1 of 2

চীনেমাটি – সন্তোষকুমার ঘোষ

চীনেমাটি
সন্তোষকুমার ঘোষ

শশী বলল, মেমসাহেব খুব ভালো। দয়ার শরীর। চ, তোকে এখুনি আলাপ করিয়ে দিচ্ছি।

কুঞ্জ বলল, এখন থাক শশীদা। পরে। বরং মাটি কুপিয়ে নিই আরেকটু।

শশী বলল, না রে। বাইরের লোক বাগানের কাজে হাত দিলে সাহেব বড়ো গোসা হন আগে ঘরের লোক হয়ে যা। তখন সব তোকে শিখিয়ে দেব। কেয়ারি করা, জল ঢালা, ইস্তক সব ফুলের নাম।

–সব ফুলের নাম শশীদা?

–সব। চ’ এবার,–শশী বলল, ভয় কিসের। মেমসাহেব সাহেব হলেও মেম তো। মেম মানে হল গিয়ে মেয়েমানুষ।

উলের কাঁটা থামিয়ে চোখ তুললেন মেমসাহেব–কী শশী।

দণ্ডবৎ বিনয়ে শশী বলল, একে নিয়ে এলাম। আমার দেশের ছেলে। এখানে এক দিদির বাড়ি থাকত, জামাইবাবু তাড়িয়ে দিয়েছে। যদি কাজে ভর্তি করে নেন। সাহেবের খাস খানসামার কাজ একে দিয়ে বেশ হবে।

মেমসাহেব বললেন, আচ্ছা তুমি একে রেখে যাও। আমি দু’চারটে কথা জিজ্ঞাসা করে দেখি।

সেলাম করে শশী বেরিয়ে যেতেই কুঞ্জর বুক ঢিপঢিপ শুরু হল। সামনের একটা দেয়ালের আয়নায় ছায়া পড়েছে দু’জনের, সিলক-ঢাকা মোমের একটি মূর্তির পাশে ধুলোকালো ঝাকড়াচুল এক ছোঁকরার। কুঞ্জর দাঁড়িয়ে থাকতে লজ্জা করছিল, সে ধপ করে বসে পড়ল মেমসাহেবের পা ঘেঁষে।

সাদা ধবধবে দুটি ননীনরম পা, আলগা ছুঁয়ে একটি হরিণাজিন চটি। কুঞ্জ তখনও কাঁপতে থাকল।

মেমসাহেব বললেন, আহা, মাটিতে বসলে কেন।।

তাহোক, মাটিতেও কুঞ্জ কিছু কম সুখে নেই। মাটি কই, কার্পেট, মেজের লজ্জা ঢাকে, মানুষের পায়ের শব্দ ঢাকে। আর এখান থেকেও তো উড়ে উড়ে পড়া সিল্কের গন্ধ পাচ্ছে কুঞ্জ; মৃদু ঝিমঝিমে, কে জানে কী এসেন্স। দীর্ঘ দুটি ভুরুর নিচে দুটি চোখ, গলার একটা ভাজে ঈষৎ স্পষ্ট পাউডারের দাগ। মেমসাহেব বললেন, এখানে কোথায় থাকতে তুমি?

—পটলডাঙ্গায়।।

—দিদির কাছে? কেমন দিদি? জামাইবাবু তাড়িয়ে দিল? কী কাজ করে তোমার জামাইবাবু?

কুঞ্জ একটা ছাপাখানার নাম করলে।

আরো দু’একটা টুকটাক কথা জিজ্ঞাসা করলেন মেমসাহেব।

বোধহয় খুশি হলেন। উলটা সরিয়ে রেখে উঠে দাঁড়ালেন, দীর্ঘশিখা দেহ, আঁচল কুড়িয়ে নিলেন।

—বেশ আজ থেকেই কাজ করবে তুমি।

শীর্ষরক্তাভ শুভ্র আঙুলগুলোর দিকে চেয়ে পলক পড়ল না কুঞ্জর। এত সুষমা থাকতে পারে শরীরের গঠনে? চকিতে বকুলদির কথা মনে পড়ল। ধোঁয়াজ্বালা রান্নাঘরে বাটনা বেটে বেটে ক্ষয়ে যাওয়া কটি আঙুল, থেতলানো, ভোতা। এই সতেরো বছর পর্যন্ত যত মেয়েমানুষ দেখেছে কুঞ্জ, তাদের কারুর সঙ্গে এই মেমসাহেরে তুলনা নেই—এই সুষমা, এই মহিমা, কোথায় পাবে তার চোখ বসে যাওয়া, কণ্ঠ-উঁচু, হাড়কালি, স্বামীর ভয়ে জুজুবুড়ি বকুলদি।

কুঞ্জ বলল, আমাকে রাখলেন মেমসাব? কিন্তু, কিন্তু সাহেব—

মেমসাহেব হাসলেন,সাহেবের ভাবনা তোমাকে ভাবতে হবে না। আমার কথাই শেষ কথা। সাহেব কিছু বলবেন না।

ঠিক তখুনি বাইরে জুতোর শব্দ শোনা গেল।

তালিম দেওয়াই ছিল। মশমশ আওয়াজ হতেই সোজা হয়ে উঠে দাঁড়াল, কাঠপুতুল, জোড়াগোড়ালি এ্যাটেনশন।

—কে? চৌধুরী জিজ্ঞাসা করলেন, অধমনস্ক পাখাটাকে পুরোদম করে দিয়ে।

ইন্দ্রাণী বললেন, নতুন লোক। বহাল করলুম আজ থেকে। উড়েটাকে দিয়ে কোন কাজ পাওয়া যেত না।

চৌধুরী বললেন ‘ও’, শুনলেন কিনা সন্দেহ, টুটিটেপা টাইটাকে ঢিলে করতে গলায় হাত দিলে।

কুঞ্জর হাত ততক্ষণ সাহেবের জুতোর ফিতেয় পৌঁছে গেছে। চৌধুরী সাহেব বাধা দিলেন না, কৌচে গা ঢেলে দিয়ে বললেন, বেশ চটপটে।

খাওয়া শেষে চৌধুরী সাহেব বিলিতি ম্যাগাজিনের পাতা ওলটান, ঠিক ওলটান না, পাখাতেই ওলটায়, সাহেব ধরে থাকেন মাত্র, কয়েক মুহূর্তের ঝিমুনি, ঘোড়াঘুম। মেমসাহেব সেই অবসরে পশমের কাটা নিয়ে বসেন, পায়ের কাছে কুকুরটা মন্ত্রশান্ত ভুজঙ্গকুণ্ডলী।

কুঞ্জ বারান্দায় এল। বিকেলবেলার একটুখানি রোদ, বাগানের ঝাউ গাছের পাতায় পাহারা এড়িয়ে যতটুকু পড়তে পারে। দেয়াল ঘেঁষে একটা লতা, টকটকে ফুল। তারপর যতদূর চাও, শুধু ফুল, যত্ন করে লাগানো, কুঞ্জ নাম জানে না। এখানে। ওখানে ছেটো গাছ, বেশি বাড়েনি কিন্তু স্তবকের মতো, সমান করে ছাঁটা। আজ আট মারে ওর কুঞ্জর চুলে কাঁচি পড়েনি, কিন্তু এ গাছগুলোর দশ আনা চার আনা ছাঁট নিয়মিত।

আস্তে আস্তে কুঞ্জ নেমে এল নিচে, সাবধানে, ঘাস বাঁচিয়ে সুরকিপথ ঘেঁষে। এ বাগানে ঘাসেরও চাষ হয়।

শশীর ঘরে তখন টোয়েন্টি নাইনের ধুম। এ পাশের বাংলো থেকে এসেছে সতীশ, ওপাশ থেকে মধু, সামনের বাড়ির ড্রাইভার নিত্যানন্দও।

কুঞ্জকে দেখে শশী উঠে এল।

-কিরে, ঠিক হল কিছু?

কুঞ্জ হাসি-হাসি মুখে সব বললে।

কেমনবলেছিলাম-কিনা ঢঙের মাতব্বরী গলায় শশী বলল, তা তুইও তো কম হাঁদা না। মেম সাহেব তোকে রাখলেন, তুই আবার সাহেবের কথা তুলতে গেলি কেন। আরে হাঁদারাম, একি তোদের আমাদের ঘরের বৌ ঝি পেয়েছিল যে সোয়ামীর মত না নিয়ে এক পা চলা নেই? আমাদের মেমসাহেব হলেন স্বাধীন, নামে মাত্তর ইস্ত্রী। উনি ক’টা সমিতির পিসিডেন, জানিস?

কুঞ্জ জানত না, বড়ো বড়ো চোখে চেয়ে রইল।

শশী বলে গেল এখানে রাত জোরে টিকে যাস যদি, সব জানবি। শুধু আমাদের মেমসাব কেন, লেডী অপর্ণা মিসেস চাকলাদার এঁদের সব্বাই। এঁরা সব অন্য জাতের জেনানা রে! তুই এখন ফিরে যা। সাহেবের বেরোবার সময় হয়েছে।

সাহেব বোরালেন না, বেরোলেন ইন্দ্রাণী। বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন, হাই তুললেন ছোট্ট করে, পেশীর কুঞ্চন ঢাকতে একটা হাত মুখের সমুখে ধরলেন।

তারপর যে-হাতে মুখের কুঞ্চন ঢেকেছিলেন সেই হাতের ইশারায় ডাকলেন কুঞ্জকে।।

কুঞ্জ ছুটে এল। কুঞ্জর গন্ধ পেয়ে ঘর থেকে ছুটে এল লুপি। যে হাতের ইশারা করে ইন্দ্রাণী ডেকেছিলেন কুঞ্জকে, সেই হাতের ইসারাতেই চুপ করতে বললেন কুকুরকে। কুঞ্জকে বললেন অত শব্দ করে ছোটে? লুপি ভয় পেয়েছিল। সাহেবের যদি ঘুম ভেঙে যেত!

লজ্জা-ভয়ে কুঞ্জ বলল, ও।

ওকে দিয়ে দু’একটা টুকরো কাজ করিয়ে নিলেন মেমসাহেব। তার ওপর কক্ষান্তরে গিয়ে নতুন বেশে পরিবর্তিত হয়ে এলেন। বললেন, আমি একটু বেরুচ্ছি কুঞ্জ। তুমি একটু বস। ঘুম ভাঙলে সাহবের যদি কিছু দরকার হয়।

মেমসাহেবের বেরিয়ে যাবার পরও ঘরে এসেন্সের গন্ধ রইল। উনি গিয়ে গাড়িতে পা দিলেন, অমনি ইঞ্জিন প্রাণবন্ত হল; সিটে মাথা এলিয়ে দিলেন, অমনি চাকা গড়াতে শুরু করল। পেট্রোলের গন্ধে চাপা পড়ল এসেন্সের, তারপর দুটোই মিলিয়ে গেল, কুঞ্জর চমক ভাঙল তখন।

একটু পরেই ঘুম ভাঙল সাহেবের। চোখের কোণ অল্প অল্প লালচে। আস্তে আস্তে বার দুই ডাকলেন, ইন্দু, ইন্দু।

সাড়া না পেয়ে বড়ো করে চোখ মেললেন। দেখলেন কুঞ্জকে।

–মেমসাব কই রে।

–এক্ষুনি তো বেরুলেন।

মেমসাহেবের ভয় করেনি, করছে কুঞ্জর। সাহেবের হুকুম না নিয়েবেরিয়েছে, যদি সাহেব ক্ষেপে যান।

সাহেব কিছুই করলেন না, শুধু বললেন, এক্ষুনি? ক’টা বেজেছে। সাড়ে চার— তাই তো।

নিজেই ঢুকলেন গোসল ঘরে।

এই গল্পটাই কুঞ্জ কদিন পরে রসিয়ে রসিয়ে করেছিল বকুলদির কাছে।

কপাল খুলে গেছে কুঞ্জর। সাহেবের কখন কী দরকার হয়, সেই জন্যে খাসদালানের বারান্দার কোণে একটা কুঠুরিতে ওকে আস্তানা দেওয়া হয়েছে। শুধু তাই নয়। দুটো কামিজ কিনতে ওকে পুরোপুরি দশ টাকার নোট দিয়েছে মেমসাহেব। তার থেকে তিনটি টাকা বাঁচিয়ে কুঞ্জ বকুলদিকে দিতে গিয়েছিল।

বকুল মহাখুশি।—চাকরি পেয়েছিস, সত্যি কুঞ্জ? সাহেব-বাড়ি? সত্যিকারের নয়; কিন্তু অত কথা বকুলদিকে ভেঙে বলবে কেন। মেমসাহেব কথাটাই হাজারবার। ব্যাখ্যান করে শোনাল কুঞ্জ। কেমন সোজা, কেমন স্বাধীন। একল-একলা বেরিয়ে যান গাড়ি করে। কাকস্য পরোয়া।

গালে হাত দিয়ে শুনছিল বকুল। সব শেষে বলল, অথচ তোর জামাইবাবুকে না বলে সিনেমায় গেছলাম বলে সেবার আমাকে কী মারটাই না মেরেছিল, তোর মনে নেই কুঞ্জ?

মনে আবার নেই?

ঘোড়া-গাড়ি করে ব্যান্ড বাজিয়ে একদল লোক সকালের দিকে সিনেমার হ্যান্ডবিল বিলি করে গিয়েছিল; তারই একটু কুড়িয়ে রেখেছিল বকুলদি। বেলা। পড়তেই দেখিয়েছিল কুঞ্জকে। চট করে দুটো টিকিট নিয়ে আয় তত ভাই।

-টাকা?

সে বন্দোবস্তও বকুলদি করেছে বই-কি। পুরনো কাপড় আর ফুটো বাসন বেচে আজই পেয়েছে টাকানগদে দুটাকা দশ আনা। এ-টাকার খবর প্রাণকৃষ্ণ রাখে না।

কুঞ্জর তবু হাত সরে না, পা পড়ে না। বলল, জামাইবাবু জানলে বকবেন।

—টের পেলে তোবকুল ভরামুখ হেসে বলল,–কদিন থেকে ওভারটাইম খাটছে, রাত দশটার আগে বাবু ফেরেন না। আমরা তার আগেই ফিরে আসব, দেখিস। বিকেলের রান্না সেরে দিইচি, ফিরে এসে দু’খানা রুটি সেঁকে নেবো’খন।

সেদিনই প্রাণকৃষ্ণ ফিরেছিল তাড়াতাড়ি। পুরো ঘণ্টা কাজ শেষ হতে ছুটল ওভারটাইমের লিষ্টি দেখতে। নাম নেই। মেজাজ গেল বিগড়ে। শালা, দুটো পয়সা উপরি আয়ের যদি জো থাকে। মুখ দেখে দেখে খাতিরের লোক বেছে বেছে লিস্ট তৈরি হয়। ফিরে এসে বাড়িতে দেখে বৌ নেই। সিঁড়ির ধাপে বসে একটার পর একটা বিড়ি টেনেছে প্রাণকৃষ্ণ।

সেই বিড়ির আগুন কুঞ্জ দেখতে পেলে গলির মুখ থেকেই। বুঝলে বেগতিক। বুকের ভেতরটা হিমহিম লাগল। একটু ভোলাবাতাস পুরে নিতে কুঞ্জ পিছিয়ে রইল।

গ্যাসের আলো গলির ইদিকে নেই। একটা কেরোসিনের ডিবে আছে, সেটা আবার রোজ জ্বলে না। তবু দেখতে পেলে প্রাণকৃষ্ণ শক্ত করে ধরেছে বকুলদির চুলের মুঠি, রাবণ যেমন করে সীতার ধরেছিল। হিড়হিড় করে প্রাণকৃষ্ণ ঘরের মধ্যে টেনে নিয়ে গেল বকুলদিকে।

অনেকক্ষণ পরে পা টিপে টিপে ফিলে এসেছিল কুঞ্জ। সারাটা রাত রকে শুয়েই কাটল। আকাশের গায়ে কাঁটা দেওয়া অজস্র তারা। কিন্তু সেদিকে তো চোখ নেই কুঞ্জর। ওর নিজের গায়েও কাটা দিয়েছে! হয়ত কার্তিকের হিমে; হয়ত অনেকক্ষণ ধরে বকুলদির কান্না শুনে শুনে।

পরের দিন, প্রাকৃষ্ণ কাজে বেরিয়ে গেলে বকুলদি ওকে কালো কালো দাগ দেখিয়েছিলো। শুধু তাই না। নাকে, গালে, কানের লতিতে অনেকগুলো ছড়ে যাওয়া দাগ।

—জামাইবাবু বুঝি দেয়ালে তোমার মুখ ঘষে দিয়েছিল বকুলদি?

গলাটাকে করুণ করে কুঞ্জ জিজ্ঞাসা করেছিল।

ফিক করে হাসল বকুল,—দূর বোকা, এসব দাগ অন্য জিনিষের। তুই বুঝবি। একটু থেমে বলল, এ হ’ল ভালোবাসার। ভালোবাসারও আঁচড় পড়ে জানিস?

কুঞ্জ তখনো অবোধ চোখে চেয়ে চেয়ে আছে দেখে বকুল বলল, সত্যি কাল আমাদের দোষ হয়েছিল ভাই। মেয়েমানুষ, সোয়ামীর অধীন। কত্তার কুম না নিয়ে আমাদের, বেরোনো উচিত হয়নি।

দিদি মানে হল বকুলদিপাড়া সম্পর্কে। বয়সে বছর দুই-এর বেশি বড়ো না। আগে বুঝি কুঞ্জ নাম ধরেই ডাকত, সেই পুকুরে চান করা, ফুল তোলা, ফল চুরি করার আমলে। তারপর বকুলের বিয়ে গেল। পাত্র প্রাণকৃষ্ণ কলকাতায় চাকরি করে।

বিয়ের পর একবার বাপের বাড়ি ফিরে গেল বকুল, চওড়াপাড় শাড়ি, মোটা টানা সিঁদুর! দু’বছরের বড়ো তো ছিলই, আরো যেন বছর দুই বয়স বাড়িয়ে এল।

ভাই বোনের খাতার পাতা ছিঁড়ে বকুল বরকে ভারি ভারি চিঠি লিখত; সেই চিঠি ডাকে দিতে হত কুঞ্জকেই। খামের ওপর যত্ন করে লেখা ঠিকানাটা দেখে দেখে ওর মুখস্ত হয়ে গিয়েছিল।

এবারে কলকাতা পাড়ি জমাবার আগে সেই ঠিকানাটুকু কাগজে লিখে এনেছিল কুঞ্জ। রাস্তাঘাট ঠাহর হতে হতে লাগল দিন চারেক। এ ক’দিন ফুটপাতে শুয়েছে, খেয়েছে মুড়ি, কলের জলে ভিজিয়ে। তারপর অনেক জিজ্ঞাসাবাদ করে ঠিকানায় গিয়ে পৌঁছেছিল ঠিক।

খোলার দোচালা, টিনের বেড়া, দর্মার ঝাপ, চটের পর্দা। বুকটা দমে গিয়েছিল, তবু ফুটপাতের চাইতে ভালো। ভরসা করে দরজায় টোকা দিলে।

বকুল ছিল রাস্তাতেই, একটা বে-আব্রু কলে চান করছিল। অচেনা লোক দেখে শপশপে কাপড়ে ফিরে এল তাড়াতাড়ি, ঘড়াটা মাটিতে রেখে, ঘোমটাটা টেনে দিল।।

কুঞ্জ দেখল, শুকনো লিকলিকে হাত, চোখে কালি, আরো বক্স চারেক বয়স বেড়েছে বকুলের।।

আর নাম ধরে ডাকা চলল না। বলল, বকুলদি?

বকুল বলল, কুঞ্জ! আমি বলি কে না কে। আয় ঘরে বস। কবে এলি।

সব শুনে গম্ভীর হয়ে গেল বকুল। মাসিমা নেই? কবে গেলেন? মেলোমশাই নিরুদ্দেশ? আহা। এখানে থাকবি বলে এসেছিস, ভালো কথা। কিন্তু বড়ো যে মুসকিলে ফেললি ভাই। এই তো দেখছিস ঘরদোরের অবস্থা, শুতে দিই কোথায়? তোর জামাইবাবুর তো ছাপাখানার সামান্য কাজ, আমাদেরই চলে না।

তা হোক, তবু ওরই মধ্যে বন্দোবস্ত হয়ে গেল। রকে শোবে কুঞ্জ, যা হোক দু’মুঠো খাবে। চেনা আর একটা ছাপাখানায় কুঞ্জকে ফতোলার কাজ জুটিয়ে দেবার ভরসা দিল প্রাণকৃষ্ণ।

বদল কি প্রাণকৃষ্ণরই কম হয়েছে। বিয়ের সময় ছিল বাগানো টেরী তেল চপচপে চুল, ছোঁকরা ছোঁকরা দেখাত। এবার কুঞ্জ দেখল, প্রাণকৃষ্ণর মাথার সমুখের। দিকটা অনেকটা ফর্সা হয়ে এসেছে, পেছনের দিকে যা কয়েক গোছ চুল আছে তার অনেকটাই সাদা। সামান্য দু’চার বছরে এতটা বয়স বেড়ে যায় মানুষের! সেবারে শ্বশুরবাড়ি গিয়ে ঘন ঘন কাঁচি সিগারেট ফুঁকত; এবারে বিলকুল খাকি, তাও হিসেব করে প’হরে প’হরে ফোঁকে, খুক খুক কাশে।

তা কাশুক, প্রাণকৃষ্ণের মুখের বড়াই আছে তেমনি। প্রথম আলাপেই কুঞ্জ বলেছিল, আপনি একটা কাজ জুটিয়ে দিন জামাইবাবু। ছাপাখানার আপনিই তো মানেজার।

ম্যানেজার? প্রাণকৃষ্ণ বলল, না ঠিক ম্যানেজার আমি নই। তবে বলতে পার বটে। ম্যানেজার নামে যেটা আছে সেটা ছাপাখানার কাজের বোঝে কী? আমাকেই ব চালাতে হয়। বিশ বছর কম্পোজ করছি, ক’ সিলিপে কইষ্টিক, চোখ বুলিয়ে বলে দেব। পারবে তুমি বলতে? পারবে আমাদের গ্র্যাজুয়েট মুখুজ্যে? ম্যানেজার হতে কত প্রেস থেকেই তো কত সাধাসাধি করে। মাইনে! বোয়েচ ভায়া, পুরনো চাকরি। তা ছাড়া ওসবে অনেক ঝুঁকি—তা দেবো তোমাকে একটা কাজ জুটিয়ে।

দিলও শেষ পর্যন্ত। পুফটানার কাজ। এ কাজটা সহজ, শিক্ষানবিশি নেই, সাকরেদি নেই। দিনকতক গেলি টানাটানি করলেই ওস্তাদ।

মাইনেপত্তর ঠিক হল কিনা, কত ঠিক হল কে জানে, প্রাণকৃষ্ণ জানতে দিল না কুঞ্জকে। বলল, এখন শুধু খেটে যা। মইয়ের নিচের ধাপে আছিস, নজর রাখবি ওপরে, ওই ম্যানেজার মুখুজ্যে যেখানে বসে আছে, তোকে গিয়ে পৌঁছতে হবে ওখানে, বুইচিস।

ছিল বেশ। দুটো খেত, পরত, শুত—কোনদিন রকে, জোর বিষ্টির দিনে সিঁড়ির নিচে চাদর বিছিয়ে।

ভোর সাড়ে আটটায় বেরিয়ে যেত প্রাণকৃষ্ণ, কুঞ্জ তারো কিছু পরে। আগে কম্পোজ হবে তবে তো পুরুষ।

বাজার করে নিয়ে এসে কুঞ্জ দেখতে পেত কাঁখালে করে রাস্তা থেকে জল তুলে আনছে বকুলদি, পারছে না। কোমর বেঁকে গেছে, ঠোঁটদুটো আলগা। আসতে আসতে হাঁপাচ্ছে।

ছুটে যেত কুঞ্জ। সরো বকুলদি, আমি ধরে দিচ্ছি জল।

এই ক’বছর শ্বশুরঘর করে, জল টেনে, বাসন মেজে আর উনুন ধরিয়ে শরীরের আর কিছু নেই বকুলদির, শুকিয়ে কাঠিসার তো হয়েছেই, সবটুকু লাবণ্য ঝরে গেছে।

টুকু বুঝি নয়! এখনও যখন কাপড় কেচে, গা ধুয়ে ঘরে এসে ঢোকে বকুলদি, অনেক কষ্টে দরজার কপাটের আড়াল করে ওর দিকে পেছন ফিরে কাপড় ঘড়ে, হাত আয়না সমুখে রেখে টেনে টেনে চিরুনী চালায়, কুঞ্জর চোখে ধাঁধা লাগে। অনেক দিন দেখা ওদের গ্রামের সিগ্ধ শ্যামল কিশোরীকে মনে পড়ে। এখনো তবে একেবারে মরে যায়নি বকুলদি, ফুরিয়ে যায়নি। এখনও যদি একটু জিরিয়ে নিতে পারত, খেতে পারত পেট ভরে, তবে বকুল আবার তাজা হয়ে উঠতে পারত, বাতাস লাগত হাড়ে, গালে মাংস, রক্ত আসত শরীরে।

কিন্তু শুধু খেতে পেলেই কি সুখী হত বকুল। প্রাণকৃষ্ণ খেয়ে উঠে গেছে, পারে কাছে বসে বকুলদিকে শুকনোমাছের কাঁটা চুষতে দেখে কুঞ্জর তাই মনে হয়েছিল বটে, কিন্তু ভালো করে নজর করে মাঝে সন্দেহ হয়েছে, শুধু খাওয়া পরা আর বিশ্রামের অভাবই কুলদির আসল অসুখ নয়, আরো কিছু আছে।

প্রাণকৃষ্ণর এঁটো তুলে নিতে এসে থালার চারপাশে লেগে থাকা দু’চারটে ভাত কুড়িয়ে কুড়িয়ে খেত বকুলদি। কোনো কোনো দিন কুঞ্জর চোখে ধরা পড়ে গেছে।

-তোমার বুঝি আজ খাওয়া হয়নি, বকুলদি?

একরকম হাসি ফুটত কুলদির মুখে। লজ্জা ঢাকে হাসি, কিন্তু হাসির দৈন্য ঢাকে কিসে।

–হবে না কেন, তাই বলে জিনিষ নষ্ট করব কেন। তোর একদম বুদ্ধি নেই। কুঞ্জ।

বুদ্ধি আছে প্রমাণ করবার জন্যেই কুঞ্জ মাঝে মাঝে পাতে অর্ধেকটা ভাত রেখে উঠতে গেছে। বকুল তা হতে দেয়নি।

–ভাত নষ্ট করছিস যে?

–খিদে নেই। তাছাড়া নষ্ট হবে কেন?

—কে খাবে তোর পাতেরটা?

ভয়ে ভয়ে, কতকটা চোখ বুজে কুঞ্জ বলেছে, কেন তুমি।

বকুল চটে উঠেছে, কিংবা ভান করেছে।—এই বুদ্ধি হয়েছে তোমার এত বয়সে। সোয়ামীর প্রসাদ খেলে পুণ্যি হয়, তোর পারেটা খেলে আমার কী।

কুঞ্জ বলতে চেয়েছে আমার পুণ্য হবে কিন্তু কথা সরেনি। কিন্তু আসলে তো খেতে পাওয়ার দুঃখই শুধু নয় বকুলের, আরো একটা আছে। ভয়।

এই ভয় স্পষ্ট নয়, প্রত্যক্ষ নয়, লু আছে। বাতাসের মতো; প্রাণকৃষ্ণর মতো। অজানিতে চোখের পলক পড়ার মতো।

বিকেলে গা ধুয়ে এসে ভালো একখানা কাপড় পরে বৈকি বকুল, প্রাণকৃষ্ণর গলার আওয়াজ শুনলেই মুখে কেমন একটা ছায়া নামে।

সে ছায়া অবশ্য মিলিয়ে যায় মুহূর্তেই। একটু পরে হাসে বকুলদি, বকুলদিকে হাসতে হয়। আজ এত দেরি?

সারাদিন পরিশ্রমের পর মেজাজ তিরিক্ষি প্রাণকৃষ্ণের। ঘর্ঘর গলায় কী বলে বোঝা যায় না। তারপর হাত মুখ ধুয়ে ঠাণ্ডা হয়ে দু’একটা ঈয়ার্কি দেয় বৌয়ের সঙ্গে। বকুলদি হাসে, হাসতে হয়। তবু সে হাসি, কুঞ্জ ঠিক ধরতে পারে, পেতলের কলসির কানার মতো, অন্তরের ছায়া লুকিয়ে যায়, ঘোঘাচে না।

শুধু বকুলদি কেন স্বামী স্ত্রী সম্পর্কে কুঞ্জর অভিজ্ঞতাই এমনি। এই বস্তিতে আরো তো ক’ঘর পরিবার আছে। ও-পাশে ললিতাদি এ পাশে নীলুদিরা। এমনিতে বেশ আছে। স্বামীর জন্যে রান্না করে, জামা রিপু করে, একসঙ্গে শোয়, বছর বছর। বিয়োয়, কিন্তু তবু কোথায় যেন একটা অস্বাচ্ছন্দ্যের পর্দা দুলতে থাকে। একই সুখ, একই দুঃখের শরিক দুজনে’লু দু’জন যেন সমান নয়। একে প্রভু অপরে দাসী।

নইলে সামান্য একটু অন্যমনস্কতার জন্যে ভাতটা একটু ধরে যায় যেদিন, সেদিন বকুলদির মুখ অমন শুকিয়ে যায় কেন, চোখে মুখে ফুটে ওঠে কেন আতঙ্ক। বলে, আজ তোর জামাইবাবু আমাকে আস্ত রাখবে না কুঞ্জ। কী করে ধরে গেল বল দেখি।

অবশ্য প্রাণকৃষ্ণও বলে। হাসতে হাসতে। একবারে পাঁচসিকে পয়সা বাজী ধরেছিল রেসে। কিছু ফিরে আসেনি। ছাপাখানার কালি ধুয়ে মুছে বাসায় ফিরতে ফিরতে প্রাণকৃষ্ণ বলেছিল, তোর দিদি একেবারে ক্ষেপে যাবে কুঞ্জ। কাপড় কাঁচা সাবান, সুতো আর মশলা কেনার পয়সা হিসেব করে দিয়েছিল। ওকে আমি কৈফিয়ৎ দেব কী। বলতে বলতে গলাটাকে ভারী করে আনে প্রাণকৃষ্ণ। চোখ মুখও গম্ভীর, তবু কুঞ্জ জানে সব কৃত্রিম। বকুলদির বিন্দুমাত্র তোয়াক্কা রাখে না প্রাণকৃষ্ণ। যেমন রাখে না পাশের ঘরের ললিতাদির স্বামী পশুপতি।

এক একদিন বাসায় ফিরতে পশুপতির খুব রাত হয়ে যায়। দরজার ওপর দুমদাম আওয়াজ করে। ললিতা যদি বলে, আজ আবার ওসব খেয়েছ,—মুহূর্তে বিনয়ে কাদা হয়ে যায় পশুপতি। ধরাধরা গলায় বলে, মাইরি না। আর কোনও দিন ওসব ছোঁব না। এই তোমার পা ছুঁয়ে বলছি–

পা ছুঁতে যায় বটে, তখন সখের জোয়ারের পর অনুতাপের ভাটা চলছে, কিন্তু সত্যি কি আর ছোঁয়, না ললিতাদি ছুঁতে দেয়।

এরপরও যদি বুঝেসুঝে চুপ করে না যায় ললিতাদি, অমনি বিনয়ের খোলস ছেড়ে কুঁসে উঠবে পশুপতি। দু’চার ঘা বসিয়ে দেবে।

এসব দেখে দেখে অভ্যাস হয়ে গেছে কুঞ্জর। দিন মন্দ কাটছিল না। কেটে যেতে-ও, যদি না প্রাণকৃষ্ণের চাকরিটা অমন হঠাৎ চলে যেত।

গেল, কাজে ঢিলেমির জন্যে নয়, গরহাজিরার জন্যে নয়, সীসে চুরির দায়ে। কিছুদিন থেকেই টাইপ কমতে শুরু করেছিল। কেস-কে-কেস দুদিনে খালি। নজর রাখা শুরু হল। সাতদিনের মাথায় ধরা পড়ল প্রাণকৃষ্ণ, হাতে নাতে, সঙ্গে সঙ্গে সাফ জবাব হয়ে গেল। থানা পুলিশ হল না, বিশ বছরের চাকরি। বাবুরা মাফ করলেন। কিন্তু চাকরিটি কেটে দিলেন। সেই সঙ্গে কুঞ্জরও। চোরে চোরে মাসতুতো ভাই নয়। শালা-ভগ্নিপতিও হয়। কে না জানে কুঞ্জ প্রাণকৃষ্ণেরই লোক।

সব শুনে গুম হয়ে বসে রইল বকুল।

—এবার কী উপায় হবে।

প্রাণকৃষ্ণ ভরসা দিল, কিছু জ্বে না, একটা জুটবেই। এত বছর ধরে আছি এ লাইনে।

জুটল না তত সহজে। কেলেঙ্কারির খর দ্রুত ছড়ায়। বাই কী করে টের পেয়ে গেছে চুরির দায়ে বরখাস্ত হয়েছে প্রাণকৃষ্ণ। আরো মাসখানেক কাটল।

এই এক মাস প্রাণকৃষ্ণ বসে থাকেনি। চায়ের দোকানের রকে বসে বসে অব্যর্থ। ঘোড়ার কুষ্ঠিকুলজি বিচার করেছে। পাঁচ ধরে দশ আনা ফেরৎ এসেছে এইমাত্র, তাতে সংসার চলে না।

বকুলের সঞ্চয়ের শেষ কড়ি পর্যন্ত ক্ষয়ে ক্ষয়ে এল, কিন্তু প্রাণকৃষ্ণ আশা অক্ষয়। রোগা জিরজিরে বুকে চাপড়মেরে বলল, সবুর আর কটা দিন। একটা হদিশ পেয়েছি। ঠিক মতো গেঁথে তুলতে পারলেই ব্যস, পায়ের ওপর পা ধুয়ে বুঝলে বকুল। বকুল ভাষাহীন, ফ্যাকাশে মুখে তাকিয়ে থাকে। বোঝে কিনা বোঝা যায় না।

একদিন বিকেলে এসে তাড়া দিলে প্রাণকৃষ্ণ। চটপট তৈরি হয়ে নাও তো বকুল, সিনেমায় যাব। সিনেমা! সকালে শুধু মুড়ি খেয়ে কেটেছে, এ বেলার জন্যে তাও নেই। বকুল বলল সিনেমা!

ধমক দিল প্রাণকৃষ্ণ। হাঁ করে তাকিয়ে থেকোনা, যাও সাবান দিয়ে মুখ ধুয়ে এস, চটপট।

সাবান কোথায়?

কেন ললিতার কাছে ধার করে চালিয়ে নাও না। দেবে না? আলবৎ দেবে।

যতক্ষণ শাড়ি বদলাল বকুল, ততক্ষণ প্রাণকৃষ্ণ ওর প্লান উন্মোচন করল। আরে, জোর একটা টিপস পেয়ে গেছি। নিরুপমা পারফিউমারির নাম শুনেছ?

পারফিউমার কি বস্তু বকুলের জানা ছিল না।

সাবান, তেলের কোম্পানী আর কী। আজ ললিতা তোমাকে সাবান মাখতে দিতে খুৎ খুঁং করছিল, দুদিন বাদে তুমি ওকে বাক্স বাক্স সাবান দিতে পারবে। তবে আমরা এখানে আর থাকব না এই যা।

আঁচলটা বেড় দিয়ে সবে মাথার ওপর তুলছিল, বকুল, হঠাৎ ওর হাত আলগা হয়ে গেলে।—এখানে আর থাকব না?

বাহাদুর গলায় প্রাণকৃষ্ণ বলল, তবে আর বলছি কেন? নিরুপমা পারফিউমারির অর্গানাইজার সুবোধ চক্কোত্তির সঙ্গে আলাপ হয়েছে। আমাকে ওরা বাইরে পাঠাতে চায় বিহার উড়িষ্যার সোল এজেন্ট করে। মালটা চালাতে হবে আর কী। ট্রেনে ট্রেনে ঘোরাঘুরি করে।

এতক্ষণে কুল বুঝতে পেরেছে।–ফিরিওয়াল হবে তুমি?

কম্পোজিটারের বউ বকুল। সামাজিক মর্যাদা সম্পর্কে বড় হুঁশিয়ার।

ফেরিওয়ালা তো আরো একধাপ নিচে।

—আরে দূর দূর। ফিরিওয়ালা হতে যাব কেন? আমার অধীনেই কত ফিরিওয়ালা থাকবে দেখ। এই কুঞ্জ ছোঁড়াটাকেও আমি একটা কাজ দিয়ে দেব। এ সব কাজে বহুৎ দায়িত্ব কুল, বিস্তর টাকা জমা দিলে তবে জোটে। নেহাৎ সুবোধ চক্কোত্তির আমাকে খুব মনে ধরেছে তাই–

তাই সুবোধ চক্রবর্তীর পয়সায় সিনেমা যেতে হল।

.

সিনেমায় কী হয়েছিল, সেদিন বোঝেনি কুঞ্জ। ফিরে এসে বকুল ভালো মন্দ কিছুই বললে না। কেমন গল্প, ক’টা গান, কিছু না। কুঞ্জ জিজ্ঞাসা করতে সাহল পেলে না।

দিনতিনেক বাদে প্রাণকৃষ্ণ বলল, চটপট তৈরি হয়ে নাও। বিকেলে বেড়াতে যাব। সুবোধ চক্কোত্তি আসবে গাড়ি নিয়ে।

বকুলের মুখ মড়াফ্যাকাসে হয়ে গেল, প্রাণকৃষ্ণ সেটা নজর করল কি না বোঝা গেল না, কিন্তু কুঞ্জ দেখে নিয়েছে ঠিক।

—আজকে? আবার!

বিবর্ণ মুখ প্রাণকৃষ্ণ দেখতে পায়নি কিন্তু বিরস গলা শুনল ঠিক। চটে গিয়ে বলল, কী রাজকাৰ্য্য করছ এখানে বল দেখি। সুবোধ চক্কোত্তির মেলা পয়সা বকুল, খাবার লোক নেই, লোকটা তাই মনমরা হয়ে থাকে। নইলে টাকাকে টাকা জ্ঞান করে না। আজ ডায়মণ্ডহারবার যাবে।

–যাক না। বকুল বলল, যত খুশি বেড়িয়ে বেড়াক। আমাদের নিয়ে টানাটানি কেন।

কথার ছিরিতে প্রাণকৃষ্ণ ক্ষেপে গেল—টানাটানি আবার কীরে যেতে ইচ্ছে হয় যাবে, না হয় যাবে না।

স্থির চোখে একবার স্বামীর মুখের দিকে তাকাল বকুল, বলল, বেশ চল।

ফিরে এসে সটান শুয়ে পড়ল। কুঞ্জ আগেই মুড়ি বাতাসা খেয়ে নিয়েছিল। সেদিন আর উনুন জ্বলল না।

নাটকীয় সেই ঘটনাটা ঘটল আরো দিন চারেক পরে।

একটা টাকা দিয়ে লোকটা ওকে ফরমাস করল, যাওতো থোকা, এক প্যাকেট সিগারেট নিয়ে এস, দুখিলি পান।

ঝাঁ ঝাঁ দুপুর—দোকানের ঝাঁপ বন্ধ, ফিরে আসতে কুঞ্জর মিনিট পনেরো লাগল। দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকতে যাবে, পারল না।

রুদ্ধশ্বাস বকুলদি, আরক্তমুখী বলছে, যান, এখনি বেরিয়ে যান আপনি। নইলে

মিটিমিটি হাসছে সুবোধ।–নইলে কী।

–নইলে উনি এসে আপনাকে ঘাড় ধরে বার করে দেবেন।

—প্রাণকেষ্টর কথা বলছ?—তেমনি হাসছে সুবোধ-আরে না সে আসছে না বকুল, তোমার ভয় নেই। প্রাণকেষ্টকে মোড়ের দোকানে বসিয়ে এসেছি—সে এখন চিংড়ির কাটলেটের কাঁটা চুষছে।

সেই মুহূর্তে কী হল কুঞ্জর, ঘরে ঢুকল ঝড়বেগে, অন্ধের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ল সুবোধের গায়ে, হাতের কাছে কিছু না পেয়ে শুধু নখে রক্তক্ষত করে দিতে লাগল।

ছিটকে পড়ল অবশ্য মুহূর্তেই। সুবোধ চক্রবর্তী লিকলিকে হলেও কুঞ্জর মতো পুঁচকেকে কায়দা করার জোর রাখে। মেজেয় ঠোকর খেয়ে কেটে গেল কপালের খানিকটা, আর, তখন আর জ্ঞান রইল না কুঞ্জর। হাতের মুঠোয় ছিল ক’আনা পয়সা, দেশলাই, সিগারেটের প্যাকেট। সব আবীর ছোঁড়ার মত ছুঁড়েদিল সুবোধের চোখ লক্ষ্য করে। চশমাটা চুরমার হয়ে পড়ল মাটিতে, তারই দু’এক টুকরো বিধে থাকবে সুবোধের চোখে। দু’হাতে মুখ ঢেকে সুবোধ মাথা হেট অপমানে ঘর থেকে সুড়সুড় বেরিয়ে গেল।

কিন্তু সে তো শুধু প্রথমাঙ্কের যবনিকা। প্রাণকৃষ্ণের প্রবেশ হল বেলা গড়িয়ে যেতে। এদিক ওদিক তাকিয়ে বলল, সুবোধ আসে নি?

হাঁটুতে মুখ গুঁজে, বসেছিল বকুল, এতক্ষণে ভেঙে পড়ল কান্নায়। গোঙানির সঙ্গে বিনিয়ে বিনিয়ে কী বললে, বাইরে দাঁড়িয়ে শুনতে পেল না কুঞ্জ।

প্রাণকৃষ্ণ ততক্ষণে কঠিন হাতে ঠেলছে বকুলকে।—যাওনি? যাওনি তবে সুবোধ চক্কোত্তির সঙ্গে?

মিনমিনে স্বরে বকুল একবার বলতে চেষ্টা করল, তুমি ছিলে না—

–সতী-নকখি! কই পাতানো ভাইয়ের সঙ্গে গলাগলি করে যাওয়ার সময় এই হিসেব তো ছিল না। ওর সঙ্গে কীসের এত গুজগুজ ফুসফুস। ও শালাকে আজই মেরে তাড়াব।

দম নিল প্রাণকৃষ্ণ, ফের হতাশার ভঙ্গিতে হাত ঘুরিয়ে শুরু করল : আর কী, যা কিছু আশা-ভরসা ছিল, সব ফরসা হয়ে গেল। কী খোয়া যেত তোমার সুবোধের কথাটা রাখলে আর মাসখানেকের মধ্যেও একটা কাজ যদি জোটাতে না পারি, তখন কোথায় থাকবে তোর এত তেজ। বেশ্যাবিত্তি করেও কুল পাবিনি।

মেরে তাড়াতে হল না, কুঞ্জ সেদিন নিজে থেকেই সরে পড়ল। তারপরেও কিন্তু একদিন লুকিয়ে দেখা করতে এসেছিল বকুলের সঙ্গে। দেখল তালাবন্ধ।

মোড়ের কাছে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে, দেখল গাড়ি থেকে নামল বকুল।

ভাঙা চশমা জোড়া লাগেনি, নতুন চশমা সুবোধের চোখে। ভুরুর ওপর ছোট একটা ব্যান্ডেজ।

উল্টোদিকে মুখ ফিরিয়ে হন হন রাগে কুঞ্জ চলতে শুরু করল।  

সব শুনে শশী বলল, রাগের কী আছে। বকুল ঠিকই করেছে কুঞ্জ। শশীর সব ঠাণ্ডামাথা বিবেচনা। বলল, স্বামীর ইচ্ছেই তো ইস্তিরীর ইচ্ছে। স্বামীর ভালোই তো ইস্তিরীর ভালো। তার আবার আলাদা সুখ কী, আলাদা ইজ্জৎ কী।

কুঞ্জ তবু বলল, তাই বলে পরপুরুষের–

শশী বলল,—পরপুরুষ আবার কী। স্বামী যার হাতে সঁপে দেন তার মধ্যেই তো স্বামীকে ধ্যান করতে হয়। গোপিনীরা যেমন করেছেন। নিজেদের শ্রীকৃষ্ণের কাছে সঁপে দিতেন, পড়িসনি? এর মধ্যে কোনো পাপ নেই কুঞ্জ। বকুলের কোন দোষ নেই।

দোষ তো নেই, কিন্তু মন বোঝে কই। মাঝে মাঝে বকুলের কাছে যায় বটে, কিন্তু গলির কাছাকাছি এসে নাকে হাত দেয়। এখানে কি সে কখনও ছিল!

এখন মনে হয় দুঃস্বপ্নের মতো। আঢাকা নর্দমার গন্ধ, ফুটো চালে উঁকি দেওয়া শত নেত্র ইন্দ্র আকাশ, আর শত ছিদ্র কাপড়ে রোগা-রোগা কতগুলো মেয়েমানুষের ঘোরাঘুরি।

ওখানে শুধু ফুলে ফুলে রামধনু, সবুজ ঘাস-গালিচা, ঝাউউদাস হাওয়া আর, আর মেমসাহেব।

একটি স্বপ্ন সুড়ঙ্গের মতো সম্মোহিত দিন-রাত্রি।

কোথায় কোন্ স্পোর্টসে বখশিস বিতরণ করে এসেছেনে মেমসাহেব। এসেই শুয়ে পড়েছেন বিছানায়। মাথা ধরেছে। একটু ওডিকোলন ছিটিয়ে দিলেন কপালে, তাতেও ব্যথা কমল না, অস্ফুট গোঙানি শুনতে থাকল কুঞ্জ, দুরে বসে। একটু পরে মেমসাহেব ওকে ইসারায় ডাকলেন, ছোট রুমালটা শুকিয়ে গিয়েছিল, আবার ভিজিয়ে আনতে বললেন।

শয়নকক্ষলগ্ন স্নানঘর। এটুকু পথ যেতে আসতে কুঞ্জর তিনমিনিট কেটে গেল। এতক্ষণ ধরে নিবিড় স্পর্শে ইন্দ্রাণীর কপালের সবটুকু তাপ আহরণ করেছে রুমালটা। সেই তাপটুকু কুঞ্জ শুষে নিতে চাইছে করপৃষ্ঠের রোমকূপ দিয়ে। বেসিনে জল ঝরছে, ঝরছে তা ঝরছেই, ইন্দ্রাণী কাতর গলায় ডাকলেন, কুঞ্জ! কী করছিস এতক্ষণ ধরে।

চকিতে সম্বিত ফিরে এল। থরথর হাতে ভিজে রুমালটা মেমসাহেবের হাতে কুঞ্জ তুলে দিল।

একটু পরেই ঘরে ঢুকেছেন চৌধুরী সাহেব। সুইচবোর্ডে হাত দিতেই ইন্দ্রাণী বলেছেন, প্লিজ, ডোন্ট।

মাথা ধরেছে?

পাশ ফিরে শুয়ে ইন্দ্রাণী বলেছেন, ইয়েস, বীষ্টলি।

তখনকার মতো কেটে গেছে বটে, কিন্তু সেই স্বপ্নমোহ বারবার ফিরে এসেছে কুঞ্জর।

আর্ট একজিবিসনে যাবেন, বিছানা থেকে উঠে মেমসাহেব চোখে জল দিতে গেছে, বিছানাটা ফের ঠিক করতে গিয়েও কুঞ্জর হাত সরেনি। চাদরে বালিশে একটি দিব্যদেহের ছাঁচ, একটি অস্পষ্ট মধুর সুরভি।

জুতো পালিশ করতে গিয়েও দেরী হয়েছে, ধমক খেয়েছে, তবে কুঞ্জর হুঁস হয়েছে।

আরেক দিন।

দামী শাড়িখানা কুঞ্জই ধুতে দিয়েছিল। ভাজ খুলেই মেমসাহেব চেঁচিয়ে উঠলেন, এ কী, এমন করে আঁচলটা কাটলে কে।

তলব পড়ল কুঞ্জর।

—এটা কে ধুতে দিয়েছিল, তুমি?

কুঞ্জ স্বীকার করল। তৎক্ষণাৎ ওকে শাড়িটা দিয়ে ইন্দ্রাণী বললেন—যাও, এক্ষুণি এটা ওদের দোকানে দেখিয়ে নিয়ে এস। বল পুরো দাম কাটব আমি।

কুঞ্জ তবু নড়ে না।

মেমসাহেব ধমক দিলেন আবার—যা-আও! দাঁড়িয়ে আছ যে।

পলক পড়ছে না কুঞ্জর চোখের। ওর পেছনের দেয়ালে বিজলী আলো,সামনে মেমসাহেব। হঠাৎ কুঞ্জর নজরে পড়েছে, মেমসাহেবের গায়ে ওর সম্পূর্ণ দেহের ছায়া। কুঞ্জর চিনতে ভুল হয়নি, সে ছায়া ওর নিজের। নিনখ শুভ্র পায়ের আঙুল আঙুল ছুঁয়ে সাপেরমত বেয়ে বেয়ে উঠেছে সে ছায়া শাড়ির ভাঁজে ভাঁজে বাধা পেয়ে পেয়ে, বাধা না মেনে, ছায়া করাঙ্গুলি থরথর করে কাঁপছে ইন্দ্রাণীর দুঃশাসন উচ্চচূড়। স্তনে, কুঞ্জর রুগ্ন, ধুকধুক বুক ছায়া হয়ে মিশে আছে ইন্দ্রাণীর অবারিত গ্রীবামূলে, আর ইন্দ্রাণীর ঈষৎভিন্ন অধরোষ্ঠ কুঞ্জর ছায়া কণ্ঠে আসক্ত।

মাথায় কুঞ্জ ইন্দ্রাণীর চেয়ে ছোট, কিন্তু ছায়া হয়ে ছাড়িয়ে গেছে।

ইন্দ্রাণী ফের অসহিষ্ণু ধমক দিলেন, কই গেলে না? যাও!

যাবে, কুঞ্জ এবার যাবে। কায়া দিয়ে যার পায়ের পাতাটুকু ছোঁবারও অধিকার কোনোদিন পাবে না, ছায়া হয়ে তার সর্বদেহের নিবিড় স্পর্শ পেয়েছে। কুঞ্জর আর আফশোস নেই।

কিন্তু কোথায় যেন সুর কেটে গেছে। কদিন ধরে স্পষ্ট টের পেয়েছে কুঞ্জ।

বাগানে জল দেওয়া বন্ধ। ঘাস বিবর্ণ, হলিহক, ভায়োলেট, পপি আর প্রিমরোজ নির্জীব। গাছগুলো ঝাঁকড়া চুল হল, তবু ছট নেই।

শশী বলল; এ বছর আর ফুল হবে না, বাড়তি খরচ সাহেব সব বন্ধ করে দিয়েছেন। একটু থেমে ক্ষুণ্ণকণ্ঠে আবার বলল, আমারও জবাব হয়ে যাবে কুঞ্জ।

জবাব হয়ে যাবে শশীদা। কুঞ্জর শহর বাস বেশ কিছুদিন হয়ে গেল, গলায় আর তেমন আন্তরিকতা ফোটে না। এমন কি শশীর সুপারিশেই যে এখানে ঢুকেছিল সেটাও যেন ভালো মনে নেই কুঞ্জর।জবাব হয়ে যাবে শশীদা! কারুর পুত্র বিয়োগের খবর পেয়ে মেমসাহেব ফোন তুলে যে সুরে শোকাতুরাকে সান্ত্বনা দেন, কুঞ্জর গলাতেও সেই নিরুত্তাপ নাগরিকতা।

আসল খবর জানা গেল ক্রমে ক্রমে। শেয়ারের খেলায় ফকির হয়েছেন চৌধুরী সাহেব। কাঁচা টাকা প্রায় সবই খাঁচাছাড়া চিড়িয়ার মত উধাও, স্থায়ী জিনিসের মধ্যে এই বাড়ি, এই গাড়ি আর কিছু জমি—সেখানেও স্পেকুলেশন—সেও বঁড়শে বেহালার দক্ষিণে, নীচুডাঙ্গায় ভূমণ্ডলের মতো তারও তিন ভাগ জল একভাগ স্থল।

ভেজানো দরজার বাইরে কুকুরটা টা টা করে, কেউ ফিরেও চায় না, দরজার আড়ালে সাহেব-মেমের কলহ চলে। দেয়ালে ঠেস দিয়ে ঝিমোয় কুঞ্জ, কী কথা হয় বোঝে না, শুধু চাপা গলার ক্রুদ্ধ তর্জন কানে আসে।

মাঝে মাঝে কুঞ্জ চমকে ওঠে, এই এক্ষুনি পর্দা ঠেলে মেমসাহেব বেরিয়ে আসবেন, একটি মাত্র আঙুলের ইশারায় ওর জবাব হয়ে যাবে। যে পথে গেছে বাগানের ফুল, লনের ঘাস, দেয়ালের কলি, সেই পথেই কুঞ্জকে যেতে হবে।

শক্ত করে টুলটা চেপে ধরে কুঞ্জ, চোখের পাতা ভিজে ওঠে। যাবে না, যেতে পারবে না। কাঁপা কাঁপা আঙুল দিয়ে কুর্তার পকেটটা হাতড়ায়, মুঠি করে ধরে। কে জানে কুঞ্জ ওখানে কী রেখেছে।

পা টিপে টিপে দরজায় চোখ রাখে। সাহেব দাঁড়িয়ে আছে টুলের ওপর পা রেখে। একটা হাত প্যান্টের পকেটে ঢুকিয়ে স্পষ্টই উত্তেজিত।

—দেখাবে না, দেখাবে না তুমি আমাকে তোমার হিসাব?

—না। সংসার খরচের টাকায় তোমাকে হাত দিতে দেব না; এটা আমার।

-তোমার। এমন স্বরে সাহেব হেসে উঠলেন যে কুঞ্জর মনে হল জানালার সার্সি ঝনঝন করে উঠল।—তোমার! তোমাকে কে চেনে ইন্দু। সবাই চেনে মিসেস চৌধুরীকে। এর কোন জিনিষটা তোমার? সংসার খরচের টাকার কথা ছেড়ে দাও। এই মুহূর্তে তোমার বাক্সের চাবি ছিনিয়ে নিতে পারি। দেখতে পারি কত আছে তোমার পাশ বইয়ে। এমন কি, এক টানে ছিঁড়ে নিতে পারি তোমার কানের ওই বার্লিংটনের বাড়ির জড়োয়া দুল—

কুঞ্জ শিউরে উঠল, দেয়ালটা ধরে, সামলে নিল, সরল না তবু। সভ্য মানুষটির মুখোশ বুঝি একেবারে খসে-খসে।

কিন্তু, না। সোজা হয়ে দাঁড়িয়েছিল ইন্দ্রাণী, দেবী প্রতিমার মতো, সাহেবের মাথাও যেন ছাড়িয়ে গেছেন। দেবীর মতো অস্ত্র-শস্ত্র নেই হাতে কিন্তু ভঙ্গিটা এক। তাছাড়া দ্রুত ওঠা পড়া বুকের সাহস প্রোজ্জ্বল চোখের ঘৃণা, ওই তো তার আয়ুধ।

একটি কঠিন আঙুল তুললেন ইন্দ্রাণী, একটি নিশিত ছুরিকার মতো, রঞ্জিত নখাগ্রে বিজলী ঝলসে গেল-যাও, এক্ষুনি চলে যাও তুমি। যাও।

সেই মুহূর্তে ইন্দ্রাণীর পায়ের কাছে কুঞ্জ মূৰ্ছিত হয়ে পড়তে পারত। পেরেছেন, ইন্দ্রাণী পেরেছে। তার কুড়িবুড়ি বকুলদি যা পারেনি, একটি মাত্র নির্ভীক আঙুল তুলেই মেমসাহেব সেই অসাধ্য সাধন করেছে।

সাহেব বেরিয়ে যেতেই মেমসাহেব শুয়ে পড়লেন, আলো নিবিয়ে। পা টিপে টিপে সেই ঘরে ঢুকল কুঞ্জ। কী ঠেকল পায়ে। একটা কটা বোধ হয় মেমসাহেবের চুলের।

সেই যে বেরিয়ে গেলেন সাহেব, আর সাতদিনের মধ্যে ঘরমুখো হলেন না। বাগানতো কবেই শুকিয়েছিল, এমন ধুলোর সর পড়েছে বারান্দায়, পদায়, আসবাব। মেমসাহেবের ভ্রুক্ষেপ নেই! ঠোঁটের কোণের হাসিটুকু মিলিয়ে গেছে,এসেছে একটু কঠিন দৃঢ়তা। পোষাকের সেই ঝিমঝিম এসেন্স গন্ধটুকু নেই, এ ক’দিন মেমসাহেব মোটে প্রসাধনই করেননি। কাছেও ডাকেননি কুঞ্জকে। তবু দূর থেকে দেখেই কুঞ্জর বুক ভরে গেছে। ইন্দ্রাণী বিদ্রোহী, বন্দিনী, তবু বিজয়িনী।

সাতদিন পরে ফিরে ঘরের মধ্যে গুনগুন আলাপ শুনে কুঞ্জর অবাক লাগল। শশী বলল, সাহেব কাল ফিরেছে যে। অনেক রাত্তিরে গাড়ি এল, শুনিসনি? সাহেব গিয়েছিলেন বোম্বাইয়ে।

-কেন?—অর্থ নেই, তবু কুঞ্জ জিজ্ঞাসা করল।

পুরানো চাকর, কী করে সব খবরই যেন চটপট জানা হয়ে যায় শশীর। একটা ফিলিম কোম্পানী খোলার ইচ্ছে সাহেবের অনেক দিনের। এবার শেয়ার বাজারে মার খেয়ে সেই ইচ্ছেটা আরো প্রবল হয়েছে। যা কিছু ঝড়তি-পড়তি পুঁজিপাটা আছে সব একত্র করেছেন। বোম্বাই থেকে পাকড়ে এনেছেন জনকয়েক চাইকে। বেশির ভাগ টাকা তারাই দেবে, বাংলা বই কলকাতাতে ভোলা হবে।

—তারা সব কোথায়? কুঞ্জ জিজ্ঞাসা করল।

—তারা উঠেছে একটা বড় হোটেলে। আজ বিকেলে জোর একটা পার্টি।

সাহেব বারান্দায় বেরিয়ে এলেন। শি দিলেন খানিকক্ষণ, নীল আকাশটার দিকে চেয়ে। লুপিকে কোলে তুলে আদর করলেন।

মেমসাহেবও এসেছেন পিছনে পিছনে। চৌধুরী বললেন, আমি তাহলে এখন চললুম। ছ’টার আগেই ওদের নিয়ে আসব। তুমি সব ব্যবস্থা এদিকে ঠিক করে রেখ, হোটেলে ফোন করলেই ওরা সব ঠিক ঠিক পৌঁছে দিয়ে যাবে।

—পারব না।

সাহেব চটলেন না, হাসলেন,–নটি গ্যল; সেম অ্যাজ এভর।

—বিকেলে আমার কাজ আছে; আর্টগ্যালারিতে সিম্পোসিয়ম।

—টু হেল উইথ ইয়োর সিম্পোসিয়ম। সাহেব বললেন, না না, এ কাজটা তোমাকে করতেই হবে ইন্দু; এটা হাসিল হলে আমার ভালো, তোমার ভালো। ইউ ক্যান ডু ইট, এ্যান্ড আই নো ইউ উইল।

মেমসাহেব জবাব দিলেন না, ধীর পায়ে ঘরে ঢুকলেন। উঁকি দিয়ে কুঞ্জ দেখেছে, সোফায় ইন্দ্রাণী আধশোয় হয়ে। করপল্লবে দু’চোখ আচ্ছাদিত। অনেক পরে মেমসাহেব উঠলেন, চাবি দিয়ে খুললেন আলমারি। কুঞ্জ তখনো দেখছে। থরে থরে সাজানো শাড়ি, জামা, পেটিকোর্ট। ভাজ খুলে খুলে মেমসাহেব দেখছেন।

নিঃশ্বাস পড়ল না কুঞ্জর। সাহেব নেই। এই অবসরে তবে পলিয়ে যাবেন মেমসাহেব। বেছে নিচ্ছেন শুধু নিজের পছন্দমতো দু’চারখানা জামাকাপড়।

কিন্তু না। মেমসাহেব সবই ফেরএকে একে গুছিয়ে রাখলেন আলমারিতে। শুধু চোখ ঝলসানো এক প্রস্থ পোষাক নিয়ে গোসল কামরায় ঢুকলেন।

একটু পরে বেরিয়ে এলেন নবরূপে; আয়নার সমুখে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পরলেন কর্ণাভরণ, যাতে তাকে সবচেয়ে মানায়।

কুঞ্জর তলব পড়ল খানিকক্ষণ বাদে। আজ ক’জন লোক আসবে, মেমসাহেব বললেন, তুমি দরজা জানালাগুলো একটু ঝেড়ে-পুঁছে রাখ।

বেলা পড়তে না পড়তেই হোটেলের গাড়িতে খাবার এল। নার্সারির লোক পৌঁছে দিয়ে গেল গুচ্ছ গুচ্ছ শ্বেত পদ্ম। ধবধবে ঢাকনা পড়ল ছোট ছোট টেবিলে; ঝকঝকে চিনে-মাটির বাসন বেরুল অনেকদিন পর।

তারপরে বেলা গড়িয়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গে প্রাঙ্গণে ঘস ঘস শব্দ শোনা গেল কয়েকটা গাড়ির সিঁড়িতে একসঙ্গে অনেকগুলো ঠক ঠক জুতো।

কুঞ্জ দেখল, স্ব সিল্ক পালুন হাওয়াই কুর্তার দল।

বার সঙ্গে আলাপ করছে মেমসাহেব, হেসে হেসে করমর্দন করছেন। ওদের বার জন্যেই মেমসাহেব পিয়ানোতে একটা গৎ বাজালেন; তারপর,—চৌধুরী সাহেবের ইশারায় বেছে বেছে খেতে বসলেন এমন একটা লোকের পাশে, যার ভুঁড়ি ঠেকেছে প্লেটের কিনারে, রোমশ একটি হাতের চার আঙুলে চারটি আংটির ঝিকিমিকি।

কয়েকটি খাবার নিজের পাতে নিল লোকটা; কটা দিল মেমসাহেবের ডিশে। হাতে হাতে ছোঁয়াছুঁয়ি হয়ে গেল। মেমসাহেব হাত সরালেন না। সরেও বসলেন না পর্যন্ত। কুঞ্জর তখন চোখদুটো জ্বলছে।

তারপর কী একটা রসিকতা করল লোকটা, সবাই হেসে উঠল। চৌধুরী সাহেবও যোগ দিলেন। মেমসাহেব লাল হলেন, কিন্তু মুহূর্তমাত্র। যেন রাগ করলেন। তারপর নিজেও সেই হাসিতে যোগ দিলেন।

চৌধুরী সাহেব বললেন, এসব বলে ইন্দুকে তুমি লজ্জা দিতে পারবে না ছবিলাল। ও ‘ফ’ হয়ে গেছে কবে। স্টেজ সাই নয়। এম্পায়ারে নেচেছে ও তো কয়েকবার।।

রিয়েলি! ছবিলাল বলল,–আসুন না মিসেস চৌধুরী, এই ছবিতেই নেমে পড়ুন তবে।

মেমসাহেব বললেন। আই ওন্ট মাইন্ড অব ইফ আই ডু-হেসে উঠলেন খিলখিল করে। কুঞ্জ সরে এসেছে বাগানের এককোণে। শরীরের সব কটা রগ যেন সলতে হয়ে জ্বলছে।

ওর কুর্তার পকেটে হাত দিতেই সযত্নে রাখা কটা জিনিস বেরুল। কুঞ্জ একটার পর একটা ছুঁড়ে ফেলে দিল—যতদূর পারে।

শাড়ির আঁচলের কটা টুকরো, চুলের কাটা। চিরুনি থেকে ফেলে দেওয়া কয়েক গাছি দীর্ঘ চুল, কয়েকটি রঞ্জিত নখাগ্র।

দাঁত দিয়ে ঠোঁট চেপে ধরেছে কুঞ্জ। ওর এতদিনের গোপন সংগ্রহ, এত দিনের চুরি, পায়ের গোড়ালি দিয়ে মাড়িয়ে দিতে দিতে অস্ফুট ক্রুদ্ধ স্বরে বলল, বাঁদি, সব বাঁদি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *