১. মরুভূমি
গোবি মরুভূমিতে জীবনের খুব একটা মূল্য নেই। মৃদুমন্দ বাতাস বয়ে যাওয়া সবুজ মালভূমিটির অবস্থান প্রায় মেঘের কাছাকাছি। উত্তরের তুন্দ্রা অঞ্চলে যাওয়ার পথে অতিথি পাখিগুলো আগাছায় ঘেরা হ্রদের দিকে এক নজর তাকায়। বিশাল বৈকাল হ্রদে ঘুরতে আসে ওপর আকাশের সব দৈত্যরা। আর মধ্য শীতের পরিষ্কার রাতে দিগন্তের ওপর উত্তরের আলোর ছটা উঠছে আর নামছে।
উত্তর গোবির এই কোণের শিশুরা এই পরিস্থিতির কারণে শক্ত হয় না, ওরা সেভাবেই জন্মায়। মায়ের দুধ ছেড়ে ঘোড়ীর দুধ খাওয়া শুরু করতে না করতেই তাদের কাছে প্রত্যাশা করা হয়— নিজের ব্যবস্থা তারা নিজেরাই করে নেবে।
পারিবারিক তাঁবুর সামনে জ্বালানো আগুনের সামনের স্থানটি বরাদ্দ থাকত যোদ্ধা আর অতিথিদের জন্য। আশ্চর্য হলেও সত্য, মহিলারাও বাম পাশে বসতে পারত, তবে একটু দূরে। আর ছোট ছেলে ও মেয়েরা যে যেখানে পারে জায়গা করে নিত।
খাবারের ক্ষেত্রেও এমন নিয়ম। বসন্তকালে, যখন মাদী ঘোড়া আর গাভী নিয়মিত পর্যাপ্ত দুধ দিত, তখন সবকিছুই খুব ভালো চলত। ভেড়াগুলোও হৃষ্টপুষ্ট হতে থাকত। শিকারও তখন অনেক বেশি পাওয়া যেত। শিকারিরা তখন লম্বা পশমে আচ্ছাদিত পশু, যেমন—শেয়াল, মারটেন (বড় ইঁদুর) বা স্যাবল (কাঠবিড়ালির মতো পশু) শিকার না করে, হরিণ, আবার কখনো ভালুক শিকার করে আনতো। সবকিছুই রান্নার পাত্রে প্রবেশ করত এবং খাওয়া হতো। শক্ত—সমর্থ পুরুষরা পাত্রের প্রথম অংশটা খেয়ে ফেলত। এরপরে সুযোগ পেত বয়স্ক আর মহিলারা। বাচ্চারা মারামারি করতো হাড্ডি আর বেঁচে যাওয়া মাংসের জন্য। গৃহপালিত কুকুরগুলোর জন্য খুব কমই অবশিষ্ট থাকতো।
শীতকালে, যখন গবাদিপশুগুলো শুকিয়ে যায়, তখন শিশুরাও খুব হৃষ্টপুষ্ট থাকে না। দুধ তখন পাওয়া যায় কেবল ‘কুমিস’ হিসেবে—চামড়ার ব্যাগে রাখা দুধকে গাঁজন করে তৈরি করা পানীয় হিসেবে। এই ‘কুমিস’ পুষ্টিকর তবে তিন—চার বছরের শিশুদের জন্য কিছুটা বিষাক্ত—অবশ্য যদি তারা চেয়ে খেতে পায় বা চুরি করে খায়। মাংসের যোগান কমতে থাকে, ক্ষুধা মেটাতে মাংসের বদলে তখন খেতে দেয়া হয় সিদ্ধ জব।
শীতের শেষে যুবকদের জন্য শুরু হয় সবচেয়ে কষ্টের সময়। তখন গবাদিপশুর পালকে আকারে ছোট করে ফেলা ছাড়া মাংস খাওয়ার কোনো উপায় থাকে না। এই সময়টায় প্রত্যেক উপজাতির যোদ্ধারা তাই বেরিয়ে পড়ে অন্য কোনো উপজাতিকে আক্রমণ করতে। লুট করে নিয়ে আসে তাদের বাঁচিয়ে রাখা খাবার, আর তাদের সঙ্গে থাকা গবাদিপশু এবং ঘোড়া।
শিশুরা নিজেরাই সম্মিলিতভাবে শিকার করা শিখতে থাকে। ভোঁতা সব বল্লম আর তীর দিয়ে কখনো কুকুর, কখনো ইঁদুর শিকার করে আনে। পশুর পিঠে চড়তেও শেখে। ভেড়ার লোম আঁকড়ে ধরে ভেড়ার ওপরে চড়ে তারা ঘোড়ায় চড়ার প্রশিক্ষণ নিতে থাকে।
সহ্যশক্তি ছিল চেঙ্গিস খানের প্রথম ঐতিহ্য, জন্মের পরে যার নাম ছিল ‘তিমুজিন’ (তিমুজিন শব্দের অর্থ ‘উৎকৃষ্ট লোহা’। আর চীনা ভাষায় এর অর্থ ‘পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মানুষ’)। জন্মের সময় তার বাবা সেখানে ছিলেন না। তিনি গিয়েছিলেন অন্য এক গোত্রকে আক্রমণ করতে, যার প্রধানের নাম তিমুজিন। ঘটনাপ্রবাহ ঘরে এবং বাইরে ভালোই যাচ্ছিল। শত্রু বন্দি হলো, আর বাবা ফিরে এসে বন্দি শত্রুর নাম তার শিশু পুত্রকে দিলেন।
তার বাড়িটি ছিল লোহার কাঠামোর ওপর পশমি কাপড়ে ঢেকে তৈরি একটি তাঁবু। ধোঁয়া বেরিয়ে যাওয়ার জন্য এর ওপরে ফাঁক ছিল। তাঁবুটায় সাদা চুনের প্রলেপ দেয়া ছিল আর ছবি এঁকে এগুলোকে আরো অলঙ্কৃত করা হয়েছিল। এই অদ্ভুত ধরনের তাঁবুগুলোকে বলা হতো ‘ইয়ার্ট’। পুরো চারণভূমির সর্বত্রই এগুলো দেখা যেত। এক ডজন কিংবা তারও বেশি ষাঁড়চালিত গাড়িতেও এই তাঁবুগুলো খাটানো থাকত। সুবিধাও ছিল এসব তাঁবুর। গম্বুজের মতো আকৃতি হওয়ায়, বাতাসে এগুলোর কোনো ক্ষতি হতো না। আর এগুলো প্রয়োজনে নামিয়েও ফেলা যেত।
তিমুজিনের বাবা ছিলেন একজন গোত্রপ্রধান। গোত্রপ্রধানদের স্ত্রীদের প্রত্যেকের জন্য থাকতো তাদের নিজেদের গোলাকার তাঁবু বা ‘ইয়ার্ট’। এখানেই তাদের সন্তানরা থাকত। বাড়ির ছোট মেয়েদের দায়িত্ব ছিল ‘ইয়ার্টে’র দেখাশোনা করা, ধোঁয়া বেরিয়ে যাওয়ার জন্য ওপরে যে গোলাকার ছিদ্র আছে তার নিচে পাথরের পাত্রের ভেতর জ্বালানো আগুনকে প্রজ্বলিত রাখা। তাঁবুর প্রবেশদ্বারে ঝোলানো পর্দার সামনে গরুগাড়ির পাটাতনে তিমুজিনের যে বোন তাঁবুর সামনে দাঁড়িয়ে থাকতো, তার কাজ গাড়ি চলার সময় ষাঁড়গুলোকে সামলানো। কোনো চারণভূমিতে এলে, এই ষাঁড় টানা গাড়িগুলোকে একটার সঙ্গে একটা পাশাপাশি বেঁধে রাখা হতো। প্রায়ই সেগুলোর সঙ্গে ঘোড়াগুলোকে বাঁধতে হতো, কারণ ঘোড়াগুলো বাঁধবার কোনো শক্ত উঁচু গাছ সে এলাকায় থাকত না।
এই ‘ইয়ার্ট’ বা তাঁবুগুলোতে পারিবারিক ধন-সম্পদ, বোখারা কিংবা কাবুল থেকে আনা কার্পেট, অন্য কাফেলা থেকে লুট করে আনা মেয়েদের গয়না কিংবা পোশাক, আরব ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে কেনা দামি সিল্কের পোশাক —এসব রাখা থাকত। সবচেয়ে জরুরি যা থাকত তা হচ্ছে দেয়ালে ঝোলানো অস্ত্র, ছোট তুর্কি তলোয়ার, বর্শা, হাতির দাঁত কিংবা বাঁশের তৈরি তীর রাখার তূণ — বিভিন্ন দৈর্ঘ্যের আর ওজনের তীর, আর সম্ভবত তেল মাখানো শুকনো চামড়ার তৈরি গোলাকার ঢাল।
এগুলোও হয় লুট করে আনা অথবা কেনা। যুদ্ধে সৌভাগ্যবান হলে বংশপরম্পরায় পিতৃপুরুষদের কাছ থেকে তারা এগুলো পেত।
বালক চেঙ্গিস খান বা তিমুজিনের তখন অনেক কাজ ছিল। গ্রীষ্মকাল থেকে শীতকাল পর্যন্ত, প্রত্যেক পরিবারের বালকদের অবশ্যই তাদের চলার পথে পড়া পাহাড়ি ঝরনা আর নদী থেকে মাছ শিকার করে আনতে হতো। তাদের আরো দায়িত্ব ছিল ঘোড়ার পালকে দেখাশোনা করা, ঘোড়ায় চড়ে হারানো গবাদিপশু গুলোকে খুঁজে আনা আর নতুন চারণভূমির খোঁজ করা। আক্রমণকারীর খোঁজে তারা রাতের বেলা দিগন্তের দিকে তাকিয়ে থাকত আর অনেক বরফঝরা রাত এভাবেই কাটিয়ে দিতে হতো, কোনো আগুন ছাড়া। প্রয়োজনের তাগিদে তারা শিখেছিল বেশ কয়েকদিন ধরে ঘোড়ায় চেপে থাকতে আর রান্না না করা খাবার নিয়ে তিন-চারদিনের জন্য বেরিয়ে পড়তে— কখনো হয়তো বেরোতে হতো খাবার ছাড়াই।
যখন ছাগল বা ঘোড়ার মাংস প্রচুর থাকতো, তখন বিশাল সব ভোজের আয়োজন করা হতো আর তখন তারা তাদের নষ্ট হওয়া সময় পূরণ করত। অভাবের দিনের তুলনায় অবিশ্বাস্য পরিমাণ খাবার দাবার এদিক-ওদিক ফেলে অপচয় করত। মনোরঞ্জনের জন্য তারা ঘোড়দৌড়ের আয়োজন করত, চারণভূমিতে বিশ মাইল গিয়ে আবার ফিরে আসাতো, অথবা কুস্তি প্রতিযোগিতা করত, যেখানে প্রায়ই কারো না কারো হাড় ভাঙত।
তিমুজিন সবার চোখে পড়ত তার শারীরিক শক্তি আর খুব ভালো পরিকল্পনা করার দক্ষতার জন্য— যা ছিল কঠিন পরিস্থিতিতে নিজেকে খাপ খাইয়ে নেয়ার আরেকটি উপায়। খুব সুঠাম দেহ না হলেও সে কুস্তিগিরদের নেতা হয়ে গিয়েছিল। ভাই কাসার বেশ ভালো তীরন্দাজ ছিল, তাকে বলা হতো ‘ধনুকমানব’। তার মতো না হলেও, তীর ধনুকে সে বেশ ভালোই ছিল। তবে কাসার তিমুজিনকে ভয় পেত।
তারা দুই ভাই তাদের সৎ ভাইদের বিরুদ্ধে লড়ার জন্য একটা সমঝোতা করেছিল। তিমুজিনের ক্ষেত্রে প্রথম যে ঘটনাটা ঘটল তা হলো—তিমুজিন তার আরেক শক্তিশালী সৎ ভাইকে খুন করল, কারণ সে তার কাছ থেকে মাছ চুরি করেছিল। এসব উপজাতি বালকের কাছে ক্ষমার কোনো মূল্য ছিল না, প্রতিশোধ নেয়াটা ছিল বাধ্যবাধকতা।
কিছুদিনের ভেতরেই তিমুজিন বুঝতে পারল বন্ধুবান্ধবদের ভেতরের এসব খুনসুটির চেয়ে জাতিগত বিদ্বেষ অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তিমুজিনের মা হৌলুন ছিলেন অপূর্ব সুন্দরী। আর তাই তার বাবা তাকে পাশের এক উপজাতির কাছ থেকে বিয়ের দিন তুলে নিয়ে আসেন। তখন সে হবু স্বামীর তাঁবুতে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছিল। তীক্ষ্ণ বুদ্ধির অধিকারী হৌলুনও পরিস্থিতি বুঝে এই বিয়েতে আর আপত্তি করেননি। তবে পুরো গোত্রই জানত, এই অন্যায়ের প্রতিশোধ নিতে একদিন না একদিন তার গোত্রের লোকেরা আসবেই।
রাতে, গোবর পোড়ানো আগুনের পাশে বসে, চারণকবিদের কাছে তিমুজিন গল্প শুনতো। বয়স্ক মানুষেরা সঙ্গে একটা একতারের বাদ্য নিয়ে এক তাঁবু থেকে অন্য তাঁবুতে যেত আর গুনগুন করে গান গেয়ে মহান বীর আর পিতৃপুরুষদের যুদ্ধগাঁথা শোনাত।
সে তার সামর্থ্য আর গোত্রপ্রধান হওয়ার অধিকার, দুটো সম্পর্কেই সজাগ ছিল। কেন হবে না? সাহসী ইয়েসুকির প্রথম সন্তান তো সে, যার ওপর নাম ইক্কার খান (মঙ্গোলদের নেতার উপাধি) বা বিখ্যাত মঙ্গোল, যার গোত্রে আছে চল্লিশ হাজার তাঁবু।
চারণকবিদের সেইসব গল্প শুনে সে জানতে পেরেছিল তারা হচ্ছে একটু আলাদা, ‘বোরচিকুন’ বা ‘ধূসর চোখের মানুষ’ জাতির উত্তরপুরুষ। সে তার পূর্বপুরুষদের গল্প শুনত। তাদের একজন ছিলেন কাবুল খান, যিনি একবার ক্যাথি সাম্রাজ্যের রাজাকে দাড়ি ধরে ঘোড়া থেকে টেনে নামিয়েছিলেন, যার পরিণামস্বরূপ তাকে বিষ খাইয়ে মেরে ফেলা হয়। সে আরো জানতে পারে, তার বাবার ‘শপথভাই’ হচ্ছেন কারাই, তাদের তোঘরুল খান। গোবি উপজাতিগুলোর মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী। এশিয়ার প্রিস্টার জনকে নিয়ে ইউরোপে যে গল্প চালু আছে, তা তারই সম্পর্কে। প্রিস্টার জন নামটা চালু হয় ইউরোপে। তখন মধ্য এশিয়া শাসন করা একজন খ্রিস্টান শাসকের অনেকগুলো গল্প চালু ছিল। মার্কো পোলো এবং তার পরে আরো অনেকের মতে তঘরুল খানই সেই প্রিস্টার জন।
কিন্তু সেই সময় তিমুজিনের দিগন্ত ছিল তার গোত্র, ইক্কা মঙ্গোলদের দখলে থাকা চারণভূমি পর্যন্ত।
একজন বিদ্বান আলোচক বলতেন, “আমরা, ইক্কা মঙ্গোলরা ক্যাথি সাম্রাজ্যের এক শ ভাগের এক ভাগও না। তারপরও আমরা এখনো টিকে আছি, কারণ আমরা সবাই যাযাবর, আমাদের দরকারি সব জিনিস সঙ্গে নিয়েই চলাফেরা করি, আর আমাদের ধাঁচের যুদ্ধে আমরা খুব পারদর্শী। যখন পারি আমরা হামলা করি আর যখন পারি না তখন খুব সহজেই লুকিয়ে যাই। আমরা যদি শহর বানিয়ে বসতি গড়ি আর আমাদের পুরনো অভ্যাস ছাড়ি, তবে আমরা আর উন্নতি করতে পারব না। এছাড়াও, ধর্মীয় উপাসনালয় বানালেই আমাদের চরিত্রে কোমলতা আসবে। আর তারাই কেবল মনুষ্যজাতির শাসক হয়, যারা ভয়ঙ্কর আর যুদ্ধবাজ।”
(মনে রাখা দরকার মঙ্গোলরা কিন্তু চীনাদের মতো একই জাতি নয়। তারা তুসি বা যাযাবর জাতি। ইরানি আর তুর্কি রক্তের মিশ্রণে জাত। এদেরকে আজ বলা হয় উড়াল আলতাকি। এরা উত্তর এশিয়ার উপজাতি। গ্রিকরা এদের ডাকে সিচিয়ান বলে।)।
রাখাল বালক হিসেবে তিমুজিনের যুদ্ধশিক্ষার শিক্ষানবিশকাল তখন শেষ। এখন সে বাবা ইয়েসুকির সঙ্গে একসঙ্গে ঘোড়ায় চড়ে বেড়াতে পারে। সবদিক থেকেই বালক তিমুজিন ছিল সুন্দর। তবে চোখে পড়ার মতো ছিল তার শারীরিক শক্তি। চালচলনে ছিল কর্তৃত্বের ছাপ।
সে ছিল বেশ লম্বা, চওড়া কাঁধ। ত্বক ছিল ফর্সা-তামাটে। ঢালু হয়ে আসা কপালের নিচে চোখ দুটো ছিল একটু দূরত্বে। সবুজ বা নীলচে ধূসর চোখের আইরিশ আর চোখের মণি ছিল কালো। পিঠের ওপর ছড়িয়ে থাকত তার লম্বা বাদামি চুল। সে ছিল বেশ স্বল্পভাষী আর যা বলত ভেবেচিন্তে, ঠাণ্ডা মাথায়। তার ছিল প্রচণ্ড রাগ আর বন্ধু তৈরি করার অদ্ভুত ক্ষমতা।
বিভিন্ন উপাধির মতো তার জীবনে প্রেমও এসেছিল হঠাৎ করে। একদিন রাতে বাবার সঙ্গে ঘুরতে বেরিয়ে যখন তারা এক অপরিচিত যোদ্ধার তাঁবুর পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন, তখন এই বালকের দৃষ্টি তাঁবুর একটি মেয়ের দিকে আকৃষ্ট হলো। সঙ্গে সঙ্গে সে বাবা ইয়েসুকির কাছ জানতে চাইল যে সে এই মেয়েকে স্ত্রী হিসেবে পেতে পারে কিনা।
বাবা বাধা দিলেন, “ও তো অনেক ছোট।”
তিমুজিন জানাল, “যখন বড় হবে, তখন।”
মেয়েটার দিকে এবার ভালো করে তাকালেন ইয়েসুকি। তার বয়স তখন নয় বছর এবং বেশ সুন্দরী, নাম বৌরতাই। নামটা শুনে তার পূর্বপুরুষদের নাম মনে পড়ে গেল ‘ধূসর চোখের মানুষ’ বা বুরচিকুন।
মেয়েটির বাবা ব্যাপারটা লক্ষ করেছিলেন, মঙ্গোলদের দেখানো আগ্রহে মনে মনে খুশি হয়েছিলেন, “যদিও ছোট, তবে ওর দিকে তুমি তাকাতে পারো।” আর তিমুজিনকে তিনি মেনে নিলেন। “তোমার ছেলেরও খুব সুন্দর চেহারা, আর দৃষ্টিও খুব তীক্ষ্ণ।”
তাই পরের দিন কথাবার্তা হলো আর মঙ্গোল খান সেখান থেকে চলে গেলেন, ছেলেকে সেখানে রেখে গেলেন কনে আর হবু শ্বশুরের সঙ্গে আলাপ—পরিচয় করার জন্য।
এর কিছুদিন পরে একজন মঙ্গোল ঘোড়া ছুটিয়ে তার কাছে খবর নিয়ে এলো যে, ইয়েসুকি, যিনি এক রাতের জন্য কয়েকজন শত্রুর তাঁবুতে ছিলেন, তাকে সম্ভবত বিষ খাইয়ে দেয়া হয়েছে। এখন তিনি মৃত্যুশয্যায় শায়িত আর তিমুজিনকে খুঁজছেন। হয়তো বিষ খাওয়ানো হয়েছিল। যদিও তেরো বছরের তিমুজিন যত জোরে পারল তাদের গোত্রের ‘তাঁবু গ্রাম’ বা ‘ওরদু’র দিকে ছুটল, কিন্তু গিয়ে দেখল তার বাবা আর নেই।
তার চেয়েও বড় কথা, তার অবর্তমানে আরো অনেক কিছু ঘটে গিয়েছিল। কে প্রধান হবে তা নিয়ে গোত্রের গণ্যমান্যরা আলোচনায় বসল। দুই-তৃতীয়াংশই গোত্রপতির পতাকা পরিত্যাগ করল আর অন্য একজন প্রতিরক্ষকের খোঁজ শুরু করল। তারা নিজেদের, নিজেদের পরিবার আর তাদের গবাদির দায়িত্ব এই অনভিজ্ঞ বালকের হাতে দিতে আস্থা পাচ্ছিল না।
তারা বলল, “গভীর সমস্যা কেটে গেছে। শক্ত দেয়ালটাও ভেঙে গেছে। এখন এই মহিলা আর তার সন্তানদের ব্যাপারে কী করা যায়?”
বুদ্ধিমতী আর সাহসী হৌলুন, গোত্রের ভাঙন আটকাবার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করলেন। মঙ্গোলদের পতাকা (নাইন ইয়াক টেইল) নিজের হাতে নিয়ে তিনি ঘোড়ায় চড়ে পরিত্যাগকারীদের কাছে গেলেন, অনুরোধ করলেন। কয়েকটি পরিবারকে তাদের পরিবার আর গবাদিসহ তাদের গরুগাড়ির মুখ ঘোরাবার জন্য বোঝাতে পারলেন।
তিমুজিন তখন সাদা ঘোড়ার চামড়ার ওপর বসে। সে তখন ইক্কা মঙ্গোলদের খান (মঙ্গোলদের নেতাকে ‘খান’ উপাধি দেয়া হয়)। কিন্তু তার সঙ্গে মাত্র অল্প কয়েকটি উপজাতি পরিবার থাকল। সে নিশ্চিতভাবে জানে, যেসব গোত্রের সঙ্গে মঙ্গোলদের শত্রুতা রয়েছে, তারা ইয়েসুকির মৃত্যুর সুযোগ নেবে। তার পুত্রের ওপর প্রতিশোধ নেবে।
২. বেঁচে থাকার সংগ্রাম
তার প্রপিতামহ কাবুল খানের সময় আর বাবা ইয়েসুকির সময় ইক্কা মঙ্গোলরা উত্তর গোবি অঞ্চলে প্রাধান্য বিস্তার করে আসছিল। মঙ্গোল হওয়ার সুবাদে স্বাভাবিকভাবেই তারা পেয়ে যেত বৈকাল হ্রদের পার থেকে পূর্ব দিকে পাহাড়গুলো পর্যন্ত বিস্তৃত সবচেয়ে ভালো চারণভূমিটি। আধুনিক মাঞ্চুরিয়ার সীমানায় অবস্থিত এই পাহাড়গুলো এখন খিঙ্গা নামে পরিচিত।
গোবির বালুময় মরুভূমির উত্তরে আর ‘কেরুলন’ আর ‘অনন’ নদীর উর্বরা উপত্যকার মাঝে হওয়ার কারণে এই চারণভূমিগুলো ছিল খুবই লোভনীয়। পাহাড়গুলো বার্চ আর ফার গাছে ঢাকা। এখানে শিকার রয়েছে প্রচুর, বরফ এবার একটু দেরিতে গলেছে বলে পানিও এখন পর্যাপ্ত। এতদিন মঙ্গোলদের অধীনে থাকা এই এলাকার পরিস্থিতি এই গোত্রের কাছে ছিল বেশ পরিচিত। এখন অন্যান্য গোত্র তেরো বছরের তিমুজিনের অধিকারে থাকা এই এলাকা ছিনিয়ে নেয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে।
এই সম্পদগুলো বাকি সব উপজাতির কাছে খুবই আকর্ষণীয়। এই সুন্দর উর্বরা চারণভূমি, শীত শুরু হলেও এখনো তীব্র ঠাণ্ডা পড়েনি আর রয়েছে প্রচুর গবাদিপশু। এসব পশু থেকেই আসে তাদের নিত্যপ্রয়োজনীয় সবকিছু। লোম থেকে তৈরি হয় তাঁবু তৈরির পশমি কাপড় বা ‘ফেল্ট’ আর ‘ইয়ার্ট’ বা গোলাকার তাঁবু বাঁধবার দড়ি, হাড় থেকে তীরের শীর্ষভাগ, চামড়া দিয়ে স্যাডল আর ‘কুমিস’ রাখবার ব্যাগ আর ঘোড়ার লাগাম।
মনে হতে পারে তিমুজিন এই বিরূপ পরিস্থিতিতে পালাবে। এই আক্রমণ প্রতিহত করার কোনো ক্ষমতাই তার নেই। খান বা গোত্রপতি সম্মানীস্বরূপ গবাদির একটি অংশ পায়। তার সঙ্গে এখন যারা আছে, যাদেরকে আমরা তার সঙ্গী বলতে পারি, তারা এই বালককে, সেই সম্মানীর কণামাত্রও দিতে রাজি ছিল না। এছাড়াও তারা পাহাড়ে ছড়িয়ে গিয়েছিল, বন্য নেকড়ের কাছ থেকে তারা তাদের নিজেদের গবাদিপশু পাহারা দিতে ব্যস্ত। আর বসন্তের ঠিক আগের এই সময়টায় ছোটখাটো আক্রমণকারীদের আগমন অনেকটাই নিশ্চিত ঘটনা।
তিমুজিন পালাল না। ইতিহাস বলে, তাঁবুতে, বাবার মৃতদেহের পাশে, একা বসে সে কিছুক্ষণ কেঁদেছিল। তারপরই নেতৃত্বের দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিল। তার ছোট ছোট ভাই, বোন, সৎভাই আর সর্বোপরি তার মা, সবাই তার প্রতি সমর্পিত ছিল। সবার অন্ন যোগানোর দায়িত্ব এখন তার কাঁধে। তার চেয়েও বড় কথা, তার মা, যিনি খুব ভালোভাবেই জানেন দুর্যোগ এখন অবশ্যম্ভাবী, আর তা তার কাছ থেকে তার প্রথম সন্তানকে অবশ্যই কেড়ে নেবে।
অবশ্যম্ভাবী, কারণ তার মতো বোরচিকুন বা ‘ধূসর চোখের যোদ্ধা’রই উত্তরপুরুষ, আরেকজন যোদ্ধা তারগোতাই আগেই ঘোষণা দিয়েছে, সেই এখন উত্তর গোবির পুরো এলাকার নেতা। তাইজুত গোত্রের নেতা এই তারগোতাই ছিল মঙ্গোলদের পুরনো শত্রু।
আর এই তারগোতাই, যে তিমুজিনে গোত্রের বেশিরভাগ লোককেই তার পতাকাতলে নিয়ে গেছে, সে এখন মঙ্গোলদের এই বালক খানকে অবশ্যই খুঁজে বের করবে। যেভাবে একজন বৃদ্ধ নেকড়ে পরবর্তীতে দলের নেতৃত্ব নিতে পারে এমন শাবককে খুঁজে বের করে আর হত্যা করে, সেভাবে।
আক্রমণটা শুরু হলো কোনো সাবধানবাণী না দিয়েই। মঙ্গোলদের ‘অরদু’ বা তাঁবু গ্রামের দিকেই ছুটে এলো এই ঘোড়সাওয়ার বাহিনী। কেউ কেউ একদিকে সরে তাদের নিজেদের গবাদি রক্ষায় ব্যস্ত হয়ে গেল। যে তাঁবুতে পতাকা উড়ছিল, তারগোতাই নিজেই সেই তাঁবুতে গেল।
যোদ্ধাদের আক্রমণ শুরু হওয়ার আগেই তিমুজিন তার ভাইদের নিয়ে পালিয়ে গিয়েছিল। সঙ্গে ছিল তীরন্দাজ ভাই কাসার। আসার আগে শত্রুকে লক্ষ করে কিছু তীর ছুড়েছিল। হৌলুনকে রেখে এসেছিল। তবে তারগোতাই তিমুজিন ছাড়া আর কাউকেই খুঁজছে না।
এভাবেই খোঁজ শুরু হলো, তাইজুতরা এই বালকদের খুব কাছে চলে এলো। শিকারিরা খুব বেশি তাড়াহুড়া করছিল না। চলার পথের চিহ্ন বেশ টাটকা আর পরিষ্কার। এই উপজাতিরা ঘোড়ার পায়ের চিহ্ন দেখে কয়েক দিন পিছু নিয়ে কাউকে খুঁজে বের করতে বেশ অভ্যস্ত। তাই, তিমুজিন যদি নতুন কোনো ঘোড়া না পায়, তবে তাকে তারা খুঁজে বের করে ফেলবে।
বালকরা সহজাত প্রবৃত্তিতে আশ্রয়ের খোঁজে জঙ্গলের দিকে এগিয়ে গেল। বড় বড় গাছগুলো তাদের জন্য আড়ালের কাজ করল। কখনো তারা ঘোড়া থেকে নেমে, গাছ কেটে সরু রাস্তার ওপরে ফেলে দিল, যেন সেই পথে শিকারিরা সহজে আসতে না পারে। সন্ধ্যা হয়ে এলে তারা আলাদা হয়ে গেল। ছোট ভাই আর বোনদেরকে একটা গুহায় লুকিয়ে রাখল। কাসার ঘুরে গেল আর তিমুজিন লুকোবার জায়গা খুঁজতে একটি পাহাড়ের দিকে এগিয়ে গেল।
এখানে সে বেশ কিছুদিন লুকিয়েও থাকল। কিন্তু ক্ষুধা তাকে বাধ্য করল ঝুঁকি নিয়ে অপেক্ষমাণ তাইজুতদের ভেতর দিয়ে ঘোড়া নিয়ে এগিয়ে যেতে। ওরা তাকে দেখতে পেল আর তাড়া করে ধরেও ফেলল। এরপরে তাকে তারগোতাইয়ের কাছে নিয়ে আসা হলো। তারগোতাই নির্দেশ দিল, তার ওপর ‘ক্যাং’ (মোটা একটা কাঠের টুকরো, যেখানে বন্দির মাথা আর দুই হাতের কবজি ঢোকানো থাকে) চাপিয়ে দিতে। এভাবে তিমুজিনকে বন্দি করে নিয়ে যোদ্ধারা তাদের নিজেদের চারণভূমির দিকে ফিরে চলল। সঙ্গে নিয়ে চলল লুট করা গবাদিপশুগুলোও। তিমুজিন তখন নিতান্তই অসহায়। এমন সময় সুযোগটা এলো। মাত্র একজন প্রহরীকে পাহারায় রেখে বাকি সব সৈন্য অন্যদিকে গেল খাবার খেতে। তাঁবুতে তখন অন্ধকার নেমে এসেছে। পালাবার এই সুযোগটা হাতছাড়া করার কোনো ইচ্ছাই ছিল না তিমুজিনের।
তাঁবুর অন্ধকারে ঘাড়ের ওপর থাকা ‘ক্যাং’ দিয়ে প্রহরীর মাথায় আঘাত করে তাকে অজ্ঞান করে ফেলল। তাঁবু থেকে বেরিয়ে দেখতে পেল বাইরে চাঁদ উঠেছে। আর জঙ্গলের ভেতর দেখা যাচ্ছে কিছু আলো, সেখানেই তারা ছাউনি ফেলেছে। জঙ্গলের ভেতর দিয়ে সে নদীর দিকে দৌড়তে লাগল। একদিন আগে এই নদীই তারা পার হয়ে এসেছিল। পেছনে সৈন্যদের আওয়াজ পেয়ে সে নদীতে নেমে গেল। নদীর ধারের আগাছায় গলা পর্যন্ত ডুবিয়ে সে সেখানেই লুকিয়ে থাকল। কেবল তার মাথাটা ছিল পানির ওপরে।
এই অবস্থায়ই সে দেখতে পেল তাইজুত যোদ্ধারা নদীর ধারে তাকে খুঁজছে। লক্ষ করল, খুঁজতে আসা প্রহরীদের একজন তাকে দেখতে পেয়েছে। সে কিছুক্ষণ ইতস্তত করল আর তার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা না করে চলে গেল।
‘ক্যাং’-এ বন্দী তিমুজিন তখনো আগের মতোই অসহায়। এরপরে, সে এমন একটা কাজ করল, যার জন্য প্রয়োজন দুরন্ত দুঃসাহস আর তীক্ষ্ণ অনুমান ক্ষমতা। সে নদী থেকে বেরিয়ে এলো। প্রহরীদের পেছন পেছন তাদের তাঁবু পর্যন্ত এলো। যে প্রহরী তাকে দেখেও কাউকে কিছু বলেনি, তার তাঁবুতে গেল।
শরীর থেকে টপটপ করে পানি পড়ছে। তিমুজিন যতটা না ভীত, তার চেয়েও বেশি ভয় পেয়ে গেল প্রহরীটা। এরপরে প্রহরীটা মুগ্ধ হয়ে বন্দিকে বাহবা দিল। সে বুঝল এখন সবচেয়ে ভালো কাজ হবে কাঠের টুকরোটা কেটে তাকে মুক্ত করে দেয়া। তাই সে ‘ক্যাংটা কেটে টুকরোগুলো পুড়িয়ে ফেলল। তিমুজিনকে উল ভর্তি একটা ঘোড়াগাড়িতে লুকিয়ে রাখল।
উলের ভেতর ছিল প্রচণ্ড গরম। লুকাবার খুব ভালো কোনো জায়গা নয়, বিশেষ করে যখন তাইজুত প্রহরীরা তাকে খুঁজতে তাঁবুতে এলো। উলের গাড়িতে তিমুজিন আছে কিনা তা পরীক্ষা করার জন্য এখানে-সেখানে তলোয়ার কোপ বসাল। একটা আঘাত তার পায়েও লাগল।
তিমুজিন চুপচাপ সেই গরম উলের ভিতর লুকিয়ে থাকল। “তোমাকে খুঁজে পেলে আমাকে মেরে আমার ঘরবাড়ি সব জ্বালিয়ে দিত” –প্রহরীরা চলে যাওয়ার পর লোকটা বলল। কিছু খাওয়ার, দুধ আর তীর ধনুক দিয়ে বলল, “যাও, তোমার মা আর ভাইদেরকে খুঁজে বের কর।”
ধার করা একটা ঘোড়ায় চড়ে তিমুজিন ফিরে এলো। সে আগন্তুক যেমনটা বলেছিল— পুরো শিবিরে এখন শুধু ছাই পড়ে আছে, গবাদিপশুগুলো একটাও নেই আর মা আর ভাইয়েরাও গায়েব। তার চেয়ে কিছুটা ভালো অবস্থায় এক সময় সে তার ক্ষুধার্ত পরিবারকে খুঁজে পেল। অনমনীয় হৌলুন, কাসার আর তার সৎ ভাই বেলগুতাইও আছে সঙ্গে।
তারা একটা নিয়ম করে চলতে লাগল। রাতের বেলা যাত্রা করে পরিচিত এক শুভাকাঙ্ক্ষীর তাঁবুতে গেল। তখন সঙ্গে ছিল কেবল আটটি ঘোড়া। বাজে শিকার, যেমন ইঁদুর ধরত আর খাবার বলতে ছাগলের মাংসের বদলে মাছের মধ্যেই তারা সীমাবদ্ধ ছিল। তাকে খুঁজে বেড়ানো লোকদের কীভাবে অতর্কিতে হামলা করতে হয়, তিমুজিন সেটা শিখল। এভাবে অতর্কিতে হামলা করে একে একে শিকারিদের নিকেশ করে ফেলতে লাগল। ধীরে ধীরে তার ধূর্ততাও বাড়তে থাকল। এর পরে আর সে কক্ষনো ধরা পড়েনি।
সে চাইলে পূর্বপুরুষদের চারণভূমি ছেড়ে পালাতে পারত। কিন্তু তার শত্রুদের হাতে সব ছেড়ে পালাবার কোনো ইচ্ছেই যুবক খানের ছিল না। সে ছড়িয়ে—ছিটিয়ে থাকা তার গোত্রের লোকেদের কাছে গেল। খানদের সম্মানীস্বরূপ চারটি পশু চাইল। তার মায়ের জন্য একটি উট, ষাঁড়, ঘোড়া আর ভেড়া।
একটা ব্যাপার লক্ষণীয়, সে দুটো কাজ করা থেকে বিরত থাকল। বৌরতাই, ধূসর নয়না সেই মেয়েটি যে অপেক্ষায় আছে, কবে একজন এসে তাকে তার তাঁবুতে নিয়ে যাবে; বৌরতাইয়ের পিতা ছিলেন একজন শক্তিশালী গোত্রপতি, কিন্তু তিমুজিন তার কাছে গেল না।
আর গেল না তার পিতার বন্ধু, কারাইত তুর্কিদের গোত্রপতি প্রভাবশালী তঘরুল খানের কাছে। তঘরুল খানের সঙ্গে তার পিতার সন্ধি ছিল, তাদের কেউ একজন মারা গেলে অন্যজন তার সন্তানকে পোষ্য করে নেবে। খুব সহজ কাজ ছিল ঘোড়ায় চড়ে অল্প দূরের কারাইতদের কাছে পৌঁছা। তারা থাকত দেয়ালের ওপারে, সেখানে রয়েছে প্রচুর সম্পদ, দামি পাথর, বুনন করা কাপড়, আগ্নেয়াস্ত্র, এমনকি সোনার কাপড়ের তাঁবুও। কারাইতদের আরেকটি পরিচয় ছিল, তারা ছিল প্রিস্টার জনের লোক।
“ভিখিরির মতো খালি হাতে কারো কাছে যাওয়া মানে তার বন্ধুত্ব চাওয়া নয়, নিজেকে অথর্ব প্রমাণ করা” –এই ছিল তিমুজিনের যুক্তি।
এ তার আত্ম-অভিমান ছিল না, এ ছিল ইক্কা মঙ্গোলদের চিন্তার ধরন। প্রিস্টার জন তাকে সাহায্য করতে বাধ্য ছিলেন, কিন্তু তিনি শহরের এই শাসককে ততক্ষণ পর্যন্ত ব্যবহার করতে চাননি, যতক্ষণ না তিনি তার সামনে একজন বন্ধু হিসেবে দাঁড়াতে পারছিলেন, একজন পলাতক হিসেবে নন।
এর মাঝে তার আটটি ঘোড়া চুরি হয়ে গেল।
আটটি ঘোড়ার এই ব্যাপারটার অন্য একটি গুরুত্ব আছে। তাইজুতরা চুরিটা করেছিল। ঘোড়াগুলোকে পাহারা না দিয়ে নবম মাদী ঘোড়াটিতে চড়ে বেলগুতাই তখন ইঁদুর শিকারে বেরিয়েছিল। এই ঘোড়ায় চড়েই তারগোতাইয়ের কাছ থেকে তিমুজিন পালিয়েছিল।
ঘটনাটা খুবই ভয়ানক। এখন হঠাৎ আক্রমণ হলে একজন ছাড়া বাকি সবাইকে দৌড়ে পালাতে হবে। কেবল একজন ঘোড়ায় চড়ে পালাতে পারবে। বেলগুতাই খুঁজতে বেরুতে চাইল।
কাসার বলল, “তুমি পিছু নিতেও পারবে না, ধরতেও পারবে না। আমি যাব।” তিমুজিন বলল, “তুমিও খুঁজে পাবে না। আর পেলেও ওদের ফেরত আনতে পারবে না। আমিই যাব।”
একমাত্র ক্লান্ত মাদী ঘোড়াটি নিয়ে সে বেরিয়ে পড়ল। আটটি ঘোড়া আর ঘোড়সওয়ারদের সেই পায়ের চিহ্ন দেখে দেখে তাদের পিছু পিছু চলতে লাগল। সে তার সঙ্গে কিছু শুকনো মাংস নিয়েছিল আর সেগুলো গরম আর নরম রাখতে সেগুলো রেখেছিল ঘোড়ার স্যাডল ও পিঠের মাঝখানে। সমস্যা হয়ে দাঁড়াল তার মাদী ঘোড়াটির ক্লান্তি। পিছিয়ে পড়তে লাগল সে। তাইজুত চোররা কিছুক্ষণ পরে পরে ঘোড়া পাল্টাতে পারছে। ফলে ধীরে ধীরে তারা চোখের আড়াল হয়ে যেতে লাগল।
চতুর্থ সূর্যোদয়ের পরে একদিন রাস্তার পাশে সমবয়সী এক যোদ্ধার সঙ্গে এই বালক মঙ্গোলের দেখা হলো। ও তখন তার ঘোড়ীর দুধ দুয়াচ্ছিল।
“তুমি কি আটটা ঘোড়া নিয়ে কিছু লোককে যেতে দেখেছ?” তিমুজিন জানতে চাইলো।
“হ্যাঁ। ভোরের আগে ওদের সঙ্গে রাস্তায় দেখা হয়। কোনদিকে গেছে দেখিয়েও দিতে পারবো।” চামড়ার ব্যাগের মুখটা বেঁধে পাশে রাখতে রাখতে ছেলেটা বলল, “তোমাকে দেখে খুব ক্লান্ত আর চিন্তিত লাগছে। আমি বরচু। ঘোড়াগুলোর পিছু নিতে আমি তোমাকে সাহায্য করতে পারি।”
তিমুজিনের ক্লান্ত মাদী ঘোড়াটাকে ঘাস খেতে দিয়ে আর তার নিজের পাল থেকে একটা সাদা ঘোড়ায় জিন চড়িয়ে সে তিমুজিনকে দিল। তারা দুজনে পায়ের চিহ্ন দেখে পিছু নেয়া শুরু করল। তিনদিন চলার পরে তারা তাইজুতদের তাঁবুর দেখা পেল। ঘোড়াগুলো সামনেই ঘাস খাচ্ছে।
ঘোড়াগুলো নিয়ে তারা দুজন ফেরত আসতে শুরু করল। যোদ্ধারা টের পেয়ে তাদের পিছু নিল। ওদের একজন সাদা স্ট্যালিয়ানে চড়ে, হাতে ল্যাসো নিয়ে তাদের প্রায় কাছাকাছি চলে এলো।
বরচু তিমুজিনের ধনুকটা চাইল আর ঘুরে ধাওয়াকারীদের আক্রমণ করতে চাইল, কিন্তু তিমুজিনের তেমনটা ইচ্ছে করল না। তারা এভাবে ঘোড়াগুলোকে তাড়িয়ে প্রায় সন্ধ্যা পর্যন্ত চলার পর সেই চোরদের ল্যাসোর আওয়তায় আনতে পারল। তাদের ধরে ফেলতে তখন আর বাকি নেই।
“এই লোকগুলো আমাদের আঘাত করতে পারে।” তিমুজিন তার নতুন সহযোগীকে বলল। “আমাদের এখন তীর ব্যবহার করা ছাড়া উপায় নেই।”
এরপর ধনুকে তীর বসিয়ে তাদের পিছু নেয়া চোরটিকে লক্ষ্য করে চালাল সে। মোক্ষম নিশানা, ঘোড়ার ওপর থেকে ছিটকে পড়ে গেল সেই ধাওয়াকারী। অন্যরা যখন ব্যাপারটা দেখল তখন তারা নিজেদের লাগাম টেনে ধরল। বাকি পথে আর কোনো সমস্যা হলো না। সারারাত দ্রুত ঘোড়া চালিয়ে নিরাপদেই তারা ঘোড়াগুলোসহ বরচুর বাবার নিরাপদ আস্তানায় পৌঁছে গেল। দুধ ভর্তি ব্যাগটা খুঁজে বরচু ছুটল তার বাবার রাগ ভাঙাতে।
“ওর করুণ অবস্থা দেখে আমার মায়া লেগে গিয়েছিল। তাই ওর সঙ্গে গিয়েছিলাম” ব্যাখা শুরু করল বরচু। বেশ বড় একটা গোত্রের প্রধান তার বাবা। বেশ মজা নিয়েই তার পুত্র আর তিমুজিনের ঘোড়া খোঁজার গল্প শুনলেন। তারপর বললেন, “দেখো, তোমরা এখন বয়সে তরুণ, নিজেরা বন্ধু হয়ে থেকো আর নিজেদের কাছে বিশ্বস্ত থেকো।”
এরপর তারা বালক খানকে বেশকিছু খাবার আর এক ব্যাগ ঘোড়ীর দুধ দিল এবং তাকে তার পথে রওনা করিয়ে দিল। অল্প কিছুদিনের ভেতরই বরচু এর প্রতিদান হিসেবে পেয়েছিল পুরো পরিবারের আর গোত্রপতির জন্য কালো পশমি পোশাক।
তিমুজিন আনন্দিত হয়ে বলল, “তোমার সাহায্য না পেলে আমি এই ঘোড়াগুলো ফেরত পেতাম না। তাই অর্ধেক ঘোড়া তোমার।’
“আমি যদি তোমার কাছ থেকে আমার ভাগ নিয়েই নিই তাহলে আর আমরা বন্ধু থাকলাম কিভাবে?” প্রতিবাদ করলো বরচু।
তিমুজিন বা তার ভাইয়েরা কেউই কৃপণ ছিল না। উদারতা ছিল তাদের রক্তে। যারা তাদের সাহায্য করেছে তাদেরও যেমন মনে রেখেছে, যারা তাদের সঙ্গে যুদ্ধে নেমেছে তাদেরকেও। গোত্রের বাইরের সবাইকেই সে সম্ভাব্য শত্রু হিসেবে দেখত।
সে তার বন্ধুকে আশ্বস্ত করল, “যেভাবে একজন ব্যবসায়ী লাভের আশায় তার লোকদের বিশ্বাস করে, মঙ্গোলরা তাদের সৌভাগ্যের জন্য তেমনি কেবল সাহসিকতার ওপর ভরসা করে।”
অন্যান্য গোত্র, যেমন আরবদের মতো উদারতা আর নিষ্ঠুরতা দুটোই ছিল তার স্বভাবে। দুর্বল চরিত্রের লোকের তার প্রয়োজন ছিল না। নিজের গোত্রের বাইরে সবাইকেই সে সন্দেহের চোখে দেখত। সে শিখেছিল ধূর্ততা দিয়ে কীভাবে অসৎ শত্রুকে পরাস্ত করতে হয়। তবে কাউকে একবার কথা দিলে তা কখনো সে নড়চড় করত না।
তিমুজিনের মতে “কথার খেলাপ করা একজন শাসকের ধর্ম নয়।”
এক সময় যারা তার বাবার সঙ্গে ছিল, সেই যোদ্ধারা ধীরে ধীরে তার গোত্রে ফিরে আসতে শুরু করল। তার নেতৃত্ব নির্ভর করছিল শত্রুপক্ষকে আঘাতের কৌশলের ওপর আর যে করেই হোক তার অনুগামীদের অধিকারে থাকা চারণভূমিগুলো রক্ষা করার ওপর। উপজাতি নিয়ম অনুসারে গবাদিপশু আর অস্ত্র যার কাছে থাকে, সেগুলোর মালিকও সে, খান বা গোত্রপ্রধান নয়। ইয়েসুকির পুত্র হিসবে সে শুধু তাদের রক্ষার জন্য তাদের সাহায্য চাইতে পারে। নিয়ম হচ্ছে, তারা কেবল তখনই তাদের আরেকজন নেতা নির্বাচন করতে পারবে, যখন সেই যাযাবর এলাকায় প্রতিনিয়ত চলা যুদ্ধে তিমুজিন তাদের ঠিকমতো রক্ষা করতে অপারগ হবে।
তিমুজিনের ধূর্ততা আর তীক্ষ্ণ বুদ্ধি তাকে এখনো জীবিত রেখেছে। তার ক্রমবর্ধমান বুদ্ধিমত্তার কারণে তার গোত্র তাকে ঘিরে ধীরে ধীরে বড় হতে লাগল। শারীরিক শক্তি আর সতর্কতা— এই দুটো ছিল তার গুণ। কেরুলন আর অনন নদীর উর্বর একালায় থাকার সময় যে গোত্রপতি তাদের আক্রমণ করেছিল, তারা তাকে সে পাহাড় ছেড়ে সমতলে আসতে বাধ্য করেছিল, তবে তাকে আরো দূরে সরিয়ে দিতে পারেনি।
বলা হয়, “ধীরে ধীরে তার আর তার ভাইদের শক্তি বাড়তে থাকে।”
দেখতে দেখতে তিমুজিন সতেরো বছরে পা দিল। এবার সে তার বাগদত্তা বৌরতাইয়ের খোঁজে বের হলো। তার প্রথম স্ত্রী হিসেবে সে তাকে নিয়ে আসবে।
৩. গরুগাড়ির যুদ্ধ
উঁচু আর সাদা পাহাড়ের এই এলাকাগুলোতে দিন খুব দীর্ঘ হয়। তীরন্দাজ আর বর্বর এসব স্থানীয় মানুষের জীবনে সুন্দর রসিকতা আর আনন্দের ঘটনাও ঘটতো। আসলে এই রুক্ষ, শুষ্ক আর কঠিন জীবনে আনন্দের কোনো ঘটনা এলেই তারা তা প্রাণ ভরে উপভোগ করত। তিমুজিন আর তার মঙ্গোলদের খুব ভালোভাবে কেউ বুঝতে পারবে না, যদি সে না জানে, এদের হাস্যরসের গল্পগুলো অনেক সময় তাদের নিষ্ঠুরতার মতোই অতিরিক্ত হয়ে যেত। তাদের ভোজগুলো হয়ে উঠতো বিশাল এক অনুষ্ঠান।
বিয়ে আর মৃত্যু— এই দুইটি ঘটনায় বিরল ‘ইখুদুর’ বা উৎসব হতো। তিমুজিনের তার কয়েক শ সশস্ত্র সহচর নিয়ে অতর্কিতে বৌরতাইয়ের বাবার তাঁবুগ্রামে এসে হাজির হওয়া এমনই একটা আনন্দের ঘটনা ছিল। ভেড়ার চামড়ার জ্যাকেট পরা, পুরোপুরি অস্ত্রে সজ্জিত, গায়ে বর্ম। সঙ্গে পানির পাত্র। কাঁধের সঙ্গে আড়াআড়ি ঝুলছে বর্শা। ঠাণ্ডা বাতাস থেকে বাঁচতে মুখে লাগানো তেলে ধুলো জমে আছে।
যুবক খানকে স্বাগত জানিয়ে বৌরতাইয়ের বাবা বলল, “তোমার পরিবারের সঙ্গে ঘটে যাওয়া ভয়ঙ্কর ঘটনার কথা যখন শুনলাম, তারপর তোমরা যে বেঁচে আছো তা এভাবে প্রমাণ করবে, ভাবিনি।”
বিরল এক হাসি-ঠাট্টা-আনন্দ-কোলাহলের ঘটনা ঘটল। ভৃত্যরা ব্যস্ত হয়ে পড়ল ভেড়া আর ঘোড়ার মাংস রান্না করতে। মঙ্গোল যোদ্ধারা তাদের অস্ত্র তাঁবুর দরজার সামনে রেখে এলো। তারা তাঁবুর বয়স্কদের ডানদিকে বসে পড়ল। চলল পানাহার আর করতালি। পাত্রের তরল শেষ হওয়ার আগেই ভৃত্যরা এসে আবার ভর্তি করে দিতে লাগল। তারা গাঁজানো দুধ আর ভাত থেকে তৈরি সুরা যতটা পারে গলায় ঢালতে লাগল।
তৃতীয় দিনের ঘটনা। গোত্রপ্রধানের তাঁবুতে নববধূর সাজে বামদিকে বসে আছে বৌরতাই। সুন্দর লম্বা সাদা সিল্কের পোশাক, মাথায় রুপোর মুদ্রা আর ছোট মূর্তি দিয়ে তৈরি মুকুট। এখন তাকে নিয়ে যাওয়ার সময় হয়েছে। নববধূ ছুটে বেড়াবে আর তিমুজিন তার পিছু পিছু ছুটবে, কনের বোন আর নারী ভৃত্যদের সঙ্গে বচসা করবে। এরপর এক সময় সে নববধূকে বুঝিয়ে রাজি করিয়ে তার ঘোড়ায় চড়াবে। তখন সব শান্ত হবে।
এটি ছোট্ট একটি ‘ইখুদুর’ বা উৎসব। ছোট্ট নাকের সুন্দরী তার তাঁবুগ্রাম ছেড়ে, তিমুজিনের পাশে আরেকটি ঘোড়ীতে চড়ে চলে যাবে। চার বছর ধরে সে এই ক্ষণের অপেক্ষায় ছিল। এই কিশোরী আজ তেরো বছরের হলো।
এভাবে সে চলতে শুরু করল। বুক আর কোমর আবৃত করে আছে নীল রঙের বর্ম। নববধূর সঙ্গে আসা দাসীদের সঙ্গে রয়েছে পশুর চামড়ায় তৈরি আলখাল্লা। এটি তিমুজিনের মাকে উপহার দেয়া হবে। এখন সে খানের স্ত্রী। এখন তার কাজ তার ‘ইয়ার্ট’ বা তাঁবুর দেখাশোনা করা, যদি প্রয়োজন হয় গবাদিদের দুধ সংগ্রহ করা, পুরুষরা যখন যুদ্ধে যাবে তখন এসব গবাদিপশুর পালকে দেখাশোনা করা, তাঁবু তৈরির পশমি কাপড় তৈরি করা। পুরুষদের জন্য পোশাক সেলাই করা, জুতা আর মোজা তৈরি করা।
যদিও এই ছিল তার প্রাত্যহিক কাজ। তবে তার জন্য অপেক্ষা করছিল আরো বড় এক প্রাপ্তি। ইতিহাসে তার পরিচিতি হবে সম্রাজ্ঞী বৌরতাই হিসেবে। রোম সাম্রাজ্যের চেয়েও বড় সাম্রাজ্য শাসন করা তিন সন্তানের জননী হিসেবে।
পশুর চামড়ার তৈরি আলখাল্লাটিরও একটা নিয়তি ছিল। তিমুজিন ঠিক করল, কারাইতদের তঘরুলের সঙ্গে এবার দেখা করা যায়। সঙ্গে কিছু তরুণ আর উপহার হিসেবে পশুর চামড়ার আলখাল্লাটা নিয়ে সে রওনা হলো।
তঘরুল খান শান্তিপ্রিয় আর নীতিবান মানুষ ছিলেন। তিনি নিজে যদিও খ্রিস্টান ছিলেন না, তবে তার গোত্রের অধিকাংশই ছিল নেরিয়ান খ্রিস্টান। এরা প্রথমদিকের ধর্মযাজক সেন্ট অ্যান্ড্রু আর থমাস-এর কাছে দীক্ষা নিয়েছিল। বর্তমানে যেখানে উরগা শহর, নদীবাহিত সেই এলাকা ছিল তাদের দখলে। তুর্কি বংশোদ্ভূত হওয়ায় তারা মঙ্গোলদের তুলনায় অনেক বেশি ব্যবসায়ী মনোবৃত্তির আর শৌখিন ছিল।
তঘরুলের দরবারে তিমুজিনের সেটি প্রথম আগমন। অনেকটা পালক পিতার অবস্থানে থাকা এই শক্তিধর কারাইতের কাছে কোনো সাহায্য তিনি চাইলেন না। ফিরে যাওয়ার সময় তাই তাদের দুজনের মধ্যকার বন্ধন সম্পর্কে তঘরুল নিজে থেকেই মনে করিয়ে দিলেন।
অবশ্য খুব শিগগিরই এই বৃদ্ধ খানের বন্ধুত্বের প্রয়োজন পড়ল তিমুজিনের। গোবি এলাকায় নতুন করে পুরনো সংঘাত জেগে উঠল। উত্তরের সমতলভূমি থেকে ভয়ঙ্কর এক উপজাতি এসে মঙ্গোল শিবির আক্রমণ করল। এরা ‘মেরকিট’ বা ‘মেরুগান’ উপজাতি। তুন্দ্রা অঞ্চল বাস করা সত্যিকারের যাযাবর এরা। কঠিন শীতে, কুকুরচালিত ‘স্লেজে’ চলাফেরা করা এই উপজাতিটি ভীষণ রকমের দুধর্ষ।
সবদিক দিয়েই দুধর্ষ যোদ্ধাদের নিয়ে গড়া এই উপজাতি। প্রায় আঠারো বছর আগে তিমুজিনের বাবা এই উপজাতির কাছ থেকে হৌলুনকে ছিনিয়ে নিয়ে এসেছিলেন। খুব সম্ভবত এখনো তারা সেই অপমান ভোলেনি। তারা এক রাতে এলো আক্রমণ করতে। হাতে জ্বলন্ত মশাল নিয়ে তারা যুবক খানের তাঁবুতে হামলা করল।
তিমুজিন কোনোরকমে তার ঘোড়া নিয়ে তীরধনুকসহ পালিয়ে নিরাপদ স্থানে সরে যেতে পারলেন। ধরা পড়ে গেলেন বৌরতাই। উপজাতীয় সমাধান হিসেবে তাই নববধূকে তুলে দেয়া হলো সেই লোকের উত্তরাধিকারীর হাতে, যে হৌলুনকে হারিয়েছিল।
উত্তরের সেই যোদ্ধা খুব বেশি সময় মঙ্গোলপত্নীর অবস্থান উপভোগ করতে পারেনি। মেরকিটদের আক্রমণ করার মতো যোদ্ধা তখন তিমুজিনের কাছে না থাকায়, তিনি গেলেন তার পালক পিতা খ্যাত তঘরুলের কাছে, আর কারাইতদের সাহায্য চাইলেন। তার অনুরোধ সঙ্গে সঙ্গে গৃহীত হলো। এক চাঁদনী রাতে মঙ্গোল এবং কারাইতরা সম্মিলিতভাবে মেরকিটদের গ্রামে আক্রমণ চালাল।
গল্পকাররা এভাবে বর্ণনা করেছেন—তিমুজিন বিধ্বস্ত তাঁবুগুলোর পাশে যাচ্ছেন আর তার হারানো স্ত্রী বৌরতাইয়ের নাম ধরে চিৎকার করে ডাকছেন। তার আওয়াজ শুনে বৌরতাই দ্রুত বেরিয়ে এলেন আর তার লাগাম টেনে ধরলেন। এবার তিনি তাকে চিনতে পারলেন। ঘোড়া থেকে নেমে সব সাথী যোদ্ধাদের উদ্দেশে বললেন, “আমরা যা চেয়েছিলাম, তা পেয়ে গেছি।”
যদিও খুব নিঃসন্দেহে বলা যায় না বৌরতাইয়ের প্রথম সন্তান তার ঔরসজাত কিনা, তবে বৌরতাইয়ের প্রতি তিমুজিনের ভালোবাসার ব্যাপারে কোনো ভ্রান্তি ছিল না। তিনি কখনোই বৌরতাইয়ের গর্ভজাত সন্তানদের প্রতিপালনে কোনো পার্থক্য করেননি। অন্য স্ত্রী এবং সেসব স্ত্রীর ঘরে সন্তান থাকলেও তাদের সম্পর্কে খুব ভালো জানা যায় না। এমন অনেক সময় এসেছে যখন বৌরতাইয়ের অনুমান তার জীবন বাঁচিয়েছে। আমরা দেখতে পাই ভোরবেলা, তিমুজিনের বিছানার পাশে তিনি বসে আছেন আর কাঁদছেন।
মরুভূমির এই গোত্রগুলোর মাঝে চিরস্থায়ী কোনো সমঝোতা কখনোই হয় না। তখনো মঙ্গোলরা ছিল মহাপ্রাচীরের ওপারে অনুর্বর এলাকায় থাকা উপজাতিগুলোর মধ্যে সবচেয়ে দুর্বল। তঘরুলের নিরাপত্তা কিছুদিন তাদেরকে সবচেয়ে পশ্চিমের প্রায় সব উপজাতির আক্রমণ থেকে রক্ষা করেছিল। তবে তাইজুত আর বায়ার হ্রদের তাতার উপজাতি দারুণ শত্রুতা আর তিক্ততা নিয়ে তার ওপর পূর্ব দিক থেকে হামলা চালাল। সুঠাম শারীরিক গড়ন আর বিপদ বুঝবার মতো নেকড়েসুলভ ধূর্ততা তখনো তাকে জীবিত রেখেছিল।
(তাতাররা ছিল আলাদা একটি উপজাতি। প্রথমদিকে যেসব ইউরোপীয় সেখানে গিয়েছিল তারা ভুল করে তাতারদেরকে মঙ্গোল ভেবেছিল। মঙ্গোল খানদের রাজত্বকে তারা ‘তাতারীয়’ রাজত্ব বলত। এই শব্দের উৎপত্তি চীনা ভাষা থেকে। এর অর্থ ‘পশমি পোশাক পরিহিত লোক’। যদিও তাতাররা নিজেদের যোগ্যতায় ‘তাতুর’ নামের এক গোত্রের সৃষ্টি করে)।
একবার তিমুজিন গলায় তীরের আঘাতে আহত হয়ে মুমূর্ষু অবস্থায় বরফের মধ্যে পড়ে ছিলেন। দুইজন সহযোদ্ধা তাকে খুঁজে পায়। তার ক্ষত থেকে রক্ত চুষে, বরফ গলিয়ে, সেই পানি দিয়ে তার ক্ষত ধুয়ে তারা তাকে বাঁচিয়ে তোলে। তবে এই উদ্ধার ছিল পারস্পরিক সাহায্যের অংশ। কারণ তারা একসঙ্গে গিয়েছিল শত্রুর তাঁবু থেকে খাবার চুরি করতে। আর তখনই তিনি আক্রান্ত হয়েছিলেন। সমতলে নেমে আসার পর যখন খুব তুষার ঝড় শুরু হলো, তখন তার ঘুমন্ত শরীরের ওপর একটা চামড়ার আলখাল্লা চাপিয়ে দেয়া হলো।
আপাত বন্ধুত্ব আছে, এমন এক গোত্রের গোত্রপতির তাঁবুতে তিমুজিন একবার গিয়েছিলেন। তিনি দেখলেন, একটা গর্তের ওপর খুব সাধারণভাবে সেখানে একটা কার্পেট বিছানো। তার ওপরে তাদের বসতে বলা হলো। কার্পেটের নিচে যে গর্ত খোঁড়া আছে, সে কথা তিমুজিন তার সহযোদ্ধাদের ডেকে জানিয়ে দিলেন। এক মহাবিপদ থেকে পুরো গোত্রকে সেদিন তিনি বাঁচিয়ে দিয়েছিলেন।
মঙ্গোলরা এখন বেশ শক্তিশালী, তাদের রয়েছে প্রায় তেরো হাজার যোদ্ধা। বিশাল উপত্যকা জুড়ে তাদের বাস। তাদের আচ্ছাদিত গাড়ি, কিবিতকাস বা ‘তাঁবু গাড়ি’ আর গবাদি নিয়ে দিন বেশ চলছিল। এমন সময় একদিন খানের কানে খবর এলো যে, দিগন্তরেখায় একদল যোদ্ধা দেখা যাচ্ছে। তারা খুব দ্রুত তাদের দিকে এগিয়ে আসছে।
তারাগোতাই-এর নেতৃত্বে ‘তাইজুত’দের প্রায় ত্রিশ হাজার শত্রুসেনা এবার তার শত্রু। এখন পালানো মানে মহিলা, গবাদিপশু আর গোত্রের সব সম্পদ হাতছাড়া হওয়া। অন্যদিকে তার সৈন্যদের একত্র করে তাইজুতদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে এগিয়ে যাওয়া মানে ওদের অধিকসংখ্যক সেনার হাতে খুব সহজেই ঘেরাও হয়ে যাওয়া। এরপরে চলবে কচু কাটা হওয়া, নয়তো ছত্রভঙ্গ হওয়া।
এই সমস্যায় প্রতিটি উপজাতিকেই পড়তে হয়। আর এভাবেই গোত্রগুলো ধ্বংস হয়। তাই খানকে এখন তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত আর কর্মপন্থা ঠিক করতে হবে।
তিমুজিন দ্রুত নিজস্ব ঢঙে সমস্যা মোকাবেলা করলেন। তার যোদ্ধারা ততক্ষণে ঘোড়ায় চড়ে বিভিন্ন পতাকার নিচে একত্রিত হয়ে গেছে। তাদেরকে তিনি সারিবদ্ধ দলে সাজালেন। তাদের এক প্রান্ত জঙ্গলের কারণে আড়ালে থাকছে। অন্য প্রান্তে তিনি বেশ বড় একটা চতুষ্কোণ তৈরি করলেন-—যার মধ্যভাগ ফাঁকা গবাদিগুলোকে তিনি এই চতুষ্কোণের ভেতরে প্রবেশ করালেন আর দ্রুত ঘোড়াগাড়ির ভেতরে প্রবেশ করিয়ে দিলেন মহিলাদের। তীরন্দাজ বালকদেরও তাদের সাথে গাড়িতে রাখলেন।
এভাবে তিনি দ্রুত এগিয়ে আসা ত্রিশ হাজার সৈন্যকে মোকাবেলা করতে প্রস্তুত হলেন। ওরা এখন উপত্যকা পার হচ্ছে। এগিয়ে আসা শত্রুসেনারা ছিল পাঁচ শ সৈন্যের একেকটি স্কোয়াড্রনে বা দলে বিভক্ত। এক সারিতে একশ জন, এমন পাঁচ সারি। প্রথম দুই সারিতে যারা আছে, তারা লোহার ভারী বর্ম পরিহিত, মাথায় লোহার শিরস্ত্রাণ। ঘোড়াগুলোর কাঁধ, বুক আর ঘাড়ও চামড়া দিয়ে ঢাকা। যোদ্ধাদের হাতে রয়েছে ছোট গোলাকার ঢাল আর ভারী বল্লম।
এক সময় সামনের সারির এই যোদ্ধারা থেমে পড়ল আর পেছনের সারির যোদ্ধারা এগিয়ে গেল। তেজস্বী ঘোড়ায় চড়া এইসব যোদ্ধার হাতে হালকা বর্শা। গায়ে শুকনো চামড়ার তৈরি পোশাক। বর্শা ছুড়তে ছুড়তে তারা মঙ্গোল যোদ্ধাদের সামনে চলে এলো।
তিমুজিনের যোদ্ধারাও একই রকমের অস্ত্র আর পোশাকে সজ্জিত। তাদের মোকাবেলা করতে হচ্ছিল শক্তিশালী ধনুক থেকে আসা তীরের বৃষ্টি।
হাতাহাতি যুদ্ধ থেমে গেল— যখন তাইজুতদের হালকা পদাতিক বাহিনী পিছিয়ে গিয়ে সশস্ত্র সম্মুখ বাহিনীর পেছনে অবস্থান নিল। এরপরে সবাই একযোগে সামনে এগোতে লাগল।
তখন তিমুজিন তার যোদ্ধাদের ছেড়ে দিলেন আর তাদের মোকাবেলা করতে দিলেন। তবে তিনি তার সেনাদলকে সজ্জিত করেছিলেন দ্বিগুণ সংখ্যার দলে। হাজারের দলে, দশ সারি গভীর। যদিও তার মাত্র তেরো হাজার সৈন্য দিয়ে তৈরি হলো মাত্র তেরোটি দল। প্রত্যেক দলে এক হাজার সৈন্য। আর তাইজুতদের ষাটটি। তার এই সরু এবং গভীর সম্মুখভাগের কারণে তাইজুতদের অগ্রযাত্রা থেমে গেল। তারা ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল।
তিমুজিন এবার ভারী অস্ত্র নিয়ে হালকা অস্ত্রধারী শত্রুসেনাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন। মঙ্গোলরা ছড়িয়ে পড়ে তাদের ঘিরে ফেলতে লাগল। আবার পতাকা অনুসরণ করে এগিয়ে যেতে লাগল, আর দুই হাতে শুরু করল তীর ছোড়া।
সেই চারণভূমিতে শুরু হলো ভয়ঙ্কর এক যুদ্ধ। অশ্বারোহী উপজাতিরা রাগে চিৎকার করছে আর তীরের বৃষ্টির ভেতর দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। ল্যাসো ছুড়ে ঘোড়া থেকে যোদ্ধাদের ফেলে দিচ্ছে। প্রত্যেকটি দলই আলাদা আলাদা নেতৃত্বে যুদ্ধ করল। উপত্যকার সর্বত্র যুদ্ধ চলতে লাগল। ধাওয়া খেয়ে যোদ্ধারা কখনো ছড়িয়ে পড়ছে, আবার একত্র হয়ে আক্রমণ করছে।
দিনের আলো হালকা না হওয়া পর্যন্ত যুদ্ধ চলল। তিমুজিনের নির্ণায়ক জয় হলো। পাঁচ থেকে ছয় হাজার সৈন্য ধরা পড়ল। সত্তর জন গোত্রপ্রধানকে অস্ত্রসহ তার সামনে পেশ করা হলো।
কোনো কোনো সূত্রমতে মঙ্গোল খান সত্তরজন গোত্রপ্রধানকে সেখানেই জীবন্ত সিদ্ধ করে মারেন— ভয়ঙ্কর নিষ্ঠুরতার এক নিদর্শন। যুবক খানের মনে দয়া খুব কমই ছিল, তবে সক্ষম যুদ্ধবন্দিদের মূল্য তিনি জানতেন, এও জানতেন কীভাবে তাদের কাজে লাগাতে হয়।
৪. তিমুজিন এবং একটি উচ্ছ্বাস
লাল চুলের মঙ্গোলদের খান তার জীবনের প্রথম যুদ্ধ করলেন এবং জয় পেলেন। তিনি যদি চান তবে এখন একজন সফল সেনাপ্রধানের নিদর্শন হিসেবে হাতির দাঁতের তৈরি রাজদণ্ড সঙ্গে রাখতে পারেন।
মানুষকে নিজের জন্য কাজ করানোর ব্যাপারে তার একটা দুর্বলতা ছিল। সন্দেহ নেই এই দুর্বলতার শুরু তার প্রথম জীবনের দুঃখকষ্ট থেকে, যখন বরচু তাকে সাহস দিয়েছিল আর কাসার-এর তীর তার জীবন বাঁচিয়েছিল।
কিন্তু রাজনৈতিক শক্তি কিংবা প্রাচুর্যকে তিমুজিন নিজের শক্তি মনে করতেন না। রাজনৈতিক শক্তির দেখা এখনো তিনি পাননি, আর ধন সম্পদ যে কোনো কাজে আসে না তাও তিনি দেখেছেন। মঙ্গোল হিসেবে তার কেবল সেসব জিনিসই চাই, যেসব তার দরকার। তার মতে শক্তি হচ্ছে জনশক্তি। যখন তিনি তার সাহসী বীরদের প্রশংসা করতেন, তখন বলতেন যে, তারা পাথর ভেঙে ধুলো করে ফেলেছে, খাড়া শৃঙ্গকে উল্টে দিয়েছে কিংবা বিশাল জলস্রোত থামিয়ে দিয়েছে।
সর্বোপরি তিনি খুঁজতেন ‘আনুগত্য’। বিশ্বাসঘাতকতা তার কাছে ছিল অমার্জনীয় পাপ। একজন বিশ্বাসঘাতক একটা গ্রাম ধ্বংস করে দিতে পারে আর পুরো একটা গোত্রকে ফাঁদে ফেলতে পারে। গোত্রের প্রতি বা বলা যায় খানের প্রতি আনুগত্যই ছিল তার শেষ চাওয়া। “এমন লোককে কী বলা যায় যে সকালে একটা প্রতিজ্ঞা করে, আর রাত হতেই সেটা ভুলে যায়?”
তার প্রার্থনায় সব সময় থাকত তার লোকেদের দীর্ঘায়ু কামনা। মঙ্গোলরা খালি পায়ে পর্বতশৃঙ্গে উঠতে অভ্যস্ত ছিল। তারা বিশ্বাস করত এই শৃঙ্গ হচ্ছে ‘তুংরি’-এর আবাসস্থল। ‘তুংরি’ হচ্ছে ওপর আকাশের সেই শক্তি, যার কারণে ঘূর্ণিঝড় আর বজ্রপাত হয়। কাঁধের ওপর মাথা ঘুরিয়ে, বাতাসের চার কোণের দিকে তাকিয়ে প্রার্থনা করতেন, “অসীম স্বর্গ, আমাকে সাহায্য করো, তোমার ওপরের বাতাসের শক্তি পাঠিয়ে আমাকে অনেক বন্ধু পরিবেষ্টিত করে পৃথিবীতে এমন মানুষ পাঠাও যারা আমাকে সাহায্য করতে পারে।
ধীরে ধীরে তার পতাকা ‘নাইন ইয়াক টেইল’-এর নিচে বিপুলসংখ্যক অনুগামী জড়ো হতে লাগল। কেবল কয়েকটি পরিবার নয়, এখন তার গোত্রে রয়েছে শত শত পরিবার। ভবঘুরে গোত্ররা, যারা এখন তার শত্রু, তারাও তিমুজিন আর মঙ্গোলদের স্বভাব নিয়ে আলাপ করত, “যুদ্ধ জয়ের পরে সবাইকেই তিমুজিন লুট করা সম্পদের ভাগ দিতেন। শিকার করে আনা পশু শিকারিকেই দিয়ে দিতেন। কখনো ঘোড়া থেকে নেমে গায়ের কোট খুলে নিয়ে এগিয়ে যেতেন। কোটটা দিয়ে দিতেন অভাবী কাউকে।”
মঙ্গোল খান যেভাবে এই যাযাবরদের প্রশংসা করতেন সেভাবে কোনো ইতিহাসবিদই তাদের কৃতিত্বকে স্বাগত জানাননি।
একবার তিনি তার রাজসভায় এক জমায়েতের মাঝে ছিলেন, কোনো সভাসদ বা রাজকর্মচারী ছাড়া, কেবল সেনারা। সঙ্গে ছিলেন বরচু আর কাসার, তার দুই ভাই। আর ছিল লুট (এক ধরনের বাদ্যযন্ত্র) বাদক অর্জুন, তার দুই সেনাপতি বায়ান আর মুহুলি। বিচার চলছে অর্থুনের। আর ছিলেন সু, বিখ্যাত ক্রসবো (এক ধরনের ধনুক) চালক।
অর্জুন সভাসদ না হলেও যোদ্ধা ছিল। আমরা তার সম্পর্কে একটা ধারণা পাই এই তথ্য থেকে যে, সে খানের প্রিয় সোনার একটা ‘লুট’ ধার নিয়েছিল আর সে সেটা হারিয়ে ফেলেছিল। খান এতে প্রচণ্ড রেগে গেলেন আর দুজন লোককে পাঠালেন তাকে হত্যা করতে। তারা তা না করে অর্জুনকে মদ খাইয়ে বেহুঁশ করে সারাদিন লুকিয়ে রাখল। পরদিন সকালে জ্ঞান ফিরলে তারা তাকে ঘুম থেকে ওঠালো আর তাকে খানের তাঁবুর প্রবেশদ্বারের সামনে নিয়ে গেল। সূর্য তখন ‘অরদু’ বা তাঁবুগ্রামের কেন্দ্রের ওপরে উঠে গেছে, “ও খান দরজা খুলুন আর আমার প্রতি আপনার ক্ষমা প্রদর্শন করুন।”
নীরবতার সুযোগে অর্জুন তাঁবুতে ঢুকেই মিষ্টি স্বরে গান ধরল। গানের কথায় ছিল খানের প্রশংসা আর ক্ষমা প্রার্থনা। জানাল সে চুরি করেনি।
যদিও খানের আইনে চুরির শাস্তি ছিল মৃত্যুদণ্ড, তবুও অর্জুনকে ক্ষমা করা হয়। সেই সোনার লুটের কী হয়েছিল তা আজ পর্যন্ত রহস্যই রয়ে গেছে।
খানের এসব বীরেরা পুরো গোবি এলাকায় ‘কিয়াত’ বা ‘এগিয়ে আসা স্রোত’ নামে পরিচিত। এদের মধ্যে দুজন, যারা তখন নেহাতই বালক ছিল, যারা পরে বিশাল এলাকাজুড়ে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছিল, তাদের একজন ছিল দুর্দান্ত তীরন্দাজ, খেপ নয়ন আর অন্যজন দুর্দান্ত সাহসী, সুবোতাই বাহাদুর।
খেপ নয়ন প্রথমে দৃশ্যপটে আসেন এক শত্রু গোত্রের যুবক হিসেবে। একবার এক আক্রমণের পরে খেপ নয়নকে তাড়া করে তিমুজিনের মঙ্গোল বাহিনী ঘিরে ফেলে। তার কাছে কোনো ঘোড়া ছিল না। তিনি একটা ঘোড়া চাইলেন আর মঙ্গোলদের ভেতর যে কোনো একজনের সাথে যুদ্ধ করতে চাইলেন। তিমুজিন তার প্রস্তাব মেনে নিলেন। তাকে দেয়া হলো সাদা নাকওয়ালা দ্রুতগামী একটা ঘোড়া। ঘোড়ায় চড়েই খেপ মঙ্গোল ঘেরাও-এর ফাঁক গলে বেরিয়ে যেতে সক্ষম হন এবং এরপরে তিনি পালিয়ে যান। এক সময় তিনি আবার ফিরে আসেন আর জানান যে, তিনি মঙ্গোলদের দলে আসতে চান।
অনেকদিন পরে, যখন তিয়ান শান দিয়ে খেপ নয়ন ঘোড়া ছুটিয়ে ব্ল্যাক ক্যাথির ঘুচলুককে ধরতে যাচ্ছিলেন, তখন তিনি সাদা নাকের এক হাজার ঘোড়া তাড়িয়ে নিয়ে আসে আর সেগুলো খানকে উপহার হিসেবে পাঠিয়ে দেন। বুঝিয়ে দেন, তিনি সে ভোলে নি তার সেই প্রাণ ভিক্ষার কথা।
উরিয়াঙ্খির সুবোতাইয়ের ঘটনাটা এতটা তাৎক্ষণিক না হলেও বেশ তীক্ষ্ণ বুদ্ধির। সুবোতাইয়ের ভেতর ছিল কোনো উদ্দেশ্য সাধনের জন্য তিমুজিনের মতো দৃঢ়তা। তাতারদের সঙ্গে যুদ্ধ শুরু করার আগে, প্রথম আঘাতের নেতৃত্ব দেয়ার জন্য খান একজন সেনাকে চাইলেন। সুবোেতাই এগিয়ে এলেন। তিমুজিন খুশি হয়ে তার সাহসের প্রশংসা করলেন। বললেন, দেহরক্ষী হিসেবে নিজের ইচ্ছেমতো এক শ’জন সেনাকে বেছে নাও।
সুবোতাই উত্তর দিলেন যে, তার কোনো সঙ্গী প্রয়োজন নেই। তিনি মূল সেনাদল এগিয়ে যাওয়ার আগে, একাই যেতে চান।
তিমুজিন যদিও সন্দেহ করলেন, তারপরও তাকে যাওয়ার অনুমতি দিলেন। সুবোতাই তাতারদের ছাউনিতে এই ব্যাখ্যা নিয়ে হাজির হলেন যে, তিনি খানদের ছেড়ে এসেছেন আর তাদের গোত্রের সঙ্গে যোগ দিতে চান। তাদেরকে তিনি বিশ্বাস করালেন যে মঙ্গোলরা কাছাকাছি নেই। ফলে মঙ্গোলরা যখন তাদেরকে আক্রমণ করল তখন তাতাররা একেবারেই প্রস্তুত ছিল না আর তাই সহজেই ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল।
সুবোতাই যুবক খানের কাছে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, “ফেল্ট কাপড় যেমন বাতাস থেকে রক্ষা করে, আমি আপনার জন্য তা-ই করব, আমি তেমন করেই আপনাকে শত্রুর হাত থেকে রক্ষা করব।”
তার সাহসী বীরেরা তাকে আশ্বস্ত করেছিল, “যখন আমরা সুন্দরী নারী আর দুর্দান্ত স্ট্যালিয়ন ধরব, আমরা তার সবটাই আপনার কাছে নিয়ে আসব। আমরা যদি আপনার আদেশ অমান্য করি বা আপনার কোনো ক্ষতি করি, তবে আমাদের শাস্তি দেয়ার জন্য আমাদেরকে বন্য আর ঊষর জায়গায় ফেলে আসবেন।”
তিমুজিন তার যোদ্ধাদের উত্তর দিয়েছিলেন, “তোমরা যখন আমার কাছে আসো, তখন আমি ছিলাম একজন ঘুমন্ত মানুষ, আমি মনের দুঃখে বসে ছিলাম, তোমরা আমাকে এসে জাগিয়েছ।”
তিনি যা ছিলেন অর্থাৎ ইক্কা মঙ্গোলদের খান, তার জন্যই তারা তার প্রশংসা করত। আর তিনি প্রত্যেক বীরের প্রশংসা আর সম্মানকে আলাদাভাবে মর্যাদা দিতেন। তাদের প্রত্যেকের চরিত্রকে আলাদাভাবে বিচার করতেন।
তিনি বললেন, “এখন থেকে বরচু গোত্রপ্রধানদের জমায়েত বা কুরুলতাইয়ে আমার সবচেয়ে কাছে বসবে আর এখন থেকে সে সেই কয়জনের অন্তর্ভুক্ত, যারা তার তীর আর ধনুক বহন করার অধিকারপ্রাপ্ত।” অন্যদের দায়িত্ব ছিল খাবার সরবরাহ, গবাদিপশুর দেখাশোনা। কারো দায়িত্বে ছিল ‘কিবিকাস’ বা তাঁবুগাড়িগুলো আর ভৃত্যরা। কাসারের ছিল দারুণ শারীরিক শক্তি আর তিনি মানুষের মধ্যে ভেদাভেদ করতেন না। তিনি দায়িত্ব পেয়েছিল তরবারি রাখার।
তিমুজিন তার সেনাদের ভেতর খুব বিচক্ষণতার সঙ্গে দায়িত্ব ভাগ করতেন। সশস্ত্র সেনাবাহিনীর সেনাপ্রধান নির্বাচনও করতেন ভেবেচিন্তে। তিনি ধূর্ততার মূল্য জানতেন। জানতেন কখন নিজের রাগকে বশে রেখে মোক্ষম সময়ের জন্য অপেক্ষা করতে হয়। আসলে ধৈর্য ছিল মঙ্গোল চরিত্রের একটা অন্যতম বৈশিষ্ট্য। সাহসীদের তিনি দায়িত্ব দিতেন গোত্রের দৈনন্দিন চাহিদার যোগান নিশ্চিত করার আর বোকাসোকাগুলোকে রাখতেন গবাদিপশুগুলো দেখাশোনার দায়িত্বে।
একজন নেতা সম্পর্কে তার বক্তব্য ছিল, “তোমাদের মধ্যে ইয়েসোতাইয়ের মতো বীর আর কেউ নেই, তার মত দুর্লভ গুণ কারো নেই। কিন্তু যেহেতু লম্বা যাত্রাও তাকে ক্লান্ত করে না, তার ক্ষুধাও পায় না, তৃষ্ণাও পায় না, তাই সে মনে করে তার সেনাদেরও এমনটাই লাগে। আর তাই সে নেতা হওয়ার যোগ্য নয়। একজন নেতাকে সব সময় তার সেনাদের ক্ষুধা, তৃষ্ণার চিন্তা করা উচিত, তাহলে সে তার অধীনে থাকা সেনাদের কষ্ট বুঝতে পারবে। তবেই সে তার সেনাদের আর পশুদের সামর্থ্যের খেয়াল রাখতে পারবে।”
‘বিষাক্ত যোদ্ধাদের’ এই রাজসভার ওপর নিজের কর্তৃত্ব বজায় রাখতে এই যুবক খানের তাই জরুরি ছিল স্থির সিদ্ধান্ত আর সবার ভেতর সমতা রক্ষা করে চলার। তার পতাকাতলে আসা কোনো গোত্রপ্রধান একজন জলদস্যুর মতোই অবিশ্বাসী হতো। একটা গল্প চালু আছে কীভাবে একবার বৌরতাইয়ের বাবা তার অনুসারী আর সাত পুত্রকে সঙ্গে নিয়ে খানের সামনে নিজেকে উপস্থাপন করতে এসেছিলেন। উপহার বিনিময়ের পরে সাত পুত্র মঙ্গোলদের মাঝে বসল। কোনো দিক থেকেই তিক্ততার কিছু ছিল না। এদের ভেতর একজনের নাম ছিল টিবেংরি। সে ছিল একজন ‘শামান’ বা আধ্যাত্যিক ক্ষমতার অধিকারী। ‘শামান’ হওয়ার কারণে বিশ্বাস করা হতো যে সে তার ইচ্ছেমতো শরীর থেকে বের হতে পারে আর আধ্যাত্মিক জগতে প্রবেশ করতে পারে। সে ছিল একজন পয়গম্বর বিশেষ
টিবেংরির ভেতর ছিল ভয়ানক উচ্চাভিলাষ। সে এবং তার কয়েকজন ভাই মিলে কয়েক দিন বিভিন্ন গোত্রপতির তাঁবুতে অবস্থান করে। তার ভাই কাসারকে ধরে ঘুষি মারে আর বেধড়ক লাঠিপেটা করে।
ক্ষুব্ধ কাসার খান তিমুজিনের কাছে নালিশ জানালেন।
তার ভাই উত্তর দিলেন, “তুমিই তো গর্ব করে বলেছিলে কেউ শক্তি আর বুদ্ধিতে তোমার সমান নয়। এরপরও এরা তোমাকে মারল কী করে?”
ক্ষুব্ধ-অপমানিত কাসার নিজের তাঁবুতে ফিরে এলেন আর তিমুজিনের কাছ থেকে দূরে দূরে থাকতে লাগলেন। এই সুযোগে টিবেংরি খানকে জানাল, “আমি আমার আধ্যাত্মিক ক্ষমতাবলে অন্য দুনিয়া থেকে খবর পেয়েছি। আর এই খবর এসেছে স্বর্গ থেকে। তিমুজিনের রাজত্ব ব্যস আর কিছুদিনের। কিন্তু এরপরে কাসার রাজত্ব করবে। যদি তুমি কাসারকে শেষ না করো, তবে তোমার রাজত্ব আর বেশি দিন টিকবে না।”
টিবেংরির ধূর্ততা খানের ওপর প্রভাব ফেলল। তিনি ভুলতে পারলেন না এই খবর একজন আধ্যাত্মিক ক্ষমতাধর লোকের দেয়া। সেই দিন সন্ধ্যায় কিছুসংখ্যক অনুসারী নিয়ে তিমুজিন তার ছোট ভাই কাসারকে বন্দি করে ফেললেন। এই কথা তাদের মা হৌলুনের কানে গেল। তার ভৃত্যদের বললেন দ্রুতগামী উটের গাড়ি তৈরি করতে আর দ্রুত ছুটলেন তিমুজিনের পেছনে।
কাসারের তাঁবুতে পৌঁছলেন আর ঘিরে রাখা সৈন্যদের ভেদ করে দ্রুত এগিয়ে গেলেন। প্রধানের তাঁবুতে পৌঁছে দেখলেন কাসার তিমুজিনের মুখোমুখি। কাসারের হাত পিছমোড়া করে বাঁধা, হাঁটুর ভারে বসে আছে। তার টুপি আর কোমরবন্ধ খুলে রাখা হয়েছে। খান ভয়ানক ক্রুদ্ধ আর ছোট ভাইয়ের চোখে তখন মৃত্যুভয়।
হৌলুন ছিলেন দৃঢ়চিত্তের মহিলা। তিনি কাসারের হাতের বাঁধন খুলে দিলেন। তাকে তার টুপি আর কোমরবন্ধ ফিরিয়ে দিলেন। এবার তিমুজিনের দিকে তাকিয়ে বললেন, “তোমরা দুই ভাই এই স্তনের দুধ খেয়েই বড় হয়েছ। তোমার তো অনেক ক্ষমতা। আর কাসারের? তার আছে কেবল শক্তি আর পারে খুব ভালো তীর চালাতে। তোমার বিরুদ্ধে যখন লোকেরা বিদ্রোহ করেছিল, তখন কাসারই তাদের তীর মেরে ঘায়েল করেছিল।”
যুবক খান স্থির হয়ে বসে নিঃশব্দে মায়ের সব কথা শুনলেন, মায়ের ক্রোধ শান্ত হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করলেন। তারপর তিনি তাঁবু থেকে এই বলে বেরিয়ে গেলেন, “এই কাজটা আমি ভয় পেয়ে করেছিলাম। আর এখন আমার কাজের জন্য আমি লজ্জিত।”
টিবেংরি তখনো বিভিন্ন তাঁবুতে আধ্যাত্মিক ক্ষমতার জোরে জানতে পাওয়া তিমুজিনের ক্ষমতা হারানোর গল্প শুনিয়ে বেড়াচ্ছিল আর সমস্যা তৈরি করছিল। আর তখন তার সম্ভাবনাই বেশি থাকবে নেতা হওয়ার এসব শুনিয়ে বেশ অনেক অনুসারী জোগাড় করে ফেলল। সে ভাবতে শুরু করল, তার আধ্যাত্মিক ক্ষমতার গল্পে হয়তো গোত্রের ওপর তরুণ যোদ্ধা তিমুজিনের প্রভাব কমিয়ে ফেলতে পারবে। আবার তিমুজিনের সঙ্গে সংঘাতের সম্ভাবনা চিন্তা করে সে আর তার সঙ্গীরা তিমুজিনের সবচেয়ে ছোট ভাই তেমুগুকে খুঁজে বের করল। তাকে বাধ্য করল তাদের সামনে হাঁটুর ভারে বসতে।
মঙ্গোলদের প্রথা ছিল তারা নিজেদের ভিতরের দ্বন্দ্বে অস্ত্রের ব্যবহার করত না। কিন্তু শামানের (আধ্যাত্মিক ক্ষমতাধর) এই কাজের পরে তিমুজিন তেমুগুকে ডেকে পাঠালেন আর তাকে জানালেন “আজকে আমার তাঁবুতে টিবেংরি আসবে তার সঙ্গে যেভাবে খুশি বোঝাপড়া করে নিও।”
তার অবস্থা খুব স্বস্তিকর ছিল না। বৌরতাইয়ের বাবা মুনলিক ছিলেন একটি গোত্রের প্রধান। তিনি অনেক যুদ্ধে তাকে সাহায্য করেছেন এবং সে কারণে তিনি তাকে সম্মানও করতেন। টিবেংরি একজন আধ্যাত্মিক ক্ষমতাধর ধর্মগুরু আর একজন জাদুকর। খান তিমুজিন এই ঝগড়ার ব্যাপারে এখন বিচারকের আসনে। তিনি চাইলেই নিজের ইচ্ছে চাপিয়ে দিতে পারেন না।
মুনলিক যখন তার সাতজন পুত্রের সঙ্গে তাঁবুতে এলেন, তখন তাঁবুতে আগুনের পাশে তিমুজিন একা বসে ছিলেন। সমাদর করে তাদেরকে তার ডান পাশে বসালেন। এমন সময় তেমুগু তাঁবুতে প্রবেশ করল। সবাই তাদের নিজেদের অস্ত্র তাঁবুর বাইরে রেখে এসেছে। তেমুগু তাঁবুতে ঢুকেই টিবেংরির ঘাড় ধরল, “কালকে আমাকে একা পেয়ে তোমাদের সামনে ঝুঁকতে বাধ্য করেছিলে, আজকে আমি তোমার সঙ্গে লড়াই করব।”
কিছুক্ষণ তাদের মধ্য লড়াই চলল। এমন সময় বাকি ভাইয়েরা উঠে দাঁড়াতে শুরু করল।
“এখানে কোনো লড়াই না। বাইরে যেয়ে লড়াই কর” দুইজনের উদ্দেশে বললেন তিমুজিন।
দরজার সামনে তিনজন শক্তিশালী কুস্তিগির এই সময়টার জন্যই অপেক্ষা করে ছিল। তেমুগু কিংবা তিমুজিনের সম্মতিতেই হয়তো। টিবেংরি বের হওয়া মাত্র তার কোমর ভেঙে ফেলল আর এক পাশে ছুড়ে ফেলল। কোনো নড়াচড়া না করে সে নিথর হয়ে একটা ঘোড়ার গাড়ির চাকার পাশে পড়ে থাকল।
তেমুগু এসে নালিশ জানাল, “কালকে আমাকে একা পেয়ে টিবেংরি আমাকে জোর করে ঝুঁকতে বাধ্য করে। আর আজকে যখন আমি যুদ্ধ করতে চাচ্ছি সে আর উঠে দাঁড়াচ্ছে না।”
কথাটা শুনেই মুনলিক তার ছয় ছেলেকে নিয়ে দরজায় গেলেন, দেখতে পেলেন পুত্রের নিথর শরীরটা পড়ে আছে। ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে বৃদ্ধ গোত্রপ্রধান তিমুজিনের কাছে ফেরত এলেন, “আজ পর্যন্ত আমি তোমাকে অনেক সাহায্য করেছি।”
এই কথার মানে খুব পরিষ্কার ছিল। ছয় ছেলে সঙ্গে সঙ্গে মঙ্গোলের ওপর আক্রমণ করতে তৈরি হলো। তিনি উঠে দাঁড়ালেন। তার কাছে তখন কোনো অস্ত্র ছিল না আর দরজা ছাড়া তাঁবু থেকে বেরোবারও কোনো পথ ছিল না। চিৎকার করে সাহায্য চাওয়ার বদলে রাগী গোত্রপতি খুব শান্তভাবে বললেন, ‘রাস্তা ছাড়, আমি এখন বাইরে যেতে চাই।”
হঠাৎ এমন একটা আদেশ শুনে তারা হতবাক হয়ে পথ ছেড়ে দিল আর তিনি বেরিয়ে বাইরে পাহারায় থাকা রক্ষীদের কাছে গেলেন। যদিও এই ঘটনা মঙ্গোলদের জীবনকে ঘিরে থাকা, কখনো শেষ না হওয়া শত্রুতার কারণে ঘটা, অনেকগুলো ঘটনার মতোই একটি ঘটনা। কিন্তু সম্ভব হলে, মুনলিকের গোত্রের সঙ্গে রক্তক্ষয়ী শত্রুতাটা তিনি এড়াতে চান। নিথর পড়ে থাকা টিবেংরির দিকে এক নজর তাকিয়েই বুঝতে পারলেন ও আর বেঁচে নেই। তিনি নিজের তাঁবুকে এগিয়ে নিতে বললেন, যেন মৃতদেহটা ঢাকা পড়ে। আর প্রবেশদরজা শক্ত করে বন্ধ করে দিলেন।
পরদিন রাতে তিমুজিন তার দুইজন লোককে পাঠালেন তাঁবুর ওপরে থাকা ধোঁয়া বেরোবার জন্য ফাঁকা অংশ দিয়ে ‘শামান’-এর লাশ বের করে আনতে। এদিকে তাঁবুগ্রামের সবার মনেই তখন জিজ্ঞাসা, ‘শামান’-এর কী হলো? তখন তিনি দরজার পর্দা খুললেন আর তাদের সব বুঝিয়ে বললেন।
“টিবেংরি আমার আর আমার ভাইদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছিল। আর এখন স্বর্গের শক্তি তার জীবন আর শরীর দুটোকেই বের করে নিয়ে গেছে।”
তবে মুনলিকের সঙ্গে একান্ত আলাপে তিনি বলেছিলেন, “আপনি আপনার সন্তানদের আনুগত্য শেখাননি। এই শিক্ষাটা ওদের জন্য খুব জরুরি ছিল। আপনার এই সন্তানটি আমার সমকক্ষ হতে চেয়েছিল। আর তাই আমি তাকে শেষ করে দিয়েছি। এমন চেষ্টা যারাই করেছে তাদের সবাইকেই আমি শেষ করে দিয়েছি। তবে আপনার কাছে আমি প্রতিজ্ঞা করেছি, আপনাকে প্রত্যেক সময় মৃত্যুর হাত থেকে আমি রক্ষা করব। আসুন ব্যাপারটা এখানেই শেষ করে ফেলি।
গোবি অঞ্চলের উপজাতিদের মধ্যে চলা এইসব জাতিগত কোন্দল, বেঁচে থাকার জন্য তাদের চিরন্তন সংগ্রাম কখনোই থেমে থাকেনি। যদিও মঙ্গোলরা তখনো অপেক্ষাকৃত দুর্বল উপজাতিগুলোর একটি ছিল, তারপরও খানের পতাকার অনুসারী ছিল প্রায় এক লাখ তাঁবু। তার ধূর্ততা তাদের রক্ষা করত আর দুর্দান্ত সাহস তাদেরকে সাহসী করে তুলত। মাত্র কয়টি পরিবারের বদলে এখন সকল লোকের দায়িত্ব তার কাঁধে। তিনি এখন শান্তিতে ঘুমাতে পারেন। সম্মানী হিসেবে পাওয়া তার গবাদিপশুর সংখ্যা এখন অনেক, আর সেগুলো বেশ আরামেই বেড়ে উঠছে। বয়সও তার এখন ত্রিশ পেরিয়ে গেছে। নিজের সামর্থ্যের চরম শিখরে এখন তিনি। এখন তিনি বেড়াতে বেরোলে তার পুত্ররা তার সঙ্গে থাকে, নিজেদের জন্য স্ত্রী খোঁজে। অনেক দিন আগে যেমন করে তিনি ইয়েসুকির পাশে ঘোড়ায় চড়ে নিজের কনে খুঁজে নিয়েছিলেন। তিনি তার শত্রুর কাছ থেকে তার হারানো ঐতিহ্য ফিরিয়ে এনেছেন আর তিনি যে কোনো মূল্যে তা অক্ষুণ্ণ রাখবেন।
তবে তার মনে অন্য একটা ব্যাপার ছিল। একটা পরিকল্পনা—যার অর্ধেকটা সম্পন্ন হয়েছে, একটি ইচ্ছে যার অর্ধেকটা ব্যক্ত করেছেন।
একদিন তিনি তার সভাসদদের উদ্দেশ বললেন, “আমাদের পূর্বপুরুষরা সব সময় বলতেন— বিভিন্ন মন আর মানসিকতা একসঙ্গে, একই শরীরে থাকতে পারে না। কিন্তু আমি এই কাজটা করতে চাই। আমি পাশের এলাকায়ও আমার ক্ষমতা প্রসারিত করতে চাই।”
তার উদ্দেশ্য ছিল ‘বিষাক্ত যোদ্ধাদের’ একত্র করে, গোত্রদের সমষ্টি তৈরি করা। তার চিরাচরিত শত্রুকে তার প্রজা বানানো। এই ছিল তার চিন্তা। কাজটা তিনি সম্ভব করেছিলেন ধৈর্য দিয়ে।
(মঙ্গোল বীরত্বগাথা অনেকটাই ছিল রূপক। এমন একটা ধারণা জন্মায় যে, গোবি অঞ্চলের ঘটনাগুলো ছিল মাত্র কয়েকজনের শৌর্য, ধূর্ততা আর বিশ্বাসঘাতকতার গল্প। সত্যি কথা হলো, ‘শামান’দের ষড়যন্ত্র অনেক দিন ধরে চলেছিল। আর এতে দুই দিকেই অনেক শক্তিশালী লোকেরা জড়িত ছিল।)
৫. যখন গুপ্ত পাহাড়ে পতাকা উড়ছিল
ক্যাথিদের মহাপ্রাচীর থেকে পশ্চিমে, মধ্য এশিয়ার পর্বতমালা পর্যন্ত বিস্তৃত এই চারণভূমিগুলোতে, যুগ যুগ ধরে চলে আসা তাতার আর মঙ্গোল, মেরকিট আর কারাইত কিংবা নেইম্যান আর উঘুইর যাযাবর উপজাতিদের মধ্যেকার যে যুদ্ধ, তা আমাদের আলোচনার বিষয় নয়। দ্বাদশ শতাব্দী তখন শেষের দিকে। তিমুজিন তখনো চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন, পূর্বপুরুষদের বারণ করা সেই সাবধানবাণীর বিপরীতে চলার, সকল উপজাতির মধ্যে সহযোগিতার একটা সম্পর্ক তৈরি করার। আর তা তখনই সম্ভব, যখন কোনো একটি উপজাতি সবার ওপর কর্তৃত্ব পেয়ে যাবে।
ক্যাথির উত্তর প্রান্ত থেকে পশ্চিমের পাহাড় পর্যন্ত কারাইতরা নিজেদের শহরের কাফেলা চলার পথের ওপর যেভাবে কর্তৃত্ব করছিল, তা ছিল আসলে একটা ক্ষমতার সামঞ্জস্য। প্রিস্টার জন নামে পরিচিত তঘরুলের কাছে তিমুজিন তাই জোট গঠনের প্রস্তাব নিয়ে গেলেন। মঙ্গোলরা এখন অনেকটাই শক্তিশালী, তাই এমন প্রস্তাব তারা করতেই পারে।
“হে পিতা, আপনার সাহায্য ছাড়া আমি সম্মানের সঙ্গে বাঁচতে পারব না। আর আপনিও আমার বন্ধুত্ব ছাড়া শান্তিতে থাকতে পারবেন না। আপনার সৎ ভাই আর চাচাতো ভাইয়েরা আপনার এলাকা আক্রমণ করবে আর চারণভূমিগুলো নিজেদের মধ্যে ভাগ-বাটোয়ারা করে নেবে। এই ভবিতব্য দেখবার মতো এতটা বুদ্ধিমান আপনার পুত্র এখনও হয়নি। তবে তার এই শত্রুরা যদি বেঁচে থাকে তবে সে তার সম্পদ আর জীবন দুই-ই হারাবে। আমাদের বেঁচে থাকা এবং কর্তৃত্ব বজায় রাখার একটাই উপায়, আমাদের নিজেদের মধ্যে বন্ধুত্ব স্থাপন করা এবং তা অটুট রাখা। আমিও তো আপনার পুত্র, আমাদের দুজনের ভেতর এ ব্যাপারটার একটা মীমাংসা হয়ে থাকা উচিত।
তিমুজিনের প্রস্তাবে সায় দিলেন প্রিস্টার জন। তার বয়স হয়ে গেছে আর যুবক মঙ্গোলের প্রতি তার একটা দুর্বলতা আগে থেকেই ছিল।
তিমুজিন তার এই জোটের প্রতি পরিপূর্ণভাবে বিশ্বস্ত ছিলেন। যখন পশ্চিম থেকে আসা গোত্ররা, যাদের বেশিরভাগ ছিল মুসলমান আর বৌদ্ধ ধর্মের, আক্রমণ করে তাদের এলাকা থেকে তাদের তাড়িয়ে দিয়েছিল, কারাইতদের মধ্যে খ্রিস্টান—শামান বিভেদ সৃষ্টি করেছিল, তখন তিমুজিন আক্রান্ত গোত্রপ্রধানকে সাহায্য করতে তার সেনাদের পাঠিয়েছিলেন।
কারাইতদের সহযোগী হিসেবে এক রাষ্ট্রনায়কোচিত চরিত্র দেখিয়েছিলেন।
এ ছিল তার মতে বিশাল এক সুযোগ। মহাপ্রাচীরের পিছনে ক্যাথি সাম্রাজ্যের স্বর্ণ রাজা ঘুম থেকে জাগলেন আর ঠিক করলেন তাতাররা তাদের বেজায় বিরক্ত করছে। তিনি জানালেন তিনি নিজে এই বিশাল অভিযানে নেতৃত্ব দেবেন আর প্রাচীর পার হয়ে এইসব উপজাতিকে শায়েস্তা করে আসবেন। এই ঘোষণায় তার প্রজারা ভীত হয়ে পড়ল। অবশেষে তাতারদের বিরুদ্ধে একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার নেতৃত্বে, একটি ক্যাথি সেনাবাহিনী পাঠানো হলো। কিছুদূর এগিয়ে তারা যথারীতি থেমে পড়ল। পদাতিক এই বাহিনী কোনোভাবেই উপজাতি বাহিনীর সমকক্ষ ছিল না।
(ত্রয়োদশ শতকের চীন দুই ভাগে বিভক্ত ছিল। উত্তরে ছিল চীন বা স্বর্ণ রাজত্ব আর দক্ষিণে ছিল সুং রাজত্ব। ‘ক্যাথি’ শব্দটা এসেছে তাতার শব্দ ‘কিতাই’ থেকে। এর অর্থ হচ্ছে চীন। তাতার সাম্রাজ্য খুব সহজেই দখল করে নেয় চীন। মধ্য এশিয়া আর রাশিয়ায় এখনো চীনকে ‘কিতাই’ বলা হয়। )
এই ঘটনা তিমুজিনের কানে গেল। তিনি খুব দ্রুত কাজে নেমে পড়লেন। সব সৈন্যসহ তিনি রওনা হলেন। প্রিস্টার জনের কাছেও খবর পাঠিয়ে দিলেন মনে করিয়ে দিলেন তাতাররাই তার পিতাকে হত্যা করেছে। কারাইতরাও যোগ দিল। এই যৌথ বাহিনী তাতারদের ওপর আক্রমণ করল। তাতাররা পিছিয়ে যেতে পারছে না, কারণ পেছনেই ক্যাথি সেনারা অবস্থান করছে।
এই যুদ্ধ তাতারদের শক্তির মেরুদণ্ড একদম ভেঙে দিল। বহু যুদ্ধবন্দি বিজয়ী গোত্রগুলোর সঙ্গে যুক্ত হলো আর ক্যাথি সেনাপ্রধানকে সুযোগ দিল এই বিজয়ের পুরো কৃতিত্ব নিজে নিয়ে নেয়ার। আর তিনি সেটা করলেনও। তিনি প্রিস্টার জনকে ‘ওয়াং খান’ বা ‘যোদ্ধাদের রাজা’ উপাধি দিলেন, তিমুজিনকে দিলেন ‘বিদ্রোহীদের বিপক্ষের সেনাপ্রধান’ উপাধি। এসব উপাধি দিতে সোনার কাপড় চড়ানো একটা রুপোর দোলন ছাড়া ক্যাথি সেনাবাহিনীকে এমন কোনো খরচ করতে হলো না। খেতাব আর উপহার দুটোই মঙ্গোলদের অবাক করে দিয়েছিল। নতুন পাওয়া, আর প্রথমবারের মতো দেখা এই দোলনা খানের তাঁবুতে প্রদর্শনের জন্য রাখা হয়েছিল।
নতুন যোদ্ধারা তার সেনাদলে যোগ দিতে লাগল। তিমুজিনের চোখের সামনে তার পুত্র বড় হচ্ছে। তীরের সম্রাট খেপ নয়নের সঙ্গে সে ঘুরে বেড়াত। নয়নের একটা দুর্বলতা ছিল। খুব পছন্দ করতেন চামড়ার জুতো পরতে আর সব সময় সঙ্গে রাখতেন ক্যাথিদের কাছ থেকে পাওয়া রুপোর একটা অস্ত্র। তার পেছনে একদল সেনা না থাকলে নয়নের ভালো লাগত না। তিমুজিনের বড় ছেলে জুখির (অর্থ অতিথি) জন্য তিনি খুব ভালো একজন শিক্ষক। ছেলেটার জন্ম নিয়ে যদিও একটা কুয়াশা আছে, তবুও তার অস্থির আর বেপরোয়া স্বভাব খানের বেশ ভালোই লাগে।
দ্বাদশ শতকের শেষের দিকের কথা। তিমুজিন তার পরিবারের সবাইকে নিয়ে কারাইতদের এলাকার নদীর দিকে শিকারে যাচ্ছিলেন। সঙ্গে ছিল একদল অশ্বারোহী, যারা বিশাল এক বৃত্ত তৈরি করেছিল। তারা অনেকগুলো অ্যান্টিলোপ (এক ধরনের হরিণ জাতীয় প্রাণী), কিছু হরিণ আর অল্পসংখ্যক শিকারকে ধাওয়া করে, ধীরে ধীরে ওগুলোকে ঘিরে ফেলল। এরপর তীর ধনুক দিয়ে শিকার করার খেলায় মেতে উঠলো। মঙ্গোলদের শিকার মানেই সেখানে হেলেদুলে চলার কোনো ব্যাপার নেই।
‘কিবিতকাস’ বা তাঁবুগাড়ি আর উটের গাড়িগুলো চারণভূমির কোনো এক জায়গায় তাদের জন্য অপেক্ষা করছিল। শিকারিরা ফেরত এলো, ষাঁড়গুলোকে খুলে দেয়া হলো। যে ফেল্ট কাপড় দিয়ে তাঁবু ঢাকা হয়, তা তাঁবুর কাঠামোর ওপর চড়ানো হলো। আগুন জ্বলে উঠল।
বেশিরভাগ শিকারই বৃদ্ধ তঘরুল খানের (নতুন উপাধি ওয়াং খান) জন্য উপহারস্বরূপ জমিয়ে রাখা হলো। কারাইতরা মঙ্গোলদের ওপর অযথাই আধিপত্য দেখাত। যুদ্ধে পাওয়া সম্পদের যেগুলো তিমুজিনের লোকদের প্রাপ্য তা এই ওয়াং খানের লোকেরা নিয়ে চলে গিয়েছিল আর মঙ্গোলরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল।
কারাইতদের এলাকায় তার অনেক শত্রু ছিল। বৌরচিকুনের উত্তরপুরুষদের তো ইচ্ছে ছিলই নেতৃত্ব থেকে তাকে উৎখাত করার, আর কারাইতপ্রধানের আনুকূল্য পাওয়ার। তাই তিনি তার পালক পিতার কাছ যাচ্ছিলেন। তাদের মধ্যে এটা আগেই ঠিক করা ছিল, যদি কোনোদিন তাদের মধ্য কোনো মতপার্থক্য হয়, তবে কেউ কারো ওপর কোনো আক্রমণ করবে না, সত্য ঘটনা জেনে পুরো ব্যাপারটা পরিষ্কার না হওয়া পর্যন্ত নিজেরা মিলিত হবে আর শান্তভাবে আলাপ করবে।
নিজের তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে তিমুজিন অনেক কিছু শিখেছেন। তিনি জানতেন ওয়াং খানের মৃত্যু হলে নতুন করে যুদ্ধ শুরু হবে। তবে কারাইতদের মধ্য অনেক যোদ্ধা ছিল, যারা তাকে পছন্দ করত। মঙ্গোলের শত্রুরা ওয়াং খানের দেহরক্ষীদেরকে বলেছিল তাকে আটক করতে, তারা রাজি হয়নি। মঙ্গোলদের কাছে বিয়ের প্রস্তাবও পাঠানো হয়েছে। কারাইতদের কাছে জুখির জন্য একজন কনে ছিল, একজন গোত্রপ্রধানের মেয়ে।
কিন্তু তিমুজিন নিজের ছাউনিতেই থাকলেন, কারাইতদের তাঁবুগ্রাম থেকে নিরাপদ দূরত্বে। ওখানে যাওয়া ঠিক হবে কিনা তা দেখার জন্য তিনি তার কয়েকজন লোককে পাঠালেন। তার অশ্বারোহীরা ফেরত এলো না, কিন্তু রাতের বেলা দুটি ঘোড়ার দল কারাইতদের কাছ থেকে খবর নিয়ে এলো। খবরটা ভয়ঙ্কর এবং অপ্রত্যাশিত।
পশ্চিমে তার শত্রু, ধূর্ত চামুকা, তুকতা বেগ, দুধর্ষ মেরকিতদের গোত্রপ্রধান, ওয়াং খানের পুত্র আর তিমুজিনের চাচা তাকে শেষ করে দিতে একত্র হয়েছে। তারা চামুকাকে তাদের নেতা ঠিক করেছে। তারা অনিচ্ছুক আর বৃদ্ধ ওয়াং খানকে রাজি করিয়েছে তাদের সঙ্গে যোগ দিতে। বিয়ের প্রস্তাবটা আসলে ছিল একটা ফন্দি। ব্যাপারটা আগেই কিছুটা সন্দেহ করেছিলেন তিমুজিন।
তার রাষ্ট্রনায়কসুলভ চেষ্টা ব্যর্থ হলো। মনে হয় তিনি চেষ্টা করছিলেন, কারাইতরা পশ্চিমের তুর্কি উপজাতিদের সঙ্গে যুদ্ধে ব্যস্ত থাকবে, আর তিনি নিজে পূর্ব দিকে তার শক্তি বৃদ্ধি করবেন। আর পূর্ব দিকের উপজাতিদের একত্র করে কারাইতদের সমকক্ষ একটা শক্তিশালী বাহিনী না হওয়া পর্যন্ত ওয়াং খানকে তার সহযোগী রাখবেন। তার নীতিটা যুক্তিযুক্তই ছিল, কিন্তু তার এই চালাকি আরও বড় ধূর্ততার মুখোমুখি হলো আর এখন মুখোমুখি হয়েছে বিশ্বাসঘাতকতার।
সেই দুইজন রাখাল আরো জানাল, কারাইতরা তাদের শিবিরের দিকে এগিয়ে আসছে, রাতের বেলাতেই আচমকা আক্রমণ করার পরিকল্পনা আছে। তার তাঁবুতে তারা তাকে তীরের আঘাতে হত্যা করবে।
অবস্থা বেশ সঙ্গিন। একে তো কারাইতরা সংখ্যায় অনেক বেশি, তার ওপর তার সঙ্গে রয়েছে তার যোদ্ধাদের পরিবার, সম্ভব হলে যাদেরকে রক্ষা করতে হবে। তার সঙ্গে আছে ছয় হাজার যোদ্ধা (কোনো কোনো সূত্র মতে তিন হাজারের কম)। তাকে সাবধান করা হয়েছে আর তারপর তিনি এক মুহূর্তও নষ্ট করলেন না।
তিনি তার তাঁবুর পাহারাদারদের শিবিরের ভেতরে পাঠিয়ে দিলেন, ঘুমন্তদের জাগালেন, নেতাদের সাবধান করলেন, পশুপালক ছেলেগুলোকে ছোটালেন। পশুগুলোকে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটিয়ে সকালের মধ্যে যতটা পারলেন ছড়িয়ে দিলেন। এছাড়া তাদেরকে বাঁচানোর আর কোনো উপায় ছিল না। তাঁবুগ্রামের মানুষদের দ্রুত কাছে থাকা ঘোড়াগুলোয় ওঠানো হলো। হালকা উটের গাড়িগুলোতে মহিলাদের ওঠানো হলো। কোনো তর্ক না করে সবাই লম্বা পথ ধরে ফিরে যেতে শুরু করল।
তাঁবু আর বড় গরুর গাড়িগুলো যেমন ছিল তেমনই রাখা হলো। কিছু লোককে দ্রুতগামী ঘোড়াসহকারে সেখানে রাখা হলো উঁচু করে আগুন জ্বালিয়ে রাখবার জন্য। তার সেনাপ্রধান আর গোত্রের সেরা লোকদের নিয়ে তিনি ধীরে ধীরে পিছু হটতে লাগলেন আর এই পিছু হটাকে প্রতিরক্ষা করতে থাকলেন। এখন, অন্ধকারের আড়ালে তাদের দিকে এগিয়ে আসা এই ঝড় থেকে পালাবার কোনো পথই আর নেই।
তারা এক পর্বতমালার দিকে আট বা নয় মাইল চললেন। যদি ছড়িয়ে যেতে বাধ্য হন, তখন এই পাহাড় কিছুটা হলেও তার লোকদের আশ্রয়ের জায়গা দেবে। একটা ছোট নদী পার হয়ে, ঘোড়াগুলো ক্লান্ত হয়ে যাওয়ার পূর্বেই, তিনি তার অশ্বারোহীদের একটি গিরিখাতে থামতে বললেন।
ইতিমধ্যে সকালের আগেই কারাইতরা তাদের পরিত্যক্ত শিবিরে আক্রমণ চালাল। একের পর এক তাঁর চালিয়ে সাদা ফেল্ট আবৃত খানের তাঁবু ঝাঁঝরা করে ফেলল। এরপর তাদের নজরে পড়ল পূর্ণ নীরবতা, গবাদিপশু আর পতাকার অনুপস্থিতি। কিছুটা সময় তাদের কাটল বিভ্রান্তি আর আলোচনায়। উজ্জ্বলভাবে জ্বলা আগুন দেখে তারা ভেবেছিল মঙ্গোলরা এখনো তাঁবুতে আছে। যখন বুঝল মঙ্গোলরা সবাই তাদের সব নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র, এমনকি অতিরিক্ত স্যাডল আর দুধের পাত্রসহই তাঁবু সেখানে ফেলে চলে গেছে, তখন তারা ভাবল মঙ্গোলরা তাদের ভয়ে পালিয়েছে, আর ছত্রভঙ্গ হয়ে গেছে।
পূর্ব দিকে বিশাল এলাকাজুড়ে যে পায়ের দাগ, তা রাতের আঁধারেও লুকানো সম্ভব নয়। কারাইতদের গোত্র সঙ্গে সঙ্গেই তাদের পিছু নেয়ার সিদ্ধান্ত নিল। সবাই একযোগে ছুটতে শুরু করল আর ভোরের পরে তারা পাহাড়ের পাদদেশে পৌঁছে গেল। তাদের পেছনে তখন ধুলার মেঘ ঘুরছে। তিমুজিন তাদের এগিয়ে আসা মনোযোগ দিয়ে লক্ষ করলেন, খুব দ্রুত আসার কারণে তারা অনেকটা এলাকাজুড়ে ছড়িয়ে গেছে। ভালো ঘোড়াগুলো ধীর গতিরগুলোর চেয়ে অনেকটা এগিয়ে গেছে।
উপত্যকায় আর বেশিক্ষণ অপেক্ষা না করে তিনি তার যোদ্ধাদের ঘন সারিতে সাজালেন আর তাদের ঘোড়াগুলোকে বিশ্রাম দিলেন। সবাই নদী পার হলেন। কারাইত সম্মুখসেনাদের ছত্রভঙ্গ করে দিলেন আর তৃণময় ঢালু এলাকায় পুনরায় একত্রিত হলেন আর গ্রামবাসীদের পিছিয়ে আসাকে পাহারা দিলেন। এমন সময় ওয়াং খান তার সেনাদের নিয়ে সেখানে পৌঁছলেন। কারাইতরা পুনরায় একত্রিত হলো আর তখন শুরু হলো জীবন-মরণ লড়াই।
তিমুজিন জীবনে কখনো এমন চাপে পড়েননি। তার সেনাবাহিনীর সবার ব্যক্তিগত সাহসিকতা আর তার গোত্রের দৃঢ়তা এখন তার দরকার। ভারী অস্ত্রে সজ্জিত উরুত আর মানহুতরা সব সময়ই তার হয়ে কাজ করেছে। তার সৈন্যসংখ্যা তাকে মুখোমুখি সংঘর্ষে যেতে দিচ্ছে না। সেই এলাকা যতটুকু সুবিধা তাকে দিচ্ছে সেটা ছাড়া তার আর কোনো সুবিধা নেই— মঙ্গোলদের এখন এটাই শেষ সম্বল। দিন যখন শেষ হয়ে এলো, পরাজয়ের একেবারে দ্বারপ্রান্তে যখন তিনি, তখন তার এক সৎ ভাই গিল্ডারকে ডাকলেন। সে পতাকার রক্ষক মাহুতদের গোত্রপ্রধান। তাকে নির্দেশ দিলেন কারাইতদের সারিকে বৃত্তাকারে ঘিরে, তাদের পেছনে আর বামে থাকা পাহাড়ে যেতে আর তার দখল রাখতে। এই পাহাড়ের নাম ‘গুপ্ত”।
ক্লান্ত গিল্ডার জবাব দিল, “হে খান, আমার ভাই, আমি আমার সেরা ঘোড়ায় চড়ব, আর আমাকে যারা বাধা দেবে তাদের ভেদ করে ভেতর দিকে চলে যাব। আপনার ‘ইয়াক টেইল’ পতাকা ‘গুপ্ত’ পাহাড়ে গাড়ব। আপনাকে আমার পূর্ণ ক্ষমতা দেখাব। আর আমি যদি ব্যর্থ হই, তবে আপনি আমার সন্তানদের দেখবেন। আমি যদি মারা যাই আমার আপনজন বলতে ওরাই এই পৃথিবীতে থাকবে।”
বৃত্তাকারে ঘুরে চলার এই কৌশলটা মঙ্গোলদের পুরনো আর খুব পছন্দের কৌশল। শত্রু গোত্রের একাংশ ঘুরে গেল আর তার পিছু নিল। তার গোত্রের লোকেরা তখন বিধ্বস্ত আর কারাইতরা তাদের সম্মুখভাগকে ভেঙে ফেলছে, আর অন্ধকারও হয়ে আসছে, এখন এই লড়াই তার চরম সীমায় পৌঁছে গেছে। কিন্তু দুঃসাহসী গিল্ডার পাহাড়ে পৌঁছে গেছে আর নিজের পতাকা পুঁতে ফেলেছে এবং সেই পাহাড়ের দখল ধরে রেখেছে। এর ফলে কারাইতরা নিজেদেরকে সংবরণ করল, ওদিকে ওয়াং খানের পুত্র মুখে তীরের আঘাত লেগে জখম হয়ে গেছে।
যখন সূর্য ডুবল, তখন মঙ্গোলরা নয়, কারাইতরা ময়দান থেকে একটু পিছিয়ে গেল। তিমুজিন কেবল গিল্ডারের প্রত্যাবর্তনকে সুরক্ষিত করার জন্য আর আহত যোদ্ধাদের একত্রিত করার জন্য অপেক্ষা করলেন। আহতদের মধ্যে তার দুই পুত্রও ছিল, যারা ধরা পড়া ঘোড়ায় চাপল, কখনো এক ঘোড়ায় দুইজন। এরপরে তিনি পূর্ব দিকে পালালেন আর কারাইতরা পরের দিন তাদের পিছু নিল।
এটি ছিল তিমুজিনের সবচেয়ে অসহায় যুদ্ধ এবং তিনি যুদ্ধে পরাজিত হলেন। তবে তিনি নিজেকে, তার মূল সেনাবাহিনীকে আর তার গ্রামকে বাঁচাতে পেরেছিলেন।
ওয়াং খান বললেন, “আমরা এমন একজনের সাথে যুদ্ধ করলাম, যার সঙ্গে কখনো বচসা করা উচিত নয়।”
মঙ্গোল কিংবদন্তি বলিয়েরা এখনো গল্প করে, কীভাবে গিল্ডার গুপ্ত পাহাড়ে তাদের পতাকা নিয়ে গিয়েছিল।
তবে ঊষর অঞ্চলের এটিই হচ্ছে প্রয়োজন যে, লম্বা পশ্চাদপসরণে যোদ্ধারা তাদের মৃত ঘোড়া ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়, তাদের ক্ষত লেহন করে, আবার শিকারিদের বৃত্তে প্রবেশ করে। যে করেই হোক অ্যান্টিলোপ বা হরিণ বা তীরের আঘাতে যা শিকার করা যায়, তা জোগাড় করে। খেলার প্রতি ভালোবাসার কারণে তারা এমনটা করে না, তাঁবুগ্রামের জন্য যে করেই হোক খাবার নিয়ে যেতেই তারা এমনটি করে।
৬. প্রিস্টার জনের মৃত্যু
কারাইতদের জয়ের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া হলো। তিমুজিনের বিরুদ্ধ বিভিন্ন শক্তি একত্রিত হয়ে নিজেদের শক্তি বৃদ্ধি করে ফেলল। উপজাতিগুলোর গোত্রপতিরা নিজেরা এই ক্রমবর্ধমান শক্তির সহযোগী হওয়ার দিকে মনোযোগী হলো। এর মানে হলো, নিজেদের প্রতিরক্ষা নিশ্চিত করা আর আরো সম্পদশালী হওয়া।
ওয়াং খানকে তিরস্কার করে ক্রুদ্ধ মঙ্গোল বললেন, “হে খান, শত্রুরা যখন আপনাকে ঘিরে ফেলেছিল, তখন কি আমি আমার সেরা চারজন বীরকে আপনার সাহায্যের জন্য পাঠাইনি? আপনি তখন আমার কাছে একটা অন্ধ ঘোড়ায় চড়ে এসেছিলেন, পরনে ছিল ছেঁড়া কাপড়। আপনাকে ভেড়ার মাংস খাইয়ে সুস্থ করে তুলেছিলাম। আমি কি আপনাকে প্রচুর ভেড়া আর ঘোড়া দিইনি?
এক সময় আপনার লোকেরা এক যুদ্ধের সব লুটের মাল নিজেরা রেখে দিয়েছিল, যদিও সেগুলোর ওপর আমার অধিকার ছিল। এরপরে সেসব আপনি আপনার শত্রুর কাছে হারান। আর আমার বীরেরা সেগুলো উদ্ধার করে দেয়। কৃষ্ণ নদীর তীরে আপনি শপথ করেছিলেন, আমাদের মধ্যে বিভেদ তৈরি করে এমন কোনো শয়তানি কথায় আপনি কান দেবেন না, বরং আমরা নিজেরা বসে সে ব্যাপারে ফয়সালা করব। আমার পুরস্কার খুব অল্প, আমার এর চেয়ে অনেক বেশি চাই— এমন কথা আমি বলিনি।
“যখন ষাঁড়টানা গাড়ির একটি চাকা ভেঙে যায়, তখন তা আর সামনে এগুতে পারে না। আমি কি আপনার সেই ষাঁড়টানা গাড়ির একটি চাকা ছিলাম না? আপনি আমার ওপর কেন রেগে গেলেন? কেন আপনি আমাকে আক্রমণ করলেন?”
এখানে অপমানের একটি প্রতিধ্বনি আমরা শুনতে পাই। আর ভর্ৎসনা ছিল একজন দোদুল্যমান মানুষের জন্য, যিনি তার নিজের মনকেই চিনতেন না—প্রিস্টার জন একটি অন্ধ ঘোড়ায় সাওয়ার ছিলেন।
জেদী তিমুজিন এবার স্থির সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন। কাছাকাছি সব গোত্রপ্রধানের কাছে এবং তার নিজের রাজত্বের খানদের কাছে দূত পাঠালেন। সাদা ঘোড়ার চামড়ার ওপর বসা মঙ্গোল গোত্রপতির চারপাশে বাকি গোত্র প্রধানরা এসে হাঁটু গেড়ে অবস্থান নিল, তাদের লম্বা কোটগুলোয় ছিল নকশা করা কোমরবন্ধনী, ইয়ার্টের আগুনের ধোঁয়ার ভেতর থেকে তাদের মুখগুলো দেখা যাচ্ছিল। এটি ছিল খানের রাজসভা।
‘বৌরচিকুন’রা বা ধূসর চোখা মানুষগুলো, প্রত্যেকেই একে একে বক্তব্য রাখল। এদের অনেকেই তিমুজিনের কাছে আগে পরাজিত হয়েছে। এদের মধ্যে কেউ শক্তিশালী কারাইতদের কাছে হাল ছেড়ে দিয়ে প্রিস্টার জন এবং তার পুত্রের সঙ্গে যোগ দিতে প্রস্তুত। অবশেষে সাহসের জয় হলো। সবাই মিলে তিমুজিনের নেতৃত্বে যুদ্ধের সিদ্ধান্ত নিল। রাজসভার সিদ্ধান্ত বহাল থাকল।
দায়িত্ব নেয়ার পরে তিমুজিন জানালেন, তার আদেশ প্রত্যেক গোত্রকেই মানতে হবে আর কাউকে যদি তিনি শাস্তিযোগ্য মনে করেন তবে তাকে তিনি শাস্তি দিতে পারবেন। “আমি শুরু থেকেই তোমাদের বলেছি, এই তিন নদীর মাঝখানের এলাকার অবশ্যই একজনই নেতা থাকতে হবে। তোমরা বুঝতে পারোনি। এখন, যখন দেখছ ওয়াং খান আমার সঙ্গে যা করেছে তোমাদের সঙ্গেও তাই করতে পারে, তখন তোমরা আমাকে তোমাদের নেতা পছন্দ করেছ। তোমাদেরকে আমি বন্দি, নারী, তাঁবু আর গবাদিপশু দিয়েছি। এবার আমি তোমাদের ভূমি আর তোমাদের পিতৃপুরুষের ঐতিহ্য ফিরিয়ে এনে দেব।”
সেই শীতে গোবি এলাকা পরস্পরবিরোধী দুটো শিবিরে ভাগ হয়ে পড়ল। বৈকাল হ্রদের পূর্ব পাশে থাকা সেনারা পশ্চিমে থাকা সেনাদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র হতে লাগল। এই সময়ে, তুষার পড়া থামার আগেই তিমুজিন প্রথম মাঠে নামলেন। নতুন সহযোগীদের নিয়ে কোনো সতর্কবাণী ছাড়াই তিনি ওয়াং খানের শিবিরে হামলা চালালেন।
এরপরের ঘটনা যাযাবরের চালাকির আশ্চর্য এক চিত্র দেখায়। তিমুজিন একজন মঙ্গোলকে শত্রুসেনাদের সম্মুখভাগে পাঠিয়ে দিলেন। সে গিয়ে নালিশ করল, মঙ্গোলরা তার সঙ্গে খুব খারাপ আচরণ করেছে। সে আরো জানাল, মঙ্গোলরা এখনো অনেক দূরে আছে। কারাইতরা খুব বিশ্বাসপ্রবণ ছিল না, তারা বাছাই করা ঘোড়ায় কয়েকজন সেনাকে সেই মঙ্গোল যোদ্ধার সঙ্গে দেখতে পাঠাল আসল ঘটনা কী।
যে ছোট পাহাড়ের ঢাল বেয়ে তারা এগিয়ে যাচ্ছিল তার অপর পাশের ঢালে, কারাইতদের শিবিরের খুব কাছে মোঙ্গোলরা তখন পতাকা হাতে উঠছে। একমাত্র মঙ্গোল যোদ্ধাটি তখন তার চারপাশে নজর রাখছিল। সে জানত, তার সাথে আসা লোকগুলো খুব ভালো জাতের ঘোড়ায় চড়ে আছে, আর যদি তারা পতাকা দেখতে পায় তবে তারা খুব দ্রুত ফিরে যাবে। তাই সে ঘোড়া থেকে নেমে, তার ঘোড়া নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। কী করছে জিজ্ঞেস করার পরে সে বলল, “ঘোড়ার ক্ষুরে একটা পাথর আটকে গেছে।”
সাহসী মঙ্গোলটি যতক্ষণে ঘোড়ার ক্ষুর থেকে কল্পিত পাথর সরাল, তিমুজিনের সম্মুখ সৈন্যরা ততক্ষণে ঢালের শৃঙ্গে পৌঁছে গেল আর কারাইত যোদ্ধাদের বন্দি করে ফেলল। ওয়াং খানের শিবিরে আক্রমণ চালানো হলো আর শুরু হলো প্রচণ্ড যুদ্ধ।
রাত শেষ হতে হতে কারাইতরা পর্যুদস্ত হয়ে পড়ল। ওয়াং খান এবং তার পুত্র দুজনেই আহত হয়ে পালাল। তিমুজিন ঘোড়ায় চড়ে দখল করা শিবিরে গেলেন আর কারাইতদের সব সম্পদ, রঙিন আর সিল্কে ঢাকা স্যাডল, লাল চামড়া, পাতলা এবং সূক্ষ্মভাবে তৈরি করা বাঁকা তলোয়ার, রুপোর থালা এবং পানপাত্র, সব তার নিজের লোকদের মধ্যে বিলিয়ে দিলেন। এসব জিনিস তার কোনো কাজের নয়। ওয়াং খানের তাঁবুতে সোনার তৈরি চাদর ছিল। গুপ্ত পাহাড়ের কাছে যে দুইজন পশুপালক সেদিন তাকে কারাইতদের এগিয়ে আসবার খবর দিয়েছিল, তাদের তিনি পুরো তাঁবুটাই দিয়ে দিলেন।
কারাইতদের মধ্যভাগে প্রবেশ করে তিনি কারাইতদের তার নিজের যোদ্ধাদের দিয়ে ঘিরে ফেললেন আর তাদের জীবন ভিক্ষার প্রস্তাব দিলেন—তারা যেন আত্মসমর্পণ করে তার সঙ্গে যোগ দেয়। “তোমরা যেভাবে তোমাদের শাসকের জন্য যুদ্ধ করেছ তা বীরের মতো। তোমরা আমার দলে চলে আসো, আর আমার হয়ে যুদ্ধ করো।”
বেঁচে থাকা কারাইতরা তার পতাকাতলে যোগ দিল আর তিনি তাদের শহর কারাকোরামের (কালো বালি) দিকে এগিয়ে গেলেন।
তার চাচাতো ভাই ধূর্ত চামুকা পরে বন্দি হয় আর তাকে তার সামনে আনা হয়।
তিমুজিন প্রশ্ন করলেন, ‘কী পরিণতি তুমি আশা করো?”
চামুকা দ্বিধা না করে বলল, “আমি তোমাকে বন্দি করলে আমি তোমার সঙ্গে যা করতাম তুমিও তাই করবে। আমাকে ধীর ধীরে মেরে ফেলবে।”
ধীরে ধীরে মেরে ফেলা মানে হচ্ছে এক ধরনের চীনা শাস্তি। প্রথমে কড়ে আঙুল কেটে ফেলা হয়। এরপর একে একে সব অঙ্গ। তবে বৌরচিকুনদের ভেতর সাহসের অভাব ছিল না। তিমুজিন অবশ্য তার ঐতিহ্য অনুসরণ করেছিলেন। ঐতিহ্য হচ্ছে বড় বংশের কোনো গোত্রপ্রধানের রক্ত ঝরাতে নেই। তিনি চামুকাকে সিল্কের দড়িতে ঝোলাবার জন্য পাঠিয়ে দিয়েছিলেন।
প্রিস্টার জন, যিনি নিজের অনিচ্ছায় এই যুদ্ধে জড়িয়েছিলেন, নিঃসহায় হয়ে নিজের দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান আর দুইজন তুর্কি গোত্রের যোদ্ধার হাতে নিহত হন। গল্প আছে, তার খুলি রুপোয় মুড়িয়ে শ্রদ্ধার নিদর্শন হিসেবে সেই গোত্রপ্রধানের তাঁবুতে রাখা হয়। তার পুত্রও অনেকটা একইভাবে নিহত হন।
একজন উপজাতির গোত্রপ্রধান, এমন জয়ের পরে, এর ফল ভোগ করে। তিনিও সেখানেই স্থির থাকতে পারতেন। আর উপজাতি যুদ্ধবিজয়ের ফলগুলো একই হতো…. সম্পদ আহরণ করা, অলসতা বা অস্থিরতা, এরপরে ঝগড়া আর যাযাবরদের অগোছাল সাম্রাজ্যে ভাঙন সৃষ্টি করা।
কিন্তু তিমুজিন দেখালেন, তিনি ভিন্ন ধাতুতে গড়া। তার হাতে এখন কারাইতদের রাজত্বের মূলশক্তি। এই কারাইতরা চাষাবাদ করত, কাদা শুকিয়ে শহর তৈরি করেছিল, স্থায়ী বাসস্থান তৈরি করেছিল। কারাইতদের শান্ত রাখতে আর তাদের সঙ্গে স্থায়ী সমঝোতা বজায় রাখতে এক মুহূর্ত দেরি না করে তিনি তার সেনাদের নিয়ে নতুন যুদ্ধযাত্রা শুরু করলেন।
তার ছেলেদের বললেন, “কোনো কাজের গুণ লুকিয়ে থাকে তার সফল পরিসমাপ্তিতে।”
গোবির একচ্ছত্র অধিপতি হওয়ার সেই যুদ্ধের তিন বছর পরে তিনি তার অভিজ্ঞ ঘোড়সাওয়ারদের পাঠালেন সাংস্কৃতিকভাবে একটু উচ্চস্তরীয় তুর্কি, নেইম্যান আর উঘুইরদের পশ্চিম উপত্যকায়। এরা ছিলেন প্রিস্টার জনের শত্রু। আর তিমুজিনকে রুখে দিতে তারা হাত মিলাতে পারত। তবে তাদের কাছে কী আছে তা বোঝার কোনো সুযোগই তিনি তাদের দিলেন না। উত্তরের সাদা পর্বত থেকে, পুরনো বিশবালিক আর খোতেন শহরের ভেতর দিয়ে, মহাপ্রাচীরের দৈর্ঘ্য বরাবর তার সেনারা ঘোড়ায় চড়ে এগিয়ে গেল।
এখানে তিমুজিন সম্পর্কে মার্কো পোলো একটি কথা বলেছেন, “তিনি যখন একটি প্রদেশ দখল করতেন তখন সেখানকার লোকদের কিংবা তাদের সম্পদের কোনো ক্ষতি করতেন না, কিন্তু কেবল নিজের কিছু লোককে সেখানে তাদের লোকদের মাঝে স্থাপিত করে দিতেন, এই সময় তিনি বাকি প্রদেশগুলোতে
আক্রমণ চালাতেন। দখল হওয়া শহরের লোকরা যখন দেখত অন্যদের কাছ থেকে তারা কত সুন্দর নিরাপদে আছে, আর এদের হাতে তাদের কোনো ক্ষতি হচ্ছে না আর দেখত কী ভালো একজন রাজপুত্র তিনি, তখন তারা মনেপ্রাণে তার সঙ্গে যোগ দিত আর তার অনুসারী হয়ে যেত। এভাবে তিনি এতটাই শক্তি সঞ্চয় করেছিলেন যে, মনে হচ্ছিল তিনি পুরো পৃথিবীতেই রাজত্ব করবেন। তিনি নিজেও এক সময় ভেবেছিলেন, পুরো পৃথিবী তিনি জয় করে ফেলবেন।”
তার পুরনো শত্রুদের অবস্থা ছিল এর চেয়ে অনেক বেশি অনভিপ্রেত। একবার তিনি শত্রুগোত্রের সমরশক্তি ভেঙে দেন, মঙ্গোলরা সেই গোত্রের সব লোক আর তাদের পরিবারকে মেরে ফেলেন। গোত্রের যুদ্ধরত পুরুষদের নির্ভরযোগ্য লোকেদের মধ্যে ভাগ করে দেয়া হয়। আর সবচেয়ে সুন্দরী নারীদের নিজেদের স্ত্রীরূপে পেলেন তার যোদ্ধারা। বাকিদের দাস করা হলো। ঘুরে বেড়ানো শিশুদের মঙ্গোল জননীরা পোষ্য করে নিল। পরাজিত গোত্রের চারণভূমি আর গবাদিপশুগুলো নতুন মালিকের কাছে চলে গেল।
এ পর্যন্ত তিমুজিনের জীবনের চলার পথ ঠিক করেছিল তার শত্রুরা। কঠিন অবস্থা থেকে তিনি সঞ্চয় করেছেন শারীরিক শক্তি আর নেকড়ের মতো ধূর্ততা, মনে হয়, যা তাকে প্রাকৃতিকভাবে কাজের দিকে নিয়ে যেত। এখন তিনি এতটাই শক্তিশালী যে, তিনি নিজের ক্ষমতায় দেশ জয় করতে পারেন। অস্ত্র হাতে তাকে মোকাবেলা করা প্রথম মানুষগুলোকে হারাবার পরে তিনি একজন অসংযত শাসক প্রমাণিত হলেন।
তিনি পৃথিবীর নতুন সব এলাকায় প্রবেশ করতে লাগলেন। বহু বছরের পুরনো কাফেলা চলা পথ আর মধ্য এশিয়ার শহরগুলো এবং বিশাল কৌতূহল তাকে পরিচালনা করতে লাগল। তিনি লক্ষ করলেন, বন্দিদের মধ্যে কিছু মানুষ আছে যাদের পোশাক খুব সুন্দর আর তারা বেশ সম্ভ্রান্ত। তারা যোদ্ধাও না, আর তিনি জানতে পারলেন যে এরা জ্যোতির্বিজ্ঞানী—যারা গ্রহ-নক্ষত্র সম্পর্কে জ্ঞান রাখে, চিকিৎসক – যারা বিভিন্ন গাছগাছালির, যেমন রুবার্ব এবং একজন অসুস্থ নারীর রোগে, তার ব্যবহার বোঝে।
একজন পরাজিত গোত্রপতির কাছে কাজ করা একজন উঘুইরকে তার সামনে আনা হলো। তার হাতে একটা সোনার জিনিস ধরা ছিল, যার ওপর অদ্ভুত কারুকাজ করা।
মঙ্গোল জিজ্ঞেস করলেন, “তুমি এটা ধরে আছ কেন?”
সে বিশ্বাসী মন্ত্রী উত্তর দিলেন, “যিনি বিশ্বাস করে আমাকে এই জিনিসটা দিয়েছিলেন, তাকে আমি কথা দিয়েছিলাম তার মৃত্যুর আগে পর্যন্ত আমি এই জিনিসটার দেখাশোনা করব।”
খান মেনে নিলেন, “তুমি সত্যিই খুবই বিশ্বস্ত একজন প্রজা। কিন্তু তিনি তো মারা গেছেন। আর তার যা কিছু ছিল এখন সবই তো আমার। এখন বলো এই জিনিসটা কী কাজের?”
“যখন আমার শাসক, খাজনা হিসেবে রূপো বা শস্য চাইতেন, তিনি তার একজন প্রজাকে অধিকার দিয়ে পাঠিয়ে দিতেন। তার আদেশনামায় এই সিলমোহরের ছাপ থাকা আবশ্যক ছিল, এতে বোঝা যেত এ আদেশ রাজার আদেশ।”
তিমুজিন তখনই তার নিজের জন্য সিল বানাতে নির্দেশ দিলেন, একটা সবুজ পাথরে সাজানো সিল। তিনি উঘুইর বন্দিকে ক্ষমা করে দিলেন। তার রাজদরবারে তাকে একটা স্থান দিলেন। তার সন্তানদের উঘুইর লেখা শেখানোর জন্য শিক্ষক নির্বাচিত করলেন।
যেসব বীর তাকে তার দুঃসময়ে সাহায্য করেছিল তাদের তিনি সবচেয়ে বড় পুরস্কার দিলেন। তাদের ‘অর খান’ করে দেয়া হলো আর সবার ওপর তাদের স্থান দেয়া হলো। কোনো আনুষ্ঠানিকতা ছাড়াই, যে কোনো সময়, রাজদরবারে প্রবেশের অধিকার তাদের ছিল। কোনো যুদ্ধে পাওয়া ধন সম্পদে তারা সবার আগে তাদের অংশ পছন্দ করতে পারত আর তাদেরকে সকল প্রকার কর থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছিল। সত্যিকার অর্থে তারা যাই করত, তার কোনোটাই অন্যায় নয়। নয়বার তাদের মৃত্যুদণ্ড মাফ করে দেয়া হয়েছিল। তাদের যে এলাকা পছন্দ, সেই এলাকাই তারা পেত আর নয় প্রজন্ম পর্যন্ত তার সন্তানরা এই সুবিধা পেত।
গোত্রের সবার মধ্যে ‘অর খান’ হতে চাওয়ার মতো প্রত্যাশিত আর কিছু ছিল না। সেই তিন বছর তারা একটার পর একটা জয় পেতে থাকল, নতুন নতুন এলাকা জয় করতে লাগল। কোনো কিছুই মঙ্গোল খানের অগ্রযাত্রা থামিয়ে রাখতে পারেনি।
কিন্তু এই বিজয়ীর চারপাশে ছিল এশিয়ার দুধর্ষ সব যোদ্ধা, তিয়ান শানের সমুদ্রতটের তুর্কো-মঙ্গোল যোদ্ধারা, যেখানে কিছুদিনের মধ্যেই ঘুচলুক কালো ক্যাথি (কারা কিতাই) শাসন করেন। কিছু সময়ের জন্য কোনো উপজাতীয় শত্ৰুতা বিস্মৃত হয়েছিল। বৌদ্ধ এবং ‘শামান’, শয়তানের পূজারি আর মুসলমান এবং নেস্তোরিয়ান খ্রিস্টান সবাই পাশাপাশি ভাইয়ের মতো বসত আর ঘটনার জন্য অপেক্ষা করত।
যে কোনো কিছুই ঘটা সম্ভব ছিল। আসলে যা ঘটেছিল তা হচ্ছে, মঙ্গোল খান তার পিতৃপুরুষদের সীমাবদ্ধতার অনেক ওপরে উঠে গিয়েছিলেন। তিনি সম্মিলিতভাবে ‘কুরুলতাই’ বা ‘খানদের রাজসভা’ ডাকলেন, যারা এশিয়ার পুরো উঁচু অঞ্চল শাসন করার জন্য একজন মানুষকে নির্বাচন করবে। একজন সম্রাটকে।
তিনি ব্যাখ্যা করে বোঝালেন, নিজেদের ভেতর থেকে তাদেরকে এমন একজনকে বেছে নিতে হবে, অন্যদের ওপর যার কর্তৃত্ব থাকবে। গত তিন বছরের ঘটনাবলির পরে, ‘কুরুলতাই য়ের স্বাভাবিক পছন্দ ছিল তিমুজিন। সবাই ঠিক করলো এর চেয়েও বেশি জরুরি তার একটা যোগ্য পদবি থাকা। সেই জটলা থেকে একজন ভবিষ্য দ্রষ্টা এগিয়ে এসে ঘোষণা দিলেন তার নতুন নাম হবে চেঙ্গিস খাঁ খান। সবচেয়ে মহান শাসক, সব মানুষের সম্রাট।
সভাসদরা খুশি হলো, আর সকলের সম্মিলিত অনুরোধে তিমুজিন নিজেও এই পদবি মেনে নিলেন।
৭. ইয়াসা
১২০৬ সালে রাজসভা হয় এবং সেই বছর ক্যাথির কর্মকর্তারা, যারা পশ্চিমের যুদ্ধযাত্রার দেখাশোনার দায়িত্বে ছিলেন, যাদের দায়িত্ব ছিল মহাপ্রাচীরের ওপারের বর্বরদের ওপর নজর রাখা আর তাদের কাছ থেকে সম্মানী আদায় করা, তারা খবর পাঠাল যে দূরের রাজ্যে একেবারে শান্তি বিরাজ করছে। চেঙ্গিস খান শাসক নির্বাচিত হওয়ার পরে, কয়েক শতকের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো তুর্কি–মঙ্গোল লোকেরা একত্রিত হয়েছিল।
উৎসাহের জোয়ারে ভাসা এই জনগোষ্ঠীর মনে তখন বিশ্বাস জন্মেছিল যে, তিমুজিন, এখন চেঙ্গিস খান, সত্যিই একজন ‘বোগডো’ বা ঈশ্বরের পাঠানো বীর। তার ওপরে রয়েছে উপরের স্বর্গশক্তির আশীর্বাদ। কিন্তু এত উৎসাহ এই বেয়াড়া উপজাতির লাগাম টানতে পারছিল না। তারা অনেক দিন উপজাতীয় সংস্কৃতি দিয়ে শাসিত হয়েছে। আর মানুষের সঙ্গে সঙ্গে সংস্কৃতিও আলাদা হয়।
তাদেরকে সংযত রাখতে চেঙ্গিস খানের রয়েছে মঙ্গোল সেনাবাহিনী। তবে তার সেনাবাহিনীর বেশিরভাগই এখন বয়স্ক। কিন্তু তিনি ঘোষণা দিলেন, তাদের শাসন করতে তিনি ‘ইয়াসা’ বানিয়েছেন। ‘ইয়াসা’ হচ্ছে তার আইনের সঙ্কলন, তার নিজস্ব ইচ্ছে আর অধিক উপযোগী উপজাতীয় সংস্কৃতির সমষ্টি।
তিনি একটা ব্যাপার পরিষ্কার করে দিলেন যে, তিনি বিশেষ করে অপছন্দ করেন চুরি আর ব্যভিচার, যার শাস্তি ছিল মৃত্যুদণ্ড। যদি একটা ঘোড়াও চুরি যায় তারও শাস্তি মৃত্যু। তিনি বলতেন, আমার সবচেয়ে বেশি রাগ হয় যখন শুনি একজন শিশু তার বাবা-মার অবাধ্য, ছোট ভাই তার বড় ভাইয়ের, একজন স্ত্রীর মাঝে একজন স্বামীর তার বিশ্বস্ততা খোঁজা, স্বামীর প্রতি একজন স্ত্রীর পূর্ণ সমর্পণ না থাকা। গরিবদের সাহায্য করতে ধনীদের ব্যর্থ হওয়া আর নেতার প্রতি অধীনস্ত দের সম্মান না দেখানো।
কঠিন পানীয়ের ব্যাপার এই মঙ্গোল ব্যর্থ হন, তিনি বলেন, “একজন মদ্যপ হচ্ছে এমন একজন মানুষের মতো যার মাথায় আঘাত লেগেছে। তার বুদ্ধি আর তার ক্ষমতার ওপর তার দখল নেই। মাসে কেবল তিনবার মদ্যপ হতে পারবে। একবারও যদি না হও, তবে আরও ভালো। তবে কেউ কি পারে একেবারে ছেড়ে দিতে?”
মঙ্গোলদের আরেকটা দুর্বলতা ছিল বজ্রপাতকে ভয় পাওয়া। গোবি অঞ্চলের ভয়ানক ঝড়ের সময় এই ভয় তাদের ওপর এতটাই শাসন করত যে, আকাশের এই ক্রোধ থেকে বাঁচতে তারা হ্রদ আর নদীতে ঝাপিয়ে পড়ত। অন্তত বিশ্বস্ত পর্যটক ফ্রা রুব্রিক তেমনটাই বর্ণনা করেছেন। ‘ইয়াসা’ আইনে বজ্রপাতের সময় গোসল করা বা পানি স্পর্শ করা নিষিদ্ধ করা হয়।
নিজে ভয়ানক রাগী হলেও, চেঙ্গিস খান তার লোকদের সবচেয়ে পছন্দের এই দুর্বলতা, সহিংসতার অধিকার কেড়ে নিলেন। ‘ইয়াসা’ মঙ্গোলদের মধ্যে ঝগড়া নিষিদ্ধ করেছিল। আরেকটা ব্যাপারে তিনি বেশ কঠোর ছিলেন—“আর কোনো চেঙ্গিস খান তৈরি হতে না দেয়া।” তার বা তার সন্তানদের নাম কেবল সোনা দিয়ে লেখা যাবে আর নয়তো লেখাই যাবে না। নতুন এই সম্রাটের প্রজারা ইচ্ছাকৃতভাবে তার নাম মুখেই আনতে পারবে না।
নিজে নাস্তিক হলেও তিনি বড় হয়েছিলেন দারুণ কষ্টে আর গোবির ‘শামান’—দের (ধর্মগুরু) মাঝে। ধর্মীয় ব্যাপারগুলোকে তার আইন প্রশ্রয় দিয়েছিল। অন্য ধর্মবিশ্বাসের নেতাদের, তাদের অনুগামীদের, মসজিদের মুয়াজ্জিনদের কর মউকুফ করেছিলেন। সত্যিকার অর্থে, বিচিত্র যাজকদের সারি মঙ্গোল শিবিরের পেছন পেছন চলত—ঘুরে বেড়ানো হলুদ আর লাল লামারা তাদের প্রার্থনার চাকতি ঘোরাত, তাদের কেউ কেউ “খ্রিস্টানদের শয়তানের সাথে মিল আছে এমন ছবি আঁকা খ্রিস্টান যাজকদের পোশাক পরত”— ফ্রা রুব্রিক এমনটাই বলেছেন। মার্কো পোলো বলেন, চেঙ্গিস খানের যুদ্ধের আগে জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা শুভ-অশুভের লক্ষণ বলত।
‘সারাসিন’ বা ভবিষ্যৎদ্রষ্টারা ঠিকঠাকমতো ভবিষ্যদ্বাণী দিতে ব্যর্থ হতো, কিন্তু নেস্তোরিয়ান খ্রিস্টানদের সাফল্য একটু বেশি ছিল। তারা দুজন প্রতিপক্ষ নেতার নামাঙ্কিত দুটো ছোট কঞ্চি একটার ওপর আরেকটা রেখে সাম বই থেকে জোরে জোরে পাঠ করত। যদিও চেঙ্গিস খান ভবিষ্যৎদ্রষ্টাদের কথা শুনতেন— তার জীবনের শেষের দিকে ক্যাথি জ্যোতির্বিদদের কথাও মনোযোগ দিয়ে শুনতেন—তবে তাদের কথায় কখনোই তার কোনো যাত্রা বন্ধ করেননি।
‘ইয়াসা’ দিয়ে তিনি ‘চর’, সমকামী, মিথ্যা সাক্ষী আর খারাপ জাদুকরদের শায়েস্তা করেছিলেন। তাদের শাস্তি ছিল মৃত্যু।
‘ইয়াসা’র প্রথম আইনটি ছিল লক্ষণীয়। “আদেশ করা যাচ্ছে যে সকলকে এক ঈশ্বরে বিশ্বাস করতে হবে। যিনি স্বর্গ আর মর্তের স্রষ্টা, প্রাচুর্য আর দারিদ্র্যের একমাত্র দাতা, জীবন আর মৃত্যু কেবল যার ইচ্ছায় হয়, সব কিছুর ওপর যার একচ্ছত্র আধিপত্য আছে।” এখানে প্রথম দিকের নেস্তোরিয়ানদের শিক্ষার প্রতিধ্বনি পাওয়া যায়। তবে এই আইনগুলো কখনো প্রকাশ্যে উচ্চারিত হয়নি। নিজের প্রজাদের মধ্যে বিভেদরেখা তৈরির কোনো ইচ্ছেই চেঙ্গিস খানের ছিল না। প্রজাদের মধ্যে তিনি নিজেদের বড় ভাববার সুপ্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতা জাগিয়ে দিতে চাননি।
একজন মনোবিজ্ঞানী ভাবতে পারেন যে ‘ইয়াসা’র তিনটি উদ্দেশ্য ছিল— চেঙ্গিস খানের প্রতি আনুগত্য, উপজাতি গোত্রগুলোর মধ্যে একটা বন্ধন তৈরি করা আর অন্যায়ের নির্দয় শাস্তি। আইনগুলো মানুষের সঙ্গে সম্পর্কিত ছিল, সম্পদের সঙ্গে নয়। একজন মানুষকে হাতেনাতে না ধরলে কিংবা সে নিজে দোষ স্বীকার না করলে তাকে দোষী সাব্যস্ত করা হতো না। একটা কথা মনে রাখা দরকার যে, অশিক্ষিত মঙ্গোলদের মধ্যে মুখের কথাই সব ছিল।
তার চেয়েও বড় কথা, একজন উপজাতির ওপর যদি কোনো অন্যায়ের ছোঁয়া লাগত, আর সে যদি সেই অন্যায় করে থাকতো, তবে সে তা স্বীকার করে নিত। এমনও ঘটনা ঘটেছে যে কেউ এসে খানকে বলেছে, সে অন্যায় করেছে আর তাকে শাস্তি দেয়া হোক।
তার জীবদ্দশার শেষের দিকে, খানের প্রতি আনুগত্য ছিল চরম। হাজার মাইল দূরে অবস্থান করা কোনো সেনাদলের সেনাপতি বরখাস্ত হয়েছেন কেবল সাধারণ এক প্রেরকের হাতে পাঠানো এক ফরমানের জোরে।
ফ্রা কারপিনি বলেছিলেন, “অন্য যে কোনো মানুষের চেয়ে তারা তাদের শাসকদের প্রতি অনেক বেশি অনুগত ছিল। তাদেরকে প্রচণ্ড সম্মান করত আর কথায় বা কাজে কখনোই তাদেরকে ধোঁকা দিত না। খুব কমই তারা ঝগড়া বা মারামারি করত। আহত বা নিহতের ঘটনা খুবই কম ঘটত। কোথাও চোর বা ডাকাত পাওয়া যেত না, আর তাই তাদের গরুগাড়িগুলো, যেখানে তাদের ধন—সম্পদ রাখা থাকত, সেখানে কখনোই তারা তালা দিয়ে রাখতো না। যদি তাদের পালের কোনো পশু কোথাও চলে যেত, তবে যে সেটা খুঁজে পেত, সে সেটা চরিয়ে ফিরিয়ে দিয়ে যেত কিংবা যে অফিসার সেটা খোঁজার দায়িত্বে আছে তাকে দিয়ে যেত। নিজেদের মধ্যে তাদের আচরণ ছিল খুবই ভদ্র। ‘ভোজ’-এর ঘটনা খুব কম ঘটত, তবে হলে, সবাই মিলে ভাগ করে খেত। খাদ্য সঙ্কটে তারা খুব ধৈর্য ধরে থাকত। কয়েক দিন অনাহারে থাকলেও, তারা গানও গাইত আবার বিয়েও করত। যাত্রাপথে গরম কিংবা ঠাণ্ডা দুটোই কোনো অনুযোগ ছাড়াই তারা মেনে নিত। মদ খেলেও একেবারে মাতাল হয়ে যেত না। আর মদ খাওয়া অবস্থায় কখনোই ঝগড়া করত না। (এই ব্যাপারটা ইউরোপের বাইরের অভিযাত্রীদের খুব অবাক করেছিল)।
“মাতাল হওয়া তাদের মধ্যে সম্মানের ব্যাপার ছিল। যখন কেউ অতিরিক্ত মদ খেয়ে বমি করে ফেলত, সে আবার মদ খাওয়া শুরু করত। অন্য লোকদের প্রতি তারা ছিল অতিরিক্ত অহঙ্কারী আর বিরক্তিকর। একজন মানুষ যতই ভালো হোক তার প্রতি তারা তাচ্ছিল্য দেখাতো। এজন্যই আমরা দেখতে পাই, যখন রাশিয়ার মহান ডিউক, জর্জিয়ার রাজপুত্র আর অনেক সুলতান বা অন্যান্য মহান লোকেরা সম্রাটের দরবারে এসেছিলেন, তাদের কোনো সম্মান দেখানো হয়নি। এমনকি তাদের আপ্যায়নের দায়িত্ব দেয়া হতো তাতারদের। এই তাতারদের অবস্থান যত নিচেই হোক না কেন, এসব উঁচু বংশের বন্দিদের সামনে তারা উঁচু স্থানে বসত।
“অন্য লোকেদের জন্য তারা খুবই বিরক্তিকর ছিল। খুবই অপমানজনক আচরণ করত আর অবিশ্বাস্য রকমের প্রতারক ছিল। যে দুব্যবহার করার ইচ্ছে তাদের থাকতো, তা তারা খুবই সতর্কতার সঙ্গে লুকিয়ে রাখত, কেউই বুঝতে পারত না। অন্যদের খুন করাকে তারা কোনো বড় ব্যাপারই মনে করত না।”
তারা নিজেদের সাহায্য করত আর অন্য লোকেদের ধ্বংস করত। এ ছিল “ইয়াসা’র প্রতিধ্বনি। এই যুদ্ধবাজ আর অপরকে ধোঁকা দেয়া গোত্রের লোকদেরকে একত্রে রাখবার এটাই ছিল একমাত্র উপায়। তাদেরকে নিজেদের মতো থাকতে দিলে তারা আবার নিজেদের মধ্যে চারণভূমি আর সম্পদ নিয়ে যুদ্ধ আর খুনোখুনি শুরু করে দিত। লাল চুলো খাঁ খান বাতাসের বীজ বপন করে ঘূর্ণিঝড়ের ফসল তুলেছিলেন।
তিনি অবশ্যই এই ব্যাপারটা বুঝেছিলেন। অন্তত তার পরের কাজ দেখে তাই মনে হয়। তিনি এসব উপজাতির মধ্যেই বড় হয়েছিলেন। তিনি জানতেন নিজেদের মধ্যে মারামারি বন্ধ করার একমাত্র উপায় হচ্ছে এদের অন্য কোথাও যুদ্ধে ব্যস্ত রাখা। তিনি ঘূর্ণিঝড় তৈরি করতেন আর তা গোবি অঞ্চলের বাইরে পাঠিয়ে দিতেন।
এই সময়ে, ‘কুরুলতাই’ বা তাঁবুগ্রামের ভোজ শেষ হওয়ার আগে, ইতিহাস আমাদের তার একটা ঝলক দেখায়। তার জন্মভূমিকে ছায়া দেয়া দেলিগু-বৌদাক পাহাড়ের নিচে, এখন সুপরিচিত ‘সাদা নাইন ইয়াক টেইল’ পতাকার নিচে দাঁড়িয়ে, বৌরচিকুন আর তার সঙ্গে একত্রিত হওয়া গোত্রপ্রধানদের উদ্দেশে বলেছিলেন, “যারা আমার সঙ্গে তাদের ভালো-মন্দ ভাগ করে নেবে, তাদের আনুগত্য আমার কাছে থাকবে ক্রিস্টাল পাথরের মতোই পরিষ্কার। আমি তাদেরকে মঙ্গোল বলেই ডাকব। তাদেরকে আমি সব সময় ক্ষমতার চূড়ায় দেখতে চাই।”
এই অবাধ্য জাতিগোষ্ঠীকে এক করার কল্পনা তিনি করেছিলেন। বুদ্ধিমান আর রহস্যময় উঘুইরদের, বিশ্বস্ত কারাইতদের, রুক্ষ ইক্কা মঙ্গোলদের, ভয়ঙ্কর তাতারদের, মেরকিটদের, তুন্দ্রা অঞ্চলের মানুষদের, শিকারিদের— এশিয়ার উচ্চভূমির সব অশ্বারোহীদের তিনি বিশাল এক জাতিগোষ্ঠীতে পরিণত করেছিলেন, যার নেতা হয়েছিলেন তিনি নিজে।
এর আগেও, ক্যাথিদের আক্রমণকারী হিউং নু, খুব অল্প সময়ের জন্য, তাদের এভাবে একত্র করতে পেরেছিলেন। মহাপ্রাচীর তৈরির মধ্য দিয়ে এই আক্রমণ বন্ধ হয়েছিল। তাদের অন্তরের গভীরে বাস করা এই অনুভূতিকে জাগিয়ে দেয়ার দারুণ এক ক্ষমতা চেঙ্গিস খানের ছিল। তাদের নেতৃত্ব দেয়ার ক্ষেত্রে ভার ক্ষমতার ব্যাপারে তার কোনো সন্দেহই কখনো ছিল না।
তিনি তাদের চোখের সামনে অপরিচিত এলাকা দখলের স্বপ্ন ঝুলিয়ে দিতেন। তবে এক্ষেত্রে তিনি নিজে ঝাঁপিয়ে পড়তেন তাদেরকে উদ্দীপ্ত করতে। এজন্যই তিনি তৈরি করেছিলেন ‘ইয়াসা’।
প্রত্যেক সৈন্যের জন্য তার গোত্রের সঙ্গীদের অর্থাৎ যে দশজন নিয়ে তার দল, তাদের পরিত্যাগ করা নিষিদ্ধ ছিল। আর অন্যদের জন্যও বারণ ছিল সেই দশজনের দলের কোনো আহত সৈন্যকে ফেলে যাওয়া। যুদ্ধের নেতৃত্বে থাকা সেনাপ্রধান নিজে পিছিয়ে আসার সিদ্ধান্ত না নিলে কোনো সৈন্যের জন্য যুদ্ধক্ষেত্র ছেড়ে পালানো নিষিদ্ধ ছিল।
(যুদ্ধে আকৃষ্ট করবার জন্য বলা ছিল সাধারণ একজন সেনা হলেও যুদ্ধে জয়ের পরে পরাজিতের কাছ থেকে যে যা পারে লুট করে নিতে পারবে)।
পর্যবেক্ষক ফ্রা কারপিনি বলেন, চেঙ্গিস খান ‘ইয়াসা’র এই অংশ প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন, আর এজন্য তিনি মঙ্গোলদের সম্পর্কে বলেছিলেন, “যতক্ষণ পতাকা উত্তোলিত থাকত, ততক্ষণ তারা ময়দান ছাড়ত না, আর কোনো শত্রুর কাছ থেকে কিছু নিলে বা ছেড়ে দিলে কোনো প্রশ্ন করা হতো না।”
তার সেনারা উপজাতির একরাশ বিশৃঙ্খল সমাবেশ ছিল না। রোমান সেনাদের মতো এর একটি স্থায়ী স্থাপনা ছিল। দশ থেকে দশ হাজার অশ্বারোহী নিয়ে তৈরি হতো একেকটি ‘ডিভিশন’। এদের বলা হতো ‘তুমান’। আর এর নেতৃত্বে থাকত ‘অর খান’রা বা খানের সেনাপতিরা। নির্ভুল সুবোতাই, অভিজ্ঞ মুহুলি, দুর্ধর্ষ খেপ নয়নসহ মোট এগারোজন।
তার সেনাদের অস্ত্রসম্ভার, বিশেষ করে বর্শা, ভারী অস্ত্র আর বর্মগুলো নির্দিষ্ট কিছু সেনা কর্মকর্তার কাছে গচ্ছিত থাকত। এগুলো দেখাশোনা করা হতো আর নিয়মিত পরিষ্কার করা হতো। যদি কখনো যুদ্ধে যাওয়ার প্রয়োজন হতো তখন যোদ্ধাদের ডেকে পাঠানো হতো। একজন ‘গুর খান’-এর তত্ত্বাবধায়নে তাদের মাঝে এসব অস্ত্র বিতরণ করা হতো। তীক্ষ্ণ বুদ্ধির এই মঙ্গোল লাখ মাইল বিস্তৃত সমতল আর পাহাড়ি এলাকায় হাজার হাজার লোককে অস্ত্র দিয়ে খোলা ছেড়ে দেয়ার পক্ষে ছিলেন না।
তার সেনাদের শক্তি অন্য খাতে ব্যয় করার জন্য, ‘ইয়াসা’ আদেশ দিল শীতকালে, বরফ পড়ার শুরু থেকে প্রথম ঘাস গজানোর আগে পর্যন্ত, সবাই ‘অ্যান্টিলোপ’, হরিণ আর বন্য গাধা শিকারে ব্যস্ত থাকবে।
বসন্তের সময় তিনি ঘোষণা করলেন রাজসভা বসবে আর সব উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সেখানে উপস্থিত হতে বললেন, “যারা আমার আদেশ শোনা সত্ত্বেও এখানে না এসে নিজেদের ডেরায় অবস্থান করেছে, তাদের অবস্থা হবে গভীর পানিতে পড়া পাথরের মতো কিংবা জঙ্গলে পড়ে থাকা তীরের মতো। তারা হারিয়ে যাবে।”
চেঙ্গিস খান যে তার পূর্বপুরুষদের ঐতিহ্য থেকে শিক্ষা নিয়েছিলেন, আর নিজে বিদ্যমান প্রথা মেনে চলেছিলেন, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে প্রশিক্ষিত এবং স্থায়ী সেনাবাহিনী সংবলিত একটি জাতি তৈরির কৃতিত্ব অবশ্যই তার। ‘ইয়াসা’ দিয়ে তিনি শাসন করেছিলেন আর তার কঠিন শাসন তাদেরকে একত্রিত রেখেছিল। চেঙ্গিস খানের অধীনে ছিল যুদ্ধ করার একদল নতুন সুশৃঙ্খল যোদ্ধা। যে কোনো দেশে খুব দ্রুত তারা যুদ্ধ করবার জন্য পৌঁছে যেতে পারত। তার পূর্বে কেবল পারস্য আর পার্থিয়া প্রদেশের সেনাদেরই সম্ভবত এমন বড় সেনাবাহিনী ছিল। তবে মঙ্গোলদের মত এমন ধংসাত্মক ক্ষমতা আর দুর্দমনীয় সাহস তাদের ছিল না।
যদি ঠিকভাবে ব্যবহার করা যায় তবে প্রচণ্ড ধ্বংসযজ্ঞ করার মতো অস্ত্র তার সেনাবাহিনীর ছিল, আর তিনি তাদের নিয়ন্ত্রণে রেখেছিলেন। কারণ চেঙ্গিস খান তাদেরকে খুব সুচারুভাবে পরিচালনা করে সংযত রেখেছিলেন। মহাপ্রাচীরের পেছনে থাকা প্রাচীন এবং স্থির ক্যাথি সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধেও এই সংযম প্রদর্শনের ব্যাপারে তিনি দৃঢ় প্রত্যয়ী ছিলেন।