চূড়ার কাছাকাছি

চূড়ার কাছাকাছি

বিস্ময়কর ঘটনার সূচনা হলো। গ্রীষ্মের শুরুতেই দেখা গেলো পিরামিডের চেহারা খুব দ্রুত পরিবর্তিত হয়ে যাচ্ছে। সিংহ মূর্তিটা আস্তে আস্তে নিচে নামিয়ে এনে সেটাকে সৌধের পাশে রাখা হলো। পাথর উত্তোলন করার কেবল একটা পথ তখনো বাকি ছিলো। সেটা দিয়ে সর্বশেষ চারটি পাথর এবং সবচেয়ে বড় পাথরটি যেটা দিয়ে পিরামিড তৈরি সমাপ্ত হবে সেই পাথরটি উত্তোলন করা হবে।

কাজের এই ফাঁকে পিরামিডের অবয়বটুকু বেশ ভালোই দেখা যাচ্ছিলো। আশপাশে ভাঙা পাথরের টুকরো স্তূপাকারে জমা করে রাখা হয়েছে। নানা ধরনের জঞ্জাল এখানে সেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।

নির্মাণ সৌধের আশেপাশে ধুলির যে মেঘটুকু ছিলো সেটা আস্তে আস্তে পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছিলো। আকাশটা বেশ ঝকঝকে লাগছিলো। কিন্তু শুধু আকাশ পরিষ্কার থাকার কারণেই পুরো জায়গাটাতে একটা নরম আভা ছড়িয়ে পড়েছে বিষয়টা তেমন ছিলো না। বরং পিরামিডের নিজের আকৃতি ও গঠনগত সৌন্দর্য থেকে এমন একটা আভা চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছিলো যে সৌন্দর্যের সেই রশ্মি রাজধানীতেও পৌঁছে গেলো। শুধু রাজধানী নয় আশপাশের আরো কয়েকটা অঞ্চলেও তার আভা টের পাওয়া গেলো। এটা কেবলই ছড়াতে লাগলো।

যা হোক, এর পরপরই দীর্ঘদিন পর প্রথম সরাইখানা খোলা হলো। তবে একটু ইতস্তত করে। এখানে সেখানে লোকজন বসে একটু আমুদে স্বরে চিৎকার, চেচামেচি করা শুরু করলো। যদিও পিরামিড তৈরি শুরুর সময় একটা গুজব ছড়িয়ে পড়েছিলো যে কাজ করার সময় কাউকে তাদের বন্ধুদের সাথে কিংবা পারিবারিক অনুষ্ঠানগুলোতে উপস্থিত থাকতে দেওয়া হবে না। অবশ্য বিষয়টা এখন সে রকম অবস্থায় নেই। বলা যায় খুব স্বাভাবিক হয়ে এসেছে।

সবার চোখে মুখে এখন একটাই ভাব।

‘আমরা পিরামিড তৈরি করে ফেলেছি। এখন কিছু আমোদ-প্রমোদ করি।’

.

আনন্দ উচ্ছ্বাসের বান চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছিলো। তবে তাতে ছেদ পড়ার মতো তেমন কিছু হয় নি। তাদের উচ্ছলতা তখনো থামেনি কিংবা কমে নি।

একটা পাথর তখনো উত্তোলনের জন্য অবশিষ্ট ছিলো। আর সেটা হবে সর্বশেষ ধাপের আগের ধাপের কাজ। সব আনন্দ উদ্বেলতা থামিয়ে দেওয়ার জন্য এই পাথরটি উত্তোলনের বিষয়টিই যথেষ্ট ছিলো। তবে ইতোমধ্যে পাথর পড়ে যে মানুষগুলো মারা গেলো সেটা ছিলো খুবই দুঃখজনক একটা ঘটনা। লোকজন বিশ্বাস করে যে কতো কষ্ট করে কতো ত্যাগ স্বীকার করে পিরামিড তৈরি হচ্ছে, এই পিরামিডটা তৈরি শেষ হলে তখন এর আসল উদ্দেশ্য আর ফলাফলটা পাওয়া যাবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। তখন সকল জল্পনা কল্পনা এমনিতেই দূর হয়ে যাবে। উন্মোচিত হবে আসল রহস্য।

অবশ্য তখন পর্যন্ত পিরামিডের সর্বশেষ যেনো চারটি পাথর উত্তোলনে বাকি ছিলো সেগুলো নিয়ে কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে তেমন কোনো নির্দেশ আসে নি। পিরামিডের সমাপ্তি টানার জন্য সবচেয়ে বড় পাথরটির বিষয়ে তেমন কিছু বলা হয় নি। হয়তো স্বর্ণপাতায় নির্দেশটা কোনো গোপন জায়গায় সুরক্ষিত ছিলো।

উত্তোলনের জন্য বাকি চারটি পাথরকে একটা ঘরে রেখে সশস্ত্র প্রহরী দিয়ে পাহারা দেওয়া হচ্ছিলো। কেন এভাবে পাহারার মাঝে রাখা হয়েছিলো সেটা সৃষ্টিকর্তাই ভালো জানেন। লোকজন এ সব দেখে হাসাহাসি করতো। তারা বলতো ‘এটা কোনো কথা হলো পাথরকে উজির নাজিরদের মতো পাহারা দিয়ে রাখতে হবে। আরে এ পাথরটাকে যেভাবে পাহারা দেওয়া হচ্ছে সেভাবে কোনো মন্ত্রীকেও পাহারা দিয়ে রাখা হয় না।’

তবে এর বিপরীতে কেউ কেউ বলতো ‘আরে ভাই মন্ত্রীরা আজ আছে কাল নেই। কিন্তু এ পাথরগুলো তুমি চিন্তা করো, মহাকালের শেষ পর্যন্ত থেকে যাবে। মন্ত্রীদের থেকে এদের মূল্য অনেক বেশি।’

সর্বশেষ এই চারটি পাথর আর যেনো পাথরটা দিয়ে পিরামিডের চুড়াটাকে বিন্যস্ত করা হবে সেগুলোর সাথে লোকজন এমনভাবে কথা বলছিলো যে এরা কোনো জীবিত প্রাণী। মানুষের মতো এদের সবকিছু আছে।

লোকজন রাজধানীতে আরো নানা রকম ব্যবসা নিয়ে আসার পাশাপাশি বিভিন্ন রকমের মুখরোচক কাহিনী আর সংবাদ নিয়েও আসতে থাকলো।

অনেকগুলো পানশালা খোলা হলো।

আজকের এখন যারা তরুণ, তারা পিরামিড তৈরির সময় অনেকেই ছিলো খুব ছোট। হয়তো তারা তখন মাত্র জন্ম গ্রহণ করেছে। এ তরুণ সমাজ পিরামিড তৈরির বিষয়টা খুব হেলা ফেলা করে দেখে। তাদের অধিকাংশকেই মনে হয় খুব ঝুঁকিপূর্ণ সাহসী। অথচ তারা ধারণাই করতে পারবে না যে পিরামিডের প্রথম দিকের কাজগুলো কী পরিমাণ সাহসিকতা আর ভয়ঙ্কর বিপদসংকুল কাজ ছিলো। বিষয়টা এমন দেখা যায় যে যখন তরুণরা তাদের বাবা মাকে পিরামিডের বিষয়ে খুব হেলা ফেলা করে জিজ্ঞেস করে তখন প্রতিউত্তরে বয়স্কদের বলতে হয়, ‘তোমরা এমনটা বলছো শুধু এই জন্য যে, এই বিষয়ে তোমাদের কোনো ধারণা নেই। তোমরা বুঝতেই পারছো না পিরামিডটা এই আকৃতিতে আসার আগে প্রথমে কেমন ছিলো।

একটা ধারণা ছড়িয়ে পড়ছিলো যে পিরামিডটা যতোই দৃশ্যমান হচ্ছিলো ততোই এর বিষয়ে মানুষের ভয়-ভীতি কেটে যাচ্ছিলো। বুড়োরা দৃশ্যমান এ পিরামিড নিয়ে কোনো কথা বললে তরুণরা তখন ঠাট্টাচ্ছলে বলতো, ‘তাহলে কি আপনারা চান যে পিরামিডটা অদৃশ্য হয়ে যাক?’

বুড়োরাও তাদের এ কথা শুনে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করে হাসতো।

এর মধ্যে আরেকটা নতুন পিরামিড তৈরির চিন্তা-ভাবনা চলতে লাগলো।

নতুন যে পিরামিডটি তৈরি হলো তার পাশেই আরেকটা পিরামিড তৈরি করার ধারণাটা নিতান্তই একটা পাগলামি। অনেকেই এটাকে নিছক গোয়ার্তুমি ছাড়া আর কিছুই ভাবলো না। এমন কি স্মৃতিসৌধের প্রধান মিস্ত্রী সে ঘোষণা করলো যে, পৃথিবীর আর কোনো নির্মাণ সৌধের পাশে একই রকম প্রাসাদ নির্মাণ করা হয় নি।

কিন্তু অতীতের নির্মাণ শৈলীর উদাহরণ টেনে আর পর্যালোচনা করার পর সাধারণ মানুষ এই নিয়ে বেশ বিভ্রান্তির মাঝে পড়ে গেলো। অবশ্য একটা বিষয় সবার কাছে আস্তে আস্তে পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছিলো। সেটা হলো নতুন আরেকটা পিরামিড তৈরির গুরুত্ব।

অতীতে দেখা গেছে ফারাও জোসের তার পিরামিড তৈরি শেষ হওয়ার পর এর সাথে আরো বিশাল আকারের চারটি সিঁড়ি পথ সংযুক্ত করেছিলেন। যেটা করতে পরবর্তীতে আরো সাত বছর সময় লেগে যায়।

অথবা ফারাও সেনেফেরু যে কিনা পর পর তিনটা পিরামিড তৈরি করেছিলেন এবং কোনটার মধ্যে তার শবদেহ রাখা হয়েছিলো সে বিষয়টা সম্পূর্ণ গোপন রাখা হয়েছিলো। যার ফলে অতীতের এ সমস্ত উদাহরণ থেকে একটা বিষয় পরিষ্কার হয় যে একটা পিরামিড তৈরি হওয়ার সাথে সাথেই আরেকটা তৈরির পরিকল্পনা শুরু হয়। তাদের নেশা আর পরিকল্পনা যেনো মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়।

তবে প্রধান স্থপতি এ বিষয়টা ফারাও-এর সামনে উপস্থাপন করে একটা বিষয় বুঝতে পারলেন যে, ব্যাপারটা ফারাওকে তেমন আগ্রহী করে তুলতে পারে নি।

এ অবস্থায় পনেরো দিন অতিবাহিত হওয়ার পর লোকজন একটা বিষয় টের পেলো যে, পিরামিডের অনির্মিত অংশের একটা পাথরও স্পর্শ করা হয় নি বা নষ্ট হয় নি।

ঠিক এ সময় রাজধানীতে আরো সরাইখানা খুলতে থাকলো। যুবকরা সেখানে নানা রকম গল্প গুজবে মেতে উঠলো। তার অধিকাংশই অবশ্য পিরামিডকে নিয়ে। চারদিকে কেবল রসাত্মক গল্প আর গল্প।

এক রাতে দেখা গেলো পিরামিডের চারপাশে কয়েকটা মশাল নিয়ে কারা যেনো হাঁটাহাঁটি করছে। আলোগুলো একবার বড় হচ্ছিলো আবার ছোট হচ্ছিলো। মনে হচ্ছিলো কোনো অদৃশ্য আত্মা ঘুড়ে বেড়াচ্ছে। তবে অনেক দূর থেকে লোকজন সেটা দেখতে পেয়ে তেমন অবাক হলো না। তারা বুঝতে পারলো যে পিরামিডের প্রধান যাদুকর এক দল লোক নিয়ে পিরামিডটা ঘুরে ফিরে দেখছে। এরা বিচিত্র কিছু নয়।

দলটি সারা রাত পিরামিডের উপর নিচে ঘুরে বেড়ালো। সকালের দিকে তারা নিচে নেমে আসলো। মশাল দিয়ে মনে হলো পিরামিডের ভেতর চাপা দিয়ে রাখা কোনো দুঃস্বপ্নকে তারা দেখছে কিংবা খুঁজে বেড়াচ্ছে। অথবা হতে পারে এখানে কোনো রহস্যময়তা কিংবা গোপন কোনো পাপ আছে যা তারা দিনের আলোতে বের করে নিয়ে আসতে চাইছে। দিবালোকের সত্যতার সাথে মেলাতে চাইছে।

কিছু চটকদার গুজব অফিস আর সরাইখানাতে আলোচিত হতে লাগলো। আর সেই গুজবগুলো আশ্চর্যরকম গতিতে মিশরের বাইরে ছড়িয়ে পড়লো। গোয়েন্দারা অনেক দূর-দূরান্তে ছড়িয়ে পড়লো। তারপর আবার তারা নতুন কোনো নির্দেশনার জন্য ফিরে এলো দুই সপ্তাহ পর। কিন্তু বাড়িতে ফিরে আসার পর তাদের অবস্থা এমন হলো যে তারা তাদের আসল বিষয়টাই ভুলে গেলো। রাষ্ট্রীয় গোপন তদন্তের বিষয় নিয়ে এবং এর সাথে বর্তমান পিরামিডের অবস্থা কী সে বিষয়ে বিচার-বিশ্লেষণ করতে তারা প্রায় হতবুদ্ধি হয়ে পড়লো। একেবারেই যেনো ভুলে গেলো।

তবে তাদের মধ্যে কেবল একজন যে কিনা কোনো রূপ চিন্তা বা কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থায় পড়লেন না। আর তিনি হলেন সুমেরিয়ান রাষ্ট্রদূত।

দিনের মিষ্টি গরম কিংবা রাতের ঠাণ্ডা কোনো পরিস্থিতিই তার রিপোর্টের একটা বর্ণও পরিবর্তন করতে পারলে না। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত তার সব কিছুই মোটামুটি সঠিক ছিলো।

একই ভাবে এক সপ্তাহের চরম উৎকণ্ঠার পর রাষ্ট্রদূত একটু শান্ত মনে বসলেন। তিনি তার সমস্ত রিপোর্ট রাজধানীতে পাঠিয়ে দিয়েছেন। এটা হলো তার পেশাগত জীবনের সেরা রিপোর্ট। মাঝরাতে তিনি কাজ করতে করতে ক্লান্ত হয়ে গিয়েছিলেন। তার দুই হাতের তালু দুটি গরমে প্রায় পুড়ে গেছে। কারণ পাথরে খোদাই করে তাকে রিপোর্টগুলো লিখতে হয়েছে। পাথরগুলো ছিলো অবিশ্বাস্য গরম। ফলে তার হাতে ফোসকা পড়ে গেছে। ভয়ঙ্কর সে ফোসকা।

প্রয়োজনীয় কাজ শেষ করে সে তার স্ত্রীর পাশে শুয়ে পড়লো। আজ তার খুব ইচ্ছে করছে স্ত্রীকে বেশ ভালোভাবে আদর করতে।

পরে স্ত্রীর ভালোবাসাবাসি শেষ করার পর সে স্ত্রীর পাশেই শুয়ে পড়লো সাধারণত যেভাবে অন্য সময় শোয়। কাত হয়ে শোয়ার পরই তার মাথায় আবার রিপোর্টগুলোর চিন্তা এলো যেটা সে আজকে মাত্র পাঠিয়ে দিয়েছে। সে ভাবছিলো সব কিছু ঠিকঠাকভাবে হওয়ায় রিপোর্টগুলো তার মাথার ভেতর ঠাণ্ডা একটা প্রশান্তি ভাব ছড়িয়ে দিয়েছে। যেভাবে তার স্ত্রী তার দেহকে জুড়িয়ে দেয়। সে ভাবছে মরুভূমির ভেতর দিয়ে পাথরের স্লাবের উপর খোদাই করা তার রিপোর্টগুলো মরুভূমির রাতের ঠাণ্ডায় এতোক্ষণে নিশ্চই জমে গেছে।

তার মাথা থেকে কিছুতেই রিপোর্টগুলোর চিন্তাটা দূর হচ্ছিলো না। সে শত চেষ্টা করেও সেটা পারছিলো না। তার চিন্তা ঘুরে ফিরে বার বার বাধা গ্রস্থ হচ্ছিলো। চোখের ঘুম পালিয়ে যাচ্ছিলো। কেবলই ভাবছিলো আর ভাবছিলো।

রিপোর্টের যে কাজ সে করেছে সেটা মোটেও খুব সহজ ছিলো না। তাকে একশো ঊনত্রিশটা পাথরের লিপিখণ্ড তৈরি করতে হয়েছিলো যেখানে রিপোর্টগুলো খোদাই করা হয়েছে অত্যন্ত সুচারুভাবে।

সে মনে করার চেষ্টা করলো প্রথম এগারো পাথর খণ্ডের কথা যেখানে সে মোটামুটি পুরো পরিস্থিতিটার একটা সংক্ষিপ্ত অবয়ব তৈরি করার চেষ্টা করেছে। তবে তিন থেকে সাতের মধ্যের পাথরগুলোতে সে এমন একটা বিষয় তুলে নিয়ে এসেছে যার ধারণাটা সে রাজধানীর কাছেই তার চাচা কিরকিরের বাড়ির ময়লা আয়না থেকে সে উদ্ধার করেছে। সেদিনই দুপুরের পর তার চাচা কিরকির আত্মহত্যা করে। সে রহস্য আরো কৌতুহলের। আরো চিন্তার।

.

প্রথম গুরুত্বপূর্ণ আর বিশেষভাবে বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত সংবাদটি লিপিবদ্ধ করা হয়েছিলো পনেরো থেকে একুশ পর্যন্ত পাথর খণ্ডে। এটা সুমেরিয়ান সরকারকে মিশরের বিষয়ে অনেক তথ্যপূর্ণ সংবাদ উপস্থাপন করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে রাজ্যের যতো অনাকাঙ্খিত ঘটনাগুলোর বিষয়েই শুধু মিশরের আগ্রহ।

সুমেরিয়ান রাষ্ট্রদূত তার তদন্তের বিষয়টা পর্যালোচনা করতে গিয়ে স্মৃতি থেকে সব কিছু আবার ঝালাই করে নিতে শুরু করলো।

এগারো নম্বর পাথর খণ্ডটি লিখিত পুরো রিপোর্টের সারমর্ম হলো যে, সাম্প্রতিক সময়ে পিরামিড তৈরির সময় পাথর পড়ে যাওয়ার কারণে যে ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটেছে তার উপর যথাযথ গুরুত্বারোপ করা। যদিও অভিযোগ উঠেছে ফারাও এর শত্রুপক্ষের লোকেরা এ দুর্ঘটনার সাথে জড়িত। অবশ্য তার ব্যক্তিগত তদন্তে তিনি বুঝতে পেরেছেন ফারাও এর নিরাপত্তা সংস্থার লোকেরাই এ ষড়যন্ত্রের মূল হোতা। অন্য কেউ নয়। এর মূল রহস্য অনেক গভীরে।

রাষ্ট্রদূত যে সমস্ত কারণ বিশ্লেষণ করেছেন তার গুরুত্ব অবশ্য অনেক। তার এ বিচার বিশ্লেষণ বর্ণনা করা আছে ঊনচল্লিশ থেকে বাহাত্তর পর্যন্ত লিপিখণ্ডে। এ অংশটাই হলো রিপোর্টের প্রাণ।

রাতের আধারে গাড়ি ভর্তি করে তার রিপোর্টগুলো যখন ছুটে বেড়াচ্ছিলো তখন সে নিজের মনেই বারবার চিৎকার করে উঠছিলো।

‘তুমি একটা আস্ত বোকা। তুমি সাবধানে থাকো!”

সে বারবার ভয় পাচ্ছিলো গাড়িগুলো না আবার বিপদগ্রস্থ হয়ে পড়ে।

তার এ গুরুত্বপূর্ণ রিপোর্টগুলো যদি ধ্বংস হয়ে যায় তাহলে তার চেয়ে এ পৃথিবীতে আর কেউ হবে না।

‘হ্যা, ঈশ্বর!’ সে চিৎকার করে উঠলো।

ভেতরে ভেতরে সে এতো বেশি অস্থির হয়ে পড়েছিলো যে তার স্ত্রী ভাজিনা তার দিকে তাকিয়ে কিছুটা আতঙ্কিত হয়ে পড়লো।

সে আবার বিশ্লেষণের চিন্তায় ডুবে গেলো। তার কাছে মনে হলো পিরামিড তৈরির সময় এই যে নানা রকম ঘটনা ঘটে যাচ্ছে এখানে নিশ্চই শৃঙ্খলা ভঙ্গের কোনো কারণ আছে যা মিশর রাষ্ট্রের পক্ষে সত্যিই বিপদজনক। কেবল বিপদজনক নয়, ভয়াবহ পরিণতিও।

মিশরের মন্ত্রীদের একটা বাজে স্বভাব হলো, যা কিছুই ঘটুক না কেন সব কিছুর জন্য সুমেরীয়ানদের দোষারোপ করে। শুধু তাই না, কোনো কিছু হলেই তারা চেষ্টা করে মিশরের সাথে সুমেরিয়ানদের তুলনা করতে। তারা এমন কি ফারাওদের পিরামিডের সাথে মেসোপটোমিয়ার খালের তুলনা সব সময়ই করে থাকে। যদিও প্রথম দর্শনে এ দুটোর মাঝে কোনো মিলই পাওয়া যায় না। দুটোই সম্পূর্ণ ভিন্ন ভিন্ন বিষয়। তারা একটা বিষয় বোঝে না যে এই দুটোর কার্যকারিতায় কতো পার্থক্য রয়েছে। মেসোপটোমিয়ার খাল থেকে মানুষ চাষাবাদ, সেচকাৰ্যসহ আরো নানা রকম উপকার পেয়ে থাকে। অথচ এ পিরামিড-এর কি উপকার আছে। এটা বরং আরো বিপদ আর ঝুকি বয়ে নিয়ে আসছে। তাহলে একটা বিষয় স্বীকার করতেই হবে যে, যাবতীয় বিপদ আর ঝুকির মূলে আছে এই পিরামিড। মেসোপটোমিয়ান খাল নয়।

তার রিপোর্টের তৃতীয় অংশটা হলো রিপোর্টের সর্বোচ্চ অংশ। এটা মূল্যবান এবং কঠিন অংশ।

পাথর খণ্ড নব্বই থেকে একশো বাইশ পর্যন্ত এটা বিস্তৃত। সম্ভাব্যময় সমাধান। অতি গোপনীয় জরুরি বৈঠকের নথিপত্র সন্নিবেশিত করা হয়েছে এখানে। বাতাসে জোর গুজব আছে যে নতুন আরেকটা পিরামিড তৈরির চিন্তা-ভাবনা চলছে।

রাষ্ট্রদূত তার কনুইটা মাথার নিচে দিয়ে উপরের দিকে তাকিয়ে শুয়ে রইলো। তার চোখে কোনো ঘুম নেই। সে কতবার কল্পনা করেছে যে লোকজন এটাকে ভেঙে ফেলছে। মানুষের ভিড় আর ভূতেরা পিরামিডের একটা একটা পাথর উঠিয়ে নিয়ে অচিন অন্ধকারে ফেলে দিচ্ছে। প্রধান জাদুকর পুরোহিত আবার চেষ্টা করছে এটাকে জন্ম দিতে। কিন্তু সেটা আর জন্ম নিচ্ছে না। বন্ধ্যা হয়ে পড়েছে। অথচ এ মুহূর্তে তারা দুটো পিরামিড তৈরির চিন্তা-ভাবনা করছে।

এক ধাপ থেকে আরেক ধাপ এভাবে কতো দিন লাগে কে জানে। হ্যা ঈশ্বর!

তবে একটা বিষয় পরিষ্কার হয়ে গেছে যে, মিশর এই কুজো মার্কা পিরামিডটা ছাড়া তাদের মুক্তির কোনো সম্ভাবনা নেই। আর সব অলীক।

এভাবেই তার একশো বাইশতম প্রস্তর খণ্ডটি শুরু হয়েছে। সেখানে খোদিত করা আছে যে যদি আরেকটি নতুন পিরামিড তৈরি করা না হয় কিংবা আগের পিরামিডকে সংস্কার করা না হয় তাহলে অনেক কিছুই ঘটে যেতে পারে।

এভাবে সে একে একে তার তদন্ত রিপোর্টের সবগুলো প্রস্তরখণ্ড মনে করতে থাকলো।

রাষ্ট্রদূত তার মাথাটাকে বালিশের উপর রেখে শুয়ে রইলো। কিছুতেই তার ঘুম আসছিলো না। মন তার পড়ে আছে সিনাই মরুভূমিতে ছুটে যাওয়া গাড়ি ভর্তি প্রস্তরখণ্ডের উপর যেখানে তার পরিশ্রমের রিপোর্টগুলো সংরক্ষিত আছে। মরুভূমিতে গাড়ির ভেতর সেই মাটির ঢেলাগুলো নিশ্চই মৃতদেহের মতো ঠাণ্ডা ও নিথর হয়ে পড়ে আছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *