চেতাবনি
কিছুদিন থেকে লক্ষ করছি রাষ্ট্রের ভার যাঁদের উপর বর্তেছে তাঁরা তাঁদের ব্যক্তিগত বা গোষ্ঠীগত ধর্মানুষ্ঠানকে রাষ্ট্রের ব্যাপার করে তুলতে ব্যস্ত। গাছ লাগানো হবে, তার একটা গালভরা সংস্কৃত নামকরণ হল বনমহোৎসব। গাছ থেকে বন হতে বিশ বছর দেরি, অথচ মহোৎসবটি এখন থেকে সেরে রাখতে হবে। যেমন পরীক্ষা পাশ করার আগেই সিদ্ধিমহোৎসব। তারজন্যে পুরোহিত ডাকো, মাটিতে বসো, মন্ত্র পড়ো, দক্ষিণা দাও, প্রণাম করো। কুম্ভমেলা হচ্ছে, পুণ্য অর্জন করতে হবে; তার জন্যে পান্ডা পাকড়াও, গঙ্গায় ডুব দাও, দক্ষিণা দাও, প্রণাম করো।
এই যদি ব্যক্তি বা গোষ্ঠীবিশেষের ধর্মবিশ্বাস হয় তাহলে অপরের বলবার কিছু নেই। কিন্তু এখানে দুটি ভুল হচ্ছে। এক, যে টাকাটা খরচ হচ্ছে সেটা আসছে সমষ্টির তহবিল থেকে। সমষ্টির তহবিলে ট্যাক্সো জুগিয়েছে অনেক অজ্ঞেয়বাদী বা নাস্তিক, অনেক জড়বাদী বা নিরাকারবাদী, অনেক পুরোহিতবিরোধী বা ব্রাহ্মণপ্রাধান্যবিরোধী, অনেক সংস্কৃতবিরোধী বা মন্ত্রবিরোধী। এরাও হিন্দু। এ ছাড়া আর যারা ট্যাক্সো জুগিয়েছে তাদের অনেকে আদিবাসী, অনেকে খ্রিস্টান, পারসি বা মুসলমান, অনেকে বৌদ্ধ বা জৈন। এদের সংখ্যা কম বলে যে মূল্য কম তা নয়। যুদ্ধবিগ্রহের দিন যখন জয়-পরাজয় সমান অনিশ্চিত তখন দু-চার হাজার লোক এদিক থেকে ওদিকে গেলেই পরাজয় অবশ্যম্ভাবী। সেইজন্যে একটি লোককেও তুচ্ছতাচ্ছিল্য করতে নেই। তাদের রক্ত-জল-করা কড়ি তোমার হাতে পড়েছে বলে তুমি তোমার দেবতাকে বা তোমার পুরোহিতকে বা তোমার সম্প্রদায়কে উৎসর্গ করবে এ কখনো ন্যায়নীতি হতে পারে না। এখানে ভোটের জোর খাটে না।
দুই, রাষ্ট্রের কর্তা যাঁরা হবেন তাঁরা এক হিসেবে প্রতীক স্বরূপ। রাষ্ট্রীয় পতাকার মতোই তাঁদের প্রতীক সত্তা। তাঁদের মাথা যদি মাটিতে গড়ায় বা পায়ে ঠেকানো হয় তাহলে দেশসুদ্ধু মানুষের মাথা হেঁট হয়—ভারতের পতাকা মাটিতে গড়ালে বা পায়ে ঠেকালে যেমন হয়। কর্তারা যখন গঙ্গাস্নানে যান তখন তাঁদের সঙ্গে বহু লোকলশকর যায়। এঁরা রাষ্ট্রের কর্মচারী। বলতে গেলে রাষ্ট্রই তাঁদের সঙ্গে গঙ্গাযাত্রা করে। আমাদের এটা নবীন রাষ্ট্র। এখনও এর গঙ্গাযাত্রার বয়স হয়নি। একে অকালে গঙ্গাযাত্রায় পাঠালে এর ভবিষ্যৎ আর কদ্দিন! এটা তো আমাদের সেক্যুলার স্টেটের মূলনীতির সঙ্গে মেলে না। হিন্দু রাষ্ট্রের মূলনীতির সঙ্গে মিলতে পারে, কিন্তু ভারত তো হিন্দু রাষ্ট্র নয়। গোপনে গোপনে তা-ই যদি হয়ে থাকে তাহলে সংবিধান সংশোধন করা হোক। এখানে বলে রাখতে চাই যে, হিন্দু রাষ্ট্র কস্মিনকালে প্রজাতন্ত্রী ছিল না। যখন প্রজাতন্ত্রী ছিল তখন সেক্যুলার স্টেটই ছিল, হিন্দু রাষ্ট্র ছিল না। প্রজাতন্ত্র বহু দেশে ও বহু যুগে প্রবর্তিত হয়েছে। কোথাও তা ধর্মের ভেক ধারণ করেনি। যখনই করতে গেছে তখনই মরেছে। তখন আর তা প্রজাতন্ত্র নয়, অভিজাততন্ত্র, তার থেকে আবার রাজতন্ত্র। অর্থাৎ পুনর্মূষিক।
ধর্ম চিরকাল থাকবেই, ধর্ম না হলে মানুষের চলে না। রাষ্ট্র চিরকাল থাকবে, যদি-না মানুষের জীবন বিকেন্দ্রীকৃত হয়। ধর্মের সঙ্গে আমাদের ঝগড়া নেই, আমরা বরং ধর্মের ঝগড়া চুকিয়ে দিতে চাই। সে-অধ্যায় শেষ হলেই আমরা বাঁচি। আমরা বলি, ধর্মও থাকুক, রাষ্ট্রও থাকুক, কিন্তু জোড়া লেগে ধর্মরাষ্ট্র না হোক। বকও ভালো, কচ্ছপও ভালো, কিন্তু সুকুমার রায়ের ছড়ার সেই ‘বকচ্ছপ’ ভালো নয়। সেক্যুলার স্টেট সকলের কাছে সমান আনুগত্য দাবি করে, তাই সকলের প্রতি তার সমান অপক্ষপাত। হিন্দু রাষ্ট্র সকলের প্রতি সমান অপক্ষপাতী হতে পারে না, কাজেই তার প্রতি সকলের সমান আনুগত্য সম্ভব নয়। আনুগত্যের প্রয়োজনই নির্দেশ করে দিচ্ছে অপক্ষপাতের প্রয়োজন। আমাদের কর্তাদের ব্যবহারে একচুল পক্ষপাত এসে পড়লেই আমাদের জনসাধারণের আনুগত্যে চিড় ধরবে। তাতে কর্তাদের কী! তাঁরা তো গঙ্গার দিকে পা বাড়িয়েই বসে আছেন। কিন্তু ভুগবে ভবিষ্যৎ বংশ। সেই ভবিষ্যতের মুখ চেয়েই বর্তমানকে সতর্ক হতে হবে। বর্তমান যদি অতীতের দিকে মুখ ফিরিয়ে সংস্কৃত মন্ত্র পড়তে থাকে তাহলে কে জানে হয়তো ভবিষ্যৎ একদিন বর্তমানের দিকে মুখ ফিরিয়ে রুশ মন্ত্র বা চীন মন্ত্র পাঠ করবে। সেও তো একপ্রকার শাস্ত্র।
ধর্ম নিজের পায়ে হাঁটতে শিখুক। ঘোড়ার পিঠে চড়া ছেড়ে দিক। ঘোড়ার পিঠ থেকে তাকে নামতে হবেই। কেউ-না-কেউ তাকে নামাবে। আমরা ধর্মের শুভানুধ্যায়ী বলেই তাকে পরামর্শ দিই—বাপু তুমি মন্দিরে থাকো, মসজিদে থাকো, গির্জায় থাকো, গৃহে থাকো, বেদিতে থাকো, মর্মে থাকো কিন্তু রাজদ্বারে যেয়ো না। রাজপুরুষদের মাথায় উঠো না। রাজকোষের অর্থ নিয়ো না। আজ নাহয় ওরা তোমার দৌলতে জনপ্রিয় হবে, জনতার ভোট পাবে, কিংবা উপরওয়ালার নেকনজর; কিন্তু কাল যখন ওরা তলিয়ে যাবে তখন তুমিও তো তলিয়ে যাবে ওদের সঙ্গে। অতএব সময় থাকতে নিরস্ত হও। তুমিও বাঁচবে, ওরাও বাঁচবে। আর নয়তো তোমার ভক্তরাই তোমাকে সাবাড় করবে। হিন্দু-মুসলমানে ওই যে খুনোখুনিটা হল তাতে তুমি হিন্দুত্ব আর তুমি ইসলাম তুমিও তো ঘায়েল হয়ে রয়েছ। মধ্যযুগের ইউরোপে তুমি খ্রিস্টধর্ম তোমার কী দশা হল মনে আছে? ক্যাথলিকে প্রোটেস্টান্টে হানাহানির ফলে তোমারও বলহানি হল। তোমার যারা শুভানুধ্যায়ী তারা তোমাকে রাষ্ট্রের পিঠ থেকে মানে মানে নেমে আসতে প্রবর্তনা দেয়। যেখানে যেখানে তুমি তা করলে সেখানে সেখানে তুমিও বাঁচলে, রাষ্ট্রও বাঁচল। ভলতেয়ারের চেতাবনি শুনলে ফরাসি বিপ্লবের প্রয়োজন হত না। ফরাসিদের শিক্ষা হয়েছে, তাদের রাষ্ট্র সত্যি সত্যি সেক্যুলার। ইংল্যাণ্ডে ক্রমওয়েলের প্রজাতন্ত্র বেশিদিন টিকল না বটে, কিন্তু রাজতন্ত্রও সাবধান হল সেই থেকে। সেখানকার রাষ্ট্র কাগজে-কলমে নয় কিন্তু ভিতরে ভিতরে সেক্যুলার; রাজা না থাকলে কাগজে-কলমেও হত। রাজার খাতিরে কতকটা আপোশ করতে হয়েছে অতীতের সঙ্গে, ঐতিহ্যের সঙ্গে। আমেরিকায় তার দরকার হয়নি। স্বাধীনতা অর্জনের পর আমেরিকা এক কলমের খোঁচায় রাজতন্ত্র খারিজ করে, সঙ্গে সঙ্গে রাজধর্মকে। সেখানে রাষ্ট্রধর্ম বলে কিছু নেই। নেই ধর্মরাষ্ট্র। এতে ধর্মও বাঁচল, রাষ্ট্রও বাঁচল। নইলে জড়াজড়ি করে দুজনেই ডুবত। যেমন ফরাসি বিপ্লবের সময় ফ্রান্সে। রুশ বিপ্লবের সময় রুশ দেশে।
সেক্যুলার স্টেট যেমন একহাতে রাষ্ট্রকে উদ্ধার করে তেমনি আর একহাতে ধর্মকে। আমরা যারা সেক্যুলার স্টেটকে ‘বকচ্ছপ’ হতে দেখলে দুঃখ পাই, আমরাই বকের বন্ধু তথা কচ্ছপের। বকও ভালো, কচ্ছপও ভালো, কিন্তু ‘বকচ্ছপ’ ভালো নয়।