চেতলার কাছে – লীলা মজুমদার
চেতলা, কালীঘাট, আদিগঙ্গা ইত্যাদি যতই পবিত্র স্থান হোক না কেন, ও-সব জায়গা মোটেই ভালো না৷ আর লোকের মুখে মুখে কী সব অদ্ভুত গল্পই যে শোনা যায়, তার লেখাজোখা নেই, তাছাড়া মশা-মাছি তো আছেই৷ চিলতে চিলতে সব গলি, তাতে মান্ধাতার আমলে তৈরি ঝুরঝুরে ঘর বাড়ি৷ তায় আবার সব বাড়ি থেকে সব বাড়ির উঠোন দেখা যায়৷ একফালি উঠোনের মধ্যে এই বড় বড় সব গাছ,—তালগাছ, আমগাছ, বটগাছ—তাদের ডালপালা বেয়ে, ঝুরি ধরে ঝুলে, যে কোনো বাড়ি থেকে যে কোনো বাড়িতে চলে যাওয়া যায়৷ বিপদ বুঝলে একটা হাঁক দিলেই হল৷ সবাই সাত পুরুষ ধরে সবার চেনা৷ পুরনো সব ঝগড়াও আছে, তার কারণ নিজেরাই ভুলে গেছে, তবু এখনো কথাবার্তা বন্ধ৷ মুখ দেখা আর কী করে বন্ধ করে, নড়বড়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ালেই সব বাড়ি থেকে সব বাড়ির রান্নাঘরের ভিতর পর্যন্ত দেখা যায়, কার বাড়িতে কী রান্না হচ্ছে, সঙ্গে সঙ্গে সবাই চোর ছ্যাঁচড় খুনে জানতে পারবে৷ একটা টিকটিকি লুকোবার কোথাও জায়গা নেই, দুষ্কৃতকারীদের কথা তো ছেড়েই দিলাম৷ কার ঘরে চুরি করার মতো কী আছে এবং কোথায় আছে তাও সবাই জানে৷ নেইও অবিশ্যি কারো কিছু৷ সেদিক দিয়ে জায়গাটাকে চোরেদের গোবি মরুভূমিও বলা যায়৷
আমার বন্ধু বটুর বড় কাকা ওখানকার থানার মেজ দারোগা৷ তাছাড়া ওদের সাত পুরুষের বাড়িও ওখানে৷ নাকি বাড়ি হবার সময় ক্লাইব জন্মায়নি৷ বটু জায়গাটার নাম দিয়েছে মিসার হতাশা৷ শুনে বড় কাকা খুবই মুষড়ে পড়েছেন, দুষ্কৃতকারীরাই যদি একটু সুযোগ না পেল, তাহলে ওঁর হেড আপিসে উন্নতি হয় কি করে? অবিশ্যি ও সব সাধারণ জিনিসের চাইতেও অন্য এবং আরো ভয়ের জিনিস আছে, ঐ তিনটে পাড়াসুদ্ধ সবাই সন্ধ্যে হতেই যার ভয়ে জুজু৷ অধিকাংশই ওপরহাতে এক-গোছা সঙ্কটতারিণী মাদুলি বেঁধে নিরাপত্তা রক্ষা করেন৷ কারণ পুলিশে আর কী-ই বা করতে পারে৷
বটুদের উঠোনের আম পাকলে বটু আমাকে তিন দিনের জন্য ধরে নিয়ে গেছিল৷ ঐ তিনদিনে আমি যতগুলো সত্যিকার ভূতের গল্প শুনলাম, সারা জীবন ধরে অত শুনিনি৷ সবাই সবার পাশের বাড়িতে অশরীরীদের দেখে৷
কী বড় বড় সবুজ রঙের চিংড়ি মাছ নিয়ে একটা লোক বিক্রি করতে এল৷ চিলেকোঠায় পুজো করতে বসে তাকে দেখেই বটুর ছোট ঠাকুমা চ্যাঁচাতে লাগলেন, ‘‘না বাছা, ও মাছ কেউ খাবে না৷ তুমি অন্য জায়গায় দেখ৷
বটু তো চটে কাঁই, কী ভালো ভালো চিংড়ি মাছ! ছোট ঠাকুমা নেমে এসে বললেন, ‘‘ব্যাস মাছ দেখেছিস তো অমনি হয়ে গেল! আরে ওকি সত্যিকার মাছ? অতবড় চিংড়ি কখনো চার টাকায় দেয় কেউ? আবার বলছে দাম পরে নেবে৷’’
বটু বললে, ‘‘আহা, বলল যে বিক্রি না হলে পচে যাবে…’’
কাষ্ঠ হেসে ছোট ঠাকুমা বললেন, ‘‘তুইও যেমন! তাছাড়া ওগুলো মাছও নয়, ঐ জেলের পো-ও মানুষ নয়, সব ইয়ে…’’ এই বলে ছোট ঠাকুমা জল খেতে বসলেন৷
বটুও বলল, ‘‘তা সত্যিও হতে পারে, মুখটা কেমন মিচকে মতো দেখলি না?’’
আমি বললাম, ‘‘যাঃ! ভূতের হাঁটু উল্টোদিকে থাকে, আর ওদের ছায়া পড়ে না৷’’
ছোট ঠাকুমা শুনতে পেয়ে ডেকে বললেন, ‘‘ইদিকে এখনো রোদ আসেনি বাবা, ছায়া দেখবে কী করে? সে যাই হোক, আদিগঙ্গার বটগাছের তলায় যেন কখনো যাসনি৷ জায়গাটা ভালো নয়৷’’
গিজগিজে সব বাড়ি, বটগাছতলায় যেতে হলে সারকাস করতে হয়৷ অথচ সেখানে নাকি কারা কাপড় কাচে, ঝগড়া করে, মাছ ধরে৷
ততক্ষণে সূর্য ডুবে গেছে, সামনের দোতলার লটঘটে বারান্দায় দুজনে গল্প করছি৷ ছপ করে কী একটা পায়ের কাছে পড়ল৷ আর সে কী সুগন্ধ ভুরভুর করতে লাগল৷ তুলে দেখি কলাপাতায় মোড়া বড় বড় চিংড়িমাছ ভাজা৷ নীচের দিকে চেয়ে দেখি, সেই মিচকে লোকটা মিটমিট করে হাসছে৷ মোটা মোটা কান, নাকে মস্ত আঁচিল৷ একতলায় বৈঠকখানা থেকে বটুর পিসেমশাই ডেকে বললেন, ‘‘কে? কে ওখানে?’’ সঙ্গে সঙ্গে কেউ কোথাও নেই৷ খেয়ে ফেললাম দুজনে মিলে সবকটা চিংড়িমাছ৷ যদি ওগুলো চিংড়িমাছ নাও হয়, তবু খেতে বেজায় ভালো৷
ভিতর দিকের উঠোনে আমগাছের গায়ে লাগা বুড়ো তালগাছ৷ ছোট ঠাকুমা সাদা পাথরের রেকাবি করে খোয়া ক্ষীর, চিঁড়ের মোয়া আর বড় বড় মনাক্কা নিয়ে, তালগাছের কোটরে রেখে ভক্তিভরে গলায় কাপড় জড়িয়ে প্রণাম করলেন৷ ছোট ঠাকুমা চলে যেতেই বটু বলল, ‘‘ব্রহ্মদত্যিকে তোয়াজ করা হচ্ছে৷ তালগাছে সে বাস করে৷’’
আর কী বলতে যাচ্ছিল বটু, ছোট ঠাকুমা পিছন থেকে বললেন, ‘‘অমন অছেদ্দা করিসনে বাছা৷ উনি আমার অতিবৃদ্ধ প্রপিতামহের ছোট ভাই৷ চটিয়ে দিলে সব্বোনাশ করবেন৷ খুশি রাখলে আমাদের জন্য না করতে পারেন এমন জিনিস নেই৷ ঐ বিদ্যেবুদ্ধি নিয়ে বছরে বছরে পাশ করে যাচ্ছিস, সেটা কী করে সম্ভব সে কথা কখনো ভেবেছিস? হুঁ:!’’ এই বলে ছোট ঠাকুমা গীতা পড়তে ঘরে গেলেন৷ যাবার সময় আরো বলে গেলেন, ‘‘তোরা বিশ্বাস না করতে পারিস, কিন্তু রোজ উনি এই জিনিস গ্রহণ করেন, আর তার বদলে একটি পয়সা আশীর্বাদী—’’
আর বলা হল না, কারণ সেই সময় বড় কাকা বাড়ি এলেন৷
বড় কাকা খুব চটে ছিলেন৷ চা আর চিঁড়ের মোয়া খেতে খেতে বললেন, ‘‘এক্ষুনি আবার বেরোতে হবে৷ বাজারের লোকদের নালিশের জ্বালায় আর টেঁকা যাচ্ছে না৷ গোলাবাড়িতে রাতে তদন্তে যেতে হবে৷’’
তাই শুনে বড়কাকি এমনি চমকে গেলেন যে, হাতের দুধের হাতা থেকে অনেকখানি দুধ মাটিতে পড়ে গেল৷ চোখ গোল গোল করে ফ্যাকাশে মুখে বললেন, ‘‘কিন্তু—কিন্তু—’’
বড় কাকা কাষ্ঠ হাসলেন, ‘‘কিন্তু কিন্তু নয়৷ এর ওপর আমার প্রমোশন নির্ভর করছে৷ কোনো ভয় নেই, ছটা ষণ্ডা লোক সঙ্গে থাকবে৷ হয়তো কিছু পাওয়া যেতে পারে৷’’
বটার কাছে শুনলাম যে বাড়িটাতে একশো বছর কেউ থাকে না৷ বড়ই দুর্নাম৷ ওটা নাকি চোরাচালানকারীদের গুহ্য আড়ত৷ মাটির তলায় সুড়ঙ্গ আছে, বুড়িগঙ্গায় তার মুখ৷ অনেকে দেখেছে৷ সেই সুড়ঙ্গ দিয়ে সোনাদানা বে-আইনী জিনিস বস্তা বস্তা পাচার করা খুব শক্ত নয়৷ বাজারে নাকি ওদের চর ঘুরে বেড়ায়, কখনো জেলে সেজে, কখনো পুরুতঠাকুর সেজে৷ এটা ওটা কিনতে চায়, চা খেতে চায়, অচল পুরনো পয়সা দিয়ে দাম দিতে চায়৷ তা লোকে শুনবে কেন? দিয়েছে নালিশ করে৷ বড় কাকা বলেছিলেন, ‘‘লোকটাকে ধরা যায় না৷ ফুস-ফাস করে এখান দিয়ে ওখান গলে পালায়৷ কোনো দোকানদারের সঙ্গে ষড়ও থাকতে পারে৷ শুনেছি চেহারা দেখেই সন্দেহ হয়, কীরকম মিচকে মতো, মোটা মোটা কান, নাকের ডগায় আঁচিল!’’
শুনে আঁতকে উঠেছিলাম, বটা কনুইয়ের গুঁতো মেরে থামিয়ে দিয়েছিল৷ আটটা বাজতেই মহা ঘটা করে আটজন সশস্ত্র লোকজন নিয়ে বড় কাকা তদন্তে চলে গেলেন৷ ছোট ঠাকুমা তাঁর গলায় হলদে সুতো দিয়ে একটা বেলপাতা ঝুলিয়ে দিয়ে বললেন, ‘‘ব্যস, আর ভয় নেই৷ সেখনে গিয়ে কেউ কিছু দিলে খাসনে যেন৷ দুগগা দুগগা!’’ বড় কাকা চলে গেলে বললেন, ‘‘কামান দেগে হাওয়া ধরা৷ হুঁঃ!’’
আমরা ছাদে গিয়ে বুড়িগঙ্গায় জোয়ার আসা দেখতে লাগলাম৷ বটু বলল, ‘‘এ গোলাবাড়িটা আমার ঠাকুরদার অতিবৃদ্ধ প্রপিতামহের ছোট ভাই পেয়েছিল৷ ব্যাটা মহা লক্ষ্মীছাড়া ছিল লেখাপড়া শেখেনি, কাজকর্ম করত না, খালি মাছ ধরার বাই ছিল আর চীনে ব্যবসাদারদের কাছ থেকে চায়ের নেশা ধরেছিল৷ দুদিনে বাড়ির সব ঝাড়বাতি, আসবাবপত্র, রুপোর বাসান বেচেবুচে সাফ করে দিল৷ ওর বুড়ি মা নাকি খুচরা পয়সাকড়ি এমনি লুকিয়ে রেখে চোখ বুজেছিলেন যে ব্যাটা সে সব খুঁজেই পায়নি৷ এখনো নাকি খুঁজে বেড়ায়৷ তাই ও বাড়িতে কেউ রাত কাটায় না৷ সেইখানে গেছে বড় কাকা তদন্ত করতে৷ খুচরো টাকাকড়ির বাক্সটা পেলে মন্দ হয় না৷ আমরাই তো ওর ওয়ারিশ৷ সে ব্যাটা তো বিয়েই করেনি৷ নাকি বিশ্রী দেখতে ছিল, সুঁটকো, কালো, বড় বড় কান, চাকর চাকর চেহারা৷ গেঞ্জি গায়ে ঘাটে বসে অষ্টপ্রহর বুড়িগঙ্গায় মাছ ধরত—কে? কে ওখানে?’’
খচমচ করে তালগাছ থেকে আমগাছ থেকে নড়বড়ে বারান্দা কাঁপিয়ে মিচকে লোকটা হাসি হাসি মুখ করে উঠে এসে নাকের ফুটো ফুলিয়ে ফোঁস ফোঁস করে নিঃশ্বাস নিয়ে বলল, ‘‘চা-চা গন্ধ পাচ্ছি মনে হচ্ছে!’’
সত্যিই ছিল চা৷ দোকানের কেতলিতে একটু চা আর একটা মাটির ভাঁড়, বটু লুকিয়ে এনেছিল সামনের দোকান থেকে৷ নীচে নামতেও হয়নি, ওদের ছোকরা তেঁতুলগাছে চড়ে হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল, রোজকার মতো৷
চা পেয়ে লোকটা আহ্লাদে আটখানা, মিচকে মুখে যেন সাত ভাঁজ হয়ে গেল৷ বললাম, ‘‘পেঁয়াজি খাবে নাকি?’’
জিব কেটে বলল, ‘‘অ্যাঁ ছি ছি! ও নাম করবেন না৷ আমার বরাদ্দ রোজকার মতো খেয়েই এসেছি, চিঁড়ের মোয়া, খোয়া ক্ষীর, মেওয়া—’’
বটা আর আমি এ ওর দিকে তাকালাম, কিছু বললাম না৷ খাক না বেচারী৷
মিচকে লোকটি বলল, ‘‘বড়কর্তা আমাদের ওখানে এমন হাঁকডাক লাগিয়েছেন যে টিকতে না পেরে ওনার এখানে গা-ঢাকা দিতে এসেছি৷ দেখ দাদা, তালগাছের মুড়োয় তোমাদের জন্য একটা দ্রব্য রেখে গেলাম৷ আমি বাড়ি চলে যাচ্ছি৷ সেখানে মা অমৃতি বানায়৷’’
বটু ব্যস্ত হয়ে বলল, ‘‘কেন চলে যাবে? এখানে বুঝি খেতে পাও না?’’
ফিক করে হেসে মিচকে লোকটা বলল, ‘‘দুবেলা নৈবিদ্যি পাই, আবার কষ্ট কিসের? ঐ এল বলে! আমি উঠি! বলেই হাওয়া৷
নীচে বড় কাকাদের রাগ-রাগ গলার হাঁক-ডাক শোনা গেল৷ নিশ্চয় কিছু দুষ্কৃতকারীটারি ধরতে পারেন নি৷ সঙ্গে সঙ্গে আদ্যিকালের তালগাছটা হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ল৷ পোকা ধরা, পুরনো গুঁড়ি ভেঙেচুরে একাকার৷ তার মধ্যে দেখা গেল বেশ বড় একটা কাঠের হাতবাক্স, পুরনো টাকাকড়িতে তার অর্ধেক ভর্তি৷ আর চাঁচাপোঁছা নৈবেদ্যের রেকাবিটা তিন টুকরো হয়ে পড়ে আছে৷ বড় কাকার রাগ ঠাণ্ডা৷
পরদিন বড় কাকা বললেন, ‘‘আশ্চর্যের বিষয়, সুড়ঙ্গের মধ্যে একটা খোপে ঐ বাক্স রাখার স্পষ্ট দাগ দেখলাম৷ সেই বুড়ি ঠাকরুণ তাহলে বাউন্ডুলে ছেলের হাত থেকে ওটাকে বাঁচাবার জন্য এইখানে লুকিয়ে রেখেছিলেন৷ এটাও তো তাঁদেরই বাড়ি৷’’
ছোট ঠাকুমা শূন্যে নমস্কার করে বললেন, ‘‘কত বাঁচিয়েছিলেন সে তো বোঝাই যাচ্ছে৷ ও বটা, নিজে পড়িস দাদু, সে তো গেল৷’’ ফোঁত ফোঁত করে একটু কেঁদেও নিলেন৷ বড় কাকা তো অবাক!