চুনিলালবাবুর লাল চুনি
গুপ্তাসাব, ব্যাপারটা ঠিক খুন নয়–তবে অনেকটা খুনের মতো।
গাড়ির জানলার বাইরে চোখ রেখে বিকেলের কলকাতা দেখতে-দেখতে কথাটা বলল ইনস্পেক্টর রঘুপতি যাদব।
ক্যাডবেরি রঙের মারুতি আটশো শ্যামবাজার পাঁচমাথার মোড় ছুঁয়ে এগোচ্ছিল বাগবাজারের দিকে। গাড়ির পিছনের সিটে উদ্বিগ্ন মুখে বসেছিল রঘুপতি। ওর পাশেই বসে অধ্যাপক ডক্টর অশোকচন্দ্র গুপ্ত, সংক্ষেপে এসিজি। তার সরু-সরু আঙুলের ফাঁকে জ্বলন্ত ডানহিল সিগারেট।
এমনিতে এসিজির প্রিয় উইলস ফিলটার। কিন্তু রঘুপতি কোথা থেকে যেন এক কার্টন ডানহিল জোগাড় করে এসিজিকে উপহার দিয়েছে একটু আগেই। আর সেই সঙ্গে উপহার দিয়েছে একটা সমস্যা–যেটা ঠিক খুন নয়, খুনের মতো।
সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে প্রাক্তন ছাত্র রঘুপতিকে দেখছিলেন এসিজি।
ছোট করে ছাঁটা চুল, কাঁচা-পাকা চওড়া গোঁফ, ফরসা মুখে সামান্য বসন্তের দাগ। হাতের শিরা এবং পেশি দুশমনদের সাবধান করে দেওয়ার মতো। আর চোয়ালের উদ্ধত রেখা সেখানে জুড়ে দিয়েছে একটা বেপরোয়া ভাব। এ ছাড়াও একটা কিলার ইন্সটিংক্ট যেন আবছাভাবে খুঁজে পাচ্ছিলেন এসিজি।
ছাত্রজীবনের রঘুপতির সঙ্গে আজকের কাজপাগল ইন্সপেক্টর রঘুপতি যাদবের কতটা অমিল, সেটাই ভাবছিলেন ওর প্রাক্তন স্যার অশোকচন্দ্র গুপ্ত।
এ ছাড়া, স্যার, ব্যাপারটার মধ্যে পাখিও আছে– এসিজির দিকে ঘুরে তাকিয়ে বলল রঘুপতি, আপকা ফেবারিটপছি। অওর উসকে সাথ এক রুবি কি কাহানি।
মাথার সাদা চুলের গোছায় টান মেরে চোখে জিজ্ঞাসা ফুটিয়ে তুললেন অশোকচন্দ্র ও রুবির কাহিনি? তার মানে?
রুবি–যাকে বাংলায় আপনারা চুনি বলেন। জেমস্টোন। খুব কলি।
ধোঁয়া ছেড়ে হাসলেন এসিজি। বললেন, তোমার টেনশান কমাও রঘুপতি। তখন থেকে যেরকম খাপছাড়াভাবে ইনফরমেশানের টুকরো ছড়িয়ে চলেছ, তাতে আমার মতো থিঙ্কিং মেশিনেরও মস্তক ঘূর্ণিত। তোমাকে তো বহুবার বলেছি, গায়ের জোরের লড়াইয়ে স্পিডটা একটা ফ্যাক্টর, কিন্তু বুদ্ধির লড়াইয়ে নয়। নাউ কাম অন, বেশ রয়েসয়ে গুছিয়ে গল্পটা বলো আমাকে।
একটু আহত হয়ে রঘুপতি বলল, বলছি গুপ্তাসাব, কিন্তু ঘূর্ণিত মানে কী?
হো-হো করে হেসে উঠলেন বৃদ্ধ হুনুর। ছোট হয়ে আসা সিগারেটের টুকরোটা গাড়ির জানলা দিয়ে বাইরে ফেলে দিয়ে বললেন, সে তোমাকে পরে বলে দেব। এখন শুরু করো তোমার রুবিকি কাহানি
ওঁদের গাড়ি তখন বাগবাজারে বাটার দোকানের কাছে বাঁ-দিকে বাঁক নিচ্ছে।
রঘুপতি যাদব একটু গম্ভীর মুখে বলতে শুরু করল। ওর ভুরু কুঁচকে গেল, চোখ সামান্য ছোট হয়ে এল।
ওর পাশে বসা খদ্দরের ঢোলা পাঞ্জাবি আর পাজামা পরা বৃদ্ধ মানুষটি তখন আনমনাভাবে মাথার সাদা চুলের গোছায় টান মারছেন, আর বাগবাজার বাটার মোড়ে পুজোর কেনাকাটার ভিড় দেখছেন। কিন্তু তার কান ও মস্তিষ্কের মনোযোগ পুরোপুরি রঘুপতির দিকে। রঘুপতির কাছ থেকে সংক্ষেপে যা জানা গেল, তা হল এই
বাড়িটার নাম লালমহল। বাগবাজারের গঙ্গার ঘাটের কাছাকাছি দুমহলা পুরোনো বাড়ি। বাড়ির দালানে বিশাল বিশাল ডোরাকাটা থাম। থামের মাথায় কার্নিশের খাঁজে গোলা পায়রার বাস। বাড়ির চণ্ডীমণ্ডপে এখনও ছোট মাপের দুর্গাপুজো হয়।
বাড়িটার রং লাল। অন্তত এককালে তাই ছিল। কালের প্রকোপে সেই লাল কোথাও গোলাপি, কোথাও বা বর্ণহীন হয়ে পড়েছে। বাড়ির সদর দরজায় রং-চটা শ্বেতপাথরের ফলকে লেখা রায়বাহাদুর রবীন্দ্রলাল গোস্বামী।
রবীন্দ্রলাল অন্তত চল্লিশ-বিয়াল্লিশ বছর আগে ইহলোক ছেড়েছেন। তবে তাঁর চার ছেলে এখনও বহাল তবিয়তে লালমহল-এ বাস করেন।
বড় ছেলে শ্যামসুন্দরলাল গতকাল মারা গেছেন। তিনি সবসময় পাখি নিয়ে মেতে থাকেন– মানে, থাকতেন। বাড়ির অনেকটা অংশ খাঁচায়-খাঁচায় ছয়লাপ।
মেজো ছেলে চুনিলাল মণিরত্নের ব্যবসা করেন। দেবদেবীভক্ত ধর্মভীরু মানুষ। অন্য ভাইদের মতো সংসার-ধর্ম করেননি।
সেজ রঙ্গলাল হিসেব মতো বেকার। তবে শোনা গেছে তিনি নাকি টুকটাক সাপ্লাইয়ের কাজ করেন।
আর সকলের ছোট গজেন্দ্রলাল এখনও ঠিক কোনও ব্যবসায় থিতু হয়ে বসতে পারেননি।
ঘটনাটা ঘটেছে গতকাল, দুপুর দুটো নাগাদ।
শ্যামসুন্দরলালের কাছে একটা ফোন এসেছিল। কে ফোন করেছিল সেটা জানা যায়নি। টেলিফোনে উত্তেজিত হয়ে কথা বলতে বলতেই তিনি আচমকা হার্টফেল করে মারা যান।
তার চিৎকারে বাড়ির অনেকে ছুটে আসেন। কিন্তু ততক্ষণে সব শেষ।
ব্যাপারটার এমনিতে কোনও জটিলতা ছিল না। অত্যন্ত স্বাভাবিক মৃত্যু। তা ছাড়া শ্যামসুন্দরলালের বয়েসও হয়েছিল প্রায় বাষট্টি।
কিন্তু গোলমাল বাঁধালেন চুনিলালবাবু। তিনি বললেন যে, প্রায় দু-লাখ টাকা দামের একটা টকটকে লাল চুনি তিনি তাঁর বড়দার কাছে রাখতে দিয়েছিলেন।
সেটার কোনও খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। সেইজন্যই গুপ্তাবকে জরুরি তলব করেছে রঘুপতি। খুঁজে বের করতে হবে চুনিবাবুর চুনি।
রঘুপতির কথা শেষ হতে-না-হতেই এসিজি প্রশ্ন করলেন, শ্যামসুন্দরলালের মারা যাওয়ার ব্যাপারটাকে তুমি খুনের মতো বলছ কেন?
বলছি কি আর সাধে! একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল রঘুপতি। তারপর বলল, ওই হতচ্ছাড়া জেবরাতের জন্যে কদিন ধরেই কোন এক আদমি শ্যামসুন্দরবাবুকে থ্রেট করছিল। তাতে উনি ভয়ও পেয়েছিলেন, আবার খুব এক্সাইটেড হয়ে পড়েছিলেন। আমার মনে হচ্ছিল, উনি এভাবে মারা না গেলে হয়তো ওই আন্নােন পারসনের হাতে খুন হয়ে যেতেন…।
এসিজি এক ফাঁকে সিগারেট ধরিয়ে ফেলেছিলেন আবার। চশমাটা নাকের ওপরে ঠিক করে বসিয়ে সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে বললেন, সেই লোকটা কেমন করে জানল যে, চুনিটা শ্যামসুন্দরলালবাবুর কাছে আছে?
ঠোঁট উলটে রঘুপতি বলল, কে জানে! হয়তো কারও কাছ থেকে ইনফরমেশান পেয়েছে।
যখন শ্যামসুন্দর মারা যান তখন চুনিলাল কোথায় ছিলেন?
বাড়িতেই। কথাটা বলে জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে রঘুপতি কী যেন দেখল। তারপর বলল, স্যার, আমরা লালমহলে এসে গেছি।
বাড়ির সামনে ভাঙাচোরা ট্রাম-রাস্তা। কোথাও কোথাও জল জমে আছে। বাড়ির উলটোদিকে দুটো বিশাল মাপের গোডাউন। তার পিছনেই বোধহয় গঙ্গা।
ড্রাইভারকে গাড়ি পার্ক করতে বলে রঘুপতি এসিজিকে আমন্ত্রণ জানিয়ে বলল, আইয়ে স্যার,–ওয়েলকাম টু লালমহল।
এসিজি প্রাক্তন ছাত্রের ভঙ্গি দেখে সামান্য হাসলেন। তারপর মাথার সাদা চুলে হাত চালিয়ে বললেন, চলো, দেখা যাক তোমার চুনিলালবাবুর চুনি উদ্ধার করা যায় কি না।
কলিংবেল টিপতেই বাড়ির দরজায় একজন বয়স্ক পুরুষ এসে হাজির হলেন। দেখে বনেদি বাড়ির পুরাতন ভৃত্য বলেই মনে হল। রঘুপতি নিজের পরিচয় দিতেই দ্রুত আদর-আপ্যায়ন শুরু হয়ে গেল।
বাড়ির ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে রঘুপতি যাদব নীচু গলায় বলল, ব্যাপারটা লালবাজার পর্যন্ত গড়াত না। তবে চুনিলালবাবুর থোড়াবহত আপার লেভেল কানেকশা আছে। সেইজন্যেই..।
কথা বলতে বলতে ওঁরা চৌকো মাপের বিশাল ঠাকুর-দালানে এসে পড়েছিলেন। তার একপাশে চণ্ডীমণ্ডপ। সেখানে প্রতিমা গড়ার কাজ চলছে। এখন শুধু শেষ তুলির টান আর সাজসজ্জা বাকি।
হঠাৎই ওঁদের সামনে এসে দাঁড়ালেন শ্যামলা রঙের একজন ভদ্রলোক। তার ডান হাতের তিন আঙুলে রুপো দিয়ে বাঁধানো তিনটে পাথরের আংটি। প্রকট হেসে তিনি বললেন, আগমনের খবর পেয়েছি । তাই রিসিভ করতে এসেছি। অধমের নাম রঙ্গলাল / চুনিটা বেপাত্তা হয়েছে। গতকাল।
এসিজি অবাক হয়ে লালমহলের রঙ্গলালবাবুকে দেখছিলেন।
পরনে ফতুয়া গোছের পাঞ্জাবি আর ধুতি। মাথার মাঝখানে সিঁথি। তেল-চকচকে কোঁকড়ানো চুল। ছোট-ছোট চোখ। কপালের বাঁ-দিকে একটা ছোট আঁচিল। নাকটা সামান্য বড় মাপের। দাড়ি গোঁফ কামানো। মুখে প্রসাধনের সুবাস। আর সদাসঙ্গী আকৰ্ণবিস্তৃত হাসি।
শ্যামসুন্দরলালবাবু কোন ঘরে মারা গিয়েছিলেন? রঘুপতি জানতে চাইল।
রঙ্গলাল অতিরিক্ত বিনয় প্রকাশ করে বললেন, দোতলায় পাখি ঘরে / ওই ঘরটার ঠিক ওপরে– আঙুল তুলে দূরের কোণে একটা ঘর দেখালেন তিনি।
এসিজি যে কথাটা মনে-মনে ভাবছিলেন সেটাই মুখে প্রকাশ করলেন, আপনি কি সবসময় ছড়া কেটে কথা বলেন?
রঙ্গলালবাবু মাথা সামান্য নীচু করে বললেন, আমি একজন স্বভাবকবি । কবিতায় কথা বলা আমার হবি।
রঘুপতি যে এই উত্তর শুনে ঠোঁট টিপে হাসল সেটা বৃদ্ধ গোয়েন্দার চোখ এড়াল না।
পুজো এবার দেরিতে। তাই রোদ্দুর পড়ে আসছে তাড়াতাড়ি। উঠোন থেকেও রোদ সরে যাচ্ছে পুবের দিকে।
মাথার ওপরে কয়েকটা পায়রা ঝটপট করছিল। শানবাঁধানো উঠোনে নানা জায়গায় ওদের অপকীর্তির ছাপ।
ওঁরা তিনজনে উঠোন পেরিয়ে এগোলেন দোতলায় ওঠার সিঁড়ির দিকে। তখনই কোথা থেকে ছুটে এল বছর ন-দশের একটা ছোট্ট মেয়ে। হাঁফাতে-হাঁফাতে রঙ্গলালবাবুকে লক্ষ্য করে বলল, জেঠু, মেজো-জেঠু বলেছে ওঁদের পাখিঘরে নিয়ে বসাতে।
কথাটা বলেই মেয়েটা ছুট্টে চলে গেল।
রঙ্গলালবাবু বললেন, গজেন্দ্রর ছোট মেয়ে। সবসময়
–চলে ধেয়ে। পাদপূরণ করে হেসে উঠলেন এসিজি।
পুরোনো আমলের শানবাঁধানো চওড়া সিঁড়ি। পালিশ করা মেহগনি কাঠের রেলিং। সিঁড়ির ল্যান্ডিং-এর দেওয়ালে এক অভিজাত পুরুষের তৈলচিত্র। গিল্ট ফ্রেমে বাঁধানো। কে জানে ইনিই হয়তো স্বর্গীয় রবীন্দ্রলাল গোস্বামী।
এসিজি আর রঘুপতি রঙ্গলালকে অনুসরণ করে উঠছিলেন। রঘুপতি চাপা গলায় ওর প্রাক্তন স্যারকে বলল, অজীব ব্যাপার, গুপ্তাসাব। যাঁর নাম চুনিলাল তিনি চুনি, মানে হিরে-জহরতের বেওসা করেন। যার নাম রঙ্গলাল তিনি সবসময় মজাক করে কথা বলেন। তবে যিনি মারা গেছেন…।
রঘুপতি কথায় বাধা দিয়ে অশোকচন্দ্র গুপ্ত বললেন, শ্যামসুন্দরলাল গোস্বামীর নামটা প্রথম থেকেই আমার পিকিউলিয়ার লাগছিল। এরকম নাম কখনও শুনিনি। তবে শ্যামসুন্দর নামে একরকম মুনিয়া পাখি পশ্চিম বাংলার স্থায়ী বাসিন্দা। বেহালার অক্সফোর্ড মিশনের বাগানে এদের বাসা আমি দেখেছি। মাপে চড়ুই পাখির মতো। মাথা কালো, বুক সাদা, বাকি গাঢ় বাদামি রঙের। ইংরেজি নাম ব্ল্যাক হেডেড মুনিয়া,আর ল্যাটিন নাম লোনচুয়া মলাক্কা। সুতরাং শ্যামসুন্দরলালবাবুর শখটাও তার নামের সঙ্গে মিল রেখে।
তা হলে বাকি রইলেন গজেন্দ্রলালবাবু। তিনি কি হাতির ব্যবসা করেন, নাকি হাতির খোঁজখবর রাখা তার শখ?
সামান্য মজা করে বলা রঘুপতি যাদবের কথাটা বোধহয় রঙ্গলালবাবুর কানে গিয়ে থাকবে। কারণ, হঠাৎই তিন-চার ধাপ ওপর থেকে ঘাড় ঘুরিয়ে তিনি বলে উঠলেন, হস্তী নয়– হস্তীদন্ত / গজেন্দ্রর পয়মন্ত।
এসিজি আর রঘুপতি চোখ চাওয়া-চাওয়ি করলেন। গজেন্দ্রলাল তা হলে হাতির দাঁতের ব্যবসা করেন!
গতকালই একজন মানুষের মৃত্যু ঘটে গেছে এ-বাড়িতে। অথচ রঙ্গলালকে দেখে মোটেই মনে হচ্ছে না তেমন কোনও আঘাত পেয়েছেন। তবে বাড়িটাকে কেমন যেন বেশিরকম চুপচাপ মনে হল। শুধু পায়রার বকবকম ওঁদের কানে আসছিল।
এসিজির সিগারেট শেষ হয়ে গিয়েছিল খানিক আগেই। দোতলায় পাখিঘরে পৌঁছেই তিনি দ্বিতীয় সিগারেট ধরালেন। ঘরটাকে একপলক দেখার পর তিনি যে বেশ উত্তেজিত হয়ে পড়েছেন সেটা রঘুপতি যাদব স্পষ্ট বুঝতে পারল।
কারণ, পাখিঘরে সাজানো রয়েছে অসংখ্য পাখির স্টাফ করা মডেল। নানান মাপের রংবেরঙের পাখি। কিন্তু ওরা সকলেই স্থির, চুপচাপ।
পাখিঘরটাকে ঘর না বলে হলঘর বলাই ভালো। ঘরের মাপ অন্তত বিশ-তিরিশ ফুট। ঘরের মেঝেতে সাদা কালো মার্বেল পাথরের নকশা। সেই নকশায় সময়ের কোনও ছাপ পড়েনি। এখনও দিব্যি ঝকঝকে তকতকে।
চুনিলালবাবু একটা আরামকেদারায় চিন্তিত মুখে বসেছিলেন। হাতে জ্বলন্ত সিগারেট। চোখ লাল।
ওঁদের ঢুকতে দেখেই তিনি উঠে দাঁড়ালেন। সংক্ষেপে পরিচয়ের পালা শেষ করে বললেন, কিছু মনে করবেন না, ইনস্পেক্টর যাদব। সরাসরি কাজের কথায় আসি। অশৌচ অবস্থায় কী বিশ্রী ঝাটে পড়লুম বলুন তো! একটু থেমে কয়েকটা চেয়ার দেখিয়ে তিনি অশোকচন্দ্র গুপ্ত আর রঘুপতি যাদবকে বসতে বললেন, বসুন, আপনারা বসুন। আপনারা আসছেন শুনে ছোটভাইকে বাইরে কাজের দায়িত্ব চাপিয়ে দিয়ে আমি আপনাদের জন্যে ওয়েট করছি।
এমন সময় ছোট্ট মেয়েটা এক দৌড়ে ঘরে এসে ঢুকল। রঙ্গলালবাবুর কাছে গিয়ে বলল, বসন্তদা চা নিয়ে আসছে। মা পাঠিয়ে দিয়েছে।
কথাটা শেষ করেই মেয়েটা বেণী দুলিয়ে আবার দে ছুট।
প্রায় সঙ্গে-সঙ্গেই চা-মিষ্টি ইত্যাদি ট্রে-তে সাজিয়ে ঘরে এসে ঢুকল মাঝবয়েসি একজন লোক। শ্বেতপাথরের তৈরি একটা গোল টেবিলে কাপ-প্লেটগুলো নামিয়ে রাখতেই রঙ্গলালবাবু সেগুলো সবিনয়ে এগিয়ে দিলেন রঘুপতি ও অশোকচন্দ্রের দিকে।
চুনিলালবাবুর পরনে হাফহাতা সাদা শার্ট আর পাজামা। গলায় সরু সোনার চেন। মাথার চুল পাতলা হয়ে এসেছে। জুলপির কাছটায় চুলে দিব্যি পাক ধরেছে। ভুরু লোমশ। দুই ভুরুর মাঝখানে চিরস্থায়ী বিরক্তির ভাব।
এসিজি ঘরটায় চোখ বুলিয়ে দেখছিলেন।
ঘরের আসবাবপত্র যা কিছু সবই ব্রিটিশ আমলের। একপাশে বড় মাপের চেয়ার-টেবিল। চেয়ারে ফুলকাটা তাকিয়া বসানো। আর টেবিলে গাদা-গুচ্ছের বই আর কাগজপত্র। সেইসঙ্গে রয়েছে। পেন-পেনসিল, আতসকাচ, পেতলের পেপারওয়েট আর কয়েকটা পাখির পালক। টেবিলের বাঁ-দিকে রাখা কর্ডলেস টেলিফোন।
দেখে বোঝাই যায়, এটা ছিল শ্যামসুন্দরলালের পড়াশোনার ঘর।
ঘরটার তিনদিকের দেওয়ালে বড়-বড় মাপের দেওয়াল আলমারি। তাতে ঠাসা রাজ্যের বই। এসিজির নজরে পড়ল সেখানে সালিম আলি ও ডিলন রিপলির কয়েক খণ্ডে লেখা ভারত ও পাকিস্তানের যাবতীয় পাখির হাত-বই পরপর সাজানো রয়েছে।
ঘরের সিলিং-এ ঝুলছে দুটো চার ব্লেডের পাখা। দেখে বোঝা যায়, ব্লেডগুলো কাঠের তৈরি। আর ঘরের দু-দিকের দেওয়ালে ডিজাইন করা শৌখিন পেতলের ব্র্যাকেটে ঝুলছে আধুনিক বৈদ্যুতিক বাতি।
অন্ধকার ঘন হয়ে আসায় চুনিলালবাবু সুইচ টিপে বাতিগুলো জ্বেলে দিলেন। তারপর রঘুপতির কাছে এসে বললেন, আমার দাদা দেবতুল্য মানুষ ছিলেন। ওঁর হার্টের প্রবলেম ছিল ঠিকই, কিন্তু হয়তো আরও কয়েক বছর বাঁচতেন। আমার জন্যেই অকালে বড়দার প্রাণটা গেল। বউদির দিকে আমি আর তাকাতে পারছি না। অথচ আমারও উপায় নেই। চুনিটা খুঁজে না পাওয়া গেলে আমাকেও হয়তো গুপ্তঘাতকের হাতে মরতে হবে। তাই শোক তাকে তুলে রেখে পাগলের মতো চুনি খুঁজতে বসেছি…।
চুনিলালবাবু থামতেই রঘুপতি তাকাল অশোকচন্দ্রের দিকে।
বৃদ্ধ তখন চোখ বুজে সিগারেটে জম্পেশ টান দিচ্ছেন।
রঘুপতি বলল, গুপ্তাব, আমার সঙ্গে চুনিবাবুরই টেলিফোনে কথা হয়েছিল। আপনি এঁকে কী জিগ্যেস করবেন করুন।
এসিজি চোখ খুলে পাখির মেলার দিকে তাকালেন। কম করেও একশো পাখি সাজানো রয়েছে ঘরের ডানদিকটায়। তার সবই পশ্চিমবাংলার পাখি। ছোট মাছরাঙা, বাঁশপাতি, টুনটুনি, চন্দনা, দোয়েল, কাদাখোঁচা, শ্যামা, ময়না, নীলকণ্ঠ, চাক দোয়েল, বেনেবউ, এমনকী একটা মোহনচূড়াও রয়েছে। পাখিগুলোর পায়ের কাছে সাদা কার্ডে ওদের পরিচয় লেখা–ঠিক যেমনটি জাদুঘরে থাকে।
এসিজি মাথার চুলে টান মেরে জানতে চাইলেন, ট্যাক্সিডার্মি করা এই পাখিগুলো কোথা থেকে নিয়ে আসা হয়েছে?
চুনিলালবাবু বললেন, দাদার খেয়াল। বেশিরভাগই কেনা। তবে কয়েকটা বোধহয় নিজে অর্ডার দিয়ে করিয়েছেন।
চুনির ব্যাপারটা আমাদের কাছে একটু খোলসা করে বলুন।
চুনিলালবাবু ওঁদের কাছাকাছি একটা চেয়ার নিয়ে বসেছিলেন। কিছুক্ষণ উশখুশ করে তার পর বললেন, আমি মণিরত্নের ব্যবসা করি। মানে দামি পাথর কেনা-বেচা করি। নিজে পাথর কাটিংও করি, পালিশও করি। তবে সেরকম এক্সপার্ট নই। ছাদের দক্ষিণ দিকের একটা ছোট ঘরে আমার কাটিং মেশিন আর গ্রাইন্ডিং মেশিন আছে।
সে যাই হোক, পাথরের কাজকারবারে আমাকে প্রায় রোজই বটতলা আর মেছুয়ায় যেতে। হয়। সেখানে মহাজনদের কাছ থেকে দরকার মতো মাল নিয়ে আসি। তত দিনসাতেক আগে মেছুয়াতে এক মহাজনের ঘরে আমি একটা বার্মিজ রুবি পেয়ে যাই। চুনিটার রং ঠিক পায়রার রক্তের মতো গাঢ় লাল। আর একেবারে বেদাগ।
আমি সেখানে গিয়েছিলাম খড় কিনতে।
খড় মানে? চুনিলালকে বাধা দিয়ে জানতে চেয়েছেন এসিজি।
খড় মানে একেবারে র পাথর–যেটা দেখে দামি পাথর বলে একেবারেই বোঝা যায় না। সেগুলো অ্যাসিড দিয়ে ট্রিট করে ঠিকমতো কেটে পালিশ-টালিশ করতে পারলে অনেকগুলো দামি পাথর পাওয়া যেতে পারে। এর আগে বেশ কয়েকবার খড় কিনে আমি ভালো প্রফিট করেছি।
তারপর কী হল? অধৈর্য হয়ে প্রশ্ন করল রঘুপতি।
হ্যাঁ, যা বলছিলাম। আমার একজন কোটিপতি কাস্টমার বার্মিজ চুনির কথা বলে রেখেছিল। এই চুনিটার হদিস পেতেই আমার মনটা নেচে উঠল। এটা তাকে বেচতে পারলে অন্তত থার্টি পার্সেন্ট প্রফিট করা যাবে।
সেই কাস্টমারের নাম কী? রঘুপতি গম্ভীরভাবে প্রশ্ন করল।
চুনিলালবাবু অবাক চোখে তাকালেন রঘুপতির দিকে ও মাফ করবেন, ইনস্পেক্টর যাদব। কাস্টমারের নাম বলতে পারব না–ট্রেড সিক্রেট।
মাথার সাদা চুলের গোছায় হাত চালিয়ে এসিজি জিগ্যেস করলেন, পাথরটার সাইজ কীরকম ছিল?
চুনিলাল গোস্বামী ব্যবসায়ীর ঢঙে বললেন, প্রায় সাড়ে ন রতি। মানে, পৌনে নক্যারাট এর কাছাকাছি।
ক্যারাট-এর হিসেব কেমন জট পাকিয়ে যায়, হেসে বললেন এসিজি, এক ক্যারাট মানে কত গ্রাম?
দুশো মিলিগ্রাম। এই পাথরটার ওজন প্রায় পৌনে দু-গ্রাম মতো ছিল। আর বেশ লম্বাটে।
ফির কেয়া হুয়া? রঘুপতির ধৈর্যে যে ভালোরকম টান পড়েছে সেটা তার প্রশ্নের ঢঙেই বোঝা গেল।
চুনিলাল কী যেন চিন্তা করছিলেন। রঘুপতির প্রশ্নে চমকে উঠে বললেন, পাথরটা আমি চেনা মহাজনের কাছ থেকে দু-সপ্তাহের ধারে নিয়ে আসি। কিন্তু ওটা নিয়ে আসার পরদিন থেকেই কেউ আমাকে টেলিফোন করে হুমকি দিতে থাকে। বলে যে, পাথরটা যেন আমি কাউকে বিক্রি না করে সোজা আবার মহাজনের কাছে ফেরত দিয়ে আসি।
মিস্টার গুপ্ত, আমাদের হিরে-জহরতের লাইনে উড়ো টেলিফোনে হুমকি দেওয়ার ব্যাপারটা নেহাতই মামুলি। তাই আমি প্রথম-প্রথম ব্যাপারটাকে পাত্তা দিইনি। কিন্তু দিনতিনেক যেতে-না-যেতেই হুমকির ব্যাপারটা সিরিয়াস চেহারা নিতে থাকে। মার্কেট থেকে কানাঘুষো খবর পেলাম, এতবড় বার্মিজ চুনি বাজারে বহুদিন আসেনি। তাই হিসেব-ছাড়া দাম দিয়ে কেনার মতো দু-তিনজন কাস্টমার নাকি ওটার জন্যে হন্যে হয়ে একেবারে মরিয়া হয়ে উঠেছে। তাদের এজেন্টরা নাকি মারাত্মকরকম ডেঞ্জারাস।
তখন আমি… একটু থেমে চুনিলালবাবু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, তখন আমি ব্যাপারটা বড়দাকে খুলে বলি। বড়দা ছিলেন দেবতুল্য মানুষ। বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে একরকম পুত্র-স্নেহে ছোট-ছোট ভাইদের মানুষ করেছেন। আমাদের বিষয়-সম্পত্তি সজাগ হয়ে দেখাশোনা করেছেন। আমাদের সবরকম বিপদ-আপদ থেকে আগলে-আগলে রেখেছেন– চুনিলালবাবুর চোখে জল এসে গেল। মুখটা সামান্য ঘুরিয়ে নিয়ে শার্টের হাতা দিয়ে চোখ মুছে নিয়ে বললেন, বড়দা চলে গিয়ে আমাদের মাথার ওপর থেকে বটগাছের ছায়া সরে গেল। আমার বিপদের কথা শুনে বড়দা আমাকে বললেন, তোর কোনও চিন্তা নেই। তুই চুনিটা আমার কাছে দে, আমি ওটা রেখে দেব। তারপর দেখি, কে ওটা আমার কাছ থেকে নিতে পারে!
আমি সেইমতো বড়দাকে পাথরটা দিয়ে দিই পরশুর আগের দিন–মানে, শুক্রবার। কিন্তু আশ্চর্য, তার পরদিন থেকেই সেই নাম-না-জানা লোকটা বড়দাকে যা-তা বলে শাসাতে থাকে।
দাদার একটাই দোষ ছিল–অল্পেতেই ভীষণ রেগে যেতেন। এই করে করেই হার্টের ট্রা বাধিয়েছিলেন। আগে দুবার স্ট্রোক হয়ে গিয়েছিল। তাই দাদা যখন লোকটার সঙ্গে টেলিফোনে চিৎকার করে কথা বলতেন তখন আমার ভয় করত। পরশু রাতেই আমি ঠিক করি, ঢের হয়েছে, চুনি বেচে প্রফিটে কাজ নেই। ওটা মহাজনকে ফেরতই দিয়ে দেব। কিন্তু দাদাকে সে কথা বলতেই তিনি একেবারে অগ্নিশর্মা। ফলে আমি গৃহশান্তির কথা ভেবে চুপ করে যাই।
তারপর…তারপর..কাল দুপুরে, ওই লোকটা আবার টেলিফোন করে। দাদা সেসময়ে এই ঘরে ওই চেয়ারটায় বসেছিলেন। দাদার চিৎকার-চেঁচামেচি শুনে আমি পাখিঘরে ছুটে আসি। দাদা তখন টেলিফোনে বলছেন, আমি থাকতে কেউ চুনির গায়ে আঁচড়টি পর্যন্ত কাটতে পারবে না। আমাকে ভয় দেখানো অত সহজ নয়…।
আমি দাদাকে সামাল দেওয়ার চেষ্টা করলাম। কারণ, দাদার তখন চোখ-মুখ লাল, বড় বড় শ্বাস নিচ্ছেন। ভয় হচ্ছিল, খারাপ কিছু না একটা হয়ে যায়…।
চুনিলালবাবু একটু থামতেই এতক্ষণ নীরবে সাক্ষী হয়ে বসে থাকা রঙ্গলাল বললেন, সেই মুহূর্তে আমিও ছুটে আসি । গজেনকেও পেলাম পাশাপাশি–
চুনিলালবাবু বিরক্ত হয়ে তাকালেন ছোট ভাইয়ের দিকে : আঃ, রঙ্গ কী হচ্ছে! পদ্য নিয়ে পাগলামির একটা লিমিট থাকা দরকার। এখন কি একটু স্বাভাবিকভাবে কথা বলা যায় না!
রঙ্গলালের মুখে আহত ভাব ফুটে উঠল। তিনি মিনমিন করে স্বগতোক্তির মতো বললেন, লিমিট থাকলে সেটা কখনও কবিতা হয় নাকি! কবিতার নামে সেটা তখন হয়ে যায় ফকি…।
আবারও ছন্দ!
দোহাই, তোর স্বভাবকবিতা এবার বন্ধ কর। চুনিলালবাবু যে বেশ রেগে গেছেন সেটা তার মুখ দেখে স্পষ্ট বোঝা গেল।
একটু সময় নিয়ে তারপর তিনি খবর পড়ার মতো নিরুত্তাপ গলায় বললেন, তারপর আমাদের তিন ভাইয়ের চোখের সামনেই বুক খামচে বড়দা টেবিলে কাত হয়ে পড়েন। চেয়ারে বসা অবস্থাতেই তিনি টেবিলে পড়েছিলেন বলে সেরকম আঘাত পাননি। কিন্তু বুকের কষ্টটা নিশ্চয়ই খুব মারাত্মক হচ্ছিল। কারণ, তিনি বুকের কাছে হাত ঘষছিলেন বারবার। আর যন্ত্রণার টুকরো টুকরো শব্দ বেরিয়ে আসছিল তার মুখ দিয়ে।
আমি গজেনকে পাঠালাম পাড়ারই এক ডাক্তারকে তক্ষুনি ধরে নিয়ে আসতে। কিন্তু বেশ বুঝতে পারছিলাম, বড়দার সময় ফুরিয়ে এসেছে। তার মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। শরীর প্রায় স্থির। মুখ থেকে একটানা গোঙানির শব্দ বেরিয়ে আসছিল।
বড়দা আমাকে বলেছিলেন, চুনিটা তিনি লুকিয়ে রেখেছেন। এমন জায়গায় লুকিয়ে রেখেছেন যে, কেউ ওটা খুঁজে পাবে না। সে কথা আমার মনে ছিল। তাই ওঁর কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে নিষ্ঠুরের মতো চেঁচিয়ে জানতে চেয়েছি, বড়দা, চুনিটা কোথায় রেখেছ?
উত্তরে বড়দা গোঙানির মতো শব্দ করে দুবার বললেন, পেলি না গো, পেলি না গো– তারপরই সব শেষ।
কাল দুপুর থেকে আমরা দাদার সৎকার নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম। তারপর কাল সারা রাত ধরে আমি চুনিটার খোঁজ করেছি। বউদি ওই শোকের মধ্যেই দারুণভাবে সাহায্য করেছেন। আমাকে হয়তো সবাই অমানুষ ভাবছে, মিস্টার গুপ্ত, কিন্তু আমার অবস্থাটা একবার বুঝুন! একে ওই হুমকি। তার ওপর চুনিটার দাম প্রায় পৌনে দু-লাখ টাকা। মহাজনকে যে এক কথায় দাম দিয়ে দেব তারও উপায় নেই। তাই মরিয়া হয়ে লোকজন ধরে লালবাজারে খবর দিয়েছি।
রঘুপতি জিগ্যেস করল, আপনারা সব জায়গা খুঁজে দেখেছেন? সিন্দুক- টিন্দুক, ব্যাঙ্কের লকার–সব?
চুনিলালবাবু ঘাড় নেড়ে জানালেন, হ্যাঁ। তারপর বললেন, আজ সকালেই বউদিকে ব্যাঙ্কে নিয়ে গিয়েছিলাম। লকারে ওটা নেই।
অশোকচন্দ্র গুপ্ত ইতিমধ্যে চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়েছিলেন। নতুন একটা সিগারেট ধরিয়ে পায়চারি করতে করতে চলে গিয়েছিলেন পাখির ঝাঁকের কাছে। রংবেরঙের পাখিগুলো দেখতে-দেখতে কল্পনায় যেন ওদের ডাক শুনতে পাচ্ছিলেন তিনি। ঘাড়ের কাছে সাদা চুলের গোছায় টান মারলেন কয়েকবার। তারপর দূর থেকেই প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন চুনিলালবাবুর দিকে ও কোনও জায়গায় খুঁজতে বাকি রাখেননি? সব জায়গা তন্নতন্ন করে খুঁজেছেন?
চুনিলালবাবু বিষণ্ণ হাসলেন। বললেন, হ্যাঁ, প্রাণের দায়ে তন্নতন্ন করে খুঁজেছি। যে করে হোক চুনিটা মহাজনকে ফেরত দিয়ে আমাকে আগে প্রাণে বাঁচতে হবে।
পাখিগুলো ভীষণ আগ্রহ নিয়ে দেখছিলেন এসিজি। আর একইসঙ্গে কী যেন ভাবছিলেন।
নীচের তলা থেকে একটা বাচ্চার কান্না ভেসে এল। সেই সঙ্গে কোনও মহিলার বকাবকির শব্দ।
রঙ্গলালবাবুও বোধহয় ব্যাপারটা নিয়ে ভাবছিলেন। তিনি হঠাৎই বলে উঠলেন, মেজদা, এমনও তো হতে পারে, বড়দা মারা যাওয়ার সময় চুনিটা কোথায় আছে সেটা বলে যাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন…।
বোঝা গেল, মেজদার ধমকে স্বভাবকবি তাঁর কাব্য প্র্যাকটিস আপাতত মুলতুবি রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
কিন্তু রঙ্গলালবাবুর কথায় ঝটিতি ঘুরে তাকালেন থিঙ্কিং মেশিন অশোকচন্দ্র গুপ্ত। দু-ভাইয়ের দিকে কয়েক পা এগিয়ে এসে বললেন, শেষ কথাটা আপনারা ঠিক শুনেছিলেন?
চুনিলাল ইতস্তত করে বললেন, আমার তো পেলি না গো বলেই মনে হয়েছিল। গোঙানির মধ্যে স্পষ্ট করে ঠিক বোঝা যাচ্ছিল না। ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে তিনি জানতে চাইলেন, তুই কী শুনেছিস, রঙ্গ?
একটু আমতা-আমতা করে রঙ্গলাল বললেন, আমার..আমার যেন গেলি না গো বলে মনে হয়েছিল…।
এর তো বাংলাটাও গণ্ডগোলের। এসিজি সিগারেটে টান দিয়ে বললেন, বাক্যের প্রথমটা তুই সম্বোধনে, আর শেষটা তুমি..কেমন যেন গোলমেলে মনে হচ্ছে…।
রঘুপতি যাদব বেশ চিন্তিতভাবে রঙ্গলালকে বলল, আপনি ওই শেষ কথাটা একবার আপনার বড়দার মতো করে বলে শোনাতে পারেন?
নিশ্চয়, নিশ্চয় । এতে কোনও শক্ত কাজ নয়। মেজদার দিকে একপলক তাকিয়ে রঙ্গলাল সোজা গিয়ে শ্যামসুন্দরলালবাবুর চেয়ারে বসে পড়লেন। তারপর টেবিলে হুমড়ি খেয়ে পড়ে যন্ত্রণাকাতর কণ্ঠে বলে উঠলেন, গেলি না গো, গেলি না গো!
ছিলে ছেঁড়া ধনুকের মতো টান-টান হয়ে গেলেন এসিজি। হাতের সিগারেটটা ছুঁড়ে ফেলে দিলেন মেঝেতে। তারপর হো-হো করে হেসে উঠলেন। সে-হাসি আর থামতেই চায় না।
ঘরের সকলেই তো এসিজির কাণ্ডকারখানা দেখে হতবাক।
রঘুপতি অবাক সুরে বলল, স্যার, কেয়া বাত হ্যায়? কোই চুটকুলা ইয়াদ আয়া?
কোনওরকমে হাসি থামিয়ে এসিজি বললেন, চুটকুলা–মানে, চুটকিই বটে, রঘুপতি। আশা করি তোমার মিষ্ট্রি সম্ভ হয়ে গেছে। চুনিলালবাবুকে লক্ষ্য করে তিনি বললেন, একটা চিমটে এনে দিন। আপনার অমূল্য চুনি বোধহয় আমি খুঁজে দিতে পারব।
কথাটা শোনামাত্রই রঙ্গলালবাবু তিরবেগে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।
একটু পরেই তিনি ফিরে এলেন, হাতে একটা লম্বা চিমটো দিয়ে অনায়াসে কোনও দৈত্যের মাথার পাকাচুল বাছা যায়।
রঙ্গলালের পিছু-পিছু যিনি এলেন, চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছিল, তিনি গজেন্দ্রলাল। চুনিলালবাবু তাঁকে একপাশে ডেকে নিয়ে গিয়ে চাপা গলায় কীসব বলতে লাগলেন।
কিন্তু ততক্ষণে রঙ্গলালের হাত থেকে চিমটে নিয়ে স্টাফ করা পাখিগুলোর একটার কাছে গিয়ে কাজ শুরু করে দিয়েছেন অশোকচন্দ্র।
পাখিটা মাপে পায়রার চেয়ে ছোট। মেটে রঙের শরীরে কালো ছোপ ছোপ দাগ। পেটের দিকটা সাদা। আর সরু লম্বা ঠোঁট।
এসিজি ওঁদের সকলের দিকে তাকিয়ে হেসে বললেন, এই পাখিটার নাম কাদাখোঁচা। মাছ, শামুক-টামুক খায়। নাকি সুরে ডাকে। গ্রাম-বাংলার সব জায়গাতেই দেখা যায়। এটার ডান চোখটা দেখুন–দেখেই বোঝা যায়, এটা নিয়ে কারিকুরি করেছে কেউ…।
এসিজি কথা বলতে বলতেই ডান চোখের পুঁতিটা খুঁচিয়ে তুলে চিমটে দিয়ে তার ভেতরটা আরও ভালো করে খোঁচাচ্ছিলেন।
হঠাৎই বেরিয়ে পড়ল হারানো চুনিটা। মেঝেতে ঠিকরে পড়ে কয়েকবার লাফিয়ে তারপর থামল।
ঘরের আলোয় ওটার লাল আভা ছড়িয়ে চিকচিক করতে লাগল।
একটা অস্ফুট শব্দ করে চুনিলালবাবু ছুটে এসে প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ে তুলে নিলেন লাল টুকটুকে পাথরটা। ওটা শক্ত মুঠোয় আঁকড়ে ধরে ঘরের সিলিং-এর দিকে মুখ তুলে চোখ বুজে আবেগ থরথর গলায় বললেন, মা তারা ব্রহ্মময়ী!
তারপর পাথরটা শার্টের বুকপকেটে রেখে এসিজির হাত চেপে ধরলেন? মিস্টার গুপ্ত, আপনি দেবদূত হয়ে আজ আমাকে বাঁচালেন–
এসিজি হেসে বললেন, আমি নয়, আপনাকে বাঁচিয়েছেন রঙ্গলালবাবু। উনি ঠিকই বলেছেন। শ্যামসুন্দরলালবাবু মারা যাওয়ার সময় পেলি না গো, পেলি না গো বলেননি, উনি বলেছিলেন গেলিনাগো গেলিনাগো। কথাটা বাংলা নয় কাদাখোঁচা পাখির বৈজ্ঞানিক নাম। এই দেখুন, এই কার্ডে ইংরেজি আর ল্যাটিন নাম–দুটোই আছে।
সকলে তাকিয়ে স্পষ্ট দেখতে পেল কার্ডে লেখা নাম দুটো? Fantail Snipe (gallinago gallinago)
রঘুপতি যাদব এগিয়ে এসে অভিনন্দন জানাল এসিজিকে : স্যার, য়ু আর এ জিনিয়াস!
অশোকচন্দ্ৰ নতুন একটা সিগারেট ধরিয়ে বললেন, সে শুধু তোমার মতে, রঘুপতি। নাও, এবার চলো–
রঙ্গলাল এসিজির সামনে এসে জোড়হাতে করে দাঁড়ালেন। আকর্ণ হেসে ছন্দে বললেন, প্রাচীন গ্রিসে জ্ঞানী ছিলেন অ্যারিস্টটল । আপনি আরও জ্ঞানী স্টুদে ব্যারিস্টটল।
এসিজি অবাক হয়ে জিগ্যেস করলেন, ব্যারিস্টটল মানে!
ওই ওয়ার্ডটা আমার ইনভেনশান– মাথা নামিয়ে বিনয়ের হাসি হাসলেন রঙ্গলাল ও কবিতার শেষটা মেলানোর জন্যে ব্যারিস্টার আর অ্যারিস্টটলের সন্ধি করেছি।
আবার হো-হো করে হেসে উঠলেন ডক্টর অশোকচন্দ্র গুপ্ত।