমানুষকে দেখেছেন অঘোরবাবু, যাঁরা অন্ধকার থেকে এক ঝটকাতে আলোতে এসে পড়ে তড়িদাহত হওয়ারই মতন আলোকাহত হয়ে মারা যান। সে মৃত্যু আক্ষরিকার্থের মৃত্যু নয়। সে মৃত্যুর চেয়েও অনেকই বেশি ভয়াবহ।
ভিজিটিং আওয়ার্স-এ ভীনা এসেছিলেন। তাঁর স্ত্রী। ভীনা মারাঠি মেয়ে। খুব ভালো নাচতেন এক সময়ে। নাচ দেখেই প্রেমে পড়েছিলেন। তাঁদের একই ছেলে। সে হুস্টনেই থাকে। আমেরিকান মেয়ে বিয়ে করে, এন আর আই হয়ে গেছে। দেশে ফিরবে না। ছুটিতেও আসে না। কোনো দ্বীপে বা SPAতে ‘হলিডে’ করে ওরা। ওদের ‘হলিডে’ও কাজেরই মতন। ঘড়ি ধরে সব কিছু করতে হয়। মনে মনে ঘেন্না করেন তিনি ওদের। ভীনা যান মাঝে মাঝে ওদের কাছে। অঘোরবাবু একবারও যাননি। স্টেটস-এ গেছেন বহু বার কিন্তু ছেলে-বউ-এর কাছে যাননি। যাবেনও না। অথচ ওই ছেলে, দীপই তাঁর চোখের মণি ছিল একদিন।
চোখের মণিকেও উৎপাটিত করে ডঃ ঘোড়পাড়ে যেমন অন্যের চোখের মণি বসিয়েছিলেন তাঁর চোখে, উপায় থাকলে তিনি তাঁর ছেলেকেও স্থানচ্যুত করতেন। কিন্তু তাঁর ছেলে তাঁর কাছ থেকে জাগতিক কিছুই প্রত্যাশা করেনি। অজাগতিক লেনদেন, যথা, অপত্যস্নেহ, শ্রদ্ধা এইসবে বিশ্বাস নেই দীপের। তার পুরো জগৎটাই মেটেরিয়ালিস্টিক। যা-কিছুকেই টাকা দিয়ে পরিমাপ করা যায় না, সেসব কিছুই তার কাছে মূল্যহীন। সে যে একদিন অঘোরবাবুর চোখের মণি ছিল, বড়ো আদরের ধন কুসুমরতন, তা বোঝার ক্ষমতা পর্যন্ত নেই তাঁর আমেরিকান ছেলের। স্থানচ্যুত হয়ে গেছে সে মণি। হয়তো মণি এবং চোখও।
দুজনেরই অজানতে।
ভীনার বোনঝির বিয়ে এই সপ্তাহের শেষে। পুণেতে। তাঁকে যেতেই হবে শুক্রবার বিকেলের ট্রেনে। পুণের আউন্দ-এ চমৎকার বাড়ি করেছেন অঘোরবাবুর শিল্পপতি ভায়রাভাই কেলকার। অঘোরবাবুদের কম্বাইণ্ড হ্যাণ্ড গোমেজ এবং ড্রাইভার পাসকাল ওঁকে শনিবারে বাড়ি নিয়ে যাবে হাসপাতাল থেকে। ডে-নার্স থাকবে দশ দিন। বাড়িতে গিয়েও পনেরো দিন অনেকই বিধি-নিয়মের মধ্যে থাকতে হবে।
অন্যের চোখের মণিকে নিজের চোখের মণি করে নেওয়া কি অত সোজা কথা?
ভীনা বললেন, বাথরুমের দরজাটা লক কোরো না।
ঠিক আছে।
অঘোরবাবু, ওরফে এ জি (অঘোর ঘোষাল) বললেন।
দাড়িটা অনেকই বড়ো হয়ে গেছে। কাঁচা-পাকা সল্ট অ্যাণ্ড পেপার দাড়িটা কেমন দেখাচ্ছে কে জানে! তার চেয়েও বড়ো কথা, এতদিন নিজে তো দাঁতও মাজেননি। শুয়েই সব। বেডপ্যান ব্যবহার করেছেন। আজই প্রথম নিজের নতুন চোখের মণির সঙ্গে শুভদৃষ্টি হবে তাঁর। ভেতরে ভেতরে একটা চাপা উত্তেজনা বোধ করছেন। ক-দিন থেকেই।
ভীনাকে বার বার জিজ্ঞেস করেছেন, হাউ ডু আই লুক?
অ্যাজ হ্যাণ্ডসাম অ্যাজ এভার। ভীনা বলেছেন হেসে, ওঁর বুকে একটা আদরের চড় মেরে।
ডু আই লুক দ্য সেম?
তোমার চোখ বদলাতে পারে, আমার চোখ তো একই আছে। তুমি আমার চোখে একই আছ। তোমাকে কেমন দেখাচ্ছে তার চেয়ে অনেক বড়ো কথা তুমি নতুন চোখ দিয়ে কেমন দেখছ? ডাজ দ্য ওয়ার্ল্ড লুক গ্রিনার নাউ?
অঘোরবাবু ওরফে এ জি হেসে ফেলে বলেছিলেন, ওয়েল। আই ডোন্ট নো।
বাথরুমের আয়নার সামনে মার্বেলের মস্ত ওয়াশ-বেসিনে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে অঘোরবাবু আয়নার দিকে তাকিয়ে দাড়ি দেখলেন। ঘেন্না হল। ওঁদের কোম্পানির অ্যাকাউন্টস ম্যানেজার, ইডিয়ট শীরশেখর-এর মতন হয়েছে দাড়িটা। অবিকল। আগে দাড়িটা কাটবেন। ডান চোখ দিয়েই দেখছেন। বাঁ-চোখের সঙ্গে এখনও শুভদৃষ্টি হয়নি।
দাড়িটা কামিয়ে ফেলে এবারে ভালো করে তাকালেন আয়নার দিকে। তাকিয়েই স্তব্ধ হয়ে গেলেন অঘোরবাবু।
তাঁর চোখ দুটি নিয়ে খুবই গর্ব ছিল তাঁর, কালো ভ্রমরের মতন আঁখিপল্লবের নীচে কুচকুচে কালো দিঘল ছিল তাঁর দুটি চোখের মণি। ডান চোখটি তেমনই আছে কিন্তু বাঁ-চোখের নতুন—
শিউরে উঠলেন অঘোরবাবু। একবার ভাবলেন, ড্রয়ার থেকে পিস্তলটা বের করে নিয়ে এখুনি গিয়ে ডঃ ঘোড়পাড়েকে গুলি করে মেরে দিয়ে আসেন। আশ্চর্য ইডিয়ট তো ওই সার্জন। বাঁ-চোখের মণিটার রং নীল। শুধু তাই নয়, সেই মণিটা তাঁর ডান চোখের মণির চেয়ে ছোটোও। তাঁর চেহারা, তাঁর চোখের দৃষ্টিও পালটে গেছে একেবারে। চেনা মানুষও হয়তো তাঁকে চিনতে পারবেন না আর। কিম্ভূত দৈত্যের মতন দেখাচ্ছে তাঁকে। একচোখে কালো বড়োমণি আর অন্য চোখে ছোটো নীল মণি। ছবিতেও কোনো দৈত্যর অমন চেহারা দেখেননি উনি জীবনে। এই ডাক্তার ঘোড়পাড়ে তো সম্ভবত শীরশেখরের চেয়েও বড়ো ইডিয়ট। এর চেয়ে তাঁর মণি না বদল করাও ভালো ছিল।
তার পর আরও একবার ভালো করে তাকালেন আয়নার দিকে। এ কী? এ কী? এ কী? প্রায় মূর্ছাই যাচ্ছিলেন অঘোরবাবু। স্মৃতিভ্রংশ হয়েছিল কয়েক মুহূর্তের জন্য। মস্তিষ্ক শূন্য হয়ে গেছিল। ব্লাস্ট ফার্নেস-এর আগুনও কি নিভে গেছিল কয়েক মুহূর্তের জন্য? তারপর মেঘ সরতে লাগল ধীরে ধীরে। অতি ধীরে ধীরে।
অস্ফুটে উনি বললেন, মণি। মণি বেন। তোমার অভিশাপ এমন করে ফলল? এতদিন পরে? কী আশ্চর্য! এখন তোমার চোখ যে উপড়ে ফেলে দেব তাও তো হওয়ার নয়। তোমার অভিশাপ বয়ে বেড়াতে হবে চিতাতে ছাই না হওয়া পর্যন্ত। তুমি তো ছাই হয়েই গেছ।
ডাক্তার ঘোড়পাড়ে বলেছিলেন, কোনোরকম মানসিক উত্তেজনার কারণ ঘটাবেন না। প্রেশার যাতে হঠাৎ বেড়ে না যায়, সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে। আর প্রেশার আর ডঃ ঘোড়পাড়ে!
বেসিনে পুরো শরীরের ভর দিয়ে, এ জি, এককালীন অঘোরবাবু চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলেন আর সেই দৃশ্যটা ফুটে উঠল তাঁর চোখে।
মণি ছিল, পোপটলালের স্ত্রী। ওয়েস্টার্ন রেলের এক ঠিকাদারের কাছে কাজ করতেন পোপটলাল। আন্ধেরিতে অঘোরবাবু যখন এক পার্সির পুরোনো ভগ্নপ্রায় বাড়ির আউট-হাউসে ভাড়া থাকতেন তখন তাঁর পাশের ঘরে থাকতেন পোপটলালেরা। পোপটলালকে তাঁর কাজে প্রায়ই বাইরে যেতে হত। মণির রূপ ছিল দেখবার মতন। গানের গলাও ছিল খুব সুন্দর। মারাঠিরা সারস্বত সাধনাতে হয়তো বাঙালিদের চেয়েও এগিয়ে। তা ছাড়া মারাঠিদের সঙ্গে বাঙালিদের চেহারা এবং মানসিকতাতেও অনেক মিল আছে। সন্ধেবেলা স্নান করে উঠে ধূপধুনো জ্বেলে বেদিতে ফুল দিয়ে, তাঁর তানপুরাটি সামনে করে মণি যখন গান গাইতেন তখন অঘোরবাবুর ঘোর লেগে যেত। জীবনে সেই একবারই কাম-দংশিত হয়েছিলেন। কিন্তু মণি বেন ছিলেন অত্যন্ত সতী মহিলা। স্বামী-অন্ত প্রাণ। অঘোরবাবু তখন সবে ওই কোম্পানিতে ঢুকেছেন। স্যাম্পলার হিসেবে। সামান্যই মাইনে পান। তবে কাগজ বিলি করে যা পেতেন, তার চেয়ে বেশি। আর পোপটলালের অবস্থাও অঘোরবাবুর চেয়ে কিছু ভালো ছিল না। কিন্তু মণি বেন জানতেন, কী করে সামান্য রোজগারেও সুন্দর করে থাকতে হয়।
পোপটলাল কাজে বাইরে গেলে অঘোরবাবুকেও বলে যেতেন, মণি বেনকে দেখাশোনা করতে। একা রইল আমার বউ।
অঘোরবাবু বলতেন, এমন সুন্দরী যুবতীকে একা রেখে যাওয়া কি ঠিক? একদিন ফিরে এসে দেখবেন যে, বউ আর আপনার নেই। অন্য কারোর হয়ে গেছে।
পোপটলাল হেসে ওপরে তাকাতেন। বলতেন, গণপতিজির যা ইচ্ছা। বউকে দিয়েছেন তিনি, নিলেও তিনি নেবেন। আমার কী করার আছে?
সেই রাতের কথা মনে পড়ল অঘোরবাবুর। বৃষ্টি আর ঝোড়ো হাওয়া হচ্ছে তো হচ্ছেই। লাগাতার। মুম্বইর মানুষমাত্রেই জানেন, এই ঝড়বৃষ্টির রকম চার মাস। সেই বাদলা রাতে মণি বেন রিওয়াজ করছিলেন। বেচারিদের ছেলেপেলে হচ্ছিল না। যদিও তিন বছর বিয়ে হয়েছিল ওদের। একটি সন্তান থাকলে তিনি বোধ হয় এমন একলা বোধ করতেন না।
সন্ধেবেলা সে-রাতে ভিজে একসা হয়ে বাড়ি ফিরলে, মণি বেন খিচুড়ি পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। নিজেদের দরজাতে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, আমার জন্যে তো করেইছিলাম, আপনার কথা ভেবে একটু বেশিই করলাম। হোটেলেই তো খান। ও এবারে ফিরলে ওর সঙ্গে কথা বলে, আমাদের সঙ্গেই খেলে পারেন, রাতের বেলা এবং ছুটির দিনে।
অঘোরবাবু বলেছিলেন, দেখি।
বাইরে ঝড়ের তান্ডব যতই বাড়ছিল, মণি বেন-এর গলার জোরও ততই বাড়ছিল। মুদারাতেও তার স্বর স্থির থাকত এবং শ্রী হারাত না একটুও। আসলে অঘোরবাবু কোনোদিনও জানতেন না যে, তাঁর মধ্যে এমন গান-পাগল একজন মানুষ লুকিয়েছিল।
খিচুড়ির পাত্র ফেরত দেওয়ার অছিলাতে অঘোরবাবু গিয়ে মণি বেনের দরজাতে টোকা দিলেন।
মণি বেন-এর মনোসংযোগ নষ্ট হল। উঠে এসে ভেতর থেকে দরজার পাশে দাঁড়িয়ে বললেন, কে?
আমি। এ জি।
হাসিমুখে দরজা খুললেন মণি বেন। একটা হালকা খয়েরি-রঙা শাড়ি আর গাঢ় খয়েরি-রঙা ব্লাউজ পরেছিলেন উনি সেদিন। ফুল আর চন্দন সাবানের গন্ধ উঠছিল সারাশরীর থেকে ম-ম করে।
মণি বেন বললেন, কাল সকালে দিলেই তো হত আমার গানটা দিলেন মাটি করে। অঘোরবাবু দাঁতে দাঁত ঘষে বললেন, আজ তোমাকেও মাটি করব। ফুল ছিঁড়ব আমি পুষ্প দলন করব। তুমি এত সুন্দর যে তোমাকে সহ্য করতে পারি না আমি। সারারাত ছটফট করি শরীরের যন্ত্রণায়। তুমি যদি পুরুষ হয়ে জন্মাতে তবে জানতে পুরুষের কষ্টের রকম।
মণি বেন তাঁর চোখে কিছু দেখে থাকবেন। তাঁর চোখে ভয়ের ছায়া পড়েই মিলিয়ে গেল। যাঁর ওপরে তাঁকে দেখাশোনার ভার দিয়ে গেছেন পোপটলাল, তিনি কি তাঁর রক্ষকের আসন থেকে ভক্ষকের আসনে নামবেন?
কিন্তু কিছু বোঝার আগেই অঘোরবাবু মণি বেনকে বাহুবন্ধনে বেঁধে ফেলে তানপুরার পাশে শুইয়ে ফেলে দ্রুতহাতে তাকে নগ্নিকা করলেন। বাধা মণি বেন দিচ্ছিলেন বটে কিন্তু অঘোরবাবুর মনে হল, সেই বাধার মধ্যে এক ধরনের আনন্দও যেন ছিল। মণি বেন ইচ্ছে করলেই চিৎকার করতে পারতেন কিন্তু তা না করে, বাঁ-হাতের আঙুল তুলে খোলা দরজার দিকে দেখিয়েছিলেন। অঘোরবাবু গিয়ে দরজা বন্ধ করলেন। ফিরে দেখলেন, মণি বেন শুধু তাঁর স্থানচ্যুত শাড়িটা দিয়ে তাঁর লজ্জাস্থান এবং বুক ঢেকেছেন।
তার পর মণি বেন আঙুল তুলে আলোটাকে দেখিয়েছিলেন। ইঙ্গিতে আলো নেভাতে বলেছিলেন কিন্তু অঘোরবাবু আলো নেভাননি।
এত বছর পরে অঘোরবাবু ভাবলেন, ইশ, কেন যে, আলোটা নেভালাম না।
তার পরের ইতিহাস সংক্ষিপ্ত। জীবনের প্রথম মিলনের আনন্দে তাঁর সারাশরীরে কান্না ছড়িয়ে গেল, ছড়িয়ে গেল কাঁপুনি। তখন আর বাধা ছিল না কোনো তাঁর তরফে বরং আনন্দর পৌনঃপুনিকতার তাগিদ ছিল। মণির নীল চোখের মণি দুটো অঘোরবাবুর নুয়ে আসা মাথার দু-চোখের মধ্যে ভরাট হয়েছিল। মণি বেন হাসি, কান্না, লজ্জা এবং আনন্দ সব মেশানো এক অভিব্যক্তির সঙ্গে বলেছিলেন, তোমার অসভ্য চোখ দুটো আমি গেলে দেব।
কেমন করে, কী করে, এতবছর পরে…..।
সেইরাতেই অঘোরবাবু সেই আস্তানা ছেড়ে চলে এসেছিলেন। মণি বেন পোপটলালকে বলে যে দিতেন না সেটুকু ভরসা হয়েছিল। কিন্তু না গেলে, যা-ছিল একরাতের হঠাৎ অভিসার, তাই হয়ে দাঁড়াত নিয়মিত চৌর্যবৃত্তি। সেটা করলে পোপটলালের কাছে মানুষ হিসেবে বড়ো ছোটো হয়ে যেতেন অঘোরবাবু। মানুষটা তো খারাপ ছিলেন না। কেউই খারাপ ছিলেন না। না পোপটলাল,না মণি বেন। তবু ভালো মানুষেরাও হঠাৎ খারাপ কাজ করে ফেলেন। ভালো বলেই তাঁরা পরে বুঝতে পারেন যে, কাজটা খারাপ। জীবন এইরকমই।
ভীনা দরজাতে টোকা মারলেন।
বললেন, তোমার হয়েছে? অতক্ষণ কী করছ? চোখে ব্যথা করছে? আমি দরজা খুললাম কিন্তু।
তার পরই অবাক হয়ে বললেন, একী জামাকাপড় পরে বেসিনের সামনেই দাঁড়িয়ে আছ এখনও? কী করলে এতক্ষণ? ওঃ, দাড়ি কামাতে এতক্ষণ লাগল?
তার পর আবার বললেন, জামাকাপড় যখন ছাড়োইনি তখন দেখা করে যাও। একজন দেখা করতে এসেছেন তোমার সঙ্গে।
না জানিয়ে। আশ্চর্য। কে?
জিশু পোপটলাল।
তিনি কে?
রতনলাল পোপটলালের একমাত্র সন্তান। তোমার চোখে তাঁর মা, মণি বেন-এর চোখের মণিই বসিয়েছেন ডঃ ঘোড়পাড়ে।
তাই? তাহলে ডঃ ঘোড়পাড়েই আমার ঠিকানা দিয়ে থাকবেন জুনিয়ার পোপটলালকে।
হবে।
ভীনা বললেন।
তার পর বললেন, তুমি চিনতে মিসেস পোপটলালকে?
চিনতাম মানে, নেবার ছিলেন। তাও স্বল্প দিনের।
তাই?
হ্যাঁ।
যে-ছেলেটি এসেছে, সে অবিকল তোমার মতো দেখতে। এমনকী চোখের মণি দুটোও ঠিক তোমার মতন।
নীল?
নীল তো তোমার নিজের মণির রং নয়। কালো।
তাই? আশ্চর্য তো!
অঘোরবাবু বললেন।
তাই?
ভীনা বললেন।