চুরি না বাহাদুরি – নগেন্দ্রনাথ গুপ্ত
প্রথম পরিচ্ছেদ
অনেকদিন পর বাড়ি যাইতেছিলাম। দুই বৎসরের অধিক প্রবাসে অর্থোপার্জন করিতেছিলাম। দুই বৎসরের সঞ্চিত অর্থ সঙ্গে লইয়া দেশে যাইতেছিলাম। রেলের পথে দুই দিন লাগে। অবশিষ্ট পথ গাড়ির ডাকে আসিয়াছিলাম। রেলে উঠিয়া অতিশয় সাবধানে যাইতেছিলাম। সঙ্গে যে অর্থ ছিল, তাহার অধিকাংশ নোট। সেগুলি বাক্সে অথবা ব্যাগে রাখিতে সাহস হয় নাই। কোমর হইতেও অনেক টাকা অনেক সময় চুরি যাইতে শুনিয়াছি। সেজন্য নোটগুলি বাঁধিয়া একখানা বড় রেশমের রুমালে পৈতার মত করিয়া কাঁধে বাঁধিয়াছিলাম। নোটের তাড়া বুকের উপর রহিল, তাহার উপর কাপড়-চোপড় পরিলাম। আমার অজ্ঞাতে টাকা চুরি যাইবার আর কোন ভয় রহিল না। দিব্য নিশ্চিন্ত হইয়া রেলে উঠিলাম। পথ-খরচের যে কয়টা টাকা আবশ্যক, তাহা একটা কুরিয়র ব্যাগে ছিল, রাত্রে সেটা মাচার তলায় রাখিলাম। সেটা গেলেও বিশেষ ক্ষতি হইত না।
ঘোড়ার গাড়িতে যতটা পথ আসিয়াছিলাম কোন ভয়ই ছিল না। সে অঞ্চলে লোকে আমাকে বিলক্ষণ চিনিত। কাজকর্মের উপলক্ষে সে-পথে আমার প্রায়ই যাওয়া আসা ঘটিত। সঙ্গে কিছু টাকা আছে জানিয়া কয়েকজন চাপরাসী সঙ্গে আনিয়াছিলাম, তাহারা আমাকে রেলে তুলিয়া ফিরিয়া গেল। রেলের পথ যে নির্বিঘ্নে কাটিয়া যাইবে, তাহাতে আমি কোন সন্দেহ করি নাই।
যে শ্রেণীর গাড়িতে আমি চড়িয়াছিলাম, তাহাতে অধিক লোকজন উঠে না। আমি প্রায়ই একা ছিলাম, কখনো কখনো দুই একজন উঠে আবার দুইচার স্টেশন পরে নামিয়া যায়। দীর্ঘকালের জন্য সঙ্গী না থাকাতে আমি বরং খুশি হইলাম। যতই একা থাকি ততই নিশ্চিন্ত থাকি। বিশেষ যে কোন ভয় হইতেছিল তাহা নহে। তবে আর কেহ আমার গাড়িতে আসিলেই মনটা খুঁতখুঁত করিতেছিল, যে আসিতেছিল তাহাকেই যে চোর মনে হইতেছিল এমত নহে, হয়তো তাহাদের মধ্যে অনেকে আমার অপেক্ষাও ভদ্রলোক, হয়তো আমার পক্ষে চুরি করা যেমন সম্ভব, তাহাদের পক্ষে চুরি করা তাহার অপেক্ষা কম সম্ভব। কিন্তু বিচার করিয়া মনকে বুঝানো যায় না। যখন কেহ আমার গাড়িতে আসে আমি তখনই মনে করি, কেন, এই বই কি আর অন্য গাড়ি নাই? মুখে কিছু বলিতে পারি না। কি করিয়াই বলিব? একখানি টিকিট লইয়া একখানা গাড়ি সমুদয় দখল করিবার আমার অধিকার কি?
প্রথম দিন নির্বিঘ্নে কাটিয়া গেল। আর এক রাত্রি কাটিলেই বাড়িতে পঁহুছি। কত কথাই মনে পড়িতে লাগিল। বাড়িতে আত্মীয় বন্ধুদিগের পুনদর্শন লালসা যেন কত প্রবল হইয়া উঠিল। আর একটা দিন যেন কাটে না। এত দিনের পর সহধর্মিনীকে কি করিয়া সম্ভাষণ করিব তাহাই ভাবিতে লাগিলাম। শেষবারের চিঠি পকেটে ছিল, বাহির করিয়া আবার পড়িতে লাগিলাম। ছেলে দুটির মুখ মনে পড়িতে লাগিল। তাহারা এখন কত বড় হইয়াছে? আবার কি আমায় চিনিতে পারিবে? বড়টি বোধহয় চিনিতে পারিবে। ক্রমে ক্রমে আর সব ভুলিয়া গেলাম। প্রিয়জনদিগের পরিচিত কন্ঠরব অস্পষ্ট ভ্রমর গুঞ্জনের ন্যায় শ্রবণে পশিতে লাগিল। প্রিয়তমার আলিঙ্গন স্পর্শ যেন হৃদয়ে অনুভব করিতে লাগিলাম। সন্তানের মুখচুম্বন শব্দ শুনিলাম। বন্ধুদিগের সাদর সম্ভাষণ শুনিলাম, সস্নেহ আগ্রহ সহস্র প্রশ্ন শুনিতে পাইলাম। অনতিদূর ভবিষ্যতের গাঢ় কল্পনায় বর্তমান বিস্মৃত হইলাম।
সন্ধ্যা হইয়া আসিল। মাঠের ভিতর দিয়া, পুষ্করিণীর সম্মুখ দিয়া, নদীর উপর দিয়া গাড়ি চলিতে লাগিল। ক্রমে ক্রমে সন্ধ্যার অন্ধকার চারিদিক আচ্ছন্ন করিল। আকাশে একে একে নক্ষত্র উঠিতে লাগিল।
অন্ধকার হইলে গাড়ি একটা স্টেশনে লাগিল। আমি এককোণে বসিয়া নিজের ভাবনায় মগ্ন ছিলাম। এমন সময় স্টেশনের একজন লোক গাড়ির দরজা খুলিল। আমি মনে মনে অত্যন্ত বিরক্ত হইয়া আরও কোণ ঘেঁসিয়া বসিলাম। শেষ রাত্রিটা যে একলা থাকিব, তাহার যো নাই। আবার একজন সঙ্গী জুটিল। কিছুক্ষণ আমার সঙ্গীর কোন চিহ্ন দেখিতে পাইলাম না। কেবল জিনিসপত্র গাড়িতে বোঝাই হইতে লাগিল। একজন লোককে গাড়িতে এত জিনিসপত্র লইয়া উঠিতে আমি কখনও দেখি নাই। গাড়ির মধ্যে একটুও স্থান রহিল না। পোঁটলা পুঁটলি পর্বতের সমান হইয়া উঠিল। আমি বিস্মিত হইয়া একজন কুলিকে জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘কয়জন উঠিবে?’
‘একজন।’
‘একজনের এত আসবাব? ব্রেকভ্যানে কিছু দেওয়া হয় নাই কেন?’
কুলিরা অতশত জানে না। তাহাদের পয়সা লইয়া কাজ। ব্রেকভ্যানে তুলিলে তাহারা কিছু পায় না। তাহারা ব্যস্ত হইয়া আসবাবের স্তূপ সাজাইতে লাগিল। দেখিতে দেখিতে স্টেশন মাস্টার আরোহীকে সঙ্গে লইয়া আসিলেন। দরজা খুলিয়া স্টেশন মাস্টার বলিলেন, ‘মহাশয়, এই গাড়ি।’
লোকটা কৃষ্ণবিষ্ণুর মধ্যে হইবে। স্টেশন মাস্টার স্বয়ং গাড়িতে তুলিয়া দিতে আসিয়াছে।
আমাকে গাড়িতে দেখিয়াই সে ব্যক্তি যেন একটু অপ্রসন্ন হইল। স্টেশন মাস্টারকে জিজ্ঞাসা করিল, ‘খালি গাড়ি নাই? এ গাড়িতে যে লোক দেখিতেছি।’
স্টেশন মাস্টার কহিল, ‘আজ কিছু ভিড়। অন্য গাড়িতে আরও লোক। আপনার এই গাড়িতেই সুবিধা হইবে। আমি দেখিয়া শুনিয়াই আপনাকে এই গাডিতে উঠিতে বলিয়াছি।’
আর একদিকে স্টেশন মাস্টারের ডাক পড়িল। আমি মুখ বাড়াইয়া স্টেশন মাস্টারকে ডাকিলাম। সে ফিরিল। আমি বললাম, ‘মহাশয়, গাড়িতে যেরকম জিনিস বোঝাই হইয়াছে তাহাতে বসিবার স্থান পাওয়া ভার। কতক বোঝা ব্রেকভ্যানে পাঠাইলে ভাল হয়।’
স্টেশন মাস্টার উঁকি মারিয়া গাড়ির ভিতর দেখিল। বলল, ‘তাইত’, তারপর দ্বিতীয় আরোহীর দিকে চাহিয়া বলিল, ‘আপনি কি বলেন?’
সে লোকটি শশব্যস্তে কহিল, ‘তাহা হইবে না। আমার সমূদয় জিনিস আমার সঙ্গে যাইবে।’
স্টেশন মাস্টার আমার দিকে চাহিয়া একটু হাসিল। কহিল, ‘মহাশয়, আপনি ভদ্রলোক; এত মাল লইয়া গাড়িতে উঠিবার নিয়ম নাই বটে, কিন্তু আপনার বোধহয় অসুবিধা হইবে না। আর কেহ বোধহয় এ গাড়িতে উঠিবে না। আর সময়ও নাই। জিনিস বাহির করিতে, টিকিট মারিতে, ব্রেকভ্যানে তুলিতে বিলম্ব হইবে। আপনি এখন আর পীড়াপীড়ি করিবেন না।’
আমারও পীড়াপীড়ি করিবার বড় ইচ্ছা ছিল না। আর একটা রাত বই ত নয়। যেমন তেমন করিয়া কাটিয়া যাইবেই। বিশেষ স্টেশন মাস্টার যেরকম করিয়া আমাকে বুঝাইয়া বলিল তাহাতে আমি নিরুত্তর হইলাম।
স্টেশন মাস্টার আরোহীর দিকে চাহিয়া বলিল, ‘আপনি গাড়িতে উঠুন। গাড়ি ছাড়ে।’ এই বলিয়া সেক্হ্যাণ্ড করিয়া চলিয়া গেল। আরোহী গাড়িতে উঠিল।
গাড়িতে উঠিয়া সে ব্যক্তি তাহার বোঁচকা কুঁচকি গুণিতে লাগিল। খানিকক্ষণ কুলিদিগের সহিত বচসা করিয়া তাহাদিগকে বিদায় দিল।
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
আমি একধারে বসিয়া নবাগত লোকটিকে দেখিতেছিলাম। তাহাকে দেখিলে বড় ভয় হইবার কথা নহে। লোকটা কিছু বেঁটে, মোটাসোটা, ছোটরকম একটু ভুঁড়ি আছে। গায়ে আঁটা পোশাক, ভুঁড়ির উপর একগাছা মোটা চেন ঝুলিতেছে। লোকটিকে দেখিলে সঙ্গতিশালী বোধহয়। অর্থ এবং পদের যে ক্ষুদ্র অভিমান তাহাও বোধহয় যথেষ্ট পরিমাণ আছে। লোকটি দেখিতে কিন্তু ডেপুটির মত, কিন্তু বোধহয় ডেপুটির অপেক্ষা অধিক ধনী। গাড়িতে উঠিয়া ব্যস্তসমস্ত ভাবে তাহার অসংখ্য পুঁটুলি সাজাইতে আরম্ভ করিল। কিন্তু অলক্ষিতে আমার প্রতি ঘন ঘন কটাক্ষপাত করিতে লাগিল। মাঝে মাঝে কুলিরা জিনিসপত্র অসাবধানে রাখিয়াছে বলিয়া তাহাদিগকে গালি দিতে লাগিল।
ঘণ্টা বাজিল, বাঁশি ডাকিল, গাড়ি চলিতে আরম্ভ করিল। আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘মহাশয়, কোথা যাইবেন?
‘কলিকাতা। আপনি কোথায় যাইবেন?’
আমি বলিলাম,‘শ্রীরামপুর।’ মনে করিয়াছিলাম এ লোক অল্পদূর গিয়া নামিয়া যাইবে। দেখিলাম আমার সাথের সাথী।
আমি শ্রীরামপুরে যাইব শুনিয়া লোকটি তাহার লটবহর ছাড়িয়া আর এক কোণে বসিয়া পড়িল। বসিয়া বলিল ‘আর’। শব্দটা সন্তোষ অথবা অসন্তোষজনক ভাল বুঝিতে পারিলাম না। ওই শব্দটি করিয়া লোকটি আমায় ভাল করিয়া দেখিতে লাগিল।
আমাকে কতকটা বিদেশীর মত দেখাইতেছিল। বসন-ভূষণের বড় পারিপাট্য ছিল না। বেশভূষার উপর অনুরাগ আমার কোনকালেই বড় নাই, তাহাতে রেলের পথে অতি সামান্য বস্ত্র ধারণ করিয়াছিলাম। ঘড়ি ও চেন বন্ধ করিয়া রাখিয়াছিলাম। আমার আকৃতি দীর্ঘ, শরীর বলিষ্ঠ। বুকের উপর দুই হাত রাখিয়া পা ছড়াইয়া বসিয়া ছিলাম।
খানিকক্ষণ আমাকে দেখিয়া বোধহয় সে ব্যক্তি বড় আশ্বস্ত হইল না। জিজ্ঞাসা করিল, ‘মহাশয়ের এ পথে যাতায়াত আছে?’
আমি বলিলাম, ‘না।’
‘আপনি রেলে বড় একটা উঠিয়া থাকেন?’
‘বড় নয়।ֹ’ লোকটার কথায় আমার একটু বিরক্তি বোধ হইতে লাগিল। কোথায় সহজ কথাবার্তা কহিবে, না আমায় পরীক্ষা করিতে আরম্ভ করিল।
কিছু পরে আমার সঙ্গী আবার জিজ্ঞাসা করিল, ‘আমি গাড়িতে এত জিনিসপত্র লইয়া কেন উঠিয়াছি জানেন?’
‘সম্প্রতি ব্রেকভ্যান হইতে অনেক সামগ্রী চুরি গিয়াছে। গার্ড বলে, সে কিছু জানে না। তাহার মেয়াদ হইয়াছে বটে কিন্তু সে যে চুরি করিয়াছে তাহার কোন প্রমাণ নাই।’
কথাটা শুনিয়া আমার ঔৎসুক্য জন্মিল। বুকের উপর হাত ছিল, হাত দিয়া নোটের তাড়া একবার টিপিয়া দেখিলাম। কিছু কুতূহলী হইয়া জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘কতদিনের কথা?’
‘এক সপ্তাহ হইবে।’
‘যদি ব্রেকভ্যান হইতে চুরি যায় তো গাড়ি হইতে চুরি যাওয়াই বা আশ্চর্যের কি?’
‘আশ্চর্য কি’, এই বলিয়া আমার সঙ্গী কাতর দৃষ্টিতে চারিদিকে চাহিতে লাগিল। একবার তাহার জিনিসপত্রের দিকে তাকায়, একবার গাড়ির চারিদিকে তাকায়, একবার গাড়ির বাহিরে অন্ধকারে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে, আবার ঘুরিয়া ফিরিয়া আমার দিকে তীব্র অথচ অলক্ষ্য কটাক্ষ করে। একটা ছোট বাক্স পায়ের কাছে ছিল, থাকিয়া থাকিয়া সেইটাকে আরও কাছে টানিয়া আনে। অবশেষে বাক্সটাকে তুলিয়া পাশে রাখিল। আমাকে চোর বলিয়া সন্দেহ করিতেছে, অথবা অকারণ সন্দেহ করিতেছে ভাল বুঝিতে পারিলাম না। স্থির হইয়া বসিয়া তাহাকে দেখিতে লাগিলাম।
এইরূপে কিছুক্ষণ যায়। আমি একটু অন্যমনস্ক হইলাম। এক একবার আমার সঙ্গীর দিকে চাহিয়া দেখি। সে লোকটা নির্নিমেষ চক্ষে আমার দিকে চাহিয়া আছে। আমার সঙ্গে চোখাচোখি হইলেই অন্য দিকে চক্ষু ফিরায়, আমি অন্য দিকে তাকাইলেই নিস্পন্দ হইয়া আমায় দেখে। আমার মনটা একটু খুঁতখুঁত করিতে লাগিল। হঠাৎ আমার সঙ্গী আমায় জিজ্ঞাসা করিল, ‘মহাশয়, আপনি কি অস্ত্র লইয়া পথ চলেন?’
আমি একটু হাসিয়া বলিলাম, ‘ইংরেজের রাজ্যে কেহ সশস্ত্র হইয়া রেলে উঠে না।’
আমার ক্ষুদ্রকায় সঙ্গী একটু রুক্ষস্বরে কহিল, ‘আমি অস্ত্র লইয়াই ভ্ৰমণ করি, এই যে আমার পাশে বাক্স দেখিতেছেন তাহাতে একজোড়া ভরা পিস্তল আছে।’
আমি হাস্যমুখে বলিলাম, ‘আপনি কি শিকারে যাইতেছেন?’
সে ব্যক্তি কিছু কঠোর হাস্য করিয়া বলিল, ‘আপাতত কোন শিকার নাই, তবে আমাদের গাড়িতে যদি কোন চোর উঠে তো তাহাকে শিকার করিব। তাহাকে প্রাণে না মারি, তাহার পা ভাঙিয়া রাখিব।’
এই বলিয়া অত্যন্ত সাহসী পুরুষের ন্যায় বুক ফুলাইয়া আমার প্রতি প্রখর দৃষ্টিপাত করিতে লাগিল। আমার বড় হাসি পাইল। লোকটা আমায় তস্কর বিবেচনা করিতেছে অথবা সেইরূপ সন্দেহ করিতেছে বেশ বুঝিতে পারিলাম। একটু রঙ্গ করিবার অভিপ্রায়ে বলিলাম, ‘পিস্তল ছোঁড়া আপনার অভ্যাস আছে?’
তাহার মুখ একটু মলিন হইল, কহিল, ‘একরকম অভ্যাস আছে। এ গাড়িতে চোর আসিলে তাহাকে অবশ্য ঘায়েল করিতে পারি।’
আমি গম্ভীরভাবে কহিলাম, ‘আপনার কাছে দুইটা পিস্তল আছে বলিতেছেন। আপনি একটা পিস্তল আমাকে দিন, আর এই দুআনিটা জানালার সম্মুখে ধরুন। আমি গাড়ির অন্য ধার হইতে পিস্তল ছুঁড়িয়া দু-আনি উড়াইয়া দিতেছি। আপনার হাতে কিছু লাগিবে না।’
আমার কথা শুনিয়া সে বেচারির মুখ বিবর্ণ হইয়া গেল। বাক্সটা আরও কাছে টানিয়া লইল। হাত একটু কাঁপিতেছিল আমি দেখিতে পাইলাম। বলিল, ‘আপনার বোধহয় বন্দুক ও পিস্তল ছুঁড়িবার বিলক্ষণ অভ্যাস আছে। কিন্তু পরীক্ষা করিবার আবশ্যক নাই।’
আমার মনে প্রথমেই সন্দেহ হইয়াছিল যে বাক্সটি দেখিতে পিস্তলের বাক্সের হইলেও তাহাতে পিস্তল নাই। আমার সঙ্গী যে মিথ্যা বলিতেছে তাহা পূর্বেই বুঝিতে পারিয়াছিলাম।
এই সময়ে আমরা একটা ছোট স্টেশনের নিকটবর্তী হইলাম। আমি স্টেশনের অপরদিকে জানালা দিয়া মুখ বাড়াইয়া দিয়া দেখিতে লাগিলাম। নিশীথের শীতল পবন মুখে লাগিতে লাগিল। আকাশে চতুর্দিকে নক্ষত্র জ্বলিতেছে, বিস্তৃত মাঠ, দূরে লোকালয়। দূর হইতে প্রদীপের আলোক দেখা যাইতেছে। অন্ধকারে কখনো বাদুড় উড়িয়া যাইতছে, কখনো পেচক ডাকিতেছে, কখনো কোন নিশাচর জন্তুর রব শোনা যাইতেছে। স্টেশনে গোলমাল, বারান্দায় লোকজন দৌড়াদৌড়ি করিতেছে, কেহ জল চাহিতেছে, কেহ কোন সামগ্রী বিক্রয় করিতেছে, কেহ অনর্থক চিৎকার করিতেছে। আমি সে দিকে মুখ ফিরাইলাম না।
দুই মিনিটের পর গাড়ি ছাড়িল। আমি ঘুরিয়া বসিলাম—দেখিলাম গাড়িতে আর একজন লোক উঠিয়াছে। অত্যন্ত বিস্মিত হইলাম। দরজা খুলিবার শব্দ অথবা অন্য কোন শব্দ শুনিতে পাই নাই। এত নিঃশব্দে যে কেহ গাড়িতে উঠিতে পারে আমি না দেখিলে বিশ্বাস করিতাম না। বিস্ময় কিছু অপনীত হইলে জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘আপনি কি এই স্টেশনে উঠিলেন?’
আগন্তুক মৃদু হাসিয়া বলিলেন, ‘হ্যাঁ, আপনি বুঝি আমায় উঠিতে দেখেন নাই?’
আমি বলিলাম, ‘দেখা দূরে থাকুক, দরজা খোলার অথবা বন্ধ হইবারও কোন শব্দ শুনি নাই। গাড়িতে, যদি ছাদ না থাকিত তবে বলিতাম, আপনি আকাশ হইতে পড়িয়াছেন।’
আগন্তুক হাসিতে লাগিল। হাসিতে হাসিতে কহিল, ‘মহাশয়, হালকা বোঝা মাথায় করিলে মুটে কিছু ভার বোধ করে না। চারগাছা মল পায়ে না পড়িলে যুবতীর পায়ে শব্দ হয় না। আমি যদি আপনার বন্ধুর মত রাজ্যের সামগ্রী লইয়া উঠিতাম, তাহা হইলে অবশ্য শুনিতেও পাইতেন, দেখিতেও পাইতেন।’
‘আমার বন্ধু’ এতক্ষণ হাঁ করিয়া বসিয়াছিলেন। তিনিও আগন্তুককে আসিতে দেখেন নাই। কিন্তু আর একজন লোক দেখিয়া তাহার ধড়ে প্রাণ আসিল। আমার হাত হইতে রক্ষা পাইল। তৃতীয় ব্যক্তিকে দেখিয়া অত্যন্ত আনন্দের সহিত কহিল, ‘আসুন মহাশয়, যেমন করিয়াই আসুন—আসিয়াছেন, বেশ করিয়াছেন। আপনি কলিকাতায় যাইতেছেন তো?’
আগন্তুক আবার হাসিয়া কহিল, ‘তাহা হইলে কি এমন করিয়া যাইতাম। অন্তত আপনার আসবাবের দশভাগের একভাগ লইয়া আসিতাম। আর তাহা হইলে আমার অলক্ষ্য আগমনও সম্ভব হইত না, আপনারাও বিস্মিত হইতেন না। আমি মোটে এক স্টেশন যাইব, তাহার পরে আপনারা স্বচ্ছন্দে নিদ্রা যাইবেন।’
কলিকাতার যাত্রী কিছু বিষণ্ণ হইল; দুই একবার আমার দিকে চাহিয়া দেখিল। আমি অন্ধকার কোণে ঠেসান দিয়া বসিয়া আগন্তুককে ভাল করিয়া দেখিতেছিলাম।
আগন্তুক যুবাপুরুষ। বয়ঃক্রম ত্রিশ বৎসরের ঊর্ধ্বে হইবে না, বরং কম হইবে। আকৃতি মাঝারি রকম, ঈষদ্দীর্ঘও বলা যাইতে পারে। শরীর ক্ষীণ কিন্তু অত্যন্ত স্ফূর্তিব্যঞ্জক। মুখের শ্রীঅত্যন্ত মনোহর, হাস্যও বড় মধুর। পরিধানে পরিচ্ছন্ন বস্ত্র, হাতে একটি ক্ষুদ্র ব্যাগ। কিন্তু যুবকের চক্ষু দেখিতে পাইলাম না। রেলে লোকে যেমন নীল রঙের চশমা পরে চক্ষে সেই রকম চশমা রহিয়াছে। রাত্রিকালে চোখে চশমা দেখিয়া একটু আশ্চর্য বোধ হইল। যুবক আমার মনোভাব বুঝিতে পারিয়া আমার দিকে চাহিয়া কহিল, ‘রাত্রে আমার চক্ষে চশমা দেখিয়া বিস্মিত হইবেন না। চক্ষে কিছু বেদনা হইয়াছে, সেইজন্য চশমা পরিয়াছি।’
এ ব্যক্তিকে দেখিয়া আমার মন একটু চঞ্চল হইল। বলিতে পারি না কেন, মনে একটু বিপদের আশঙ্কা হইল। বোধহয় অন্যমনে দুই একবার বুকে হাত দিয়া নোটের তাড়া স্পর্শ করিয়া থাকিব। যুবক দেখিয়াছিল কিনা তাহার চক্ষে চশমা থাকাতে কিছুই বুঝিতে পারিলাম না। সে এদিকে ওদিকে না চাহিয়া আমার পূর্ব পরিচিত সঙ্গীর সহিত কথাবার্তা কহিতেছিল। একবার হাসিয়া জিজ্ঞাসা করিল, ‘মহাশয়, আপনার ও বাক্সের ভিতর কি? পিস্তল নাকি?’
আমার সঙ্গী অত্যন্ত বিস্মিত ও কিছু শঙ্কিত হইয়া কহিল, ‘হ্যাঁ, আপনি কি করিয়া জানিলেন?’
যুবক কহিল, ‘পিস্তলের বাক্স দেখিয়া কহিলাম। আপনি কি চোরের ভয়ে পিস্তল লইয়াছেন?’
সে ব্যক্তি আরও বিস্মিত হইল, বলিল, ‘আপনি কিভাবে জানেন?’
যুবক আবার হাস্য করিল; তাহার দশন পঙতি শুভ্র ও সুন্দর। কহিল, ‘আমি কিছুই জানি না। কিন্তু চোর যদি আসে তো কি আপনাকে বলিয়া চুরি করিবে?’
আমার সঙ্গী অত্যন্ত ভীত হইয়া বলিল, ‘চোর তো বাহির হইতে আসিবে না। যদি চোর আসে তো এই গাড়িতেই আসিবে।’
যুবক আমার দিকে মুখ ফিরাইয়া হাসিতে লাগিল। জিজ্ঞাসা করিল, ‘আমাদের দুইজনের মধ্যে কাহাকেও সন্দেহ হয়?’
‘না। না। আপনাদের কথা হইতেছে না। যদি আর কেহ ওঠে!’
যুবক কহিল, ‘তাও বটে।’
আমার সন্দেহ ও আশঙ্কা বাড়িতে লাগিল। আশঙ্কার কোন কারণ ছিল না, তথাপি অত্যন্ত শঙ্কা হইতে লাগিল। দেখিতে দেখিতে অন্য স্টেশন আসিল। যুবক উঠিয়া দাঁড়াইল। আমাদের দুইজনকে লক্ষ্য করিয়া কহিল, ‘আপনারা এখন নিশ্চিন্তে নিদ্রার চেষ্টা করুন। চোরের ভয়ে সমস্ত রাত্রি জাগিয়া থাকিবেন না।’ এই বলিয়া নিঃশব্দে দরজা খুলিয়া যুবক নামিয়া গেল।
অকারণে এইরূপ আশঙ্কা হওয়াতে আমার অত্যন্ত আশ্চর্য বোধ হইতে লাগিল। কিন্তু যুবক নামিয়া গেলে স্বচ্ছন্দ বোধ হইতে লাগিল। বিছানার উপর পা ছড়াইয়া দিয়া নিশ্চিন্ত হইয়া শুইলাম।
তৃতীয় পরিচ্ছেদ
আমাকে শুইতে দেখিয়া আমার সঙ্গী জিজ্ঞাসা করিল, ‘আপনি কি নিদ্রা যাইবেন?’
আমি বলিলাম, ‘সমস্ত রাত্রি কি বসিয়া থাকা যায়?’
আমার সঙ্গী কহিল, ‘আমি সমস্ত রাত্রি জাগিয়া থাকিব।’
‘আপনার যেমন অভিরুচি হয় করিবেন’ বলিয়া আমি পাশ ফিরিলাম।
শুইলাম বটে কিন্তু চক্ষে নিদ্রা আসিল না। ঘণ্টা কয়েক পরেই বাড়ি পঁহুছিব—এমন সময় নিদ্রা হয়ও না। যে আরোহী এক স্টেশন আমাদের সঙ্গে আসিয়াছিল তাহার বিষয় ভাবিতে লাগিলাম। রাত্রে চক্ষে চশমা কেন? তাহাকে দেখিয়া মনে মনে আশঙ্কাই বা কেন হইল? লোকটি দেখিতে মন্দ নয়, কথাবার্তা শিক্ষিত ভদ্রলোকের মত। তথাপি সে নামিয়া গেলে নিশ্চিন্ত বোধ হইল না কেন? ভাবিয়া কিছু স্থির করিতে পারিলাম না।
একবার আমার সঙ্গীর দিকে ফিরিয়া দেখিলাম সে বাক্সটি মাথার কাছে লইয়া প্রাণপণে জাগিয়া থাকিবার চেষ্টা করিতেছে কিন্তু কিছুতেই বসিয়া থাকিতে পারিতেছে না। অবশেষে শয়ন করিবামাত্র নিদ্রাভূত হইল। আমার তখনও নিদ্রাবেশ হয় নাই!
⋯ক্রমে ক্রমে আমার শরীর শিথিল হইল। মনে হইল তন্দ্রাকর্ষণ হইতেছে। কিন্তু এরূপ নিদ্রাবেশ পূর্বে কখনও অনুভব করি নাই। বোধ হইল যেন অনন্ত শরীর গুরুভারাক্রান্ত হইতেছে, নেত্রদ্বয় যেন কে চাপিয়া ধরিয়াছে। একবার চক্ষু উন্মীলন করিবার চেষ্টা করিলাম—চক্ষু নিমীলিত রহিল। ক্রমে চৈতন্য লুপ্ত হইতে লাগিল। কিন্তু একেবারে অচৈতন্য হইলাম না।⋯দেখিতে দেখিতে সমস্ত শরীর অবসন্ন হইয়া পড়িল, চক্ষু মুদিত হইয়া আসিল। নিশ্বাস ত্যাগ করিয়া আমি অচৈতন্য হলাম।
কতক্ষণ এরূপ রহিলাম বলিতে পারি না। যখন আবার চৈতন্যোদয় হইল তখন রাত্রি শেষ হইয়া আসিয়াছে, অন্ধকার তত গাঢ় নাই।⋯আমি একেবারে উঠিয়া বসিতেই অভ্যাসবশত বুকে হাত পড়িল। আমি তীরের মত উঠিয়া দাঁড়াইলাম। বুকে নোটের তাড়া নাই।
সর্বাঙ্গ থরথর করিয়া কাঁপিতে লাগিল, মাথা ঘুরিতে লাগিল। চক্ষে কিছু দেখিতে না পাইয়া বসিয়া পড়িলাম।⋯বিছানার নিচে, বেঞ্চের নিচে চারিদিকে খুঁজিলাম, কোথাও কোন চিহ্ন দেখিতে পাইলাম না।
⋯গাড়িতে কেবল সেই একজন সঙ্গী, তৃতীয় ব্যক্তি নাই। আমি দ্বিতীয় আরোহীর দিকে চাহিয়া দেখিলাম, সে অকাতরে নিদ্রা যাইতেছে। গাড়ির আলোক ক্ষীণ হইয়া আসিতেছে।
আমি ক্ষিপ্তের মত হইয়া উঠিয়াছিলাম।⋯আমার সঙ্গীকে ধরিয়া সবলে আকর্ষণ করিলাম। সে অর্দ্ধস্ফুট স্বরে বকিতে বকিতে উঠিয়া বসিল। আমার মূর্তি দেখিয়া সে অত্যন্ত ভীত হইল—সম্পূর্ণ জাগরিত হইল। আমি বলিলাম, ‘এ কেমন তামাসা? আমার টাকা?’
তাহার মুখ শুকাইয়া গেল। কহিল, ‘টাকা, আমার কাছে কিছু টাকা নাই।’
⋯আমি চিৎকার করিয়া কহিলাম, ‘আমার নোট কোথায় আছে বল।’
ভয়ে ও বিস্ময়ে আকুল হইয়া সে বলিল, ‘তোমার নোট আমার কাছে?’ এই কথা বলিয়াই তাহার শিয়রের দিকে দৃষ্টি পড়িল। অত্যন্ত কাতর স্বরে চিৎকার করিয়া কহিল, ‘আমার বাক্স?’
আমি দেখিলাম তাহার বাক্সটি নাই।⋯সে শোকে ও ভয়ে বিহ্বল হইয়া বেঞ্চের উপর বসিয়া পড়িল। কিছু পরে অতি করুণ স্বরে আমায় কহিল, ‘আমার বাক্সটি কোথায় রাখিয়াছ?’
আমি বুকে হাত দিয়া কহিলাম, ‘আমার নোট?’
সে ব্যক্তি কহিল, ‘আমার বাক্স?’
আমি ভাবিতে লাগিলাম, আমাদের দুইজনের মধ্যে কেহ চোর নয় বেশ বুঝিতে পারিলাম। দুইজনেরই চুরি গিয়াছে। ⋯আমি কিছু স্থির হইয়া আমার সঙ্গীকে বলিলাম, ‘মহাশয়, আমিও চোর নই, আপনিও চোর নন। দুইজনেরই চুরি গিয়াছে। কে চুরি করিয়াছে সেইটে জানা কঠিন।’
সে ব্যক্তি বোধহয় আমার একটা কথাও বিশ্বাস করিল না। আমার দিকে চাহিয়া কেবল বলিল, ‘আমার বাক্স?’
আমি কহিলাম, ‘আপনার কত গিয়াছে আমি জানি না। আমি সর্বস্বান্ত হইয়াছি। আমার প্রতি আপনার যে সন্দেহ হইতেছে তাহা শীঘ্রই দূর হইবে, কিন্তু আর কিছু গেল কিনা দেখি?’
বাক্স ব্যাগ যেমন তেমনি রহিয়াছে, আমার আর যে সামান্য টাকাকড়ি ছিল তাহাও তেমনি রহিয়াছে। আমার সঙ্গীর বাক্সটি ছাড়া আর কিছু যায় নাই। তাহার ঘড়িটিও যেমন তেমনি রহিয়াছে, তবে চেনে কিছু তফাৎ হইয়াছে। সোনার চেনের বদলে একগাছি লোহার চেন রহিয়াছে। নূতন ধরনের চুরি বটে।
তাহার পরের স্টেশনে আমার সঙ্গীটি বড় গোল বাধাইল। আমি আবার প্রকৃতিস্থ হইয়াছিলাম, স্টেশন মাস্টার আসিলে বলিলাম, ‘আমাদের দুইজনেরই চুরি গিয়াছে।’
স্টেশনের লোক দেখিয়া আমার সঙ্গীর সাহস বাড়িল। আমার কথায় বাধা দিয়া কহিল, নোট ফোট কিছু নয়। এই ব্যক্তি চোর! আমার বাক্সে দুই হাজার টাকার গহনা ছিল।’
আমি স্টেশন মাস্টারকে কহিলাম, ‘আমার কাছে দশ হাজার টাকার নোট ছিল, নোটের নম্বর আমার কাছে আছে। আমার পরিচয় আমার কর্মস্থানে টেলিগ্রাম পাঠাইলেই পাইবেন। নোট ট্রেজারি হইতে লইয়া আসিয়াছি। জিজ্ঞাসা করিলেই জানিতে পারিবেন।’ এই বলিয়া স্টেশন মাস্টারকে কাগজপত্র দেখাইলাম, রাত্রে যে বিশেষ অদ্ভুত ব্যাপারে ঘটিয়াছিল সেটা কেহ বিশ্বাস করিবে না বলিয়া আর বলিলাম না।
স্টেশন মাস্টার কহিল, ‘আপনার কথায় আমি সম্পূর্ণ বিশ্বাস করিতেছি। কিন্তু এখানে আপনাকে কেহ চেনে না। যতক্ষণ টেলিগ্রামের উত্তর না আসে ততক্ষণ আপনাকে এইখানে থাকিতে হইবে।’
আমি কহিলাম, ‘অবশ্য।’
আমার সঙ্গী স্টেশন মাস্টারের প্রতি চাহিয়া কহিল, ‘আমাকেও কি থাকিতে হইবে? আমাকে এদিকে অনেকে চেনে।’
স্টেশন মাস্টার কহিল, ‘আজ্ঞা হ্যাঁ, লোকনাথবাবুকে অনেকে চেনে।’
আমি মৃদু মৃদু কহিলাম, ‘লোকনাথবাবু! নিবাস?’
‘সোমড়া। মহাশয়ের নামটা কি বলিলেন?’
আমি বলিলাম, ‘অমরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়।’
লোকনাথবাবু আমার নিকটে সরিয়া আসিলেন। জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘আপনার নিবাস শ্রীরামপুর বলিলেন না?’
‘আজ্ঞে হ্যাঁ।’
‘ঠাকুরের নাম?’
‘মহেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়।’
‘কর্মস্থান?’
‘ফরাক্কাবাদ।’
‘এতক্ষণ বলিতে নাই? আমার নাম লোকনাথ মুখোপাধ্যায়। নিবাস সোমড়া। আমায় চিনিতে পার?’
আমি প্রণাম করিয়া বলিলাম, ‘আপনাকে পূর্বে দেখি নাই। আপনি আমার কনিষ্ঠ ভ্রাতাকে আপনার কন্যা দান করিয়াছেন।’
লোকনাথবাবু ব্যস্ত হইয়া স্টেশনমাস্টারকে ডাকাইলেন। বলিলেন, ‘ইহার উপর কোন সন্দেহ নাই। ইনি আমার আত্মীয় লোক। আমাদের দুইজনেরই চুরি গিয়াছে।’
স্টেশন মাস্টার জিজ্ঞাসা করিল, ‘ইহার উপর আপনার কোন সন্দেহ নাই?’
লোকনাথবাবু সবেগে বলিলেন, ‘কিছু না।’
স্টেশন মাস্টার আমার দিকে ফিরিয়া কহিল, ‘তবে টেলিগ্রামের উত্তরের অপেক্ষা করিবার প্রয়োজন নাই।’
আমরা দুইজনে আবার গাড়িতে উঠিলাম।
চতুর্থ পরিচ্ছেদ
গাড়িতে উঠিয়া আমি একটু কুণ্ঠিতভাবে কহিলাম, ‘আপনাকে চিনিতে না পারিয়া রাত্রে সদ্ব্যবহার—’
লোকনাথবাবু কথাটা সমাপ্ত হইতে দিলেন না। কহিলেন, ‘বিলক্ষণ, তোমার তো কোন দোষই নাই। আমি যে তোমাকে দশজনের সাক্ষাতে চোর বলিয়াছি।’
আমি বলিলাম, ‘অমন অবস্থায় সকলেই বলে। আমিও তো প্রথমে আপনাকে সন্দেহ করিয়াছিলাম।’
লোকনাথবাবু কহিলেন, ‘সে কথা যাক্। চোর কেমন করিয়া ধরা যাইবে? এ তো সাধারণ চুরি নয়?’
লোকনাথবাবু একজন প্রসিদ্ধ ধনী এবং অত্যন্ত কৃপণ। সেইজন্য তাঁহাকে অনেকে চিনিত। আমার সর্বস্ব গিয়া যত না বিপদ হইয়াছে, দুই হাজার টাকার গহনা গিয়া তাঁহার ততোধিক বিপদ। একমাত্র কন্যার জন্য এই গহনা গড়াইয়াছিলেন।
রাত্রে যাহা যাহা ঘটিয়াছিল অবিকল লোকনাথবাবুকে তাহা বলিলাম। শুনিয়া তিনি কাঁপিতে লাগিলেন। বললেন, ‘আমি বরাবর ঘুমাইয়া ছিলাম, কিছু টের পাই নাই।’
আমি বলিলাম, ‘আমাদের সঙ্গে সেই যে একজন চশমাপরা লোক উঠিয়াছিল, তাহাকে মনে পড়ে?’
লোকনাথবাবুর মুখ এবং চোখ খুলিয়া গেল। ‘অ্যাঁ, পড়ে বই কি! সে তো বেশ লোক বোধ হইল। আর সে এক স্টেশন বই তো আর আসে নাই।’
আমি বলিলাম, ‘তাহাকে দেখিয়া আমার কেমন ভয় হইয়াছিল বলিতে পারি না। তাহাকেই আমার সন্দেহ হইতেছে।’
লোকনাথবাবু বলিলেন, ‘তোমার বুক থেকে কেমন করিয়া রুমাল খুলিয়া লইল? আর তুমি যাহা বলিতেছ এরকম আশ্চর্য ব্যাপার আমি কখনও শুনি নাই।’
শ্রীরামপুরে আমি নামিয়া গেলাম। স্টেশনে আমার জ্যেষ্ঠ সহোদর দাঁড়াইয়াছিলেন তাঁহাকে সব বলিলাম। তিনি লোকনাথবাবুকে নামিয়া আহার করিয়া কলিকাতায় যাইতে অনুরোধ করিলেন। লোকনাথবাবু বলিলেন, ‘আর একদিন আসিব। এখন এই চুরির একটা উপায় করি।’
গাড়ি ছাড়িলে আমার জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা কহিলেন, ‘ব্যাঙ্কে টেলিগ্রাম পাঠাও। নোটের নম্বর তোমার কাছে আছে। ব্যাঙ্কে নোট গেলে ধরা পড়িবে। আহার করিয়া আমরা কলিকাতায় যাইব।’
তখন মনে হইতে লাগিল সঙ্গে টাকা আনিয়া কি মূর্খের কাজই করিয়াছি।⋯এখন গিয়া মাকে কি বলিব? বাড়ি ফিরিবার এত আনন্দ নিরানন্দে পরিণত হইল।
মা বড় বুদ্ধিমতী। সমস্ত টাকা চুরি গিয়াছে শুনিয়া মনে যাহাই হউক, মুখে কোন দুঃখ প্রকাশ করিলেন না। বলিলেন, ‘অমর, বেঁচে থাক, টাকার ভাবনা কি? পুরুষ মানুষ আবার কত টাকা রোজগার করবে।’
আহারাদির পর দুপুরের গাড়িতে আমরা দুই ভাই কলিকাতায় গেলাম। রেলওয়ে পুলিশে চারিদিকে সন্ধান করিতেছিল, কিন্তু তাহারা যে তদন্ত করিতে পারিবে আমাদের সে ভরসা বড় ছিল না। আমরা একজন বিখ্যাত ডিটেক্টিভের কাছে গেলাম। তাহাকে সকল কথা আদ্যোপান্ত বলিলাম। সে একটু চুপ করিয়া রহিল, পরে জিজ্ঞাসা করিল, ‘সে ব্যক্তির চক্ষু আপনি দেখতে পাননি?’
আমি বলিলাম, ‘একবারও না।’
ডিটেক্টিভ বলিল, ‘তাহা হইলে তাহাকে চেনা দুষ্কর। মানুষের চোখ না দেখিলে তাহাকে চেনা যায় না।⋯আমরা ইহাতে কিছু করিতে পারি না।’
আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘কেন? যে চুরি আর কেহ ধরিতে পারে না সেই চুরি ধরাই তো তোমার ব্যবসা।’
ডিটেক্টিভের দুটি দাঁত বাহির হইল, কহিল, ‘চুরি হইলে তো? এ চুরি নয়।’
আমি বিস্মিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘তবে কি?’
‘বাহাদুরি।’
‘সে কি?’
ডিটেক্টিভ বাম হস্তে দক্ষিণ হস্তের দুই অঙ্গুলি রাখিয়া ধীরে ধীরে কহিতে লাগিল, ‘আপনারা একটু বিবেচনা করিয়া দেখুন। এ সহজ কৌশলের চুরি নয়। যখন চুরি কোনমতে সম্ভব নয়, তখন চুরি হইল। আপনি জাগিয়া ছিলেন, আপনাকে কোন কৌশলে ঘুম পাড়াইয়া রাখিল। আপনার সঙ্গীরও সেই দশা। যে নোটের তাড়ার জন্য আপনি বড় ভীত সেই নোটের তাড়া গেল। আপনার সঙ্গী যে বাক্সটির জন্য ভয়ে সারা, সেই বাক্সটি গেল। আপনার ঘড়ি, খুচরো টাকা, আপনার সঙ্গীর ঘড়ি কিছু গেল না। চেনছড়া লইল, সেটা যেন তামাসা করিবার জন্য। এমন সুবিধা পাইয়া কোন্ চোর দুই দুইটা ঘড়ি রাখিয়া যায়?’
আমি একথাগুলো আগে ভাবি নাই। এখন নিরুত্তর রহিলাম।
ডিটেক্টিভ বলিতে লাগিল, ‘যার চোখে চশমা ছিল, আমারও তাহাকেই সন্দেহ হইতেছে, কিন্তু তাহাকে চিনিবার কোন উপায় নাই।’
বোধহয় চুরি করা তাহার কাজ নয়। আর যদি এরকম চুরি করে তো তাহাকে কোন কালে কেহ ধরিতে পারিবে না। যদি ব্যাঙ্কে আপনার নোট ভাঙাইতে যায় কিম্বা চশমা পরিয়া কেবল রেলে বেড়ায় তাহা হইলেই ধরা পড়িবে। কিন্তু তাহাকে এমন বোকা বোধ হয় না।’
আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘তবে তুমি চেষ্টা করিবে না?’
ডিটেক্টিভ বলিল, ‘চেষ্টা অবশ্য করিব, কিন্তু আপনাকে কোন আশা দিতে পারি না। আমাকে নিযুক্ত করিয়া আপনাদের কোন লাভ হইবে না।’
আমরা হতাশ হইয়া বাড়ি ফিরিয়া আসিলাম।
পঞ্চম পরিচ্ছেদ
সংবাদপত্রে এই ঘটনা নানারূপ অলঙ্কারবিশিষ্ট হইয়া প্রকাশিত হইল। আমি প্রকৃত ঘটনা একখানি পত্রে লিখিয়া পাঠাইলাম। কেবল যেটুকু সাধারণের বিশ্বাসযোগ্য নহে তাহাই গোপন করিলাম। নোটগুলো যে আর কখন পাইব সে আশা কিছুমাত্র ছিল না।
দুই মাসের বিদায় লইয়া বাড়ি আসিয়াছিলাম। দুই মাস দেখিতে দেখিতে গেল। আমি কর্মস্থানে ফিরিবার উদ্যোগ করিলাম। দুই বৎসর পূর্বে যেমন রিক্ত হইয়া গৃহত্যাগ করিয়াছিলাম, এখনও সেইমত বাহির হইলাম। রাত্রি দশটার সময় গাড়িতে সেই রাত্রের সমস্ত বৃত্তান্ত মনে পড়িতে লাগিল। দুই মাস ভাবিয়া আমি কিছুই ঠিক করিতে পারি নাই—চুরি না বাহাদুরি।
দ্বিতীয় দিবস সন্ধ্যার সময় গাড়ি বদল হয়। আমি নূতন গাড়িতে উঠিতে গেলাম। দেখিলাম, গাড়িতে বড় ভিড়। একখানি গাড়িতে কেবল একজন লোক, আর কেহ নাই। আমি সেই গাড়িতে উঠিলাম।
সে লোকটা মুখ ফিরাইয়া বসিয়াছিল। আমাকে উঠিতে দেখিয়া ফিরিয়া চাহিল। আমি আর এক বেঞ্চে গিয়া বসিলাম। অপর ব্যক্তি অন্য দিকে মুখ ফিরাইল। সে পর্যন্ত আমি তাহার মুখ দেখি নাই, তাহার অবয়ব দেখিয়া বোধ হইল, যেন তাহাকে পূর্বে কোথাও দেখিয়াছি। কোথায় দেখিয়াছি মনে করিতে লাগিলাম।
সে আবার ফিরিয়া চাহিল। দেখিলাম যুবা পুরুষ। অকস্মাৎ স্মরণ হইল, যে ব্যক্তি লোকনাথবাবু ও আমার সঙ্গে এক স্টেশনে আসিয়াছিল সেও এইরূপ যুবা পুরুষ। অলক্ষিতে নিরীক্ষণ করিতে লাগিলাম। মনে মনে সন্দেহ হইবামাত্রই শরীর কণ্টকিত হইয়া উঠিল।
যুবক আমার দিকে ফিরিয়া বসিল। চক্ষে চশমা নাই। আমি তাহার চক্ষের প্রতি লক্ষ্য করিতে লাগিলাম। তখন সন্ধ্যা হইয়াছে। গাড়ির বাহিরে অন্ধকার হয় নাই, গাড়ির ভিতরে আলোক জ্বলিতেছে।
যুবকের চক্ষু দীর্ঘ। দৃষ্টি শান্ত। চক্ষের পাতা কিছু ভারী। আর কিছু লক্ষ্য করিতে পারিলাম না। আমি একদৃষ্টে তাহার প্রতি চাহিয়া আছি এমন সময় সে মুখের দিকে চাহিল। আমি কিছু অপ্রতিভ হইয়া চক্ষু নত করিলাম। যুবক আমায় জিজ্ঞাসা করিল, ‘মহাশয়, কোথায় যাইবেন?’
আমি আবার বিস্মিত হইলাম। এ স্বর কোথাও শুনিয়াছি না? বলিলাম, ‘ফরাক্কাবাদ।’
যুবক আমার প্রতি কটাক্ষ করিল। বলিল, ‘ফরাক্কাবাদ?’ সম্প্রতি সেখানে একটা আশ্চর্য ঘটনা ঘটিয়াছিল না?’
আমি যুবকের প্রত্যেক কথা, প্রত্যেক কটাক্ষ লক্ষ্য করিতেছিলাম। বলিলাম, ‘ফরাক্কাবাদ নয়। ফরাক্কাবাদের একজন লোকের রেলে চুরি গিয়াছিল।’
যুবক বলিল, ‘হ্যাঁ, মনে পড়িয়াছে। আপনি অমরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়কে চেনেন?’
‘অমরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় আমারই নাম।’
যুবক আমার দিকে ভাল করিয়া চাহিল। আমার বোধ হইল তাহার চক্ষু পূর্বাপেক্ষা উজ্জ্বল হইয়াছে।
যুবক জিজ্ঞাসা করিল, ‘এ পর্যন্ত চুরির কোন সন্ধান পাইয়াছেন?’
‘কিছু মাত্র না।’
‘পাইবার কোন আশা আছে?’
‘কোন আশা নাই।’
‘কেন?’
‘এরকম চোর ধরা যায় না।’
যে যুবক লোকনাথবাবু ও আমার সঙ্গে গাড়িতে উঠিয়াছিল সে রঙ্গপ্রিয়, চঞ্চল; এ ব্যক্তি গম্ভীর, মুখে হাসি নাই। তাহাকে দেখিয়া আমার মনে শঙ্কা হইয়াছিল, ইহাকে দেখিয়া কোন শঙ্কা হয় নাই। তথাপি আমার বোধ হইতেছিল এ দুইজন একই ব্যক্তি।
আমার কথা শুনিয়া যুবক যেন একটা হাসিল। কহিল, ‘পুলিশে কিছু করিতে পারিল না?’
আমি বলিলাম, ‘পুলিশের সে ক্ষমতা নাই।’
যুবক জিজ্ঞাসা করিল, ‘সংবাদপত্রে যাহা প্রকাশিত হয় সেইমতই কি আনুপূর্বিক ঘটয়াছিল? না আপনি কিছু অপ্রকাশিত রাখিয়াছেন?’
একবার উত্তর দিব কিনা মনে করিয়া আমি একটু ইতস্তত করিতে লাগিলাম। যুবক বুঝিতে পারিয়া বলিল, ‘অপরিচিত ব্যক্তিকে সব কথা বলিতে পারা যায় না। যদি কোন কথা গোপনীয় থাকে তো প্রকাশ করিবার আবশ্যক নাই।’
যুবক সেকথা ছাড়িয়া দিল। কহিল, ‘আপনার সঙ্গে গাড়িতে আর কে ছিলেন?’
‘আমার একজন আত্মীয়—লোকনাথবাবু।’
‘বড় ধনী?’
‘হাঁ।’
‘কৃপণ?’
‘লোকে বলে বটে।’
‘তাহার কি চুরি গিয়াছিল?’
‘দুই হাজার টাকার গহনা।’
‘আপনার কত গিয়াছিল?’
‘দশ হাজার টাকা। আমার সর্বস্ব।’
যুবক আমার প্রতি চাহিয়া জিজ্ঞাসা করিল, ‘আপনি কি সর্বস্বান্ত হইয়াছেন?’
আমি বলিলাম, ‘দুই বৎসরে যাহা উপার্জন করিয়াছিলাম তাহার সমুদয়ই গিয়াছে! আমার কিছুই নাই।’
যুবক সহসা জিজ্ঞাসা করিল, ‘নোটের নম্বর আপনার কাছে আছে।’
আমি কিছু বিস্মিত হইয়া কহিলাম, ‘আছে।’
যুবক জিজ্ঞাসা করিল, ‘সে রাত্রে আপনাদের গাড়িতে তৃতীয় ব্যক্তি কেহ ছিল?’
আমি কহিলাম, ‘একজন লোক এক স্টেশন আমাদের গাড়িতে আসিয়াছিল। তারপর আর কেহ ছিল না।’
‘লোকটি দেখিতে কিরকম?’
‘চোখে চশমা পরা, দেখিতে অনেকটা আপনার রকম।’ এই বলিয়া যুবকের মুখ দেখিতে লাগিলাম।
সে ভ্রূ কুঞ্চিত করিল। কহিল, ‘আপনার ভ্রম হইয়াছে। আপনি যাহাকে দেখিয়াছিলেন, আমি তাহাকে চিনি।’
এবার আর কুতূহল সম্বরণ করিতে পারিলাম না। আগ্রহাতিশয্যে জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘সে ব্যক্তি কে? তাহার নাম কি?’
যুবক উত্তরে কেবল কহিল, ‘রাত্রে যাহা যাহা ঘটিয়াছিল অবিকল বর্ণনা করুন।’
আমি সব কহিলাম, পরিশেষে জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘সে লোকটি কে?’
যুবক কহিল, ‘তাহা বলিতে পারিব না। কিন্তু আপনার টাকা চুরি যায় নাই। আপনি টাকা ফিরিয়া পাইবেন।’
আমি দীর্ঘ নিশ্বাস ত্যাগ করিয়া বলিলাম, ‘আমার সে আশা নাই।’ তখনি আবার জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘মহাশয়, এ পর্যন্ত আপনার নাম শুনিতে পাইলাম না।’
যুবক কহিল, ‘নাম শুনিলেও আমার পরিচয় পাইবেন না। আমাকে অপরিচিত বিবেচনা করুন।’
এই কথা শুনিয়া আমার নানা সন্দেহ হইতে লাগিল। এ ব্যক্তি আপনার নাম গোপন করিতেছে কেন? আমি আমার টাকা ফিরিয়া পাইব এ কথাই বা কেমন করিয়া বলিতেছে?
কিছু পরে একটা বড় স্টেশনে গাড়ি লাগিল। আমি কোন প্রয়োজনে গাড়ি হইতে নামিলাম, একটু পরে ফিরিয়া আসিয়া দেখি যে যুবক আর গাড়িতে নাই। স্টেশনে খুঁজিলাম, সব গাড়িতে খুঁজিয়া দেখিলাম, কোথাও কোন সন্ধান পাইলাম না। স্টেশনে কত লোক আসিতেছে কত লোক যাইতেছে কে তাহার খবর রাখে।
গাড়িতে আবার উঠিয়া নিজের সামান্য জিনিসপত্র ভাল করিয়া দেখিলাম। দেখিলাম কিছু চুরি যায় নাই। অপরিচিত যুবক যাহাই হউক, চোর নহে।
রাত্রে চক্ষে নিদ্রা আসিল না। রাত্রি অনেক হইল, তথাপি নিদ্রার লেশমাত্র নাই। আমার সঙ্গী যাহা যাহা বলিয়াছিল সব কথাই ভাবিতে লাগিলাম। সে যেরূপে অদৃশ্য হইল তাহাতে আরও অনেক ভাবনা বাড়িল।
অকস্মাৎ উঠিয়া বসিলাম। যে রাত্রে নোটগুলি চুরি যায় সেইরাত্রে যেমন শরীর অবসন্ন হইয়াছিল, এখনও সেইরূপ বোধ হইতে লাগিল। মনে অত্যন্ত ভয় হইল, ভিতরে চারিদিকে চাহিয়া দেখিলাম, কোথাও কিছু নাই। ক্রমে শরীর অবশ হইয়া পড়িল, আর বসিয়া থাকিতে পারিলাম না। চক্ষু মুদিত করিলাম, মুখে যেন কাহার নিশ্বাস লাগিল, চক্ষু খুলিয়া যে দেখিব সে সাধ্য নাই। কয়েক মুহূর্ত পরে নিদ্রা আসিল, গভীর নিদ্রায় মগ্ন হইলাম।
নিদ্রাভঙ্গ হইলে দেখিলাম প্রভাত হইয়াছে। আমি চক্ষু মুছিতে মুছিতে উঠিয়া বসিলাম। বসিলে বোধ হইল যেন বুকে কি বাঁধা রহিয়াছে। বুকে হাত দিয়া দেখিলাম উঁচু মতন যেন কি ঠেকিল। নোট নহে তো? নিমেষের মধ্যে অঙ্গবস্ত্র খুলিয়া ফেলিলাম, দেখিলাম আমার সেই রেশমের রুমালে যেমন করিয়া আমি বাঁধিয়া রাখিয়াছিলাম সেই রকম নোটের তাড়া বাঁধা রহিয়াছে। খুলিয়া গণিয়া দেখিলাম। নোটের নম্বর মিলাইয়া দেখিলাম, সব ঠিক আছে। যেমন টাকা তেমনি ফিরিয়া পাইলাম।
ফরাক্কাবাদে পঁহুছিয়া কাহাকেও কিছু বলিলাম না। যে কথা শুনিয়া সকলে হাসিবে সেকথা না বলাই ভাল। নোটগুলি রেজিস্টারি করিয়া মার কাছে পাঠাইয়া দিলাম।
কয়েকদিন পরে লোকনাথবাবুর একখানি পত্র পাইলাম। তিনি লিখিতেছেন, ‘বড়ই অদ্ভুত ব্যাপার ঘটিয়াছে। পরশু রাত্রের গাড়িতে আমি বাড়ি যাইতেছি। পথে ঘুমাইয়া পড়িয়াছিলাম। ঘুম ভাঙ্গিয়া দেখি, যে গহনার বাক্স চুরি গিয়াছিল সেই বাক্স আমার শিয়রে রহিয়াছে। তাহার কাছে নীল রঙের চশমা। যে বাক্স ফিরাইয়া দিয়াছে আমি তাহাকে দশ টাকা পুরস্কার দিতে স্বীকার করিয়াছি, কিন্তু কেহই সে পুরস্কার লইতে আসে নাই। চশমা জোড়া কি করিব বুঝিতে পারিতেছি না। গহনাগুলি পাইলাম, ভাল হইল। আমার কন্যার জন্য নূতন গহনা গড়াইতে হইবে না।’