1 of 2

চুল – অদ্রীশ বর্ধন

চুল – অদ্রীশ বর্ধন

যে কাহিনীটি আপনাদের আজ বলতে যাচ্ছি, তা বিশ্বাস করা না-করাটা আপনাদের অভিরুচি। কেননা, নিজের মনেই বিশ্বাস উৎপাদন করানোর মত যুক্তি আজও আমি খুঁজে পাইনি।

বেশ কয়েক বছর আগেকার কথা। সালটা খুব সম্ভব উনিশশো বত্রিশ। রাত সাড়ে দশটা বেজে গেছে। শয়নের উদ্যোগ করছি, এমন সময়ে সদর দরজার কলিং বেলটা বেজে উঠল এবং তার মিনিট খানেক পরেই বিবেকের পুরোন চাকর রাধু হাতে তুলে দিলে ওপরে লাল পেন্সিলে ‘জরুরী’ লেখা ভারী এনভেলাপটা। ভেতরে কয়েক তাড়া কাগজে দ্রুতহস্তে লেখা একটা চিঠি। ড্রইংরুমের সোফায় পাশাপাশি বসে আমি আর রমিতা চিঠিটা পড়তে শুরু করলাম।

প্রিয় আশিস,

সময় খুব অল্প, তাই যথাসম্ভব সংক্ষেপ করে আমার এ কাহিনীটা তোমায় বলে যেতে চাই। এ চিঠি আমার স্বীকৃতি-পত্ৰ—প্রয়োজন হলে যথাস্থানে এটা হাজির করার অধিকারও তোমার রইল।

প্রায় বছর খানেক আগে ফ্রি স্কুল স্ট্রীট ধরে বাড়ি ফিরছিলাম। রাত তখন প্রায় ন’টা। আশপাশের কয়েকটি দোকান বন্ধ হয়ে গেছে, আরও কয়েকটি বন্ধ হচ্ছে। এমন সময়ে হঠাৎ চোখ পড়ল একটা কিউরিওর দোকানের ওপর।

দোকানটা খুব বড় নয়। বাইরের ধুলো-পড়া কাচের শো-কেসে পুরোন আমলের বহু দর্শনীয় বস্তু থরে থরে সাজানো। জানোই তো আমার হবি কি, দাঁড়িয়ে পড়লাম সেখানে। শো-কেসের একেবারে পেছন দিকে একটা সেল্‌ফের ওপর দেখলাম একটা গোলাকার তামার ডিবে। ডিবেটার আকার মোটেই পাউডার-কেসের মত নয়, আর বোধ হয় সেই কারণেই জিনিসটার ওপর আমার দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়েছিল প্রথম থেকেই। সঠিক কি কারণে জানি না, বোধ হয় এরকম কোন বাক্স ইতিপূর্বে দেখিনি বলেই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সেটা খুঁটিয়ে দেখতে লাগলাম।

শো-কেসের কাচটায় ময়লা এমনই পুরু হয়ে জমেছিল যে সে আস্তর ভেদ করে আমার দৃষ্টি ভেতরে ভাল করে প্রবেশ করতে পারছিল না। তাই, জিনিসটাকে একবার হাতে করে দেখবার জন্যে দোকানের ভেতরে পদক্ষেপ করলাম। কাউন্টারের পেছন থেকে এগিয়ে এল অবিশ্বাস্য রকমের বৃদ্ধ এক চীনাম্যান। ভাঙা ভাঙা ইংরেজীতে সে আমায় কৌটো সম্বন্ধে অনেক কথা বললে। ডিবেটা বেশ ভারী, আগাগোড়া তামা দিয়ে তৈরি, গোলাকার, চার ইঞ্চি উঁচু আর ব্যাস প্রায় তিন ইঞ্চি। ভেতরে একটা কিছু জিনিস নিশ্চয় ছিল, কেননা ঝাঁকানি দিলে ভেতরে সেটা নড়ে ওঠার শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম। কিন্তু কৌটোটাকে কেউ নাকি আজ পর্যন্ত খুলতে পারেনি। চীনাম্যানটি এটি কিনেছিল চট্টগ্রাম থেকে সদ্য আগত এক জাহাজের খালাসীর কাছ থেকে। কিন্তু পৃথিবীর কোন্ অংশ থেকে ডিবেটির আবির্ভাব ঘটেছে—সে সম্বন্ধে কোন তথ্যই সে আমায় সরবরাহ করতে পারল না।

‘গিভ মি টু লুপিজ স্যার।’ বললে চীনাম্যানটি।

আমি তাকে একটা টাকা দিলাম। ডিবেটি নিয়ে বাড়ি ফিরে সিধে গেলাম আমার ছোট্ট ওয়ার্কশপটায়। প্রথমেই কৌটোটাকে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে ভাল করে জোর আলোয় পরীক্ষা করলাম। সেটার গঠনভঙ্গি থেকেই মনে হল, বহু পুরোন আমলের সামগ্রী সেটি—এমন কি ডিবেটা তৈরি করার সময়ে লেদের ব্যবহারও করা হয়নি—আগাগোড়া হাতে তৈরি। কৌটোর ঢাকনির ওপর এক সময় একটা কিছু খোদাই করে লেখা হয়েছিল, কিন্তু উকো দিয়ে ঘষে সেটুকুও তুলে ফেলা হয়েছে।

এরপর আমার কাজ হল ডিবেটার কোন ক্ষতি না করে ঢাকনিটিকে খোলার ব্যবস্থা করা। ডালাটা এমনই এঁটে বসে গেছল যে শুধু হাতের জোরে অথবা কোন মামুলী পদ্ধতিতে তা খোলা অসম্ভব। অতএব বিজ্ঞানের শরণ নিতে হল।

প্রথমেই আমি ডিবেটার ডালা নিচের দিক করে এক ডিস গ্লিসারিনে এক হপ্তা ডুবিয়ে রাখলাম। ইতিমধ্যে তামার পাত কেটে তৈরি করে ফেললাম দুটি কলার—একটা কৌটোটির জন্য, অপরটি কৌটোর ঢাকনির জন্যে। সাতদিন কেটে যাবার পর আমি নাট স্ক্রু দিয়ে কলার দুটোকে বেশ শক্ত করে লাগিয়ে দিলাম। তারপর কৌটোটিকে ‘ভাইস’এ চেপে ধরে কলারের ওপর হাতুড়ি ঠুকে ঢাকনিটাকে ঘুরিয়ে দেবার চেষ্টা করতে লাগলাম। ঢাকনিটা ঘুরল না। তখন বিপরীত দিকে হাতুড়ির ঠোকা দিতেই তৎক্ষণাৎ ঘুরে গেল ডালাটা। বুঝলাম, আজ পর্যন্ত কেন কেউ এটা পেঁচিয়ে খুলতে পারেনি। কৌটোটার প্যাঁচ সাধারণ নিয়মের সম্পূর্ণ উল্টো—ডান দিকে যোরালে তবে সেটা খোলে। মনে পড়ল, বহু বছর আগে এইরকম উল্টো নিয়মেরই প্রচলন ছিল।

যাই হোক, ধীরে ধীরে ঢাকনিটা ঘুরিয়ে দিতে লাগলাম। অতি সন্তর্পণে হাত দুটি সামনে বিস্তার করে ধরেছিলাম ডিবেটা। কেননা, ভেতরে এত বছর ধরে কি বস্তু যে লুকিয়ে আছে, তা তো জানি না। বোমার মত সেটা আচমকা ফেটেও পড়তে পারে, লাফিয়ে উঠে হয়তো আমার মুখে প্রচণ্ড আঘাতও হানতে পারে। ডালাটা খুলে আনার পর কিন্তু চাঞ্চল্যকর বিশেষ কিছু ঘটল না। মনে হল ডিবেটার অর্ধেক শুধু ধুলোতেই ভর্তি, কিন্তু একেরে তলায় ছিল বিনুনি পাকান খানিকটা কোঁচকান চুল। সিধে করে ধরলে লম্বায় সেটি প্রায় ন’ ইঞ্চি আর প্রায় একটা পেন্সিলের মত মোটা। বিনুনির দু-একটি পাক খুলে দেখলাম, অতি সূক্ষ্ম শত শত চুলের সমষ্টি ছাড়া আর কিছু সেখানে নেই। কিন্তু চুলগুলির ওপর নোংরা এমনই জমাট বেঁধে রয়েছে যে, উল্লেখযোগ্য আর কিছুই দেখতে পেলাম না। সুতরাং সেগুলোকে পরিষ্কার করাই হল আমার পরবর্তী কাজ।

প্রথমে জল-মেশানো পাতলা হাইড্রোক্লোরিক অ্যাসিডে ডুবিয়ে রাখতে চুলের তেলতেলে ভাবটা চলে গেল, তারপর কাপড়—কাচা সোডার জলে ডুবিয়ে রাখতে চুলে আর অ্যাসিডের অবশিষ্ট লেগে রইল না। এর পরে ডিস্‌টিলড ওয়াটারে বেশ করে ধুয়ে অ্যালকোহলে ডুবিয়ে তুলে নিলাম। ফলে জলকণামুক্ত হল চুলগুলি। সবশেষে ইথারে ডুবিয়ে দিলাম বিনুনিটা।

ইথার থেকে যখন চুলের গোছাটা সবে তুলেছি, এমন সময়ে খবর এল যে ফোনে আমায় কে ডাকছে। সুতরাং হাতের কাছে প্রথমেই যে পরিষ্কার জিনিসটা পেলাম, সেটা একটুকরো সাদা কার্ডবোর্ড—তার ওপরেই পিন দিয়ে বিনুনিটাকে গেঁথে চলে গেলাম ফোন ধরতে।

পরে যখন চুলের গুচ্ছটাকে ভালভাবে পরীক্ষা করলাম, একটি বিষয় দেখে যেমনই আশ্চর্য হলাম, তেমনই হলাম কৌতূহলী। চুলগুলি একজন নারীর কেশ থেকে সংগৃহীত হয়নি—বিভিন্ন নারীর কেশসম্ভার থেকে সংগ্রহ করে এনে তবে তাদের বিনুনি পাকিয়ে একত্র করে রাখা হয়েছে। ঘোর কৃষ্ণবর্ণ থেকে শুরু করে বাদামী, লালচে, সোনালী এমন কি শ্বেতশুভ্র চুল পর্যন্ত পাকিয়ে রাখা হয়েছে পরম যত্নে। কোন চুলেরই কৃত্রিম রঙ নেই, তা থেকেই প্রমাণিত হয় কত বহু বছর আগেকার সে বিনুনিটি।

এরপর নিছক কৌতূহলের বশে দু’একজনকে বিনুনিটি দেখালাম, কিন্তু বস্তুটি তাদের বিশেষ আগ্রহের খোরাক হয়ে উঠেছে বলে মনে হল না। সুতরাং সেটিকে আমি তামার ডিবেতে ভরে কাবার্ডের অন্যান্য সংগ্রহের সাথে রেখে দিলাম। তারপর এক সময়ে ধীরে ধীরে মন থেকে মুছে গেল সেকথা।

আর তারপরেই ঘটল অদ্ভুত ঘটনাটা।

প্রায় দিন দশেক পরে হঠাৎ দেখা হয়ে গেল আমার এক বন্ধুর সাথে আর এক বন্ধুর বৈঠকখানায়। বন্ধুটির নাম সমরজিৎ। সমরজিতের কপাল ঘিরে একটা পুরু ব্যাণ্ডেজ। স্বভাবতই জিজ্ঞেস করলাম তার মাথায় কি হয়েছে। কিন্তু তার উত্তর শুনে অবাক হয়ে গেলাম। মাথায় যে তার কি হয়েছে, তা সে নিজে তো জানেই না, এমন কি তার ডাক্তারও জানে না। চা খেতে খেতে আচম্বিতে সে ধড়াস করে পড়ে যায় মেঝের ওপর—নিস্পন্দ দেহে থাকে পড়ে। বেজায় ভয় পেয়ে গিয়ে তার স্ত্রী তৎক্ষণাৎ খবর পাঠালে ডাক্তারের কাছে। মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই চেতনা ফিরে আসতে উঠে বসে জিজ্ঞাসা করলে সমরজিৎ যে কে তার কপালে মারল। কিছুক্ষণের মধ্যে সুস্থ হয়ে উঠল সে—শুধু কপালে তীব্র যন্ত্রণাবোধ ছাড়া আর কোন অসুবিধা রইল না। কপালের যে স্থানটায় যন্ত্রণাটা অনুভূত হচ্ছিল, সেখানটায় ডাক্তার প্রথমে একটা লালচে দাগ ছাড়া আর কিছুই দেখতে পেলে না। দাগটা ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়ে উঠছিল।

ধীরে ধীরে পরিষ্কার হয়ে ফুটে উঠতে লাগল দাগটা—শেষে মনে হল কপালের ওই স্থানটায় লাঠি দিয়ে হানা হয়েছে এক প্রচণ্ড আঘাত। পরের দিন দাগটা সেই রকমই রইল, তবে দেখা গেল দাগটার চারদিকে বেষ্টন করে গোল ভাবে ফুটে উঠেছে থেঁতলে যাওয়ার মত একটা চিহ্ন—নীলচে কালসিটার আভা। তারপর ধীরে ধীরে সব ভাল হয়ে আসতে লাগল। ব্যাণ্ডেজ খুলে সমরজিৎ দাগটা আমায় দেখাল। গোলাকার কালসিটার মাঝে ঈষৎ বাঁকানো রক্তবর্ণ একটা দাগ ছাড়া আর কিছুই নেই—বিশ্রী কৃমিকীটের মত লাল আভা নিয়ে প্রকট হয়ে রয়েছে দাগটা।

ডাক্তারের মতে দুর্বলতা বশত হঠাৎ মাথা ঘুরে যাওয়ার ফলে পড়ে যায় সমরজিৎ, সেই সময়ে কোনরকমে মাথাটা ঠুকে যাওয়ার ফলেই এই বিপত্তির সৃষ্টি। ডাক্তারের যুক্তিহীন মতের এইখানেই সমাপ্তি।

প্রায় মাসখানেক পরে সুমিতা বলল, সত্যি তোমার ওয়ার্কশপটা একটু গোছাই করা দরকার। মাগো, কি নোংরা!

তাই নাকি?—বললাম আমি।

আজ্ঞে হ্যাঁ মশাই, কোন ভদ্রলোক কি ওখানে কাজ করতে পারে?

শুনে দীর্ঘশ্বাস ফেললাম আমি, কিন্তু সুমিতা ছাড়বার পাত্রী নয়। কোমরে আঁচল জড়িয়ে এক হাতে ঝাঁটা এবং অপর হাতে আমাকে ধরে যাত্রা করল ওয়ার্কশপ অভিমুখে।

পরিষ্কার করার মধ্যে কাজ ছিল শুধু ঘরের বিভিন্ন স্থান থেকে যন্ত্রপাতিগুলো সংগ্রহ করে সেল্‌ফের যথাস্থানে রক্ষা করা আর মেঝের বাজে জিনিস দেখলেই তুলে জঞ্জাল-গাদায় স্তূপীকৃত করা। আর তার মাঝেই সবিরাম চলতে লাগল সুমিতার সম্মার্জনী।

প্রথমেই আমার দৃষ্টি আকৃষ্ট হল একটুকরো সাদা কার্ডবোর্ডের ওপর—এটা সেই বোর্ড, যার ওপর আমি টেলিফোন-কল আসার জন্যে চুলের গুচ্ছটা রেখে গেছলাম।

কার্ডবোর্ডটার অপর দিকে চোখ পড়তে দেখলাম, সেটা ফ্ল্যাশলাইটে ভোলা একটা গ্রুপ ফটোগ্রাফ—বন্ধুবান্ধবদের মধ্যে আমিও আছি সে ফটোটিতে। সুমিতা ফটোগ্রাফটার দিকে তাকিয়ে ছিল, হঠাৎ সে বলে উঠল, আচ্ছা, সমরজিৎ বাবুর কপালে ওটা কিসের দাগ বল তো?

আমি সেদিকে তাকালাম, আর দেখলাম—না, কোন ভুল হয়নি আমার—সেই একই দাগ, যে দাগ দেখেছিলাম একমাস আগে সমরজিতের কপালে; সেই রকমই ঈষৎ বাঁকানো, রক্তবর্ণ চিহ্ন। কিন্তু সবচেয়ে অদ্ভুত ব্যাপার হল এই যে ফটোটা তোলা হয়েছিল প্রায় পাঁচ মাস আগে।

এরপর আমরা ফটোগ্রাফের পেছন দিকটা লক্ষ্য করলাম। দেখলাম একটা আবছা বাদামী রেখা। ইথার থেকে তুলে নিয়ে পিন দিয়ে গেঁথে শুকোতে দিয়ে গেছলাম—রেখাটা নিশ্চয় সেই পিনেরই দাগ। আর তারপরে কার্ডবোর্ডটা ইথারটুকু শুষে নিয়েছে বলেই বিপরীত দিকে সমরজিতের কপালে ফুটে উঠেছে ওই দাগটা। পিনের দাগের মধ্যে দিয়ে একটা ছুঁচ এফোঁড়-ওফোঁড় করে দিতে, সত্যই সেটা এপাশে সমরজিতের কপালের সেই চিহ্নটার মধ্য দিয়ে বেরিয়ে এল। দুটো ঘটনাই একসাথে সংঘটিত হওয়াটা আপাতদৃষ্টিতে বেশ অদ্ভুত।

এরপর কি জানি আমার মনে হল, আমি সময় সম্বন্ধে নিঃসন্দেহ হবার প্রয়াস পেলাম। অবশেষে স্থির একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছলাম। একটা বিশেষ দিনে ৪টা থেকে ৪-১৫ মিনিটের সময় আমি ফটোগ্রাফটা পিন দিয়ে গেঁথেছিলাম, আর ঠিক সেইদিনেই প্রায় ৪-১৫ মিনিটের সময়ে সমরজিতের ওপর হয়েছিল সেই আশ্চর্য আক্রমণটা (!)—এ সিদ্ধান্ত সম্বন্ধে আমার মনে সন্দেহের বাষ্পটুকুও অবশিষ্ট রইল না। দুটো ঘটনার মধ্যেই রয়েছে বেশ স্পষ্ট একটা এককালীন সংঘটনের সম্পর্ক।

এই কথাগুলোই একদিন চিন্তা করতে করতে আচম্বিতে মনের মধ্যে উদিত হল একটা মতলব। পরীক্ষাটা একবার চেষ্টা করে দেখতে হবে। অবশ্য সমরজিৎ বেচারার ওপর আর নয়, কেননা, ইতিপূর্বেই তার ওপর অজান্তেই তো বেশ একচোট হয়ে গেছে, আর তা ছাড়া সে আমার বন্ধু তো বটেই। শত্রুদের প্রতি আমাদের যে সদয়ভাবাপন্ন হওয়া উচিত—এ হিতবাক্য আমার অজানা নয়, আর বাস্তবিকপক্ষে সে বাক্য আমি কিছু কিছু মেনে চলতেও চেষ্টা করি। কিন্তু যেখানে এরকম একটা এক্সপেরিমেন্টের নিতান্ত প্রয়োজন হয়ে পড়েছে—যদিও সহস্রের মধ্যে একটিতে সাফল্য আসবে কিনা সন্দেহ, তবুও স্বভাবতই বন্ধু অপেক্ষা শক্র মনোনয়নই শ্রেয়। সুতরাং এর পর থেকে আমি ব্যস্ত রইলাম মনোমত একটা শিকার অন্বেষণে। যাতে দৈবাৎ যদি আবার একটা coincidence ঘটে যায়, তবে আমার বিশেষ ক্ষতি হবে না। আর যে ব্যক্তিবিশেষটিকে মনোনীত করলাম, সে আমার পরবর্তী গৃহের অধিবাসিনী এক আয়া।

বাথরুমের জানলা থেকে ওদের উঠোনটা আমরা দেখতে পেতাম। প্রায় লক্ষ্য করেছি, শিশুটা যখন তার তত্ত্বাবধানে থাকত, আর আশপাশে যদি কাউকে না দেখা যেত, তখন শিশুটির সঙ্গে নিতান্ত অকারণে ব্যবহার করতে অত্যন্ত হৃদয়হীনার মত। অপরের গৃহের দৈনিক ঘটনাবলী লক্ষ্য করা অবশ্য অত্যন্ত গর্হিত কাজ। কিন্তু অবোধ শিশুটার ওপর তার অযৌক্তিক নির্দয় আচরণ তুমি দেখলে নিশ্চয় এ অপরাধ থেকে আমায় মুক্তি দিতে। আমরা তো ওকে দু-চোখে দেখতেই পারতাম না এ জন্যে। আরও একটা ব্যাপারে মেজাজটা আমার তার ওপর বিগড়ে ছিল। প্রথম যখন সে ও বাড়িতে এল, বাগানের পাঁচিলটার ওপর ঝুঁকে পড়ে গোলাপের গন্ধ শুঁকত। এতেই যদি ক্ষান্ত থাকত, তাহলে কিছুই হত না। কিন্তু অনর্থক বোঁটাশুদ্ধ ফুলগুলো তুলত আর ছুড়ে ফেলত মাটিতে। অচিরেই সে ঘটনার পুনরাবৃত্তি হওয়া আমি বন্ধ করলাম। পাঁচিলের ওপর থেকে সহজলভ্য কয়েকটি গোলাপ গাছের চারপাশে বঁড়শি দিয়ে এমন সুকৌশলে এক দুর্ভেদ্য ব্যারিকেড রচনা করলাম যে, পরের দিনই সকালে বেশ একটু হৈ-চৈ শোনার পর এক হপ্তা ধরে দেখেছিলাম আয়ার হাতে পুরু ব্যাণ্ডেজটা।

মোটের ওপর আমার এক্সপেরিমেন্টের পক্ষে সম্পূর্ণ উপযুক্ত ব্যক্তি হল সে। কাজেই আমার প্রথম কাজ হল তার একটা ফটোগ্রাফ তুলে ফেলা। পরের দিন ঝলমলে রোদ্দুর ভরা সকালে যখন সে উঠোনে পায়চারি করছে, আমি বাথরুমের জানলা থেকে এরোপ্লেন ওড়ার মত কি ওইরকম একটা বিদ্‌ঘুটে শব্দ করতে সে মুখ তুলে তাকাল, আর তক্ষণাৎ শাটার টিপে দিলাম আমার জাইসআইকনের।

প্রথম প্রিন্টটা যখন শুকোল, সেই রাত্রেই প্রায় এগারটার সময়ে, আমি চুলের বিনুনিটা নিয়ে তার কপালে দুটো পিন দিয়ে আটকে রাখলাম। অবশ্য নিজের এই নির্বোধ কার্যকলাপের জন্য হাসি পাচ্ছিল খুবই, কিন্তু নিতান্তই একটা ছেলেখেলা পরীক্ষার মত সহজভাবে সেটাকে গ্রহণ করতে পেরেছিলাম। তারপর, পিন লাগানো ফটোগ্রাফটা রেখে দিলাম ওয়ার্কশপের কাবার্ডে।

পরের দিন সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরতে সুমিতা বলল, শুনেছ আজ সকালে পাশের বাড়ির আয়াটাকে বিছানায় মরে পড়ে থাকতে দেখা গেছে। আরও অনেক কিছুই গর্‌ গর্‌ করে বলে গেল সুমিতা, লোকজন এ ব্যাপারে বেশ চঞ্চল হয়ে উঠেছে, পুলিশ এসে জোর তদন্ত শুরু করেছে, ইত্যাদি।

মনে হল, চোখের সামনে ঘরের দেওয়ালগুলো ঘুরতে শুরু করেছে। কতক্ষণ স্তম্ভিতের মত দাঁড়িয়ে ছিলাম জানি না, অবশেষে আত্মসংবরণ করে নিয়ে প্রশ্ন করলাম, কিসে মারা গেছে, কিছু শুনেছ?

বুঝতেই পারছ, সুমিতা আমার এক্সপেরিমেন্ট সম্বন্ধে বিন্দুবিসর্গ জানত না। জানলে, এ পরীক্ষায় হাত দিতে কখনই সে আমায় দিত না। জানোই তো, কুসংস্কারের হাওয়া সব সময়ে তাকে কেমন ঘিরে থাকে—আমার সঙ্গে এতকাল বসবাসের পরও মনের অন্ধকার তার এখনও পুরোপুরি ঘোচনি।

যত তাড়াতাড়ি পারলাম, সুমিতা চোখের অন্তরালে যেতেই ওয়ার্কশপের কাবার্ড থেকে বার করলাম ফটোগ্রাফটা—আর, জানি তুমি বিশ্বাস করবে না একথা, কিন্তু তাতে আমার কিছু ক্ষতিবৃদ্ধি হবে না—বিনুনি থেকে যখন পিন দুটো খুলে নিলাম, দেখলাম আমার কপালে দুটি সুস্পষ্ট রক্তবর্ণ চিহ্ন!

কতক্ষণ যে অভিভূতের মত বসেছিলাম, সে সময়ের হিসাব ছিল না। ইংরাজীতে যাকে coincidence বলে, তা কি কখনও দুবার ঘটা সম্ভব? একবার সমরজিতের ক্ষেত্রে, আবার এই আয়ার ক্ষেত্রে, কিন্তু আমার চোখকে আমি অবিশ্বাস করতে পারি না, আমার চোখের সামনে আয়ার কপালে দুটি জ্বলজ্বলে রক্তবর্ণ বিন্দু আমার শিক্ষা-সংস্কৃত মনকে যেন মৌন ভাষায় বিদ্রুপ করতে লাগল।

এই ব্যাপারে তখনকার মত মনের মধ্যে যেটুকু অনুতাপের অগ্নিশিখা দেখা দিয়েছিল, প্রবল ঔৎসক্যের বারি-সিঞ্চনে অচিরেই তা নিভে গেল। প্রথমেই শুরু হল আমার ব্যক্তিগত তদন্ত, কিভাবে আয়ার মৃত্যু ঘটেছে, সে অনুসন্ধান করতে আমি উঠেপড়ে লাগলাম। পুলিশী রিপোর্টে অবশ্য ছিল মৃত্যুটা হয়েছে নিছক প্রকৃতির নিয়মানুসারে, অর্থাৎ ব্রেনের মধ্যে কয়েকটি শিরা অতিরিক্ত রক্তের চাপে ফেটে যাওয়ার ফলেই মৃত্যু এসেছে; কিন্তু শুধু একটি স্থানেই সব ডাক্তারদের বুদ্ধি ঘুলিয়ে গেল যে প্রকৃতির সেই নিয়মটি কি কারণে হঠাৎ কার্যকরী হয়ে উঠে এ মৃত্যুকে ডেকে আনলে। সমরজিতের কপালে যেমন চিহ্ন দেখেছিলাম, এরও কপালে ছিল হুবহু সেই চিহ্ন, তবে এবার সংখ্যায় দুটি। দু-একজন ডাক্তার অবশ্য বলেছিল যে এক্সরে করে করোটির ভেতরটা দেখা যাক। এক্সরে ফটোও উঠেছিল, কিন্তু আভ্যন্তরিক কোন স্নায়ু—বিকৃতি দেখা যায়নি। সুতরাং ব্যাপারটা শেষ হয়ে গেল এইখানেই।

কিন্তু আমার মস্তিষ্কে তখন চিন্তার বন্ধুরী ঔৎসুক্যের বনস্পতিকে ঘিরে পাক খেয়ে ঊর্ধ্বে উঠছে। শরীর খারাপ থাকার জন্যে মাথা ঘুরে পড়ে যাওয়াটাও তো আয়ার পক্ষে সম্ভব? আরও তো কত কারণ থাকতে পারে! সত্যিই কি ওই কেশগুচ্ছের সঙ্গে এ মৃত্যু সম্পর্কিত? বাস্তবিকই, ওইখানেই বিষয়টার ওপর আমি যবনিকা টেনে দিতে পারলাম না। সুতরাং আবার একটা পরীক্ষার জন্য খুঁজতে লাগলাম আর একজনকে, আর অনেক ভেবে-চিন্তে আমার বাড়ির বিপরীত দিকের বাড়ির এক বাসিন্দাকে মনে মনে বেশ পছন্দ হয়ে গেল।

লোকটি অবশ্য আয়ার মত ততটা খারাপ ছিল না। কেননা, নিষ্ঠুর প্রকৃতির মানুষ সে নয়—অন্তত নিজের ইচ্ছায় তো নয়ই। শুধু সারাদিন, বিশেষ করে গভীর রাত পর্যন্ত বেহালা বাজাবার এক বিদ্‌ঘুটে নেশা তার ছিল। সুতরাং স্থির করলাম, খুন করাটা উচিত হবে না—তার চেয়ে অল্পের ওপর দিয়ে একটু মজা করা যাক।

মুশকিল হল ফটো তোলা নিয়ে। কেননা, বাইরে সে খুবই কম বেরোত। যার সঙ্গে আমার দৈনিক একাধিকবার চোখাচোখি হচ্ছে, তার অগোচরে তারই মুখের পরিষ্কার ফটো তোলো যে কি কঠিন ব্যাপার, তা তুমি উপলব্ধি করছে নিশ্চয়ই। যাই হোক, প্রায় দিন পনেরো পরে এ দিকটা আমি কোনমতে কায়দা করে সামলে নিলাম। ফটোটা যদিও খুবই ছোট্ট হয়েছিল, কিন্তু পরে আমি সেটা বেশ বড় করে এনলার্জ করে নিলাম।

সন্ধ্যার পর থেকে ওপরের একটা ঘরে বেশ অঙ্গভঙ্গি করে ছড়ি টানত ভদ্রলোক। একনাগাড়ে টেনেই যেত, আর বিচিত্র সব রাগ-রাগিনীর স্বরলহরীতে ভরিয়ে তুলত আকাশ-বাতাস। সুতরাং রাত্রের খাওয়া সাঙ্গ হলে আমি গেলাম আমার ওয়ার্কশপের জানলায়। অপেক্ষা করতে লাগলাম সেখানে। খেয়েদেয়ে এসে লোকটি যখন আবার ছড়ি তুলল, আমিও তুলে নিলাম আমার চুলের গোছাটি—সে যখন ছড়ি ছোঁয়ালে বেহালার তারে, আমি বিনুনি দিয়ে স্পর্শ করলাম ফটোটি—খুব আলতো ভাবে।

প্রথম যখন বিনুনিটা ছুঁয়ে গেল ফটোটা—ভদ্রলোকের বেহালা থেকে উত্থিত হল এক বেসুরো শব্দ। এতে আমার মনটা তৃপ্ত হল না—আবার ধীরে ধীরে বিনুনি ছোঁয়ালাম ফটোটিতে। এবার আর কোন সন্দেহই রইল না। অত্যন্ত ক্ষিপ্রভাবে কাঁধ থেকে সে নামিয়ে নিল বাদ্য-যন্ত্রটি এবং প্রায় মিনিট পাঁচেক ধরে ডাঙায় ওঠা মাছের মত খাবি খেতে লাগল। তার ছটফটানি দেখে মনে হল, নিশ্বাস যেন তার রুদ্ধ হয়ে আসছে। উদ্‌গ্রীব হয়ে দেখতে দেখতে আমি এমন অবাক হয়ে গেলাম, মনে হৃল যেন আমার নিজেরও নিশ্বাস-ক্রিয়া রহিত হয়ে আসছে।

বিনুনিটা আমি সরিয়ে নিলাম।

তারপরে ভাবতে লাগলাম যে, এর পরে আমার কর্তব্য কি। বিপদজনক ওই চুলের গোছাটা কি পুড়িয়ে ফেলব, না রেখে দেব? অনেক ভেবে দেখলাম, সাধারণদর্শন কিন্তু অসাধারণ শক্তিসম্পন্ন ওই চুলগুলোকে আরও বিভিন্ন উপায়ে আমি ব্যবহার করতে পারি। সঙ্গে সঙ্গে আমার কার্যপন্থাও স্থির হয়ে গেল।

আমার পরবর্তী এক্সপেরিমেন্টগুলোর বিশদ বিবরণ তোমায় বলতে গেলে একটা বই লিখে ফেলা দরকার। এ-সব পরীক্ষা চলেছিল বেশ কয়েকটি মাস ধরে। শেষকালে সমগ্র বিষয়টাকে আমি এমন একটা নিখুঁত বিজ্ঞান-পরিধির মধ্যে কেন্দ্রীভূত করে ফেললাম যে, যে কোন জীবন্ত প্রাণীকে মশক দংশনের মত ক্ষুদ্র যন্ত্রণা দেওয়া থেকে শুরু করে হত্যা করা পর্যন্ত আমার কাছে নিতান্ত ছেলেখেলার ব্যাপার হয়ে দাঁড়াল। মনে রেখ, এ সাফল্য এসেছিল একটি পুরুষ, একটি নারী, অসংখ্য কুকুর, বেরাল, খরগোশ আর চেতনা সম্পন্ন প্রাণীর বিনিময়ে।

এরকম একটা আবিষ্কার করে যে আনন্দ আমি পেয়েছিলাম, এক্সপেরিমেন্টের পর এক্সপেরিমেন্ট করে যে মজা অনুভব করেছিলাম—তা প্রকাশ করা ভাষার সাধ্য নয়। মনটা কেমন জানি এক নিষ্ঠুর আনন্দে উঠত ভরে, আর বার বার সেই আনন্দেরই আস্বাদ পাওয়ার নেশায় মনটা ব্যাকুল হয়ে উঠত। তারপর একদিন আমার দৃঢ় বিশ্বাস জন্মাল যে, এই অপরিমেয় শক্তির প্রসাদে ত্রিভুবন জয় করাও আমার আর অসাধ্য নয়।

কেশগুচ্ছটার ব্যবহার-মাত্রা সম্বন্ধে আমার জ্ঞান, অভিজ্ঞতা এবং দক্ষতা এমনই গভীর আর নির্ভুল হয়ে উঠল যে, ভাবলাম এরপর যদি এ শক্তিকে বাস্তব ক্ষেত্রে প্রয়োগ না করি, তাহলে সেটা হবে নিতান্তই পরিতাপের বিষয়। অর্থাৎ অন্য ভাবে বলতে গেলে, অধিক জীবন নষ্ট না করে অল্প সময়ে এবং অল্পায়াসে সৌভাগ্য-সূর্যকে মধ্যগগনে আনতে হলে এবার শক্তির বাস্তব প্রয়োগ নিতান্ত প্রয়োজন।

ভেবে দেখলাম, অপ্রিয়ভাজন আর অবাঞ্ছিত ব্যক্তিদের ওপর ক্রমাগত শক্তির প্রয়োগ করতে গেলে সময় লাগবে অনেক। অর্থাৎ ধরা যাক, যে লোকগুলোকে তুমি দু’চক্ষে দেখতে পার না, তাদের নামে মোটা ইন্সিওর করে দিলে। এর পরেই তাদের মৃত্যু হওয়াটা নিতান্ত অস্বাভাবিক হয়ে দাঁড়াবে—সুতরাং অন্তত পক্ষে একবছর তো তোমাকে অপেক্ষা করতেই হবে। আর তাছাড়া, কয়েকবার এই রকম মৃত্যু হওয়ার পর প্রত্যেকেরই মনে একটা খটকা লাগবে—তখনই কোম্পানীর পেমেন্ট দেওয়া নিয়ে শুরু হবে হাঙ্গামা। ভাবতে ভাবতে, আচম্বিতে মস্তিষ্কের স্নায়ুগুলোর মধ্য দিয়ে বিদ্যুৎ-চমকের মতই খেলে গেল এক অভিনব পরিকল্পনা।

তোমার বোধ হয় মনে থাকতে পারে যে, কয়েকমাস আগে থেকে আমি রেসকোর্সের মাঠে যাতায়াত শুরু করেছিলাম, আর প্রতিটি বাজীতে মোটা অর্থ ফেলেছি তুলে এনেছি তার বহুগুণ অর্থ। তোমরা বলেছিলে, হঠাৎ আমার ওপর মা-লক্ষ্মী সদয় হয়ে উঠেছেন—কেননা একটি বাজীতেও না হেরে স্বল্পকালের মধ্যে কয়েক লক্ষ টাকার মালিক হওয়ার এরকম নজীর তোমাদের চোখে আর পড়েনি। কিন্তু আমার এ সৌভাগ্যের মূলে কি ছিল জানো?

বিচিত্র বর্ণের ঐ কেশগুচ্ছটি।

কাজটা খুবই সহজ। আমাকে সংগ্রহ করতে হয়েছিল শুধু একটুকরো কার্ডবোর্ড, আর তার ওপরে আঠা দিয়ে লাগিয়ে রেখেছিলাম একটি ছাড়া সব কটি দৌড়বাজ ঘোড়ার ফটোগ্রাফ—যেটির ফটো ছিল না, সেটির ওপরই বাজী ধরতাম আমার সর্বস্ব। তারপর দৌড় শুরু হওয়ার একটু আগে এসে বসতাম সুবিধামত নিরালা দেখে এক জায়গায়। এমন জায়গা বেছে নিতাম, যেখান থেকে সমস্ত রেসকোর্সটা পড়ে থাকত আমার চোখের সামনে।

ভাবছ বুঝি, রেসের ঘোড়াগুলোকে আমি জখন করে দিতাম? ভুল ধারণা! মারাত্মক রকমের আমি কিছুই করতাম না। শুধু ঘোড়াগুলো যখন দৌড়তে শুরু করত, আমি বিনুনিটি খুব আলতো ভাবে ফটোগুলোর ওপর দিয়ে বুলিয়ে নিয়ে যেতাম—ফলে ক্লান্তিবোধ ছাড়া ঘোড়াগুলোর আর কোন ক্ষতিই হত না। যদি দেখতাম, তা সত্ত্বেও কোন তেজী ঘোড়া আমার প্ল্যান বানচাল করার চেষ্টা করছে, তখন আবার একটু মোলায়েম স্পর্শ—ব্যস!

দৌড়ের মাঝে সব কটি ঘোড়াই যেন ক্লান্ত হয়ে না পড়ে আর দৌড় যেন পও না হয়ে যায়—সেজন্য আমি গোড়া থেকেই বেশ সতর্ক থাকতাম। একটা ছাড়া সব কটি ঘোড়াই যদি ভূমিশয্যা গ্রহণ করে, অথবা থেমে গিয়ে ছটফট করতে থাকে—তাহলে রেস বাতিল হয়ে যাবার সম্ভাবনা খুবই বেশি। সুতরাং রীতিমত নৈপুণ্যের সঙ্গে চুলের গোছা ব্যবহার করেছি প্রতিবার, আর ঘরে এনেছি রাশি রাশি অর্থ।

কিন্তু এজন্যে আগে থেকেই আমায় দিতে হয়েছিল তিন-তিনটি মহড়া। আর প্রতিটিই হয়েছিল অতীব চমৎকার।

এই সময় থেকেই আমার মানস-তটে আছড়ে পড়তে লাগল একটির পর একটি পরিবর্তনের ঢেউ। তোমার কাছে সবই আজ স্বীকার করতে বসেছি—গোপন কিছুই করব না। সাধারণ মধ্যবিত্তের অনটনের মধ্য থেকে অপরিমেয় ক্ষমতা আর অর্থ-প্রাচুর্যের মধ্যে এসে পড়লে পরিবর্তন আসাটা স্বাভাবিক। আমি যে শুধু বৈভব-স্রোতেই গা ভাসালাম, তা নয়, সেই সাথে বিস্মৃত হলাম আমার আজম্মের শিক্ষা—নৈতিক নিষ্ঠা। ভুলে গেলাম আমার চরিত্রের বলিষ্ঠতা আর আদর্শ, ভুলে গেলাম আমার বিবাহিত জীবনের কর্তব্য।

আমি মদ ধরলাম, একদিনেই আসক্তি আমার আসেনি। মনটা যখন বেজায় খুশি হয়ে উঠত—তখন খুশির মাত্রায় আরও দু’এক পদা রঙ চড়াবার অভিলাষে দু’এক চুমুক রঙিন পানীয়ের আস্বাদ গ্রহণ করতাম। যত দিন যেতে লাগল, অর্থ আসতে লাগল স্রোতের মত, আর ততই ধীরে ধীরে মনের যেটুকু বাধা ছিল, তাও গেল মুছে। বিজয় গৌরবে উল্লসিত হয়ে মদ খাওয়াটা তখন প্রায় নিত্য-কর্মেই দাঁড়িয়ে গেল। এজন্যে কোনদিন আর অনুভব করিনি কোন মানি। সুমিতা প্রথমটা ধরতে পারেনি—তারপর যখন পানীয়ের মাত্রা সীমা ছাড়াল, সুমিতার আর কিছুই অজ্ঞাত রইল না। কিন্তু ভাই আশিস্‌, তার মত স্ত্রী পাওয়া বহু জন্মের পুণ্যের ফল। সে রাগ করেনি, রুক্ষ কথা শোনায়নি, অভিমান করেনি। শুধু গভীর দুটি বড় বড় চোখে নীল সায়রের মত অশ্রুধারা দুলিয়ে আমাকে মিনতি করেছে, দুটি পা চোখের জলে ধুইয়ে দিয়েছে—কিন্তু তবুও আমার চৈতন্য হয়নি। হেসে তার মিনতিকে উড়িয়ে দিয়েছি বলেছি—খাচ্ছি তো একটা খাবারই জিনিস। অখাদ্য তো নয়, কেন এত ভাবছ বল তো? আর যে কত কি বলেছি—তা মনে নেই। কিন্তু জানোই তো যার ওপর সুরার ক্রিয়া একবার হয় শুক—ধীরে ধীরে লুপ্ত হয়ে আসে তার স্বাভাবিক বুদ্ধিবৃত্তি আর চৈতন্য বোধ। এই রকমই এক রঙিন নেশাভরা মুহূর্তে সুমিতা চোখের জলে দুটি গাল ভাসিয়ে আমাকে কাকুতি মিনতি করে বলছিল এ জিনিস ত্যাগ করতে—ওইরকম একটা সুন্দর আমেজভরা মিষ্টি মুহূর্তে কানের কাছে একঘেয়ে কান্না শুনতে শুনতে হঠাৎ কেমন জানি মেজাজটা বিগড়ে গেল। বললাম, আমার স্ত্রী তুমি, তুমি আমার সহধর্মিনী। যে ধর্ম আমার, সে ধর্ম তোমারও। অতএব—

এরপর যা হল তা লিখে আর লেখনী কলঙ্কিত করতে চাই না। সুমিতার মুখে শেষ পর্যন্ত এক ফোঁটা হুইস্কিও ঢালতে পারিনি। কিন্তু সেদিন তার যা মূর্তি দেখেছিলাম—জীবনে আর দেখিনি সে মূর্তি। এখনও যেন চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি তাকে—তার মুখ অশ্রুসিক্ত, চুল এলোমেলো আর অঙ্গের বসন বিশ্রত। কণ্ঠে তার সে কি তীব্রতা। যেটুকু চৈতন্য আমার জেগেছিল—এরপর সেটুকুও যেন লোপ পেল। কি সে বলেছিল মনে নেই—শুধু মনে আছে মাথার মধ্যে যেন দাউ দাউ করে জ্বলে উঠেছিল নরকের আগুন। চিৎকার করে বলেছিলাম, তবে দেখ আমার ক্ষমতা—মদ তোমাকে আজ খাওয়াবই! চক্ষের পলকে আলমারি থেকে টেনে বার করলাম পারিবারিক অ্যালবাম। আর পকেট থেকে চুলের গোছাটা বার করে চেপে ধরলাম ফটোটির ওপর…

তুমি জানো, ডাক্তার বলেছে, হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে সুমিতা মারা গেছে। হৃদরোগ তার সত্যই ছিল—অতখানি উত্তেজনার পর শক্তির ওই আকস্মিক আঘাত তার দুর্বল হৃদযন্ত্র বহন করতে পারেনি—চিরতরে নিস্পন্দ হয়ে গেছে।

তারপরে দিনের পর দিন গেছে কেটে, সপ্তাহের পর সপ্তাহ। রাতের নিদ্রা আমায় ত্যাগ করেছে, অনুভব করতে পারি না ক্ষুধা-তৃষ্ণার জ্বালা। চোখ বুজলেই চোখের সামনে দেখি উস্কোখুস্কো কেশে বিশ্ৰস্ত-বসনা বিস্ফারিত-চক্ষু সুমিতার সেই মূর্তি—যে মূর্তি জীবনে একবারই দেখেছিলাম। আর চোখ খুললেই মাথার মধ্যে অনুভব করি এক যন্ত্রণা; দিবানিশি একটি চিতা অক্টোপাশের মত মারণ-বাহু দিয়ে আঁকড়ে রয়েছে আমার মস্তিষ্কের স্নায়ুগুলোকে—নির্মল, নিষ্ঠুর, নির্দয়ভাবে শোষণ করছে, পেষণ করছে আমার মস্তিষ্ককে। আমার স্ত্রীর হত্যাকারী আমি স্বয়ং শ্রীবিবেক রায়। এ ছাড়া আর কোন চিন্তা আমার নেই। বুঝতে পারছি, আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি। দিবারাত্র বিড় বিড় করে কি সব বকি—ভালবাসি নির্জনে থাকতে—এমন কি রাধুও সামনে এসে পড়লে উঠি আঁৎকে—এই বুঝি সে ধরে ফেলল আমার অপরাধ। আমি বেশ বুঝতে পারছি, আমার চিন্তাধারা বিকৃত হয়ে যাচ্ছে—আমি উন্মাদ হয়ে যাচ্ছি। কিন্তু তার আগেই লিখে রেখে গেলাম আমার স্বীকৃতি। বিশ্বাস করো আর নাই করো, যে মহাপাপ আমি করেছি—তার শাস্তি দেবার আয়োজন করেছেন বিধাতা স্বয়ং সারাটা জীবন ধরে। কিন্তু আমি পারব না, পারব না—এ শাস্তি সারা জীবন ধরে বহন করতে আমি পারব না!

ইতি—

তোমার বিবেক

স্ত্রী-শোকে সত্যই বেচারা একেবারে উন্মাদ হয়ে গেছে।

চিঠিটা ভাঁজ করতে করতে বললাম আমি।

ওগো, না, তোমার দুটি পায়ে পড়ি—এখুনি চল। আমার কেমন জানি মনে হচ্ছে—একটা বিষম বিপদ এখুনি ঘটবে। বলতে বলতে রমিতার দুই চোখ জলে ভরে ওঠে।

কয়েক মিনিটের মধ্যেই আমরা পৌঁছলাম বিবেকের প্রাসাদে। তিনতলায় ওর কক্ষ। দরজা বন্ধ ছিল—ঠেলা দিতেই খুলে গেল।

প্রথমে ঘরে কাউকে চোখে পড়ল না। নিবিড় নৈঃশব্দে ঘরের আবহাওয়া থমথমে হয়ে উঠেছে। টেবিলের ওপর রক্ষিত একটিমাত্র টেবিল-ল্যাম্পের মৃদু নীলাভ আলোয় রহস্যঘন আলো আঁধারিতে ভরে উঠেছে ঘরের কোণগুলি।

চারদিকে ভাল করে চোখ বোলাতে গিয়ে দৃষ্টি আকৃষ্ট হল পালঙ্কের ওপর শায়িত একটি দেহের ওপর। এগিয়ে গেলাম।

বহুদিন ধরে অযত্নবর্ধিত দাড়ি-গোঁফে মুখ আচ্ছন্ন থাকলেও, বিবেককে চিনতে আমাদের দেরি হল না। সে যেন গভীরভাবে ঘুমোচ্ছ। শান্ত মুখশ্রী। কপালের ডানদিকে একটা বীভৎস রক্তবর্ণ ক্ষতচিহ্ন—চিহ্নটিকে বলয়াকারে বেষ্টন করে রয়েছে নীলচে কালসিটার সুস্পষ্ট চিহ্ন।

পাশেই পড়ে রয়েছে একটা ফটোগ্রাফ। আলোর কাছে ধরলাম সেটি। বিবেকের ফটো। তার প্রশস্ত ললাটের মাঝে বিদ্ধ একটা পিন আর একটা চুলের গোছা।

পিনটা আর কেশগুচ্ছটা সরিয়ে আনতে যা দেখলাম, তাতে আমার মেরুদণ্ডের মধ্য দিয়ে হিম-শীতল একটা স্রোত বয়ে গেল।

ফটোতে বিবেকের ললাটে উজ্জ্বল হয়ে জেগে রয়েছে একটা রক্তবর্ণ চিহ্ন!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *