চুলকানি দিয়ে শুরু – রবার্ট শেকলে

চুলকানি দিয়ে শুরু – রবার্ট শেকলে

কাল রাতে এক অদ্ভুত স্বপ্ন দেখেছি। স্বপ্নে দেখলাম যেন এক অচেনা কণ্ঠ আমাকে কা বলছে– মধুর স্বপ্ন ভাঙিয়ে দেবার জন্যে আন্তরিক দুঃখিত। কিন্তু আমার সমস্যা আরও গুরুতর। একমাত্র আপনিই আমাদের বাঁচাতে পারেন।

স্বপ্নের মধ্যে আমি বলেছিলাম– না না… কিন্তু কিন্তু করার কিছু নেই… আর আমি কখনওই মধুর স্বপ্ন দেখি না… যাই হোক, আমার দ্বারা আপনাদের কোনও উপকার হলে সে কাজ কেন করব না?

–আপনার উপযুক্ত কথাই বলেছেন। একমাত্র আপনি, আপনিই সাহায্য করতে পারেন… নয়ত আমি এবং আমাদের লোকজন, শহর সভ্যতা সব ধ্বংস হয়ে যাবে।

আমি বলেছিলাম, ঈশ্বর তুমি রক্ষা করো।

…নাম ওর ফ্রোকা… এক অতি প্রাচীন জাতির বংশধর। এক প্রকাণ্ড পাহাড়ের কোলে বিস্তৃত উপত্যকায় ওদের বসবাস সে কোন অনাদিকাল থেকে সেটা কেউ জানে না। অতি শান্তিপ্রিয় জাতি। সভ্যতার অগ্রগতির সময়ের সঙ্গে শিল্পকলায় প্রভূত উন্নতি করে ওরা। আধুনিক শাসন ব্যবস্থায় ওদের সমাজ চালিত হয়… উত্তরপুরুষরা অতিরিক্ত শান্তিপ্রিয় মিষ্টভাষী এবং ধর্মপরায়ণ। সব জাতির মতো এদের মধ্যেও কুলাঙ্গার কয়েকজন আছে, তবে তারা খুবই নগণ্য। হিংসা দ্বেষ কাকে বলে এরা তা জানে না।

আমি বাধা দিলাম। বললাম, ইতিহাস বলে সময় নষ্ট না করে ব্যাপারটা বলে ফেলো দেখি!

সঙ্গে সঙ্গে ক্ষমা চেয়ে নিল ফ্ৰোকা। বলল যে ওদের সমাজে এটাই নিয়ম… কোনও কথা বলার আগে পশ্চাতের কাহিনিটাও শোনাতে হয়। বলতে হয় ওদের নৈতিক দাবি তথা… কতটাই বা তা যুক্তিযুক্ত।

–বেশ, বুঝলাম। এবার আসল সমস্যাটা বলে ফেলো ভাই।

এক বুক গভীর শ্বাস নিয়ে ফ্ৰোকা আরম্ভ করল। যা বলল তার মর্মকথা হল যে, প্রায় কয়েকশো বছর পূর্বে (এই সময়জ্ঞান অবশ্যি ফ্রোকাদের মতে) বিশাল এক রক্তবর্ণ হলুদ দণ্ড মহাকাশ থেকে নেমে এসেছিল… অজানা ভগবানের মূর্তির খুব কাছে… আর তিন নম্বর বড় শহরের সিটি হলের ঠিক সামনের মাঠে।

দণ্ডটা সম্পূর্ণ মসৃণ না হলেও প্রায় গোলাকৃতি… ব্যাসের পরিমাপ প্রায় দু’ মাইল। (অবশ্যি ফ্রোকাদের মাপে)… দণ্ডটির দৈর্ঘ্য এতই বিশাল যে, ওদের যন্ত্রে নাগাল পাওয়া যায়নি। ওদের মতে এটা এক প্রাকৃতিক ভ্রষ্টাচার ছাড়া আর কিছুই নয়। নানা পরীক্ষা করার পর ওরা বুঝেছিল যে, ঠান্ডা, গরম, জীবাণু, এমন কি প্রোটন বোম্বাৰ্ডমেন্টেও দণ্ডটির কোনও পরিবর্তন হয়নি। নিশ্চল নিশ্চুপ ভয়ঙ্করের প্রতিভূর মতো সেটা দণ্ডায়মান ছিল পাক্কা পাঁচমাস উনিশ ঘণ্টা ছ’মিনিট।

এরপরেই ঘটল দুর্যোগ… অজানা কারণে হঠাৎ একদিন দণ্ডটি উত্তর-উত্তর পশ্চিমদিকে ক্রমাগত সরে যেতে থাকে। সেই গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ৭৮.৪৪১ মাইল। (ফ্রোকাদের গতিবিদ্যা অনুসারে) এর ফলে মাটিতে ১৮৩.২২৩ মাইল দীর্ঘ এবং ২,০১১ মাইল বিস্তৃত এক গভীর ক্ষতের সৃষ্টি হয়। এরপরেই নিমেষে মহাকাশে মিলিয়ে যায় ওই দণ্ডটি।

এই নিয়ে বিজ্ঞানীদের একাধিক সভাসমিতি হয়েছে, কিন্তু কোনও স্থির সিদ্ধান্তে আসা। যায়নি। অবশেষে বিজ্ঞানীরা এটাকে অপ্রাকৃত একটি ঘটনা বলে অভিহিত করেন।

কিন্তু প্রায় একমাস পরে দণ্ডটি পুনরায় আবির্ভূত হয়… এবারে অকুস্থল রাজধানী। ঘণ্টায় ৮২০.৩৩১ মাইল গতিতে এলোমেলোভাবে ছুটে চলে যায়। যায় ফলে অপূরণীয় ক্ষতি হয়। অসংখ্য প্রাণহানি ঘটে।

আবার দু’মাসের মাথায় দণ্ডটি নেমে আসে এবং তিনটি শহরকেই ধ্বংসস্তূপে পরিণত করে।

এবারে সবাই সচেতন হয়ে ওঠে। সকলের কাছে পরিষ্কার হয়ে যায় যে, শুধু কিছু ধনসম্পত্তি নষ্ট বা প্রাণহানি নয়, সম্পূর্ণ সভ্যতাটাই নিশ্চিহ্ন হওয়ার পথে… যুক্তি বুদ্ধি জ্ঞানের বাইরে কোনও এক প্রাকৃতিক দুর্ঘটনা অতি পুরাতন এক সভ্যতাকে বিলীন করে। দিতে চায়।

এই খবর ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে জনসাধারণের মনে নিরাপত্তার অভাব জাগে… জনসাধারণ আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে আত্মকলহে ডুবে যায়।

চতুর্থবারে দণ্ডের আক্রমণ হয় রাজধানীর পূর্বদিকে অনাবাদী জমির ওপরে ক্ষয়ক্ষতি যৎসামান্য হলেও জনগণ একযোগে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে ওঠে… ফলে আত্মহত্যার ঘটনা অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায়।

ক্রমেই অবস্থা আয়ত্তের বাইরে চলে যায়… বিজ্ঞানীদের সঙ্গে সঙ্গে এবার যোগ দেয়। অপবিজ্ঞানীর দল… কিন্তু কোনও ফল হয় না… অতি প্রাচীন শহর আজ এখন শুধু ভাঙাচোরা ইট কাঠের স্তূপ। অন্য দুটো শহরও–

ব্যস ব্যস… অনেক শুনেছি। তোমাদের করুণ অবস্থা শুনে আমার হৃদয় ফেটে যাচ্ছে।… কিন্তু এখানে আমার ভূমিকা কোথায়?

হ্যাঁ এইবার সেই প্রসঙ্গেই আসছি। অজানা কণ্ঠ বলে ওঠে।

চটপট বলে ফেলো, তোমার কথা বলার ব্যাপারটা যেন আর শেষ হয় না। এবার চট করে বলে না ফেললে পরে সময় পাবে না… মনে হচ্ছে আমার ঘুম ভাঙব ভাঙব করছে। যে কোনও সময়ে আমি জেগে উঠতে পারি।

আপনি ঠিকই বলেছেন। কিন্তু সমস্ত ঘটনা বিস্তারিত না বললে আপনার বুঝতে অসুবিধে হবে… আসলে আমি একজন অ্যাকাউন্টটেন্ট… কিন্তু আমার হবি হল নানান অপ্রাকৃত ঘটনার অনুসন্ধান করে সত্যের সন্ধান করা। এর জন্যে আমি অনেক কিছুরই সাহায্য নিই। এমনকি মানসিক কল্পনাও আমাকে অনেক সাহায্য করে। ইদানীং আমি এক রাসায়নিক পদার্থ নিয়ে কাজ করছিলাম… আমরা বলি কোলা… যা অন্ধকারেও জ্বলজ্বল করে…

হ্যাঁ হ্যাঁ… আমাদেরও এমন পদার্থ আছে! বলো বলো তারপর কী হল?

এরপর আমি বুঝলাম যে, আমাদের পৃথিবী অনেক স্তরের ওপর নির্ভরশীল যেমন… অ্যাটমিক, সাব-আটমিক, ভাইব্রেশনারি প্লেন, এবং বাস্তবতার একাধিক স্তর… এরাই আবার সকলে সকলেরই অংশবিশেষ।

এসব আমার জানা… এই ক’দিন হল আমাদের পৃথিবী সম্বন্ধে আরও কিছু সত্য বুঝতে পারলাম।

হ্যাঁ… হ্যাঁ… আপনার মতো আমিও বুঝতে পারলাম যে, আমাদের কোনও এক স্তরে বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছে।

আরও স্পষ্ট করে বলবে কি?

আমার অনুমান হল আমাদের জগতে মলিকিউলার স্তরে কোনও অনুপ্রবেশ ঘটেছে।

–অসম্ভব! অনুপ্রবেশটা সঠিকভাবে নির্ণয় করতে পেরেছ?

মনে হয় পেরেছি। কিন্তু আমি কোনও প্রমাণ দিতে পারব না… এ সব কিছুই আমার ইনটুইশান!

আরে আমিও তো ইনটুইশানে বিশ্বাস করি। বলো বলো… এরপর কী আবিষ্কার করলে তা বলো!

হ্যাঁ সেটাই বলছি স্যার… ইনটুইশানের ওপরে নির্ভর করেই বুঝতে পারলাম যে, আপনাদের অনুবীক্ষণ যন্ত্রের মাধ্যমে দেখা পরজীবী জীবাণুর জগতই হচ্ছে আমাদের পৃথিবী… আমরা সকলে।

কী! কী বললে… আর স্পষ্ট করে বলো!

বেশ, বলছি। আমি আবিষ্কার করলাম যে, আমাদের বাস্তবতার একটি স্তর হিসাবে আপনার বাঁ হাতের তর্জনীর দ্বিতীয় আর তৃতীয় গাঁটের মধ্যবর্তী অংশটাই আমাদের পৃথিবী… আমাদের এই পৃথিবীর অস্তিত্ব প্রায় কয়েক লক্ষ বছর… অবশ্যই আমাদের হিসাবমত… আপনাদের কাছে এই সময়টা কয়েক মিনিটের সমতুল্য… আমি অবশ্য আপনাকে দোষারোপ করছি না।

বুঝেছি… বুঝেছি… সব বুঝেছি… মোদ্দা কথা হল যে, আমার বাঁ হাতের তর্জনীর দ্বিতীয় আর তৃতীয় গাঁটের মধ্যবর্তী অংশটাই হল তোমাদের পৃথিবী… আর তোমরা হচ্ছ জীবাণুর দল… বেশ এবার বলো আমায় কী করতে হবে!

আমার মনে হয় স্যার, বর্তমানে আপনি আপনার তর্জনীর ওই অংশটা চুলকিয়েছেন… ওটাই আমাদের জগৎ কিনা?

চুলকিয়েছি?

হ্যাঁ স্যার। আমার অনুমান বলে…

আর রক্তবর্ণ ধ্বংসের তাণ্ডব-দণ্ডটা আমার হাতের আঙুল?

যথার্থ বলেছেন। আপনার অনুমান…

থামো। তুমি কি আমাকে চুলকোতে নিষেধ করছ?

ঠিক তাই। তবে এমন অনুরোধ করাটা অসমীচীন আমি বুঝতে পারছি… কিন্তু আমাদের পৃথিবীকে সমূহ ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করার এ ছাড়া যে আর কোনও পথ নেই স্যার। আর সেই জন্যে আমাদের সমস্ত জাতির পক্ষ থেকে…

ক্ষমা চাইবার কী আছে? হ্যাঁ? সচেতন জীবদের পরের উপকার করাই ধর্ম! এতে লজ্জার কিছু নেই ভাই।

আপনার উপযুক্ত কথাই বলেছেন। আমরা না-মানুষের দল… পরজীবী জীবাণুমাত্র… আপনাদের কাছে আমাদের দাবি শোভা পায় না।

–আপনারা যে সচেতন জীব এ জানার পর আমারই লজ্জা হচ্ছে… সচেতন জীবদের পরস্পরের প্রতি টান থাকা প্রয়োজন। যাই হোক… কথা দিলাম আমি আর চুলকোব না… যতদিন বাঁচব বাঁ হাতের তর্জনীর দ্বিতীয় আর তৃতীয় গাঁটের মাঝে আর কোনওদিন চুলকোব না!

–মনে রাখবেন স্যার… দ্বিতীয় আর তৃতীয় গাঁটের মধ্যবর্তী স্থান!…

–বেশ… বাঁ হাতের কোনও গাঁটের মাঝেই আর চুলকোব না… হল তো? বুঝলে এ আমার প্রতিজ্ঞা… আমৃত্যু এই কথার নড়চড় হবে না।

–স্যার… আপনার অসীম করুণা… আমাদের পৃথিবীকে বাঁচিয়ে দিলেন… ধন্যবাদ দিয়ে আপনাকে আর ছোট করব না… কিন্তু আমাদের সমস্ত জাতির কৃতজ্ঞতা রইল।

–এসব বলে ছোট কোরো না আর… লজ্জায় লাল হয়ে বলে ফেললাম। অদৃশ্য কণ্ঠস্বর স্তব্ধ হয়ে গেল। আমি ঘুম থেকে জেগে উঠলাম।

…স্বপ্নের কথা মনে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে তর্জনী জুড়ে ব্যান্ড-এড লাগিয়ে দিলাম… এর পরও ওই স্থানে আরও সুড়সুড় চিনচিন করেছিল।.. কিন্তু নিজেকে দমন করেছি… আর চুলকোইনি… সারাদিন হাতে আমার ব্যান্ড-এড জড়ানো ছিল।

পরের দিন সকালে ব্যান্ড-এড তোলার আয়োজন করলাম। ভাবলাম এতক্ষণে ফ্রোকাদের নিশ্চয় কয়েক কোটি বছর কেটে গেছে… আর যে কোনও জাতির পক্ষেই এই সময়টা নেহাৎ কম নয়।

আমার সমস্যা কিন্তু এটা নয়। আমার সমস্যা হল ইদানীং কিছুকাল ভূমিকম্প নিয়ে আমার এক অস্বস্তিকর ইনটুইশন, বিশেষত স্যান অ্যান্ড ড্রিজ ফল্ট বরাবর… এবং পুনরায় মেক্সিকোর আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত সংক্রান্ত… মনে হল নিখিল বিশ্বচরাচর যদি ঈশ্বরের বহিঃপ্রকাশ হয়, তাহলে এই অংশটা ঈশ্বরের দেহের কোনও স্থান…

বুঝতে পারছি… এসব আমার পাগলামি, কিন্তু ঈশ্বরের কাছে আমরা কি জীবাণু-তুল্য পরজীবী নই? ভাবনা একটাই, ঈশ্বরও কি স্বপ্ন দেখেন?