চেঙ্গিস খান – চিরকুট

১. গণহত্যাগুলো

মৃত্যুর যে ভয়ঙ্কর প্রদর্শন মঙ্গোল অশ্বারোহীদের যাত্রাপথে দেখা গিয়েছিল, তার বিস্তারিত বিবরণ এই বইয়ে দেয়া হয়নি। এই গণহত্যার একটা চিত্র পাওয়া যায় মঙ্গোলদের নিয়ে ইউরোপীয়, মুসলমান আর চীনাদের লেখা ইতিহাসে। পরোক্ষভাবে এমন কিছু ধ্বংসযজ্ঞের কথা, যেমন—কিয়েভের গণহত্যা, স্বর্ণালি প্রধানদের রাজসভা (বাইজেন্ট সাম্রাজ্যের স্বর্ণ খচিত গম্বুজের কারণে তাদের স্বর্ণালি বলা হতো) সম্পর্কে এখানে বলা হলো। এখানে বৃদ্ধ মানুষদের অত্যাচার করা, যুবতী নারীদের ধর্ষণ করা আর শিশুদের হত্যা করার মাধ্যমে শহরটিকে জনশূন্য করে দেয়ার ঘটনাটা আরো বীভৎস আকার নেয় মহামারী আর দুর্ভিক্ষের পরে। দুর্গন্ধ এতটাই তীব্র ছিল যে মঙ্গোলরাও এইসব এলাকা এড়িয়ে চলত, এই শহরের নাম তারা দিয়েছিল ‘মৌ বালিঘ’ বা দুঃখের শহর। 

ইতিহাসের ছাত্ররা এই নজিরবিহীন দুঃখ-দুর্দশা এবং এরপরে এখানে নতুন সভ্যতা গড়ে ওঠার মাঝে কোনো তাৎপর্য খুঁজে পেতে পারেন। চেঙ্গিস খানের কারণে মঙ্গোলদের প্রভাবের সারাংশ করেছেন ক্যামব্রিজ মেডিয়েভ্যাল হিস্টোরির লেখক। 

“দুর্দান্ত সাহসে অপ্রতিরোধ্য হয়ে তারা বিশাল মরুভূমির আতঙ্ককে জয় করেছিল। পাহাড় আর সমুদ্রের বাধাকে জয় করেছিল। জয় করেছিল জলবায়ুর নিষ্ঠুরতা এবং মহামারি আর দুর্ভিক্ষের ধ্বংসযজ্ঞকে। কোনো ভয় তাদের বাধা দিতে পারেনি, কোনো শক্ত ঘাঁটি তাদের প্রতিরোধ করতে পারেনি। দয়া বা ক্ষমাভিক্ষার কোনো প্রার্থনা তাদের টলাতে পারেনি… আমরা ইতিহাসের নতুন এক শক্তির দেখা পেলাম। যে কোনো শক্তিকে হঠাৎ থামিয়ে দেয়া এমন এক শক্তির দেখা পেলাম, যা এমন অনেক নাটকের ইতি টেনেছিল, যা হয়তো অমীমাংসিত অবস্থায় আঁটকে থাকত কিংবা যা হয়তো অনন্তকাল ধরে চলত। 

“এই ইতিহাসের নতুন শক্তি’— একজন মানুষের পুরো সভ্যতা পাল্টে দেয়ার ক্ষমতা— চেঙ্গিস খানকে দিয়ে শুরু হয়েছিল, আর শেষ হয়েছিল তার দৌহিত্র কুবলাই খানে, যখন মঙ্গোল সাম্রাজ্য ভেঙে পড়তে শুরু করে। এরপরে আর নতুন করে তা শুরু হতে পারেনি।” 

এই লেখায় চেঙ্গিস খানের তরফ থেকে ক্ষমা চাওয়ার বা তাকে আরো বেশি রক্তে রঞ্জিত করার চেষ্টা করা হয়নি। শুধু এই কথা স্বীকার করা হয়েছে যে, পূর্বে, এই সম্রাট সম্পর্কিত আমাদের বেশিরভাগ জ্ঞানের উৎস ছিল মঙ্গোলদের হাতে সবচেয়ে বেশি অত্যাচারিত মধ্যযুগের ইউরোপীয়, পার্সি আর সিরীয়রা। তারা এবং মূল চীনারা ছিল মঙ্গোল ধ্বংসযজ্ঞের সবচেয়ে বড় ভুক্তভোগী। গ্যালিক জয়ের স্মৃতিচারণা সিজার নিজে লিখেছেন আর আলেকজান্ডারের ছিল তার নিজের আরিয়ান আর কুইন্ডিস কুরতিয়াস। 

যখন আমরা তার নিজস্ব পরিবেশে দেখি, তখন আমরা চেঙ্গিস খানের ভেতর একজন শাসককে দেখতে পাই, যিনি তার কোনো সন্তান, মন্ত্রী কিংবা সেনাকে হত্যা করেননি। তার দুই ভাই, জুখি আর কাসার, নির্দয় আচণের বেশ কিছু সুযোগ তাকে দিয়েছিলেন, আর যেসব মঙ্গোল সেনার কারণে তিনি যুদ্ধে হেরেছেন, তাদের যে তিনি মৃত্যুদণ্ড দেবেন এই ব্যাপারটাও প্রত্যাশিত ছিল। বিভিন্ন লোকের প্রতিনিধি তার কাছে আসতে পারতো এবং নির্বিঘ্নে ফেরত যেতো। খুব অস্বাভাবিক পরিস্থিতি ছাড়া আমরা তাকে কোনো বন্দিকে অত্যাচার করতে দেখিনি। 

কারাইত, উঘুইর এবং লিয়াও তুং-এর (লৌহ মানব) মতো যুদ্ধবাজ জাতিকে তিনি সহনশীলতার সঙ্গে মোকাবেলা করেছিলেন। আর তার উত্তরপুরুষরা করেছিল আর্মেনীয়, জর্জীয় এবং ক্রুসেডারদের অবশিষ্টাংশের সাথে। যা কিছু তার এবং তার লোকদের কাজে দেবে সেসব জিনিসকে সংরক্ষণ করার ব্যাপারে চেঙ্গিস খান যত্নশীল ছিলেন, বাকি সব ধ্বংস করে ফেলতেন। নিজ মাতৃভূমি থেকে তিনি যত দূরে এগিয়ে গেছেন, যত নতুন সভ্যতার মাঝে গিয়েছেন, তার ধ্বংসযজ্ঞ ততই প্রায় সর্বজনীন হয়ে গিয়েছিল। 

আমরা আধুনিক মানুষরা এখন ধীরে ধীরে বুঝতে পারছি মনুষ্য জীবনের এমন অভূতপূর্ব ধ্বংসযজ্ঞ এবং কাজের কারণে, কেন মুসলমানদের কাছ থেকে তার সম্পর্কে কটূক্তি পেয়েছিলেন, আর তার অপূর্ব বুদ্ধিমত্তার কারণে তার বৌদ্ধ প্রজাদের কাছে থেকে সম্মান পেয়েছিলেন। 

চেঙ্গিস খান যেহেতু মুহাম্মাদের মতো একটি ধর্মের কারণে যুদ্ধ করেননি অথবা নেপোলিয়ান বা অ্যালেকজান্ডারের মতো নিজের ব্যক্তিগত কিংবা রাজনৈতিক উচ্চাভিলাসের জন্য যুদ্ধ করেননি, তাই তার সম্পর্কে আমাদের ধারণা অনেকটা রহস্যাবৃত। তার সম্পর্কে এই রহস্যের সমাধান পাওয়া যায় মঙ্গোল চরিত্রের প্রাচীন সরলতায়। 

তার সন্তান এবং তার লোকদের জন্য যা দরকার, তা তিনি পৃথিবীর কাছ থেকে নিয়েছেন। আর এই কাজটা তিনি করেছেন যুদ্ধ করে। কারণ অন্য কোনো উপায় তার জানা ছিল না। যা তিনি চাইতেন না তা ধ্বংস করে দিতেন, কারণ এসব নিয়ে কী করতে হবে, তা তিনি জানতেন না। 

২. এশিয়ার প্রিস্টার জন 

দ্বাদশ শতকের মধ্যভাগে, তুর্কিদের ওপর এশিয়ার একজন খ্রিস্টান রাজার জয়ের খবর ইউরোপে পৌঁছল। পরবর্তী সময়ের গবেষণা থেকে এটা প্রমাণিত হয়, জেরুজালেমের পূর্বে অবস্থানরত একজন খ্রিস্টান রাজার যে আভাস আমরা পাই তা মুসলমানদের ওপর জনের জয়ের খবর। তিনি ছিলেন জর্জিয়ার একজন উচ্চপদস্থ রাজকীয় সেনা। ককেশাস অঞ্চলের এই এলাকাটি তখন আর্মেনিয়া ও ভারতের সঙ্গে অস্পষ্টভাবে যুক্ত ছিল। 

বলা হয়, তিনজন মেজাই (যারা শিশু যিশুর জন্য উপহার এনেছিলেন) এই এলাকা থেকে এসেছিলেন। ক্রুসেডের উদ্দীপনা ইউরোপে ছড়িয়ে গিয়েছিল। এশিয়ার একজন শক্তিশালী খ্রিস্টানের জয়ের গল্প তখন প্রবাদ হয়ে গিয়েছিল আর্মেনিয়া থেকে ক্যাথি পর্যন্ত ছড়িয়ে থাকা নেস্তোরিয়ান খ্রিস্টানরা একবার পোপ তৃতীয় অ্যালেকজান্ডারকে লিখেছিলেন। ধারণা করা হয় প্রিস্টার জন সেই চিঠি লিখেছিলেন। পুরনো ধাঁচে লেখা সেই চিঠিতে মরুভূমি সম্পর্কে, তার চারপাশে থাকা সত্তরজন রাজা, সুন্দর পশু আর মরুভূমির ওপর সুন্দর শহর সম্পর্কে লেখা ছিল। সংক্ষেপে সেই সময়ের রূপকথার একটি খুব ভালো সারাংশ ছিল সেখানে। 

কিন্তু এতক্ষণ পর্যন্ত বর্ণনায় সত্যতা পাওয়া যায় এবং কারাইতদের ওয়াং খানের সঙ্গে তা মিলে যায়। তিনি ছিলেন মুলত খ্রিস্টান। তার শহর কারাকোরাম সম্ভবত সেই শহর, যেখানে এশিয়ার নেস্তোরিয়ানদের শক্ত ঘাঁটি ছিল। শহরটি মরুভূমিতে ছিল, আর তিনি ছিলেন এর সম্রাট। খানরা বা রাজারা ছিল তার প্রজা। বেশ কয়েকজন ইতিহাসবিদ একজন ‘কেরিথদের’ রাজার ধর্মান্তরিত হওয়ার কথা উল্লেখ করেন। মার্কো পোলো এই ওয়াং খানের মধ্যে প্রিস্টার জনের ছায়া খুঁজে পেয়েছিলেন। 

৩. চেঙ্গিস খানের আইন 

১। আদেশ করা যাচ্ছে যে, সকলকে বিশ্বাস করতে হবে মাত্র একজন ঈশ্বর আছেন। যিনি পৃথিবী আর স্বর্গের স্রষ্টা। যিনি একাই কেবল জীবন আর মৃত্যু, প্রাচুর্য আর দারিদ্র্য দিতে পারেন। যাকে খুশি দিতে পারেন। সবকিছুর ওপরে যার রয়েছে সর্বময় ক্ষমতা। 

২। বিভিন্ন ধর্মের নেতা, ধর্ম প্রচারক, পুরোহিত, ধর্মের আচার-অনুষ্ঠানের সঙ্গে যারা জড়িত, মসজিদের মুয়াজ্জিন, চিকিৎসক আর যারা মৃতদেহ গোসল করায়, তাদের সকলকে কর থেকে অব্যহতি দেয়া হলো। 

৩। যদি না কোনো রাজপুত্র, খান, সেনা বা অন্য মঙ্গোল সভাসদদের দ্বারা নির্বাচিত হয়, তবে কেউই, সে যেই হোক না কেন, নিজেকে সম্রাট ঘোষণা করতে পারবে না। এমন কাজকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হলো আর কেউ তা করলে তার শাস্তি হবে মৃত্যুদণ্ড। 

৪। এই জাতির এবং গোত্রের কোনো গোত্রপ্রধান, যে মঙ্গোলদের প্রজা, কোনো সম্মানসুচক উপাধি ধারণ করতে পারবে না। 

৫। আত্মসমর্পণ না করলে কোনো রাজা বা রাজপুত্র কিংবা কোনো জনগোষ্ঠীর সঙ্গে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হলো। 

৬। যে আইনে সেনাদের দশ, শত, হাজার এবং দশ হাজারের দলে ভাগ করা হয়েছিল সেই আইন বলবত থাকবে। এই সজ্জা খুব অল্প সময়ে সেনাবাহিনী গঠন করতে কাজে দেয় আর সেনাদের নেতৃত্ব দিতে সুবিধা হয়। 

৭। যুদ্ধ শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে, প্রত্যেক সেনা তার অস্ত্র সেই কর্মকর্তার কাছ থেকে পাবে, যিনি তাদের দ্বায়িত্বে থাকবেন। সেনাকে সেই অস্ত্র ভালোভাবে রাখতে হবে আর যুদ্ধ শুরুর পূর্বে তার সেনাপ্রধানকে দিয়ে সেটা পরীক্ষা করিয়ে নিতে হবে। 

৮। সেনাপ্রধানের অনুমতি ছাড়া কোনো সেনা শত্রুকে লুট করতে পারবে না। এমনটা করা মৃত্যুদণ্ডযোগ্য অপরাধ। তবে অনুমতি দিলে সেই সেনা এবং সেনাপ্রধানের লুট করার সমান অধিকার থাকবে। যা সে পাবে তার সবটাই সে রাখতে পারবে, তবে তার আগে সেখান থেকে সম্রাটের কর করসংগ্রহকারীকে দিয়ে দিতে হবে। 

৯। সেনাবাহিনীর লোকদের প্রশিক্ষণে ব্যস্ত রাখতে, প্রতি শীতে বিশাল এক শিকার অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হবে। এই কারণে মার্চ থেকে অক্টোবর পর্যন্ত সাম্রাজ্যের যে কোনো মানুষের জন্য হরিণ, খরগোশ, রোবাক (এক ধরনের পুরুষ হরিণ), বন্য গাধা আর কিছু পাখি হত্যা নিষিদ্ধ ছিল। 

১০। খাবারের জন্য কোনো পশুকে গলা কেটে হত্যা করা নিষিদ্ধ করা হলো। শিকারিকে অবশ্যই পশুটিকে বেঁধে, বুক চিরে, হৃৎপিণ্ড নিজ হাতে বের করতে হবে। 

১১। যদিও এতোদিন নিষিদ্ধ ছিল, তবে এখন থেকে পশুর রক্ত এবং নাড়িভুঁড়ি খাওয়া যাবে। 

১২। (নতুন রাজ্যের গোত্রপ্রধান আর সেনাদের জন্য কিছু সুবিধা এবং বিমুক্তির সূচি দেয়া হয়)। 

১৩। যুদ্ধে না যাওয়া প্রত্যেক মানুষকে, একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত কোনো পারিশ্রমিক ছাড়া রাষ্ট্রের জন্য কাজ করতে হবে। 

১৪। কেউ যদি কারো ঘোড়া বা গবাদি কিংবা সেই সমমূল্যের কিছু চুরি করে তবে তা মৃত্যুদণ্ড যোগ্য অপরাধ বলে গণ্য হবে আর তার শরীর কেটে দুই টুকরা করা হবে। ছোটখাট চুরির জন্য শাস্তি নির্ধারিত হবে চুরি করা জিনিসের দামের ওপর ভিত্তি করে, একজন লোকের ঘুষি-সাত, সতেরো, সাতাশ হতে সাত শ পর্যন্ত। তবে চুরি করা জিনিসের নয়গুণ ফেরত দিলে এই শারীরিক শাস্তি থেকে সে অব্যহতি পেতে পারে। 

১৫। এই সাম্রাজের কোনো প্রজা কোনো মঙ্গোলকে ভৃত্য বা ক্রীতদাস বানাতে পারবে না। খুব বিরল ক্ষেত্র ছাড়া, প্রত্যেককেই সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে হবে। 

১৬। ভিনদেশী ক্রীতদাসদের পালিয়ে যাওয়া বন্ধ করতে তাদের আশ্রয়, আহার অথবা পোশাক দেয়া নিষিদ্ধ করা হলো। এমন কাজ করলে তার শাস্তি হবে মৃত্যুদণ্ড। কেউ যদি এমন কোনো পলাতক ক্রীতদাসের দেখা পায় আর সে তার মালিকের কাছে ফেরত না নিয়ে যায়, তবে তাকেও মৃত্যুদণ্ড দেয়া হবে। 

১৭। বিয়ে সম্পর্কে আইন হচ্ছে, প্রত্যেক মানুষকে তার স্ত্রীকে কিনতে হবে। আর প্রথম এবং দ্বিতীয় নিকটতম আত্মীয়ের মধ্যে বিয়ে করা নিষিদ্ধ। একজন মানুষ, দুই বোনকে বিয়ে করতে পারবে কিংবা অনেক উপপত্নী রাখতে পারবে। নারীর উচিৎ পরিবারের এবং সম্পদের দেখাশোনা করা, নিজেদের ইচ্ছেমতো কেনা-বেচা করা। পুরুষদের কেবল যুদ্ধ আর শিকারে ব্যস্ত থাকা উচিৎ। ক্রীতদাসের গর্ভের সন্তানও স্ত্রীর গর্ভজাত সন্ত নিদের মতোই বৈধ। প্রথম স্ত্রীর গর্ভজাত সন্তান অন্যান্য সন্তানদের ওপরে স্থান পাবে এবং সবকিছুর উত্তরাধিকারী হবে। 

১৮। ব্যভিচারকে মৃত্যুদণ্ডযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হবে। যারা এই 

অপরাধে দণ্ডিত হবে তাদের হত্যা করা হবে। 

১৯। যদি দুই পরিবার বিয়ের মাধ্যমে একত্রিত হতে চায়, আর যদি তাদের কেবল শিশুসন্তান থাকে এবং তাদের একজন বালক আর একজন বালিকা হয়, তবে এই বিয়ে তারা দিতে পারবে। যদি সন্তানরা মারা যায়, বিয়ের অঙ্গীকারনামা তারপরও বলবত থাকবে। 

২০। বজ্রপাতের সময় স্রোতস্বিনী নদীতে গোসল বা কাপড় ধোয়া নিষিদ্ধ করা হলো। 

২১। গুপ্তচর, মিথ্যা সাক্ষীদাতা, কুখ্যাত ব্যক্তি আর খারাপ জাদুকরকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হবে। 

২২। নিজের কাজ ঠিকমতো করতে না পারা সেনা এবং গোত্রপ্রধানরা, বা যারা খানের সমন পাওয়ার পরেও আসবে না, তাদের মৃত্যুদণ্ড দেয়া হবে। বিশেষ করে যারা দুরের এলাকায় আছে, যদি তাদের অপরাধ কম হয়, তবে সশরীরে তাদেরকে খানের সামনে আসতে হবে। 

চেঙ্গিস খানের আইনের এই উদাহরণগুলো পেতিস দে লা এক্স থেকে অনূদিত। তিনি ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন ইয়াসা চেঙ্গানি’-এর সবগুলো আইন তিনি জোগাড় করতে পারেননি। তিনি এই বাইশটি আইন বিভিন্ন সূত্র, যেমন—পারস্য গল্পগাঁথা, ফ্রা রুব্রিক আর কারপিনি থেকে জোগাড় করতে পেরেছেন। এখানে দেয়া সূচি সম্ভবত অসম্পূর্ণ আর আমরা তা পেয়েছি অজানা সূত্র থেকে। 

কৌতূহল উদ্দীপক দশম আইনের ব্যাখ্যা সম্ভবত পাওয়া যায় শিকারকে হত্যা এবং খাওয়ার উপায়ের ব্যাপারে বিদ্যমান তৎকালীন ধর্মীয় কুসংস্কারে। এগারোতম আইন মনে হয় দুর্ভিক্ষের সময় খাবারের সংরক্ষণের জন্য তৈরি করা হয়। বজ্র আর পানি সম্পর্কে বিংশতম আইন সম্পর্কে রুব্রিক বলেন, এই আইন করা হয়েছিল বজ্রপাতের সময়, বজ্রপাতকে ভয় পাওয়া মঙ্গোলদের, ভয়ে হ্রদ বা নদীর পানিতে নেমে পড়া থামানোর জন্য। 

পেতিস দে লা ক্রক্স বলেন, চেঙ্গিস খানের ইয়াসা তৈমুর লংও অনুসরণ করেছিলেন। ভারতের প্রথম মোঘল বাদশাহ বাবর বলেন, “আমার পূর্বপুরুষ এবং পরিবারবর্গ শ্রদ্ধার সঙ্গে চেঙ্গিস খানের আইন অনুসরণ করেছিলেন। তাদের অনুষ্ঠানে, রাজসভায়, উৎসবে, আপ্যায়নে, তাদের ওঠা-বসায় কখনোই তারা চেঙ্গিস খানের আইনের পরিপন্থী কিছু করতেন না। 

৪. মঙ্গোল সেনাদের সংখ্যার শক্তি 

ইতিহাসবিদদের খুব সাধারণ এবং স্বাভাবিক একটা ভুল হচ্ছে, তারা মঙ্গোল সেনার বর্ণনা দিতে গিয়ে বলতেন, মঙ্গোলদের বিশাল সেনাবাহিনী ছিল। আধুনিক সময়ের অন্যতম ইতিহাসবিদ ড. স্ট্যানলি লেন পোলও তার ‘টার্কি (জাতিসমূহের গল্প)’ বইয়ে একই কাজ করা থেকে নিজেকে বিরত রাখতে পারেননি, বলেছেন, ‘চেঙ্গিস খান তার গোত্রের অনুসারী সেনাদের নিয়ে যখন চলতেন, তখন মনে হতো তার পিছে রয়েছে ধুলোর সমুদ্র, যার কোনো সংখ্যা নেই। ‘ 

ম্যাথু প্যারিস আর মধ্যযুগের ধর্মগুরুদের কাছ থেকে যে ধারণা আমরা পেয়েছিলাম, আমাদের জ্ঞানের কারণে মঙ্গোলদের সম্পর্কে তার চেয়ে একটু বেশি জানতে পেরেছি। যতটা বুঝেছি, চেঙ্গিস খানের সেনারা, হুনদের (চতুর্থ শতাব্দীতে ইউরোপ আক্রমণকারী এক উপজাতি) মতো অতিথি সেনা ছিল না। তারা ছিল আক্রমণের জন্য রীতিমতো প্রশিক্ষিত সেনা। স্যার হেনরি হাওয়ার্থ তার সেনার নিম্নরূপ সংখ্যা দিয়েছিলেন : 

রাজকীয় রক্ষী – ১,০০০

মূল সেনাদল, তুলির অধীনে  – ১,০১,০০০

ডান পাশের দল – ৪৭,০০০

বাম পাশের দল – ৫২,০০০

অন্যান্য বাহিনী – ২৯,০০০

শাহ এবং পশ্চিমের সঙ্গে যুদ্ধের সময় এই ছিল মোটামুটি তার সেনাবাহিনীর গঠন। এটা ছিল চেঙ্গিস খানের সবচেয়ে বেশিসংখ্যক সেনার সমষ্টি। অন্যান্য বাহিনীর সংখ্যা ছিল ১০,০০০। এদের মধ্যে ছিল ক্যাথিসেনা, উঘুইরের ইদিকুতদের সেনা আর ছিল আল মালিকের খানেরা। আক্রমণ শুরুর পরে শেষ দুই সেনাদল ফেরত পাঠিয়ে দেয়া হয়। 

বিশিষ্ট পণ্ডিত লিওন ক্যাহুর মতে, মঙ্গোলদের প্রকৃত সেনা ৩০, ০০০-এর ওপরে ছিল না। জুখির ২০, ০০০ এবং তার সহযোগীর পাশাপাশি এই অভিযানে এ রকম তিনটি সেনাগুচ্ছ ছিল। সেই হিসাবমতে তার সেনাসংখ্যা ছিল প্রায় ১,৫০,০০০। আর এশিয়ার উঁচু ঊষর অঞ্চলে, শীতের সময়, এর চেয়ে বেশি সেনা পাওয়া সম্ভবও ছিল না। 

মৃত্যুর সময় চেঙ্গিস খানের নেতৃত্বাধীন সেনা দলে তার রাজকীয় রক্ষী ছাড়া চারটি সেনাগুচ্ছ ছিল, অর্থাৎ মোট ১,৩০,০০০ সেনা। গোবি এলাকায় যে ক্ষুদ্র জনসংখ্যা ছিল, তার পরিমাণ ১৫,০০,০০০। আর এই জনসংখ্যা থেকে বড়জোর ২,০০,০০০ কার্যকর এবং প্রশিক্ষিত সেনা পাওয়া সম্ভব। ব্রিগেডিয়ার জেনারাল স্যার পার্সি সাইক্স তার ‘পারসিয়া’ বইয়ে বলেছেন, “মঙ্গোলরা সংখ্যায় কম ছিল আর তারা তাদের মূল সেনাঘাঁটি থেকে কয়েক হাজার মাইল দূরে গিয়ে যুদ্ধ করত।” 

সমসাময়িক মুসলমান লেখকরা অভ্যাসগতভাবে তার সেনাসংখ্যা অনেক বাড়িয়ে বলতেন, বলতেন পাঁচ থেকে আট লাখ। কিন্তু সকল তথ্য-প্রমাণ থেকে দেখা যায়, ১২১৯-১২২৫ সালের এই সময়ে, চেঙ্গিস খান তিব্বত থেকে কাস্পিয়ান সাগরের এলাকায় যে আক্রমণ চালিয়েছিলেন, সেখানে ১,০০,০০০ সেনার বেশি ছিল না। আর নিপার থেকে চীন সাগরে অভিযানের সময় সর্বসাকল্যে ছিল ২,৫০,০০০ সেনা। আর এসব অভিযানের সময় মঙ্গোলসেনার সংখ্যা অর্ধেকের বেশি ছিল না। গল্পকাররা বলেন ৫০,০০০ তুর্কোমান সেনা তার এই অভিযানের শেষে তার সঙ্গে যুক্ত হয়। জুখির সেনার শক্তি বৃদ্ধি পায় মরুবাসী বন্য কিপচাক সেনাদের দিয়ে। চীনে মঙ্গোলদের পতাকাতলে যুদ্ধ করেছিল বর্তমান কোরীয় আর মাঞ্চুদের পূর্বপুরুষরা। 

চেঙ্গিস খানের পুত্র ওগোতাইয়ের শাসনামলে মধ্য এশিয়ার অনেক তুর্কি উপজাতি মঙ্গোলদের সঙ্গে যুদ্ধ করে। সুবোতাই আর বাঁর যে সেনারা পূর্ব ইউরোপ জয় করেছিল, সেই সেনার বেশিরভাগ সদস্য ছিল এই তুর্কিরা। নিশ্চিতভাবে বলা যায়, ওগোতাইয়ের ছিল পঞ্চাশ লাখের বেশি কার্যকর সেনা। আর চেঙ্গিস খানের দৌহিত্র মাঙ্গু আর কুবলাই খান এই সৈন্যসংখ্যা দ্বিগুণ করেন। 

৫. মঙ্গোলদের আক্রমণ পরিকল্পনা 

কোনো বিরূপ দেশ আক্রমণ করতে চেঙ্গিস খানের সেনারা একটা নির্দিষ্ট পরিকল্পনা অনুসরণ করত। আর এই পদ্ধতিতে মঙ্গোল সেনারা একের পর এক জয় পাচ্ছিল। তাদেরকে কেবল আটকাতে পেরেছিল মামলুকরা, ১২৭০ সালে যখন সিরিয়া পেরিয়ে মিসরে আক্রমণ করতে যায়, তখন। 

১। চেঙ্গিস খানের মূল কার্যালয়ে ডাকা হতো ‘কুরুলতাই’ বা সাধারণ সভা। যাদের কোনো নির্দিষ্ট কাজে নিয়োজিত থাকবার অনুমতি দেয়া আছে তারা ছাড়া বাকি সব উচ্চপদস্থ সেনা কর্মকর্তাই উপস্থিত থাকতেন এই সভায়। এখানে পুরো পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হতো আর অভিযানের পরিকল্পনা ব্যাখ্যা করা হতো। অভিযানের যাত্রাপথ নির্ধারণ করা হতো, বিভিন্ন কাজের জন্য বিভিন্ন সেনাবিভাগকে নির্বাচন করা হতো। 

২। গুপ্তচর পাঠানো হতো আর সংবাদ সংগ্রহকারীদের প্রশ্ন করার জন্য ডেকে পাঠানো হতো। 

৩। আক্রান্ত হতে যাওয়া দেশটিকে কয়েক দিক থেকে একই সঙ্গে আক্রমণ করা হতো। একেকটি সেনাদলের দায়িত্বে থাকতেন একজন সেনাপ্রধান আর তিনি নির্দিষ্ট লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যেতেন। তার স্বাধীনতা ছিল সেনাবাহিনীকে যেভাবে প্রয়োজন সেভাবে পরিচালনা করার, আর শত্রুসেনাকে ইচ্ছেমতো আক্রমণ করার, তবে অবশ্যই সংবাদ প্রেরকের মাধ্যমে মূল কার্যালয়ে থাকা খান বা অর খানের সঙ্গে সর্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখতে হতো। 

৪। কোনো বড় সমৃদ্ধশালী শহরে আলাদা একদল পর্যবেক্ষক সেনাকে মোতায়েন রাখা হতো আর পাশের জেলায় আক্রমণ চালানো হতো। যদি আক্রমণ দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার সম্ভাবনা থাকত, তবে কাছাকাছি দেশে বসানো হতো ঘাঁটি। আর সেখান থেকে সরবরাহের ব্যবস্থা করা হতো। খুব কমই এমন হতো যে, মঙ্গোলরা খুব শক্ত কোনো শহরকে কেবল দেখেছে; বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তাদের ইচ্ছে থাকতো আক্রমণ করার। এমন পরিস্থিতিতে যুদ্ধবন্দিসহ এক অথবা দুই দল সেনা অবরোধের সরঞ্জামসহ সেখানে থেকে যেত আর মূল সেনাদল এগিয়ে যেত। 

যখন মঙ্গোলরা ময়দানে খুব ভয়ঙ্কর সেনাবাহিনীর দেখা পেত, তখন দুটি রাস্তার একটা বেছে নিত। যদি সম্ভব হতো, তবে দিনে এবং রাতে, খুব দ্রুত এগিয়ে শত্রুসেনাকে তারা ভড়কে দিত—দুটি কিংবা তার চেয়ে বেশি সেনাদল নির্দিষ্ট একটি যুদ্ধক্ষেত্রে, নির্দিষ্ট সময়ে তীব্র আক্রমণ চালাত। যেমনটা করেছিল ১২৪১-এ পেস্থের কাছে হাঙ্গেরীয় যোদ্ধাদের পরাজিত করতে। আর এভাবে সফল না হলে, খুব দ্রুত তারা শত্রুকে ঘিরে ফেলত অথবা এক প্রান্তকে ঘিরে ফেলত। 

অন্য পদ্ধতি ছিল নকল যুদ্ধ করা এবং কয়েক দিন ধরে পিছিয়ে আসা। এমন করলে শত্রু সেনারা ছড়িয়ে পড়ত কিংবা তাদের ভেতর আয়েসী ভাব চলে আসত। তখন মঙ্গোলরা নতুন ঘোড়াসহ নতুন করে আক্রমণ করত। এভাবে নেপিয়ারের কাছে তারা দারুণ শক্তিধর রাশিয়ার সেনাদের পর্যুদস্ত করেছিল। 

অনেক সময় এ ধরনের ছলনাময় পিছু হটা দিয়ে, শত্রুসেনাদের পুরোপুরি ঘিরে ফেলা পর্যন্ত, তারা তাদের রেখা প্রসারিত করত শত্রুসেনার অজান্তেই। যদি শত্রুসেনারা দারুণ সাহসিকতার সাথে একত্রিত হয়ে যুদ্ধ করত তবে তাদের পালিয়ে যাওয়ার জন্য ঘেরাও-এর কিছু অংশ ফাঁকা করে তাদের পালিয়ে যেতে দেয়া হতো। এরপর তাদেরকে চলন্ত অবস্থায় আক্রমণ করত। বোখারার সৈন্যদের এই পরিণতি হয়েছিল। 

তাদের এ ধরনের অনেক অভিযানের পরিকল্পনা, সমৃদ্ধশালী প্রথম দিকের তুর্কিরা আর হিউং নুরা নিজেরা প্রয়োগ করত। মঙ্গোলরা কিছুটা এই হিউং নু উপজাতিরই উত্তরসূরি। অশ্বারোহী সেনাদের কলাম তৈরি করে লড়াইয়ে অভ্যস্ত ছিল ক্যাথিবাসীরা আর মূল চীনারা জানত পরিকল্পনা তৈরির সব নিয়ম। পুরো ব্যাপারগুলোর সঙ্গে চেঙ্গিস খান শুধু যোগ করেছিলেন দৃঢ় সিদ্ধান্ত আর সঠিক সময়ে সঠিক কাজ করার দুর্লভ এক ক্ষমতা। আর নিজের লোকদের তিনি নিয়ন্ত্রিত রেখেছিলেন শক্ত হাতে। 

দিমিত্রি বোলজার এই মহান মঙ্গোলের সামরিক প্রতিভা সম্পর্কে বলেছেন, “এমনকি চীনারাও বলতে, তিনি ঈশ্বরের মতো তার সেনাদের চালনা করতেন। যেভাবে তেমন কোনো বাধা ছাড়াই তিনি তার বৃহৎ সেনাদলকে সঙ্গে নিয়ে অনেক দূরের পথ পাড়ি দিতেন নিজ এলাকা থেকে দূরের কোনো দেশে, আর পরস্পরের থেকে অনেক দূরের বিভিন্ন দেশে যে বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে একসঙ্গে চলা যুদ্ধ তিনি পরিচালনা করতেন, অজানা দেশে যুদ্ধে তার সেই পরিকল্পনা, সব সময় সতর্ক থাকা, আবার অতি সতর্কতা কিংবা দ্বিধা ছাড়াই যুদ্ধ পরিচালনা, অবরোধগুলোর খুব সুন্দর পরিসমাপ্তি, দুর্দান্ত সব জয়— সবকিছু মিলিয়ে তার সম্পর্কে এমন এক ছবি তুলে ধরে যে, ইউরোপের পক্ষে সম্ভব হয়নি তার এসব সাফল্যকে ছাড়িয়ে যাওয়ার মতো কারো কোনো নজির তুলে ধরার।” 

৬. মঙ্গোল এবং গান পাউডার 

চেঙ্গিস খানের পূর্বে কোনো চীনা আবিষ্কার সম্পর্কে আমাদের যথাযথ জ্ঞান খুবই কম আর তার মঙ্গোলরাই এই বিচ্ছিন্ন সাম্রাজ্যে প্রবেশের পথ খুলে দেয়। এরপরে, অর্থাৎ ১২১১ সালের পরে আমরা প্রায়ই বারুদ সম্পর্কে শুনতে পাই। এটা ‘হো পাও’ বা আগুন প্রক্ষেপকে ব্যবহৃত হতো। 

এক অবরোধের সময় কাঠের তৈরি মিনার জ্বালিয়ে দিতে ‘হো পাও’-এর উল্লেখ আছে। আগুন প্রক্ষেপক থেকে ‘গান পাউডার’ বা বারুদ ছোড়ার সময়, বিজলি চমকানোর মতো বিকট আওয়াজ হয়েছিল, যা ত্রিশ মাইল দূর থেকেও শোনা গিয়েছিল। ‘ত্রিশ মাইল’ সম্ভবত একটু বাড়িয়ে বলা। ১২৩২ সালের কাইফ অবরোধের সময় একজন চীনা সমরবিশারদ এই তথ্যটি নথিভুক্ত করেছিলেন— “মঙ্গোলরা নিজেরা মাটিতে গর্ত খুঁড়ে, মিসাইল থেকে বাঁচবার জন্য তার ভিতরে নিজেদের লুকিয়েছিল। আমরা ঠিক করলাম, আমাদের যন্ত্র, যার নাম ছিল ‘চীন তেন লাই’ (যা ছিল এক ধরনের অগ্নি প্রক্ষেপক), তার সঙ্গে লোহা বেঁধে, মুখ নিচু করে, মঙ্গোলরা যেখানে লুকিয়ে আছে, সেই দিকে তাক করব। বিস্ফোরণ হলো আর তারা তাদের বর্মসহ টুকরো টুকরো হয়ে গেল।” 

আবার কুবলাই খানের সময় : “সম্রাট… আগুন বন্দুক দাগতে নির্দেশ দিলেন। এই তথ্য শুনে শত্রুসেনাদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ল।” ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. হার্বার্ট গোয়েন চতুর্দশ শতাব্দীর একটি জাপানি সূত্রের উল্লেখ করে এই মঙ্গোল অস্ত্র সম্পর্কে বলেন—

“ফুটবলের মতো বড় লোহার বল, একটা বিকট শব্দের সঙ্গে আকাশে উড়ে যেত আর সঙ্গে থাকত দারুণ এক আলোর ঝলকানি।” 

চীনা এবং মোঙ্গোলরা যে গান পাউডারের বিধ্বংসী ক্ষমতা সম্পর্কে জানত তা বেশ স্পষ্ট, আর এটাও পরিষ্কার যে তাদের অগ্নি প্রক্ষেপক প্রধানত ব্যবহৃত হতো শত্রুদের পুড়িয়ে দিতে অথবা ভয় দেখাতে। কামান কীভাবে দাগতে হয় তা তারা জানত না, আর প্রক্ষেপণে খুব কমই অগ্রগতি হয়েছিল। প্রচণ্ড টান বা উল্টো দিকে ওজন দেয়া অবরোধ যন্ত্রের ওপরই তারা নির্ভর করত। 

এই মঙ্গোলরাই ১২৩৮-৪০ সালে মধ্য ইউরোপ দখল করে আর এখন যেটা রুশ পোল্যান্ড বা পোলিশ রাশিয়া সেখানে যাজক সোয়ার্টজ-এর জীবদ্দশায় সে এলাকায় তারা ছিল। ফ্রিবার্গ তাদের জয় করা এলাকার মধ্যে ছিলেন। আর এই জার্মান যাজক অবশ্যই এই মঙ্গোলদের দুর্গের তিন শ মাইলের মধ্যে তার আবিষ্কারের ওপর কাজ করেছিলেন। (সোয়ার্টজের দাবির প্রতি পূর্ণ সম্মান রেখেই একটা কথা যোগ করা আবশ্যক যে, মঙ্গোলরা ইউরোপে বারুদ ব্যবহার করেছিল তার কোনো প্রতিষ্ঠিত নথি নেই। তবে এটা মনে রাখতে হবে যে, ব্যবসায়ীরা প্রতিনিয়ত তাদের সঙ্গে ব্যবসা করত আর ইউরোপের বিভিন্ন শহরে ফেরত যেত।)। 

ফ্রাইয়ার রজার বেকনের দিকে দৃষ্টি ফেরালে আমরা দেখতে পাব, মনে হয় না যে তিনি নিজে জনগণের ব্যবহারের জন্য কোনো গান পাউডার তৈরি করেছিলেন। তিনি এমন একটি পদার্থের অস্তিত্বের কথা এবং এর জ্বলে ওঠার ক্ষমতার কথা নথিভুক্ত করে গিয়েছিলেন। রজার বেকন, রুরুকের ফ্রায়ার উইলিয়ামের সঙ্গে দেখা করেছিলেন, কথা বলেছিলেন, তার নিজের ভৌগোলিক এবং অন্যান্য জ্ঞান সম্পর্কে জেনেছিলেন। এই রজার বেকনকে ফ্রান্সের সেন্ট লুই মঙ্গোলদের কাছে দূত হিসেবে পাঠিয়েছিলেন। রজার বেকনের ‘ওপাস মাজুস’ উইলিয়াম রুরুকের বই সম্পর্কে বলেন, “যে বইটা আমি দেখেছিলাম আর যে বইয়ের লেখকের সঙ্গে আমি কথা বলেছিলাম” (এই তথ্যের বিপক্ষে এই যুক্তি দেখানো যায় যে, রুকের বইয়ে গান পাউডার সম্পর্কে কোনো উল্লেখ নেই, আর তিনি মঙ্গোল রাজসভায় যে ছয় মাস ছিলেন, সেই সময় এ সম্পর্কে জেনেছেন তাও বলা যাচ্ছে না। কারণ বেকন যে সময় গান পাউডারের উপকরণ অর্থাৎ সল্ট পেত্রে আর সালফার-এর কথা উল্লেখ করেন, তা রুকের রাজসভা থেকে ফেরত আসার আগের ঘটনা। 

এ ব্যাপারটা পুরোটাই একজনের নিজের মতামতের ওপর নির্ভর করছে—তিনি কোনো ঘটনাকে কতটা গুরুত্ব দেবেন। গান পাউডারের এই দুই ইউরোপীয় সন্দিগ্ধ আবিষ্কারক, সেই পঁচাত্তর বছর সময়টাতেই বাস করতেন, যে সময়টা ইউরোপ জেগে উঠছিল মঙ্গোল আক্রমণে আর তাদের ব্যবহার করা অস্ত্রে। আর তারা দুজনই মঙ্গোলদের ব্যবহৃত এসব অস্ত্রের সংস্পর্শে এসেছিলেন। 

তবে যাজক সোয়ার্টজ-এর সময় যে জার্মানিতে প্রথম আগ্নেয়াস্ত্র আর কামানের ব্যবহার শুরু হয়েছিল তার অকাট্য প্রমাণ আছে। ইউরোপে খুব দ্রুত কামানের উন্নয়ন হয় আর তা এশিয়ায় প্রবেশ করে কনসট্যান্টিনোপল আর তুর্কিদের পথে। তাই আমরা দেখতে পাই, প্রথম মোঘল বাবর, ১৫২৫ সালে বড়সড় কামান ব্যবহার করেন। পরিচালনায় ছিলেন একজন তুর্কি, রমিস। সপ্তদশ শতাব্দীতে চীনে জেসু প্রথম ধাতব কামান ব্যবহার করেন। আর আমরা ইউরোপীয় কসাকদের মাঝে এক মজাদার চিত্র দেখতে পাই, ১৫৮১ সালে তাতারদের এলাকা আক্রমণের সময় এশীয় লোকেরা একটি গোলাবিহীন কামান টেনে নিয়ে যাচ্ছিল, তারা এর ব্যবহার জানত না, ভেবেছিল এটি আক্রমণকারীদের ওপর বিস্ফোরিত হবে। 

সব তথ্যকে একত্র করলে এটাই বের হয়ে আসছে যে, ফ্রায়ার, বেকন আর সোয়ার্টজের আগেই চীনারা বারুদ তৈরি এবং এর বিধ্বংসী ক্ষমতা সম্পর্কে জেনেছিল। তবে যুদ্ধক্ষেত্রে এর খুব কমই ব্যবহার করেছিল। ইউরোপীয়রা তাদের কাছ থেকে এর ব্যবহার শিখেছিল, না তারা নিজেরাই এর আবিষ্কার আর ব্যবহার শিখেছিল তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। তবে ইউরোপীয়রা অবশ্যই প্রথম কর্মক্ষম কামান বানিয়েছিল। 

সত্য সম্ভবত কখনোই জানা যাবে না। ম্যাথু প্যারিস আর স্প্ল্যাটোর থমাসসহ মধ্যযুগের অন্য ইতিহাসবিদরা যে মঙ্গোলদের তৈরি একটা ভীতি সম্পর্কে বলেছেন—যারা ধোঁয়া আর আগুন দিয়ে তাদের পরাজিত করত, তা বেশ কৌতূহল উদ্দীপক। ব্যাপারটা অবশ্য এমন হতে পারে যে, গোবি অঞ্চলের এই যাযাবরেরা গ্রামাঞ্চলে শুকনো ঘাসে আগুন লাগিয়ে সেই আগুনের পিছনে পিছনে অগ্রসর হওয়ার একটা চালাকি করত। কিন্তু এই ব্যাপারটা থেকে বোঝা যায় মঙ্গোলরা আগুনের পাত্রে বারুদের ব্যবহার করত আর সেই ব্যাপারটা ইউরোপ তখনো জানত না। কার্পিনি খুব মজার একটা তথ্য দেন। তিনি মঙ্গোল অশ্বারোহীদের বিকট শব্দের সঙ্গে আগুনের শিখা ছোড়ার একটা ঘটনা বলেন। 

প্রত্যেক ক্ষেত্রেই আমাদের মধ্যযুগের ইতিহাসবিদরা, মঙ্গোলদের শিখা এবং ধোঁয়ার প্রতি এই আকর্ষণের কথা স্বীকার করে গেছেন আর এগুলোকে উল্লেখ করে গেছেন শয়তানের নিদর্শন হিসেবে। 

৭. জাদুকর এবং ক্রুশ 

যখন সুবোতাই আর খেপ নয়নের নেতৃত্বে মঙ্গোলদের এক সেনাদল ককেশাসের বিভিন্ন অঞ্চল জয় করে এগিয়ে যাচ্ছিল, তখন তারা জর্জিয়ার খ্রিস্টান সেনাদের সম্মুখীন হয় আর তাদেরকে পরাজিত করে। জর্জিয়ার রানি, রুসাদান, অ্যানির বিশপ ডেভিডের হাতে পোপের কাছে একটি চিঠি পাঠান। সেই চিঠিতে তিনি বলেন যে, মঙ্গোলরা তার সেনাদের সামনে যে পতাকা দেখায় সেখানে ক্রুশ ছিল, যে কারণে তার সেনারা ধোকা খায়, আর ভেবে নেয় মঙ্গোলরা খ্রিস্টান। 

আবার পোলিশ ইতিহাসবিদরা বলেন, লিগনিজের যুদ্ধের সময় মঙ্গোল সেনারা যে বিশাল পতাকা নিয়ে তাদের সামনে আসে সেখানে গ্রিক ‘এক্স’ অক্ষরের মতো একটা কিছু আঁকা ছিল। একজন ইতিহাসবিদ বলেন জিনিসটা শামানদের কোনো প্রতীক হতে পারে, যেটা দেখতে ক্রুশের মতো লেগেছিল। প্রতীকটা ভেড়ার পায়ের হাড়কে আড়াআড়ি রেখে তৈরি করা হয়েছিল, শামানরা যেমনটা সচরাচর ব্যবহার করে। ধোঁয়ার ভেতর জিনিসটা ভয়ঙ্কর দেখায়। পতাকা যার হাতে ছিল, আলখাল্লা পরিহিত সেই মানুষটির হাতেই ছিল আগুনের পাত্র। 

এটা মনে হয় না, দারুণ বুদ্ধিমান মঙ্গোল অর খানরা কেবল শত্রু-সেনাকে ধোঁকা দেয়ার জন্য ক্রুশ পরে তাদের সামনে যাবে। একটা সম্ভাবনা হতে পারে, তাদের সঙ্গে যেসব নেস্তোরিয়ান খ্রিস্টান যুদ্ধে ছিল, তারা ক্রুশ পরে এগিয়ে যাচ্ছিল। লিগনিজেও সম্ভবত সেই যাজকদেরকেই তাদের সঙ্গে দেখা গিয়েছিল। 

৮. সুবোতাই বাহাদুর বনাম মধ্য ইউরোপ 

মঙ্গোল এবং ইউরোপীয়দের শক্তির পরীক্ষা চেঙ্গিস খানের জীবদ্দশায় হয়নি। এই ঘটনাটা ঘটে মহারাজসভার পরে, ১২৩৫ সালে, ওগোতাইয়ের নেতৃত্বে। 

যা ঘটেছিল এখানে খুব সংক্ষেপে তা বলা হলো। 

১২২৩ সালে সুবোতাইয়ের ঘুরে আসা এলাকা নিজের দখলে নেয়ার জন্য জুখির পুত্র বাতু স্বর্ণালি সেনাদের সাথে নিয়ে পশ্চিমে রওনা হলেন। ১২৩৮ থেকে ১২৪০ সালের বসন্ত পর্যন্ত এই দুর্দান্ত যোদ্ধা বাতু ভল্গার উপজাতিদের, রাশিয়ার শহরগুলো আর কৃষ্ণ সাগরের এলাকার চারণভূমিগুলো দখল করেন আর সবশেষে কিয়েড আক্রমণ করেন এবং দক্ষিণ পোল্যান্ডের বা রুথেনিয়ার দিকে আরেক দল সেনাকে পাঠিয়ে দেন। পোল্যান্ড তখন বেশকিছু এলাকায় বিভক্ত ছিল, তার একটি ছিল রুথেনিয়া। 

১২৪১ সালে, যখন মার্চ মাসে বরফ গলতে লাগল, মঙ্গোল সদর দপ্তর তখন কার্পেনথেনিয়ানদের উত্তরে আধুনিক লেম্বার্গ আর কিয়েভের মাঝখানে। যুদ্ধ পরিচালনায় দক্ষ সুবোতাইকে তখন নিম্নেবর্ণিত শত্রুদের সঙ্গে মোকাবেলা করতে হচ্ছিল। 

তার সামনে পোল্যান্ডের যোদ্ধা বোলেসলাস তার সৈন্য জড় করেছেন। এছাড়াও উত্তরদিকে, সাইলেসিয়ায় ধর্মপ্রাণ হেনরি জড়ো করেছেন পোল, ব্যাভ্যারিয়ান, টিউটনিক নাইট আর ফ্রান্স থেকে আসা টেম্পলারদের নিয়ে গড়া ৩০,০০০ শক্তিশালী সেনা। বর্বরদের আক্রমণ প্রতিহত করতে এরা সবাই স্বেচ্ছায় একত্রিত হয়েছে। বোসেলাসের এক শ মাইল পেছনে বোহেমিয়ার রাজাও আরো শক্তিশালী এক সেনাদল একত্র করছেন। তার সঙ্গে যোগ দিচ্ছে অস্ট্রিয়া, স্যাক্সোনি আর ব্র্যান্ডেনবার্গ-এর সেনারা। 

মঙ্গোলদের বামদিকে গ্যালাসিয়ার মিসেসলাস আর অন্যান্য যোদ্ধারা নিজেদের কার্পেন্থেনীয় এলাকা রক্ষার জন্য তৈরি হচ্ছে। মঙ্গোলদের বামে, আরো দূরে, হাঙ্গেরির ম্যাগিয়ার যোদ্ধারা। এক লাখ শক্তিশালী সেনা, কাৰ্পেন্থেনীয় পাহাড়ের ওপারের রাজা, চতুর্থ বেলার পতাকাতলে সৈন্য সমাবেশ করছে। 

বাতু আর সুবোতাই যদি দক্ষিণে হাঙ্গেরির দিকে যান, তবে পোল্যান্ডের সেনারা তাদের পেছনে থাকবে। যদি তারা পশ্চিমে, পোলদের সঙ্গে মোকাবেলায় যান, হাঙ্গেরীয় সৈন্যরা তাদের প্রান্তের ওপর আক্রমণ করবে। 

বাতু আর সুবোভাই খ্রিস্টান সেনাদের এই প্রস্তুতি সম্পর্কে বেশ ভালমতো জানতেন। গত বছরের তাদের ঘোরাফেরা থেকে এই দেশ সম্পর্কে আর যেসব রাজা তাদের বিরোধিতা করছে তাদের সম্পর্কে বেশ প্রয়োজনীয় তথ্য তারা পেয়েছেন। অন্যদিকে মঙ্গোলদের চলাচল সম্পর্কে খ্রিস্টান রাজাদের জ্ঞান খুবই কম। 

যদিও প্রিপেটের দিকে জলাভূমি ছিল আর কার্পেন্থেনীয় পাহাড়ের কাছে ভেজা জঙ্গল ছিল, তারপরও যেই মুহূর্তে রাস্তা শুকিয়ে ঘোড়াগুলো চলার উপযোগী হলো, সঙ্গে সঙ্গেই বাতু কাজ শুরু করে দিলেন। তিনি তার সেনাদের চারটি বড় সেনাদলে ভাগ করলেন। এর ভেতর থেকে দুটি দলকে দুজন বিশ্বস্ত সেনাপতির অধীনে পোলদের বিরুদ্ধে পাঠালেন। সেই দুইজন সেনাপতি হচ্ছেন চেঙ্গিস খানের দুই দৌহিত্র কাইদু আর বাইবার। 

এই সেনাদল দ্রুত পশ্চিমে এগিয়ে গেল আর বোলেসলাসের সৈন্যদের সামনে পড়ল। কারণ পোলরা মঙ্গোলদের খবর সংগ্রহকারীদের ওপর নজর রাখছিল। পোলরা তাদের স্বাভাবিক সাহসিকতার সঙ্গে আক্রমণ করল এবং পরাজিত হলো। বোলেসলাস মোরাভিয়াতে পালিয়ে গেল আর তার বাকি সৈন্যরা উত্তরের দিকে পিছিয়ে গেল। মঙ্গোলরা সেদিকে তাদের পিছু নিল না। সময়টা তখন মার্চের ১৮। ক্র্যাকভ জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছিল, আর কাইদু ও বাইবারের মঙ্গোলরা সাইলসিয়ার রাজপুত্রকে মোকাবেলা করার জন্য দ্রুত এগিয়ে গেলেন, যাতে তারা বোহেমীয় সৈন্যদের সঙ্গে যোগ দেয়ার আগেই পৌঁছে যেতে পারেন। 

ধর্মপ্রাণ হেনরির সেনাবাহিনীর সঙ্গে লিগনিজের কাছে ৯ এপ্রিল তাদের যুদ্ধ হলো। এই যুদ্ধ সম্পর্কে কোনো প্রত্যক্ষদর্শীর কোনো তথ্য আমাদের কাছে নেই। আমরা শুধু জানি যে, জার্মান আর পোলিশ সৈন্যরা মঙ্গোল পতাকার সামনে ভেঙে পড়ে, আর তাদের প্রায় সবাইকেই শেষ করে ফেলা হয়। বাকি সব আহতদের মত হেনরি আর তার অনুসারীরাও তাদের হাতে মারা পড়ে। বলা হয় টিউটনিক নাইটদের সেনাপ্রধান যুদ্ধক্ষেত্রেই মারা যান। তখন তার সঙ্গে ছিল নয়জন টেম্পলার আর পাঁচ শ সশস্ত্র সেনা। 

প্রতিরক্ষাকারীরাই লিগনিজকে জ্বালিয়ে দেয়। আর কাইদু আর বাইবারে এবং তাদের সেনাবাহিনী সঙ্গে, পঞ্চাশ মাইল দূরে, বোহেমিয়ার রাজা উইনসেসলাসের বৃহৎ সেনাবাহিনীদর মোকাবেলা হয়। মঙ্গোলদের উদিত হওয়া আর হারিয়ে যাওয়ার মাঝে উইনসেসলাস খুব ধীরে এক স্থান থেকে আরেক স্থানে সরে যেত। তার বিশাল অগোছাল সৈন্যবাহিনী মঙ্গোলদের তুলনায় শক্তিশালী হওয়া সত্ত্বেও ক্যাথি থেকে আসা এই অশ্বারোহী সেনাদের সঙ্গে পেরে উঠল না। তারা তাদের ঘোড়াগুলোকে বিশ্রাম দিল আর তার চোখের সামনেই সাইলেসিয়া আর সুন্দর মোরাভিয়া তছনছ করে ফেলে এবং সবশেষে চালাকি করে উইনসেসলাসকে উত্তর দিকে যুদ্ধযাত্রা করায় এবং তারা নিজেরা দক্ষিণে গিয়ে বাতুর সঙ্গে যোগ দেয়। 

ফ্রান্সের সেন্ট লুইকে পন্স ডি অবন লেখেন, “আর জেনে রাখুন যে, জার্মানির সব জমিদার আর রাজা, যতধর্মযাজক, হাঙ্গেরির যত মানুষ, তাতারদের বিরুদ্ধে অভিযান চালাতে ক্রুশ হাতে তুলে নিয়েছে। আর আমাদের ভাইয়েরা আমাদের যা বলেছে তা যদি সত্যি হয়, যদি ঈশ্বরের ইচ্ছায় এসব হয়, তবে তাদের পরাজিত করা যাবে। তাদের বিরুদ্ধে দাঁড়াবার মতো একজনকেও তাতাররা আপনাদের এলাকা পর্যন্ত খুঁজে পাবে না।”

তবে টেম্পলারদের প্রধান যখন এই চিঠি লেখেন, ততক্ষণে হাঙ্গেরীয় সেনা পরাজিত হয়ে গেছে। সুবোতাই আর বাতু, কার্পেন্থেনীয়ার ভিতর দিয়ে তিনটি বড় সেনাদল নিয়ে অগ্রসর হলেন। ডান প্রান্তের দলটি গ্যালিসিয়া থেকে হাঙ্গেরির দিকে গেল। সুবোতাই-এর নেতৃত্বে বামদিকের দলটি মলদোভিয়ার দিকে গেল। তাদের পথে যেসব ছোটখাটো সেনাদল পড়ল, সবগুলোকে সাফ করে ফেলা হলো। এই তিন সেনাদল পেস্থের কাছে বেলা এবং তার হাঙ্গেরীয় সেনাদলের সামনে একত্রিত হলো। 

সময়টা তখন এপ্রিলের শুরু, লিগনিয়ের যুদ্ধ শুরুর ঠিক আগে। উত্তরে কী ঘটছে সে সম্পর্কে সুবোতাই আর বাতু কোনো খবর পাচ্ছিলেন না। তারা ওডেরে অবস্থিত চেঙ্গিস খানের দৌহিত্রদের সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য তাদের এক সেনাদলকে পাঠালেন। 

উগোলিনের বিশপের ছোট এক সেনাদল তাদের বিরুদ্ধে অগ্রসর হলো। তারা একটি জলাভূমির কাছে পিছিয়ে এলো এবং হাঙ্গেরীয় সেনাদের ঘিরে ফেলল। বিশপ তার তিন সহযোগীসহ পালালেন। এই তিনজনই কেবল জীবিত ছিলেন। 

ইতিমধ্যে বেলা তার সেনাদের নিয়ে দানিউব পাড়ি দিতে শুরু করলেন। সেখানে ছিল ম্যাগিয়াররা, ক্রোয়াটরা আর জার্মানরা, সঙ্গে হাঙ্গেরিতে অবস্থানরত ফ্রান্সের টেম্পলাররা। সব মিলিয়ে এক লাখ। মঙ্গোলরা তাদের সামনে প্রথমে ধীরে ধীরে পিছিয়ে গেল। কিয়েভ জয়ী বাতু, সুবোতাই আর মাঙ্গু তাদের সেনাদের রেখে সরে এলেন আর যুদ্ধের স্থানটা পর্যবেক্ষণ করতে লাগলেন। এই এলাকাটা ছিল মহির একটি সমতলভূমি। সায়ো নদী, তোকের পাহাড় আর লোমনিযের ঘন জঙ্গল আর উঁচু পাহাড় দিয়ে চারদিক থেকে ঘেরা 

মোঙ্গোলরা নদীর ওপরের চওড়া পাথরের সেতুটি অক্ষত রেখে, পিছিয়ে নদীর অপর পাশে চলে গেল। আরো দূরে পাঁচ মাইল পর্যন্ত জঙ্গলের ভেতরে গেল। আর ওদেরকে অন্ধের মতো অনুসরণ করছিল বেলার সেনারা। তারা মহির সমতল এলাকায় তাঁবু ফেলল। অনুসারীদের সঙ্গে আরো ছিল ভারী সব তল্পিতল্পা ও অস্ত্রশস্ত্র। সেতুর অপর পাশে এক হাজার লোককে রাখা হলো। পাশের জঙ্গলেও শত্রুদের খোঁজা হলো, তাদের উপস্থিতির কোনো লক্ষণ পাওয়া গেল না। 

রাত হলো। মঙ্গোলদের ডান প্রান্তের দলের নেতৃত্ব নিলেন সুবোতাই। বড় একটা বৃত্ত করে নদীর দিকে এগিয়ে গেলেন। সেখানে তিনি নদীতে একটি অংশ দেখতে পেয়েছিলেন। নদী পারাপারে কাজে লাগানোর জন্য তিনি নদীর ওপরে সেতু বানাবার কাজ শুরু করলেন। 

সকাল হলো। সেতুর দিকে বাতুর অগ্রযাত্রা শুরু করলেন। সেতু পাহারা দেয়া লোকেদের দেখতে পেয়ে তিনি অবাক হলেন এবং তাদের পরাজিত করলেন। তার মূল সেনাদের নদীর ওপারে পাঠিয়ে দেয়া হলো। সাতটি বড় আকারের গুলতি দিয়ে বেলার যোদ্ধারা যারা সেতু দিয়ে দ্রুতগতিতে অপর পাশের অশ্বারোহীদের দিকে এগিয়ে আসছিল তাদের ওপর আক্রমণ করছিল। মঙ্গোলরা তাদের এলোমেলো শত্রুদের দিকে শক্তভাবে এগিয়ে গেল। আগুনের ধোঁয়া দিয়ে ঘেরাও হয়ে শামানরা, ভয়ঙ্কর নাইন ইয়াক টেইল পতাকা নিয়ে এগিয়ে গেল। একজন ইউরোপীয় বর্ণনা দিয়েছিলেন, “একজন ধূসর মুখের লম্বা দাঁড়িওয়ালা প্রচুর ধোঁয়া ছড়াচ্ছিল।” 

বেলার সৈন্যদের সাহসের ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। বেশ শক্ত যুদ্ধ হয়েছিল আর তা দিনের মধ্যভাগ পর্যন্ত চলেছিল। এরপর সুবোতাই তার প্রান্তের অগ্রযাত্রা বন্ধ করলেন এবং বেলার যোদ্ধাদের পেছনে আবির্ভূত হলেন। মঙ্গোলরা দ্রুতগতিতে এগিয়ে গেল আর হাঙ্গেরীয়দের পরাজিত করে ফেলল। লিগনিযের টিউটনিক নাইটদের মতো, টেম্পলাররাও যুদ্ধক্ষেত্রে একজন মানুষের হাতে মারা পড়ল। 

এরপর মঙ্গোল সেনারা পশ্চিম দিকে আলাদা হয়ে গেল। যে পথে বেলার যোদ্ধারা সমতল ভূমিটিতে এসেছিল, গিরিখাতের সে পথটা তারা খোলা ছেড়ে দিল। হাঙ্গেরীয়রা পালাল আর তাদের ধীরে সুস্থে আক্রমণ করা হলো। দুই দিনের যাত্রাপথে ইউরোপীয়দের মরদেহ ছড়িয়ে থাকতে দেখা গেল। চল্লিশ হাজার মারা পড়ল। তার ভাইকে মৃত্যু মুখে ফেলে বেলা তার বাকি অনুসারীদের থেকে আলাদা হয়ে পড়লেন। আর্চ বিশপ মারা গেলেন। শুধু ঘোড়ার দ্রুতগতির কারণে পালিয়ে বাঁচতে পারলেন। দানিউবের পাড়ে লুকালেন, তাকে খুঁজে বের করা হলো এবং তিনি কার্পেন্থেনীয়দের কাছে পালালেন। সেখানে, এক সময়ে তিনি সেই আশ্রমে পৌঁছলেন যেখানে তার ভাই, পোল্যান্ডের রাজা বোলেসলাস আশ্রয় নিয়েছিলেন। 

মঙ্গোলরা পেস্থে হানা দিল আর গ্রানের গ্রামাঞ্চলে আগুন লাগিয়ে দিল। তারা অস্ট্রিয়ার দিকে এগোল, নিস্তাট পর্যন্ত গেল। জার্মান আর বোহেমীয়দের ধীরগতির সেনাদের উপেক্ষা করে, ঘুরে অ্যাড্রিয়াটিক পর্যন্ত গেল। পথে যত শহর পড়ল সব তছনছ করল, শুধু বাদ দিল রাগুসা। দুই মাসেরও কম সময়ে তারা ইউরোপ দখল করে ফেলল। তারা তিনটি বড় আর এক ডজন ছোট সেনাবাহিনীকে হারিয়েছিল 1 পথের সব শহর দখল করেছিল। শুধু পারেনি ওলমুজকে দখলে নিতে। স্টার্নবার্গের ইয়ারোস্লাভের নেতৃত্বে বারো হাজার সেনা দারুণ প্রতিরোধ গড়েছিল। 

দ্বিতীয় কোনো অভিযান না হওয়া পশ্চিম ইউরোপকে অবশ্যম্ভাবী ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচিয়েছিল। সার্বভৌম রাজা বেলা বা ফ্রান্সের সেন্ট লুইয়ের মতো অথর্বের নেতৃত্বাধীন সেনারা একসঙ্গে সবাই অভিযানে যাওয়ার জন্য অভ্যস্ত ছিল। এদের সৈন্যরা সাহসী ছিল, তবে দ্রুত ধেয়ে আসা মঙ্গোল সেনাদের সামনে টিকে থাকার ক্ষমতা ছিল না। বিশেষ করে সে দলের নেতৃত্ব যদি থাকে সুবোতাই, মাঙ্গু আর কাইদুর মতো সেনাপতিরা। 

কিন্তু কখনোই যুদ্ধটা তার শেষ পরিণতি পায়নি। কারাকোরাম থেকে দূত এসে ওগোতাইয়ের মৃত্যু সংবাদ জানাল। আর শোনাল গোবিতে ফেরার সমন। 

এক বছর পরে রাজসভায় মহির যুদ্ধের এক মজার পরিণাম হয়েছিল। বাতু, সুবোতাইয়ের ওপর অভিযোগ আনলেন। বললেন, সুবোতাই যুদ্ধক্ষেত্রে যেতে দেরি করেছেন, ফলে অনেক মঙ্গোল সেনা মারা যায়। বয়স্ক সেনাপতি উত্তর দিলেন, “মনে রেখো যে তুমি যখন নদী পার হয়েছিলে, তখন নদী খুব বেশি গভীর ছিল না আর সেখানে একটা সেতু আগে থেকেই ছিল। আর আমি যখন যাই, তখন নদীও গভীর ছিল আর আমাকে সেতু বানিয়ে তারপরে পার হতে হয়েছে।” 

বাতু যুক্তির সত্যতা স্বীকার করে নিলেন। এরপরে আর তিনি সুবোতাইয়ের ওপর কখনো এ ব্যাপারে অভিযোগ তোলেননি। 

৯. মঙ্গোলদের সম্পর্কে ইউরোপ কী ভাবত 

এখানে সম্ভবত অনেকবার বলা হয়েছে যে, সেই সময়ে ইউরোপীয়দের চেয়ে, মঙ্গোল সেনাদের বেশকিছু সুবিধা ছিল। তারা ছিল অনেক বেশি চলমান। সুবোভাই হাঙ্গেরি অভিযানের সময় তার সেনাদের নিয়ে তিনদিনের কম সময়ে, দুই শ নব্বই মাইল পাড়ি দিয়েছিলেন। সেই একই পন্স ডি ওবেন বলেছিলেন, “মঙ্গোলরা, একদিনে চার্টেস থেকে প্যারিসে যেতে পারত।” 

সমসাময়িক ইউরোপের এক ইতিহাসবিদ হতাশ হয়ে মঙ্গোলদের সম্পর্কে বলেছিলেন, “পৃথিবীর কোনো জনগোষ্ঠী, বিশেষ করে খোলা দেশে যুদ্ধের সময়ে ব্যক্তিগত সাহস বা যুদ্ধের জ্ঞান দিয়ে শত্রুকে হারানোর ব্যাপারে এতটা সক্ষম ছিল না।” 

ফ্রা কারপিনিও এই মতকে সমর্থন করেছেন। ১২৩৮-১২৪২ সালের অভিযানের মাত্র কিছুদিন পূর্বেই, তাকে মঙ্গোল খানের কাছে পাঠানো হয়েছিল খ্রিস্টান লোকদের গনহত্যায় বিরাম দিতে এই ভয়ানক বিজয়ীকে অনুরোধ করার জন্য। “কোনো একটি দেশ কিংবা অঙ্গরাজ্যের পক্ষে তাতারদেরকে থামানো সম্ভব ছিল না।” তিনি আরও যোগ করেন, “তাতাররা কেবল শক্তি দিয়ে নয়, পরিকল্পনা দিয়ে যুদ্ধ করে।” 

সেনাবাহিনীর বিভিন্ন ব্যাপারের ওপর নজর রাখা এই সাহসী যাজক মন্তব্য করেছিলেন, “তাতাররা সংখ্যায় কম, আর ইউরোপীয়দের মতো শারীরিক গড়ন এবং শক্তিও তাদের ছিল না। তিনি ইউরোপীয় রাজাদের অনুরোধ করেছিলেন, মঙ্গোলদের ধাঁচে সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব তৈরি করতে। কারণ, যুদ্ধে নেতৃত্ব দেয়ার যোগ্যতা থাকুক আর নাই থাকুক, যুদ্ধে তারা সব সময় নিজেরাই নিজেদের সেনাদের নেতৃত্ব দিতেন। 

“তাতারদের মতো করে এবং যুদ্ধের কঠিন নিয়মে আমাদের সেনাদের পরিচালনা করতে হবে। সম্ভব হলে যুদ্ধের স্থান পছন্দ করতে হবে সমতল একটি জায়গায়, যেখানে সব দিকের সব কিছু দেখা যায়। পুরো সেনাদল একটি মাত্র দলে ভাগ হয়ে চলাফেরা করবে না, অনেকগুলো দলে ভাগ হয়ে চলবে। খোঁজ—খবর করার জন্য চারিদিকে লোক পাঠিয়ে রাখতে হবে। আমাদের সেনাপতিদের, দিন-রাত সব সময় তাদের সেনাদের সতর্ক রাখতে হবে এবং সব সময় সশস্ত্র, যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত থাকবে। কারণ তাতাররা শয়তানের মতো সব সময় সতর্ক। 

“যদি খ্রিস্টান রাজ্যের রাজা আর রাজপুত্ররা তাদের অগ্রযাত্রাকে থামাতে চায়, তবে তাদের একত্র হতে হবে আর একসঙ্গে তাদের প্রতিরোধ করতে হবে।” কার্পিনি মঙ্গোলদের অস্ত্রের দিকে নজর দিতে ব্যর্থ হননি। আর তাই ইউরোপীয় সেনাদের উপদেশ দিয়েছিলেন তাদের অস্ত্র উন্নত করতে। “খ্রিস্টানরাজ্যের রাজপুত্রদের উচিত শক্ত-ধনুক আর তাতাররা ভয় পায় এমন অন্যান্য অস্ত্রে সজ্জিত অনেকসংখ্যক সৈন্য রাখা। এছাড়াও ভালো লোহার মুখোশ পরা কিংবা লম্বা হাতলওয়ালা কুড়ালে সজ্জিত বেশকিছু সেনা রাখতে হবে। তীরের লোহার শীর্ষ ভাগটা তাতারদের মতো, গরম অবস্থায় লবণ পানি ব্যবহার করে পরিবর্তন করে ফেলতে হবে। এর ফলে অস্ত্রগুলো লক্ষ্যের অনেক গভীরে প্রবেশ করতে পারবে। আমাদের লোকদের খুব ভালো শিরোস্ত্রাণ আর বর্ম থাকতে হবে, যেন তারা নিজেদের আর তাদের ঘোড়াগুলোকে অক্ষত রাখতে পারে। আর যাদের এসব থাকবে না তাদেরকে বর্মধারীদের পেছনে রাখতে হবে।” 

কাপিনি মঙ্গোল শিশুযোদ্ধাদের দুর্দান্ত তীরন্দাজির একটি ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরেছিলেন। “তাদের হাতে আহত হওয়া মানুষ আর ঘোড়াগুলোকে তারা তীর দিয়ে মেরে ফেলতো। আর যখন মানুষ আর ঘোড়াগুলো এভাবে বিধ্বস্ত হতো, তখন তাদেরকে তারা ঘিরে ফেলত।” 

এই সময় রাজা দ্বিতীয় ফ্রেড্রিক, যিনি পোপের সঙ্গে শত্রুতা শুরু করেছিলেন, অন্য রাজপুত্রদের কাছ থেকে সাহায্য চাইলেন। ইংল্যান্ডের রাজার কাছে পত্র লিখলেন, “তাতাররা খর্বাকৃতির মানুষ, তবে তাদের হাত-পা বেশ শক্ত। চওড়া কাঁধ, দুর্ধর্ষ আর সাহসী। সেনাপতির নির্দেশে ভয়ানক বিপদে সব সময় প্রস্তুত। কিন্তু, দুঃখের সাথে বলতে হচ্ছে, আগে যেখানে তারা চামড়া এবং লোহার ঢাল নিয়ে যুদ্ধ করত, এখন তারা অনেক সূক্ষ্ম আর উপকারী অস্ত্রে সজ্জিত। আর এসব অস্ত্র তারা পেয়েছে খ্রিস্টানদেরকে হারিয়ে। আর এখন আমরা আমাদের অস্ত্রেই লজ্জাজনকভাবে খুন হচ্ছি। এছাড়াও ওরা অনেক ভালো জাতের ঘোড়ায় চড়ে, আমাদের চেয়ে অনেক ভালো আহার গ্রহণ করে আর আমাদের চেয়ে অনেক কম রুক্ষ কাপড় পরিধান করে।”

যে সময় তিনি এই চিঠিটা লেখেন, সে সময় বিজয়ী মঙ্গোল সেনারা সম্রাট ফ্রেড্রিককে ডেকে পাঠান আর তাকে তাদের প্রজা হওয়ার প্রস্তাব দেন। মঙ্গোলদের দৃষ্টিতে যেসব শর্ত দেয়া হয়েছে তা বেশ যুক্তিসংগত। সম্রাট নিজে এবং তার প্রজারা বন্দি হওয়ার বদলে তাদের প্রাণে মেরে ফেলা হবে না। সম্রাট নিজে কারাকোরাম যাবেন আর সেখানে তার জন্য যে সরকারি পদ বরাদ্দ করা হবে সেটাই তাকে মেনে নিতে হবে। ফ্রেড্রিক এই প্রস্তাবে বেশ বিনয়ের সঙ্গে জানালেন যে, খানের মতো শিকারি পাখি সম্পর্কে তিনি বেশ ভালোই জানেন। 

১০. ইউরোপীয় রাজা এবং মঙ্গোলদের মধ্যে যোগাযোগ 

১২৪২ সালে ইউরোপ থেকে বাতু আর সুবোতাই সরে আসার পরে স্বাধীন খ্রিস্টান দেশগুলোর ওপর আরেকটি বিশাল মঙ্গোল আক্রমণ হয়, তবে অন্য উপায়ে। পোপ চতুর্থ ইনোসেন্ট লিয়ন শহরের সভাসদদের আলোচনার জন্য ডাকলেন। অন্যান্য ব্যাপারের সঙ্গে আলোচনার আরো একটি বিষয় ছিল কীভাবে খ্রিস্টধর্মকে রক্ষা করা যায়। উদ্ধত সেন্ট লুই ঘোষণা করলেন, যদি তাতাররা আবার আসে, তবে ফ্রান্সের সব সেনা চার্চের প্রতিরক্ষায় জীবন দেবে। এরপরে তিনি মিসরে ভয়ঙ্কর ধর্মযুদ্ধ শুরু করেন। কাস্পিয়ান সাগরের দক্ষিণে মঙ্গোলদের কাছে বেশ কয়েকবার সংবাদ আর যাজকদের পাঠানো হয়। সেই এলাকার নেতৃত্বে তখন ছিলেন বাইচু খান। 

তার এক রাজদূতকে কারাকোরামে খানের কাছে পাঠিয়ে দেয়া হলে আশ্চর্য এক পরিণতি হয়। মধ্যযুগের একজন ইতিহাসবিদ, জয়েনভিলে বলেন, “সেই রাজদূতকে যখন তার স্বল্প উপহারসহ উপস্থাপন করা হলো, খান তখন তার বিদ্বান সভাসদদের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন, ‘এই হচ্ছে ফ্রাঙ্কদের রাজার উপহার, আমাদের জন্য এই সামান্য সম্মানী সে পাঠিয়েছে’।” 

মঙ্গোলরা বেশ কয়েকবার লুইকে জানিয়েছিল, তারা খানের জন্য কর আর উপহার পাঠিয়ে যেন অন্য রাজাদের মতো নিজেকে খানের আক্রমণ থেকে রক্ষা করে। তাকে তারা আরো উপদেশ দেয়, যেন তিনি এশিয়া মাইনরে সেলজুকদের বিরুদ্ধ যুদ্ধ করেন, যাদের সঙ্গে তাদের তখন যুদ্ধ চলছিল। লুই এর কয়েক বছর পরে বুদ্ধিমান রুব্রিককে খানের রাজসভায় পাঠান, তবে তাকে বলে দেন নিজেকে যেন তিনি রাজপ্রতিনিধি হিসেবে উপস্থাপন না করেন কিংবা তার যাত্রাকে যেন একজন প্রজার কাজ মনে না হয়। 

মঙ্গোলদের কাছ থেকে যে কয়টি চিঠি লুইয়ের কাছে পৌঁছে, তার একটি চিঠিতে এই তথ্যের উল্লেখ আছে যে, মঙ্গোলদের মধ্যে অনেক খ্রিস্টান আছে। “আমরা এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে মুসলমান শহরে যত খ্রিস্টান আছে তাদের কর মউকুফ করে দেয়া হবে। তাদেরকে সম্মান আর শ্রদ্ধার সঙ্গে দেখা হবে। কেউ তাদের অসম্মান বা তাদের সম্পদের ক্ষতি করবে না। তাদের যেসব চার্চ নষ্ট করে ফেলা হয়েছে সেসব পুনরায় বানিয়ে দেয়া হবে। তাদেরকে আওয়াজ করে উপাসনা করতে দেয়া হবে।” 

এ কথা সত্য যে পারস্যের ইল মঙ্গোল খানের বেশ কয়েকজন খ্রিস্টান স্ত্রী ছিল। খ্রিস্টান আর্মেনীয়রা তার মন্ত্রী হিসেবে কাজ করেছেন। প্যালেস্টাইনে পরিত্যক্ত খ্রিস্টান ধর্মযোদ্ধারা তার অধীনে মঙ্গোলদের সেনায় থেকে যুদ্ধ করেছিল। আগের যুদ্ধগুলোতে ধ্বংস হয়ে যাওয়া চার্চগুলো ইল খান অরঘুন পুনরায় তৈরি করে দিয়েছিলেন। 

১২৫৯ সালে একজন ক্ষুব্ধ মুসলমান লিখেছিলেন, ‘মঙ্গোল ইল খান হালাগু নির্দেশ দিয়েছিলেন যে পুরো সিরিয়াতে, সব ধর্ম বিশ্বাসীরা, সর্বসমক্ষে তাদের নিজের বিশ্বাস অনুযায়ী ধর্ম পালন করবে। কোনো মুসলিম এ কাজে বাধা দেবে না। সেই দিন সাধারণ কিংবা উচ্চপদের কোনো খ্রিস্টান ছিল না যারা সর্বসমক্ষে তাদের সবচেয়ে সুন্দর পোশাক পরে বেরিয়ে আসেনি।” 

প্যালেস্টাইনের খ্রিস্টানদের প্রতি তাদের যতটাই পক্ষপাত থাক না কেন, মঙ্গোল নেতারা গোপনে মুসলমানদের বিরুদ্ধে ইউরোপীয় সেনাদের সাহায্য চাইছিলেন, আর ১২৭৪ সালে ষোলজন রাজদূতের একটি দল পোপ এবং তারপরে ইংল্যান্ডের প্রথম এডয়ার্ডের কাছে পাঠিয়েছিলেন। এডওয়ার্ড খুব কূটনৈতিক একটি উত্তর দেন। কারণ জেরুজালেমের দিকে এগিয়ে যাওয়ার কোনো ইচ্ছে তার ছিল না। তিনি লিখলেন, “খ্রিস্টানদের শত্রুদের হাত থেকে পুণ্যভূমিকে উদ্ধারের ব্যাপারে আপনার সিদ্ধান্ত দেখলাম। এর জন্য আমরা খুবই কৃতজ্ঞ। আপনাকে এর জন্য ধন্যবাদও জানাই। তবে আমরা কবে এই পুণ্যভূমিতে পৌঁছতে পারব সে ব্যাপারে এই মুহূর্তে আমরা কোনো নিশ্চিত সংবাদ দিতে পারছি না।” 

এদিকে, কাস্পিয়ানের কাছে বাইচুর উদ্দেশে পোপ তার প্রতিনিধি পাঠালেন। এই কাজ মঙ্গোলদের বেশ অপমানিত করে, কারণ তারা খানের নাম জানতেন না আর তারা রক্তপাতের পাপের ওপর এই পৌত্তলিকদের ভাষণ দিয়েছিলেন। মঙ্গোলরা বলল, পোপ অবশ্যই খুব মূর্খ, কারণ তিনি পুরো পৃথিবী শাসন করা মানুষটির নাম জানেন না। আর শত্রুকে খুন করার ব্যাপারে তারা বলল, এই খুন তারা করে স্বর্গের পুত্রের নিজস্ব নির্দেশে। বাইচুকে সেই দুর্ভাগা যাজককে খুন করার কথা মনে করিয়ে দেয়া হলো। তবে তা করা হয়নি। তাদের নিরাপদে ফেরত পাঠানো হয়, কারণ তারা তো ছিল কেবল রাজদূত। 

বাইচুর চিঠির উত্তরটা, যা চতুর্থ ইনোসেন্টের দূতের কাছে দেয়া হয়, তা উল্লেখ করার মতো—

“সর্বোচ্চ খানের নির্দেশে, বাইচু নয়ন এই চিঠি লিখছে— পোপ, আপনি কি জানেন আপনার দূত আমাদের কাছে আপনার চিঠি নিয়ে এসেছিলেন? আপনার দূত অনেক বড় কথা বলেছে। আমরা জানি না, সে এসব কথা আপনার নির্দেশে বলেছে কিনা। তাই আপনাকে আমরা এই সংবাদ পাঠাচ্ছি। আপনি যদি এই পৃথিবীর মাটি আর পানির ওপর রাজত্ব করতে চান, আপনার উত্তরাধিকার বজায় রাখতে চান, তবে পোপ, আপনাকে নিজেকে আমাদের কাছ আসতে হবে। যে এই পুরো পৃথিবী শাসন করছেন, তার সামনে নিজেকে উপস্থাপন করতে হবে। যদি না আসেন, তবে আমরা জানি না কী হবে। ঈশ্বর জানেন। ভালো হয় যদি আপনি দূত মারফত এই খবরটা দেন যে আপনি আসবেন, নাকি আসবেন না, আর আমাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব চান, নাকি চান না।”

এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, চতুর্থ ইনোসেন্ট কারাকোরাম যাননি। মঙ্গোলরাও আর মধ্য ইউরোপে ফেরত আসেনি। তবে পশ্চিম ইউরোপের অস্ত্রের কারণে তারা নিজেদের সংবরণ করেছিল, তার কোনো লক্ষণ পাওয়া যায়নি। অস্ট্রিয়ার নিস্টাডে তারা তাদের মূল ঘাঁটি থেকে প্রায় ছয় হাজার মাইল এগিয়ে গিয়েছিল। সুবোতাই আর ভয়ঙ্কর তুলি মারা গিয়েছিলেন। জুখির পুত্র বাতু ভল্গায়, তার সোনালি শহর সারিতেই, নিজেকে আবদ্ধ রেখেছিলেন। এশিয়ার আবর্জনায়, ধীরে ধীরে গৃহযুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ে আর এই সেনাদলের পশ্চিমের অগ্রযাত্রা থেমে যায়। ত্রয়োদশ শতকের শেষদিকে, তারা পুনরায় হাঙ্গেরি তছনছ করে দেন, এরপরে তারা ভল্গার সমভূমিতে ফিরে যান। 

১১. চেঙ্গিস খানের সমাধি 

সম্প্রতি লন্ডনে সংবাদপত্রে ছাপা হওয়া এই খবর দারুণ আগ্রহ জাগিয়েছিল যে, প্রফেসর পিটার কোষলফ মঙ্গোল সম্রাটের সমাধিস্থান খুঁজে শনাক্ত করেছেন। লেলিনগ্রাদের এক তারবার্তা অনুসারে, সংবাদটি পরে প্রফেসর লোযলফ অস্বীকার করেন। সংবাদটি ১৯২৭-এর ১১ নভেম্বর নিউইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত হয়। 

১৯২৫-২৫ সালে দক্ষিণ গোবির কারা খত এলাকায় তার শেষ ভ্রমণের ফলাফল সম্পর্কে আর প্রাচীন সাইবেরীয় সভ্যতার নিদর্শন থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে প্রফেসর কোযলফ বলেন, চেঙ্গিস খানের সমাধিস্থল কোথায়, তা এখনো জানা যায়নি। এই হারিয়ে যাওয়া সমাধি সম্পর্কে অনেক পরস্পরবিরোধী বক্তব্য পাওয়া যায়। মার্কো পোলো খুব অস্পষ্টভাবে বলেছিলেন। তিনি ধারণা করেছিলেন এটি পরের কোনো স্বাধীন মঙ্গোলের সমাধি হবে। 

রশিদ আল দ্বীন বলেন চেঙ্গিস খানকে উরগার কাছে ইক্কা কুরুক পাহাড়ে সমাধিস্থ করা হয়। এলাকাটির কথা সাং সেজেনরা প্রায়ই বলত। কাত্রিমের এবং অন্যরা উরগার কাছে খানুলার কাছে কিছুদূরে গিয়েছিলেন তার সমাধি খুঁজতে। তবে সবগুলো ঘটনাই সন্দেহজনক। 

আর্কিম্যান্ড্রাইট প্যালাডিয়াস বলেন, “মঙ্গোল আমলের কোনো নথিতে চেঙ্গিস খানের সমাধিস্থল সম্পর্কে কোনো সঠিক তথ্য দেয়া নেই।” 

অপেক্ষাকৃত পরবর্তী তথ্য অনুযায়ী ই টি সি ওয়ার্নার বলেন, এই সম্রাটের সমাধি অরদোষ দেশে, ইজেন করোতে অবস্থিত। এখানে বছরের তৃতীয় মাসের একবিংশতম দিনে মঙ্গোল রাজপুত্ররা একটা উৎসব করত। মহান খানের নিদর্শন, যেমন তার স্যাডল, একটি ধনুক এবং অন্যান্য জিনিস তার সমাধিস্থলে আনা হতো। এটা কোনো সমাধিস্থল ছিল না, এটা ছিল পাথর দিয়ে ঘেরা অনেকটা দুর্গের মতো জায়গা। এখানে দুটো সাদা পশমি কাপড়ের তাঁবু আছে। সেখানে আছে পাথরের তৈরি কারুকার্যখচিত একটা বাক্স। সেই বাক্সে কী আছে, কেউ জানে না। 

ওয়ার্নারের মতে সম্রাটের দেহাবশেষ যে এই দুর্গের মধ্যে আছে, মঙ্গোলদের এই দাবি সঠিক। এখনো এই এলাকা বিশেষ অধিকারপ্রাপ্ত পাঁচ শ পরিবার দ্বারা পরিবেষ্টিত। জায়গাটা মহাপ্রাচীরের ওপারে অবস্থিত, হোয়াং-এর লুপের দক্ষিণে, ৪০ ডিগ্রি উত্তর অক্ষাংশ এবং ১০৯ ডিগ্রি পূর্ব দ্রাঘিমাংশে। 

এই তথ্যের প্রমাণস্বরূপ তিনি চেঙ্গিস খানের উত্তরপুরুষ মঙ্গোল রাজপুত্র কালাচিনের বক্তব্য উদ্ধৃত করেন। সম্ভবত অন্যান্য অস্পষ্ট তথ্যের চেয়ে এটি অনেক ভালো প্ৰমাণ। 

১২. ক্যাথির বিদ্বান ইয়ে লিউ চুসাই 

চেঙ্গিস খানের চোখে পড়ার পরে, এই যুবক ক্যাথিবাসীর মতো জীবনে এত কঠিন দায়িত্ব পালন খুব কম মানুষকেই করতে হয়েছে। এই গোত্রের লোকদের সঙ্গে ঘোড়ায় চড়ে যাত্রা করা প্রথম কয়েকজন চীনা দার্শনিকের মধ্যে তিনি ছিলেন একজন। আর মঙ্গোলরা দর্শন, জ্যোতির্বিজ্ঞান আর চিকিৎসার এই ছাত্রের জন্য পরিস্থিতি খুব সহজ হতে দিত না। ধনুক তৈরিতে দক্ষ এক সেনা একবার এই লম্বা দাড়িওয়ালা ক্যাথিবাসীকে বলল, “যোদ্ধাদের মধ্যে বই হাতে একজন মানুষের কী দরকার?” 

ইয়ে লিউ চুতসাই উত্তর দিয়েছিলেন, “খুব সুন্দর ধনুক বানাতে একজন কাঠের কারিগর দরকার, কিন্তু যখন একটি রাজত্ব পরিচালনার ব্যাপার আসে তখন একজন বুদ্ধিমান মানুষ দরকার।” 

বৃদ্ধ সম্রাটের তিনি খুব প্রিয়পাত্র হয়ে যান আর পশ্চিমের দীর্ঘ আক্রমণের সময়, মঙ্গোলরা যখন লুটের জিনিস জড়ো করতে ব্যস্ত থাকত, এই ক্যাথিবাসী তখন নিজের জন্য বই, জ্যোতির্বিজ্ঞানের ছক আর ঔষুধি গাছ জোগাড় করতেন। তিনি রণযাত্রার সময় মানচিত্র টুকে রাখতেন। মহামারি যখন সেনাদের কাবু করে ফেলত, তখন যেসব সেনা তাকে নিয়ে হাসি-তামাশা করেছিল তাদের বিরুদ্ধে তিনি দার্শনিকের প্রতিশোধ নিতেন। তিনি তাদের তিক্ত ওষুধ খাওয়াতেন, এরপর সারিয়ে তুলতেন। 

চেঙ্গিস খান তার সততার জন্য তাকে পছন্দ করতেন। ইয়ে লিউ চুতসাই এই উপজাতির যাত্রাপথে কোনো হত্যাযজ্ঞ আটকানোর কোনো সুযোগই ছাড়তেন না। হিমালয়ের পাদদেশে একবার এক রাস্তায়, হরিণের মতো দেখতে তবে এক শিংওয়ালা আর সবুজ রঙের এক দারুণ জন্তু চেঙ্গিস খান দেখতে পেলেন। তিনি ইয়ে লিউ চুসাইয়ের কাছে এর ব্যাখ্যা জানতে চাইলেন। ক্যাথিবাসী উত্তর দিলেন—

“এই অদ্ভুত জন্তুর নাম কিও তুয়ান। সে পৃথিবীর সব ভাষা জানে আর সে জীবিত মানুষ পছন্দ করে, আর হত্যাকে খুব ভয় পায়। এর দেখা পাওয়া নিঃসন্দেহে আপনার জন্য সাবধান বাণী, হে খান, এখান থেকে ফিরে চলুন।” 

চেঙ্গিস খানের পুত্র ওগোতাইয়ের অধীনে এই ক্যাথিবাসীই প্রকৃত অর্থে সাম্রাজ্য পরিচালনা করতেন। তিনিই শাস্তি দেয়ার দায়িত্ব মঙ্গোল সেনাদের হাত থেকে নিয়ে প্রশাসকের হাতে দিয়েছিলেন। রাজকোষ রেখেছিলেন কর আদায়কারীদের দায়িত্বে। 

তার উপস্থিত বুদ্ধি এবং সাহস, এই সম্রাটদের খুশি করেছিল, আর তিনি জানতেন কীভাবে তাদের প্রভাবিত করতে হয়। ওগোতাই ছিলেন অতিরিক্ত মদ্যপ, আর তার দীর্ঘায়ু কামনা করার অনেক কারণ ছিল ইউ লিউ চুতসাইয়ের। বাধাদান, খানের ওপর কোনো প্রভাব ফেলবে না, তাই একবার এই ক্যাথিবাসী অনেকক্ষণ ধরে মদ রাখা আছে এমন একটা লোহার পাত্র তাকে এনে দেন। মদ সেই পাত্রের ধার ক্ষয় করে ফেলেছে। 

তিনি বললেন, “মদ যদি এই লোহার পাত্রের এমন দশা করতে পারে, তবে আপনি নিজেই ভেবে দেখুন তা আপনার নাড়ির কী অবস্থা করেছে।” 

ওগোতাই এই দৃশ্য দেখে ধাক্কা খেলেন এবং এরপরে তিনি মদ খাওয়া কমিয়ে দেন, যদিও মদের কারণেই তার মৃত্যু হয়। একবার তার এই সভাসদের একটি কাজের ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে ইউ লিউ চুতসাইকে তিনি কারাগারে পাঠিয়ে দেন, কিন্তু পরে তিনি তার মত পরিবর্তন করেন এবং তাকে মুক্তি দিতে বলেন। এই ক্যাথিবাসী তার ঘর থেকে বের হচ্ছিলেন না। ওগোতাই জানতে পাঠালেন কেন তিনি রাজসভায় আসছেন না। 

এই বিদ্বান প্রত্যুত্তর পাঠালেন, “আপনি তো আমাকে আপনার মন্ত্রী করেননি। আপনি যেহেতু আমাকে কারাগারে পাঠিয়েছিলেন, তার মানে আমি অপরাধী। আপনি দয়া করে আমাকে মুক্ত করেছেন। তাই আমি নির্দোষ। আপনি চাইলেই আমাকে শিকার বানাতে পারেন। কিন্তু আমি কীভাবে রাজ্যের সব কিছু দেখাশোনা করব?” 

এরপর তিনি পুনরায় কাজে বহাল হন, যে কারণে লাখ লাখ মানুষের উপকার হয়। ওগোতাই-এর মৃত্যুর পরে প্রশাসনের ক্ষমতা তার হাত থেকে কেড়ে নিয়ে আবেদ আল রাহমান নামক একজন মুসলমানের হাতে দেয়া হয়। এই নতুন সভাসদের অত্যাচারী আচরণের ভয়ে তার মৃত্যু ত্বরান্বিত হয়। 

খানদের সময়ে তিনি অনেক সম্পদের মালিক হয়েছেন, এই সন্দেহে মঙ্গোল সেনারা তার বাড়ি তল্লাশি করে। তারা তার বাড়িতে বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র, সাহিত্য, মানচিত্র, ছবি খোদাই করা পাথর-এসব ছাড়া আর কিছুই পায়নি। 

১৩. ওগোতাই এবং তার সম্পদ 

চেঙ্গিস খানের যে সন্তান তার সিংহাসনে বসেছিলেন, তিনি দেখলেন, তিনি হচ্ছেন অর্ধ পৃথিবী শাসনে বেজায় অনিচ্ছুক এক শাসক। একজন মঙ্গোলের মতো ভালো রসবোধ আর সহনশীলতা ওগোতাইয়ের ছিল। ছিল না শুধু তার ভাইদের মতো নিষ্ঠুরতা। তিনি কারাকোরামে তার তাঁবু প্রাসাদে বসে খানের সিংহাসনকে সম্মান জানাতে আসা ভিড়ের মানুষগুলোর কথা শুনতে পারতেন। তার ভাই আর সেনারা যুদ্ধ করতে যেত আর ইয়ে লিউ চুতসাই দেখতেন রাজকোষের সঞ্চয়। 

দীর্ঘদেহী তবে ধীরস্থির ওগোতাই সম্পর্কে কৌতূহলউদ্দীপক চিত্র পাওয়া যায়। একজন উদার বেদুইন চরিত্রের সঙ্গে মিশে ছিল ক্যাথি সাম্রাজের সম্পদ। এক ডজন সাম্রাজের নারী আর দিগন্তবিস্তৃত চারণভূমির ঘোড়ার পাল, সব ছিল তার দখলে। তার কার্যকলাপ একেবারেই রাজার মতো ছিল না। তিনি যা কিছু দেখতেন তা খুব সহজে ছেড়ে দিতেন। সেনারা যখন এর প্রতিবাদ করত তখন তিনি বলতেন, তিনি খুব দ্রুতই পৃথিবী ছেড়ে চলে যাবেন আর তখন তার একমাত্র আবাসস্থল হবে মানুষের স্মৃতি। 

পারস্য আর ভারতীয় রাজাদের সম্পদ সংগ্রহ তিনি অনুমোদন করেননি। তিনি বলেছিলেন, “তারা বোকা। এসব তাদের কোনো কাজেই লাগবে না। এই পৃথিবী থেকে তারা কিছুই নিয়ে যেতে পারেনি।” 

তার উদারতার কথা শুনে এক ধূর্ত মুসলমান ব্যবসায়ী প্রতিদিন তার রাজসভায় বিভিন্ন জিনিস নিয়ে ভিড় করত আর বিনিময়ে অনেক বেশি রশিদ জমা দিত। এই রশিদগুলি, প্রতিদিন সন্ধ্যায় খান যখন সর্বসমক্ষে থাকতেন তখন তার কাছে পেশ করা হতো। একদিন তার এক সভাসদ তার কাছে প্রতিবাদ করলেন 

যে, এই ব্যবসায়ী তার কাছে অনেক বেশি দাম ধরছে। 

ওগোতাই স্বীকার করলেন, “তারা তো আমার কাছ থেকে লাভ করার আশা নিয়েই এসেছে। আর আমি চাই না আমার দরবার থেকে কেউ আশাহত হয়ে ফেরত যাক।” 

তার বাইরে বেরোনো ছিল অনেকটা মরুভূমির হারুন-উর-রশিদের মতো। হঠাৎ পথ চলতি লোকের সঙ্গে কথা বলতে তিনি পছন্দ করতেন। একবার এক বৃদ্ধের দারিদ্র্য তাকে আহত করে, বৃদ্ধ তাকে তিনটি তরমুজ দেয়। তার কাছে তখন রুপো বা দামি কোনো কাপড় ছিল না। খান তার একজন স্ত্রীকে আদেশ করলেন তার কানের দামি মুক্তার দুল উপহার হিসেবে এই লোকটিকে দিয়ে দিতে। তার স্ত্রী প্রতিবাদ করে বললেন, “হে শাসক, লোকটিকে আগামীকাল আপনার দরবারে আসতে বললে ভালো হয়। তাকে তখন রুপোর কিছু দিলে বরং তা এই মুক্তোর চেয়ে তার বেশি উপকারে আসবে।” 

মঙ্গোল বললেন, “এই দরিদ্র আগামীকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে পারবে না। আর তাছাড়া এই মুক্তা খুব শীঘ্রই আমার রাজকোষে ফেরত আসবে।” 

অন্য সব মঙ্গোলের মতো ওগোতাইয়েরও দুর্বলতা ছিল শিকার, কুস্তি প্রতিযোগিতা দেখা আর ঘোড় দৌড়ের প্রতি। চারণকবি এবং ক্রীড়াকুশলীরা সুদূর ক্যাথি আর পারস্যের শহর থেকে তার রাজসভায় আসত। তার এই সময়ে শুরু হওয়া দ্বন্দ্ব মঙ্গোল সাম্রাজ্যকে বিভক্ত করেছিল। বৌদ্ধ আর মুসলমানদের এবং পার্সি আর চীনাদের শত্রুতা—এই দ্বন্দ্ব চেঙ্গিস খানের পুত্রকে বিরক্ত করত। এসব ষড়যন্ত্র দেখে তার সরল মনে অস্বস্তি হতো। একবার এক বৌদ্ধ তার কাছে এক গল্প নিয়ে এলো যে, গতকাল চেঙ্গিস খান তার স্বপ্নে এসেছিলেন আর তিনি তাকে আদেশ করেছিলেন, “তুমি আমার সন্তানের কাছে যাও আর বলো মুহাম্মাদের সব 

অনুসারীকে মেরে ফেলতে। কারণ তারা হচ্ছে শয়তানের জাতি।” 

ইসলামের অনুসারীদের প্রতি মৃত সম্রাটের নিষ্ঠুরতা সবারই জানা ছিল। আর ‘ইয়ারলিগ’ বা স্বপ্নে দেখতে পাওয়া মহান খানের এক আদেশ ছিল গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। ওগোতাই কিছুক্ষণ ধ্যানমগ্ন হলেন। 

এরপর তিনি জিজ্ঞেস করলেন, “চেঙ্গিস খান কি একজন অনুবাদককে সাথে নিয়ে তোমার সঙ্গে কথা বলেছিলেন?” 

“না, হে খান, তিনি নিজে কথা বলেছিলেন।”

ওগোতাই এবার জানতে চাইলেন, “তুমি কি তাহলে মঙ্গোল ভাষা জানো?”

একথা তার জানা ছিল, যে লোক স্বপ্ন দেখার কথা বলতে এসেছিল সে তুর্কি ছাড়া আর কোনো ভাষা জানে না। 

এবার খান বললেন, “তাহলে তুমি আমাকে মিথ্যা কথা বলেছ। কারণ চেঙ্গিস খান শুধু মঙ্গোল ভাষা জানেন।” এরপর তিনি মুসলমান বিদ্বেষী সেই লোককে মৃত্যুদণ্ড দিলেন। 

আরেকবার কিছু চীনা বাজিকর ওগোতাইকে পুতুল খেলা দেখাচ্ছিল। খেলাগুলোর মধ্যে একটায় তিনি দেখলেন পাগড়ি পরা, লম্বা মোচওয়ালা এক বৃদ্ধ লোককে এক ঘোড়ার লেজের সঙ্গে বেঁধে টেনে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। তিনি সেই চীনার কাছে এর মানে জানতে চাইলেন। 

খেলার দায়িত্বে থাকা লোকটি জানাল, “মঙ্গোল যোদ্ধারা একজন মুসলমান বন্দিকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে।” 

তিনি তৎক্ষণাৎ এই খেলা দেখানো বন্ধ করতে বললেন। তার রাজকোষ থেকে চীন আর পারস্য দুই দেশেরই কাপড়, পর্দা আর দামি কারুকার্য আনতে বললেন। তারপর তিনি সেই চীনাকে দেখালেন তাদের জিনিসগুলো পশ্চিমের তুলনায় কত নিম্নমানের, তিনি আরো যোগ করলেন, “আমার সাম্রাজ্যে এমন কোনো ধনী মুসলমান নেই যার বাসায় একাধিক চীনা ক্রীতদাস নেই। আবার কোনো চীনা ধনীর কাছে মুসলমান ক্রীতদাস নেই। এছাড়াও, তুমি নিশ্চয়ই জানো যে, চেঙ্গিস খান আদেশ করেছিলেন প্রতিটি মুসলমানকে হত্যা করার জন্য হত্যাকারীকে চল্লিশটি স্বর্ণ খণ্ড পুরস্কার দেয়া হবে। কিন্তু কোনো চীনা জীবনকে একটা গাধার সমান মূল্যও দেয়া হতো না। তাহলে তুমি কীভাবে একজন মুসলমানকে এভাবে ব্যঙ্গ করো? এরপর তিনি সেই বাজিকরকে তার খেলাসহ রাজসভা থেকে তাড়িয়ে দেন। 

১৪. এই উপজাতির শেষ রাজসভা 

খানদের আবাসভূমি ক্যাথিতে সরে যাওয়ার আগে কেবল দুইজন ইউরোপীয় আমাদের জন্য মঙ্গোলদের বর্ণনা দিয়ে গেছেন। একজন ছিলেন যাজক কারপিনি আর অন্যজন শক্ত গড়নের ফ্রা রুব্রুক, যিনি বেশ সাহসী মন নিয়ে তাতারদের এলাকায় গিয়েছিলেন। অর্ধেকটা বিশ্বাসও করে ফেলেছিলেন যে, অত্যাচার করে তাকে মেরে ফেলা হবে। তার রাজকীয় শাসক, ফ্রান্সের সেন্ট লুইয়ের পক্ষ থেকে রাজদূত হয়ে তিনি যাননি, গিয়েছিলেন শান্তির দূত হয়ে। মনে আশা ছিল যে তিনি এই পৌত্তলিক বিজয়ীকে হয়তো বুঝিয়ে ইউরোপের বিরুদ্ধে যুদ্ধ থেকে বিরত রাখতে পারবেন। 

সঙ্গ দেয়ার জন্য তার সঙ্গে ছিল এক ভীতু যাজক ভাই। কন্সট্যান্টিনোপল তাদের পেছনে থাকল আর এশিয়ার বিশাল চারণভূমি চারপাশ থেকে তাদের দিকে এগিয়ে আসতে লাগল। তিন হাজার মাইলের পথচলা আর অর্ধাহারে তিনি প্রায় কঙ্কালসার হয়ে গিয়েছিলেন। মঙ্গোলরা তাকে ভেড়ার চামড়ার পোশাক আর পশমি মোজা দিয়েছিল। চামড়ার জুতা আর মাথার হুড দিয়েছিল। তিনি বেশ ভারী ছিলেন। তাই ভরা প্রান্ত থেকে লম্বা যাত্রার সময় তারা খুব সতর্কতার সঙ্গে প্রতিদিন একটি শক্তিশালী ঘোড়া পছন্দ করে নিতেন। 

মঙ্গোলদের কাছে তিনি ছিলেন এক রহস্য। সুদূর ফ্রান্স থেকে আসা, লম্বা এক আলখাল্লা পরিহিত, খালি পায়ে পথচলা একজন মানুষ। তিনি না ছিলেন ব্যবসায়ী, না কোনো রাজদূত। সঙ্গে কোনো অস্ত্রও ছিল না, কোনো উপহারও দেননি আবার কোনো পুরস্কারও নেন না। বেশ কৌতূহলউদ্দীপক এক অবস্থা। দারুণ নীতিবান এক যাজক, যিনি আক্রান্ত ইউরোপ থেকে খানের সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন। দারিদ্র্যপীড়িত, তবে দুর্বল নন। বিশাল যাত্রা শেষে পূর্ব দিকে এই মরুভূমিতে এসেছেন— পথে রাশিয়ার রাজপুত্র ইয়ারস্লাভ, ক্যাথিবাসী, তুর্কি লড়াকু, জর্জিয়ার রাজা, বাগদাদের খলিফার দূত আর সারাসিনদের সুলতানদের সঙ্গে দেখা করেছেন। তার তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণী দৃষ্টি দিয়ে, রুব্রিক আমাদের জন্য বর্ণনা করে গেছেন এই উপজাতি বিজয়ীর রাজসভার, যেখানে যোদ্ধারা মণিমুক্তা খচিত পাত্রে দুধ খেত আর ভেড়ার চামড়া গায়ে দিয়ে স্বর্ণ খচিত স্যাডলের ওপরে চড়ত। 

মাঙ্গু খানের রাজসভায় উপস্থিত হওয়াকে তিনি এভাবে বর্ণনা দিয়েছেন : 

ডিসেম্বরের সেন্ট স্টিফেন ডেতে, আমরা বিশাল এক সমভূমিতে এসে পৌঁছলাম। এখানে একটাও টিলা দেখা যাচ্ছে না। আর পরের দিন আমরা মহান খানের রাজসভায় পৌঁছলাম। 

আমাদের পথপ্রদর্শককে বেশ বড় একটা বাড়ি দেয়া হলো আর আমাদের তিনজনকে দেয়া হলো ছোট একটা কুঁড়েঘর। যতটুকু জায়গা তাতে কোনোরকমে আমাদের ব্যাগপত্র, বিছানা আর ছোট্ট একটু আগুন জ্বালবার জায়গা হলো। আমাদের পথপ্রদর্শকের কাছে অনেকেই লম্বা বোতলে চাল দিয়ে তৈরি মদ নিয়ে এলো। সেগুলো খুব ভালো ওয়াইনের চেয়ে আলাদা কিছু নয়, শুধু গন্ধটা একটু অন্য রকম। আমাদেরকে ডাকা হলো আর আমাদের কাজ সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলো। একজন সহকারী আমাকে বলল যে, আমরা সারাসিনদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে তাতার সেনাদের সাহায্য চাই। এটা শুনে আমি অবাক হয়ে গেলাম। আমার জানামতে, মহামান্য রাজার কাছ থেকে আনা চিঠিতে কোনো সেনাবাহিনীর কথা বলা নেই। শুধু খানকে উপদেশ দেয়া হয়েছে তিনি যেন খ্রিস্টানদের বন্ধু হন। 

মঙ্গোলরা তখন জানতে চাইল, আমরা তাদের সঙ্গে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে চাই কিনা। এই কথায় আমি উত্তর দিলাম, “আমরা তো কোনো অন্যায় করিনি। ফ্রান্সের রাজা তো যুদ্ধ শুরু করার মতো কিছু করেননি। যদি কোনো কারণ ছাড়াই যুদ্ধ করেন তবে আমরা ঈশ্বরের সাহায্যের ওপর বিশ্বাস করে থাকব।”

এই কথা শুনে তারা অবাক হয়ে বলল, “তুমি শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য আসোনি?” 

পরের দিন আমি খালি পায়ে রাজসভায় গেলাম। এটা দেখে সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলো। ওদের ভেতর একজন হাঙ্গেরীয় ছেলে ছিল, সে আমাদের আদেশ সম্পর্কে জানত, সে সবাইকে কারণটা জানাল। সেখানে প্রধান সহকারী ছিলেন একজন নেস্তোরিয়ান। এরপর তিনি আমাদের অনেকগুলো প্রশ্ন করলেন আর আমরা আমাদের থাকার জায়গায় ফিরে এলাম। 

সেইদিন রাজসভা শেষে পূর্ব দিকে যাওয়ার পথে, রাস্তায় আমি একটা ছোট বাড়ি দেখলাম, যার ওপরে রয়েছে ছোট্ট একটা ক্রস। এটা দেখে, আমি খুবই খুশি হলাম। ভাবলাম সেখানে হয়তো কোনো খ্রিস্টান আছে। আমি সেখানে সোজাসুজি ঢুকে গেলাম। গিয়ে দেখি সেখানে সুন্দর সাজানো টেবিলের (বেদি) ওপরে সোনালি চাদর বিছানো। তার ওপরে ক্রাইস্ট, ভার্জিন, সেন্ট জন দ্য ব্যাপ্টিস্ট আর দুইজন আঞ্জেল-এর ছবি আঁকা। তাদের শরীর আর পোশাক মণিমুক্তা খচিত। 

টেবিলের ওপরে একটা বড় রুপোর তৈরি ক্রস। দামি পাথর আর কারুকাজে সেটা ঝকমক করছে। আর তার সামনে আটটি আলোর একটি প্রদীপ জ্বলছে। আমি দেখলাম, কিছুটা কালো আর পাতলা একজন আর্মেনীয় যাজক বেদিটার পাশে বসে আছেন। রুক্ষ লোমশ আলখাল্লা পরা, পাতলা আর পশমি পোশাকের নিচে লোহার একটি আঁটুনি। 

যাজককে সম্মান জানানোর আগে আমরা মাটিতে শুয়ে পড়লাম, ‘আভে রেগিনা’ এবং অন্যান্য ধর্মসঙ্গীত গাইলাম। সেই যাজক আমাদের সঙ্গে প্রার্থনায় যোগ দিলেন। আমরা তখন সেই যাজকের পাশে বসলাম। তার সামনে ছোট একটা পাত্রে আগুন ছিল। তিনি জানালেন, তিনি জেরুজালেমের একজন হেরমিট, আমাদের এক মাস আগে এসেছেন। 

বেশ কিছুক্ষণ কথা বলার পরে আমরা আমাদের থাকবার জায়গায় ফেরত গেলাম। রাতের খাবারের জন্য মাংস আর মিলেট দিয়ে একটা ঘেঁটি বানালাম। আমাদের মঙ্গোল পথপ্রদর্শক আর তার সহকারী রাজসভায় বেশ মদ খেয়েছিল। ফলে আমাদের তেমন কোনো খোঁজ কেউ নিল না। এতই ঠাণ্ডা ছিল যে, পরের দিন আমার পায়ের আঙুলগুলো বরফে শক্ত হয়ে গিয়েছিল আর আমি খালি পায়ে হাঁটতে পারছিলাম না। 

বরফ পড়া যখন শুরু হয়, তখন থেকে মে মাসের আগে পর্যন্ত তা আর থামেনি। আর তখনো প্রতিদিন, রাতে আর সকালে ঠাণ্ডায় জমে যেতাম। আর যত দিন আমরা সেখানে ছিলাম, বাতাসের সঙ্গে বেড়ে যাওয়া ঠাণ্ডায় বহু জীবজন্তু মারা যেত। রাজসভার লোকেরা আমাদের জন্য ভেড়ার তৈরি কোট, ছোট পাজামা আর জুতো এনে দিল। আমার সঙ্গী আর দোভাষী সেটা গ্রহণ করল। জানুয়ারির পাঁচ তারিখে আমাদেরকে রাজসভায় নিয়ে যাওয়া হলো। 

আমাদের জিজ্ঞেস করা হলো, খানের সামনে আমরা কী উপহার পেশ করব? আমি বললাম যে, আমরা অনেক দূরের দেশ থেকে এসেছি। যদি তোমরা অনুমতি দাও তবে প্রথমে আমরা সেই ঈশ্বরের প্রশংসা করে গান গাইব, যার কারণে আমরা এখানে নিরাপদে পৌঁছতে পেরেছি। এরপরে খান যে কাজে খুশি হন, সেই কাজ করব। তারপর তারা উপস্থিত সভাসদের কাছে গেল আর আমাদের বলা এসব কথা জানাল। ফিরে এসে তারা আমাদেরকে বড় ঘরটির প্রবেশদ্বারের কাছে নিয়ে এলো, দরজায় ঝুলন্ত ফেল্টের পর্দা ওঠাল আর আমরা গাইলাম, “অ্যা সলিস অরতুস কার্ডাইম”। 

তারা আমাদের কাপড়ের বুক পকেট তল্লাশি করে দেখল, সেখানে আমাদের কোনো অস্ত্র লুকানো আছে কিনা। তারা আমাদের দোভাষীকে, তার কোমরবন্ধ আর চাকু খুলে, সেগুলো দরজায় দাঁড়ানো একজন রক্ষীর তত্ত্বাবধায়নে রেখে যেতে বলল। আমরা যখন প্রবেশ করলাম, তারা আমাদের দোভাষীকে টেবিলের কাছে দাঁড় করাল। সুন্দরভাবে সজ্জিত টেবিলে ছিল ঘোড়ীর দুধ। আর একজন মহিলার সামনে বেঞ্চে আমাদের বসানো হলো। 

পুরো ঘর সোনায় খচিত কাপড়ে সজ্জিত ছিল। ঠিক মাঝখানে শিং, শুকনো গাছের গুঁড়ি আর গোবর দিয়ে তৈরি অগ্নিকুণ্ড জ্বলছিল। সিলের চামড়ার মতো উজ্জ্বল আর চকচকে পশমি চাদরে ঢাকা একটি আসনে খান বসেছিলেন। খান ছিলেন বোঁচা নাকের একজন মধ্যম উচ্চতার মানুষ। প্রায় পঁয়তাল্লিশ বছর বয়স হবে। তার স্ত্রীদের একজন, বেশ সুন্দরী দেখতে, তার পাশে বসে ছিলেন। একইভাবে তার কন্যাদের একজন, শক্ত গোছের একজন যুবতী, তার পাশে একটি আসনে বসেছিলেন। এই বাড়িটি কন্যাটির মায়ের, তিনি ছিলেন একজন খ্রিস্টান। আর কন্যাটি এখন এই বাড়ির কর্ত্রী। 

আমাদের জিজ্ঞেস করা হলো যে আমরা চালের তৈরি ওয়াইন বা ঘোড়ীর দুধ অথবা মধুর মধ্যে কোনোটা পান করতে চাই কিনা। শীতে পান করার জন্য ওরা এই তিন ধরনের পানীয়ই ব্যবহার করতো। আমরা উত্তর দিলাম যে, কোনো প্রকার পানীয় পানের প্রতিই আমাদের বিশেষ কোনো আগ্রহ নেই। খান যা আদেশ দেবেন আমরা শুধু তাই পালন করব। এরপরে আমাদের চালের তৈরি ওয়াইন দেয়া হলো। সম্মান দেখাতে আমি সেটার একটু স্বাদ নিলাম। 

বেশ অনেকটা সময় খান তার বাজপাখি আর অন্যান্য পাখি নিয়ে ব্যস্ত থাকলেন। এরপরে আমাদের কথা বলার জন্য আদেশ দেয়া হলো আর আমাদের হাঁটুর ভারে বসতে হলো। খানের একজন নেস্তোরিয়ান দোভাষী ছিল। আমাদের দোভাষী এতটাই পান করেছে যে সে এখন রীতিমতো মাতাল হয়ে গেছে। আমি খানকে উদ্দেশ করে বলতে শুরু করলাম : 

“আমরা ঈশ্বরকে ধন্যবাদ আর প্রশংসা জানাই যে, তিনি পৃথিবীর অন্য প্রান্ত থেকে আমাদেরকে পরম পরাক্রমশালী মাঙ্গু খানের সামনে এনে দিয়েছেন। পশ্চিমের খ্রিস্টানরা, বিশেষ করে ফ্রান্সের রাজা, একটি চিঠি দিয়ে আমাদেরকে আপনার কাছে পাঠিয়েছেন। আমাদেরকে যেন আপনি তার দেশে থাকতে দেন। আমরা সকল মানুষকে ঈশ্বরের আইন শিখাই। আমরা তাই রাজাধিরাজের কাছে আমাদেরকে থাকতে দেবার অনুমতি চাইছি। আমাদের কাছে আপনাকে দেয়ার মতো রুপো, সোনা কিংবা কোনো দামী পাথর নেই। তবে আমরা নিজেদেরকে আপনার সেবায় পেশ করছি।” 

খান এই কথায় উত্তর দিলেন : 

“সূর্য যেমন চারিদিকে তার আলো ছড়ায়, আমাদের এবং বাতুর ক্ষমতাও তেমনি চারিদিকে ছড়ায়। তোমার সোনা বা রুপোর আমাদের কোনো দরকার নেই।” 

সোনা আর রুপোর কথা বলায় আমার ওপর অখুশি না হতে আমি রাজাধিরাজকে রাজি করাতে পেরেছিলাম। কারণ, খানকে সেবা করার ইচ্ছা পরিষ্কার করে জানাতে আমি এ কথা বলেছিলাম। এতক্ষণ পর্যন্ত আমি আমাদের দোভাষীর কথা বুঝতে পারছিলাম। তবে এখন সে পুরোপুরি মাতাল, আর আমার মনে হলো, এখন আর সে কোনো বুদ্ধিদীপ্ত কথা বলতে পারছে না। আর আমার ধারণা খানও এখন সেরকম মাতাল হয়ে গেছেন। ফলে আমি চুপ করে থাকলাম। 

এরপর তিনি আমাদের দাঁড়িয়ে আবার বসতে বললেন, আর কিছু প্রশংসাসূচক বাক্যের পরে আমরা সেখান থেকে বেরিয়ে এলাম। একজন সহকারী আর দোভাষী আমাদের সঙ্গে বেরিয়ে এলো। ফ্রান্স রাজ্যের ব্যাপারে তারা খুব কৌতূহলী ছিল। বিশেষ করে সেখানে অনেক ভেড়া, গরু আর ঘোড়া আছে কিনা জানতে। মনে হলো এগুলোকে তারা নিজেদের ভাবছে। তারা একজনকে আমাদের দেখাশোনার দায়িত্ব দিল। আর আমরা সেই আর্মেনীয় যাজকের কাছে গেলাম। কিছুক্ষণ পরে সেখানে দোভাষী এলো, জানাল, তীব্র শীত শেষ না হওয়া পর্যন্ত মাঙ্গু খান আমাদের দুই মাস থাকবার অনুমতি দিয়েছেন। 

একথা শুনে আমি উত্তর দিলাম, “ঈশ্বর মাঙ্গু খানকে দীর্ঘজীবী করুন। আমরা এখানে যে যাজককে পেয়েছি, তাকে আমাদের বেশ পবিত্র মানুষ মনে হয়েছে। আমরা স্বেচ্ছায় তার কাছে থেকে তার সঙ্গে খানের সুস্থতার জন্য প্রার্থনা করব।” 

ভোজের দিনগুলোতে খ্রিস্টানরা রাজসভায় আসত আর তার জন্য প্রার্থনা করত। এরপরে সারাসিন যাজকরা প্রার্থনা করত আর এরপরে করত একজন মূর্তি পূজারি যাজক (তিনি আসলে ছিলেন বৌদ্ধ পুরোহিত, রুব্রিক তা জানতেন না ) যাজক সেরগিয়াস বোঝাতে চাইলেন যে তিনি খ্রিস্টান ধর্ম ছাড়া আর কোনো ধর্মে বিশ্বাস করেন না। তবে তিনি মিথ্যা বলেছিলেন। খান কোনো ধর্মেই বিশ্বাস করতেন না। মাছি যেমন মধুকে অনুসরণ করে তেমনি তার রাজসভায় সবাই তাকে অনুসরণ করে। তিনি সবাইকেই দান করেন। আর তাই সবাই ভাবত, তিনি বোধহয় শুধু তাদেরটাই পছন্দ করছেন। 

যখন আমরা আমাদের ঘরে গেলাম, তখন দেখলাম সেখানে বেজায় ঠাণ্ডা। সেখানে কোনো জ্বালানিও নেই আর আমরা সবাই ক্ষুধার্ত। ততক্ষণে রাতও হয়ে গেছে। আমাদের দেখাশোনার দ্বায়িত্বে যিনি ছিলেন তিনি আমাদের কিছু কাঠ আর কিছু খাবার দিলেন। আর আমাদের পথপ্রদর্শক, যে তখন বাতুর কাছে ফেরত যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল, সে আমাদের কাছে একটা কার্পেট চাইল। আমরা তাকে দিলাম আর তাই নিয়ে সে শান্তিতে চলে গেল। 

শীত তীব্রতর হলো। মাঙ্গু খান আমাদের জন্য বাইরের দিকে লোমওয়ালা তিনটি পশুর চামড়ার কোট পাঠালেন। আমরা কৃতজ্ঞচিত্তে তা গ্রহণ করলাম। আমরা ব্যাখ্যা করে বললাম, আমাদের ঘরটা এত ছোট যে আমরা খানের জন্য প্রার্থনাও করতে পারি না। ঠিকমতো দাঁড়াতেও পারি না। ধোঁয়ার জন্য আলো জ্বালিয়ে বইও পড়তে পারি না। খানকে সেই যাজকের কাছে খবর পাঠালাম, তিনি আমাদের সঙ্গে পেলে খুশি হবেন কিনা? তিনি খুশি হয়ে সম্মতি দিলেন। এরপর থেকে আমরা একটা ভালো আবাস পেলাম। 

আমাদের অনুপস্থিতিতিতে, মাঙ্গু খান নিজে একদিন চার্চে এসেছিলেন আর একটা সোনার বিছানা আনানো হয়েছিল। টেবিলের উল্টোদিকে সেটার ওপর রানীকে পাশে নিয়ে তিনি বসেছিলেন। আমাদের তখন বাইরে পাঠানো হলো আর একজন রাজপ্রহরী লুকানো অস্ত্রের খোঁজে আমাদের তল্লাশি করল। আমাদের হাতে ছিল শুধু বাইবেল আর অন্তরে ছিল সাহস। আমি প্রথমে টেবিলের সামনে ঝুঁকলাম। এরপরে মাঙ্গু খানকে সম্মান জানালাম। তিনি তখন আমার হাতের বইটা তার সামনে নিয়ে যেতে বললেন। ছোট করে যে লেখাগুলো দিয়ে সেটা অলঙ্কৃত ছিল তিনি সেই লেখাগুলোর মানে জানতে চাইলেন। নেস্তোরিয়ানরা যা সঠিক মনে করল, উত্তর দিল। কারণ তিনি আমাদের দোভাষী ছিলেন না। আমাদের মতো করে আমাদের একটা ভক্তি সঙ্গীত শোনার ইচ্ছে প্রকাশ করলেন তিনি। আমরা গাইলাম। এরপরে খান চলে গেলেন, কিন্তু রানী থেকে গেলেন আর উপহার বিতরণ করলেন। 

ক্রসের সম্মানের জন্য, আমি যাজক সেরগিয়াসকে আমার বিশপ হিসেবে সম্মান করতাম। তিনি এমন অনেক কাজ এমনভাবে করেছিলেন, যে কারণে আমি তাকে অপছন্দ করতাম। তিনি নিজের জন্য ময়ূরের পেখম দিয়ে একটা টুপি বানিয়েছিলেন। সেখানে একটা ছোট সোনার ক্রস ছিল। তবে আমি সেই ক্রসে খুশি ছিলাম। আমার উপদেশে যাজক একটা উঁচু বর্ণায় সেই ক্রসটা লাগায়, যেন নিয়ে ঘোরা যায়। মাঙ্গু খান আমাদের অনুমতি দিলেন সেটা নিয়ে ঘোরার। 

তাই ক্রসের সম্মানের জন্য আমরা সেরগিয়াসের কাছে গেলাম। বর্শার সমান উঁচু একটি বাঁশের কঞ্চিতে তিনি একটি ব্যানার লাগিয়েছিলেন আর আমরা সেটা নিয়ে সব তাতারদের তাঁবুতে গিয়েছিলাম, গান গাইছিলাম, মুসলমানরা আমাদের প্রতি ঈর্ষান্বিত ছিল আর এতে তারা বেশ গ্লানি বোধ করল। আর নেস্তোরিয়ান যাজকও আমাদের প্রতি ঈর্ষান্বিত ছিল। 

কারাকোরামের কাছে মাঙ্গুর ছিল আমাদের গির্জার মতো চারদিক ইট দিয়ে ঘেরা বিশাল একটি রাজদরবার। সেই রাজদরবারে ছিল একটা বিরাট প্রাসাদ, খান যেখানে বছরে দুইবার, ইস্টারে আর গ্রীষ্মে অনুষ্ঠানের আয়োজন করতেন। এই সময় তিনি তার নৈপুণ্য দেখাতেন। যেহেতু প্রাসাদের ঘরের মধ্যে মদের বিশাল ভাণ্ড নিয়ে চলাচল করা অসভ্যতা ছিল তাই প্যারিস থেকে আসা উইলিয়াম বোচার, বড় ঘরটির মাঝের দরজার বাইরে, বেশ বড় একটা রুপোর গাছ বানিয়েছিলেন। সেই গাছের শিকড়ের কাছে ছিল চারটি রুপোর সিংহ। তার ভিতর থেকে গরুর দুধ প্রবাহিত হতো। গাছের চারটি মূল ডালে চারটি সোনার সাপ পেঁচানো ছিল, যার মুখ থেকে বিভিন্ন ধরনের মদ প্রবাহিত হচ্ছিল। 

প্রাসাদটা ছিল তিনটি স্তম্ভ আর দুই সারি পিলারের একটা চার্চের মতো। উত্তর দিকের একটি উঁচু জায়গায় খান বসেন, যেখান থেকে সবাই তাকে দেখতে পাচ্ছিলেন। খান এবং রুপালি গাছের মাঝের জায়গাটা, পানপাত্র বাহকদের আসা-যাওয়ার জন্য ফাঁকা রাখা হয়েছিল। খানের ডানদিকে সব পুরুষরা বসেছিলেন আর বামদিকে মহিলারা। শুধু একজন নারী তার পাশে বসেছিলেন। তবে তার মতো অতটা উঁচুতে নয়। 

খানের প্রাসাদ ছাড়া বাকি কারাকোরাম কিন্তু সেন্ট ডেনিসের শহরের মতো ততটা সুন্দর নয়। শহরের মূল দুটি সড়ক আছে। একটা ছিল সারাসিনদের, যেখানে মেলা হচ্ছিল। আরেকটি ছিল ক্যাথিবাসীদের রাস্তা, সেখানে ভর্তি থাকত শিল্পীরা। এছাড়াও অনেকগুলো প্রাসাদ ছিল, সেখানে খানের সচিবদের দপ্তর ছিল আর ছিল মিলেট আর শস্য, ভেড়া, ঘোড়া, ষাঁড় আর পশুটানা গাড়ি এসবের বাজার। বারোটা মূর্তিসহ মন্দির, মুসলমানদের দুটি মসজিদ আর একটি নেস্তে ারিয়ান চার্চ ছিল। 

প্রায় ‘প্যাসান সানডে’র সময় খান কেবল তার তাঁবুগাড়ি সহযোগে কারাকোরামের উদ্দেশে বের হলেন আর যাজক এবং আমরা তাকে অনুসরণ করলাম। যাত্রাপথে আমাদের পাহাড়ি রাস্তা দিয়ে যেতে হলো। সেখানে আমরা প্রচণ্ড বাতাস, তীব্র ঠাণ্ডা আর প্রচুর তুষারের মুখোমুখি হলোাম। মধ্যরাতের দিকে খান যাজককে আমাদের কাছে পাঠালেন যেন আমরা ঈশ্বরের কাছে ঝড় থেমে যাওয়ার জন্য প্রার্থনা করি, কারণ তার সঙ্গে থাকা পশুগুলোর সবগুলোই প্রায় বাচ্চা, আর তাই এই আবহাওয়ায় তারা এখন মৃত্যুপথযাত্রী। যাজক তাকে একটি সুগন্ধি দ্রব্য দিয়ে এটা কয়লার ওপরে রাখতে বললেন। তিনি কাজটা করেছিলেন কিনা জানি না, তবে বাতাস আর তুষারপাত দুই দিনের জন্য থেমে গিয়েছিল। 

‘পাম সানডে’তে আমারা কারাকোরামের কাছাকাছি পৌঁছে গেলাম। সন্ধ্যায় আমরা পাতা না গজানো উইলো গাছ দেখতে পেলাম। প্রায় নয়টার সময় আমরা শহরে প্রবেশ করলাম। ক্রস উঁচু করে ধরে, সারাসিনের রাস্তায় অগ্রসর হতে থাকলাম। আমরা চার্চের দিকে অগ্রসর হলে পথে নেস্তোরিয়ানরা আমাদের সঙ্গে যোগ দিল। একত্রিত হওয়ার পরে স্বর্ণকারিগর উইলিয়াম বুচার আমাদেরকে তার বাসায় রাতের খাবারের জন্য নিয়ে গেলেন। তখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে। তার একজন স্ত্রী ছিল যার জন্ম হাঙ্গেরিতে। এখানে আমরা সেই ইংরেজের সন্তান ব্যাসিলিকাসকেও দেখলাম। 

রাতের খাবার শেষ করে আমরা আমাদের ঘরে ফিরে এলাম। ঘরটা যাজকের নিজস্ব প্রার্থনাগারের মতোই, নেস্তোরিয়ান চার্চের কাছেই। চার্চটা বেশ বড়সড়, খুব সুন্দর করে তৈরি। উপরের ছাদটা সিল্কের ওপর সোনার কাজ করা চাদর দিয়ে ঢাকা। 

আমরা ইস্টারের উৎসব উদযাপনের জন্য শহরে থেকে গেলাম। এখানে বহু সংখ্যক হাঙ্গেরীয়, অ্যালান, রুথেনীয় বা রাশিয়ান আর জর্জীয় এবং আর্মেনীয়রা ছিল। বন্দি থাকায় তারা এখনো ‘স্যাক্রামেন্ট’ পায়নি। নেস্তোরীয়রা আমাকে উৎসব উদযাপনের জন্য অনুরোধ করল। আমার কাছে না ছিল ‘ভেস্টমেন্ট’ না ছিল বেদি। 

কিন্তু স্বর্ণকারিগর আমাকে ‘ভেস্টমেন্ট’ দিয়ে সাজিয়ে দিলেন আর একটা ছোট প্রার্থনাগার করে দিলেন। ভার্জিন মেরির ছবিসহ রুপালি একটা বাক্স দিলেন। এতক্ষণ পর্যন্ত আমি আর্মেনিয়ার রাজার আগমনের প্রতীক্ষায় ছিলাম, আর একজন নির্দিষ্ট জার্মান যাজকেরও আসার কথা ছিল। রাজার কাছ থেকে কোনো কথা শুনতে পেয়ে এবং আরেকটা ভয়াবহ ঠাণ্ডার ভয় পেয়ে আমি খানের কাছে গিয়ে জানতে চাইলাম, আমরা থাকব না চলে যাব। 

পরদিন, খানের কয়েকজন প্রধান সচিব আমার কাছে এলেন। এর মাঝে একজন মঙ্গোল, যিনি ছিলেন খানের পানপাত্র বাহক, আর বাকিরা সারাসিন। খানের হয়ে এই লোকগুলো জানতে চাইলেন, আমি আসলে কেন তাদের কাছে এসেছি? এর উত্তরে আমি বললাম যে, বাঁ আমাকে খানের কাছে আসবার নির্দেশ দিয়েছেন। কারো তরফ থেকে তাকে আমার তেমন কিছু বলার নেই। যদি তিনি ঈশ্বরের কথা শুনতে চান, তবে আমি সেগুলো পুনরায় বলতে পারি। 

এরপরে তারা জানতে চাইল, আমি কী বলতে চাই। অন্যরা যেমন করেছে আমিও তেমনি ধর্ম প্রচারে কিছু বলতে চাইলাম। বললাম, “আমি মাঙ্গুকে বলতে চাই, ঈশ্বর তাকে যে ক্ষমতা আর সম্পদ দিয়েছেন তা বৌদ্ধদের মূর্তির কারণে আসেনি।” 

এরপরে তারা জানতে চাইল, আমি কি কখনো স্বর্গে গিয়েছি, যে ঈশ্বরের আদেশ সম্পর্কে বলছি? এরপরে তারা মাঙ্গুর কাছে ফেরত গিয়ে জানাল, আমি তাকে বৌদ্ধ আর মূর্তিপূজারি বলেছি, যিনি কিনা ঈশ্বরের আদেশ মানেন না। এ কথা শুনে খান পুনরায় তাদেরকে পাঠালেন। জানালেন, তিনি জানতে পেরেছেন যে আমাদের কাছে তার জন্য কোনো সংবাদ নেই। তবে আমরা অন্য যাজকদের মতো তার জন্য প্রার্থনা করতে এসেছি। তারপরও তিনি জানতে চান আমাদের কোনো রাজদূত আগে কখনো তার দেশে এসেছিল কিনা। তখন ডেভিড আর খ্রিস্টান ভিক্ষু আন্ড্রুর ওপর শ্রদ্ধা রেখে, আমি যা জানি তা তাদেরকে জানালাম। সবকিছু তারা লিখে নিল আর মাঙ্গুর সামনে রাখল। 

‘হুইট সানডে’তে, খানের সামনে আমাকে ডাকা হলো। সেখানে যাবার আগে স্বর্ণকারিগরের পুত্র, যে এখন আমার দোভাষী হিসেবে কাজ করছে, আমাকে জানালো, মঙ্গোলরা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে আমাকে দেশে ফেরত পাঠিয়ে দেবে। আর আমাকে উপদেশ দিল আমি যেন এর বিপক্ষে কিছু না বলি। 

যখন আমি খানের সামনে আসলাম, হাঁটু ভাজ করে বসলাম, আর তিনি জানতে চাইলেন, আমি কি তার সহকারীদের বলেছি যে তিনি একজন বৌদ্ধ? এর উত্তরে আমি বললাম, “জাঁহাপনা, আমি এমনটা বলিনি।”

তিনি উত্তর দিলেন, “আমিও চিন্তা করেছিলাম, আপনি এমনটা বলেননি। এই কথা বলা আপনার উচিৎও না।” এরপরে তিনি ঝুঁকে একটু এগিয়ে এসে বললেন, “আপনি নির্ভয়ে বলুন”। 

এর উত্তরে আমি মৃদু হেসে উত্তর দিলাম যে আমি যদি ভয় পেতাম তবে আমি এখানে আসতাম না। 

তিনি তখন বললেন, “আমরা মঙ্গোলরা বিশ্বাস করি, কেবল একজন ঈশ্বর আছেন। এবং তার প্রতি আমাদের সবার সম্মান আছে।” 

আমি তখন উত্তরে বললাম, তাহলে আমি প্রার্থনা করব যেন ঈশ্বর আপনার এই ভাবনাকে মেনে নেন, কারণ তার ইচ্ছা ছাড়া কিছু হয় না। 

তিনি যোগ করলেন, “ঈশ্বর আপনাদের হাতে অনেকগুলো আঙুল দিয়েছেন। মানুষকে অনেক পথ দিয়েছেন। তিনি আপনাদের জন্য পবিত্র বাণী দিয়েছেন। এরপরও আপনারা তা ভালো করে রাখেননি। নিশ্চয়ই আপনাদের পবিত্র বাণীতে অন্য কাউকে অসম্মান করার কথা বলা নেই।” 

আমি বললাম, “না। আমি মহামান্য রাজাকে প্রথম থেকেই সম্মান জানিয়ে আসছি। এবং আমি কাউকে অসম্মান করিনি।” 

তিনি বললেন, “আমি আপনার কথা বলিনি। আপনার সে পবিত্র বাণীতে এমনও নিশ্চয়ই বলা নেই যে, কিছু লাভের আশায়, একজন মানুষের সুষ্ঠু বিচার থেকে সরে আসা উচিত।” 

এ কথার উত্তরে আমি বললাম যে, আমি তো কোনো অর্থ চাইতে এখানে আসিনি। এমনকি আপনি আমাকে যা দিতে চেয়েছেন তা নিতেও আমি অস্বীকৃতি জানিয়েছি। এবং একজন সচিব প্রকাশ্যে আমাকে উপহার দিয়েছিলেন। রুপোর বার এবং সিল্কের কাপড়ের সে উপহারও আমি ফিরিয়ে দিয়েছি। 

খান বললেন, “আমি সেসবের কথা বলছি না। ঈশ্বর আপনাদেরকে পবিত্র বাণী দিয়েছেন এবং আপনারা তা ঠিক করে রাখেন না, কিন্তু তিনি আমাদেরকে ভবিষ্যৎ দ্রষ্টা দিয়েছেন। আমরা তার কথামতো চলি আর শান্তিতে থাকি।” 

আমি চিন্তা করে দেখলাম, একথা উচ্চারণ করবার আগে, তিনি চারবার পান করেছিলেন। এরপর আমি যখন প্রত্যাশা নিয়ে মনোযোগী হয়ে অপেক্ষা করে বসে আছি যে তিনি তার বিশ্বাসকে শ্রদ্ধা জানিয়ে খোলাসা করে কিছু বলবেন, তখন তিনি আবার বলতে শুরু করলেন— 

“আপনি এখানে অনেক দিন অবস্থান করলেন। আর আমার জন্য এটা খুব আনন্দের ব্যাপার যে আপনি এখন ফেরত যাচ্ছেন। আপনি বলেছেন আপনি আপনার সঙ্গে আমার রাজদূতকে নিয়ে যাবেন না। সে ক্ষেত্রে আপনি কি আমার দূত কিংবা সংবাদ সঙ্গে করে নিয়ে যাবেন?” 

এর উত্তরে আমি বললাম, খান যদি আমাকে তার বক্তব্য বুঝিয়ে দেন আর লিখিত দেন, তবে আমি আমার সাধ্যমতো চেষ্টা করব তা বহন করে নিয়ে যাওয়ার। 

তিনি তখন জানতে চাইলেন আমার কাছে সোনা, রুপো বা দামি কোনো পোশাক আছে কিনা। এর উত্তরে আমি জানালাম, এ ধরনের দামি উপহার নেয়ার রেওয়াজ আমাদের নেই, তবে তার দেশ থেকে তার সাহায্য ছাড়া যাওয়া সম্ভব নয়। তিনি ব্যাখ্যা করে বললেন, তা তিনি আমাদের দেবেন, আর জানতে চাইলেন আমাদেরকে কত দূর এগিয়ে দিতে হবে। এর উত্তরে আমি বললাম, তিনি যদি আর্মেনিয়া পর্যন্ত পৌছবার ব্যবস্থা করে দেন, তাহলেই যথেষ্ট। 

এর উত্তরে তিনি বললেন, “আমি আপনাদের সেখানে পৌঁছার ব্যবস্থা করে দেব। এরপরে আপনাদের দায়িত্ব আপনাদের নিজেদের। যদিও একটি মুখমণ্ডলে দুটি চোখ থাকে, তবে তারা একটি জিনিসই দেখে। আপনি বাতুর কাছ থেকে এসেছেন। অতএব আপনাকে আগে অবশ্যই তার কাছে ফেরত যেতে হবে।” 

এরপরে, একটু চুপ থেকে, অনেকটা স্বগোতোক্তির মতো করে, বললেন, “আপনাদেরকে অনেকটা পথ যেতে হবে। পুরো যাত্রাপথ যেন পাড়ি দিতে পারেন— খাওয়া-দাওয়া করে নিজেদের সেভাবে শক্ত করুন।” 

তাই তিনি তাদেরকে নির্দেশ দিলেন আমাকে পানীয় দিতে। আর আমি তার উপস্থিতিতেই বেরিয়ে এলাম। আর কখনো ফেরত যাইনি। 

১৫. পবিত্র ভূমিতে চেঙ্গিস খানের উত্তরপুরুষ 

চেঙ্গিস খানের মৃত্যুর পরে আর্মেনীয় এবং প্যালেস্টাইনের খ্রিস্টানদের সঙ্গে মঙ্গোলদের দেখা হয়েছিল কিনা সে সম্পর্কে ইতিহাসে খুব বেশি কিছু বলা নেই। তার দৌহিত্র, মাঙ্গুর ভাই, হালাকু তখন খান (নেতা)। তিনি ত্রয়োদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে পারস্য, মেসোপটেমিয়া আর সিরিয়ার সেই এলাকা দখল করে নেন। 

এরপরে কী ঘটে তা খুব সুন্দরভাবে সারাংশ করা আছে ক্যামব্রিজ মেডিয়েভ্যাল হিস্ট্রিতে— এক শ বছরের বেশি সময়ের অভিজ্ঞতার পরে আর্মেনীয়রা আর তাদের ল্যাটিন প্রতিবেশীদেরকে সহযোগী হিসেবে বিশ্বাস করতে পারছিল না। আর্মেনীয় রাজা হাইথন তখন খ্রিস্টানদের পরিবর্তে মঙ্গোলদের ওপর বিশ্বাস স্থাপন করেন। প্রায় অর্ধশতাব্দী ধরে তারা ছিল আর্মেনীয়দের শ্রেষ্ঠ বন্ধু। 

হাইথনের রাজত্বের প্রথম দিকে, মঙ্গোলরা সেলজুকস জয় করে আর্মেনীয়দের খুব ভালো উপকার করে। মঙ্গোল সেনাপতি বাইচুর সঙ্গে আগ্রাসন এবং প্রতিরক্ষা দু’ক্ষেত্রেই হাইথন জোট করেন। ১২৪৪ সালে তিনি খান ওগোতাইয়ের সামন্ত হয়ে যান। দশ বছর পরে, সশরীরে তিনি মাঙ্গুর কাছে পৌঁছে তাকে সম্মান জানান আর মোঙ্গোল রাজসভায় দীর্ঘ সময় অবস্থান করে দুই জাতির মধ্যে বন্ধুত্ব স্থায়ী করেন। 

তার রাজত্বের শেষ দিনগুলো মামলুকদের সঙ্গে যুদ্ধে কেটেছিল। সৌভাগ্যক্রমে মামলুকদের উত্তরদিকের যুদ্ধযাত্রা মঙ্গোলরা প্রতিহত করে। হাইথন এবং হালাগু, এডেসায় তাদের সেনাদের সম্মিলিত করে মামলুকদের কাছ থেকে জেরুজালেম দখল করে নেন। 

তথ্যসূত্র 

সর্বপ্রথম উৎস ছিল মঙ্গোলীয় ‘অ্যান্টিন ডেটার’, স্বর্ণালি বই, যা হারিয়ে গেছে। এর ওপর ভিত্তি করে চীনা ‘ইয়ান শি’ বা ‘মোঙ্গোল নথি’ রচিত হয় আর রচিত হয় রাশিদ আদ—দিনের ইতিহাস। 

অন্য একটি মঙ্গোলীয় কাজ, যাকে বলা হয় ‘গোপন ইতিহাস’ কেবল চীনা ভাষায় অনূদিত হয়ে সংরক্ষিত আছে, ‘ইউয়ান চাও মি শি’। মূল লেখা (১২২৮) ছিল মঙ্গোল ভাষায়, উগুইর বর্ণমালায়। মহান খানের একজন সমসাময়িকের লেখা। 

মধ্য সপ্তদশ শতকে বিশিষ্ট মঙ্গোল বিশেষজ্ঞ, সানাং সেজেন সঙ্কলিত করেন তার ‘চুং ভাইশি’ (খাদুন তঘুজি), চেঙ্গিস খানের জীবনের এবং তার পূর্বপুরুষদের ওপর বিখ্যাত লেখা। বৌদ্ধ কুসংস্কারের কারণে এটায় বিকৃতি আসে, তবে একমাত্র এখানেই প্রাচীন মঙ্গোলদের সম্পর্কে একটি অন্তরঙ্গ চিত্র পাওয়া যায়। লেখাটি আরকিম্যান্ডিট হাইয়াসিন্থ রুশ ভাষায় অনুবাদ করেন আর এরপরে—এর শেষ ভাগে–আইসাক জ্যাকব সিমিট তা জার্মান ভাষায় অনুবাদ করেন, ১৮২৯ সালে। 

চীনা উৎসের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে : 

‘তুং কিন কাং মৌ’ বা রাজকীয় সাম্রাজ্যের ইতিহাস। সঙ্কলন করেছেন সি মা কুয়াং। এখানে প্রথম মঙ্গোল শাসকদের সম্পর্কে খুব কমই বলা আছে। বর্তমানে তা ফ্রেঞ্চ অনুবাদ হিসেবে পাওয়া যায়, তবে তার গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নসাপেক্ষ। 

অজানা একজন লেখকের লেখা ‘চিং চেং লু’ মঙ্গোলদের শুরু সম্পর্কে আমাদের একটি বর্ণনা দেয় ইয়েসুকি থেকে শুরু করে ওগোতাইয়ের মৃত্যু পর্যন্ত। 

এই বই এবং “ইউয়ান চাও মি শি’ থেকে, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চীনা উৎস ‘ইয়ান শি’ বা মঙ্গোল নথি সঙ্কলিত হয় ১৩৭০ সালে। সানাগ সেজেনের কাজ থেকে এই বইটি অনেক বেশি বিশ্বাসযোগ্য। মঙ্গোল রূপকথার ক্ষেত্রে যেমনটা হয়েছে— যখন পশ্চিমা দুনিয়া সম্পর্কে কোনো তথ্য দিয়েছে, তা সন্দেহজনক থেকেছে। 

সব মতভেদ সত্ত্বেও, সবচেয়ে দামি উৎস হচ্ছে ফাদলাল্লাহ্ রাশিদ এদ দিনের লেখা ‘জামিউত তাভারিখ’ বা নথির সঙ্কলন। তিনি ছিলেন ত্রয়োদশ শতাব্দীর শেষের দিকে গাজান খানের অধীনে পারস্য শাসন করা একজন পার্সি। রাশিদ তার সূচনায় বলেছেন, “পারস্যের মঙ্গোল খানদের সংগ্রহশালায় কিছু ঐতিহাসিক চিরকুট রয়েছে। স্বীকৃত দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তির লেখা, মঙ্গোল ভাষায় এবং উঘুইর অক্ষরে। এই লেখা অনুবাদ এবং বোঝার জন্য প্রতিভাবাদ ইতিহাসবিদ রাশিদকে চীনা, উঘুইর আর তুর্কি এবং মঙ্গোলদের নিজেদের ইতিহাসবিদরা সাহায্য করেন। দুর্ভাগ্যবশত জামি-উত-তাভারিখ এখনো অনূদিত হয়নি, কিন্তু রোসেট কর্তৃক প্রকাশিত হয়েছে। লন্ডনের লেইডেনে, গিবস মেমোরিয়াল সিরিজে। 

আলা-এদ দিনের লেখা তারিখ-ই-জাহান বা পৃথিবীর বিজয়ীদের ইতিহাস, যাকে বলা হয় জুলাইনি, লেখা হয় ১২৫৭ বা ১২৬০ সালে। এই লেখাটিও একই পরিমাণ দামি। কিন্তু চেঙ্গিস খানের জীবনী লেখকের জন্য দুঃখজনক হচ্ছে, এই বইয়ে তিনি তার রাজত্বের শেষ দশ বছরের বর্ণনা দিয়েছেন। 

অন্য একটি সমসাময়িক উৎস হচ্ছে ইবনে আথিরের লেখা ‘কামিল-উত-তাভারিখ’, যাকে বলা হয়, ‘নিসাভি’। এটি আসলে জালাল এদ দিনের এবং পারস্য যুদ্ধের ইতিহাস। 

খুয়ান্দমিরের শেষের কাজগুলো, ‘হিব্বা সিয়ার’ (১৫২৩) আর ‘রৌদাতা সাফা’ (১৪৭০)। এখানে চেঙ্গিস খানের ছেঁড়া ছেঁড়া চিত্র পাওয়া যায়। ‘ফাতেহ নামা তাভারিখ আল ওসমান’ বা আবুল কায়েরের ওসমান ইতিহাসে (১৫৫০) একই ঘটনা ঘটেছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *