গৌড়ানন্দ কবি ভনে

চুয়াত্তরের সুসমাচার

চুয়াত্তরের সুসমাচার

চুয়াত্তর সালটা যে দামী বছর, পশ্চিমবঙ্গ সরকার আমাদের তা নানাভাবে বুঝিয়ে দেবার জন্য গোটা বছরের এক কর্মসূচী গ্রহণ করেছেন। ১ জানুয়ারি রেশনে চালের দাম বাড়িয়ে এই কর্মসূচীর সূচনা।

খাদ্য ও সরবরাহ দফতরের এক মুখপাত্র এই প্রসঙ্গে বলেন, আমাদের জীবনযাত্রার মান এর ফলে বৃদ্ধি পাবে। শুধু এই নয়, আমরা চালের দাম যেমন বাড়িয়েছি তেমনি আবার পারিবারিক বাজেটের ভারসাম্য যাতে নষ্ট না হয়, সেই কারণে দুধের সরবরাহও নিয়ে যে সংকটের সৃষ্টি হয়েছিল, এবার, অত্যন্ত আনন্দের কথা যে সেই সংকটেরও নিরসন করা গিয়েছে। আমাদের সদা তৎপর খাদ্যমন্ত্রী কেন্দ্রীয় সরকারকে এক চিঠিতে জানিয়েছেন, চিনি পাঠান। ট্রেনের গোলমাল থাকলে লরিতেই পাঠান। আমাদের দৃঢ় আশা, ১৯৭৫ সালের মাঝামাঝি কলকাতায় চিনি এসে যাবে। কাজে কাজেই ১৯৭৪ সালে চিনি সরবরাহের কোনও ঝামেলাই থাকবে না।

কয়লা পাবার ব্যাপারে যে ঝামেলা চলছিল, তা দূর করার জন্য জরুরি ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। ভারতে কয়লা খনির উন্নতিকল্পে ভারত-সোভিয়েত সহযোগিতা চুক্তি অনুযায়ী কয়লা তোলার ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। আমাদের আশা, ১৯৮০ সালের মধ্যেই আমরা এই নতুন ব্যবস্থার কয়লা পেতে শুরু করব।

হ্যাঁ গ্যাস। দুর্গাপুর থেকে গ্যাস আসার ব্যাপারে এতদিন যে অনিশ্চয়তা চলছিল, তা আর থাকছে না। কারণ গ্যাসের সরবরাহ ব্যবস্থা প্রায় ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়েছে। ইনডেন বা অন্যান্য সিলিনডার গ্যাসের খালি খোলগুলো সুভেনির হিসাবে ব্যবহার করা চলবে।

পরিবহণ দফতরের গোপন সূত্র থেকে জানা গিয়েছে যে, বেসরকারী বাস এবং ট্যাকসি ধর্মঘটের ফলে মাঝে মাঝেই যে যাত্রীদের হয়রানি পোয়াতে হচ্ছে, পরিবহণ মন্ত্রী সে ব্যাপারে মুশকিল আসানের সূত্র বের করে ফেলেছেন। এই সূত্র অনুসারে জানা গিয়েছে যে পরিবহণমন্ত্রী বাসে চড়া নিয়ন্ত্রণ করতে চান। আপাতত তিনি পরিবার পিছু দুখানা করে বাসে চড়ার পারমিট ইস্যু করবেন। এবং ওই পারমিট দেখিয়ে— একটি পারমিটে একজন এই ভিত্তিতে— প্রত্যেকে মাসে পাঁচ দিন বাসে চড়তে পারবেন। পরিবহণ দফতরের ঘনিষ্ঠ মহল মনে করেন, সরকারী বাসে বর্তমানে যাত্রী বহনের যে ক্ষমতা আছে, পারমিট প্রথা চালু হলে, তদনুযায়ী সরকারী বাস একাই কলকাতার পরিবহণ সমস্যার সমাধান করতে পারবে। বেয়াদব বেসরকারী বাসের আর দরকারই হবে না।

চুয়াত্তরের আরও একটা ভালো খবর, দ্বিতীয় সেতু। অনেকেই হতাশ হয়ে ভাবছিলেন, দ্বিতীয় সেতু বুঝি ধামা চাপা পড়ে গেল। হয়তো অন্য কেউ হলে ধামা চাপা পড়েই যেত। কিন্তু পারাপারের ভারটা পূর্তমন্ত্রী ভোলা সেনের হাতে থাকায়, ভাগ্যিস ছিল, দ্বিতীয় সেতুর কথা বার্তা এখনও চলছে। দ্বিতীয় সেতুর চেয়ারম্যান হিসাবে ভোলা সেন জানান, এখন বিদেশি উপদেষ্টার পারিশ্রমিক নিয়ে কেন্দ্র, ব্রিটেন ও জারমানির সঙ্গে চিঠি চালাচালি চলছে।

দ্বিতীয় সেতু মহলের সূত্র প্রকাশ, ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত এই চিঠি চাপাটি চালাচালির কাজ চালিয়ে যাবার রণকৌশল গ্রহণ করা হয়েছে। এইভাবে ঐ কটা বছর কাটিয়ে দিতে পারলে গঙ্গা বা ভাগীরথী বা হুগলি নদী শুকিয়ে শুকিয়ে তাতে চড়া পড়ে যাবে। তখন গরান এবং সুন্দরি কাঠ দিয়ে মজবুত দুটো আপ আর ডাউন সাঁকো অনায়াসে বানিয়ে ফেলতে আর অসুবিধা হবে না। এবং পূর্তমন্ত্রীর কীর্তি অক্ষয় করে রাখার জন্য ‘ভোলা বাবা পার করে গা’ এই চরণটি দুটো কাষ্ঠ ফলকে উৎকীর্ণ করে রাখা হবে।

টেলিভিশনের ব্যাপারেও আমাদের উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। তথ্য ও জনসংযোগ দফতরের এক মুখপাত্র জানালেন, ‘নিশিদিন ভরসা রাখিস, ওরে মন হবেই হবে’— আমরা এই নীতি অনুসরণ করে চলেছি। চুয়াত্তর সালে টেলিভিশনের ব্যাপারে আমরা যে কর্মসূচী গ্রহণ করেছি, সেটা দেখলেই বুঝতে পারবেন, আমাদের মাননীয় মন্ত্রী এ বিষয়ে কতটা সিরিয়াস। তিনি এই কথা বলে আমাকে ওদের কর্মসূচীটা দেখালেন। দেখা গেল চুয়াত্তর সালের বারো মাসে তথ্য ও জনসংযোগ মন্ত্রী বারোটা সাংবাদিক বৈঠক তলব করবেন বলে ঠিক করেছেন। এবং ওই সকল বৈঠকে তিনি, জনসাধারণ যাতে টেলিভিশনের বিষয় ভুলে না যায়, তার জন্য প্রয়োজনীয় ঘোষণা করবেন।

চুয়াত্তরের শিক্ষা বিষয়ক সুসমাচার এই যে যে-সকল ছাত্রছাত্রী দশ ক্লাশের নতুন সিলেবাস অনুযায়ী পড়বে, এই বছরটা তাদের ছুটি। কারণ তাড়াহুড়ো করে যে সিলেবাস তৈরি করা হয়েছিল এবং যে-সকল আবশ্যিক বিষয় পাঠ্যতালিকাভুক্ত করা হয়েছিল, জানা গিয়েছে অধিকাংশ ইশকুলেরই ঐ ফিরিস্তি অনুযায়ী পড়াবার মতো ব্যবস্থা নেই। পাঠ্যবইও বছরের শেষদিকে পাওয়ার সম্ভাবনা, যদি বই ছাপাবার কাগজের জোগাড় করা যায়।

শিক্ষা দফতরের এক মুখপাত্র জানান, এইসব অসুবিধা যাতে তাড়াতাড়ি দূর করা যায় তার চেষ্টা তাঁরা করছেন। বই ছাপার কাগজ যাতে ঠিক মতো পাওয়া যায়, সে বিষয়ে তাঁরা ইতিমধ্যেই শিল্প দফতরের সহযোগিতা ভিক্ষা করবেন বলে জানালেন।

শিল্প দফতর জানালেন, তাঁরা সহযোগিতা করতে সর্বদাই প্রস্তুত। শিক্ষা দফতর থেকে তাঁরা এখনও পর্যন্ত সরকারিভাবে কোনও অনুরোধ পাননি। তবে তাঁরা নিজেরাই অগ্রণী হয়ে কাগজকলের মালিকদের কাছে অনুরোধ জানিয়ে রেখেছেন যে, বই ছাপার কাগজের সরবরাহ যেন বজায় থাকে। এই প্রসঙ্গে কাগজকলের পক্ষ থেকে শিল্প দফতরকে জানানো হয়েছে, কাঁচা মালের অর্থাৎ বাঁশের যোগাড় যদি শিল্প দফতর করে জিতে পারেন তবে তাঁরা বই ছাপার কাগজের সরবরাহ অব্যাহত রাখতে পারবেন।

শিল্প দফতর জানান, শিক্ষা দফতর থেকে বই ছাপার কাগজ সরবরাহ সম্পর্কে সরকারিভাবে অনুরোধ পেলেই অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে বাঁশের চাষ বাড়াবার জন্য কৃষি দফতরকে অনুরোধ জানাবেন। তাঁরা বলেন এই বিষয় স্বনির্ভরতাই আমাদের লক্ষ্য। অন্য রাজা বাঁশ দেবে তবে আমাদের শিক্ষা চলবে, এই নীতি অবিলম্বে পরিত্যাগ করাই শিল্প দফতরের নীতি।

পুনশ্চ : চুয়াত্তরের সব থেকে বড় খবর, পশ্চিমবঙ্গ সরকার কেন্দ্রের কাছে তদ্বিরের জন্য শ্রী সিদ্ধার্থশংকর রায় নামক এক ব্যারিস্টারকে মুখ্য জনসংযোগ অফিসার হিসাবে স্থায়ীভাবে নিয়োগ করেছেন।

২ জানুয়ারি ১৯৭৪

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *