চুরির তদন্ত – প্রতিভা বসু
বাড়িতে একটা বিচ্ছিরি চুরি হয়ে গেল। রাত্রিবেলা নয়, একা বাড়িতে নয়, নির্জন ঘরে নয়, একেবারে কড়কড়ে দুপুরের জনাকীর্ণ শোবার ঘরের আলমারি থেকে। সবাই জিজ্ঞেস করলে হৈমন্তী দেবী তার সময়ও বলে দিতে পারলেন, “বেলা দুটো থেকে পৌনে পাঁচটার মধ্যে।” যাকে বলে ভোজবাজি। সাড়ে তিন হাজার টাকা। টাকাটা ছিল একটা তালা-দেওয়া পিতলের ঝালির মধ্যে, ঝালিটা ছিল দেওয়াল আলমারির মেজো তাকে। আলমারিতে তালা দেওয়া ছিল। বিলিতি তালা। আলমারি যেমন আটকানো থাকে তাই আছে, খুলে দেখা গেল ভিতরে ঝালিটি নেই।
হৈমন্তী দেবীর মাথায় হাত। এখন কী করবেন তিনি? কলকাতা থেকে বেড়াতে এসেছেন শান্তিনিকেতনে, মাঝে মাঝেই আসেন, এসে থেকে যান কয়েকদিন করে। এবার এসেছেন একটু বেশিদিনের জন্য। দু’-একটা জরুরি কাজ আছে, সেরে যেতে হবে। সঙ্গে বরাবরের মতো তাঁর আয়া পদ্মা আছে, আর আছে এই বাড়িটি যে দেখাশুনো করে সেই আদিবাসী মেয়ে রঙ্গি। পদ্মা তাঁর কাছে আছে বছর সাত-আট হয়ে গেল। রঙ্গিও আছে তিন বছর ধরে। এসেই এই কাণ্ড।
ঠিক মনে আছে একটার সময় তিনি স্নান করতে গেলেন, ফিরে এসে দেখলেন মাছওলা দাঁড়িয়ে আছে টাকার জন্যে, ঝালি থেকে তাকে টাকা দিলেন। পদ্মাকে বললেন, “শোন, ঝালিতে অনেক টাকা। এটা এক্ষুনি আলমারির মধ্যে ঢুকিয়ে রাখ।” তারপর হেসে বললেন, “সবাই বলে, দেখবেন আপনার এই ঝালি একদিন ঠিক চুরি হয়ে যাবে। কেউ সুযোগ বুঝে হাতে ঝুলিয়ে নিয়ে চলে যাবে।”
পদ্মাও হেসে বলে, “বুঝলে মা, যারা মতলব করে তারা তোমার আলমারি থেকেও চুরি করতে পারে। তুমি তো সক্কলকে দেখিয়ে এটা থেকে টাকা বার করো।”
“ঠিক আছে, তুই না করলেই হয়। এখন তো তুই-ই আমার গার্জেন, তোর হাতেই তো আমার সব।”
রঙ্গি এসে বলল, “পোদ্মা বুলছে, উর বিহাতে উ তোমার কাছ থেকে একটা সোনার হার লিবে।”
“সোনার হার! ওরে বাপ রে! সোনার কত দাম জানিস? ভারী তো শখ দেখছি তোর।”
রঙ্গি বলল, “হামিও ছাড়বুনি, হামিও লিব। তুমি ঘোটা করে পদ্মার বিহা দিবে আর আমাকে একটা রূপহার পৈছে গড়িয়ে দিবে না, সে হোবেনি।”
কুল খেতে খেতে মুখ সাদা করে ছুটে এল অন্তু। সে যে কখন কোথায় থাকে ধরতেই পারেন না হৈমন্তী দেবী। সারাদিন বাইরে বাইরে ঘুরছে। সারা শান্তিনিকেতন তার নখদর্পণে। কত বন্ধু যে জুটিয়ে নিয়েছে, তার ঠিক নেই। সে ব্যস্তসমস্ত হয়ে বলল, “শোনো দিদা, আমি খেয়ে উঠেই সুমনকাকুর বাড়ি যাচ্ছি, কাকুর সঙ্গে আলমবাজার যাব। কাকুর ফরেস্টের বন্ধু দারুণ দাবা খেলে, আমি তাকে হারিয়ে দেব।”
অন্তু হৈমন্তী দেবীর নাতি। এখন তার ছুটি, তাই সে দিদার সঙ্গে এসেছে। মহা দুষ্টু, কিন্তু হাতে একখানা বই ধরিয়ে দিলে আর কথা নেই। বই তার নেশা। গোগ্রাসে গেলে। বই পেলে বিশ্বসংসার ভুলে যাবে। এখানে এসে বই পাচ্ছে না, যে দুটো নতুন নিয়ে এসেছিল, কোন জন্মে শেষ হয়ে গেছে। কেবল ডিটেকটিভ বই পড়বে। বয়েস এগারোর কাছাকাছি। হৈমন্তী দেবী ঠিক করেছেন, এবার থেকে ওর রুচিটা একটু বদলাবার চেষ্টা করবেন। কিন্তু অন্তু যে বড় হয়ে ডিটেকটিভই হবে, এ বিষয়ে তাঁর নিজের মনে কোনও সন্দেহ নেই। সুমন মুখার্জি এখানকার এসডিপিও, হৈমন্তী দেবীর বন্ধুর ছেলে। অন্তুর বেকার অবস্থার দুষ্টুমি দেখে একটা দাবার সেট কিনে এনে দিয়েছে। দুর্দান্ত বুদ্ধি। দু’দিনেই চমৎকার শিখে নিয়েছে। এখন ডিটেকটিভ বই ভুলে সারাদিন শুধু দাবা আর দাবা। দাবা বিনে কথা নেই।
হৈমন্তী দেবী পদ্মার হাতে চাবি দিলেন, পদ্মা আলমারি খুলে দ্বিতীয় তাকে ঝালিটা রাখল, আলমারি বন্ধ করল, টেনে দেখল, তারপর চাবিটা আবার হৈমন্তী দেবীর হাতে দিল। হৈমন্তী দেবী সেই চাবি কোমরে গুঁজে অন্তুকে নিয়ে খেতে এলেন খাবার ঘরে। ঘড়িতে তখন ঠিক দুটো বাজতে সাত।
খেয়ে উঠে একটু বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন, মালির সাইকেল নিয়ে অন্তু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে প্যাডেল করতে করতে চলে গেল সুমনের বাড়ি। অন্তুর সাইকেল চালানো দেখে হৈমন্তী দেবীর হাসি পেল। সিটে বসলে নাগাল পায় না, তাই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে প্যাডেল করে কী অদ্ভুতভাবে যাচ্ছে। এই অন্তটার জন্যই তিনি কলকাতা ছাড়তে পারেন না, নইলে কবে এখানকার বাসিন্দা হয়ে যেতেন। শান্তিনিকেতন তাঁর খুব ভাল লাগে।
তিনি যতক্ষণ বারান্দায় বাগানে একটু ঘোরাঘুরি করলেন, ততক্ষণে পদ্মা আর রঙ্গি কাজকর্ম গুছিয়ে স্নান করে খেতে বসল। রঙ্গি বলেছিল, আজ একবার বাড়ি যাবে। খেয়ে উঠে বলল, “আজ আর যাবুনি।”
তিনি বললেন, “সেই ভাল। রোজ রোজ কার জন্য ঘরে যাস? কেউ তো নেই।”
তা ঠিক। রঙ্গির কেউ নেই। একটা মেয়ে ছিল, খুব নাকি সুন্দর ছিল। এনসিসি-র এক সাহেব বিয়ে করে দিল্লি নিয়ে গেছে। রঙ্গি তার ঠিকানা জানে না, কেবল একে-ওকে জিজ্ঞেস করে। শেষে কী ভেবে ফাঁকা ঘরে গিয়ে বসে থাকে অনেকক্ষণ। লেপেপুছে পরিষ্কার করে ফেলে ঘরটা।
হৈমন্তী দেবী ঘরে এসে কোমর থেকে চাবি খুলে বালিশের কাছে রেখে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। ঘুম ভেঙে দেখলেন, বেলা পড়ে এসেছে। মালির ছেলে দাশু বলল, “আমি দোকানে যাচ্ছি। সর্ষের তেল আর চাল আনতে দেবেন বলেছিলেন।”
হৈমন্তী বললেন, “হ্যা, হ্যাঁ, দাঁড়া। টাকা নিয়ে যা।”
ঘরে এসে চাবি নিয়ে আলমারি খুললেন, অবধারিতভাবে নির্দিষ্ট জায়গায় হাত দিলেন, তারপরেই তাকিয়ে তাঁর চোখ কুঁচকে গেল। ঝালিটা সেখানে নেই। অন্যান্য তাক হাতড়ালেন, নেই। কাপড়চোপড় জিনিসপত্র সব ঘেঁটে সরিয়ে দেখলেন, নেই। বিস্মিত হয়ে ভয়ের গলায় ডাকলেন, “পদ্মা, পদ্মা।”
পদ্মা খাবার জল ধরছে বাইরের কল থেকে, ছুটে এসে বলল, “কী হয়েছে মা?”
“নেই।”
“কী নেই?”
“দ্যাখ তুই, আমি তো পাচ্ছি না।”
“কী পাচ্ছ না?”
“ঝালিটা।”
“ও ঝালিটা? সে তো আমি মেজো তাকে রেখেছি।” পদ্মা এগিয়ে এল। তারপর সে-ও আলমারি তছনছ করে ফেলল, ঝালিটা সত্যি নেই।
গেল কোথায়? নেবে কে? আলমারি তো তালা দেওয়া। চাবি তো তাঁর কাছে। রঙ্গিও তন্নতন্ন করল, নেই তো নেই। আলমারি ছেড়ে তখন সারা বাড়ি খোঁজা শুরু হল। রান্নাঘর, বাথরুম পর্যন্ত। অবস্থা দেখে দাশু বলল, “এখন আমি যাই মা, কাল সব এনে দেব।”
হৈমন্তী স্তম্ভিত।
আলাদা করে এবার তিনি পদ্মা আর রঙ্গির সঙ্গে কথা বললেন, “দ্যাখ, তোরা ছাড়া তো বাইরের কেউ নেই, কে নেবে? যদি হঠাৎ কোনও লোভবশত করে থাকিস আমাকে বল, আমি এ-নিয়ে আর কাউকে কিছু বলব না।”
ওরা কাঁদো কাদো গলায় বলল, “বিশ্বাস করো, আমরা নিইনি মা। আমরাও অবাক হয়ে যাচ্ছি ঝালিটা গেল কোথায়। অতগুলো টাকা। এদিকে আলমারি বন্ধ।”
বেলা পাঁচটা থেকে সন্ধে সাতটা হয়ে গেল ঝালি তো খুঁজে পাওয়া গেল না, কে চোর তাও বোঝা গেল না। ভোম্বল এল। ভোম্বল তাঁদের কলকাতার প্রতিবেশী, অবসরপ্রাপ্ত জজবাবুর নাতি, অবিনাশ ব্যারিস্টারের ছেলে। লেখাপড়ায় ভাল না হোক, দেখতে বড় সুন্দর ছেলেটা। হৈমন্তী দেবী খুব ভালবাসেন। ভোম্বল বলল, “দিদা, আমি কিছুতেই দুপুরে আসতে পারলাম না। আমার এক মামাতো ভাই আমাকে জোর করে সিনেমায় নিয়ে গেল, রেস্টুরেন্টে খাওয়াল, বলল কলকাতায় এই দিদার কাছে তো বারোমাসই থাকিস, বারোমাসই খাস, আজ আমি খাওয়াব। তুমি রাগ করোনি তো?”
ভোম্বলও কয়েকদিন হল কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে শান্তিনিকেতন বেড়াতে এসেছে। সকালের দিকে প্রায়ই আসে। আজও এসেছিল। হৈমন্তী দেবী বলেছিলেন, “দুপুরে এসে আমার সঙ্গে খাস।” আসেনি। এল এখন। তিনি বললেন, “আজ বাড়িতে বিশ্রী একটা কাণ্ড হয়েছে।”
ভোম্বল উদ্বিগ্নভাবে বলল, “কী?”
হৈমন্তী দেবী বললেন, “আমার ঝালিটা চুরি হয়ে গেছে।”
“তোমার ঝালিটা? ওই সুন্দর ঝালিটা। বেশি টাকাপয়সা ছিল না তো?”
“তা ছিল।”
“ছিল? কত?”
“সে-কথা বলে আর কিছু লাভ নেই। কিন্তু কী করে গেল সেটাই তাজ্জব ব্যাপার।”
সতেরো বছরের ভোম্বল, যাট বছরের বুড়োর মতো পাকা গলায় বলল, “এ যে একদিন হবে তা আমি জানতাম। কলকাতায় হয় না, সেখানে অনেক লোক। এখানে আর অসুবিধে কী? আমি তো সকালেও দেখে গেলাম, ঝালি খুলে রঙ্গিকে তুমি বাজারের পয়সা দিচ্ছ।”
“সকালে কেন, দুপুরেও ছিল। আলমারির ভিতরে চাবি দেওয়া ছিল।”
“তা সেখান থেকে কী করে যাবে? তালা ভাঙল কে?”
“তালা তো ভাঙেনি। সেটা যেমনকে তেমনই আছে। শুধু ভিতরে ঝালিটা নেই।”
“চাবি কোথায় ছিল?”
“যেমন থাকে, বালিশের তলায়।”
ভোম্বল ঠোঁট ভ্যাটকাল, “দেখলে তো, তোমার অত আদরের অত ইয়ে, কীরকম বিশ্বাসী। আরে বাবা, ওই পথের মানুষকে পথেই মানায়। ঘেঁটুফুল ফুলদানিতে মানায় না।”
বোঝা গেল ঘেঁটু ফুলটা কে। পদ্মাকে হৈমন্তী দেবী বলা যায় পথের থেকেই কুড়িয়ে এনেছেন। সাত-আট বছর আগে পদ্মা বালিকাই ছিল। মিষ্টি চেহারার সরল নিস্পাপ মুখ একটা মেয়ে। পথে বসে কাঁদছিল ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে। কোথাও যেতে যেতে তাকে দেখতে পেয়ে তিনি থামলেন, পিঠে হাত বুলিয়ে বললেন, “কাঁদছিস কেন রে?” আদরে যদিও ফোঁপানিটা বেড়ে গেল, কিন্তু ছোট্ট জীবনের ইতিহাসটি ও বলল— মা-বাবা নেই, জ্যাঠা-জেঠিমার কাছে থাকত, আজ তারা মেরে তাড়িয়ে দিয়েছে, তাই শহরে এসেছে খেটে খাবে বলে। কিন্তু যাদের সঙ্গে এসেছিল, তাকে তারা ফেলে যে কোথায় গেল আর খুঁজে পাচ্ছে না, তাই পথ হারিয়ে কাঁদছে। হৈমন্তী দেবী তক্ষুনি তাকে রিকশাতে তুলে নিয়ে বাড়ি চলে এলেন। সেই থেকে সে আছে এতদিন। বলা যায় প্রায় বাড়িরই মেয়ে। তেমনই আদরেই তাকে তিনি রাখেন। বাড়ির সব্বাই তাকে ভালবাসে। বিশেষত অন্তু। অন্তু একেবারে পদ্মাদি অন্ত-প্রাণ।
একটা বিয়ে ঠিক করেছেন। তাঁদেরই ড্রাইভারের ছেলে। টেন পর্যন্ত লেখাপড়া শিখে এখন কোন গ্যারাজে কাজ শিখে মেকানিক হয়েছে, ভাল রোজগার করে, ছেলেও খুব ভাল। ভোম্বলের কথায় হৈমন্তী দেবী দুঃখিত হলেন, কিন্তু প্রতিবাদও করতে পারলেন না। কে জানে কার মনে কখন কী পাপ ঢোকে, কী দুর্মতি হয়। সোনার হার করে করে যা অস্থির। তিনি যতই দিন সোনার হার তো দেবেন না? সারা দুপুর তিনি নিজে আর পদ্মা-রঙ্গি ছাড়া তো কেউ ছিলও না। সুযোগও ছিল। পদ্মা জানত ঝালিতে কত টাকা আছে। ম্লান মুখে চুপ করে রইলেন।
ভোম্বল এরপরে সাংঘাতিক চোটপাট করল ওদের উপরে। উত্তেজিত হয়ে অনেক খোঁজাখুঁজিও করল। তারপর বলল, “বাবা বলে দিয়েছেন, আমাকে আজই বাড়িতে ফিরতে হবে। এখন সিউড়ি যাচ্ছি, সেখান থেকে চলে যাব। ওই কথাই বলতে এসেছিলাম। কিন্তু তোমার যা অবস্থা দেখছি, এভাবে একা রেখে যাই কী করে? অথচ না গেলেও তো নয়।”
ব্যস্ত হয়ে হৈমন্তী দেবী বললেন, “না, না, তুই থেকে কী করবি? যা হবার তা তো হয়েইছে। ওরা আছে।”
“ওরা আছে।” রাগে গরগর করল, “দুটো ডাকাত। তোমার অতিরিক্ত সাহস। তুমি এক্ষুনি পুলিশে খবর দাও। রিটন কমপ্লেইন দাও, নয়তো কাজ হবে না। তুমি লিখে দাও, আমি বরং যাবার পথে দিয়ে যাই।”
হৈমন্তী দেবী বিষণ্ণভাবে বললেন, “এখানকার এসডিপিও সুমন মুখার্জি আমার খুব চেনা। এক্ষুনি এসে যাবে অন্তুকে নিয়ে। তারপর দেখি কী হয়।”
“হ্যাঁ, হ্যাঁ, অন্তু কই? চুরির খবরে অন্তুর কথা জিজ্ঞেস করতেই ভুলে গেছি।”
সুমনের আসতে বেশ দেরি হল। অন্তু টগবগ করে লাফাচ্ছে, সুমনকাকার সঙ্গে সে একটা খুনের জায়গায় গিয়েছিল। একজন বড় গোয়েন্দাও সঙ্গে ছিল। সুমন বলল, “আর বলবেন না মাসিমা, গিয়েছি বন্ধুর কাছে ছুটির দুপুর কাটাতে, গিয়েই এই সংবাদ। ছুটতে হল গাঁওহরিদ্রায়, পথ কি কম নাকি? উঁচু-নিচু গ্রামের মাঠ দিয়ে যাওয়া, পুলিশ নিয়ে, জিপ নিয়ে— ওই জন্যই দেরি হয়ে গেল ফিরতে। আপনি চিন্তা করেননি তো?”
হৈমন্তী দেবী হাসলেন, “অন্তু তবে একটা জলজ্যান্ত গোয়েন্দা চোখে দেখে এল? তার উপরে খুনের তদন্ত? কিন্তু বাড়িতেও যে একটি তদন্তের ব্যাপার ঘটে গেছে সুমন, তার কী করি বলো তো?”
“কী হল?”
“তুমি তো দেখেছ, ব্যাবসাদারদের যেমন একটা হাত-বাক্স থাকে, আমার ঠিক তেমনই একটা ঝালি থাকে পাশে। শুধু এটা আনতে হবে, সেটা আনতে হবে—সারাদিন পঞ্চাশবার উঠে উঠে আলমারি খোলা মহা ঝামেলা। ওই ঝালির তালা খুলেই পয়সা টাকা যে যা চায় দিই।”
“হ্যাঁ, হ্যাঁ, সে তো আমি বরাবর দেখে আসছি।”
“ওই ঝালিটি চুরি গেছে।”
“মানে?”
“কিছু বেশি টাকা ছিল তার মধ্যে, সেজন্য বেশি সাবধান হয়ে ওটাকে আলমারির ভিতরে ঢুকিয়ে চাবি দিয়ে রেখেছিলাম।”
“অর্থাৎ ঝালিতেও তালা ছিল, আলমারিতেও চাবি ছিল?”
“হ্যাঁ।”
‘তারপর?”
“আলমারি খুলে দেখি ঝালিটা নেই।”
“সে কী! কত টাকা ছিল?”
“সাড়ে তিন হাজার।”
“সাড়ে তিন হাজার?”
“হ্যাঁ।”
“সেই টাকাসুদ্ধ ঝালিটা নেই? অথচ আলমারি বন্ধ আছে।”
“হ্যাঁ।”
“আশ্চর্য, কখন টের পেলেন?”
“বেলা দেড়টা নাগাদ ওটা খুলে আমি টাকা বার করেছি, তারপর তালা বন্ধ করেছি, তারপর আমার সামনে পদ্মা আলমারি খুলে ঝালি রেখে আলমারি বন্ধ করে চাবি আমার হাতে দিয়েছে।”
“সেই থেকে চাবি আপনার কাছে?”
“হ্যাঁ।”
“আলমারিটা বন্ধ করেছে কি করেনি, তা কি আপনি নিজে টেনে দেখেছিলেন?”
“না।”
“ওই তো আপনাদের দোষ। সকলকে এত বিশ্বাস করেন? বাড়িতে তখন আর কে ছিল?”
“আমি রঙ্গি আর পদ্মা।”
“কেউ এসেছে তার মধ্যে?”
“না।”
“তা হলে আর তদন্তের প্রয়োজন কী? চোর তো আপনার ঘরেই রয়েছে। কাকে সন্দেহ করেন? পদ্মা, না রঙ্গি? নাকি দু’জনেরই সাঁট আছে, এত টাকা যখন।”
“আমি তো কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না সুমন। এদের সন্দেহ করতে আমার খুব খারাপ লাগছে, অ্যাদ্দিন ধরে আছে…”
“দাড়ান দেখছি। পদ্মা…” সুমনের পুলিশি গলা বেরিয়ে এল। পদ্মা ভয়ে জড়সড় হয়ে এসে দাঁড়াল।
“দুপুরবেলা তুমি আর রঙ্গি ছাড়া আর কেউ বাড়িতে ছিল?”
“না দাদাবাবু।”
“শুধু তোমরা দু’জন ছিলে?”
“হ্যাঁ।”
“কী করছিলে?”
“ঘুমোচ্ছিলাম।”
“রঙ্গি কী করছিল?”
“ও-ও ঘুমোচ্ছিল।”
“মাসিমাও ঘুমোচ্ছিলেন?”
“আজ্ঞে হ্যাঁ।”
“দরজা বন্ধ রইল, আলমারি বন্ধ রইল, তোমরা ঘুমিয়ে রইলে, ঘরে আর কেউ ঢুকল না, তবে ঝালিটা গেল কোথায়?”
“আমি কিছু জানি না, আমি কিছু করিনি, আমি নিইনি দাদাবাবু।”
সুমন প্রচণ্ড গলায় ধমক দিয়ে বলল, “ন্যাকামি কোরো না। বলো টাকা কোথায় গেল। ও-সব মেকি কান্না ঢের দেখেছি।”
“আমি জানি না, দাদাবাবু!” হাউমাউ করে উঠল পদ্মা আর সঙ্গে সঙ্গে অন্তুও কেঁদে ফেলে বলল, “পদ্মাদিকে কেন বকছ, পদ্মাদি নেয়নি।”
অন্তুর অবস্থা দেখে হৈমন্তী দেবী বললেন, “আজ বরং থাক সুমন, কাল যা হয় হবে।”
“তা তো হবেই। আমি কি ছাড়ব নাকি? টাকা তো এরাই নিয়েছে। সাড়ে তিন হাজার টাকা কি কম? কী দুর্জয় সাহস। রতিদারোগাকে পাঠিয়ে দেব কাল। দু’-চারটে রুলের গুঁতো না খেলে কি সিধে আঙুলে ঘি উঠবে?”।
“না, না, না।” অন্তু পদ্মাকে জড়িয়ে ধরল।
চলে গেল সুমন। বলে গেল এক্ষুনি গিয়ে একটা পুলিশ পাঠিয়ে দিচ্ছি, এদের চোখে চোখে রাখা দরকার।
পরের দিন সুমন আবার সেই খুনের তদন্তে কোথায় চলে গেল, আসতে পারল না। কিন্তু পুলিশ প্রহরায় রইল, দারোগাও এলেন। তিনি এসে একেবারে নাস্তানাবুদ করে ফেললেন পদ্মা আর রঙ্গিকে। হৈমন্তী দেবীকে বললেন, “আপনার আদিবাসী মেয়েটি মক্রমপুরের। মক্রমপুর হচ্ছে এখানকার বিখ্যাত গুন্ডা-বদমাশদের আড্ডা। যদূর সম্ভব দুটোতে মিলে সাঁট করেই করেছে। ওই জন্যেই বাড়ি গেল না। কিন্তু কিছুতেই স্বীকার করানো যাচ্ছে না। আসলে পিছনে মস্ত গ্যাং আছে, তাই ভয় কম। জানে ওরাই রক্ষা করবে। আজ রোববার, কিচ্ছু করা যাবে না। কাল থানায় নিয়ে গিয়ে যা করব, তখন দেখা যাবে এত সাহস বাছাধনদের থাকে কোথায়।”
হৈমন্তী ভীত গলায় বললেন, “মারধর করবেন না তো?”
দারোগা বললেন, “প্রয়োজনমতো সবই হবে, দুটো-চারটে আঙুল ভেঙে দিলেই মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসবে সব কথা।”
“না, না, না।” হৈমন্তী দেবী প্রায় আর্তনাদ করে বললেন, “যা বলবার বাড়িতে জিজ্ঞেস করুন। ওসব থানাটানার দরকার নেই।”
সে-কথা গ্রাহ্য না করে চলে গেলেন দারোগাসাহেব।
পুরো দুটো দিন দুটো রাত কারও ঘুম নেই, খাওয়া নেই, কী অবস্থা! টাকার কষ্ট ভুলে এখন হৈমন্তী দেবীর পদ্মা আর রঙ্গির চিন্তাই বড় হয়ে উঠেছে। একথা ভেবেই বেশি কষ্ট বোধ করছেন, এই অপকর্মটি ওরা কেন করল? ধরা যে পড়বেই সে তো জানা কথা। এদিকে অন্তু সাংঘাতিক মনমরা হয়ে আছে! কারও সঙ্গে কথা বলছে না, বিশেষত দিদার উপরই তার রাগ বেশি। দারোগাবাবু এসে মারবার মতো করে কত বিশ্রী বিশ্রী গালিগালাজ করে গেলেন, টেবিলে হান্টার মেরে মেরে কত ভয় দেখালেন, অথচ দিদা একটুও প্রতিবাদ করল না। সেজন্য দিদাকে সে কিছুতেই ক্ষমা করতে পারছে না।
দুপুরবেলা খুব মন খারাপ করে শুয়ে ছিল। দিদা পাশে শুয়ে বই পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে পড়েছেন। বাকুম বাকুম পায়রা ডাকছে বাইরে, শিরীষ গাছের শুকনো ফলগুলো বাতাসে নড়ে নড়ে গানের মতো আওয়াজ করছে। শুনতে শুনতে সে আস্তে আস্তে উঠে বসল। খাট থেকে নামল, তারপর নরম পায়ে ঘুরতে লাগল ঘরের মধ্যে। সেই মুহূর্তে নিজেকে সে অন্তু ভাবছিল না, কোনও বইয়ের কোনও বড় ডিটেকটিভের সঙ্গে একাত্ম বোধ করছিল। কচি মুখের চেহারা। তাদের মতোই পাশ করে রীতিমতো গম্ভীর। আজ সে একটা হেস্তনেস্ত করবেই করবে, এই তার পণ। তার দৃঢ় ধারণা, যে-কোনওভাবে হোক, একটা চোর ঘরে ঢুকেছিল। পদ্মাদি কক্ষনও চুরি করেনি। রঙ্গিদিও না।
সব ঘর ঘুরে রান্নাঘরে এল। দেখল দরজাটা আধো খোলা, সংলগ্ন চাতালের রোদে পদ্মাদি আর রঙ্গি শুয়ে ঘুমোচ্ছে। ওরা রোজই এরকম ঘুমোয়। তাদের পাশ কাটিয়ে সে বাইরে এল। কিন্তু তারা জেগে গেল না, আর তক্ষুনি মনে হল চোর এভাবেই ঢুকেছিল। সে আবার পাশ কাটিয়ে যেন চোর ঢুকছে সেভাবেই ঘরে ঢুকল, এখনও তারা টের পেল না। এবার অন্তু সন্তর্পণে দিদার মাথার কাছে এসে আস্তে চাবিটা নিল। তবু দিদা টের পেলেন না। চাবি নিয়ে আলমারি খুলল। মজা তো! তবে তো চোর এই পথেই এসে এইভাবেই আলমারি খুলে চুরি করেছে। যেখানে ঝালিটা ছিল হাত দিল সেখানে। কোণের দিকে কী একটা হাতে লাগতে টেনে এনে দেখল একটা ছোট্ট গোল, চারপাশে সোনালি কাজ করা আয়না। বুকের ভিতরে বিদ্যুৎ চমকে উঠল। চকচক করল চোখ, বুঝে ফেলল চোরমশায়টি কে।
তক্ষুনি চাবি ছুড়ে ফেলে আলমারি খোলা রেখে ধাক্কা মেরে দিদাকে জাগিয়ে গায়ের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে বলল, “দিদা, আমি চোর ধরেছি, এই যে তার চিহ্ন। কেমন করে কীভাবে ঘরে ঢুকেছে, তাও আমি দেখিয়ে দিতে পারি। তুমি পুলিশ পাঠিয়ে ওকে এক্ষুনি অ্যারেস্ট করে নিয়ে এসো।”
অন্তুর মুখ লাল, উত্তেজনায় সে থরথর করে কাঁপছে।
ঘুম-চোখে কিছুক্ষণ নাতির মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে দিদাও উত্তেজিতভাবে উঠে বসলেন, “কী বলছিস তুই? কে চোর? কোথায় চোর।”
“এই দ্যাখো, এই দ্যাখো।”
“কী এটা?” তারপরেই আয়নাটা দেখে অবাক হয়ে বললেন, “ওমা, এটা তুই কোথায় পেলি? এ-আয়নাটার কথা তো আমি ভুলেই গিয়েছিলাম। কী সুন্দর আয়নাটা, তোর ছোটপিসি দিয়েছিল আমাকে। সবসময়ে আমার ব্যাগে থাকত, তারপর হঠাৎ একদিন দেখি নেই।”
“এটা তোমার আয়না?”
“পাঁচ-সাত বছরের মধ্যেও তো আয়নাটার কথা আমার মনে পড়েনি। কী লক্ষ্মী ছেলে, কেমন তামার আয়নাটা খুঁজে পেয়েছে।”
হাত বাড়িয়ে আদর করতে গিয়েছিলেন, অন্তু সবেগে সরে দাঁড়িয়ে ক্রুদ্ধভাবে বলল, “এটা মোটেও তোমার আয়না নয়। এ-আয়না ভোম্বলদার, সবসময় ভোম্বলদার পকেটে থাকে। এ-আয়না আমি আলমারিতে পেয়েছি। ওই ঝালি ভোম্বলদা চুরি করেছে। ভোম্বলদার পকেট থেকে এ-আয়না পড়ে গেছে সেখানে।”
“ভোম্বলদা!” অন্তুর কথা শুনে হৈমন্তী দেবী অবাক।
“হ্যাঁ, ভোম্বলদা। ভোম্বলদা মিছে কথা বলেছে, দুপুরে এসে নিজে চুরি করে সন্ধেবেলা এসে পদ্মাদির নাম বলেছে।”
“অন্তু!” তিরস্কারের গলায় নামটা উচ্চারণ করে হৈমন্তী দেবী বললেন, “তুমি কাকে কী বলছ, তা জানো না।”
“জানি। ভোম্বলদা ভাল না। একটুও ভাল না। আমি একদম দেখতে পারি না ভোম্বলদাকে। আমি ক্লাসে ফার্স্ট-সেকেন্ড হই বলে একা পেলেই আমার মাথায় টকাটক চাঁটা মারে, আর বাড়ির কাউকে দেখলে আদর করে।”
“যা বলেছ আমার কাছে বলেছ, আর যেন কখনও এ-কথা কেউ তোমার মুখ থেকে না শোনে। ছি ছি ছি, নিজের দাদার মতো, কত ভালবাসে, চকোলেট এনে দেয়, ক্যারম খেলে বসে বসে।”
লজ্জায় মরে গেলেন হৈমন্তী দেবী। ভোম্বলকে কেন যে অন্তু দেখতে পারে না, কে জানে। “ভোম্বলের বাবা অবিনাশ যদি শোনে এ-কথা? ছি ছি। ওর দাদু জজবাবু যদি শোনেন। কত সম্রান্ত লোক—ছি ছি…”
দিদার গরম গলা শুনে অন্তু ধড়াস করে বিছানায় শুয়ে পড়ে বালিশে মুখ ঢেকে ফুলে ফুলে কাঁদতে লাগল। এতখানি বয়সে কোনওদিন তো দিদার গলায় এরকম গরম শোনেনি। মা বকেন বলে কত রাগ করেন। আর আজ কিনা সে ওই দুষ্ট ভোম্বলদাটার জন্য বকুনি খেল?
হৈমন্তী দেবী তক্ষুনি পদ্মা-রঙ্গিকে ডেকে সব গুছিয়ে নিতে বললেন। আর এখানে থাকা নয়। কাল ভোরের ট্রেনেই চলে যাবেন কলকাতা। সুমন সন্ধেবেলা এলে বললেন, “টাকা উদ্ধারের চেষ্টা করে দরকার নেই। যা গেছে, গেছে। কারা নিয়েছে সে তো বোঝাই গেল। রঙ্গিকে ছাড়িয়ে দিয়ে যাব। পদ্মার ব্যবস্থা যা হয় কলকাতা গিয়ে হবে। এখানে থাকাটা অন্তর পক্ষে ক্ষতিকর হচ্ছে।”
রাত্রিবেলা সাড়ে ন’টার ট্রেনে এক অপ্রত্যাশিত অতিথি এসে হাজির। সকলের খাওয়া-দাওয়া সারা, অন্তু ঘুমিয়ে পড়েছে, পদ্মা-রঙ্গিও শুয়ে পড়েছে, হৈমন্তী দেবী জানালা দিয়ে দেখে দরজা খুলে অবাক হয়ে বললেন, “তুমি! হঠাৎ! এখানে?”
“এর মধ্যেই শুয়ে পড়েছিলেন?”
“আর কী? শান্তিনিকেতনে তো এখন গভীর রাত। আমার বাড়িতেই আলো। কী ব্যাপার? এসো, এসো। এই পদ্মা, ওঠ দ্যাখ কে এসেছে।”
অতিথি বলল, “খুব একটা জরুরি কাজে এসেছি মাসিমা। কথাটা ব্যক্তিগতভাবে আপনাকেই শুধু বলতে চাই।”
“বলো।”
অতিথি কোনও ভণিতা না করে বলল, “আমার পুত্রটি একটি গুণধর। নানারকম কু-অভ্যাস তো হয়েইছে, তা বলে তার অধঃপতন যে এতদূর, এ আমি কল্পনাও করতে পারিনি। যাই হোক, সংক্ষেপে ঘটনাটা এই, ভোম্বল চুপিচুপি দুপুরবেলা এসে আপনার আলমারি থেকে সাড়ে তিন হাজার টাকা চুরি করে কলকাতা গেছে। সিনেমার হিরো হবে। ওই টাকা নিয়ে পালিয়ে বম্বে যাচ্ছিল আর-এক বন্ধুর সঙ্গে। ওর মা ধরে ফেলেছেন। আমার হাতে যথেষ্ট মার খেয়ে শেষে স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছে, এ-টাকা সে কোথায় পেল, কীভাবে চুরি করল। এই সেই টাকা।”
রাবার-ব্যান্ড আটকানো টাকার বান্ডিলটা ভোম্বলের বাবা অবিনাশ বালিশের তলায় গুঁজে দিলেন।
হৈমন্তী দেবীর মুখে আর বাক্য সরল না। চকিতে একবার অন্তুর দিকে তাকালেন শুধু।
১৬ মার্চ ১৯৮৮
অলংকরণ: কৃষ্ণেন্দু চাকী