চুরি বিদ্যা ও বিদ্যা চুরি
সিঁধেল চুরি করা যেমন চৌর্যবৃত্তি, ব্যাংকের টাকা চুরি করাও চৌর্যবৃত্তি। তেমনি মানুষের কথা, ভাবনা কিংবা উদ্ভাবন চুরি করাও চৌর্যবৃত্তি। কথা, লেখা, সুর, উদ্ভাবন-আবিষ্কার এগুলো হলো বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পত্তি (Intelectual Properties)। বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পত্তির মালিক থাকে। স্বত্বাধিকারী থাকে। মালিকের অনুমতি ছাড়া সেটাকে নিজের নামে কিংবা বেনামে ব্যবহার করা অপরাধ। অন্যায়।
সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষকের বিরুদ্ধে কুম্ভিলতার (Plagiarism) অভিযোগ উঠেছিল। এই কুম্ভিলতা অবশ্য দেশে অহরহ হচ্ছে। বহু কর্মকর্তা-কর্মচারী প্রমোশনের জন্য এই কাজটি করছেন। নামে-বেনামে, ভিত্তিহীন, অস্তিত্বহীন জার্নালে আর্টিকেল প্রকাশ করছেন। সেসব পাবলিকেশন দেখিয়ে প্রমোশন নিচ্ছেন। আমরা আদতে চৌর্যবৃত্তির চক্রেই বাস করছি। ছেলেমেয়েরা পাসের জন্য প্রশ্ন চুরি করেন আর তাদের পথপ্রদর্শকেরা প্রমোশনের জন্য গবেষণাকর্ম চুরি করেন।
আমি গবেষণা করে সেটার ফলাফল নির্দিষ্ট জার্নালে প্রকাশ করি। সেসব কাজ যদি কেউ আমার নাম উল্লেখ না করে ব্যবহার করেন, তাহলে সেটা হলো কুম্ভিলতা বা চৌর্যবৃত্তি। এই কাজ করলে মৌলিকত্ব নষ্ট হয়। অজ্ঞতা ও অকৃতজ্ঞতা প্রকাশ পায়। স্বত্বাধিকার হুমকিতে পড়ে। তাই কুম্ভিলতারও শাস্তি আছে। যক বছর আগে রসায়নের এক প্রফেসর কুম্ভিলতার জন্য। ভক্ত হয়েছিলেন। আমেরিকান কেমিক্যাল সোসাইটি (ACS) তাকে চিরদিনের জন্য নিষিদ্ধ করেছে। তিনি এসিএসের কোনো জার্নালে কোনো দিন তার গবেষণাকর্ম প্রকাশ করতে পারবেন ল। এবং যে বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকাকালীন তিনি সেটা করেছেন, সে। বিশ্ববিদ্যালয় তাকে বিদায় দিয়েছে। উন্নত সমাজে কুম্ভিলতাকে শক্ত হাতে দমন করা হয়।
চরি করার কৌশলই হলো চুরি বিদ্যা। মানুষ জন্মগতভাবেই। সম্ভবত সেটা নিয়ে আসে। যে চুরি করে না, সেও জানে চুরি কীভাবে করতে হয়। তবে সে বিদ্যা প্রয়োগ করাই অপরাধ। মানুষ খাদ্য চুরি করে, অর্থ চুরি করে। এই যে দুর্নীতি, ব্যাংক চরি, অর্থ চুরি এগুলো সারা দুনিয়াতেই হয়েছে। হচ্ছে। তবে সবচেয়ে ভয়ংকর হলো বিদ্যা চুরি। বিদ্যা চুরি করলে সমাজ মূল থেকে পচে যায়। নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। যে সমাজে বিদ্যা চুরি হয়, সেখানে সত্যিকারে বিদ্বান-বিদগ্ধরা থাকেন না। থাকতে পারেন না। কারণ, বিদ্যা চুরি করা লোক বিদ্বানের মূল্যায়ন করতে জানেন না। তার অস্তিত্ব ধরে রাখার জন্য, তার চেয়ে নিম্নমানের কাউকে দরকার হয়!
আমাদের দেশে যে গবেষণা হচ্ছে, সেগুলো যেভাবে-সেভাবে যেখানে-সেখানে প্রকাশ করা হচ্ছে, সেসব প্রকাশনা দেখিয়ে প্রমোশন হচ্ছে। এগুলো দেখার কি শক্ত কোনো অভিভাবক আছে? নেই। অভিভাবকহীন কোনো সমাজ উর্বর হয় না। আমার পিএইচডির প্রফেসর হলেন সুইডিশ রয়েল একাডেমির নির্বাচিত। ফেলো। ডিপার্টমেন্টের প্রফেসর ব্যাকভাল ছিলেন রসায়নের। নোবেল কমিটির সভাপতি। ইউপ্যানের পোস্টডক প্রফেসর হলেন আমেরিকান কেমিক্যাল সোসাইটির জার্নালের এডিটর। তাদের দেখেছি, কী করে অভিভাবকত্বের দায়িত্ব পালন করতে হয়। কী ম পূণকে দমন করতে হয়। মুখরা ক্ষমতাকে ব্যবহার করে নিজের জন্য। জ্ঞানীরা সেটা করেন সমাজের জন্য। সে অভিভাবকত্ব কি আছে আমাদের?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনাকে যারা তদন্ত করছেন, তারা যদি সত্যি সত্যি কোনো অপরাধ পেয়ে থাকেন তাহলে যেন। কঠোরভাবে সেটা দমন করেন। বিদ্যা চুরির হাত থেকে বাঁচান এ সমাজ! প্লিজ!!