চেতলায়

চেতলায়

চেতলা, কালীঘাট, আদিগঙ্গা যতই পবিত্র স্থান হোক-না-কেন, ও-সব জায়গা মোটে ভালো না। আর লোকের মুখে মুখে কী সব অদ্ভুত গল্পই যে শোনা যায় তার লেখাজোখা নেই। তা ছাড়া মশামাছি তো আছেই। চিলতে চিলতে সব গলি, তাতে মান্ধাতার আমলে তৈরি ঝুরঝুরে সব বাড়ি, তার আবার প্রায় সব বাড়ি থেকে সব বাড়ির উঠোন দেখা যায়। এক ফালি উঠোনের মধ্যে এই বড় বড় সব গাছ— তালগাছ, আমগাছ, বটগাছ; তাদের ডালপালা বেয়ে, ঝুরি ধরে ঝুলে যে কোনো বাড়ি থেকে যে-কোনো বাড়িতে চলে যাওয়া যায়। বিপদ বুঝলে একটা হাঁক দিলেই হল। সবাই সাত পুরুষ ধরে সবার চেনা, পুরোনো সব ঝগড়াও আছে, তার কারণগুলো নিজেরাই আবার ভুলে গেছে, তবু এখনো কথাবার্তা বন্ধ থাকে। মুখ-দেখা আর কী করে বন্ধ করে, নড়বড়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ালেই, সব বাড়ি থেকে সব বাড়ির রান্নাঘরের ভিতর পর্যন্ত দেখা যায়, কার বাড়িতে কী রান্না হচ্ছে, সঙ্গে সঙ্গে সবাই জানতে পারে। একটা টিকটিকি লুকোবার কোথাও জায়গা নেই, চোর-ছ্যাঁচোড়, খুনে দুষ্কৃতকারীদের কথা তো ছেড়েই দিলাম। কার ঘরে চুরি করার মতো কী আছে এবং কোথায় আছে তাও সবাই জানে; নেই-ও অবিশ্যি কারো কিছু। সেদিক দিয়ে জায়গাটাকে চোরদের গোবি মরুভূমিও বলা যায়।

আমার বন্ধু বটুর বড় কাকা ওখানকার থানার মেজো দারোগা। তা ছাড়া ওদের সাত পুরুষের বাড়িও ওখানে। নাকি বাড়ি হবার সময় ক্লাইভ জন্মায়নি৷ বটু জায়গাটার নাম দিয়েছে ‘মিসার হতাশা’। ওর বড় কাকাও কিছুটা মুষড়ে পড়েছেন, দুষ্কৃতকারীরাই যদি একটু সুযোগ না পেল তা হলে ওঁর হেড-অফিসে উন্নতি হয় কী করে? অবিশ্যি ও-সব সাধারণ জিনিসের চাইতেও অন্য এবং ভয়ের জিনিস আছে, ঐ তিনটে পাড়াসুদ্ধ সবাই সন্ধে হতেই যার ভয়ে জুজু। অধিকাংশই ওপর হাতে এক গোছা শঙ্কটতারিণী মাদুলী বেঁধে নিরাপত্তা রক্ষা করেন। কারণ পুলিশে আর কীই-বা করতে পারে?

বটুদের উঠোনের আম পাকলে বটু আমাকে তিন দিনের জন্য ধরে নিয়ে গেছিল। ঐ তিন দিনে আমি যতগুলো সত্যিকার ভূতের গল্প শুনলাম, সারা জীবন ধরে অত শুনিনি। সবাই সবার পাশের বাড়িতে অশরীরীদের দেখে। কী বড় বড় সবুজ রঙের চিংড়িমাছ নিয়ে কে বিক্রি করতে এল। চিলেকোঠায় পুজো করতে বসে তাকে দেখেই বটুর ছোট্‌-ঠাকুমা চাঁচাতে লাগলেন, “না বাছা, এখানে ও মাছ কেউ খাবে না। তুমি অন্য জায়গায় দেখ। বটু তো চটে কাঁই, কী ভালো ভালো চিংড়িমাছ। ছোট্‌-ঠাকুমা নেমে এসে বললেন, “ব্যাস মাছ দেখেছিস তো অমনি হয়ে গেল! আরে ওকি সত্যিকার মাছ? অত বড় চিংড়ি কখনো চার টাকায় দেয় কেউ? আবার বলছে পরে নেবে। বটু বলল, “আহা, বলল যে বিক্রি না হলে পচে যাবে!”

কাষ্ঠ হেসে ছোট্‌-ঠাকুমা বললেন, “তুইও যেমন। তা ছাড়া ওগুলো মাছও নয়, ওই জেলের পো-ও মানুষ নয়, সব ইয়ে।” এই বলে ছোট্‌-ঠাকুমা জল খেতে বসলেন। বটুও বলল, “তা সত্যিও হতে পারে, মুখটা কেমন কেমন মিচকে মতো দেখলি না।” আমি বললাম, “যাঃ! ভূতের হাঁটু উলটো দিকে থাকে আর ওদের ছায়া পড়ে না।” ছোট্‌-ঠাকুমা শুনতে পেয়ে ডেকে বললেন, “ইদিকে এখনো রোদ আসেনি বাবা, ছায়া দেখবি কী করে? সে যাই হোক, আদিগঙ্গার বটগাছের তলায় যেন কখনো যাসনে। জায়গাটা ভালো নয়।” গিজগিজে সব বাড়ি, বটগাছ তলায় যেতে হলে সারকাস করতে হয়। অথচ সেখানে নাকি কারা কাপড় কাচে, ঝগড়া করে, মাছ ধরে।

ততক্ষণে সূর্য ডুবে গেছে, সামনের দোতলার লটখটে বারান্দায় দু’জনে গল্প করছি। ছপ্‌ করে কী একটা পায়ের কাছে পড়ল। আর সে কী সুগন্ধ ভুর ভুর করতে লাগল। তুলে দেখি কলাপাতায় মোড়া বড় বড় চিংড়িমাছ ভাজা। নীচের দিকে চেয়ে দেখি সেই মিচকে লোকটা মিট্‌ মিট্‌ করে হাসছে। মোটা মোটা কান, নাকে মস্ত আঁচিল। একতলার বৈঠকখানা থেকে বটুর পিসেমশাই ডেকে বললেন, “কে, কে ওখানে?” সঙ্গে সঙ্গে কেউ কোত্থেও নেই। খেয়ে ফেললাম দুজনে মিলে সব কটা চিংড়ি মাছ। যদি ওগুলো চিংড়িমাছ না-ও হয় তবু খেতে বেজায় ভালো।

ভিতর দিকের উঠোনে আমগাছের গায়ে লাগা বুড়ো তালগাছ। ছোট্‌-ঠাকুমা সাদা পাথরের রেকাবি করে খোয়া ক্ষীর, চিঁড়ের মোয়া আর বড় বড় মনাক্কা নিয়ে, তালগাছের কোটরে রেখে, ভক্তিভরে গলায় কাপড় জড়িয়ে প্রণাম করলেন। ছোট্‌-ঠাকুমা চলে যেতেই বটু বলল, “ব্ৰহ্মদত্তিকে তোয়াজ করা হচ্ছে। তালগাছে সে বাস করে—” আরো কী বলতে যাচ্ছিল বটু, ছোট্‌-ঠাকুমা পিছন থেকে বললেন, “অমন অচ্ছ্রদ্ধা করিসনে, বটা। উনি আমার অতি-বৃদ্ধ-প্রপিতামহের ছোট ভাই। চটিয়ে দিলে সব্বনাশ করবেন, খুশি রাখলে আমাদের জন্য না করতে পারেন এমন জিনিস নেই। ঐ বিদ্যেবুদ্ধি নিয়ে যে বছরে বছরে পাশ করে যাচ্ছিস, সেটা কী করে সম্ভব সে কথা কখনো ভেবেছিস? হুঁঃ!” এই বলে ছোট্‌-ঠাকুমা গীতা পড়তে ঘরে গেলেন। যাবার সময় আরো বলে গেলেন, “তোরা বিশ্বাস না করতে পারিস, কিন্তু রোজ উনি এই জিনিস গ্রহণ করেন আর তার বদলে একটি আশীর্বাদী—” আর বলা হল না কারণ সেই সময় বড় কাকা বাড়ি এলেন।

বড় কাকা খুব চটে ছিলেন। চা আর চিঁড়ের মোয়া খেতে খেতে এক্ষুনি আবার বেরোতে হবে। বাজারের লোকদের নালিশের জ্বালায় বললেন, “আর টেকা যাচ্ছে না। গোল-বাড়িতে রাতে তদন্তে যেতে হবে।”

তাই শুনে বড় কাকি এমনি চমকে গেলেন যে হাতের দুধের হাতা থেকে অনেকখানি দুধ মাটিতে পড়ে গেল। চোখ গোল গোল করে ফ্যাকাশে মুখে বললেন, “কিন্তু— কিন্তু—” বড় কাকা কাষ্ঠ হাসলেন, “কিছু কিন্তু কিন্তু নয়। এর ওপর আমার প্রমোশন নির্ভর করছে। কোনো ভয় নেই, ছটা ষণ্ডা লোক সঙ্গে থাকবে।”

বটার কাছে শুনলাম যে, বাড়িটাতে একশো বছর কেউ থাকে না। বড়ই দুর্নাম। নাকি ওটা চোরাচালানকারীদের গুহ্য আড়ত। মাটির তলায় সুড়ঙ্গ আছে, বুড়ি-গঙ্গায় তার মুখ। অনেকে দেখেছে। সেই সুড়ঙ্গ দিয়ে সোনাদানা বে-আইনী জিনিস বস্তা বস্তা পাচার হয়। বাজারে নাকি ওদের চর ঘুরে বেড়ায়, কখনো জেলে সেজে, কখনো পুরুত-ঠাকুর সেজে এটা-ওটা কিনতে চায়, চা খেতে চায়, অচল পুরনো পয়সা দিয়ে দাম দিতে চায়। তা লোকে শুনবে কেন। দিয়েছে নালিশ করে।

বড় কাকা বলেছিলেন, “একটা লোককে কিছুতেই ধরা যায় না, ফুসফাস করে এখান দিয়ে ওখান দিয়ে গলে পালায়। কোনো দোকানদারের সঙ্গে ষড়ও থাকতে পারে, শুনেছি চেহারা দেখেই সন্দেহ হয়, কীরকম মিচকে মতো, মোটা মোটা কান, নাকের ডগায় আঁচিল।”

শুনে আঁতকে উঠেছিলাম, বটা কনুয়ের গুঁতো মেরে থামিয়ে দিয়েছিল। আটটা বাজতেই মহা ঘটা করে আটজন সশস্ত্র লোকজন নিয়ে বড় কাকা তদন্তে চলে গেলেন। ছোট্‌-ঠাকুমা তাঁর গলায় হলদে সুতো দিয়ে একটা বেলপাতা ঝুলিয়ে দিয়ে বললেন, “ব্যাস, আর ভয় নেই। সেখানে গিয়ে কেউ কিছু দিলে খাস নে যেন। দুগ্না! দুগ্না!” বড় কাকা চলে গেলে বললেন, “কামান দেগে হাওয়া ধরা। হুঁঃ!”।

আমরা ছাদে গিয়ে বুড়ি-গঙ্গায় স্পষ্ট জোয়ার আসা দেখতে লাগলাম। বটু বলল, “ওই গোল-বাড়িটা আমার ঠাকুরদার অতি-বৃদ্ধ প্রপিতামহের ছোট ভাই পেয়েছিল। ব্যাটা মহা লক্ষ্মীছাড়া ছিল, লেখাপড়া শেখেনি, কাজকর্ম করত না, খালি মাছধরার বাই ছিল আর চীনে ব্যবসাদারদের কাছ থেকে চায়ের নেশা ধরেছিল। সুদিনে বাড়ির সব ঝাড়বাতি, আসবাবপত্র, রূপোর বাসন বেচে-বুচে সাফ করে দিল। ওর বুড়ি মা নাকি খুচরা পয়সাকড়ি এমনি লুকিয়ে রেখে চোখ বুজেছিল যে ব্যাটা খুঁজেই পায়নি— এখনো নাকি খুঁজে বেড়ায়। তাই ও-বাড়িতে কেউ রাত কাটায় না। সেইখানে গেছে বড় কাকা তদন্ত করতে। খুচরা টাকাকড়ির বাক্সটা পেলে মন্দ হয় না। আমরাই তো ওর ওয়ারিশ। সে ব্যাটা তো বিয়েই করেনি। নাকি বিশ্রী দেখতে ছিল, শুঁটকো, কালো, চাকর-বাকর চেহারা। গেঞ্জি গায়ে ঘাটে বসে অষ্টপ্রহর বুড়ি-গঙ্গায় মাছ ধরত।— কে? কে ওখানে?”

খচমচ করে তালগাছ থেকে আমগাছ, আমগাছ থেকে নড়ঝড়ে বারান্দা কাঁপিয়ে মিচকে লোকটা হাসি হাসি মুখ করে উঠে এসে, নাকের ফুটো ফুলিয়ে ফোঁস ফোঁস করে নিশ্বাস নিয়ে বলল, “চা চা গন্দ পাচ্চি মনে হচ্ছে।” সত্যিই ছিল চা-দোকানের কেতলিতে একটু চা, একটা মাটির ভাঁড়, বটু লুকিয়ে এনেছিল সামনের দোকান থেকে। নীচে নামতেও হয়নি, ওদের ছোকরা তেঁতুলগাছে চড়ে, হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল, রোজকার মতো। চা পেয়ে লোকটা আহ্লাদে আটখানা, মিচকে মুখ যেন ভাঁজ হয়ে গেল। বললাম, “পেঁয়াজি খাবে নাকি?” জিব কেটে বলল, “এ্যা, ছি ছি, ও নাম করবেন না। আমার বরাদ্দ রোজকার মতো খেয়ে এসেছি, চিঁড়ের মোয়া, খোয়া ক্ষীর, মেওয়া—” বটা আর আমি এ ওর দিকে তাকালাম, কিছু বললাম না।

মিচকে লোকটি বলল, “বড়-কর্তা আমাদের ওখানে এমন হাঁকডাক লাগিয়েছেন যে টিকতে না পেরে ওনার এখানে গা-ঢাকা দিতে এসেছি। দেখ দাদা, তালগাছের মুড়োয় তোমাদের জন্য একটা দ্রব্যি রেখে গেলাম। আমি বাড়ি যাচ্ছি। সেখানে মা অমৃতি বানায়।”

বটু ব্যস্ত হয়ে বলল, “কেন চলে যাবে? এখানে বুঝি খেতে পাও না?” ফিক্‌ করে হেসে মিচকে লোকটা বলল, “দু বেলা নৈবিদ্যি পাই, আবার কষ্ট কীসের। ঐ এল বলে! আমি উঠি!” বলেই হাওয়া! নীচে বড় কাকাদের রাগ-রাগ গলার হাঁকডাক শোনা গেল, নিশ্চয় কিচ্ছু দুষ্কৃতকারী-টারি ধরতে পারেননি। সঙ্গে সঙ্গে হুড়মুড় করে আদ্যিকালের তালগাছটা ভেঙে পড়ল। পোকা ধরা, পুরোনো গুঁড়ি ভেঙেচুরে একাকার! তার মধ্যে দেখা গেল বেশ বড় একটা কাঠের হাতবাক্স, পুরোনো টাকাকড়িতে তার অর্ধেক ভরতি আর চাঁচাপোঁছা নৈবেদ্যের রেকাবিটা, তিন টুকরো হয়ে পড়ে আছে। বড় কাকার রাগ ঠান্ডা।

পরদিন বড় কাকা বললেন, “আশ্চর্যের বিষয়, সুড়ঙ্গের মধ্যে একটা খোপে ঐ বাক্স রাখার স্পষ্ট দাগ দেখলাম। সেই বুড়ি ঠাকরুন তা হলে বাউন্ডুলে ছেলের হাত থেকে ওটাকে বাঁচাবার জন্য, এইখানে লুকিয়ে রেখেছিলেন। এটাও তো তাঁদেরই বাড়ি।”

ছোট্‌-ঠাকুমা শূন্যে নমস্কার করে বললেন, “কত বাঁচিয়ে ছিলেন সে তো বোঝাই যাচ্ছে! ও বটা, নিজে পড়িস দাদু, সে তো গেল।” ফোঁৎ ফোঁৎ করে একটু কেঁদেও নিলেন। বড় কাকা তো অবাক।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *