চেতন পদার্থ।
সমুদায় চেতন পদার্থের সাধারণ নাম জন্তু। জন্তগণ মুখ ও নাসিকা দ্বারা বায়ু আকর্ষণ এবং মুখ দ্বারা আহার গ্রহণ করিয়া প্রাণধারণ করে। আহার দ্বারা শরীরের পুষ্টি হয়, তাহাতেই বঁচিয়া থাকে। আহার না পাইলে শরীর শুষ্ক হইতে থাকে এবং ত্বরায় মরিয়া যায়! প্রায় সকল জস্তুরই পাঁচ ইন্দ্রিয় আছে। সেই পাঁচ ইন্দ্রিয় দ্বারা তাহারা দর্শন, শ্রবণ, ঘ্রাণ, আস্বাদন ও স্পর্শ করিতে পারে।
পুত্তলিকার চক্ষু আছে দেখিতে পায় না; নাসিকা আছে গন্ধ পায় না; মুখ আছে খেতে পারে না; হস্ত আছে কোন বস্তু গ্রহণ করিতে পারে না; কর্ণ আছে কিছুই শুনিতে পায় না; পা আছে চলিতে পারে না। ইহার কারণ এই, পুত্তলিকা অচেতন পদার্থ, তাহার জীবন নাই। ঈশ্বর জন্তুদিগকেই জীবন দিয়াছেন। তিনি ভিন্ন আর কোন ব্যক্তিরই জীবন দিবার শক্তি নাই। দেখ, মনুষ্যেরা পুত্তলিকার মুখ, চোথ, নাক, কান, হাত, পা, সমুদায় গড়িতে পারে ও উহাকে ইচ্ছামত বেশ ভুষাও পরাইতে পারে; কিন্তু জীবন দিতে পারে না। উহা কেবল অচেতন পদার্থই থাকে, দেখিতেও পায় না, শুনিতেও পায় না, চলিতেও পারে না, বলিতেও পারে না।
পুথিবীর সকল স্থানেই ক্ষুদ্র ও বৃহৎ নানা প্রকার জন্ত আছে। তাাহাদের মধ্যে কতকগুলি স্থলচর অর্থাৎ কেবল স্থলে থাকে। কতকগুলি জলচর অর্থাৎ কেবল জলে থাকে। আর কতক গুলি স্থল ও জল উভয় স্থানেই থাকে, তাহাদিগকে উভচর বলা যাইতে পারে। যাবতীয় জন্তুর মধ্যে মনুষ্য সর্ব্বপ্রধান; আর সমুদায় জন্তু তদপেক্ষায় নিকৃষ্ট; তাহারা কোন ক্রমেই বুদ্ধি ও ক্ষমতাতে মনুষ্যের তুল্য নহে।
যে সকল জন্তুর শরীরে চর্ম্ম রোমশ অর্থাৎ রোমে আবৃত,এবং যাহারা চারি পায় চলে,তাহা দিগকে পশু কহে। গো, অশ্ব, গৰ্দভ,ছাগ,মেষ, কুকুর, বিরাল ইহরা ও এইরূপ অন্য অন্য জন্তু পশুশ্রেণীতে গণ্য। পশুর চারি পা এই নিমিত্ত ইহাদিগকে চতুষ্পদ কহা যায়। কোন কোন পশুর খুর অখণ্ডিত অর্থাৎ জোড়া; কেমন ঘোড়ার। কতকগুলির খুর দুই খণ্ডে বিভক্ত; যেমন গো. মেষ, ছাগল প্রভৃতির। কোন কোন পশুর পায়ে খুরের পরিবর্ত্তে নখর আছে; যথা বিড়াল, কুকুর, ব্যাাঘ্র প্রভূতির। কোন কোন পশুর রোম অনেক কাজে লাগে। মেষের লোমে কম্বল, বনাত প্রভৃতি প্রস্তুত হয়; তিব্বৎ দেশীয় ছাগলের লোমে শাল হয়।
জন্তুর মধ্যে পক্ষিজাতি দেখিতে অতি, সুন্দর। তাহাদের সব্বাঙ্গ পালকে ঢাকা। দুই পাশে দুইটী পক্ষ অর্থাৎ ডান আছে; তদ্বারা উড়িতে পারে, অনেক দূর গেলেও ক্লেশ বোধ হয় না। উহাদিগের দুটী পা আছে তাহার দ্বারা চলিতে পারে এবং বৃক্ষের শাখায় বসিতে পারে। কোন কোন পক্ষী অত্যন্ত ক্ষুদ্র; যেমন চড়ুই, বাবুই ইত্যাদি। ইহারা খড়, কুটা, তুণ প্রভৃতি আহরণ করিয়া অতি পরিস্কৃত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বাসা নির্ম্মাণ করে। কাক, কোকিল, পায়রা প্রভূতি কতকগুলি পক্ষির আকার কিছু বৃহৎ। হংস, সারস প্রভৃতি কতকগুলি পক্ষী জলে খেলা করে ও সাঁতার দিতে ভাল বাসে। ইহারা জলচর পক্ষী। সকল পক্ষী আপন আপন বাসায় ডিম পাড়ে এবং কিছু দিন ডানায় ঢাকিয়া গরমে রাখিলে ডিমের ভিতর হইতে ছানা বাহির হয়। ইহাকেই ডিমে তা দেওয়া ও ডিম ফুটান কহে।
মৎস্য এক প্রকার জন্তু। ইহারা কেবল জলে থাকে। ইহাদের শরীর ছালে আচ্ছাদিত; ঐ ছালের উপর মসৃণ চিক্কণ শল্ক অর্থাৎ আঁইস আছে। বোয়াল মাগুর প্রভূতি কতকগুলি মৎস্যের ছালে শল্ক নাই। মৎস্যের দুই পাশে ষে পাথনা আছে তাহার বলেই জলে ভাসে। মৎস্যেরা অতিবেগে সাঁতার দিতে পারে; এবং জলের ভিতর দিয়া গিয়া কীট ও অন্য অন্য ভক্ষ্য বস্তু ধরে। তিমি নামে এক প্রকার মৎস্য আছে তাহার আকার অতি বৃহৎ; মানুষের অপেক্ষা অনেক বড়। কখন কখন দীর্ঘে ৫৬ হাত ও প্রস্থে প্রায় ১০ হাত তিমি দেখা গিয়াছে।
আর এক প্রকার জন্তু আছে তাহাদিগকে সরীসৃপ কহে। কতকগুলি সরীসৃপের পা নাই, বুকে হাঁটে; কতকগুলির ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পা আছে, তদ্দ্বারা চলে। সর্প এক প্রকার সরীসৃপ। সর্পের পা নাই, বুকে ভর দিয়া ভূতলে বক্র গমন করে। সর্পের শরীরের চর্ম্ম অতি মসৃণ ও চিক্কণ। ভেক, কচ্ছপ, গোসাপ, টিক্টিকী প্রভৃতি কতকগুলি সরীসৃপের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পা আছে, তদ্দ্বারা তাহারা চলিতে পারে। ভেক জাতি অতি নিরীহ। কৌতুক ও আমোদের নিমিত্ত তাাহাদিগকে ক্লেশ দেওয়া উচিত নহে। কেহ কেহ এমত নিষ্ঠুর, যে, ভেক দেখিলেই ডেলা মারে ও যষ্টি প্রহার করে।
পতঙ্গ জাতি এক প্রকার জন্তু। পতঙ্গ নানাবিধ। গ্রীষ্ম ও বর্ষা কালে ফড়িঙ্, মশা, মাছি, প্রজাপতি প্রভৃতি বহুবিধ পতঙ্গ উড়িয়া বেড়ায়। কোন কোন পতঙ্গ জাতি সময় বিশেষে অত্যন্ত, ক্লেশকর হইয়া উঠে। পতঙ্গগণ পক্ষী, মৎস্য প্রভৃতি জন্তুর আহার।
কীট আতিক্ষুদ্র জন্তু| কীট নানাপ্রকার। উকুন, মৎকুণ, পিপীলিকা, উই, ঘুণ প্রভৃতি ক্ষুদ্র জন্তু কীটজাতি। এ সমস্ত ভিন্ন আরও নানাপ্রকার জন্তু আছে। উহারা এমত ক্ষুদ্র যে অণুবীক্ষণ ব্যতিরেকে কেবল চক্ষুতে দেখিতে পাওয়া যায় না। তাহারা স্ব স্ব প্রকৃতি অনুসারে জলে ও স্থলে অবস্থিতি করে। সমুদায় জগৎ বৃহৎ ও ক্ষুদ্র প্রাণিসমূহে পরিবৃত। অবশ্যই কোন না কোন প্রয়োজন সাধনের উদ্দেশে সমুুদায় প্রাণী সৃষ্ট হইয়াছে। কিন্তু সেই প্রয়োজন কি, অনেক স্থলেই তাহা নির্ণয় করিতে পারা যায় না।
জগতে কত জীব জন্তু আছে তাহার সঙ্খ্যা করা যায় মা। কিন্তু স্তষ্টিকর্ত্তার কি আপার মহিমা। তিনি তাহাদিগের প্রতিদিনের অপর্য্যাপ্ত আহার যোজনা করিয়া রাখিয়াছেন। তাহাদিগের অধিকাংশই লতা, পাতা, ফল, মূল ঘাস খাইয়া প্রাণধারণ করে। কতকগুলি জন্তু আপন অপেক্ষা ক্ষুদ্র ও দুর্ব্বল জন্তু ধরিয়া তাহাদের প্রাণ বধ করিয়া ভক্ষণ করে।
সিংহ, ব্যাঘ্র, তরক্ষু প্রভৃতি কতকগুলি বড় বড় চতুষ্পদ জন্তু শ্বাপদ অর্থাৎ শিকারী জন্তু ইহারা মৃগ, মেষ প্রভূতি দুর্ব্বল জন্তু বধ করিয়া মাংস ভক্ষণ করে। অশ্ব, গো, গর্দ্দভ, কুকুর, বিড়াল আদি কতকগুলি জন্তু মনুষ্যের অধীন থাকিতে অধিক রত এবং মানুষে যাহা দেয় তাহাই আহার করে। এই সকল জন্তুকে গ্রাম্য পশু বলে। ইহারা অতি নম্রস্বভাব; আমাদিগের অনেক উপকারে আইসে; এই নিমিত্ত ইহাদিগের উপর দয়া রাখা উচিত।
কোন্ জন্তু কোন্ শ্রেণীভক্ত, কাহার কি নাম, এবং কে কোন্ জাতীয়, বিশেষরূপে জানা অতি আবশ্যক। কোন পশুকেই অযথানামে ডাক উচিত নহে; যার যে নাম, তাকে সেই নামেই ডাকা কর্ত্তব্য। কোন কোন ব্যক্তি ফড়িঙকে পশু কহে; কিন্তু ফড়িঙ পশু নয়, পভঙ্গ। যে সকল জন্তুর চারি পা তাহাদিগকে চতুষ্পদ কহে। পক্ষী চতুষ্পদ নহে কারণ উহার দুটী বই পা নয়; অতএব উহাকে চতুষ্পদ না কহিয়া দ্বিপদ কহা উচিত।
কোন্ জন্তুর কি প্রকৃতি ও ঈশ্বর কি অভিপ্রায়ে সৃষ্টি করিয়াছেন, আমরা তাহা সবিশেষ অবগত নহি। এই নিমিত্ত কতকগুলিকে পবিত্র, পূজ্য, ও আদরণীয় জ্ঞান করি; কতক গুলিকে ঘৃণা করি ও স্পর্শ করি না। কিন্তু ইহা অত্যন্ত অন্যায় ও ভ্রান্তিমুলক। বিশ্বকর্ত্তা ঈশ্বরের সন্নিধানে সকল জন্তুই সমান; অতএব আমাদিগেরও ঐরূপ জ্ঞান করা উচিত।
পশুদিগের মধ্যে পদমর্য্যাদা নাই। সিংহরে মৃগেন্দ্র অর্থাৎ পশুর রাজা কহে; কিন্তু তাই কদাচ ঈশ্বরের অভিপ্রেত নহে। সকল পশু অপেক্ষা সিংহের পরাক্রম অধিক, এই নিমিত্ত মনুষেরা তাহাকে ঐ নাম দিয়াছে। নচেৎ সিংহ অন্য অন্য পশু অপেক্ষা কোন মতে উত্তম নহে।