চৈতালি

চৈতালি 

ফাল্গুন গিয়া চৈত্র পড়িয়াছে। কয়েক দিন মাত্র হইয়াছে, কিন্তু তবুও রোদের দিকে চাওয়া যায় না। অদূরে জুট মিলটার গায়ে রোদ যেন ঠিকরাইয়া পড়িতেছে; কলের ক্লান্ত নিশ্বাসের মতো অভ্র-রং লাগানো চিমনিটা দিয়া একটা তাম্রাভ ধুঁয়ার অস্পষ্ট রেখা মন্থর গতিতে কুণ্ডলি পাকাইয়া আকাশে মিশাইয়া যাইতেছে। প্রশস্ত মাঠটার সবুজ রঙে একটা অস্বস্তিকর চিক্‌চিকে শ্বেতাভ—মনে হয় তৃষ্ণার্ত কী-একটা এই কাঁচা হরিৎ তাহার লালাক্ত জিব দিয়া যেন চাটিয়া বেড়াইতেছে। দূরে গঙ্গার দিকেও চাওয়া যায় না—রুক্ষ আকাশের নিচের জলের রেখাটা দুলিতেছে যেন একখানা কম্পমান মরীচিকা। 

মাঠের ও-প্রান্তে একটা পত্রহীন পলাশ গাছের মাথায় এক থোকা টকটকে ফুল এখনও কী করিয়া আত্মরক্ষা করিয়া আছে। বেশ একটা প্রীতির ভাব জাগায় না, মনে হয়—দগ্ধাবশিষ্টের শেষ অগ্নিরেখা। 

অশ্বিনী বলিল, এবার চৈত্রের রূপ দেখছ? বৈশাখ যে তা হলে কী বেশে আসবেন বলতে পারি না। 

তারাপদ বলিল, জানালাটা বরং বন্ধ করে দিই, সত্যি, চোখে বড় লাগছে আলোটা। সমস্ত বছরটাই প্রায় শুকো গেল, হবেই তো এ রকম। 

উঠিতেই শৈলেন বলিল, থাক না, তোমরা না হয় এ দিকে মুখ করে ঘুরে বসো।

তারাপদ, অশ্বিনী, অক্ষয়—তিন জনেই মুখ-চাওয়া-চাওয়ি করিয়া একটু হাসিল।

তারাপদ বসিতে বসিতে বলিল, তোমাদের অন্ত পেলাম না শৈলেন;–বর্ষা সরস, তাতে রস পাও বুঝি; কিন্তু এই জ্বলন্ত আকাশ আর ধরিত্রী,—চাইলে চোখ ঠিকরে পড়ে, এতে তোমরা কী রসের, কী কবিত্বের যে সন্ধান পাও মাথায় ঢোকে না। নাঃ, তোমাদের নিয়ে যে কী মুশকিলেই— 

শৈলেন স্থিরদৃষ্টিতে বাহিরের দিকে চাহিয়া ছিল, মুখটা অল্প ফিরাইয়া লইয়া একটু হাসিল। সত্যই একটু আবিষ্ট হইয়া গিয়াছে। তারাপদর পানে একটু চাহিয়া থাকিয়া হাসিয়াই বলিল, মুশকিল বরং তোমাদের নিয়ে—প্রত্যেকটি ব্যাপার তোমরা মানুষ বা জীবজন্তুর সুখ সুবিধের মাপকাঠি দিয়ে বিচার করবে। জল হয়নি—অর্থাৎ তোমাদের ধান-মুগ-মুসুরির অসুবিধে হয়েছে, কী তোমাদের গোরু-ঘোড়ার একটু ঘাসের অভাব হয়েছে, ব্যস, তোমরা চোখে অন্ধকার দেখছ বলে পৃথিবীর সব সৌন্দর্য লোপ পেল! ধরো, যদি একটা বৃহত্তর প্রয়োজনে বা কোনও এক বিরাটতর সত্তার—পুরুষেরই বলো—অদ্ভুত সৌন্দর্যলিপ্সা মেটাবার জন্যেই এক রুক্ষতার সৃষ্টি হয়ে থাকে তো তাঁর সেই বিরাট আনন্দের সঙ্গেই আমাদের মনের সুর বাঁধবার চেষ্টা করাটাই কি বেশি সংগত— 

এমন সময় অক্ষয় হঠাৎ উঠিয়া বসিয়া জানালার বাহিরে অঙ্গুলিনির্দেশ করিয়া বলিয়া উঠিল, দেখ, দেখ, উস— 

সকলে নির্দিষ্ট পথে দৃষ্টি ফিরাইয়া নিশ্চল হইয়া গেল। একটা মুষলাকৃতি বিরাট দেহ তাণ্ডবের মত্ত আনন্দে জ্বলন্ত মাঠের উত্তর হইতে দক্ষিণে চক্রগতিতে ছুটিয়া চলিয়াছে। তাহার ধূলিপাটল অঙ্গ হইতে জীর্ণ-পত্রের ছিন্ন বসন ক্রমাগত পড়িতেছে খসিয়া, আর ক্রমাগতই সে শিকড়ের মতো শীর্ণ বক্র অঙ্গুলি দিয়া সেটাকে জড়াইয়া লইতেছে। পাতায় পাতায় সংঘাতের ফলে যে একটা উগ্র মরমর উঠিতেছে, সেটা এত দূর থেকেও স্পষ্ট শোনা যায়। 

তারাপদ বলিল, এ রকম ঘূর্ণি অনেক দিন দেখিনি,—কখনও দেখেছি কি না মনে পড়ে না। 

অক্ষয়ের একটু যেন ঘোর লাগিয়াছিল, বলিল, ঘূর্ণিই তো? দেখ, দেখ কপালে আগুন জ্বলছে! 

একটানা নয়, তবে একটু থামিয়া থাকিয়া সত্যই রুদ্রের তৃতীয় নয়নের মতো ঘূর্ণিটার ললাটে একটা অগ্নিশিখা জ্বলিয়া উঠিতেছে। যত আবর্জনা দেহলগ্ন করিতে করিতে গতিটা হইয়া উঠিতেছে আরও প্রমত্ত। 

তারাপদও একটু কী রকম হইয়া গিয়াছিল, কতকটা যেন নিজের মনেই বলিল, শুনেছি সব ঘূর্ণিই ঘূর্ণি-মাত্র নয়। 

আবার নিজের সেটা সামলাইয়া লইয়া বলিল, অবশ্য মেয়েলি কথা। 

অক্ষরের ঘোরটা তখনও কাটে নাই, একটু বিরক্তির কণ্ঠেই বলিল, মেয়েলি! কপালে ওই আলোটা তা হলে কী? ওই দেখ, আবার—ওই—ওই— 

শৈলেন বলিল, আগুনই। কোন উনুনের তাও সন্ধান পেয়েছি আমি।

সকলে তাহার মুখের দিকে চাহিল। শৈলেন পলাশ গাছটার পানে অঙ্গুলি নির্দেশ করিয়া প্রশ্ন করিল, ফুলের সেই গোছাটা কোথায়? 

সকলেই দেখিল, ডালের বেশ খানিকটা পর্যন্ত লইয়া ফুলের সমস্ত স্তবকটা অদৃশ্য হইয়া গিয়াছে। অক্ষয় প্রশ্ন করিল, বলতে চাও, ঘূর্ণিতে ডালসুদ্ধ মুচড়ে নিয়ে চলে গেছে? 

শৈলেন মাথা দোলাইল, বলিল, বাংলার ম্যালেরিয়াগ্রস্ত ঘূর্ণি এর বেশি বোধ হয় পারে না, তবে অন্যত্র সে গাছকে-গাছ উপড় নিয়ে নাচের সহচর করেছে এ আমার নিজের চক্ষে দেখা। 

সকলে ধরিয়া বসিল—গল্পটা তাহা হইলে বলিতে হইবে, চৈতালি গল্পই চলুক আজ। 

***

শৈলেন মাথার তলায় মোটা তাকিয়াটা ভালো করিয়া বসাইয়া লইল যাহাতে দৃষ্টিটা বেশ সোজাসুজি জানালার বাহিরে গিয়া পড়িতে পারে। বলিল, সে গল্পটা বলতে গেলে আমাকে আগে অক্ষয়ের ক্ষমা ভিক্ষা করে নিতে হয়। তার মানে, যদিও সে ঘূর্ণিটা বোধ হয় একটা আটপৌরে চৈতালি ঘূর্ণি ব্যতীত আর কিছুই ছিল না, তবু সমস্ত ব্যাপারটার যোগাযোগের মধ্যে এমন কতকগুলো কাণ্ড হয়েছিল, যার টীকা আমি এখনও সম্পূর্ণভাবে করে উঠতে পারিনি। 

শৈলেন রহস্যের স্মৃতিতেই যেন একটু থামিয়া গেল, তাহার পর আবার আরম্ভ করিল, সেবার হঠাৎ নেপালে পশুপতিনাথ দর্শনের খেয়াল চাপল। চমকিয়ো না, ভক্তির টান নয়। শিব উদাসীন কিন্তু আমি ওঁর বা ওঁদের সম্বন্ধে তার চেয়ে লাখোগুণ উদাসীন, এ কথা জানাই। ঝোঁক চাপল দলে পড়ে। মেয়ে-পুরুষে বেশ একটি বড় দল হল আমাদের। ওদের অবশ্য লোভ সাক্ষাৎ শিবকে দেখবে, আমার শখ, দেখব হিমালয়। অন্তত এই উদ্দেশ্য নিয়ে তো বেরুলাম। 

—কিন্তু জানো, ধর্ম জিনিসটা বড় সংক্রামক। চার দিন লাগল আমাদের হিমালয়ের গোড়ায় পৌঁছোতে। এই চার দিনেই দলের সবার মুখে ক্রমাগত শিবের কীর্তিকাহিনি শুনতে শুনতে আমার মনে অল্প অল্প করে রং ধরতে লাগল। তার পর দল ক্রমেই বাড়তে লাগল আর আলোচনাও ঘোরাল হয়ে উঠতে লাগল, শেষে এমন হল যে, যখন হিমালয়ের গোড়ায় পৌঁছোলাম তখন হঠাৎ দেখি, আর সবার মতনই আমিও এক রীতিমতো শৈব হয়ে পড়েছি। আমার মানসিক পরিবর্তন আর সেই সঙ্গে নিষ্ঠা দেখে সবাই সাব্যস্ত করলে—বাবাই আমায় ঘরছাড়া করে টেনে নিয়ে এসেছেন। 

–ক্রমে কথাটা আমিও বেশ জোরের সঙ্গে বিশ্বাস করলাম এবং বোধ হয় দেবতার এই বিশেষ অনুগ্রহের বিশ্বাসেই আমার আকাঙ্ক্ষাটা সব সীমানা ছাড়িয়ে একেবারে সম্ভাব্যের কোঠায় গিয়ে উঠল। আকাঙ্ক্ষা না বলে যদি আবদার বলি তো বোধ হয় আরও ঠিক হয়। হিমালয়ের নিচেকার গোটাকতক পাহাড় অতিক্রম করতে করতেই তার বিরাটতায় আমি যেন অভিভূত হয়ে পড়তে লাগলাম। কতকটা যেন একটা নেশার ভাব আমার মাথায় ঘনীভূত হয়ে উঠতে লাগল—খুব বড় একটা কিছুর নেশা। মনে হল, এই তো আমি পৃথিবীর সবচেয়ে যা বিরাট, সবচেয়ে যা রহস্যময়—দেবতাদের লীলাভূমি, শঙ্কর-উমার তপঃপ্রাঙ্গণ যে হিমালয় তার গহ্বরে বিচরণ করছি; এখানে এসেও কি আমায় ক্ষুদ্র সংকীর্ণ একটা মন্দিরের মধ্যে স্বপ্নায়তন একটি শিলাবিগ্রহকে দেখেই দেবদর্শনের সাধ মিটিয়ে যেতে হবে? আমার প্রতি যদি দেবতার এতই করুণা যে, আমার কঠিন ঔদাসীন্যের মধ্যেও তাঁর আকর্ষণকে এমন প্রবল আর অমোঘ করে তুলেছেন তো তিনি আমার কাছে নিজের স্বরূপে প্রকট হোন। কালের অপ্রমেয় অতীতে এই দেবভূমির উপর লোকাতীত যে সমস্ত লীলা সংঘটিত হয়েছিল, তার অল্প একটুও আবর্তিত করে আমার নয়নের সামনে ধরুন। আমি চরিতার্থ হব। তপঃক্ষীণা ধ্যানরতা উমার প্রশান্ত জ্যোতির্ময়ী মূর্তিই হোক, ভিক্ষার্থী শঙ্করের সামনে শিবানীর অন্নপূর্ণামূর্তিই হোক বা মদন-ভস্মের সময় যোগিবরের প্রলয়-মূর্তিই হোক—-কালের যবনিকা তুলে আমায় দেখান একবার। তার জন্যে যা তপস্যা তা আমি করব। আমার জাগ্রত চেতনায় যদি সম্ভব না হয় তো স্বপ্নেই হোক বা আমার চেতনাকে সম্মোহিত করেই হোক, আমায় দেখান! আমি সেটাকেও সত্যরূপেই গ্রহণ করে আমার তীর্থ-অভিযানের পরম সঞ্চয় করে রাখব। তাঁর লীলাক্ষেত্রে এসেও যদি আমায় মাত্র স্থাবর শিলামূর্তি দেখেই ফিরতে হয় তো ভাব, আমি বঞ্চিত হলাম। 

—যতই এগুতে লাগলাম, হিমালয়ের বিস্ময় যতই আমায় আচ্ছন্ন করে ফেলতে লাগল, আমার মনটা ততই যেন অপ্রসন্ন হয়ে উঠতে লাগল।…এই তো এসে পড়লাম বলে—ভিড়ের পেছনে শিলামূর্তিকেও ভালোভাবে না পেয়ে, আর শিলামূর্তির পেছনে দেবতাকেও হারিয়ে দু-দিন পরে ফিরে যাব। শূন্য-হাতেই যাব ফিরে। এর জন্যেই কি সুদূর বাংলা ছেড়ে এত আশা এত উদ্যম নিয়ে আসা? যে দেবতার প্রসাদ লাভ করেছি বলে সবাই বলছে, এক এক সময় যে দেবতাকে অন্তরতম অন্তরে পাই বলেও যেন অনুভব করি, তাঁর কী করে পুজো করব, যদি এই দারুণ নিরাশা মনকে তিক্ত করে রাখে? বরকে অভিশাপে পরিণত করবার জন্যেই কি তিনি আমায় এখানে নিয়ে এলেন? আমার খাওয়া কমে এল, পথ অতিক্রম করার উৎসাহ কমে এল, দলের পক্ষে আমি যেন একটা বোঝা এবং সমস্যা হয়ে উঠতে লাগলাম, যে দল বিশেষ করে আমার ওপরই একটা অলৌকিক শক্তির আকর্ষণ ধ্রুব বলে মেনে নিয়েছিল।

–এরই মধ্যে কিন্তু আমার মনে এক এক সময় আবার হঠাৎ কোথা থেকে একটা জোয়ার ঠেলে উঠত—একটা প্রবলতর বিশ্বাসের জোয়ার। সমস্ত মনটা লোকোত্তর কিছু একটা দেখতে পাবে বলে যেন উদগ্র হয়ে উঠত, মনে হত, এই এক্ষুণি দেখতে পাবে, সে এক অদ্ভুত ধরনের অনুভূতি, যাতে না-দেখতে পাওয়াটাই আশ্চর্য মনে হত। এই যে প্রত্যক্ষ সমস্ত ঘটনা—এই রুক্ষ ইন্দ্রিয়াধীন হিমাচল, এই দলের পর দল আমাদের যাত্রীদের অভিযান, তাদের প্রতিদিনের চলার ইতিহাস, চটিতে এসে নিতান্ত পার্থিব ব্যাপারগুলোর অনুষ্ঠান—এই সবগুলোকেই কেমন যেন অলীক আর অদ্ভুত বলে মনে হত। ঠিক যেন এসব মিলিয়ে আসছে আর সামনেই অন্য এক নাট্যশালার একটা পর্দার দোল অনুভব করা যাচ্ছে। এখুনি পর্দা উঠবে আর আরম্ভ হবে নটরাজের খেলা। বেশ অনুভব করছি, এই যে পেছনের জগৎ আমার, এটা সে খেলার সামনে প্রেক্ষাগৃহের মতনই আমার চেতনা থেকে বিলীন হয়ে যাবে। 

—তোমরা বলবে—আশা-নিরাশার সঙ্গে উপবাস আর পথশ্রাত্তি মিলে আমার মস্তিষ্ককে বিকৃত করে আনছিল। সম্ভব। 

—এই সময় একটা ব্যাপার হল যার দ্বারা আমি আমার দল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলাম। তোমাদের বলতে ভুলে গেছি যে, মেলা লোককে কুড়িয়ে বাড়িয়ে নিয়ে আমাদের যাত্রা করতেই অনেক দেরি হয়ে গিয়েছিল। ফলে, যদি বলা যায় যে, সব যাত্রীদলের মধ্যে আমরাই প্রায় শেষ দল ছিলাম তো বিশেষ মিথ্যা বলা হয় না। পৌঁছোবার আগের দিন দুপুরবেলায় আমরা যে চটিতে এসে উঠলাম, সেখানে খবর পেলাম যে একটা আকস্মিক প্রবল ঝড় আর বৃষ্টিপাতে সামনের রাস্তায় একটা বড় রকম ধস্ নেমে রাস্তাটা বন্ধ হয়ে গেছে। এ রকম জায়গায় একটা আতঙ্কের কথা শুনলে তার সত্য মিথ্যা নির্ধারণ করবার আর সাহস থাকে না মনে। স্থির হল, আমরা একটা অন্যপথ দিয়ে ঘুরে যাব, তাতে আমাদের একটা দিন বেশি লাগবে। আমি ছাড়া সবাই বড় নিরুৎসাহ হয়ে পড়ল। 

তিন জনেই প্রশ্ন করিয়া উঠিল, তুমি ছাড়া?

শৈলেন উত্তর করিল, হ্যাঁ, আমি ছাড়া বইকি।

তিন জনেই আবার প্রশ্ন করিয়া উঠিল, তার মানে? 

শৈলেন উত্তর করিল, আমার মনে হল, আমার মনের আবেদন যেন যথাস্থানে পৌঁছে গেছে। যদি তখন এও ভেবে থাকি যে, পাহাড়ের এই ধস্ কোনও এক মহাশক্তির আবির্ভাবই সূচিত করছে তো কিছু আশ্চর্য হয়ো না। আমার মনটা তীক্ষ্ণ প্রত্যাশায় আরও চঞ্চল হয়ে উঠল। ওই ধস্—আমাদের যাত্রাপথে যা একটা এত বড় অন্তরায় হয়ে দাঁড়াল, সেটা কার পদচিহ্ন মাত্র? তাকে দেখতেই হবে, তা সে যতই ভৈরব হোক না কেন। 

—পথ অত্যন্ত খারাপ। ক্রমাগতই যেন মনে হচ্ছে, গভীরতর অরণ্যের মধ্যে প্রবেশ করেছি। যখন পরের চটিতে পৌঁছোলাম আমরা, তখন দিব্যি অন্ধকার হয়ে এসেছে। আমাদের সঙ্গে মাত্র আর একটি ছোট দল ছিল—যাত্রীরা উত্তর-মাদ্রাজ অঞ্চলের। সবাই তাড়াতাড়ি রাঁধবার খাবার ব্যবস্থায় লেগে গেল। 

অন্ধকারমগ্ন সেই জায়গাটা আর সেই রাত্রিটা আমার মনে একটা এমন ছাপ রেখেছে, যা এ জন্মে মেটাবার নয়। চটিটা একটা পাহাড়ের গোড়ায়, তার পেছনের দেয়ালটা পাহাড়েরই একটা অংশ। সেই দেয়ালটা একটু একটু ঢালের ওপর যে কতদূর পর্যন্ত চলে গেছে কিছুই ঠাহর হয় না। চটির কলরব থেকে একটু আড়ালে এসেই একটা অদ্ভুত থমথমে ভাব। শব্দের রেশমাত্রও কোথাও কিছু নেই—অবস্থাটাকে যেন শুধু মৌনতা বললেই যথেষ্ট হয় না; মনে হয় মৌনতাও যেন তার কাছে ঢের মুখর। সেই অন্ধকার, সেই রহস্যময় বন, সেই পাহাড়—যা কোথায় গিয়ে যে ঠেকেছে কেউ জানে না, আর, সমস্তকে আচ্ছন্ন করে সেই অদ্ভুত স্তব্ধতা—এই সব কটি একসঙ্গে আমার মনকে ভরাট করে আমার উল্লাসে বিস্ময়ে যেন কী এক রকম করে দিলে। মনের ভাবটা ঠিক গুছিয়ে বলতে পারছি না—কেন না, মানুষ যখন একটা ভাবে অভিভূত হয়ে পড়ে, তখন তার স্মৃতিশক্তিটা হয়ে পড়ে বড় অস্পষ্ট; তবে আবছাগোছের একটু মনে আছে যে, হঠাৎ যেন একটা বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার নেশা আমায় পেয়ে বসল, ঠিক আত্মহত্যা করবার নয়, শুধু বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার— এই তরল কষ্টিপাথরের মতো অন্ধকারে, চির-অজ্ঞেয় বনাশ্রিত এই পাহাড়ে, এই অপরূপ স্তব্ধতায়। বিরাট্ এক অজগর তার অপলক ঘনকৃষ্ণ চক্ষু দিয়ে আমায় সম্মোহিত করে ফেলে তার অন্ধকার জঠরে আকর্ষণ করছে। সব তুচ্ছ করে, সব ভুলে আমি স্থির পদক্ষেপে চলেছি, কেন না গতির মধ্যে রয়েছে এক অপূর্ব মাদকতা…আর একটা ঘূর্ণি উঠেছে, দেখ। 

অপেক্ষাকৃত ছোট ঘূর্ণি; মিলাইয়া গেল, সকলে আবার পূর্ববৎ দৃষ্টি ফিরাইয়া বসিল। শৈলেন বলিল, খুব বেশি দূর যাইনি, কেন না একটু গিয়েই পদে পদে জঙ্গলের ডালপালায় বাধা পেয়ে আমার চৈতন্য হয়েছিল—এটা বেশ মনে আছে। ঠিক যেন আমার মনে হল প্রাণপণে কে আমায় সামনে ঠেলে রাখবার চেষ্টা করছে, কার যেন নিঃশব্দ সতর্কবাণী শুনতে পাচ্ছি—’এস না, এস না, এ পথ নয়।’ ভরা চৈতন্য হবার সঙ্গে সঙ্গে ফেরবার চেষ্টা করছি, কিন্তু সে তো আর সম্ভব নয়। সমস্ত রাত শুধু ঘুরে বেড়িয়েছি মাত্র। ভোরেও নয়, সকালেও নয়, যখন চটিতে ফিরলাম, তখন দুপুর গড়িয়ে গিয়েছে। সঙ্গীরা—দুই দলের সবাই যথাসাধ্য খোঁজাখুঁজি করে দুপুরে অল্প একটু আগে নিরাশ হয়ে বেরিয়ে পড়েছে। বোধ হয় আরও থেকে যেত কিছুক্ষণ, কিন্তু এই সময় একজন তিব্বতি লামা চটিতে হঠাৎ এসে পড়েন। তিনি সব শুনে বললেন, তিনিও পশুপতিনাথের পথেই যাচ্ছেন—আমায় সঙ্গে করে নিয়ে আসবেন। 

—কথাগুলো শুনলাম আমার চটিওয়ালার কাছে; লোকটা তরাইয়ে এক সময় ছিল—ভাঙা গোছের এক রকম হিন্দি একটু একটু জানে, কাজ চালিয়ে নেয়। জিজ্ঞাসা করলাম, লামা কোথায়? 

—চটিওয়ালা একটা অন্ধকারগোছের ঘর দেখিয়ে বললে, তিনি ওইখানে বিশ্রাম করছেন! 

—বললাম, আমায় নিয়ে চলো, অবশ্য যদি তাঁর আপত্তি না থাকে। 

—ঘরের মধ্যে গিয়ে কিন্তু দেখলাম, কেউ নেই। বেরিয়ে বারান্দায় এসে চটিওয়ালা বললে, বাঃ, এই একটু আগে তো ঢুকলেন ঘরে! 

—বাইরে রোদটা খুব স্বচ্ছ, এদিকে ঘরটা কতকটা অন্ধকার, ধাঁধা লাগল না তো? সংশয়টা চটিওয়ালাকে জানাতে সে আবার ঘরে ঢুকল আমিও পেছন পেছন গেলাম। অন্ধকার কোণটার পানে গলাটা একটু বাড়িয়ে চটিওয়ালা এবার একটা ডাকও দিলে। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই আমরা দুইজনেই চমকে উঠলাম। উত্তর এল আমাদের পেছন থেকে, ফিরে দেখি, ঠিক দরজার বাইরে বারান্দায় একজন দীর্ঘকায় পুরুষ আমাদের দিকে স্থিরদৃষ্টিপাত করে দাঁড়িয়ে। চটিওয়ালা একটু অপ্রতিভ হাসি হেসে কী একটা কথা বললে, তিনি তার উত্তরও দিলেন। চটিওয়ালা আবার কী একটা প্রশ্ন করলে, তারও উত্তর হল। কিন্তু লক্ষ করলাম, এবার স্বরটা একটু যেন রুক্ষ, দৃষ্টিতেও একটু যেন বিরক্তি—কারুর কথায় বিশ্বাস না করলে তার মুখের ভাবটা যেমন হয়, কতকটা সেই রকম। এবার চটিওয়ালার মুখে একটু খোশামোদের হাসি ফুটে উঠল, একটা কথাও কী বললে, না-বুঝতে পারলেও মনে হল, একটা জবাবদিহি দিয়ে লোকটির বিরক্তিটা মিটিয়ে দিতে চায়। তারপর একটা প্রশ্ন করলে। তার উত্তরে লোকটা আমার পানে স্থিরভাবে সেকেন্ড কয়েক চেয়ে থেকে ঠিক তিনটে শব্দে কী একটা কথা বললে। সমস্ত শরীরটি নিশ্চল, শুধু চাপা ঠোঁট দুটি অল্পমাত্র একটু নড়ল। 

—ঘরের মধ্যে সেই প্রথম না-পাওয়া থেকে তীক্ষ্ণদৃষ্টির সঙ্গে এই স্বল্পাক্ষর প্রশ্ন, আমার কেমন যেন একটা অস্বস্তি হচ্ছিল। পূর্বেই বলেছি, লোকটা বেশ দীর্ঘাকৃতি, মুখটা তিব্বতি ছাঁদেরই, তবে সাধারণত এদের মুখ যেমন ভাবলেশহীন হয় তেমন নয়—বেশ বুদ্ধিদীপ্ত। মোঙ্গোলীয় জাতের বয়স নির্ণয় করা আমাদের পক্ষে শক্ত, তবুও সমস্ত আকৃতিটার কোথায় যেন কী আছে, যার দ্বারা একটা ধারণা আপনি থেকেই বদ্ধমূল হয়ে যায় যে, বয়সটার মধ্যে কিছু একটা অসাধারণত্ব আছে—যেন আমাদের বয়সের মাপকাঠি দিয়ে মাপা চলে না—শতও হতে পারে, দুই শত হওয়াও কিছু বিচিত্র নয়, যদি তার ওপরে কিছু হয় তো তা হলেও কিছু আশ্চর্য হবার নেই। আমাদের চেহারায় থাকে খণ্ডিত কালের নিশানা, ওর চেহারায় কালের যদিই বা কিছু ছাপ লেগে থাকে তো সে অখণ্ড কালের।—সমস্ত মাথাটি মুণ্ডিত, গায়ে হলদে-রঙে—ছোরানো মোটা সিল্কের একটা তিব্বতি আলখাল্লা। লোকটা তিব্বতি নিশ্চয়, কিন্তু একটু বিস্মিত হয়ে দেখলাম বৌদ্ধ নয়; কেন না হাতে একটি রুদ্রাক্ষের মালা; তার মানে, লামা নয়, বোধ হয় কোনও মঠধারী শৈব। আমি একটু বিস্মিত হলাম এইজন্যে যে, আমার ধারণা ছিল তিব্বতি মাত্রেই বৌদ্ধ। 

–প্রশ্নটা বুঝতে না পেরে একটু অস্বস্তির সঙ্গে মুখের পানে চেয়ে আছি, চটিওয়ালা বললে, বলছেন ঠিক সূর্যাস্তের সঙ্গে সঙ্গে বেরুবেন। 

—অদ্ভুত প্রস্তাব, যেখানে সূর্যাস্তের সঙ্গে সঙ্গে আশ্রয় খুঁজে বের করতে না পারলে জীবনই বিপন্ন, সেখানে আশ্রয় ছাড়বারই ব্যবস্থা হল সূর্যাস্তে! একটু হতভম্ভ হয়ে লোকটির মুখের পানে চাইলাম, প্রস্তরমূর্তিতে কোনও পরিবর্তন না দেখে, চটিওয়ালার মুখের দিকে চেয়ে বললাম, বেশ, তাই হবে। 

—চলে আসতে আসতে চটিওয়ালা রুক্ষস্বরেই বললে, অথচ আমার যেন মনে হচ্ছে ঘর থেকে বেরুননি বাবু; কখন বেরুলেন? এই সব তিব্বতি লামারা সব কিছুই — 

—হঠাৎ পেছনের দিকে একবার চেয়ে চুপ করে গেল। 

—বুঝলাম, নিশ্চয় এই রকম গোছের কোনও মন্তব্য করতেই তিব্বতির মুখে বিরক্তির চিহ্ন ফুটে উঠেছিল, এবং ফিরে না দেখলেও মনে হল, সে সেইখানেই দাঁড়িয়ে আমাদের দেখছে বলেই চটিওয়ালা হঠাৎ থেমে গেল। অস্বীকার করব না, একটু যেন গা-ছমছম করতে লাগল— লোকটার চেহারা অশ্রদ্ধা জাগায় না—মোটেই না, বরং বেশ একটা সম্ভ্রম জাগায়, কিন্তু সেই সঙ্গে সঙ্গে জাগায় অপরিমেয় রহস্যের ভাব। রাত্রিকে সামনে রেখে এই লোকের সঙ্গে পা বাড়াতে বেশ একটু গা-ছমছম করতে লাগল; চটিওয়ালার অসমাপ্ত মন্তব্য সেটা আরও বাড়িয়ে দিলে। 

—তারপর আবার এল সেই জোয়ার, সেই উগ্র কৌতূহলের জোয়ার। মনটা আস্তে আস্তে একটা অদ্ভুত উল্লাসে ভরে উঠতে লাগল। বুঝলাম, আমার প্রার্থনা মঞ্জুর হয়েছে, দূত এসেছেন আমায় নিয়ে যেতে। রহস্যলোকের যাত্রা তো সন্ধ্যার মহেন্দ্ৰলগ্নেই; সামনে থাকবে দূরবিস্তৃত রাত্রি-অন্ধকার—অন্ধকার—আরও, আরও অন্ধকার, তারপর যাত্রাপথের অসীম নিরাশা, অসীম ক্লান্তির শেষে আসবে প্রদোষ তার সামনে দীপ্ত দিবালোক নিয়ে। দেখব আমি লোকাতীত এক নতুন জগৎকে, সেখানে বিস্মৃত অতীতের রহস্যলীলা মরণহীন কালের কোলে নিত্য লীলায়িত হচ্ছে। কোথা শঙ্কর? কোথা উমা? কোথা যক্ষ-গন্ধর্বলোকের সঙ্গে লোকের অপূর্বমিলন? কোথা স্বর্গমর্তচারী দেবর্ষিদের জ্যোতিঃ-পথ-রেখা? দিব্যাঙ্গনাদের প্রমোদভূমি? প্রত্যক্ষ করতে হবে। ভয়? ভীতু যে, সে কী? যে বিপদকে আহ্বান করতে পারলে না, মরণকে যে পরম ত্রাতা বলে আলিঙ্গন করে নিতে পারলে না, তাকে যে এই খর্ব বিরস বৈচিত্র্যহীন জীবনকে আঁকড়ে পড়ে থাকতে হবে, যে জীবন হীনতর, দীর্ঘীকৃত মরণেরই নামান্তর মাত্র। কী আনন্দ! আমি যাব। এই অগণিত যাত্রীদের মধ্যে দেবতা আমায়ই বেছে নিয়েছেন এই মহা-সৌভাগ্যের জন্যে! আমার ললাটেই তাঁর জয়টীকা দিয়েছেন পরিয়ে, আমারই জন্যে পাঠিয়েছেন তাঁর দূতকে! তাঁর অসীম করুণার জন্যে কোটি কোটি প্রণাম। আমি যাব, যাব। সন্ধ্যা পর্যন্ত প্রতীক্ষা করে থাকা আমার অসহ্য হয়ে উঠছে ক্ৰমেই— 

শৈলেন ভাবের উন্মাদনার মধ্যে ভাষাকে একটা ঝংকার দিয়াই জানালার বাহিরে দৃষ্টি নিবদ্ধ করিয়া থামিয়া গেল। খানিকক্ষণ পর্যন্ত সেই ভাবেই চুপ করিয়া রহিল— যে রহস্য-অভিযান একদিন সত্য হইয়াছিল জীবনে আজ হঠাৎ উদবেলিত স্মৃতিতে সেই অভিমান যেন রেখা-অনুরেখায় ফুটিয়া উঠিয়া এক অপ্রত্যক্ষ নূতনতর বাস্তবের রূপ ধরিয়াছে। এই আবেশের মধ্যে এরা তিনজনেও মৌন হইয়াই রহিল। 

শৈলেন আবার আরম্ভ করিল, চলার কথা আমি বিশেষ কিছুই বলব না, পথের বর্ণনারও চেষ্টা করব না। হিমালয়ের বর্ণনার জন্যেই চাই কালিদাস—ওই রকম এক উত্তুঙ্গ প্রতিভা। দিন নেই, রাত্রি নেই, চলেছি আর প্রতি পদক্ষেপে পেয়েছি নতুন বিস্ময়। রাত্রির কথায় তোমরা আশ্চর্য হচ্ছ, কিন্তু সত্যি আমরা রাত্রিতেও চলতাম পথ। ব্যাপারটা খুব আশ্চর্যের নয়; আমরা যে ক্রমোচ্চ পথে চলছিলাম বেশি শাখাপ্রশাখার ঘন জঙ্গল তাতেই ক্রমেই কমে আসছিল, মোটেই অলৌকিক নয়, নিত্য ভৌগোলিক ব্যাপার। আমরা যে স্তরে আরম্ভ করেছিলাম, সেইটে ছিল ঘন বনের শেষ চিহ্ন আমরা সেই রাত্রির প্রথম অংশেই সেটা অতিক্রম করে গেলাম। আশ্চর্যের মধ্যে এইটুকু দেখলাম যে, যে পথে আমরা যাচ্ছিলাম “সেটা রেড রোড না হলেও যে পথে এতক্ষণ চলেছি তার চেয়ে ঢের সহজ, ঢের পরিচ্ছন্ন। হতে পারে আমি একটা প্রবল আকর্ষণে ছোট ছোট সব বাধাকেই অগ্রাহ্য করে চলেছি, তবু এ কথা মানতেই হয় যে খুব বেশি বাধা তেমন কিছুই ছিল না। আর একটা কথা যা তখন ভেবে দেখিনি, অথবা যা তখন, কেন জানি না, অত্যন্ত স্বাভাবিক বলে মনে হয়েছিল, তা এই যে, সে রাত্রে এবং পরে সব রাত্রেই বরাবর একটা অস্পৃষ্ট আলো পেয়ে গেছি। পরে মিলিয়ে দেখেছি, সে আলো–বা আলোর আভাস বলাই ঠিক—বেরিয়েছে সেই তিব্বতি সঙ্গীর দেহ থেকে। তোমরা আপত্তি করবে জানি, কিন্তু এটাও খুব একটা অলৌকিক জিনিস নয়। কখনো কখনো মানুষের মধ্যে যে এ জিনিসটা পাওয়া যায়, বিজ্ঞান থেকে ধর্মশাস্ত্র পর্যন্ত সব কিছুই এটা স্বীকার করে। বিজ্ঞান বলে, এটা শরীরের মধ্যে কোনও একটা রাসায়নিক দ্রব্যের আধিক্যের জন্যে হয়। ধর্মশাস্ত্রের মধ্যে বিজ্ঞান-ঘেঁষা বলে আপাতত থিয়োসফিকেই ধরা যাক—-থিয়োসফি বলে, ও একটা তেজ বটে তবে অলৌকিকের চেয়ে লৌকিকই বেশি। প্রয়োজনমতো উৎকর্ষ করলে সবারই হতে পারে। কতটা অন্ধকারের মধ্যে পূর্ণ দৃষ্টি-শক্তির মতো। এই আমার থিয়োরি; না হয়, সম্মোহন তো মানোই, ধরে নাও আমি সম্মোহিত হয়েই বরাবর একটি অস্পৃষ্ট আলোককে অনুসরণ করে চলতাম। যাই হোক, ব্যাপারটা হত, আর আমার কাছে আগাগোড়াই এত সহজভাবে দেখা দিয়েছিল যে, আমি কখনও বিস্মিত হইনি বা প্রশ্ন করিনি। এই সঙ্গে এটাও জেনে রাখো যে, হিমালয়-গর্ভে পদে পদেই এত বিস্ময়, এত নূতনত্ব যে প্রশ্ন করবার প্রবৃত্তিটা লুপ্ত হয়ে আসে। 

অশ্বিনী বলিল, দু-একটা উদাহরণ ছাড়তে ছাড়তেই চলো না। 

শৈলেন তাহার পানে চাহিয়া ক্ষণমাত্র কী একটা ভাবিয়া লইয়া বলিল, দাঁড়াও, কথাটা আমি একটু ভুল বুঝেছি। হিমালয় — হিমালয় হলেও প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলির মধ্যে যে সর্বদাই রহস্য আর বিস্ময় আছে এমন নয়, শুধু অপরূপত্ব আছে—এতটুকু বলতে পারি। তবে আমি মাঝে মাঝে একটা অতিপ্রাকৃত জগতেরও পেয়েছিলাম সন্ধান। তাই বা কেমন করে বলি?—তখন চেষ্টা করিনি, মনের অবস্থা চেষ্টা করবার মতো ছিল না, তাই বিস্মিতই হয়েছিলাম; পরে কার্য-কারণের সম্বন্ধ মিলিয়ে অনেকগুলোরই যেন রহস্য উদ্ঘাটন করতে পেরেছি, অবশ্য অনেকগুলোর পারিনি এখনও, কিন্তু সেটা আমার জ্ঞান বা অভিজ্ঞতার অল্পতার জন্যেও তো হতে পারে। তা ভিন্ন এখনও পারিনি বলে যে ভবিষ্যতেও কখনও পারব না, তাই বা কেমন করে মেনে নিই? 

অক্ষয় একটু তর্কের ঝাঁজের সঙ্গে প্রশ্ন করিল, তা হলে বলতে চাও যে, অলৌকিক বলে নেই কিছু এত বড় সৃষ্টিটার মধ্যে? 

শৈলেন একটু মাথা নিচু করিয়া চিন্তা করিয়া কী একটা উত্তর দিতে যাইতেছিল, তারাপদ বলিল, এ সব পরে হবে, আগে গল্পটাই শেষ করো! 

শৈলেন বলিল, হ্যাঁ একটা কথা ভুলে যাচ্ছিলাম,—যাত্রার দ্বিতীয় দিনেই আমি একবার পশুপতিনাথের কথা তুলেছিলাম। তাতে লোকটা ভূভঙ্গী করে আমায় কী একটা প্রশ্ন করলে। তার অর্থ যাই হোক, আমার যেন মনে হল জিজ্ঞাসা করলে, সত্যিই কি আমি সেইখানে যেতে চাই? হয়তো অন্য কিছু জিজ্ঞাসা করে থাকবে, কিন্তু আমার চিন্তার গতির জন্যেই এই মানেটা ক’য়ে আর আমি কিছু বলতে সাহস করলাম না। যেদিকে যাচ্ছিলাম, সেই দিকেই হাতটা বাড়িয়ে ইঙ্গিত করলাম—আমি ওর পথেই চলব। মনে হল, ও যখন মনের অন্তস্তল পর্যন্ত দেখতে পাচ্ছে, তখন প্রবঞ্চনার চেষ্টা করা কেন? তারপর চলেছি; কত দিন যে চলেছি, প্রথম প্রথম হিসেব রাখলেও কয়েক দিন পর থেকে আর রাখতে পারিনি, চেষ্টাও করিনি বোধ হয়। দিনের পর রাত এসেছে, রাতের পর দিন; আমরা চলেছি, এমন একটা ব্যস্ত অধীরতার সঙ্গে, যেন বিশেষ কোথাও একটা পৌঁছোতে সামান্য বিলম্ব হয়ে গেলে আমাদের সমস্ত যাত্রাটাই মাটি হয়ে যাবে। উৎকট ঔৎসুক্যের জন্যই হোক বা যে—জন্যেই হোক এক একবার মনে হ’ত খুব সুদূরের বাঁশির অতি ক্ষীণ সুরের মতো কী একটা কানে এসেই মিলিয়ে গেল, কিংবা অতি দূরের একটা গন্ধের রেশ—যেন এই তরঙ্গায়িত, শ্রেণির পর শ্রেণিবদ্ধ গিরিস্তূপের কোন সুদূর প্রান্তে একটা মহোৎসবের আয়োজন হচ্ছে—তারই আসরে সুরে বাঁধার এই ছিন্ন সংগীত, তারই জন্য সুগন্ধি সমাবেশের এই খণ্ডিত আভাস। কত উপত্যকা, অধিত্যকা পেরিয়ে, পর্বতের চূড়ার পর চূড়া ডিঙিয়ে আমরা চলেছি। খর্ব এক রকম ঘাসের স্তর পেরিয়ে ঝাউয়ের স্তরে পড়লাম, সেটা বেরিয়ে প্রথম তুষারের দেশে সবুজ মখমলের মতো এক রকম উদ্ভিদ, মাঝে মাঝে নেমে আবার পরিচিত অপরিচিত উদ্ভিদের স্তরে। রাঁধার হ্যাঙ্গামা নেই, আহার মাত্র ফলমূল, কখনো কখনো কোনো লতাপাতার রস। সবগুলোই যে সুস্বাদ তা নয়, তবে সবগুলো থেকেই যে শক্তি পেয়েছি, এ কথা অস্বীকার করতে পারি না। বিশ্রাম করতে পেরেছি অতি অল্পই, একটানা তিন ঘণ্টার বেশি যে কখনও নিদ্রা দিতে পেরেছি বলে মনে হয় না—অবশ্য সূর্য বা চন্দ্র যতটুকু দেখতে পেতাম, তারই আন্দাজে বলছি; কিন্তু কখনও ক্লান্ত হইনি। শেষে আমরা একদিন আমাদের পথের উচ্চতম জায়গাটিতে একটা ঘন বরফের অধিত্যকায় এসে পৌঁছোলাম, তার পর শুধুই নামতে আরম্ভ করলাম। আবার সেই সবুজ মখমলের মতো উদ্ভিদ, তার পর ঝাউ, তার পর বেঁটে খড়ের বন, কিন্তু তার পর যখন অনেক রকম গাছের সংস্থানে ঘন জঙ্গল আশা করছি তখন এক দিন সূর্যাস্তের সঙ্গে সঙ্গে এসে পড়লাম অত্যন্ত একটা রুক্ষ দেশে—না আছে একটি জলের ধারা, না আছে একটি সবুজের রেখা, যেন একটা প্রকাণ্ড পোড়া মাটির নরম তাল সমস্ত নিশ্চিহ্ন করে ওপর থেকে নামতে নামতে কয়েকটা ঢেউ তুলেই হঠাৎ কঠিন হ’য়ে গেছে এইখানে এসে। আমাদের যাত্রা শেষ হয়ে গেল। 

শৈলেন চুপ করিয়া বালিশে এলাইয়া পড়িল। তারাপদ সিগারেট খাইতেছিল, হাতটা বাড়াইয়া বলিল, এবার দাও। 

তিন জনেই প্রবল আপত্তি করিয়া উঠিল। অক্ষয় বলিল, বাঃ, শেষ হয়ে গেল! এত দূর বন জঙ্গল নদী বরফ পার করিয়ে এনে তুমি আমাদের এই আঘাটায় তুলে ছেড়ে দেবে নাকি? আর কিছু না হোক মনগড়াও দু-একটা বিস্ময়ের নমুনা—

শৈলেন সিগারেটের ধুঁয়া ছাড়িয়া বলিল, প্রথম বিস্ময় হল, এই রুক্ষ প্রাকৃতিক দৃশ্য থেকে এক সময় দৃষ্টিটা কাছে ফিরিয়ে নিয়ে এসে দেখি আমি সঙ্গীহীন। 

সকলেই একসঙ্গে বলিয়া উঠিল, আশ্চর্য!― সে কী! 

শৈলেন বলিল, অবস্থাগতিকে বোধ হয় স্মৃতিবিভ্রম ঘটে থাকবে, তাই আমার যা তখন সব চেয়ে আশ্চর্য বলে মনে হয়েছিল তা এই যে, আমি কী করে ভাবলাম যে আমার একজন সঙ্গী ছিল? ছিল না তো কেউ। গভীর নিদ্রার পর ক্লান্তির মতো আমার সমস্ত শরীর মন থেকে যাত্রাপথের যা কিছু সবই যেন মুছে গিয়ে খুব অস্পষ্ট একটা স্মৃতিমাত্র অবশেষ রইল। মনে স্পষ্ট শুধু এই রইল যে, আমি এখানে রয়েছি। ভয়ের বদলে একটা পুলক-রোমাঞ্চ আমার শরীরে ঢেউয়ের পর ঢেউ তুলে আমায় কোন এক ঊর্ধ্বলোকে যেন তুলে ধরলে। বেশ বুঝলাম, এইবার পট উঠবে। সেই সুরের তরঙ্গ, সেই শত পুষ্পসারের গন্ধ আরও স্পষ্ট হয়ে উঠবে। তাদের উৎসের সন্ধানে আমি সব শক্তিকে নিয়োগ করে দিলাম। জ্যোৎস্না-পক্ষ অনেক দিন থেকেই চলছিল, সেই শুকনো মাটির ঢেউ ভাঙতে ভাঙতে আমি এগিয়ে চললাম, এইটুকু জ্ঞান আছে—ক্রমাগত নেমেই চলেছি, তার পর আকাশে স্বচ্ছ চাঁদ যখন প্রায় পশ্চিমে হেলে পড়েছে, সেই সময় মনে হল, বাড়ি ছাড়ার পর থেকে আজ পর্যন্ত পথ চলার যত ক্লান্তি যেন আমার ঘাড়ে একসঙ্গে চেপে এল; একটা চাতালের ওপর দাঁড়িয়ে ছিলাম আমি, সেইখানেই অবসন্ন দেহে শুয়ে পড়লাম। 

—জানি না তার পরের দিনের কথা, কী আরও দু-দিন পরের কথা—যখন ঘুম ভাঙল দেখলাম, পূর্ব দিকে প্রথম উষার অস্পষ্ট আলো দেখা দিয়েছে। সেই ক্ষীণ আলোতেই সামনে যা দেখলাম তাতে বিস্ময়ে আনন্দে আমার সমস্ত মন আচ্ছন্ন হয়ে গেল। কেন্দ্র থেকে চারিদিকে প্রায় চার পাঁচ মাইলের দূরত্ব নিয়ে একটা বিশাল উপত্যকা। চারিদিকে পাহাড় ধাপের পর ধাপে উঠে গেছে—গোড়ায় ঘন জঙ্গলের আবরণের নীল, তার পর সেই নীল স্তরে স্তরে ফিকে হতে হতে শেষ রেখায় গিয়ে বরফের রূপালিতে মিলিয়ে গেছে। সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে যেমন সেই রূপালির গায়ে সোনার জলের প্রলেপ পড়ল, নিচের তরাইও অমনি ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়ে উঠতে লাগল। তার পর চোখের সামনে যা একে একে ফুটে উঠতে লাগল, তাকে দৃশ্য বলব, কী কাব্য বলব বুঝে উঠতে পারছি না। কাব্যই—উদীয়মান সূর্যের এক এক ঝলক কিরণে সেই কাব্যের এক-একটা পাতা যেন আমার চোখের সামনে উলটে যেতে লাগল। একটা ছোট গণ্ডির মধ্যে অত বিচিত্র রঙের সমারোহ আমি জীবনে কখনও দেখিনি। কত ফুল–রাঙা, হলদে, সাদা, নীল, বেগুনে—রঙের তার ইয়ত্তা নেই, স্তবকের পর স্তবক চলেছে তো চলেছেই। দূরে অস্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে, আবার সূর্যের বর্ধমান তেজ সেগুলোকে জাগিয়ে তুলেছে। কত বিচিত্র লতাগুল্ম, গাছপালা তাদের সবুজটা গাঢ় আর ফিকে রঙের উঁচু-নিচু পর্দায় যেন একটা অপূর্ব সংগীতের সৃষ্টি করেছে।…ভোরের প্রথম দিকেই এক সময় তরাইয়ের সুপ্তি চকিত করে কোথায় একটি মাত্র পাখির কণ্ঠস্বর উঠল। ঠিক যেন মনে হল, মূল গায়েন প্রথম কলিটা ধরিয়ে দিলে, তার পর একসঙ্গেই উত্তর-দক্ষিণ, পূর্ব-পশ্চিমের সমস্ত কোণকান থেকে হাজার হাজার পাখির কাকলি সমস্ত তরাই সুরে সুরে ভরাট করে দিয়ে পাহাড়ের অলিগলি বেয়ে বাইরে ছুটে চলল। একটা হাওয়া উঠেছিল, পাখিদের এই সমতানকে দুলিয়ে, খেলিয়ে, গাছে গাছে রঙের ঢেউ তুলে, একটা অদৃশ্য স্রোতের মতো পাহাড়ের দেয়ালে দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে ঘুরতে লাগল। সবার ওপর সেই মিষ্ট গন্ধ—অপূর্ব, কল্পনা করা যায় না যে একই বায়ুস্তরে একই সময়ে এত বিচিত্র গন্ধ ঠাসাঠাসি করে থাকতে পারে, সবুজটাকে সুর বলেছি, এ হেন আর সূক্ষ্মতর এক সংগীত।… বিস্ময়ের মধ্যেই একবার মনে পড়ল, যত দিন চলেছি তাতে তো এটা ভরা বসন্তই হওয়া উচিত, ফাল্গুনের শেষ কী চৈত্রের আরম্ভ; কিন্তু যত বসন্ত কি হিমালয়ের এই একটি তরাইয়ের মধ্যে গাদাগাদি করে আসতে হয়! আর এ কী হিমালয়? নাগরাজের সে পৌরুষ গাম্ভীর্য কোথায়? এতটা পথ এলাম, এ হালকা রূপ তো কোথাও দেখিনি এ যেন এক সুরনর্তকী তার হাস্যেলাস্যে —সাজসজ্জায়, বিলাস-বিভ্রমে ধ্যানমগ্ন যোগিবরের— 

—বেশ মনে পড়ে, যখন চিন্তার ঠিক এই জায়গাটিতে, আমার দৃষ্টি হঠাৎ সামনের একটা দৃশ্যের ওপর আটকে গিয়ে আমি নিশ্চল স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। 

—বহুদূরে তরাইয়ের পশ্চিম দিকে, উঁচু একটা চাতালের ওপর পূর্বাস্য হয়ে ধ্যানরত এক বিরাট মূর্তি। তাঁর পদ্মাসনবদ্ধ উন্নতশরীরের ওপরের দিকটা আচ্ছন্ন করে দীর্ঘ জটাভার, বায়ুচালিত লতার মতোই ফণীর দল তাঁর বিরাট শরীরের ওপর মসৃণ গতিতে চলে বেড়াচ্ছে; এক এক সময় যেন শত শত ক্রুদ্ধ ফণায় উচ্ছ্বসিত— সূর্যের কিরণে সমস্ত দেহ উজ্জ্বল শ্বেতাভ–এমন ভাবে কিরণ-পুঞ্জ এসে পড়েছে যে, একটু বেশিক্ষণ দৃষ্টিটাকে ধরে রাখলেই মনে হয় যেন ধাঁধা লেগে গেল। 

—আমি এক মুহূর্তেই বুঝে গেলাম, ব্যাপারটা কী। আমার সমস্ত মেরুদণ্ডের মধ্যে দিয়ে একটা বিদ্যুতের প্রবাহ খেলে গেল। তারপরে আমার যে অভিজ্ঞতা, সেটা চৈতন্যের কোন স্তরের তা আমি ঠিক করে বলতে পারি না। আমার দুদিন থেকে উপোস যাচ্ছিল—এক পাতার রস খাওয়া ছাড়া সেই সমস্ত দিনটাও কিছু খাইনি। শুধু বসে বসে অপলক নেত্রে দেখে গেছি—জেগে, কী তন্দ্রায়, কী গাঢ় ঘুমের স্বপ্নে, কী মনের আরও গভীরতম কোনও অজ্ঞাত চেতনার স্তরে, কিছুই বলতে পারব না। শুধু দেখলাম, দিন আর একটু অগ্রসর হতে নটরাজের নাট্যশালার আর একটা পট উঠল। সেই বসন্ত, যার কাছাকাছিও কিছু একটা কেউ পৃথিবীতে কখনও দেখেনি, সেটা রূপে, শব্দে, গন্ধে আরও যেন শতগুণ মন্দির হয়ে উঠল, ক্রমে নেশার মতো একটা অনুভূতি সমস্ত ইন্দ্রিয়কে অবশ করে ফেলতে লাগল—মনে হতে লাগল, এই বসন্তই সত্য আর সব কিছু মিথ্যা, মনের শত নিষ্ঠা দিয়ে জীবনে যা-কিছু অর্জন করেছি সবই যেন অক্লেশে ফাল্গুনের এই জ্বলন্ত শিখায় আহুতি দেওয়া যায়। সব সাধনার, সব তপস্যার—সেই যেন চরম সার্থকতা। চিন্তার মধ্যেই আর একটা আশ্চর্য ব্যাপার ঘটল। পুবের পাহাড়ের সোনা-রূপার ওপর দিয়ে সূর্যের যে কিরণ এসে পড়েছিল, সেইগুলোই বিভিন্ন ভাবে প্রতিফলিত হওয়ার জন্যেই হোক বা আমার দৃষ্টিবিভ্রম হোক, অথবা দুটোর মিলিত পরিণতিই হোক, এক সময় মনে হল ঊর্ধ্বে কোথা থেকে আলোর পথ বেয়ে কারা সব নেমে এসে সেই তপস্যাদেবীর চারিদিকটা ফেললে ঘিরে, আর সঙ্গে সঙ্গে আরম্ভ হল তাদের বিলাসোচ্ছল নৃত্য। যা ছিল পাখিদের কাকলি মাত্র, সুরে সুরে ঘনীভূত হয়ে তারই একটা অংশ যেন এক অপার্থিব সংগীতে রূপান্তরিত হয়ে উঠল। সব চেয়ে আশ্চর্য এই যে, আয়োজনের এই পূর্ণতার মধ্যেও কোথায় একটা কী অভাবের সুর ঘনিয়ে উঠতে লাগল,—একটা অব্যক্ত যাতনা, একটা চাপা হাহাকার। বহুক্ষণ ধরে চলল, আমারও মাথার মধ্যে একটা ঘূর্ণি জেগে উঠছে। দিন বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে, আলো উজ্জ্বলতর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রঙের রাশি হয়ে উঠছে আরও তীক্ষ্ণ যেন তরাইয়ের শেষ পুষ্পকলিটি পর্যন্ত কীসের তাড়ায় তাড়াতাড়ি ফুটে উঠছে, সংগীত হয়ে উঠছে আরও উচ্ছল হওয়া মদিরতায় আরও বিহ্বল—বেশ বোঝা যাচ্ছে সবগুলোই একটা ক্লাইম্যাক্সের দিকে মত্ত গতিতে এগিয়ে চলেছে,—লয় ক্রমশই দ্রুত করতে করতে সংগীত যেমন শেষতম সমের পানে ছুটে চলে। 

—তার পর, দুপুরের একটু পরেই এই রহস্যময় মাদকতা যখন শেষ সীমায়, হঠাৎ যোগীর ধ্যানভঙ্গ হল। সব গেল বদলে, বাতাসের গতিটা পর্যন্ত। এতক্ষণ ছিল দক্ষিণপ্রবাহী, হঠাৎ মূর্তির পেছন থেকে গিরিসংকট বেয়ে আগুনের হলকার মতো একটা বায়ুস্রোত ঢুকে পড়ল। একটা বিকট ঝম্-ঝম্-ঝম্ শব্দ, তার পরেই সেকেন্ড—কয়েকের জন্যে সমস্ত তরাইটা স্তব্ধ হয়ে গেল, সব যেন একটা উৎকট ভয়ে আঁতকে উঠছে। এর পরে যা আরম্ভ হল, তাকে মদনভস্মের পুনরভিনয় ভিন্ন আর কিছুই বলা চলে না। প্রথমেই সেই মুর্তিটা মাথার জটা ফুলিয়ে, গায়ের আভরণ ফণীদলকে ত্রস্ত করে উগ্র দৃষ্টিতে জেগে উঠল। আর, শুধু এক দক্ষিণ দিক ছাড়া সব দিক দিয়েই সেই রকম আগুনের হলকার মতো স্রোত ঢুকতে লাগল—পাহাড়ের অলি-গলি যেখানেই একটু পথ পেলে সেখান দিয়েই। ক্রমে চারিদিককার হাওয়ার সংঘর্ষে, তাণ্ডব নাচে ভূতনাথের সঙ্গীদলের মতোই, ঘূর্ণির পর ঘূর্ণি। সেও নিশ্চয় এই চৈতালি ঘূর্ণিই, কেন না, আগেই বলেছি, আমি যা দেখেছিলাম, সেটা ফাল্গুন-শেষের বা চৈত্র-আরম্ভের ব্যাপার; চৈতালি ঘূর্ণিই, কিন্তু তার কাছে এ ঘূর্ণি শিশুমাত্র। গাছ উপড়ে, ফুলে-ভরা গাছের ডালগুলোকে লুকতে লুকতে প্রলয় হুংকারে সমস্ত তরাইটা ওলটপালট করে ফিরতে লাগল। ধুলোয় দিগন্ত হয়ে এল অন্ধকার, ডাল-পাতার সংঘর্ষের পাহাড়ের কোলে দাবাগ্নি জ্বলে উঠে সেই ধুলোকে গৈরিকে রাঙিয়ে আগুনের মতোই উত্তপ্ত করে তুললে। সূর্যও হয়ে উঠল প্রলয়ের সূর্যের মতোই প্রখর। চারিদিক পাহাড়ে ঘেরা সেই প্রকাণ্ড তরাইয়ের গহ্বরে একটা হুংকার গর্জে ফিরতে লাগল— সংহার—সংহার—শুধুই সংহার। তার সঙ্গে মিশল ধ্বংসের হুতাশ, মৃত্যুর আর্তনাদ একটি দিন যার প্রভাত ছিল এত অপরূপ সুন্দর, অপরাহ্ণে সেটা অকস্মাৎ এত বিকট হয়ে উঠতে পারে কল্পানাও করা যায় না। 

—ক্রমে ঘূর্ণির ধুলো-বালির সঙ্গে পোড়া জঙ্গলের ছাই মিশে তরাইটাকে লুপ্ত করে সূর্যকে নিষ্প্রভ করে আনলে। মাতুনি আরও বেড়েই চলল। ঘূর্ণিতে গাছের জ্বলন্ত শাখা ঘোরাতে ঘোরাতে ধ্বংসের অট্টহাসের সঙ্গে চারিদিকে অগ্নিবৃষ্টি করে ঘুরতে লাগল, মাঝে মাঝে দৃশ্য আরও বীভৎস—শূন্যে জ্বলন্ত শাখার সঙ্গে ফুলের শাখার জড়াজড়ি—চাপা আর্তনাদের সঙ্গে ফুলের স্তবক দাউ দাউ করে জ্বলে উঠে মুহূর্তে এক মুঠো ছাই হয়ে ধুঁয়ায়-ভরা আকাশে মিলিয়ে গেল। বিনষ্টতপা শঙ্করের তৃতীয় নয়নের আগুন পঞ্চশরের শেষ চিহ্নটি পর্যন্ত ভস্মীভূত না করে তৃপ্ত হবে না। 

—কখন সূর্যাস্ত হল বোঝা গেল না, ধুলো আর ধোঁয়ার সঙ্গে কখন যে মেঘ এসে মিশে গেল তার টের পাইনি। এক সময় বৃষ্টি নামল—-বোধ হয় সন্ধ্যার কিছুক্ষণ পরেই। 

শৈলেন চুপ করিল। আর তিন জনেও খানিকক্ষণ চুপ করিয়াই রহিল; তাহার পর অক্ষয় একটা দীর্ঘশ্বাস মোচন করিয়া বলিল, আশ্চর্য! 

শৈলেন বাহিরের দিকে চাহিয়াছিল, তাহার পানে দৃষ্টি ফিরাইয়া প্রশ্ন করিল, কোনটে? 

অক্ষয় উত্তর করিল, কোনটে নয়? সেই মঠধারী; তার আবির্ভাব, তিরোভাব— দুই-ই। সেই ধ্যানমগ্ন বিরাট মূর্তি, যা শেষে অমন করে প্রলয়ে মেতে উঠল— 

অশ্বিনী কথাটা কাড়িয়া লইয়া বলিল, এমন কি সেই খণ্ড প্রলয়ের মধ্যেও তোমার অক্ষত থাকাটা পর্যন্ত— 

শৈলেন বলিল, তোমরা যে অর্থে আশ্চর্য বলছ তার কিছুই নয়, তবে অসাধারণ বটে, বিশেষ করে সমতলবাসী বাঙালির দৃষ্টিতে। রাতটা আমি সেইখানেই কাটালাম আশ্রয় খোঁজাখুঁজি করবার ইচ্ছা বা উৎসাহ কিছুই ছিল না। সকালে পিছন দিকের একটা সংকীর্ণ পথ দিয়ে নেমে যখন তরাইয়ের কোলে এলাম, দেখি রং-বেরঙের কাপড়-পরা স্ত্রী-পুরুষের দল তরাই ছেড়ে ফিরে যাচ্ছে। এক নূতনতর কৌতূহলে নিজেকে পাহাড়ের আড়ালে রেখে রেখে আমি এগিয়ে গেলাম। দেখলাম অধিকাংশই সব যুবক আর যুবতী, ক্বচিৎ একআধটা প্রৌঢ়, বৃদ্ধ নেই—একটু তিব্বতিঘেঁষা চেহারা হলেও সব অপূর্ব সুন্দর। আর দেখলাম সকলেই সেই মহাশ্বশানের এক-এক মুঠো ছাই সংগ্রহ করে নিয়ে যাচ্ছে। 

তারাপদ প্রশ্ন করিল, ছাই! 

শৈলেন বলিল, ছাই। বুঝতে পারছ না? আমাদের দেশের দোলপর্বের ঠিক বিপরীত একটা পর্ব, একটা বাৎসরিক অনুষ্ঠান; যে মদন নিত্যই যুব হৃদয়ে পঞ্চশরের আগুন জ্বালছে, তার বিরুদ্ধে শঙ্করের রোষাগ্নিপূত রক্ষা-কবচ। 

—তারাও সবাই অক্ষত দেখে আমি একবার চারিদিকে চেয়ে দেখলাম। দেখি, এই বিরাট নাট্যশালার একটা অডিটোরিয়াম বা প্রেক্ষাগৃহ আছে—প্রেক্ষাপ্রাঙ্গণ বললে আরও ঠিক হয়। তার অসাধারণত্ব এইখানে যে সেটা কলকাতা বা অন্য কোনও জায়গার একটা সাধারণ অডিটোরিয়ামেরই মতন। রুক্ষ, কঠিন হয়ে-যাওয়া গলা পাথরের পাহাড়টা সিঁড়ির মতো থাকে থাকে ওপর দিকে উঠে গেছে, মাঝে মাঝে কতটা ব্যালকনির মতোনই এক একটা অংশ সামনের দিকে ঠেলে এসেছে। তার ওপর তাকলে নিচের ধাপগুলো চোখের আড়ালে পড়ে যায়। বুঝলাম, আমি খুব উঁচুতে এই রকম একটা ব্যালকনিতে আশ্রয় পেয়েছিলাম। আমার বা আমাদের গায়ে যে আঁচড় লাগেনি, তার কারণ আগেই বলেছি—ঘূর্ণিগুলো এক দক্ষিণ দিকটা ছেড়ে আর সব দিক দিয়েই এসেছিল—স্বভাবত ধ্বংসলীলাটাও অনুষ্ঠিত হয়েছিল এই দিকটা বাদ দিয়েই। সেটার মধ্যে আশ্চর্য কথা তো দূরে থাক, অসাধারণত্বেরও কিছু নেই—নিতান্ত ভৌগোলিক ব্যাপার—হিমালয় এবং তিব্বতের সংস্থান আর আদিম ইতিহাসটা জানলেই সবটা পরিষ্কার হয়ে যাবে; একটু পরে বুঝিয়ে দিচ্ছি। এখন শুধু জেনে রাখো যে, আমি যেখানটায় গিয়ে পৌঁছেছিলাম সেটা হিমালয়ের শেষ প্রান্ত।

—এবার তোমার দ্বিতীয় আশ্চর্যের কথা। তরাই যাত্রীশূন্য হলে সেই মূর্তির দিকে এগুতে আরম্ভ করলাম— 

অক্ষয় বিস্মিত হইয়া প্রশ্ন করিল, মূর্তি ছিল তখনও? 

শৈলেন উত্তর করিল, প্রায় দেখা যায় পাহাড়ের গা থেকে একটা অংশ ঠেলে এসে একটা জীব, জন্তু বা মানুষের আকারে দাঁড়িয়ে বা বসে থাকে। কত যুগ ধরে উত্তরায়ণের সঙ্গে তিব্বতের হাওয়া তেতে উঠতে যে ঘূর্ণির সৃষ্টি হয়ে এসেছে, সেই সব ঘূর্ণি বালির উকো দিয়ে এই রকম একটা ঠেলে আসা পাথরের গায়ে ঘাঁজঘোজ তৈয়ের করে একটা আসনবদ্ধ মানুষের মূর্তি সৃষ্টি করে ফেলেছে। পাহাড় অঞ্চলে খুবই সাধারণ একটা দৃশ্য—বিশেষ যেখানে ঝড়ের প্রাবল্য আছে। সমস্ত বৎসর ধরে এই মূর্তির কোণ-কানে কোনও বিচিত্র রঙের লতাপাতা জন্মে সমস্ত মূর্তিটাকে— 

অক্ষয় একটু নিরাশ হইয়া বলিল, এই পর্যন্ত থাক। 

তারাপদ, এমন কি অশ্বিনীর মতো অবিশ্বাসীও এই বিরতিতে আপত্তি করিল না। তিনজনেই বাইরের তপ্ত প্রকৃতির পানে একদৃষ্টে চাহিয়া রহিল। যেন অন্তরে যে সুরের প্রবাহ, তাহাকে নষ্ট না হইতে দিয়া বাহিরে তাহার সংগত খুঁজিতেছে। 

শুধু শৈলেনের মুখেই একটা মৃদুহাস্যের জের কোথায় যেন লাগিয়া রহিল। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *