চীনা পুতুল
ক্লাবঘরে বৃদ্ধ ভদ্রলোকটির মুখোমুখি আমরা বসে ছিলাম। ভদ্রলোকের চুলগুলি তুষারের মতো সাদা, গালের চামড়া কুঁচকে গেছে, দু-হাত দস্তানায় ঢাকা। মৃদুকণ্ঠে তিনি তাঁর কাহিনি বলছিলেন
আমার তখন যুবা বয়স বাবা মা দু-জনেই মারা গেছেন। তখন এত ঘিঞ্জি বসতি ছিল না, লোকজনের এত ভিড়ও ছিল না। বাবা যে ছোটো দোতলা বাড়ি করেছিলেন আমিই তার মালিক এবং একমাত্র বাসিন্দা। একমাত্র বললে হয়তো ভুল হবে কারণ নবীনও অনেকদিন ধরে ছিল। নবীন আমাদের পুরোনো চাকর, ঘরের কাজকর্ম, রান্নাবান্না সবই সে করে। আমার একটা শখ ছিল প্রাচীন দুষ্প্রাপ্য জিনিসপত্র সংগ্রহ করা, এর জন্য কম টাকা আমি খরচ করিনি। এই সময় হঠাৎ একটা লাক্ষার বাক্স আমার হাতে এল। চমৎকার বাক্সটি! সোনালি বার্নিশ, মসৃণ আর যেন ঝকঝক করছে। আট ইঞ্চি লম্বা, চার ইঞ্চি চওড়া আর ভেতরের গভীরতা প্রায় পাঁচ ইঞ্চি।
বাক্সর ঢাকনার ওপর কালো আলখাল্লা পরা এক চীনার ছবি। তার ডান হাতে উদ্যত তরোয়াল। ছবিটা এত জীবন্ত যে চমকে যেতে হয়। ছবির মুখটা অত্যন্ত ভয়াবহ হলেও শিল্পীর শিল্পনৈপুণ্যের তারিফ করতে হয়। নিপুণ হাতে ছোট্ট একটা মুখের মধ্যে তিনি হিংসা ও ঘৃণার অভিব্যক্তি এমন নিখুঁতভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন যে হঠাৎ দেখলে মনে হয় জীবন্ত মুখ। সময় ও কালের ঝড়ঝাপটা উপেক্ষা করে ছবিটা অম্লান রয়েছে।
বাক্সটা বাড়িতে এনে আমি দেখলাম, ওটা তালা বন্ধ। দোকানে আমাকে কোনো চাবি দেয়নি, আমিও তখন অত খেয়াল করিনি। আমি ওটা তুলে চাবির ছোট্ট ফুটোটা পরীক্ষা করছি এমন সময় আমার মনে হল, বাক্সর মধ্যে যেন কিছু একটা নড়েচড়ে বেড়াচ্ছে! আমি একটু অবাকই হলাম কারণ ওই বন্ধ বাক্সর মধ্যে কোনো জীবন্ত প্রাণী থাকতে পারে তা আমি ঠিক বিশ্বাস করতে পারছিলাম না।
একটা ছোটো স্ক্রু-ড্রাইভার দিয়ে আমি বাক্সর তলাটা খুলে ফেললাম। ঢাকনা খুলেই আমি চমকে উঠলাম। একজোড়া খুদে কালো চোখ আমার দিকে তাকিয়ে আছে। কুচকুচে কালো চোখে খুদে শানিত দৃষ্টি। চোখ দুটো একটা হলদে পুতুলের মতো মুখের ওপর বসানো। পুতুলের মুখটা মনে হয় সূক্ষ্ম, নরম চামড়া দিয়ে তৈরি কারণ মানুষের মুখের চামড়ার সঙ্গে তার এতটুকু প্রভেদ আমার চোখে পড়ল না। আমি বাক্সর মধ্যে হাত ঢুকিয়ে একটা আঙুল দিয়ে ওটার গাল স্পর্শ করলাম আর সঙ্গেসঙ্গে আঙুলটা সরিয়ে আনলাম। আমি হলপ করে বলতে পারি, কোনো জীবিত মানুষের গালে আঙুল ছোঁয়ালে যেরকম অনুভূতি হয় আমারও ঠিক সেইরকম অনুভূতি হয়েছিল। এই খুদে মূর্তিটার শরীর সাড়ে তিন ইঞ্চির বেশি হবে না, কিন্তু হলদে মুখের সঙ্গে শরীরের আকৃতিগত সামঞ্জস্য এত নিখুঁত যে, মনে হয় যেন শিল্পী সব কিছু মেপে মূর্তিটাকে বানিয়েছেন। মূর্তিটার গায়ে কালো সিল্কের আলখাল্লার মতো একটা পোশাক, পায়ে জুতো। কোমরে একটা কারুকার্য করা তরোয়ালের খাপ, খাপের ওপরদিকে তরোয়ালের হাতলটা দেখা যাচ্ছে। আমি দু-আঙুল দিয়ে সন্তর্পণে হাতলটা চেপে ধরে তরোয়ালটা বের করে আনলাম। ওটা আকারে একটা দেশলাইয়ের কাঠির মতো কিন্তু ক্ষুরধার। আমি ওটাকে আবার খাপে ঢুকিয়ে বাক্সর ঢাকনার ওপর যে ছবিটা ছিল সেটার দিকে তাকালাম। আমার মনে কোনো সন্দেহ রইল না যে ওই ছবিটারই অবিকল নকল হল মূর্তিটা।
আমি কৌতূহলী হয়ে মূর্তির একটা হাত আঙুল দিয়ে নাড়াচাড়া করতে লাগলাম। আশ্চর্য! চামড়ার তলায় হাড়, শিরা-উপশিরা সবই যেন আমি অনুভব করতে পারছি। আঙুলগুলিও আলাদাভাবে নাড়ানো যাচ্ছে, প্রত্যেকটি আঙুলের ডগায় ছুঁচোলো নখ। বাক্সর ঢাকনার তলার দিকে চীনা ভাষায় কী যেন লেখা ছিল। আমি ঢাকনা বন্ধ করে বাক্সটাকে একটা টেবিলের ওপর রেখে দিলাম।
সেদিন রাত্রে আমার ফিরতে অনেক দেরি হল, প্রায় একটা। সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় আমার শোবার ঘরে যাব এমন সময় মনে হল একতলায় যে ঘরে বাক্সটা রেখেছিলাম, সে-ঘর থেকে কেমন একটা শব্দ আসছে।
আমার বাবা ছিলেন ইঞ্জিনিয়ার। বাড়িটাও তৈরি করিয়েছিলেন নিজের তত্ত্বাবধানে, অনেকটা বিলিতি কায়দায়। সদর দরজায় ইয়েল-লকের ব্যবস্থা, ঘরের জানলাগুলি গরাদহীন হলেও দামি কাচের শার্সি লাগানো আর বসবার ঘরে শীতকালের জন্য একটা চুল্লির ব্যবস্থাও ছিল।
আমি শব্দটা শুনে ঘরের দরজা খুলে আলো জ্বাললাম। টেবিলের ওপর রাখা বাক্সটার ওপর আমার চোখ পড়তেই দেখলাম, বাক্সর ঢাকনাটা খোলা। আমি একটু অবাক হয়েই বাক্সর ভেতরে উঁকি মারলাম। কী আশ্চর্য! পুতুলটা তো নেই!
পরদিন সকালে ঘুম ভাঙতেই আমি নীচে নেমে এলাম। টেবিলের ওপর বাক্সটা আছে ঠিকই কিন্তু রাত্রে আমি ওটার ঢাকনা খোলা দেখেছিলাম, এখন সেটা বন্ধ। আমি ঢাকনা খুলতেই পুতুলটা আমার চোখে পড়ল। খুদে চোখ দুটো অমঙ্গলভরা দৃষ্টি নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি তাড়াতাড়ি ঢাকনাটা বন্ধ করে দিলাম। একটা অদ্ভুত জিনিস আমার নজরে পড়ল। ঢাকনার ওপর যে চীনে লোকটার ছবি ছিল, তার তরোয়ালের ডগায় ক্ষীণ লাল রঙের ছোপ। আমার স্পষ্ট মনে আছে গতকাল ওই ছোপটা আমি কিন্তু দেখিনি।
চা খেতে খেতে আমি খবরের কাগজটা খুলে বসলাম। বড়ো বড়ো হরফে শিরোনামা একটা সংবাদ সহজেই দৃষ্টি আকর্ষণ করে
‘নৃশংস হত্যাকাণ্ড! গতকাল রাত্রে জেমস অ্যান্ড কোম্পানির ম্যানেজিং ডাইরেক্টর মি প্যাটারসনকে কেউ নৃশংসভাবে হত্যা করেছে। তীক্ষ্ন অস্ত্রের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত তাঁর দেহ পথের ওপর পড়ে থাকতে দেখা যায়।’
কেন জানি না আমার মনটা একটা অস্বস্তিতে ভরে গেল।
পরদিন সকালে কী মনে করে আমি ওই বাক্সর ঢাকনার ওপর আঁকা ছবিটা ভালো করে লক্ষ করলাম। স্বীকার করতে লজ্জা নেই, আমার বুক যেন হিম হয়ে গেল। উদ্যত সেই তরোয়ালের ওপর লাল ছোপটা প্রসারিত হয়ে আরও একটু নীচে নেমেছে। আমি আঙুল দিয়ে জোরে জোরে ঘষলাম কিন্তু লাল দাগটা উঠল না। আমি বাক্সটা খুলে পুতুলের কোমরের খাপ থেকে খুদে তরোয়ালটা তুলে ধরলাম। আমার সর্বাঙ্গ যেন অবশ হয়ে গেল। সেটারও ডগায় রক্তের মতো লাল ছোপ। ঢাকনার ওপর ছবিতে যতটুকু নেমেছে, তরোয়ালেরও ঠিক ততটুকু লালচে হয়ে আছে। আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো তরোয়ালটা আবার খাপে পুরে বাক্সটা বন্ধ করে দিলাম।
সেদিনও খবরের কাগজে এক নৃশংস হত্যার ঘটনা চোখে পড়ল। দুটো হত্যাই যে একই ধরনের এবং একই লোক বা দলের কাজ সে-বিষয়ে পুলিশের সন্দেহ নেই। আমার মনে একটা ক্ষীণ সন্দেহ উঁকি দিতে লাগল। লাক্ষার বাক্সে খুদে পুতুলটার সঙ্গে এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের কি কোনো সম্পর্ক আছে? কিন্তু তাও কি সম্ভব! সমস্ত ব্যাপারটাই অবিশ্বাস্য।
বাক্সর ঢাকনার তলার দিকে চীনা ভাষায় যা লেখা ছিল তার ঠিক অনুলিপি করে চীনা ভাষায় দক্ষ আমার এক বন্ধুর কাছে সেটা ডাকে পাঠিয়ে দিলাম। তাকে অনুরোধ করলাম যেন লেখাটার পাঠোদ্ধার করে আমাকে ফিরতি ডাকে পাঠিয়ে দেয়। তারপর যে দোকান থেকে বাক্সটা কিনেছিলাম সেই দোকানের মালিকের সঙ্গে দেখা করে বাক্সটার ইতিহাস জানতে চাইলাম।
দোকানদার তার খাতাপত্র দেখে বলল, ‘চীনদেশে তৈরি সেই লাক্ষার বাক্সটার কথা জানতে চাইছেন তো? এই যে পেয়েছি। ওটার নম্বর ছিল ছিয়াত্তর, ত্রিশ টাকায় বিক্রি হয়েছে। আপনি ওটা জলের দামে পেয়েছেন, চাবিটি ছিল না তাই অত কম দামে ছেড়ে দিতে হয়েছে। ওটার মালিক ছিলেন মি জোনস। ভদ্রলোক একটা বিলিতি কোম্পানিতে বড়োসাহেব ছিলেন, বিয়ে-থা করেননি, সংসারে কেউ ছিল না। সম্প্রতি চীনে বেড়াতে গিয়ে বাক্সটা তিনি সংগ্রহ করেছিলেন। হঠাৎ তাঁর মৃত্যু হয়। তিনি উইল করে তাঁর সমস্ত সম্পত্তি এক খ্রিস্টান সোসাইটিকে দান করে যান, তারাই তাঁর মৃত্যুর পর কিছু জিনিসপত্র নিলামে বিক্রির ব্যবস্থা করেন। দোকানের মালিক বাক্সটা ওই নিলামেই কিনেছিলেন।
আমি বাড়ি ফিরে এলাম। রাত্রে খাওয়া-দাওয়া সেরে শুয়ে পড়লাম। গভীর রাত্রে কেন জানি না হঠাৎ আমার ঘুমটা ভেঙে গেল, টেবিলের ওপর রাখা টাইমপিসের রেডিয়াম ডায়ালে দেখলাম ঠিক বারোটা বেজেছে। চারদিক নিস্তব্ধ। একটা অজানা ভয় আমার বুকে যেন পাথরের মতো চেপে বসেছে। তারপরই আমি বাইরে রাস্তায় জুতোর শব্দ শুনতে পেলাম, শব্দটা যেন আমার মাথার সামনের জানলার ঠিক তলা থেকে শুরু হয়ে আস্তে আস্তে মিলিয়ে গেল। আমি বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লাম। মনের মধ্যে কী যেন একটা খচ খচ করছে। দোতলায় আমার শোবার ঘরের ঠিক নীচের ঘরেই লাক্ষার বাক্সটা ছিল। আমি একতলায় নেমে ওই ঘরে ঢুকে আলো জ্বাললাম। দেখি জানালাটা খোলা, কেউ ছিটকিনি খুলে রেখেছে। আমি ঘুরে বাক্সটার দিকে তাকালাম, ওটার ঢাকনা খোলা। আমি পা টিপে টিপে এগিয়ে গেলাম, যা সন্দেহ করেছিলাম ঠিক তাই! বাক্সর ভেতরটা খালি, পুতুলটা নেই।
ঘরের জানালাটা খোলাই ছিল। বিছানায় শুয়ে এই অবিশ্বাস্য ঘটনার কথা ভাবতে ভাবতে একসময় আমি ঘুমিয়ে পড়লাম। পাতলা ঘুমের মধ্যে একবার যেন মনে হল নীচের ঘরের জানলাটা বন্ধ করার শব্দ হল। পরদিন সকালে বাক্সর মধ্যে যথারীতি পুতুলটাকে দেখতে পেলাম, আরও দেখলাম যে বাক্সর ঢাকনায় এবং পুতুলের কোমরবন্ধ তরোয়ালে লাল দাগটা বেড়ে প্রায় হাতলের কাছে পৌঁছেছে।
পরদিন সকালে কাগজে আরও একটা নৃশংস হত্যার কাহিনি পড়লাম। ধারালো অস্ত্র দিয়ে আততায়ী হত ব্যক্তিকে যেন ফালা ফালা করে ফেলেছে। পুলিশ দিশেহারা হয়ে পড়েছে, সন্দেহবশে কাউকে গ্রেফতার করতে পারেনি। পুলিশের বিরুদ্ধে তীব্র সমালোচনায় সমস্ত কাগজগুলিই মুখর হয়ে উঠেছে। শুধু একটা ব্যাপার পুলিশ জানতে পেরেছে তা হল নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিল। সুতরাং আন্দাজ করা কঠিন নয় যে, একটা আক্রোশই এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডগুলির মূল কারণ।
এদিকে আমিও নানা সূত্রে অনুসন্ধান করতে শুরু করলাম। অনেক ছোটাছুটির পর একটা সূত্র আবিষ্কার করলাম, হত ব্যক্তিদের এক পূর্বপুরুষ ছিলেন কর্নেল বার্টন। তাঁর সম্বন্ধে খোঁজখবর করে জানতে পারলাম ইংরেজ আমলে তিনি ভারতের সামরিক বাহিনীতে ছিলেন এবং পরে চীনে মোতায়েন ব্রিটিশ সৈন্যবাহিনীতে তাঁকে বদলি করা হয়। ১৯০০ খ্রিস্টাব্দে চীনে এক গোঁড়া ধর্মীয় সম্প্রদায়ের সশস্ত্র অভ্যুত্থান কঠোর হস্তে দমন করার পুরস্কারস্বরূপ তাঁকে সম্মানিত করা হয়। ১৯০৪ খ্রিস্টাব্দে হংকং-এ এক অজ্ঞাত আততায়ীর হাতে তিনি নিহত হন।
যেদিন এই ঘটনার কথা জানতে পারলাম, সেদিনই আমার বন্ধুর কাছ থেকে চিঠি পেলাম, তিনি চীনা ভাষার লেখা লিপিটার পাঠোদ্ধার করে পাঠিয়েছেন। আমি সেটা পড়লাম, ‘আমি প্রতিশোধ নেব।’ আমার মনে আর কোনো সন্দেহ রইল না যে পুতুলটা মন্ত্রপূত এবং কর্নেল বার্টনের ওপর বিজাতীয় আক্রোশবশে ওই গুপ্ত ধর্মীয় সম্প্রদায় ওটাকে বার্টনের আত্মীয়স্বজন নিধন-যজ্ঞে নিযুক্ত করেছে। আমি বাক্সর ডালাটা খুললাম, পুতুলটা যেন ব্যঙ্গভরা দৃষ্টি নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।
সেদিনই আমি মনস্থির করে ফেললাম বাক্সটাকে বিদায় করতেই হবে, ওটা যেন আমার জীবনে অভিশাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বেশ অনেক রাত্রে বাক্সটাকে হাতে নিয়ে আমি বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়লাম। আমার বাড়ি থেকে চেতলা ব্রিজটা বেশি দূরে নয়। বর্ষাকাল, গঙ্গার জল দু-কূল ছাপিয়ে গেছে। ঝিরঝির করে বৃষ্টি পড়ছিল, ব্রিজের ওপরটা একেবারে ফাঁকা। সুযোগ বুঝে আমি বাক্সটাকে সজোরে গঙ্গাবক্ষে বিসর্জন দিলাম। ঝপ করে একটা শব্দ হল আর ঠিক সেইসময় টালিগঞ্জ থানা থেকে ঢং ঢং করে মধ্যরাত্রি ঘোষণা করল। ঘণ্টাধ্বনি মিলিয়ে যাবার সঙ্গেসঙ্গে নদী থেকে একটা চিৎকার আমার কানে ভেসে এল। মানুষের চিৎকার।
এমন সময় ঝম ঝম করে বৃষ্টি নামল আর বৃষ্টির শব্দ ভেদ করে আরও একটা শব্দ আমার কানে ভেসে এল। কেউ যেন গঙ্গায় প্রবল স্রোতের বিরুদ্ধে হাত-পা ছুড়ে জীবনমরণ সংগ্রাম করছে। কয়েক মিনিট মাত্র, তারপরই আমি পায়ের শব্দ শুনতে পেলাম, কেউ যেন আমার দিকে এগিয়ে আসছে। একটা ভয়ানক আতঙ্কে আমার শরীর যেন অবশ হয়ে গেল! আমি দৌড়ে পালাবার চেষ্টা করলাম, কিন্তু পা ওঠাতে পারলাম না। যেন নড়বার ক্ষমতাটুকু পর্যন্ত হারিয়ে ফেলেছি। বৃষ্টি জোরে পড়ছিল, সব কিছু ঝাপসা, আর সেই পায়ের শব্দটা ক্রমেই আমার দিকে এগিয়ে আসছে। ক্রমে বৃষ্টির মধ্যে দিয়ে একটা মূর্তি অস্পষ্ট আকার নিতে লাগল, তারপর একসময় দৈত্যের মতো চেহারার একটি লোক আমার কাছে এসে দাঁড়াল, তার বাঁ-হাতে সেই গালার বাক্সটা। আমি বোবার মতো তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। একজন চীনা, সাধারণ চীনাদের চাইতে অনেক লম্বা, চওড়া বুক-কাঁধ। হলদে মুখে নিষ্ঠুরতার ছাপ ভয়ংকরভাবে ফুটে উঠেছে। আমার ঘরে সেই পুতুলটার মুখই যেন আমি দেখছি, শুধু পুতুলটা অনেকগুণ বড়ো হলে যে মানুষের আকার নেবে, আমার সামনে দাঁড়ানো চীনেটা তাই। তার সর্বাঙ্গ সিক্ত, পোশাক থেকে জল ঝরছে। আমার দিকে তীব্র দৃষ্টিতে ও তাকাল, রাগে ফেটে পড়তে চাইছে। আমি মনে মনে ঈশ্বরের নাম জপতে লাগলাম, এই বুঝি ও খাপ থেকে তরোয়াল বের করে আমাকে কোপ মারে! ওর হাতটাও তরোয়ালের হাতলের ওপর নড়াচড়া করছে, একটু যেন ওর দোনামনা ভাব। কিন্তু আমাকে বোধ হয় ও নগণ্য ভেবে মুখে একটা তাচ্ছিলের ভঙ্গি করে হঠাৎ বড়ো বড়ো পা ফেলে অদৃশ্য হয়ে গেল।
পরদিন সকালে বাক্সটাকে যথারীতি আবার আমার টেবিলের ওপর দেখতে পেলাম। তরোয়ালটা লাল হয়ে গিয়েছিল। পরের দিন সংবাদপত্রে আর একটি মর্মান্তিক হত্যার খবর চোখে পড়ল। বলা বাহুল্য, হতভাগ্য ব্যক্তিও একজন ইংরেজ। বোধ হয় যে রাত্রে আমি ওকে ধ্বংস করতে চেয়েছিলাম সে-রাত্রের হত্যাটাই ওর জিঘাংসার শেষ বলি।
কিন্তু কর্নেল বার্টনের ওপর বিজাতীয় বিদ্বেষবশত তাঁর বংশধরদের নিশ্চিহ্ন করার জন্য যে হত্যালীলা শুরু হয়েছিল, সেই জিঘাংসা চরিতার্থ হলেও নৃশংস হত্যাকাণ্ড কিন্তু ওখানেই থামেনি। খুনের নেশায় বোধ হয় ওই চীনে জল্লাদটা উন্মাদ হয়ে উঠেছিল। নিরীহ লোকও তার তরোয়ালের আঘাতে প্রাণ হারাতে লাগল। নবীন একদিন আতঙ্কগ্রস্তের মতো এসে বলল, ‘আমাদের পাড়াতেই এক ভদ্রমহিলা তাঁর শোবার ঘরে গভীর রাতে নৃশংসভাবে খুন হয়েছেন। ভদ্রমহিলা একা ফ্ল্যাটে ছিলেন, তাঁর স্বামী অফিসের কাজে বাইরে গিয়েছিলেন, আর সেই সুযোগে খুনি তার কাজ হাসিল করেছে।
ইতিমধ্যে আমার মধ্যে একটা অদ্ভুত পরিবর্তন এসেছে। ওই জল্লাদটা আমাকে যেন জাদুমন্ত্র-বলে বশ করে ফেলেছে। ওর প্রভাব আমি মর্মে মর্মে অনুভব করি। সত্যি কথা বলতে কী, আমাদের দু-জনের মধ্যে যেন একটা যোগসূত্র গড়ে উঠেছে। প্রতিটি হত্যার পর ও যেন আমার সঙ্গে উল্লাস করতে চায় আর আমিও ওর গোপনীয়তা রক্ষা করার প্রয়াস পাই। কখন মাঝরাত হবে আর জল্লাদটা জেগে উঠবে, এই প্রত্যাশায় সন্ধের পর থেকেই আমার মধ্যে একটা উন্মাদনা দেখা দেয়।
কিন্তু এরপর থেকে ক্রমশ আমি ওর মধ্যে একটা পরিবর্তন লক্ষ করতে লাগলাম। আমার বাড়িতে আশ্রয় নেবার জন্যই আমাকে ওর প্রয়োজন হয়েছিল, কিন্তু এখন ওর মুখের ভাবে ও পরিবর্তনে আমার মনে হতে লাগল আমিও হয়তো আর নিরাপদ নই।
‘আমি পুতুলটার মধ্যে যেন একটা বিদ্রূপের আভাস লক্ষ করলাম। গভীর রাত্রে রক্তের নেশায় ও বেরিয়ে পড়ত, ফিরে আসার পর সাফল্যের আনন্দে ওর মুখ আনন্দে উদ্ভাসিত হয়ে উঠত, আমরা দু-জনে হাসাহাসি করতাম। এখন কিন্তু আর ও আমার সঙ্গে হাসাহাসি করে না, আমাকে লক্ষ করেই হাসে বটে, কিন্তু সেটা উপহাসের হাসি। সেই হাসির মর্ম বুঝতে আমার দেরি হয় না, বুঝতে পারি আমারও দিন ঘনিয়ে এসেছে।
কিন্তু জল্লাদটা আমার বিচারবুদ্ধিকে আমল না দিয়ে ভুল করেছিল। রাত বারোটার পর ও অজেয় হয়ে ওঠে, কিন্তু ভোর থেকে রাত বারোটা পর্যন্ত ও যে অসহায় পুতুল ছাড়া আর কিছু নয় এ সত্যটা আমার কাছে আর গোপন ছিল না। আমি স্থির করলাম ও আঘাত হানবার আগেই ওকে ধ্বংস করতে হবে।
নবীনকে আমি ক-দিনের ছুটি দিলাম। এক সন্ধ্যায় বেশ কিছু শুকনো কাঠ দিয়ে আমি আমার চুল্লিটায় আগুন জ্বালালাম। আগুন বেশ ভালোরকম জ্বলে ওঠার পর আমি লাক্ষার বাক্সটা সেই ঘরে নিয়ে এলাম। শয়তানটাকে একবার শেষ দেখার প্রলোভন আমি সংবরণ করতে পারলাম না। ডালাটা খুলে আমি ওর মুখের দিকে তাকালাম। ওর মুখে সেই এক অশুভ অভিব্যক্তি, এতটুকুও বদলায়নি। বাক্সর ডালাটা বন্ধ করে আমি ওটাকে প্রজ্বলিত অগ্নিকুণ্ডের মধ্যে নিক্ষেপ করলাম। লাক্ষার বাক্স মুহূর্তের মধ্যে জ্বলে উঠল।
লেলিহান আগুনের শিখায় জীবন্ত দগ্ধ প্রাণীর মতোই যেন ও ছটফট করছে। ও চিৎকার করে উঠল, এক ক্ষীণ শব্দ আমার কানে ভেসে এল, তারপর পুতুলটা ভস্মে পরিণত হল। চামড়া পোড়ার একটা কটু গন্ধ আমার নাকে এসে লাগল। আমি ঘরের সব জানলাগুলি খুলে দিলাম, মুক্ত বাতাস ঘরে ঢুকতেই অনেকদিন পরে আমি নিজেকে মুক্ত, স্বাধীন অনুভব করলাম।
হঠাৎ একটা সত্য আমার কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠল। এতদিন প্রত্যক্ষভাবে না হলেও পরোক্ষভাবে আমি যেন নিজেকে ওর জঘন্যতম অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে ফেলেছি, একথা আমি কোনো মতেই অস্বীকার করতে পারি না।
সেরাত্রে আমি এক ভয়ংকর স্বপ্ন দেখলাম। দেখলাম, ওই শয়তানটা যত লোককে হত্যা করেছে তাদের সকলের হৃৎপিণ্ডের রক্ত একটা গামলায় ভরা হয়েছে, তারপর কেউ যেন সেই রক্তে বার বার আমাকে হাত ধুতে বাধ্য করছে, আমার দু-হাত রক্তে রাঙা হয়ে উঠেছে। সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে সেই দুঃস্বপ্নের হাত থেকে মুক্তি পেয়ে আমি যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম। হঠাৎ নিজের হাতের দিকে আমার দৃষ্টি পড়ল আর একটা হতাশা ও আতঙ্কে আমার গলা দিয়ে একটা আর্তস্বর বেরিয়ে এল। দিনের পরিষ্কার আলোয় আমি সভয়ে দেখলাম আমার হাত দুটো সত্যিই রক্তাক্ত মনে হচ্ছে, যেন সদ্য রক্তের মধ্যে হাত ডুবিয়েছি। আমি বাথরুমে ছুটে গেলাম, সাবাদন দিয়ে খুব ভালো করে দু-হাত ধুয়ে ফেললাম, কিন্তু লালচে ভাবটা আর কিছুতেই গেল না। আমার অপরাধের জ্বলন্ত সাক্ষী সেই গাঢ় লালিমা আজও আমি দু-হাতে বয়ে বেড়াচ্ছি।
বৃদ্ধ ভদ্রলোক থামলেন। কিছুক্ষণ পর আমাদের সকলের মুখের ওপর দৃষ্টি বুলিয়ে বললেন, ‘আপনারা আমার কথা হয়তো বিশ্বাস করছেন না, ভাবছেন আমি এক গাঁজাখুরি গল্প ফেঁদেছি! হায় রে, তা যদি সত্যি হত! কিন্তু আমার কাহিনির এক বর্ণও মিথ্যে নয়, এই দেখুন।’ ভদ্রলোক টান দিয়ে দু-হাতের দস্তানা খুলে ফেললেন আর আমরা সবাই সবিস্ময় লক্ষ করলাম, ভদ্রলোকের দু-হাতের আঙুলের ডগা থেকে কবজি পর্যন্ত লালচে, যেন এক গামলা রক্তের মধ্যে হাত দুটোকে ডোবানো হয়েছে!