চৈত্র মাসের লক্ষ্মীপূজার কথা
একদিন নারায়ণ রথে চড়তে যাচ্ছেন, এমন সময়ে লক্ষ্মী বললেন, ‘তুমি কোথায় যাবে প্রভু? আমি তোমার সঙ্গে যাব।’ নারায়ণ বললেন, ‘তুমি আমার সঙ্গে কোথায় যাবে? মেয়েমানুষ নিয়ে পথে যেতে নাই, পদে পদে বিপদ ঘটে। তুমি ঘরে থাকো, আমি একবার জগতের লোকে কী করছে দেখে আসি।’ লক্ষ্মী কোনোকথা শুনলেন না। নারায়ণ কী করেন, বললেন, ‘যেতে চাও চলো, কিন্তু আমি যা বলব তা শুনো, যা বারণ করব তা করতে পারবে না।’ লক্ষ্মী বললেন, ‘আমি কি কখন তোমার অবাধ্য হয়েছি?’ এই বলে হাসতে হাসতে দুজনে রথে উঠলেন। কতদূর যাচ্ছেন, যেতে যেতে একজায়গায় রথ রেখে নারায়ণ বললেন, ‘লক্ষ্মী, তুমি এইখানেই থাকো, আমি এখনই আসছি। দেখো লক্ষ্মী, আমার কথা যেন ভুলো না, সব দিকে চেয়ো, কেবল দক্ষিণদিকে চেয়ো না, তাহলে বিপদ ঘটবে।’ নারায়ণ চলে গেলেন, লক্ষ্মী মনে মনে ভাবলেন যে, নারায়ণ সকল দিকে চাইতে বললেন, কিন্তু দক্ষিণদিকে চাইতে কেন বারণ করলেন? মেয়েমানুষের মন, লক্ষ্মী সেই দক্ষিণদিকেই আগে চেয়ে দেখলেন, দেখেন যে একখানি তিলখেত সাদা ধপধপে ফুলগুলিতে যেন আলো করে রয়েছে। তিনি আর থাকতে পারলেন না, অমনি রথ থেকে নেমে এক আঁচল ফুল তুলে এনে, খোঁপায় দিলেন, কানে দিলেন, শেষে গলায় পরে রথে চড়ে বসে রইলেন।
নারায়ণ এসে দেখে বললেন, ‘লক্ষ্মী, সর্বনাশ করেছ? আমি যা বারণ করেছি, তুমি তাই করেছ; এখন যাও তিল-সন খাটো। কারুর খেতে নেমে তিলফুল তুলতে নেই, তিলফুল তুললে বারো বছর তিল-সন খাটতে হয়। তাই তোমায় দক্ষিণ দিকে চাইতে বারণ করে গেছলুম। এখন আমি আর কী করব বলো।’ একেই বলে স্ত্রী-বুদ্ধি! লক্ষ্মী কাঁদতে লাগলেন। নারায়ণ বললেন, ‘আর কী হবে বলো, যেমন আমার কথা শোনোনি এখন বৃদ্ধ ব্রাহ্মণীর বেশ ধরো।’ তিনিও বৃদ্ধ ব্রাহ্মণের বেশ ধরে, ‘এ কার খেত গো! এ কার খেত গো!’ এই বলে জিজ্ঞাসা করতে লাগলেন। এক ব্রাহ্মণ এসে বললেন, ‘কেন গো? এ আমার খেত?’ নারায়ণ বললেন, ‘বাপু! এ মেয়েমানুষটি তিলফুল তুলেছে, তাই তিল-সন খাটবে, তুমি একে তোমার ঘরে নিয়ে যাও, পাতের এঁটো খেতে দিও না, আর ছাড়া কাপড় কাচতে দিও না।’ এই বলে নারায়ণ চলে গেলেন।
লক্ষ্মী ব্রাহ্মণের সঙ্গে তাঁর বাড়িতে গেলেন। ব্রাহ্মণের গিন্নি ও তিন বউ বেরিয়ে এলেন, ব্রাহ্মণ সব বুঝিয়ে বললেন। গিন্নি বললেন, ‘আমরাই খেতে পাই না, আবার এই ব্রাহ্মণীকে কেমন করে রাখব গো!’ কর্তা বললেন, ‘তা থাক আমাদের জুটলে ওঁরও এক মুঠো জুটবে, তোমরা ওঁকে বেশ যত্ন করো।’ এই বলে কর্তা বাইরে গেলেন। সবাই চুপ করে বসে রইলেন। তখন লক্ষ্মী বললেন, ‘তোমরা বসে রইলে কেন মা? বেলা হয়েছে, তেল মাখো, নেয়ে এসো, রান্না-টান্না করো।’ গিন্নি বললেন, ‘তেল কোথায় পাব মা, যে তেল মাখবো, কাপড় কোথায় পাব যে কাপড় পরব, চাল-ডাল কোথায় পাব যে রান্না হবে? ছেলেরা ভিক্ষে করতে গেছে, এলে তারপর সব হবে।’ লক্ষ্মী বললেন, ‘ঘরের ভেতর গিয়ে দেখো সবই আছে।’ বড়ো বউ ঘরের ভেতর গিয়ে দেখলেন—আলনায় কাপড়, ভাঁড়ভরা তেল, সকল জিনিসই ঘর ভরা রয়েছে। দেখে খুব আহ্লাদ হল, সকলকে ডেকে দেখালেন—দেখে অবাক। ভাবলেন, বুঝি ইনি কোনো দেবতা। তখন সবাই স্নান করে এলেন, রান্না-টান্না করে খুব যত্ন করে আগে লক্ষ্মীকে খাওয়ালেন। তারপর ছেলেরা ভিক্ষে করে এসে সব শুনলে, তারাও খুব যত্ন করতে লাগল। এই রকমে দিন যায়, কেবল মেজো বউ একটু খিট খিট করে। বলে মাগি দাসীবৃত্তি করতে এসে, পাতের এঁটো খাবেন না, ছাড়া কাপড় কাচবেন না, সুখ দেখে আর বাঁচি না। মেজো বউ কিছু দিলে লক্ষ্মী খান না, যা দেন সব ডালিম গাছের গোড়ায় পুঁতে রাখেন। এমনি করে বারো বছর কেটে গেল।
একদিন গিন্নি বললেন, ‘মা, আজ বারুণী, চলো আজ সকলে গঙ্গাস্নান করে আসি।’ লক্ষ্মী বললেন, ‘আমি যাব না মা, আমি বাড়িতে থাকি, তোমরা যাও। আমার এই পাঁচ কড়া কড়ি নিয়ে যাও, গঙ্গার পূজা দিও।’ তখন সকলে গঙ্গাস্নানে গেলেন, স্নানকরে খুব ঘটা করে সকলে পূজা দিলেন। বড়ো বউ যেমন আসবেন অমনি তাঁর পিঠে কি ঠক করে উঠল। খুলে দেখলেন সেই পাঁচ কড়া কড়ি, অমনি তাঁর পূজার কথা মনে পড়ল। তিনি বললেন ‘পাঁচ কড়া কড়ির আর কী কিনে পূজা দেব, ওই কড়ি গঙ্গায় ফেলে দি।’ তখন তিনি যেমন সেই পাঁচ কড়া কড়ি গঙ্গায় ফেলে দেবেন, অমনি মা গঙ্গা চার হাত বার করে ধরে নিলেন। তখন সকলকার মনে সন্দেহ হল, বললেন, ‘আমরা এত জিনিস দিয়ে পূজা করলুম, কই মা গঙ্গা ত হাত পেতে নিলেন না! তবে কি উনি মানুষ নন। নিশ্চয়ই কোনো দেবী আমাদের ছলনা করতে এসেছেন।’ এই রকম বলাবলি করতে করতে সকলে বাড়িতে যেতে লাগলেন।
ওখানে নারায়ণ গণনা করে দেখলেন যে, বারো বছর পূর্ণ হয়েছে। অমনি তিনি বৃদ্ধ ব্রাহ্মণের বেশ ধরে এসে লক্ষ্মীকে বললেন, ‘লক্ষ্মী চলো, আজ তোমার বারো বৎসর পূর্ণ হয়েছে। দেবতাদের নিমন্ত্রণ করেছি, তুমি না-গেলে কে অন্ন দেবে?’ লক্ষ্মী বললেন, ‘এদের বাড়িতে এত দিন আছি, না-দেখা করে কি যাওয়া উচিত?’ এদিকে মেয়েরা গঙ্গাস্নান করে বাড়িতে এসে দেখেন যে, মা লক্ষ্মী এক পা রথে, এক পা পথে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। গিন্নি তখন তাঁর চরণ ধরে বলতে লাগলেন, ‘মাগো! তোমায় চিনতে পারিনি, অপরাধ মার্জনা করো মা। আমাদের ছেড়ে কোথাও যেও না মা!’ মা লক্ষ্মী বললেন, ‘আমার আর থাকবার জো নাই। ওই দেখো, নারায়ণ আমায় নিতে এসেছেন। আমি চললুম, ডালিমতলায় যা আছে, তুলে নিও, তাতে তোমাদের দুঃখ দূর হবে। আর মেজো বউয়ের ঝাঁপির মধ্যে যে হার আছে তাকে নিতে বলো। ভাদ্র মাসে, কার্তিক মাসে, পৌষ মাসে, চৈত্র মাসে, লক্ষ্মীর পূজা কোরো, তোমাদের কোনো কষ্ট থাকবে না।’ এই বলে লক্ষ্মী-নারায়ণ অন্তর্হিত হলেন। গিন্নি ডালিম গাছের তলা খুঁড়ে দেখলেন, পচা ভাত-তরকারি সব সোনা হয়ে আছে। মেজো বউ হারের লোভে যেমনি ঝাঁপি খুলেছেন, অমনি একটা কেউটেসাপ তার ভেতর থেকে বেরিয়ে কামড়ে দিলে। তখন সকলে বলতে লাগল, আহা মেজো বউ চিনতে পারলে না, যেমন অচ্ছেদ্দা করতে তেমনি হল। হায়! হায়! করে সকলে কাঁদতে লাগল। মেজো বউ মরে গেল। আর সকলে সুখে ঘরকন্না করতে লাগল। সেই অবধি চৈত্রমাসে মা লক্ষ্মীর পূজা চারদিকে প্রচার হল।
চৈত্র মাসের লক্ষ্মীপূজার কথা সমাপ্ত।