চেঙ্গিস খান – দ্বিতীয় পৰ্ব

১০. ক্যাথি

মহা প্রাচীরের পেছনের সবকিছুই এশিয়ার উঁচু অঞ্চল থেকে বেশ আলাদা ছিল। এখানে বিদ্যমান ছিল পাঁচ হাজার বছরের পুরনো একটি সভ্যতা, ছিল ত্রিশ শতকের পুরনো লিখিত নথি। এখানে বসবাস করা মানুষদের জীবন কাটত গভীর চিন্তা আর মারামারি করে। 

এক সময় এদের পূর্বপুরুষরা ছিল উপজাতি, অশ্বারোহী, আর তীর-ধনুক চালনায় অভ্যস্ত। তবে তিন হাজার বছর ধরে এরা আরো ছুটে বেড়ানোর বদলে শহর তৈরি শুরু করে। আর এই সময়টায় অনেক কিছু তৈরি করা সম্ভব হয়। তাদের জনসংখ্যা বেশ বেড়ে যায়। যখন জনসংখ্যা অনেক বেড়ে যায় তখন ভিড় আটকাতে তারা দেয়াল তৈরি করে। আর তারা নিজেদেরকে বিভিন্ন শ্রেণিতে ভাগ করে ফেলে। 

মহাপ্রাচীরের পেছনের মানুষগুলো গোবি অঞ্চলের মতো ছিল না। তাদের মধ্যে ছিল কৃতদাস আর কৃষক —বিদ্বান, সৈন্য আর ভিক্ষুক—সাহিত্যিক, শাসক আর রাজপুত্র। সব সময় তাদের থাকতো একজন সম্রাট বা স্বর্গের পুত্র (তিয়েন সি) আর থাকতো রাজদরবার বা স্বর্গের মেঘ। 

১২১০ সালে, বারো পশুর পঞ্জিকার ভেড়া বছরে, সিংহাসন তখন চীন বা স্বর্ণ সাম্রাজ্যের দখলে। রাজদরবার ছিল আধুনিক পিকিংয়ের কাছে ইয়েন-কিংয়ে। 

ক্যাথি ছিল একজন বয়স্ক মহিলার মতো। ধ্যানে মগ্না, সম্ভবত একটু বেশি বিস্ত ত পোশাক পরিহিতা, চারপাশে অনেক শিশু, কিছুটা অবহেলিত। শহরটির জেগে ওঠা আর ঘুমিয়ে পড়বার সময় ছিল নির্ধারিত। দুই চাকার ঘোড়া গাড়িতে চড়ে, ভৃত্য পরিবেষ্টিত হয়ে এটি এগিয়ে যেত। মৃত্যুর পাথরের সামনে প্রার্থনা করত। 

এদের পোশাক ছিল হরেক রঙের খসখসে সিল্কের —যদিও ভৃত্যরা চলত নগ্নপায়ে আর সুতি কাপড়ের আলখাল্লায়। উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের মাথার ওপরে ধরা থাকত ছাতা। অশুভ আত্মাকে প্রবেশে বাঁধা দিতে বাড়ির প্রবেশদ্বারে থাকত পর্দা। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে মাথা নুইয়ে তারা সম্ভাষণ জানাত। সব সময় চেষ্টায় থাকত কীভাবে আচার-আচরণ আরো উন্নত করা যায়। 

এক শতাব্দী আগে এই ক্যাথিবাসী এবং চীনবাসীদের পূর্বসূরিরা বর্বর ছিল। তারা উত্তর থেকে এখানে এসেছিল। ধীরে ধীরে মহা প্রাচীরের পেছনের বিশাল ভিড়ে তারা বিলীন হয়ে যায়। এক সময় ক্যাথিদের আচার-আচরণের সঙ্গে তারা একাত্ম হয়ে যায়। তাদের পোশাক পরতে থাকে আর তাদের অনুষ্ঠান পালন করতে থাকে। 

ক্যাথি শহরে ছিল বিনোদন হ্রদ। সেখানে থাকত বজরা। পুরুষরা সেখানে সুরা সহযোগে বসত, রমণীর হাতের বাজানো রুপোর ঘণ্টার সুর শুনত। কখনো প্যাগোডার বাঁকা ছাদের নিচে পৌঁছে যেত বা মন্দিরের ঘণ্টাধ্বনির ডাকে সাড়া দিত। 

বাঁশের ওপর লেখা ভুলে যাওয়া কোনো এক সময়ের বই পড়ত আর দীর্ঘক্ষণ চলা ভোজে বসে তাংয়ের সোনালি দিন নিয়ে একসঙ্গে আলোচনা করত। এরা ছিল চীনের লোক। একটি সাম্রাজ্যের অনুসারী। সিংহাসনে আসীনদের ভৃত্য। তারা প্রথা অনুযায়ী চলত। প্রথা তাদের শিখিয়েছিল, প্রথম কাজ হচ্ছে সম্রাটের সেবা করা। যদিও এর বিরোধিতা তারা একবার করেছিল। যখন সম্রাট কুং সম্রাট হওয়ার পরে একজন পতিতা নারীকে সঙ্গে নিয়ে রাজকীয় গাড়িতে চড়ে ভৃত্যদের সামনে এসেছিলেন, তখন ভৃত্যরা সম্মিলিতভাবে সবাই চিৎকার করেছিল, “দেখো এখানে সামনে আছে লোভ আর পিছনে পুণ্য।” 

একজন ভবঘুরে কবি, নদীর ওপরে অপূর্ব জ্যোৎস্না রাতের মাতাল করা সৌন্দর্য উপভোগ করতে গিয়ে যদি পানিতে ডুবে মারাও যায়, তারপরও সে কেবল কবিই থাকত। নিখুঁত হওয়ার চেষ্টা ছিল খুব কষ্টকর কাজ। তবে ক্যাথিদের সময়ের অভাব ছিল না। 

অল্প একটু রং আর সিল্কের তুলি নিয়ে একজন আঁকিয়ে মগ্ন হয়ে আঁকতেন কখনো গাছের ডালে বসা একটা পাখি, কখনো বরফে ঢাকা পাহাড়। শুধু পুঙ্খানুপুঙ্খ নয়, নিখুঁতভাবে পুঙ্খানুপুঙ্খ। জ্যোতির্বিদ তার বাড়ির ছাদে গ্রহ—নক্ষত্রের প্রতিটি নড়াচড়া লক্ষ্য করছেন, যুদ্ধের চারণকবিরা ছিলেন ধ্যানমগ্ন। 

চারণকবিরা, নিজেরা মৃত্যুর দৃশ্য দেখে ইস্তফা দিয়ে বলতেন, এই হচ্ছে ক্যাথিদের ঐতিহ্য। 

যুদ্ধের যে সরঞ্জাম তাদের ছিল তা হচ্ছে বিশটি ঘোড়ায় চালিত ঘোড়াগাড়ি, যা ছিল পুরনো এবং অকার্যকর। কিন্তু ছিল পাথর নিক্ষেপকারী যন্ত্র। বিশাল এক ধনুক, দশজন মিলেও সেটা বাঁকা করে দড়ি পরাতে পারত না। দুই শ সৈন্য দিয়েও সেই টান টান দড়িকে পেছনে টানা যেত না। তাদের ছিল ‘উড়ে যাওয়া আগুন’, আর বাঁশের নল ফাটিয়ে দিতে পারে এমন আগুন। 

যখন থেকে সশস্ত্র সেনারা ঘোড়ার গাড়ি নিয়ে পশ্চিম এশিয়ার দিকে যুদ্ধযাত্রা করত তখন থেকেই যুদ্ধ শুরু করাটা ক্যাথিদের কাছে ছিল একটা শিল্প। সেনাপ্রধানের ঘাঁটিতে একটা উপাসনালয় স্থাপন করা হতো, যাতে তিনি কোনো বাধা ছাড়াই পুরো পরিকল্পনা নিয়ে মগ্ন থাকতে পারেন। যুদ্ধের ঈশ্বর নামে পরিচিত কুওয়ান তাইয়ের কখনো অনুরাগীর অভাব হতো না। ক্যাথির শক্তি ছিল এর প্রশিক্ষিত সেনাদের নিয়মানুবর্তিতায়। আর দুর্বলতার ব্যাপারে সপ্তদশ শতকের এক ক্যাথি জেনারেল আশঙ্কা করে লিখেছিলেন, “একজন শাসক যদি তার সেনাকে তার রাজ্যের মতো করে চালাতে চান তবে তিনি তার সেনাদের জন্য দুর্ভাগ্য বয়ে আনবেন। তার সেনারা কী সমস্যায় পড়েছে বা সেনার মধ্যে কী সমস্যা আছে, সে সম্পর্কে তিনি যখন কোনো খোঁজ না রাখেন তো একে বলা হয় সেনাবাহিনীর খুঁড়িয়ে চলা। এমনটা হলে সেনাদের মধ্য অস্থিরতা কাজ করে। 

“আর যখন সেনারা অস্থির আর অবিশ্বাসী হয়ে যায়, তখন উচ্ছৃঙ্খলতা আসে আর জয় তখন পরিত্যক্ত হয়।” 

ক্যাথির দুর্বলতা ছিল এর সম্রাটে, যার অবশ্যই উচিত ছিল ইয়েন-কিংয়ে থাকা আর যুদ্ধের ব্যাপার সেনাপতিদের হাতে ছেড়ে দেয়া। প্রাচীরের ওপাশের উপজাতির মূল শক্তি ছিল যুদ্ধ পরিচালনায় খানের পারদর্শিতা, যিনি নিজে ব্যক্তিগতভাবে তার সেনাদেরকে নেতৃত্ব দিতেন। 

চেঙ্গিস খানের অবস্থা অনেকটা ইতালির হ্যানিবলের মতো ছিল। তার ছিল সীমিতসংখ্যক সৈন্য। একটা নির্ণায়ক পরাজয় তাকে আবার ফেরত পাঠাবে মরুভূমিতে। সন্দেহজনক একটা জয়ও কোনো কাজে দেবে না। তার জয় হতে হবে নির্ণায়ক এবং তা আসতে হবে খুব কম সৈন্য হারিয়ে। আর তাকে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামতে হবে এমন একজনের সঙ্গে যে কৌশলে সেরা। 

এদিকে কারাকোরামে তিনি এখনো স্বর্ণালি সম্রাটের প্রজা ছিলেন। তাকে বলা হতো ‘বিদ্রোহীদের বিপক্ষের সেনাপ্রধান।’ 

আগে, যখন ক্যাথিদের সৌভাগ্য ঊর্ধ্বমুখী ছিল, প্রাচীরের বাইরের যাযাবরদের কাছে রাজা সম্মানী দাবি করেছিলেন। দুর্বল সময়ে ক্যাথি রাজত্ব এই যাযাবরদের কিনে ফেলত। রুপোর জিনিস, সিল্ক, কারুকার্য করা চামড়া, গাড়ি ভর্তি শস্য আর মদ পাঠিয়ে তাদের আক্রমণ থেকে বিরত রাখত। নিজেদের সম্মান বজায় রাখতে রাজপরিবার তখন এগুলোকে বলত উপহার। শক্ত সময়ে এসব যাযাবর খানদের কাছ থেকে চাওয়া এই অর্থকে তারা তাদের সম্মানী বলত। 

এই শিকারি উপজাতি দারুণ সব উপহারও ভোলেনি, আর ভোলেনি তাদের কাছ থেকে ক্যাথি কর্মকর্তাদের বিরক্তিকরভাবে সম্মানী আদায় করা আর প্রাচীরের ওপার থেকে টুপি আর কোমরবন্ধ’ পরা এসব মানুষদের বিরল অভিযান। তাই পূর্ব গোবির লোকজনরা, এই বর্তমান সময়ে, স্বর্ণালি রাজার প্রজা— তত্ত্বীয়ভাবে রাজার পশ্চিমাঞ্চলের সেনাপ্রধান দ্বারা প্রশাসিত, যদিও তিনি সেখানে অনুপস্থিত। চেঙ্গিস খান ‘বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে সেনাপ্রধানে’র পদে আসীন। সময়মতো নথি দেখে ইয়েন কিং তার কাছ লোক পাঠালেন সম্মানী হিসেবে ঘোড়া এবং গবাদি নেয়ার জন্য। তিনি সেই সম্মানী দিলেন না। 

অবস্থা, বুঝতেই পারছেন, এখন ঠিক চীনাদের মতো। চেঙ্গিস খানের বর্তমান মানসিকতা এখন দুটো শব্দ দিয়ে বর্ণনা করা যায়— ‘সতর্কভাবে অপেক্ষমাণ। 

গোবি একাকায় যুদ্ধযাত্রার সময় তিনি মহাপ্রাচীর দেখেছেন। এর পাথর আর ইটের গড়ন, সঙ্গে এর দরজার ওপরের মিনারগুলো এবং এর ওপরের অংশ, যার ওপরে ছয়জন ঘোড়সওয়ার পাশাপাশি চলতে পারে, খুব মনোযোগ দিয়ে দেখেছেন। 

অতি সম্প্রতি তিনি এমনভাবে তার পতাকা প্রদর্শন করেছিলেন যেন কাছের এক দরজা থেকে অন্য দরজায় তা দেখা যায়—আর এই ঘটনায় স্বর্ণালি রাজা বা তার পশ্চিমের সেনাপ্রধান বিন্দুমাত্র নজর দেয়নি। কিন্তু সেই প্রান্তের উপজাতিরা, যারা দেয়ালের ছায়ায় থেকে ক্যাথির রাজার জন্য কাজ করত, এই সাহসী কাজটা দেখেছিল। আর তারা নিজেদের মধ্যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যে স্বর্ণালি রাজা এই যাযাবর গোত্রপ্রধানকে ভয় পান। 

আসলে ব্যাপারটা তা ছিল না। দেয়ালঘেরা শহরে নিরাপদ লক্ষ লক্ষ ক্যাথিবাসী ঘুণাক্ষরেও এই আড়াই লাখ যোদ্ধার গোত্রকে নিয়ে ভাবেনি। স্বর্ণালি রাজা, দক্ষিণে, সমুদ্রের পুত্রের ওপারে, ইয়াং ঝিতে, সুংদের সঙ্গে অবিরাম চলা পুরনো যুদ্ধে মঙ্গোলদের কিছু সম্মানী দিয়ে তাদের সহযোগিতা চেয়েছিলেন। 

চেঙ্গিস খান সঙ্গে সঙ্গে বেশকিছু সেনা তাদেরকে ধার দিলেন। খেপ নয়ন অর খানদের ভেতর আরো অনেকে এই সেনাদলের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। স্বর্ণালি রাজার হয়ে তারা কী করেছিলেন তা জানা যায় না। তবে তারা তাদের চোখ ব্যবহার করেছিলেন, আর প্রশ্ন করেছিলেন। 

যাযাবরদের মতো রাস্তা মনে রাখার সব ক্ষমতা তাদের ছিল। যখন তারা গোবিতে ফিরে এলো, তখন তারা ক্যাথি সম্পর্কে সুন্দর একটা পরিষ্কার ধারণা নিয়ে ফেরত এলো। 

তারা আশ্চর্য সব গল্প তাদের সাথে নিয়ে ফেরত এলো। ক্যাথিতে, পাথরের পাটাতনের ওপর, নদীর এক পাশ থেকে অন্য পাশে পরিষ্কার রাস্তা চলে গেছে, কাঠের তৈরি ‘কিবিকাস’ বা তাঁবুগাড়ি নদীর ওপর ভাসছে, সব বড় শহর উঁচু প্রাচীর দিয়ে ঘেরা। ঘোড়া সেসব প্রাচীর লাফিয়ে পার হতে পারবে না। 

ক্যাথির লোকেরা সব রঙের নানকিন আর সিল্ক কাপড়ের ‘ভেস্ট’ (কোমর পর্যন্ত ঝোলানো হাতাবিহীন একধরনের পোশাক) পরত, এমনকি বেশ কয়েক ভৃত্যের সাতটির মত ‘ভেস্ট’ ছিল। পুরনো চারণকবিদের বদলে নতুন কবিরা রাজদরবারকে আনন্দ দিত— বীর পুরুষদের নিয়ে গুনগুন করে গান গাইত না, সিল্কের কাপড়ে শব্দগুলো লিখত। এই শব্দগুলোয় নারীদের সৌন্দর্যের বর্ণনা থাকত। সবকিছু ছিল খুব সুন্দর। 

তার সেনারা মহা প্রাচীরের ওপারে আঘাত হানতে খুবই উৎসাহী হয়ে উঠেছিল। তাদের তুষ্ট করলে, তার বন্য যোদ্ধাদের নিয়ে যদি তিনি ক্যাথি আক্রমণ করতেন, তবে তা হতো খানের সর্বনাশ ডেকে আনারই নামান্তর। এবং তার নিজের রাজত্বের জন্যও তা বিপর্যয়কর। তিনি যদি তার নিজ রাজ্য ছেড়ে এভাবে যুদ্ধে যান, আর ক্যাথিতে যুদ্ধে পরাজিত হন, তবে তার অন্য শত্রুরা এই সুযোগে মঙ্গোল রাজত্বের ওপর হামলা করতে দ্বিধা করবে না। 

গোবি মরুভূমি ছিল তার। তবে তিনি দক্ষিণ, দক্ষিণ-পূর্ব আর পশ্চিমে তাকালে তিনজন ভয়ঙ্কর শত্রু দেখতে পাচ্ছিলেন। দক্ষিণের কাফেলা চলার পথ বা ‘নান লু’ বরাবর আছে হিয়ার আশ্চর্য সাম্রাজ্য—যাকে বলা হয় ডাকাতের সাম্রাজ্য। এখানে থাকে শীর্ণকায় শিকারি তিব্বতিরা। এরা পাহাড়ের ওপর থেকে নেমে এসে ক্যাথিদের লুটপাট করে। এদের ওপারে রয়েছে কালো ক্যাথিদের ক্ষমতা, এক ধরনের পাহাড়ি সাম্রাজ্য। পশ্চিমে আছে কিরঘিজরা, এখনো পর্যন্ত এরা মঙ্গোলদের থেকে দূরেই থেকেছে। 

এমন সব ভয়ঙ্কর প্রতিবেশী থাকা সত্ত্বেও, চেঙ্গিস খান, অর খানদের নেতৃত্বে তার সেনার একটি অশ্বারোহী অংশকে পাঠিয়েছিলেন। তিনি নিজেও এই হিয়া দেশে কয়েকবার যুদ্ধ করেছেন। এই হামলাগুলোর কারণে, হিয়া গোত্রপ্রাধান ঠিক করলেন, মঙ্গোলদের সঙ্গে শান্তি চুক্তি করাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। রক্তের বন্ধন দিয়ে শান্তিচুক্তিকে শক্তিশালী করা হলো। হিয়াদের একজন গোত্রপ্রধানের কন্যাকে কনে হিসেবে চেঙ্গিস খানের কাছে পাঠানো হলো। পশ্চিমেও কিছু সন্ধি হলো। এর সবই ছিল সাবধানতার কারণে। তবে এতে অনেক গোত্রপতির ভেতর তিনি অনেক সহযোগী পেলেন আর তার সেনাদলের জন্য অনেক সৈন্য। এর ফলে তার সেনারা নিজেরা অভিযানের জন্য বেশ প্রত্যাশিত কিছু অভিজ্ঞতা পেল। 

এর মাঝে ক্যাথির রাজা মারা গেলেন। ড্রাগন সিংহাসনে তার পুত্র আসীন হলেন। লম্বা এবং শ্মশ্রুমণ্ডিত মানুষটি প্রধানত চিত্রকলা আর শিকারে আগ্রহী। তিনি নিজেকে পরিচয় দিলেন ‘ওয়াই ওয়াং’ হিসেবে—একজন সাধারণ মানুষের ওপর চাপিয়ে দেয়া একটি উপাধি 

ক্যাথির উচ্চপদস্থ লোকেরা নতুন রাজাকে সম্মান জানিয়ে মানপত্র পাঠ করল। এরপর একজন কর্মকর্তাকে পাঠানো হলো গোবির মালভূমি এলাকায় চেঙ্গিস খানের কাছ থেকে সম্মানি আদায়ের জন্য। তিনি তার সঙ্গে নিয়ে গেলেন নতুন সার্বভৌম রাজা ওয়াই ওয়াংয়ের ঘোষণাপত্র। এটি হাঁটু ভাজ করে গ্রহণ করা একটি রাজকীয় অনুশাসন। কিন্তু মঙ্গোল দাঁড়িয়ে থেকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে এটি নিলেন। তিনি দাঁড়িয়েই থাকলেন আর এটা পড়ার জন্য কোনো অনুবাদকের হাতেও দিলেন না। 

তিনি জিজ্ঞেস করলেন, “নতুন রাজা কে?” 

“ওয়াই ওয়াং”। 

দক্ষিণের দিকে হাত বাড়িয়ে দেয়ার বদলে, খান ঝগড়ার সুরে বললেন, “আমি ভেবেছিলাম স্বর্গের পুত্র অসাধারণ একজন মানুষ হবে, কিন্তু ওয়াই ওয়াং—এর মতো একজন বেকুব সিংহাসনের যোগ্য নন। আমি কেন তার সামনে নিজেকে অসম্মানিত করব?” 

সেই সঙ্গে তিনি তার ঘোড়ায় চড়ে চলে গেলেন। সেই রাতে অর খানদের আর তার নতুন সঙ্গী, যেমন— ইদিকুত আর সিংহ শাসক নামে পরিচিত পশ্চিমের তুর্কিদের তার দরবারে ডাকা হলো। পরের দিন একজন দূতকে খানের সামনে হাজির করা হলো আর স্বর্ণালি সম্রাটের কাছে ফেরত নিয়ে যাওয়ার জন্য একটি সংবাদ দেয়া হলো। 

মঙ্গোল খান বললেন, “আমাদের রাজত্ব এখন এতটাই সংগঠিত যে আমরা ক্যাথিতে যেতে পারি। স্বর্ণালি সম্রাটের রাজত্বও কি এতটা সংগঠিত যে তিনি আমাদের গ্রহণ করতে পারবেন? আমরা উত্তাল সাগরের মতো দ্রুত ধাবমান একদল সেনা নিয়ে যাব। তিনি আমাদের বন্ধুত্ব দিয়ে বরণ করবেন না শত্রুতা দিয়ে, তা আমাদের বিবেচ্য বিষয় নয়। যদি স্বর্ণালি সম্রাট আমাদের বন্ধু হতে চান, তবে আমরা, আমাদের অধীনে থেকে তাকে নিজ রাজ্য শাসন করতে দেব। আর যদি তিনি যুদ্ধ চান, তবে যুদ্ধ হবে। আমাদের দুইজনের মধ্যে একজন জয়ী আর অন্যজন পরাজিত না হওয়া পর্যন্ত এই যুদ্ধ চলবে।” 

এর চেয়ে বেশি অসম্মানজনক সংবাদ পাঠানো সম্ভব নয়। চেঙ্গিস খান অবশ্যই তখনই সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছিলেন-—আক্রমণ করার সময় এসে গেছে। যত দিন পুরনো রাজা বেঁচে ছিলেন, তিনি শৃঙ্খলিত বোধ করছিলেন। সম্ভবত ক্যাথি রাজার প্রতি সম্মানের কারণে। তবে ওয়াই ওয়াং-এর ব্যাপারে এমনটা ছিল না। 

৯. স্বর্ণালি সম্রাট 

প্রথমবারের মতো এই যাযাবর উপজাতিটি, সভ্য আর বিশাল সামরিক ক্ষমতার অধিকারী অপর এক শক্তিকে আক্রমণ করতে যাচ্ছে। এবার আমরা চেঙ্গিস খানকে যুদ্ধক্ষেত্রে নিজে যুদ্ধ করতে দেখব। 

প্রথম সেনাদলটিকে অনেক আগেই গোবি থেকে রওনা করিয়ে দেয়া হয়েছে— এরা মূলত গুপ্তচর আর যোদ্ধা। এরা গিয়েছে সংবাদ সংগ্রহকারীদের ধরে ফেরত আনতে। আগে থেকেই এরা মহাপ্রাচীরের পিছনে অবস্থান করছিল। 

এরপরে পাঠানো হলো অগ্রগামী ছোট দলটিকে। প্রায় দুই শ অশ্বারোহীর এই দলটি, জোড়ায় জোড়ায় ছড়িয়ে গেল গ্রামাঞ্চলে। এদের অনেক পেছনে আছে আরেক অগ্রগামী দল, ভালো ঘোড়ার ওপর আসীন প্রায় ত্রিশ হাজার বাছাই করা অশ্বারোহী— প্রত্যেকের কাছে রয়েছে অন্তত দুইটি করে ঘোড়া তিনজন ‘তুমান’ বা সেনাপ্রধান, অভিজ্ঞ মুহুলি, ভয়ঙ্কর খেপ নয়ন আর নতুন আশ্চর্য বালক সুবোতাই— এরা হচ্ছেন খানের সেনাপ্রধানদের মধ্যে রত্ন। 

এই অগ্রগামী সেনাদলের সঙ্গে দূতের মাধ্যমে সর্বক্ষণিক যোগাযোগ রেখে, ধুলোর মেঘ উড়িয়ে মূল সেনাদল এগিয়ে গেল, পৌঁছল ঊষর মালভূমির ওপর। মূলত ইক্কা মঙ্গোলদের নিয়ে তৈরি প্রায় এক লাখ সৈন্যের দলটি রয়েছে মাঝখানে। ডান আর বাম প্রান্তের দুটি দলেও রয়েছে একই সংখ্যক সেনা। চেঙ্গিস খান সব সময় মধ্যভাগের সেনাদলটিকে নেতৃত্ব দিতেন। তার ছোট ছেলেকে সব সময় পাশে রাখতেন নির্দেশ দেয়ার জন্য। 

নেপোলিয়ানের মতো তারও নিজস্ব রাজকীয় দেহরক্ষী ছিল কালো ঘোড়ায় আসীন, চামড়ার বর্ম পরিহিত প্রায় এক হাজার শক্তিশালী সেনা। সম্ভবত ১২১১ সালে ক্যাথিদের বিরুদ্ধে পরিচালিত এই অভিযানে, তাদের শক্তি এতটা ছিল না। 

দলটি মহাপ্রাচীরের কাছাকাছি পৌঁছে গেল। সময় নষ্ট না করে এবং কোনো হতাহত ছাড়াই প্রাচীরের বাধা পেরিয়ে ভিতরে ঢুকেও গেল। কিছুদিন ধরে প্রাচীরের কাছাকাছি জেলাগুলোর উপজাতিদের চেঙ্গিস খান হাত করেছিলেন, আর তার এক শুভাকাঙ্ক্ষী একটা দরজা খুলে দিয়েছিল। 

মহাপ্রাচীরের ভেতরে প্রবেশ করেই, মঙ্গোল সেনারা আলাদা হয়ে গেল, শান—সি আর চিহ্ন-লির বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে গেল। তাদের নির্দিষ্ট নির্দেশনা দেয়া ছিল। তাদের কোনো যানবাহন দরকার পড়ল না আর সরবরাহ পাঠাবার ঘাঁটির অর্থও তারা জানত না। 

ক্যাথি সেনাদের প্রথম সারির দলটির কাজ ছিল সেই এলাকাগুলোর রাস্তাঘাট পাহারা দেয়া। এরা বেতন পেত খুবই কম। মঙ্গোল সশস্ত্র সেনারা সম্রাটের ছড়িয়ে থাকা এই সেনাদের, যারা বেশিরভাগই ছিল পদাতিক খুব সহজেই হারিয়ে দিল। দ্রুতগামী ঘোড়ার পিঠে চড়ে সশস্ত্র এই মঙ্গোল সেনাদল পেছন থেকে তীর ছুড়ে ক্যাথি সেনাদের ঘনভাবে সজ্জিত পদাতিক সেনাদের ছত্রভঙ্গ করে দিল। 

সম্রাটের প্রধান সেনাবাহিনীর একটি, আক্রমণকারীদের ধাওয়ায় এগিয়ে যাওয়ার সময়, ছোট পাহাড় আর গিরিখাতের মধ্যে এদিক-ওদিক ছোটোছুটি করতে থাকল। যে সেনাপ্রধান দায়িত্বে ছিল, সে নতুন এসেছে। পথঘাট খুব ভালো চেনে না। লোকজনকে জিজ্ঞেস করে পথ চলছিল। আর ওদিকে খেপ নয়ন, যিনি তাকে তাড়া করছিলেন, তিনি এই শহরের পথ আর উপত্যকা খুব ভালোভাবেই চেনেন, সত্যিকার অর্থে তিনি একেকটি নিশি যুদ্ধযাত্রা করে পরদিন চীনা সেনাদের ধরে ফেললেন। এই সেনাদের নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হলো, আর এদের মধ্যে বাকিরা পূর্ব দিকে পালিয়ে গেল এবং সেখানে বাকি বিশাল চীনা সেনাবাহিনীর মাঝে তা ভীতি ছড়িয়ে দিল। 

এর ফলে সেনারা আতঙ্কিত হয়ে গেল আর এর সেনাপতি রাজধানীর দিকে পালাল। চেঙ্গিস খান তাইতং-ফু বা মহাপ্রাচীর ঘেরা প্রথম বড় শহরে পৌঁছে গেলেন এবং তার দখল নিলেন। এরপরে তিনি তার সেনাদের নিয়ে শাসনকার্য পরিচালনাকারী শহর ইয়েন-কিংয়ের দিকে এগিয়ে গেলেন। 

এই সেনাদলের ধ্বংসযজ্ঞ আর তাদের এগিয়ে আসা ওয়াই ওয়াংকে ভীত করে দিল। তার সভাসদরা তাকে নিবৃত্ত না করলে ড্রাগন সিংহাসনে আসীন এই রাজা ইয়েন-কিং ছেড়ে পালিয়েই যেতেন। চীনে যেমনটা সব সময় ঘটে, আক্রান্ত হলে সাম্রাজের সবচেয়ে শক্তিশালী প্রতিরোধ ব্যবস্থা তখন ওয়াই ওয়াংয়ে ছুটে আসছিল— বিপুলসংখ্যক মধ্যবিত্ত, বিশালসংখ্যক সমর্পিত জনতা, যোদ্ধা পূর্বপুরুষদের উত্তরসূরি। সম্রাটের সিংহাসন সুরক্ষিত করা ছিল তাদের কাছে মহানতম দায়িত্ব। 

খুবই দ্রুততার সাথে ক্যাথির প্রথম সেনাদলের প্রতিরোধ চেঙ্গিস খান ভেঙে ফেললেন। তার সেনাদল অনেকগুলো শহর দখল করে নিল। পশ্চিমের রাজদরবার তাইতং-ফুর তখনো পতন হয়নি। 

রোমের সামনে হ্যানিবলের যেমনটা হয়েছিল, তেমনি চেঙ্গিস খান এই সাম্রাজ্যের দৃঢ়চেতা মানুষদের সত্যিকারের প্রতিরোধের মুখে পড়লেন। এই আক্রান্ত শহরটির সেনা দিন দিন বাড়তে থাকল। তিনি নিজে ইয়েন-কিংয়ের বাইরের বাগানগুলো দিয়ে বেরিয়ে এলেন। এরপর তিনি প্রথমবারের মত এই অবাক করা প্রাচীর আর শহর রক্ষাকারী এতগুলো পাহাড়, সেতু আর দূর্গের সারির উঁচু ছাদ প্রত্যক্ষ করলেন। 

তিনি এই অল্পসংখ্যক সেনা নিয়ে এমন একটা জায়গা অবরোধের অকার্যকারিতা নিশ্চয়ই বুঝে গিয়েছিলেন। তাই তিনি সঙ্গে সঙ্গে পিছিয়ে গেলেন। আর যখন বসন্তকাল এলো, তিনি তার পতাকা নিয়ে গোবিতে ফেরত যাওয়ার নির্দেশ দিলেন। 

পরবর্তী বসন্তে যখন তার ঘোড়াগুলো শক্তি ফিরে পেল, আবার তিনি প্রাচীরের কাছে পৌঁছে গেলেন। প্রথম অভিযানের সময় যে শহরগুলো তার কাছে আত্মসমর্পণ করেছিল সেসব শহরে এখন শক্ত সেনাঘাঁটি তৈরি হয়ে গেছে। ফলে তাকে আবার প্রথম থেকে শুরু করতে হলো। পশ্চিমের রাজদরবার আবার দখল করলেন আর এবার সেখানে পুরো সেনা রেখে দিলেন। 

এই অবরোধকে তিনি এক ধরনের বাজি হিসেবে ব্যবহার করলেন। যে সেনাদের এই শহর পুনরুদ্ধারের জন্য পাঠানো হচ্ছিল তাদের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলেন আর তারা আসামাত্রই তাদের হত্যা করতে থাকলেন। এই যুদ্ধ দুটো ব্যাপার পরিষ্কার করে দিল—মঙ্গোল অশ্বারোহীরা যুদ্ধক্ষেত্রে ক্যাথি সেনাদের পুরোপুরি পরাস্ত করে ধ্বংস করতে পারবে, কিন্তু শক্ত শহরগুলো দখল করতে পারবে না। 

খেপ নয়ন অবশ্য এই কঠিন কাজটা করে দেখলেন। তাদের সহযোগী লিয়াও রাজপুত্ররা উত্তরে ষাট হাজার ক্যাথি সেনার আক্রমণে বেশ পর্যুদস্ত অবস্থায় ছিলেন এবং চেঙ্গিস খানের কাছে সাহায্য চাইলেন। তিনি খেপ নয়নকে একদল সেনাসহ পাঠালেন। দারুণ উৎসাহী এই মঙ্গোল সেনাপ্রধান ক্যাথি সৈন্যদের পেছনে লিয়াও-ইয়াংয়ে অবরোধ করলেন। 

এই অভিযানের প্রথম প্রচেষ্টায় মঙ্গোলরা কোনো এলাকাই দখল করতে পারল না। মার্শাল নে’র মতো অধৈর্য খেপ নয়ন, চেঙ্গিস খানের একটা চাল, যা তিনি আক্রমণের সময় প্রায়ই ব্যবহার করতেন, তবে অবরোধের সময় করতেন না, সেই চাল চাললেন। তিনি তাদের সেনাদের তল্পিতল্পা, গরুগাড়ি আর খাওয়া—দাওয়া সব ক্যাথিবাসীদের দৃষ্টিসীমায় ফেলে রেখে অশ্বারোহীদের নিয়ে ফেরত আসতে শুরু করলেন, শত্রুরা যাতে মনে করে প্রতিরোধকারী সেনাদের ভয়ে কিংবা রণে ভঙ্গ দিয়ে তারা পালাচ্ছেন। 

এভাবে দুই দিন মঙ্গোলরা ধীরে ধীরে পিছু হটল, এরপর দ্রুতগামী ঘোড়ায় চেপে খুব দ্রুত এক রাতের মধ্যে খোলা তরবারি হাতে ফিরে এলো। ভোর হওয়ার আগে লিয়াও ইয়াংয়ে পৌঁছে গেল। ক্যাথিবাসীরা ভেবেছিল মঙ্গোলরা পালিয়েছে, তারা তখন মঙ্গোলদের ফেলে যাওয়া সব সম্পদ প্রাচীরের ওপারে নিতে ব্যস্ত ছিল—প্রাচীরের সব দরজা খোলা আর শহরের লোকেরাও তখন যোদ্ধাদের সঙ্গে মিশে গেছে। হঠাৎ উপজাতিদের ফেরৎ আসা তাদের একেবারে হতচকিত করে দেয়। পরিণতি দাঁড়াল ভয়ঙ্কর এক গণহত্যা আর এরপরে লিয়াও ইয়াংয়ে হামলা। 

খেপ নয়ন তার তল্পিতল্পা ফেরত তো পেলেনই, সঙ্গে পেলেন আরো অনেক কিছু। 

কিন্তু পশ্চিমের রাজদরবার অবরোধ করতে গিয়ে চেঙ্গিস খান আহত হলেন। ফলে তার সেনাদলও তাকে সঙ্গে নিয়ে ক্যাথি থেকে পিছিয়ে এলো। 

প্রত্যেক হেমন্তে মঙ্গোলদের তাদের নিজ বাসভূমিতে ফেরা প্রয়োজনীয় ছিল। অবশ্যই নতুন ঘোড়া জোগাড় করতে হবে। গ্রীষ্মের সময় তারা দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে মানুষ আর পশু জোগাড়ে বেরিয়ে পড়ত। কিন্তু এই শীতে উত্তর চীনে থাকবার কারণে, তাদের সেনাদলের জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম জোগাড় করা হয়নি। এছাড়াও তাদের যুদ্ধবাজ প্রতিবেশীদের দূরে সরিয়ে রাখা জরুরি। 

পরের বছর চেঙ্গিস খান ছোটখাটো কিছু আক্রমণ ছাড়া আর কিছুই করলেন না—ক্যাথিরা যেন নিশ্চিন্তে বিশ্রাম নিতে না পারে। 

তার প্রথম বড় আকারের যুদ্ধযাত্রা, কোনো জয়-পরাজয় ছাড়াই থমকে থাকল। হ্যানিবলের মতো, জয় করা রাজ্যে তিনি পুরো সেনাদলকে রেখে যেতে পারছিলেন না। তার মঙ্গোলরা তখনো প্রাচীরের পেছনে থেকে যুদ্ধ করতে অভ্যস্ত ছিল না, শীতকালে ক্যাথি সেনারা তাদের হারিয়ে দিতে পারত। 

কিছু কিছু জয় মঙ্গোলরা পেল। প্রথমে তারা আলাদাভাবে এগিয়ে যেত। এরপর হঠাৎ করে খুব দ্রুত একত্রিত হয়ে ক্যাথিদের বিরুদ্ধে আক্রমণ চালাতো। এ ধরনের আক্রমণে কেবল ক্যাথিদের প্রাচীরের পেছনে আশ্রয় নিতে বাধ্য করা যাচ্ছিল। তিনি সম্রাটের কাছে পৌঁছতে ইয়েং কিংয়ের দৃষ্টিসীমার ভেতরে চলে এসেছিলেন। কিন্তু চীনা এই সম্রাটকে, তার প্রায় দুর্ভেদ্য দুর্গ থেকে তাড়াতে পারছিলেন না। এদিকে লিয়াও তাংয়ের সেনা আর মঙ্গোলদের সাহায্য করা হিয়া অশ্বারোহীদের বিরুদ্ধে চীনা সেনারা অবস্থান করছিল। 

এমন অবস্থায় একজন উপজাতি গোত্রপ্রধান এভাবেই চলতে দিত। গত বছর লুট করে জোগাড় করা সম্পদ নিয়ে মহাপ্রাচীরের বাইরে অবস্থান করত। চীনা শক্তিকে অনেকখানি পরাজিত করেছি— এই গর্ব নিয়ে থাকত। তবে চেঙ্গিস খান, যদিও তখন আহত, তবুও ছিলেন অদম্য। দ্রুত অভিজ্ঞ হয়ে উঠছেন আর সেই অভিজ্ঞতায় উপকৃত হচ্ছেন। ওদিকে স্বর্ণালি সম্রাট শিকার হচ্ছেন ভীতির। 

এই ভয় আরো বেড়ে গেল যখন ১২১৪ সালের বসন্তে ঘাস গজাতে শুরু করল। তিন মঙ্গোল সেনাদল তিনদিক থেকে ক্যাথি আক্রমণ করল। দক্ষিণে খানের তিন পুত্র সান সিতে অনেক এলাকা দখলে নিলেন। উত্তরে জুখি খিঙ্গা পর্বতমালা পার হয়ে লিয়াও তাংয়ের সেনাদের সঙ্গে মিলিত হলেন। ইতিমধ্যে সেনাবাহিনীর মূল অংশ নিয়ে চেঙ্গিস খান ইয়াং কিংয়ের পিছনের সমুদ্র সৈকতে উপস্থিত হলেন। 

এই তিন সেনাদল নতুন উপায়ে কাজ শুরু করল। তারা আলাদা আলাদা থাকল এবং শক্ত শহরগুলোর প্রান্তে অবরোধ করে অবস্থান নিল। আশপাশের এলাকা থেকে তারা মানুষজনকে বন্দি করত আর সেই বন্দিদের সামনে এগিয়ে দিয়ে কোনো শহরে প্রথম আক্রমণ চালাত। প্রায়ই ক্যাথিরা প্রাচীরের দরজা খুলে দিত। সে সময় তাদের প্রাণ কেড়ে নেয়া হতো, এমনকি তাদের সর্বস্ব লুটে নিয়ে যাওয়া হতো, শস্যে আগুন লাগিয়ে দেয়া হতো, গবাদিপশুর পাল ছিনিয়ে নিয়ে যাওয়া হতো আর পুরুষ, নারী আর শিশুদের হত্যা করা হতো। 

এমন যুদ্ধের মুখোমুখি হয়ে বেশ কয়েকজন ক্যাথি সেনাপ্রধান তাদের সেনাদের নিয়ে মঙ্গোলদের সঙ্গে মিলিত হলো। লিয়াও তাংয়ের সেনাদেরসহ অন্য অফিসারদের দখল করা শহরগুলোতে নিয়োগ দেয়া হলো। 

দুর্ভিক্ষ আর অসুখ মঙ্গোল অশ্বারোহীদের পিছু নিল। দিগন্তে সেনাদের কাফেলা, তাদের অন্তহীন ষাঁড়-টানা গাড়ির সারি, তাদের গবাদিপশুর পাল, আর শিংওয়ালা পতাকা দেখা গেল। 

হেমন্তকাল যত শেষের দিকে এগোতে লাগল, সেনাদের মৃতের সংখ্যা ততই বাড়তে থাকল। ঘোড়াগুলো হয়ে যাচ্ছিল দুর্বল আর অথর্ব। চেঙ্গিস খান তার মধ্যভাগের সেনাদের নিয়ে তখনো ইয়াং কিংয়ের যুদ্ধক্ষেত্রের কাছে ঘাঁটিতে অবস্থান করছেন আর তার সেনারা শহর আক্রমণ করতে তার অনুমতি চাইছিল। 

এবারও তিনি সম্মতি দিলেন না। তবে স্বর্ণালি রাজার কাছে একটি সংবাদ পাঠালেন — “আমাদের দুজনের মধ্যে চলা এই যুদ্ধ সম্পর্কে আপনি এখন কী ভাবছেন? ইয়োলো নদীর উত্তরের সবগুলো প্রদেশই আমার দখলে। আমি আমার নিজ বাসভূমে ফেরত যাচ্ছি। কোনো উপহার পেয়ে খুশি হওয়া ছাড়াই ফিরে যাওয়ার অনুমতি কি আপনি আমার সেনাদের দেবেন?” 

নিজ গুণেই অভূতপূর্ব এক অনুরোধ এটি। আবার এর ভিতর মঙ্গোলদের খুব ধূর্ত একটি পরিকল্পনা ছিল। যদি স্বর্ণালি সম্রাট তার দাবি মেনে নেন, তবে তিনি সেনাদের পুরস্কার দেয়ার জন্য উপহার পেয়ে যাবেন আর সেটা তাদের অস্থিরতা শান্ত করবে, আর ড্রাগন সিংহাসনের সম্মান ভয়ানকভাবে খর্ব হবে। 

মঙ্গোলদের বর্তমান অবস্থা জানা কিছু ক্যাথি সভাসদ সম্রাটকে অনুরোধ করল মঙ্গোলদের বিরুদ্ধে ইয়াং কিংয়ে সেনা অভিযান চালাতে। কাজটা করলে কী পরিণাম হতো সে সম্পর্কে কিছু বলা সম্ভব নয়। তবে চীনা সম্রাট এতটাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলেন যে, তার পক্ষে এমন শক্ত সিদ্ধান্ত নেয়া সম্ভব ছিল না। তিনি চেঙ্গিস খানকে পাঁচ শ যুবক আর সমপরিমাণ নারী ভৃত্য পাঠালেন। সঙ্গে থাকল এক পাল ভালো প্রজাতির ঘোড়া আর একরাশ সিল্ক এবং সোনা। শান্তিচুক্তি হলো। চীনারা মঙ্গোলদের সহযোগী লিয়াও রাজপুত্রদেরকে লিয়াও তাংয়ে শান্তি তে থাকতে দেয়ার ব্যাপারে সম্মত হলো। 

এর পরও চেঙ্গিস খান দাবি করলেন, যদি তাদের মধ্যে সন্ধি হতেই হয় তবে রাজকীয় রক্তের এক কন্যাকে তিনি স্ত্রী হিসেবে চান। এবং সম্রাটের পরিবারের এক তরুণীকে তার কাছে পাঠিয়ে দেয়া হলো। 

সেই হেমন্তে চেঙ্গিস খান গোবিতে ফিরে গেলেন। কিন্তু মরুভূমির প্রান্তে এসে তিনি তার সেনাদের সঙ্গে আসা যুদ্ধবন্দিদের হত্যা করলেন— অপ্ররোচিত এক নিষ্ঠুরতা। 

(এমনটা মনে হচ্ছে যে যুদ্ধ শেষে যখন বাড়ির দিকে ফিরত, তখন শিল্পী এবং ভৃত্য ছাড়া বাকি যুদ্ধবন্দিদের হত্যা করা মঙ্গোলদের একটা প্রথা ছিল। সেই সময়, মঙ্গোলদের নিজ ভূমিতে খুব অল্প কিংবা একেবারেই কোনো ভৃত্য দেখা যেত না। শীর্ণকায় একদল যুদ্ধবন্দি হেঁটে মঙ্গোলদের আবাসভূমি ঘিরে থাকা বিশাল ঊষর মরুভূমি পার হতে পারত না। তাদেরকে খোলা ছেড়ে দেয়ার বদলে, তাদের সমাপ্তি টেনে দেয় আমরা যেমনটা পুরনো কাপড় ফেলে দিই। মানুষের জীবনের কোনো মূল্য মঙ্গোলদের কাছে ছিল না। গবাদিগুলো যেন চরে বেড়ানোর জায়গা পায়, সেজন্য তারা কেবল চাইত চারণভূমিগুলোকে মানবশূন্য রাখতে। ক্যাথিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের শেষে, তাদের এই অহঙ্কার ছিল যে ক্যাথির অনেক শহরে হোঁচট না খেয়েও ঘোড়ায় চড়ে যাওয়া সম্ভব।) 

ক্যাথিকে চেঙ্গিস খান শান্তিতে থাকতে দিতেন কিনা তা অনিশ্চিত। তবে স্বর্ণালি সম্রাট নিজের বুদ্ধিতে একটা কাজ করেন। তার বড় ছেলেকে ইয়েন কিংয়ে রেখে তিনি দক্ষিণে পালিয়ে যান। 

“আমরা আমাদের প্রজাদেরকে জানাচ্ছি যে, আমরা আমাদের আবাসস্থল দক্ষিণের রাজধানীতে সরিয়ে নিচ্ছি।” 

এই ছিল রাজকীয় ডিক্রি—নিজের সম্মান বাঁচানোর একটা দুর্বল চেষ্টা। তার সভাসদরা, ইয়েন কিংয়ের গভর্নররা, প্রবীণ চীনা সুশীলরা সকলেই তাকে অনুরোধ করেছিল তার লোকদের এভাবে পরিত্যাগ না করতে। কিন্তু তিনি চলে যান আর তার পলায়নের পরেই বিদ্রোহ দেখা দেয়। 

১০. মঙ্গোলদের প্রত্যাবর্তন 

চীনা সম্রাট যখন তার দলবল নিয়ে রাজকীয় শহর ছেড়ে পালালেন, তখন তিনি প্রাসাদে রেখে গেলেন তার ভবিষ্যৎ উত্তরাধিকারী, তার পুত্রকে। তিনি তার রাজত্বের কোনো নিদর্শন না রেখে তার দেশের মধ্যমণি শহর ইয়েং কিং ছেড়ে আসতে চাননি। তিনি প্রজাদেরকে দেখাতে চেয়েছিলেন অন্তত তার রাজবংশের কেউ একজন সেখানে আছে। ইয়েং কিং ছিল খুব শক্তভাবে সেনা দিয়ে সুরক্ষিত। 

প্রবীণ বিদ্বান মানুষেরা যে বিশৃঙ্খল অবস্থা আশঙ্কা করেছিলেন, তা চীনের সেনাবাহিনীকে খণ্ডিত করে ফেলতে শুরু করল। সম্রাটের প্রহরীদের কয়েকজন বিদ্রোহ করল আর মঙ্গোলদের সঙ্গে যোগ দিল। 

রাজকীয় শহরটিতে অদ্ভুত এক বিদ্রোহ হলো। বাকি সব রাজপুত্র, রাজ্যের কর্মকর্তারা আর তার মন্ত্রীরা সমবেত হয়ে রাজ পরিবারের প্রতি নতুন করে আনুগত্য জানাল। তাদের সম্রাটের কাছ থেকে পরিত্যক্ত হওয়ার পরে তারা ঠিক করল এবার তারা নিজেরাই যুদ্ধ করবে। বৃষ্টিতে, খোলা মাথায়, রাস্তায় জড়ো হয়ে জনতা ক্যাথি রাজত্বের এই ভবিষ্যৎ উত্তরাধিকারী এবং সব জ্ঞানীদের সঙ্গে একাত্মতা জানাল। দুর্বল এক শাসকের পলায়নের পরে, পুরনো আর গভীর দেশপ্রেম, যা তাদের অন্তরে ছিল, আজ আবার তা জেগে উঠল 

তার সন্তানকে দক্ষিণে ডেকে পাঠাবার জন্য সম্রাট ইয়েন কিংয়ে দূত পাঠালেন।

বয়স্ক চীনারা প্রতিবাদ জানিয়ে বলেছিলেন, “এমনটা করবেন না।”

কিন্তু সম্রাট ছিলেন একরোখা, আর তার ইচ্ছেই ছিল সেই রাজ্যের সর্বোচ্চ আইন। হবু উত্তরাধিকারী তড়িঘড়ি পালালেন, কেবল রাজপরিবারের কয়েকজন নারী, পুরনো শহরের গভর্নর খোজা আর সৈন্যরা ইয়েন কিংয়ে থেকে গেল। ইতিমধ্যে অনুগত বিদ্বানদের ছড়িয়ে দেয়া আগুন অগ্নিকাণ্ডে রূপ দিল। মঙ্গোল সেনাঘাঁটি আর প্রহরাকেন্দ্র আক্রান্ত হলো। আর দুর্দশাগ্রস্ত প্রদেশ লিয়াও তাংকে উদ্ধার করার জন্যও একদল সেনা পাঠানো হলো—যে ‘এলান’ বা হুঙ্কারে শুরু হয়েছিল, সেই হুঙ্কারেই সেনারা আশ্চর্যজনকভাবে সফল হলো। 

ঘটনার হঠাৎ বিপরীত মোড় এই পিছিয়ে আসা সেনারা জানতে পারলো। চেঙ্গিস খান তার অগ্রযাত্রা থামালেন, তার গুপ্তচরদের আর তার কাছে ছুটে আসা সেনাদের কাছ থেকে পুরো তথ্যের জন্য অপেক্ষা করলেন। 

যখন তিনি পুরো ব্যাপারটা বুঝতে পারলেন, তখন সঙ্গে সঙ্গে পদক্ষেপ নিলেন।

তার সবচেয়ে শক্তিশালী সেনাদলকে তিনি দক্ষিণে ইয়োলো নদীর দিকে পাঠালেন। নির্দেশ ছিল, পিছু হটা সম্রাটকে বুঝিয়ে রাজি করানো। 

সময়টা ছিল শীতকাল। তারপরও মঙ্গোলরা খুব দ্রুত এগিয়ে গেল। চীনের রাজাকে নদী পেরিয়ে তার পুরনো শত্রু সুংদের এলাকায় ঢুকতে বাধ্য করা হলো। এমনকি সেখানেও মঙ্গোল সেনারা তার পিছু নিল। পথে তাদের পেরোতে হলো বরফঢাকা পাহাড়। বর্শার হাতল আর গাছের ডাল দড়ি দিয়ে বেঁধে তারা পার হলো সরু উপত্যকা। বস্তুত এই সেনাবাহিনী শত্রু এলাকার এতটা ভেতরে ঢুকে পড়ল যে, মূল সেনাদের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে গেল। এরপরও তারা পলাতক রাজাকে তাড়া করতে থাকল। রাজা তখন সুংয়ের রাজসভায় সাহায্য প্রার্থনা করলেন। খান তখন দূত মারফত এই অগ্রগামী সেনাদের ডেকে পাঠালেন, যে কারণে তারা নিজেদেরকে এই ভয়ঙ্কর যাত্রা থেকে বিরাম দেন। সুং শহরকে ঘিরে বিশাল বৃত্ত করে, বরফের ওপর দিয়ে ইয়োলো নদী পেরিয়ে, চেঙ্গিস খান নিরাপদ এলাকায় এলেন। 

খেপ নয়নকে গোবি এলাকায় তার গোত্রপতিদেরকে শান্ত করার জন্য পাঠানো হলো। 

চেঙ্গিস খান সুবোতাইকে পাঠালেন অবস্থার খোঁজ নিতে। এই ‘অর খান’ বা সেনাপতি কয়েক মাসের জন্য দৃষ্টিসীমার বাইরে চলে গেলেন। তিনি ঘোড়াগুলোর হাল-হকিকত জানাতেন এবং রুটিন খবর দিতে কেবল দূত পাঠাতেন। উত্তর ক্যাথিতে অবস্থানকালে তেমন ভালো কিছু তিনি পেলেন না। কারণ তিনি যখন মূল দলের কাছে ফেরত এলেন, তখন তিনি কেবল সাথে নিয়ে এলেন কোরিয়ার আত্মসমর্পণ। মূল সেনাদলে এসে তিনি চুপচাপ থাকলেন আর লিয়াও তাং উপসাগরকে ঘিরে এগিয়ে গিয়ে নতুন দেশ আবিষ্কার করলেন। যখন তাকে স্বাধীনভাবে নেতৃত্ব দেয়া হতো তখন তার এই ঘুরে বেড়ানোর ঝোঁক, পরবর্তীতে ইউরোপে ভয়ঙ্কর দুর্যোগ বয়ে এনেছিল। 

খান নিজে মহাপ্রাচীরের কাছে মূল দলের কেন্দ্রের সঙ্গে থাকলেন। তার বয়স তখন পঞ্চান্ন বছর। তার দৌহিত্র কুবলাই খান গোবিতে তখন কেবল জন্মেছে। সেখানে এখন তারা বিশাল প্রাসাদে থাকে, তাঁবুতে নয়। তার পুত্ররা তখন সবাই বড় হয়ে গেছে। কিন্তু এই সঙ্কটময় পরিস্থিতিতে তার সেনাদলের নেতৃত্ব তিনি তুলে দিলেন ‘অর খানদের’ বা সেনাপতিদের হাতে, যারা পুরো সেনাদলের প্রমাণিত নেতা, যারা কোনো ভুল করে না আর খানের যার উত্তরপুরুষরা তাদের এই গুণের কারণে কখনো কোনো শাস্তি পাবে না। খেপ নয়ন আর সুবোতাইকে তিনি শিখিয়েছিলেন কীভাবে অশ্বারোহী বাহিনীকে নেতৃত্ব দিতে হয়। প্রবীণ মুহিলিকেও তিনি পরীক্ষা করে দেখেছেন। 

তাই ক্যাথিদের পতন দেখার জন্য নিজ তাঁবুতে তিনি একজন দর্শক হয়ে বসে থাকলেন। খবর শোনার জন্য অপেক্ষা করে বসে থাকতেন। আর খাবার রান্না বা ঘুমানোর জন্য ঘোড়া থেকে না নামা দূতেরা ছুটে আসত শুধু তাকে খবর দেয়ার জন্য। 

লিয়াও তাংয়ের একজন রাজপুত্র মিঙ্গানের সহায়তায় মুহুলি ইয়েন কিংয়ে আক্রমণ পরিচালনা করলেন। পাঁচ হাজারের কম মঙ্গোল সেনা নিয়ে, নিজের পথচলাকে অনুসরণ করে, তিনি পূর্ব দিকে সরে গেলেন। সামনে তখন অনেক বেশি গুণ ক্যাথি সেনা। পাশাপাশি সুবোতাই তার সেনা নিয়ে এগোচ্ছেন। মুহুলি ইয়েং কিংয়ের বাইরের দেয়ালের সামনে তার তাঁবু ফেললেন। 

এই অবরোধ মোকাবেলা করার জন্য ইয়েন কিংয়ে যথেষ্ট সৈন্য, প্রচুর অস্ত্র আর যুদ্ধের সরঞ্জাম থাকা সত্ত্বেও, ক্যাথিরা এর প্রতিরোধ করার জন্য ছিল খুবই অগোছাল। যখন বাইরের এলাকায় যুদ্ধ শুরু হলো, তখন চীনাদের একজন সেনাপতি দল ত্যাগ করল। রাজকীয় নারীরা, যারা তার সঙ্গে যাওয়ার জন্য কাকুতি-মিনতি করছিল, তাদেরকে সে অন্ধকারে ফেলে রেখে গেল। বাণিজ্যের রাস্তাগুলোতে লুটপাট শুরু হয়ে গেল, আর দুর্ভাগা মহিলারা রাস্তাঘাটের চিৎকাররত আর যুদ্ধরত সৈন্যদের কাছে সাহায্যের জন্য ঘুরে বেড়াতে থাকল। 

শহরের বিভিন্ন এলাকায় তখন আগুন জ্বালিয়ে দেয়া হলো। প্রাসাদে, করিডোরে, খোঁজা আর ভৃত্যদের ভয়ে দৌড়াদৌড়ি করতে দেখা গেল। তাদের হাতে ছিল সোনা আর রুপোর গহনা। রাজসভার বড় কক্ষটি ছিল জনশূন্য। রক্ষীরা নিজেদের কুঠরি ছেড়ে লুণ্ঠনকারীদের দলে যোগ দিল। 

অপর আরেকজন সেনাপতি ছিলেন ওয়াং ইয়েন। তার শরীরে ছিল রাজরক্ত। কিছুদিন আগে পলাতক রাজার কাছ থেকে একটি আদেশ পেয়েছেন— ক্যাথির সব অপরাধী আর বন্দিদের ক্ষমা করে মুক্তি দিয়ে দেয়ার জন্য আর সেনাদের উপহার বাড়িয়ে দেয়ার জন্য। একটি ব্যর্থ শেষ চেষ্টা। এতে একাকী ওয়াং ইয়েনয়ের শক্তি একটুও বাড়ল না। 

নিরাশ এই অবস্থায় তখন সেনাপতি প্রথা অনুযায়ী প্রয়োজনে নিজে মৃত্যুবরণ করতে প্রস্তুত হলেন। তিনি তখন নিজের ঘরে ফিরে গেলেন আর সম্রাটের কাছে পত্র লিখলেন, নিজেকে অপরাধী স্বীকার করে নিলেন। আরো জানালেন, ইয়েন কিংকে রক্ষা করতে ব্যর্থ হওয়ার এই অপরাধে তার শাস্তি হওয়া উচিত মৃত্যুদণ্ড। 

তার এই বিদায়বাণী তার পোশাকের একটি অংশে লেখা হয়। এরপর তিনি তার ভৃত্যদেরকে ডেকে তার সব পোশাক আর সম্পদ তাদের মাঝে বিলিয়ে দেন। একজন সভাসদকে ডাকলেন যে এক কাপ বিষ তৈরি করতে তাকে সঙ্গ দিল। এরপর তিনি লেখা চালিয়ে গেলেন। 

এরপর ওয়াং ইয়েন তার বন্ধুদের কক্ষ থেকে বেরিয়ে যেতে অনুরোধ করলেন। ইয়েন কিংয়ে তখন আগুন জ্বলছে আর মঙ্গোলরা অরক্ষিত শহরে ত্রাসের রাজত্ব শুরু করে দিয়েছে। 

রাজপরিবারের পতন নিয়ে অনাগ্রহী মুহুলি ছিলেন বেশ নিয়মতান্ত্রিক। তিনি শহরের সম্পদ আর সব যুদ্ধ উপকরণ সংগ্রহ করে খানের কাছে পাঠাতে লাগলেন। খানের কাছে পাঠানো যুদ্ধবন্দি কর্মকর্তাদের মধ্যে একজন ছিলেন লিয়াও তাং-এর রাজপুত্র। সে ক্যাথি সেনাদের সঙ্গে যুদ্ধ করছিল। সে ছিল বেশ লম্বা আর তার ছিল কোমর পর্যন্ত লম্বা বড় দাড়ি। তার গম্ভীর আর পরিষ্কার আওয়াজ খানের দৃষ্টি আকর্ষণ করল। তিনি এই যুদ্ধবন্দির কাছে তার নাম জানতে চাইলেন আর জানতে পারলেন যে তার নাম ইয়ে লিউ চুসাই। 

চেঙ্গিস খান জানতে চাইলেন, “তুমি এমন একজনকে কেন সাহায্য করলে যার সঙ্গে তোমার পরিবারের পুরনো শত্রুতা আছে?” 

যুবক রাজপুত্র উত্তর দিলেন, “আমার বাবা এবং আমার পরিবারের অন্যরাও ছিলেন চীনাদের ভৃত্য। আমার পক্ষে অন্য কিছু করা সম্ভব ছিল না।”

এ কথা শুনে মঙ্গোল খুশি হলেন। 

“তুমি যদি তোমার আগের মালিকের জন্য এত সততার সঙ্গে কাজ করে থাকো তবে তুমি আমার জন্য কেন তেমনভাবে কাজ করবে না? আমার সভাসদদের একজন হয়ে যাও।” 

অন্য কয়েকজন যারা রাজপরিবারের সঙ্গ ছেড়ে তার সঙ্গে যোগ দিয়েছিল, তিনি তাদের মৃত্যুদণ্ড দিলেন, কারণ তাদের বিশ্বাস করা যায় না। হয়ে লিউ চুতসাই তখন তাকে বলেছিলেন, “আপনি এত বড় রাজ্য ঘোড়ার স্যাডলে বসে জয় করেছেন, কিন্তু আপনি একে এভাবে শাসন করতে পারবেন না।” 

হয়তো বিজয়ী মঙ্গোল তার কথায় সত্য খুঁজে পেয়েছিলেন কিংবা এই বিদ্বান ক্যাথিবাসী মানুষটির প্রতিভাকে তার পাথর বা আগুন ছোঁড়ার যুদ্ধ উপকরণের মতোই গুরুত্বপূর্ণ ভেবেছিলেন। যে কারণেই হোক, তিনি তার নিজেকে উপদেশ নেয়ার অনুমতি দিলেন। ক্যাথির এই দখল করা শহরগুলোর শাসক হিসেবে তিনি লিয়াও তাংয়ের লোকদেরকেই নিযুক্ত করলেন। 

তিনি খুব ভালোভাবেই বুঝেছিলেন উর্বর আর উদারমনের ক্যাথি দেশটিকে মঙ্গোলদের পছন্দের মরুর চারণভূমিতে পরিণত করা ঠিক হবে না। চীনাদের ব্যবসায়ের কলাকৌশল, তাদের দর্শন আর তাদের যেসব ভৃত্য আর নারী তার কাছে ছিল, সবকিছু থেকেই বোঝা যাচ্ছিল তারা কতটা পিছিয়ে আছেন। তার মালিকের যুদ্ধে ছলনার পরেও যেভাবে তিনি সাহস করে যুদ্ধ চালিয়ে গিয়েছিলেন সেজন্য এই মন্ত্রীকে তার বেশ পছন্দ হলো। তার এই সাহস আর জ্ঞান তার নিজের জন্যও উপকারী হতে পারে তা তিনি বুঝলেন, যেমন— ইয়ে লিউ চুসাই গ্রহ-নক্ষত্রের নাম বলতে পারতেন আর তাদের গুরুত্বও ব্যাখ্যা করে বলতে পারতেন। 

তিনি যখন তাকে সঙ্গে করে কারাকোরাম নিয়ে এলেন তখন সম্পদের সঙ্গে ক্যাথির এই বিদ্বানদেরকেও সঙ্গে করে নিয়ে এলেন। তিনি তার এই নতুন রাজ্যে এবং পরবর্তীতে জয় করা সুং রাজ্যের সেনা শাসক হিসেবে মুহুলিকে সেখানে রেখে আসেন। সবার সামনে তার ভূয়সী প্রশংসা করে তার হাতে একটি পতাকা দিয়ে এলেন। সেই পতাকায় ছিল নয়টি সাদা ইয়াক-এর লেজ (নাইন-ইয়াক টেল)। 

তিনি মঙ্গোলদের ব্যাখ্যা দিলেন, “এই অঞ্চলে সেনাপতি মুহুলির আদেশকে আমার আদেশ বলে মেনে চলতে হবে।” 

আর কোনো প্রতিষ্ঠান এই বয়স্ক মানুষটির ওপরে খবরদারি করাতে পারত না। আর চেঙ্গিস খান যথারীতি তার সিদ্ধান্তে অটল ছিলেন। মুহুলি তার এলাকায় তার সেনাদের নিয়ে নির্বিঘ্নে ছিলেন। 

মঙ্গোলরা এই সিদ্ধান্ত কেন নিয়েছিল সে সম্পর্ক সম্পূর্ণ তথ্য পাওয়া যায় না। নিঃসন্দেহে তার পশ্চিমের সেনাদের শক্তিশালী করতে তিনি ফেরত আসতে চেয়েছিলেন। তিনি হয়তো বুঝেছিলেন, পুরো চীন রাজ্য নিয়ন্ত্রণে রাখা বেশ দীর্ঘ সময়ের কাজ। তবে এটা অনস্বীকার্য যে, কোনো দেশ জয়ের পরে সেই দেশ সম্পর্কে তার আগ্রহ শেষ হয়ে যেত। 

১১. কারাকোরাম 

অন্যান্য বিজয়ী যোদ্ধাদের মতো তিনি তার নতুন জয় করা, সবচেয়ে প্রাচুর্যপূর্ণ শহর ক্যাথিতে থেকে যাননি। চীনের পতনের পরে মহাপ্রাচীরের ভেতর দিয়ে বেরিয়ে আসার পর তিনি আর ফেরেননি। মুহুলিকে গোত্রপ্রধান হিসেবে সেখানে রেখে তিনি দ্রুত তার জন্ম অধিকার পাওয়া ঊষর মালভূমিতে ফিরে যান। 

এখানে ছিল তার সদর দপ্তর। মরু শহরগুলোর মধ্যে কারাকোরাম বা ‘কালো বালি’-কে তিনি তার রাজধানী বা ‘অরদু’ নির্বাচন করেছিলেন। 

একটি উপজাতি গোত্রের যা কিছু প্রত্যাশা তার সবকিছুই তিনি এখানে একত্রিত করেছিলেন। মরুভূমির মাঝে একটি জনবসতিপূর্ণ আশ্চর্য এক শহর কারাকোরাম। বাতাসও বইত আর তার সঙ্গে যেন বালুও চাবুক চালাত। বাড়িঘর, শুকনো কাদা আর তার ওপর খড়ের ছাদ। রাস্তার কোনো চিন্তা ছাড়াই এসব তৈরি করা হয়। আর এর চারপাশেই রয়েছে কালো ফেল্ট কাপড়ের তাঁবু গাড়ির (ইয়ার্ট) গম্বুজ। 

দারিদ্র্য আর পালিয়ে বেড়ানোর দিন বিগত হয়েছে। শীতের সময় তার কাছে প্রচুর গবাদিপশু থাকে। দুর্ভিক্ষ এড়াতে গুদাম ঘরে রয়েছে পর্যাপ্ত খাবার। মানুষের জন্য গম আর জব এবং ঘোড়ার জন্য রয়েছে খড়। উত্তর এশিয়া ঘুরে বেড়ানো পর্যটক আর বিদেশি দূতদের থাকবার জন্য আছে সরাইখানা। 

দক্ষিণ থেকে এলো আরব আর তুর্কি ব্যবসায়ীরা। তাদের সঙ্গে চেঙ্গিস খান নিজস্ব লেনদেনের নিয়ম তৈরি করলেন। তিনি দরদাম পছন্দ করতেন না। যদি ব্যবসায়ীরা তার সঙ্গে দরদাম করত তবে তিনি তাদের কোনো দাম না দিয়ে জিনিস রেখে দিতেন। আর যদি তারা খানকে সব কিছু দিয়ে দিত, তবে তারা সে জিনিসের দামের চেয়েও বেশি দামের উপহার পেয়ে যেত। 

বিদেশিদের থাকবার শহরের পাশে ছিল ধর্মযাজকদের থাকবার ব্যবস্থা। পুরনো বৌদ্ধ মন্দির, সুন্দর পাথরের মসজিদ আর কাঠের ছোট নেস্তোরিয়ান চার্চ ছিল। যতক্ষণ কেউ ‘ইয়াসা’ আর মঙ্গোল শিবিরের নিয়ম-কানুন মেনে চলত, ততক্ষণ নিজের ইচ্ছামতো উপাসনা করার স্বাধীনতা সবার ছিল। 

শহরের মুখে দর্শনার্থীদের প্রথমে মঙ্গোল সেনাদের সঙ্গে দেখা হতো। এরপরে একজন পথপ্রদর্শক সহযোগে তাদেরকে কারাকোরামে পাঠানো হতো। আর এই খবর একজন দূতের হাতে আগেই পাঠিয়ে দেয়া হতো। একবার যখন তাদের দৃষ্টিসীমার মধ্যে ঘাস খেয়ে চরে বেড়ানো গবাদিগুলো, তাঁবু-গাড়ির কালো গম্বুজগুলো, খানের শহরকে ঘিরে থাকা গাছবিহীন আর পাহাড়বিহীন সমতলে থাকা সারি সারি তাঁবুগুলো এসে যেত, তখন এলাকার আইনের দায়িত্বে থাকা লোকেরা তাদের দায়িত্ব নিত। 

পুরনো উপজাতীয় প্রথা অনুযায়ী তাদেরকে দুটো বড় অগ্নিকুণ্ডের মাঝখান দিয়ে এগিয়ে যেতে হতো। তাদের সাধারণত কোনো ক্ষতি হতো না, কিন্তু মঙ্গোলরা বিশ্বাস করত, তার মনে খারাপ কোনো উদ্দেশ্য থাকলে আগুন তাকে গ্রাস করে ফেলবে। এরপরে তারা তাকে আহার আর থাকার জায়গা দিত খান যদি সম্মতি দিতেন তবেই তাকে মঙ্গোল সম্রাটের সামনে আনা হতো। 

তিনি তার রাজদরবার বসাতেন বড় আর উঁচু একটি বড় সাদা পশমি কাপড়ের প্যাভিলিয়নে। প্রবেশদ্বারে একটি রুপালি টেবিলে ঘোড়ীর দুধ, ফল আর মাংস রাখা থাকত, যেন তার সঙ্গে দেখা করতে আসা যে কেউ যত খুশি খেতে পারে। দূরে অপর প্রান্তে একটি মঞ্চে নিচু একটি বেঞ্চে খান বসতেন। বৌরতাই কিংবা অন্য কোনো স্ত্রী বসতেন তার সঙ্গে, একটু নিচে আর বাম পাশে। 

তার সঙ্গে থাকতেন খুব কমসংখ্যক মন্ত্রী। থাকতেন ইয়ে লিউ চুসাই, সম্ভবত তার পরনে থাকত নকশি করা পোশাক, লম্বা দাড়ি আর গম্ভীর কণ্ঠের কারণে তাকে বেশ রাজকীয় লাগত। একজন উঘুইর লেখক থাকতেন, সঙ্গে কাগজের রোল আর ব্রাশ। থাকতেন একজন মঙ্গোল ‘নয়ন’ বা দশ হাজার সেনার সেনাপতি, অবৈতনিক পানপাত্র বাহক। এই প্যাভিলিয়নের দেয়াল ঘিরে থাকা বেঞ্চগুলোতে বড়সড় কোট, সাদা টুপি পরে নিঃশব্দে বসে থাকতেন অন্যান্য গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ। মধ্যখানে শিং আর ঘুঁটে পুড়িয়ে জ্বালানো আগুন জ্বলত। 

সবচেয়ে সম্মানিত ‘অর খান’রা ইচ্ছেমতো প্রবেশ করতে পারতেন, আর তাদের বেঞ্চে বসতে পারতেন। বেঞ্চের নিচে তাদের পা আড়াআড়ি করা থাকত। অর খান আর সেনাদলের সেনাপতিরা তাদের সঙ্গে যোগ দিতে পারতেন। সঙ্গে থাকত তাদের বর্শা। আলাপ-আলোচনা হতো নিম্নস্বরে। খান যখন কথা বলতেন, তখন থাকত পিন পতন নীরবতা। I 

কোনো ব্যাপারে তিনি কথা বলা মানে, সেই বিষয়ে আলোচনা শেষ। আর কেউ সেই বিষয়ে একটা কথাও যোগ করবে না। তর্ককে ভদ্রতার বরখেলাপ ধরা হতো— বাড়িয়ে বলা ছিল নৈতিক স্খলন। আর মিথ্যে ছিল রাজার শাস্তির যোগ্য একটি ব্যাপার। কথাবার্তা ছিল খুব কম আর খুবই কষ্টকর রকমের যথার্থ। 

আশা করা হতো আগন্তুকরা তার জন্য উপহার সঙ্গে নিয়ে আসবেন। সেই আগন্তুকের প্রবেশের আগে সেদিনের পাহারায় থাকা সেনাদের প্রধান প্রথমে সেই উপহার নিয়ে তার সামনে রাখত। এরপরে আগন্তুকের তল্লাশি নেয়া হতো—কোনো অস্ত্র আছে কিনা। সাবধান করে দেয়া হতো যেন প্যাভিলিয়নের পাদদেশ না ছোঁয়। আর তাঁবু হলে তাঁবুর দড়ি যেন না ছোঁয়। খানের সঙ্গে কথা বলতে চাইলে তাদের অবশ্যই হাঁটু গেড়ে বসতে হবে। নিজেকে তার সামনে উপস্থাপন করার পরে, খান চলে যেতে না বলা পর্যন্ত, সেখান থেকে সে যেতে পারবে না। 

ক্রমে জমে ওঠা গোবির বালুর নিচে হারিয়ে যাওয়া কারাকোরাম এক সময় শক্ত হাতে শাসিত হয়েছে। এই গোত্রে প্রবেশ করা মানুষরা তার মুকুট আর সিংহাসনের দাস হয়ে যেত। আর কোনো আইন সেখানে থাকত না। 

শক্ত মনের যাজক ফ্রা রুক বলেছিলেন, “তাতারদের সঙ্গে যোগ দেয়ার পরে, আমার মনে হয়েছিল আমি অন্য এক পৃথিবীতে প্রবেশ করলাম।” 

এটা এমন এক পৃথিবী যেখানে সব কিছু চলে ইয়াসা’ আইনে আর নিঃশব্দে অপেক্ষা করে থাকে খানের আদেশের জন্য। সব নিয়ম ছিল সেনাবাহিনীর নিয়মের মতো— আর তার আদেশই বজায় থাকত। তার প্যাভিলিয়ান সব সময় দক্ষিণমুখী হতো, আর সেই দিকে কিছু অংশ ফাঁকা থাকত। ডানে আর বামে সেনাদের বসার নির্দিষ্ট জায়গা ছিল। 

তার পরিবারের সদস্যসংখ্যা ততদিনে অনেক বেড়েছে। তাঁবুগ্রামের ভেতর ছড়িয়ে থাকা তাদের তাঁবুতে, তারা তাদের মানুষটির জন্য অপেক্ষা করত। ধূসর নয়না বৌরতাই ছাড়াও তার আরও অনেক স্ত্রী ছিল। তিনি ক্যাথি আর লিয়ায়ের রাজকন্যাকে, রাজকীয় তুর্কি পরিবারের কন্যাকে আর এই মরুভূমির গোত্রের সবচেয়ে সুন্দরী মহিলাদের বিয়ে করেছিলেন। 

তিনি নারীদের সৌন্দর্যের প্রশংসা করতে পারতেন, যেমন পারতেন পুরুষদের জ্ঞান আর দৃঢ়তার আর ভালো ঘোড়ার দ্রুততা আর সহ্যশক্তির প্রশংসা করতে। একবার এক দেশ দখলের পরে একজন মঙ্গোল তাকে জানাল সেখানে থাকা এক সুন্দরীর কথা। তবে ঠিকঠাকভাবে বলতে পারল না কোথায় তাকে পাওয়া যাবে। শুনে খান অধৈর্য হয়ে উত্তর দিলেন, “যদি সে সত্যিই সুন্দরী হয়, তাকে আমি খুঁজে পাব। 

তাকে বিরক্ত করা এক স্বপ্ন সম্পর্কে মজার একটা গল্প আছে। তিনি স্বপ্নে দেখলেন তার এক স্ত্রী তার ক্ষতি করার ফন্দি করছে। সে সময় যথারীতি তিনি যুদ্ধক্ষেত্রে ছিলেন। যখন তার ঘুম ভাঙল তিনি সাথে সাথে ডাকলেন, “তাঁবুর প্রবেশদ্বারের রক্ষীদের দলনেতা কে?” 

প্রশ্ন শোনা অফিসারটি যখন তার নাম বলল, খান তখন তাকে নির্দেশ দিলেন, “এই মহিলাকে তোমাকে দিয়ে দিলাম উপহার হিসেবে। তাকে নিজের তাঁবুতে নিয়ে যাও।” 

পুরো ব্যাপারটার নৈতিকতার দিকটা তিনি নিজের মতো করে সমাধান করেছিলেন। তার আরেকজন উপপত্নী পরিবারের অপর এক মঙ্গোলের প্রতি অনুরক্ত হয়। তিনি যখন ব্যাপারটা ধরতে পারলেন, তখন তিনি তাদের দুজনের কাউকেই মৃত্যুদণ্ড দিলেন না, কিন্তু তাদেরকে তার অবস্থান থেকে এই বলে ফেরত পাঠালেন, “এমন নিচু মানসিকতার একজন নারীকে আমার কাছে এনে আমিই ভুল কাজ করেছি।”

তার সব সন্তানের মধ্যে বৌরতাইয়ের ঘরে জন্মানো চার সন্তানকে তিনি তার উত্তরাধিকার করেছিলেন। তারা ছিল তার পছন্দের সঙ্গী। তিনি তাদের ওপর লক্ষ রাখতেন আর প্রত্যেককে শিক্ষক হিসেবে একজন করে বয়স্ক সেনা কর্মকর্তা দিয়েছিলেন। যখন তিনি নিজে তাদের বিভিন্ন ক্ষমতা আর চরিত্রের ব্যাপারে সন্তুষ্ট হয়েছিলেন তখন তাদেরকে ‘অরলুখ’ বা ‘ঈগল’ বা রাজ রক্তের রাজপুত্র বানিয়েছিলেন। আর তারা তাদের নির্দিষ্ট কাজ নির্দিষ্ট নিয়মে করতেন। 

প্রথম পুত্র জুখিকে শিকারে দক্ষ করা হয়েছিল— যেখান থেকে মঙ্গোলরা তখনো তাদের চাহিদার অনেক কিছু সংগ্রহ করত। ছাতাগাইকে করা হয়েছিল আইন আর শাস্তির কর্ণধার। ওগোতাই ছিল সভাসদদের নেতা। আর সবচেয়ে ছোট তুলিকে সেনাবাহিনীর প্রধান করে সব সময় তার পাশে রেখেছিলেন। জুখির পুত্র বাতু তৈরি করেছিলেন সোনালি গোত্র আর তারা রাশিয়া দখল করেছিল। ছাতাগাইয়ের দখলে ছিল মধ্য এশিয়া। তারই বংশধর ছিলেন বাবর, ভারতের প্রথম মোগল শাসক। তুলির পুত্র কুবলাই খান চীন সাগর থেকে মধ্য ইউরোপ পর্যন্ত শাসন করেছিলেন। 

প্রাণোচ্ছল কুবলাই, খানের খুব প্রিয় ছিলেন। দাদার মনোযোগ তার দিকে আকৃষ্ট করতে পেরেছিলেন, “কুবলাইয়ের এই কথাটা মনে রেখো, খুবই বিজ্ঞের মতো বলেছে।” 

.

ক্যাথি থেকে ফেরত এসে চেঙ্গিস খান দেখলেন তার নতুন রাজত্বের পশ্চিমের অর্ধেক অংশ খুবই হতাশ। মধ্য এশিয়ার শক্তিধর তুর্কিরা, কারা খিতাই সাম্রাজ্যের যোদ্ধারা, নেইমানদের একজন রাজপুত্র ঘুচলুকের অধীনে চলে এসেছে। কিছুদিন আগে, কারাইতদের সঙ্গে যুদ্ধের সময় মঙ্গোলদের হাতে পরাজিত হয়েছিল ঘুচলুক। 

ঘুচলুক লাভজনক ছলনা করে বেশ ভালোই খ্যাতি অর্জন করেছিল পশ্চিমের আরো বড় শক্তির সহযোগিতায় ব্ল্যাক ক্যাথির খানকে হত্যা করে। মহাপ্রাচীরের ওপারে যখন চেঙ্গিস খান ব্যস্ত ছিলেন, তখন সে খুব প্রয়োজনীয় উঘুইরদের এলোমেলো করে দেয়, আর মঙ্গোলদের প্রজা, আলমালাইকের খ্রিস্টান খানকে হত্যা করে। সদা অস্থির মেরকিটরা তাদের দল ছেড়ে তার সঙ্গে যোগ দেয়। 

তিব্বত থেকে সমরখন্দ পর্যন্ত বিস্তৃত প্রশস্ত পর্বতমালার মাঝে ছিল ঘুলচুক এবং তার এই ছোট সাম্রাজ্য। চেঙ্গিস খান কারাকোরামে ফেরত আসবার পরে তাকে নির্ণায়কভাবে মোকাবেলা করলেন। সেনারা পুনরায় নতুন ঘোড়ায় চড়ে, নেইম্যানদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করল। ব্ল্যাক ক্যাথির শাসককে গোপনে ফাঁদে ফেলে সরিয়ে, এই বয়স্ক মঙ্গোল তাকে চাবুক-পেটা করলেন। সুবতাই আলাদা একদল সৈন্য নিয়ে মেরকিটদের উচিত শিক্ষা দিতে গেলেন। খেপ নয়নকে বিশাল দুই সেনাদলের নেতৃত্ব দিয়ে আদেশ করা হলো—যেভাবেই হোক ঘুলচুককে খুঁজে, তার মরদেহ নিয়ে আসতে হবে। 

খেপ নয়ন কীভাবে তার চাতুর্য দিয়ে বিভিন্ন গোত্রকে কাজে লাগিয়েছিলেন, এই মুহূর্তে আমরা সেদিকে মনোযোগ দেব না। তিনি ঘুচলুককে ছাড়া বাকি সব শত্রুকেই ক্ষমা করে দেয়ার প্রস্তাব দিলেন আর মুসলমানদের দারুণভাবে উৎসাহিত করলেন। যুদ্ধের কারণে বন্ধ হয়ে যাওয়া বৌদ্ধ মন্দিরের দরজা খুলে দিলেন। আর এক বছর ধরে তিনি পৃথিবীর ছাদে ঘুচলুককে তাড়া করলেন। থামলেন তখন, যখন তিনি ঘুচলুককে হত্যা করে তার মাথা কারাকোরামে পাঠিয়ে দিতে পারলেন। সঙ্গে পাঠালেন এক হাজার সাদা নাকওয়ালা ঘোড়া। এই মঙ্গোল অনেক দিন ধরেই এগুলো জোগাড় করছিলেন। 

যদি প্রথম যুদ্ধটা তিনি হারতেন, তবে তা খানের জন্য ভয়াবহ ফল বয়ে আনত। এই ঘটনা দুটো পরিণাম তৈরি করল। ভয়ঙ্কর তুর্কি গোত্রের নিকটতম লোকেরা যারা তিব্বত থেকে শুরু করে রাশিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল, তার গোত্রের অংশ হয়ে গেল। উত্তর ক্যাথির পতনের পরে এই উপজাতিই এশীয় অঞ্চলে শক্তির ভারসাম্য রক্ষা করেছিল। বিজয়ী মঙ্গোলরা তখনো ছিল সংখ্যালঘু। 

মন্দিরের দরজা খুলে দেয়া চেঙ্গিস খানকে নতুন একটা সম্মান এনে দিয়েছিল। পাহাড়ি শহর থেকে উপত্যকা পর্যন্ত সবাই বলত এই লোকই ক্যাথি জয় করেছে আর বৌদ্ধ ক্যাথিদের প্রভাব এই লোকটার ওপর আছে। অন্যদিকে উৎপীড়ন না করে আর তাদের কর মাফ করে অপদস্থ মোল্লাদেরও তিনি সমীহ আদায় করেছিলেন। তিব্বতের বরফের নিচে, পৃথিবীর ভয়ঙ্করতম ধর্মীয় হিংসার মাঝে, মোল্লা এবং লামাদের সমান অধিকার দিয়ে তিনি প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন এবং সতর্কও করে দিয়েছিলেন। “ইয়াসা’-এর ছায়া দিয়ে খানের লোক, দাড়িওয়ালা ক্যাথিবাসী, এই বিজয়ীর জন্য এই নতুন আইন করে, বিশৃঙ্খল অবস্থা থেকে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনেন। এমনকি মুহুলির শক্ত শাসনেও যে ক্যাথিতে শান্তি আনতে পারছিল না, এই আইন সেখানেও শান্তি আনল। 

একজন দূত ঘোড়ায় চেপে খেপ নয়নের কাছে এলো। জানাল হাজার ঘোড়া খানের কাছে পৌঁছে গেছে। খান বলেছেন, “যদিও জয় এসেছে তারপরও এতে গর্বিত হয়ো না!” 

নিজেকে পুনরায় প্রমাণ করবার জন্য কিনা, খেপ নয়ন তিব্বতের পাহাড়ের নিচে যোদ্ধা জোগাড় করা শুরু করলেন। তিনি কারাকোরামে ফিরে গেলেন না। পৃথিবীর অন্য প্রান্তে তার করার মতো কাজ পড়ে আছে। 

ইতিমধ্যে, ঘুচলুকের উৎখাতের পরে, উত্তর এশিয়ায় হঠাৎ করে এবং বেশ নির্ণায়কভাবে যুদ্ধবিরতি হলো। চীন থেকে আড়াল সমুদ্র পর্যন্ত একজন শাসকই শাসন করত। বিদ্রোহ থেমে গেল। খানের সংবাদ নিয়ে একজন দূত পঞ্চাশ ডিগ্রি দ্রাঘিমাংশ পেরোত। কথিত আছে একজন কুমারী মেয়ে অলঙ্কার পরে নির্ভয়ে এই উপজাতি সাম্রাজ্যের এক সীমা থেকে অন্য সীমায় যেতে পারত। 

কিন্তু এসব প্রশাসনিক কাজকর্ম বয়স্ক সম্রাটের পুরোপুরি মনঃপূত হচ্ছিল না। তিনি আর চারণভূমিতে শীতকালীন শিকারে যেতে চাইতেন না। একদিন কারাকোরামের প্যাভিলিয়নে তিনি মঙ্গোল রক্ষীবাহিনীর এক কর্মকর্তাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, পৃথিবীর কোন জিনিস সবচেয়ে বেশি সুখ এনে দেয়? 

কিছুক্ষণ চিন্তা করে সেনা কর্মকর্তাটি বলল, “একটি খোলা মাঠ, খুব সুন্দর একটা দিন আর আপনার নিচে থাকা দ্রুতগামী একটি ঘোড়া এবং আপনার কব্জির ওপর একটি বাজপাখি।”

খান উত্তর দিলেন, “না। তোমার শত্রুকে পিষে ফেলা। তাদেরকে তোমার পদানত করা। তাদের ঘোড়া আর সম্পদ কেড়ে নেয়া। আর তাদের মহিলাদের আর্তচিৎকার শোনা। সেটাই হচ্ছে সর্বোত্তম।” 

সিংহাসন আর মুকুটের প্রভু আবার ছিলেন আশ্চর্য রকমের শান্ত। তার পরবর্তী পদক্ষেপ ছিল আরো একটি জয়, পরিণতিতে যা ছিল ভয়ঙ্কর, আর এটা ছিল পশ্চিমের দিকে। জয়টা এসেছিল এক দারুণ আশ্চর্য উপায়ে। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *